মিডিয়াম

মিডিয়াম

একেই বোধহয় বলে আকাশ ভেঙে পড়া। গলগল করে জল ঝরছে। খড়খড়ে, তীক্ষ্ণ শব্দে। পতনের তীব্রতায় এক-একটা জলকণা ভেঙে গিয়ে কুয়াশার মতো বলয় তৈরি করছে। একহাত দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে দাপিয়ে বইছে জোলো বাতাস। শনশন আওয়াজটা যেন বেড়েই চলেছে। হাওয়ার ক্রমাগত ঝাপটায় নুইয়ে পড়ছে লম্বা-লম্বা গাছগুলো। মটমট শব্দ তুলে সেগুলো ভারমুক্ত হচ্ছে ডালপালা খসিয়ে। টিনের চাল, জামাকাপড়, গাছের শুকনো ডাল, সাইনবোর্ড, ত্রিপল, ভাঙা চেয়ার, বালতি দলবেঁধে উড়ে যাচ্ছে বাতাসের তোড়ে। মানব সভ্যতা মুছে দিতে চাইছে যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পাড়াটা এখন প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে তলিয়ে। একচিলতে আলোর রেখাও দেখা যাচ্ছে না। মুহুর্মুহু বিদ্যুতের চমকে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে কালচে রাত। ঘনঘন বিস্ফোরণ হচ্ছে মেঘের অস্থির ঘষটানিতে।

লেক প্লেসের মোড়ে চায়ের দোকানটাতে গুটিসুটি মেরে বসে রয়েছে ‘দেখে নেবো’। একে ডিসেম্বরের রাত, তার ওপর অবিরাম বৃষ্টিতে আপাদমস্তক ভিজে ঠকঠক করে কাঁপছে সে। তার জট পাকানো চুল, দাড়িগোঁফের জঙ্গল থেকে টপটপ করে ঝরছে জল। চায়ের এই দোকানটা অনেক রাত অবধি খোলা থাকে। একটু দূরে লেকমার্কেট। একদিকে সাদার্ন অ্যাভিনিউ। অন্য দিকে গড়িয়াহাট। জায়গাটা সবসময় যে কারণে জমজমাট। ছেলে-ছোকড়াদের ভিড় লেগেই থাকে। দিন দুয়েক হল এই শহরে তীক্ষ্ণ নখ বসিয়েছে শীত। সন্ধের পর থেকেই মনে হচ্ছিল, তেড়ে বৃষ্টি আসছে। রাত ছোঁয়ার আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চায়ের দোকানটা। বৃষ্টির তাণ্ডব শুরু হতেই চায়ের দোকানে আশ্রয় নিয়েছে দেখে নেবো। কালচে, ময়লাটে শতছিন্ন শার্টের ওপর ছেঁড়াখোড়া একটা পাতলা কম্বলে জড়ানো তার শরীর। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে সে। ছেঁড়াফাটা চটের থলিটা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরেছে দেখে নেবো। তার একজোড়া অস্থির লালচে চোখ কেঁপে কেঁপে উঠছে বিদ্যুতের চমকে। বিড়বিড় করে কিছু বলছে সে। ভয়ে মুখ লুকোচ্ছে দু’হাতের তালুতে। গাছের শুকনো ডালের মতো আঙুলের লম্বা কালো বাঁকা নখে কেটে যাচ্ছে তার মুখ।

দেখে নেবো নতুন এসেছে এ পাড়ায়। চায়ের দোকানটার সামনে বসে থাকে সারাদিন। আর পাঁচটা পাগলের থেকে সে একটু আলাদা। তার মধ্যে উগ্রতা নেই। গায়ে পড়াও নয়। তার স্বভাব ঠান্ডা। শুধু হঠাৎ-হঠাৎ ‘দেখে নেবো’ বলে চিৎকার করে। তাই এ পাড়া তার নাম দিয়েছে ‘দেখে নেবো’। দিনভর ফুটপাথে কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় বসে থাকে সে। রাত হলে চায়ের দোকানটায় ঢুকে পড়ে।

তুমুল প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়ে দেখে নেবো-র অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। মুখে তীব্র যন্ত্রণা। লাল চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। তার দু’হাতের তালু থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরচ্ছে। দু’পায়ের চেটোতে যেন কাঁটা ফুটেছে। নাভির কাছটা প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে সে। বুকে কিছু একটা বিঁধে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। গলার আপেলটা ভীষণ জ্বালা করছে। অসহায়, উদভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকায় দেখে নেবো। যে তীব্রতা নিয়ে বৃষ্টি পড়ছে, অন্তত রাতভর থামার লক্ষণ নেই। অফুরন্ত বর্ষণে ডুবে গিয়েছে রাস্তা। ফুটপাথেও জল উঠে পড়বে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। বিভ্রান্ত, দিশেহারা, ভয় পাওয়া দেখে নেবো বেরিয়ে পড়ে চায়ের দোকান থেকে। হুড়মুড় করে পড়তে থাকা তির্যক অসংখ্য জলকণা সঙ্গে সঙ্গে ঘিরে ফেলে তাকে।

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের কলকাতা দেখছে সুরজিৎ। এইরকম দুর্যোগের রাত খুব একটা নামে না পৃথিবীতে। ঘন কালো আকাশ ছেয়ে রয়েছে শহরের মাথায়। লেক রোডের এই তিনতলা বাড়ি থেকে শহরের অর্ধেকটা দেখা যায়। প্রবল বৃষ্টি, ঝড়ের তাণ্ডব আর শীতের প্রকোপে পুরো শহরটা এখন অন্ধকারে ডুবে। একবিন্দু আলো দেখা যাচ্ছে না। ধোঁয়ার একটা আস্তরণ পুরো শহরটাকে যেন গ্রাস করে ফেলেছে। এইরকমই একটা রাত তার দরকার ছিল।

রিস্ট ওয়াচে এখন একটা বাজতে পাঁচ। তিনতলায় সুরজিৎ একা থাকে। দোতলায় দাদা অভিজিতের পরিবার নিয়ে বাস। তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। নীচেরতলায় অফিস। তিনতলা থেকে সুরজিৎ নেমে এল একতলায়। এই বাড়ির প্রতিটা স্কোয়ার ফুট তার ছেলেবেলা থেকে চেনা। অন্ধকারে কোনও অসুবিধা হল না। কোণের দিকের ঘরটার সামনে এসে পেন্সিল টর্চটা জ্বালাল সুরজিৎ। প্রায় নিঃশব্দে দরজাটা খুলে ঢুকে পড়ল ভিতরে। এই ঘরের চাবি সুরজিতের কাছেই থাকে। সে ছাড়া অন্য কেউ ঢোকে না। ঘরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কোণে পরিপাটি করে গোছানো একটা টেবল ও চেয়ার ছাড়া আর কোনও ফার্নিচার নেই। এমব্রয়ডারি করা সাদা টেবলক্লথ পাতা। সুরজিৎ চেয়ারে এসে বসল। ড্রয়ার খুলে তিনটে মোমবাতি বের করে জ্বালাল। মোমের নরম আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ঘরটা। আর একবার হাতঘড়িটা দেখে নিশ্চিত হল সে। ঠিক একটা বাজছে। উপযুক্ত সময় উপস্থিত। টেবলের সামনের দেওয়ালটাতে বড় সাইজের পিচবোর্ড ঝুলছে। ড্রয়ার থেকে একটা এ-ফোর সাইজের ছবি বের করল সুরজিৎ। জট পাকা চুল, দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে ভরা একটা মুখ। অস্থির, উদভ্রান্ত একজোড়া লালচে চোখ। গতকাল পাগলটার ছবি তুলেছে সে। চারটে পিন দিয়ে বোর্ডের সঙ্গে ছবিটা সেঁটে দিল সুরজিৎ। ড্রয়ার থেকে বের করল চার ইঞ্চি সাইজের একটা কাপড়ের পুতুল, ছোট আয়না, কিছু শুকনো ফুল ও সাতটা বড়মাপের পেরেক বা গজাল।

গা থেকে টি-শার্টটা খুলে দেশলাই বক্সের মাপে ছোট আয়নাটা গলায় ঝুলিয়ে নিল সুরজিৎ। ব্লেড দিয়ে চিড়ল বাঁহাতের তালুটা। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত জমা হচ্ছে বাঁহাতের তালুতে। একটা পেরেকের ডগা রক্তে ডুবিয়ে ছবির ওপর কাপড়ের পুতুলটার একটা হাত গেঁথে দিল। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে সুরজিৎ বলে উঠল, ‘নিহোনো মাহো নিনগো’!

আর একটা পেরেক দিয়ে গাঁথল পুতুলের আর একটা হাত। সুরজিৎ মন্ত্রের মতো ফের উচ্চারণ করল, ‘নিহোনো মাহো নিনগো’। দুটো পা, নাভি, বুক, গলায় পর পর গেঁথে দিল বাকি পেরেকগুলো। রক্তাক্ত বাঁ হাতটা বুলিয়ে দিল সারা পুতুলটায়। কাপড়ের ছোট্ট পুতুলটা রক্তে ভিজে গিয়ে চকচকে হয়ে উঠেছে। শুকনো ফুল গুড়িয়ে ছড়িয়ে দিল বোর্ডটার নীচে। গলায় ঝোলানো আয়নাটা সে তুলে ধরল পুতুলের সামনে। যেন পুতুলটা নিজের মুখ দেখবে আয়নায়! সুরজিতের ঠোঁট নড়ে উঠল আবার, ‘নিহোনো মাহো নিনগো। মেয়োসামাসু, মেয়োসামাসু, মেয়োসামাসু!’

ঘরের বাতাস এই মুহূর্তে ভারী হয়ে উঠেছে। তিরতির করে কাঁপছে মোমবাতি তিনটের শিখা। একটা কালো ছায়া ক্রমশ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মৃদু কম্পন দেখা গেল ছোট্ট পুতুলটায়। সুরজিৎ যেন এই মুহূর্তের অপেক্ষাতেই ছিল। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল একচিলতে নিষ্ঠুর হাসি।

অঙ্গিরার আজ কিচ্ছু ভালো লাগছে না। এইসব দিনগুলোয় দিগন্তকে বড্ড মনে পড়ে। জীবন যে তাকে এতটা নিঃসঙ্গতা দেবে, কখনও ভাবেনি। মাঝেমাঝে মনে হয়, সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবে কোথাও। যেখানে কোনও পিছুটান থাকবে না। যেখানে কেউ চিনবে না তাকে। ঢিলেঢালা একটা জীবন কাটিয়ে দেবে সে। এক-একসময় মনে হয়, মায়ার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে কোনও একটা বেসরকারি অ্যাসাইলামে বাঁধনকে রেখে দিলে ভালো করত। মাঝেমাঝে গিয়ে দেখে আসত। তারও তো নিজের জীবন আছে। অপ্রাপ্তি আছে, চাহিদা আছে। থমকে থাকা নির্বাক কিছু স্বপ্ন আছে। পরিমিত জীবন নিয়ে বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছে সে। বাঁধনের জন্যই অঙ্গিরা চাইলেও নিজের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পারে না। বাঁধনে বাঁধা পড়ে গিয়েছে সে। দিগন্ত তার পাগল বোনটাকে খুব ভালোবাসত। তার কথা ভেবেই বাঁধনের দায়িত্বটা এড়িয়ে যেতে পারে না অঙ্গিরা।

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোগটা বাড়ছে। প্রচণ্ড বৃষ্টির সঙ্গে তুমুল ঝড়। ঘনঘন বাজ পড়ার শব্দ বন্ধ জানলা দিয়ে ছিটকে ঢুকে পড়ছে ঘরে। চার দেওয়ালের মধ্যে থইথই করছে মৃদু জোলো গন্ধ। এমন রাত অঙ্গিরা আর কখনও দেখেনি। এই রাতগুলো ডিপ্রেশন বাড়িয়ে দেয়। চারপাশের শূন্যতা যেন আরও নিঃস্ব করে দেয়। ইদানীং অঙ্গিরার ছটফটানি বেড়েছে। জীবনকে বড় বেশি মাত্রায় দমবন্ধ করা মনে হয় তার। একাকীত্ব প্রতিটা রাতে তাকে পোড়ায়, জ্বালায়, ছাড়খাড় করে। ঘুম খোঁজে অঙ্গিরা। এক দীর্ঘ শান্তির ঘুম।

উত্তরদিকের যে ঘরটাতে আধশোয়া হয়ে রয়েছে অঙ্গিরা, সেটা তার আর দিগন্তের বেডরুম ছিল। এই ঘরে পা দিলে স্মৃতি ভিড় করে আসে। টেবলের ছোট ফটোস্ট্যান্ডে এখনও তাদের হানিমুনের ছবি রয়েছে। দিগন্তের রিস্টওয়াচের শখ ছিল। শোকেসে সার দিয়ে সাজানো ঘড়িগুলো এখনও টিকটিক করে সময় দিয়ে চলছে। শুধু তারই সময়টা থমকে গিয়েছে। চিরতরের জন্য। রোজ রাতে ফেলে আসা টুকরো টুকরো স্মৃতি ঘেঁটে ঘুমের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে অঙ্গিরা। কিন্তু আজ এই ঘরে পা দেওয়ার পর থেকে নিজেকে আর সামলাতে পারছে না। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মিহি জলের গুড়োয় ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে তার বর্তমান, তার অতীত।

মাত্র আড়াই বছরের দাম্পত্য ছিল তাদের। তার আগে বছরখানেকের প্রেম। ভীষণ নরম স্বভাবের ছিল দিগন্ত। বিশ্বাস করত মানুষকে। ভালোবাসতে জানত। অচেনা যে কেউ খুব দ্রুত তার কাছের মানুষ হয়ে উঠত। একটা উচ্ছ্বল শিশু বাস করত ওর মধ্যে। দিগন্তের এই স্বভাবটাই চুম্বকের মতো টেনে ছিল অঙ্গিরাকে। স্বার্থপর এই দুনিয়াতেও এমন বিরল কেউ কেউ আছে! বিয়ের পর হইহই করে পেরিয়ে যাচ্ছিল দিনগুলো। ঘুরে বেড়ানো নেশা ছিল দিগন্তের। একটা ট্রলিব্যাগ সব সময় গোছানো থাকত। বিয়ের আগে অঙ্গিরা ততটা ঘোরার সুযোগ পায়নি। সেও দিগন্তের ফ্রিকোয়েন্ট ট্রাভেলার পার্টনার হয়ে উঠেছিল। অঙ্গিরার এখনও মনে হয়, বছরখানেক আগে সিমলা বেড়াতে যাওয়ার জন্য সে ঝোঁক না ধরলেই ভালো করত। তা হলে তার জীবনটা আর অন্ধকারে তলিয়ে যেত না।

সিমলা যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট ক্যাফে থেকে কফি আর স্ন্যাকস আনতে নেমেছিল অঙ্গিরা। গাড়িটা পার্ক করা ছিল রাস্তার ধারে। সেদিন শীত যেন অতিমাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছিল পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। ক্যাফেতে দাঁড়িয়ে অঙ্গিরা দেখেছিল, গাড়িটা গড়িয়ে যাচ্ছে খাদে। সে ছুটে আসতে আসতে সব শেষ। দিগন্ত ছাড়া ওই গাড়িতে ড্রাইভার আর অনুলেখাও ছিল। ঘণ্টাখানেক পর রেসকিউ টিম এসেছিল। কিন্তু ওদের কাউকে বাঁচাতে পারেনি।

একবছর পেরিয়ে গেছে ওই ঘটনার। তবু এই ঘরে এলে চোখ ভিজে যায় অঙ্গিরার। যে কারণে সে সাধারণত দক্ষিণ দিকের বেডরুমটাতেই শোয়। আজ বাঁধন কিছুতেই এই ঘরে শুতে চাইল না। দক্ষিণ দিকের বেডরুমটাই তার পছন্দ। মেয়েটা কোনও ঝোঁক ধরলে সামলানো যায় না। কাল সকালে কোম্পানির বোর্ড মিটিং। দিগন্ত মারা যাওয়ার পর কোম্পানিটা দেখতে হচ্ছে তাকে। ‘প্রাইড সিমেন্টস’ দেশের প্রথমসারির কোম্পানি। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পর অঙ্গিরা বুঝতে পারছে, হিসেবে প্রচুর গরমিল রয়েছে। প্রোডাকশন যা দেখানো হচ্ছে, তার অর্ধেকও হয় না। অঙ্গিরা ঠিক করেছে তার ভাগের শেয়ার বিক্রি করে দেবে। কিন্তু সেটা নিয়েই দেখা দিয়েছে সমস্যার কালচে মেঘ। অঙ্গিরা কাল একটা হেস্তনেস্ত করবেই।

বিদ্যুতের চকিৎ আলোর ছটায় গোলাপি রংয়ের দোতলা বাড়িটাকে দুধসাদা মনে হচ্ছে। উঁচু, লম্বা পাঁচিলে ঘেরা বাড়িটা। ফুটপাথের ধারে বিশাল কালচে গেট। লাগোয়া ছোট গেটটা টপকে বাড়ির লনে এসে দাঁড়াল দেখে নেবো। বৃষ্টি আর শীতের জোড়াফলায় সিকিউরিটি গার্ড ঘুমিয়ে পড়েছে। কে-ই বা ঘর ছেড়ে বেরোতে চাইবে এই রাতে! দুর্যোগের জন্য পুরো পাড়াটা অন্ধকারে তলিয়ে। একটু আগে ট্রান্সফর্মাটা বার্স্ট করে যাওয়ায় পুরো এলাকায় কোত্থাও কারেন্ট নেই। এই বাড়ির চারদিক সিসিটিভিতে মোড়া থাকে। লোডশেডিং থাকায় দেখে নেবো-র গেট টপকে ঢুকে পড়া যান্ত্রিক নোটবুকে ধরা পড়ল না। সবুজঘাসের লনটা পেরিয়ে নিঃশব্দে বাড়ির দিকে হেঁটে গেল দেখে নেবো। হাতল ঘুরিয়ে আর্কডোরটা খুলে অবলীলায় বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল দেখে নেবো। তার ফেলে যাওয়া পায়ের ছাপ একেএকে মুছে দিল বৃষ্টির অসংখ্য নতুন ফোঁটা।

দরজা পেরিয়ে হলঘরে এসে দাঁড়াল দেখে নেবো। তার সারা গা থেকে চুঁইয়ে নামছে জলের ধারা। তার চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম বড় আর ঘোর লালচে দেখালেও এখন কোনও অস্থিরতা নেই। ধীরে, খুব ওঠানামা করছে তার বুক। ছোট্ট ছোট্ট শ্বাস নিচ্ছে দেখে নেবো। মনে হচ্ছে, সে যেন নিজের ইচ্ছেয় এই বাড়িতে আসেনি। তার মধ্যে বাসা বেঁধেছে কোনও চালিকাশক্তি। যাকে উপেক্ষা করা যায় না। যার নির্দেশ মেনে এগিয়ে চলেছে সে। দরজার মুখে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে দোতলায় উঠে আসে দেখে নেবো। নিঃশব্দে এগিয়ে যায় দক্ষিণদিকের বেডরুমের দিকে। ঘরের দরজা খোলা। ফিনফিনে রেশমি পর্দা মৃদু উড়ছে। দেখে নেব দরজার সামনে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। রুমের বাঁ দিকে কাচের শাটার দেওয়া জানলাটা একফালি খোলা। ডানদিকে মাস্টারবেড। বিদ্যুতের চমকে সে দেখতে পায়, চাদর ঢাকা দিয়ে বিছানায় গুটিসুটি শুয়ে রয়েছে একটা মেয়ে। নির্দ্বিধায় দেখে নেবো ঢুকে পড়ে ঘরে। নিশ্চিন্ত হেঁটে এসে দাঁড়ায় মাস্টারবেডের সামনে। শক্ত, সবল একটা হাত বাড়িয়ে চাদরের ওপর দিয়ে চেপে ধরে মেয়েটির মুখ। দূরে কোথাও সশব্দে বাজ পড়ল। মুহূর্তের চকিত আলোয় দেখা যায় দেখে নেবোর হাতে চকচকে, ধারাল উদ্ধত একটা ছুরি। মসৃণ তীক্ষ্ণ ফলা দিয়ে গড়াচ্ছে তরল খুনে মাদকতা। দেখে নেবো এলোপাথারি ছুরি চালাতে থাকে মেয়েটার বুকে, পেটে, গলায়।

ভাঙাচোরা যন্ত্রণায় আচমকা ঘুম ভেঙে গিয়ে দুটো বিস্ফোরিত চোখ তাকিয়ে থাকে দেখে নেবোর দিকে। বিস্ময়, আর্তি, প্রার্থনা, আতঙ্ক মুছে গিয়ে সীমাহীন ক্লান্তি ভর করে আসে তাতে। ধীরে ধীরে চোখ দুটো আবার বন্ধ হয়ে যায়। চিরকালের জন্য।

মোমবাতির আলোয় উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ঘরটা। ঘরের দরজা ও জানলা বন্ধ হলেও মৃদু কাঁপছে মোমের শিখা। হয়তো সুরজিতের নিঃশ্বাসে। হয়তো এতক্ষণের জমে থাকা উৎকন্ঠায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক হল এই চেয়ারে বসে রয়েছে সে। অপেক্ষা করছে বিশেষ মুহূর্তের জন্য। একটা ইঙ্গিত, যা দেখে সে বুঝতে পারবে, লক্ষ্য পূরণ হয়েছে তার। এখনও টেনশন হচ্ছে তার। এরকম আগেরবার হয়নি। মোমবাতির আলোয় সুরজিৎ দেখতে পেল, যে সাতটা পেরেক দিয়ে বোর্ডের গায়ে, ছবির ওপর গাঁথা পুতুলটা, সেখান থেকে রক্তের ক্ষীণধারা গড়াতে শুরু করেছে। সুরজিতের মুখে আবার ফুটে উঠল নিষ্ঠুর হাসি।

ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে সুরজিৎ বলল, ‘আমি, আমি যা চাই, তা-ই পাই। কেউ পারবে না আমাকে আটকাতে। কেউ না। তুমিও না!’

বছর তিনেক আগে বিজনেস ট্যুরে জাপানের সাপোরোতে গিয়েছিল সুরজিৎ। ওখানকার একটা কোম্পানির সঙ্গে মউ স্বাক্ষর করতে। বড় ডিল ছিল। ওটা নিয়ে সুরজিৎ নিজে কম টেনশনে ছিল না। কোম্পানির কী লাভ হবে, সে সব নিয়ে ভাবেনি। জাপানি কোম্পানির সঙ্গে সিমেন্ট সরবরাহের ডিলটা কনফার্ম করতে পারলে মোটা টাকার কমিশন আসত তার কাছে। সে জন্যই মরিয়া হয়ে উঠেছিল। অনেক জটিলতা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সব মেটাতে পেরেছিল সুরজিৎ। কাজ মেটার পর সাপোরো ঘোরার জন্য একটা দিন পেয়েছিল। এশিয়ার ওই দেশগুলো বড় রহস্যময়। যে শহর যত পুরোনো, তার আচারে, অনুষ্ঠানে আরও বেশি রোমাঞ্চ লুকিয়ে থাকে। উত্তর জাপানের অত্যন্ত প্রাচীন শহর সাপোরো। ওখান থেকেই এই পুতুলটা কিনেছিল। ফুটপাথ থেকে। লং নামে একটি অল্প বয়সী ছেলে কয়েকদিনের জন্য গাইড ছিল সুরজিতের। তোপো নামে একটা প্রান্তিক গ্রাম দেখাতে নিয়ে যাওয়ার সময় সে শুনিয়েছিল জাপানি পুতুলের অদ্ভুত গল্প। বহুযুগ আগে জাপানের কিছু সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ছিল, মাসের একটা নির্দিষ্ট দিন বা সময়ে বিদেহি আত্মাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মন্ত্রবলে কোনও আত্মাকে এই পুতুলে বন্দি রাখতে পারলে, তাকে দিয়ে যে কোনও কাজ করানো যেতে পারে। এই বিশ্বাস ক্রমে উপাচারে পরিণত হয়েছিল। তোপো ছাড়িয়ে একসময় সারা সাপোরোতে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই উপাচার। বিভিন্ন অনৈতিক কাজে ওই ধরনের পুতুল ব্যবহার করা হত। এখনও নাকি অনেকে প্রাচীন প্রথা বিশ্বাস করে।

লং আধুনিক ছেলে। সে হেসে বলেছিল, ‘এখন ওই সব প্রথার চল আর নেই। আমার মনে হয়, পুরো ব্যাপারটাই জনশ্রুতি। পুতুলে আবার আত্মা বন্দি রাখা যায় নাকি!’ একটু থেমে মজা করে সে বলেছিল, ‘তবে আপনি পুতুল কিনতে পারেন। সুভেনির হিসেবে। কখনও ইচ্ছে হলে কাজে লাগাতে পারেন।’

তোপো একফালি ছোট্ট একটা গ্রাম। একটা মাঝারি বাজার আর তাকে ঘিরে ছোট জনপদ। বাজারটার উল্টো দিকের ফুটপাতের এক কোণে বসে থাকা অশীতিপর বৃদ্ধের সামনে দাঁড়িয়েই লং শুনিয়েছিল তার অবিশ্বাসের কথা। বৃদ্ধ ইংরেজি জানত না। তবু সে কী বুঝেছিল কে জানে, মাথা নেড়ে অন্য কথা বলেছিল। বয়সে ভারে নুব্জ হয়ে পড়া ছোট্ট চেহারার বৃদ্ধ বোধহয় হাবেভাবে বুঝে নিয়েছিলেন লংয়ের কথা। নীচুগলায় জাপানিতে কিছু বলেছিলেন। লং ভাষান্তর করে বলেছিল, ‘উনি বলছেন, পুতুল এখনও কাজ করে। তবে এটাকে কাজে লাগাতে হলে কিছু নিয়ম মানতে হয়।’

নেহাতই কৌতুহলবশত পুতুলটা কিনেছিল সুরজিৎ। বৃদ্ধ জাপানিতে লেখা একটা কাগজ দিয়েছিল হাতে। পুতুল ব্যবহারের পদ্ধতি লেখা ছিল তাতে। লং কাগজটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিয়েছিল। ওতেই ছিল মন্ত্রটা— নিহোনো মাহো নিনগো, মেয়োসামাসু! যার অর্থ হল, জাগো জাদু পুতুল, জাগো! এই পুতুল সরাসরি কাজ করে না। একটা মিডিয়াম বা মাধ্যম লাগে। যাকে দিয়ে কাজটা করায়। যাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হবে, তার ছবির ওপরে এই পুতুলটাকে গেঁথে দিতে হয় সাতটা পেরেক দিয়ে। পেরেকগুলো গাঁথার সময় যে পুতুলকে জাগাচ্ছে, তার রক্তে ডুবিয়ে নিতে হয়। তিনটে মোমবাতি জ্বালতে হয় সামনে। যে পুতুলকে জাগ্রত করবে, তার গলায় থাকবে একটা বিশেষ মাপের আয়না। যে আয়নায় পুতুল দেখবে তার মাধ্যমের মুখ। যার গলায় এই আয়না থাকবে, তার সঙ্গে একটা যোগসূত্র তৈরি হয়ে যায় পুতুলের। মনে-মনে সে যাকে স্মরণ করবে, মাধ্যমকে দিয়ে তাকেই খুন করাবে এই পুতুল!

সুরজিতের মনে এতক্ষণ একটা তীব্র ভয় কাজ করছিল। সাপোরোর ওই বৃদ্ধ যে পদ্ধতিতে পুতুল জাগাতে বলেছিল, সেটা এর আগেও সফলভাবে করেছে সে। তবে তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল, আয়নায় যেন ব্যবহারকারীর মুখের প্রতিবিম্ব ধরা না পড়ে। তাহলে বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, তখন ওই দ্বিতীয় মুখের মালিককেও খতম করবে পুতুল। একটু আগে সেই কাণ্ডটাই উত্তেজনার বশে ঘটিয়ে ফেলেছে সুরজিৎ। পুতুলটা নড়ে ওঠার পর আয়নাটা উল্টে রাখতে হয়। গলা থেকে খুলে উল্টে রাখার সময় হাত ফস্কে টেবলে পড়ে যায় আয়নাটা। আর ওই কালচে দেশলাই খোলের মতো আয়নাটাতে সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে। প্রাণ সঞ্চার হওয়া পুতুলটাও কি দেখেছে তার প্রতিবিম্ব? কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছে না সুরজিৎ। চাপা উত্তেজনা কাজ করছে তার মধ্যে।

পুতুলটা দিকে এক মনে তাকিয়ে রয়েছে সুরজিৎ। যে সাতটা পেরেক দিয়ে গাঁথা, সব ক’টা ক্ষত স্থান দিয়ে তাজা রক্ত ঝরছে। তার মানে কার্যসিদ্ধি হয়েছে। সুরজিতের মুখে হাসি ফুটে উঠেই হারিয়ে গেল। শুধু পুতুল নয়, এখন মিডিয়াম, মানে ওই পাগলটার বড় বড় দুটো লালচে চোখ থেকেও রক্ত ঝরছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল সুরজিৎ। এমন তো হওয়ার কথা নয়। আগের বার যখন ব্যবহার করেছিল সে, তখন তো হয়নি। অজানা আশঙ্কায় তার গায়ের সমস্ত রোম খাড়া হয়ে গেল। একটা ঠান্ডা ভয় ক্রমশ চেপে ধরছে তাকে। পুতুলটা কি আবার সামান্য নড়ে উঠল? নাকি চোখের ভুল তার? তাহলে কি সত্যিই এখন তার ওপর বদলা নেবে পুতুলটা? সে ঝট করে পাগলটার ছবির ওপর থেকে খুলে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে ফেলল জাপানি পুতুলটাকে।

জাপান থেকে আনার পর এই পুতুলটার কথা ভুলে গিয়েছিল সুরজিৎ। পুতুলটার কথা মনে পড়েছিল সেদিন, যেদিন তার চুরি ধরে ফেলেছিল দিগন্ত। সে আর দিগন্ত মিলে খুলেছিল ‘প্রাইড সিমেন্টস’। ডিরেক্টর্স বোর্ডে সে আর দিগন্ত ছাড়া আরও পাঁচ সদস্য রয়েছে। বাজারে অন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাদের কোম্পানি বেশ ভালোই চলছিল। একটি প্রতিযোগী সংস্থা বিপুল টাকায় কিনে ফেলেছিল সুরজিৎকে। সে জল মেশাতে শুরু করেছিল, হিসেবে, প্রোডাকশনে। শুরুতে কিছুই বুঝতে পারেনি দিগন্ত। একসময় ধরে ফেলে। দিগন্ত মানুষটা ভালো ছিল। বিশ্বাস করত তাকে। তার চুরি ধরে ফেলার পরও তার বিরুদ্ধে বড় কোনও স্টেপ নেয়নি। বন্ধুকে বোধহয় একটা শেষ সুযোগ দিতে চেয়েছিল। অঙ্গিরাকেও কিছু বলেনি তার সম্পর্কে। তাকে শুধু বলেছিল, সুরজিৎ যেন তার শেয়ারটা বিক্রি করে দেয়। দিগন্তই কিনে নেবে। কিছুদিন পরেই সিমলা বেড়াতে যায় দিগন্ত। অনুলেখা আর তাকেও যেতে বলেছিল অঙ্গিরা। সুরজিৎ নিজে না গেলেও অনুলেখাকে পাঠিয়েছিল ওদের সঙ্গে। সুরজিতের মাথায় তখন আগুন জ্বলছে। সে ঠিক করে ফেলেছিল, ছাড়খাড় করে দেবে দিগন্তের দুনিয়া। তাকে বাঁচতে দেবে না। জাপানি পুতুলটা ব্যবহার করার কথা তখন মাথায় এসেছিল তার। সুরজিৎ নিজে না গেলেও ওদের ট্রিপটা প্ল্যান করে দিয়েছিল। জুবারহাট্টি এয়ারপোর্ট থেকে যে গাড়িতে করে সিমলা শহরে যাওয়ার গাড়ি বুক করা হয়েছিল, তার ড্রাইভারের ছবি হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়েছিল কার এজেন্সি। বাকি কাজটুকু সারতে সমস্যা হয়নি তার। কিন্তু অঙ্গিরা বেঁচে গিয়েছিল। ওই সময় সে গাড়িতে ছিল না। এর জন্য কম আফসোস ছিল না সুরজিতের। কফি শপে অঙ্গিরা নেমেছে, যদি জানতে পারত, আর একটু পরে জীবিত করত পুতুলটাকে। তবে অনুলেখাকে মারতে চায়নি সুরজিৎ। সে দুর্ঘটনার শিকার।

আজ এই দুর্যোগের রাতে আবার জাদু পুতুলটাকে জাগিয়েছে সুরজিৎ। কারণ, তার চুরি এবার ধরে ফেলেছে অঙ্গিরা। বোর্ডের বাকি তিন ডিরেক্টর সুরজিতের হাতে। কিন্তু অঙ্গিরা, সে এখন আর বিশ্বাস করে না সুরজিৎকে। দিগন্ত মারা যাওয়ার যখন অঙ্গিরা দায়িত্ব নিল কোম্পানির, তখন থেকেই একটা ব্যাপার মাথায় ঘুরছিল সুরজিতের, যদি অঙ্গিরাকে সে বিয়ে করতে পারে, তাহলে পুরো কোম্পানিটাই তার হবে। ওটাকে বিক্রি করে আবার অন্য ব্যবসা শুরু করবে। সুরজিতের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল মেয়েটা। দিগন্ত এখনও নাকি বাস করে তার মধ্যে। সে আর অন্য কাউকে আর বিয়ে করতে পারবে না। যত্তসব বাজে সেন্টিমেন্ট! সুরজিৎকে বোধহয় তখন থেকেই অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিল অঙ্গিরা। সুরজিৎ যখন শুনল, কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দিতে চায় অঙ্গিরা, সে-ই কিনে নিতে চেয়েছিল। অঙ্গিরা রাজি হয়নি।

প্রকান্তরে সুরজিৎ সোজা কথাটা সেদিনই বলে দিয়েছিল তাকে, কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করলে তাকেই করতে হবে, অন্য কাউকে নয়। অঙ্গিরা রাজি হয়নি। বাধ্য হয়েই আজকের রাতটা বেছে নিয়েছে সুরজিৎ। অঙ্গিরাকে মারতে কষ্টই হচ্ছিল। সে একটু হলেও ভালোবেসে ফেলেছিল মেয়েটাকে। তার নরম, আলতো মিষ্টি মুখটা ভেসে উঠছিল বারবার। কিন্তু কিছু করার নেই। চরম সিদ্ধান্তটা নিতেই হত। এতদিন ধরে যে দাবার বোর্ডটা তিলতিল করে সাজিয়েছে সে, একটা সামান্য বোড়ে তাকে কিস্তিমাৎ দিয়ে যাবে, তা হতে পারে না। লেক প্লেসে দিগন্তদের বাড়ির প্রতিটা ইঞ্চি মুখস্ত সুরজিতের। সে খুব ভালো করে জানে বাঁধন এখন দিগন্তের বেডরুমে শোয়। সাউথএন্ড রুমটা অঙ্গিরার বেডরুম। পুতুলটাকে জাগানোর পর ওই রুমটাই ভেসে উঠেছিল তার চোখের সামনে। আর বিছানায় ঘুমে আচ্ছন্ন একটা মেয়েলি শরীরের অবয়ব।

টেবলের ড্রয়ার থেকে খটখট আওয়াজ আসছে। পুতুলটা বোর্ড থেকে নামিয়ে একটু আগে ওখানে রেখেছে সুরজিৎ। ওটা কি বেরিয়ে আসতে চাইছে? প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সুরজিৎ। বাইরে এখনও প্রবল বৃষ্টি পড়ছে। শীতের শহরকে আরও হীমশীতল করে তুলেছে বৃষ্টি। তবু এই ঠান্ডাতেও সে রীতিমতো ঘেমে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। দু’হাতের তালু ক্রমশ ভিজে যাচ্ছে। মৃত্যুভয় জমাট কালো ছায়ার মতো ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে তাকে। সে কি দোতলায় গিয়ে অভিজিৎকে বলবে? বিশ্বাস করবে না হয়তো। বাইরে বৃষ্টিপাতের গতিবেগ আরও বেড়েছে। বাজ পড়ছে ঘনঘন। প্রাকৃতির তাণ্ডবের নিজস্ব সাউন্ড এফেক্ট থাকে। যে শোনে, তার বুকে আছড়ে পড়ে আদিম সুর। সুরজিৎ প্রতিবার ভয় পাচ্ছে। ঘরের অন্ধকার কোণ, টেবলের তলায় জমা নিবিড় নিকষ কালো, এমনকি তার অস্পষ্ট ছায়া পর্যন্ত চমকে দিচ্ছে তাকে। বৃষ্টির ধারাপাত আর বজ্রপাতের কোরাস ছাপিয়ে মৃদু ছপ-ছপ আওয়াজ শুনতে পেল সুরজিৎ। রাস্তায় এতক্ষণে নিশ্চয় হাঁটু জল জমে গেছে। সেই জল ভেঙে কেউ আসছে! দ্রুত পায়ে কেউ আসছে তার বাড়ির দিকে।

সুরজিৎ কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল। ছপ-ছপ শব্দটা এসে থেমেছে তার বাড়ির দরজায়। বাইরে কি কেউ এসেছে? এত রাতে? একটু কি সময় নিল সে? কাঠের দরজার ওপর ভারী হাতের আঘাতও শুনতে পেল কি?

ঠকঠক ঢোঁক গিলে অস্পষ্ট স্বরে সুরজিৎ বলে উঠল, ‘কে?’

নৈশব্দেরও নিজস্ব ভাষা আছে। ঘরের নীরবতা চুরমার করে দরজার বাইরে থেকে ভাঙাচোরা ঘষা গলা ভেসে এল, ‘দেখে নেবো!’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *