১৩
জন্মদিনের উৎসব মিটে গেছে অনেকক্ষণ। সবাই অবাক হয়ে দেখেছে। হিমাদ্রির ছেলে, মেয়ে আর জামাই কি সুন্দরভাবে সকলকে আপ্যায়ন করল, কি যত্ন করে খাওয়াল সকলকে।
হেমকায়ার অনুপস্থিতি নিয়ে সকলেই মন্তব্য করেছিলেন। অমিয় আর তাঁর স্ত্রী বললেন, রণো। হেম মা—র জন্মদিনটা জেনে নাও তো? সবাই মিলে আনন্দ করব?
দূর্বা, রণো আর প্রদীপ প্রত্যেককে বলেছে, হেম মাকে তো জানেন। তাঁর এক কলীগ সত্যিই খুব অসুস্থ। এমার্জেন্সীতে ভর্তি করতে হল। সে মহিলার পরিবার এখানে থাকে না। হেম মাকেই ছুটতে হল।
অমিয়র স্ত্রী বললেন, সে আর জানি না? আমার অপারেশানের সময় কি ছুটোছুটি না করলেন।
অমিয় আরেকটু ছানার পায়েস খেয়ে বললেন, হিমাদ্রি তো উদ্যোগ নেবে না, তোমরাই আয়োজন করো। আমি প্রস্তাব করছি, হিমাদ্রির সঙ্গে সাতাশ বছর ঘর করার জন্য তোমাদের হেম মাকে আমরা সংবর্ধনা দেব। না হিমাদ্রি, মুখ বুজে এ ভাবে…
দূর্বা ঈষৎ হেসে বলল, হেম মা কিন্তু যথেষ্ট শক্ত মানুষ।
হিমাদ্রি হঠাৎ বললেন, না হলে পারত? তুমি এতটুকু, রণোর সবে পাঁচ…
অমিয়র স্ত্রী বললেন, আমি তো ওঁকে মনে মনে শতবার নমস্কার করি।
ইতু মাসি শুধু হালকা ফ্রায়েড রাইস, রাধাবল্লভী, চিকেন গোয়ানিজ, দই মাছ, জলপাইয়ের কাশ্মীরী চাটনি, পাতলা রুটি, আর ছানার পায়েস করে আনেননি, সগর্বে বলেছেন, সব রান্না সাফোলায়। কোন অসুবিধে হবে না।
খাবারটা বুফেই হয়েছিল।
হিমাদ্রিও এক সময়ে বলতে শুরু করলেন, কারো বিপদ দেখলে ওকে তো আটকে রাখা যায় না। ড্রাইভারের টাইফয়েডে বাড়িতেই রেখে দিল।
দূর্বার শাশুড়ি দূর্বাকে বললেন, মধুলাকে নিয়ে আমি চলে যাই। মনে হচ্ছে, তোমার থাকা উচিত।
প্রদীপ একান্তে বলল, সামথিং সিরিয়াস?
—জানি না। হেম মা—র একটা খবর না পেলে…
—তুমি থেকে যাও। ওলড ম্যান খুব ভেঙে পড়েছেন, নইলে আমাকে জড়িয়ে ধরেন?
—আমার মা বেচারি যদি পারত!
রণো বলল, মা’র যাবার জায়গাই ছিল না।
খাওয়া—দাওয়া হয়ে গেলে ইতু মাসি বললেন, সব গুছিয়ে ফ্রিজে তুলে দাও সরমা। বাসন কোসন মাজিয়ে নিয়ে কাল ভোর ভোর চলে এসো।
দূর্বা বলল, দাদা পৌঁছে দেবে।
—এবারে দাদার একটা বিয়ে দাও মা। বেটাছেলে এমন সন্নেসী হয়ে থাকতে পারে?
—তাই দেব। ইতু মাসি গলা নামিয়ে বললেন, বড় চাকরি করছে। অন্যত্তর থাকে বাউন্ডুলে হয়ে যেতে কতক্ষণ?
দূর্বা হাসি চেপে বলল, আমারও তো সেই ভয়।
—আসি মা! ভাল থাকো। দিব্যি শাশুড়ি। দিব্যি স্বামী, মেয়েটাও কী সুন্দর হয়েছে।
এক সময়ে সবাই চলে গেল।
হিমাদ্রি বললেন, অমিয় ”ভাগবদগীতা” দিল কী বলে?
—ওটা অমিয় কাকার ঠাট্টা।
—তোমার শাশুড়ি এত বড় একটা ক্রসওয়ার্ডের বই! রণো বলল, ওরা ভুল করছে বাবা। এগুলো রিটায়ার করা বুড়োদের দেয়। ওরা তো জানে না তুমি এখন বই লিখছ।
—কাউকে বলিনি। ওটা সারপ্রাইজ হবে।
—নিশ্চয়। নাটকুর সঙ্গে ওপরে চলে যাও। শুয়ে পড়ো। ক্লান্তও হয়েছ।
—লতু এল না।
—অপারেশান করে এসে ঘুমোচ্ছে।
—আর হেম…
রণো বলল, আমাকে চাবি দিয়ে গেছে। নিজের তো তিন চারটে কাপড় নিয়ে গেছে। ফিরে আসবেই। দেখো, আজ দূর্বাও থেকে গেল। সব তো তোমারই জন্যে। সেটা দেখো।
—হ্যাঁ…আমি এত প্রাপ্তি ডিজার্ভ করি না।
দূর্বা ও রণো চুপ।
সবিস্ময়ে হিমাদ্রি বললেন, এটাও হেম করে দিয়ে গেল। অথচ আমি শুধু ”আমি আমি” করতাম?
রণো বলল, হেম মা ফিরে এলে সেটা মনে রেখো বাবা। তাহলেই হবে।
—তুমি তিরস্কার করলে, ঠিকই করলে।
নৈঃশব্দ্য। কিন্তু কী বাঙ্ময় এ নৈঃশব্দ্য। বিগত সাতাশ বছর ধরে তিলে তিলে জমে ওঠা কথার তীর এ—ওকে বিঁধছে, চলে যাচ্ছে।
—না। রণোকে আমি চড় মারতে পারি।
—না। তুমি আমার মাকে অপমান করেছ।
—না, রণো সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেবে।
—ঝি—চাকরকে ”মাসি”, ”দাদা” বলতে শেখাচ্ছ?
—ভদ্রতার তুমি কি জানো হেম? নিজের ব্যাকগ্রাউন্ড ভুলে যেও না।
আবার নৈঃশব্দ্য।
রণো, দূর্বা ও হিমাদ্রি পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। তারপর রণো বলে, সরি। শুতে যাও বাবা।
—হ্যাঁ…যাচ্ছি…তোমরাও…রাত কোরো না….
—নাটকু! সঙ্গে যা।
হিমাদ্রি উঠে যান।
—দাদা! খাসনি তো কিছুই। এখন খাবি?
—নিজেকে…শান্ত করি…।
—বলেছিস বলে অনুতাপ হচ্ছে?
—না। একটুও না।
—তবে খাবি চল।
দূর্বা রণোর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, হেম মা নির্ঘাৎ কাল চলে আসবে।
—বাবা জানে না, যে কোনদিন আমি হেম মাকে নিয়ে চলে যেতে পারি। নিয়ে যাইনি, বাবাকে আরেকটু সুযোগ দিয়েছি।
—দাদা, শান্ত হ’।
—এত সহ্য করেছি, এত সহ্য করেছি দূর্বা। আমার মা আমাকে নিয়ে বাগানে বসে কাঁদত, আমার এখনও মনে পড়ে।
—দাদা! শান্ত হ’! চল খাবি চল। নইলে আমি ভীষণ কেঁদে ফেলব, তুই বোকা বনে যাবি।
—পিপু ঠিক তোর মতন। ওকে সব বলা যায়।
—খাবি চল।
—তুইও চল।
—সকালে প্রথম কাজ ইতু মাসির সব বাসন মাজানো, এ সব ব্যবস্থা করা। তবে কাল বিকেলে আমাকে ফিরতেই হবে।
—আমিও কাল অফিসে ফোন করব। হেম মা কবে ফিরবে জানি না। অফিস খ্যাঁচ খ্যাঁচ করবে।
—যদি না ফেরে?
—চলে যাবার হলে আগেই চলে যেত।
—কেন যায়নি তা জানিস তো…
—আগে আমাদের জন্যে…এখন আমার জন্যে…
—বাবার জন্যেও খানিকটা। হেম মা আসলে নির্মম হতে পারে না।
—যখন পারত, আমরা ছিলাম। এখন আমার কথা ভাবে, এত ভাবে…এত চিঠি লেখে…এবারই বলিনি। নইলে সব সময়ে বলি। তোমার চিঠিগুলো আমাকে ধরে রাখে। নইলে কবে কী করে বসতাম।
—ঠিক করিসনি।
—এবার, ঠিক করে ফেললাম দূর্বা। পিপুকে বিয়ে করছি তা জানিয়েও দেব। তাহলে অন্তত…আমার বিষয়ে…
—নিশ্চিন্ত হবে। চোখ মোছ।
—আজ রাতটা কাটবে। কাল?