মাসাবোর গুপ্তধন
অবসরজীবনের সবই ভালো শুধু রোববারগুলো ছাড়া। অন্তত সমরেশের পক্ষে ব্যাপারটা সেই রকমই। সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোতে নেই নেই করেও অনেক কাজ থাকে যেমন, বাজারে যাওয়া নানারকমের ট্যাক্স জমা দেওয়া, বাড়ির ছোটোখাটো কাজের জন্যে মিস্ত্রির সন্ধান লাগানো আর তাদের কাজে লাগিয়ে কারণে-অকারণে তাদের পেছনে টিকটিক করা, ব্যাঙ্কে গিয়ে বেশ কিছুটা সময় কাটানো, ইত্যাদি। কিন্তু রোববারের বাজারটা দময়ন্তী নিজে করবেই কারণ তার ধারণা যে সমরেশের হাতে পাঁঠার মাংস কেনবার গুরুদায়িত্ব প্রাণ থাকতে দেওয়া যায় না। কাজেই, সেদিনটা বিরস দিন বিরল কাজ। তবে, যদি সেদিন বিকেলবেলা সস্ত্রীক শিবেন অথবা অন্য কোনো বন্ধু এসে পড়ে, তখন পরমানন্দে আড্ডা উপভোগ করা চলে। নইলে, সকাল থেকে ভয়ংকর টেলিভিশন আর আদ্যোপান্ত খবরের কাগজ ভরসা।
মাঘ মাসের এমনই এক রবিবারের কুয়াশাচ্ছন্ন বিষণ্ণ বিকেলে সমরেশের অর্কিড রোডের বাড়িতে একজন অপ্রত্যাশিত অতিথির শুভাগমন হল। ইনি সমরেশের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সহপাঠী, (বর্তমানে ড.) বিক্রম দেবনাথ। ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল পরীক্ষা পাশ করেই বিদেশে চলে গিয়েছিলেন, অনেক পড়াশুনো করেছেন, সেখানেই কোনো এক ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন। তার বাড়িঘর সব ওদেশেই। এখন একটা বিশেষ কারণে কলকাতায় এসেছেন অনির্দিষ্টকাল থাকবেন বলে।
শনিবার বিক্রম দেবনাথের ফোন পেয়ে সমরেশ খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। একথা সেকথার পর বিক্রম জানালেন যে তিনি সমরেশের বাড়িতে আসতে চান। কবে এলে সুবিধে হয়, সেটা জানতে চাইলেন। সমরেশ জানাল যে যেকোনো দিন বিকেল পাঁচটা থেকে ছ-টার মধ্যে এলে খুবই সুবিধে। তাহলে একসঙ্গে চা খাওয়া যাবে। কথা সেই পর্যন্তই হয়েছিল। তাই বলে যে পরদিনই বিক্রম দেবনাথের শুভাগমন হবে, সেটা একেবারেই প্রত্যাশা করেনি।
***
বিক্রম দেবনাথ লম্বায় সমরেশের কাঁধের একটু নীচেই হবে। চওড়ায় দোহারা বলা যায়। বুক পেট সমান, কোনো, উঁচু-নীচু টক্কর নেই। বিরলকেশ তবে মুখে কাঁচা-পাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। চোখে স্টিলফ্রেমের চশমা। পরনে নীল রঙের গরম সুট। টাই নেই। মুখ গম্ভীর।
প্রাথমিক পরিচয়পর্ব শেষ হলে গম্ভীর মুখে বিক্রম বলল, ‘শুনুন মিসেস দত্তগুপ্ত, এই হারামজাদা যদি আমার সম্বন্ধে আপনাকে কিছু বলে থাকে, সেটা ডাহা মিথ্যে কথা বলে জানবেন। বাড়িয়ে বলা আর রং চড়িয়ে বলা ওর স্বভাব।’
দময়ন্তী সহাস্যে বলল, ‘না না, ও আপনার কথা আমাকে প্রায় কিছুই বলেনি। শুধু বলেছে যে আপনারা দু-জনে কলেজ ফুটবল টিমে খেলতেন।’
বিক্রম বলল, ‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক। সে অবশ্য বহুকাল আগের কথা। বিদেশে গিয়ে অবধি ফুটবলে একটা লাথিও মারিনি।’
সমরেশ বলল, ‘কোন দেশে গিয়েছিলি? সেখানে ফুটবল খেলা হয় না? দক্ষিণ মেরু নাকি?’
গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বিক্রম বলল, ‘না। আমি গিয়েছিলুম জার্মানি। সেখানে খুবই ফুটবল খেলা হয় কিন্তু আমি খেলিনি। ‘ভুরু কুঁচকে সমরেশ জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন? খেলিসনি কেন? পেছনে ফোঁড়া হয়েছিল?’
‘দুর। তা নয়। জার্মানিতে রওনা হওয়ার আগে মা আমাকে বলেছিলেন যে আমি যেন ওখানে গিয়ে আজেবাজে কাজে সময় নষ্ট না করে খুব মন দিয়ে পড়াশুনো করে যত তাড়াতাড়ি হয় তাঁর কাছে ফিরে আসি। এই আজেবাজে কাজের মধ্যে ছিল, মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করা, ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, ফুটবল খেলা আর সিনেমা-থিয়েটারে যাওয়া। জানেন মিসেস দত্তগুপ্ত, আমি মায়ের সব ক-টা আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। কিন্তু তাতে কিছুই হল না।’
দু-জন শ্রোতা সমস্বরে প্রশ্ন করল, ‘তার মানে?’
মাথা নীচু করে বিক্রম থেমে থেমে বলল, বছর চারেক বাদে আমার পিএইচ. ডি. ডিগ্রি অ্যাপ্রুভ হবার পরে যখন দেশে ফেরার তোড়জোড় করছি, প্লেনের টিকিটও কাটা হয়ে গেছে, তখন খবর পেলুম, বাবা আর মা একসঙ্গে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কেন করেছেন তার কারণ আমরা আজও জানি না। তবে, মায়ের কথামতো আর কোনোদিন ফুটবল খেলিনি।’
দময়ন্তী বলল, ‘কী ভয়ানক! কোনো সুইসাইড নোট ছিল না?’ ‘ছিল। সাদা কাগজে ওপরে নীচে ইংরেজিতে লেখা দুটো লাইন। দুটোরই বয়ান এক— আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ওপরেরটা বাবার নিজের হাতে আর নীচেরটা মার নিজের হাতে। শুনেছি স্পষ্ট পরিষ্কার লেখা ছিল।’
‘কোনো ডায়েরি বা বাড়ির কাগজপত্র থেকে কোনো কু পাওয়া যায়নি?’
‘না, কিচ্ছু না।’
‘সেই নোটটা কি পাওয়া যাবে?’
সমরেশ বলল, ‘সে তো প্রায় পঁয়ত্রিশ কি ছত্রিশ বছর আগেকার কথা। সে কি আর পাওয়া যায়। তুই কি সেই ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিস?’
মাথা তুলে বিক্রম পূর্ণদৃষ্টিতে সমরেশের দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় বলল, ‘আমাদের? এটা কি গৌরবে বহুবচন? তোর সঙ্গে নয়, আমি মিসেস দত্তগুপ্তর সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।’
‘তবে তোরাই কথা বল। আমি একটু ঘুরে আসি।’
‘তুই কোথাও যাবি না। এখানেই থাকবি। তোদের বন্ধু মি. শিবেন সেন আমাকে বলেছেন যে তুই না থাকলে তোর স্ত্রী কোনো কথা বলবেন কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কাজেই তোকে থাকতেই হবে। তবে, শিবেনবাবু বলেছেন যে তোর নাকি যেকোনো আলোচনার মধ্যে আজেবাজে ফোড়ন কাটার স্বভাব আছে। কাজেই, আমি যখন কথা বলব তখন তোকে একেবারে স্পিকটি নট হয়ে থাকতে হবে।’
‘তুই এখানে আসবার আগে এষণায় গিয়েছিলি?’
‘হ্যাঁ। ওঁরাই তো আমাকে তোদের খবর দিয়েছেন। শিবেনবাবুও এলেন বলে। আমি তো ভাবতেই পারিনি যে তোর মতো একটা হাঁদাগঙ্গারামের স্ত্রী একজন অপরাধ-বিজ্ঞানী হতে পারেন।’
‘তুই তোর নামের পেছনে যে লম্বা একটা ল্যাজ লাগিয়েছিস, তাতে তুই আমাকে হাঁদাগঙ্গারাম বলতে পারিস। তবে ওই ল্যাজটা কেটে দিলে তোর যে কত বুদ্ধির বহর তা আমার বিলক্ষণ জানা আছে।’
দময়ন্তী হাসতে হাসতে বলল, ‘আপনাদের দুই বন্ধুর এই মিষ্টালাপ
আপাতাত বন্ধ রেখে, আপনার সমস্যাটা কি সেটা বললে হয় না?’ ঠিক তখুনি সিঁড়িতে একজোড়া ভারী জুতোর আওয়াজ পাওয়া গেল।
***
দময়ন্তী বলল, ‘সবার আগে বলুন, আপনার বাবা এবং মা কী করতেন।’
বিক্রম পূর্ববৎ বললেন, ‘আমার বাবা ড. কৃষ্ণেন্দু দেবনাথ ছিলেন জিয়োলজিস্ট। সারাজীবন ভারত সরকারের জিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় চাকরি করেছেন। রিটায়ার করবার সময় উঁচু পদে ছিলেন। আর এই সুবাদে, পৃথিবীর যেখানে যত জনহীন মরুভূমি বা হিংস্র জন্তুজানোয়ার আর ভয়ংকর সাপখোপে ভরতি ঘন জঙ্গল বা বরফে ঢাকা বিপজ্জনক জায়গা আছে সেসব জায়গায়, ভগবান জানেন কীসের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেরেংগেটি থেকে সাইবেরিয়া, টঙ্গি থেকে টিম্বাকটু, কাঁহা কাঁহা সব মুল্লুক।’
‘আর, আপনার মা?’
‘আমার মা, অনুরূপা দেবনাথও কিছু কম যান না। কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরাজি সাহিত্যে এম এ আর সেযুগের ময়দানে ওরায়ন ক্লাস্কেটবল টিমের প্লেয়ার। বাবার সঙ্গে বহু জায়গায় ঘুরেছেন। বাবার কাজের জায়গার কাছে-পিঠে কোনো শহর থাকলে সেখানে ঘর ভাড়া করে থাকতেন। বাবা ভোরবেলা কাজে বেরিয়ে গেলে, বাড়ি বসে না থেকে তিনি ও সেই শহরে ঘুরে ঘুরে কোনো একটা কাজ জোগাড় করে তাই নিয়ে সময় কাটাতেন। এই করতে গিয়ে তিনি অ্যাঙ্গোলায় স্কুলে ইংরেজি পড়িয়েছেন। স্পেনে একটা বইয়ের দোকানে হিসেবপত্র রাখার কাজ করেছেন। ভিয়েতনামে টুরিস্ট গাইডের কাজ করেছেন। হোবার্টে বাস্কেটবল কোচ ছিলেন। দু-জনেরই অজস্র আর অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ওঁদের সঙ্গে সেইসব অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে শুরু করলে রাত কাবার হয়ে যেত।’
সমরেশ বলল, ‘তুই তখন কি করতি? ওঁদের সঙ্গে ঘুরতি?’ ‘হ্যাঁ, সাতবছর বয়েস পর্যন্ত। তারপরে আমাকে কার্সিয়াঙয়ে একটা মিশনারি স্কুলে ভরতি করে দেওয়া হয়। তারপরে আর ওঁদের সঙ্গে বিদেশে ঘোরাঘুরি হয়নি। ছুটিছাটায় হয় জামতাড়ায় আমার বাবার মামাবাড়িতে নয়তো টালিগঞ্জে ঠাকুরদার বাড়িতে থাকতুম। সেই সময় বাবা-মা নিজেরাই আসতেন আমার সঙ্গে থাকতে।
‘এখন আমার পরিচয়। আমি থাকি জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে। সেখানে স্টুটগার্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। এ ছাড়া আমার স্ত্রী সুনীতা ওখানে একটা কফিশপ চালায় যেখানে ভারতীয় খাবারও পাওয়া যায়। সেটার অনেক খদ্দের। বেশ ভালোই চলে। আমরা ওদেশে একটা ছোটো দোতলা বাড়িও কিনেছি। এখন আমরা পুরোপুরি জার্মান নাগরিক।
‘গত তিন বছর যাবৎ আমাদের একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে যার হাত থেকে আমরা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে চাই। ‘সমস্যাটা হল, কোনো এক কলকাতার ব্যবসায়ী আমাদের কলকাতার বাড়িতে গিয়ে ভাড়াটের ওপরে হামলা করছে আর বলছে যে তিনি যেন আমাদের বলেন, যে আমাদের এখন উচিত জার্মানির পাট চুকিয়ে কলকাতায় গিয়ে পৈত্রিক বাড়িতে থাকা। রীতিমতো চোখরাঙানি, ধমকাধমকি, এমনকী ভয় দেখানো পর্যন্ত।
‘আশ্চর্য তো! এই বাড়িটা কোথায়?’
টালিগঞ্জ টেরাসে। রিটায়ার করবার সময় বাবা বাড়িটা কিনেছিলেন। দোতলা বাড়ি। একতলায় একজন সাহিত্যিক, রামকুমার গাঙ্গুলী, ভাড়া থাকেন। অত্যন্ত সজ্জন লোক। কোনো ঝামেলা-টামেলার মধ্যে নেই। দোতলাটা তালা বন্ধ থাকে। চাবি থাকে গাঙ্গুলীবাবুর কাছে। আমরা মাঝে মাঝে যখন যাই, উনি ঘরদোর পরিষ্কার করে রাখেন।’
দময়ন্তী জিজ্ঞাসা করল, ‘এই ব্যাবসাদারটি কে? কীসের ব্যাবসা?’ ‘এঁর নাম মনীশ সাধু। ইনি জার্মানি থেকে বড়ো বড়ো পাওয়ার লুম আর অন্যান্য টেক্সটাইল মিলের যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। কলকাতার তালতলার ছেলে, এখন ব্যাবসার সুবিধের জন্যে মুম্বাই-প্রবাসী।’
ইনি আপনার ভাড়াটেকে বাড়িটা ছেড়ে দিতে বলছেন না?’ ‘না। রামবাবুরা একতলায় থাকলে তার কোনো আপত্তি নেই । কিন্তু, দোতলাটা খালি থাকলেই তাঁর ভয়ানক আপত্তি। ওখানে যে মালিক, তাকেই থাকতে হবে। এবং থাকতেই হবে।’
সমরেশ বলল, ‘তোর মনীশ সাধু কোথাকার কোন হরিদাস পাল রে? কলকাতার কোন বাড়ির মালিক তাঁর নিজের বাড়িতেই থাকবেন, নাকি আস্তানানারিভোর কোনো এঁদো গলির একটা পোড়োবাড়িতে থাকবেন, সেটা তিনি স্থির করে দেবেন? কলকাতা শহরটা ওই হরিদাসবাবুর জমিদারি না বাপের সম্পত্তি? পাগল না গাধা?’
বিক্রম হাত নেড়ে বলল, ‘আহা, সেটাই তো রহস্য। আমি জার্মানি ছেড়ে কলকাতায় এসে থাকলে এই লোকটার যে কী সুবিধে হতে পারে, সেটাই তো আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আমি গাঙ্গুলীবাবুর চিঠি পেয়ে প্রথমে তোর মতোই কোনো ছিটগ্রস্তের পাগলামি ভেবেছিলুম। পাত্তাই দিইনি। কিন্তু, ব্যাপারটা এখন ক্রমশ ঘোরালো হয়ে উঠেছে। গাঙ্গুলীবাবুকে রীতিমতো প্রাণের ভয় দেখানো হচ্ছে।’
এতক্ষণ শিবেন মনোযোগ দিয়ে তার ডায়েরিতে কীসব নোট করছিল। মুখ তুলে বলল, ‘আপনি গাঙ্গুলীবাবুকে বলে দিন যে তাঁকে একটু সাবধানে চলাফেরা করতে। বাড়িতে দরজা-জানলা বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকার দরকার নেই। তবে অস্বাভাবিক কোনো কিছু দেখলে যেন সঙ্গেসঙ্গে থানায় খবর দেন। আমি এখুনি লোকাল থানাকে খবর দিচ্ছি। ওরা ওঁর বাড়ির ওপরে আর ওঁর চলাফেরার ওপরে নজর রাখবে।’
‘সেটা ঠিক আছে। তবে, আমরা আসবার সঙ্গে সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী দরজায় তালা মেরে মুর্শিদাবাদে ওনার দেশের বাড়িতে চলে গেছেন।’ ‘আপনারা কি টালিগঞ্জ টেরাসের বাড়িতেই উঠেছেন?’
‘না। হোটেলে উঠেছি। সুনীতা একটু নার্ভাস প্রকৃতির। ভয় পেলে উলটোপালটা কিছু করে বসতে পারে।’
‘ভালোই করেছেন। এখন তাহলে শুধু আপনার বাড়ির ওপরে নজর রাখলেই হবে। যাই হোক, এই মনীশ সাধুর আমি খোঁজ লাগাচ্ছি। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং, কি বলেন, বউদি? নিন, এবার আপনার প্রশ্নমালা শুরু করে দিন।’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘বেশ। আমার প্রথম প্রশ্ন, আপনার ছেলে-মেয়ে ক-টি?’
বিক্রম বললেন, ‘একটি ছেলে। তার নাম অর্জুন। সে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলাইনা ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে সেখানেই রিসার্চ-স্কলার হয়ে কাজ করছে।’
‘বিয়ে-থা করেছে?’
‘না। তবে মনে হচ্ছে, তার আর দেরি নেই। একটি গার্লফ্রেন্ড আছে।’ ‘আপনার আর কোনো ভাই বা বোন আছেন?’
‘আমার এক দাদা আছেন। আমার থেকে দু-বছরের বড়ো। আমরা এক স্কুলে পড়েছি, এক হোস্টেলে থেকেছি। স্কুলের পরীক্ষা পাশ করে উনি গেলেন ডাক্তারি পড়তে। বউদি মারা যাবার পর, এখন সংসার ত্যাগ করেছেন। মহাগুরু মহাদেবানন্দজির নৈনিতালের আশ্রমে থাকেন আর সাধন ভজন করেন। ‘
‘এখন তাঁর নাম কী হয়েছে?’
‘সঠিক জানি না। বোধ হয় মহাপ্রেমানন্দজি।’
‘আপনার বাবা-মার মৃত্যুসংবাদ তাঁকে দিয়েছিলেন?’
‘অবশ্যই। তিনি কোনো উত্তরও দেননি, আসেনওনি। মনে হয়, তিনি এখন সাধনার অনেক ওপরের স্তরে পৌঁছে গেছেন। এসব তুচ্ছ খবরে তিনি আর বিচলিত হন না।’
শিবেন জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার দাদা যখন সংসারে ছিলেন, তখন তাঁর নাম কী ছিল
‘ডাক্তার শৌর্য দেবনাথ।’
‘কোথায় প্র্যাকটিস করতেন?’
লিলুয়া স্টেশনের কাছে একটা ওষুধের দোকানে বসতেন। এর বেশি আমি আর কিছু জানি না।’
‘লিলুয়া? টালিগঞ্জ থেকে লিলুয়া? কেন?’
‘লিলুয়ায় ওঁর শ্বশুরবাড়ি। বিয়ের পরে বউদির সঙ্গে বাবা-মায়ের বনিবনা হল না। তাই দাদা টালিগঞ্জ ছেড়ে লিলুয়ায় চলে গিয়েছিলেন।’
দময়ন্তী আবার আলোচনায় ফিরে এল। বলল, ‘ওনার ছেলে-মেয়ে?’
‘একটি মেয়ে। তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সে তার স্বামীর সঙ্গে আমেদাবাদে থাকে।’
‘এই মনীশ সাধুকে আপনি কখনো দেখেছেন?’
‘না। কোনোদিনও না। আমি দেশে এলে তিনি ভ্যানিশ হয়ে যান। তাঁর যত হম্বিতম্বি সব গাঙ্গুলীবাবুর ওপরে। গাঙ্গুলীবাবুর কাছে শুনেছি, লোকটা খুব সম্ভবত অবাঙালি যদিও তাঁর বাঙলায় একটু টান থাকলেও প্রায় নির্ভুল। লম্বা-চওড়া চেহারা, মাথাভরা তেল চুকচুকে কালো চুল, সম্ভবত কলপ লাগান, গলার স্বর সরু, মেয়েলি। হাতের দশ আঙুলে কুড়িটা আংটি। সবসময় সুট পরে থাকেন।’
সমরেশ বলল, ‘তোর মতো?’
‘তোকে না বললুম ফোড়ন না কাটতে? আর শোন, আমি শীতকাল বলে সুট পরে আছি, বুঝলি? সে যাকগে, ভদ্রলোকের চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। রেগে গেলে চশমা খুলে ফেলেন।’
দময়ন্তী বলল, ‘বেশ। এবার বলুন সাহিত্যিক রামকুমার গাঙ্গুলীর কথা। কীরকম লোক? উনি কি শুধু সাহিত্য করেই সংসার চালান?’ ‘রামকুমার গাঙ্গুলী একজন নেহাতই গোবেচারা শান্তশিষ্ট মানুষ।
ওনার সহিত্য ছাড়াও স্কুলে পড়ানো আছে, আর আছে প্রাইভেটে ছাত্র পড়ানো। তিন-চার জন ছাত্র তাঁর কাছে অঙ্ক পড়তে আসে। বোধ হয় তাঁর দেশে কিছু জমিজমা আছে। সেখান থেকেও কিছু রোজগার হয়। আর উনি নিজে গোবেচারা হলে কী হবে? টাইফুন ছদ্মনামে যেসব রগরগে রোমহর্ষক প্রেমকাহিনির উপন্যাস লিখে থাকেন, সেগুলো নাকি ভালোই বিক্রি হয়।
‘রামকুমারবাবু কোন স্কুলে পড়ান?’
‘বোড়ালের শিবকান্তি সরকার স্মৃতি বিদ্যামন্দিরে।’
‘মনীশ সাধুর যে বর্ণনা আপনি দিলেন, সেটা কি রামকুমারবাবুর কাছ থেকে পাওয়া?’
‘হ্যাঁ।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দময়ন্তী বলল, ‘আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা করবার নেই। আপাতত।’
***
ড. বিক্রম দেবনাথ। বিদীয় নিবার পর ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল সমরেশ। বলল, ‘বিক্রম অনেক পালটে গেছে। আগে খুব হাসিখুশি ছিল। ক্লাসে যা চ্যাংড়ামো করত! এখন একটা গোমড়াথেরিয়াম হয়ে গেছে।’
শিবেন বলল, ‘তুই কি আশা করেছিলি বিক্ৰমবাবু আগে যেমন ছিলেন, এখনও তেমনি থাকবেন? একটা জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ার প্রফেসার লারেলাপ্পা গাইতে গাইতে ঘরে ঢুকে কলেজের চ্যাংড়া ছাত্রের মতো নৃত্য শুরু করে দেবেন? তুই না আর বড়ো হলিনে। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকতে চলল, এখনও কচি খোকাই রয়ে গেলি।’
দময়ন্তী কাপপ্লেটগুলো ওঠাতে ওঠাতে বলল, ‘গোমড়াথেরিয়ামই বলো আর যাই বলো, ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনে কিন্তু আমার মনে হল গাম্ভীর্যটা জোর করে এনে বসানো। মাঝে মাঝেই তাঁর পেছন থেকে ওঁর ফেলে আসা ছাত্রজীবনটা উঁকিঝুঁকি মারছিল। আমি না থাকলে হয়তো সেটা পুরোনো ফর্মেই বেরিয়ে আসতো।’
সমরেশ কোনো কথা বলল না। চিন্তিতমুখে চুপ করে বসে রইল।
রান্নাঘর থেকে দময়ন্তী বেরিয়ে এসে শিবেনকে বলল, ‘আপনি সব ক-টা পয়েন্ট ডিটেলে নিয়েছেন তো? আপনার খাতাটা একবার দিন তো।’
শিবেন তার ডায়েরিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, দেখে নিন । আমি কিন্তু সমরেশের সঙ্গে দু-হাত দাবা খেলেই চলে যাব। রমলা অনেক রান্না করেছে আজকে। এখান থেকে খেয়ে গেলে আমাকে মার খেতে হবে।’
‘জানি। আমরাও যাচ্ছি আপনার সঙ্গে। রমলা আজ সকালেই আমাদের যেতে বলেছে।’ বলে, ডায়েরিটায় চোখ বুলিয়ে বলল, ‘সব ঠিকই আছে। কতদিনে এঁদের খবর পাওয়া যাবে?
‘দিন দশেক তো লাগবেই।’ সমরেশ বলল, ‘তোদের যত লোক আছে, লাগিয়ে দে। বিক্রম কিন্তু আগামী সপ্তাহের পরের সপ্তাহে, খুব সম্ভবত বৃহস্পতিবার, জার্মানি ফিরে যাবে।’
‘দেখছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খবর জোগাড় করছি।’
***
তিন দিন পার হতে না হতেই, শিবেনের ফোন এল। বলল, ‘শুনুন বউদি, ভয়ংকর ঘটনা। গতকাল বিক্রমবাবু আর তাঁর স্ত্রী ময়দানে মর্নিং ওয়াকে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের কেউ গুলি করে। দুই রাউন্ড গুলি চলেছিল। মিসেস দেবনাথের গায়ে লাগেনি কিন্তু বিক্রমবাবুর কোমরের নীচে দুটো গুলিই লেগেছে। তাঁকে সঙ্গেসঙ্গে খিদিরপুরের ক্যালকাটা লাইফ নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। কাল বিলেক পর্যন্ত খবর হল, বিক্রমবাবুর শরীর থেকে গুলি দুটো অপারেশন করে বের করা হয়েছে। কিন্তু, ভদ্রলোকের দুটো পা-ই অবশ হয়ে গিয়েছে। সেটা আর ভবিষ্যতে কোনোদিন সারবে কি না, ডাক্তাররা সে বিষয়ে এখনই কিছু বলতে রাজি হচ্ছেন না। ফিজিওথেরাপি শুরু হবে কিছুদিন পরে।’
দময়ন্তী উদবিগ্ন হয়ে বলল, ‘বিক্রমবাবুর স্ত্রীর খবর কি? তিনিও কি হাসপাতালে?’
‘হ্যাঁ, মাঠের ওপরে দৌড়তে গিয়ে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছেন। আপাতত, স্বামী-স্ত্রী একই কেবিনে আছেন। পুলিশ তাদের চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দিচ্ছে। পুলিশের সন্দেহ, তাঁদের ওপরে আবার হামলা হতে পারে। বিদেশের নাগরিক তো। কাজেই, এর পরে আবার হামলা হলে, ব্যাপারটা বহুদূর গড়াবে।’
‘ঠিক। ব্যাপারটা আমি যতটা হালকা ভেবেছিলুম, ততটা দেখছি নয়। বিক্রমবাবু আর তাঁর স্ত্রী তো এর আগেও অনেকবার দেশে এসেছেন। তখন তো এ-রকম কিছু ঘটেনি। মনে হচ্ছে, কেউ তাঁদের ওপরে দিনরাত্রি নজর রাখছে। বিক্রমবাবুর আপনাদের এষণায় যাওয়াটাই বোধ হয় কাল হল।’
.
‘হতে পারে। আরও অনেক কিছুই হতে পারে। ঠিক আছে, আমি আজ সন্ধে সাতটা নাগাদ আপনাদের ওখানে যাচ্ছি।’ ‘আসুন। রমলাকেও নিয়ে আসুন। তখন সব কথা হবে।’
সস্ত্রীক শিবেন সাতটা নাগাদই এল। হাতে একটা ফাইল। চা খেতে খেতে বলল, ‘এই দু-দিনে বেশ কিছু খবর জোগাড় করা গেছে। প্রথমত, মনীশ সাধু। এই নামের কোনো এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যাবসাদারের কথা মুম্বাই পুলিশের জানা নেই। বিশেষত, টেক্সটাইল মিলের বড়ো বড়ো যন্ত্রপাতি যাঁরা আমদানি করেন তাঁদের মধ্যে এই নামের কেউ নেই। আমার থেকে কয়েক বছরের জুনিয়ার এক বন্ধুস্থানীয় মুম্বাই পুলিশের অফিসার, নাম সতীশ গাইতোন্ডে, আমাকে জানিয়েছে। কিন্তু, একনাথ সাধু বলে একজন এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের লোক আছে। সে একটা আদ্যন্ত ক্রিমিনাল। বহুবার জেল খেটেছে। তাতে তার চরিত্রে কিছুমাত্র সংশোধন হয়েছে বলে মনে হয় না। খুব ধোঁয়াটে একটা চরিত্র। কখন কোথায় থাকে আর কোথায় উদয় হয়, বলা খুব মুশকিল। সম্প্রতি পুলিশ তাকে খুঁজছে কারণ নাগপুরের একটা মিউজিয়াম থেকে একটা অত্যন্ত মূল্যবান মূর্তি চুরি করে সে বিদেশে পাচার করেছে বা করতে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। লোকটা এখন ভারতে আছে কিন্তু, যথারীতি, কোথায় যে আছে তা কেউ জানে না।’
দময়ন্তী বলল, ‘এই সাধুব্যক্তিটি কি শুধুই আমাদের পুরাকীর্তিগুলো বিদেশে পাচার করে থাকে, না আরও কিছু তার লিস্টে আছে?’ ‘সে অতি সুবোধ বালক। যাহা পায়, তাহাই খায়। কোনোরকম বাছবিচার আছে বলে মনে হয় না।’
‘ভালো কথা। তারপরে বলুন।’
‘এরপরে ড. কৃষ্ণেন্দু দেবনাথ। ইনি খুবই পণ্ডিত লোক ছিলেন। জি এস আই-তে খুব বড়ো পোস্টেও ছিলেন। কিন্তু রিটায়ার করবার বছর দশেক আগেই কোনো অজ্ঞাত কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় পাকাপাকিভাবে চলে আসেন। তাঁর চেয়ে অনেক জুনিয়ার অফিসার যাঁরা তাঁদের তিনি নাকি তাঁর কর্মক্ষেত্রের ভেতরের কোনো কাজকর্ম অপছন্দ হওয়ায় পদত্যাগ করেছিলেন।
.
‘মিসেস অনুরূপা দেবনাথ সম্পর্কে বিশেষ কোনো খবর পাওয়া যায়নি। জামতাড়ায় বিহার পুলিশের কাছে খোঁজ নিয়ে কোনো লাভ হয়নি। ওখানে যে ক-টি বাঙালি পরিবার এখনও টিকে আছে তাদের কারোরই নাকি ওই নামের কোনো মেয়ের নাম জানা নেই। মনে হয়, আজ থেকে বহু বছর আগে মিসেস দেবনাথের বাপের বাড়ির পরিবার ওখান থেকে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। আর কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে ওই নামের কোনো ছাত্রীর কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি।’
সমরেশ বলল, ‘তুইও যেমন। আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেকার রেকর্ড কখনো থাকে?’
‘তুই মনে হয় ঠিকই বলেছিস। কিন্তু আমার একটা জায়গায় খটকা লাগছে। তোর বন্ধু তার মায়ের বিষয়ে যা যা বলেছেন, সেগুলো ঠিক মিলছে না।’
দময়ন্তী হেসে উঠে বলল, ‘আপনার এ-রকম মনে হচ্ছে কেন?’ ‘তার কারণ, যে মা একজন স্পোর্টসপারসন, সারা পৃথিবী ঘুরেছেন, স্বেচ্ছায় যত্রতত্র ছোটোখাটো চাকরি করেছেন, তাঁকে আমরা নিশ্চিতভাবে একজন মুক্তচিন্তার মহিলা বলে ধরে নিতে পারি। সেই মহিলা তাঁর উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশযাত্রী ছেলেকে বলতে পারেন কখনো যে ওখানে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে মিশো না, খেলাধুলো কোরো না, পড়াশুনো ছাড়া অন্য কোনোদিকে মন দিও না? এটা কখনো সম্ভব?’
সমরেশ বলল, ‘এমন তো হতে পারে যে তাঁর স্বামী হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর তাঁরা গভীর অর্থকষ্টে পড়েছিলেন আর সেইজন্যে চাইছিলেন যে ছেলে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এসে সংসারের ভার নিক।’
‘তোর মুণ্ডু। এমন বোকার মতো কথা বলিস না তো। ওরে গাধা, একজন ইংরাজিতে এম এ, বাস্কেটবল প্লেয়ার, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে স্কুল লেভেলে বাস্কেটবলে কোচিং-এর অভিজ্ঞতা যাঁর পকেটে, তিনি কলকাতার কোনো স্কুল বা কলেজে একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলেন না? এই ডাকাবুকো মহিলা অ্যাঙ্গোলার সিংহ বা হাতি আর অস্ট্রেলিয়ার টাসমেনিয়ান ডেভিলের দল তাড়িয়ে চাকরি পেলেন আর শান্তশিষ্ট ভারতবর্ষে ফেল করে গেলেন? তার পরে না খেতে পেয়ে আত্মহত্যা করে বসলেন?’
‘ঠিক আছে, তোর কথা না-হয় মেনে নেওয়া গেল। সেক্ষেত্রে, বিক্রম মিথ্যে কথা বলেছে, বলতে হয়। তাহলে, তুই বল যে কোথাও কিছু নেই, খামোখা বিক্রম মিথ্যে কথা বলল কেন?’
শিবেন দত্তবিকাশ করে বলল, ‘তা আমি কী করে বলব? আমার সঙ্গে পরামর্শ করে তো আর বলেনি। যেমন তুই, তেমনি তোর বন্ধুরা। আচ্ছা বউদি, আপনি বলুন তো, এই মহিলার উলটোপালটা ব্যবহারের সঙ্গে মনীশ সাধুর রহস্যের কি কোনো যোগাযোগ আছে? যদি না থাকে, তাহলে কি আমরা ব্যাপারটা আমাদের তদন্ত থেকে ছেঁটে দিতে পারি?’
দময়ন্তী চিন্তিতমুখে বলল, ‘সেটা এই স্টেজে বলা শক্ত। আরও কিছু খোঁজখবর নেওয়া দরকার। আর এই ব্যাপারটা সম্বন্ধে আমি বলতে পারি যে ওঁর স্বভাবে যদি এতটা পরিবর্তন হয়েই থাকে, তাহলে সেটা কোনো একটা প্রবল মানসিক বিপর্যয়ের ফলেই হয়েছে, তাতে সন্দেহ থাকে না।’
সমরেশ বলল, ‘সে আবার হয় নাকি? কথায় বলে স্বভাব যায় না মলে আর ইল্লত যায় না ধুলে।’
শিবেন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তুই থামবি? সিরিয়াস কথা হচ্ছে, তার মধ্যে ইনি এলেন যত ঠাকুমার ছড়া নিয়ে। হ্যাঁ বউদি, এটা একটা ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট। কোনো কারণে, বিক্রমবাবুর মায়ের মেন্টাল ব্রেকডাউন হয়ে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে, তিনি অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েন আর সবসময় সন্ত্রস্ত থাকেন। তাঁর চরিত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন আসে। আর, ছেলের কাছ থেকেই তিনি সাহস সংগ্রহ করেন।’
দময়ন্তী বলল, ‘ঠিক বলেছেন। এখন আমাদের জানা দরকার যে কী সেই কারণ যার জন্যে মিসেস দেবনাথের এমন ভয়ংকর মানসিক বিপর্যয় হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে সেই কারণ আজও বিদ্যমান আছে আর তার জন্যেই সমরেশের বন্ধ আর তার স্ত্রী এখন হাসপাতালে শয্যাশায়ী।’
‘তাহলে এখন আমাদের কী কর্তব্য?’
‘স্পষ্টতই, হাসপাতালে গিয়ে বিক্রমবাবুর সঙ্গে একান্তে কথা বলা। এটা যদি তাঁর কোনো পারিবারিক গোপন কাহিনি হয়, তাহলে তিনি তাঁর স্ত্রীর সামনে সেই ব্যাপারে কোনো কথা বলতে নাও চাইতে পারেন।’
‘ঠিক। তাহলে, আমি এখনই হাসপাতালে যোগাযোগ করে সমরেশের বন্ধুর সঙ্গে, তাঁর স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে, একটা আলোচনার ব্যবস্থা করছি।’
‘তার আগে বলুন, আর কী খবর পেলেন?’
‘আর একটা ছোটো খবর আছে। বোড়ালে যে স্কুলে রামকুমারবাবু পড়ান, সেখানে খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল, সব ঠিকই আছে, কেবল উনি যে একজন মুর্শিদাবাদের লোক সেটা ওঁর সহকর্মীরা কেউ জানতেন না।’
‘এটা কোনো ব্যাপার নয়। হতে পারে, ওঁর পরিবার হয়তো পূর্ববাংলা থেকে বর্ডার পেরিয়ে মুর্শিদাবাদে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আজ এত বছর বাদেও, তিনি মুর্শিদাবাদকে নিজের দেশ বলে মেনে নিতে পারেননি। সে যাই হোক, এই ভদ্রলোকটি সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নিন। এই মনীশ সাধুকে তো একমাত্র তিনিই দেখেছেন। মনীশ বলে সত্যি সত্যি কেউ আছে কি না সেটা জানতে গেলে তার সাহায্য ছাড়া তো অন্য উপায় নেই। কাজেই ওঁকে একটু বাজিয়ে দেখুন।’
‘আর একটা কথা। টালিগঞ্জ টেরাসের লোকেদের কাছ থেকে এই দেবনাথ আর গাঙ্গুলী পরিবার দুটো সম্পর্কে মতামত যতটা পারেন জোগাড় করুন।’
শিবেন একটা সিগারেট ধরিয়ে ফাইল পড়তে পড়তে বলল, ‘সেটা কিছুটা করেছি। বলছি সেটা।’
‘এই টালিগঞ্জ টেরাস রাস্তাটা একটা কানাগলি। চারু অ্যাভেনিউ থেকে বেরিয়েছে। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত লোকেদের বেশ পুরোনো পাড়া। বিক্রমবাবুর বাড়িটা টালিগঞ্জ টেরাসের একদম শেষে। রাস্তাটা গিয়ে শেষ হচ্ছে একটা তিনতলা গার্লস স্কুলবাড়ির দশফুট উঁচু পাঁচিলে। তার ওপাশে একটা দশফুট চওড়া বাঁধানো প্যাসেজ। সেখানে স্কুলের গোটা তিনেক বাস আর তাদের ড্রাইভার আর ক্লিনাররা থাকে। আর, টালিগঞ্জ টেরাসে বিক্রমবাবুর বাড়ির উলটোদিকে একটা একেবারে বাচ্চাদের গানের স্কুল। ফলে, মোটামুটি শান্ত পাড়া।’
‘বাড়িটা বিশাল পুরোনো, মোটা মোটা দেওয়াল, খুব শক্তপোক্ত দোতলা। এর উত্তরে উমেশচন্দ্র স্মৃতি হায়ার সেকেন্ডারি গার্লস স্কুল, পুব দিকে অন্য পাড়ার বাড়ি, দক্ষিণ দিকে পাড়ার পাশের বাড়ি আর পশ্চিম দিকে রাস্তা আর গানের স্কুল। তবে, বাড়িগুলো ঘিঞ্জি নয়। সব বাড়িতেই সামনে পেছনে একফালি করে ছোটো বারান্দা আর ছোটো বাগান আছে। আর খুব কম বাড়িতেই গ্যারেজ আছে।’
‘এবার আসছি পাড়ার লোকেদের কথায়।’
সমরেশ হাই তুলে বলল, ‘বাঁচালি, বাপ। তোর এই বাড়িনামা এই বছরে শেষ হবে বলে তো মনে হচ্ছিল না।’
শিবেন সমরেশের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল, তবে কিছু বলল না। দময়ন্তীকে বলল, ‘বিক্রমবাবুর সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী, মানে পাশের বাড়ির চন্দ্রমোহন মৌলিকের বয়েস সত্তরের ওপরে। ওনার ডালহৌসি স্কোয়ারে ছোটো একটা স্টেশনারি দোকান ছিল। বছর পনেরো আগে দোকানের সামনে বাস থেকে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান। দুটো পা-ই ভেঙে গিয়েছিল। একটা পা ঠিক হয় কিন্তু অন্যটা আর হয় না। কাজেই তখন দোকানের ভার তাঁর ভাগনের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজে সারাদিন বাড়িতে বসে থাকতে শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবেই, তিনি পাড়ার সমস্ত ঘটনাবলির খবরাখবর রাখেন।’
‘এই চন্দ্রমোহন বা চাদুবাবুর কাছে জানা গেল যে বিক্রমবাবুর বাবা, কৃষ্ণেন্দু বা কেষ্টবাবু আর তার স্ত্রী তাদের দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁর পাশের বাড়িতে আসেন তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে। ছেলে দুটির বয়েস তখন ছিল মোটামুটি চব্বিশ আর তিরিশ। এই ছেলেদের বিবরণ আমরা আগেই পেয়েছি।’
‘কেষ্টবাবু ছিলেন মাটির মানুষ। অত্যন্ত শান্তশিষ্ট, নীচু গলায় কম কথা বলতেন। তাই বলে গোমড়ামুখো রামগড়ুরের ছানা ছিলেন না। পুজোর সময় হাসিমুখেই চাঁদা দিতেন। শোনা যায়, তিনি নাকি মাটি নিয়ে গবেষণা করতেন। তার জন্যেই হয়তো তাঁর স্বভাবটা সেই রকমই হয়ে গিয়েছিল।’
সমরেশ বলল, ‘সর্বনাশ। তাহলে তো তোকে একদিন হাতে হাতকড়া পরে জেলে গিয়ে ঢুকতে হবে।’
নির্বিকার শিবেন সমরেশকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, ‘কেষ্টবাবুর স্ত্রী অনুদি বা মিসেস অনুরূপা দেবনাথ একটু অন্য ধরনের মহিলা ছিলেন। বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা ছিল। এমনিতে ভদ্র, সভ্য, মার্জিত, নিরহংকার কিন্তু রেগে গেলে যেন কেমনধারা হয়ে যেতেন। তখন দিগবিদিক জ্ঞান থাকত না। তবে, সে রকম ঘন ঘন তো হত না, বরং খুব কমই হত। এমনিতে সেই মহিলা ঘরোয়াই ছিলেন। বাড়ি থেকে কালেভদ্রে বেরোতেন। বাড়িতে একটি মাত্র কাজের লোক ছিল। রান্নাবান্না, ঘর পরিস্কার করা এসবই বোধ হয় সেই করতেন। মিসেস দেবনাথ সবসময় বই পড়তেন। খুব বই কিনতেনও। কেষ্টবাবু কিনে আনতেন। উনি একেবারেই মিশুকে ছিলেন না। পাড়ার মহিলারা ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করে দেখেছেন। পারেননি। চাঁদুবাবু এঁদের কাছে শুনেছেন যে মিসেস দেবনাথের স্বভাবটা ঠিক সাধারণ গৃহস্থ বাঙালি মহিলাদের মতো ছিল না। উনি ছিলেন অনেকটা যেন মেমসাহেব মেমসাহেব। আলগোছে থাকতে চাইতেন।’
দময়ন্তী বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। এবার বলুন, চন্দ্রমোহনবাবু দেবনাথদের আত্মহত্যা করবার কারণ সম্বন্ধে কিছু বললেন।’
‘অনেক কিছু বললেন। তবে, বোঝাই গেল যে তার অনুমান মিসেস দেবনাথ ছিটগ্রস্ত ছিলেন। অর্থাৎ, এ ব্যাপারে বিক্রমবাবু যে তিমিরে, উনিও সেই তিমিরে। তাহলেও উনি যা বলেছেন, শুনুন। হয়তো, এই না বোঝার ভেতর থেকেই সত্যিটা বেরিয়ে আসতে পারে।’
‘প্রথমত, দেবনাথদের মধ্যে সম্পর্কটাও, ওই যে বললুম, আলগোছে ছিল। বাঙালি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে ন্যূনতম ঘনিষ্ঠতা আমরা আশা করি, সেটুকুও নাকি তাঁদের মধ্যে দেখা যেত না।
‘দ্বিতীয়ত, পাড়ার মহিলারা, যাঁরা কয়েক বার ওই বাড়িতে গেছেন, তাঁরা নাকি দেখেছেন যে মিসেস দেবনাথ, আগেই বলেছি, বাড়ির কোনো কাজই করতেন না। রান্নাঘরের দিকে তো কখনোই যেতেন না।
‘তৃতীয়ত, জনৈকা মিসেস রেখা চট্টোপাধ্যায়ের দৃঢ় ধারণা যে বাড়িতে ঘরের কোনো অভাব নেই। হয়তো, সেইজন্যেই দু-জনের শোবার ঘর আলাদা। ভদ্রলোকের ঘর একতলায় আর ভদ্রমহিলার ঘর দোতলায়। অবশ্যই, তার মানে এই নয় যে তাঁদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা কিন্তু সহজ আর স্বাভাবিক।
‘চতুর্থত, ভদ্রমহিলা খুব সুন্দর বাংলা বলেন, কিন্তু বাংলা পড়েন না। বসবার ঘরে প্রকাণ্ড আলমারি ভরতি বই কিন্তু তাদের সবকটাই ইংরেজি বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষার। এমনকী বাড়ির কোথাও কোনো ঠাকুর-দেবতার ছবি নেই ।
‘এইসব থেকে বোধ হয় স্বামী-স্ত্রী দু-জনেই নাস্তিক ছিলেন আর একটু বেশি রকমের অ্যাঙ্গলিসাইজড ছিলেন।
‘এখন আমি যা বুঝতে পারছি তাতে এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে এগুলো একত্রে বা একসঙ্গে কোনোমতেই এ-রকম মর্মান্তিক একটা জোড়া আত্মহত্যা ঘটে যাওয়ার কারণ হতে পারে না।’
দময়ন্তী বলল, ‘কেন পারবে না? তবে, সেই আলোচনায় যাবার আগে এই অনুরূপা দেবনাথের সম্পর্কে আরও খবর দরকার। আপনি যেখান থেকে হোক, যেভাবে হোক, যা খবর পান জোগাড় করুন।’
হঠাৎ রমলা বলে উঠল, ‘কী খবর?’
‘খবর হচ্ছে, আজ থেকে সত্তর কী পাঁচাত্তর বছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা ময়দানের ওরায়ন ক্লাবের অনুরূপা দেবনাথ নামের কোনো মেয়েকে আজ কারোর মনে আছে কি না?
‘তার মানে একজন থুবড়ো বুড়োকে ধরতে হবে।’ ‘ঠিক বলেছিস।’
‘তাই হবে।’
সমরেশ বলল ‘তোমার অসাধ্য কাজ নেই। জয় হোক।’
***
দু-দিন পরে বিকেলবেলা মহাখুশি রমলা আর শিবেন এল দময়ন্তীর কাছে। রমলার কাছে যা জানা গেল, সেটা এইরকম। রমলা আর শিবেন ঢাকুরিয়ার যে কমপ্লেক্সে থাকে সেখানে ‘নারীশক্তি সংঘ’ বলে একটা ক্লাব আছে। সেখানে শুধু তাস খেলা হয়। সেই ক্লাবে বর্ষীয়ান মেম্বার তিন নম্বর টাওয়ারের পুতুলদির বাবা কলকাতা পোর্টট্রাস্টের মহিম সান্যাল, যাঁর বয়েস এখন আশির কাছাকাছি তিনি যৌবনে পোর্টট্রাস্টের বাস্কেটবল টিমে নিয়মিত খেলতেন । তিনি রমলাকে জানিয়েছেন যে সেই সময়ে ওরায়ন তো দূরস্থান, ময়দানের কোনো ক্লাবেই অনুরূপা নামের কোনো মেয়ে খেলত না। তবে, বহুদিন আগে অ্যানা উইলিয়ামস নামে একজন খুব লম্বা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে ওযারন ক্লাবে বাস্কেটবল খেলত। তাকে তাঁর খুব ভালো করে মনে আছে কারণ সে ভয়ানক বদমেজাজি ছিল। একবার রেগে গিয়ে পোর্টট্রাস্টের মেয়েদের বাস্কেটবল টিমের কোচ মারি ডি’কস্টাকে বেধড়ক ঠেঙিয়েছিল।
দময়ন্তী অত্যন্ত খুশি হয়ে রমলাকে বলল, ‘ঠিক বলেছিল সমরেশ— তোর অসাধ্য কাজ নেই।’
শিবেন দম্ভবিকাশ করে বলল, ‘সত্যিই তাই। অনেকগুলো ধোঁয়াটে ব্যাপার পরিস্কার হয়ে গেল।’
সমরেশ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, ‘যথা?’
‘প্রথমেই ধর টালিগঞ্জ টেরাসের মহিলাদের বর্ণনা। তাঁদের লম্বা-চওড়া অনুদির সকলের সঙ্গে আলগোছে ব্যবহার, দূরত্ব রেখে চলা, বাড়িতে কোনো বাংলা বই না রাখা, ইত্যাদি। বোঝাই যাচ্ছে দীর্ঘদিন একজন বঙ্গসন্তানের ঘর করলেও তাঁর দুরন্ত ‘মেম মেম ভাব’ অপরিবর্তিত ছিল। আর তারপরে তোর বন্ধুর বয়ান মোতাবেক, সেই মহিলার স্বামীর সঙ্গে বিদেশে গিয়ে বেকার বাড়িতে বসে না থেকে অফিসে। অফিসে ঘুরে কাজ জোগাড় করা কোনো বিবাহিতা বাঙালি মেয়ের পক্ষে একেবারে অসম্ভব না হলেও, অত্যন্ত কঠিন কাজ। সে বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই । রমলার চেষ্টায় সেই ধোঁয়াটে ব্যাপারগুলো পরিস্কার হয়ে গেল।’
‘কী পরিস্কার হল? বোঝা গেল যে অনুরূপা দেবনাথের বিয়ের আগে পদবি ছিল উইম্বলডন আর তিনি কলকাতায় কোন মান্ধাতার আমলে এক উদ্ভট নামের ক্লাবে ভলিবল খেলতেন। তাতে তাঁর বাড়িতে এখন, এতদিন পরে, মনীশ নামক একজন লোক হামলা করছে কেন আর মিসেস দেবনাথ স্বামী সমভিব্যাবহারে আত্মহত্যাই বা করতে গিয়েছিলেন কোন দুঃখে? তিনি বাঙালি ছিলেন না অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছিলেন, এতে কী এসে যায়?’
দময়ন্তী হাসি চেপে বলল, ‘অনুরূপা দেবনাথের বিয়ের আগের পদবি ছিল উইলিয়ামস, উইম্বলডন নয় আর কম বয়েসে তিনি বাস্কেটবল খেলতেন ভলিবল নয়।’
‘ঠিক আছে। তাই হল। কিন্তু, আমার প্রশ্নটার উত্ত পাওয়া গেল না।’
‘এর উত্তর পেতে গেলে, আমাদের আরও কিছু খবর পাওয়া দরকার। আর, তার জন্যে বিক্রমবাবুর সঙ্গে আর একবার বসা একান্তই দরকার। শিবেনবাবু, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর একটা ব্যবস্থা করুন।’
শিবেন বলল, ‘সে ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আগামী শনিবার, বিক্রমবাবুর স্ত্রীকে যখন ফিজিওথেরাপির জন্যে নিয়ে যাওয়া হবে, তখন আমরা বিক্রমবাবুর সঙ্গে কথা বলে নেবার অনুমতি পেয়েছি। ক-টার সময় যেতে হবে, সেটা কাল জানিয়ে দেব আপনাকে। আমি শনিবার গাড়ি নিয়ে আসব।’
***
একটা সাদা চাদরে আগাপাস্তলা ঢেকে ক্লিষ্ট মুখে শুয়েছিলেন বিক্রম দেবনাথ। কিছুক্ষণ সৌজন্য বিনিময়ের পর দময়ন্তী বলল, ‘আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর চাই। আপনার পক্ষে যদি কোনো প্রশ্ন অস্বস্তিকর হয়, তাহলে উত্তর দেবার কোনো দরকার নেই।’
বিক্রম বললেন, ‘দেখুন ম্যাডাম, আমি যথেষ্ট অভিজ্ঞ, বয়স্ক আর শিক্ষিত লোক, আমার কাছে কোনো প্রশ্নই অস্বস্তিজনক হওয়া উচিত নয়। আপনি প্রশ্ন করুন, আমি আমার যথাসাধ্য উত্তর দেব।’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘বাঃ, সে তো খুব ভালো কথা। তাহলে আমার প্রথম প্রশ্ন।
‘আপনি কি জানেন যে আপনার মা বাঙালি নন?’
অবিচলিত বিক্ৰম বলল, ‘জানি। ওনার বিয়ের আগে পদবী ছিল উইলিয়ামস। বাবার সঙ্গে তাঁর কোথায় পরিচয় হয় সে বিষয়ে আমাকে কিছু বলা হয়নি। তবে, এটুকু শুনেছি যে উনি এম এ পাশ এবং বিয়ের আগে সেন্ট বার্নাডেট ডে-স্কুল ফর গার্লস-এ টিচার ছিলেন। সেখানে ইংরেজি সাহিত্য আর বাস্কেটবল শেখাতেন।’
‘উনি যে আপনাকে খুবই ভালোবাসতেন আর আপনার ওপরে নির্ভর করতেন, সে তো আপনার কথায় বুঝতেই পেরেছি। কিন্তু আমার ধারণা, আপনি আপনার ছাত্রজীবনের শেষ দিকে তার স্বভাব এবং চালচলনে একটা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ করেছিলেন। আমি কি ঠিক বলছি?’
বিক্রম কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল, ‘কে বলেছে আপনাকে?’
‘কেউ বলেনি। এটা আমার অনুমান। আপনারই কথা শুনে আমার এইরকম একটা ধারণা হয়েছে।’
আবার কিছুক্ষণ নীরবতার পরে বিক্রম বলল, ‘আপনার অনুমান সঠিক। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করবার পরে আমি বছর দুয়েক চাকরি করেছিলুম এল্টন ওহারা ইন্ডিয়া লিমিটেডে। থাকতুম টালিগঞ্জে ঠাকুরদাদার বাড়িতে। বাবা তখন আফ্রিকায় পোস্টেড ছিলেন। এইসময়ে আমি জার্মানিতে পড়াশুনো করবার স্কলারশিপটা পাই। ইতিমধ্যে বাবা যে কখন এবং কীভাবে ঠাকুরদাদার বাড়ির কাছেই টালিগঞ্জ টেরাসের বাড়িটা কিনে রেখেছেন আমি জানতেই পারিনি।’
‘কীরকম পরিবর্তন?’
‘দেখুন, আমার মা একজন বেশ সাহসী মহিলা ছিলেন। সুনীতার মতো নার্ভাস প্রকৃতির একেবারেই না। উনি বিপদ-আপদের খুব একটা পরোয়া করতেন না। এবারে দেখলুম ওনার প্রকৃতি একদম অন্যরকম। সবসময় কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকেন। বাড়ি থেকে পারতপক্ষে বের হন না। কেউ বাড়িতে কখনো এলে নিজে দরজা খোলেন না, বাবাকে বলেন খুলে দিতে। এরজন্যে, বাবা, কিছুদিন একতলা দোতলা করে শেষ পর্যন্ত একতলাতেই থাকা সাব্যস্ত করেছিলেন। একাই থাকতেন। মা থাকতেন দোতলায়।’
‘আপনার বাবার স্বভাবে কি পরিবর্তন এসেছিল?’
‘হ্যাঁ, বাবা যে খুব একটা গল্পে লোক ছিলেন, তা নয়। কিন্তু সেবারে দেখলুম একেবারেই নির্বাক আর অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছেন।’
‘ওনারা দু-জন কি মাঝে মাঝেই কোনো মন্দির বা চার্চ বা মিশনে যেতেন?’
‘আমি যে ক-টা দিন ওঁদের সঙ্গে ছিলুম, তখন একদিনও দেখিনি।’ ‘আপনার বাবার কাছে লোকজন বা আত্মীয়স্বজন আসতেন?’ ‘স্বভাবতই, আত্মীয়স্বজন কেউ আসতেন না। অন্য লোক কেউ কেউ আসতেন।’
‘তাঁদের সম্পর্কে কিছু মনে আছে?’
‘এঁদের, বেশির ভাগই ছিলেন বাবার মাইনে করা লোক যেমন, কেউ বাজার করে দিতেন, কেউ ছিলেন পাড়ার লন্ড্রির কর্মচারি, খবরের কাগজওয়ালা ইত্যাদি। একজন আসতেন সিভিল কনট্রাক্টর। উনি আমাদের বাড়ির দেখভাল করতেন। আর একজন আসতেন গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো বুড়ো ডাক্তার। তিনি মাঝে মাঝেই আসতেন। কাছেই ওনার বাড়ি আর তার একতলায় চেম্বার ছিল।’
‘ছিল কেনো? এখন আর নেই।’
‘না। বাবা-মা মারা যাবার পরে কয়েক বছরের মধ্যেই তিনিও মারা যান। তাঁর ছেলে আশু ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি করে ফ্রান্সের কোনো এক শহরে। সে তার পৈত্রিক বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে কলকাতার সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে।’
‘এই আশুর সঙ্গে আপনার কোনো যোগাযোগ আছে?
‘না। কোনো যোগাযোগ নেই।’
‘আপনার বাবা রিটায়ার করবার সময় কোথায় ছিলেন সেটা আপনার মনে পড়ে?’
‘হ্যাঁ, মধ্য-আফ্রিকার কঙ্গো নদীর ধারে গভীর জঙ্গলে ঘেরা মাসাবো বলে একটা ছোটো শহরে। সেখানে তখন খুব গোলমাল চলছিল। আইন-শৃঙ্খলার বালাই ছিল না। ডাকাতের দল সৈন্যবাহিনির ইউনিফর্ম পরে অকুতোভয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল।’
‘উনি অসময়ে রিটায়ার করেছিলেন কেন, সেটা জানেন?’
‘না। উনি সে ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেননি। মা-ও জানতেন বলে মনে হয় না। তবে, আমার ধারণা, বছরের পর বছর হিংস্র জানোয়ার আর হিংস্র মানুষ তাড়িয়ে পাহাড়ে, জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বোধ হয় বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।’
দময়ন্তী হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
বলে হনহন করে হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
***
গাড়িতে উঠে সমরেশ দময়ন্তীকে বলল, ‘কী হল? তুমি কথা নেই বার্তা নেই দুম করে উঠে চলে এলে কেন?’
গাড়ি চালাতে চালাতে শিবেন বলল, ‘রহস্যটা হঠাৎ ক্লিয়ার হয়ে গেল বলে। তাই না বউদি
দময়ন্তী কোনো জবাব দিল না। বলল, ‘শিবেনবাবু, বিক্রমবাবুর বাবার বাড়িতে যে সিভিল কনট্রাক্টর, বা ঠিকেদার, মাঝে মাঝে আসত, তাকে খুঁজে বের করতে পারেন? আমি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তার সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই।’
‘হয়তো বের করতে পারি। চন্দ্রমোহন মৌলিকের সাহায্য দরকার হবে। সেটা পাওয়া যাবে বলেই মনে হয়। কালই খোঁজ লাগাচ্ছি।’
‘যাবার আগে, আমার দুটো কথা শুনে যাবেন।’
***
দু-দিন পরেই শিবেন আর রমলা সন্ধে বেলা একজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত ভদ্রলোককে সঙ্গে করে এসে উপস্থিত। জানা গেল ভদ্রলোকটি সিভিল কনট্রাক্টর। ইনি অবাঙালি, নাম বললেন শঙ্করলাল দূবে। চমৎকার বাংলা বলেন, থাকেন কলেজ স্ট্রিটে মেডিকেল কলেজের উলটোদিকের একটা গলিতে।
দময়ন্তী প্রশ্ন করা শুরু করল, ‘মি. দুবে, আপনি ড. কৃষ্ণেন্দু দেবনাথকে কতদিন থেকে চিনতেন?’
প্রশ্নটা করা মাত্র শঙ্করলাল চমকে উঠলেন। একটু যেন সন্ত্রস্ত হলেন। বললেন, ‘কতদিন তা তো মনে নেই। মানে হিসেব করে বলতে হবে। তবে, আমাকে কাজের জন্যে ডাকার আগে তিনি বিদেশে ছিলেন। ফিরেই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।’
‘আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কে?’
‘সেটা আমি ঠিক বলতে পারব না। আমাকে একজন ফোন করেছিলেন। নাম বলেছিলেন, আমার যতদূর মনে পড়ে, শোভনা সমর্থ বা ওইরকম কিছু। হিন্দিতে কথা বলেছিলেন। উনি আমাকে বলেছিলেন যে উনি ড. দেবনাথের বন্ধু। ডক্টরসাহেব অনেকদিন বিদেশে ছিলেন, এখন রিটায়ার করে টালিগঞ্জে একটা বাড়ি কিনে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় থাকবেন, স্থির করেছেন। সেই বাড়িটাকে উনি রিপেয়ার রংচং করাতে আর কিছু ছোটোখাটো অ্যাডিশনও করাতে চান। কাজেই আমি যেন ডক্টরসাহেবকে একটা ফোন লাগাই।’
.
‘কী অ্যাডিশন করিয়েছিলেন?’
‘ম্যাডাম, সে আজ বহু বছর আগেকার কথা। সে কি আর আজ কিছু মনে আছে?’
‘নেই, না? থাকলে ভালো হত। যাই হোক, তার মধ্যে যা ছিল তা আজ আর নেই। চোর সব কাচিয়ে নিয়ে গেছে।’
‘বাজে কথা। তা হতেই পারে না।’
‘তাই হয়েছে। ডক্টরসাহেব আর তার স্ত্রী হঠাৎ মারা যাওয়ায়, বাড়িটা কিছুদিন খালি পড়ে ছিল। চোর সেই সময়েই এসেছিল । যে সে চোর তো নয়, আফ্রিকা থেকে এসেছিল।’
কিছু বলতে গিয়েই ঢোক গিলে, ভুরু কুঁচকে শঙ্করলাল বললেন, ‘আপনি আমার সঙ্গে দিলগি করছেন। আমাকে দিয়ে কিছু কথা বলিয়ে নিতে চান যা আমার আপনাদের বলা উচিত নয়, তাই না?’
দময়ন্তী হেসে উঠল। বলল, ‘না না, সে রকম কোনো খারাপ ইচ্ছে আমার নেই। বাড়ির মালিককে তো বলবেন?’
‘হ্যাঁ, তা তো বলতেই হবে। আপনার আর কোনো প্রশ্ন আছে?’ বলতে বলতে শঙ্করলাল উঠে দাঁড়ালেন। দেখা গেল তিনি বেশ ক্রুদ্ধ।
শিবেন বলল, ‘এক মিনিট। আমার একটা প্রশ্ন আছে। ওই বাড়ির মালিক যে এখন হাসপাতালে, সেটা জানেন তো?’
একটু থমকে গিয়ে শঙ্করলাল বললেন, ‘না, জানি না।’ বলে শঙ্করলাল প্রস্থান করলেন।
***
শিবেন বলল, ‘আপনি কি পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন।’
দময়ন্তী বলল, ‘না, সবটা বুঝেছি সে রকম কথা বলতে পারব না। কিছুটা, বলতে পারেন। আপনি কী বুঝেছেন, বলুন।’
‘আমি বুঝেছি যে ডক্টর কৃষ্ণেন্দু দেবনাথ খুব একটা সৎ লোক ছিলেন না। তাঁর মতো শিক্ষিত লোকের চরিত্রটা আর একটু উন্নত হওয়া উচিত ছিল।
‘এর পরে, তিনি কিছু একটা গোপন করছিলেন বা গোপন করে রেখেছিলেন। সেটা, যাই হোক, আপাতত আছে ওনার বাড়ির দোতলায় অথবা তিনতলার ছাদে চিলেকোঠা থাকলে সেইখানে কোনো গোপন জায়গায়। তার সন্ধান শঙ্করলাল বিলক্ষণ জানেন কারণ, তিনিই সেই গোপন জায়গাটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে যেতে পারছেন না কারণ একটা ঘনবিন্যস্ত পাড়ার মধ্যে বাসিন্দাদের না জানিয়ে সেটা করা সম্ভব নয়। তার ওপরে একতলার মাস্টার মশাইয়ের গলা টিপে ধরলে তিনি সুড়সুড় করে ওপরতলার চাবি দিয়ে দেবেন তা মনে হয় না। এই কারণে, একটা ডাকাতি করাও খুব কঠিন।’
সমরেশ বলল, ‘তুই বলছিস ডক্টর দেবনাথ আফ্রিকা থেকে মহামূল্যবান কিছু চুরি করে এনে বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলেন। শঙ্করলাল সেটা জানতেন। কিন্তু আইনসংগত পথে সেটা বাট পাড়ি করতে পারছেন না বলে এতবছর হাঁ করে বসে আছেন আর মাঝে মাঝে বিক্রমকে তার নিজের বাড়িতে এসে থাকার জন্যে পীড়াপীড়ি করে যাচ্ছেন। এই তো? তাহলে তো বলতে হয়, এই শঙ্করলাল ব্যাটাচ্ছেলে একটা আস্ত রামছাগল।’
শিবেন মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি একবারও বলিনি যে শঙ্করলাল জানতেন বা জানেন যে কি জিনিস ডক্টর দেবনাথ লুকিয়ে রাখতে চাইছেন। ধর, ডক্টর দেবনাথ আফ্রিকা থেকে একগাদা সোনার পাথরবাটি নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। তিনি একজন ঠিকেদার ডেকে তাকে বললেন যে, দ্যাখো, এই সোনার পাথরবাটিগুলো আফ্রিকা থেকে চুরি করে এনেছি, এখন এগুলো লুকিয়ে রাখার একটা ব্যবস্থা করে দাও তো হে। এরকম গাড়োলের মতো কথা আমি বলেছি যদি তুই ভেবে থাকিস, তাহলে তুই-ই একটা রামছাগল।’
দময়ন্তী বলল, ‘আপনাদের এই মনোগ্রাহী বাক্যালাপ বন্ধ করে একটু অন্য ব্যাপারে মন দিলে বোধ হয় ভালো হয়।’
লজ্জিত হয়ে শিবেন বলল, ‘সরি সরি, বলুন আপনি কী বলছিলেন।’
‘বলছিলুম, ডক্টর দেবনাথ কঙ্গো নদীর দুইধারে যে ঘন জঙ্গল আছে, সেইখানে কাজ করতে গিয়ে এমন কিছু একটা আবিষ্কার করেন, যার লোভ সামলানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেটা কি হতে পারে? আর, সেটা ওখানে এল কী করে?
‘আমরা জানি, কঙ্গো নদীর দুই পাড়ে কয়েকটা জায়গায়, পোর্তুগিজ জলদস্যুদের নদী-বন্দর ছিল। বিপদে পড়লে তারা ওখানে গিয়ে লুকিয়ে থাকত। তাদের শতাব্দী-প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ এখনও ওই সব এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সম্ভবত জঙ্গলে ঢাকা মাসাবো শহরের কাছে ওরকম কিছু একটা আছে। সেখানে কাজের সূত্রে গিয়ে ডক্টর দেবনাথ একটা বড়োসড়ো গুপ্তধনের সন্ধান পান। সেটা সেখানকার সরকারের হাতে তুলে না দিয়ে তিনি আত্মসাৎ করবার চেষ্টা করেন।
‘আত্মসাৎ করব বললেই তো আর করা যায় না। সেটা দেশে আনবেন কী করে? তিনি গেলেন এক চোরাই মালের কারবারির কাছে। তার কাছ থেকে তিনি বিরাট অঙ্কের টাকা পেলেন। টাকাটা সঙ্গে সঙ্গে হাওলার মাধ্যমে দেশে পাঠিয়ে দিলেন। এই অনুমান যদি ঠিক হয়, তাহলে বলতে হয় যে ডক্টর দেবনাথ সত্যিই একজন সৎ লোক ছিলেন না। এরকম অভিজ্ঞতা তাঁর আগে থেকেই ছিল।
‘কিন্তু তাঁর একটা হিসেবে মনে হয় ভুল হয়েছিল। এত বড়ো একটা খবর তো চাপা থাকতে পারে না। প্রথমে আন্ডারওয়ার্ল্ড, সেখান থেকে দেশের সরকারের কানে গেল ডক্টর দেবনাথের কীর্তির কথা। ডক্টর দেবনাথ নিশ্চয়ই ব্যাপারটা বুঝতেই পারেননি। পারলে তৎক্ষণাৎ, অন্তত মাসাবো থেকে পালিয়ে কোনো উন্নততর দেশে চলে যেতেন। কিন্তু কোথাও কোনো উত্তেজনা নেই দেখে বোধ হয় ভেবেছিলেন যে কেউ কিছু বুঝতে বা জানতে পারেনি। এত বড়ো একটা অপরাধ যে চাপা থাকতে পারে না সেটা ভুলে না গেলে শান্ত জলের নীচে ক্ষিপ্ত হাঙরদের হাতে পড়তেন না ।’
সমরেশ বলল, ‘তা তো বুঝলুম। কিন্তু এ সবই তো অনুমান। সলিড আদালতগ্রাহ্য প্রমাণ তো নয়৷’
‘তোমার কথা ঠিক তবে মনে রাখতে হবে যে অনেক সময় সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স আদালতগ্রাহ্য হয়। এক্ষেত্রে আমার অনুমানগুলো আকাশ থেকে পড়েনি। একের পর এক বলছি।’
বিক্রমবাবুর কথায় পরিস্কার বোঝা যায় যে, তার মা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা ছিলেন। এঁদের ফুর্তিবাজ, বহির্মুখী চরিত্র সাধারণত চট করে পালটায় না। আর ধর্ষণ ব্যাপারটা ভারতীয় মহিলারা যেরকম একেবারে সব-শেষ হয়ে-যাওয়া মৃত্যুর থেকেও খারাপ বলে ভেবে থাকেন এঁরা সে রকম মোটেই ভাবেন না। বরং, তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁদের নারীত্বকে অপমান বলে মনে করেন এবং গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার চেয়ে প্রতিশোধ নিতে নিজেকে তৈরি করেন।’
‘ধর্ষণ? ধর্ষণ আবার কোত্থেকে এল?’
শিবেন বলল, ‘দুর গাধা। বিদেশ থেকে শেষবারের মতো চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফেরার পর ডক্টর দেবনাথ আর অনুরূপা দেবীর স্বল্পবাক আর অন্তর্মুখী হয়ে যাওয়াটা সেটাই তো প্ৰমাণ করে। আচ্ছা বউদি, আপনার কি মনে হয় ডক্টর দেবনাথের চরিত্র চোখের সামনে তাঁর স্ত্রীর ওপরে নৃশংস আর কদর্য অত্যাচার দেখে পালটে গিয়েছিলেন না। তিনি নিজেও “অত্যাচারিত হয়েছিলেন?’
দময়ন্তী বলল, ‘যে রাক্ষসগুলো তাঁদের তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে একটা বিরাট গুপ্তধন কোথায় লুকোনো আছে তার খোঁজ করছিল, তারা ডক্টর দেবনাথকে ছেড়ে কথা বলবে তা আমার মনে হয় না।’
‘বেশ, তারপর বলুন।’
‘যার জন্যে দেবনাথ দম্পতিকে অত্যাচারিত হতে হয়েছিল, সেটা তো আকাশ থেকে মাসাবোয় আসেনি। তবে কোত্থেকে এল? মাসাবোর আশেপাশে গভীর জঙ্গলে কোনো পোর্তুগিজ জলদস্যুদের দুর্গের ধ্বংসাবশেষের ভেতরে সেটি খুঁজে পেয়েছিলেন ডক্টর দেবনাথ। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলেন না। কত ডলার হাওলার মাধ্যমে দেশে আনতে পেরেছিলেন তা আমি জানি না। আমার জানবার ইচ্ছেও নেই।’
‘সেটা বলা বাহুল্য। তবে, ওই টাকাটা কি টালিগঞ্জ টেরাসের বাড়িতেই আছে?’
‘অবশ্যই। তাতে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না। আর, যারা এই সম্পত্তির পেছনে পড়ে আছে, তাদেরও কোনো সন্দেহ নেই । ‘দেখুন, ডক্টর দেবনাথ কলকাতায় এত জায়গা থাকতে একটা ঘন বসতির সরু গলির ভেতরে বাড়ি কিনতে গেলেন কেন? এখানে পাড়াসুদ্ধু লোকের ঘুম না ভাঙিয়ে ডাকাতি করা সম্ভব নয়। দেবনাথরা যদি হঠাৎ মারা না যেতেন, তাহলে হয়তো ওঁদের ভয়-টয় দেখিয়ে একটা চেষ্টা করা যেত। তা হল না। ওঁদের সঠিক অবস্থানটা খুঁজে বের করতে দেরি হয়ে গেল । তখন দায়টা গিয়ে পড়ল বিক্রমবাবুর ঘাড়ে।’
‘ওঁরা আত্মহত্যা করতে গেলেন কেন? বেশ তো ছিলেন?’
‘না, তা ছিলেন না। মাসাবোর অকথ্য অত্যাচারের ফলস্বরূপ তাঁদের শরীরে কোনো কুৎসিত রোগ দানা বেঁধেছিল। প্রথমদিকে দেবনাথরা তার লক্ষণগুলোকে সাধারণ অসুখ বলে ভেবেছিলেন। সেইজন্যেই প্রায়ই ডাক্তারবাবুকে ডেকে পাঠতেন। কিন্তু ক্রমশই অসুখটা যে চিকিৎসা সত্ত্বেও তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে সেটা ডাক্তারবাবু বিলক্ষণ বুঝতে পারছিলেন। শেষ পর্যন্ত কিছু টেস্ট করবার পর অসুখটা যে কি সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল।
‘মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল ডাক্তারবাবুর। অনোন্যপায় হয়ে কেষ্টবাবুকে ব্যাপারটা জানালেন তিনি। তখন নিশ্চয়ই চিকিৎসার শুরু হয়েছিল। কিন্তু যখন বোঝা গেল যে কিছুতেই কিছু হবার নয়, এদিকে ছেলের বিদেশ থেকে ফেরবার সময়ও এসে গেছে। তার সামনে কুৎসিত রোগের যন্ত্রণায় মারা যাওয়া দেবনাথদের আত্মসম্মানে লাগল। কাজেই ছেলে এসে পৌঁছোনোর আগেই দু-জনে সসম্মানে বিদায় নেওয়া স্থির করলেন। তাঁদের সাধের গুপ্তধন পেছনেই পড়ে রইল।’
.
সমরেশ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ‘দেবনাথদের ঘটনাটার সঙ্গে তোমার অনুমানগুলো প্রায় নির্ভুলভাবে মিলে যাচ্ছে। এবার আমাদের কর্তব্য কী?’
‘আমার মনে হয়, মাসাবোর ব্যাপারটা তোমার বন্ধুকে বলার কোনো দরকার নেই। আমরা বলব যে আমাদের ধারণা টালিগঞ্জ টেরাসের বাড়িটার দোতলায় কোনো জায়গায় একটা মূল্যবান কিছু লুকিয়ে রাখা আছে। সে খবরটা এদেশের কোনো একটা চোরাই মালের ব্যবসায়ী অসাধু দল জানে। তারাই আপনার ভাড়াটেকে উত্যক্ত করছে। এখন আপনি বাড়িটা বিক্রি করে যা টাকা পাওয়া যায় তাই নিয়ে জার্মানি চলে যেতে পারেন অথবা লোক লাগিয়ে আপনার বাড়ির দোতলা আর তিনতলা ভাঙচুর করে ওই মূল্যবান বস্তুটি খুঁজে বের করতে পারেন অথবা কোনো নামজাদা সিকিউরিটি কোম্পানিকে বাড়ি পাহারা দেবার কাজে লাগাতে পারেন।’
শিবেন ফিক করে হেসে বলল, ‘আগে আমাদের সেন্সর করা বয়ানটা সমরেশের বন্ধুকে বলা তো যাক। তার পরে না-হয় প্রস্তাবগুলো পেশ করা যাবে।’
শিবেনের হাসির একটা কারণ ছিল।
***
বিক্রম ভাবলেশহীন মুখে শিবেনের বক্তব্য শুনে বলল, ‘আপনারা মূল্যবান বস্তুটা কি, জানেন? ‘
শিবেন বলল, ‘না। কী করে জানব? আপনি জানেন?’
‘না, জানি না। তবে, এটুকু জানি যে জিনিসটি অত্যন্ত দামি । আমার বাবা মাসাবোর কাছে গভীর জঙ্গলের ভেতরে একটা ভাঙাচোরা দুর্গের ভেতরে সেটা দেখতে পান। সেটা দেশের সরকারের কাছে জমা না দিয়ে তিনি আত্মসাৎ করেন এবং তারপরেই ওখান থেকে পালিয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন।
‘ব্যাপারটা অত্যন্ত বেআইনি অনুচিত কাজ হয়েছিল। এর কিছুদিন পরে আমি জার্মানিতে চলে যাই এবং ব্যাপারটা পরে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। ফলে, বাবার চাকরি যায়। উনি ভাবতেই পারেননি যে একথা আমার কানে উঠতে পারে। কিন্তু, বাবা-মার নিশ্চয়ই প্রচণ্ড অনুশোচনা হয়েছিল। তাঁদের স্বভাবের পরিবর্তন সেটাই প্রমাণ করে। আর সেইজন্য, আমি দেশে ফেরবার আগেই তাঁরা দু-জনে একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছিলেন।’
‘আপনি আমাদের এসব কথা বললেন কেন? আমরা তো জানতে চাইনি।’
‘তার কারণ আমার এখন কী কর্তব্য সে ব্যাপারে আমি নিঃস্বার্থ উপদেশ চাই। এখন আমাকে সে রকম উপদেশ দেবার তো কেউ নেই। আমার বিশ্বাস, আপনারা সেই উপদেশ দিতে পারবেন।’
‘সে হবে’খন। আগে বলুন, মূল্যবান জিনিসটি কি-বা সেটা কোথায় আছে, তা কি আপনার জানা আছে? হ্যাঁ অথবা না।’
‘না। আমার কোনো ধারণাই নেই। তবে মনে হয়, আমাদের দেশেই, হয়তো এই বাড়িতেই কোথাও, কোনোভাবে লুকোনো আছে। কাস্টমস যখন ধরতে পারেনি, তখন এরকম ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক। যে দলটা আমাদের বাড়ির ওপর হামলা করছে, তারা খবর পেয়েই করছে। তবে সঠিক খবর তারাও জানে বলে মনে হয় না। এমনকী, খবরটা সঠিক কি না সে বিষয়েও তারা একেবারে নিঃসন্দেহ নয় বলেই আমার মনে হয়। হলে, তারা এত ধীরে-আস্তে দায়সারা গোছের কাজ করত না। প্রথমেই মার-মার করে মাঠে নেমে পড়ত।’
দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘আপনি জার্মানিতে বসে এইসব খবর পেলেন কী করে?’
ম্লান হেসে বিক্রম বলল, ‘আমার স্ত্রীর একজন আত্মীয়ের কাছ থেকে। আমার স্ত্রী যে অবাঙালি সেটা তার নাম শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে সচরাচর সুনীতা নামটি শোনা যায় না। ওরা রাজস্থানের ব্যবসায়ী পরিবার। ওদের ব্যাবসা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে।
‘সে যাই হোক, সুনীতার এক আত্মীয়ের ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসা এবং তার আশে পাশে বিস্তীর্ণ এলাকায় অনেক দিনের পারিবারিক ব্যাবসা। তাঁর কানে মাসাবোর খবরটা তো উঠবেই। সেই ভদ্রলোক ওই ব্যাবসা সূত্রে জার্মানিতে এসে আমার সামনেই সুনীতাকে ব্যাপারটা জানান। তাঁর ঘটনাটার নায়কের নামটা মনে ছিল না। দেবনাথ পদবীটা মনে ছিল। তাই তিনি সুনীতাকে জিজ্ঞাসা করেন যে সে এরকম পদবীর কাউকে চেনে কি না। সুনীতার উত্তর ছিল যে তার স্বামী ছাড়াও সারা ভারতবর্ষে কয়েক লক্ষ দেবনাথ আছে। তাদের সবাইকে চেনা সম্ভব নয়।’
‘আমার দুর্ভাগ্য যে আমার চিনতে কোনো অসুবিধে হয়নি।’
***
বিক্রমের কথা শেষ হবার পর সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। অবশেষে নীরবতা ভেঙে বিক্রম বলল, ‘এখন বলুন আমার প্রতি আপনাদের কী উপদেশ।’
শিবেন বলল, ‘আপনি যদি আপনার বাবার লুকিয়ে রাখা জিনিসটি খুঁজে পান তাহলে সেটা নিয়ে কী করবেন? সে বিষয়ে কিছু ভেবেছেন? ওড়াবেন, না ভোগ করবেন, না দান করে দেবেন না কী করবেন?’
বিক্রম মেপে মেপে বলল, ‘যে অভিশপ্ত বিষাক্ত জিনিসটির প্রতি আকৃষ্ট হতে গিয়ে আমার মা-বাবাকে প্রাণ দিতে হল, সেটার জন্যে আমি কিছুই করব না। খুঁজবো তো না-ই, যদি ওপর থেকে টুপ করে আমার হাতে এসে পড়ে, তাহলে সেটাকে একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ায় জড়িয়ে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়ে আসব।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু, সেক্ষেত্রে আপনাদের বাড়িটার ওপরে একদল লোকের নজর থেকেই যাবে। এই, বাড়িটাতো অভিশপ্ত বা বিষাক্ত নয়। ভবিষ্যতে একদিন না একদিন আপনি এখানে এসে থাকতেও পারেন। অন্তত, কলকাতায় আপনার একটা থাকবার জায়গা তো রইল। যদি বাড়িটা বিক্রি করে দেন, তবে একটা সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যায়।’
‘যথা?’
‘ওই অভিশপ্ত জিনিসটা হয়তো কোনো একদিন বেরিয়ে পড়বে। তখন যার জন্যে আপনার মা-বাবা প্রাণ দিলেন, সেটা কোনো উটকো লোকের হাতে পড়ুক সেটা কি আপনি চাইবেন?’
বিক্রম কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘আপনি বোধ হয় ঠিকই বলেছেন, শিবেনবাবু। এখন আপনি কী পরামর্শ দেন?’
‘আমি বলি কী, আপনি বাড়িটা এষণাকে ভাড়া দিন। আমাদের পাঁচজন ইনভেস্টিগেটর। আর চারজন নেপালি গার্ড আছে। তারা মেস করে থাকে। জায়গাগুলো ভালো নয়। তাদের জন্যে আমরা ভালো ঘর খুঁজছি। ওখানে, চারটে থাকবার ঘর আছে। প্রত্যেক ফ্লোরে দুটো করে। কিচেন বাথরুম এসব তো আছেই। খুব ভালো ব্যবস্থা। কাজেই, আপনি যদি আমাদের বাড়িটা ভাড়া দেন, তাহলে অত্যন্ত উপকৃত হই। ভাড়া আপনি যা চাইবেন তাই দেব আমরা। আমাদের ছেলেগুলো একটা ভালো জায়গায় থাকবে আর আপনার বাড়িতেও চব্বিশ ঘণ্টা কেউ না কেউ উপস্থিত থাকবে। আপনি যখন ফিরে আসবেন, তখন আপনার বাড়ি আপনি পেয়ে যাবেন। তার গ্যারান্টি থাকবেন আপনার বন্ধু।’
বিক্রম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ‘এখন যা অবস্থা তাতে একমাত্র এই প্রস্তাবটাই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে।’
– সমাপ্ত –
আনন্দবাজার পত্রিকা
কলকাতার কড়চা, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, সোমবার
রোমাঞ্চকর
বিশ শতকের সত্তর দশক থেকে টানা কুড়ি বছর ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকায় রহস্য, অলৌকিক, বিজ্ঞানভিত্তিক, রূপকথা ইত্যাদিমিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার পাতা ছোট ও বড়দের উপযোগী কাহিনি লিখেছেন। ১৯৯২ সালে ‘রোমাঞ্চ’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রায় এক দশক লেখা বন্ধ। শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনীশ দেবের উৎসাহে নতুন শতকে আবার নানা পত্রপত্রিকায় লেখা শুরু করেন মনোজ সেন (জন্ম ১৯৪০)। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। স্কটিশ চার্চ স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ, বি ই কলেজে পড়াশোনা। প্রচারের আড়ালে থাকা এই প্রবীণ লেখকের একটিমাত্র সঙ্কলন প্রকাশিত হয় বছর দশেক আগে, তাও নিজের উদ্যোগে। এ বার বুকফার্ম প্রকাশ করল ‘৫x৫=২৫’ (পাঁচমিশেলি সঙ্কলন)। ভূতের গল্প, থ্রিলার ইত্যাদির সঙ্কলনও প্রকাশের পথে। অন্য দিকে ‘ক্যামেরাজি’ নামের এক অলাভজনক ভিডিয়োগ্রাফি সংস্থা সোশ্যাল মিডিয়া ও ইউটিউবে মনোজ সেনকে নিয়ে প্রকাশ করেছে একাধিক প্রোমো-ভিডিয়ো।
‘বুক ফার্ম’-এর প্রয়াস নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন