১০
ইজিচেয়ারে বসে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন হিমাদ্রি। পাতলা ঘুম। ক্লান্ত লাগছিল। আবার মনও উৎকণ্ঠ।
দূর্বা আর রণোর কথা শুনতে পাচ্ছিলেন।
—ফুলগুলো পরে সাজাব দাদা। তুই শুধু মালাটা মায়ের ছবিতে পরিয়ে দে।
—হেম মা কি কিছু ভোলে না?
—ভুলতে তো দেখিনি কখনও। দাদা, মাকে তো আমার কিছু মনে নেই। তোর মনে পড়ে?
—আবছা।
—এত সুন্দর ছিল?
—লতু মাসি বলে আরও অনেক সুন্দর ছিল।
—আমার তো জ্ঞান থেকেই হেম মা।
—আমিই কি হেম মা ছাড়া আর কিছু জানি?
—কীভাবে আগলে থেকেছে আমাদের। লতু মাসি তো বলে, হেম মা না থাকলে আমরা মেন্টাল হয়ে যেতাম।
—কত না সহ্য করেছে হেম মা!
—দাদা! তুই বিয়ে করবি না।
—এখনও জানি না। ভয় করে।
—সবাই কি মোমো হবে?
—নিজে বিয়ে করে, সকলকে বিয়ে দিতে চাস।
—সত্যি কথা। আমি এত সুখী হয়েছি…
—তুই তো অন্যরকম। আমি যে ভীষণ ঘরোয়া।
—ঠিক উতরে যাবে।
—শ্রীজয়কে দেখতে ইচ্ছে করে, আবার বুঝি, ও ওখানেই খাপ খেয়ে গেছে।
—দেখা একদিন হবেই।
—কী জানি!
—হেম মা গেল কোথায়?
—এলেই জানা যাবে।
—চল খেয়ে নেয়া যাক।
—হ্যাঁ, বাবাকে ডাকি।
—বাবারই সবচেয়ে মুশকিল। এক হেম মা ছাড়া কারো সঙ্গে কথাও বলেনি কখনও।
রণো একটু হেসে বলল? হেম মার সঙ্গেও কথা বলত না কি? হেম মা কথা বলিয়ে ছেড়েছিল। বাবা তো…কম অপমান করতে চেষ্টা করেনি হেম মাকে। পারেইনি। আমার মা…খুব নরম ছিল…শুনেওছি, মনেও আছে।
—যাক গে দাদা। বাবাকে ডাকি।
হিমাদ্রি ওদের কথা শুনেছিলেন। দূর্বা ডাকতে বললেন, নিয়ে নাও, আমি আসছি।
দূর্বা বলল, মাসি, আমরা বসলে পোস্তর বড়া ভাজবে, কেমন?
—জানি গো জানি।
ধপধপে সাদা গোবিন্দভোগ চালের ভাত, সোনালি মুগের ডাল, পোস্ত বড়া, মোচাঘণ্ট, তেল কই, জলপাইয়ের চাটনি,—হিমাদ্রি বললেন, হেমের মতোই রাঁধতে শিখেছ।
—ভাল লাগছে?
—সুন্দর হয়েছে।
দূর্বা বলল, ভাল করে খাও। ওপরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। একতলায় আমাদের অনেক কাজ।
—ঘুমোব? দুপুরে তো…
—সুপ্রতীপের লেখার ভুল শোধরাও, জানি। আজ তো সুপ্রতীপ আসেনি।
—তাই তো! কিছুই খেয়াল হয়নি।
—না আসুক। শোও, ঘুম আসবে।
—দূর্বা! মাছটা তো একেবারে…
—হেম মা আমাকে কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে রান্না শিখিয়েছে। তোমার প্রিয় তেল কই, ছোট পোনা বেগুন বড়ি কাঁচালঙ্কা দিয়ে ঝোল…দাদার প্রিয় কষা মাংস…পালং শাকের ঘণ্ট…সুজির পায়েস…সত্যি দাদা। তোর খাবার ব্যাপারে জগাখিচুরি টেস্ট। প্রদীপের তো ওটুকুও নেই। কী খায় তা মনেই থাকে না।
—কখন শেখাল?
—বাঃ, ছুটির সময়ে? দাদা ইস্ত্রি শিখতে গিয়ে কম পুড়িয়েছে নিজের জামা?
—আমি…কিছু…জানতাম না…
হিমাদ্রির গলা ভেঙে গেল। লজ্জা, লজ্জা, দুস্তর লজ্জা! এক বাড়িতে থাকলেন, তাঁরই স্ত্রী—ছেলে—মেয়ে! তিনি তিনজনের বিষয়ে এসব ছোট ছোট ঘরোয়া কথা জানতেনই না।
নৈঃশব্দ্য। নৈঃশব্দ্য।
—হেম চলে গেল…সুপ্রতীপও এল না আজ…আমি, আমি কিছুই বুঝিনি…আমি শুধু নিজেকে নিয়ে…আবার নৈঃশব্দ্য।
—মিলু তো চলেই গেল…নাটকুও যদি চলে যায়?
রণো তো চলে যাবে…
আবার নৈঃশব্দ্য।
রণো নরম গলায় বলল, চলো, ওপরে চলো। সব ঠিক হয়ে যাবে। হেম মা না এলে আমি যাব কী করে? আমাকে চাবি দিয়ে গেছে বাড়ির।
দূর্বা চোখ নিচু রেখেই বলল, বাবাকে নিয়ে যা দাদা। আমি মাসি, নানকু, ওদের খেতে দেব।
রণো বাবার পিঠে হাত রাখল।
—ওঠো বাবা।
—উঠি।
ঘরে শুয়ে পড়লেই কি ঘুম আসে?
রণো জন্মায় পাঁচই মে, ১৯৬২।
দূর্বা জন্মায় ষোলই আগস্ট, ১৯৬৭।
হেমকায়া জন্মান ১৯৩৭ সালে। তারিখটা কোনদিন জানতে চাননি হিমাদ্রি।
হেমকায়ার গলা মনে আসে। ক্লান্ত, ভদ্র, সংযত কণ্ঠস্বর।
—তারিখ দিয়ে কী হবে? এ বাড়িতে একজনেরই জন্মদিন হয়। একটা তারিখই মনে রাখার মতো। আমার কথা তো জানোই। ছোটবেলা থেকে শুধুই মনে হয়েছে, আমি না জন্মালেও চলত।
—ডাক্তার বসুরা তো তোমায় অনাদর করেননি।
—বেশি আদর করেছেন। কিন্তু আড়াল তো আমার নিজের মধ্যেই ছিল।
একদিন হিমাদ্রি কী কারণে ভীষণই চেঁচামেচি করেছিলেন।
হেমকায়া কিছুই বলেননি।
রাতে হিমাদ্রি বললেন, রণো কী বলছিল, শুনি?
হেমকায়া ঈষৎ হেসে বলেছিলেন, বলছিল, তোমার দুঃখ লেগেছে হেম মা? আমি বললাম, না রে রণো।
তারপর বলেছিলেন, তোমার কোনও ব্যবহারেই আমার মনে লাগে না। কেন না পরস্পর ভদ্র আচরণ করব এ কথা তো শর্তে ছিল না। তবে বলছি, এবং এটা মনে রাখবে। রণোর বয়স সতেরো। খুব সেনসিটিভ বয়েস। ওর উপস্থিতিতে আমার ওপর চেঁচিও না।
বলে একটা বই নিয়ে হেমকায়া নিজের বেডল্যাম্পটি জ্বেলে শুয়ে পড়েছিলেন।
সেই হিমাদ্রিরই জন্মদিন।
কত দিনের কত কথা।
—রণো বা দূর্বার জন্মদিন করলেই পারো।
—ওই তো একটু পায়েস করে দিই, নতুন জামাকাপড় দিই, আর কী করব?
চাকরি করার পর থেকে কাজের লোকদের, রণো, দূর্বার জন্মদিনে নতুন কাপড় দেন হেম।
রণো আর দূর্বা হেম মাকে কাপড় দেয়।
হিমাদ্রি কখনও দেননি।
হিমাদ্রি হেমকায়ার জন্মদিন কবে তা জানেন না।
যে দিদিকে সাহায্য করবে বলে হেমকায়া কাজ নিল, তার কথাও জিগ্যেস করেননি কখনও।
কতভাবে অপমান করেছেন হেমকায়াকে?
হেম! ফিরে এসো। একটা সুযোগ দাও।