মালিনী মঞ্জরী

মালিনী মঞ্জরী

চোখ মেলে সে প্রথমে কিছুই মনে করতে পারল না। সে যেখানে শুয়ে আছে তার চারপাশে খেলা করছে আধো অন্ধকার। তার মনে হল যেন সে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঘুমিয়ে ছিল। যুগযুগ ধরে এক অতলান্ত ঘুমের সমুদ্র অতিক্রম করে এসে সবশেষে পাড়ে উঠে চোখ মেলল। অন্ধকার যেন একটু হালকা মনে হয়। মাথাটা তুলতে গিয়ে বেশ ভারী মনে হল। সে ভাবার চেষ্টা করল সে কে? কোথায় শুয়ে আছে সে?

বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে শুয়ে থাকার পর প্রথমে এক সময় তার নিজের নামটা মনে পড়ল। তার নাম চম্পক—চম্পক সিংহ। এরপর নিজের পরিচয়টাও তার মনে পড়ে গেল। মরুময় বিকানিরের বাসিন্দা সে। কিশোর বয়সে এক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে বিকানির থেকে সে এসেছিল অম্বর রাজ্যে। তারপর থেকে সে অম্বর রাজ্যেই স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করল। পেশায় একজন শিল্পী সে। পাথর কুঁদে মূর্তি নির্মাণ করে চম্পক। মানুষের মূর্তি, পশুপাখির মূর্তি, শ্বেতপাথরের মূর্তি, বেলে পাথরের মূর্তি। আর সে সব মূর্তি স্থান পায় অম্বর প্রাসাদের আনাচে-কানাচে, প্রাসাদ সংলগ্ন সুরম্য বাগিচাতে দৃষ্টি নন্দনের জন্য। আত্মপরিচয় স্মরণে আসার পর চম্পক কিছুটা যেন আশ্বস্ত বোধ করতে লাগল।

মাথাটা এক পাশে সে কষ্ট করে ঘোরাল। গরাদ বসানো গবাক্ষ দিয়ে ক্ষীণ আলো প্রবেশ করতে শুরু করেছে কক্ষে। চাঁদের আলো। তা দেখে চম্পক বুঝতে পারল এখন রাত। কিন্তু এ কক্ষ তো অম্বর কেল্লার শিল্পী মহল্লার তার নিজের শয়নকক্ষ নয়! তার কক্ষের বাতায়ন অমন লৌহ শলাকা সমৃদ্ধ নয়। মর্মর পাথরের চাদরের জাফরি বসানো তার গবাক্ষে। চম্পক নিজের হাতেই বানিয়েছিল সেটা। তবে এ কোন কক্ষ? তাছাড়া তার কক্ষে কোনও পালঙ্ক ছিল না! কিন্তু সে বর্তমানে এক লৌহ নির্মিত ক্ষীণকায় পালঙ্কে শুয়ে আছে। ইতিপূর্বে ও ধরনের পালঙ্ক আগে দেখেনি সে! চম্পক বুঝতে পারল এ তার শয়নকক্ষ নয়। তবে সে কোথায়? বাতায়ন দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করা আলোর রেখার দিকে তাকিয়ে চম্পক ভাবার চেষ্টা করতে লাগল সে এই অপরিচিত জায়গাতে কীভাবে এল?

অন্ধকারটা যেন ধীরে ধীরে আরও পরিষ্কার হচ্ছে। চাঁদ আকাশের ওপর দিকে উঠতে শুরু করেছে। সম্ভবত পূর্ণিমার চাঁদ। তাই আলো বাড়ছে। কোথা থেকে একটা ঘণ্টাধ্বনি যেন অস্পষ্ট ভাবে ভেসে এল গবাক্ষ দিয়ে। অম্বর থেকে কিছুটা তফাতে পাহাড়ের মাথায় নাহারগঞ্জে যে দেবী মন্দির আছে তার ঘণ্টাধ্বনি কি? ঠিক বুঝে উঠতে পারল না চম্পক। একটা মুখ যেন চম্পকের চোখের সামনে ভেসে উঠছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। অস্পষ্ট এক নারীর মুখ। কে সে? এক সময় সেই মুখ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল চম্পকের মনে। তারপর নামটাও তার মনে পড়ল। এ নারীর নাম মঞ্জরী। যার মূর্তি নির্মাণ করেছে চম্পক। অম্বর প্রাসাদের মালিনী মঞ্জরী। পুষ্প চয়ন করে মালা গেঁথে রানিকে সাজায় সে।

মঞ্জরীর মুখ আর পরিচয় তার মনের মধ্যে ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মাকুর থেকে সুতো খোলার মতো একে একে চম্পকের মনে পড়ে যেতে লাগল সব কিছু।

মঞ্জরী তার প্রেয়সী। অম্বর প্রসাদ কাননে সারাদিন ধরে এক অপ্সরার মূর্তি নির্মাণের কাজ করছিল চম্পক। বেলা তখন পড়ে এসেছে। আপন মনে মূর্তির গায়ে অলঙ্কার খোদাই করছিল চম্পক। হঠাৎই পিছনে এক অস্পষ্ট শব্দ হলে ফিরে তাকিয়ে চম্পক দেখতে পেয়েছিল এক অপরূপ রাজপুত দুহিতাকে। নিবিষ্ট মনে গোধূলির মায়াবী আলোতে সে চেয়েছিল পাষাণ খোদিত অপ্সরা মূর্তির দিকে। চম্পক প্রথম দেখাতেই তাকে রাজকন্যা বলেই ভেবেছিল। কিন্তু সে মাথা ঝোঁকাতেই তার দিকে দৃষ্টিপাত করে সেই যুবতী মৃদু হেসে বলে উঠেছিল; ‘না, না, আমি রাজকন্যা নই। আমি মালিনী। রানি, রাজকন্যাদের জন্য পুষ্প চয়ন করে মালা গাঁথি। নগণ্য এক দাসী।’

‘তুমি দাসী! দাসীর এত রূপ!’—মালিনীর কথা শুনে একথাটা বলে ফেলেছিল চম্পক।

একটু চুপ করে থেকে মালিনী জবাব দিয়েছিল ‘আমার নাম মঞ্জরী। দাসী হলেও দাসীর ঘরে জন্ম নয় আমার। অম্বর রাজ টিকাডোরের সময় এক গ্রাম থেকে এখানে এনেছিলেন আমাকে। টিকাডোর কাকে বলে জানো তো?’ টিকাডোর হল কিছু কিছু রাজপুত রাজাদের মধ্যে প্রচলিত এক প্রাচীন প্রথা। অভিষেকের পর ললাটে রাজটিকা ধারণ করে কাছাকাছি কোনও শত্রু রাজ্য লুঠ করতে বেরোয় নতুন রাজা। শত্রু রাজ্য না থাকলে বন্ধু রাজারাই তার কোনও গ্রাম বা নগর লুঠ করার জন্য অনুমতি দেন নতুন রাজাকে। সেই গ্রামবাসী বা নগরবাসীকে অবশ্য খবরটা জানানো হয় না। সদ্য অভিষিক্ত রাজা অতর্কিতে সেখানে হানা দিয়ে সে গ্রামের সম্পদ লুঠ করেন। আর সেই লুণ্ঠিত সামগ্রীর মধ্যে অবশ্যই থাকে নারীরত্ন। তাদের লুঠ করে এনে রাজা তাদের দাসী বানান। ভাগ্য ভালো থাকলে তাদের কেউ কেউ মহরাজের শয্যা সঙ্গিনীও হয়।

মঞ্জরীর কথায় এবারে চম্পক বলেছিল, ‘হ্যাঁ, টিকাডোর প্রথা সম্বন্ধে জানি। এবার বুঝতে পারছি তুমি কেন এত রূপবতী। নিশ্চয়ই তুমি কোনও সম্ভ্রান্ত বংশীয় রাজপুত কন্যা ছিলে।

চম্পকের কথা শুনে মঞ্জরী মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে বলল ‘আচ্ছা, কে বেশি সুন্দরী বলো তো? আমি নাকি ওই প্রস্তুর মূতি?’

চম্পক বলল, ‘আমি যদি তোমার মূর্তি রচনা করি তবে সে মূর্তি, এই অপ্সরা মূর্তির চেয়েও বেশি সুন্দর হবে। তোমার মূর্তি নির্মাণ করতে দেবে আমাকে?’

শিল্পীর চোখ চম্পকের। মঞ্জরীর দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পেরেছিল মরালগ্রীবা, শঙ্খের মতো জেগে থাকা উদ্ভিন্ন স্তন, ক্ষীণ কটিদেশ, ভারী নিতম্ব সমন্বিত এই নারী মূর্তি রচনার পক্ষে আদর্শ। তাই সে প্রস্তাবটা দিয়েছিল মঞ্জরীকে। মঞ্জরী তার কথা শুনে চমকে উঠে বলেছিল, ‘কী বলছ তুমি ভাস্কর? মালিনীর মূর্তি আবার কেউ রচনা করে নাকি?’

চম্পক বলেছিল ‘হ্যাঁ করে। যদি সে নারী অপ্সরার থেকেও রূপবতী হয়।’

এ কথাটা শুনে মালিনী মঞ্জরী লজ্জিতভাবে বলে উঠেছিল, ‘আমার মূর্তি রচনা করে তুমি কী করবে? কী কাজে লাগবে সেই মূর্তি?’

ভাস্কর চম্পক তার উত্তরে জানিয়েছিল, প্রাসাদের অতিথিশালার প্রবেশ তোরণে একটা নারীমূর্তি নির্মাণ করে স্থাপন করতে বলা হয়েছে আমাকে। জানো নিশ্চয়ই যে অম্বররাজের পূর্বপুরুষ ছিল রাজা মান সিংহ। সম্রাট আকবর তাকে একবার বঙ্গদেশের দোয়াব অঞ্চলে পাঠিয়েছিলেন। তার সঙ্গে বেশ কিছু অম্বরবাসী রাজপুতও গেছিলেন বঙ্গদেশে। যাদের মধ্যে একটা অংশ আর এ দেশে ফেরেননি। সেখানেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন বংশ পরম্পরায়। তাদেরই এক উত্তরপুরুষ পিতৃপুরুষের দেশ দেখতে আসছেন। তাঁর নাম মোতি সিংহ। অত্যন্ত ধনাঢ্য ব্যক্তি। তার জন্য অতিথিশালা সাজানো হচ্ছে। মোতি সিংহ নাকি অর্থ সাহায্য করবেন অম্বররাজকে। তাই তাঁর আতিথেয়তায় ত্রুটি রাখতে চান না অম্বররাজ।’

কথাটা শুনে মঞ্জরী হেসে বলেছিল, ‘ঠিক আছে তোমার যখন মন চায় তখন আমার মূর্তি রচনা কোরো তুমি। প্রতিদিন এই সায়াহ্নে যখন পুষ্প চয়ন করতে আসব তখন কিছু সময়ের জন্য তোমার কাছে উপস্থিত হব আমি। এই বলে সে সেদিনের মতো ফুলের সাজি হাতে রওনা হয়েছিল প্রাসাদ অভিমুখে।—সব কিছু এবার মনে পড়ে যাচ্ছে চম্পকের।

সেই শুরু মঞ্জরীর সঙ্গে চম্পকের সাক্ষাতের। যে কক্ষে চম্পক শুয়ে আছে সে কক্ষটাকে চিনতে না পারলেও তার চোখের সামনে এরপর ভেসে উঠতে লাগল পরবর্তী ঘটনাগুলো। চম্পক, মঞ্জরীকে তার মূর্তি নির্মাণের প্রস্তাব দিলেও প্রাথমিক ভাবে সে কিছুটা সন্দিহান ছিল মঞ্জরীর সম্মতির ব্যাপারে। হয়তো বা মঞ্জরী নেহাতই কথার কথা বলেছে তাকে। কিন্তু মঞ্জরীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর সেই প্রথম রাতে ঘুমে জাগরণে মঞ্জরীর মুখটাই যেন চম্পকের চোখের সামনে ভেসেছিল। কে জানে হয়তো প্রথম দর্শনেই মঞ্জরীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল শিল্পী চম্পক।

পরদিন সারাক্ষণই মঞ্জরীর কথাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল তার। একটা মর্মর প্রস্তর খণ্ড কাননের নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হয়েছিল। দিনের শেষে গোধূলির রাঙা আলো যখন ছড়িয়ে পড়েছিল অম্বর প্রাসাদের মাথায়, সংলগ্ন পুষ্পশোভিত বাগিচাতে তখন সেদিন সেই ক্ষণে সারা দিনের সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফুলের সাজি হাতে ভাস্কর চম্পকের সামনে উপস্থিত হয়েছিল মালিনী মঞ্জরী। বেলা শেষের আলোতে মঞ্জরীকে সেদিন যেন আরও বেশি সুন্দরী দেখাচ্ছিল। তাকে দেখে চম্পকের মনে হচ্ছিল কাননের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত বিশাল হর্ম্য প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তার রূপ, শরীরী বিভঙ্গ দেখে যেন লজ্জা পাবে ইন্দ্রসভার উর্বশীরাও। চম্পকের বিহ্বল দৃষ্টি দেখে মঞ্জরী বলেছিল, ‘নাও এবার কাজ শুরু করো। সূর্য ডুবতে বেশি দেরি নেই আর। অন্ধকার নামলেই আমাকে প্রাসাদে ফিরতে হবে। বাইরে থাকার অনুমতি নেই।’

মঞ্জরীর কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে ছেনি দিয়ে মর্মর স্তম্ভের গায়ে আঁক রচনা করার আগে একবার ভালো করে মঞ্জরীর পায়ের দিক থেকে ধীরে ধীরে তার শরীর বেয়ে ওপর দিকে তাকাল চম্পক। ঠিক কোন অংশ যে পাথরের গায়ে প্রথমে রচনা করবে তা দেখে নেওয়া প্রয়োজন। চম্পকের চোখ গিয়ে স্থির হল মঞ্জরীর বক্ষবিভাজিকাতে। করজোড়ে কেউ যেমন কোনও কিছু গ্রহণ করে ঠিক তেমনই মঞ্জরীর শঙ্খের মতো স্তন যুগল যেন দুটো হাতের পাতার মতোই তাদের সংযোগ স্থলে, বক্ষ বিভাজিকাতে ধরে রেখেছে সূর্যের রক্তিম আলোককে। সেদিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর পাথরের গায়ে ছেনি দিয়ে প্রথম আঁক কাটল চম্পক। নিষ্প্রাণ মর্মর পাথরের গায়ে প্রথম রচিত হয়েছিল একটা গভীর দাগ—মঞ্জরীর বক্ষ বিভাজিকা। সেই গোধূলি বেলাতে পাথরের গায়ে রচিত হয়েছিল প্রাণের প্রথম স্পন্দন। আর তারপরই অবশ্য সন্ধে নেমেছিল। মঞ্জরী ফিরে গেছিল প্রাসাদে।

তবে শুধু সেদিন নয়, তারপর থেকে প্রতিদিনই সেই নির্দিষ্ট সময় আসতে শুরু করল মঞ্জরী। মর্মর পাথরের গায়ে ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে শুরু করল তার অবয়ব। প্রথমে তার স্তন যুগল, তারপর গ্রীবা, মুখমণ্ডল। এ প্রস্তর খণ্ড যেন মঞ্জরীর আয়না! প্রথম প্রথম তেমন কোনও কথা বলত না মঞ্জরী। ওইটুকু সামান্য সময়ে কথা বলে কাজের ব্যাঘাত ঘটাত না কেউই। সূর্য ডুবলেই ফিরতে হয় মঞ্জরীকে। সে ফিরে যাবার পর ভাস্কর চম্পকও প্রাসাদ কানন ত্যাগ করে ফিরে আসত অম্বরনগরীর এক দরিদ্র পল্লীতে, তার বাসস্থানে। তবে স্বপ্নে জাগরণে সে শুধু দেখতে পেত সেই প্রস্তরমূর্তিকে অথবা মঞ্জরীকে। দুটোই তো সমার্থক। দিনের বেলাতে নিজ গৃহতেই থাকত চম্পক। তার সময় যেন কিছুতেই কাটতে চাইত না। কোনও রকমে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত কাটিয়ে সে গিয়ে উপস্থিত হত প্রাসাদ কাননে। তারপর প্রতীক্ষা করত মঞ্জরীর জন্য।

ধীরে ধীরে এক সময় মৃদু কথাবার্তাও শুরু হল তাদের দুজনের মধ্যে। চম্পক জানতে পারল মঞ্জরী অষ্টাদশ বর্ষীয়া। মঞ্জরী লিখতে পড়তে জানে। তার মাতা বাল্যকালেই প্রয়াত হয়। পিতা ছিলেন একজন সামন্ত সর্দার। অর্থাৎ ছোট ভূস্বামী। অম্বররাজ যখন তাদের গ্রাম লুঠ করতে যান তখন মঞ্জরীর পিতা মঞ্জরীকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্র ধরেছিলেন। মহারাজের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরাতে তিনি শিরচ্ছেদ করেছেন মঞ্জরীর পিতার। তার আর কেউ নেই। মঞ্জরীর প্রতি কেমন যেন একটা মমত্ববোধও জেগে উঠতে শুরু করেছিল যুবক ভাস্কর চম্পকের মনেও। মমত্ববোধ তো ভালোবাসারই এক রূপ। কিন্তু মঞ্জরীও যে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে ভাস্কর চম্পক বুঝে গেল একদিন।

মূর্তি নির্মাণের কাজ তখন অনেকটাই এগিয়ে গেছে। কোমরের ওপরের অংশ, বক্ষ, গ্রীবা, মুখমণ্ডল রচিত হয়েছে। শুধু কোমর থেকে নীচের অংশ নির্মাণ বাকি। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সূর্য ডুবতে চলেছে। লৌহ শলাকার আঘাতে কোমল মর্মর পাথরের গায়ে মঞ্জরীর নাভিমূল খোদাই করছিল চম্পক। হঠাৎ তাকে মঞ্জরী প্রশ্ন করল, ‘কাজ শেষ হতে আর কতদিন লাগবে?’

পাথরের গায়ে খোদাই করতে করতে চম্পক জবাব দিয়েছিল ‘আর বেশি দিন নয়। নিম্নাঙ্গে তো বেশি কাজ নেই। শুধু তোমার নিতম্ব, পদযুগল রচনা আর ঘাগরার অলঙ্করণ। আশা করছি, একপক্ষকাল আর সামান্য কিছু সময়ের মধ্যেই নির্মাণ সম্পন্ন করব।’

জবাব শুনে মঞ্জরী বলল, ‘কাজটা আর একটু ধীর গতিতে করা যায় না ভাস্কর?’

‘কেন, ধীর গতিতে কেন?’ কাজ থামিয়ে, মঞ্জরীর দিকে তাকিয়ে বিস্মিতভাবে জানতে চাইল চম্পক।

দিন শেষের রক্তিম আভা এসে পড়েছে মঞ্জরীর মুখে। চম্পককে অবাক করে দিয়ে মঞ্জরী জবাব দিল, ‘তখন তো আর আমাকে তোমার প্রয়োজন হবে না ভাস্কর। আমার আর তোমার সঙ্গে দেখাও হবে না। তুমি হয়তো আর এখানে আসবে না। এই প্রাসাদ আর কানন ছেড়ে বাইরে যাবার অনুমতি নেই আমার।’

এরপর একটু চুপ করে থেকে সে বলল, ‘জানো, ইচ্ছা করলেই দ্বিপ্রহরের পরই আমি এখানে চলে আসতে পারি। আমার তো ভোরে আর সন্ধ্যায় পুষ্প চয়ন করে মালা গাঁথা ছাড়া অন্য কোনও কাজ থাকে না। তাছাড়া, তুমি যে আমাকে দেখে মূর্তি রচনা করছো তা আমি মহারানির প্রধান পরিচারিকাকে জানিয়েছি, যার অধীনে আমরা নানা শ্রেণির দাসীরা কাজ করি। কথাটা তাকে আগাম জানিয়েছি কারণ, ভবিষ্যতে ব্যাপারটা গোপন থাকবে না। অতিথিশালাতে এ মূর্তি স্থাপিত হলেই সবাই চিনতে পারবে এ মূর্তি কার। তখন আমাকে বিড়ম্বনায় পড়তে হত, হয়তো বা শাস্তির মুখেও। তাই আগাম জানাতে হয়েছে ব্যাপারটা। দ্বিপ্রহরে তোমার কাছে আসতে কেউ বাঁধা দিত না আমাকে। কারণ, মহারানি, প্রধান পরিচারিকার মাধ্যমে এ খবর জানার পর আমাকে এ কাজের অনুমতি দিয়েছেন। তবুও আমি ভয়ে আসিনি পাছে তুমি দ্রুত কাজ সেরে ফেল সে জন্য।’ কথাগুলো বলে অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইল মালিনী মঞ্জরী।

হতভম্ব ভাস্কর চম্পক। সে যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। মঞ্জরী তার সঙ্গ লাভের জন্য তার কাছে আসে! মঞ্জরীর কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে অসুবিধা হল না ভাস্কর চম্পকের। বিস্মিত ভাবে সে বলল, ‘তুমি আমার জন্য এখানে আসো!’

মঞ্জরী জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, তুমি যখন তন্ময় হয়ে মর্মর পাথরের গায়ে আমার ছবি ফুটিয়ে তোলো তখন আমিও তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকি তোমার দিকে।’

এই বাক্যালাপের পর নিশ্চুপ ভাবে পরস্পরের মুখোমুখি বেশ কিছুক্ষণ তারা দুজন দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অম্বর প্রসাদের আড়ালে সূর্য ডুবে গেল। তার ছায়া এসে পড়ল মালিনী মঞ্জরীর মুখমণ্ডলে। যাবার সময় সে শুধু বলে গেল, ‘কাল দ্বিপ্রহরেই আমি আসব। কিন্তু দোহাই ভাস্কর, আরও ধীর গতিতে আমার মূর্তি রচনা কোরো তুমি। আমি আরও কিছুদিন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।’

মঞ্জরী এ কথা বলে চলে যাবার পর বুকের ভিতর প্রবল এক উচ্ছ্বাস নিয়ে চম্পকও রওনা হল তার গৃহ অভিমুখে। সেরাতে দু-চোখের পাতা এক করতে পারল না চম্পক। তার কানে শুধু বাজতে লাগল মঞ্জরীর বলা কথাগুলো, চোখে ভেসে উঠতে লাগল রাঙা আলোতে দেখা মঞ্জরীর করুণ মুখমণ্ডল—যেখানে জেগে ছিল ভাস্কর চম্পকের প্রতি প্রেমের আকুতি। মঞ্জরীরও কেউ নেই, চম্পকেরও কেউ নেই। এমনটা কী হতে পারে না যে অম্বর থেকে দূরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে ঘর বাঁধল তারা? হ্যাঁ, এমন তো হতেই পারে। কিন্তু মঞ্জরী কি রাজি হবে তার প্রস্তাবে? এ সব ভাবতে ভাবতেই সে রাত কেটে গেল চম্পকের।

পরদিন দ্বিপ্রহরে সে উপস্থিত হল প্রাসাদ কাননে। সে সেখানে উপস্থিত হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হল মঞ্জরী। ভাস্কর চম্পক তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘তোমার ভয় নেই মঞ্জরী। অতি ধীর গতিতেই মূর্তি নির্মাণ করব আমি। প্রতিদিন শুধু একবার শলাকার আঘাত হানব মূর্তির গায়ে। আর তাতে কাজ শেষ হতে হয়তো পক্ষকাল নয়, বৎসরও অতিক্রান্ত হয়ে যাবে।’ ভাস্কর চম্পকের কথা শুনে হাসল মালিনী মঞ্জরী। তার মুখের দিকে তাকিয়ে চম্পক বলল, ‘কিন্তু তুমি আমাকে কোনওদিন ছেড়ে যাবেনা তো মঞ্জরী?’

নিস্তব্ধ দুপুরে আম্রকুঞ্জ থেকে একটা কোকিলের ডাক ভেসে এল। ‘কী করে যাব? তুমি যে আমাকে বেঁধে ফেলেছ আমার এই মূর্তির মধ্যে। আমার যদি কোনওদিন মৃত্যুও হয়, তবুও যুগ যুগ ধরে আমি ওই মূর্তির মধ্যে অবস্থান করব তোমার হাতের ছোঁয়াতে, ভালোবাসাতে গড়ে তোলা ওই মূর্তির মধ্যে। তুমি আমাকে স্পর্শ করলেই আবার জীবন্ত হয়ে উঠব আমি। মৃত্যুও আমাকে কেড়ে নিতে পারবে না তোমার থেকে।’

কথাটা শুনেই চম্পক তার হাত স্পর্শ করে বলল, ‘না, না, এসব মৃত্যুর কথা মুখে এনো না তুমি। আমি যে ঘর বাঁধতে চাই তোমার সঙ্গে। বাঁধবে?’

কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল মঞ্জরী। তারপর বিষণ্ণ ভাবে বলল, ‘সে ঘর তো স্বপ্নে বাঁধা ছাড়া উপায় নেই। অম্বররাজ তো সে অনুমতি দেবেন না আমাদের।’

ভাস্কর চম্পক চারপাশে তাকিয়ে কেউ নেই দেখে জবাব দিল, ‘অনুমতির দরকার নেই। অম্বর রাজ্য ছেড়ে দূরে কোথাও পালাব আমরা। এক বণিকের মুখে শুনছিলাম গুর্জর প্রদেশে নাকি এক প্রাচীন মন্দিরের সংস্কার চলছে। প্রচুর শিল্পীর প্রয়োজন সেখানে। তেমন হলে সেখানেও পালানো যেতে পারে।

ভাস্করের কথায় যেন আশার আলো ফুটে উঠল মঞ্জরীর চোখে। সে বলল, ‘তুমি যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাব। প্রাসাদের বন্দি জীবনে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।’ এই বলে সে প্রচণ্ড আবেগে আলিঙ্গন করল চম্পককে। কাঁপতে থাকল তাদের শরীর প্রথম প্রেমের আলিঙ্গনে।

এদিনের পর থেকে প্রতিদিনই দ্বিপ্রহরে বাগিচায় আসতে শুরু করল মঞ্জরী। ফিরত সেই সূর্য ডোবার পর। সে ফিরে যাবার আগে মূর্তির গায়ে একটা মাত্র আঁচড় কাটত শিল্পী চম্পক। দ্বিপ্রহর থেকে দিন শেষের সময়টুকু তারা ডুবে থাকতে লাগল প্রেমালাপে। তাদের মনে হতে লাগল জন্মজন্মান্তর যেন এমনই প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ তারা। তবে দিনের আলোতে উন্মুক্ত বাগিচাতে শরীরের ঘনিষ্ঠতা, মিলন সম্ভব ছিল না। মনের মিলন ঘটত তাদের। সময় এগিয়ে চলল। এক পক্ষকাল থেকে দু-ই পক্ষকাল, তিন, চার…

কিন্তু সাত পক্ষকাল পর একদিন প্রাসাদের প্রধান স্থপতি চম্পককে ডেকে জানিয়ে দিলেন আর কালক্ষেপ করা যাবে না। অতিথি এসে পড়লেন বলে! যে ভাবেই হোক আর এক পক্ষকালের মধ্যে মূর্তি নির্মাণ শেষ করে প্রাসাদের অতিথিশালাতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’

সেদিন দ্বিপ্রহরে মালিনী মঞ্জরী উপস্থিত হতেই চম্পক কথাটা জানাল মঞ্জরীকে। ম্লান হয়ে গেল মঞ্জরীর মুখ। ভাস্কর চম্পক অবশ্য ততদিন খোঁজখবর নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেছিল যে, হ্যাঁ, মঞ্জরীকে নিয়ে সে গুর্জর প্রদেশেই পালাবে। বণিকদের থেকে সেখানে পৌঁছবার পথের হদিশও পেয়েছে চম্পক। মঞ্জরীর বিষণ্ণ মুখের দিকে চেয়ে তাকে আশ্বস্ত করে চম্পক বলল, ‘এ সংবাদে তোমার শঙ্কিত হবার কোনও কারণ নেই। বরং এখন এক অর্থে মূর্তি নির্মাণ শেষের পর বিকানিরে ফিরে আমার ক্ষূদ্র সম্পত্তি বিক্রি করলে আরও কিছু রৌপ্য মুদ্রা আসবে আমার হাতে। তারপর সেই মুদ্রা নিয়ে গুর্জরে পালাব আমরা। নতুন জায়গাতে ঘর বাঁধার জন্যে অর্থের প্রয়োজন হবে আমাদের।

মঞ্জরী জানতে চাইল, ‘বিকানির গিয়ে ফিরে আসতে কত সময় লাগবে তোমার? আমি যে মালা হাতে তোমার পথ চেয়ে থাকব?’

ভাস্কর চম্পক জবাব দিল, ‘এক পক্ষকাল। তার মধ্যে সেই অতিথি এসে ফিরে চলে যাবেন। প্রাসাদের নজরদারীও শিথিল হবে কিছুটা। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোনও এক রাতে অম্বরের সীমানা পেরিয়ে প্রথমে দিল্লির দিকে রওনা হব আমরা। তারপর সেখান থেকে ঘোড়ায় চেপে গুর্জরের পথ ধরব। আমার কণ্ঠে পরানো থাকবে তোমার মালা।’

এরপর এই পরিকল্পনা মতোই এগিয়ে চলছিল সব কিছু। ক’দিনের মধ্যেই মূর্তি রচনার কাজ সম্পন্ন করল ভাস্কর চম্পক। মালা হাতে মালিনী মঞ্জরীর অপূর্ব সুন্দর মর্মর মূর্তি। আকারে, উচ্চতায় অবিকল সে মঞ্জরীর মতোই। সেই শ্বেত পাথরের মালিনী মূর্তি যেন দু-হাতে একটা ফুলের মালা তুলে পরিয়ে দিতে চাইছে তার সামনে যে দাঁড়াবে তার গলাতে। সবাই চমৎকৃত হল সেই জীবন্ত মূর্তি দেখে। মূর্তি স্থাপন করা হল অতিথিশালাতে। প্রাপ্য পারিতোষিক একশ স্বর্ণমুদ্রাও মিলে গেল শিল্পী চম্পকের। আর তার পরদিন দ্বিপ্রহরে মঞ্জরীর থেকে বিদায় নিয়ে বিকানিরের উদ্দেশে রওনা হল চম্পক। অশ্রু সজল চোখে, তাকে বিদায় জানালো মালিনী।

—বিছানাতে উঠে বসল চম্পক। অন্ধকার তখন অনেকটাই কেটে গেছে। জ্যোৎস্নার আলো ঢুকছে ঘরে। কিন্তু মঞ্জরী এখন কোথায়? আর সেই বা এই অপরিচিত কক্ষে কীভাবে এল? ভাবার চেষ্টা করতে লাগল চম্পক।

প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল চম্পক। অস্পষ্ট কিছু ভাবনা তার মনের মধ্যে ফুটে উঠছে ঠিকই, কিন্তু তা যেন গাঢ় কুয়াশার চাদরে মোড়া! ভাবতে ভাবতে চম্পকের রগগুলো দপদপ করতে লাগল। প্রচণ্ড অস্বস্তি বোধ করতে লাগল সে। সেই মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য চম্পক পালঙ্ক থেকে নেমে সেই লৌহ শলাকা স্থাপিত বাতায়নের সামনে এসে দাঁড়াল। ভাস্কর চম্পক যে কক্ষে অবস্থান করছে তা বাটিকার দ্বিতলে অবস্থিত। চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত বাইরের পৃথিবী। সুউচ্চ প্রাকার বেষ্টিত উদ্যান শোভিত এই প্রাসাদোপম বাটিকা। চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। নিস্তব্ধ পৃথিবীতে মোম জ্যোৎস্না যেন চুঁইয়ে পড়ছে তাদের গা বেয়ে।

গবাক্ষ দিয়ে নীচের উদ্যানের দিকে তাকাল চম্পক। তার দৃষ্টি ছুঁয়ে যেতে লাগল কাননের প্রাচীন বৃক্ষগুলোকে। হঠাৎই একটা গাছের দিকে তাকিয়ে চম্পকের চোখ আটকে গেল। যে গাছের মাথাটা ঠিক যেন একটা ছাতার মতো। তার ছায়া আধো অন্ধকার সৃষ্টি করেছে বাড়ির চারপাশে। তবু মধ্যে চম্পক দেখতে পেল একজন দাঁড়িয়ে আছে সেই অন্ধকারে! মনে হচ্ছে কোনও এক নারী মূর্তি! গাছের নিচে তার দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সেও যেন তাকিয়ে আছে দ্বিতলের এই গবাক্ষের দিকে। ভালো করে তার দিকে তাকিয়ে চম্পক বুঝতে পারল, হ্যাঁ, সে একজন নারী! কিন্তু কে এই নারী? তার দাঁড়াবার ভঙ্গিটা যেন বিশেষ পরিচিত ভাস্কর চম্পকের কাছে! আর এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চম্পক চিনে ফেলল তাকে। ও যে মঞ্জরী! চম্পকের জন্যই প্রতীক্ষা করছে সে!

যে কুয়াশার চাদরে চম্পকের স্মৃতি আবৃত ছিল তা যেন চকিতে সরে গেল। চম্পকের মনে পড়ে গেল তার ভুলে যাওয়া অতীতের বাকি অংশটুকু, বর্তমান সবকিছু। এ স্থান রাজপুত ভূমি অম্বর বা বিকানির নয়। এ হল বঙ্গদেশ, আর এ প্রাসাদ শ্রেষ্ঠী মোতি সিংহের প্রাসাদ। অম্বররাজ যার কাছে মালিনী মঞ্জরীকে তুলে দিয়েছিল!

ঝড়ের গতিতে ভাস্কর চম্পকের মনে পড়ে যেতে লাগল সব ঘটনা। মঞ্জরীকে অম্বরে রেখে বিকানিরে গেছিল চম্পক। বিকানির থেকে অম্বরে ফিরেও এসেছিল নির্দিষ্ট সময়তেই। কিন্তু বিকানিরে ফিরে সে সেই ভয়ঙ্কর খবরটা পায়। মঞ্জরীর যে প্রস্তরমূর্তি অনেক যত্নে, ভালোবাসাতে ভাস্কর চম্পক নির্মাণ করেছিল সেই মূর্তিই সর্বনাশ ঘটিয়েছে চম্পক আর মঞ্জরীর জীবনে।

চম্পক বিকানির রওনা হবার দু-দিনের মধ্যেই অম্বর প্রাসাদে এসে উপস্থিত হন ধনাঢ্য শ্রেষ্ঠী মোতি সিংহ। অতিথিশালাতে প্রস্তর মূর্তিটা দেখে তিনি জানতে চান যে এই সুন্দর নারী মূর্তি কি শুধুই মনের কল্পনা, নাকি কোনও নারীকে দেখে রচনা করা হয়েছে? ব্যাপারটা সবারই জানা ছিল, তাই অতিথির সামনে হাজির করা হয় মালিনী মঞ্জরীকে। অম্বররাজ নিজেও তখন অতিথি সৎকারের জন্য অতিথিশালায় উপস্থিত ছিলেন। মঞ্জরীকে, অতিথির মনে ধরেছে বুঝতে পেরে অম্বররাজ তাকে বলেন যে তিনি মালিনীকে উপহার স্বরূপ প্রদান করবেন শ্রেষ্ঠীকে। সেই নারীরত্ন উপহার নিয়ে বঙ্গদেশে রওনা হয়েছেন ধনাঢ্য মোতি সিংহ। শুধু মঞ্জরীই নয় তার মূর্তিটাও তার সঙ্গে গেছে। কারণ, মঞ্জরী নাকি কিছুতেই মোতি সিংহের সঙ্গীনী হতে রাজি হচ্ছিল না। সে নাকি তার মূর্তিটাকে আঁকড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অনেক অনুরোধ, শাস্তির ভয় দেখাবার পরও যখন মালিনীকে পালকিতে বসাতে রাজি করানো গেল না। তখন মূর্তি সমেত তাকে হাতির শুঁড় দিয়ে পিঠে তুলে বঙ্গদেশের পথে রওনা হন শ্রেষ্ঠী।

খবরটা যেন বজ্রপাতের মতো আঘাত হেনেছিল ভাস্কর চম্পকের ওপর। প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠার পর চম্পক অম্বর ত্যাগ করে রওনা হয় বঙ্গদেশের দিকে। সে যাত্রাপথ যেন অনন্ত এক যাত্রাপথ! কত ঘটনা দুর্ঘটনা। কখনও সে ঠগীদের খপ্পরে পড়েছে, কখনও রাজপ্রহরীদের, কখনও সে আবার আশ্রয় পেয়েছে কোনও অচেনা জায়গাতে এক একজন অপরিচিত মানুষের গৃহে। তারপর এক সময় সে এসে পৌঁছেছে এই বঙ্গদেশে।

বঙ্গদেশে কোনও ক্ষুদ্রদেশ নয় যে সঙ্গে সঙ্গে মিলে যাবে মোতি সিংহের বাড়ির ঠিকানা। বঙ্গদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে সে ছুটে বেড়িয়েছে মঞ্জরীর খোঁজে। কখনও মুর্শিদাবাদে নবাবের ভৃত্যের কাজ, কখনও সুতানুটিতে মৃৎ শিল্পীর কাজ, আলীনগরে ফিরিঙ্গি কোঠীতে গোমস্তার কাজ। মনে হয় যেন এসব এক-একটা আলাদা আলাদা জন্মের ঘটনা। কত মানুষ তার জীবনে এসেছে আবার হারিয়ে গিয়েছে। আর এসবের মধ্যেই সে খুঁজে বেড়িয়েছে তার প্রেয়সী মঞ্জরীকে। তাকে যে উদ্ধার করতেই হবে চম্পককে।

গত কয়েকদিন যাবত যে কাজটা সে করছিল, সেটা ছিল একটা শিল্প শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষকের কাজ। কিন্তু হঠাৎ কেন জানি তাকে একদিন বিনা অপরাধে কারাগারে বন্দি করা হল। সেখানে তার নতুন নাম দেওয়া হয়েছিল অপরেশ। কতরকম লোক বন্দি আছে সেখানে। তাদের মধ্যে কেউ রাজা, কেউ ওমরাহ, কেউ নবাব, কেউ বণিক বলেও পরিচয় দিত নিজেদের। তাছাড়া সাধারণ মানুষ তো ছিলই। দীর্ঘদিন সেই কারাগারে বন্দি থাকার পর তিনদিন আগে সঞ্জীবন নামে এক সহৃদয় ব্যক্তি তাকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন এই প্রাসাদে। কিন্তু এ প্রাসাদেই যে মঞ্জরীর দেখা মিলে যাবে তা ভাবতেও পারেনি শিল্পী চম্পক।

যে গাছটার নীচে মঞ্জরী এখন দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেই গাছটার নীচেই বিকালবেলা উদ্যান ভ্রমণের সময় তাকে দেখতে পায় চম্পক। আশেপাশে তখন আরও অনেক লোকজন ছিল। তারা পরস্পরকে দেখতে পেলেও কেউ কোনও বাক্যালাপ করেনি পাছে অন্যদের কাছে তাদের পূর্ব পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যায় সেই ভয়ে। তাদের যে পালাতে হবে বঙ্গদেশের এই সুতানুটি ত্যাগ করে। তবে তারা মুখে কোনও কথা না বললেও মঞ্জরীর চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনের ভাব পাঠ করতে অসুবিধা হয়নি চম্পকের। যে চোখ বলছিল, ‘তুমি একদিন আসবে আমি জানতাম। আমি যে তোমারই জন্য অপেক্ষা করে আছি।’

লোকজনের সামনে কথা বলতে না পারলেও চম্পক একটা কাজ করে এসেছিল। একটা বার্তা লিখে সবার অলক্ষে কাগজের টুকরোটা গুঁজে দিয়েছিল মঞ্জরীর কাঁচুলির ভাজে। আর সে জন্যই এখন গাছের নীচে উপস্থিত হয়েছে মঞ্জরী। সে অপেক্ষা করে আছে তার প্রেমিকের জন্য। যেন জন্ম জন্মান্তরের প্রতীক্ষার অবসান হবে এবার। আজ রাতেই মঞ্জরীকে নিয়ে পালাবে চম্পক।

মুহূর্তের মধ্যেই যেন সব স্মৃতি ফিরে পেল চম্পক। আর দেরি করা চলবে না। মঞ্জরী দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য। কক্ষের অর্গল খুলে বাইরে বেরিয়ে এল চম্পক। না, অলিন্দে অন্য কেউ নেই। নিস্তব্ধ, শূন্য অলিন্দ অতিক্রম করে সোপানশ্রেণি বেয়ে চম্পক বাটিকা প্রাসাদের উদ্যানে নেমে এল। হ্যাঁ, কিছুটা তফাতে সেই গাছের নীচে মঞ্জরী দাঁড়িয়ে আছে। ভাস্কর চম্পক এগোল সেই গাছের দিকে।

মঞ্জরীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল চম্পক। আধো অন্ধকারে একটা ফুলের মালা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে মালিনী মঞ্জরী। ঠিক যেন তার মূর্তিটার মতোই। পাতার ফাঁক গলে এক খণ্ড চাঁদের আলো এসে পড়েছে মঞ্জরীর মুখমণ্ডলে। আনত দৃষ্টি তার। ভাস্কর চম্পক তার বাহু স্পর্শ করতেই বহু দিন পর প্রেমিকের স্পর্শ পেয়ে একটু কেঁপে উঠে মুখ তুলে চম্পকের দিকে তাকাল মালিনী। তার চোখের পাতাদুটো যেন তিরতির করে আবেগে, রোমাঞ্চে নড়ে উঠল। এত দিন পর পরস্পরকে পেয়ে বেশ কিছু সময় বাকরুদ্ধ ভাবে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল তারা। চাঁদ যেন হাসছে আকাশ থেকে। আশেপাশের বৃক্ষরাজী যেন নির্বাক ভাবে তাকিয়ে দেখছে এই মিলনদৃশ্য। চম্পক খেয়াল করল মালিনী মঞ্জরীর চোখের কোণ যেন চাঁদের আলোতে চিকচিক করছে। আনন্দাঅশ্রু। তা দেখে চম্পক মৌনতা ভঙ্গ করে বলল, ‘আমি এসেছি মঞ্জরী। তোমার আর কোনও চিন্তা নেই। জানো, কত দিন ধরে আমি খুঁজে বেড়িয়েছি তোমাকে। মনে হয় যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তোমাকে আমি খুঁজে বেড়িয়েছি। যেন বহুযুগ পেরিয়ে এসে আজ তোমার দেখা পেলাম।’

ভাস্কর চম্পকের কথা শুনে মঞ্জরীর ঠোঁটদুটো আবেগে কেঁপে উঠল। সে বলল, ‘আমিও যে জন্ম জন্মান্তর ধরে তোমার জন্যই এই মালা হাতে প্রতীক্ষা করছিলাম। আমি জানতাম এক জন্মে না হলেও অন্যজন্মে, পরজন্মে তুমি আমার কাছে আসবেই। এই ফুলমালা তোমার কণ্ঠে পরাবই আমি। তুমি যে আমার জন্ম জন্মান্তরের ভালোবাসা।’

কথাগুলো বলে মঞ্জরী সেই ফুলমালা পরিয়ে দিল চম্পকের কণ্ঠে। জ্যোৎস্নার আলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঝিকিমিকি করে উঠল বহু যুগের ওপার থেকে আসা মৃত তারার দল।

চম্পক জানতে চাইল ‘আমি যেমন পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছি তেমন কি তুমিও খুঁজে বেড়িয়েছ আমাকে?’

মঞ্জরী জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, যুগ যুগ ধরে আমিও তোমাকে খুঁজে বেড়িয়েছি আমার হৃদয়ে। তবে আমি বন্দিনী। এ প্রাসাদ কাননে আসার পর আমার আর বাইরে যাবার কোনও উপায় ছিল না। তবে আমি জানতাম আমাদের ভালোবাসা সত্যি। তুমি একদিন এখানে আসবেই আমার এ মালা কণ্ঠে ধারণ করার জন্য। তুমি যখন নিমগ্ন হয়ে আমার মূর্তি রচনা করতে তখন আমিও একদৃষ্টে চেয়ে থাকতাম তোমার দিকে। মনে পড়ে ভাস্কর? আমি জানতাম শেষ একবার তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হবেই। তোমার গলায় ফুলমালা পরিয়ে দিয়ে মুক্তি পাব আমি। আর তুমিও মুক্তি পাবে জন্ম জন্মান্তরের এই বিরহ যন্ত্রণা থেকে। এই শেষ দেখা আমাদের।’

কথাটা শুনেই ভাস্কর চম্পক বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, সব কিছু মনে আছে আমার। অম্বর প্রাসাদ কাননে শেষ বিকালের সূর্যালোকে তোমাকে প্রথম দেখা থেকে শুরু করে নির্জন দ্বিপ্রহরে তোমার স্পর্শ পাওয়া প্রতিটা মুহূর্ত। কিন্তু, শেষ দেখা বলছ কেন তুমি? শেষ নয় শুরু বলো। আজ রাতেই এ স্থান ত্যাগ করে দূরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে ঘর বাঁধব আমরা। যেমন আমরা ভেবেছিলাম। তোমাকে পথে পথে খুঁজে বেড়াতে বেড়াতে বহু দেশ পেরিয়ে এসেছি আমি। অনেক গ্রাম-নগরী চেনা আছে আমার। নানা ধর্ম, নানা জাতের নানা ভাষার মানুষও আমার চেনা। তারা আমাদের আশ্রয় দেবে। শেষ নয়, এবার শুরু হবে আমাদের নতুন জীবন।’

কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে রইল মঞ্জরী। একটা বিষণ্ণতা জেগে উঠল তার মুখমণ্ডলে। সে বলল, ‘তা আর হবার নয়। আমাদের প্রেমের আখ্যান এখানেই শেষ হল।’

ভাস্কর চমকে বিস্মিত ভাবে বলল, ‘শেষ হল মানে? এ প্রাসাদ পরিত্যাগ করে এখনই রওনা হব আমরা। রক্ষীরা সব নিদ্রামগ্ন। চলো তবে। আর এখানে থাকা আমাদের উচিত হবে না।’

মালিনী জবাব দিল, ‘কিন্তু আমার যে তোমার সঙ্গে যাওয়া হবে না ভাস্কর।’

চম্পক উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল, ‘যাওয়া হবে না মানে? কত কাল ধরে তোমাকে আমি খুঁজে বেড়িয়েছি ফিরিয়ে নিয়ে যাব বলে। তোমার সঙ্গে ঘর বাঁধব বলে। কেন যাবে না তুমি?’

একটা অদ্ভুত বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল মালিনীর ঠোঁটে। সে জবাব দিল যাওয়া যাবে না কারণ, যে যুগ যে সময় আমরা পিছনে ফেলে এসেছি সেখানে আর ফেরা যাবে না বলে। অতীতে কেউ ফিরে যেতে পারে না বলে!’

মঞ্জরী কী বলছে তা বুঝতে না পেরে চম্পক তাকিয়ে রইল তার দিকে। মালিনী মঞ্জরীর চোখের কোণ বেয়ে এবার জল নামতে শুরু করেছে। না, এ অশ্রু আনন্দের নয়, বেদনার অশ্রু, বিচ্ছেদের অশ্রু।

শেষ একবার তার প্রিয়তমর দিকে মুখ তুলে তাকাল মালিনী মঞ্জরী। তারপর বলল, ‘নবজন্মে ভালো থেকো ভাস্কর। এবার তুমি আমাকে ভুলে যাবে।’

চাঁদের আলোতে চম্পকের দিকে তাকিয়ে আছে মঞ্জরী। বন্যার স্রোতের মতো তার দু-চোখ ছাপিয়ে জল নামছে।

চম্পক তাকে কিছু একটা বলতে গেল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে কোথা থেকে এক খণ্ড মেঘ এসে যেন ঢেকে দিল চাঁদটাকে। চারপাশে নেমে এল গাঢ় অন্ধকার। ভাস্কর চম্পকের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল মালিনী মঞ্জরী। চম্পক বলে উঠল, ‘মঞ্জরী তুমি কোথায়?’

কিন্তু কোনও সাড়া মিলল না। আর এরপরই চম্পকের মাথার ভিতরটা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে শুরু করল। তার মনে হতে লাগল তার মাথার ভিতর থেকে সব ভাবনা সব স্মৃতি যেন মুছে যাচ্ছে। মরুপ্রদেশের অম্বর প্রাসাদের সেই কানন, সেই প্রস্তর মূর্তি, মালিনী মঞ্জরীর মুখ, এমনকী ভাস্কর চম্পকের নিজস্ব সত্তাটুকু, আত্মপরিচয়ও যেন হারিয়ে ফেলছে সে। তার গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোচ্ছে না। শরীর কাঁপছে তার। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ল ভাস্কর চম্পক।

আর যখন হুশ ফিরল, তখন আবার চাঁদের আলো ফুটেছে। সে দেখল বাগানে একটা গাছের নীচে সে বসে আছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা শ্বেত পাথরের নারীমূর্তি। এই প্রাচীন বাড়িটার বাগানে নানা ধরনের মূর্তি আছে। তেমনই একটা মূর্তি এটা। তবে এত রাতে সে এখানে কেন বুঝতে পারল না। উঠে দাঁড়িয়ে মূর্তিটার দিকে একবার তাকিয়ে বাগান ছেড়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করার জন্য এগোল সে।

কলকাতা শহর একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করলেও শহরের উপকণ্ঠে এ বাড়িটা বেশ প্রাচীন। বাড়ি না বলে একে ছোটখাটো একটা প্রাসাদ বলাই ভালো। নাম ‘মোতি মঞ্জিল।’ ডাক্তার সঞ্জীবন বসু এ বাড়ি সম্পর্কে যতটুকু শুনেছেন তাতে কলকাতা নগরী পত্তনের কিছু সময় পরই মোতি সিংহ নামের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী নাকি এই প্রাসাদ ভবন নির্মাণ করান। অর্থাৎ এই বাড়িটার বয়স কমপক্ষে তিনশ বছর। নিজের দেশ রাজস্থান থেকে বেশ কিছু সুন্দর পাথরের মূর্তি এনে মোতি সিংহ সাজিয়েছিলেন বাড়িটাকে। এখনও তার বেশ কিছু দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটাতে। কিছু দিন আগে এ বাড়িটাকে তুলে দেওয়া হয়েছে এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের হাতে। তাদের মাধ্যমেই প্রাচীর ঘেরা এই বাড়িটাকে মেরামত করে নিয়ে এখানে একটা ‘মানসিক স্বাস্থ্য উদ্ধার কেন্দ্র’ চালান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সঞ্জীবন বসু। অর্থাৎ ‘লুনাটিক অ্যাসাইলাম’, লোকে যাকে চলতি কথায় পাগলাগারদ বলে, সেখান থেকে প্রায় সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার আগে কিছুদিনের জন্য এই মানসিক স্বাস্থ্য উদ্ধার কেন্দ্রে এনে রাখা হয়।

বাড়ির ভিতর নিজের কাজের ঘরে বসেছিলেন সঞ্জীবন। বেলা দশটা বাজে। সূর্যের আলো খেলা করছে সামনের বাগানে। তিনদিন আগে তিনি অ্যাসাইলাম থেকে একজন প্রায় সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীকে এনেছেন এ বাড়িতে। লোকটার নাম অপরেশ মিশ্র। লোক মানে একজন যুবক। তার কেস হিস্ট্রিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন মনোবিদ সঞ্জীবন। প্রায় সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর কেস হিস্ট্রিটা বড় অদ্ভুত!

সরকারি আর্ট কলেজে অধ্যাপনার কাজ করেন অপরেশ। হঠাৎই তার মাথাটা কেমন যেন গণ্ডগোল হয়ে যায়। সে দাবি করতে থাকে তার নাম নাকি চম্পক সিংহ। জয়পুরের অম্বর প্রাসাদে সে নাকি ভাস্করের কাজ করত। আদি বাড়ি তার রাজস্থানের বিকানিরে! তার প্রেমিকা মঞ্জরী নামের কোনও এক মেয়ের খোঁজে সে রাজস্থান থেকে এ-বাংলাদেশে এসেছে! অথচ তার পরিবারের দাবি রাজস্থান তো দূরের কথা অপরেশ কোনওদিন কলকাতা ছেড়ে দীঘা পর্যন্ত যায়নি। যাই হোক, সেই মঞ্জরীর খোঁজে নাকি কলকাতার রাস্তায় পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছিল অপরেশ। বাধ্য হয়ে তাকে তার বাড়ির লোকরা অ্যাসাইলামে পাঠায়। দীর্ঘদিন সেখানে থাকার পর বর্তমানে সে প্রায় সুস্থ।

কেস হিস্ট্রিটা দেখছিলেন তিনি। এমন সময় অপরেশ সে ঘরে প্রবেশ করল। গুড মর্নিং জানিয়ে সে ডাক্তার সঞ্জীবন বসুর চেম্বারে বসল। তারপর প্রশ্ন করল, ‘আমি কবে বাড়ি ফিরব ডাক্তারবাবু? বাড়ি ফিরে আমাকে কাজে যেতে হবে। অনেকদিন সেখানে যেতে পারিনি অসুস্থ ছিলাম বলে।’

মনোবিদ সঞ্জীবন প্রথমে হেসে জবাব দিলেন ‘আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে ছেড়ে দেব।’

এ কথা বলার পর অপরেশ কতটা সুস্থ হয়েছে তা একবার পরীক্ষা করার জন্য সঞ্জীবন তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, আপনি চম্পক সিংহ বলে কোনও নামের সঙ্গে পরিচিত?’

অপরেশ জবাব দিল ‘না।’

‘মঞ্জরী নামের কোনও মহিলার সঙ্গে?’

অপরেশ জবাব দিল, ‘না, এ নামের কোনও মহিলাকে তো চিনি না। নামটাই প্রথম শুনলাম।’

সঞ্জীবন তাকে শেষ প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি রাজস্থানে গেছিলেন কখনও? জয়পুরের অম্বর প্রাসাদে?’

সমরেশ বলল, ‘দীঘা, পুরী দেখা হল না তো রাজস্থান! কলকাতার বাইরেই কখনও যাওয়া হয়ে ওঠেনি।’

অপরেশের জবাব শুনে ডাক্তার সঞ্জীবন বসু বুঝতে পারলেন অপরেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে। তার মাথার ভিতর থেকে মুছে গেছে অদ্ভুত ভাবনাগুলো।

অপরেশ এরপর তাকাল জানলার দিকে। আলো ঝলমলে সকালে জানলার বাইরে একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতপাথরের তৈরি একটা পূর্ণাবয়ব নারীমূর্তি। যেটা দেখিয়ে অপরেশ, ডাক্তারবাবুকে বলল ‘মূর্তিটা খুব সুন্দর তাই না? কাল বিকালে বাগানে ঘুরতে ঘুরতে দেখেছিলাম। ওটা কার মূর্তি?’

সঞ্জীবন মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ভারি সুন্দর মূর্তি। প্রাচীন মূর্তি। তবে কার মূর্তি বলতে পারব না। শুনেছি মূর্তিটা নাকি রাজস্থান থেকে বহুকাল আগে আনা হয়েছিল।’

তবে মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে একটা ব্যাপার তারা কেউ খেয়াল করল না। মূর্তির হাতে ধরা পাথরের তৈরি ফুলের মালাটা আর নেই। সেটা তার হাত থেকে খসে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে তার পায়ের কাছে।

মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অপরেশ বলল, ‘মঞ্জরী বলে কাউকে আমি না চিনলেও আপনার বলা ওই নামটা আমার বেশ লেগেছে। শিল্পী ভাস্করদের মধ্যে প্রস্তরমূর্তির নাম দেওয়ার একটা রেওয়াজ আছে, জানেন নিশ্চয়। আমি এই মূর্তির ভাস্কর না হলেও আমার খুব ইচ্ছে করছে সেই মূর্তিটার একটা নাম দিতে। তাই, আজ থেকে এই মূর্তিটার নাম দিলাম—”মঞ্জরী”।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *