মিত্ৰপ্ৰাপ্তি

মিত্ৰপ্ৰাপ্তি

হরিণ কচ্ছপ ইঁদুর কাক

দক্ষিণ ভারতে মহিলারোপ্য নামে এক নগর ছিল। তার কাছেই ছিল এক বিশাল বটগাছ। কত পাখি তার শাখায় বাস করত। তার ফল খেত। কত যে বানর তার ডালে লাফালাফি করত আর পাতা-ফুল-ফল খেত। কত পোকা-মাকড় তার কোটরে বাস করত। আর কত পথিকই না তার ছায়ায় আশ্রয় নিত। তাই তাকে দেখে সবাই বলত―এভাবে যারা পরের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়, তারাই পৃথিবীর অলঙ্কার, বাকি সব ভারস্বরূপ।

সেই বটগাছে থাকত এক কাক। লঘুপতনক। খুব দ্রুত উড়তে পারত। তাই এ নাম। একদিন ভোরবেলা লঘুপতনক যাচ্ছে নগরের দিকে। খাবারের সন্ধানে। হঠাৎ দেখে―যমদূতের মতো নিকষকালো এক ব্যাধ। এক হাতে জাল, অন্য হাতে খাবারের ভাণ্ড। এদিকেই আসছে। ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল! আজ বোধ হয় বটবাসী পক্ষিকুলের শেষ দিন! সে দ্রুত ফিরে এসে পক্ষিদের বলল: ভায়েরা! ঐ শয়তান ব্যাধ আসছে আমাদের ধরতে। ও নিশ্চয়ই জাল পেতে খাবার ছড়াবে। সাবধান! কেউ লোভে পড়ে খেতে যেও না। মারা পড়বে।

একথা বলতে বলতেই ব্যাধ এসে পড়ল। জাল বিছিয়ে চাল ছড়িয়ে লুকিয়ে রইল। কিন্তু বৃক্ষবাসী কোনো পক্ষিই ধরা দিল না। ব্যাধ হতাশ হয়ে বসে রইল। এমন সময় চিত্রগ্রীব নামে এক কবুতর এল তার দলবল নিয়ে। হাজার কবুতর তার দলে। নিচের দিকে তাকিয়ে নিসিন্দা ফুলের মতো সাদা চাল দেখে আর লোভ সামলাতে পারল না। লঘুপতনকের নিষেধ সত্ত্বেও চাল খেতে নেমে দলসহ আটকা পড়ল। কথায় বলে—লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আসলে, লোভে কারো বুদ্ধিনাশ হলে বিপদ তাকে ছাড়ে না। তাইতো—পরস্ত্রীহরণ দোষ জেনেও রাবণ তা করে সবংশে নিহত হয়েছিল। সোনার হরিণ অসম্ভব জেনেও রাম তা ধরতে গিয়ে সীতাকে হারিয়েছিলেন। পাশাখেলার ভয়াবহ পরিণতি জেনেও যুধিষ্ঠির তা খেলে রাজ্যহারা হয়েছিলেন। তদ্রূপ চিত্রগ্রীবও লোভে পড়ে এখন মৃত্যুর দ্বারে উপস্থিত।

ব্যাধ তো মহাখুশি! এতগুলো কবুতর! একসঙ্গে! সে লাঠি উঁচিয়ে এগিয়ে এল মারা জন্য। চিত্রগ্রীব দেখল, এভাবে পড়ে থাকলে মরণ নিশ্চিত। বাঁচার জন্য চেষ্টা করতে হবে। সে পায়রাদের ডেকে বলল: তোমরা ভয় পেওনা, ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা কর। দেখ—

বিপদে যে ধৈর্য ধরে সে-ই বেঁচে থাকে।
দুর্বলেরা যখন তখন পড়ে যে বিপাকে।।
মহতেরা সমান থাকে সুদিনে দুর্দিনে।
সুর্য যেমন উদয়ে লাল তেমনি অস্তগমনে।।

তাই, চলো, জালসহ উড়ে আমরা অন্য কোথাও যাই। সেখানে গিয়ে মুক্ত হব। তবে, সাবধান! সবাইকে একসঙ্গে উড়তে হবে। তা না হলে বিপদ! জড়াজড়ি করে সবাই মারা পড়ব। দেখ—সুতা যতই চিকন হোক, অনেকগুলো এক সঙ্গে হলে তা দিয়ে হাতিও বাঁধা যায়।

চিত্রগ্রীবের কথামতো পায়রাগুলো তা-ই করল। জাল সমেত উড়ে চলল। তা দেখে ব্যাধ পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল। প্রথমে একটু হতাশ হলেও পরে এই ভেবে আশ্বস্ত হলো যে—

পাখিরা সব এক হয়ে মোর
জাল নিয়ে ঐ যাচ্ছে চলে।
আর কতক্ষণ? দেখো না ঐ
ঝগড়া করে পড়ল বলে।।

ঘটনা দেখে লঘুপতনকের বিস্ময় লাগে। সে আহার ভুলে ‘দেখি না কি হয়’― এই কৌতূহলে পেছনে পেছনে উড়তে লাগল। কিন্তু পায়রাগুলো উড়ছে তো উড়ছেই। থামার কেনো লক্ষণ নেই। অনেক দূরে চলে গেছে। ব্যাধের দৃষ্টির বাইরে। ব্যাধ তাই নিরাশ হয়ে বলল:

যা হবার নয় তা হয় না কভু
যা হবার তা এমনিতেই হয়।
ভাগ্যে যদি না-ই থাকে
হাতে পেয়েও ফসকে যায়।।
এমন বস্তু পেতে গিয়ে
যার যা আছে তা-ও যায়।
মাংস থাক দূরের কথা
জালটাও যে গেল, হায়!!

এই বলে ব্যাধ অতিশয় দুঃখিত মনে ফিরে এল। তা দেখে চিত্রগ্রীব বলল: বন্ধুরা, ও বেটা হার মেনেছে। এবার উত্তর-পূর্ব দিকে চল। সেখানে পাহাড়ের গায়ে আমার এক বন্ধু আছে—হিরণ্যক। দেখি, সে আমাদের জন্য কি করে। কথায় বলে— বিপদেই বন্ধুর পরিচয়।

চিত্রগ্রীবের নির্দেশে পায়রারা উত্তর-পূর্ব দিকে উড়ে চলল। অনেকটা পথ গিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে অবতরণ করল। সেখানেই সুড়ঙ্গ করে থাকে হিরণ্যক নামে এক ইঁদুর। হাজারটা প্রবেশপথ তার সুড়ঙ্গের। এ যেন এক শক্তিশালী দুর্গ। এমনই সুরক্ষিত যে, কেউ তাকে ধরতে পারবে না। তা দেখে চিত্রগ্রীব পায়রাদের উদ্দেশ করে বলল: দেখ, মদহীন হাতি, দাঁতহীন সাপ আর দুর্গহীন রাজা এ তিনজনই অরক্ষিত। কারণ, যুদ্ধে সহস্র হাতি আর লক্ষ ঘোড়া যা না করতে পারে, একটি শক্তিশালী দুর্গ তার চেয়ে বেশি করতে পারে। এটা রাজনীতির কথা।

চিত্রগ্রীব একটি সুড়ঙ্গদ্বারে গিয়ে তারস্বরে ডাক দিয়ে বলল: বন্ধু হিরণ্যক! শিগির এস! মহাসঙ্কট!

বন্ধুর গলা শুনে হিরণ্যকের যেন আনন্দ আর ধরে না। গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। মনে মনে বলে: বন্ধু-বান্ধব হচ্ছে চোখের উৎসব, দেখলেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। আর যখন-তখন বন্ধুরা বাড়িতে এলে যে-আনন্দ পাওয়া যায়, তা ইন্দ্রপুরীতেও মেলে না।

এরপর প্রকাশ্যে চিৎকার দিয়ে সে বলল: আসছি!

বাইরে এসে দেখে দলবলসহ চিত্রগ্রীব জালে আটকা। জিজ্ঞেস করার আগেই চিত্রগ্রীব বলল: দেখ, নিজের পাপ-পুণ্যের ফল মানুষ পায়—যার কাছ থেকে, যে-কারণে, যখন, যেভাবে, যা, যতটা, যেখানে তার পাওয়ার কথা—তার কাছ থেকে, সে-কারণে, তখন, সেভাবে, তা-ই, ততটা, সেখানে এ হলো শাস্ত্রের বিধান। তাই, জিভের লালসা মেটাতে গিয়ে আজ আমাদেরও এই দশা! এবার তুমি দ্রুত আমাদের মুক্ত কর, বন্ধু।

সব শুনে হিরণ্যক বলল: পাখিদের স্বভাবই এই—শতযোজন দূর থেকে তারা শুধু খাবারটাই দেখে, জালটা আর চোখে পড়ে না। এরপর যখন সে চিত্রগ্রীবের কাছে গিয়ে বাঁধন কাটতে শুরু করবে তখন চিত্রগ্রীব বিনয়ের সঙ্গে বলল: বন্ধু, এমনটি করো না। আগে ওদের মুক্ত কর, তারপর আমাকে।

হিরণ্যক রাগ করে বলল: কি বলছ তুমি! আগে রাজা, তারপর প্রজা।

চিত্রগ্রীব: তা নয়, বন্ধু! ওরা সবাই আমার ওপর নির্ভরশীল। ওদের সমস্ত বিশ্বাস আমায় অর্পণ করেছে। বিশ্বাস নষ্ট হলে আর কি থাকে? তাছাড়া, ধর, আমার বাঁধন কাটতে কাটতেই তোমার দাঁত ভেঙ্গে গেল, কিংবা শয়তান ব্যাধটা এসে পড়ল। তখন? তখন আমার নরক ঠেকাবে কে? তাছাড়া দলপতি হিসেবে ওদের দায়-দায়িত্ব তো আমারই। কথায় বলে না—

প্রজারা সব কষ্টে আছে রাজা আছে সুখে।
স্বর্গ মর্ত্য পাতাল নরক কাটবে যে তার দুঃখে।।

শুনে হিরণ্যক ভীষণ খুশি হয়ে বলল: বন্ধু, রাজধর্ম আমি জানি বৈ-কি! তোমায় একটু পরীক্ষা করছিলাম। ঠিক আছে, আগে ওদেরটাই কাটব, পরে তোমারটা। এভাবে চললে নিশ্চয় তুমি লক্ষ পায়রার রাজা হতে পারবে। শাস্ত্রে আছে না—

ভৃত্যে দয়া, ধনবণ্টন করেন যিনি সমান।
সেই মহীপাল শাসন করতে পারেন ত্রিভুবন।।

এই বলে হিরণ্যক একে একে সকলের বাঁধন কেটে চিত্রগ্রীবকে বলল: বন্ধু, এবার যাও। আবার কখনো বিপদে পড়লে এসো। সকলের পক্ষ থেকে চিত্রগ্রীব তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ির উদ্দেশে উড়াল দিল। নীতিশাস্ত্র যথার্থই বলেছে:

বন্ধুর সাহায্যে হয় দুঃসাধ্য সাধন।
অতএব, মিত্র করো নিজের মতন।

এই সমস্ত ঘটনা লঘুপতনক বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছে। ভাবছে, ওঃ! হিরণ্যকের কি বুদ্ধি! কি সুরক্ষিত তার দুর্গ! বন্ধুর প্রতি তার কি বিশ্বাস-ভক্তি! এ না থাকলে তো পাখিদের নিশ্চিত মরণ ছিল। আমি তো জীবনে কাউকে বিশ্বাসই করতে পারলাম না। যেমন আমার চেহারা, তেমন গলা, আর তেমনই চঞ্চল স্বভাব।

কিছুক্ষণ ভেবে সে স্থির করল, যেভাবেই হোক, এর সঙ্গে ভাব করতে হবে। তারপর গাছ থেকে নেমে সুড়ঙ্গদ্বারে গিয়ে চিত্রগ্রীবের কণ্ঠে বলল: বন্ধু, আরেকটি বার এসো তো। কথা আছে।

হিরণ্যক বেরিয়ে এল। কিন্তু, লঘুপতনককে দেখে দ্রুত গর্তে ঢুকে বলল: তোমার এখানে কি চাই? দূর হয়ে যাও এক্ষুণি।

লঘুপতনক: অমন করছ কেন? আমি তোমাদের সব ঘটনা দেখেছি। তোমার এই বিশাল দুর্গ! তোমাদের গভীর বন্ধুত্ব! কিভাবে তুমি পাখিদের মুক্ত করলে! সব! সব! আমি মুগ্ধ! আমার কোনো বন্ধু নেই। আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। ভবিষ্যতে বিপদে পড়লে তুমি আমায় উদ্ধার করতে পারবে। তুমি না করো না।

হিরণ্যক: তা কি করে হয়? তুমি হচ্ছ খাদক, আর আমি খাদ্য। এই অসমতে বন্ধুত্ব হয় না। তুমি যাও।

লঘুপতনক: তুমি যতই বল, আমাকে তোমার বন্ধু করতেই হবে। এই আমি তোমার দরজায় বসলুম। হয় বন্ধুত্ব, না হয় অনশনে মৃত্যু।

হিরণ্যক: আঃ! মিছিমিছি বিরক্ত করছ কেন! বলেছি না—শত্রুর সঙ্গে কখনো মিত্ৰতা হয় না। শাস্ত্রে আছে—শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা যতই গভীর হোক তা স্থায়ী হয়না, যেমন জল যতই গরম হোক তা আগুনকে নেভাবেই।

লঘুপতনক: আরে, তোমার সঙ্গে আমার তো কখনো দেখাই হয়নি। তবে আমি তোমার শত্রু হলাম কি করে?

হিরণ্যক: দেখ, শত্রু দু-রকমের

জন্মগত ও কারণগত। কারণগত শত্রুতা প্রতিকারে দূর হয়। কিন্তু, জন্মগত শত্রুতা জীবন দিয়ে শোধ করতে হয়। সাপে-নেউলে, জলে—আগুনে, ব্যাধে-হরিণে, সতীনে-সতীনে, দুর্জনে-সুজনে ইত্যাদি হলো জন্মগত শত্রুতা, যেমন তোমাতে-আমাতে। তাই, তুমি ফিরে যাও।

লঘুপতনক: আরে ধ্যাৎ! কি আজে-বাজে বকছ! শোনো কাজের কথা। এ দুনিয়ায় বন্ধুত্ব হয় কারণে, আবার শত্রুতাও হয় কারণে। তাই এসো, আমরা বন্ধু হয়ে পরস্পরের কাজে লাগি। আরো শোনো—মানুষে মৈত্রী হয় উপকারে, পশু ও পক্ষিতে হয় বিশেষ কারণে, মূর্খদের হয় ভয়ে কিংবা লোভে, আর সজ্জনের হয় কেবল দর্শনে। তুমিও সজ্জন, আমিও সজ্জন। কাজেই আমাদের বন্ধুত্ব তো হয়েই গেছে। সজ্জনের বন্ধুত্ব আখের রসের মতো আগা থেকে গোড়ার দিকে পাকে পাকে বাড়ে। আর দুর্জনের বন্ধুত্ব এর বিপরীত—গোড়া থেকে আগার দিকে পাকে পাকে কমে। কিংবা ধরো, দিনের প্রথমার্ধ ও পরার্ধের ছায়ার মতো। পরার্ধের ছায়া যেমন শূন্য থেকে ক্রমে ক্রমে বাড়ে, সজ্জনের বন্ধুত্বও তেমনি। কিন্তু দুর্জনের বন্ধুত্ব প্রথমার্ধের ছায়ার মতো—শুরুতে ব্যাপক, ক্রমশ কমে। আমি শপথ করে বলছি, তুমি আমায় সজ্জন বলে বিশ্বাস করতে পার।

হিরণ্যক: দেখ, আমি তোমার এই শপথ-টপথে বিশ্বাস করি না। শাস্ত্রে আছে—শপথ নিয়ে সন্ধি করলেও শত্রুকে বিশ্বাস করবে না, কারণ দেবরাজ শপথ নিয়ে বিশ্বাসের সুযোগেই বৃত্রাসুরকে বধ করেছিলেন। শত্রু সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে ভেতরে ঢুকে এক সময় ধ্বংস করে দেয়, যেমন বানের জল ছিদ্রপথে প্রবেশ করে নৌকা ডুবিয়ে দেয়। যে—ব্যক্তি শত্রু কিংবা অসতী স্ত্রীকে বিশ্বাস করে, সে অকালে প্রাণ হারায়। কাজেই নিজের সুখ-সমৃদ্ধিকামী বিচক্ষণ ব্যক্তি দেবগুরু বৃহস্পতিকেও বিশ্বাস করেনা। লঘুপতনক ভাবল: এ তো রাজনীতিতে ভীষণ তুখোড়! এজন্যই তো এর সঙ্গে ভাব করতেই হবে। প্রকাশ্যে বলল: দেখ, পণ্ডিতেরা বলেন সজ্জনদের বন্ধুত্ব হয় সাত কথায় কিংবা সাত পা এক সঙ্গে চললে। তাই তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এবার আমি যা বলি শোনো। তুমি যদি আমায় বিশ্বাস না-ই করতে পার, তাহলে ঠিক আছে, তুমি তোমার দুর্গের মধ্যেই থাক। আমি বাইরে থেকেই তোমার সঙ্গে আলাপ করব।

হিরণ্যক ভাবল: এ তো খুব বিদগ্ধের মতো কথা বলছে! তা ভাব করিই না। প্রকাশ্যে বলল: তবে তা-ই হোক। কিন্তু, এক শর্ত—তুমি কখনো আমার দুর্গে ঢুকতে পারবে না। শাস্ত্রে আছে— শত্রু প্রথমে ভয়ে ভয়ে রাজ্যে পা দেয়, তারপর অনায়াসে ঢুকে পড়ে—যেমন প্রণয়ীর হাত নারীর শরীর দখল করে।

লঘুপতনক: তা-ই হবে।

তারপর তারা দুজনে পরম আনন্দে দিন কাটাতে লাগল। ইঁদুর গর্তে, কাক গাছে। তাতে কি? মনের মিলটাই আসল। তাই হাসি-ঠাট্টা, সুখ-দুঃখের কথা বলে তাদের দিন কাটতে লাগল। লঘুপতনক দূর-দূরান্ত থেকে মাংসের টুকরো, নৈবেদ্যের অবশেষ রান্নাকরা খাবার ইত্যাদি এনে হিরণ্যককে দেয়। হিরণ্যক চাল, ডাল ইত্যাদি যোগাড় করে রাখে। লঘুপতনক এলে দেয়। এভাবে তাদের বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। এক সময় ইঁদুর গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে, আর কাকও গাছ থেকে নেমে আসে। আসলে— গোপন কথা বলা, সুখ-দুঃখের খবর নেয়া, দান করা, দান গ্রহণ করা, খাওয়া এবং খাওয়ানো এই ছয়টি হলো ভালোবাসার লক্ষণ। এ সংসারে ভালোবাসা ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ দানের ব্যাপার থাকে। দেবতারাও দান না পেলে অভীষ্ট বর দেয় না। দুধ ফুরোলে বাছুর মাকে ত্যাগ করে। খাবার দিলে গাভী সব দুধ দিয়ে দেয় মালিককে, বাছুরের কথা ভাবে না। কাজেই আদান-প্রদান হচ্ছে ভালোবাসার প্রধান কারণ। এই আদান-প্রদানের মাধ্যমেই এক সময় কাক ও ইঁদুর জন্মশত্রুতা ভুলে অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হয়। শুধু তা-ই নয়, ইঁদুর কখনো কখনো কাকের পাখার নিচেও পরম নিশ্চিন্তে আশ্রয় নেয়।

একদিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে লঘুপতনক এসে বলল: ভাই হিরণ্যক, তোমাকে যে আমার ছেড়ে যেতে হবে!

হিরণ্যক: কেন, কি হয়েছে, ভাই?

লঘুপতনক: এই দেশটার প্রতি আমার বিরক্তি ধরে গেছে! অন্য কোথাও যেতে হবে!

হিরণ্যক: খুলে বল না, কি হয়েছে!

লঘুপতনক: প্রচণ্ড খরায় দেশে আকাল পড়েছে! কোথাও খাবার জুটছে না! পশু-পাখির বরাদ্দ খাবরটুকুও কেউ ছড়িয়ে দিচ্ছে না! উচ্ছিষ্ট পর্যন্ত কেউ ফেলছে না! ফেলবে কি করে? মানুষই তো না খেয়ে মরছে! দেখার কেউ নেই! রাজার এ ব্যাপারে কোনো উদ্বেগ নেই! মানুষ খাবার না পেয়ে বাড়ি বাড়ি জাল পাতছে। পাখি ধরার জন্য। আমিই তো প্রায় আটকা পড়েছিলাম। বুদ্ধির জোরে বেঁচে গেছি। জালে আটকা পড়ে দলে দলে পাখি মরছে! এ আমি দেখতে পারব না! তাই, এদেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাচ্ছি! হিরণ্যক: তা কোথায় যাবে?

লঘুপতনক: দাক্ষিণাত্যে এক বিশাল বন আছে। সেখানে।

হিরণ্যক: কিন্তু, সেখানে তোমাকে কে সমাদর করবে?

লঘুপতনক: দেখ, রাজত্ব আর বিদ্বত্ত্ব সমান নয়। রাজা শুধু নিজের দেশেই সমাদর পান। কিন্তু, বিদ্বানের সমাদর সর্বত্র। তাছাড়া, ঐ বনের মধ্যে এক গভীর জলাশয় আছে। সেখানে আমার এক কচ্ছপ-বন্ধু থাকে মন্থরক। সে আমাকে মাছটা—কাঁকড়াটা ধরে দেবে। আমি খাব। দিন চলে যাবে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে হিরণ্যক বলল: বন্ধু, আমাকেও তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও! আমার বড় কষ্ট!

লঘুপতনক: তোমার আবার কষ্ট কিসের?

হিরণ্যক: সে অনেক কথা। ওখানে গিয়েই বলব।

লঘুপতনক: তা-তো বুঝলাম, কিন্তু তুমি যাবে কি করে? আমি তো উড়ে যাব।

কাতর স্বরে হিরণ্যক বলল: তুমি যদি আমার প্রাণের বন্ধু হয়ে থাক, তাহলে তোমার পিঠে করে আমায় নিয়ে চল।

লঘুপতনক মহাখুশিতে ‘কা কা’ রবে বলল: সে তো আমার পরম সৌভাগ্য! তবে আর দেরি কেন? উঠে এসো আমার পিঠে।

হিরণ্যক লঘুপতনকের পিঠে উঠে শক্ত করে ধরে থাকল। আর লঘুপতনক উড়ে চলল মন্থরকের উদ্দেশে। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। আঁধার নামতে কিছু বাকি। এমন সময় তারা গিয়ে পৌঁছল গন্তব্যে। জলাশয়ের তীরে এক গাছের কোটরে হিরণ্যককে রেখে লঘুপতনক ডাক ছাড়ল: বন্ধু মন্থরক, আমি লঘু। একবার উঠে এসো না, ভাই।

দীর্ঘদিন পর বন্ধুর ডাক শুনে মন্থরক চমকে উঠল। বিপদ-টিপদ নয় তো! তাড়াতাড়ি উঠে এসে লঘুপতনককে জড়িয়ে ধরে বলল: কেমন আছ, বন্ধু?

লঘুপতনকও মন্থরককে আলিঙ্গন করে বলল: মনটা বড়ই উতলা ছিল। তোমার স্পর্শে শান্ত হলো। দেখ, লোকে শরীরের দাহ কমাতে কর্পূরমাখা চন্দন মাখে, কিন্তু তোমার মতো বন্ধু থাকলে তার আর চন্দনে কি প্রয়োজন? বন্ধুর আলিঙ্গনই যথেষ্ট।

এমনি সময় হিরণ্যক কোটর থেকে বেরিয়ে এসে লঘুপতনকের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তা দেখে মন্থরক বলল: ভাই, এ ইঁদুরটি কে? এ তো তোমার খাদ্য?

লঘুপতনক: না, ভাই। এ এক অসাধারণ গুণী ব্যক্তি। মাথার চুল, বৃষ্টির ধারা কিংবা আকাশের তারা যেমন গোণা যায় না, এর গুণের কথাও তেমনি বলে শেষ করা যায় না। তাই তো, এ-ও তোমার মতো আমার এক পরম বন্ধু। এর বিশাল রাজত্ব আছে। কিন্তু, মনে বড় কষ্ট। তাই সব ছেড়ে চলে এসেছে।

মন্থরক: কিসের কষ্ট?

লঘুপতনক: জানতে চেয়েছিলাম। বলল, এখানে এসে বলবে।

মন্থরক: তা-ই হবে। তবে রাত হয়ে এল। এবার আমি যাই। কাল শুনব। লঘুপতনক ও হিরণ্যক: তথাস্তু।

হিরণ্যকের আত্মকথা

পরদিন সকালে লঘুপতনক, মন্থরক ও হিরণ্যক একত্র মিলিত হয়েছে। মন্থরক হিরণ্যককে বলল: তা তোমার কাহিনী বলো, ভাই, শুনি।

লঘুপতনক সাগ্রহে বলল: হ্যাঁ বন্ধু, এতদিনতো আমাকেও বলোনি। আজ বলো, আমরা শুনি।

হিরণ্যক বলতে লাগল: দাক্ষিণাত্যে মহিলারোপ্য নামে এক নগর ছিল। তার অদূরেই ছিল এক শিবমন্দির। সেখানে থাকতেন তাম্রচূড় নামে এক পরিব্রাজক। নগরে ভিক্ষে করে তাঁর জীবন কাটত। খেয়েদেয়ে যা অবশেষ থাকত, তা তিনি নাগদন্তে ঝুলিয়ে রাখতেন। পরের দিন ভোরে চাকর-বাকরদের সেই খাবার দিতেন। বিনিময়ে তারা মন্দির ধুয়ে-মুছে দিত।

একদিন আমার লোকেরা এসে বলল: কত্তা, আমরা যে না খেয়ে মারা যাচ্ছি গো! একটা কিছু করুন!

জানতে চাইলে তারা বলল: মন্দিরের খাবারগুলো বেটা এত উঁচুতে ঝোলায় যে, আমাদের নাগালের বাইরে। কিছুতেই ওখানে পৌঁছুতে পারি না। কিন্তু, কত্তা যেতে পারেন না এমন জায়গা নেই। তাই একটা ব্যবস্থা করুন।

এ-কথা শোনার পর আমি তাদের নিয়ে সেখানে গেলাম। এক লাফে নাগদন্তে উঠে একে একে সবাইকে উঠালাম। তারপর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চলে এলাম। এভাবে দিন চলতে লাগল। আমাদের তাড়ানোর জন্য তাম্রচূড় এক সময় পাহারা দিতে শুরু করেন। কিন্তু পাহারা দিতে দিতে যখন ঘুমে ঢলে পড়তেন, সেই ফাঁকে আমরা সব সাবার করে আসতাম।

কিন্তু একদিন বিপত্তি ঘটল। তাম্রচূড় একটা ফাটাবাঁশ এনে শুয়ে শুয়ে ঐ ঝুলন্ত ভিক্ষাপাত্রটা পেটাতে লাগলেন। ভয়ে আমরা আর কাছেই যেতে পারলাম না। এভাবে দিন যেতে লাগল। একদিন মন্দিরে এলেন তাম্রচূড়ের বন্ধু বৃহৎস্কিক। তিনিও পরিব্রাজক। ধার্মিক। তীর্থভ্রমণে বের হয়ে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

বন্ধুকে পেয়ে তাম্রচূড়তো মহাখুশি। সসম্মানে দাঁড়িয়ে অতিথিকে গ্রহণ করলেন। রাতের বেলা কুশাসনে শুয়ে দু-বন্ধু আলাপচারিতায় মগ্ন। বৃহৎস্কিক কতরকম গল্প করছেন। ধর্মের কথা। পাপ-পুণ্যের কথা। আরো কত কি। কিন্তু তাম্রচূড় কেবল ফাটাবাশ দিয়ে ভিক্ষাপাত্র পেটাচ্ছেন, আর মাঝে-মধ্যে হুঁ-হাঁ করছেন। কোনো কথা বলছেন না। তাঁর মন সম্পূর্ণ ঐদিকে।

খানিক পরে অতিথি চটে লাল! তিনি তাম্রচূড়কে বললেন: আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি আসল বন্ধু নও। আমি আসায় তুমি খুশি হওনি। দেখ, প্রকৃত বন্ধু বন্ধুকে পেলে সাগ্রহে বলে— আরে! এস এস। বস। বিশ্রাম নাও। কদ্দিন পরে এলে। খবর কি? কেমন আছ? বড় রোগা হয়ে গেছ। বেশ কিছুদিন থাকবে এবার। ইত্যাদি। কিন্তু বাড়িতে অতিথি এলে গৃহস্থ যদি কেবল উপরে আর নিচের দিকে তাকায়, কিংবা মিষ্টিমুখে পাঁচটি কথা না বলে, তাহলে তার বাড়িতে মূর্খ ছাড়া আর কে যায়? আর তোমার এত গর্বই বা কিসের? সবেধন তো এই মঠটি। তাতেই এত গর্ব! জাননা, পণ্ডিতেরা বলেছেন—নরকে যেতে চাওতো বছরখানেক যজমানি কর, কিংবা দিনতিনেক মোহন্তগিরি। তুমিও দেখছি সেই পথেই এগুচ্ছ। কাজেই আমি চললুম। এই রাতেই। তোমার এখানে আর নয়।

এই বলে বৃহৎস্ফিক উঠে দাঁড়ালেন। তাম্রচূড় তাঁর হাত ধরে মিনতি করে বললেন: বন্ধু, আমায় ভুল বুঝনা। একটা ভয়ানক ইঁদুর বড্ড জ্বালাচ্ছে। ও দলবল নিয়ে এসে শিকেয় তোলা ঐ ভিক্ষান্ন সব খেয়ে যায়। পরের দিন চাকর-বাকরদের কিছু দিতে পারি না। তাই মন্দির ধোয়া-মোছার কাজও বন্ধ। ওকে তাড়ানোর জন্যই এ ব্যবস্থা। অন্য কিছু নয়।

ঘটনা শুনে বৃহৎস্কিক শান্ত হলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন: ইঁদুরটা কোথায় থাকে?

তাম্রচূড়: ঠিক জানি না।

একটু চিন্তা করে বৃহৎস্কিক বললেন: নিশ্চয়ই ওর গর্তটা কোনো গুপ্তধনের উপর। কারণ, টাকার গরম ছাড়া এত লম্ফ-ঝম্প করা যায় না। কথায় বলেনা—

ট্যাকে যদি থাকে টাকা, তাতেই বাড়ে জোর।
দান-ধ্যান করলে আর, কথা কি-বা ওরা।।

তবে দানের উদ্দেশ্য অসৎ হলে ধরা পড়তে হয়, যেমন পড়েছিল ব্রাহ্মণী।

তাম্রচূড় উৎসাহের সঙ্গে বলল: সে কেমন?

বৃহৎস্ফিক: শোনো তাহলে …

ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী

এক গাঁয়ে থাকতেন এক ব্রাহ্মণ দম্পতি। কোনরকমে দিন কাটছিল। বর্ষাকালের এক সকাল। ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণীকে বললেন: আজ দক্ষিণায়ন সংক্রান্তি। খুব প্রশস্ত দিন। এই দিনে দান-ধ্যান করলে অনন্ত পুণ্য হয়। তাই আমি দান নিতে ভিন গাঁয়ে যাচ্ছি। তুমি ভগবান সূর্যের নামে একজন ব্রাহ্মণকে ডেকে কিছু খাইয়ে দিও।

সঙ্গে-সঙ্গে ক্রুদ্ধ ফণিনীর ন্যায় ফোঁস-ফোঁস করে ব্রাহ্মণী বলে উঠলেন: টাকা নেই, পয়সা নেই, ব্রাহ্মণ খাওয়াব! বলতে লজ্জা লাগে না? তোমার হাতে পড়ে আমার জীবনটাই মাটি হয়ে গেল! না পেলুম একটু সুখ! না পেলুম একটু মিষ্টি-মাষ্টা চাটতে! গয়না পরার বায়না? সে আর বলতে মন চায়না!

ব্রাহ্মণ মনে একটু কষ্ট পেলেও ধীরে-ধীরে বললেন: এরকম বলতে নেই, গিন্নি। দেখ ঘরভর্তি টাকা না থাকলেই কি এক মুষ্টি অন্ন কাউকে দেয়া যায় না? শাস্ত্র বলছে না—বড়লোকেরা কাড়িকাড়ি দান করে যে ফল পায়, গরিবকে এক কড়ি দিলেই সে-ফল পাওয়া যায়। তাইতো, কৃপণ যতই ধনী হোক তার কাছে কেউ যায় না, যায় দাতার কাছেই। তাছাড়া দেখ—

মিঠেজলের কুয়ো সে যতই ছোট হোক
তার কাছেই ছুটে যায় গাঁয়ের সর্বলোক।
সমুদ্র সে অনন্ত যার নাহি সীমারেখা
তৃষ্ণা পেলে তার কাছে পাও কারো দেখা??

আরো দেখ— কুবেরের অঢেল সম্পদ। কোনো দান-ধ্যান করেনি। আজীবন আগলে রেখেছে। কিন্তু, কেউ কি তার কথা বলে? অথচ শিব? নির্ধন। তবুও তাঁকেই সবাই মহেশ্বর বলে। কাজেই দান করতে বেশি ধন লাগেনা। তোমার যা আছে, তা দিয়েই অতিথিসেবা কর।

ব্রাহ্মণের কথায় ব্রাহ্মণী শান্ত হলেন। মনে মনে ভাবলেন—ঘরে কিছু তিল আছে। তা দিয়েই ব্রাহ্মণসেবা করবেন।

ইতোমধ্যে ব্রাহ্মণ গাঁয়ে চলে গেছেন। ব্রাহ্মণী ঐরূপ চিন্তা করতে করতে ঘরে ঢুকলেন। পাত্র থেকে তিলগুলো বের করে খোসা ছাড়িয়ে রোদে দিলেন। কিছুক্ষণ পরে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দেখেন—একটি কুকুর তাতে মূত্রপাত করছে। বৈশাখী রোদের মতো ব্রাহ্মণীর মেজাজ গেল চড়ে। তিনি খিস্তি মেরে বললেন: হায়রে কুত্তার পো! মরার আর জায়গা পেলি না!

ব্রাহ্মণী রান্নাঘরের দাওয়ায় ধপাস করে বসে পড়লেন। রাগে-দুঃখে কিছুক্ষণ তিনি কথাই বলতে পারলেন না। হঠাৎ মাথায় এক দুষ্টবুদ্ধি এল। তিনি ভাবলেন: পাশের বাড়ি গিয়ে কোটা তিলের পরিবর্তে যদি গোটা তিল আনি, তাহলে আমার তিনগুণ লাভ। মূত্রদুষ্ট তিল এমনিতেই ফেলে দিতে হতো, কারণ এতে ব্রাহ্মণসেবা হবেনা। আর কোটা তিলের পরিবর্তে গোটা তিল পাব বেশি। অর্ধেক রেখে দেব। বাকি অর্ধেকে ব্রাহ্মণসেবা হবে।

এরূপ চিন্তা করে ব্রাহ্মণী তিলগুলো ধুয়ে-মুছে পাশের বাড়ি নিয়ে গেলেন। হাঁক দিয়ে বললেন: কই গো দিদি, গোটা তিল দিয়ে কোটা তিল নেবে? তাহলে এস।

গিন্নিমা ভাবলেন গোটা তিল দিয়ে যদি কোটা তিল পাওয়া যায় তাহলে মন্দ কি? তিনি উত্তর দিলেন: একটু বস, বামুনদিদি। আমি আসছি।

এদিকে গিন্নিমা’র কামন্দকী শাস্ত্রপড়া পুত্র ভাবল: কোটা তিল দিয়ে গোটা তিল নিচ্ছে, এর কারণ কি? নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো রহস্য আছে। সে মাকে সাবধান করে বলল: মা, কোটা তিল দিয়ে কেউ গোটা তিল নেয় না। নিলে, শাস্ত্রমতে এক্ষেত্রে রহস্যদোষ আছে। তুমি হাত বাড়িও না। আমি দেখছি।

এই বলে ব্রাহ্মণীর দিকে এগোতে থাকলে তিনি সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু, ধরা পড়ে সব স্বীকার করলে বিচারে তাঁদের গ্রামছাড়া করা হয়। আসলে, অতিলোভীর এভাবেই মরণ হয়, যেমন হয়েছিল লোভী শেয়ালের।

তাম্রচূড়: সে আবার কি?

বৃহৎস্ফিক: শুনবে? শোনো তাহলে …

অদ্যভক্ষ্য ধনুর্গুণ

এক গাঁয়ে থাকত এক ব্যাধ। একদিন সে শিকারে গেল। সেখানে একটা হরিণ শিকার করল। হরিণটাকে কাঁধে নিয়ে ফেরার পথে এক নাদুস-নুদুস শূকর দেখতে পেল। তাড়াতাড়ি হরিণটাকে ফেলে শূকরটাকে তাক করল। তীর খেয়ে শূকরটাও ঘোঁৎ-ঘোৎ করতে করতে ছুটে এল ব্যাধের দিকে। দুজনে ধস্তাধস্তি হলো। এক পর্যায়ে শূকরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এদিকে সাপের লেজে পা পড়তেই দুটি বিষদাঁত বসে গেল ব্যাধের পায়ে। সঙ্গে-সঙ্গে সাপটাকে ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলল। কিন্তু ব্যাধ আর বাঁচল না। কিছুক্ষণ মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করে সেও অক্কা পেল।

এমনি সময় খাবারের সন্ধানে সেখানে এল এক শেয়াল। কদিন ধরে না খাওয়া। পেটের হাঁড়-কখানা গোনা যায়। একসঙ্গে এত খাবার দেখে তার মাথা গেল ঘুরে। সে একবার হরিণটার কাছে যায়। আবার ছুটে আসে শূকরটার কাছে। ব্যাধের নাকটাও শুঁকে দেখে। ফাঁকে সাপের তাজা রক্ত একটু চেটে নেয়। আঃ! এখনও গরম! এরপর যায় ব্যাধের ধনুকের কাছে। ওর গুণটা স্নায়ুর তৈরি। একটু কামড় দিয়ে দেখে। না, খাওয়া চলবে। এবার সে হিসাব করে। শূকরে যাবে একমাস। ব্যাধে যাবে এক পক্ষ। হরিণটায় অর্ধপক্ষ তো যাবেই। সাপে একদিন যাবে। একটু রয়ে-সয়ে খেতে হবে। পণ্ডিতেরা বলেন না— স্বোপার্জিত ধন টনিকের ন্যায় একটু একটু করে ভোগ করতে হয়। তাই আজ ধনুর্গুণ দিয়েই শুরু করি।

এই বলে যেই ধনুকের গুণে কামড় দিয়েছে, অমনি তা ছিঁড়ে যাওয়ায় ধনুকের বাঁশ সোজা হয়ে একেবারে ব্রহ্মতালু ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ছটফট করতে করতে ওখানেই শেয়ালের মৃত্যু হয়।

বৃহৎস্কিক তাম্রচূড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন: তাই বলছিলুম— অতিলোভ করতে নেই। কিছুক্ষণ পরে তাম্রচূড়ের কাছে জানতে চাইলেন: আচ্ছা, ইঁদুরটা থাকে কোথায়? ওর যাতায়াতের রাস্তাটাই বা কি?

তাম্রচূড়: তা তো জানি না। তবে দলবল নিয়ে আসে, আবার দলবল নিয়ে চলে যায়।

বৃহৎস্ফিক: হুঁ। যাক গে। তা তোমার কি শাবল-টাবল কিছু আছে?

তাম্রচূড়: আছে। ঐ তো, আগা-গোড়া লোহার।

বৃহৎস্কিক: বেশ। ওটা কাজে লাগবে। কাল কাকভোরে উঠে লোকজনের চলাফেরায় মাটির দাগ মুছে যাওয়ার আগেই আমরা ওদের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে পৌঁছে যাব ওর ডেরায়। তারপর ওর সব কেরামতি শেষ।

এসব বলতে বলতে হিরণ্যকের গলাটা একটু ধরে এল। দম নিয়ে লঘুপতনকের দিকে তাকিয়ে সে বলতে শুরু করল: বিশ্বাস কর, বন্ধু! ও বেটার কথা শুনে আমার পিলে গেল চমকে! ভাবলুম, আর বুঝি রক্ষে নেই। বুদ্ধির জোরে এ যখন টাকার খবরটাই জেনে গেছে, তখন আমার দুর্গও সে খুঁজে বের করবে! ওর কথা শুনেই আমি বুঝতে পেরেছি! মানুষ চিনতে আমার ভুল হয়না! দক্ষ ব্যক্তি হাতে ধরেই বস্তুর ওজন নিতে পারে!

একটু দম নিয়ে হিরণ্যক আবার শুরু করল: আমিও কম নই। দল চালাতে হলে নানা রকম বুদ্ধি রাখতে হয়। আমি দুর্গের পথ ছেড়ে অন্যপথে দল নিয়ে ছুটতে লাগলাম। কিন্তু বিধি বাম! ব্যাধের জাল ছিঁড়ে তীর এড়িয়ে হরিণ বাঘের মুখে পড়লে যে অবস্থা হয়, আমাদেরও যেন সেই অবস্থা হলো। হঠাৎ সামনে পড়ল এক প্রকাণ্ড বেড়াল। মুহূর্তে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল আমাদের উপর। অনেককে মারল, অনেককে আহত করল। বাকিরা আমায় ভুল বুঝল। ইচ্ছে করেই আমি তাদের ভুলপথে এনেছি এই অভিযোগ দিয়ে রক্তমাখা পায়ে তারা দুর্গের পথে ছুটল। আমার কথা শুনল না। ফলে যা হবার তা-ই হলো। ঐ দুষ্ট পরিব্রাজক ফোঁটা-ফোঁটা রক্তমাখা পায়ের দাগ অনুসরণ করে ঠিক দুর্গে গিয়ে পৌঁছে গেল। তারপর শাবল দিয়ে খুঁড়ে টাকার ভাণ্ডটা নিয়ে দুজনে মন্দিরে চলে গেল। এতদিন যার গরমে আমি অসাধ্য সাধন করতাম, আমার সে শক্তি শেষ হয়ে গেল। কিছুদিন পরে দুর্গে ফিরে গেলাম। সেই ধ্বংসযজ্ঞ দেখে আর ভাল লাগল না। কয়েকদিন কষ্টে-শিষ্টে কাটালাম। তারপর এক রাতে দলবল নিয়ে গেলাম মন্দিরে। বুক ধড়ফড় করছে! গিয়ে দেখি দুজনে বসে গল্প করছে। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েই তাম্রচূড় ভিক্ষাপাত্রটা পেটাতে শুরু করলেন। বৃহৎস্ফিক বললেন: কি হলো?

তাম্রচূড়: ঐ পাজিটা আবার এসেছে।

বৃহৎস্ফিক হেসে বললেন: বন্ধু, ও আর লাফাবে না। ওর কেরামতি শেষ। যার জোরে লাফাত, তাতো এখন তোমার বালিশের নিচে।

হিরণ্যক: ওদের ঐ মস্করা শুনে আমার পিত্তি গেল জ্বলে! আমি আর ধৈর্য ধারণ করতে পারলাম না। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দিলাম লাফ। কিন্তু, না! পারলাম না! ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলাম। তা দেখে ওরা হো-হো করে হাসতে লাগল। আমার বড় শত্রুটা তাম্রচূড়কে বললেন: দেখলে তো মজাটা! ওর লম্ফ-ঝম্প সব শেষ! বলেছি না—টাকাই সব। টাকা থাকলেই শক্তিমান, টাকা থাকলেই পণ্ডিত। টাকা নেই তো সব সমান। ইঁদুরটাও তাই এখন অন্যদের সমান হয়ে গেছে। এবার তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। কথায় বলে না—

দাঁতহীন সাপ আর মদহীন হাতি।
অর্থহীন পুরুষ খায় সকলের লাথি॥

বৃহৎস্ফিকের কথা শুনে আমারও তখন মনে হতে লাগল, সত্যিই তো! অর্থহীন পুরুষের জীবনের দাম কি? গরমকালে ছোট নদী যেমন শুকিয়ে যায়, অর্থহীন পুরুষের সকল গুণও তেমনি নষ্ট হয়ে যায়। দরিদ্রের গুণ থাকলেও তা প্রকাশ পায় না। সূর্য যেমন জগৎকে প্রকাশ করে, অর্থও তেমনি মানুষের সকল গুণ প্রকাশ করে। যে গরিব হয়েই জন্মায়, তার তেমন কষ্ট থাকে না। কিন্তু একবার যার প্রচুর ধন ছিল, দারিদ্র্য তার কাছে অত্যন্ত কষ্টদায়ক। সমাজে দরিদ্রের কোনো স্থান নেই। সবাই তাকে সন্দেহের চোখে দেখে। সে কারো উপকার করতে গেলেও কেউ আমল দেয় না। উঠে চলে যায়। ভাবে, কিছু চাইতে এসেছে। দরিদ্রের কোনো বন্ধু থাকে না। বন্ধুও শত্রু হয়ে যায়। আত্মীয়রা পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। বিধবার স্তনযুগলের মতো গরিবের বুকে কত স্বপ্নই জাগে! কিন্তু তা বুকেই মিলিয়ে যায়। দারিদ্র্যের অন্ধকারে যে আচ্ছন্ন, পরিপূর্ণ দিবালোকেও কেউ তাকে দেখতে পায় না। এসব ভাবতে ভাবতে দেখলাম, তাম্রচূড় টাকার থলেরাখা বালিশটায় গালটা লাগিয়ে শুয়ে পড়ল। কয়েকদিন আগেও আমি যার উপর বসে থাকতাম। তারপর এক সময় শূন্য দুর্গে ফিরে এলাম। কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি যে, শেষ আঘাতটা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।

একথা বলতে বলতে হিরণ্যকের কণ্ঠ আবার রুদ্ধ হয়ে এল। কাক আর কচ্ছপের হৃদয় করুণায় গলে যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে হিরণ্যক আবার বলল: আমি দুর্গের কাছে যেতেই দেখি আমার ভৃত্যরা সব চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলাবলি করছে—যার ভরণ-পোষণ দেয়ার মুরোদ নেই, তার সঙ্গে থেকে লাভ কি? তাতে শুধু বিপদই বাড়ে। আমি তখন একেবারেই একা। এতদিন যাদের আহার যুগিয়েছি, তারা কেউ আর পাশে রইল না! ভাবলাম—ধিক্ এই দারিদ্র্যকে। এ জীবন দিয়ে কি হবে? কথায় বলে না—যে শ্রাদ্ধে বৈদিক ব্রাহ্মণ আসে না, সে শ্রাদ্ধ মৃত। যে মিলনে সন্তান হয় না, সে মিলন মৃত। যে যজ্ঞে দক্ষিণা নেই, সে যজ্ঞ মৃত। আর যার ধন-দৌলত নেই, সে জীবত। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে হিরণ্যক বলতে লাগল: কষ্টের এখানেই শেষ নয়! দেখি, আমার চোখের সামনে দিয়ে আমার ভৃত্যরা আমার শত্রুর সেবক হয়ে গেল। শুধু তা-ই নয়, আমার দিকে মুচকি মুচকি হেসে আমাকেই টিটকারি মারতে লাগল। আমি আর সইতে পারলাম না। দুর্গে ঢুকে কপাট মেরে পড়ে রইলাম। এভাবে অনাহারে অনিদ্রায় কয়েকদিন কাটল। তারপর একদিন ভাবলাম: আমার ধন চুরি করে অন্যে ধনী হবে, সম্মান পাবে, আর আমি অপমানিত হব এ হয় না। চুরি যাওয়া ধন উদ্ধারে যদি আমার প্রাণও যায় তা-ও ভাল। শাস্ত্রে আছে—চুরি যাওয়া ধন উদ্ধার না করে যে নিজের প্রাণটি রক্ষা করে, তার দেয়া জলাঞ্জলি পিতৃপুরুষও গ্রহণ করেন না। তাছাড়া, যে গোরক্ষায়, ব্রাহ্মণ রক্ষায়, স্ত্রীরক্ষায়, বিত্তরক্ষায় কিংবা যুদ্ধে প্রাণ দেয়, সে শাশ্বত স্বর্গ লাভ করে। তাই সিদ্ধান্ত নিলুম—যা আছে কপালে, আমার ধন আমার চাই-ই। ও বেটা ঘুমুলে চুপি-চুপি বালিশ কেটে টাকার থলেটা নিয়ে ভাগব। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একদিন রাতে গিয়ে কুট-কুট করে বালিশ কাটছি। অমনি বেটা জেগে উঠল। ফাটাবাশ দিয়ে মারল এক বাড়ি। মাথাটা আমার ফেটে গেল। নেহাৎ আয়ুর জোরে বেঁচে গেলাম। কোনরকমে দুর্গে ফিরে ভাবলাম, পণ্ডিতেরা ঠিকই বলেছেন—

যার যা পাবার পাবেই সে তা।
কাহার সাধ্য ঠেকাইবে তা।।
গ্রন্থ কিনে বণিকপুত্র।
ঘরছাড়া হয় বলামাত্ৰ।।
ভাগ্যগুণে, শোনো কথা—
হয়ে গেলো রাজ-জামাতা॥

কাক ও কচ্ছপ পরম উৎসাহে বলল: তার মানে?

হিরণ্যক: শোনো তাহলে…

বণিকপুত্র ও রাজকন্যা

এক নগরে থাকত এক বণিক। নাম সাগরদত্ত। তার একমাত্র পুত্র ছিল বিদ্যোৎসাহী ও চরিত্রবান। সারাক্ষণ বই নিয়েই পড়ে থাকত। কিন্তু, বণিকের এটা পছন্দ নয়। বণিকপুত্র বণিক হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, পুত্র তার ধার দিয়েও যায় না। তাই বণিকের মনে অনেক দুঃখ!

একদিন পুত্র একখানা বই কিনে আনল। বণিক দাম জানতে চাইলে বলল—একশ টাকা।

বণিকের তো মাথায় হাত! একশ টাকা! একখানা বইয়ের দাম! তা তুই কিনলি? হায়! হায় রে! তুই আমার সর্বনাশ করে ছাড়বি রে! আমি এখন কি করি? তোকে কি করে বোঝাই যে, বস্তা-বস্তা বই গিললেও পেটের কোণাটুকুও ভরে না!

বণিকের চিৎকারে বাড়িটা যেন ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো। বণিক চিৎকার করে বলেই চলেছে—এই বুদ্ধি নিয়ে তুই কি করে টাকা রোজগার করবি? এর চেয়ে আমার অপুত্রক থাকাও ঢের ভাল ছিল! যা, এক্ষুণি আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা। আর কোনদিন এ বাড়িতে ঢুকবি না! বণিকপুত্র কিছু না বলে রাগে-দুঃখে তৎক্ষণাৎ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। সঙ্গে নিল সেই বইখানা।

ঐ বইতে একটি সংস্কৃত শ্লোক ছিল। তার প্রথম লাইনটি ‘প্রাপ্তব্যমর্থং লভেত মনুষ্যঃ’—অর্থাৎ, মানুষ তার প্রাপ্য বস্তু পাবেই। বণিকপুত্র শুধু এই লাইনটিই বলত আর নগরময় ঘুরে বেড়াত। লোকে তাই তাকে ‘প্রাপ্তব্যমর্থং’ বলে ডাকত। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে সে এক ভিন রাজ্যে চলে গেল। সেখানেও সে এই নামেই পরিচিত হলো।

এদিকে বসন্তের এক দিনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মদনমহোৎসব। হাজার লোকের সমাগম রাজকন্যা চন্দ্রাবতীও এসেছে উৎসব দেখতে। পূর্ণযৌবনা। সৌন্দর্যের তুলনা হয়, পৃথিবীতে এমন কিছু নেই। হাতির পিঠে চড়ে সখীর সঙ্গে উৎসব দেখছে। হঠাৎ রাজপুত্রের ন্যায় এক যুবক দেখে চন্দ্রাবতী কামশরে বিদ্ধ হলো। সখীকে বলল—হয় আজ রাতেই ওর সঙ্গে আমার মিলন ঘটাও, নইলে চিতা সাজাও। সখী আর কি করবে? নেমে গিয়ে যুবকের পরিচয় নিল। নগরেই বাস। সামান্য ভূমিকার পর রাজকন্যার অভিলাষের কথা তাকে জানাল। এবং বলল চন্দ্রাবতীর প্রাসাদ থেকে একটা দড়ি ঝোলানো থাকবে। সেটা বেয়ে সোজা তার ঘরে চলে যেও।

যুবক প্রথমে একটু ইতস্তত করছিল। কিন্তু সখীর অনুরোধে রাজি হলো। সখী ফিরে গিয়ে রাজকন্যাকে আশ্বস্ত করল। এবং মনের আনন্দে মদনোৎসব দেখে দুজন প্রাসাদে ফিরে গেল।

চন্দ্রাবতীর মনে হচ্ছে, যুগ যেন কয়েকটা চলে গেল, অথচ রাত আর আসছে না। আসলে অপেক্ষার সময় এবং কালরাত শেষ হতে চায় না। যা হোক, অনেক অপেক্ষার পর সেই কাঙ্ক্ষিত সময় ঘনিয়ে এল। রাজকন্যা সেজে-গুজে জানালার ধারে বসে আছে কখন দড়িতে টান পড়ে। কিন্তু, না! কেউ এল না! প্রহরের পর প্রহর যায়। দড়িতে টান আর পড়ে না। কারণ, যুবক ভাবছে—কাজটা ঠিক হবে না। সে শিক্ষিত। শাস্ত্ৰ জানে। গুরুকন্যা, মিত্রভার্যা, প্রভুকন্যা কিংবা ভৃত্যপত্নীতে যে উপগত হয়, লোকে তাকে ব্রহ্মঘাতী বলে। এই ভেবে যুবক নিরস্ত হয়।

এদিকে বণিকপুত্র ঘুরতে ঘুরতে ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল। প্রাসাদ থেকে দড়ি ঝোলানো দেখে তার কৌতূহল হয়। সে দড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর রাজকন্যার তন্দ্রার মতো এসেছিল। কিন্তু বণিকপুত্রের ঘরে ঢোকার শব্দে তার তন্দ্রা কেটে যায়। সে ভাবে, তার প্রাণবল্লভই এসেছে। তাই অন্ধকারে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে অনুযোগের সুরে বলে: আমি তোমার জন্য প্রাণে মরে যাচ্ছি! আর তুমি এত দেরি করে এসেও চুপ করে আছ? কথা বল, প্ৰাণনাথ!

বণিকপুত্র ঘটনার আকস্মিকতায় কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তাই সে বলে উঠল: প্রাপ্তব্যমর্থং লভেত মনুষ্যঃ। রাজকন্যা বুঝল—এ-তো সে নয়। তাই দ্রুত সরে এল। এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় উভয়েই লজ্জিত হলো। পরে রাজকন্যার কথামতো বণিকপুত্র সেই দড়ি বেয়ে নেমে অদূরবর্তী একটা মন্দিরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

কিন্তু এখানেও বিড়ম্বনা। নগরের চৌকিদার গোপন অভিসারে এসে দেখে, কে যেন শুয়ে আছে। তাই অভিসারের কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে একে সরানোর উদ্দেশ্যে সে বলল: কে তুমি? এত রাতে কি চাও এখানে?

বণিকপুত্র বলল: প্রাপ্তব্যমৰ্থং লভেত মনুষ্যঃ।

চৌকিদার ভাবল, প্রেয়সী এখনই চলে আসবে। তাই এর সঙ্গে বেশি কথা বলার সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একে সরিয়ে দিলেই মঙ্গল। তাই সে নরম গলায় বলল: ভাই, এ মন্দির জনশূন্য। নিরাপদ নয়। পাশেই আমার বাড়ি। তুমি সেখানে গিয়ে নির্ভয়ে ঘুমাও।

বণিকপুত্র আর কি করবে। বিদেশ-বিভূঁই। যে যা বলে তা-ই শুনতে হয়। তাই উঠে চলে গেল চৌকিদারের বাড়িতে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোনরকমে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই এক নারীকণ্ঠ বলে উঠল: এসেছ, নাথ! কেউ দেখেনি তো?

বণিকপুত্র তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারল না। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হতবিহ্বল। কণ্ঠটি আসলে চৌকিদারের ষোড়শী কন্যা বিনয়াবতীর। প্রেমিকের অপেক্ষায় ছিল। সে-ছাড়া এই রাতে এই অন্ধকারে আর কে আসবে? বাবা তো কর্তব্যরত। তাই হাত ধরে টানতে টানতে আবার প্রশ্ন: কথা বলছ না কেন?

বণিকপুত্রের কথা একটাই: প্রাপ্তব্যমর্থং লভেত মনুষ্যঃ।

অপরিচিত কণ্ঠে এই দুর্বোধ্য বাক্য শুনে বিনয়াবতী কিংকর্তব্যবিমূঢ়। লজ্জা, ভয় সব কিছু একত্র হয়ে তাকে কাবু করে ফেলল। ঝটকা মেরে দূরে সরে গিয়ে সে বলল: কে আপনি?

বণিকপুত্র: সে পরিচয়ে কাজ নেই। আমি যেমন এসেছি তেমনই চলে যাচ্ছি। অন্ধকার আমাদের উভয়ের বন্ধু। ভালোবাসায় কোনো পাপ নেই। তবে সাবধানতাও দরকার। এই বলে বণিকপুত্র রাস্তায় নেমে ধীরপায়ে হাটতে লাগল। জোরে হেটে কোথায় যাবে? জানা নেই। হঠাৎ দেখে, বাদ্য-বাজনাসহ বর যাচ্ছে বিয়ে করতে। বণিকপুত্র ভিড়ে গেল তাদের দলে। গান-বাজনা। আতশবাজি। হৈ-চৈ। মজাই আলাদা। সব কষ্ট ভুলে সে-ও মহানন্দে হেটে চলল। দেখতে দেখতে কনের বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেল তারা। এ যে-সে কন্যা নয়। শ্রেষ্ঠিকন্যা। রাজ্যের সব অলঙ্কার পরে যেন ডানাকাটা পরিটি বসে আছে স্বর্ণাসনে। চতুষ্পার্শ্বে সখীরা। তার রূপে লজ্জা পেয়েই চন্দ্রমা যেন লুকিয়েছে। তাই ধরায় এত অন্ধকার।

হঠাৎ চিৎকার চেচামেচি! দিক-বিদিক ছোটাছুটি! মরলাম গো! বাঁচাও গো! কে কোথায় আছ! এসবের কারণ বরের হাতিটি। মাতাল হয়ে মাহুতকে মেরে সব দলে-মলে ছুটছে। বরসহ যে যেদিকে পারে পালিয়ে বেঁচেছে। কনেটি কচি কলাপাতার মতো ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। কেউ তার কাছে নেই। বণিকপুত্র দৌড়ে গিয়ে অভয় দিল: আমি আছি। এই বলে সে হাতিটাকে কৌশলে অন্যদিকে নিয়ে গেল। তারপর সব শান্ত। সূর্যদেব চোখ মেলেছেন। একে একে সবাই ফিরে এল। ভোরের আলোযে সবাই দেখল শ্রেষ্ঠিকন্যা পরম নিশ্চিন্তে বণিকপুত্রের পাশে বসা। বর শ্রেষ্ঠীকে অনুযোগ করে বলল: শ্বশুরমশাই, এ কি করে হলো? আমি যে বেদখল হয়ে গেলাম!

শ্রেষ্ঠী: হাতির ভয়ে তুমিও পালিয়েছিলে, আমিও পালিয়েছিলাম। তুমিও ফিরেছ, আমিও ফিরেছি। তাই আমি কি করে জানব?

শ্রেষ্ঠিকন্যা এবার ক্রুদ্ধস্বরে বলল: ইনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। তাই ইনি ছাড়া আর কেউ আমার পাণিগ্রহণ করতে পারবে না।

এ নিয়ে বচসা শুরু হলো। জলের ঢেউয়ের মতো একথা কানে-কানে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই ছুটে এল স্বচক্ষে দেখার জন্য। চৌকিদার এল। চৌকিদারের মেয়ে এল। রাজকন্যা এল। এমনকি রাজাও এলেন। তিনি বণিকপুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমিই খুলে বল, কি হয়েছে?

বণিকপুত্র নির্বিকারভাবে বলল: প্রাপ্তব্যমর্থং লভেত মনুষ্যঃ। একথা শুনে চৌকিদার, চৌকিদারের মেয়ে এবং রাজকন্যা তিনজনই আঁতকে উঠল। মনে মনে বলল: এ-ই তাহলে সেই! কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলল না।

রাজা তাকে অভয় দিয়ে বললেন: তুমি নির্ভয়ে সত্যি কথা বল।

বণিকপুত্র তখন বই কেনা থেকে শুরু করে শ্রেষ্ঠিকন্যা উদ্ধার পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। রাজা একে একে রাজকন্যা, চৌকিদার এবং তার মেয়েকে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। সবাই স্বীকার করল। রাজা বণিকপুত্রের সততা, সাহস এবং বিদ্যানুরাগের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হলেন এবং ঐ জনসমাবেশেই ঘোষণা দিলেন রাজকন্যার সঙ্গে তার বিয়ে হবে। একই সঙ্গে মৃতদার চৌকিদারের সঙ্গে তার প্রেয়সী, তার মেয়ে বিনয়াবতীর সঙ্গে তার প্রেমিক এবং শ্রেষ্ঠিকন্যার সঙ্গে উক্ত বরের বিবাহের ও অনুমতি দিলেন। তারপর শুভ দিনক্ষণ দেখে বণিকপুত্রের সঙ্গে চন্দ্রাবতীর মহাধুমধামে বিবাহ হলো। রাজা তাকে অর্ধেক রাজ্য দিয়ে তার অভিষেক করলেন। বণিকপুত্রও তার পিতা-মাতাকে এনে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।

হিরণ্যক এবার একটু দম নিয়ে পুনরায় বলল: তাই বলছিলাম—যার যা পাবার, সে তা পাবেই। এই হচ্ছে আমার দুঃখের কাহিনী। আমি যখন এমনি বিষাদে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই বন্ধু হিসেবে পেলাম এই লঘুপতনককে। সে নিয়ে এল তোমার কাছে। এখন বাকিটা তোমাদের হাতে।

এবার মন্থরক বলল: ভাই, হিরণ্যক! লঘুপতনক তোমার প্রকৃতই বন্ধু। তা নাহলে তুমি তার খাদ্য হওয়া সত্ত্বেও সে তোমার অনিষ্ট করেনি। পিঠে করে এতদূর নিয়ে এসেছে। আমিও তোমার তেমনই বন্ধু। আমাদের জাত আলাদা হলে কি হবে? তার মধ্য দিয়েও মিলেমিশে থাকা যায়, যদি মনটা ভাল হয় এবং পারস্পরিক বিশ্বাস থাকে। দেখ— বিত্ত হলেও যার চিত্ত-বিকার না জন্মায়, বিপদে যে এগিয়ে আসে, সে-ই হচ্ছে আসল বন্ধু। আর অর্থের জন্য ভেবনা। দেখ, শাস্ত্র বলছে—

খলের প্রীতি মেঘের ছায়া জোয়ার সিদ্ধ-অন্ন।
ধন-যৌবন ভোগ-মাত্র কয়েকদিনের জন্য।।

তাই জিতেন্দ্রিয় পুরুষ কখনো ধনস্পৃহা করেন না। তাছাড়া, ধন উপার্জনে কষ্ট, রক্ষণে কষ্ট, নাশে কষ্ট, ব্যয়ে কষ্ট। আর বুদ্ধি থাকলে তার কাছে ধনার্জন কোনো ব্যাপার নয়। দেশ-বিদেশ বলতেও তার কাছে কিছু নেই। আর একটা কথা। অর্থ কারো চিরদিন থাকে না। আজ এর হাতে তো কাল ওর হাতে। তাই পণ্ডিতরা এর নাম দিয়েছেন ‘চঞ্চলা’। আর অর্থ হচ্ছে ভোগের জন্য। যে তা না করে শুধু উপার্জনই করে, পরিণামে সে কষ্ট পায়, যেমন পেয়েছিল সোমিলক।

হিরণ্যক সাগ্রহে বলল: খুলে বল তো ব্যাপারটা!

মন্থরক: আচ্ছা, শোনো…

সোমিলক ও গুপ্তধন

এক নগরে থাকত এক তাঁতি। নাম তার সোমিলক। হরেক রকম মিহি কাপড় বোনায় তার জুড়ি ছিল না। তাই রাজা-মহারাজা সকলেই আসতেন তার কাছে। কাপড় বানাতে। এত গুণী শিল্পী হলে কি হবে? খাওয়া-পরার বেশি টাকা তার ছিলনা কোনো কালেই। কিন্তু যারা মোটা কাপড় বুনত, তারা সবাই ছিল ধনী।

একদিন সে স্ত্রীকে বলল: আমি বিদেশ যাব।

স্ত্রী বিস্ময়ের সঙ্গে বলল: হঠাৎ বিদেশ কেন?

তাঁতি: মোটা কাপড় বুনে ওরা সব বড়লোক! সোনা-দানায় ভরা ওদের ঘর! আর এত মিহি কাপড় বুনেও আমার ঘরে কিছু নেই! তাই এ অন্যায়ের দেশে আর কাজই করব না! বিদেশ গিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা আনব।

স্ত্রী: দেখ, বিদেশ গেলেই টাকা হয়, আর দেশে থাকলে হয় না—এটা ঠিক নয়। আসলে সবই অদৃষ্ট। তাইতো শাস্ত্র বলছে যা হবার, তা এমনিতেই হয়। যা হবার নয়, তা কোথাও হয় না। অদৃষ্টে না থাকলে তা হাতের মুঠোয় এসেও ফসকায়। তাছাড়া, কর্ম অনুযায়ী ফল লাভ হয়। দেখ না যে পাখিটি নীল আকাশে ওড়ে, সে মাটিতেও নামে। হাজার গাভীর মধ্যে বাছুরটি যেমন তার মাকে খুঁজে নেয়, পূর্বজন্মের কর্মও তেমনি এ জন্মে তার কর্তাকে খুঁজে নেয়। আলো আর ছায়া যেমন একে-অন্যের জোড়া, কর্ম ও তার ফলও তেমনি পরস্পর আবদ্ধ। কাজেই দূরে গিয়ে কাজ নেই। তুমি এখানেই লেগে থাক।

স্ত্রীর কথার তীব্র প্রতিবাদ করে তাঁতি বলল: তোমার কথা মোটেই ঠিক নয়। উদ্যম ছাড়া জগতে কিছুই হয় না। হাত থাকলেই যেমন তালি বাজে না, তেমনি উদ্যম ছাড়া কার্যসিদ্ধিও হয় না। দেখ—কর্মফলে খাবার জুটলেও হাতের চেষ্টা ছাড়া তা কি মুখে যায়? আর চঞ্চলা লক্ষ্মী উদ্যোগী পুরুষকেই আশ্রয় করে, অদৃষ্টবাদী কাপুরুষকে নয়। ইচ্ছা ছাড়া কোনো কার্যসিদ্ধি হয় না। সিংহ বনের রাজা। সবাই তাকে ভয় পায়। কিন্তু ক্ষুধার্ত সিংহ যদি চোখ বুজে হাঁ করে থাকে, তাহলে কোনো প্রাণী কি আপনা থেকেই তার মুখে ঢোকে? তাই অদৃষ্টের দোহাই দিয়ে বসে থাকার চেয়ে চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়াও ভালো। অতএব, আমি বিদেশ যাবই।

এই বলে সোমিলক একদিন বর্ধমান শহরে গেল। সেখানে তিন বছর কাটাল। তারপর একদিন তিনশ সোনার মোহর নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল।

চলতে চলতে রাত নেমে এল। জন্তু-জানোয়ারের ভয়। তাই বড় একটা বটগাছের গুঁড়ির উপর উঠে সে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর রাতে স্বপ্ন দেখল ভয়ঙ্কর দুই পুরুষ কথা বলছে।

প্রথম: কর্তামশাই, সোমিলকের কপালে তো খাওয়া-পরার বেশি টাকা লেখা নেই। তবু আপনি তাকে তিনশ মোহর দিলেন কেন?

দ্বিতীয়: শোনো কর্ম, যে চেষ্টা করে, তাকে আমি দিতে বাধ্য। এর পরের ব্যাপার তোমার।

একথা শুনে সোমিলকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে থলিতে হাত দিয়ে দেখে—খালি! তখন সে ক্ষোভের সঙ্গে বলল হায় রে! এত কষ্ট করে টাকা রোজগার করলাম! মুহূর্তে তা কোথায় গেল? আমার সব পরিশ্রম জলে গেল! এতদিন পরে খালি হাতে আমি বৌয়ের কাছে গিয়ে মুখ দেখাব কি করে?

এরূপ চিন্তা করে সে আবার সেই শহরে ফিরে গেল। সেখানে এক বছরে পাঁচশ মোহর উপার্জন করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল। মাঝপথে আবার রাত হয়ে গেল। কিন্তু পাছে মোহর হারিয়ে যায়—এই ভয়ে সে আর কোথাও থামল না। জোর কদমে এগিয়ে চলল বাড়ির দিকে। কোনোমতে পৌঁছতে পারলেই হয়।

কিন্তু আবার সেই ভয়ঙ্কর দুই পুরুষ। একজন বলল: ওহে কর্তা, যার কপালে খাওয়া—পরার বেশি নেই, তাকে আপনি পাঁচশ মোহর দিলেন?

অন্যজন: ওহে কর্ম, ও যে কাজ করেছে। তাই আমাকে যে দিতেই কবে। আমার কাজ আমি করেছি। এখন তোমার কাজ তুমি কর।

শুনে তৎক্ষণাৎ সোমিলক থলিতে হাত দিয়ে দেখে মোহর নেই। দুঃখে-কষ্টে সে নির্বাক হয়ে গেল। তার চলচ্ছক্তি নেই। ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ভাবল: আমার টাকা নেই, পয়সা নেই। এই দরিদ্র জীবন দিয়ে কি হবে? এর চেয়ে আত্মহত্যাই ভালো।

এই ভেবে সে ঘাস দিয়ে দড়ি বানাল। উঁচু গাছে উঠে গলায় ফাঁস লাগিয়ে যেই ঝুলে পড়বে, ঠিক তখন এক সুপুরুষ তার সামনে শূন্যে দাঁড়িয়ে বলল: থাম সোমিলক, তোমার মোহর আমিই নিয়েছি।

সোমিলক বিস্ময় এবং কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলল: কেন?

পুরুষ: কারণ, তোমার ভাত-কাপড় তো ঠিকই চলছিল। তোমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছিল দিকে দিকে। কেন তুমি অর্থের পেছনে ছুটছ? এটা আমার পছন্দ নয়। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। তবে, তোমার সাহস ও উদ্যোগ দেখে আমি সন্তুষ্ট। তুমি আমার কাছে যে—কোনো বর প্রার্থনা কর।

সোমিলক এবার সাহসে ভর করে বলল: প্রভু, যদি তাই হয়, তাহলে আমাকে অনেক টাকা দিন।

পুরুষ: অনেক টাকা দিয়ে তুমি কি করবে? খাওয়া-পরার বেশি তো তোমার কপালে নেই। নপুংসকের স্ত্রীর মতো এ ধন নিয়ে তুমি কি করবে?

সোমিলক: ভোগ না করতে পারি, তবু আমার টাকা হোক। কারণ, যার টাকা আছে তাকে সবাই কঞ্জুস বললেও, সজ্জনেরা তার ত্রিসীমায় না এলেও, তার বংশ অতি সাধারণ হলেও লোকে তাকে সমীহ করে। তাছাড়া—

স্ত্রীর বাক্যবাণ বড়ই নির্দয়।
হানে যবে পুরুষের কঠিন হৃদয়।।
অণ্ডলোভে ছোটে তাই চতুর শেয়াল—
ষণ্ডের পেছনে, কিন্তু পোড়া যে কপাল।।

পুরুষ: সে কি রকম?

সোমিলক: শুনুন তাহলে …

ষাঁড় ও শেয়াল

এক অরণ্যে ছিল এক ষাঁড়। নাম তার তীক্ষ্ণবিষাণ। বিষাণ (শিং) দুটো ভীষণ ছুঁচালো তো। তাই এই নাম। যৌবনের অসীম শক্তি গায়ে। কুছ পরোয়া নেহি ভাব। তাই ছুটতে ছুটতে একদিন দলছুট হয়ে পড়ল। শিংজোড়া দিয়ে নদীর পাড় খুঁড়ে বেড়াত, আর কচি-কচি ঘাস খেত। তাই চেহারাখানা হয়েছে শিবঠাকুরের নন্দীর মতো।

সেই বনে থাকত এক শেয়াল। নাম তার প্রলোভক। যেমন হ্যাংলা, তেমন পেটুক। তাইতো নামটাও হয়েছে যুতসই।

একদিন প্রলোভক স্ত্রীকে নিয়ে নদীর ধারে বসে আছে। কত গল্প দুজনে। হাসি-ঠাট্টা I রসের কথা। বেশ কাটছিল সময়। এমন সময় তীক্ষ্ণবিষাণ এল জল খেতে। উবু হয়ে যখন জল খাচ্ছিল, তখন পেছন থেকে তার অণ্ডযুগল কেমন লম্বা হয়ে ঝুলছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি খসে পড়বে। তা দেখে শেয়ালনীর আর ধৈর্য ধরছিল না। সে স্বামীকে বলল: ওগো, দেখনা, কেমন সুন্দর পিণ্ডদুটি ঝুলছে! এক্ষুণি খসে পড়বে! নিয়ে এস না! মজা করে খাব!

স্ত্রীর কথা শুনে প্রলোভক একটু ভরকে গেল। যে তীক্ষ্ণ শিং! এক গুঁতো মারলে সোজা স্বর্গবাস! কিন্তু এ দুর্বলতার কথা স্ত্রীর কাছে বলা যায় কি করে? পৌরুষত্বের ব্যাপার তাই ঘুরিয়ে বলল: প্রিয়ে, ও-দুটো খসবে কি-না কে জানে। তাই অনিশ্চিতের পেছনে ছুটে কি হবে? তার চেয়ে নদীতে জল খেতে আসা দু-চারটে ইঁদুর ধরে দুজনে বসে খাই। সে-ই তো ভালো। শাস্ত্রে আছে না—

নিশ্চিতকে ছেড়ে যে অনিশ্চিতকে চায়।
নিশ্চিত অনিশ্চিত সে উভয়ই হারায়।।

তাছাড়া, তোমাকে ফেলে আমি যদি ওর পেছনে ছুটি, তাহলে খালি জায়গায় অন্য কেউ এসে বসে পড়বে। তখন দুই-ই যাবে।

শেয়ালনী মুখ বাঁকিয়ে তিরস্কারের সুরে বলল: তুমি আসলে একটা কাপুরুষ! ইঁদুর—বিড়াল যা পাও তাতেই খুশি হও। ঠিক যেমন পণ্ডিতেরা বলেছেন

ছোট নদী যথা ভরে অল্প জলে।
কাপুরুষ তথা খুশি স্বল্প পেলে।।

তাইতো মরদ যে, সে সর্বদা উৎসাহে টগবগ করে। সবাই তাকে ভয় পায়। ঠাণ্ডা জলে যে-কেউ হাত দিতে পারে। কিন্তু ফুটন্ত জলে? আসলে উদ্যম, আলস্যদমন, নীতি আর পরাক্রম—এসবের যেখানে সম্মেলন ঘটে, চঞ্চলা লক্ষ্মী সেখানেই স্থায়ী হয়। দেখ

অদৃষ্টের কথা ভেবে বসে থাকলে কি হয়?
তিল থেকে তেল কি চেষ্টা ছাড়া পাওয়া যায়??

তাছাড়া ইঁদুর খেতে-খেতে আমার অরুচি ধরে গেছে। ও-দুটো খেলে একটু রুচিরও পরিবর্তন হতো। তাই যাও না, নিয়ে এস পিণ্ডদুটো।

শেয়াল আর কি করে? স্ত্রীর আবদার। তাই বাধ্য হয়ে ষাঁড়ের পেছনে ছুটল। সঙ্গে শেয়ালনীও। কিন্তু পিণ্ডদুটি আর পড়ে না। একে একে এক যুগ চলে গেল। অবশেষে একদিন শেয়াল বলল: নিশ্চিত ইঁদুরও গেল, অনিশ্চিত পিণ্ডও পেলাম না। লাভের বেলা শূন্য!

শেয়ালনী সান্ত্বনার সুরে বলল: তা-ও ভালো। চেষ্টা করে না পেলেও কুড়েমির অপবাদ ঘোচে। চল আমরা আগের জায়গায় ফিরে যাই।

শেয়াল: তা-ই চল।

কিছুক্ষণ বিরাম নিয়ে সোমিলক বলল: ষণ্ডাণ্ড না পেলেও স্ত্রীর কাছে প্রলোভকের পুরুষত্ব রক্ষা পেয়েছে। তাই আমিও চাই, ভোগ না করতে পারলেও অর্থ আমার ঘরে থাকুক। তাতে মর্যাদা বাড়বে।

সোমিলকের কথায় যুক্তি আছে। অগ্রাহ্য করার মতো নয়। তাই পুরুষ বলল: ঠিক আছে। তুমি তাহলে আবার বর্ধমানে যাও। সেখানে দুই বণিক থাকে গুপ্তধন আর ভুক্তধন। প্রথমজন শুধু টাকা জমায়। আর দ্বিতীয়জন দিয়ে-থুয়ে ভোগ করে। তারা কে কেমন তা জান। জেনে তুমি যার মতো হতে চাইবে, তোমায় আমি তার মতো করে দেব। এই বলে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সোমিলক কিছুক্ষণ চিন্তা করে বর্ধমানে ফিরে গেল। সূর্য তখন ডোবে-ডোবে। ক্লান্তিতে পা যেন আর চলে না। জনে-জনে শুধিয়ে গুপ্তধনের বাড়ি গিয়ে উঠল। তখন রাত।

ঢোকামাত্র গুপ্তধন তো রেগে লাল! এ আবার কোন উৎপাত! অসময়ে এসেছে! নিশ্চয়ই থাকার ফন্দি! কি যে করি! এতসব ভেবে তাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সোমিলক জোর করেই বসে পড়ল। আর কি করা। একবেলা বাড়তি খরচ! এরূপ ভেবে গুপ্তধন নিতান্ত মনের বিরুদ্ধে সোমিলককে খাওয়ালো। সারাদিনের ক্লান্তির পরে মুহূর্তেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। এক সময় সে ভীষণাকৃতির সেই পুরুষদ্বয়কে দেখতে পেল। একজন বলল: কর্তা, গুপ্তধনকে দিয়ে এই বাড়তি খরচ কেন করালেন?

অন্যজন: দেখ কর্ম, সোমিলকের কপালে ছিল এখানে একবেলা খাওয়া। আমি কি করব? পরিণাম অবশ্য তোমার হাতে।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সোমিলক দেখল, গুপ্তধনের পেটে-অসুখ হয়েছে। তাই সে উপোস দিচ্ছে। এভাবে তার একবেলা বাড়তি খরচ পুষে গেল। এসব দেখে সোমিলক তক্ষুণি এ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল। ঘুরতে-ঘুরতে এক সময় উপস্থিত হলো ভুক্তধনের বাড়ি। এখানের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেখামাত্র ভুক্তধন সাদর সম্ভাষণে তাকে গ্রহণ করল। অতি আদরে খাওয়ালো-দাওয়ালো। নতুন পোশাক দিল। সজ্জিত বিছানা দিল। এবং অল্প সময়েই সোমিলক সুখনিদ্রায় আচ্ছন্ন হলো।

মধ্যরাতে স্বপ্নে দেখল ভীষণ সেই দুই পুরুষ। পরস্পর কথা বলছে। প্রথমজন বলছে: কর্তা, সোমিলকের সেবা করতে গিয়ে ভুক্তধনের তো অনেক খরচ হয়ে গেল। বেচারি সবই তো এনেছে প্রায় ধার করে। তা ওকে দিয়ে এত খরচ করালেন কেন?

দ্বিতীয়জন: ওহে কর্ম, ওর যে স্বভাব এ-ই। সেবাই ওর ধর্ম। তাই আমি বাধ্য হয়েছি করতে। এখন তোমার কাজ তুমি কর।

সকাল বেলা দেখা গেল এক রাজকর্মচারী এসে বলছে: ওহে ভুক্তধন, তুমি ভাগ্যবান! রাজা প্রসন্ন হয়ে এই টাকা তোমায় দিলেন। এই বলে একশটি সোনার মোহর তার হাতে দিল।

এসব দেখে সোমিলক ভাবল: এ-ই তো ভালো। না-ই বা থাকল জমানো টাকা। ঐ হাড়-কঞ্জুষ গুপ্তধনের চেয়ে এই ভুক্তধনই তো শ্রেষ্ঠ। রাজা স্বয়ং তাকে কত সম্মান করেন! পণ্ডিতরা তো ঠিকই বলেছেন—বেদের ফল ধর্মার্জন, বিদ্যার ফল চরিত্র, পত্নীর ফল প্রেম ও সন্তান আর টাকার ফল ভোগ ও দান। তাই আমার খাওয়া-পরার অতিরিক্ত গুপ্তধনের প্রয়োজন নেই। বিধাতা আমাকে দত্তভুক্তধন করুন। আমি যেন সবাইকে দিয়ে-থুয়ে খেতে পারি।

সেদিন থেকে সোমিলক দত্তভুক্তধন হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে মন্থরক হিরণ্যকের উদ্দেশে বলল: ভাই হিরণ্যক, তাই বলছিলুম—ঐ হারানো টাকার জন্য তুমি মন খারাপ করো না। আর দেখ, মাটির নিচে সঞ্চিত টকায় কেউ ধনী হয় না। সৎকাজে ব্যয় করাই হচ্ছে উপার্জিত অর্থের সার্থকতা। জলাশয়ে এক মুখে জল ঢুকবে, অন্য মুখে বেরিয়ে যাবে। তবেই জল ভাল থাকবে। বদ্ধজল এমনিতেই নষ্ট হয়ে যায়। টাকা ভোগ না করে যে কেবল সঞ্চয় করে, তার দান, টাকা মৌচাকের মধুর মতো অন্যেই খায়। টাকার পরিণতি হচ্ছে তিন রকম ভোগ আর নাশ। যে দানও করে না, ভোগও করে না, তার টাকা নষ্টই হয়। তাই বিবেকবান ব্যক্তি কেবল সঞ্চয়ের জন্যই টাকা আয় করে না। তাতে পরিণামে দুঃখ পেতে হয়।

তাছাড়া, বুনো হাতি লতা-পাতা খায়, অথচ তার গায়ে কি বল! মুনি-ঋষিরা ফল-মূল খেয়ে জীবান কাটান। অথচ তাঁদের কি তেজস্বিতা! আসলে সন্তোষই শান্তির মূল কারণ। ধনের পেছনে যারা ছোটে, তাদের শান্তি কোথায়? সূর্যকে মেঘে ঢাকলে তার রোদ্দুরও যেমন ঢাকা পড়ে, তেমনি কামনা-বাসনা মানুষের চিত্তকে রুদ্ধ করলে তার ইন্দ্রিয়সমূহও রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে তার সুখানুভূতি থাকে না। তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি আগুন পোহালে কি তার তৃষ্ণা মেটে? তাতে তৃষ্ণা আরো বেড়ে যায়। শোননি—

লোভের তুল্য শত্রু নেই, দানের তুল্য ধন।
চরিত্রতুল্য অলঙ্কার নেই—বলেন গুণিজন।।

আর অধিক কি বলব? দেখ—জগতে আসল দরিদ্র সে, যার আত্মসম্মান বোধ নেই। তার প্রমাণ শিব ঠাকুর। সম্বল মাত্র একটি বৃদ্ধ ষাঁড়। রাজ্য নেই। সিংহাসন নেই। আর কিছুই নেই। অথচ তিনিই দেবাদিদেব। সুতরাং, লোভ করো না। সন্তোষ করো। মন্থরক হিরণ্যককে এত উপদেশ দিল। অনেক রূঢ় কথাও বলল। এতে সে মনে কষ্ট পেতে পারে। এই ভেবে লঘুপতনক সান্ত্বনার সুরে বলল: ভাই হিরণ্যক, মন্থরকের কথায় কিছু মনে করো না। তার কথাগুলো সর্বদা মনে রেখ। প্রকৃত বন্ধু বন্ধুর মঙ্গলের জন্য এমন উপদেশই দেয়। দেখ, মুখে মিষ্টি কথা বলে এমন লোক পাওয়া শক্ত নয়। কিন্তু শুনতে খারাপ লাগে, অথচ পরিণামে মঙ্গলজনক— এমন কথা-বলা লোক দুর্লভ। আবার এমন কথা শোনার লোকও দুর্লভ। কিন্তু প্রকৃত বন্ধু প্রিয় অহিতকর কথার চেয়ে অপ্রিয় হিতকর কথাই বলে থাকে। মন্থরককেও তুমি তা-ই মনে করবা।

এরা তিনজন যখন এরূপ আলাপ করছিল, তখন চিত্রাঙ্গ নামে এক হরিণ ব্যাধের ভয়ে সেই জলাশয়ে এসে লুকাল। তাকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে লঘুপতনক গাছে উঠে গেল। হিরণ্যক শরবনে গিয়ে লুকাল। আর মন্থরক গেল জলাশয়ে। তারপর লঘুপতনক ভালো করে নিরীক্ষণ করে মন্থরককে বলল: বন্ধু, হরিণটা তেষ্টা পেয়ে জল খেতে এসেছে। ভয় নেই। চলে এস।

মন্থরক: কিন্তু ওকে যেরকম দেখছি রীতিমতো হাঁপাচ্ছে, ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে—তাতে মনে হচ্ছে, ও ভয় পেয়েছে। নিশ্চয়ই ব্যাধ ওকে তাড়া করেছে। দেখো তো ওর পেছন-পেছন ব্যাধগুলো ছুটে আসছে কি-না। কারণ—

ভয়াতজন ঘন-ঘন জোরে নেয় শ্বাস।
স্বস্তি পায় না কিছুতে, করে হাস-পাস॥

মন্থরকের কথা শুনে চিত্রাঙ্গ বলল: মহায়শয় ঠিকই ধরেছেন। ব্যাধ আমাকে তাড়া করেছে। ওদের তীর এড়িয়ে কোনরকমে আমি পালিয়ে এসেছি। দলের অন্যরা হয়তো এতক্ষণে ওদের কাঁধে ঝুলছে। আমি শরণাগত। আমায় বাঁচান।

মন্থরক: ওহে চিত্রাঙ্গ, তুমি কি নীতিশাস্ত্র শোনো নি—

শত্রু এলে মুক্তি পাবার দুটি উপায় মোটে।
হাত কেমন চলে, আর পা কেমন ছোটে।।

তাই শিগগির পালাও। ঐ কাছেই গভীর বন আছে। সেখানে ঢুকে পড়।

এমন সময় লঘুপতনক এসে বলল: ওহে চিত্রাঙ্গ, ব্যাধগুলো তাল-তাল মাংস নিয়ে ফিরে গেছে। আর বিপদ নেই। তুমি জল থেকে উঠে এস।

অশ্বাস পেয়ে চিত্রাঙ্গ জল থেকে উঠে এল। মন্থরকও এল। লঘুপতনক নিচে নেমে ‘কা কা’ রবে ডাকলে হিরণ্যকও চলে এল। তারপর সেই গাছের নিচে তারা একত্র হলো। নতুন বন্ধু চিত্রাঙ্গকে পেয়ে সবাই খুশি। মাহসুখে তাদের দিন কাটতে লাগল।

একদিন আড্ডার সময় হঠাৎ চিত্রাঙ্গ অনুপস্থিত। কি ব্যাপার! সবারই মুখ কালো হয়ে গেল। মন্থরক উদ্বেগের সঙ্গে বলল: ভাই লঘুপতনক, আমরা দুজনেই ধীরে চলি। তোমার গতি দ্রুত। একটু খোঁজ করে দেখ না, বন্ধুর কোন বিপদ হলো না-কি! প্রিয়জন দূরে থাকলে যেকোন অসঙ্গতি মনে শঙ্কা জাগায়।

লঘুপতনক তক্ষুণি উড়াল দিল। উড়তে-উড়তে দেখে, এক বনের ধারে ব্যাধের জালে আটকা পড়ে আছে চিত্রাঙ্গ। কাছে যেতেই হাউ-মাউ করে উঠল। বন্ধুকে দেখে তার শোক উথলে উঠল। বিপদে প্রিয়জনকে দেখলে এমনই হয়। চিত্রাঙ্গ কাঁদতে-কাঁদতে বলল: বন্ধু, মরণকালে তোমায় কাছে পেয়ে মনের সাধ মিটল। আমি চললুম। কোনো অপরাধ করে থাকলে মাফ করে দিও। মন্থরক আর হিরণ্যককে বলো আমার কথা আমায় যেন ক্ষমা করে।

লঘুপতনক তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল: তুমি এত ভেঙ্গে পড়ছ কেন? আমরা আছি না। তাছাড়া শাস্ত্রে আছে—

সুদিনে দুর্দিনে যে নির্বিকার রয়।
তার জন্মদাত্রীরা কদাচিৎ হয়।।

তুমি ধৈর্য ধর। আমি এক্ষুণি গিয়ে হিরণ্যককে নিয়ে আসছি। সে মুহূর্তে তোমাকে মুক্ত করবে।

এই বলে লঘুপতনক উড়ে গিয়ে হিরণ্যককে পিঠে করে নিয়ে এল। তাকে দেখে চিত্রাঙ্গ আশ্বস্ত হয়ে বলল—

কে পারে রে তরতে বিপদ, এই দুনিয়ায় বন্ধু ছাড়া।
তাই তো উচিত বুদ্ধিমানের, ভালো দেখে বন্ধু করা।

হিরণ্যক হাসতে হাসতে বলল: হয়েছে। এবার চুপ করে বসো তো একটু। আমি বাঁধনটা খুলে দেই।

এমন সময় মন্থরকও এসে হাজির। তাকে দেখে তিনজনই ভয়ে আঁতকে উঠল । লঘুপতনক বলল: বন্ধু, এ তুমি কি করলে? ব্যাধটা যদি এসে পড়ে তাহলে কি হবে? আমরা না হয় পালাতে পারব। কিন্তু তুমি?

মন্থরক কিছুটা ইতস্তত করে বলল: কি করব, ভাই! ঐখানে বসে বসে বন্ধুর বিপদের অগ্নিজ্বালা আর সইতে পারছিলাম না। তোমরা তিনজনেই চলে এলে। তোমাদের কিছু হলে আমার একার জীবন দিয়ে আর কি হবে? তাই চলে এলুম। দেখ—প্রিয়বিরহ কিংবা অর্থনাশ—এ-ও সওয়া যায়, যদি ভালো বন্ধু থাকে। প্রাণ গেলে হয়তো জন্মান্তরে প্রাণ ফিরে পাব। কিন্তু তোমাদের মতো বন্ধু পাব—তার নিশ্চয়তা কোথায়? লঘুপতনক: আচ্ছা, ঠিক আছে। ঐ যমদূতটা আসার আগেই তুমি ফিরে যাও। আমরাও আসছি।

এমন সময় দূর থেকে দেখা গেল কালবৈশাখীর মেঘের মতো ব্যাধটা ছুটতে ছুটতে আসছে। তা দেখেই হিরণ্যক তাড়াতাড়ি চিত্রাঙ্গের বাঁধন কেটে দিল। সে দ্রুত বনের মধ্যে ঢুকে গেল। লঘুপতনক উড়ে গেল গাছে। হিরণ্যক নিকটেই এক গর্তে ঢুকে পড়ল। আর মন্থরক গুটিগুটি পায়ে চলতে লাগল।

এদিকে ব্যাধ এসে দেখল, হরিণটা পালিয়ে গেছে। ক্ষোভে-কষ্টে তার বুক যেন ফেটে যায়। কি আর করা? হঠাৎ দেখল মন্থরককে। তাকেই জালে আটকে চলল বাড়ির দিকে।

মন্থরককে নিয়ে যেতে দেখে হিরণ্যকের বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে। সে বিধাতার উদ্দেশে বলল: আমার অর্থ নিয়েছ, তা সয়েছি। চাকর-বাকর ছেড়ে গেছে। তা-ও সয়েছি। দীর্ঘদিনের দুর্গ। তা-ও এক বাক্যে ছেড়ে এসেছি। এত কিছু হারিয়ে এমন একজন বন্ধুকে আকড়ে ধরলাম, যে কোনো দিন কারো ক্ষতি করে নি। তাকেও আজ হারাতে হবে? তবে এ জীবন দিয়ে আর কি হবে? হে বিধাতা, তুমি কেন আমার প্রতি এত নিষ্ঠুর হলে? আসলে ঘায়ের ওপরই ঘা পড়ে। একবার বিপদগ্রস্ত হলে, হাজার বিপদ তাকে ঘিরে ধরে।

হিরণ্যক যখন এভাবে বিলাপ করছে, তখন চিত্রাঙ্গ আর লঘুপতনকও কাঁদতে-কাঁদতে সেখানে এল। তিনজনের শোক একত্র হয়ে সমুদ্রে ঢেউ তুলল। তারপর এক সময় হিরণ্যক বলল: কেঁদে কোনো লাভ নেই। বন্ধুকে নিয়ে আড়ালে যাওয়ার আগেই উদ্ধারের উপায় ভাবতে হবে। কথায় বলে—হাতের ধন রক্ষা করা, অপ্রাপ্তকে পাওয়ার চেষ্টা করা আর বিপন্নকে মুক্ত করা এ তিনটি হচ্ছে সেরা মন্ত্রণা। তাই উপায় ভাব। হিরণ্যকের কথায় সায় দিয়ে লঘুপতনক বলল: উপায় একটা আছে। শোনো। ব্যাধের যাওয়ার পথে একটা ডোবা পড়বে। চিত্রাঙ্গ তার পাড়ে গিয়ে মরার মতো পড়ে থাকবে। আমি ঠোঁট দিয়ে তোমার কান খুটতে থাকব। ব্যাধ ভাববে—হরিণটা জাল থেকে ছুটে এসে এখানে মরে আছে। সে নিশ্চয়ই মন্থরককে ফেলে চিত্রাঙ্গকে ধরতে যাবে। সেই মুহূর্তে হিরণ্যক গিয়ে মন্থরকের বাঁধন কেটে দেবে। সে দ্রুত ডোবায় ডুববে। আর আমি ডাক দিতেই চিত্রাঙ্গ দেবে দৌড়। সব ঠিক মতো হলে সবাই বাঁচব।

প্লানমতো সবই হলো। ব্যাধ কচ্ছপ ফেলে হরিণ ধরতে গিয়ে উভয়ই হারাল। তারপর বিধাতা আর ভাগ্যকে দোষারোপ করতে করতে খালি হাতে বাড়ি ফিরল।

এদিকে ব্যাধ চলে গেলে লঘুপতনক, মন্থরক, হিরণ্যক ও চিত্রাঙ্গ একত্র মিলিত হলো। তারা আবার সেই জলাশয়ের পাড়ে গিয়ে মহাসুখে দিন কাটাতে লাগল। তাই শাস্ত্ৰ বলছে—

বন্ধুর মতো বন্ধু পেলে, আর কি লাগে জীবনে।
সহায় থাকে এমন বন্ধু, জীবনে ও মরণে।।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *