মায়া মারীচ
শাম্বদের কটেজটার সামনে থেকেই শুরু হয়েছে ঘাসবন। মাঝে মাঝে কিছু বড়ো বড়ো গাছও আছে। তারপর জমিটা কিছুটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে পান্নাসবুজ কেন নদীর বুকে। নদীর ওপাশেও জঙ্গল। কেন নদী এঁকেবেঁকে সাপের মতো প্রবাহিত হয়েছে মধ্য ভারতের এই পান্না অভয়ারণ্যের বুক চিরে। যার পোশাকি নাম—পান্না টাইগার রিজার্ভ। শাম্বদের এই কটেজটা বেসরকারি হলেও পান্না টাইগার রিজার্ভের অন্তর্গতই বলা যায়। দিন পাঁচেক হল, মধ্য ভারতের এই জঙ্গলময় অঞ্চলে এসেছে তারা। বান্ধবগড়, কানহা হয়ে অবশেষে তারা আজ সকালেই এসে উপস্থিত হয়েছে পান্নাতে। তারা মানে শাম্ব আর তাদের সফটওয়্যার কোম্পানির অন্যতম ডিরেক্টর পেডি ডায়ার। ‘ডায়ার’ শব্দটা শুনলে ভারতীয়দের জেনারেল ডায়ারের কথা মনে পড়ে গেলেও ডায়ারের সঙ্গে রাজনীতি বা পুলিশ-মিলিটারির কোনও সম্পর্ক নেই তার স্বদেশ বা এ দেশে। যদিও তার পূর্বপুরুষরা একসময় এ দেশে প্রায় দুশো বছর ধরে শাসন করেছিল। ব্রিটিশ নাগরিক মাঝবয়সি পেডি ডায়ার একজন আদ্যোপান্ত ব্যবসায়ী। ব্যবসায়িক কাজে দিন দশেক আগে সে কলকাতায় এসেছিল। সে কাজ মেটার পর সে ভারতীয় জঙ্গল, বিশেষত বাঘ দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। সুন্দরবন কলকাতার ঘরের কাছে হলেও বাঘের দেখা পাওয়া সেখানে দুর্লভ ব্যাপার। ট্যুরিস্টদের জন্য বাঘ দেখার আদর্শ জায়গা মধ্যপ্রদেশের অভয়ারণ্যগুলো। তাই পেডি ডায়ারের এখানে আসা ঠিক হয় আর শাম্বদের কোম্পানিও ডায়ারের সফরসঙ্গী হিসাবে শাম্বকে জুড়ে দেয় তার সঙ্গে। এ সুযোগ হাতছাড়া করেনি শাম্ব। এর কারণ, এ জায়গাগুলোতে আগে কোনও দিন বেড়াবার সুযোগ হয়নি শাম্বর। তার ওপর আবার কোম্পানির পয়সায় ভ্রমণ। এমনকি কলকাতায় ফিরে তার ওপর খুশি হয়ে ডায়ার তার পদোন্নতির ব্যবস্থা করে যেতে পারে। ডায়ারকে এই বহুজাতিক সংস্থার অন্যতম মালিকও বলা যেতে পারে। তবে শাম্বদের বরাতটা খারাপই বলতে হবে। বান্ধবগড় বা কানহাতে ট্যুরিস্টরা প্রায়শই বাঘের দেখা পেলেও শাম্বরা পায়নি। হয়তো জুন মাসের প্রচণ্ড গরমই এর কারণ। গভীর বনের ঝোপঝাড়ের ছায়ার আড়াল থেকে বাইরে বেরোচ্ছে না তারা। বান্ধবগড়েও যখন বাঘের দেখা মিলল না তখন ডায়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে কলকাতা ফিরে যাবে। তারপর সেখান থেকে হিথরো এয়ারপোর্টের বিমান ধরবে। এই পান্নার জঙ্গলের কটেজে আসার কথাই ছিল না শাম্বদের। কিন্তু বান্ধবগড়ের রিসর্টে তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল এক মারাঠি ট্যুরিস্ট দম্পতির। তারা এ জায়গা হয়ে বান্ধবগড় গিয়েছিল। তারাই শাম্বদের জানাল যে, এই কটেজের বারান্দা থেকে নাকি তারা পরপর দু-দিন বাঘ দেখেছে! কথাটা শুনে ডায়ার শাম্বকে বলল, ‘বাঘের খোঁজে পাঁচ দিন যখন দুটো জঙ্গলে সময় নষ্ট করলাম, তখন না হয় আরও দুটো দিন নষ্ট করার ঝুঁকি নিই। আমি ওই পান্নার জঙ্গলে যাব। হয়তো শেষ পর্যন্ত ওখানেই বাঘের দেখা পাব। জঙ্গলে অনেক ঘুরেছি আমি। আমি যখন যে দেশে যাই, তখন সে দেশের বিশেষ প্রাণীটাকে দেখার চেষ্টা করি। ঠিক সেই প্রাণী, যা অন্য দেশে বিশেষ মেলে না। যেমন আফ্রিকাতে লোকে সিংহ দেখতে যায়। কিন্তু সিংহ তো আফ্রিকা, এশিয়ার অনেক দেশেই পাওয়া যায়। আমি আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলাতে দুষ্প্রাপ্য অ্যান্টিলোপ ‘কুডু’ দেখতে গিয়েছিলাম, তার দেখা পেয়েছি। ব্রাজিলের আমাজনের অরণ্যে কালো বাঘ অর্থাৎ ব্ল্যাক প্যান্থার দেখতে গিয়েও বিফল হইনি। আর ভারতবর্ষের বন্য প্রাণী মানেই আমাদের কাছে বাঘ। তা শুধু ব্রিটিশ শিকারি জিম করবেটের শিকার কাহিনির জন্য নয়। এখনও লন্ডনের অনেক বাড়িতে এ দেশের বাঘের মাথা রাখা আছে, যাদের পূর্বপুরুষরা এ দেশে নানা কাজে এসেছিলেন। এ দেশে এসে বাঘ না দেখে ফিরে যাবে? চলো, একবার দেখেই আসি জায়গাটা।’ আর তারপরই শাম্বদের এ জায়গাতে আসা। এই কটেজের কেয়ারটেকারের নাম ভুজবল সিং। স্থানীয় মানুষ সে। বংশপরম্পরায় এই বুন্দেলখণ্ডের মানুষ প্রৌঢ় লোকটা। এখানে আসার পরই ডায়ার আর শাম্ব লোকটার মুখ থেকে শুনেছে যে, কথাটা নাকি মিথ্যা নয়, এরপর বেশ ক-টা দিন নাকি বাঘ ঘোরাফেরা করেছে এই বনবাংলো আর কেন নদীর মধ্যবর্তী অবস্থান। আরও একটা কথা তাদের বলেছে ভুজবল। বাঘটা নাকি নরখাদক! কেন নদীর ওপারে দুজন গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে সে। তারা কাঠ সংগ্রহ করতে বনে ঢুকেছিল। সেই দুটো নরহত্যার পর গ্রামবাসীরা যখন ক্যানেস্তারা-বাজানো বন-খেদানো ‘হুলা পার্টি’ আর স্থানীয় গাদাবন্দুকধারী শিকারিদের নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করে, তখন তাদের তাড়া খেয়েই নাকি সেই বাঘটা কেন নদী সাঁতরে এদিকে এসেছে। কথাটার সত্য-মিথ্যা অবশ্য জানা নেই শাম্বদের। এটা ঠিক যে, একটা বাঘকে এখানে দেখা গেছে। কিন্তু এমনও হতে পারে যে, কেয়ারটেকার ভুজবল বাঘটার প্রতি বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি করার জন্য এ গল্প ফেঁদেছে।
বেলা বারোটা নাগাদ এই কটেজ বা বনবাংলোতে এসে পৌঁছেছিল শাম্বরা। বেশ অনেকটা পথ একটা ভাড়া গাড়িতে অতিক্রম করে তারা এখানে এসেছে। সে গাড়িটা তাদের নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে গেছে মাঝের দুটো দিন বাদ দিয়ে তারপর আবার শাম্বদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। অর্থাৎ তিন রাত এখানে কাটাবে তারা। আর তেমন যদি হয় যে, আজকালের মধ্যেই ডায়ার বাঘের দেখা পেয়ে গেল, তবে ফোন করলেই এখানে চলে আসবে— বলে গেছে ভাড়ার গাড়ির সেই ড্রাইভার। বান্ধবগড় থেকে পান্নার দূরত্ব বেশ অনেকটা। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তারা এই বাংলোতে পৌঁছে বেশ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। বিশেষত ডায়ার বলতে গেলে শীতের দেশের মানুষ। মধ্য ভারতের এ গরমে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল সে। কটেজে পৌঁছোবার পর স্নান সেরে ভুজবলের রান্না-করা রুটি আর গরম মুরগির ঝোল খেয়ে পাশাপাশি দুটো ঘরে শুয়ে পড়েছিল ডায়ার আর শাম্ব। তিনটে মাত্র ঘর এখানে। তার মধ্যে দুটো ঘর অতিথিদের আর একটা ঘর ভুজবলের নিজের জন্য বরাদ্দ। বিছানাতে শোবার পরই ঘুম নেমে এসেছিল তাদের চোখে।
(২)
শাম্বর যখন ঘুম ভাঙল, তখন শেষ বিকেল। ঘর সংলগ্ন কাঠের রেলিং-দেওয়া বারান্দায় সে এসে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডায়ারও তার ঘর থেকে ঘুম ভাঙার পর বাইরে এসে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুজবল চা এনে হাজির করল তাদের সামনে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে শাম্বরা তাকাতে লাগল সামনের ঘাসবন আর নদীর দিকে। আর একটু পরই সূর্য অস্ত যাবে। দিনশেষের আলো ছড়িয়ে পড়েছে পান্নাসবুজ কেন নদী আর ঘাসবনের বুকে। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে পুড়ে এমনিতেই হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে ঘাসবন। তার ওপর বিদায়ি সূর্যের আলো পড়ে তাকে ঠিক উজ্জ্বল সোনারঙের মনে হচ্ছে। অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য! চুপচাপই চা পান করছিল ডায়ার। শাম্বর সঙ্গে অন্তত বছর পনেরোর বয়সের পার্থক্য ডায়ারের। এ ক-দিনে তার সঙ্গে বেশ কিছুটা অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছে শাম্বর। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ডায়ারই কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। কার্যক্ষেত্রে ডায়ার শাম্বর ঊর্ধ্বতন কর্তা হলেও সে শাম্বকে কলকাতা ছাড়ার পরই বলেছিল, ‘দেখো, এটা অফিস নয়। কাজেই অফিশিয়াল ফর্মালিটিজের দরকার নেই। তাতে ভ্রমণের ছন্দ ব্যাহত হতে পারে। ধরে নাও, আমরা এখন বন্ধু। অফিসে ফিরে গেলে তখন আমি আবার তোমার বস।’
কিছুটা তফাতে বারান্দাতে দাঁড়িয়ে ছিল কেয়ারটেকার ভুজবল। হঠাৎ সে শাম্বদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, ‘ওই দেখুন স্যার। ঘাসবনের মাঝখানে ফাঁকা জমিটা দেখুন।’
বাঘ নাকি? ভুজবলের কথা শুনে মৃদু চমকে উঠে বেতের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল ডায়ার আর শাম্ব। ঘাসবনের মাঝে একটা জায়গাতে টাকের মতো ফাঁকা জায়গা আছে। ভুজবলের কথা অনুসরণ করে সেদিকে তাকিয়ে তারা দুজন দেখতে গেল প্রাণীটাকে। তবে সে বাঘ নয়, বিশাল আকৃতির একটা চিতল হরিণ বা স্পটেড ডিয়ার। একটা পুরুষ হরিণ। কী বিশাল শাখাপ্রশাখাযুক্ত শিং তার! বান্ধবগড় আর কানহাতে বাঘ চোখে না পড়লেও চিতল হরিণ বিস্তর চোখে পড়েছে শাম্বদের। কিন্তু এত বড়ো হরিণ তারা এর আগে দেখেনি। ভুজবল এরপর বলল, ‘ওর নাম মারীচ। আমরা ওকে এ নামে ডাকি। হরিণদের দলপতি ও। এত বড়ো চিতল হরিণ মধ্যপ্রদেশের কোনও ফরেস্টে দেখতে পাবেন না। অনেক ট্যুরিস্ট এখানে আসে শুধু মারীচকে দেখতে। রামায়ণের মারীচের কথা আপনি জানেন নিশ্চয়ই?’ বলা বাহুল্য, শেষ বাক্যটা কেয়ারটেকার বলল শাম্বর উদ্দেশে। অন্য সবার মতো রামায়ণের মারীচের গল্পটা শাম্বরও জানা। রাক্ষসরাজ রাবণ তার অনুচর মারীচকে স্বর্ণ মৃগের ছদ্মবেশে পাঠিয়েছিলেন রাম-সীতা-লক্ষ্মণের পর্ণকুটিরের কাছে। সোনার হরিণ দেখে সীতা তার পতি রামকে অনুরোধ করেন সোনার হরিণ ধরে দেবার জন্য। রামচন্দ্র তাঁর ভ্রাতা লক্ষ্মণকে সীতাদেবীর প্রহরার দায়িত্বে রেখে বনমধ্যে স্বর্ণমৃগের পশ্চাদ্ধাবন করেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই রামচন্দ্র বুঝতে পারেন যে এই স্বর্ণমৃগ আসলে মায়াবী মারীচ। রাম বাণ নিক্ষেপ করলেন মারীচকে লক্ষ্য করে। কিন্তু শরবিদ্ধ ধূর্ত মারীচ মৃত্যুর আগে রামচন্দ্রর কণ্ঠস্বর নকল করে চিৎকার করল, ‘ভাই লক্ষ্মণ, আমাকে বাঁচাও।’ আর সেই কণ্ঠস্বর সত্যি ভেবে সীতাদেবী লক্ষ্মণকে বাধ্য করলেন রামচন্দ্রের সন্ধানে যাবার জন্য। লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের খোঁজে বনমধ্যে প্রবেশ করলে পর্ণকুটির থেকে অরক্ষিত সীতাকে ভিখারির ছদ্মবেশে কৌশলে হরণ করেন লঙ্কাপতি রাবণ। ভুজবলের কথা শুনে শাম্বর রামায়ণের সেই মারীচের গল্পটা আবার মনে পড়ে গেল। এ মারীচ নিশ্চয়ই রামায়ণের মায়াবী মারীচ নয়। কিন্তু দিনান্তের সোনালি আলোতে বিশালাকৃতির এই হরিণটাকে ঠিক সোনার হরিণের মতোই লাগছে। সোনার বনে সোনার হরিণ। সে তাকিয়ে আছে এই বনবাংলোর দিকেই। এরপর তার পেছনে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করতে লাগল বিরাট একটা হরিণের পাল। মারীচ সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল বাংলো আর ঘাসবনের চারপাশে। আর তার তত্ত্বাবধানে ঘুরে বেড়াতে লাগল অন্য হরিণগুলো। অপূর্ব দৃশ্য।
মারীচকে দেখে ডায়ার একটা বিস্ময়সূচক শব্দ করল ‘ওয়াও!’ বলে।
শাম্ব ডায়ারকে বলল, ‘কেয়ারটেকার বলছে এই হরিণটার নাম মারীচ।’
ডায়ার কথাটা শুনে ভুজবলকে প্রশ্ন করল, ‘মারীচ মানে কী?’
এই বনবাংলোতে মাঝে মাঝে বিদেশি ট্যুরিস্ট আসে বলে ভাঙা ভাঙা কিছু ইংরেজি বলতে ও বুঝতে পারে ভুজবল। কিন্তু ইংরেজিতে মারীচের কাহিনি ডায়ারকে ব্যাখ্যা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই সে শাম্বকে বলল, ‘আপনি সাহেবকে বুঝিয়ে দিন।’
শাম্ব ডায়ারকে প্রথমে প্রশ্ন করল, ‘তুমি রামের নাম শুনেছ? তার কাহিনি রামায়ণে পড়েছ?’
ঘাসবনে দাঁড়িয়ে থাকা মারীচের দিকে চোখ রেখে ডায়ার জবাব দিল, ‘রামের নাম আমি শুনেছি। তোমরা হিন্দুরা তাকে দেবতা মানো। কিন্তু রামায়ণ পড়িনি।’
ডায়ারের জবাব শোনার পর শাম্ব সংক্ষেপে তাকে ব্যক্ত করল রামায়ণের মারীচের সেই কাহিনি। ছদ্মবেশী সোনার হরিণের গল্প। ডায়ার মারীচের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললেন, ‘সত্যিই ওই প্রাণীটাকে সোনার হরিণের মতোই লাগছে!’
কিন্তু এরপরই শাম্ব আর ভুজবলের দিকে তাকিয়ে ডায়ার বলে উঠল, ‘কিন্তু এ দৃশ্যের মানে হল বাঘটা আর এখানে নেই। আমাদের এখানে আসাটাও সম্ভবত বৃথা গেল!’
কথাটা শুনে শাম্ব মৃদু বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ‘বাঘ নেই কেন?’
ডায়ার হতাশভাবে বলল, ‘কাছাকাছি বাঘ থাকলে তোমাদের ওই মারীচ নিশ্চয়ই তার সঙ্গীদের নিয়ে এ জায়গাতে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারত না? বাঘ চলে গেছে এ জায়গা থেকে।’
ডায়ার নানা দেশের অনেক জঙ্গলে ঘুরেছে। জঙ্গলের নিজস্ব কিছু ভাষা আছে তা অল্পস্বল্প হলেও পাঠ করতে জানে ডায়ার। তার নিরিখেই কথাটা বলল সে।
ডায়ারের কথাটা শুনে শাম্বও কিছুটা হতাশ হল। কিন্তু ভুজবল সম্ভবত শাম্বদের প্রবোধ দেবার জন্যই বলল, ‘বাঘ তো আর এক জায়গাতে থাকে না। আট-দশ মাইল এলাকা নিয়ে চক্কর দেয়। যাকে বলে বাঘ চক্কর বা বিট। সে হয়তো এখন দূরে আছে। রাত হলেই আবার এখানে ফিরে আসবে। আপনারা তাকে দেখতে পাবেন। পরপর দু-দিন ওই মারীচ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই একদিন ভোরে আর একদিন রাতে বাঘটা এসে দাঁড়িয়েছিল।’
কিন্তু তার কথা শুনে ডায়ার বলল, ‘সে তুমি যা-ই বলো না কেন, আমার ধারণা, বাঘটা আর এখানে ভিড়বে না।’
এ কথা বলার পর সে শাম্বর উদ্দেশ্যে বলল, ‘অরণ্যের আর এক নাম রোমাঞ্চ। কিন্তু তোমাদের এ দেশের জঙ্গলে তেমন কোনও রোমাঞ্চ পেলাম না।’
শাম্ব এ কথার কী জবাব দেবে? সে চুপ করে তাকিয়ে রইল মারীচ আর হরিণগুলোর দিকে। ডায়ারও দেখতে লাগল হরিণগুলোকে।
হঠাৎ ডায়ার ভুজবলকে বলল, ‘আমরা এসে তোমার দরজাতে কড়া নাড়ার পর তুমি দরজা খুললে, তখন তোমার ঘরের দেওয়ালে একটা বন্দুক ঝুলতে দেখেছি, মনে হচ্ছে?’
ডায়ারের কথা ঠিক। শাম্বও ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল ডায়ারের কথার জবাবে ভুজবল বলল, ‘হ্যাঁ, সাহেব। দিশি বন্দুক। যদি কোনও হিংস্র প্রাণী এখানে উঠে আসে, তবে ফাঁকা আওয়াজ করে তাকে তাড়িয়ে দেবার জন্য বন্দুকটা রাখা আছে।
ডায়ার বলল, ‘ও বন্দুক দিয়ে বাঘ বা হাতি শিকার না করা গেলেও নিশ্চয়ই হরিণ শিকার করা যায়? তুমি কোনও দিন শিকার করোনি?’
ভুজবল জবাব দিল, ‘হরিণ শিকার তো নিষিদ্ধ। তবে একবার একটা দাঁতাল শূকর মেরেছিলাম। খুব উৎপাত করত প্রাণীটা। এই কটেজের কাছাকাছি ঘুরত সে। কোনও লোক দেখলেই তাড়া করত। তবে সেটাও ঠিক শিকার বলা যাবে না। তাড়াবার জন্য গুলি চালিয়েছিলাম, কিন্তু গুলিটা তার গায়ে লেগে গেল। তবে মিথ্যা বলব না, খাবারের জন্য কিছু বুনো খরগোশ মেরেছি ওই বন্দুক দিয়ে।’
ডায়ার বলল, ‘তোমাদের এখানে তো শিকার নিষিদ্ধ। নইলে হরিণ শিকার করলেও একটু উত্তেজনার স্বাদ পাওয়া যেত। বাঘ না দেখার আক্ষেপটা কাটত।’
ডায়ারের কথা শুনে শাম্ব বিস্মিতভাবে বলল, ‘তুমি শিকার করেছ?’
ডায়ার বলল, ‘আমার ইয়র্কশায়ারের বাড়িতে একটা উইনচেস্টার রাইফেল আছে। লেপার্ড-বাইসনের মাথা এমন কিছু ট্রফিও আছে। আমার ঠাকুরদা একসময় ভারত আর আফ্রিকার জঙ্গলে শিকার করেছেন। কেনিয়াতে মাঝে মাঝে শিকারের পারমিট দেয়। বছরখানেক আগে আমি ব্যবসার কাজে নাইরোবি গিয়েছিলাম। তখন ওই পারমিট নিয়ে, এক স্থানীয় শিকারিকে সঙ্গে নিয়ে আফ্রিকার কেনিয়াতে শিকার করেছি। সিংহ হয়তো মারিনি, কিন্তু বেশ কয়েক ধরনের হরিণ আর অ্যান্টিলোপ মেরেছিলাম। সামান্য হলেও আমার শিকারের অভিজ্ঞতা আছে। শিকার ব্যাপারটা কিন্তু বেশ থ্রিলিং। সে হাতি শিকারই হোক বা হরিণ।’
ডায়ারের ও শখের কথা জানা ছিল না শাম্বর। সে বেশ অবাক হল ডায়ারের কথা শুনে।
সূর্য এরপর দ্রুত ঢলতে শুরু করল। মারীচ যেন এবার একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। রাত এলে অরণ্যে খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক প্রকট হয়ে ওঠে। বিশেষত যেসব জঙ্গলে মাংসাশী হিংস্র প্রাণী আছে, সেখানে। অরণ্যের রাতই বিশেষত হরিণজাতীয় প্রাণীদের মধ্যে কে কে পরদিন সূর্যোদয় দেখবে তা ঠিক করে দেয়। বিশালাকার চিতল হরিণটা শেষ একবার তাকিয়ে নিল কটেজটার দিকে। তারপর অদ্ভুত একটা ডাক ছেড়ে প্রবেশ করল ঘাসবনের ভেতর। তাকে অনুসরণ করল তার সঙ্গীরা। বেশ অনেকক্ষণ ঘাসবনের মাথার ওপর দিয়ে মারীচের বিশাল চলমান শিংটা দেখতে পেল শাম্বরা।
আর এরপরই ঝুপ করে অন্ধকার নামল অরণ্যের বুকে।
(৩)
সন্ধ্যা নামার পরই যে যার ঘরে ঢুকে পড়েছিল শাম্বরা। আর ভুজবল চলে গিয়েছিল তার ঘর সংলগ্ন রান্নাঘরে শাম্বদের রান্না চাপাতে। রাত আটটা নাগাদ সে ঘরে এসে খাবার দিয়ে গেল। চাপাটি আর মুরগির কারি। এই কটেজে ইলেকট্রিসিটি নেই। ছাদের ওপর একটা সোলার বা সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসানো আছে, তাতে দুটো ঘরে খুব মন্থরভাবে ফ্যান ঘোরে আর একটা করে খয়াটে বাতি জ্বলে। সেই আলোতেই খাওয়া সেরে নিল শাম্ব। তারপর রাতের পোশাক পরে সে যখন বারান্দায় এসে দাঁড়াল, তখন সে দেখতে পেল, তার আগেই ডায়ার খাওয়া সেরে বাইরে বারান্দাতে চেয়ারে এসে বসেছে। তার পরনে ড্রেসিং গাউন। সামনের নিচু টেবিলটাতে বেশ বড়ো একটা পানীয় ভরতি গ্লাস রাখা। সে নিশ্চুপভাবে তাকিয়ে আছে জঙ্গলের দিকে। তার কিছুটা তফাতে সম্ভ্রমের দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে ভুজবল। তারও দৃষ্টি ঘাসবনের দিকে। সম্ভবত ব্যাঘ্র সন্দর্শনের যদি সুযোগ ঘটে, সে জন্যই জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে তারা। শাম্ব এসে ডায়ারের কাছেই একটা চেয়ারে বসল। ডায়ার একবার শাম্বর দিকে তাকিয়ে নিয়ে আবার ঘাস-জঙ্গলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।
অনেকক্ষণই চাঁদ উঠে গেছে। চাঁদটা দেখে শাম্বর মনে হল, সম্ভবত কাল বা পরশুই পূর্ণিমা হবে। প্রায় পূর্ণচন্দ্র। বিরাট বড়ো গোল সোনার মতো চাঁদ। সেই চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জঙ্গলটা। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত অরণ্য। কেন নদীর একটা অংশও দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোতে চওড়া রুপোলি ফিতের মতো চিকচিক করছে নদীটা। ভুজবল শাম্বদের বলেছে যে, পরদিন ভোরে ওই নদীর তীরে নিয়ে যাবে। নানা প্রাণী সকালে নদীতে জল খেতে আসে। ভাগ্য ভালো থাকলে তাদের দেখা মিলে যেতে পারে। একবার নাকি সকালবেলা ভুজবল ট্যুরিস্ট পার্টিদের নিয়ে নদীর তীরে গিয়ে বাঘের দর্শনও পেয়েছিল। ওপারের জঙ্গল থেকে একটা বাঘ বেরিয়ে এসে নদীতে জল খেতে নেমেছিল! চাঁদের আলোতে অপূর্ব লাগছে জঙ্গলের নৈসর্গিক দৃশ্য। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শাম্বর একটা কথা মনে হল। কে যেন একবার তাকে বলেছিল যে, ‘বন্যপ্রাণী দেখার জন্য জঙ্গলে না যাওয়াই ভালো। কারণ তাদের দেখা না মিললে এমন জঙ্গলের রূপও চোখে ধরা দেয় না। বন্যপ্রাণী দেখতে হলে, বাঘ-সিংহ-গন্ডার দেখতে হলে চিড়িয়াখানায় যাওয়াই ভালো। আর জঙ্গলে যদি যাও, তবে তার সৌন্দর্য দেখার জন্যই যাও। বন্যপ্রাণী দেখার আশা নিয়ে যেয়ো না। যদি তাদের কারও দেখা সেখানে পাও, তবে জানবে সেটা তোমার বাড়তি পাওনা।’ জ্যোৎস্নাময় ঘাসবনের অপরূপ সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে ও কথা যে কতটা সত্যি তা বুঝতে পারল শাম্ব।
সময় এগিয়ে চলল। নিশ্চুপভাবে শাম্বরা চেয়ে আছে জঙ্গলের দিকে। ডায়ার মাঝে মাঝে তার গ্লাসে আলতো করে চুমুক দিচ্ছে। মাঝে মাঝে নানা আবছা শব্দও ভেসে আসছে ঘাসবনের ভেতর থেকে। ঘাসবনের আড়ালে যেসব প্রাণীরা নৈশবিহারে বেরিয়েছে, ওই শব্দগুলো সম্ভবত তাদেরই পদচারণার শব্দ।
হঠাৎই একটা সময় নদীর পাড় থেকে হরিণজাতীয় কোনও প্রাণীর ডাক শোনা গেল। কয়েকবার ডেকে উঠেই থেমে গেল প্রাণীটা।
ডাকটা শুনে ভুজবল বলে উঠল, ‘ওটা কাঁকর হরিণের ডাক। বাঘ দেখলে অনেক সময় ওরা এমন ডাকে।’ কথাটা শুনে শাম্বরা সোজা হয়ে বসল। কিন্তু এরপর আর ডাকটা শোনা গেল না। জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বসে রইল শাম্বরা। রাত আরও বেড়ে চলল। একসময় শাম্বর মনে হল উঠে যাওয়াই ভালো। কিন্তু ডায়ার একইভাবে বসে আছে বলে উঠে যেতে একটু ইতস্তত বোধ করতে লাগল যে। ঠিক এমন সময় ভুজবল হঠাৎই একটু উত্তেজিতভাবে চাপা স্বরে বলে উঠল, ‘দেখুন, দেখুন স্যার। ফাঁকা জমিটার ডান পাশের ঘাসবনটা নড়ছে! কিছু আছে ওর আড়ালে!’
কথাটা শুনেই উত্তেজনায় চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল ডায়ার আর শাম্ব। হ্যাঁ, ভুজবলের কথাটাই ঠিক। আন্দোলিত হচ্ছে ঘাসবন। কোনও একটা প্রাণী যেন ঘাসবনের আড়াল থেকে এগোচ্ছে ফাঁকা জমিটার দিকে। ওই জায়গাতেই তো চাঁদের আলোতে বাঘের দর্শন পেয়েছিল! কিছু আগে নদীর পাড় থেকে কাঁকর হরিণের ডাকও শোনা গেছে! কাজেই দম বন্ধ করে তারা চেয়ে রইল সেদিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় বনের আড়াল থেকে চাঁদের আলোতে ফাঁকা জমিতে আত্মপ্রকাশ করল প্রাণীটা। না, তবে সে বাঘ নয়, হরিণ। মাথায় বিশাল শিং। দেখে মনে হচ্ছে যে, তার মাথার ওপর শাখাপ্রশাখাওয়ালা শিং দিয়ে যেন ধরে রেখেছে মাথার ওপরের চন্দ্রালোকিত বিশাল আকাশটাকে! সেই মারীচ! হরিণটা ফাঁকা জমিটার মাঝখানে এসে কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল কটেজটার দিকে। চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল শিংওয়ালা মারীচকে দেখে শাম্বর মনে হল, এ দৃশ্য বাঘদর্শনের চেয়ে কম সুন্দর নয়! প্রাণীটা এরপর ধীরে ধীরে ফাঁকা জমি পেরিয়ে উলটো দিকের ঘাসবনের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
শাম্বর চোখে দৃশ্যটা অপূর্ব লাগলেও হরিণটা অদৃশ্য হবার পরমুহূর্তেই ডায়ার বলে উঠল, ‘ডিসগাস্টিং! বাঘ দেখার আশা এ রাতের মতো সত্যি ছাড়তে হল। ও যখন দেখা দিল, তখন এখানে ধারে কাছে কোনও বাঘ নেই।’ কথাগুলো বলে হতাশভাবে আবার ডায়ার চেয়ারে বসে পড়ল। শাম্ব ভুজবলের দিকে তাকিয়ে দেখল, তার মুখেও একটা হতাশার ছাপ ফুটে উঠেছে। সে গরিব মানুষ। সাহেবকে বাঘদর্শন করাতে পারলে বাড়তি বকশিশ পাবার সম্ভাবনা তার থেকেই যায়। সামান্য বেতন আর ট্যুরিস্টদের বকশিশই তো তার সম্বল। কটেজ ভাড়ার টাকা তো তাকে তুলে দিতে হয় মালিকের হাতে। ট্যুরিস্ট সিজন বলতে তো শীতকালের তিন-চার মাস। এই গ্রীষ্মে হাতে গোনা ট্যুরিস্ট আসে। আর এর পরের তিন মাস বর্ষাকালে ফরেস্ট বন্ধ থাকে সে সময় কটেজও বন্ধ থাকে। তিন মাস বেকার অবস্থায় গ্রামে থাকতে হয় ভুজবলকে। কথাগুলো সকালবেলা এখানে আসার পর ভুজবলের মুখ থেকেই শুনেছে শাম্বরা। কাজেই বকশিশের সুযোগ নষ্ট হলে হতাশা তো আসবেই তার মনে।
নিস্তব্ধভাবে কেটে গেল আরও কিছু মিনিট। তারপর হঠাৎ ডায়ার, ভুজবলকে প্রশ্ন করল, ‘মারীচ নামের এই হরিণটা কি এই কটেজের সামনের ঘাসবনেই সবসময় ঘোরাঘুরি করে?’
ভুজবল বলল, ‘হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও ও দর্শন দেবে এখানে। কখনও দলবল নিয়ে আবার কখনও একা। তবে ও আসবেই।’
শাম্ব জানতে চাইল, ‘এখানে আসে কেন?’
ভুজবল জবাব দিল, ‘আসলে আমি মাঝে মাঝে গিয়ে ওই ফাঁকা জমিটাতে নুন ছড়িয়ে আসি। জানেন তো, হরিণরা নুন চাটতে খুব ভালোবাসে। ওই নুনের লোভেই ও এখানে আছে। ওর জন্যই আমি নুন ছেটাই, যাতে ও এখানে আসে। জঙ্গলে বাঘ দেখার সৌভাগ্য আর কজনের হয়। যাতে ট্যুরিস্টরা এখানে এলে ওকে অন্তত দেখতে পায়, সে জন্য।’
কিন্তু ডায়ারের হতাশা যেন কিছুতেই কাটছে না। সে বলে উঠল, ‘হরিণ তো আমি আফ্রিকাতে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখেছি। বান্ধবগড়, কানহাতেও দেখলাম। হরিণ সর্বত্রই থাকে। আমি কিন্তু বাঘ দেখতেই এখানে এসেছিলাম, হরিণ দেখতে নয়।’
ডায়ারের কথা শুনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল ভুজবল।
ডায়ার এরপর হঠাৎ ভুজবলকে প্রশ্ন করল, ‘তোমাদের এখানে পোচার অর্থাৎ চোরাশিকারি নেই?’
ভুজবল জবাব দিল, ‘আছে। মাঝে মাঝে উৎপাত করে তারা।’
ডায়ার তার জবাব শুনে বলল, ‘তোমাদের এই মারীচ নামের হরিণটা তো বেশ নধরকান্তি। শুনেছি চিতল হরিণের মাংস বেশ সুস্বাদু হয়। এর মাংসই নাকি সেরা মাংস। চোরাশিকারিরা ওকে মারার চেষ্টা করেনি।’
কেয়ারটেকার বলল, ‘করেছিল বেশ কয়েকবার, কিন্তু পারেনি।’
ডায়ার জানতে চাইল, ‘পারেনি কেন?’
এ প্রশ্ন শুনে প্রথমে একটু চুপ করে থাকল ভুজবল। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, ‘লোকে বলে রামায়ণের সেই মারীচ হরিণের মতো এ হরিণটাও মায়াবী। এ জন্যই ওর নাম মারীচ দেওয়া হয়েছে। শিকারিরা ওকে মারতে পারে না। ওর গায়ে গুলি লাগে না, ফসকে যায়। বাঘও নাকি ওর কিছু করতে পারে না। বাঘের নাকের ডগায় ও ঘুরে বেড়ায়। শেষ একবার এক শিকারি ওর পিছু ধাওয়া করেছিল। মারীচ তাকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে নদীর তীরে দলবদল অর্থাৎ চোরাবালির মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলে। সেখানেই ডুবে মরে লোকটা। তারপর থেকে চোরাশিকারিরা আর ভয়ে ওর দিকে নজর দেয় না।’
ভুজবলের কথাগুলো শাম্ব আরও একবার ডায়ারকে বুঝিয়ে বলতেই ডায়ার হেসে উঠে বলল, ‘মায়াবী! যত্তসব আজেবাজে কথা। হরিণটাকে যাতে কেউ মারার চেষ্টা না করে, সে জন্য নির্ঘাত এই বাজে গল্প রটনা করা হয়েছে। রক্তমাংসের হরিণ কি গল্পের হরিণের মতো মায়াবী হয়? ওসব শুধু গল্পেই হয়। তুমি এ কথা বিশ্বাস করো নাকি?’
শাম্ব জবাব দিল, ‘না, করি না। তবে গ্রামের সহজ সরল মানুষ অনেক সময় এসব কথা বিশ্বাস করে।’
সাহেব যে তার কথা বিশ্বাস করেনি তা বুঝতে পারল ভুজবল। সে একটু বিমর্ষভাবে শাম্বকে বলল, ‘আমি এবার যাই স্যার। বাসনপত্র ধোয়া-মোছা করতে হবে। কাল ভোরের আলো ফুটলে আপনাদের নদীর তীরে নিয়ে যাব। কাছেপিঠের জঙ্গলটাও পায়ে হেঁটে যতখানি দেখানো যায় দেখাব। আর তার আগে নাস্তার জন্য কিছুটা বন্দোবস্তও আজ করে রাখতে হবে। দেখতে দেখতে ভোর হয়ে যাবে।’
কথাগুলো বলে ভুজবল চলে গেল। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসতে লাগল বাসনপত্র ধোয়ার টুং টাং শব্দ।
জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে লাগল ডায়ার। আর এরপরই মশার ঝাঁক এসে ছেঁকে ধরল শাম্বদের। অনেক রাতও হয়েছে। এবার সত্যিই ঘুম পাচ্ছে শাম্বর। বাধ্য হয়ে সে এবার ডায়ারকে বলল, ‘আমি এবার তবে ঘরে যাই?’
শাম্বর কণ্ঠস্বর শুনে যেন চিন্তাজাল ছিন্ন হল ডায়ারের। গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক চুমুকে অবশিষ্ট পানীয়টা শেষ করে ঠক করে গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল, ‘হ্যাঁ, যাও। আমিও যাব কিছুক্ষণ পর। তার আগে একবার ওই কেয়ারটেকার ভুজবলের সঙ্গে কিছু কথা বলে আসি।’—এই বলে ডায়ার লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোল রান্নাঘরের দিকে।
শাম্বও বারান্দা ছেড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। দরজা বন্ধ করে মশারি টাঙিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। মিনিট কুড়ি পর শাম্ব তখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু দরজাতে টোকা মারার শব্দে আবার খাট ছেড়ে উঠে তাকে দরজা খুলতে হল। ডায়ার দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোনাতে আবছা হাসি। শাম্বকে সে বলল, ‘শেষ পর্যত ভুজবলকে রাজি করালাম। নগদ দশ হাজার টাকা দেব। আর আমাদের কলকাতার অফিসে ওর ছেলের একটা দারোয়ানের চাকরি।’
ডায়ারের কথা বুঝতে না পেরে শাম্ব প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপারে রাজি করিয়েছ?’
শাম্বর কথার জবাবে ডায়ার হেসে বলল, ‘কাল সকালে সব বলব। আপাতত গুড নাইট।’—এই বলে শাম্বকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল ডায়ার। শাম্বর চোখও ঘুমে ঢলে আসছে। সে আবার দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
(৪)
ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল শাম্ব। অ্যালার্মের শব্দে ঠিক ভোর পাঁচটাতে ঘুম থেকে উঠল সে। দাঁত মুখ ধুয়ে পোশাক পালটে তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে বেরোতে মাত্র আধ ঘণ্টামতো সময় লাগল তার। প্রায় একই সময় ঘর থেকে বারান্দায় এল শাম্ব আর ডায়ার। তারা বাইরে বেরোনোর জন্য একেবারে তৈরি হয়েই বেরিয়েছে। সকালের শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বারান্দায় এসে বসল তারা। জঙ্গলের দিকে তাকাল শাম্ব। মনোরম পরিবেশ। ভোরের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়ছে ঘাসবনের ওপর। মৃদু বাতাস বইছে, যে বাতাসে মৃদু মৃদু দুলছে ঘাসবন। পাখির ডাক ভেসে আসছে। শাম্বরা বসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভুজবল নাস্তা নিয়ে এসে টেবিলে নামিয়ে রাখল। ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা, ডিম সেদ্ধ আর বাটার টোস্ট। নাস্তা নামিয়ে রেখে ভুজবল বলল, ‘আমি তৈরি হয়ে আসছি। আপনাদের নাস্তা শেষ হলেই আমি বেরিয়ে পড়ব।’
ভুজবলকে দেখেই শাম্বর মনে পড়ে গেল ডায়ারের বলা গতকাল রাতের কথাগুলো। ভুজবল তার ঘরের দিকে পা বাড়াতেই শাম্ব ডায়ারকে প্রশ্ন করল, ‘ওকে কী ব্যাপারে রাজি করিয়েছ তুমি? ও কি তোমাকে শেষ পর্যন্ত বাঘের ডেরাতে নিয়ে যাবে? বাঘ দেখাবে?’
চায়ের কাপ মুখে তুলে ডায়ার জবাব দিল, ‘আগে জঙ্গলে চলো, তারপর সব বলছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।’
শাম্বরা মিনিট দশেকের মধ্যেই নাস্তা শেষ করল। ভুজবলও এসে হাজির হল তাদের সামনে। তার পরনে খাকি পোশাক। কাঁধে বন্দুক। কটেজের বারান্দা থেকে নেমে এরপর ঘাসবনের দিকে এগোল তারা।
শাম্বরা ঘাসবনে প্রবেশ করল। নতুন আলোতে অন্ধকার মুছে গিয়ে জেগে উঠেছে জঙ্গল। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে পাখির কলকাকলি। একটা বিরাট ধনেশ পাখি শাম্বদের মাথার ওপর দিয়ে উল্লাসে ডাক ছেড়ে উড়ে গিয়ে দূরে একটা গাছের ডালে বসল। তারা তিনজন একটা শুঁড়িপথ বেয়ে এগোতে লাগল নদীতটের দিকে। সেদিকে এগোতে এগোতে একটা নীলগাইও তারা দেখতে পেল। ডায়ার প্রশ্ন করল, ‘মারীচও কি ওদিকে আছে?’
ভুজবল জবাব দিল, ‘সকালের দিকে বন্যপ্রাণীরা নদীতে জল খেতে যায়। হয়তো ও আছে ওখানে।’ ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বড়ো গাছগুলোর মাথায় হনুমানও চোখে পড়তে লাগল। চারপাশ দেখতে দেখতে একসময় নদীর পাড়ে পৌঁছে গেল তারা। নদীর জলের রং পান্নাসবুজ। এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে নদীটা। তবে এখানে নদীটা খুব চওড়া নয়। ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট বিরাট গাছের জঙ্গল। ভুজবল শাম্ব আর ডায়ারকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, ‘নদীতে নামবেন না কিন্তু। বিরাট বিরাট কুমির আছে নদীতে। ওই দেখুন, ওপারে সাদা পাথরটার গায়ে শুয়ে আছে একটা।’ শাম্ব আর ডায়ার ভুজবলের দৃষ্টি অনুসরণ করে সত্যিই দেখতে পেল সেই কুমিরটাকে। নদীর পাড়ে ভেজা মাটিতে জেগে আছে নানা জন্তুর পায়ের ছাপ। তারা সেখানে উপস্থিত হবার কিছুক্ষণের মধেই ঘাসবনের কিছুটা তফাত দিয়ে বাইরে নদীতটে বেরিয়ে এল ছানাপোনা সমেত একটা শূকর পরিবার। কাস্তের ফলার মতো কী বিশাল দাঁত দলপতি বন্য বরাটার। শাম্বদের প্রথমে খেয়াল করেনি তারা। নদীতে নেমে প্রথমে জলপান করল সকলে। এরপরই দলপতি শূকরটা দেখতে পেয়ে গেল তাদের। অদ্ভুত বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে সঙ্গীদের নিয়ে নদীতট ছেড়ে সে আবার ঘাসবনে ঢুকে গেল।
ডায়ার ভুজবলকে বলল, ‘কিন্তু যার খোঁজে এখানে আসা, সেই মারীচ কই?’
ভুজবল বলল, ‘জল খেয়ে হয়তো তার দলবল নিয়ে ফিরে গেছে। কিন্তু সে এখানে থাকলেও কাজটা করা যেত না। ওপারের জঙ্গলের ভেতর ফরেস্ট গার্ডরা অনেক সময় বসে বাইনোকুলার নিয়ে এপারের দিকে নজর রাখে। তাছাড়া খোলা জায়গাতে বন্দুকের শব্দ অনেক দূর যায়।’
কথাটা শুনে শাম্ব বলল, ‘তার মানে?’
ডায়ার এবার তাকে বলল, ‘তুমি যে কথাটা জানতে চাইছিলে, সে কথাটা এবার বলি—মারীচকে শিকার করব আমি।’
কথাটা শুনে শাম্ব বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ‘কেন? তাছাড়া শিকার তো নিষিদ্ধ। জেল হবে হরিণ মারলে।’
ডায়ার বলল, ‘হরিণটা মারব রোমাঞ্চ অনুভব করার জন্য। বাঘ তো দেখা হল না। অরণ্যের একটা রোমাঞ্চকর ঘটনা অন্তত মনের মধ্যে করে দেশে ফিরব। তবে ভয়ের কোনও কারণ নেই। ওর দেহটা জঙ্গলের মধ্যেই পুঁতে ফেলব। তার আগে অবশ্য কিছুটা মাংস কেটে নেব। হরিণের মাংস খুব সুস্বাদু। বিশেষত চিতলের।’
শাম্ব এবার স্পষ্টই প্রতিবাদের স্বরে বলে উঠল, ‘না, তুমি এ কাজটা করতে পারো না। শুধু আইনকে ফাঁকি দেবার ব্যাপারই নয়। একটা নৈতিকতার প্রশ্নও আছে। কী সুন্দর নিরীহ একটা প্রাণী। কত লোক দেখতে আসে ওকে। ও তো কারও ক্ষতি করেনি। শুধু শিকারের নেশাতে ওকে অযথা হত্যা করবে কেন?’
ডায়ারের কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে শাম্বর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আমি যা সিদ্ধান্ত নিই, সেটাই করি। তোমার আমাকে সঙ্গদানের ইচ্ছা না থাকলে তুমি চলে যেতে পারো। তবে একটা কথা মনে রেখো যে, তোমার পদোন্নতি এবং কর্মচ্যুতি—এ দুটোই কিন্তু আমার ওপর নির্ভর করে।’
ডায়ারে কথা শুনে চমকে উঠল শাম্ব। এ কোন ডায়ার? এ তো সেই ডায়ার নয়, যে তাকে বলেছিল যে, ‘অফিসের বাইরে আমরা বন্ধু।’ পাঁচ দিনের সফরসঙ্গী হবার পর এই প্রথম সত্যি শাম্ব বুঝতে পারল যে ডায়ার তার কর্মস্থলের মালিক।
ডায়ারের কথার জবাবে কী বলবে বুঝতে না পেরে থতোমতো খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল শাম্ব। ডায়ার ভুজবলের থেকে বন্দুকটা নিয়ে ভুজবলকে বলল, ‘চলো, এবার মারীচের খোঁজ করা যাক। দেখা যাক সে সত্যি মায়াবী কি না?’
নদীতট থেকে আবার ঘাসবনে প্রবেশ করল ভুজবল আর ডায়ার। তাদের নিশ্চুপভাবে অনুসরণ করল শাম্ব। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই সুন্দর সকালটা কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল শাম্বর কাছে।
(৫)
চারপাশে লক্ষ রাখতে রাখতে ঘাসবনের ভেতর তল্লাশি চালাতে শুরু করল ভুজবল আর ডায়ার। না, কটেজের দিকে নয়। ঘাসবনের দু-পাশে। সময় এগিয়ে চলল, সূর্যও ক্রমশ মাথার ওপর উঠতে লাগল। কিন্তু মারীচ বা হরিণের পালের কোনও চিহ্ন নেই। একসময় ডায়ার বলেই ফেলল, ‘আমার ভয়ে তোমাদের মায়াবী মারীচ গায়েব হয়ে গেল নাকি!’
ভুজবল বলল, ‘এত বড়ো বন। নিশ্চয়ই ওরা আছে কোথাও।’ প্রলোভন পেয়ে বসেছে গরিব ভুজবলকে। অতগুলো টাকা আর সন্তানের ভবিষ্যৎ তাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে মারীচ সন্ধানে।
আর শাম্ব মনে মনে বলতে লাগল, ‘এমন যেন হয় যে, হরিণটাকে আর খুঁজেই না পাওয়া যায়। সে যেন অনেক দূরে চলে গিয়ে থাকে।’
বেলা আরও বাড়তে লাগল। মধ্য ভারতে এই গ্রীষ্মকালের সূর্য ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আগুন ছড়াতে থাকে। ঘেমে উঠতে শুরু করল শাম্বরা। আরও লাল হয়ে উঠতে লাগল ডায়ারের লাল মুখ। তবু মারীচকে খোঁজার বিরাম নেই। ধীরে ধীরে বনবাংলো থেকে বেশ অনেকটাই তফাতে সরে এল তারা।
বেলা দশটা নাগাদ হঠাৎই ঘাসবনের মধ্যে একখণ্ড ফাঁকা জমিতে বেশ কিছু হরিণের পায়ের ছাপ মিলল। ভুজবল উবু হয়ে বসে ছাপগুলোকে পরীক্ষা করে একটা ছাপ দেখিয়ে বলল, দেখুন, এই হরিণের পায়ের ছাপটা অন্য হরিণের ছাপের থেকে বড়ো। মারীচের পায়ের দাগ! কিছুক্ষণ আগেই ওরা সামনের ঘাসবনে ঢুকেছে। কেউ কোনও কথা বলবেন না। সে কাছেই আছে।’
নিঃশব্দে ঘাসবনে গুঁড়ি মেরে প্রবেশ করল ডায়ার আর ভুজবল। তাদের পেছনে শাম্ব। ঘাসবনের ভেতর হরিণের চলাচলের চিহ্ন স্পষ্ট জেগে আছে। কোথাও পায়ের ছাপ আর কোথাও নুইয়ে পড়া ঘাস হরিণদের যাত্রাপথ চিনিয়ে দিতে লাগল। একসময় ঘাসবন একটু পাতলা হয়ে এল। আর তারপরই শাম্বরা দেখতে পেল তাদের।
ঘাসবনের ওপাশে ছোটো একখণ্ড ফাঁকা জমি। আর তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বাজ পড়ে পুড়ে যাওয়া পাতাহীন একটা বিশাল অশ্বত্থ গাছ। ফাঁকা জমিটার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণের দল। আর গাছের গুঁড়িটার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে তাদের দলপতি মারীচ। বিশাল শিং উঁচিয়ে বুক চিতিয়ে সত্যিই দলপতির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সে লক্ষ রাখছে তার সঙ্গীদের ওপর। সূর্যালোক খেলা করছে তার সোনার অঙ্গে। তার রূপ দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হয় ডায়ারও মোহিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সময় নষ্ট করা যাবে না। তাদের দেখে ফেললেই পালাবে হরিণের ঝাঁক। ডায়ার বন্দুক তুলে নিল কাঁধে। হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে আসছে শাম্বর। প্রথমে মৃদু খুট করে একটা শব্দ হল। আর তারপরই ডায়ারের বন্দুকের প্রচণ্ড গর্জনে কেঁপে উঠল বনভূমি। আর তার পরমুহূর্তেই শাম্ব দেখল, মারীচ যেন শূন্যে লাফিয়ে উঠে ছিটকে পড়ল বাজ পড়ে কালো হয়ে যাওয়া মোটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে। বন্দুকের শব্দে নিমেষের মধ্যেই ফাঁকা জমিটা থেকে ঘাসবনে অদৃশ্য হয়ে গেল হরিণের দল। আর ডায়ার আর ভুজবল ঘাসবন থেকে বেরিয়ে ছুটতে শুরু করল গাছটার দিকে। আর তাদের পেছনে শাম্বও। তারা পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট জায়গাতে। গুঁড়ির পেছনেই পড়ে আছে বিশাল হরিণটা। জিব বেরিয়ে আছে তার। বিস্ফারিত স্থির চোখ। ডায়ারের গুলি একদম মর্মস্থলে বিদ্ধ হয়েছে। রক্তের স্রোত বইছে সেখান থেকে। এক গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে তার। একবার সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল শাম্ব। কিন্তু ডায়ারের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ভুজবলকে উদ্দেশ্য করে সে বলল, ‘কী, তোমাদের এই মারীচ নাকি মায়াবী? তার গায়ে গুলি লাগে না? কোনও শিকারি তাকে নাকি মারতে পারে না? দেখলে, আমি এক গুলিতেই তার মায়ার খেলা কেমন সাঙ্গ করলাম?’
মিনিট দশেক সে জায়গাতে দাঁড়িয়ে রইল সকলে। ভুজবল তারপর বলল, ‘এখনই কটেজে ফিরে গিয়ে ছুরি আর কোদাল আনতে হবে। মাংস কেটে নিয়ে মাটিতে পুঁতে দিতে হবে দেহটা। গুলির শব্দ ফরেস্ট গার্ডদের কানে গিয়ে পৌঁছোতে পারে। তারা খোঁজ নিতে আসতে পারে।’
ডায়ার বলল, ‘হ্যাঁ চলো। ওর শিংটা দেশে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সে উপায় তো নেই। অগত্যা শুধু ওর মাংসেই তৃপ্তি লাভ করতে হবে।’ এই বলে শিস দিতে দিতে ফেরার পথ ধরল ডায়ার।
কটেজে ফিরে এল শাম্বরা। বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল তারা। ভুজবল চা করে আনল। কিছু ভালো লাগছে না শাম্বর। তার খালি মনে পড়ছে সেই দৃশ্যটা—পড়ে আছে হরিণটা। বিস্ফারিত চোখ। জিব বেরিয়ে আছে, গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে তার বুক থেকে!
শাম্বর বিষণ্ণতা লক্ষ করে ডায়ার প্রফুল্লচিত্তে বলল, ‘চিয়ার আপ! এটাকে খেলা হিসাবে নাও। আমি না মারলেও ওকে একদিন মরতেই হত। তবে সে মরার আগে কিছুটা আনন্দ দিয়ে গেল আমাকে। ধন্যবাদ জানাই মায়াবী মারীচকে।’
ডায়ারের কথার কোনও জবাব দিল না শাম্ব। মনে মনে সে বলল, ‘নিরীহ প্রাণীটাকে মেরে খুব অন্যায় করলে তুমি।’
একটা কোদাল আর ছুরি নিয়ে উপস্থিত হল ভুজবল। কটেজ থেকে বেরিয়ে আবার অকুস্থলের দিকে রওনা হল তারা। শাম্বর কোনও উপায় নেই। কাজেই তাকেও যেতে হল ডায়ারের সঙ্গে।
কিছু সময় পর তারা সে গাছের কাছে পৌঁছে গেল। কিন্তু সেখানে পৌঁছে অবাক হয়ে গেল তারা। এখনও মাটি রক্তে ভিজে থাকলেও মারীচ সেখানে নেই! কেমন যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে জায়গাটার চারপাশে। ব্যাপারটা দেখে ভুজবলের মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে বলে উঠল, ‘আমি বলেছিলাম না, মারীচকে মারা যায় না! ও মায়াবী!’
ডায়ারও ব্যাপারটাতে কম অবাক হয়নি। তবুও এ কথা বিশ্বাস করা যায় না। ভুজবলের কথা শুনে সে ধমকে উঠে বলল, ‘কী পাগলের মতো বকছ! এমন হতে পারে, দেহটা কোনও হিংস্র প্রাণী টেনে নিয়ে গেছে। অথবা হয়তো গুলির চোটটা অত মারাত্মক নয়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল প্রাণীটা। তারপর জ্ঞান ফিরে আহত অবস্থায় কাছেই কোথাও আছে। চলো, ওকে খুঁজে দেখি। দ্বিতীয় গুলিটা খাবার পর আর ওর জ্ঞান ফিরবে না।’
যে জায়গাটাতে হরিণটা পড়ে ছিল, সে জায়গাটা প্রথমে ভালো করে পরীক্ষা করল ডায়ার আর ভুজবল। কিন্তু সেখানে অন্য কোনও প্রাণীর পায়ের ছাপ বা হরিণটাকে টেনে নিয়ে যাবার দাগ মিলল না। অতঃপর জঙ্গলের চারপাশে তল্লাশি শুরু হল। কিন্তু ঘণ্টা দুই-তিন ধরে খোঁজ চালিয়েও মারীচের খোঁজ মিল না। অগত্যা কটেজে ফেরার পথ ধরল সবাই। শেষ দুপুরে কটেজে ফিরল তারা। সে দিন বিকেলে একটা হরিণও দেখা গেল না কটেজের সামনে। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা যেন বিরাজ করছে ঘাসবনে। সূর্য ডুবে গেল একসময়।
৬
শেষ দুপুরে জঙ্গল থেকে ফিরে ডায়ার আর শাম্ব যে যার নিজের ঘরে ঢুকে গেল। ভুজবল ঘরেই দুপুরের আর রাত ন-টা নাগাদ রাতের খাবার দিয়ে গেল। এর মাঝে অবশ্য শেষ বিকেলে ঘর থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল শাম্ব। তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছিল। সারা ঘাসবন জুড়ে কেমন যেন এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা ধরা দিচ্ছিল শাম্বর চোখে। ভালো লাগেনি তার। ঘরে ফিরে এসেছিল সে। পরদিন ভোরে গাড়ি আসবে শাম্বদের এখান থেকে নিয়ে যাবার জন্য। রাতের খাওয়া সারার বেশ কিছুক্ষণ পর শাম্বর মনে হল যে, শেষ একবার বারান্দা থেকে চাঁদের আলোতে দেখে আসা যাক ঘাসবন বনভূমিকে। হয়তো আর কোনও দিন তার এখানে না-ও আসা হতে পারে। এই ভেবে বারান্দাতে বেরিয়ে এল সে।
একটা বেতের চেয়ারে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বসে আছে ডায়ার। একফালি চাঁদের আলো তার মুখে এসে পড়েছে। গম্ভীর মুখ তার। ডায়ারের কিছুটা তফাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ভুজবল। শাম্ব এসে তাদের কাছেই একটা চেয়ারে নিঃশব্দে বসল। ডায়ার যেন তাকে দেখেও দেখল না। সে তাকিয়ে ঘাসবনের দিকে। আজ পূর্ণিমা। আকাশে বিরাট সোনার থালার মতো গোল চাঁদ। আর আলো ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘাসবন জুড়ে। কিছুটা দূরে ঘাসবনের ওপাশে চিকচিক করছে কেন নদীর জল। এবার কিন্তু এ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল শাম্বর। জঙ্গলের সারাদিনের বিষণ্ণতাকে যেন মুছিয়ে দিয়েছে ওই চাঁদের আলো। বনজ্যোৎস্নাতে উদ্ভাসিত ঘাসবন। চাঁদ যেন হাসছে মাথার ওপর থেকে। সেই জ্যোৎস্নাবিধৌত বন্য চরাচরের দিকে তাকিয়ে বসে রইল শাম্ব। সময় এগিয়ে চলল।
হঠাৎ ভুজবল মৃদু বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ‘আরে ঘাসবন নড়ছে! বাঘ নাকি? আজ তো হরিণের দল এ পথ মাড়াবে না!’
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ডায়ার আর শাম্ব তাকাল জায়গাটার দিকে। হ্যাঁ, ঘাসবনের ভেতর দিকে কে যেন এগোচ্ছে ফাঁকা জমিটার দিকে! আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ফাঁকা জমির মাঝখানে যে আত্মপ্রকাশ করল তাকে দেখে চমকে উঠল সবাই। সে মারীচ! চাঁদের আলো চুইয়ে পড়ছে তার গা বেয়ে। অসংখ্য শাখাপ্রশাখাযুক্ত শিং দুটো যেন উদ্ধত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। ফাঁকা জমিটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে তাকিয়ে আছে কটেজটার দিকে। অচঞ্চল, স্থির তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি।
মুহূর্তের মধ্যে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে ডায়ার বলল, ‘বলেছিলাম না, ও হয়তো মরেনি। আবার তাই ফিরে এসেছে। তবে এবার আর ও পার পাবে না। ভুজবল, বন্দুক দাও।’
শাম্ব খেয়াল করল যে, মারীচকে দেখে ভুজবলের মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে বলে উঠল, ‘এত রাতে জঙ্গলে নামবেন আপনি?’
ডায়ার বলে উঠল, ‘হ্যাঁ। চাঁদের আলো আছে দিনের আলোর মতোই উজ্জ্বল। সব দেখা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বন্দুক আনো। ওকে না মারতে পারলে আমার মনেও কুসংস্কার বাসা বাঁধতে পারে যে ও মায়াবী। সেটা যে মিথ্যা তা প্রমাণ করার জন্যই ওকে মারতে হবে।’
ডায়ারকে নিরস্ত করার জন্য ভুজবল এবার একটা শেষ চেষ্টা করে বলে উঠল, ‘মারীচ সত্যিই মায়াবী। নইলে বুকে গুলি খাবার পর কেউ বেঁচে থাকতে পারে! আপনি যাবেন না সাহেব।’
ডায়ার এবার চাপা স্বরে গর্জন করে উঠল, ‘স্টুপিড!’ তারপর এক ছুটে গিয়ে ভুজবলের ঘরের ভেতর থেকে বন্দুকটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে বারান্দা থেকে নেমে পড়ল। মারীচ তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ডায়ার এগোতেই সে ধীরপায়ে ঘাসবনের ভেতর ঢুকে পড়ল।
শাম্বর হুঁশ ফিরতে মিনিটখানেক সময় লাগল। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে সে ভুজবলকে বলল, ‘চলো, আমাদেরও যেতে হবে সাহেবের কোনও বিপদ হতে পারে।’
ভুজবলও মনে হয়, এবার ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারল। সে ছুটে গিয়ে একটা ছুরি আর লাঠি নিয়ে এল। সে অস্ত্র দুটোকে সম্বল করে তারা যখন কটেজের বাইরে এল, তখন ডায়ার অদৃশ্য হয়ে গেছে ঘাসবনের ভেতর।
শাম্বরাও প্রবেশ করল বনের ভেতর। ফটফটে জ্যোৎস্নায় চারপাশের সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও কোনও শব্দ নেই। মারীচের পিছু ধাওয়া করে ডায়ার কোন দিকে যেতে পারে তা অনুমান করে ভুজবলের পেছনে এগোতে লাগল শাম্ব।
বেশ কিছুটা চলার পর একসময় নদীর পাড়ে পৌঁছে গেল শাম্বরা। নদী এখানে বেশ সংকীর্ণ। নদীর বুকে জলের ভেতর থেকে কিছুটা তফাতে চাঁদের আলোতে জেগে আছে ধবধবে সাদা পাথরখণ্ড। শাম্বরা দেখতে পেল, একদল চিতল হরিণ দাঁড়িয়ে আছে নদীর ওপারে। ভুজবল চাপা স্বরে বলল, ‘নদীর ওপর ওই পাথরখণ্ডগুলোতে লাফিয়ে লাফিয়ে ওরা নদী পেরোয়।’
কিন্তু হরিণগুলো যেন নদীর ওপারে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে এপারের একটা নির্দিষ্ট জায়গার দিকে চেয়ে আছে। তারা যেন প্রতীক্ষা করছে কোনও কিছুর জন্য।
তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে শাম্বরা এবার দেখতে পেল তাকে। মারীচ! ঘাসবন থেকে এপারে নদীর তটে বেরিয়ে এসেছে সে। নদীর পাড় বরাবর শাম্বরা সেখানে দাঁড়িয়ে তার উলটো দিকে ধীরপায়ে হাঁটছে সে আর মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে ঘাসবনের দিকে তাকাচ্ছে পেছন ফিরে। আর এরপরই ডায়ারকে দেখতে পেল তারা। ঘাসবন থেকে বেরিয়ে শাম্বদের দিকে পেছন ফিরে মারীচের দিকে এগোতে লাগল সে। মারীচ তাকে নিশ্চিত দেখতে পেল, কিন্তু ওর মধ্যে কোনও চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল না। হয়তো সে আহত বলেই আর ছুটে পালাতে পারছে না। ধীরপায়ে সে এগোতে লাগল কিছুটা দূরে বেশ বড়ো একটা ঝোপের দিকে। তাকে বন্দুকের পাল্লার মধ্যে আনার জন্য ডায়ারও এগোল সেদিকে। শাম্বরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে সব কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোতে। মারীচ সেই ঝোপটার সামনে গিয়ে একবার থমকে দাঁড়িয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ডায়ারের দিকে। চাঁদের আলোতে সত্যিই যেন এবার তাকে সোনার হরিণ বলে মনে হচ্ছে। কী বিশাল দুটো শিং তার! কী অভিজাত ভঙ্গি এই মৃগপতির! ডায়ারকে একবার দেখে নিয়ে সে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল ঝোপের আড়ালে। শুধু ঝোপের আড়াল থেকে আকাশের দিকে জেগে রইল তার বিশাল শাখাপ্রশাখাযুক্ত শিং। শাম্বরা দেখল, বন্দুক ”উঁচিয়ে সেই ঝোপের দিকে এগোচ্ছে ডায়ার। এবার আর নিস্তার নেই হতভাগ্য প্রাণীটার। ওপার থেকে চাঁদের আলোতে হরিণের দলও স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে ঝোপটার দিকে।
ঝোপটার হাত-কুড়ি তফাতে গিয়ে দাঁড়াল ডায়ার। ঝোপের দিকে তাকিয়ে তার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণীটার অবয়ব অনুমান করে বন্দুক তাক করল ডায়ার। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর বন্দুকের গর্জনে কেঁপে উঠল নদীতট। কিন্তু এর পরমুহূর্তেই আরও একটা গর্জন শোনা গেল। সে শব্দ বন্দুকের গর্জনের থেকেও ভয়ংকর! ঝোপের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল বিশাল একটা বাঘ! শাম্বরা দূর থেকেও দেখতে পেল, প্রচণ্ড আক্রোশে তার চোখ দুটো যেন ভাটার মতো জ্বলছে! ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা হরিণটার দলটা যেন এবার অদ্ভুত স্বরে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল। আর এরপরই বাঘটা আরও একবার প্রচণ্ড গর্জনে বনভূমির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ঝাঁপ দিল ডায়ারের ওপর। একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল ডায়ারের গলা থেকে। সামান্য একটু ঝটাপটির পর বাঘটা ডায়ারের ঘাড় কামড়ে ধরল। তারপর তাকে নিয়ে অদৃশ্য হল ঘাসবনের গভীরে। শাম্বদের চোখের সামনে পুরো ব্যাপারটা ঘটতে হয়তো আধ মিনিট সময়ও লাগল না। সংবিৎ ফিরতেই শাম্ব আর ভুজবল ছুটতে শুরু করল কটেজের দিকে।
ভোর হতে না হতেই একদল ফরেস্ট গার্ড এসে হাজির হল কটেজে। গত রাতে গুলির শব্দ আর বাঘের গর্জন শুনেছে তারা। তাদেরকে কী বলবে তা আগেই আলোচনা করে রেখেছিল শাম্ব আর ভুজবল। ফরেস্ট গার্ডদের তারা বলল, ‘রাতে কটেজ চত্বরে বাঘ হানা দিয়েছিল। ডায়ার বাঘটাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। বাঘ তুলে নিয়ে গেছে ডায়ারকে।’
ভোরের আলো ভালো করে ফুটতেই বনরক্ষীদের সঙ্গে ডায়ারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল শাম্বরা। দিনের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়েছে বনে। কলকাকলির শব্দে মুখরিত চারদিক। ঘাসবনের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে বিধ্বস্ত শাম্বর এক-একসময় মনে হচ্ছিল, গত রাতের সেই ভয়ংকর দৃশ্যটা হয়তো নিছকই একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। তবে একটা কথা তার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। ঝোপের আড়ালে বাঘ আর হরিণের একসঙ্গে উপস্থিতি সম্ভব হল কীভাবে? বাঘ আছে জেনেও মারীচ কীভাবে প্রবেশ করল সেখানে।
ঘণ্টা দুয়েক খোঁজাখুঁজির পর একসময় ঘাসবনের ভেতরে ডায়ারের দেহের কিছু অংশ মিলল। তার দেহের অর্ধেকটাই প্রায় বাঘে খেয়ে গেছে। দেহটা আবিষ্কৃত হবার পর কিছু বনকর্মী সেখানে রয়ে গেল। বাকিরা শাম্বদের নিয়ে রওনা হল ফেরার জন্য। গতকাল সকালে যে বাজ পড়া গাছটার নীচে মারীচকে গুলি করা হয়েছিল, তার কাছ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ একজন ফরেস্ট গার্ড বলল, ‘গাছটার মাথায় শকুন বসে আছে কেন? কিছু মরেছে নাকি? এমনও হতে পারে যে, সাহেবের দেহের কিছু অংশ এখানে টেনে এনেছে বাঘটা! চলো, জায়গাটা একবার দেখে আসি।’
বন্দুক উঁচিয়ে গাছটার দিকে এগোল বনরক্ষীর দল। তাদের অনুসরণ করল শাম্ব আর ভুজবল। গাছের গুঁড়ির পেছনে মাছি ভনভন করছে। বনরক্ষীরা সেখানে গিয়ে যা আবিষ্কার করল তা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল শাম্ব। সেখানে পড়ে আছে মারীচের মৃতদেহ! কিন্তু এ দেহ তো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল এখান থেকে!
একজন বনরক্ষী বলে উঠল, ‘আরে এ তো সেই মারীচ! চোরাশিকারিরা মেরেছে। দেহটা দেখে মনে হচ্ছে, একদিন আগে মেরেছে। ফুলে উঠে পচতে শুরু করেছে শরীরটা।’
শাম্ব আর ভুজবল বাকরুদ্ধ। মারীচের দেহটা যদি এখানেই পড়ে থাকে, তবে কাল রাতে ডায়ারকে যে ঝোপের দিকে টেনে নিয়ে গেল, সে কে? বাঘটা ওখানে আছে জেনেই কি তাকে ওখানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মায়াবী মারীচ? তার মায়ার শরীর বলেই বাঘটার সঙ্গে সহাবস্থান করতে পেরেছিল ঝোপের আড়ালে? মারীচ মায়াবী রূপে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিল? কৌশলে হত্যা করল তার হত্যাকারীকে? আর একটু হলে সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল শাম্ব। পা টলছিল তার। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একজন বনকর্মী তাকে ধরে ফেলে বলল, ‘চলুন কটেজে ফিরে বিশ্রাম নেবেন। জানি, এসব দৃশ্য অনেকের সহ্য হয় না।’
ফেরার পথে ভুজবল চাপা স্বরে শাম্বর কানের কাছে শুধু একবার বলল, ‘বলেছিলাম না মারীচ মায়া জানে? ও মায়াবী!’
—