(১)
সন্দীপ যখন নেতিধোপানি থেকে রওনা হয়েছিল তখনও ভোরের কুয়াশা ভালো করে কাটেনি। আগের দিন সে রাত কাটিয়েছে ওখনকার এক বনবাংলোয়। রাতে তার ঘুম হয়নি। সারা রাত কেটেছে একটা চাপা উৎকণ্ঠার মধ্যে। তাঁর সঙ্গে শেষপর্যন্ত দেখা হবে তো? সূর্য এখন মাথার উপর, নদীর জলে পড়েছে তার প্রতিবিম্ব। গাঙ বেয়ে এগিয়ে চলেছে নৌকো। দু-পাশে গহিন জঙ্গল। মাঝে মাঝে তার বুক চিরে বেরিয়ে গিয়েছে খাঁড়ি। দিনের আলো সেখানে ভালো করে ঢোকে না। গাঙ বেয়ে এগিয়ে নদী যেখানে দু-ভাগে ভেঙেছে, সেখানে পৌঁছে যে মাঝি দাঁড় বাইছিল সে অনেক দূরের একটা কালো বিন্দু দেখিয়ে বলল, ‘ওই হল চামটা। এখনও ভেবে দেখুন বাবু, ওখানে যাবেন কিনা! সুন্দরবনের তামাম বাঘের ঠিকানা ওই চামটা আর হলদি। বন্দুক কাঁধে নেওয়া ফরেস্ট গার্ডরা পর্যন্ত ওখানে যাওয়ার আগে দশবার ভাবে।’
তার কথা শুনে সন্দীপ বলল, ‘তোমরা নয় খাঁড়ির বাঁকে দ্বীপ যেখানে শুরু হচ্ছে সে পর্যন্ত আগে চলো, তারপর ফেরার কথা ভাবা যাবে। ওখানে আমার জন্য একজনের অপেক্ষা করে থাকার কথা।’
তার কথা শুনে নৌকার মাঝি দু-জন এমনভাবে তাকাল যে, সন্দীপ স্পষ্ট বুঝতে পারল, কথাটা ওদের মোটেই বিশ্বাস হয়নি। অবশ্য এ ব্যাপারে তাদের দোষ দেওয়া চলে না। একে তো জায়গাটা সুন্দরবন, তার উপর আবার দ্বীপের নাম চামটা। বাঘেদের একেবারে স্বর্গরাজ্য। সেখানে যে কোনো লোক বাঘের পেটে না গিয়ে কারও জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারে তা বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন। মাঝিদের ওই দ্বীপের কাছে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। নেহাত এই বাবুর কাছ থেকে ভুল করে মোটা টাকা নিয়ে নিয়েছে তারা, তাই সন্দীপের কথা শুনে আবার দাঁড় টানতে শুরু করল। নদীর দু-পাশে জেগে আছে বিস্তীর্ণ চর, তার একটু দূরে শুরু হয়েছে সুন্দরী, কেওড়া, বাইনের ঘন জঙ্গল, হেঁতালের ঝাড়। সন্দীপ অবশ্য কোনো গাছই চেনে না। এই জল-জঙ্গলের দেশে সে প্রথম এসেছে। নৌকোয় বসে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে সেই কথা ভাবছিল সন্দীপ। শেষপর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সন্দীপের দেখা হবে তো? তাঁকে সন্দীপ যতটুকু চেনে, তাতে তাঁকে কোনোদিন ফালতু কথা বলার লোক মনে হয়নি। নিছক তামাশা করার জন্য এই জল-জঙ্গলের দেশে সন্দীপকে তিনি টেনে আনবেন বলে মনে হয় না। বিশেষত, তিনি যখন ভালো করে জানেন যে, তিনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন তাঁর ডাক অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা সন্দীপের নেই। কারণ, তিনিই সন্দীপের অন্নদাতা, আর সন্দীপ অকৃতজ্ঞ নয়।
কেন সন্দীপ আজ নৌকোয় চেপে দূরের ওই কালো বিন্দুর দিকে এগিয়ে চলেছে সে ব্যাপারটা একটু খুলে বলা ভালো। যাঁর আমন্ত্রণে সন্দীপ এই জঙ্গলের দেশে হাজির হয়েছে, তিনি প্রফেসর নীলকান্ত সোম। যাঁর কাছে কৃতজ্ঞতার সীমা নেই সন্দীপের। তাঁর সঙ্গে সন্দীপের প্রথম পরিচয় বছর দশেক আগে কলেজের স্পোর্টসে। সন্দীপ তখন মাত্র কয়েক মাস হল তার গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় এসে কলেজে ভর্তি হয়েছে। সন্দীপের ছেলেবেলাতেই ওর বাবা গত হয়েছিলেন, আর মা চলে গেলেন সে কলকাতায় চলে আসার মাস ছয়েক আগে। ফলে গ্রামে আর পিছুটান না থাকার জন্য কলকাতা শহরে হাজির হয়েছিল সে। সেদিন কলেজে স্পোর্টস। সন্দীপ স্পোর্টসে নাম দিয়েছিল বাহবা কুড়োবার জন্য নয়, তার তখন প্রচণ্ড অর্থকষ্ট চলছে। মেসের ভাড়াও বাকি পড়ে গিয়েছে। সন্দীপ বরাবরই খেলাধুলোয় ভালো। তার উদ্দেশ্য ছিল স্পোর্টসে যদি সে প্রাইজ জিততে পারে তাহলে সেগুলো বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় করতে পারবে। সেদিনের স্পোর্টসে ভাগ্যলক্ষ্মী মনে হয় প্রসন্ন হয়েছিলেন সন্দীপের প্রতি। পাঁচ পাঁচটা ফার্স্ট প্রাইজ জিতে নেয় সন্দীপ। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সেদিন প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন জীববিজ্ঞানের বিশিষ্ট অধ্যাপক নীলকান্ত সোম। পুরষ্কার দেওয়া শেষ হয়ে গেলে মঞ্চ থেকে নেমে তিনি ডেকে নিয়েছিলেন সন্দীপকে। সন্দীপের ব্যক্তিগত অবস্থা জানার পর, পরের দিন সকালে তিনি তাকে দেখা করতে বলেছিলেন তাঁর নিজের বাড়িতে। তাঁর কথা শুনে সন্দীপ পরের দিন সকালে গিয়ে হাজির হয়েছিল তাঁর উত্তর কলকাতার বিশাল বাড়িতে। সন্দীপ সেদিন ভেবেছিল তার দুরবস্থার কথা শুনে হয়তো তাকে কিছু অর্থসাহায্য করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন প্রফেসর। কিন্তু সন্দীপ তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াবার পর তিনি অন্য প্রস্তাব দিলেন তাকে। তিনি বললেন, তিনি চান সন্দীপ তাঁর বাড়িতে থাকুক। তার বদলে তিনি সন্দীপের খাওয়াপরার দায়িত্ব নেবেন।
একা মানুষ তিনি, মাঝে মাঝেই গবেষণার কাজে বাড়ি ছেড়ে বাইরে যেতে হয়। বাড়িতে তাঁর একটা গবেষণাগার আছে। বেশ কিছু দুর্মূল্য যন্ত্রপাতি আছে সেখানে। কিছু পশুপাখিও আছে। বাড়িতে বিশ্বস্ত কেউ থাকলে তার তত্ত্বাবধানে বাড়িটাকে রেখে নিশ্চিন্তে কাজে যেতে পারেন তিনি। প্রফেসরের এই লোভনীয় প্রস্তাবে না করার মতো কোনো কারণ ছিল না সন্দীপের। বরং বলা যেতে পারে, প্রফেসরের কথা শুনে সেদিন যেন হাতে চাঁদ পেয়েছিল সে। তার পরদিন থেকেই সে থাকতে শুরু করল প্রফেসরের বাড়িতে। কাজকর্ম বলতে সেখানে প্রায় কিছুই ছিল না। বাড়ি থাকলে প্রফেসর প্রায় সারাক্ষণই সময় কাটাতেন তাঁর ল্যাবরেটরিতে, আর সন্দীপ থাকত তার পড়াশোনা নিয়ে। শুধু মাঝে মাঝে যখন প্রফেসর দিন কয়েকের জন্য তাঁর গবেষণার কাজে উধাও হয়ে যেতেন, তখন তাঁর বাড়ি আর পশুপাখিগুলোকে দেখভালের দায়িত্ব পড়ত সন্দীপের ওপর। থাকতে থাকতে প্রফেসরের সঙ্গে একটা স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সন্দীপের। যদিও প্রফেসর কথা বলতেন খুব কম। সব সময় তিনি ডুবে থাকতেন নিজের চিন্তার জগতে।
সন্দীপের কলেজের পাট শেষ হওয়ার পর তাকে একটা স্কুলমাস্টারির চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিলেন প্রফেসর। সন্দীপ এখনও সেই চাকরিটাই করে। থাকে প্রফেসরের সেই বাড়িতেই। যদিও প্রায় বছর পাঁচেক হল, সে বাড়িতে আর নিজে পা রাখেননি প্রফেসর। যেদিন তিনি ওই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলেন, সেদিন সকালে তিনি নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সন্দীপকে। একতাড়া কাগজ তিনি সন্দীপের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘কাগজগুলো যত্ন করে রেখে দিও। এর মধ্যে বাড়ির দলিল এবং একটা উইল আছে। আজই আমার গবেষণার কাজের জন্য বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছি। কাজ শেষ হতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে। তারপর ফিরে আসব আমি। কিন্তু কোনো কারণে যদি দশ বছরের মধ্যে না ফিরি, তাহলে এই বাড়ি সহ আমার যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হবে তুমি। আমার উইলে সে কথা লেখা আছে।’
সন্দীপ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘কোথায় যাবেন আপনি? সঙ্গে আর কে যাবে?’
প্রফেসর বলেছিলেন, ‘একলাই যাব, আর কোথায় যাব তা আমার গবেষণার গোপনীয়তা রক্ষার জন্য বলা সম্ভব নয়। আর একটা কথা, আমার কোনো খোঁজ করার চেষ্টা করবে না তুমি, তাতে আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। দরকার হলে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করে নেব বা তোমাকে ডেকে পাঠাবো।’
আর কোনো কথা বাড়াননি। সেদিন রাতেই বাড়ি ছেড়েছিলেন তিনি। এরপর পাঁচটা বছর কেটে গিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে প্রফেসরের কোনো খোঁজখবর পায়নি সন্দীপ। এই বিরাট পৃথিবীতে যদি কেউ স্বেচ্ছায় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চান, তাহলে কীভাবে খোঁজ পাওয়া যাবে তাঁর! ইদানীং তো সন্দীপের প্রায়ই মনে হত, প্রফেসরের সঙ্গে আর কোনোদিন বোধ হয় দেখা হবে না কিন্তু সে ধারণা বদলে গেল দিন সাতেক আগে। স্কুল থেকে দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে লেটার বক্সে একটা চিঠি পেয়েছিল সে। ঘরে এসে চিঠিটা খুলতেই তাতে প্রফেসরের হাতের লেখা দেখে চমকে উঠেছিল।
তারিখবিহীন সেই চিঠিতে লেখা ছিল—
‘প্রিয় সন্দীপ,
‘আজ এতদিন পর আমার চিঠি পেয়ে নিশ্চয়ই তুমি খুব আশ্চর্য হবে। এতদিন তোমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করিনি বলে হয়তো তুমি মনে দুঃখ পেয়েছ। এর কারণ আমার গবেষণার গোপনীয়তা রক্ষা করতে এখনও পর্যন্ত কিছু বাড়তি সতর্কতা নিয়ে চলেছি। আজ এই চিঠি তোমাকে লিখছি এক বিশেষ দরকারে। তুমি নিশ্চয়ই জান যে, দীর্ঘদিন ধরে জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত এক জটিল গবেষণার কাজ করে চলেছি। ঠিক কী বিষয়ে আমার গবেষণা তুমি তা না জানলেও এই চিঠিতে তা লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু বলি, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে এক জনহীন জায়গায় একাকী কঠিন পরিশ্রম আর সাধনার মধ্যে দিয়ে শেষে তার ফল লাভ করেছি আমি, যা চমকে দেবে বিশ্ববাসীকে। কারণ, এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছি আমি। তার অন্তিম পর্যায়ে একটা কাজ বাকি, যার জন্য আমার এখানে তোমার আসা বিশেষ দরকার। আশা করি তুমি আমাকে নিরাশ করবে না।
এবার বলি, কোথায় তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে। তুমি কোনোদিন নাম শুনেছো কিনা জানি না, সুন্দরবনের গভীরে চামটা নামের একটা দ্বীপ আছে। তার চারপাশে কোনো জনবসতি নেই। জায়গাটা বাঘেদের খাসতালুক বললেও বেশি বলা হয় না। দ্বীপের চারদিক নদী আর খাঁড়ি দিয়ে ঘেরা। এই দ্বীপেই আমার সঙ্গে তোমাকে দেখা করতে হবে। সুন্দরবনের দ্বীপ বলতে যা বোঝায় তা হল সবই নালা আর খাঁড়ি দিয়ে ঘেরা জঙ্গলময় ছোট ছোট দ্বীপের সমষ্টি। কয়েক মাইল লম্বা দ্বীপে কোথায় তুমি আমার দেখা পাবে এবং কীভাবে চামটা পৌঁছবে, সে কথা তোমাকে বাতলে দিচ্ছি আমি। সজনেখালি থেকে পঞ্চমুখানি হয়ে নেতিধোপানি পর্যন্ত আসতে অসুবিধা হবে না তোমার। নেতিধোপানি হল সুন্দরবনের কোর এলাকার প্রবেশদ্বার। এরপরেই শুরু হয়েছে আসল সুন্দরবন, সত্যি সত্যি যেখানে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। তাই বনবিভাগ সাধারণ মানুষকে এই অঞ্চলে আসার অনুমতি দেয় না। নেতিধোপানি থেকে জলপথে তোমাকে এগোতে হবে পূর্ব দিকে। তারপর তুমি হাজির হবে এক ত্রিবেণী সঙ্গমে। সেখান থেকে দক্ষিণে এগোবার পর বাঁ পাশে যে দ্বীপটি দেখতে পাবে, সেটাই হল চামটা। সে দ্বীপটা বাঁ দিকে রেখে কিছুটা চলার পর ডান পাশে শুরু হবে হলদি দ্বীপ। এই দুই দ্বীপের মাঝ দিয়ে চলার পর নদী যেখানে হঠাৎ বাঁ দিকে বাঁক নিয়েছে সেখানে একটা খাঁড়ি এসে মিশেছে। সেই খাঁড়ির চরে বাজ পড়ে পুড়ে যাওয়া পাতাবিহীন বিরাট শিমুল গাছ আছে একটা। তার দুটো ডাল মাথার ওপর হাত বাড়িয়ে যেন আকাশটাকে ধরতে চাইছে। সেই গাছের তলায় আমি ১০ তারিখ সারাদিন তোমার প্রতীক্ষায় থাকব আমি। আশা করি তোমার দেখা পাব। মনে রেখো, তোমার আসার উপর আমার সারাজীবনের সাধনার সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে আছে।
ইতি,
আশীর্বাদক
নীলকান্ত সোম
‘পুনশ্চ : চামটায় আসার জন্য সরকারি অনুমতি নিতে যেও না। তাতে বিপরীত ফল হতে পারে। তোমাকে সরকারি নিয়ম ভাঙতে হবে ঠিকই, কিন্তু তার পিছনে রইল বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মহৎ উদ্দেশ্য। মাঝিদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিলে তারা তোমাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে। আমার চিঠি বা তোমার আসার খবর কেউ যেন জানতে না পারে। চিঠি পড়া শেষ হলে এ চিঠি পুড়িয়ে ফেলবে তুমি। গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে একাজ বিশেষ দরকার।’
প্রফেসরের চিঠি সন্দীপকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে চামটার উদ্দেশে। মাঝিদের সেখানে যেতে রাজি করাতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সন্দীপকে। একে তো সেখানে যাওয়ার সরকারি অনুমতি নেই, ধরা পড়লে জেল জরিমানা হয়তো আছেই। তবে সবচেয়ে বড় ভয় হল বাঘের। সন্দীপকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রফা করতে হয়েছে মাঝিদের সঙ্গে। তবে তারা জানিয়ে দিয়েছে যে, খাঁড়ির ভেতর নৌকো নিয়ে যাবে না। আর বনের মাটিতে নামার তো কোনো প্রশ্নই নেই। তারা আরও বলেছে, কোনো অবস্থাতেই এক ঘণ্টার বেশি সেখানে অপেক্ষা করবে না।
এক সময় ওই কালো বিন্দু কাছে এগিয়ে এল। নদীর বাঁ দিকে শুরু হল চামটার ঘন জঙ্গল। আস্তে আস্তে কমে এল মাঝিদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা। আরও কিছুটা এগোবার পর ডানদিকে শুরু হল হলদির জঙ্গল। মাঝিদের আগেই পথ বুঝিয়ে দিয়েছে সন্দীপ। ঠিক পথেই এগোচ্ছে তারা। যত তারা এগোচ্ছে, সন্দীপের উত্তেজনা ততই বেড়ে চলেছে। প্রফেসরের সঙ্গে তার দেখা ঠিক হবে তো! হলদির জঙ্গল শুরু হতেই একদম কথা বন্ধ করে দিল তারা। নদী ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে। দু-পাশের ঘন জঙ্গলের উপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে শুধু ছপ ছপ শব্দে দাঁড় বইতে লাগল দু-জন। বেলা দেড়টা নাগাদ নৌকো এসে পৌঁছল বাঁকের মুখে। সন্দীপের চোখে পড়ল সেই খাঁড়ি আর প্রফেসরের চিঠিতে লেখা সেই শিমূল গাছ। খাঁড়ির একটু ভেতর দিকে নির্জন চরে একলা দাঁড়িয়ে আছে গাছটা। সত্যিই যেন সে হাতের মতো দুটো ডাল দু-পাশে মাথার উপর তুলে আকাশকে ধরতে চাইছে। কিন্তু গাছের তলায় কেউ দাঁড়িয়ে নেই। শুধু গাছের একটা ডালে বসে আছে পাটকিলে রঙের বিরাট একটা চিল জাতীয় পাখি। প্রফেসরকে না দেখতে পেলেও গাছটাকে দেখতে পেয়ে সন্দীপের মনে আশা-নিরাশার দোলাটা অনেকখানি কেটে গেল। তার মনে হল, সবই যখন মিলে গেল তখন নিশ্চয়ই প্রফেসর কাছে কোথাও আছেন। মাঝিরা তাদের কথা মতো নৌকো খাঁড়িতে নিয়ে গেল না। খাঁড়ির মুখে নৌকো নোঙর করল। তাদের একজন একটা লম্বা ধারালো দা খোলের ভেতর থেকে টেনে বের করে হাতের কাছে রাখল। সন্দীপ বুঝতে পারল, সেটা বাঘের জন্য, তার জন্য নয়। দু-পাশে ঘন জঙ্গল। দিনের আলো সেখানে পৌঁছয় না। চারিদিকে কেমন যেন একটা গা ছমছমে পরিবেশ। যে কোনো মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে। একজন মাঝি চাপা গলায় সন্দীপকে বলল, ‘জায়গা মোটেই ভালো নয় বাবু। এখানে বড় কুমির আছে। ওই দেখুন, খাঁড়ির চরের কাদা মাটিতে তার বুক ঘষটে জলে নেমে যাওয়ার লম্বা লম্বা দাগ দেখা যাচ্ছে।’
সন্দীপ তার কথার কোনো উত্তর দিল না। একবার শুধু দাগগুলো দেখে নিয়ে তারপরেই তাকিয়ে থাকল শিমুল গাছটির দিকে। তার হাতের ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে শুরু করল।
(২)
সময় আস্তে আস্তে গড়িয়ে যেতে লাগল, কিন্তু প্রফেসরের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝি দু-জনের মুখ-চোখ দেখে সন্দীপ বুঝতে পারল, ক্রমশই অধৈর্য হয়ে উঠেছে তরা। প্রফেসর কি তাহলে দিনটার কথা ভুলে গেলেন! আবার আশঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করল সন্দীপের মনে। প্রায় এক ঘণ্টা সময় কেটে যাওয়ার পর একজন মাঝি সন্দীপকে বলল, ‘এখানে কোনো মানুষ থাকতে পারে না বাবু, নিশ্চয় আপনাকে কেউ ঠকিয়েছে, আর এখানে দাঁড়ানো যাবে না। এবার ফিরতে হবে।’
এই বলে সে নৌকোর নোঙর তোলার জন্য হাত বাড়াল। ঠিক তখনই শিমুল গাছের ডাল থেকে ডানা ঝটপট করে আকাশের দিকে উড়ে গেল পাখিটা। আর তারপরই পিছনের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে শিমুল গাছের তলায় এসে দাঁড়াল একজন লোক। লোকটি বেশ লম্বা, পরনে খাকি পোশাক, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সন্দীপ চিনতে পারল তাকে। হ্যাঁ, তিনিই প্রফেসর সোম! তিনি একবার দূর থেকে হাত নাড়ালেন সন্দীপের উদ্দেশে। সন্দীপও হাত নাড়াল। এরপর, তিনি শিমুল গাছের কাছে ঝোপের ভেতর থেকে একটা ছোট ডিঙি বের করে জলে নামালেন। তারপর নৌকো নিয়ে খাঁড়ির জল কেটে এগিয়ে আসতে লাগলেন সন্দীপের দিকে। মাঝি দু-জন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছে তাকে দেখতে পেয়ে। সন্দীপের কাছেই যে মাঝিটি বসেছিল, সে দু-বার বলে উঠল, ‘রাম-রাম।’
সন্দীপ বুঝতে পারল প্রোফেসর সোমকে দেখে ঠিক মানুষ বলে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। প্রফেসর সোমের নৌকো এসে দাঁড়াল সন্দীপের নৌকোর পাশে। প্রফেসর সোম সন্দীপের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘আমি জানতাম তুমি আসবে। এসো, এবার আমার নৌকোয় উঠে পড়ো।’
সন্দীপ তার ছোট্ট ব্যাগটা নিয়ে উঠে পড়ল প্রফেসরের নৌকায়। মাঝিরা যেন এই মুহূর্তের প্রতীক্ষাতেই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে তারা নোঙর তুলে নিল, তারপর নৌকোর মুখ ফিরিয়ে একবারের জন্যও পিছনের দিকে না তাকিয়ে জোরে জোরে দাঁড় বইতে শুরু করল। সন্দীপ প্রফেসরের নৌকোয় ওঠার পর প্রফেসর তাকে বললেন, বসে পড়ো, খাঁড়ি বেয়ে বেশ খানিকটা পথ আমাদের যেতে হবে।’
নৌকোয় বসার পর সন্দীপ প্রশ্ন করল, ‘আপনি কেমন আছেন স্যার?’
‘ভালো।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে প্রফেসর দাঁড় বইতে শুরু করলেন।
সন্দীপ এবার ভালো করে তাকাল প্রফেসরের দিকে। তার চেহারায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গৌরবর্ণ শরীর রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গিয়েছে। মেদ ঝরে গিয়েছে, দড়ির মতো পাকানো ধমনী ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বাহু থেকে। সারা শরীরে কেমন যেন একটা রুক্ষভাব। শুধু একই রকম আছে ভ্রূর নীচে তাঁর উজ্জ্বল চোখ দুটো। সন্দীপ ভেবেছিল অনেকদিন পর দেখা হয়েছে, প্রফেসর বুঝি তাকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করবেন। কিন্তু প্রফেসর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলেন না। আপনমনে দাঁড় বাইতে লাগলেন। সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলেছে গহিন খাঁড়ি। দু-পাশে ঘন জঙ্গল। সূর্যের আলো আসে না সেখানে। চারপাশে কেমন থমথমে পরিবেশ। একটা পাখির ডাক পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। যেন কোনো অজানা আতঙ্ক থমকে আছে চারদিকে। বেশ ভয় ভয় করতে লাগল সন্দীপের। মাঝে মঝে খাঁড়ি এত সংকীর্ণ যে, জলের ওপর ঝুঁকে পড়া গাছগুলোকে নৌকোয় দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। কে জানে কোনো ডোরাকাটা প্রাণী জঙ্গলের আড়াল থেকে সন্দীপকে দেখে জিভ চাটছে কিনা! আধঘণ্টা মতো নিঝুম খাঁড়ি বেয়ে চলার পর একটা বাঁকের মুখে যেখানে অন্য একটা খাঁড়ি এসে মিশেছে, সেখানে এসে, খাঁড়ির চরে নৌকো ভেড়ালেন প্রফেসর। তারপর লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে সন্দীপের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘নেমে পড়ো, আমরা এসে গিয়েছি।’
সন্দীপ তার হাতটা ধরল। তারপর ব্যাগ নিয়ে লাফিয়ে নামল কাদামাটিতে। সন্দীপের মনে হল প্রফেসরের হাতটা যেন বরফের মতো ঠান্ডা। তার গা থেকে একটা তীব্র আঁশটে গন্ধও পেল সন্দীপ। মনে হল তিনি অনেকদিন স্নান করেননি। সন্দীপ নীচে নামার পর প্রফেসর নৌকোটাকে টেনে চরে তুলে একটা ঝোপের আড়ালে নিয়ে গেলেন। তারপর সন্দীপকে বললেন, ‘সাবধানে হাঁটো, কাদামাটি খুব পিছল।’ এই বলে তিনি হাঁটতে শুরু করলেন বনের দিকে। কাদায় বসে যাচ্ছে সন্দীপের পা। অতিকষ্টে সে প্রফেসরের পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করল। জঙ্গলের ভেতরে ঢোকার ঠিক মুখটায় হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রফেসর। তারপর জামার তলা থেকে একটা লম্বা রিভলভার টেনে বের করলেন। সন্দীপ খুব আশ্চর্য হয়ে গেল প্রফেসরের হাতের জিনিসটা দেখে। প্রফেসর এরপর সন্দীপকে বললেন, ‘কোনো কথা বলো না, এখানে জলের চেয়ে ডাঙায় ভয় বেশি।’
এই বলে তিনি রিভলভার বাগিয়ে শুঁড়িপথ ধরে জঙ্গলে ঢুকলেন। সন্দীপ অনুসরণ করল তাকে। দু-পাশে নিবিড় জঙ্গল। দিনের বেলাতেও ঝিঁঝিপোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। দু-পাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছেন তিনি। আর তার পিছন পিছন সন্দীপ। অন্য কোনো শব্দ কানে গেলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছেন তিনি। কান খাড়া করে শব্দের উৎস বোঝার চেষ্টা করছেন, তারপর আবার এগোচ্ছেন। মিনিট কুড়ি এভাবে চলার পর এক সময় সন্দীপের চোখের সামনে ফুটে উঠল জঙ্গলের মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গা। আর সেই জমির ঠিক মাঝখানেই মাটি থেকে বেশ কিছুটা ওপরে শালকাঠের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরোনো বাংলো ধরনের বাড়ি। বাড়ির তিন পাশের ফাঁকা জমি উঁচু লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। আর বাড়ির পিছনে কিছুটা ফাঁকা জমির পর রয়েছে একটা খাঁড়ি। জালের কাছে এসে একটা দরজা মতো জায়গা দিয়ে জালের ভেতরে সন্দীপকে নিয়ে ঢুকলেন প্রফেসর। তারপর তিনি সন্দীপকে বাড়িটা দেখিয়ে বললেন, ‘এই আমার থাকার জায়গা।’
সন্দীপ প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করল, ‘এত গভীর জঙ্গলে বাড়িটা কে তৈরি করেছিলেন?’
বাড়িটার দিকে হাঁটতে হাঁটতে প্রফেসর বললেন, ‘ব্রিটিশ আমলে একবার হ্যামিলটন সাহেব সুন্দরবন অঞ্চলে এসেছিলেন জমি জরিপের কাজেই। সেই সময় সুন্দরবনের বেশ কয়েকটা জঙ্গলে এরকম বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকবার বনদপ্তর তাদের কাজে বাড়িটা ব্যবহারের চেষ্টা করেছিল। বিভিন্ন সময়ে কিছু লোকজনকেও এখানে থাকার জন্য পাঠিয়েছিল তারা। কিন্তু বাঘের জ্বালায় কেউই বেশিদিন এখানে টিকতে পারেনি। তাদের অর্ধেক বাঘের পেটে যায়। শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকে বাড়িটা। বনদপ্তরের লোকও এর অস্তিত্ব ভুলে গিয়েছে।’
সন্দীপ তাঁর কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, ‘তাহলে আপনি আছেন কী করে?’
প্রফেসর তার কথা শুনে বললেন, ‘কিছুটা বুদ্ধির জোরে আর কিছুটা বরাত জোরে।’
প্রফেসরের সঙ্গে ফাঁকা জমি পেরিয়ে সন্দীপ এসে দাঁড়াল বাড়িটার সামনে। কাঠের বাড়িটার চারপাশ ঘিরে রয়েছে কোমর সমান উঁচু কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা বারান্দা। বারান্দা পার হয়ে তবে ঘরে ঢুকতে হয়। মাটি থেকে বারান্দা আর ঘরগুলোর উচ্চতা অন্তত আট ফুট হবে। মাটি থেকে ওপরে ওঠার জন্য কোনো সিঁড়ি নেই। বারান্দা থেকে ঢালু চওড়া একটা কাঠের পাটাতন নেমে এসেছে মাটি পর্যন্ত। প্রফেসর সেই ঢালু পাটাতন বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলেন। পাটাতন বেয়ে ওপরে উঠতে সন্দীপের একটু ভয় করছিল। তার মনের কথা বুঝতে পেরে প্রফেসর বললেন, ‘প্রথম প্রথম উঠতে নামতে একটু অসুবিধা হবে। পরে ঠিক হয়ে যাবে।’
ধীরে ধীরে সাবধানে কাঠের পাটাতন বেয়ে বারান্দায় উঠে এল সন্দীপ। বারান্দার মেঝেটা ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে ধরনের। কাদামাটি মাখানো আছে কাঠের মেঝেয়। ওপরে ওঠার পর সামনেই যে ঘরটা পড়ল তার দরজা খুলে সন্দীপকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন প্রফেসর। ভেতরে ঢুকে প্রফেসর দরজার ঠিক উলটো দিকের একটা জানলা খুলে দিলেন। পশ্চিমের সূর্যের আলো এসে ঢুকল ঘরের ভেতর। সন্দীপ তাকাল ঘরের চারিদিকে। ঘরের এক পাশে রাখা আছে একটা কাঠের চৌকি মতো শোওয়ার জায়গা। তার ওপর একটা কম্বল রাখা আছে। জানলার কাছে আছে অপটু হাতে তৈরি একটা টেবিল ও চেয়ার। টেবিলের উপর বিরাট একছড়া কলা আর কিছু ফলমূল রাখা আছে। তার পাশেই একগোছা মোম আর একটা দেশলাই। একটা জলের কুঁজোও টেবিলের নীচে চোখে পড়ল সন্দীপের। প্রফেসর সন্দীপকে বললেন, ‘এ ঘরেই থাকতে হবে তোমাকে। এটা এবাড়ির সবচেয়ে ভালো ঘর।’ সন্দীপ প্রফেসরকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার ঘর কোনটা?’
প্রফেসর বললেন, ‘এ বাড়িতে পাশাপাশি চারটে ঘর। তোমার পাশেরটা হল আমার ভাঁড়ার ঘর। তার পর ল্যাবরেটরি আর সবশেষে বারান্দার শেষ প্রান্তে আমার শোবার ঘর।’ এরপর তিনি সন্দীপকে বললেন, ‘সারাদিন তোমার খুব ধকল গিয়েছে। খাবার, মানে ফল আর জল রাখা আছে। তুমি বরং খেয়েদেয়ে এখন বিশ্রাম নাও। আমি পরে আসব তোমার এখানে। তখন কথা হবে।’ এরপর প্রফেসর বললেন, ‘ঘরের দরজা সব সময় বন্ধ করে রাখবে। আর সন্ধে নামার আগে জানলাটাও বন্ধ করে দেবে। জায়গাটা তো ভালো নয়! তাই এই সতর্কতা দরকার।’ সন্দীপ তার কথা শুনে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘আচ্ছা।’
প্রফেসর বেরিয়ে যাওয়ার পর সন্দীপ দরজাটা বন্ধ করে দাঁড়াল জানলার ধারে। জানলার ওপাশে, রেলিং ঘেরা বারান্দা। তারপর নীচে কিছুটা ফাঁকা জমি খাঁড়ির পারে গিয়ে শেষ হয়েছে। ওপারে শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল। পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছে জঙ্গলের মাথায়। বাতাসে গাছের পাতা মৃদু নড়ছে। বেশ কিছুক্ষণ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রইল সন্দীপ। হঠাৎ তার খুব খিদে পেয়ে গেল। জানলা ছেড়ে এসে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। কিছুক্ষণ পর ফল আর জল খেয়ে জানলা বন্ধ করে চৌকিতে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে সে ভাবতে লাগল প্রফেসর কী এমন গবেষণা করছেন যে তার জন্য তাঁকে এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কাটাতে হচ্ছে! ভাবতে ভাবতে তার চোখে ঘুম নেমে এল। বাইরে জঙ্গলের বুকে তখন রাত নেমে আসছে।
প্রফেসরের ডাকে ঘুম ভেঙে সন্দীপ যখন অন্ধকার ঘরে চৌকি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তখন ঘড়িতে রাত আটটা বাজে। দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকলেন প্রফেসর। তারপর টেবিলের কাছে গিয়ে একটা মোম জ্বালিয়ে টেবিলের ওপর রেখে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন। সন্দীপ বসল চৌকিতে। কয়েক মুহূর্ত সন্দীপের দিকে তাকিয়ে থাকার পর প্রফেসর বললেন, ‘তুমি যে এখানে আসছ সে খবরটা কালকেই পেয়ে গিয়েছিলাম আমি।’
সন্দীপ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কীভাবে পেলেন?’
প্রফেসর বললেন, ‘কাল তোমাকে আমি চোরাগাজি খালের ওখানে লঞ্চে দেখেছি।’
জায়গাটার নাম গতকালই লঞ্চের মাঝিদের কাছে শুনেছে সন্দীপ। গতকাল লঞ্চে যখন সে নেতিধোপানি থেকে আসছিল, তখন নদীর চরে এক জায়গায় বড় একটা কুমিরকে রোদ পোহাতে দেখেছিল। মাঝিদের কাছে জায়গাটার নাম জানতে চাওয়ায় তারা বলেছিল, ‘জায়গাটার নাম চোরাগাজি খাল।’
সন্দীপ প্রফেসরের কথা শুনে বলল, ‘দেখলেন যখন তখন ডাকলেন না কেন! তাহলে আপনার সাথেই চলে আসতাম।’
প্রফেসর মৃদু হেসে বললেন, ‘ডাকিনি, কারণ তা সম্ভব ছিল না বলে।’ এরপর প্রফেসর চলে গেলেন অন্য প্রসঙ্গে। সন্দীপকে বললেন, ‘দ্যাখো সন্দীপ, আমার গবেষণা প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। চূড়ান্ত সাফল্য পাওয়ার জন্য একটা শেষ পরীক্ষা বাকি আছে আমার। সে কাজের জন্য তোমার সাহায্য আমার দরকার। তবে কী সাহায্য লাগবে তা আমি সময়মতো বলব। তবে এটুকু শুধু বলি যথাসম্ভব দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। গবেষণার জন্য বিশেষ একটা জিনিস জোগাড় করা শুধু বাকি আছে। তা জোগাড় করতে পারলেই দ্রুত কাজ শেষ করব। আর তার জন্য হয়তো কয়েকটা দিন তোমাকে এখানে কাটাতে হবে। আশা করি এ ব্যাপারে তুমি সাহায্য করবে।’
তাঁর কথা শুনে সন্দীপ বলল, ‘আপনি আমার জন্য কত করেছেন। আপনাকে সাহায্য করতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।’
তার কথা শুনে প্রফেসর হেসে বললেন, ‘না, না, ধন্য মনে করার কিছু নেই। মানুষই তো মানুষকে সাহায্য করে। এরপর প্রফেসর বললেন, ‘এবার তোমাকে কয়েকটি কথা বলব, সেগুলো খেয়াল রাখলে বিপদের আশঙ্কা কমবে তোমার। প্রথমত, সন্ধে নামার পর থেকে ভোর না হওয়া পর্যন্ত দরজা জানলা বন্ধ করে রাখবে। কোনো অবস্থাতেই রাতে ঘরের বাইরে বেরোবে না। দ্বিতীয়ত, কখনও একটানা বারান্দার নীচে জমিতে বেশিক্ষণ থাকবে না। ভোরবেলা আর সন্ধে নামার আগে সতর্ক থাকবে। ওই সময় বাঘেরা জল খেতে আসে। তৃতীয়ত, খাঁড়ির পারে বা ওদিকের জমিতে কখনো বেড়াতে যাবে না। জাল নেই বলে ওদিকটা খুব বিপজ্জনক।’ এই কথাগুলো বলার পর প্রফেসর বললেন, ‘একদিন আমাকে কাজের জন্য বেশি সময় ল্যাবরেটরিতে কাটাতে হবে। তোমাকে একলা এখানে রেখে বাইরেও যেতে হতে পারে। তোমাকে হয়তো আমি খুব বেশি সঙ্গ দিতে পারব না। ব্যাপারটা মানিয়ে নিও তুমি। এরপর প্রফেসর সন্দীপের কাছ থেকে কলকাতার সম্বন্ধে কিছু মামুলি খোঁজখবর নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
প্রফেসর চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে পোশাক পালটে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল সন্দীপ। সারাদিনের ক্লান্তিতে তার চোখে ঘুম নেমে এল। মাঝরাতে একবার ঘুম ভেঙে গেল সন্দীপের। বাইরে মনে হল মেঘ ডাকছে। তবে কি বৃষ্টি নামবে! আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল সন্দীপ।
(৩)
সন্দীপের যখন ঘুম ভাঙল তখন সাতটা বেজে গিয়েছে। ঘরের ছাদের ওপর একটা গোল ফোকর আছে। সেখান দিয়ে আলো এসে পড়েছে তার বিছানার পাশে। এখানে আজ তার প্রথম সকাল। চৌকি থেকে নীচে নেমে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল সন্দীপ। সুন্দর সকাল। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সামনের ফাঁকা জমিতে। কিছু দূরে লোহার জালের ওপাশে জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে আসছে পাখির ডাক। সন্দীপ চারপাশে তাকিয়ে প্রফেসরকে দেখতে পেল না। ঘরে ফিরে জানলাটা খুলে দিল। এবার সে দেখতে পেল প্রফেসরকে। বারান্দা থেকে একটু দূরে ফাঁকা জমিতে দাঁড়িয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছেন। তাকে দেখতে পেয়ে সন্দীপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বারান্দার ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল। প্রফেসর তাকালেন বারান্দার দিকে। সন্দীপকে দেখতে পেয়ে তিনি দূর থেকে চিৎকার করে বললেন, ‘গুডমর্নিং সন্দীপ। রাতে ভালো ঘুম হয়েছে তো?’ সন্দীপ বলল, ‘হ্যাঁ,’ তারপর সে বলল, ‘আমি ওখানে যাব স্যার?’
প্রফেসর সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন তার কথা শুনে। সন্দীপ বারান্দার ওপাশে ফিরে এসে সাবধানে কাঠের পাটাতন বেয়ে প্রথমে নীচে নামল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়াল খাঁড়ির দিকের জমিতে প্রফেসর কাছে। জমিতে কোনো ঘাস নেই। মাটি যেন কেমন ভেজা ভেজা। তা দেখে সন্দীপ প্রফেসরের কাছে গিয়ে বলল, ‘কাল রাতে কি বৃষ্টি হয়েছিল? রাতে যেন মেঘের ডাক শুনেছিলাম?’
তার কথা শুনে প্রফেসর বললেন, ‘কই না তো! কাল সারারাত তো আমি ল্যাবরেটরিতে জেগেই কাটিয়েছি।’ পরমূহূর্তেই প্রফেসর বললেন, ‘ও, বুঝতে পেরেছি। তুমি যেটা মেঘের ডাক বলে ভেবেছ তা আসলে বাঘের গর্জন।’
সন্দীপ অবাক হয়ে বলল, ‘বাঘের গর্জন?’
প্রফেসর উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ!’
এই বলে তিনি আঙুল তুলে দেখালেন সামনের মাটির দিকে। সন্দীপ দেখল কাদামাটিতে আঁকা হয়ে গিয়েছে বাঘের পায়ের ছাপ। সেগুলো এগিয়ে গিয়েছে খাঁড়ির দিকে। ছাপগুলো দেখতে দেখতে সন্দীপ জিজ্ঞাসা করল, ‘বাঘটা কত বড়?’
প্রফেসর বললেন, ‘সুন্দরবনের বাঘ সাধারণত দশ থেকে বারো ফুটের মতো হয়। আমার অনুমান এটা ন থেকে দশ ফুট মতো হবে। তবে এটা বাঘ নয়, বাঘিনী। ভালো করে মাটিটা দ্যাখো।’
সন্দীপ ভালো করে তাকিয়ে দেখতে পেল বড় ছাপগুলোর পাশে অস্পষ্ট ছোট ছোট কয়েকটা ছাপ আঁকা আছে। সঙ্গে বাচ্চা আছে তার। প্রফেসর এবার বললেন, ‘বাচ্চাটার পায়ের ছাপটা না থাকলেও ও বাঘ না বাঘিনী আমি বুঝতে পারতাম।’
সন্দীপ জিজ্ঞেসা করল, ‘কীভাবে?’
প্রফেসর বললেন, ‘অভিজ্ঞতা থেকে।’ তারপর বক্তৃতার ঢঙে বলতে শুরু করলেন, বাঘ যখন হাঁটে তখন বাঘের চার আঙুলের ছাপ মাটিতে পড়ে। পঞ্চম আঙুলের ছাপ মাটিতে পড়ে না। বাঘের পায়ের ছাপকে বলে ‘খোঁচ’। খোঁচ দেখে বাঘ চেনা যায়। বাঘিনীর খোঁচের চারদিকে কল্পিত রেখা টেনে চতুর্ভূজ অঙ্কন করলে তা হয় আয়তাকার। আর বাঘের ক্ষেত্রে হয় বর্গাকার। এরকম বেশ কিছু পার্থক্য আছে খোঁচের মধ্যে। তবে ছ-মাস বয়স না হলে খোঁচ দেখে বাঘ না বাঘিনী চেনা যায় না। যেমন এই বাচ্চাটা বাঘ না বাঘিনী চেনা সম্ভব নয়। কারণ এর বয়স সম্ভবত মাস দুয়েকের বেশি নয়।’ এই বলে থেমে গেলেন প্রফেসর। সন্দীপ অবাক হয়ে শুনল তার কথা। তিনি সন্দীপকে বললেন, ‘চলো, এবার ওপরে যাওয়া যাক। অনেকক্ষণ নীচে দাঁড়িয়ে আছি। কে জানে খাঁড়ির ওধারের জঙ্গল থেকে কেউ আবার আমাকে দেখছে কিনা!’ এই বলে হেসে উঠলেন প্রফেসর, তারপর হাঁটতে শুরু করলেন বাড়িটার দিকে।
হাঁটতে হাঁটতে সন্দীপ প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, সুন্দরবনের সব বাঘই কি মানুষখেকো?’ প্রফেসর বললেন, ‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’ সন্দীপ ফের জিজ্ঞেস করল।
প্রফেসর বললেন, ‘বাদা বন বা ম্যানগ্রোভ অরণ্যের প্রতিকূল পরিবেশে অন্য প্রাণীর মতো বনের রাজাকেও প্রচণ্ড সংগ্রাম করতে হয়। তাই তার খাদ্যতালিকায় মানুষ থেকে ব্যাং কিছুই বাদ যায় না। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবার নতুন এক তথ্য দিয়েছেন। তারা বলেছেন, খাঁড়ির লোনা জল খাওয়ার ফলে যে নুন বাঘের শরীরে ঢোকে সেই নুন বাঘের শরীরে এক জটিল রাসায়নিক ক্রিয়া তৈরি করার ফলে বাঘ মানুষখেকো হয়। তারা আরও জানিয়েছেন যে, মে-জুন মাসে নদীতে জলে নুনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হয়, তাই এই সময় বাঘ আক্রমণ করে বেশি।’ কথা বলতে বলতে প্রফেসর সন্দীপকে নিয়ে বারান্দায় উঠে এলেন। তারপর তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন, ‘আমি এখন আবার আমার ল্যাবরেটরিতে গিয়ে ঢুকব। বিকেলের আগে আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। একলাই তোমাকে কাটাতে হবে।’
সন্দীপ বলল, ‘আচ্ছা।’
প্রফেসর এবার বারান্দার ওপাশে চলে গেলেন, সম্ভবত তার ল্যাবরেটরিতে যাওয়ার জন্য।
সারা সকাল দুপুর বন্ধ ঘরের মধ্যে সঙ্গে আনা একটা বই পড়ে আর ঘুমিয়ে কেটে গেল সন্দীপের। মাঝে একবার দুপুরবেলা খাবার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠেছিল। তখন জানলা দিয়ে দেখেছিল দুটো বিরাট চিতল হরিণ জল খেতে এসেছে খাঁড়িতে। জল খাওয়ার পর আবার তারা চলে গেল জঙ্গলে। প্রফেসরেরও আর কোনো সাড়াশব্দ পায়নি সন্দীপ। নিশ্চয়, তিনি ল্যাবরেটরিতে ব্যস্ত রয়েছেন।
বিকাল বেলা ঘর ছেড়ে বাইরে বের হল সন্দীপ। গতকাল এই সময় এখানে এসে হাজির হয়েছিল। একটা দিন কেটে গেল। সারাটা দিন বদ্ধ ঘরের মধ্যে কেটেছে। সে ভাবল, নীচে নেমে একটু হেঁটে আসা যাক। এই ভেবে সে ধীরে ধীরে নীচে নেমে হাঁটতে শুরু করল জালে ঘেরা জমিটার দক্ষিণ দিকে। কিছুদূর এগোবার পর সে বুঝতে পারল ওদিকে একটা ছোট পুকুর মতো আছে। হাঁটতে হাঁটতে সে গিয়ে হাজির হল সেখানে। দেখল, পুকুরের পারে খেলে বেড়াচ্ছে বেশ কয়েকটা তারখেল বা সর্দার গোসাপ। এই প্রাণীগুলোর সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল সন্দীপের। প্রফেসরের কলকাতার ল্যাবরেটরির খাঁচায় বেশ কয়েকটা এই প্রাণী ছিল। তিনি বাড়ি ছাড়ার আগে কী কারণে যেন মারা যায় প্রাণীগুলি। এদের বৈজ্ঞানিক নামটাও মনে পড়ে গেল তার, ‘ভেরেনাস সালভেটর’। এই নামটা অবশ্য প্রফেসরের মুখ থেকেই শুনেছিল সে। তাহলে কি এদের নিয়ে গবেষণা করার জন্যই তিনি সুন্দরবনে এসেছেন! মনে মনে একবার ভাবল সন্দীপ। প্রাণীগুলো সন্দীপকে দেখে একবার ঘাড় উঁচু করল, তারপর আবার নিজেদের মনে খেলে বেড়াতে লাগল। কাছেই মাটিতে একটা কাঠের গুঁড়ি পড়ে আছে। সন্দীপ গিয়ে বসল তার ওপর। তারপর তারখেলগুলোর খেলা দেখতে লাগল। পুকুরের ওপাশে জালের ওপারে জঙ্গলের ভেতর থেকে কী যেন একটা পাখি কিটকিট শব্দ করে মাঝে মাঝে ডাকছে।
আর কয়েক ঘণ্টা পরেই সন্ধে নামবে। নিস্তব্ধ হয়ে যাবে অরণ্য। শ্বাপদরা বের হবে শিকার ধরার জন্য। সন্দীপ বসে বসে ভাবতে লাগল, এই জনমানবহীন ভয়ংকর পরিবেশে কি করে এত দিন কাটাচ্ছেন প্রফেসর। এ তো আর সুন্দরবনে বেড়াতে এসে লঞ্চে বসে দূর থেকে নদীর চরে হরিণ দেখা বা কুমির দেখা নয়। এ হল আসল সুন্দরবন। দিনে-রাতে যখন-তখন বাঘ বেড়াতে আসে এখানে। সত্যিই প্রফেসরের অসীম সাহস।
মিনিট কুড়ি বসার পর সন্দীপ ভাবল, এবার ফেরা উচিত। প্রফেসর তাকে একনাগাড়ে বেশিক্ষণ নীচে থাকতে বারণ করেছেন। সন্দীপ উঠে দাঁড়াতে যাবে, ঠিক এই সময় তারখেলগুলো হঠাৎ ঘাড় উঁচু করে কী যেন দেখল। আর তারপরই যে যেখানে ছিল ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুকুরের জলে সঙ্গে সঙ্গে সন্দীপ টের পেল একটা আঁশটে গন্ধ। সন্দীপ পিছন ফিরে দেখল কখন যেন নিঃশব্দে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন প্রফেসর সোম। সন্দীপ উঠে দাঁড়াল তাকে দেখে। প্রফেসরের দৃষ্টি পুকুরটার দিকে। সেদিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘এই প্রাণীগুলো হয়তো একদিন পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে যাবে।’ সন্দীপ প্রফেসরের কথা শুনে কিছু বুঝতে না পেরে বলল, ‘কেন?’
তিনি তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সময় হলে জানতে পারবে।’ এরপর আর তারখেলের প্রসঙ্গে কোনো কথা বললেন না তিনি। সন্দীপকে বললেন, ‘আজ বন্ধ ঘরে একা একা সময় কাটাতে নিশ্চয় খুব কষ্ট হয়েছে? কাল তোমায় আমি এক জায়গায় নিয়ে যাব।’ সন্দীপ জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাব আমরা?’
প্রফেসর বললেন, ‘আমরা যাব গোয়াসাবা দ্বীপের কাছে।’
সন্দীপ বলল, ‘গোসাবা? সে তো সজনেখালি আসার পথে!’
প্রফেসর তার কথা শুধরে দিয়ে বললেন, ‘না, গোসাবা নয়, গোয়াসাবা। গোয়াসাবা দ্বীপ হলদির একদম দক্ষিণ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের গায়ে। ভঙ্গদুয়ানি আর গোসাবা নদী মিলেছে দ্বীপটার কাছে। তুমি হয়তো মায়া দ্বীপের নাম শুনেছ। ভঙ্গদুয়ানি ধরে দক্ষিণে এগোলেই মায়াদ্বীপে পৌঁছনো যায়।’
সন্দীপ প্রফেসরের কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, ‘ওখানে আপনি কী করতে যাবেন?’
প্রফেসর সোম উত্তর দিলেন, ‘গেলেই দেখতে পাবে।’ তারপর বললেন, ‘এবার ফিরে চলো। একটু পরেই সন্ধ্যা নামতে শুরু করবে। সময়টা ভালো নয়।’
দু-জনেই এবার ফিরতে শুরু করল বাড়িটার দিকে। বারান্দায় ওঠার পর সন্দীপ আবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। আর প্রফেসর চলে গেলেন তাঁর নিজের কাজে।
ঘরের ভেতর আলো কমে এসেছিল। তাই ঘরে ঢোকার পর একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে সঙ্গে নিয়ে আসা বইটা চৌকিতে বসে পড়তে শুরু করল সন্দীপ। বইটা ইংরেজি রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাসের সংকলন। সন্দীপ পড়তে শুরু করল স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’। জীববিজ্ঞানের এক অধ্যাপক সভ্যজগৎ থেকে অনেক দূরে এক পার্বত্য বনাঞ্চলের সন্ধান পেয়েছিলেন। লক্ষ কোটি বছর আগের এক হারানো পৃথিবীর। যেখানে ঘুরে বেড়ায় ভয়ংকর প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীরা। সেখানকার অভিযানের কাহিনি নিয়েই এই রোমাঞ্চকর উপন্যাস। সন্দীপ পড়তে পড়তে গল্পটার মধ্যে এতটাই ডুবে গেল যে বাইরে কখন অন্ধকার নামল সে বুঝতে পারল না। রাত আটটা নাগাদ তার পড়া শেষ হল। বাতিটাও জ্বলে নিভু নিভু হয়ে এসেছে। হঠাৎ সে খেয়াল করল জানলাটা বন্ধ করা হয়নি। প্রফেসর তাকে সন্ধের তপর জানলা দরজা বন্ধ করে রাখতে বলেছেন। নিজের অসতর্কতায় মনে মনে লজ্জা পেয়ে বই রেখে উঠে গেল জানলার কাছে সেটা বন্ধ করার জন্য। জানলা বন্ধ করার আগে বাইরের দিকে তাকাল সন্দীপ। ক-দিন পরই মনে হয় পূর্ণিমা। বেশ বড় চাঁদ আকাশে। চাঁদের আলোয় বারান্দার নীচের জমিটা, খাঁড়ির পার আর তারও পাশের জঙ্গলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নাম না জানা বনফুলের গন্ধ ভেসে আসছে জঙ্গলের দিক থেকে। হঠাৎ সন্দীপের চোখ পড়ল, বারান্দার নীচের জমিতে একটা লম্বা গাছের গুঁড়ি পড়ে আছে। ওটা তো এর আগে এখানে দ্যাখেনি! সন্দীপ ভালো করে তাকাল সেদিকে, ঠিক তখনই যেন নড়ে উঠে চলতে শুরু করল গুঁড়িটা। সন্দীপ এবার বুঝতে পারল সেটা আসলে গাছের গুঁড়ি নয়, বড় একটা কুমির। প্রাণীটা বুকে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল খাঁড়ির পারে। তারপর বাড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে বড় একটা হাঁ করল। দূর থেকে হলেও চাঁদের আলোয় সন্দীপ স্পষ্ট দেখতে পেল তার চোয়ালের সাজানো দাঁতগুলো। তা দেখে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে শিউরে উঠল সন্দীপ। তারপরেই অদৃশ্য হয়ে গেল প্রাণীটা। একটা মৃদু শব্দের সঙ্গে আকাশের দিকে লাফিয়ে উঠল খাঁড়ির জল। সন্দীপ বুঝতে পারল খাঁড়িতে ঝাঁপ দিল প্রাণীটা। ঘরের মোমটা দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল। সন্দীপ তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করে আরেকটা মোম জ্বালিয়ে নিল। তারপর চৌকিতে বসে ভাবতে লাগল, সত্যিই এক ভয়ংকর জায়গায় রাত কাটাচ্ছে সে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সন্দীপের ঘরের দরজায় টোকা দিলেন প্রফেসর। সন্দীপ উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই ঘরের ভেতর ঢুকলেন প্রফেসর। সন্দীপকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খাওয়া হয়েছে তোমার?’
সন্দীপ বলল, ‘না এখনও হয়নি। মোমের আলোয় সন্দীপ দেখতে পেল প্রফেসরের মাথা ভেজা। জল ঝরছে চুল থেকে। তা দেখে সন্দীপ জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার চুল ভিজে কেন? এখন স্নান করলেন নাকি?’
প্রফেসর বললেন, ‘না, আমি খাঁড়ির পারে একটু আগে গিয়েছিলাম। কাল যাব বলে নৌকোটা ঠিক করে রাখতে। খাঁড়ির জলই ছিটকে মাথায় লেগেছে।’
তার কথা শেষ হতে না হতেই, সন্দীপ বলল, ‘সে কী! এতরাতে আপনি ওখানে গিয়েছিলেন! জানলা দিয়ে কিছুক্ষণ আগেই আমি বড় একটা কুমিরকে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। তারপর খাঁড়িতে নেমে গেল সেটা।’
প্রফেসর চমকে উঠলেন সন্দীপের কথা শুনে। তারপর কিছুটা অসন্তাোষ প্রকাশ করে বললেন, ‘কাজটা তুমি ভালো করোনি। সন্ধে নামার পর জানলা-দরজা বন্ধ রাখতে বলেছিলাম তোমাকে। সামান্য অসতর্কতা এখানে তোমার বিপদ ডেকে আনতে পারে। আশা করি ভবিষ্যতে এসব ব্যাপারে সচেতন থাকবে তুমি।’
প্রফেসর একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘যে কথাটা বলার জন্য তোমার ঘরে এলাম সেটা এবার বলি। কাল ঠিক সাতটায় আমরা বেরোব। তুমি তৈরি হয়ে নিও।’ এই বলে প্রফেসর ঘর ছেড়ে বারান্দায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
সন্দীপ স্পষ্ট বুঝতে পারল জানলাটা খেলা ছিল বলে তার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন প্রফেসর। শুধু একটা জিনিস সে বুঝতে পারল না যে, খাঁড়ির দিকটা বিপজ্জনক জেনেও এত রাতে তিনি ওখানে গেলেন কেন! কাজটা তো তিনি অন্য সময় করতে পারতেন।
(৪)
বেলা তখন প্রায় দশটা বাজে। জল কেটে এগিয়ে চলছিল প্রফেসরের নৌকো। আজ ঠিক সকাল সাতটাতেই বেরিয়ে পড়েছে তারা। প্রফেসর সঙ্গে করে মুখ বাঁধা একটা বড় চটের বস্তা এনেছেন। তার ভেতর কী আছে তা অবশ্য সন্দীপ জানে না। প্রফেসরের মনমেজাজ মনে হয় আজ ভালো। দাঁড় বাইতে বাইতে মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান গাইছেন, নিজেই সন্দীপকে এটা-ওটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। ঘণ্টা তিনেক বড় গাঙ বেয়ে চলার পর নৌকো ঢুকল খাঁড়ির ভেতর। তার দু-পাশে সুন্দরী গাছের জঙ্গল। সুন্দরীর পাতাগুলো ছোট ছোট। অনেকটা লবঙ্গ পাতার মতো দেখতে। তার ওপরটা মসৃণ আর নীচের অংশ ধূসর রঙের। দাঁড় বাইতে বাইতে প্রফেসর বললেন, ‘একসময় বনের সব জায়গায় সুন্দরী গাছ দেখা যেত, এখন শুধু বনের দক্ষিণ দিকেই বেশি দেখা যায়।’
খাঁড়ি বেয়ে চলতে চলতে হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল সন্দীপের। খাঁড়ির নির্জন চরে একটা নৌকোর বৈঠা পোঁতা আছে। তার ফলার দিকটা আকাশের দিকে মুখ করা। তার মাথার দিকে রং চটে যাওয়া একটা কাপড়ের ফালি পতাকার মতো উড়ছে। সন্দীপ বলল, ‘ওটা কী?’ প্রফেসর বললেন, ‘ওর মানে হল এখানে কোনো মানুষকে বাঘে নিয়ে গিয়েছিল। যখন কোনো মাঝিকে বাঘে নিয়ে যায় তখন অন্য মাঝিরা সেই নৌকোর বৈঠা চরে পুঁতে দিয়ে কাপড়ের পুঁটলিতে কিছু চাল বেঁধে দেয় তার সঙ্গে।’
তার কথা শুনে সন্দীপ বলল, ‘কেন?’ প্রফেসর বললেন, ‘ব্যাপারটা মৃত মানুষের আত্মার শান্তি কামনায় করা হলেও, এর আসল উদ্দেশ্য হল জায়গাটা সম্বন্ধে মানুষকে সতর্ক করা।’ একটু থেমে প্রফেসর বললেন, ‘জায়গাটা আসলে সুন্দরবন তো, এখানে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ, মৃত্যু এখানে পায়ে পায়ে খেলে বেড়ায়। জঙ্গলের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হলে সে ভাষা জানতে হয়।’ সন্দীপ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, বাঘ আর কুমিরের মধ্যে কে বেশি ভয়ংকর।’
সন্দীপের প্রশ্ন শুনে প্রফেসর একবার ফিরে তাকালেন তার দিকে, ‘আমার মনে হয় কুমির। বাঘের মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছে এমন মানুষ খুঁজলে তুমি দু-একজন পাবে। কিন্তু কুমিরের চোয়াল থেকে কেউ ফিরে আসে না। সুন্দরবনের কুমির পৃথিবীর বৃহত্তম মোহনার কুমির। জোয়ারের জল অনেক সময় পনেরো ষোলো ফুট উঁচু হয়ে দ্বীপ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বাগে পেলে বাঘকেও তারা তখন টেনে নিতে চেষ্টা করে। এমনই শক্তিধর এই প্রাণী।
তার কথা শুনে সন্দীপ বলল, ‘তাদের চোয়াল কত বড়?’
প্রফেসর দাঁড় বাইতে বাইতে বললেন, ‘তাহলে তোমাকে একটা উদাহরণ দিই। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এর যে নমুনা রাখা আছে আকারে তা তেত্রিশ ফুট। কুড়ি-বাইশ ফুটের কুমির তো হামেশাই চোখে পড়ে সুন্দরবনে। এদের বৈজ্ঞানিক নাম হল, ‘কোকোডাইলাস পোরোসাস।’
কথা বলতে বলতে প্রফেসরের নৌকা এসে পৌঁছল একটা বড় গাঙে। প্রফেসর সন্দীপকে বললেন, ‘আর বেশিক্ষণ নয়, আমরা প্রায় এসে গিয়েছি।’
বড় নদী, ডান দিকের চর ঘেঁষে এগোচ্ছেন প্রফেসর। হঠাৎ তিনি সন্দীপকে বললেন, ‘ওই দ্যাখো!’ এই বলে তিনি নৌকাটিকে দ্রুত চরে ভিড়িয়ে দিলেন।
সন্দীপ দেখতে পেল একটু দূরে কাদার চরে গোল পাথরের মতো কী যেন পড়ে আছে। প্রফেসর নৌকো থেকে লাফিয়ে কাদা মাটিতে নামলেন, তারপর জিনিসটা তুলে নিয়ে আবার নৌকোর কাছে ফিরে এলেন। সন্দীপ দেখতে পেল সেটা একটা কচ্ছপ। তবে তার পাগুলো অনেকটা ডানার মতো। প্রফেসর সেটা নিয়ে নৌকোয় উঠতে উঠতে বললেন, ‘এর নাম অলিভ রিডলে টার্টল। দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ। সুদূর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে মোহনায় ডিম পাড়তে আসে।’
সন্দীপ বলল, ‘কী করবেন এটা দিয়ে?’ প্রফেসর বললেন, ‘ওর ফ্লিপার দুটো ভেঙে গিয়েছে। ও আর সমুদ্রে ফিরে যেতে পারবে না। এটা দিয়ে বরং রাতে উদরপূর্তি করা যাবে।’ এই বলে আবার দাঁড়টা জলে ফেলবার জন্য তুলে নিলেন প্রফেসর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার বড় গাঙ ছেড়ে খাঁড়িতে এলেন প্রফেসর। তারপর এমন একটা জায়গায় এসে তারা হাজির হলেন, সেখানে কোনাকুনিভাবে দুটো খাঁড়ি এসে পরস্পরের সঙ্গে মিশেছে। ওপাশে ক্যাওড়া আর বাইনের ঘন জঙ্গল। প্রফেসর সেখানে এসে চরে নৌকো ভেড়ালেন না। খাঁড়ির মাঝখানে নৌকো থেকে ছোট্ট নোঙরটা জলে ফেললেন। তারপর কীসের জন্য যেন নৌকোয় বসে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। সময় কাটতে লাগল। সন্দীপ দেখতে পেল জোয়ারের জল আস্তে আস্তে বাড়ছে। চরের মধ্যে জেগে থাকা শুলোগুলো আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে জলের তলায়। প্রফেসরের কপালেও যেন ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা সময় কেটে যাওয়ার পর তিনি একসময় স্বগতোক্তি করলেন, ‘ওরা মনে হয় আজ আসবে না, এবার ফিরতে হবে। নইলে সন্ধের আগে আর পৌঁছনো যাবে না।’ এই বলে প্রফেসর হাত বাড়াতে লাগলেন নোঙরের শিকলটার দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা কীসের যেন শব্দ শুনতে পেল সন্দীপ। শব্দটা শুনতে পেলেন প্রফেসরও। সন্দীপ দেখল, প্রফেসরের মুখে ফুটে উঠল একটা মৃদু হাসি। শিকলটা আর তুললেন না তিনি। শব্দটা ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে। একসময় সন্দীপ দেখতে পেল মোটর লাগানো একটা দ্রুতগামী নৌকো উলটো দিকের খাঁড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। জনাচারেক লোক রয়েছে তার মধ্যে, ওরা কারা? নৌকোটাকে দেখে অবাক হয়ে গেল সন্দীপ। নৌকোটা এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সন্দীপের নৌকোর ঠিক পাশে। তিনজন যুবক আর একজন মাঝবয়সি লোক রয়েছে তাতে। প্রত্যেকেরই পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি। পাশে এসে দাঁড়াবার পর মাঝবয়সি লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে প্রফেসরের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ছালাম কত্তা।’
প্রফেসরও উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, ‘আমি তো ভাবলাম তুমি আর এলেই না। এখনই ফিরে যাচ্ছিলাম।’ তাঁর কথা শুনে লোকটা বলল, ‘কী করুন কত্তা! দুই দেশের জল- পুলিশের চোখে ধুলো দিয়া আইতে হয়। আজ আবার নৌকোর খোলে বাঘ মারা বন্দুক। ধরা পড়লেই দশডা বছর জ্যাল। অনেক ঘুইরা আইতে হল আজ।’ তারপর লোকটি বলল, ‘আপনি বরং একটা দল গড়ুন কত্তা। আমরা তাতে যোগ দিমু।’
তার কথা শুনে ধমকে উঠলেন প্রফেসর, ‘বাজে কথা রাখো। এখন আমার জিনিসটা দাও আর তোমাদেরটা নাও।’
লোকটি এবার নৌকোর খোল থেকে বের করে আনল একটা রাইফেল আর একটা ছোট লম্বাটে বাক্স। প্রফেসরের হাতে সেগুলো তুলে দিতে দিতে বলল, ‘ছাইলেনছর আর গুলি বাক্সর মধ্যে আছে। আমাদের তো এ জিনিস কামে লাগে না। এমনই বোমাগুলিতেই কাজ চলে যায়।’
প্রফেসর তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে জিনিসগুলো নিয়ে নৌকোর খোলের মধ্যে রাখলেন। তারপর চটের বস্তাটা তুলে নিয়ে লোকটির দিকে এগিয়ে দিলেন। লোকটি বস্তাটা তুলে নিয়ে তার নৌকোর খোলের মধ্যে রেখে বলল, ‘তাহলে এখন আসি কত্তা? সামনের পাঁচ তারিখ ফের আসুম।’
প্রফেসর উত্তর দিলেন, ‘আচ্ছা।’ তাদের নৌকোর মোটরটা চালুই ছিল। নৌকোর মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে দ্রুত আবার ফিরে চলল তারা। প্রফেসরও এরপর নোঙর তুলে নিয়ে দাঁড় ফেললেন জলে।
পুরো ঘটনাটা অবাক হয়ে দেখল সন্দীপ। প্রফেসর ফেরার জন্য দাঁড় বাইতে শুরু করতেই সন্দীপ জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা কারা?’
প্রফেসর একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘ওরা জলদস্যু।’
সন্দীপ শুনেছে যে, সুন্দরবন অঞ্চলে জলদস্যুরা মাছ ধরার ট্রলার ছিনতাই করে, নিরীহ ধীবরদের ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে। খবরের কাগজে ছাপা হয় এসব খবর। তাই প্রফেসরের কথা শুনে সে বলল, ‘ওরা তো ভয়ংকর লোক। মানুষ খুনও করে। ওদের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?’
প্রফেসর দাঁড় বাইতে বাইতে বললেন, ‘বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আমার যোগাযোগের ওরাই একমাত্র মাধ্যম। অন্য দেশ থেকে আসে ওরা। ওদের জিনিসপত্র আমার কাছে লুকিয়ে রেখে যায়, পরিবর্তে আমারও কিছু কাজ করে দেয়। তোমার ওই চিঠিটা ওদের মাধ্যমেই পাঠিয়েছিলাম আমি।’
সন্দীপ বলল, ‘কিন্তু এসব কাজ তো আইনের চোখে অপরাধ।’
প্রফেসর বললেন, ‘তা আমি জানি। কিন্তু ব্যক্তিগত সুখস্বাচ্ছন্দ্য, ভোগবিলাসের জন্য আমি এসব করছি না। আমি যা করছি তার পিছনে বিজ্ঞান সাধনার মহৎ উদ্দেশ্য আছে।’
প্রফেসরের বক্তব্য ঠিক গ্রহণযোগ্য মনে হল না সন্দীপের। সে বলল, ‘বন্দুক আর সাইলেন্সর দিয়ে কী করবেন আপনি?’
নৌকো চালাতে চালাতে প্রফেসর বললেন, ‘কাল সকালে যে বাঘের বাচ্চার পায়ের ছাপ দেখেছিলে তাকে আমার অন্তিম গবেষণার জন্য বিশেষ দরকার। কিন্তু বাঘিনী বেঁচে থাকতে সেটা সম্ভব নয়। আমাকে মারতে হবে ওকে। বন্দুকের শব্দ যাতে অন্য কারও কানে না যায়, তার জন্য সাইলেন্সরটা আমার দরকার।’ এরপর চুপ করে গেলেন প্রফেসর। সন্দীপও আর কোনো কথা বলল না। নৌকোয় বসে বনের দিকে তাকিয়ে চলতে চলতে সে শুধু ভাবতে লাগল, প্রফেসর কী এমন গবেষণা করছেন যার জন্য এত আইন ভাঙছেন তিনি!
সন্দীপের আশ্চর্য হওয়া বোধ হয় আরও বাকি ছিল। ফেরার সময় আরও অবিশ্বাস্য ঘটনা সন্দীপ দেখল। প্রফেসরের ডেরা আর তখন ঘণ্টাখানেকের পথ। বেলা পড়ে এসেছে। একটা নির্জন চরে হঠাৎ তারা দেখতে পেল, একটা ফুট দুয়েক লম্বা কুমিরের বাচ্চাকে ধরার চেষ্টা করছে একটা শেয়াল। বাচ্চাটাকে খাঁড়ির জলে নামতেও দিচ্ছে না। শুধু তার পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে আর তার গায়ে কামড় বসাবার চেষ্টা করছে। ঘটনাটা দেখামাত্রই একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলেন প্রফেসর। নৌকো চরে ভিড়িয়ে বইঠা নিয়ে লাফিয়ে নীচে নেমে তাড়া করলেন শিয়ালটাকে। শিয়ালটা মনে হয় ভাবেনি যে, এই নির্জন চরে কেউ তার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে! তাই সে একবার থমকে তাকাল প্রফেসরের দিকে, তারপর তিনি কাছে পৌঁছতেই সে দৌড় লাগাল চরের পাশে জঙ্গলের ভেতর। কুমিরের বাচ্চাটা কিন্তু পালাল না। প্রফেসর বাচ্চাটিকে মাটি থেকে তুলে নিলেন, তারপর ফিরে আসতে লাগলেন নৌকোর দিকে। সন্দীপ ভাবল এটাকেও তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন নাকি!
প্রফেসর এসে দাঁড়ালেন নৌকোর কাছে। ড্যাবড্যাবে চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে প্রফেসরের হাতে ধরা প্রাণীটি। তিনি প্রাণীটি দেখিয়ে সন্দীপকে বললেন, ‘কী সুন্দর দেখেছ! এত সুন্দর প্রাণী এই বনে আর নেই।’
সন্দীপের কিন্তু মোটেও ভালো লাগল না প্রাণীটিকে। তার শরীরটা কেমন শিরশির করে উঠল। হঠাৎ সন্দীপ দেখল নৌকোটা চরে যেখানে ভেড়ানো আছে সেখানে চরের কাদামাটির ওপর লম্বা কয়েকটা দাগ। সেগুলো চিনতে পেরে সন্দীপ প্রফেসরকে বলল, ‘শিগগির নৌকোয় উঠে পড়ুন। জায়গাটা কুমিরের আড্ডা। ওই দেখুন কাদার ওপর কুমিরের দাগ।’
সন্দীপের কথায় প্রফেসর স্মিত হেসে বললেন, ‘তা আমি জানি। কিন্তু নৌকোয় ওঠার আগে দেখি এর কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা।’ এই বলে বইঠাটা নৌকোয় ছুড়ে ফেলে প্রফেসর জল থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বাচ্চাটিকে মাটিতে নামিয়ে রাখলেন। তারপর কয়েক পা পিছিয়ে জঙ্গলের দিকে দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করতে শুরু করলেন। সন্দীপ বুঝতে পারছিল না কী করতে চাইছেন প্রফেসর। সে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তিনি কিন্তু শব্দটা করে যেতেই লাগলেন।
মিনিট কয়েক পর জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেল সন্দীপ। আর তার পরমুহূর্তেই জঙ্গলের ভেতর থেকে লাফিয়ে চরে নেমে এল প্রকাণ্ড একটা কুমির। সেটা এগোতে শুরু করল প্রফেসরের দিকে। নৌকোয় দাঁড়িয়ে সন্দীপ ভয়ে চিৎকার করতে গেল। কিন্তু তার গলা দিয়ে শব্দ বেরোল না। বিস্ফারিত চোখে সন্দীপ দেখল ঘটনাটি। কুমিরটা কিন্তু প্রফেসরকে আক্রমণ করল না। তাঁর ফুট দশেক দূরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তারপর কয়েক মুহূর্ত প্রফেসর আর কুমিরটা যেন পরস্পরকে দেখল, তারপর বাচ্চাটাকে মুখে নিয়ে ধীরে ধীরে জঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল কুমিরটা।
প্রফেসর নৌকোয় এসে ওঠার পর কিছুক্ষণ বিস্ময়ে কোনো কথা বলতে পারল না সন্দীপ। তারপর সে প্রফেসরকে বলল, ‘কুমিরটা আপনাকে আক্রমণ করল না কেন?’
প্রফেসর নৌকো বাইতে বাইতে উত্তর দিলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ওদের সঙ্গে আছি। আমরা পরস্পরকে চিনি, বুঝি।’
সন্দীপ বলল, ‘তার মানে?’
তার এই কথার কোনো উত্তর দিলেন না প্রফেসর। বাকি পথটা তিনি চুপচাপই রইলেন। সন্দীপ যখন প্রফেসরের ডেরায় এসে পৌঁছল তখন অন্ধকার নেমে আসছে জঙ্গলে।
ফিরে এসে নিজের ঘরে শুয়ে পড়েছিল সন্দীপ। রাত আটটা নাগাদ প্রফেসর এলেন সন্দীপের ঘরে। তাঁর হাতে একটা পাত্র। ঘরে ঢুকে তিনি বললেন, ‘কচ্ছপের মাংসটা তোমার জন্য আগুনে ঝলসে আনলাম। আমার এখানে তো আর রান্নার ব্যবস্থা নেই। খেয়ে দ্যাখো কেমন লাগে।’ এরপর তিনি পাত্রটা টেবিলে নামিয়ে রেখে সন্দীপকে বললেন, ‘কাল আর পরশু এই দুটো দিন কিন্তু আমি থাকব না। সেই বাঘের বাচ্চাটার সন্ধানে যাব। এই দুটো দিন কিন্তু একাই কাটাতে হবে তোমাকে।’
প্রফেসরের কথা শুনে ঘাবড়ে গেল সন্দীপ। এরকম পরিবেশে একা সে এই বাড়িতে কাটাবে কী করে? সে প্রফেসরকে কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। প্রফেসর বোধহয় বুঝতে পারলেন তার মনের কথা। তাই তিনি বললেন, ‘তোমার বিশেষ ভয়ের কিছু নেই, শুধু আমার কথাগুলো মনে রাখবে। একটু সতর্ক থাকবে, তা হলেই হবে। আর এটা তোমার কাছে রাখো, মনে বল আসবে।’ এই বলে তিনি তাঁর জামার নিচ থেকে রিভলভারটা বের করে টেবিলের উপর রাখলেন।
সন্দীপ টেবিলের কাছে গিয়ে রিভলভারটা নিয়ে দেখতে লাগল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই প্রফেসর একটা চটের থলে নিয়ে ঘরে ফিরে এলেন। সেটাকে ঘরের মেঝেয় নামিয়ে রেখে তিনি বললেন, ‘এর মধ্যে একটা ছোট হাঁড়ি আর কিছু চাল-ডাল আছে। আমি বারান্দায় কাঠ রেখে যাব। ইচ্ছে হলে ফুটিয়ে খেতে পারো।’
সন্দীপ প্রফেসরের কথা শুনে বলল, ‘এখানে চাল-ডাল আপনি কোথা থেকে জোগাড় করলেন?’
প্রফেসর তার কথা শুনে একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘মাসখানেক আগে হলদির চরে একটা পরিত্যক্ত নৌকোয় আমি বস্তাটা পেয়েছিলাম। নৌকোর মাঝিকে মনে হয় বাঘে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। এই চালডালগুলো বোধহয় তারই।’ বস্তার জিনিসগুলো মৃত মানুষের, একথা শুনে সন্দীপের মনের ভেতর একটু অস্বস্তি হল। কিন্তু সে তাঁকে কিছু বলল না।
প্রফেসর এরপর সন্দীপকে বললেন, ‘আমি এবার আসি, তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো। কাল যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাব।’ সন্দীপ বলল, ‘আচ্ছা।’
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর। তিনি চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে টেবিলে বসে মাংস খেতে শুরু করল সন্দীপ। সারাদিন খাওয়া হয়নি। খুব সুস্বাদু না লাগলেও পুরো মাংসটাই শেষ করল। তারপর জল খেয়ে, বাতি নিভিয়ে, রিভলভারটা মাথার কাছে নিয়ে চৌকিতে শুয়ে পড়ল।
(৫)
প্রফেসরের ডাকে ঘুম ভাঙার পর সন্দীপ দরজা খুলে বাইরে এসে দেখতে পেল প্রফেসর একদম তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে খাকি রঙের পোশাক। কাঁধে রাইফেল, পায়ে হাঁটু পর্যন্ত উঁচু রাবার সোলের জুতো। তার এক হাতে ঝুলছে ফুট তিনেক লম্বা শক্ত লোহার জালের একটা খাঁচা। সন্দীপ দরজা খোলার পর প্রফেসর বললেন, ‘গুডমর্নিং সন্দীপ, ঘুম কেমন হল?’
সন্দীপ তাকে গুডমর্নিং জানিয়ে বলল, ‘ভালো।’
প্রফেসর এরপর বললেন, ‘তাহলে এখন আমি আসি সন্দীপ? ভয়ের কোনো কারণ নেই, শুধু একটু সাবধানে থাকতে হবে, এই যা। আমার কাজ শেষ হয়ে গেলে আমি আগেও ফিরে আসতে পারি।’
সন্দীপ বলল, ‘আচ্ছা।’
এই বলে প্রফেসর পা বাড়ালেন। সন্দীপও ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। তার ইচ্ছে ছিল নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। কিন্তু প্রফেসর ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, ‘তোমাকে আর আমার সঙ্গে নীচে আসতে হবে না।’
সন্দীপ রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল। প্রফেসর নিজের জমিটা পার হয়ে জালে ঘেরা জায়গাটার বাইরে জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
প্রফেসর চলে যাওয়ার পর পরে ফিরে এল সন্দীপ। তারপর জানলাটা খুলে সেখানে দাঁড়াল। ভোরের আলোয় খাঁড়ির জল চিকচিক করছে। বাতাসে দুলছে ওপারের জঙ্গল। দুটো বন মুরগি পোকা খুঁটে খাচ্ছে খাঁড়ির পারে। চারপাশে বেশ একটা শান্ত সুন্দর পরিবেশ। কিছুক্ষণ জানলায় দাঁড়িয়ে থাকার পর সন্দীপ মুখ হাত ধুয়ে কয়েকটা ফল খেল। তারপর ভাবতে লাগল, একা সে দু-দিন সময় কাটাবে কী করে? হঠাৎ নিজেকে তার গল্পে পড়া রবিনসন ক্রুসোর মতো মনে হল। অচেনা নির্জন দ্বীপে তারই মতো একাকী সে। তারপর সন্দীপ ভাবল পুরো বাড়িটা একবার ঘুরে দেখবে। কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে? চৌকিতে প্রফেসরের রিভলভারটা রাখা ছিল। সেটা হাতে নিতেই মনের মধ্যে যেন একটা বাড়তি বল পেল সন্দীপ। রিভলভারটা নিয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে খাঁড়ির দিকের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এদিকে আসতে গেলে সন্দীপকে তার ঘরটাকে বেড় দিয়ে আসতে হয়। তার ঘরের দরজা বাদ দিয়ে অন্য তিনটি ঘরের দরজাই খাঁড়ির দিকে মুখ করা। প্রফেসর বারান্দার অন্য প্রান্ত দিয়ে এই পাশে আসা-যাওয়া করেন। বারান্দার কাঠের মেঝে কেমন যেন ভেজা ভেজা আর কাদামাখা। সন্দীপের ঘরের জানলা থেকে একটু দূরে এদিকেও একটা ঢালু পাটাতন আছে বারান্দা থেকে নীচে নামার জন্য। তার ঘরের পাশেই ভাঁড়ার ঘরের দরজা বাইরে থেকে দুটো আড়াআড়ি কাঠের পাটাতনে পেরেক ঠুকে বন্ধ করা আছে। সন্দীপ হাঁটতে শুরু করল বারান্দার অন্য প্রান্ত দিয়ে। ভাঁড়ার ঘরের পরেরটাই প্রফেসরের ল্যাবরেটরি। দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সন্দীপ। দরজাটা শুধু ভেজানো আছে। তালা দেওয়া নেই। হয়তো এখানে চুরি যাওয়ার কোনো ভয় নেই বলেই। সন্দীপের হঠাৎ ইচ্ছে হল ল্যাবরেটরির ভেতরটা ঘুরে দেখার। কিন্তু সে ভাবতে লাগল প্রফেসরের অনুপস্থিতিতে তার ল্যাবরেটরিতে ঢোকা উচিত হবে কিনা! কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ইচ্ছেটাকে দমন করতে পারল না। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর। একটা আঁশটে আর কোনো এক রাসায়নিক বিচ্ছিরি গন্ধ মিলেমিশে ছড়িয়ে আছে ল্যাবরেটরিতে। লম্বা ঘরটার মধ্যে লম্বা লম্বা বেশ কয়েকটা কাঠের টেবিল, র্যাক রাখা আছে। সেগুলো নানা ধরনের শিশি-বোতল, টেস্টটিউব ইত্যাদিতে ভর্তি। ঘরের দু-প্রান্তে আরও দুটো দরজা আছে। সন্দীপ বুঝতে পারল, তার একটা প্রফেসরের শোয়ার ঘর, আর অন্যটা তার ভাঁড়ার ঘরে যাওয়ার জন্য। শোওয়ার ঘরের দরজাটা সন্দীপ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার খুব কাছেই। তার পাল্লা দুটো খোলা। ঘরে ঢোকার পর পায়ে পায়ে সন্দীপ এগিয়ে গেল সেই দরজার কাছে। তারপর উঁকি মারল ঘরে। ঘরের অন্য দরজা জানলা বন্ধ, শুধু দেওয়ালের মাথায় যে ঘুলঘুলির মতো ছিদ্র আছে, তা দিয়ে কিছু আলো ঢুকছে ঘরের ভেতর। আধো অন্ধকার খেলা করছে ঘরে। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে কাদামাখা ঘর। কোনো আসবাব নেই। ঘরের এক কোনায় একটা কাঠের বেদিমতো জায়গার ওপর ডাঁই করে রাখা আছে পচা পাতার রাশি। অবাক হয়ে গেল সন্দীপ। ওটাই তাহলে প্রফেসরের বিছানা! সত্যিই ওঁকে কী কৃচ্ছ্রসাধন করতে হচ্ছে সাধনার জন্য, মনে মনে ভাবল সন্দীপ। এছাড়া ঘরের এক কোনায় দেওয়ালের গায়ে ঝুলছে কিছু পোশাক। আর কিছুই নেই সেই ঘরে। দরজা থেকে সরে গিয়ে এবার সে মুখ ফিরিয়ে ভালো করে তাকাল ল্যাবরেটরির চারদিকে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল ঘরের কোনায় টেবিলের ওপর রাখা অ্যাকোরিয়ামের মধ্যে কী যেন একটা নড়ছে। কী রয়েছে ওর ভেতর আধো অন্ধকার জায়গাটায়? কৌতূহল নিয়ে সন্দীপ এগিয়ে গেল সেদিকে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের মধ্যে শুরু হল একটা আলোড়ন। সন্দীপ কাছে গিয়ে দাঁড়াবার কয়েক মুহূর্ত পর থামল ভেতরের প্রাণীটার দাপাদাপি। সন্দীপ দেখল আকোরিয়ামের ভেতর থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে একটা কুমিরের বাচ্চা। কিছুক্ষণ তাকে দেখার পর সন্দীপ পা বাড়াল ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য। ঠিক সেই সময় তার চোখে পড়ল, পাশে টেবিলের উপরে রাখা আছে চামড়ায় বাঁধানো একটা বড় খাতা, সঙ্গে একটা কলমও। সন্দীপ খুলে দেখল খুদে খুদে অক্ষরে লেখা আধো অন্ধকার ঘরে ঠিক পড়া যাচ্ছে না। কী লেখা আছে খাতায়? প্রফেসরের অজ্ঞাতবাসের দিনলিপি? খাতাটা নিয়ে সন্দীপ ল্যাবরেটরির দরজার সামনে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তারপর পাতা ওলটাতে শুরু করল। সন্দীপ বুঝতে পারল, আসলে খাতাটা প্রফেসরের ল্যাবরেটরি নোটবুক। নানা ধরনের জটিল হিসেব, ডায়াগ্রাম ইত্যাদি লেখা আঁকা আছে খাতার পাতায়। ইংরেজিতে কিছু লেখাও আছে খাতায়। সবই বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্বগত বিষয়। সন্দীপ পড়েও তার মানে উদ্ধার করতে পারল না। খাতাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু একটা পাতায় হঠাৎ চোখ আটকে গেল। পাতার নীচের দিকে কী যেন লেখা আছে। সে দেখল, সেখানে লেখা, ‘ছেলেবেলায় ‘কথামালা’ বইয়ে পড়া সেই ‘মুনি আর ইঁদুরের গল্প’র তাৎপর্য বুঝতে পারছি এতদিনে। গল্পের সেই মুনি আসলে বিজ্ঞানী ছিলেন।’
লেখাটা দেখে অবাক হয়ে গেল সন্দীপ। এই লেখার মানে কী! এরকম আরও কিছু লেখা আছে কিনা তা দেখার জন্য পরের পাতাগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। গোটা দশেক পাতা ওলটানোর পর সে একই ধরনের লেখা দেখল। প্রফেসর সেখানে লিখেছেন, ‘এবার পরীক্ষা নিজের উপর। একটাই শুধু ভয়, যদি ফিরতে না পারি! বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রার কথা কে জানাবে বিশ্বকে?’ খাতাটার কোনো পাতাতেই কোনো সাল তারিখের উল্লেখ নেই, ফলে এই লেখাগুলো যে প্রফেসর কবে লিখেছেন তা বোঝার কোনো উপায় রইল না। এ ধরনের শেষ লেখা সন্দীপ যেটা দেখল, সেটা একদম মোটা খাতাটার শেষের দিকে। দ্বিতীয় লেখার সঙ্গে দূরত্ব প্রায় একশো পাতা। তবে এই লেখাটা যে সন্দীপ এখানে আসার পর প্রফেসর লিখেছেন, তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না, কারণ তিনি লিখেছেন, ‘সন্দীপ যে এখানে আসবে আমি জানতাম, কিন্তু আমি ওকে কীভাবে বলব আমার কথা? ও বিজ্ঞানী নয়, বিজ্ঞানের স্বার্থে নিজেকে উৎসর্গ করতে রাজি হবে তো? তারপর আর কোনো লেখা নেই। পাতাগুলো একদম সাদা। খাতাটা বন্ধ করে দিল সন্দীপ। খাঁড়ির দিকে তাকাল সে। কখন যেন একপাল বুনো শূকর এসে হাজির হয়েছে খাঁড়ির পারে। মাটি খুঁড়ছে তারা। মনে হয় কন্দমূলের লোভে। সেদিকে তাকিয়ে সন্দীপ ভাবতে লাগল এই লেখাগুলোর মানে কী? একটা ব্যাপার মনে হচ্ছে, প্রফেসরের লেখাগুলোর মধ্যে কোনো কিছুর যেন একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে।
কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার পর সে আবার ল্যাবরেটরিতে ঢুকে খাতাটা ঠিক জায়গায় রেখে দিয়ে ল্যাবরেটরির দরজাটা আগের মতো বন্ধ করে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল।
বিকেল পর্যন্ত ঘরেই কাটিয়ে দিল সন্দীপ। কিছুটা ঘুমিয়ে, কিছুটা সময় কাটল বইপড়ে। সন্দীপের চোখে পড়েছে প্রফেসর তার ঘরের দরজার কাছে বারান্দার এক কোণে শুকনো কাঠ রেখে গিয়েছেন। কিন্তু দুপুরের রান্না না করে সে ফল খেয়েই কাটাল। বিকেলবেলা হাঁটবার জন্য বাইরে বেরিয়ে একটু নীচে নেমেছিল সে। তারপর আবার ঘরে ফিরে দরজা জানলা বন্ধ করে মোমবাতি জ্বালিয়ে সঙ্গে আনা বইটা পড়তে বসে গেল। রাত আটটা নাগাদ বইটা বন্ধ করল সন্দীপ। কিছু খেতে তার ইচ্ছা করছে না। শুধু জল খেয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার। অন্ধকার ঘর, কোথাও যেন শব্দ হচ্ছে। একটা মৃদু খসখস শব্দ। ঘরের মধ্যে কোনো প্রাণী ঢোকেনি তো! সন্দীপ মাথার কাছ থেকে রিভলভারটা হাতে নিল। তারপর বিছানায় শুয়ে শব্দের উৎস বোঝার চেষ্টা করতে লাগল, মাঝে মাঝে শব্দটা শোনা যাচ্ছে, একটানা নয়। সন্দীপ বুঝতে পারল, শব্দটা আসলে খাঁড়ির দিকের বারান্দা থেকে আসছে। কীসের শব্দ ওটা? রিভলভারটা হাতে নিয়ে চৌকি থেকে নীচে নেমে অন্ধকারের মধ্যে ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়াল জানলার কাছে। শব্দটা এবার স্পষ্ট কানে আসতে লাগল। যেন কোনো প্রাণী ঘষটে ঘষটে বারান্দায় চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। তবে সম্ভবত সে বেশ ভারী। তার দেহের ভারে পুরোনো কাঠের মেঝে থেকে মচমচ শব্দ হচ্ছে। কিন্তু কী প্রাণী ওটা? প্রফেসর রাতে জানলা খুলতে বারণ করেছে। একটা কৌতূহল পেয়ে বসল তাকে। সাবধানে জানলার পাল্লাটা ধীরে ধীরে ফাঁক করল। চাঁদের আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। সেই আলোয় সন্দীপ স্পষ্ট দেখতে পেল বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এক অতিকায় কুমির! লেজটা মাঝে মাঝে সে এপাশে ওপাশে নাড়াচ্ছে। কাঠের মেঝেয় লেজের ঘষটানিতে খসখস শব্দ হচ্ছে। সন্দীপ দেখতে লাগল। কুমিরটা একবার বারান্দা দিয়ে সন্দীপের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে প্রফেসরের ঘরের দিকে, পরক্ষণেই আবার ফিরে আসছে। ঠিক যেন বারান্দায় পায়চারি করছে কুমিরটা।
একসময় কুমিরটা এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সন্দীপের জানলার একটু দূরে। তারপর সে একটা বিরাট বড় হাঁ করল। সন্দীপ চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল, তার ভয়ংকর মুখগহ্বর। চোয়ালে সাজানো সারি সারি দাঁত! সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কও পেয়ে বসল সন্দীপকে। তার মনে হল, কয়েক হাত দূরে ওই ভয়ংকর চোয়াল যেন তারই অপেক্ষায় রয়েছে। কুমিরটা যদি এখন ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে তাহলে কী হবে? এই ঘুণধরা কাঠের পাটাতনের দেওয়াল কি আটকাতে পারবে তাকে! রিভলভারটা শক্ত করে মুঠোর মধ্যে চেপে ধরল সন্দীপ। কুমিরটা বাইরে একইভাবে হাঁ করে আছে। ওকে আটকাতে হবে। নিশ্চয়ই ও সন্দীপের জন্যই খাঁড়ি থেকে ওপরে উঠে এসেছে। নইলে বারান্দায় কীসের প্রতীক্ষায় রয়েছে প্রাণীটা? সন্দীপ আস্তে আস্তে রিভলভার ধরা হাতটা উঠিয়ে আনল জানলার পাল্লার ফাঁকে। ঠিক সেই সময় খাঁড়ির পার থেকে একটা চিতল হরিণের ডাক শোনা গেল, ‘কাঁআক, কাঁক।’
ডাকটা শোনামাত্র কুমিরটা জানলার দিক থেকে ঘাড় তুলে খাঁড়ির দিকে তাকাল। যেন এই সময়ের অপেক্ষায় ছিল সন্দীপ। অপটু কাঁপা কাঁপা হাতে কুমিরটাকে লক্ষ্য করে সে চালিয়ে দিল গুলি। প্রচন্ড শব্দ আর ধোঁয়ায় ভরে গেল জানলার চারপাশ। গুলিটা প্রাণীটার গায়ে লাগল কিনা বুঝতে পারল না। গুলি চালানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীটা বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ল নীচের জমিতে। তারপর বিদ্যুৎগতিতে জমিটা পার হয়ে ঝাঁপ দিল খাঁড়ির জলে। চাঁদের আলোয় বেশ খানিকটা জল লাফিয়ে উঠল আকাশের দিকে।
জানলার পাল্লাটা তারপর জোরে বন্ধ করে দিল সন্দীপ। এবার বুকের ধুকপুকুনি একটু কমলে একটা মোম জ্বালিয়ে চৌকিতে বসল সে। বসে বসে ভাবতে লাগল প্রাণীটা যদি আবার ফিরে আসে তাহলে কী হবে? তার লেজের এক আঘাতেই তো ভেঙে পড়তে পারে পুরোনো দরজা-জানলা, কাঠের দেওয়াল। কালকের রাতটাও তো একাই কাটাতে হবে। হঠাৎ মনে মনে প্রফেসরের ওপর রাগ হল সন্দীপের। কেন তিনি এরকম ভয়ংকর জায়গায় তাকে একলা রেখে গেলেন? একটা রিভলভার দিয়ে সন্দীপ কি ঠেকাতে পারবে বাঘ বা কুমিরকে? কালকের দিন-রাত যদি ভালোয় ভালোয় কেটে যায়, তাহলে প্রফেসর ফিরে আসার পর সে তাকে লোকালয়ে পৌঁছে দিতে বলবে। কিন্তু কথাটা ভাববার পরই সন্দীপ আবার ভাবল প্রফেসর কতকিছু করেছেন তার জন্য। তার তুচ্ছ জীবনের অনেকটাই তো প্রফেসরের দান। এ কী ভাবছে সে! তার জন্য একটু কষ্ট স্বীকার করতে পারবে না সন্দীপ! এ তো তার কর্তব্য। তার যত কষ্টই হোক, প্রফেসরের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফিরে যাওয়ার কথা মুখে আনবে না সে। বাকি রাতটা চৌকিতে বসে এসব কথা ভাবতে ভাবতে কাটিয়ে দিল সন্দীপ। এক সময় খাঁড়ির পার থেকে বুনো মোরগের ডাক ভেসে এল। তারপর ধীরে ধীরে দেওয়ালের মাথার ওপর ফোকর গলে আলো আসতে শুরু করল। আবার জেগে উঠতে শুরু করেছে বাইরের পৃথিবী। তা দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে রিভলভারটা নিয়ে শুয়ে পড়ল সন্দীপ।
(৬)
সন্দীপের যখন ঘুম ভাঙল সূর্য তখন প্রায় মাথার ওপর উঠে গিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে রাতের ঘটনার কথা চিন্তা করল সে। ঘটনাটা সত্যি না দুঃস্বপ্ন। ছ-ঘরা রিভলভারটা পাশ থেকে তুলে নিয়ে সেটা খুলে ফেলল। তার একটা ঘর শূন্য। এরপরেই জানলার ঠিক নীচে গুলি চালাবার পর ছিটকে পড়া ফাঁকা কার্তুজের খোলটা চোখে পড়ল। ঘটনাটা স্বপ্ন নয় তা হলে! রিভলভারটা ঠিক করে নিয়ে সন্দীপ এর পর উঠে গিয়ে দাঁড়াল জানলার ধারে। তারপর জানলাটা খুলল সে। ফাঁকা বারান্দা, সেই শূকরের দলটা আবার খাঁড়ির পারে এসেছে মাটি খুঁড়তে। কালকের সেই প্রাণীটা তা হলে কাছাকাছি কোথাও নেই। রিভলভারটা কোমরে গুঁজে নিল সে। জিনিসটাকে সবসময় কাছেই রাখতে হবে। ঘরের দরজাটা খুলল সন্দীপ। তারপর বারান্দায় জল নিয়ে বেরিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর সে খাঁড়ির দিকের বারান্দায় দাঁড়াবার পর শূকরের পালের দাঁতাল দলপতি বাতাসে সন্দীপের বিজাতীয় গন্ধ টের পেল। সে ঘাড় উঠিয়ে একবার বারান্দার দিকে তাকাল। তারপর হয়তো ভয়ের কিছু নেই বুঝতে পেরে আবার মাটি খুঁড়তে লাগল। সন্দীপ তাকাল বারান্দার কাঠের মেঝের দিকে। মেঝেয় লম্বা লম্বা দাগ। কাল রাতে কুমিরটার চলে ফিরে বেড়ানোর স্পষ্ট চিহ্ন আঁকা হয়ে রয়েছে। হঠাৎ এক জায়গায় মেঝের ওপর কালচে রঙের কয়েক ফোঁটা কী যেন পড়ে রয়েছে দেখতে পেল সন্দীপ। জায়গাটার কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে মেঝের ওপর পড়ে থাকা ফোঁটাগুলোকে দেখল সে। তার মনে হল, ওগুলো যেন জমাট বাঁধা রক্তের ফোঁটা। তবে একেবারে নিশ্চিত হতে পারল না এ ব্যাপারে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে লাগল, এটা কি কুমিরের রক্ত? এখান দিয়েই তো লাফ দিয়ে নীচে নেমে পালিয়েছিল প্রাণীটা। তবে কি গুলিটা লেগেছিল কুমিরটার গায়ে? একবার ভাবল, নীচে নেমে দেখে আসবে জমিতে এরকম কোনো ফোঁটা পড়ে আছে কি না! কিন্তু সাহসে কুলোল না তার। সে হাঁটতে শুরু করল প্রফেসরের ল্যাবরেটরির দিকে। ল্যাবরেটরির দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। প্রফেসরের দরজার সামনের মেঝেতেও লম্বা লম্বা স্পষ্ট দাগ। তার আরও একবার ল্যাবরেটরির ভিতরটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে হল। দরজার পাল্লা দুটো ভালো করে খুলল সে। আলো ঢুকল ঘরের ভেতর। কিন্তু এ কী! ঘরের মেঝেতেও তো আঁকা রয়েছে সেই দাগগুলো! তা হলে কুমিরটা ঘরে ঢুকেছিল নাকি! রিভলভারটা কোমর থেকে বের করে হাতে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকল সন্দীপ। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল ঘরের ভিতর। হাঁটতে হাঁটতে একসময় সেই অ্যাকোয়ারিয়ামের কাছে হাজির হল সে। অ্যাকোয়ারিয়ামের দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সন্দীপ। আরে, কালকের সেই কুমিরের বাচ্চাটা গেল কোথায়? বদলে তার মধ্যে রাখা আছে একটা একই মাপের নিরীহ তারখেল। সে চোখ পিটপিট করছে তাকে দেখে। তা হলে কি গতকাল ভুল দেখেছিল সে? হতে পারে। হয়তো এখানে এসে বেশ কয়েকবার কুমির দেখার জন্যে তার হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে। নইলে কুমিরের বাচ্চা তো আর তারখেল হয়ে যেতে পারে না! কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়াবার পর সন্দীপ আবার ফিরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ পড়ল সেই খাতাটার ওপর। একই জায়গায় রাখা আছে খাতাটা। তার মনে পড়ে গেল প্রফেসরের লেখাগুলোর কথা। প্রফেসর কী বলতে চেয়েছেন ওই লেখাগুলোর মধ্যে দিয়ে? ভাবতে ভাবতে সন্দীপ গিয়ে দাঁড়াল ভাঁড়ার ঘরের দরজার সামনে। এই ঘরটা কাল তার দেখা হয়নি। ঘরের দরজার পাল্লা দুটো বন্ধ করা আছে। সন্দীপ টেনে খুলে ফেলল পাল্লাটা। ঘরটা খুব বড় নয়, মাঝারি ধরনের। এর ওপাশের ঘরটাই সন্দীপের। ঘরের এক পাশে দেওয়ালের কাছে মুখ বাঁধা কিছু বস্তা রাখা আছে। আর এক পাশে মেঝের উপর রাখা আছে কিছু শিশি বোতল। আর রয়েছে একটা লম্বা টেবিল। তার উপর কিছু নেই। ঘরটা একবার ভালো করে দেখার পর সে ঘরের দরজাটা আগের মতো বন্ধ করে দিয়ে পা বাড়াল ল্যাবরেটরির বাইরে যাওয়ার জন্য। দু-পাশে টেবিলের সারি, কয়েক পা হাঁটার পরই হঠাৎ যেন সন্দীপের একটা পা মেঝের মধ্যে ঢুকে গেল। পড়েই যাচ্ছিল সে, কিন্তু একটা টেবিলের পায়া ধরে কোনোরকমে সামলে নিল নিজেকে। পা-টা টেনে মেঝে থেকে বের করে আনল। প্রথম সে ভাবল, কাঠের পচা পাটাতন ভেঙে বোধহয় পা ঢুকে গিয়েছে তার। ভালো করে তাকাল জায়গাটার দিকে। আর তারপরেই মনে হল, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। মেঝেতে যেন একটা ছিদ্র আছে, আর কয়েকটি আলগা কাঠের পাটাতন দিয়ে সেটা ঢাকা দেওয়া। কোনোভাবে তারই একটা পাটাতন সরে যাওয়ার ফলে পা ঢুকে গিয়েছিল সন্দীপের। জায়গাটায় বসে পড়ল। তারপর আলগা কাঠগুলো সরিয়ে ফেলতেই বেরিয়ে পড়ল একটা গোল ফোকর। অনায়াসে একটা মানুষ গলে যেতে পারে। সন্দীপ সেই ফোকর দিয়ে নীচে তাকাতেই আরও একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল। সেখান থেকেও একটা ঢালু পাটাতন নেমে গিয়েছে মাটির দিকে। অর্থাৎ ল্যাবরেটরি থেকে বাইরে আসা-যাওয়ার এটা একটা রাস্তা! সন্দীপ এরপর কাঠের পাটাতনগুলো যথাস্থানে সাজিয়ে রেখে, ল্যাবরেটরি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। খাঁড়ির দিকে তাকাল সন্দীপ। সেই শূকরের দলটা কখন যেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। খাঁড়ির পাড় নিঝুম, কোনো জীবন্ত প্রাণীর চিহ্ন নেই সেখানে। কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ চারপাশে। সন্দীপ অনেকক্ষণ ঘরের বাইরে রয়েছে। সে আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত বলে মনে করল না। পা বাড়াল নিজের ঘরে ফেরার জন্য।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চৌকিতে শুয়ে পড়ল সন্দীপ। শোওয়ার পর কয়েকটা প্রশ্ন ঘিরে ধরল তাকে। নিচ থেকে বাড়ির ওপরে ওঠার জন্য সিঁড়ির বদলে ঢালু পাটাতনের ব্যবহার কেন? প্রফেসরের নোটবুকে লেখা কথাগুলোর কী অর্থ? প্রফেসর হঠাৎ কথামালার গল্পের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন কেন? বিজ্ঞানের স্বার্থে সন্দীপের নিজেকে কতখানি উৎসর্গ করতে হবে? প্রফেসরের লেখাগুলোর মধ্যে কীসের যেন একটা ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে, যেটা ধরেও ধরতে পারছে না সে! প্রশ্নগুলো নিয়ে চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
তার ঘুম ভাঙল শেষ বিকেলে। শুয়ে শুয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল, বাইরে সন্ধে নামতে চলেছে। জানলাটা বন্ধ করে দিতে হবে এবার। আরও একটা রাত আসছে। কুমিরটা যদি আজ রাতেও আবার ফিরে আসে? উঠে বসল সন্দীপ। মনে সাহস রাখতে হবে। জানলাটা বন্ধ করার জন্য চৌকি ছেড়ে নীচে নামতে গেল। ঠিক সেই সময় শুনতে পেল, তার নাম ধরে কে যেন ডাকছে! কান খাড়া করল সন্দীপ। হ্যাঁ, এ তো প্রফেসরের গলা। তিনি আজই ফিরে এসেছেন তা হলে! চৌকি থেকে নেমে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। দেখতে পেল প্রফেসর নীচের জমিটায় দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁকে দেখতে পেয়েই মুহূর্তের মধ্যে সব আতঙ্ক মুছে গেল সন্দীপের মন থেকে। সে ছুটে নীচে নেমে গিয়ে দাঁড়াল প্রফেসরের সামনে। প্রফেসরের পোশাক ধুলো-কাদা, মাথার চুল উশকোখুশকো, চোখে-মুখে পরিশ্রমের আর ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সন্দীপ তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কাজ হয়েছে প্রফেসর?’
প্রফেসর মুখে কোনো উত্তর দিলেন না, শুধু আঙুল তুলে দেখালেন পাশে নামিয়ে রাখা খাঁচাটার দিকে। খাঁচাটার ওপর একটা চটের কাপড় জড়ানো আছে। প্রফেসরের কথা শুনে সন্দীপ খাঁচাটার উপর ঝুঁকে পড়ে চটের কাপড়টা একটু সরাল। দেখতে পেল তার ভিতর গুটিসুটি মেরে বসে আছে বিড়ালের চেয়ে একটু বড় একটা প্রাণী, বাঘের বাচ্চা! সন্দীপ তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাঘিনীটাকে কী সত্যিই মেরে ফেললেন আপনি?’
প্রফেসর নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও জবাব দিলেন, ‘না মারতে পারিনি, গুলি খেয়ে পালিয়ে গিয়েছে আহত প্রাণীটা।’
সন্দীপ প্রফেসরকে বলল, ‘জানেন, কাল রাতে একটা কুমির খাঁড়ি থেকে বারান্দায় উঠে এসেছিল। আমি গুলি করে তাড়িয়েছি প্রাণীটাকে।’
সন্দীপের মনে হল, তার কথা শুনে হঠাৎ যেন জ্বলে উঠল প্রফেসরের চোখ। তিনি সন্দীপকে কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন নিজেকে নিমেষে সংযত করে নিলেন। এরপর তিনি একটু রুক্ষ স্বরে বললেন, ‘আমার উপর দিয়ে ধকল গিয়েছে। খাঁচাটা নিয়ে ওপরে চলো।’ সন্দীপ খাঁচাটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে ওপরে যাওয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করল, তার সঙ্গে সঙ্গে প্রফেসরও। সন্দীপের মনে হল, প্রফেসর যেন একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। কাঠের পাটাতন বেয়ে উপরে ওঠার সময় ‘উঃ’ করে একটা যন্ত্রণাসূচক শব্দ যেন বের হল তাঁর মুখ থেকে। ওপরে ওঠার পর প্রফেসর সন্দীপকে বললেন, ‘খাঁচাটা তোমার ঘরেই থাকবে। একে অন্য ঘরে রাখার মতো পরিবেশ নেই।’ তারপর তিনি বললেন, ‘রিভলভারটা এবার আমায় দাও। আমি এসে গিয়েছি, ওটা আর এখন তোমার দরকার হবে না।’
রিভলভারটা চৌকির উপর রেখেই ঘর থেকে প্রফেসরের ডাক শুনে বাইরে বেরিয়েছিল সে। প্রফেসরের কথা শুনে সন্দীপ ঘরে ঢুকে খাঁচাটা মেঝের ওপর নামিয়ে রাখল। তারপর রিভালভারটা চৌকি থেকে তুলে নিয়ে ঘরের বাইরে এসে প্রফেসরের হাতে দিল। জিনিসটা তিনি হাতে নেওয়ার পর সন্দীপকে বললেন, ‘ভালো করে দরজা-জানলা বন্ধ করে দাও, আর খাঁচার ওপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিয়ো। অনেকক্ষণ ঢাকা আছে প্রাণীটা।’ এই বলে প্রফেসর সন্দীপের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ালেন নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য। ঠিক তখনই সন্দীপের চোখে পড়ল প্রফেসরের শরীরের পিছনের অংশে পায়ের ওপরের কিছুটা রক্তে ভিজে আছে। তা হলে কী কোনোভাবে আহত হয়েছেন প্রফেসর? কিন্তু কী ভাবে? প্রফেসর এগিয়ে গেলেন বারান্দা ধরে আর সন্দীপ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
দরজা বন্ধ করার পর সে প্রথমে টেবিলের কাছে গিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালাল, তারপর জানলাটা বন্ধ করে খাঁচাটাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরের এক কোনায় রাখল। চটের আবরণটা খাঁচার ওপর থেকে সরিয়ে নিল সন্দীপ। প্রাণীটা তাকাল তার দিকে। তার চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। কী সুন্দর দেখতে বাচ্চাটাকে। সন্দীপের একবার ইচ্ছে হল, খাঁচার ফাঁকে হাত দিয়ে প্রাণীটাকে ছোঁয়। কিন্তু তার সাহসে কুলোল না। বাচ্চা হলেও সে বাঘের বাচ্চা তো! এই প্রাণীটাই বড় হলে শাসন করবে সারা জঙ্গল। সন্দীপ খাঁচাটার কাছ থেকে সরে এসে চৌকির ওপর বসল, তারপর তাকিয়ে রইল বাচ্চাটার দিকে।
রাত আটটা নাগাদ প্রফেসরের ডাক শুনে দরজা খুলল সন্দীপ। ঘরে ঢুকলেন প্রফেসর। পোশাক পালটে এসেছেন তিনি। সন্দীপ দেখল প্রফেসরের ডান হাতে ধরা আছে অদ্ভুত দেখতে একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। সন্দীপের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘কী ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?’
সন্দীপ উত্তর দিল, ‘না ঘুমোইনি।’
প্রফেসর তাকালেন খাঁচাটার দিকে। সন্দীপ দেখল, বাচ্চাটা থরথর করে কাঁপছে। সে একটু ইতস্তত করে প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি বাচ্চাটাকে ইঞ্জেকশন দেবেন?’
প্রফেসর বাচ্চাটাকে দেখতে দেখতে উত্তর দিলেন, ‘না, ওর শরীর থেকে একটু রক্ত নেব।’
সন্দীপ অবাক হয়ে বলল, ‘ওইটুকু প্রাণীর শরীর থেকে রক্ত নেবেন!’
প্রফেসর শান্ত গলায় উত্তর দিলেন, ‘ওতে ওর কোনো ক্ষতি হবে না।’
কথাগুলো বলার পর প্রফেসর তাঁর হাতের সিরিঞ্জটা আলোর দিকে ধরে কী যেন দেখলেন। সিরিঞ্জের পেটটা গোল বাটির মতো। তার অর্ধেক কী একটা হলুদ রঙের তরলে ভর্তি। প্রফেসর খাঁচার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে বসলেন। বাচ্চাটার কাঁপুনি আরও বেড়ে গেল। প্রফেসর বাঁ হাতে খাঁচার দরজাটা খুলে বাচ্চাটার ঘাড় ধরে বের করে আনলেন। তারপর ডান হাত দিয়ে তার পিঠের কাছে সুচটা বিঁধিয়ে রক্ত টেনে নিলেন। বাচ্চাটাকে এরপর আবার খাঁচার ভিতরে পুরে তার দরজা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। এত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে প্রফেসর কাজটা করলেন, তাতে তার এক মিনিটের বেশি সময় লাগল না। রক্তটা সিরিঞ্জের তরলের সঙ্গে মিশে একটা অদ্ভুত নীল রং হয়ে গেল। প্রফেসর এবার সন্দীপের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার আমি যাই। সারারাত ল্যাবরেটরিতে জেগে আমাকে কাজ করতে হবে।’ প্রফেসর পা বাড়ালেন দরজার দিকে।
সন্দীপের আবার চোখ পড়ল প্রফেসরের শরীরের পিছনের সেই জায়গায়। সে দেখতে পেল, প্রফেসরের নতুন পোশাকও রক্তে ভিজে উঠতে শুরু করেছে। তা দেখে সন্দীপ বলল, ‘আপনি কি আহত স্যার? আপনার পোশাকে রক্ত কেন?’
তার কথা শুনে প্রফেসর যেন একটু চমকে উঠে ফিরে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘ও কিছু না, জঙ্গলে পড়ে গিয়ে সামান্য একটু আহত হয়েছি আমি। ও ঠিক হয়ে যাবে।’ এই বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
প্রফেসর চলে যাওয়ার পর সামান্য কিছু খাবার আর জল খেয়ে শুয়ে পড়েছিল সন্দীপ। মাঝরাতে সেদিনও কীসের শব্দে যেন ঘুম ভেঙে গেল তার। কোথায় যেন একটা শব্দ হচ্ছে। শব্দটা শুনেই বিছানার ওপর উঠে বসল সন্দীপ। সেই কুমিরটা আবার ফিরে আসেনি তো! কান খাড়া করে সন্দীপ বোঝার চেষ্টা করল শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে। হঠাৎ সে লক্ষ করল অন্ধকার ঘরের কাঠের মেঝের ওপর কোথা থেকে যেন হালকা আলো এসে পড়ে একটা বৃত্ত রচনা করেছে। কোথা থেকে আসছে আলোটা? কয়েক মুহূর্ত পর সে বুঝতে পারল, আলোর রেখাটা আসছে তার ঘর আর ভাঁড়ার ঘরের মাঝে যে কাঠের দেওয়াল আছে, তার একটা ছিদ্র দিয়ে। তার মানে ওপাশের ঘরে বাতি জ্বলছে। এরপর সে বুঝতে পারল, শব্দটাও আসছে ও ঘর থেকেই। এত রাতে ও ঘরে কী করছেন প্রফেসর! কৌতূহল নিয়ে সন্দীপ চৌকি ছেড়ে নেমে ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়াল দেওয়ালের কাছে, তারপর সন্তর্পণে চোখ রাখল সেই ছিদ্রে। সন্দীপের চোখের সামনে ফুটে উঠল পাশের ঘরের বৃত্তাকার একটা ছবি। সে দেখতে পেল, ও ঘরের সেই টেবিলের উপর একটা মোম জ্বলছে। তিনি টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একটা খুব সরু, লম্বা ছুরি মোমের শিখায় গরম করছেন। ওই ছুরি দিয়ে তিনি কী করবেন? সন্দীপ দেখতে লাগল দৃশ্যটা। কিছুক্ষণ পর ছুরিটা গরম হয়ে গেলে প্রফেসর পিছন ফিরে দাঁড়ালেন। সন্দীপের স্পষ্ট চোখে পড়ল, প্রফেসরের থাইয়ের পিছনের অংশে একটা গোল ক্ষতচিহ্ন। এরপর প্রফেসর একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলেন, যা দেখে দেওয়ালের এপাশে দাঁড়িয়ে শিউরে উঠল সন্দীপ। প্রফেসর ছুরির গরম ফলাটা বিঁধিয়ে দিলেন তাঁর ক্ষতস্থানের মধ্যে। তারপর চাড় দিতে শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতস্থান থেকে পা বেয়ে বইতে শুরু করল রক্তের স্রোত। যন্ত্রণায় বেঁকে যেতে লাগল প্রফেসরের মুখ। সন্দীপ আর দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছিল না। সে ভাবল চোখটা সরিয়ে নেবে। ঠিক সেই সময় ক্ষতস্থান থেকে কী একটা ছোট্ট জিনিস যেন ছিটকে বেরিয়ে ঠক করে কাঠের মেঝেয় পড়ল। মেঝেটা সন্দীপ দেখতে পাচ্ছে না, তাই প্রথমে সে বুঝতে পারল না জিনিসটা কী! প্রফেসর ছুরিটা ক্ষতস্থান থেকে বের করে, ঝুঁকে পড়ে মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেন সেই ছোট্ট জিনিসটা। সেটা ভালো করে দেখার জন্য আলোর কাছে আনলেন। সন্দীপ স্পষ্ট দেখতে পেল, প্রফেসরের দু-আঙুলের মধ্যে ধরা আছে রিভলভারের ছোট্ট একটা বুলেট! সেটা নেড়েচেড়ে দেখার পর প্রফেসর ফুঁ দিয়ে মোমটা নিবিয়ে দিলেন। সন্দীপের চোখের সামনে মুছে গেল সব কিছু। তা হলে তিনি পড়ে গিয়ে আহত হননি, গুলিতে আহত হয়েছেন! সন্দীপকে মিথ্যে বলেছেন তিনি। কিন্তু কে গুলি করল তাঁকে? বনরক্ষীরা, না তাঁর কোনো শত্রু? এসব ভাবতে ভাবতে বিছানায় শুয়ে পড়ল সন্দীপ।
(৭)
শেষরাতের দিকে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল সন্দীপ। এক গহিন খাঁড়ি দিয়ে সে একলা নৌকো বেয়ে চলেছে। অন্ধকার নেমে আসছে চারপাশে। একসময় সে হাজির হল সেই জায়গায়। সে দেখতে পেল বাজপড়া সেই শিমুল গাছের নীচে প্রফেসর দাঁড়িয়ে আছেন। প্রফেসর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি একা কোথায় যাচ্ছ সন্দীপ?’
সে উত্তর দিল, ‘ফিরে যাচ্ছি।’
প্রফেসর হেঁকে বললেন, ‘আমার কাজ শেষ না হতেই চলে যাচ্ছ তুমি! কিন্তু তোমার নৌকো তো ফুটো হয়ে গিয়েছে। তুমি যাবে কী করে? এখানে আমার নৌকো রাখা আছে, তুমি নিয়ে যাও।’
তার কথা শুনে সন্দীপ দেখতে পেল সত্যিই তার নৌকো ফুটো হয়ে গিয়েছে। সে তাড়াতাড়ি নদীর চরে নৌকো ভিড়িয়ে দিল। ঠিক সেই সময় ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল কয়েক মুহূর্ত চারপাশে কিছু দেখতে পেল না। তারপর আকাশে চাঁদ উঠল, সন্দীপ দেখল, খাঁড়ির চরে প্রফেসরের নৌকোটা রাখা আছে। কিন্তু প্রফেসর কোথাও নেই। সে চারপাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগল তাকে। হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে এল বাঘের ডাক। আর অপেক্ষা না করে সে চেপে বসল প্রফেসরের নৌকোয়। চলতে শুরু করল নৌকো। খাঁড়ি বেয়ে বড় গাঙে গিয়ে পড়ল। তারপর চাঁদের আলোয় উল্কার গতিতে ছুটতে শুরু করল নৌকোটা। সে কিছুতেই আর গতি কমাতে পারছে না নৌকোটার। কোথায় চলেছে সে? ভয় পেয়ে গেল। হঠাৎ সে আবার দেখতে পেল প্রফেসরকে। নদীর চরে দাঁড়িয়ে তিনি হাসছেন। সন্দীপ তাকে নৌকো থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘প্রফেসর, আপনার নৌকো আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’
প্রফেসরও চেঁচিয়ে জবাব দিলেন, ‘ও তোমাকে নিয়ে যাচ্ছে মোহনার দিকে। ওখানেই ওর বাসা।’
তার কথা শুনে সন্দীপ চমকে উঠে তাকাল নৌকোটার দিকে। আরে নৌকো কোথায়! সন্দীপ চেপে বসে আছে বিরাট বড় এক কুমিরের পিঠে! আতঙ্কে সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘প্রফেসর, আমাকে বাঁচান! এ যে একটা কুমির!’
তার কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠলেন প্রফেসর। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কুমিরটা সন্দীপকে পিঠে নিয়ে ডুব দিল জলে। স্বপ্নে এই পর্যন্ত দেখে আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেল সন্দীপের। বিছানায় উঠে বসল। একেবারে ঘেমে গিয়েছে। সে বুঝতে পারল সকাল হয়ে গিয়েছে।
কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে বাইরে এল সন্দীপ। কিন্তু বাইরে আলো এত কম কেন! হাতের ঘড়িতে দেখল, সাড়ে সাতটা বাজে। তাহলে? কয়েক মুহূর্ত পর সন্দীপ বুঝতে পারল আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে। ঠান্ডা বাতাসও গায়ে লাগছে। সে কোথাও প্রফেসরকে দেখতে পেল না। তাই ঘুরে গিয়ে দাঁড়াল খাঁড়ির দিকের বারান্দায়। এবার সে দেখতে পেল প্রফেসরকে। খাঁড়ির কাছে এক জায়গায় মাটির দিকে তাকিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখছেন তিনি। তার এক হাতে ঝুলছে ছোট্ট একটা প্রাণী। মনে হয় সেটা মারা গিয়েছে। তার মাথাটা মাটির দিকে ঝুলছে। কয়েক মুহূর্ত পর তিনি একবার তাকালেন বারান্দার দিকে। সন্দীপকে দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে কাছে ডাকলেন। তারপর আবার তাকালেন মাটির দিকে। বারান্দা থেকে পাটাতন বেয়ে নীচে নামল সন্দীপ। তারপর ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়াল প্রফেসরের কাছে। তার সারা শরীর জলে ভেজা। তার হাতে ঝুলছে সদ্য মৃত ছোট্ট হরিণের বাচ্চা। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত চুইয়ে পড়ছে তার শরীর থেকে। সন্দীপ তার কাছে গিয়ে দাঁড়াবার পর প্রফেসর মুখ না তুলে আঙুল দিয়ে সামনের মাটির ওপর দেখালেন। সেদিকে তাকিয়ে সন্দীপ বলল, ‘এ তো বাঘের পায়ের ছাপ!’
সেদিকেই চোখ রেখে তিনি চিন্তিতভাবে বললেন, ‘বাঘ নয়, বাঘিনীর। যার বাচ্চা রয়েছে তোমার ঘরে। কাল আমাকে ও আড়াল থেকে অনুসরণ করে চলে এসেছে এখানে। কাল সারারাত ও ঘুরে বেড়িয়েছে বাড়ির চারপাশে। মনে হয় ও বুঝতে পেরেছে বাচ্চাটা এখানেই আছে।’ এরপর একটু হেসে তিনি বললেন, ‘একে আহত বাঘিনী। তার ওপর বাচ্চাকে খুঁজছে। এই মুহূর্তে ওর চেয়ে ভয়ংকর প্রাণী গোটা সুন্দরবনে নেই।’
এই বলে প্রফেসর মুখ তুলে তাকালেন সন্দীপের দিকে। সন্দীপ দেখতে পেল তাঁর মুখ আর চিবুকে কাঁচা রক্ত লেগে আছে। তা দেখে সন্দীপ বলল, ‘এ কী! আপনার মুখে রক্ত কেন?’
তার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রফেসর তার জামার হাতা দিয়ে ঘষে রক্তটা মুছে ফেলে বললেন, ‘ও, ওই হরিণের বাচ্চাটার রক্ত কোনোভাবে মুখে লেগে গিয়েছে আর কি! তোমার ঘরে যে বাচ্চাটা আছে সে তো নরম মাংস ছাড়া কিছু খেতে পারবে না, তাই এই বাচ্চাটাকে মারতে হল।’ সন্দীপ তার কথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে বলল, ‘ও! কীভাবে মারলেন বাচ্চাটাকে?’ প্রফেসর তার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। আর তখনই বাজের প্রচণ্ড গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে দুজনেই দৌড়লেন বারান্দায় ওঠার জন্য।
বারান্দায় ওঠার পর সন্দীপ নিজের ঘরে ফিরে এল, আর প্রফেসর চলে গেলেন তার নিজের ঘরের দিকে। আধ ঘণ্টা পরে প্রফেসর এসে ধাক্কা দিলেন সন্দীপের ঘরের দরজায়। দরজা খোলার পর প্রফেসর ঘরে ঢুকলেন। তার এক হাতে পাতায় মোড়া কী একটা জিনিস, আর অন্য হাতে কয়েক টুকরো কাঁচা মাংস। পাতা জড়ানো জিনিসটা তিনি সন্দীপের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এর মধ্যে কিছু খেজুর আছে, তোমার জন্য আনলাম।’ তারপর তিনি মাংসের টুকরোগুলো নিয়ে এগিয়ে গেলেন খাঁচাটার দিকে। সন্দীপ দেখল প্রফেসরকে দেখেই বাচ্চাটা আবার কাঁপতে শুরু করেছে। খাঁচার সামনে বসতে বসতে প্রফেসর সন্দীপকে বললেন, ‘তুমি এর বৈজ্ঞানিক নাম জান?’
সন্দীপ বিজ্ঞানের ছাত্র না হলেও সে জানে, বলল, ‘প্যানথেরা টাইগ্রিস।’
প্রফেসর বললেন, ‘বাঃ’। খাঁচার দরজা খুলে মাংসের টুকরোগুলো তার ভেতর ঢুকিয়ে দরজা আবার বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সন্দীপের দিকে ফিরে বললেন, ‘এখন আমি আমার ল্যাবরেটরিতে গিয়ে ঢুকব। রাতে আমি আসব তোমার ঘরে। তোমাকে আমি আমার গবেষণার ব্যাপারে কিছু কথা বলব, যা আমি ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি জানে না। তারপর তোমাকে নিয়ে আজ থেকে আমার শেষ কাজ শুরু করব।’
সন্দীপ প্রফেসরের কথা শুনে বলল, ‘আচ্ছা।’
এরপর প্রফেসর খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজ পূর্ণিমার জোয়ার, তারপর যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাতে জোয়ারের জল শেষে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে না যায়।’ প্রফেসরের কথা শুনে সন্দীপের হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই কুমিরটার কথা। কারণ, প্রফেসরের মুখ থেকেই সন্দীপ শুনেছে যে, জোয়ারের জলের সঙ্গে কুমির ভেসে আসে দ্বীপে। আর তখন নাকি তারা বাঘকেও জলে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। তাই সে প্রফেসরের কথা শুনে বলল, ‘জোয়ারের জলের সঙ্গে সেই কুমিরটাও যদি চলে আসে তাহলে কী হবে?’
সন্দীপের প্রশ্ন শুনে তার চোখের দিকে তাকালেন প্রফেসর। তারপর শান্ত গলায় বললেন, ‘তোমার কোনো ভয় নেই। সে যদি তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করত তাহলে অনেক আগেই করতে পারত।’
এই অদ্ভুত কথা বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর। তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর দরজা বন্ধ করে জানলা খুলে দাঁড়াল সন্দীপ। খাঁড়িটা বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। প্রচণ্ড বাতাসে জলের ছাট বারান্দা টপকে তার মুখে এসে লাগছে। জানলাটা বন্ধ করে চৌকিতে শুয়ে পড়ল।
বাইরে অঝোরধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। তার সঙ্গে কান ফাটানো মেঘের গর্জন। ক্রমেই যেন বেড়ে চলেছে বৃষ্টি। মনে হচ্ছে, বৃষ্টি যেন এই জল-জঙ্গল বিশ্বচরাচর সব কিছুকে ধুয়ে মুছে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। চৌকিতে শুয়ে সন্দীপ ভাবতে লাগল, ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রফেসর যে কথাটা বলে গেলেন সেই নিয়ে। কুমিরটা যে ইচ্ছে করেই সন্দীপের ক্ষতি করেনি তা তিনি জানলেন কী করে? কুমিরটা যেভাবে বারান্দায় ঘুরে বেড়িয়েছে, এমনকী প্রফেসরের ল্যাবরেটরিতে ঢুকেছে তা চিন্তা করে আর প্রফেসরের কথা শুনে সন্দীপের মনে হতে লাগল ওই কুমিরটার সঙ্গে প্রফেসরের কোনো সম্পর্ক আছে। তাহলে কি কুমিরটা প্রফেসরের পোষা? নইলে বাঘের সম্পর্কে প্রফেসর সন্দীপকে সাবধান করলেও কুমিরের ব্যাপারে সাবধান করেননি কেন! ব্যাপারটার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো গন্ডগোল আছে। এরপরই সন্দীপের মনে প্রশ্ন উঁকি মারল প্রফেসরের গবেষণা নিয়ে। সে বিষয়ে এ ক-দিনের মধ্যে একবারও মুখ খুললেন না তিনি। বিশেষত এ ব্যাপারেই যখন তিনি সন্দীপকে এখানে ডেকে এনেছেন। তাহলে কি সন্দীপের কাছ থেকে কিছু গোপন করতে চাইছেন তিনি! সন্দীপের মনে পড়ে গেল প্রফেসরের নোটবুকে লেখাগুলোর কথা। কী তাৎপর্য ওই লেখাগুলোর? মুনি আর ইঁদুরের গল্পের উল্লেখ করলেন কেন প্রফেসর। বহু প্রচলিত ওই গল্পটা সকলের মতো সন্দীপও পড়েছে। তার বিষয়বস্তুর সংক্ষেপ হল এক মুনি ছোট্ট একটা ইঁদুরকে রূপান্তরিত করেছিলেন বাঘে। তারপর আবার তাকে রূপান্তরিত করেছিলেন ইঁদুরে। প্রফেসর কেন নোটবুকের পাতায় ওই মুনিকে বিজ্ঞানী বলে মন্তব্য করেছেন। ওই গল্পের সঙ্গে প্রফেসরের গবেষণার কী সম্পর্ক আছে? তাহলে কি ধরে নিতে হবে ওই মুনির মতো প্রফেসরও পারেন…।
আর ভাবতে পারল না সন্দীপ। তার মাথার ভেতরটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কান-মাথা গরম হয়ে উঠতে লাগল তার। বিছানা থেকে উঠে জল নিয়ে মাথায় জলের ছিটে দিল। তারপর আবার চৌকিতে শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগল।
ঘুম কিন্তু এল না তার। আবার সেই প্রশ্নগুলো তার মাথায় ভিড় করতে লাগল। এক সময় সন্দীপ বুঝতে পারল, প্রশ্নগুলো আর কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। তখন সে প্রশ্নগুলোর উত্তর ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করতে লাগল। সে এখানে আসার পর যেসব ঘটনা দেখেছে বা শুনেছে, সেগুলো পরপর সাজিয়ে নিয়ে সন্দীপ তার বিশ্লেষণ করতে শুরু করল। বাইরে তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে শুরু করেছে। কিন্তু বৃষ্টির কোনো বিরাম নেই। ঘন্টা তিনেক ভাববার পর একসময় সন্দীপের মাথার জট আস্তে আস্তে খুলে গেল। শেষ পর্যন্ত সন্দীপ যে সিদ্ধান্তে পৌঁছল তা অবিশ্বাস্য। বিছানার ওপর উঠে বসল সন্দীপ। তারপর শুরু হল এক নতুন চিন্তা। যদি কোনো নতুন বিপদ তার সামনে আসে, তাহলে সে কীভাবে মোকাবিলা করবে? সন্দীপ বুঝতে পারল, এখন তার একমাত্র কর্তব্য হল মাথা ঠান্ডা রাখা। সেই চেষ্টাই করতে লাগল সে।
সন্ধে নাগাদ শেষে বৃষ্টি নামল। অন্ধকার ঘরে একইভাবে বসে আছে সন্দীপ। সারাদিন কিছুই খায়নি। তার খিদেও অনুভব হচ্ছে না। বাইরে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর শুরু হল একটা গুমোট ভাব। অন্ধকার ঘরের কোনায় খাঁচার মধ্যে মাঝে মাঝে শুধু বাঘের বাচ্চাটার নড়াচড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে সেদিকে তাকিয়ে সন্দীপের মনে হল, তাদের দুজনের অবস্থাই এখন একরকম। পার্থক্য একটাই। সন্দীপের খাঁচাটা আকারে বড়। এক সময় ঘরের ভেতরে গুমোট ভাবটা এত বেড়ে গেল যে, আর বসে থাকতে পারল না সন্দীপ। চৌকি ছেড়ে উঠে গিয়ে সে জানলাটা খুলে পাল্লাটা একটু ফাঁক করল। সঙ্গে সঙ্গে একঝলক ভেজা ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগল। সে তাকাল বাইরের দিকে। আকাশে মেঘ কেটে গিয়েছে। প্রফেসর বলেছিলেন আজ পূর্ণিমা। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। তার আলোয় বাইরেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খাঁড়ি আর বাড়ির মাঝখানের জমিতে জল থইথই করছে। জোয়ারের জল খাঁড়ি ছাপিয়ে জমিতে ঢুকেছে। তার সঙ্গে মিশেছে বৃষ্টির জল। চাঁদের আলোয় সেই জল চিকচিক করছে। খাঁড়ির দিকের জমিটা বাড়ির অন্য দিকের জালে ঘেরা জমিটার তুলনায় অনেক নিচু। খাঁড়ির ওপারে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টি ভেজা অন্ধকার। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সন্দীপ। সারাদিন বদ্ধ ঘরের মধ্যে ছিল সে, ঠান্ডা বাতাসটা যেন তার মনপ্রাণ জুড়িয়ে দিল। দুশ্চিন্তাগুলোও যেন অনেকখানি মুছে গেল তার মন থেকে। এবার খিদে পেতে শুরু করল তার। ঘরের ভেতর আরও কয়েকটা ফল আছে। সন্দীপ ভাবল সেগুলো খেয়ে নেওয়া যাক। এই ভেবে সন্দীপ যখন জানলা বন্ধ করতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই সে চাঁদের আলোয় দেখতে পেল খাঁড়ির দিক থেকে জলে ভাসতে ভাসতে কী যেন একটা বাড়িটার দিকে এগিয়ে আসছে। সেই কুমিরটা নয় তো! বুকটা ধক করে উঠল সন্দীপের। হ্যাঁ, তার মনে হচ্ছে সেই কুমিরটাই। সন্দীপ সঙ্গে সঙ্গে জানলার পাল্লাটা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে খুব সামান্য ফাঁক করে রাখল। তারপর সেই ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। একসময় প্রাণীটা এসে হাজির হল বাড়িটার কাছে। তারপর সন্দীপের চোখের আড়ালে বারান্দার নীচে কয়েক মুহূর্তের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেল প্রাণীটা। সম্ভবত কাঠের পাটাতন বেয়ে সে বারান্দার দিকে উঠতে শুরু করেছে। হ্যাঁ, তার অনুমানই ঠিক। ভেজা কাঠের পাটাতনে তার শরীরের চাপে শব্দ হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর তাকে দেখতে পেল সন্দীপ। সন্দীপের হৃৎস্পন্দন যেন থেমে গেল। একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার এতক্ষণ ধরে ভাবলেও এতটা কল্পনা করেনি। সন্দীপের চোখের সামনে পাটাতন বেয়ে বুকে হেঁটে বারান্দায় উঠে এলেন প্রফেসর! তার শরীরে কোনো আচ্ছাদন নেই। জল ঝরছে গা দিয়ে। ওপরে উঠে আসার পর মুহূর্তের জন্য থামলেন তিনি। তারপর সাপের মতো সামনের দুহাতে ভর দিয়ে বুক উঁচু করে ঘাড় বাঁকিয়ে একবার চাঁদের দিকে তাকালেন। ঠিক যেন লক্ষ কোটি বছর আগের কোনো আদিম প্রাণী। তারপর বুকে হেঁটে তাড়াতাড়ি অদৃশ্য হয়ে গেলেন নিজের ঘরের দিকে।
প্রফেসর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ এক জায়গায় পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল সন্দীপ। তারপর জানলাটা কোনোরকমে বন্ধ করে চৌকিতে এসে বসল। তার কাছে কয়েকটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেল। কেন তাঁর হাত বরফের মতো ঠান্ডা, কেন তার শরীরে আঁশটে গন্ধ, কেন বাড়ির ওপরে ওঠার জন্য সিঁড়ির পরিবর্তে ঢালু পাটাতনের ব্যবস্থা। পরিষ্কার হয়ে গেল। কীভাবে প্রফেসর গুলিবিদ্ধ হলেন তাও বুঝতে পারল সন্দীপ। তার হাত-পা ক্রমে অবশ হয়ে আসতে লাগল। গলা শুকিয়ে গেল। এভাবে বসে থাকলে সে আর বাঁচবে না। চৌকি ছেড়ে উঠে সন্দীপ একটা মোমবাতি জ্বালাল। তারপর একটু জল খেয়ে যখন সে চৌকিতে বসতে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় দরজায় টোকা মারার শব্দ শুনতে পেল। প্রফেসর এসে গিয়েছেন। মনটা শক্ত করে দরজা খোলার জন্য এগিয়ে গেল সন্দীপ।
(৮)
দরজা খুলে ঘরের ভেতরে কয়েক পা পিছিয়ে এসে দাঁড়াল সন্দীপ। প্রফেসর তার গায়ের সেই আঁশটে গন্ধটা সঙ্গে নিয়ে পা রাখলেন ঘরের ভেতর। তার চুল থেকে জল ঝরছে এখনও। পরনে সেই খাকি পোশাক। তার এক হাতে তরল ভর্তি সেই ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ, আর অন্য হাতে ঝুলছে একটা লোহার খাঁচা। একটা তারখেল তার ভেতর। ঘরে ঢুকে প্রফেসর একবার সন্দীপের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার মুখ এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ নাকি?’
সন্দীপ নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে উত্তর দিল, ‘না।’
প্রফেসর টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘একটু আগে পর্যন্ত আমাকে ল্যাবরেটরিতে কাটাতে হল তাই তোমার ঘরে আসতে পারিনি।’
তার কথাটা যে মিথ্যে তা জানে সন্দীপ। সে কোনো উত্তর দিল না। প্রফেসর খাঁচাটা টেবিলের ওপর রাখলেন, সিরিঞ্জটাও সাবধানে খাঁচার পাশে নামিয়ে রাখলেন। চেয়ারটা সেখানে টেনে নিয়ে বসলেন প্রফেসর। সন্দীপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রফেসর সন্দীপকে বললেন, ‘তুমি দাঁড়িয়ে কেন! বোসো!’
সন্দীপ ধীরে ধীরে চৌকির এক কোনায় গিয়ে বসল। এরপর প্রফেসর কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন সন্দীপের দিকে। সন্দীপও তাকাবার চেষ্টা করল তার চোখের দিকে। কিন্তু তার চোখে চোখ পড়তেই কী একটা অস্বস্তিতে আবার অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল।
প্রফেসর এবার সন্দীপকে বললেন, ‘তোমাকে ঠিক কেন এখানে ডেকে এনেছি, তা এখন বলব তোমাকে। তার আগে তোমাকে আমি একটা ম্যাজিক দেখাব। তুমি খাঁচার ভেতর রাখা তারখেলটার দিকে তাকাও।’
সন্দীপ তাকাল সেদিকে। খাঁচার ভেতর থেকে প্রাণীটা ঘাড় উঁচিয়ে ঘরের চারপাশ দেখছে আর মাঝে মাঝে তার জিভটা বাইরে বের করছে। সন্দীপ সেদিকে তাকাবার পর প্রফেসর ম্যাজিশিয়ানের ঢঙে বললেন, ‘খাঁচার ভেতর কী দেখছ, একটা নিরীহ তারখেল তো?’
সন্দীপ মাথা নেড়ে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’
প্রফেসর একটু হেসে বললেন, ‘এবার দ্যাখো কী হয়!’
এই বলে প্রফেসর তাঁর জামার পকেট থেকে তরল ভর্তি একটা টেস্টটিউব বের করে তার ছিপিটা খুলে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের তরল থেকে বিশ্রী একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল গোটা ঘরে। এরপর তিনি বাঁ হাত দিয়ে খাঁচার দরজা খুলে তারখেলটাকে শক্ত হাতে চেপে ধরে বাইরে বের করে ডান হাত দিয়ে টেস্টটিউবের মুখটা চেপে ধরলেন তার নাকের কাছে। গ্যাসের তীব্র গন্ধে ছটফট করে উঠল প্রাণীটা। কিন্তু প্রফেসরের হাত থেকে সে মুক্ত হতে পারল না। প্রাণীটাকে কিছুক্ষণ এভাবে ধরে রাখার পর প্রফেসর তাকে আবার ভেতরে ঢুকিয়ে খাঁচার দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর তিনি সন্দীপকে বললেন, ‘এবার ভালো করে তাকিয়ে থাকো ওর দিকে।’
সন্দীপ চুপচাপ চেয়ে রইল প্রাণীটার দিকে। খাঁচার ভেতর ছেড়ে দেওয়ার পর কয়েক মুহূর্ত যেন নেতিয়ে রইল প্রাণীটা। তারপর হঠাৎ যেন তার দেহটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগল। সন্দীপের চোখের সামনে ঘটতে লাগল এক বিস্ময়কর ব্যাপার। তারখেলের শরীরের গঠন কেমন যেন পালটে যেতে লাগল। তার হলুদ রং কালো হয়ে গেল। পিঠের ওপর থেকে লেজের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত জেগে উঠল খাঁজ। চোয়ালে জেগে উঠল সারি সারি দাঁত। উত্তেজনায় সন্দীপ চৌকি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কোনো এক জাদুমন্ত্রে সন্দীপের চোখের সামনে তারখেলটা রূপান্তরিত হল ফুট চারেক লম্বা কুমিরে। খাঁচায় আর তার জায়গা ধরছে না। খাঁচার ভেতর থেকে সে একবার হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাল সন্দীপের দিকে। তারপর মুক্তি পাওয়ার জন্য দাঁত দিয়ে খাঁচার জাল কাটবার চেষ্টা করতে লাগল। তার দাঁতের ঘষটানিতে একটা বিশ্রী খরখর শব্দ হতে শুরু হল। সন্দীপ এবার তাকাল প্রফেসরের মুখের দিকে। তাঁর মুখে ফুটে উঠল আত্মবিশ্বাসের হাসি। প্রফেসর সন্দীপকে বললেন, ‘খাঁচার প্রাণীটাকে চিনতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হচ্ছে না তোমার? ও সুন্দরবনের বিখ্যাত মোহনার কুমির ‘ক্রোকোডাইলাস পোরোসাস’।
সন্দীপ এতটা আশ্চর্য হয়ে গেল যে তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোল না। সে চৌকির ওপরে আবার বসে পড়ল। প্রফেসর খাঁচাটা টেবিল থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরের এক কোনায় রেখে আবার টেবিলের সামনে চেয়ারে এসে বসলেন। সন্দীপের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘এতক্ষণ তুমি যা দেখলে তা ম্যাজিক নয়, বিজ্ঞানের খেলা। আমার সারা জীবনের সাধনার ফল। হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন মুনি ঋষিরা আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন এই বিজ্ঞান। যে কারণে তারা এক প্রাণীকে অন্য প্রাণীতে পরিণত করতে পারতেন। তারপর কোনো কারণে মানুষ ভুলে যায় বিজ্ঞানের সেই কৌশল। তারই নতুন কৌশল রপ্ত করতে পেরেছি। তবে তুমি যা দেখলে তা একটি ছোট উদাহরণ মাত্র। এর চেয়ে অনেক বড় ঘটনা ঘটাতে পারি আমি।’
প্রফেসরের কথা শুনে হঠাৎ সন্দীপের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘এ তো অসম্ভব! এ কাজ কীভাবে করলেন আপনি।’ তার কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে প্রফেসর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘যদিও তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র নও। তবুও প্রশ্নটা যখন করলে তখন তোমাকে সরলভাবে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। তুমি জান যে, আমি একজন জীববিজ্ঞানী। আমার দীর্ঘদিনের কাজের বিষয় বায়ো-টেকনোলজি। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে বলতে হয় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। তুমি এটুকু নিশ্চয়ই জান যে কোনো জীবের শরীরই খুব ছোট এক অণুবীক্ষণিক একক দিয়ে তৈরি। যার নাম ‘কোষ’। তার মধ্যে আছে এর চেয়ে আরও ছোট ছোট এক বস্তু। যার নাম ‘জিন’। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের সেই দানব জিনের চেয়েও অনেক ক্ষমতাধর এই জিন। কোনো প্রাণীর স্বভাব, আকার থেকে শুরু করে তার চরিত্রের গঠন পর্যন্ত ঠিক করে এই জিন নামের আশ্চর্য বস্তু। দীর্ঘদিন ধরে জিন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এক প্রাণীর গুণাবলী অন্য প্রাণীর মধ্যে আরোপ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জীববিজ্ঞানীরা। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা এ কাজে বেশ কিছুটা সাফল্য পেলেও প্রাণীবিজ্ঞানীরা এ কাজে এখনও পর্যন্ত বড় রকমের সাফল্যের মুখ দেখেননি। আমি এ কাজে শুধু সাফল্য পেয়েছি তাই নয়, আরও একটা ভয়ংকর অসাধ্যসাধন করেছি। এক জটিল পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত জিনকে প্রকট করে তুলতে সক্ষম হয়েছি। যদিও এই ব্যাপারটা তুমি ঠিক বুঝবে না। এর ফলে বিশেষ বিশেষ সময় যে প্রাণীর শরীরে জিন প্রতিস্থাপিত হয়, তার নিজস্ব অস্তিত্ব মুছে গিয়ে সে পরিণত হবে জিনের আসল মালিকে। তবে এর জন্য শুধু জিন প্রতিস্থাপন করলেই হবে না। প্রতিস্থাপিত জিনের আসল মালিকের শরীরের বেশ কিছু উপাদানও প্রতিস্থাপিত করতে হবে বা প্রবেশ করাতে হবে যার শরীরে জিন প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে, তার শরীরে। ওই প্রতিস্থাপিত জিনকে জাগিয়ে তোলার চাবিকাঠি কী? এক্ষেত্রে আমি এক উপায় বের করেছি। যদি স্বাভাবিক নিয়মে বা কৃত্রিমভাবে গ্রহীতা প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে তোলা যায়, তাহলে জেগে উঠবে ওই জিন। ঠিক যেমন তারখেলটাকে আমি কৃত্রিমভাবে উত্তেজিত করে তাকে কুমিরে পরিণত করলাম। ওর শরীরে কুমিরের জিন ও কিছু শরীরী উপাদান প্রতিস্থাপিত করা আছে। অবশ্য স্বাভাবিক কোনো কারণে অর্থাৎ ভয় পেলে বা রেগে গেলেও প্রাণীটার এই পরিবর্তন হতে পারত। আর মানুষের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা তার ইচ্ছেশক্তির ওপরে নির্ভর করবে।’ এই পর্যন্ত বলে চুপ করে গেলেন প্রফেসর।
সন্দীপ এবার বুঝতে পারল কেন প্রফেসরের ল্যাবরেটরিতে কুমিরের বাচ্চাটা পরের দিন তারখেলে পরিণত হয়েছিল। আসলে সেটা তারখেলই ছিল। প্রথম দিন সন্দীপ ল্যাবরেটরিতে ঢোকার পর তাকে দেখে ভয় পেয়ে বা অন্য কোনো কারণে উত্তেজিত হয়ে সে পরিণত হয়েছিল কুমিরে।
প্রফেসর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এবার শোনো, তোমাকে আমি ডেকে এনেছি কেন? তোমার ওপর শেষ পরীক্ষা চালাতে চাই।’
সন্দীপ চমকে উঠে বলল, ‘মানে?’
প্রফেসর কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সন্দীপের দিকে। তারপর বললেন, ‘মানে হল, তোমাকে আমি এক অমিত শক্তিধর প্রাণীতে রূপান্তরিত করতে চাই। ওই যে খাঁচার মধ্যে বাঘের বাচ্চাটা বসে আছে, ওর জিন, অর্থাৎ প্যানথেরা টাইগ্রিসের জিন আমি প্রতিস্থাপিত করতে চাই তোমার শরীরে।’
কথাটা শুনেই সন্দীপ চৌকি ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছেন প্রফেসর? কী বলছেন আপনি?’
প্রফেসর এবার টেবিল থেকে সিরিঞ্জটা তুলে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ‘তুমি ভয় পেয়ো না সন্দীপ। তোমাকে আমি পৃথিবীবিখ্যাত করে দেব একদিন। শুধু একটু কষ্ট সহ্য করতে হবে তোমাকে। খুব সামান্য কষ্ট, ও কষ্ট আমিও সহ্য করেছি।’
সন্দীপ চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আমি বিখ্যাত হতে চাই না। এ কাজ আমি আপনাকে কিছুতেই করতে দেব না। আমি এখনই চলে যাব এখান থেকে।’
প্রফেসর তার কথা শুনে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আমি কিন্তু কাজটা এখনই শুরু করতে চাই।’ এরপর তিনি একটু হেসে বললেন, ‘ইচ্ছে হলে অবশ্য তুমি এখন চলে যেতে পারো। কিন্তু কোথায় যাবে তুমি? জঙ্গলে গেলে বাঘের পেটে যাবে আর জলে নামলে…।’
এ কথাটা আর শেষ করলেন না প্রফেসর। তারপর বললেন, ‘তার চেয়ে বরং আমার কথা মেনে নাও। আমাকে এখন কাজ করতে দাও। বাধা দিলে গুলি চালাতে বাধ্য হব। সন্দীপ আতঙ্কিত হয়ে দেখল প্রফেসরের বাঁ হাতে কোন ফাঁকে যেন উঠে এসেছে রিভলভার। তার মুখ সন্দীপের দিকে তাক করা। এক পা এক পা করে সন্দীপের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন প্রফেসর। তার বাঁ হাতে রিভলভার আর ডান হাতে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। ঠোঁটের কোনায় একটা কুটিল হাসি। সন্দীপ পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে রইল প্রফেসরের দিকে। সন্দীপ বুঝতে পারছে না কীভাবে সে প্রতিরোধ করবে প্রফেসরকে। আর মাত্র হাত খানেকের ব্যবধান। প্রফেসরের হাতে ইঞ্জেকশনের সূচটা একবার ঝিলিক দিয়ে উঠল মোমের আলোয়। ঠিক এই সময় যেন প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল ঘরের মধ্যে। প্রফেসর আর সন্দীপ দুজনেই চমকে উঠে দেখল, দরজার পাল্লাটা ফাঁক হয়ে গিয়েছে, আর সেখান দিয়ে উঁকি মারছে একটা প্রকাণ্ড বাঘের মাথা। না সে বাঘ নয়, সেই আহত বাঘিনী। সে এসেছে তার বাচ্চাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। তার উপস্থিতি মনে হয় বাচ্চাটাও টের পেয়েছিল। খাঁচার ভেতর থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ করে ডেকে উঠল সে। সেই শব্দ লক্ষ করে ঘরের ভেতর তাকাল বাঘিনী। তার চোখ দুটো থেকে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। বাঘিনী পা বাড়াল ঘরের ভেতর। প্রফেসর দু-এক মুহূর্তের জন্য স্থবির হয়ে গিয়েছিলেন তাকে দেখে। সম্বিত ফিরে পেয়ে বাঘিনীকে লক্ষ্য করে তিনি চালিয়ে দিলেন গুলি। গুলিটা বাঘিনীর গায়ে লাগল কিনা বুঝতে পারল না সন্দীপ। একটা বিকট গর্জন করে সেই মুহূর্তে প্রফেসরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটা তাণ্ডবে মুহূর্তের মধ্যে লন্ডভন্ড হয়ে গেল ঘরের সব কিছু। টেবিলটা উলটে মোমবাতিটা নিভে গিয়ে সারা ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। কীসের যেন আঘাতে সন্দীপও ছিটকে পড়ল ঘরের কোনায়। প্রফেসর আর বাঘিনী ঝটাপটি করতে করতে দরজা দিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে দুজনে দলা পাকিয়ে বারান্দার কাঠের রেলিং ভেঙে নীচে গড়িয়ে পড়ল। নিচ থেকে ভেসে আসতে লাগল প্রবল ঝটাপটি আর ক্রুদ্ধ বাঘিনীর গর্জন। বাঘিনীটা যদি আবার ঘরের ভেতর ছুটে আসে? দরজার একটা পাল্লা তো ভেঙে পড়েছে, বাইরে পালাতে হবে, এই ভেবে সন্দীপ দ্রুত মেঝে থেকে উঠে ঘরের বাইরে পালাতে গেল। দরজার বাইরে পা রাখতেই সন্দীপের চোখে পড়ল বারান্দার মেঝেতে পড়ে আছে প্রফেসরের রিভলভারটা। সঙ্গে সঙ্গে সন্দীপ সেটা কুড়িয়ে নিল। সেটা হাতে নিয়ে একটা সাহস সঞ্চয় হল তার মনে। কিন্তু সে এখন কোনদিকে পালাবে! হঠাৎ তার চোখ পড়ল বারান্দার নীচের দিকে জমিটায়। যেখানে বাঘে-মানুষে লড়াই চলছে। সঙ্গে সঙ্গে তার পা যেন কেউ আটকে দিল মেঝের সঙ্গে। প্রফেসর কোথায়! চাঁদের আলোয় সন্দীপ স্পষ্ট দেখতে পেল, বাঘিনীর সঙ্গে লড়াই করছে বিরাট বড় এক মোহনার কুমির! কুমিরের লেজের ঝাপট আর বাঘিনীর গর্জনে খানখান হয়ে যাচ্ছে অরণ্যের নিস্তব্ধতা। দুজনেই দুজনার গায়ে দাঁত বসাবার চেষ্টা করছে। শেষ লড়াইতে অবতীর্ণ হয়েছে জলের রাজা আর বনের রানি। আধঘণ্টা ধরে চলতে থাকল লড়াই। লড়তে লড়তে ক্রমশই তারা এগিয়ে যেতে শুরু করল খাঁড়ির দিকে।
বারান্দায় স্থবির হয়ে সন্দীপ তাকিয়ে রইল সেদিকে। জোয়ারের জল ক্রমশ বাড়ছে। খাঁড়ি ছাপিয়ে জমি পেরিয়ে বাড়ির তলা দিয়ে জল এগিয়ে আসছে লড়াইয়ের ময়দানের দিকে। একসময় তারা দুজনেই গিয়ে পড়ল সেই জলের মধ্যে। প্রচণ্ড লড়াইয়ে জল ছিটকে উঠতে লাগল আকাশের দিকে। হঠাৎ একটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠল বাঘিনী। মোহনার কুমিরের বিরাট চোয়ালের মধ্যে আটকে পড়েছে বাঘিনীর গলা। সেই চোয়াল থেকে বাঘিনী আর মুক্ত করতে পারল না নিজেকে। ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে গেল বাঘিনী। কুমিরটা বেশ কিছুক্ষণ কামড়ে ধরে রইল তাকে। মনে হয় নিশ্চিত হতে চাইল তার মৃত্যু সম্পর্কে। তারপর প্রচণ্ড এক ঝটকায় অত বড় বাঘিনীর শরীরটা শূন্যে তুলে ছুড়ে ফেলল খাঁড়ির দিকের জলে। চাঁদের আলোয় অনেকটা জল ছিটকে উঠল আকাশের দিকে। খাঁড়ির জল বাঘিনীর শরীর ভাসিয়ে নিয়ে গেল সন্দীপের চোখের আড়ালে।
বিশাল কুমিরটা এরপর ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল বারান্দার দিকে। তারপর কিছুটা জলে ভেসে, কিছুটা বুকে হেঁটে দ্রুত এসে হাজির হল বারান্দায় ওঠার তক্তার সামনে। চাঁদের আলোয় সন্দীপ স্পষ্ট দেখতে পেল কুমিরটার পিঠের ওপর লেগে আছে প্রফেসরের খাকি রঙের জামার একটা টুকরো। তক্তা বেয়ে কুমিরটা ওপরে ওঠার জন্য আরও কিছুটা এগিয়ে এল। ওকে ওপরে উঠতে দেওয়া যাবে না। মনের সব শক্তি সঞ্চয় করে সন্দীপ ছুটে গিয়ে দাঁড়াল তক্তাটা বারান্দার যে জায়গাটা থেকে নীচে নেমেছে সেখানে। সন্দীপ চিৎকার করে বলল, ‘প্রফেসর ওপরে ওঠার চেষ্টা করবেন না। আমি কিন্তু গুলি চালাব।’ থমকে গেল কুমিরটা। তারপর সন্দীপকে ভয় দেখানোর জন্যই মনে হয় তার দিকে তাকিয়ে প্রকাণ্ড একটা হাঁ করল। চাঁদের আলোয় সন্দীপ দেখতে পেল তার বিশাল মুখের মধ্যে চোয়ালে সাজানো সারি সারি ভয়ংকর দাঁত। নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি! আতঙ্কে শিউরে উঠল সন্দীপ। নিজের অজান্তেই তার হাতের রিভলভার থেকে প্রচণ্ড শব্দে ছিটকে বেরিয়ে গেল একটা গুলি। সেই গুলি কুমিরটার গায়ে লাগল না ঠিকই, কিন্তু সে একটু পিছু হটে দাঁড়াল। সন্দীপ দাঁড়িয়ে রইল বারান্দার ওপর আর কুমিরটা পাটাতনের নীচে। দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে যেন ধৈর্যের পরীক্ষায় নেমেছে। কেটে যেতে লাগল সময়। খাঁড়ির জল একসময় গ্রাস করে নিল সামনের জমিটা। জলে ঢেকে গেল প্রাণীটার শরীর। শুধু জেগে রইল তার পিঠের খাঁজকাটা অংশ আর এক জোড়া ড্যাবড্যাবে চোখ। সারারাত সেই চোখের দিকে তাকিয়ে সন্দীপ হাতের রিভলভারটা তাক করে দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মূর্তির মতো। বিশ্ব চরাচরের সব কিছু সন্দীপের চোখের সামনে থেকে মুছে গেল। ওই দুটো ভাসমান চোখ ছাড়া। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল। শেষরাতের দিকে নেমে গেল বানের জল। আবার ফুটে উঠতে লাগল তার শরীরের স্পষ্ট অবয়ব। একসময় পুবের আকাশ যেন লাল হতে শুরু করল। ঠিক এই সময় ওপরে ওঠার জন্য শেষ চেষ্টা করল কুমিরটা। সে এগিয়ে এল তক্তার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালাল সন্দীপ। সচেতনভাবেই সে চালাল। কিন্তু তার অপটু হাতের জন্য গুলি এবারও লাগল না এবার মনে হল সত্যিই ভয় পেয়ে গেছে কুমিরটা। অনেকটা পিছু হটে, তারপর মাটির ওপর আস্তে আস্তে লেজের ঝাপটা মারতে লাগল। একসময় আলো ফুটতে শুরু করল। কুমিরটা শেষবারের মতো বিরাট হাঁ করল। তার পর সরসর করে এগিয়ে গেল খাঁড়ির দিকে। সন্দীপও খাঁড়ির দিকের বারান্দায় দাঁড়াল। খাঁড়ির পাড়টা কুয়াশা মাখানো। কুমিরটা দ্রুত সেদিকে এগিয়ে মুহূর্তের জন্য ঘাড় ফেরাল বাড়িটার দিকে। তারপর অদৃশ্য হল খাঁড়ির পারে কুয়াশার মধ্যে। কুমিরটার জলে ঝাঁপ দেওয়ার অস্পষ্ট শব্দ কানে এল সন্দীপের। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে শুনতে পেল দিনের প্রথম পাখির ডাক।
সকাল সাতটা নাগাদ বন দপ্তরের লোক যখন বাড়িটার সামনে হাজির হল তখনও বারান্দায় একইভাবে দাঁড়িয়ে সন্দীপ। আসলে তারা ঘটনাচক্রে কাল রাতে এসে নোঙর ফেলেছিল কাছের এক বড় খাঁড়িতে। চোরাশিকারীদের ধরার জন্য মাঝে মাঝে তারা এরকম গভীর জঙ্গলের মধ্যে লঞ্চ নোঙর করে। মাঝরাতে তারা শুনেছে বাঘের গর্জন আর গুলির শব্দ। তাই ভোর হতেই তারা বেরিয়ে পড়েছিল শব্দের উৎসের খোঁজে। তারপর পৌঁছেছিল বাড়ির সামনে। সন্দীপকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল তারা। সন্দীপ তাদের খুলে বলল কীভাবে সে সেখানে এসে হাজির হয়েছে। বলল, বাঘিনী আর কুমিরের লড়াইয়ের ঘটনা। শুধু বলল না তার আসল অভিজ্ঞতার কথা। কারণ, সেকথা কেউ বিশ্বাস করত না। বনদপ্তরের যে অফিসার দলের দায়িত্বে ছিলেন তিনি কীভাবে যেন চিনতেন প্রফেসরকে। প্রফেসর যে সুন্দরবনেরই কোনো অঞ্চলে থাকেন একথাও তিনি জানতেন। কাজেই সন্দীপের পক্ষে কথাগুলো তাদের বিশ্বাস করানো সহজ হল। বাড়ির সামনের জমির কাদামাটিতে কুমির বাঘিনীর পায়ের ছাপ আর তাদের লড়াইয়ের চিহ্ন। খাঁড়ির পাড়ে পরে থাকা বাঘিনীর ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ সন্দীপের বক্তব্যের সাক্ষ্য দিল। প্রফেসর কোথায়? তাঁরা জিজ্ঞেস করতে সন্দীপ বলল, ‘প্রফেসরকে কুমিরে টেনে নিয়ে গিয়েছে।’
বন দপ্তরের লঞ্চ এখন সন্দীপকে নিয়ে চোরাগাজি খাল বেয়ে এগিয়ে চলেছিল সজনেখালির দিকে। সূর্য মাথার ওপর। লঞ্চের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সন্দীপ তাকিয়ে ছিল জলের দিকে। আরও দুজন লোক একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল। তাদের কথাবার্তা টুকরো টুকরো কানে আসছিল সন্দীপের। হঠাৎ তাদের একজন আর একজনকে বলল, ‘চোরাগাজি খালের চরে যে বিরাট কুমিরটা রোদ পোয়ায় সেটাকে কদিন ধরে দেখছি না কেন?’
অন্য একজন তার কথা শুনে উত্তর দিল, ‘কী জানি, মোহনার দিকে চলে গিয়েছে হয়তো।’
সন্দীপের মনে পড়ে গেল প্রফেসরের সেই কথা, ‘কাল আমি চোরাগাজি খালে তোমাকে দেখেছি।’ কথাটা মনে পড়তেই সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার নীচে জলের মধ্যে একটা শব্দ হল। সন্দীপের চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা লম্বা কালো মাথা। আর তাতে বসানো একজোড়া ড্যাবড্যাবে চোখ। অপলক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে সন্দীপের দিকে। সন্দীপ চিৎকার করে বলে উঠল ‘ওই যে! ওই যে!’
তার কথা শুনে কাছে থাকা লোক দুটি চমকে উঠে সন্দীপের পাশে এসে দাঁড়াল। ততক্ষণে সে ডুব দিয়েছে জলের গভীরে। তাদের একজন সন্দীপকে প্রশ্ন করল, ‘কী?’
সন্দীপ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘একটা কুমির’।
তার কথা শুনে লোকটি একটু নিরাশ হয়ে বলল, ‘আমি ভাবলাম আপনি নদীর চরে জঙ্গলে বাঘ দেখলেন বুঝি! কুমির তো আমরা হামেশাই দেখি সুন্দরবনের খাঁড়িতে।’
—