মাঝখানের দরজা
রোজকার মতো হল না, রাথরুম সেরে আলোটালো নিবিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করতে অনুভা আজ প্রায় বারোটা বাজিয়ে দিল। মেয়ে শুয়ে পড়েছে ঢের আগে, তার মর্নিং স্কুল, এতক্ষণে নিশ্চিত কাদা। তবু ভালো যে, হুড়কো লাগিয়ে ছিটকিনি তোলা ও বেডসুইচ অফ করার মধ্যে অনুভা আজ বেশি সময় নেয়নি। গত মাসদুয়েক ধরে রোজ যেমন, সারারাতের জন্যে অন্ধকার হয়ে গেল ঐ ঘর। মাঝখানের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ থাকবে সারারাত।
খুব পীড়াপীড়ি না করলে, অনুভা আজকাল আর এ-ঘরে আসে না। ঝাড়া পাঁচটি বছর কাঠখড় পুড়িয়ে উত্তর-কলকাতা-ভাবাবেগে-ভরা যে বিধুর সহপাঠিনীকে বিয়ে করেছিল ধ্রুব, কে জানত, মেয়ের বয়স বছর-চোদ্দ হবার আগেই সারারাত-নারী থেকে সে তাকে এমন নিঃশেষে বঞ্চিত করবে। দীননাথও তো চিনত অনুভাকে, বলতে গেলে তারই বান্ধবী, বিয়ের বেলা শাহলা দত্ত-হারামজাদা কেমন ক্লিন বারো বছরের মার্জিন রাখল। পড়তি-কুড়িতে বীথি এখন যা, বিয়ের সময় অনুভা তার চেয়ে বড়ো বই কিছু ছোট ছিল না।
অনুভা এবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাবল-মার্চ করে ঘুমের বাড়ি যাবে। ঘুমের বাড়ি না যমের বাড়ি? সে যাই হোক, ততক্ষণ এ-ঘরে একটি চেয়ার টানাটানিও বারণ। হাঁচি পেলে, ধ্রুব আস্তে হাঁচবে। মুনের না মর্নিং স্কুল? অনুভাকে উঠতে হবে না তার সঙ্গে? হ্যাপা কে পোয়াবে, ধ্রুব না অনুভা?
এখন সারা ফ্ল্যাটে অন্ধকার। শুধু ঝলমল করছে ধ্রুবর মাথা। আর বিলম্বের প্রয়োজন কী। মশারি তুলে ধ্রুব বিছানা থেকে বেরোয়। ধ্রুবদের ফ্রিজটি নতুন না, বেশ শব্দ হয়। দুই ঘরে পাখা চলছে ফুলফোর্সে, একটা সাইসাঁই শব্দ আছে তাদেরও। পদশব্দ যদি কিছু হয়, ঢাকার পক্ষে এটা যথেষ্ট। অবশ্য ঝোপ থেকে বেরোনো চিতার সঙ্গে তার এখন বিশেষ তফাৎ নেই। নোখটোক যা কিছু, সবই থাবার মধ্যে।
কিছু আগে অনুভাকে শুনিয়ে ধ্রুব যে ছিটকিনি লাগিয়েছিল তা ছিল শব্দমাত্র আসলে লাগায়নি। ভেজানো দরজা সাবধানে খুললে শব্দ হয় না, হলও না, চৌকাঠ ডিঙিয়ে কড়িডোরের বাঁ-দিতে ডাইনিং স্পেশের সামনে গিয়ে ধ্রুব দাঁড়ায়। টেবিলের পাশে যার-পর-নেই নোংরা, যত্রতত্র গিঁট-বাঁধা, তেলচিটে, টাঙানো মশারি একটি মশারির বোঁটকা গন্ধে নাকের পাটা কুঁচকে দাঁড়িয়ে, অন্ধকারে, যে-ভাবে সারা শরীর সে স্ট্রেচ করে নেয় তাতে একটি চিতার জীবনসর্বস্ব দাঁড়িয়ে ছিলই, বস্তুত, তা ছিল চিতাসুলভ। যেন, খরগোশের বিধিলিপির জন্যে সে এক ঝোপের সামনে স্বাধীকারপ্রমত্ত দাঁড়িয়ে। তার পরনে পপলিনের আণ্ডারউয়্যার, উরু অবধি উলঙ্গ পা-দুটি ঘন লোমে ঢাকা।
বাইরে গুমোট। মশারিতে কিছু জ্যোৎস্না এসে লেগেছে বটে, কিন্তু চিটপিটে ময়লা এত পুরু যে ভিতরে প্রবেশ করতে পারেনি। উবু হয়ে বসে, মশারি তুলে, ধ্রুব তার দক্ষিণ থাবা মশারির মধ্যে পাঠায়। ফ্রক সরিয়ে বছর-ষোলোর দুটি স্তন সে পায়, যার মধ্যে একটি ধরে সে মৃদু আকর্ষণ করে। ডাকে, আয়। থাবার সর্বস্ব তাকে ডাকে। ডেকেই সে কিছু এ-ঘরে চলে আসে না। সে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকে।
ধ্রুব যাকে ডাকে, ষোলো বছরের সেই মেয়েটির নাম সিন্ধু। এবার সে বেরোয়। ভারি পরিপাটি করে মেঝেয়-লগ্ন বিছানায় সে ফের মশারি গোঁজে। অনুভা যখন থাকে না, এ-সব ধ্রুব তাকে হাতে ধরে শিখিয়েছে। এর মধ্যে একদিন, কোনো-একদিনও কি ঘর খুলে বেরিয়ে পড়েনি অনুভা? তা নয়। একদিন পড়েছিল। শেষরাতে বাথরুম যাবার ভারি অসচরাচর প্রয়োজন হয়েছিল মুন-এর, দেখতে-শুনতে তা মুনও চোদ্দয় পড়েছে। বছর-দুই আগেও কত ছোট ছিল যখন ভোরের বাথরুম থেকে এসে, মা নয়, বাবাকে নাড়া দিয়ে বলেছিল (হেসে), ‘বাপি, আমার হিসির সঙ্গে রক্ত বেরুচ্ছে!’ বজ্রাঘাত হোক ধ্রুবর মাথায় যদি এ-কথা সত্যি না হয়। মাত্র দু-বছরে ছোটবেলাটা কোথা দিয়ে যে নষ্ট করে ফেলল মেয়েটা, ভালো করে একবারটি আদর করে নেবার আগেই।
সেই মেয়ে ও মা একসঙ্গে বেরুল, শেষরাতে, যখন সিন্ধু এ-ঘরে ধ্রুবর বুকে লীন, ওঃ ভাবা যায়! অনুভা অবশ্য একদম ধরতেই পারেনি যে ঝোপ তখন ফাঁকা। ধরবে কী করে, এ-সব মহালয়া-মহালয়ায় কাচা মশারির ময়লা এত পুরু আর এমন চিটপিটে যে দিনমানেই বোঝা যায় না ভিতরে কে আছে না নেই, তো রাতে। আর, ছেঁড়া কাঁথাকুথির বিছানার সঙ্গে কি পরিপাটি করে গোঁজা মশারিটি! একটিও বেশি হৃৎস্পন্দন হতে না দিয়ে, ধ্রুব শুধু অপেক্ষা করেছিল। হার্ট তো নয় ধ্রুবর, দেওয়ালি-ঘড়ি যেন। গুণে ষাটটি দুলুনি পেণ্ডুলামের, ষাটটি টিক-টিক, তবে এক মিনিট। পাক্কা ষাট মিনিট, তবে ঢঙ।
বাথরুম বন্ধ হল। অনুভার ঘরে হুড়কো উঠল। ছিটকিনি উঠল। আলো নিবল। তবে টানটান হাত থেকে সুটকেশ নামিয়ে রাখল ধ্রুব। অর্থাৎ, বুক থেকে সিন্ধু।
প্রায় মাস তিনেক হতে চলল কাজে লেগেছে মেয়েটি। মাসদুই ধরে এই আসা-যাওয়া চলছে, মাঝে মাঝে। মোট কবারই বা। তবে এত চটজলদি, অনুভা সুইচ অফ করতে না-করতে, এমনটা এই প্রথম। এর আগে মধ্যরাতে বা যখন রাতশেষ, ঘুম রেগে গেলে তবেই টেনে এনেছে ধ্রুব। আ-খাওয়া মড়ি যেন বাঘের, কাছে যেতেই হয়েছে, টেনে আনতেই হয়েছে। কিন্তু না, ঘুমের ওপর সে আর বিশ্বাস রাখে না। নতুবা দেখতে দেখতে একটা হপ্তা কাবার হয়ে গেল, একদিনও কি ঘুম ভেঙে যেতে নেই? কই, ভাঙে নি তো। অগত্যা, বাধ্য হয়ে, তাকে আজ এই চরম ব্যবস্থা নিতে হল।
আজ ধ্রুবর হাত ধরে এ-ঘরে পা-টিপে ঢুকে, মশারি তুলে, সিন্ধু সোজা বিছানায় উঠে যায়। সিঙ্গল বেড, তবে ধ্রুবর কিছু অসুবিধে হয় না। রোগা মেয়েটা কতটুকু বা জায়গা নেয়, আর, আসলে কটা মুহূর্ত বা সে পাশে থাকে। হয় সে থাকে ধ্রুবর বুকে, না-হয়তো ধ্রুব তার। এবং কাজ ফুরনো মাত্র যাঁহাকা মাটি তাঁহা পাঠিয়ে দেয় ধ্রুব। ডাইনিং স্পেশে গিয়ে সিন্ধু পূর্ববৎ শুয়ে পড়ে। আসল কথা, সংকট মুহূর্ত তো একটাই হয় আর সেই অদ্বিতীয় মুহূর্ত-ব্যত্যয়ে এক-জীবনের ভুলচুক হয়ে যায়। ধ্রুব তাই, বরং তিলার্ধ আগেই, পাঠিয়ে দেয়।
সিন্ধু ধ্রুবর বিছানায় ঢুকে গেলে ধ্রুবর কাজ তবু কিছু বাকি থাকে। কনট্রাসেপটিভ সে আগে থেকে ছিঁড়ে খুলে রাখে। বাচ্ছা মেয়ে, জেলি লাগে সামান্য, নিরোধক হিসাবেও এটা অধিকন্তু, সে মায় টিউবের কর্কটিও আগেভাগে খুলে রাখে।
বাকি থাকে শুধু ছিটকিনি তোলা। ধ্রুব এতক্ষণে সত্যিসত্যি ছিটকিনি তোলে। ভূমিকম্প না-হওয়া সত্বেও যদি বেরয় অনুভা, সেদিন যেমন, ডাইনিং স্পেশের পাশে পরিপাটিভাবে গোঁজা মশারি ও ধ্রুবর বন্ধ দরজায় সে একবার করে, অকারণে, চোখ বোলাবেই। আঙুল দিয়ে ঠেলে পরখ করেও নিতে পারে, অসম্ভব কি। ধ্রুব তাই ছিটকিনি দেয়। এবং, হ্যাঁ, একটিও কিঁচ শব্দ না করে। যখন অনুভা থাকে না, বা বেরয়, সেইসব সময়ে বহু অনুশীলন করে সে এটা আয়ত্ত করেছে। এই অসাধ্য সাধন, একটিও টু-শব্দ হতে না-দিয়ে, ডাঁটি-ধরে এই ছিটকিনি-তোলা। রাতে অনুভা এ-ঘরে একদম আসে না সে প্রায় মাস ছয়েক হতে চলল।
খুব ফিসফিস করে এখন মশারির মধ্যে কথা বলা চলে। কিন্তু তার প্রয়োজন কী।
মোট কবারই বা, কিন্তু সেই প্রথমবার থেকে আজও, বারেকের জন্যও, প্রয়োজন হয়নি। উঠে যাবার আগে সিন্ধু তোশকের নীচে হাঁটকে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে একটি পাঁচ টাকার নোটের পেটে অতিরিক্ত টাকাটি আছে কিনা বুঝে নেয়। নিয়ে, নিজের জায়গায় চলে যায়। সাধনালব্ধ কুশলতায় ধ্রুব দেয় ছিটকিনি তুলে। হেয়ারক্লিপ কি একটা সেফটিফিন যে পড়ে থাকবে, সেটা হবার যো নেই। সব মায় ইজেরটি পর্যন্ত, খুলে আসে সিন্ধু। এ-জন্যে, যখন মুন যায় স্কুলে এবং অনুভা বেরয় এবং ধ্রুব বাড়িতে— ক্বচিৎ হলেও এমনটা হতেই হয়—বেশ কয়েকটি ক্লাস নিতে হয়েছে ধ্রুবকে। এই সব ক্লাসে, বাংলা অনার্সের মেয়েগুলোকে ‘সো মোহ কান্তা দুর দিগন্তা’ বোঝানোর তুলনায়, প্রফেসরদের চেয়ে, ঢের বেশি বেগ পেয়েছে সে। তবু সিন্ধুর বিবর্ণ মাথার চুল একটা যদি কোনোদিন আটকে থাকে বালিশে, বলা কি যায়, তাতেও ঘাবড়াবার কিছু নেই। সকালবেলা বেশ দেখেশুনে বিছানা ঝাড়ার সুশিক্ষা ধ্রুব তাকে দিয়ে রেখেছে।
প্রথম কবার পাঁচ পায়। মাসের হিসেবে অঙ্কটি খুব-একটা বেশি দাঁড়ালো কই। কটা বা টাকা পেল সিন্ধু, যা নিশ্ছিদ্র ঘুম ধ্রুবর। প্রথম মাসেই তো দিল একটা গোটা হপ্তা কাবার করে। একদিনো তো জাগতে পারল না! সে-মাসের শেষ-সপ্তাহে ছিটকিনি তুলে ধ্রুব বিছানায় ঢুকতেই, সিন্ধু তাই, ঘোর কটাক্ষ করে, দুহাত তুলে, বোবাদের মত ঈষৎ ঝঙ্কার লাগিয়ে হাতে, ধ্রুবর মুখের সামনে ছটা আঙুল মেলে ধরেছিল, জানালা দিয়ে সেদিনও কিছু জ্যোৎস্না এসে পড়েছিল। নীল নাইলনের ঝাঁ-চকচকে যা স্বচ্ছ মশারি ধ্রুবর, সে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল। পাঁচ-প্লাস-এক সেই থেকে ছয় চলছে।
অনুভা এ-ঘরে আসে না, সে প্রায় মাস ছয়েক হতে চলল।
গত বছর সেটা এপ্রিল না মে মনে নেই, দার্জিলিঙ-এ তারা তখন, অনুভা তাকে বাথরুমে ডেকে নিয়ে যায় ও পায়খানার দরজা খুলে দেওয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকে। জীবনে যে-কটি কাজ দেখে ধ্রুবর বোবা মন মুখর হয়ে উঠেছে প্রশংসায়, তার মধ্যে একটি হল দার্জিলিঙে থাকতে তাদের জমাদারনী ফুলমনি ছেত্রীর ধোয়া প্যানের অকলঙ্ক সাদা : সেদিন তার ওপর পড়ে আছে পোয়াটাক, কমসে-কম তিনছটাক তো হবেই, ঘোরবর্ণে রক্তের একটি ডেলা। লাল যেন কালো হয়ে যাচ্ছে এমন… ধ্রুব খুব-একটা অনুমানী লোক নয়, তবে অনুভার তখনও পীরিয়ড চলছে—সে দেখেই বুঝেছিল, এ-জিনিস মুখ থেকে আসেনি।
সুস্থ পীরিয়ডে ঠিক কতটা রক্ত পড়ে ধ্রুবর জানার কথা নয়। স্ত্রীর পীরিয়ডের হিসেব রাখা সে অন্য ব্যাপার, দীননাথ রাখে, তবু, তুহিন সাদার ওপর ঐ লালা রিরংসা— প্রতীক সৌন্দর্য যেন—সে দেখেই বুঝেছিল, এটা ঠিক স্বাভাবিক না, বা, এমন-কি কিছুটা ভয়ের। সে ভয়ে ভয়ে অনুভার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, ‘দ্যাখ হতভাগা, আমার কী অবস্থা করেছিস’, শান্ত, কঠিন গলায় কেটে কটে বলেছিল অনুভা।
কলকাতায় ফিরেই প্রথমে ডি, সি করানো হল। কাজ হল না। জুলাই-এর শেষাশেষি সেই অপারেশন করাতে হল। ‘ইউটেরাস রিমুভড বল তো কী, এ’, দীননাথ বলেছিল, ‘ও কিছু না। আমার ছোট শালির তো, এ, ঐ এক ব্যাপার। বাচ্ছা মেয়ে! ভায়রার তো, দীননাথ আশ্বাস দিয়েছিল, ‘এ, ফকিং-টকিং দিব্বি চলছে।’
যদিও কার্যত দেখা গেল, একটি গভীর প্রশ্বাস নিয়ে তা মোচন করে আজ ভাবে ধ্রুব, তা না। দীননাথের কথা বিশ্বাস করে ধ্রুব ঠিক করে নি; ভুলই করেছিল। দীনুর বাঁজা বৌটা তো পাছাটি লেজ হিসাবে নাড়াচাড়া করেই দশ বছর দিব্বি কাটিয়ে দিল অ্যাকোরিয়ামে, যে ডাকল তার সঙ্গে শুয়ে এল, এক স্বামী ছাড়া। শালা গাণ্ডু, বৌ-যন্ত্রের তুমি কী বুঝবে?
অনুভা আর ঠিক সেরে উঠতে পারল কই। সেপ্টেম্বরে মনে হল বুঝি সেরেছে, একদিন ট্রায়াল দিতে এ-ঘরে এল। নাঃ, উঃ, অসম্ভব। অক্টোবর…নভেম্বর…গত বছরটা মাঝে-মাঝেই চেষ্টা চলল। ডিসেম্বরের শেষাশেষি ও-ঘরে হুড়কো লাগাল অনুভা। জানুয়ারিতে ছিটকিনি! বছর ঘুরতে চলল। অনশনে এত দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার কোনো রেকর্ড নেই, কোনো জন্তুর, মানুষ বলে এতদিন বেঁচে ছিল ধ্রুব।
মার্চে, বাগবাজারে অনুভার বাপের বাড়ির পাড়া থেকে এসে সিন্ধু কাজে লাগল। সপ্তাহ না পুরোতেই একদিন শেষরাতে ধ্রুবর ঘুম ভেঙে গেল। সেই থেকে শুরু হল আসা-যাওয়া।
মোট কবারই বা, তবে দু-আড়াই মাসে যার আদৌ দরকার হয়নি, আজ তার প্রয়োজন হল। একটা খালি ট্রাম লটর-পটর করে ফিরে যাচ্ছে গুমটিতে। সেই ফাঁকা আওয়াজের সুযোগ নিয়ে এই প্রথম ফিসফিসিয়ে কথা বলল সিন্ধু।
‘মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল,’ সে বলল।
ধ্রুব কিছু কথা বলছিল না, বলেওনি কোনোদিন : সিন্ধুর সঙ্গে কাজের কথা যা কবেই শেষ হয়ে গেছে। তবু, সিন্ধু যা বলল, শুনে সে টের পেল এতদিন সে সিন্ধুর সঙ্গে কত কথাই না বলেছে এবং আজই এই প্রথম চুপ করে আছে। সিন্ধুর পাতলা, পরিণতিকামী কোমরের খাঁজে আটকে আছে তার হাত, উঠে এতক্ষণে তার অন্যত্র যাবার কথা, সে ভুলে গেছে তুলে নিতে।
ডাক্তার! মা? কিন্তু কেন? পেট-খারাপের জন্যে নয় তা বুঝেছে, তবে কেন? সে চুপ করে রইল।
প্রেগন্যান্ট হবার বিন্দুমাত্র বা কোনোরূপ চান্স তো নেই। যখন অনুভা বেরয় বা থাকে না আর মুন-ও স্কুলে, আমি কি তোকে বোঝাইনি কেন কনডোম, কেন জেলি আর কী করলে বাচ্ছা হয়, আর কী না-করলে বাচ্ছা হয় না? শরীর ককিয়ে উঠে বলেছে ‘ঢাল, ঢাল—’ কিন্তু কোনোদিন কি তা হতে দিয়েছি? মাই-মাই, দ্যাটস নো কাপ অফ মাইন, লেডি! সরি।
এই তো, আবার ভাষা খুঁজে পেয়েছে সে, আর ঐ তো একটা ট্রাক না এলেও নিদেনপক্ষে একটা গ্যারাজগামী বাস আসছে। আসুক, কাছাকাছি এলেই শুরু করে দেবে ধ্রুব এবং বাস বেরিয়ে যাবার আগেই যা বলার বলে দেবে ভেবে, সিন্ধুর কানে মুখ রেখে তবু, অভিপ্রেত লোডেড ট্রাকটি গাঁ-গাঁ শব্দে বাড়ির সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে, ‘সে কী!’ —এর বেশি কিছু সে বলতে পারল না। এবার ‘কেন, কী হয়েছিল’, জানতে চাইবে বলে সে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে। না:, কিছু এলো না। না-ট্রাম, না-বাস, না-ট্রামস, নিদেন একটা ট্যাক্সি—না-কিছু।
এখন বাড়ির বাইরে জ্যোৎস্না। ঘরে ঘোর অন্ধকার। সে তাই তার মুখ থেকে রক্তাভা অন্তর্হিত হতে দিল। সিন্ধুর অভিব্যক্তি দেখা যায় না।
হাতের ভাষায় সিন্ধুকে উঠে বসতে বলে ধ্রুব ছিটকিনি খুলে দাঁড়ায়। একটি কিঁচ-শব্দ হল কি? ‘এ নিয়ে পরে কথা বলব’, বাস বা ট্রাক কি ট্রাম কোনোকিছুর পরোয়া না করে বিবর্ণ ফাঁসা গলায় সে সিন্ধুকে জানাল। ছিটকিনি দিতে ভুলে গেল সে আজ। সিন্ধু টাকা নিয়েছে কি নেয়নি, এটা জানার আজ খুবই প্রয়োজন ছিল। তার মনে এল না।
সে জানালায় দাঁড়াল। বৃষ্টি শুরু এবং শেষ হল কখন? একটি জলধোয়া ডাবলডেকার আলোটালো জ্বালিয়ে গ্যারাজে গেল। তারপর রাস্তা ফাঁকা পড়ে রইল অনেকক্ষণ। সারারাত যেন আর একটাও গাড়ি যাবে না এমন চকচকে রাস্তা দিয়ে একটি সওয়ারিবিহীন কালো মোষ অতি মন্থরভাবে হেঁটে যাচ্ছে, সে দেখল।
বাসি মুখে চা খেয়ে ধ্রুব দাঁত মাজতে যায়। বহুগুণধর এই পেস্টটির একটি অঘোষিত আসল-কর্ম, জিভে গেলেই পেটের মধ্যে গুরুগুরু ধ্বনি। যার হয়, সে ছাড়া নাকি আর কেউ শুনতে পায় না? সিন্ধুর কথা মনে পড়তেই হাত দিয়ে মাছি উড়িয়ে দিল সে। ‘মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল…।’ ক্যানোগা কুকি, মনে মনে ভেঙিয়ে ওঠে সে, তোমার কি পেট-কারাপ ওয়েছিল!
দীননাথকে বলতে হবে, দাঁত মাজতে মাজতে ধ্রুব ভাবল। বেসিনের নীচেই একটা গামলায় শায়া ও ব্রেসিয়ার কেচে রেখেছে অনুভা, এখনো শুকোতে দেবার সময় পায় নি। সঙ্গে তার একটি গেঞ্জিও রয়েছে। একসঙ্গে খানিকক্ষণ পড়ে থাকলে যা হয়, সায়ার হলুদ কিছুটা গেঞ্জিতে লেগে গেছে। যখন ও-দুটি জিনিস, সায়া ও ব্রেসিয়ার, ঝিকে দিয়ে কাচানো যায় না, তখন ও-দুটি পরা কেন— সে একবার জানতে চেয়েছিল অনুভার কাছে। মিষ্টি হেসে আর ছোট্ট হাই তুলে যৌবন তখন সবে অনুভাকে বলেছে, ‘এবার উঠি রে।’ অনুভা বলেছিল, ‘কেন আর ভালো লাগে না খুলতে?’
উত্তরটি কী রসভরা আর পাকা! সঙ্গে অতটুকু হাঁ-মুখের অবিশ্বাস্য চওড়া রক্তাভ হাসি যা আনকথা মনে পনায় এবং এক কথায় যা চেনে নিয়ে যায় রাতের খোড়ো বিছানার কামময় উমে। উত্তর-কলকাতা-ভাবাগেবে মথিত যে। বিধুর সফিস্ট্রিকে সে বিয়ে করেছিল, খাঁটি সুপ্রভা সরকার গায়কীতে যে গাইতে পারত চল্লিশ দশকের ‘স্বপ্ন ও সাধনা’ ছবির ‘গানের সুরে জ্বালব তারার দীপগুলি’ গানটি এবং এখনও পারে— যে ফ্রিজিড ছিল না ও যার অর্গ্যাজম হত—সেই বাহুল্যবর্জিত তলপেট, উরুতে স্পন্দিত ফরসা, সবই তো আগের মতো—সত্যি, অনুভার মতো রিমার্কেবল মেয়ে কেন যে আর কটা বছর অফার করতে পারল না। সিন্ধুর সঙ্গে এই যে রাতের ব্যাপার, অনুভা কী এ-জন্যে পুরোপুরি দায়ী নয়! ছোট-বড়ো চাপ নিঃশ্বাসে ধ্রুবর বুক ভরে ওঠে।
তবে তার ভয় নেই, ধ্রুব নিশ্চিত যে, সে দায়ী হতে পারে না। লাভার-টাভার আছে নিশ্চয়। বাগবাজারে মার কাছে তো প্রায়ই যায় সিন্ধু। তার সঙ্গে সিন্ধুর অ্যাফেয়ারটা হয়ত গোড়া থেকেই স্টাডি করছে, এখন কিছু টাকা খেঁচার ধান্দা আর কি, সিন্ধুর মায়ের। দু-একশো যাবে, সিন্ধুর হাতেই সুযোগমত গুঁজে দেবে ধ্রুব। খসিয়ে নিক, বিয়ে দিয়ে দিক, যা পারে করে নিক। অনুভা না জানলেই হল। যদি বেশি ত্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করে তো ডি-সি-নর্থ সুনীতি বসুরায়কে বলে ঘড়িচুরির একখানা পুলিশ-কেসে ফাঁসিয়ে দিলেই হবে। সুনীতি তার ক্লাস-মেট।
আর হ্যাঁ, অফিসে দিয়ে দীননাথকে ডেকে পাঠাতে হবে। সব শুনে, দেখা যাক, এরিয়া ম্যানেজার কী বলে। কমার্শিয়াল ম্যানেজারকে এতদিন তো অন্তত ঘরে ঢুকে ‘সার’ বলত। এরপর থেকে ‘ধ্রুব’ ডাকবে নিশ্চিত। চাই কি, ডাকনামে, এ, হাবু বলেও ডাকতে পারে। বলুক, শালা ঘ্যাম খচ্চর, বৌ না-জানুক, ঝি জানে। দ্যাবা-দেবী জমিয়েছে ভালো, ঘুরে ঘুরে পছন্দ করে বীথি তাকে প্রতি পুজোয় নতুন ঝি উপহার দিয়ে যাচ্ছে। দীনুর কাছে সারেন্ডার করা ছাড়া উপায় নেই।
কমোডে বসে ধ্রুব আজকের বাংলা কাগজখানা মেলে ধরে। আ, এই কাগজখানা! নাকি ঐ পেস্ট? বসামাত্র এই তাৎক্ষণিক গলা-ধাক্কা দেয় কে যে, তা এক ওপরঅলা ছাড়া কেউ জানে না। প্রথম পাতায় সুরূপা মামলার অনুসরণে সে বাকি ‘দ্রষ্টব্য’ খুঁজতে পঞ্চম পাতার ষষ্ঠ কলাম খুঁজে বের করতে গিয়ে, ‘আইন ও আদালতে’র অষ্টম কলামে তার চোখ পড়ে। সে আগে ওটা পড়ে। বাঃ, শালারা বাছে ভালো। নিঃশেষে নিঙড়ে বের করবে আজ সবটুকু, কিছুই ভিতরে রাখবে না।
মুরারই থানার মন্দিরবাজার গ্রামে এবার একটি বালিকা-ধর্ষণের জন্য ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৩০০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ২ বছরের বিস্তৃত বিবরণ ছাপা হয়েছে। … ‘সে সুধারাণীকে (১৪) বলে, তার ছাগলটি ঐ শালবনের মধ্যে চলে গেছে। সে বালিকাটির সঙ্গে সেই জঙ্গলের মধ্যে যায়। …জানতে পেরে সুধারাণীর বাবা শ্রীফকিরচন্দ্র সেনাপতি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় ও পরীক্ষা করায়। তারপর থানায় ডায়েরি করে…’
ডাক্তার… থানা… পেট খারাপের ব্যাপার না, প্রেগন্যান্ট হবার প্রশ্ন ওঠে না—এসব সে আগেই বুঝেছিল। কিন্তু ডাক্তারি-পরীক্ষা? মাত্র একটি শব্দ তার ধ্রুব-পৃথিবীকে ঠাস করে চালু করে দিল। নীল ফুল তোলা শাদা টালির চকচকে বাথরুমে দুগ্ধফেননিভ কমোডে বসে তার ভারি পাছাটি টুপির মতো ছোট হয়ে যাচ্ছে, সে টের পেল। পরমুহূর্তে মনে হল, শূন্যে নিক্ষিপ্ত, সে যেন এক বায়ুভেদী তির, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, কখন আর কোথায় গিয়ে পড়বে তার ঠিক নেই।
কমোড থেকে উঠে পড়তে গিয়ে সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ফের কমোডে বসে পড়ল। তার হাত থেকে কাগজ পড়ে গেছে, কাঁপা হাতে না ছুঁয়েও সে টের পায়, মাথায় চুলের গোড়াগুলো ভিজে ইতিমধ্যেই জবজবে হয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে একটি স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে জেনেও, কাঁপুনি সে থামাতে পারে না। কমোডে বসে, সে কাঁপতে থাকে।
সিঁড়িতে চটির শব্দ। বাজারের থলি হাতে সিন্ধু ওপরে উঠে আসছে।
বোসপাড়ায় অনুভা দাদাবৌদির বিয়ের আজ রৌপ্যজয়ন্তী। নিউ মার্কেট থেকে পঁচিশ-গোলাপের তোড়া নিয়ে সন্ধেবেলা সেখানে যাবার কথা। এদিকে লোডশেডিং। তবে অফিসের জেনারেটর আছে। এয়ার-কণ্ডিশানড ঘরে সাতটা পর্যন্ত ধ্রুব বসে। একা? হ্যাঁ, একা। বাইরে বেয়ারা রাম-আধার।
৭টা নাগাদ ধ্রুব তলদেশ দেখতে পেল। খাঁড়া ঝুলছে, পড়বে, এবং এককোপে মুণ্ডু ছিটকে যাবে। আর কিছু হবার নেই, ধড়ের দিকে মুণ্ডুর চেয়ে-থাকা, এ-ছাড়া। ৭টা নাগাদ সে বুঝতে পারল, কানা নয়, খোঁড়া নয়, প্রেমিক নয়; লম্পট নয়, জোচ্চোর, সাধু, ক্লামজি, সোবার, মনমরা, চালাক, স্টুপিড, লাজুক, লোভী, উদাসীন, স্মার্ট, এ-সব কিছুই নয়—হাজবণ্ড নয়, বাবা নয়, কমার্শিয়াল ম্যানজার নয়—সে, সংক্ষেপে, ভীতু। ৭টা নাগাদ আধগজি গদির রিভলভিং চেয়ার বোঁ করে ঘুরিয়ে দেওয়ালের মুখোমুখি শূন্যে দুহাত ছুঁড়ে সে নিজেই নিজেকে ‘ডেস্ট্রয়েড’ বলে ঘোষণা করতে শুনল।
এবং ৭টা নাগাদই সে সেই সাহস পেল যা পুরুষ মানুষের নয়, মেয়ে মানুষের নয়, এমন কি নপুংসকেরও না; যা ভীতুর। অফিস থেকে বেরিয়ে সে, ধ্রুবজ্যোতি মিত্র, একটা ট্যাক্সি নিল। ‘সিধা চলিয়ে’, ভারি গম্ভীর আর জমকালো গলায় সে বলছে শুনল, ‘জলদি।’ যেন সে নয়, বুলেটের কথা ভুলে গিয়ে, প্রান্তরের পর প্রান্তর ভরিয়ে ডোরাকাটা লাফে, অ-খাওয়া মড়ির দিকে ছুটে চলেছে স্বাধীকারপ্রমত্ত চিতা।
চারতলায় ল্যাচ-কী খুলে ধ্রুব ঘরে ঢুকল। ‘সিন্ধু?’ অন্ধকারে সে নিচু গলায় ডাকল। সাড়া নেই।
ডাইনিং স্পেশে আলো জ্বলছে। কদিন ধরেই অনুভা বলছিল শাড়ি পরাবে, আজ পরিয়েছে। একটা লালপেড়ে তাঁতের শাড়ি পরে, টেবিলের পাশে, বিনা মশাড়িতে, এই ভরা সন্ধেবেলা সিন্ধু চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে। ‘ও কী ভাবে শুয়ে আছিস, ধিঙ্গি মেয়ে কোথাকার’, অনুভাকে কতবার বলতে শুনেছে সে, ‘ঠিক হয়ে শো।’ তবু তার ভঙ্গিমা পালটায়নি। ঘুমিয়ে পড়লে, কিছু যদি মনে থাকে মেয়েটার।
স্যুট-টাই না খুলে সিন্ধুর পাশে বোঁটা-ছেঁড়া পাতার মত ধ্রুব খসে পড়ে। তাকে জাগাতে, এত বিপদগ্রস্ত, তবু, শাড়ি সরিয়ে স্তনে হাত না-রেখে সে পারে না।
‘সিন্ধু’, কানের কাছে মুখ এনে সে বলে, ‘মানইজ্জৎ নয়। অনুভা নয়; মুন নয়, কেউ নয়, ওরে কিছু না।’ সে ফুঁপিয়ে ওঠে, ‘সাত বছর পাথর ভাঙতে আমি পারব না।’ এত বলে সিন্ধুর ঘুম না-ভাঙা পর্যন্ত সে পাশে পড়ে থাকবে বলে শুয়ে থাকে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠে স্যুট টাই-পরা ধ্রুবকে পাশে শুয়ে থাকতে দেখে সিন্ধু এক অবাক-কাণ্ড করে। বালিকার গাম্ভীর্যে মুখ ঢলঢলে করে সে ইঙ্গিতে বলে, ‘ও-ঘরে।’
অর্থাৎ, আজ ও-ঘরে হবে। দিদিমনির বিছানায়।
হাত ধরে তুলে সে ধ্রুবকে তাদের প্রাক্তন দাম্পত্য বিছানায় নিয়ে যায়। জয়পুরে-কেনা মহার্ঘ চাদরটি অনুভা তাকে দিয়ে আজই পাতিয়েছে। পাখার রেগুলেটার ডানদিকের চরমে ঠেলে দিয়ে লীলাভরে সে নীল আলো জ্বালায়। জয়পুরী কারুকাজের ওপর অবলীলায় শুয়ে পড়ে।
জামাকাপড় খুলে পা-জামা পরতে পরতে যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে ধ্রুব বলল, ‘হ্যাঁ, কাল কী যেন বলছিলি? মাকে সব বলেছিস নাকি…’
‘মা-কে? কী-সব?’
‘ঐ-যে। ডাক্তার-ফাকতার।’
‘আপনি আমাকে তাই ভাবলেন জামাইবাবু?’ বহু-ভর্ৎসিত ভঙ্গিমায় চিৎ হয়ে শুয়ে সিন্ধু ঠোঁট ফোলায়, ‘ছিঃ।’
‘কাল যে বলছিলি, ডাক্তার…’
‘ও, ওটা। ওটা একটা ঠাট্টা করলুম!’ ফিক করে হেসে সে পা দোলায়, ‘আমি শাড়ি পরেছি।’ ধ্রুবর সাড়া নেই দেখে অভিমানে সে এবার হরিণীর কালো ঘনিয়ে আনে চোখে, ‘মাকে বলব, আমি কি এত খারাপ মেয়ে।’ তার বুক ফুলে ফুলে ওঠে। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সে আবার বলে, ‘ছিঃ।’ বলে অনুভার বালিশে মুখ গোঁজে।
মেঘ-ডাকাডাকি হচ্ছিল সকাল থেকেই। ঝোড়ো হাওয়ায় জানালার একটা পাল্লা হুশ করে খুলে গেল। চমকে উঠে সিন্ধু বন্ধ করতে যাচ্ছিল, ধ্রুব বাধা দিল। প্রয়োজন কী, আকাশ ছাড়া ওদিকে তো কিছু নেই।
বাইরে এ-গ্রীষ্মের প্রথম বর্ষা নামল। যেন মাত্র এক বছর পরে নয়। যেন কত খরার পরে—আবার। জানালার শার্শি আবার মেঘমেধুর হয়ে উঠছে, সেখানে, আবার, ঘন ঘন বিদ্যুৎ। বাইরের পাগল হাওয়া আর ঘরের ঝুলন্ত খৈতান ঘরের মধ্যে যে পরস্পরবিরোধিতা তৈরি করেছে, বোধহয় তো সেইজন্যে, পোড়ামাটির কারুকার্যময় শেড-দেওয়া নীল বাল্বটি এমন রীতি-গর্হিত দুলছে।
কট করে একটি শার্শি ফাটার শব্দে ধ্রুবর জীবন জুড়ে ঝনঝন করে সব কাচ ভেঙে পড়ল। ষোলো বছরের হালকা বালিকাকে বিছানা থেকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল বিয়াল্লিশ বছরের বালক। এবং আগে যা কখনও করেনি, মনেও হয়নি যে করা যায়, সে তার মুখ চুমায় চুমায় ভরিয়ে দিতে লাগল।
অনুভার পাউডার-ব্লু ছ-ফিট গোদরেজের সামনে সে তাকে দাঁড় করায়। অনুভার ভ্যানিটি থেকে চাবি বের করে ব্যগ্র কাঁপা হাতে সে আলমারি হাট করে খুলে ফ্যালে। বাঁদিকে ওয়াড্রোবে ঝোলানো তা অন্তত খান পনেরো শাড়ি। পিছনের গোপন চেম্বার থেকে বের করে এনে সে অনুভার গয়নার বাক্স ভাঁজ করা শাড়ির ডাঁই-এর ওপর রাখে। রেখে ডালা খুলে ফ্যালে। এখন, ঝলমলে রত্নগুহার সামনে, মর্জিনার সঙ্গে, গাধায় পিঠে আলিবাবার মত সে যেন।
পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে উন্মুক্ত আলমারির দিকে ইঙ্গিত করে ধ্রুব সিন্ধুকে বলে, ‘বেছে নে।’
শাড়ি না নিয়ে, দেখুন-দেখুন জড়োয়া-সেট তর্জনীর ঠেলায় সরিয়ে কত সপ্রতিভভাবে ইমিটেশান-হীরের রোল্ড-গোল্ডের নাকছাবিটি তুলে নিয়ে নাকের পাটায় পড়ছে মেয়েটা! লাল ভেলভেটের ডালা-সংলগ্ন আয়নায় ফুটে উঠেছে প্রতিবিম্ব। কী দুর্ধর্ষ মানিয়েছে ওর গর্বিত, সপ্রতিভ, ককেটিশ মুখে?
আ, পছন্দ আছে মেয়েটার।
১৯৮০