মিলুর জন্য – ১২

১২

লতু বেরিয়ে এল ঘর থেকে। হেমকায়া পাথর হয়ে বসে আছেন চেয়ার।

—আর ভেবো না হেম। মিলু ঘুমোচ্ছে।

—উঠে পড়ে যদি?

—সেডেটিভ দিয়েছি। ওঠার কোন চানস নেই।

—লতু! বাঁচবে তো?

—হেম! তোমার কাছে এমন দুর্বলতা আশা করিনি। স—ব বলছি তোমাকে। আগে একটু দম নিতে দাও। পিপুকে চা আনতে বলেছি। এখন আমরা চা খাব। তারপর আমরা স্নান করব। তারপর পিপুর তৈরি হায়দ্রাবাদি ওমলেট আর টোস্ট খাব। পিপুকে এ ওমলেট বানাতে শিখিয়েছে রণো।

—রণো?

—হ্যাঁ হেম। পিপু তো হায়দ্রাবাদেই কাজ করে এখন। ও আর রণো খুব বন্ধু। আমি তো ছিলাম না। তোমাদের পিপু বসিয়ে যত্ন করছিল কেন বলো তো? তুমি আমার বন্ধু, রণোর হেম মা!

পিপু চা নিয়ে ঢোকে।

লতু বলে, চিনেছিস?

—রণোর ঘরে ফোটো আছে।

পিপু সমালোচকের চোখে চায়। ছবি না কি ক’মাস আগেকার। তার চেয়ে অনেক…ভেঙে গেছেন।

লতু বলেন, হেম তো শুনবে না। ওর বিশ্রাম দরকার।

—না…আমি ভালই আছি। শুধু মিলুর জন্যে…ভাবতে পারো। ও আত্মহত্যা করবে বলে বিষ খুঁজছিল? অন্তত দশ প্যাকেট ইঁদুরমারা বিষ জমিয়েছিল।

—কেন? কী হয়েছে?

—চা খাই লতু। সারাদিন যা গেছে…তোমার এখানে বসেই আছি। মিলু যেন পাথর। কথা বলে না, কাঁদে না, শুধু বলে, আমার কী হবে? আমি তো পিপুকে বসিয়ে বাথরুমে গেলাম।

—আমিও আজ…তিনটে বড় অপারেশান…কিন্তু হেম। আজ রণোর বাবার জন্মদিন না?

—হ্যাঁ। রণো, দূর্বা সামলাক। ওর বাবা বুঝুক।

—তিনি তো পাগল হয়ে যাবেন।

হেম ক্লান্ত স্বরে বলে, পাগলও হয় না কেউ লতু, মরেও যায় না। আমাকে দেখছ না?

—তুমি সারভাইভার। বেঁচেই আছ।

—মিলুর কী হয়েছে?

—কাল ভাল করে দেখব। আজ হেভি সেডেটিভ দিয়েছি। পিপু! ওর ঘরে গঙ্গা যেন থাকে।

—ওর কোনও ব্যবস্থা না করতে পারলে, সেটা হবে আমার পরাজয়।

ফিসফিস করে বললেন, ও বিশ্বাস করছে ও প্রেগনান্ট।

—ক’মাস মিস করেছে?

—তিন মাস।

—ইউরিন টেস্ট?

—করাইনি। কেন না আমার বাড়িতে থেকে মিলু প্রেগনান্ট হলে কাকে দায়ী করব, জানি না। দায়ী যদি কেউ হয়, তাকে শাস্তি দেব। কিন্তু আগে তো ওকে…বড় মুখ করে এনেছিলাম।

—চলো তো স্নান করবে, আমিও করব। খাওয়ার পর সব শুনব।

—তোমার ফ্ল্যাটটা সত্যি ভাল।

—বহুদিন আছি। ভাড়াও তেমন নয়। সবচেয়ে ভাল, বাড়িঅলা আমাকে রাখতেই চান।

পিপু বলে, চাইবেন না? হাম থেকে ব্রেস্ট ক্যানসার সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছ?

—যেতে দে। তিতিল কোথায়?

—সারা রাত গান শুনছে বন্ধুর বাড়িতে। তোমাকে বলেছে, ও অ্যাডওন—এ কাজ পেয়েছে?

—বলছিল, শুনিনি।

—ওর মাথায় ঢুকেছে অ্যাড—ছবি করবে। করতে পারলে ভাল মার্কেট।

—রান্নাঘরে যা পিপু।

.

—আর হেম। তুমি ওই বাথরুমে ঢোকো।

স্নান করে যখন টেবিলে এলেন, পিপু ভাত, পাতলা ডাল, মাছের পাতলা ঝোল আর পটল ভাজা নিয়ে এল। বলল, রণোর খুব প্রিয় এ সব।

—আর পালং শাকের ঘণ্ট। বত্রিশ বছর বয়স, বোধহয় বত্রিশ কুইন্টাল পালং শাক খেয়েছে।

—ওর বাবার তো নানা বাতিক।

—খুব। তুমি বোসো পিপু।

—আপনি না গেলে তো রণো ফ্রি হবে না।

—আমি মিলুর ব্যবস্থা না করে যাব না।

—খাও হেম। সব শুনব। ও বাড়ির জন্যে টেনশান হচ্ছে না তো?

—না। একটুও না। ছেলে, মেয়ে আর বাবা,—তিনজন একসঙ্গে থাকা দরকারিও।

—একটুও টেনশান হচ্ছে না?

—পরে কী হবে জানি না। এখন তো হচ্ছে না।

—পিপু। আর ভাত নিস না।

—বোকো না তো লতু! চিরকাল আমার খাওয়া কমাতে চেষ্টা করছ, চিরকাল খেয়ে যাচ্ছি। একটুও মোটা হয়েছি? আসলে মাছের ঝোল আর ভাতটা খুবই প্রিয়।

—ওখানে কী করিস?

—ওখানেও তো ভীষণ খাই। হায়দ্রাবাদি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, যতরকম রান্না বলো, খেয়ে নিই।

—খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়। আমরা আধ ঘণ্টা কথা বলব।

—রাত করো না লতু। আজ খুব ধকল গেছে।

—না। রাত করব না!

.

লতুর খাটটি খুব বড় সড়। এ বাড়ির ঘরগুলো বড়, আসবাব পুরনো ধাঁচের বড় সড়। সবই একদা নীলামে কেনা। হেম হেলান দিয়ে বিছানায় বসলেন।

—এবার বলো হেম। ব্যাপার কী।

—বলছি। সরমাকে দিয়েই শুরু।

—সরমা তো ইতুর ওখানে কাজ করে।

—হ্যাঁ, তিনটি কর্মী। সরমা একজন ওদেরই মধ্যে। একদা বস্তিতে থাকত, সে বস্তি উচ্ছেদ হয়ে গেছে কবে। ওর স্বামীকে দেখিনি কোনদিন, ওকেই দেখেছি। ওর ছেলেমেয়েরা খোঁজখবর নেয় না। মাঝে মাঝে আমাদের স্কুলে বদলি—আয়ার কাজ করেছে। মিলু ছোট মেয়ে ওর। বেশ পড়ছিল মেয়েটা, ক্লাস সেভেনে উঠেছিল। একদিন শুনলাম ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।

—ওর বয়স কত হয়েছিল?

—বছর ষোল হবে। আঠার বছর না হলে মেয়ের বিয়ে দিও না, এ বলে তো লাভ নেই। মেয়ের বিয়ে পাত্র জোটাতে পারলেই দিয়ে দেয়।

—ছেলেটি কেমন?

—শুনেছি রং মিস্ত্রির কাজ করে। মধ্যমগ্রামের কাছে সুভাষপল্লীতে বাড়ি। বছর পাঁচেক কিছু জানি না। তারপর থেকে থেকেই মিলু হঠাৎ হঠাৎ চলে আসে। ততদিনে চেহারাও খুব খারাপ হয়েছে। শুনলাম ওখানে ঠিকে কাজ করছে।

শ্বশুরবাড়িতে পরিস্থিতি খুব খারাপ। কেননা মিলুর সন্তান হচ্ছে না।

—মারধোর। অত্যাচার?

—করলেও বলেনি। ওর স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের প্রধান অভিযোগ মিলুর সন্তান হচ্ছে না কেন। তাগাতাবিজ, ইত্যাদি ইত্যাদি সবই হয়েছে। যেমন হয়ে থাকে।

—দু’জনে পরীক্ষা করানো…সে শিক্ষিত লোকরাই করায় না। সন্তান না হবার দায় তো মেয়েদের।

—জানি। তবে একটা কথা বলা দরকার, মিলু যতবারই এসেছে, ওকে শুধু রাতটা কাটাতে দিয়েছে সরমা। সরমার এটা নিজের জায়গা নয়। আর সরমা ইতুর এখানে কাজ করে পয়সা জমাচ্ছে, যাতে গোবরডাঙা না কোথায় ওর বোনের বাড়ির কাছে নিজের একটা ঘর তুলতে পারে।

—সে তো ভাল।

—ইতু পছন্দ করে না মিলুর থাকাটা। মিলুকে ভোরে চলে যেতে হয়। সরমাও ভয় পায় যে মিলু আসছে যাচ্ছে বলে ইতু বলতে পারে, ”সরমা। তুমি এবার এসো।” মিলু স্কুলে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করে কেঁদে কেটে চলে যায়। আমার খুব খারাপ লাগছিল ব্যাপারটা।

—মেয়েদের এ অবস্থার কথা শুনতে আর পারি না হেম। আমার কাছে কি কম অভিযোগ আসে?

—মিলু বোধহয় ওর স্বামীকে খুব মিনতি করে থাকবে যে চলো, তোমাকে পরীক্ষা করাও। এ নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি। খুব কলহ, মনে করি একতরফা। কেননা মিলু তো এমন মেয়ে যে কেটে ফেললেও চেঁচাবে না। ঝগড়াঝাঁটির ফলে স্বামী ওকে ঘর থেকে বের করে দেয়।

—তারপর?

—মিলু বারান্দায় শুয়ে ছিল…ওর দেওর…, মিলু যখন খুব মিনতি করে, দেওর বলে, মিলুর স্বামী অক্ষম, অক্ষম এবং সেই…ছি ছি!

—মিলু কী করে?

—হাতের কাছে কি ছিল তাই দিয়ে মেরে ওকে ঠেলে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ভোরে মায়ের কাছে রওনা হয়।

—সরমা নিশ্চয় জায়গা দেয়নি?

—না। মিলু বলে, তাহলে ও রেলে মাথা দেবে।

—আর তুমি নিয়ে এলে?

—না এনে উপায়?

—তারপর কী হল?

—বোঝাতে সময় গেল। কাজ অনেক করেছি লতু! সুভাষপল্লী দৌড়েছি। নিয়ে গেছি রণোর বন্ধু সজয়কে। সজয় তো পুলিশে কাজ করে। ওর সে দেওর ছিল না। তবে স্বামী, শাশুড়ি ছিল। তারা বলে যে মিলু চলে যাবার পর ওর স্বামী না কি কোন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল।

—ও সত্যিই অক্ষম?

—হ্যাঁ। আমি বলি, মিলু আর ফিরবে না।

—সে কতদিন হল?

—মাস আড়াই হবে। বাড়ি থেকে বের করতে পারি না, সর্বদা ভয় পায় ওর স্বামী কিছু করবে। আমি বললাম, তোকে দিয়ে আমি ডিভোর্স করাব। লেখাপড়া শেখ, কোনও কাজ শেখ, নিজের পায়ে দাঁড়া। ইচ্ছে হলে বিয়ে তার পরেও করতে পারবি।

—বলেনি তো, মেয়েছেলের বিয়ে একবারই হয়?

—না।

—যথেষ্ট হিন্দি সিনেমা দেখেনি বোধহয়।

হেমকায়া এত দুঃখেও ঈষৎ হেসে বললেন, দেখেছে নিশ্চয়। কেননা শাশুড়ি বলল, ছেলে মেজাজ করুক, যা করুক, বউকে নিয়ে সিনেমা যায়।

—তাহলে দেখেছে।

—যত বোঝাই, যত বোঝাই, আমারও জেদ যে ওকে এ আবর্ত থেকে টেনে তুলবই। সরমা তো বলে দিল আমার ক্ষমতাও নেই, আমি পারবও না। যা পারো করো। আমি অক্ষম। মেয়ের পিছনে দৌড়ই, এমন সময় আমার হয় না।

—স্বাভাবিক।

—অবশ্য শনিবার মেয়ের জন্যে কালীঘাটে মাথা কুটতে যায়। কোনও একটা রূপকথা আশা করে। জানি না।

মিলুকে নিয়েই ব্যস্ত।

—মিলু কি সহজ হচ্ছিল?

—অনেক। উকিলের কাছে যেতে রাজি হল। আমিও খুব খুশি। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখি অসম্ভব ডিপ্রেশান। কিসের যেন আতঙ্ক। কিছু বলে না, মাঝে মাঝে কাঁদে। রাতে উঠে ঘুরে বেড়ায়। এক মাস ধরে সাধাসাধি, ধমকাধমকি, তার পরে তো বললাম, পরশু আবিষ্কার করলাম ইঁদুরমারা বিষের প্যাকেট।

—ওঃ হেম!

—একটা চড় মেরেছিলাম। তখন বলে ফেলল, মাসিক হচ্ছে না…এক মাস খুব কম…তারপর বন্ধ…এটা যে গর্ভ সঞ্চার তাতে সন্দেহ কি? স্বামী তো অক্ষম। এখন জানা যাচ্ছে। হয়তো দেওর…লতু! দেওরের সঙ্গে দেহ সংযোগ হয়েছিল কি না ও সিওর নয়। কিন্তু গর্ভ সম্পর্কে নিশ্চিত।

—নিজেকে পাপী ভাবছে…

—একেবারে।

—আত্মহত্যা ছাড়া…

—ওর গতি নেই, ও নিশ্চিত। আমার বাড়িতে থেকে এর কোনও সুরাহা আমি করতে পারতাম না। তাতেই কোনও মতে রাতটা সামলে রেখে তোমার এখানে ছুটে এসেছি।

—যদি গর্ভবতী হয়?

—ও চাইলে নষ্ট করবে। প্রসব করলে আমি ওকে নিয়ে থাকব। সে তো পরের কথা। যেই দায়ী হোক, ওকে তো ফেলে দিতে পারব না।

—আজ ঘুমোই হেম। কাল দেখব। আমার কাছে এসেছ, ভাববে কেন? কালই ভর্তি করব পাড়ার নার্সিংহোমে, আমি ওটাতেও আছি। তারপর…যা দরকার সব করব।

—ও উঠবে না তো?

—অসম্ভব। ধমক দিয়ে দুধ পাউরুটি খাইয়েছি। কড়া সেডেটি দিয়েছি। গঙ্গা থাকছে ঘরে। এমন সঙ্কট বছরে দু’তিনটি সামলাতে হয়। গঙ্গা খুব কাজের। আমার কাজের লোক তিনজনই খুব নির্ভরযোগ্য।

—তোমার…একা লাগে না লতু?

—অল্প বয়সেই লাগছে কিনা ভাবতে সময় পাইনি। এখন তো মোটেই পাই না। ঘুমোও দেখি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *