মিলুর জন্য – ১

আজ সন্ধ্যায় হিমাদ্রিশেখরের সত্তর বছরের জন্মদিন পালন করা হবে। সর্দারশংকর রোডের এ বাড়িটা কিছু অন্যরকম। হিমাদ্রিশেখর আছেন, তাঁর স্ত্রী হেমকায়া আছেন। এ শহরে ওঁদের মেয়ে জামাই নাতনিও থাকে।

জন্মদিনটা হিমাদ্রিরই হয়।

খুব অন্যরকম বাড়ি একটা। এত বছর এ পাড়ায় বসবাস, কিন্তু পাড়াপড়শির সঙ্গে আসা—যাওয়া নেই। পাড়ার এ দিকটা তো এমন নয় যে অনেক হাইরাইজ উঠেছে। ভূগোল পালটে গেছে পাড়ার। এখনো সুধন্য মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, কমলা ফার্মেসী আছে। সরিৎবাবুর বাড়ির নিচে ওঁর মেয়ে জামাই কি একটা ভি. ডি. ও. ছবির দোকান করেছে, আর বেলী মাসিমার অনেক গর্বের যৌথ পরিবার ভেঙেচুরে অনেকগুলো একক পরিবারে ভাগ হয়ে গেছে।

পাড়াপড়শি বলতে যা বোঝায়, সবই আছে। কিন্তু হিমাদ্রিশেখর কোনদিন তাঁর পাড়াপড়শিকে মেলামেশার সমকক্ষ মানুষ বলে মনে করেন নি। এটাকে দোষ বা গুণ বলা যাবে না। ব্যাপারটা হিমাদ্রির বংশগত। ওঁদের রক্ত না কি নীল রক্ত। ওঁদের কোনো পূর্বপুরুষ না কি মোগলদের কাছে রায়রায়ান খেতাব পেয়েছিলেন। হিমাদ্রির পিতামহীও ছিলেন কোন রায়বাহাদুরের মেয়ে।

 হিমাদ্রি ছোটবেলা থেকে দেখেছেন,—ঠাকুমা পাড়াপড়শি সম্পর্কে বলতেন, ওরা মেশার যুগ্যি নয়।

মা চিরকাল বলেছেন, সমানে সমানে মেলামেশা হয়। বংশগৌরবটি মনে রেখো।

হিমাদ্রি যখন এ বাড়ি করেন, তাঁর প্রথমা স্ত্রী তখন জীবিত। তার আবার নামও প্রথমা। প্রথমাকে তার বাপেরবাড়ি ও শ্বশুরবাড়িতে একটা কথাই শেখানো হয়েছিল, স্বামী যেমন রাখবে, তেমন থাকবে।

প্রথমা কারো সঙ্গে আলাপ করতে যায়নি, পাড়াপড়শিও তার অহংকার দেখে নিন্দে করেছে। কেউ বলেছে, ভদ্রলোক অত্যন্ত নাক উঁচু মানুষ। কেউ বলেছে, বউটা দেমাকী।

এখন সবাই জেনে গেছে, এ বাড়ি অসম্ভব নিয়মে বাঁধা অন্যরকম বাড়ি। একদা ছেলেমেয়ে ছোট ছিল, জন্মদিনের ঘটাপটা হয়নি। শুধু একদিন এ বাড়িতে আলো জ্বলে, লোকজন আসে, যেদিন গৃহকর্তার জন্মদিন পালিত হয়।

অবশ্য হিমাদ্রি জানেন, ব্যাপারটা শুরু করে প্রথমা। বিয়ের পর ওঁরা যখন মালদায় যান,—অন্যান্য সরকারী অফিসারদের জন্মদিনে নেমন্তন্ন পেতেন।

প্রথমা বলল, আমরা যাই আর খেয়ে আসি। ওঁদের একবার ডাকাটা তো কর্তব্য।

—কি উপলক্ষ্যে ডাকবে?

—কেন, তোমার জন্মদিনে!

এমনি করেই জন্মদিন পালন শুরু হয়। সেই যে শুরু হয়, সেটা এখন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। হিমাদ্রি নিজেই হইচই লাগিয়ে দেন, মনে আছে তো?

মনে রাখে সকলেই।

হিমাদ্রির জন্মদিনে দুপুরে বাড়ির লোকজন খায় গোবিন্দভোগ চালের ভাত, সোনামুগের ডাল, পোস্তর বড়া, মোচাঘণ্ট, তেলকই আর জলপাইয়ের চাটনি।

রাতে হালকা ফ্রায়েড রাইস, রাধাবল্লভী, চিকেন গোয়ানিজ, দই—মাছ, জলপাইয়ের চাটনি, পাতলা হাতরুটি আর ছানার পায়েস।

একদা এই তালিকা চালু হয়েছিল, আজও চলছে। প্রথমা প্রথমবার এই সবই রেঁধেছিল তো!

হেমকায়া বলেছিলেন, প্রথমার জন্মদিন হত?

—না না, কে করবে?

—তোমার জন্মদিন তার উদ্যোগে হত, তুমিও তো ওর জন্মদিনটা পালন করতে পারতে!

হিমাদ্রি বলেছিলেন, সে তো আমি ছাড়া কারো কথা ভাবত না। এই ধরো না, রণো প্রথম সন্তান, তায় ছেলে। এক বছরের জন্মদিনে প্রথমা বলল, দরকার কি?

সবাই তো অবাক। প্রথম সন্তান, তার ছেলে! তার একটা জন্মদিন হবে না?

প্রথমা ঘাড় নাড়ল। হিমাদ্রির বাড়ি, বা প্রথমার বাড়ি, কোথাও কেউ জীবনে দেখেননি যে প্রথমা তার নিজের মত জাহির করছে।

প্রথমা বলল, দরকার কি? ওইটুকু ছেলের তো আনন্দ হবে না। বড়দের আনন্দ হবে। আমি ঘটাপটা চাই না। জন্মদিনটা পালন করা? সে হয়ে যাবে। এই তো অন্নপ্রাশনে অনেক উৎসব হল।

রণজয়ের জন্মদিন মানে পায়েস রান্না, একটা নতুন জামাপ্যাণ্ট।

প্রথমার মৃত্যুর পর সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।

দূর্বার জন্মদিন করার কথাই ভাবেনি কেউ। যে মেয়ে জন্মাবার ক’দিন বাদে মা মরে যায়, সে মেয়ে তো অলক্ষণা, রাক্ষসী। তার জন্মদিন কে করে?

হিমাদ্রির কথা আলাদা।

সত্তর বছরের জন্মদিন, সে কি সোজা কথা?

.

কয়েকদিন ধরেই হিমাদ্রি চাইছিলেন, এবারকার জন্মদিনের কথা হেমকায়া বলুন।

হেমকায়াকে দেখে মনেই হল না, এমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা তাঁর মনে আছে।

শেষে হিমাদ্রি বললেন, কালকে তো…

—হ্যাঁ, তোমার জন্মদিন!

—তোমার মনে আছে তা হ’লে?

—তা কেন থাকবে না!

—কই, কিছু তো বলছ না!

—কি বলব, বলো?

—সত্তর বছর পার করে দেয়া চারটিখানি কথা নয়।

—এখন তো মানুষ একশো বছরও বাঁচে।

—না না, অথর্ব অসহায় হয়ে অতদিন…

—না, তুমি তো শরীর রাখতে জানো।

—কাল মনে করি, জনা তিরিশ হবে।

—তিরিশ!

—কেন, তা জানতে চাইলে না?

—চাওয়ার কথা তো ছিল না।

হিমাদ্রির মনে হ’ল বিয়ের আগেকার শর্ত হেমকায়া এমন করে না মানলেও পারতেন।

কিন্তু মনটাও তো খুঁতখুঁত করছে। সকালের কাগজে দেবাংশুর খবরটা পড়ে মনে ঘা লাগে খুব। দেবাংশু মারা গেল? ক্যানসারে মারা গেল? এক ব্যাচের অফিসার ছিলেন, যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল দু’জনের। দেবাংশুর শখ ছিল সেতার বাজানো—অভ্যাসটা রেখেও ছিলেন। সঙ্গীত সম্মেলনে যেতেন সব সময়ে।

রাতে পাশাপাশি শুয়ে বলেই ফেললেন কথাটা।

—দেবাংশুর খবরটা দেখে…

—দেখলাম কালকে।

—মনটা যেন কেমন হয়ে গেল। সত্যি! জীবন কি অনিত্য! ভাবলাম এবার একটু বন্ধুবান্ধবকে ডাকি।

—ভালই করেছ।

—জানতামও না যে ওর ক্যানসার হয়েছে।

—ক্যানসার তো! এ তো অন্য অসুখ নয়।

—সে জন্যেই আমি শরীরের কথা এত ভাবি।

—ও সব কথা আর ভেবো না।

—জন্মদিনে সকালে ফোন ওই করত।

—ঘুমোও, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

—ঘুম আজকে আসবে না হেম!

অথচ হিমাদ্রি ঠিক ঘুমিয়ে পড়েন। হেমকায়ার আঙুলগুলো চলতে থাকে, চলতে থাকে।

হেমকায়া বিছানা থেকে উঠে যান।

.

মিলু তার ঘরে বিছানায় বসেছিল চিবুকটা হাঁটুতে রেখে। ভয়ে লজ্জায় মুখটা শুকিয়ে গেছে। চোখে এক সমুদ্র ভাবনা। ভেবে ভেবে চোখের নিচে কালি পড়েছে।

হেমকায়া ওর মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, ভেবে ভেবে শরীরটা কত খারাপ করবি মিলু?

—কাল কি হবে জানি না!

—কি আবার হবে? তোকে লতু মাসির কাছে নিয়ে যাব। কেউ জানবেও না বাড়িতে।

—জানাজানি হলে তোমাদের মুখ পুড়বে।

—মুখ পুড়বে না মিলু।

—জানাজানি হলে…

—কেউ তো জানে না আমি ছাড়া।

—কাকে বলব? মা তো আগেই চেঁচাতে শুরু করবে। মা এমন করে।

—অনেক সয়েছে তো! ধৈর্য রাখতে পারে না।

—আমার যে কি হ’ল মাসিমা!

—মিলু! বারবার বলেছি না, যে তোর সব দায়দায়িত্ব আমার। হলে কি হবে, একটা ছেলে, বা মেয়ে!

—ওর বাপ মানবে না।

—আমি তো মানব। তোর কোন কষ্ট হবে না।

—দাদা, দিদি, মেসোমশাই!

—দরকার হয়, তোকে নিয়ে চলে যাব কোথাও।

—তা কি হয় না কি!

—যা হয় করব মিলু। তোর দায়িত্ব এখন আমার। আমি যা বলব, তাই করবি, কথা দিয়েছিস।

—তাই করব মাসিমা।

—কোন রকম আজেবাজে চিন্তা করবি না।

—না, আর না।

—আত্মহত্যার কথাও ভাবিস না।

—না, কখখনো ভাবব না।

—কাল অনেক কাজ আছে মিলু। আজ রাতে ঘুমিয়ে পড়ো।

—হ্যাঁ, শুয়ে পড়ছি।

মাথার নিচে ঠাকুরের ছবি রাখল মিলু। খুব গভীর বিশ্বাস ওর। বিষ্যুৎবারে লক্ষ্মীপুজো করবে, শনিবার যাবে লেক কালীবাড়ি।

ওর বিশ্বাস যেন ওকে মনে জোর দেয়। কাল হিমাদ্রির জন্মদিন, আর হেমকায়ার অগ্নিপরীক্ষা।

.

সকালে কিছুই বোঝা যায়নি।

ছটা পনেরোতে হিমাদ্রিশেখর হাঁটতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সত্তরেও যুবকঈর্ষিত স্বাস্থ্য এবং শরীর। ঘড়ি ধরে একঘণ্টা লেকটা চক্কর মেরেছিলেন। একেবারে নিয়ম মেনে হাঁটেন। হাঁটার মত ভাল ব্যায়াম কি আছে?

অমিয় এবং মহীতোষ পাশাপাশি বসেছিলেন। অমিয় স্বাস্থ্যের—শরীরের—ডাক্তারের— বউয়ের, বা দূরদর্শনের শাসন—বারণ মানেন না। তিনি সর্বত্র নেমন্তন্ন খান। যথেষ্ট সিগারেট ফোঁকেন। বলেন, আমার তো একশো বছর বাঁচার দরকার নেই। মহীতোষও মোটামুটি নিশ্চিন্ত মানুষ। তিনি অনেক রত্ন ধারণ করে নিজেকে সুরক্ষিত রেখেছেন।

হিমাদ্রি বসলেন না। বললেন, যাচ্ছ তো?

—অবশ্যই, অবশ্যই। স্ত্রী রত্ন বটে তোমার কাজের মেয়েটি। মিলু। রন্ধনে দ্রৌপদী।

—তাহলে দেখা হবে।

—বসবে না?

—না, আজ বসব না।

—দেবাংশুর ওখানে তোমায় দেখলাম না।

—যাই না তো কেউ মরলে টরলে। চিঠি পাঠাই।

—তুমি একরকমই থেকে গেলে।

না, কেউ মারা গেলে যান না হিমাদ্রি। মৃত্যু বিষয়ে তাঁর মনে একটা বিতৃষ্ণা। মৃত্যু মানেই কান্না, বিলাপ, সৎকার নিয়ে কথাবার্তা। ভাল লাগে না।

হাঁটলেন একঘণ্টা। হাঁটার যে কত গুণ!

এমন ভ্রমণ, যাতে খরচ নেই।

এমন চিকিৎসা, যাতে ডাক্তার লাগে না।

এমন বন্ধু, যে সর্বদা সাহায্য করে শরীরকে।

বাড়ি ফিরলেন। এখন বসে জুড়োবেন। তারপর স্নান করবেন। টেবিলে বসলে মিলু দুটি মচমচে শুকনো টোস্ট, কিছু ফল, এক গেলাস পাতলা ঘোল দেবে।

তারপর হিমাদ্রি কাগজ পড়বেন। ন’টা থেকে বারোটা থাকবেন স্টাডিতে। সুপ্রতীপ তাঁর দীর্ঘ চাকরি জীবনের স্মৃতিকথা নামক মহাগ্রন্থ টাইপ করবে। বইটা ইংরিজিতে হবে। অবশ্যই তাঁর স্বখরচে। কিন্তু এটুকু বিলাসিতা তিনি করতে পারেন। ছেলে রণজয়, সুপ্রতিষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার, হায়দ্রাবাদে থাকে। কলকাতা এলে হোটেলে ওঠে। দেখা করতে আসে। এবার এখানেই থাকছে।

—হঠাৎ এখানে থাকছে?

—আমি লিখেছিলাম।

হ্যাঁ, হেমকায়াই ছেলেমেয়ের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ। ওরা ‘মা’ বলে না, ‘হেম মা’ বলে।

এখনও ক’দিন থাকবে। বাবার জন্মদিনটা এর মধ্যেই পড়ছে? তাহলে থেকে যাওয়া যাক, এরকমই কথাবার্তা ওর। দূর্বা হেমকায়ার অত্যন্ত অনুগত প্রজা। থাকে সল্টলেকে, নতুন বাড়ি করেছে। প্রদীপ শহরের এমন এক হার্ট সার্জন, যার নাম মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে। দূর্বা একটি কম্পিউটার কেন্দ্রে কাজ করে। আজ দূর্বা, প্রদীপ, মধুলা সবাই আসবে।

মধুলা তাঁর দৌহিত্রী, তৃতীয় প্রজন্ম, যাকে দেখতে পান। দূর্বা হিমাদ্রিদের বাড়িতে প্রথম মেয়ে, যে কেরিয়ার করেছে, অন্য জাতে বিয়ে করেছে হিমাদ্রির অমতে।

অবশ্যই হেমকায়ার সক্রিয় সমর্থনে। আর, দূর্বার বিয়ের ব্যাপারে হেমকায়া যখন কথা বলেন, হিমাদ্রি বিয়ের পূর্ব শর্ত আবারও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। হেমকায়া বলেছিল, তোমার আমার মধ্যেকার শর্ত তো আমি অমান্য করিনি। তুমি যা করো, বা যা বলো, আমি ‘হ্যাঁ’ ছাড়া ‘না’ বলিনি।

—বলবেই বা কেন? আমি কোন অন্যায়টা বলি?

—থাক ওসব কথা। কিন্তু রণো আর দূর্বার ব্যাপারে কোনো শর্ত তো হয়নি? তোমরা রায়চৌধুরি, প্রদীপ মহান্তি এতে আপত্তির কী আছে?

—অত্যন্ত জেদি মেয়ে তৈরি করেছ। ওর মায়ের সঙ্গে ওর এতটুকু মিল নেই।

—ওসব কথা অবান্তর। ভাল ছেলে, কৃতী ছেলেকে বিয়ে করছে, আর কী চাও?

—বড়দা মেজদার মেয়েরা তো করেনি এ রকম।

—তোমার বড়দা আর মেজদার মেয়েদের সঙ্গে দূর্বার তুলনা করছ? কিসে আর কিসে!

—দূর্বার মা থাকলে…

—দূর্বার মা থাকলে তো হেম মা থাকতই না বাবা! তুমি এত ভুলে যাও!

দূর্বা বলেছিল।

—দূর্বা, তুমি খুব উদ্ধত হয়েছ।

—সে তো চিরকালই আছি। তবে দিদিদের বিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা বিয়ে করেনি। আমি বিয়ে করছি। এ ব্যাপারে হেম মাকে অযথা অপমান কোরো না বাবা।

এত রেগে যান হিমাদ্রি, সে ঘর ছেড়ে চলে যান। দেবাংশু বলেছিলেন, তোমার মেয়ে যেমন ঝকঝকে, জামাই তেমনি নামকরা ডাক্তার!

—বাঙালী নয়!

—কাকে বলছ? একটি জামাই, সে গুজরাটী, একটি পুত্রবধূ, সে পাঞ্জাবী। দিনকাল পালটে যাচ্ছে হিমাদ্রি, তুমি কি কিছুই বোঝ না?

তবু হিমাদ্রি সহজ হতে পারেননি।

দূর্বা আর প্রদীপের রেজেস্ট্রি এই বাড়িতেই হয়। হেমকায়া আর রণো দুজনেই বলেছিল, বাড়িতে অধিকার দূর্বার যত, রণোরও তত।

কোন লোকজনই ডাকা হয়নি। হিমাদ্রির মন রাখতে রেজেস্ট্রির পর কোন অনুষ্ঠানও হয়নি। লতু অবশ্য এসেছিল। চুলে পাক ধরে গেছে, স্বভাব ও মুখ তেমনি ধারালোই আছে।

লতু বলল, যাক! দূর্বা যে ওর মায়ের মতো হয়নি, এটা মস্ত বড় পাওনা।

প্রদীপদের বাড়ির রিসেপশান হয় ওদের লনে। ডাক্তার যত, সমাজের উচ্চকোটির মানুষও তত। লতু বলেছিল, দেখুন, এদের বন্ধুবান্ধব কি রকম সব!

বিশাল আয়োজন ছিল ওদের বাড়িতে। চা—কফি—কোলড ড্রিংকের ঢালাও ব্যবস্থা। মঞ্চে বিখ্যাত শিল্পী সেতার বাজাচ্ছেন। খুব বড় কেটারার, ব্যুফে এবং বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বেনারসী পানওয়ালার ব্যবস্থা ছিল। প্রদীপের স্যার তাপস বসু হিমাদ্রিকে বললেন, আপনি খুবই সৌভাগ্যবান।

হিমাদ্রি স্মিত হাসলেন।

—দূর্বার মুখে তো শুধু হেম মা’র কথা শুনেছি। দূর্বাও, যাকে বলে জেম অফ এ গার্ল।

হিমাদ্রি স্মিত হাসলেন। মনে মনে একটুও খুশি হতে পারছিলেন না। তিনি ”বিয়েবাড়ি” বলতে যা বোঝেন, এ যে তার চেয়ে একেবারে অন্যরকম।

বাড়ি ফিরে হেমকায়াকে বললেন, এ কি একটা বিয়েবাড়ি, না ফ্যাশান শো?

—ওরা অন্যরকম মানুষ!

—বড়লোকী দেখাতে গেছে!

হেমকায়া বললেন, দেখাবে না কেন? বাড়িটা নিজেদের। সেতার বাজালেন বসন্ত মিশ্র, উনি প্রদীপের মামাত দাদা। পরিবারে ডাক্তার, টেকনোলজিস্ট অনেক। খুব অভিজাত ব্যবস্থা হয়েছিল।

—রণোর বিয়েতে দেখিয়ে দিইনি?

হেমকায়া ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। বলেছিলেন, রণোর বিয়ের পরিণতি এখন সবাই দেখছি।

.

হিমাদ্রির এ বিষয়ে যথেষ্ট বক্তব্য আছে। রণো যদি তেমন ব্যক্তিত্বধারী পুরুষ হত, বিয়ে ভাঙত না।

রণজয়ের বিয়ে তো প্রেমজাত নয়। হিমাদ্রিকে বারবার বলেছিলেন মহীতোষ, হিমাদ্রির বিশ্বাসভাজন মানুষ। খুব নাকি বড়লোক, তাদের একতমা সুন্দরী মেয়ে। ওরা বড় বংশ খুঁজছে, টাকা টাকা খুঁজছে না।

হিমাদ্রি বললেন, রণোকে রাজী করাতে পারে তার হেম মা। আমার কথার দাম সে দেবে না।

—আরে, মেয়ের ছবি দেখুক আগে।

হ্যাঁ, বনেদী বড়লোক এবং ব্যারিস্টার, মেয়েকে বিয়ে দেবার সময়ে ছবি পাঠিয়েছিলেন।

সদুঃখে দূর্বা বলেছিল, ঘটক পাঠালেই পারত?

হেমকায়া বলেছিলেন, ঘটকালি তো আজকালও হয় দূর্বা। রং ঢং পালটে গেছে, এই যা! কাগজে বিজ্ঞাপনও বেরোয়, বিবাহ—যোগাযোগ অফিসও অনেক। আমাদের দেশে যা যা ছিল, তাই থেকেও যায়।

—দাদাটা যে কি অপদার্থ!

—সবাই কি একরকম হবে?

—যাক গে, ভাল হলেই ভালো।

—আমার শুধু মনে হচ্ছে, অত বড়লোকের আদুরে মেয়ে রণোকে পছন্দ করবে তো?

—হিমাদ্রি বলেছিলেন, আরে! আগ্রহ তো ওদেরই। কন্যাপক্ষই আগ্রহ দেখাচ্ছে।

—রণো একে চাপা, তায় শান্তিপ্রিয় ছেলে!

—কেন! বউ মানিয়ে নিতে পারবে না?

—জানি না। ও সমাজটা তো জানিই না।

—আরে আমি তো জানি! রণোর মা কি কম বড়ঘরের মেয়ে ছিল? মানিয়ে নেয়নি?

—দেখি, তুমিও দেখ!

—তুমি বললে রণো রাজী হবে।

রণজয় মধুমিতা বা মোমোর ছবি দেখেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুন্দর, এত সুন্দর।

—দেখ হেম মা, ঠিক যেন…

—পরী না দেবকন্যা রে রণো?

—সেসব নয়, তবে খুবই সুন্দরী।

—তোর পছন্দ তো?

—হ্যাঁ, দেখতে ভারি সুন্দর।

সে ছবিটা গেল কোথায়? কোন সমুদ্রের তীরে মোমো। আঁচল উড়ছে, লম্বা চুল উড়ছে, আশ্চর্য টানা টানা চোখ, ঝলমলে সৌন্দর্য।

লতু বলল, ইন্দ্রজিৎ বাবু আর তস্য পত্নী তো মেয়েকে নয়নের মণি করে রেখেছেন।

—চেনো ওঁদের?

—তেমন নয়, তবে চিনি না বলব না।

—কেমন মেয়েটি, লতু?

—তা তো জানি না। তবে আদুরে খুব।

—রণোর সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছেন কেন?

—আমার ধারণা, ওঁরা খুব বশংবদ ছেলে চান। যে ওঁদের প্রতি অনুগত থাকবে।

দূর্বা বলল, ঘরজামাই খুঁজছে না তো? তাহলে কিন্তু দাদা রাজী হবে না।

হেমকায়া সদুঃখে বললেন, বালিগঞ্জ সার্কুলারে অত বড় বাড়ি, অতগুলো কুকুর, দু’খানা গাড়ি। সে মেয়ে কেমন করে এখানে থাকবে? রণো তো ছবি দেখেও মুগ্ধ, আলাপ করেও মুগ্ধ।

দূর্বা বলল, অত ভেবো না তো! দাদা যদি সুখী হয়, তাহলে তো সবই ভালো।

হিমাদ্রি মনের সাধে জাঁকজমক করেছিলেন। মস্ত বাড়ি ভাড়া নেয়া হয় সাহেবী পাড়ায়, আলোর বালবে ছলমলে চাঁদোয়া, মস্ত সিংহাসন, কিছু বাদ থাকেনি। গয়না হিমাদ্রিই কিনেছিলেন। অবশ্য মোমোদের বাড়ির দিক থেকে আরো অনেক বেশি আড়ম্বর করা হয়।

রণো তখন মুগ্ধ, ধন্য। মোমোকে দেখলে রণো ভেসে যেত, যেন মন্ত্রাবিষ্ট হয়ে যেত। লম্বা হনিমুন হয়েছিল ওদের,—উটিতে অনেকদিন ছিল।

ফিরে এসে দিন দুই বাদেই মোমো বাপের বাড়ি চলে গেল। ওদের আত্মীয়স্বজনরা নবদম্পতিকে নেমন্তন্ন করে না, পার্টি দেয়। এত পার্টি, এত হৈ চৈ, সে একটা অন্য অভিজ্ঞতা।

হিমাদ্রি বেয়াইগর্বে গর্বিত ছিলেন খুব। মোমো ওঁকে ভীষণ ভালবাসে। নিজের বাবাকে ”বাপী” বলে। হিমাদ্রিকে ”বাবা”। কখনো ”আপনি” বলে না, ”তুমি” বলে। খেতে বসে যা খায়, তাই ”লাভলি” বলে। অবশ্য কুকুরদের আদর করতে যখন তখন বাপের বাড়ি যায়, কি আর করা যাবে।

অসম্ভব হইচই, সুখ ও আনন্দে ভাসাভাসি কিছুদিন চলেছিল। মোমো এ সংসারে এক আদরণীয় অতিথির মতো থাকত। হিমাদ্রির টোস্ট বা লেবুর জল, ঘড়ির কাঁটা মেপে খাওয়া, এ সবের রহস্যে ও ঢুকতে চেষ্টাই করেনি।

দূর্বা বলত, হাতে করে কিছু তো করতে হবে না, তবু একটু তো ভেতরে ঢুকতে পারে।

হেমকায়া কিছুই বলতেন না। মোমোর সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করতেন, রণোর মুখ দেখে মনে মনে প্রমাদ গণতেন।

মোমো মাঝে মাঝেই এ বাড়ির শান্ত জলে ঢিল ফেলত। যেমন, ও মা! বলিনি বুঝি? আজ তো মামের সঙ্গে ক্লাবে লাঞ্চ খাব।

—আজ তো আমার বন্ধুর ডানস প্রোগ্রাম। তারপর কি ফেরা যাবে?

—আপনাদের পাড়াটা ভীষণ বাঙালী বাঙালী, তাই না?

—আচ্ছা, বাবা এ রকম করে সেবাযত্ন আদায় করেন কেন? আমার বাপী তো অন্যরকম!

তারপর বোঝা গেল, একটি শোবার ঘর, একটি বাথরুম আর একটি ব্যালকনিতে ওকে আঁটছে না।

—ম্যাচবক্স হাউস!

ও হরদম বলত।

রণোর সঙ্গেও খিটির মিটির বাধছিল। ক্রমে বোঝা গেল, শ্বশুর, সৎ শাশুড়ী এবং দূর্বাকে নিয়ে বসবাস করতে ও পারবে না।

হেমকায়া বলেছিলেন, তোরা কোনো ফ্ল্যাট নিয়ে চলে যেতেও পারিস। মোমো নিজের মতো থাকবে।

—ফ্ল্যাটে থাকবে মোমো? ওর বক্তব্যটা পরিষ্কার। ও একতমা মেয়ে। বালিগঞ্জ সার্কুলারের বাড়িতে আমাকে যেতে হবে।

—তুই যেতে চাস?

—তা কখনো চাইতে পারি?

দূর্বা বলল, দাদা ওকে ধরে রাখতে পারবে না হেম মা! ওদের বিয়ে টিকবে না।

টেকেনি, বিয়েটা টেকেনি।

চার বছরের মাথায় মোমো চলেই যায় বাড়ি ছেড়ে। শ্রীজয়কে নিয়ে গেল। শ্রীজয়ের বয়স তখন দেড় বছর।

মাত্র দেড় বছরের ছেলে। মায়ের রং, নাক, ঠোঁট,—রণোর মত চোখ,—কালো ও কোঁকড়া চুল। শ্রীজয় মাঝে মাঝেই হাতে খাবার নিয়ে খেতে ভুলে যেত।

হিমাদ্রি অনেক তর্জন গর্জন করলেন। দূর্বা আর হেমকায়া অনেকবার গেলেন। রণোকে নিয়ে মোমোর বাবা মা আলোচনায় বসলেন বারবার।

রণো ওঁদের প্রস্তাবে রাজী হতে পারেনি। শেষে মোমোই মানসিক নির‍্যাতনের ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদের কেস করে।

ডিক্রি পেয়ে রণোকে বলেছিল, আমরা বন্ধু থাকব, কেমন? আর সানিকে দেখতে তো তুমি আসবেই।

যখন বলেছিল, মোমো নিজের কথাগুলো বিশ্বাস করেছিল। মিষ্টি আন্তরিকতায় গলে পড়েছিল। বলেছিল, বিয়ে একটা অভিজ্ঞতা। সেটাও হয়ে গেল।

—ভাল থেকো মোমো, সানিকে সঙ্গ দিও।

—ও তো মাম আর বাপীর চোখের মণি।

এসব বলে টলে মোমো তার মাসির কাছে চলে গেল বিলেতে। সানিকেও নিয়ে গেল।

এ বিচ্ছেদ ঠেকানো যেত কি না হেমকায়া জানেন না। পরে রণো বলেছিল, ও বরাবরই চেয়েছিল আমি ওদের বাড়িতে থাকি, ওদের মতো হয়ে যাই। এ বিয়ে তো হবার কথা নয় হেম মা, হয়েছিল ওদের গুরুদেবের নির্দেশে। ওর বাবা মা তো…

ছেলেকে দেখতে যাবার অনুমতি থাকলেও বিলেত কিন্তু বর্ধমান নয়, যে যাবে আর আসবে। রণো অবশ্য জন্মদিনে, বড়দিনে উপহার কেনার টাকা পাঠায়, ছেলেকে চিঠি লেখে।

এসব ঘটনাও অতীতের কথা হয়ে গেছে।

পাঁচ বছর তো কাটল।

রণজয় হায়দ্রাবাদে আজ বছর চারেক। আগে বিয়ের কথা বললে ‘না’ বলত। হেমকায়া বলেছেন, ওখানে একটি মেয়ের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হয়েছে।

—চমৎকার! বাংলাভাষী মেয়ে ছিল না?

—রণোই জানবে।

—কথা কইবে কোন ভাষায়?

—ইংরিজিতেই বলে নিশ্চয়। মেয়েও তো দিল্লিতে পড়েছে, ওর বাবা কোথাও সেক্রেটারিও ছিলেন।

—সংসারটা ভেঙে গেল।

—ওর জীবন, ওই ভাবুক না।

—বাড়ি, ট্রাডিশন, এসব রণো বুঝল না। বুঝত, যদি আমার সঙ্গে কথা বলত! ও তো যত কথা তোমাকেই বলে।

হেমকায়া আস্তে বললেন, আমাকেও যদি বলতে না পারত, ওর অবস্থা কী দাঁড়াত?

—হ্যাঁ, দূর্বা, প্রদীপ, লতু, সবার সঙ্গে ওর খুব ভাব। এড়িয়ে চলে শুধু আমাকে।

—কোনদিন তো ওদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশোনি।

—আমার বাবার সঙ্গে তো আমরা কথাই বলতে সাহস করতাম না। বাবা আবার বন্ধু হয় কবে?

—রণোও করত না।

—কিন্তু বাবাকে ভক্তি করতাম।

—রণো তো অভক্তি করে না।

—তুমিই ওদের মাথাটা খেয়েছ।

—বলেছিলে, ওদের মা হতে হবে, মানুষ করতে হবে। অবশ্য ওরা এতই ভাল, যে আমাকে কোনো কষ্ট করতে হয়নি।

আজ, অনেক কথাই মনে পড়ছে।

হিমাদ্রি টেবিলে এসে বসলেন। রণো নেই, হেমকায়া নেই। ব্যাপার কী?

মিলু কোথায়, মিলু? সকালে তাঁর ট্রে তো সেই নিয়ে আসে। কালো রং মিলুর, মুখে বসন্তের দাগ। বছর বাইশ বয়স হয়েছে। অত্যন্ত নম্র, ভীরু, শান্ত একটি মেয়ে। হেমকায়ার পেছন পেছন ঘোরে।

—মিলু! মিলু!

অধীর হয়ে হিমাদ্রি ডাকলেন। সময়ের মূল্য, তাঁর সময়ের মূল্য তো এ বাড়িতে সবাই জানে। খাবেন, উঠে যাবেন, স্টাডিতে ঢুকবেন, তাঁর দুর্গে। বাড়িটা তাঁর, এবং তাঁর নিয়মে চলবে, সেটা সবাই জানে। সাতাশ বছর আগে বিয়ে করেন হেমকায়াকে। সাতাশ বছর ধরেই হেমকায়া এ রুটিন মেনে আসছেন।

—মিলু!

রণজয় ওপর থেকে নেমে এল। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি হাঁটতে যাবার পরেই হেম মা ট্যাক্সি ডাকিয়ে মিলুকে নিয়ে চলে গেছেন। তোমাকে এই চিঠিটা দিয়ে গেছেন।

—চলে গেছেন?

—তোমাকে চিঠিটা দিয়ে গেছেন।

—হেম, তোমাকে চিঠি দিয়ে গেল?

—বাবা, চিঠিটা পড়ো।

রণোর গলায় যেন একটা আদেশের ভাব। হিমাদ্রি বললেন, পরে পড়ব।

পকেটে রাখলেন চিঠি। কি বিশ্রিভাবেই না জন্মদিনটা শুরু হল! হেমকায়া মিলুকে নিয়ে কোথায় গেছেন!

হিমাদ্রির সকালের ব্রেকফাস্টের ওপর নির্ভর করে স্টাডিতে ঢোকার মেজাজ। স্টাডিতে সময়টা ঠিকমত কাটতে খাবার টেবিলে এসে বসেন। খাওয়া নিয়ে গণ্ডগোল করেন না কোনো। লতু তাঁকে বলে, একনায়কতন্ত্র চালাচ্ছেন।

বোঝে না। ওরা বোঝে না। একটা লোক কি কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলেছে এই ডামাডোলের দিনে। নিয়ম মানতে জানে না বলেই বাঙালীর এই অবস্থা। হিমাদ্রি মনে করেন। রাষ্ট্রকে মাঝে মাঝে সামরিক শাসনে রাখা দরকার।

মায়া একটি ট্রে রেখে গেল। একটি শুকনো টোস্ট, এক গেলাস ঘোল, কয়েকটি কাজু, নেহাৎ অভ্যাসবশেই খেলেন হিমাদ্রি।

—বাবা চিঠিটা পড়ো।

—তোমার যেন বড্ড তাড়া, রণো?

কোনদিন, কোনদিন বাপ—ছেলেতে সংবাহন নেই। কোনদিন দুজনে মন খুলে কথা বলেননি। সে আন্দাজে রণোর বারবার একই কথা বলা একটু আশ্চর্য।

—তোমার কিসের তাড়া, রণো?

—দূর্বাকে আনতে যাব।

—এখন?

—চিঠিটা পড়ো।

চিঠিটা খুললেন। বিবাহিত জীবনে এটাই প্রথম চিঠি। সাতাশ বছর ধরে দুজনে একসঙ্গে আছেন। চিঠি লেখার দরকার হয়নি।

প্রথমার কথা মনে পড়ল। প্রথমা এখন একটা স্মৃতি, ধূসর হয়ে যাওয়া ছবি, কোন বেদনার্ত স্মৃতি বা শোক নয়।

বেচারি প্রথমা! এত অল্প বয়সে চলে গেল। এমন ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রেখে, সন্তানরাও মনে রাখেনি বোধ হয়।

প্রথমা নিয়ম করে পোস্টকার্ড লিখত, শ্রীচরণেষু—তুমি কেমন আছ? আমরা ভাল আছি। শাশুড়ি মা পুরী যাচ্ছেন। কিছু টাকা তাঁকে পাঠিও। প্রণাম নিও।

স্কুলের মেয়ের মত গোটা গোটা লেখা। লেখার বিষয়বস্তুও বিচিত্রহীন।

হেমকায়ার হাতের লেখাই চেয়ে দেখেননি কোনদিন। হেমকায়া স্কুলের খাতা দেখছেন। বই পড়ছেন মন দিয়ে। ”আরণ্যক” বইটি একাধিকবার ওর হাতে দেখেছেন।

—এক বই কতবার পড়বে?

—ভালো লাগে।

খবরের কাগজ পড়ছেন হেমকায়া। ছেলেমেয়ের সঙ্গে তুমুল তর্ক করছেন। রাজ্য, রাজনীতি, মেয়েদের অবস্থান, ভূপাল গ্যাস, কত বিষয়ে যে তর্ক হত।

হেমকায়ার লেটার বক্সে নিয়মিত চিঠি আসে। দূর্বা, লতু, রণো, সকলকে চিঠি লেখেন হেমকায়া। হেমকায়ার লেখাপড়ার টেবিল দূর্বা করিয়ে দিয়েছে। খাম, পোস্টকার্ড, সাদা খাম, ডাকটিকিট থাকে আলাদা খোপে। টেবিল ল্যাম্প জ্বলে। বড় বড় চিঠি লেখেন হেমকায়া।

আজ হেমকায়া তাঁকে লিখেছেন।

সাদা প্যাডে হেমকায়ার নাম ও ঠিকানা ছাপানো। এ সব করিয়ে দেয় রণো ও দূর্বা। হেমকায়া বালিকার মতো খুশি হন। ওঁর চটি কেনে রণো। জামাকাপড় কেনে দূর্বা। হিমাদ্রি কোনদিন হেমকায়াকে কোন উপহার দিয়েছেন কি? হেমকায়া অবশ্য প্রতি জন্মদিনে কোন না কোন উপহার দেন হিমাদ্রিকে।

এ সব কথা এখন মনে হচ্ছে কেন? হিমাদ্রি চিঠিটা খুললেন।

সুন্দর তেজী তেজী, স্পষ্ট হরফ। চিঠিতে কোন সম্বোধন নেই। অবশ্য হেমকায়া কি সম্বোধন বা করতেন? ”শ্রীচরণেষু” লিখতে পারতেন না। কোনদিন প্রণাম করেননি। তবে পায়ে ব্যথা হলে মালিশ করে দিয়েছেন।

”প্রিয়তমেষু” লেখাও অবাস্তব হত। শর্তের ভিত্তিতে বিয়ে। হেমকায়া শর্ত মেনে চলেছেন। ”প্রিয়তমেষু” প্রথমাও লিখত না। হিমাদ্রিকে অমন অন্তরঙ্গ সম্বোধন করা বড় কঠিন। আরেকটি স্ত্রীলোক এসেছিল তাঁর জীবনে। সে লেখাপড়াই জানত না। হঠাৎ কেন তার কথা মনে হল?

ছোট্ট, সংক্ষিপ্ত চিঠি। হিমাদ্রি রণো নয় যে হেমকায়া বড় বড় চিঠি লিখবেন। বাংলায় বড় বড় চিঠি, মোটা মোটা খাম।

—বাংলায় কি লেখো অত?

—রণোও বাংলাই লেখে। সব লিখি, কি রাঁধলাম, কোথায় গেলাম, হাসনুহেনা গাছে ফুল ফুটেছে কিনা, কি বই পড়লাম, কি কি সিনেমা দেখলাম, ভিটামিন খাচ্ছি কি না!

এ চিঠিও বাংলাতেই লেখা।

—”মিলুকে নিয়ে চলে যাচ্ছি মিলুরই জন্য। আর কোন উপায় ছিল না। মিলু আত্মহত্যার কথা ভাবছিল। সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে রণো আর দূর্বা যা পারে করবে। মিলুর কোন সম্মানজনক ব্যবস্থা করতে পারলে তবেই ফিরব। নইলে ফিরব না।”

হিমাদ্রির চোখের সামনে অক্ষরগুলো তালগোল পাকিয়ে গেল। এ কিসের পুনরাবৃত্তি তাঁর জীবনে? প্রথমা আর মনোরমা। হেমকায়া আর মিলু। কিন্তু কি হয়েছে মিলুর? কেন তার সম্মানরক্ষা এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠল হেমকায়ার কাছে? মিলুর প্রতি হিমাদ্রি তো কোন অশোভন আচরণ করেননি? চেয়ে দেখেননি সে কেমন দেখতে,—হেমকায়া তাকে অত্যধিক আগলে আগলে চলেন বলে বিরক্ত হয়েছেন। বলেছেন, ও তো মেয়ে নয় তোমার।

হেমকায়া ঈষৎ হেসে বলেছেন, সে তো দূর্বাও নয়।

বেহিসেব হয়ে যাচ্ছে সব, মিলছে না অঙ্কে। হেমকায়া মিলুর জন্য আজ চলে গেল? না, হিসেব মিলছে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *