শীতকাল। ন্যাড়া মেপল গাছের ডালগুলো বরফে ঢেকে গিয়েছে। সারাদিন গোটা আকাশের রংটা কেমন যেন ছাই ছাই হয়ে ছিল। এখন সেটা নিকষ কালো। কাচের জানলা দিয়ে সেই অন্ধকার আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের পড়ার টেবিলে এসে বসেন টিমোথি। রাগে তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। এমনভাবে তাঁদের এতদিনের পরিকল্পনা যে বানচাল করে দিল, তাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তাঁর। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁকে চেনার কোনও উপায়ই নেই।
দাঁতে দাঁত চেপে টিমোথি মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, এত সহজে হার তিনি মানবেন না। তারপর কম্পিউটার খুলে ডি এন এ-সংক্রান্ত সব রকম রিসার্চ পেপার খুলে পড়তে-পড়তে একসময় এসে হাজির হলেন ডঃ মহীয়ান দত্তের ফাইলে। ডি এন এ নিয়ে সত্যিই যুগান্তকারী কাজ করেছেন ডঃ দত্ত। টিমোথিরা যে আজ পারফেক্ট ইউনিভার্সের কথা ভাবতে পেরেছে, সেটা তো তাঁরই সৌজন্যে। তিনি অবশ্য নিশ্চিত এতসব ভেবে কাজটা করেননি। তবে তাতে তো কিছু আসে যায় না। বিজ্ঞানীর কাজ আবিষ্কার করা। তারপর সেটাকে কীভাবে কাজে লাগানো হবে, সে তো যারা দেশ চালায় তারা ঠিক করবে। আবিষ্কারের জন্য যথেষ্ট পুরস্কারও পেয়েছিলেন মহীয়ান দত্ত। যদিও পরের দিকে তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পিউ-এর প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছিলেন। তার ফলও অবশ্য হাতেনাতে পেয়েছেন।
রিসার্চের পেপারগুলো দেখে নিয়ে টিমোথি কী ভেবে পিউ-এর সংগ্রহে রাখা মহীয়ান দত্তের নিজস্ব ফাইলটাও খোলেন। এতে ডঃ দত্তের ব্যক্তিগত জীবনের সব রকম তথ্য দেওয়া আছে। বিশেষ করে জুরান্তিতে থাকার সময় যেহেতু তিনি আন্ডার-সার্ভিলেন্স ছিলেন, তাই প্রতিদিনের খুঁটিনাটি সবই সেখানে রয়েছে। ডঃ দত্তের বাড়িতে ছিল পিলু নামের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী রোবট। সে প্রতিদিন মহীয়ান এবং তাঁর স্ত্রীর যাবতীয় গতিবিধি-কথাবার্তার একটা রিপোর্ট পাঠাত। টিমোথি খুব মন দিয়ে পিলুর পাঠানো সেই রিপোর্টগুলো পড়তে লাগলেন। বেশির ভাগই খুব মামুলি ইনফরমেশন। তার মধ্যে দুটো জিনিস টিমোথির দৃষ্টি আকর্ষণ করল। প্রথমত জুরান্তিতেও ডঃ দত্ত একটা নিজস্ব ছোট্ট ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিলেন। সেটাতে যন্ত্রপাতি অবশ্য খুব কম ছিল। অন্যান্য ব্যবস্থাও একেবারেই সাধারণ মানের। অন্তত পিলুর পাঠানো রিপোর্ট থেকে যা মনে হয়। কিন্তু সেখানে তিনি কী কাজ করতেন তার কোনও ফোটো পিলু পাঠায়নি। তার মানে তিনি ল্যাবে কাজ করার সময় পিলুকে সুইচড অফ করে দিতেন। ব্যাটারি চার্জের জন্য রাত বারোটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত পিলু সুইচড অফ থাকত। সেটা ডঃ দত্তরও ঘুমনোর সময়। সুইচড অফ থাকার সময়ের এদিকওদিক হলে সেটার উল্লেখ থাকত রিপোর্টে। কিন্তু তা হয়নি। তার মানে ডঃ দত্ত ল্যাবরেটরিতে যাই-ই কাজ করুন না কেন, সেটা রাত জেগে করতেন। কিন্তু কেন?
এই গোপনীয়তা কীসের জন্য? দ্বিতীয়ত জুরান্তিতে থাকাকালীন মাত্র দু‘জন মহীয়ান দত্তর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। দু‘জনেই তার পরিবারের সদস্য। তার মধ্যে একজন দেখা যাচ্ছে মহীয়ান বাবুর আগেই মারা গিয়েছেন। দ্বিতীয়জন হল নয়ন দত্ত। মহীয়ান বাবুর বংশের ছয় প্রজন্ম পরের একজন মানুষ। এই নয়ন দত্ত কে? কেন তিনি জুরান্তিতে ডঃ দত্তের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?
পিউ-এর ডেটা বেস খুলে নয়ন দত্তের নাম দিয়ে সার্চ করতে গিয়েই চমকে ওঠেন টিমোথি। হেনরি বার্ট যে ল্যাবরেটরিতে কাজ করে, যেখানে বাচ্চাদের ওই ওষুধ নেভিটা তৈরি হয় নয়ন দত্তও কাজ করে ওই একই গবেষণাগারে। কপালের ভাঁজ গভীর হয় টিমোথির। যদিও নয়ন দত্তর বায়োডাটা দেখে তিনি খানিকটা হতাশই হন। নয়নও বার্টের মতোই খুব সাধারণ মাপের একজন বিজ্ঞানী। বাচ্চাদের জন্য যেসব ওষুধ তৈরি হয় তার কোনও সাইড এফেক্ট আছে কি না, সেটা বোঝাই তার কাজ। কাজকর্মের ধারা দেখে স্পষ্টই বোঝা যায়, অ্যান্টিডোট তৈরির ক্ষমতা তার নেই। তা ছাড়া তার যা বয়স, তাতে নিশ্চিত ডি এন এ কারেকশনও হয়েছে।
কিন্তু তবু মনের খুঁতখুঁতুনি যায় না টিমোথির। তিনি নয়নের জীবনের প্রতিটি ছোটখাটো ঘটনা, যার রেকর্ড পিউ-এর দফতরে রয়েছে সেগুলো পরীক্ষা করতে থাকেন। করতে-করতে ডি এন এ কারেকশনের রিপোর্টে এসেই আবার একটা সাংঘাতিক চমক লাগে তাঁর। এমনকি প্রথমটায় মনে হয় তিনি বোধ হয় চোখে ভুল দেখছেন। রিপোর্টে লেখা আছে মুম্বাইয়ের যে হাসপাতালে নয়নের ডি এন এ কারেকশন হয়েছিল সেখানকার দায়িত্বে ছিলেন ডঃ সুরানা। কিন্তু ডি এন এ কারেকশনের কাজটা করেছেন ডঃ মহীয়ান দত্ত।
ডঃ সুরানা পিউ-এর একজন নিচুতলার সদস্য। পরদিন সকালেই তাঁকে ফোন করেন টিমোথি। অনেকদিন আগের কথা। কিন্তু ঘটনাটা যেহেতু বেশ অভিনব, তাই ডঃ সুরানার সবটাই বেশ স্পষ্ট মনে আছে। ডঃ দত্ত সুরানাকে বলেছিলেন গবেষণার কাজের জন্য কয়েকটা ডি এন এ কারেকশন তাঁকে নিজে হাতে করতে হবে। নয়নের মা যেহেতু তাঁর আত্মীয়। তাই ওর সন্তানের ক্ষেত্রে কাজটা তিনি করতে চান। পিউ-এর একেবারে উপরতলার সদস্যের এমন অনুরোধে স্বাভাবিকভাবেই রাজি হয়েছিলেন ডঃ সুরানা। রিপোর্টেও সেটাই লিখেছিলেন। কোনোদিন এ নিয়ে তাঁকে কেউ কোনও প্রশ্নও করেনি।
এখানেই শেষ নয়। নয়নের বায়োডাটায় এটাও লেখা আছে যে, তার যখন বছর পাঁচেক বয়স, তখন তার মায়ের অরগ্যান রিপ্লেসমেন্ট হয়। মা শয্যাশায়ী ছিলেন বলে ডঃ মহীয়ান দত্ত বিশেষভাবে আবেদন করে নয়ন দত্তকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে প্রায় চার-পাঁচ মাস রেখেছিলেন। ডঃ দত্তের ফ্যামিলি ট্রি-তে আর কোনও আত্মীয়ের ক্ষেত্রে কিন্তু তিনি এরকম করেছেন বলে দেখা যাচ্ছে না।
‘এই নয়ন দত্ত লোকটা খুবই গোলমেলে। একে এখুনি সার্ভিলেন্সের আন্ডারে নিয়ে আসা দরকার…’ আপনমনে কথাগুলো বিড়বিড় করেন টিমোথি।
নয়নের বারান্দা-বাগানের টবে একটা লতানে গোলাপের গাছ লাগানো হয়েছিল কিছুদিন আগে। নয়ন আর নীল গিয়েই জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছিল চারাটা। তাতে একটা ছোট্ট কুঁড়ি ধরেছে। সেটা দেখেই সকালবেলায় মন ভাল হয়ে গিয়েছিল নীলের। কিন্তু লতাটা মাটিতে ঝুলে পড়েছে। সেটাকে তাই তুলে একটা পাতলা সুতো দিয়ে বারান্দার ফাইবার গ্লাসের পাল্লাটার গায়ে বাঁধার চেষ্টা করছে সে এমন সময় দরজার সোলার বেলটা বেজে উঠল। ভোলু রান্নাঘরে ভারী সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে কী যেন রাঁধছে। তার দিকে হাত নেড়ে নীল নিজেই গিয়ে দরজাটা খুলল। দু‘জন অচেনা লোক। তারা এসেছে সার্ভিসিং কোম্পানি থেকে। ভোলুর সার্ভিসিং করানোর সময় হয়ে গিয়েছে।
নীল একটু আশ্চর্য হয়। ছয় বছরেরও বেশি সে নয়নের সঙ্গে এই বাড়িতে আছে। ভোলুর সার্ভিসিং এর আগেও কয়েকবার হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই নয়নই চার্ট দেখে সার্ভিসিং কোম্পানিকে খবর দেয় অথবা ভোলুকে গাড়িতে করে নিয়ে যায়। সার্ভিসিং কোম্পানি নিজে নিজে কখনও এরকম বাড়িতে আসে না। সন্দেহ হয় নীলের। কিন্তু সে মুখে কিছু বলে না। ভোলু রান্না শেষ করে আসার পর তাকে সুইচড অফ করে কাজ শুরু করে লোকগুলো। নীল একটু দূরে বসে আড়চোখে সেদিকে লক্ষ রাখে। ভোলুকে খুলে টুকটাক কীসব পরিষ্কার করে লোকগুলো। তারপর বন্ধ করার আগে তার ঘাড়ের কাছে একটা খোপে ছোট্ট একটা চিপ ঢুকিয়ে দেয়। কাজটা নজর এড়ায় না নীলের। লোকগুলো অবশ্য নীলকে মোটেই গুরুত্ব দেয় না। কারণ নীলের তো এটা দেখার কিংবা এটা নিয়ে ভাবার কথাই নয়।
নয়ন বাড়ি ফেরে সন্ধের পর। সাধারণ কিছু কথাবার্তার পর নীল নয়নকে জানায় যে আজ সার্ভিসিংয়ের লোক এসেছিল ভোলুর জন্য। “সে আবার কী! ভোলুর সার্ভিসিং তো এখনও দেরি আছে। আমি তো কোনও খবরও দিইনি।”
“তাতে কী আছে। ওরা তো ওদের রেকর্ড মেনেই এসেছে। হয়তো কোনও কারণ এবারে সার্ভিসিংটা আগে করা দরকার। তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করোনি।”
নীলের চোখের দিকে তাকিয়ে নয়ন বুঝতে পারে যে সে আলোচনাটা আর বাড়াতে চাইছে না। তাই থেমে যায় তখনকার মতো। কিন্তু রাতে রোজকার মতো ভোলুকে সুইচড অফ করার পর সে নীলকে জিজ্ঞেস করে, “ব্যাপারটা কী বলো তো? আমার মনে হল তখন তুমি কিছু চেপে গেলে?”
“তার আগে বলো তো, তুমি কি ভোলুকে খুলতে পার?”
“কেন পারব না। ছোটখাটো গণ্ডগোল হলে তো আমি নিজেই ওকে সারাই। ওকে যখন কিনেছিলাম তখনই ওগুলো আমাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খোলার জন্য কয়েকটা আলাদা যন্ত্রপাতিও আছে।” “তা হলে এখুনি ওকে খোলো।”
নয়ন নিজের ঘর থেকে থেকে যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে এসে খাবার টেবিলের উপর ভোলুকে শুইয়ে তার পিঠের স্ক্রুগুলো খুলে ফেলতেই ভিতরের যন্ত্রপাতি সব বেরিয়ে পড়ে। নীল এবার ঘাড়ের নীচের সেই খোপ থেকে টেনে বার করে চিপটা।
“এটা ভাল করে দ্যাখো। আমার ধারণা এটা একটা মনিটরিং সিস্টেম। এই চিপটা আজ সার্ভিসিংয়ের লোকেরা লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এটা কিন্তু ভোলুর ভিতরে আগে ছিল না।”
“কম্পিউটারে লাগিয়ে দেখলেই তো বোঝা যাবে।”
“না, কম্পিউটারে লাগিয়ে দেখা চলবে না। কারণ তা হলে এটা অন হয়ে যাবে। যারা এটা লাগিয়েছে তারা বুঝে ফেলবে।”
নীলের কথা শুনে একটু চিন্তা করে নয়ন। তারপর বলে, “দাঁড়াও এটার একটা ফোটো তুলে সার্চ দিয়ে দেখি। তা হলেই বুঝতে পারব।”
চিপের ফোটোটা কম্পিউটারে দিয়ে সার্চ করতেই বোঝা যায় যে নীলের সন্দেহই ঠিক। চিপটা আসলে একটা খুব উন্নতমানের মনিটরিং সিস্টেম। তাতে চারপাশের সব ঘটনার ফোটো এবং কথাবার্তা রেকর্ড হয়।
“সার্ভিসিংয়ের লোকগুলো এটা বসাল কেন বলো তো?”
“ওরা সার্ভিসিংয়ের লোক নয় নয়ন। ওরা পিউ-এর লোক। তার মানে পিউ ঘটনার সূত্র সন্ধান করতে-করতে তোমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। কতটা তোমার সম্বন্ধে জেনেছে সেটা বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু ওরা যে তোমার কাজকর্মের উপর নজর রাখছে, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। অফিসেও নিশ্চয়ই এরকম কোনও একটা ব্যবস্থা হয়েছে। সেটা তুমি টের পাওনি। বাড়ির ব্যাপারটাও তুমি টের পেতে না। কারণ ওরা যেসময় এসেছিল তখন তো তোমার বাড়িতে থাকার কথা নয়। সুতরাং ওরা যদি চিপটা বসিয়ে চলে যেত, তুমি জানতেও পারতে না। আমি থাকাতেও অবশ্য ওদের কোনও অসুবিধে হয়নি। কারণ ওরা তো ধরেই নিয়েছে যে, আমি একজন ডি এন এ কারেকশন করা মানুষ। তাই আমি ব্যাপারটা লক্ষও করব না, আমার মনে কোনও প্রশ্নও জাগবে না।”
“বুঝতে পেরেছি। আমাদের এখন খুব সতর্ক থাকতে হবে নীল। তুমি কিন্তু কোনও কারণেই তোমার ঘরে ভোলুকে ঢুকতে দেবে না কিংবা ভোলুর সামনে কোনও কিছু করবে না। কারণ অন্য রকম কিছু দেখলেই ওদের সন্দেহ হবে।”
“সেটা আমি আজ থেকেই শুরু করে দিয়েছি নয়ন। আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখছি। তবে আমার থেকেও তোমার সতর্ক হওয়াটা বেশি জরুরি। কারণ তুমি হচ্ছ মহীয়ান দত্তর বংশধর। কাজটা যে মহীয়ান দত্তই করেছেন, সেটা আমার মনে হচ্ছে ওরা আন্দাজ করেছে।”
“আমার মনে হচ্ছে ওরা আমার ডি এন এ পরীক্ষা করে দেখতে পারে। ওহ হো, কী সাংঘাতিক ব্যাপার! আজই তো ওরা আমাদের সবার ব্লাড স্যাম্পল নিলো। বলল কী একটা প্রজেক্টের জন্য যেন দরকার আছে।”
চমকে ওঠে নীল, “কী সর্বনাশ! তুমি রক্ত দিয়েছ?”
“না দেওয়ার তো কোনও উপায় নেই। সত্যি কথা বলতে কী, আমার সন্দেহও হয়নি কিছু। এখন তো আবার ট্যাবলেট এক্সপোর্ট শুরু হয়ে গিয়েছে। আর কাউকে ডেকে কিছু বলাও হয়নি। আমি নিজেও অনেকদিন অ্যান্টিডোট মেশানো বন্ধ রেখেছি। তাই ভেবেছিলাম পিউ বোধ হয় হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি মোটেই তা নয়।”
“একেবারেই নয়। আমারা ধারণা তোমাকে ফাঁদে ফেলার জন্যই ওরা এরকম একটা গা-ছাড়া ভাব দেখাচ্ছে। আসলে ওরা একটু-একটু করে জাল গুটিয়ে আনছে।”
ভূমধ্যসাগরের একটা নির্জন দ্বীপে সমুদ্রের ধারে পিউ-এর মিটিংয়ে বসে ঠিক এই জাল গুটিয়ে আনার কথাটাই বলছিলেন টিমোথি, “আমি এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে, অ্যান্টিডোটটা তৈরি করেছেন মহীয়ান দত্ত। ওঁর ওইরকম একটা ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে বসে কীভাবে কাজটা করলেন সেটা অবশ্য বলতে পারব না। তবে মারা যাওয়ার আগে তিনি নয়ন দত্তকে অ্যান্টিডোটটা দিয়ে গিয়েছেন সেটাও বুঝতে পারছি। আমার মনে হয় নয়নের বাড়ি তল্লাশি করলে এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণও পাওয়া যাবে। সেই কারণেই ওকে সারাক্ষণ মনিটার করার ব্যবস্থাও হয়েছে। ডঃ দত্ত যে নয়নকেই এই কাজের ভার দিয়েছেন তারও একটা কারণ আছে। ডি এন এ পরীক্ষা করে আমরা বুঝতে পেরেছি যে নয়ন একজন স্বাভাবিক মানুষ। তার ডি এন এ কারেকশন করা হয়নি। ডঃ দত্ত সুরানাকে বলেছিলেন যে, তিনি নিজে কারেকশনের কাজটা করবেন। কিন্তু তিনি কোনও কারেকশনই করেননি। তার মানে তখন থেকেই হয়তো তিনি খুব সচেতনভাবে পরিকল্পনা করে নয়ন দত্তকে এই কাজের ভার দেবেন বলে ঠিক করেছিলেন। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ কোনও ডি এন এ কারেকশন করা মানুষ যে একাজটা করতে পারবে না, সেটা ওঁর থেকে ভাল আর কে জানে?”
“কিন্তু নয়ন দত্ত ওই ল্যাবরেটরিতে কাজ করলেও সে তো বাচ্চাদের ট্যাবলেট তৈরি করে না। যদি ওর কাছে অ্যান্টিডোট থাকেও, তা হলে ও সেটা ট্যাবলেটে মেশাবে কী করে?”
“এইখানেই এখনও পর্যন্ত একটা ছোট্ট মিসিং লিঙ্ক রয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের লোকেরা হেনরি বার্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। যদি জানা যায় ওষুধটা তৈরির সময় নয়ন কোনোভাবে সেখানে ছিল, তা হলে আমরা সঙ্গে-সঙ্গে কাজে নেমে পড়ব।”
স্নান করে বেরিয়ে এসে চুল আঁচড়াচ্ছিল নীল। মনটা একটু ভার হয়ে রয়েছে। কীরকম যেন মনে হচ্ছে নয়নের চারপাশে একটা বিপদ ঘনিয়ে আসছে। এই কয়েক বছরে নয়নকে ভারী ভালবেসে ফেলেছে সে। তাই তাকে কী করে এই বিপদ থেকে বাঁচানো যায়, সেই চিন্তাটাই সারাক্ষণ তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ টেবিলের উপর রাখা সোলার ডায়েরিতে সবুজ আলো জ্বালিয়ে বিপ বিপ করে উঠল। সবুজ আলো মানে অচেনা কারও মেসেজ। নীলের চেনা মানুষ তো নয়ন ছাড়া আর কেউ নেই। তাই অচেনা নম্বর থেকে মেসেজ এলে সাধারণত খুলে দেখে না। কিন্তু আজ কী মনে হতে মেসেজটা খুলেই চমকে উঠল নীল। তাড়াতাড়ি বাথরুমের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল আবার। নয়নের মেসেজ।
নয়ন লিখেছে, “আমার মনে হচ্ছে আমাকে ওরা ট্র্যাপ করে ফেলেছে। ইদানীং রোজই খেয়াল রাখছিলাম। আজ অফিসে এসে দেখলাম হেনরি নিজের সিটে নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ওকে নাকি উপরঅলারা ডেকে পাঠিয়েছে। আমি যে প্রায়ই ফাইনাল মিক্সিংয়ের দিন হেনরির ঘরে যেতাম, সেটা হেনরিকে জিজ্ঞেস করলে ও নিশ্চয়ই বলে দেবে। আমার উপরও যে নজরদারি চলছে সেটাও স্পষ্ট। কারণ খবরটা পেয়েই আমি ঠিক করেছিলাম এখান থেকে বেরিয়ে যাব। কিন্তু হেনরিদের ডিপার্টমেন্ট থেকে নিজের ঘরে ফিরতেই রহিম শাহ ফোন করে বললেন, ওঁকে না জানিয়ে আমি যেন ল্যাব ছেড়ে কোথাও না যাই। আমার সঙ্গে ওঁর জরুরি দরকার আছে। আমি তারপরেও বেরনোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমার পাস কার্ড ইতিমধ্যেই ডিঅ্যাক্টিভেট করে দেওয়া হয়েছে। কার্ডের পাসওয়ার্ড দিয়েও দরজা খুলল না। মনে হচ্ছে এখন আর কিছু করার নেই। আমার কলিগ ফাতিমা ওর সোলার ডায়েরিটা কাল ল্যাবে ফেলে চলে গিয়েছে। আজ ফাতিমা আসেনি। তাই এটাতে তোমায় মেসেজ করছি। আমার ডায়েরিতে কিছু লেখা ঠিক হবে না। ওটা নিশ্চয়ই ওরা মনিটর করছে।”
মেসেজটা পড়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল নীল। তারপর লিখল, “তোমার ওখান থেকে বেরনোর আর কোনও রাস্তা কি আছে?”
নয়নের উত্তর এলো সঙ্গে-সঙ্গেই, “একমাত্র উপায় সুপারসনিক কার। ওটা যাতে আমাদের অফিসের হ্যাঙ্গারে নামানো যায়, তার ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু আমি তো ওটা আজ নিয়ে আসিনি। অধিকাংশ দিনই নিয়ে আসি না। তাই হ্যাঙ্গারে যাওয়ার জন্য যে দরজা, তার পাসওয়ার্ড এখনও কাজ করছে। ওটা ওরা ডিঅ্যাক্টিভেট করা দরকার মনে করেনি।”
নীল লিখল, “তোমার সুপারসনিক কার নিয়ে আমি যাচ্ছি। তুমি বেরনোর দরজার কাছাকাছি থাকবে। আমি সিগন্যাল দিলেই বেরিয়ে এসে উঠে পড়বে।”
মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে খুব স্বাভাবিক মুখ করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো নীল। ভোলু তখন ঘরদোর ডাস্টিং করছে। তাকে বলল, “আমার আজকে ডাক্তারের সঙ্গে একটা ডেট আছে ভোলু। আমি একবার বেরচ্ছি। দুপুরের খাবারের আগেই ফিরে আসব।”
ভোলু মাথা নেড়ে সায় দিতেই তার চোখ এড়িয়ে দরজার পাশে আলমারির উপর ভাঁজ করে রাখা সুপারসনিক কারটা ব্যাগে ভরে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল নীল। নয়নের সঙ্গে নিয়মিত জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়ার সময় এই গাড়িটা চালানো সে খুব ভাল করে শিখে নিয়েছে। সুপারসনিক কারে নয়নদের ল্যাবে পৌঁছতে মিনিট দশেকের বেশি সময় লাগল না। সিগন্যাল আগেই দেওয়া ছিল। গাড়িটা এসে হ্যাঙ্গারে দাঁড়াতেই উঠে পড়ল তাতে। কোনও দিকে না তাকিয়ে গাড়ি নিয়ে আকাশে উড়ান দিল নীল।
হাতে সময় খুব কম। নয়ন যে ওখান থেকে পালিয়েছে সেটা বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। আর তারপরেই ব্লাড হাউন্ড কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে-শুঁকে তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে পিউ-এর দলবল।
“আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি নীল?” ভীষণ উদ্বিগ্ন আর বিষণ্ণ গলায় জানতে চায় নয়ন।
“আপাতত তুমি আমাকে যেখান থেকে তুলে এনেছিলে সেখানটায় যাব। বাকি কথা সেখানে গিয়ে বলছি। এখন অন্যমনস্ক হলে বিপদ বাড়বে।”
খুব দ্রুত কিন্তু নিপুণ হাতে গাড়িটাকে চালিয়ে জঙ্গলের ভিতর যে জায়গাটায় নীলকে প্রথম দেখেছিল নয়ন, সেখানে এসে গাড়িটাকে দাঁড় করাল নীল। তারপর নয়নের দিকে ফিরে বলল, “আজ তোমাকে কতগুলো কথা বলব নয়ন। এতদিন বলিনি। ভেবেছিলাম হয়তো বলার দরকার হবে না। কিন্তু এখন আর না বললেই নয়।”
নীলের গলায় কেমন যেন একটা অন্য রকম সুর। অবাক হয়ে বন্ধুর দিকে তাকায় নয়ন।
“গল্পটা শুরু করতে হবে একটু পিছন থেকে। প্রায় পাঁচশো বছর আগের কথা। পৃথিবী তখন একটা সাংঘাতিক সংকটের ভিতর দিয়ে চলছে। বাতাসে দূষণ ভীষণ বেড়ে গিয়েছে। ক্রমশ বাড়ছে তাপমাত্রা। গলে যাচ্ছে মেরুপ্রদেশের হিমবাহ। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছিলেন এভাবে চললে পৃথিবীর অস্তিত্ব খুব বেশিদিন টিকে থাকবে না। তখন তাঁরা একটা সিদ্ধান্ত নেন। একদল বিজ্ঞানী প্রাণপণে গবেষণা করতে থাকেন কীভাবে পৃথিবীকে এই বিপদ থেকে বের করে আনা যায়। আর-একদল বিজ্ঞানী, সঙ্গে কিছু নানা ধরনের উৎসাহী মানুষকে নিয়ে একটি মহাকাশযানে চেপে বেরিয়ে পড়েন, এই সৌরজগতের বাইরে কোথাও পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য গ্রহ আছে কি না তার সন্ধানে। মজার ব্যাপার হচ্ছে দু‘দলই কিন্তু নিজেদের লক্ষ্যে সফল হয়েছিলেন। প্রথম দলের সাফল্য তো তুমি নিজেই দেখছ। দ্বিতীয় দলটিও শেষ পর্যন্ত ঠিক পৃথিবীর মতোই সবুজ, জল আর অক্সিজেনে ভরপুর একটি গ্রহের সন্ধান পান। তার নাম তাঁরা দেন ‘সেকেন্ড আর্থ’ বা ‘দ্বিতীয় বিশ্ব’। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সেখানে পৌঁছনোর পরে তাঁদের মহাকাশযানটি খারাপ হয়ে যায়। ফলে তাঁরা আর ফিরতে পারেন না, সেই নতুন গ্রহেই তাঁদের থেকে যেতে হয়। সেখানে তাঁরা বসতি তৈরি করেন। জনসংখ্যা ক্রমশ বাড়ে। পৃথিবীর মতোই লেখাপড়া, বিজ্ঞান, শিল্প সবেরই চর্চা চলতে থাকে। কিন্তু বুঝতেই পারছ বিজ্ঞানের চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেসব উপকরণ দরকার, তার অনেক কিছুই তো সেখানে নেই। তাই এখানে যেমন সভ্যতা অনেক দ্রুত এগিয়েছে, ওখানে সেরকমটা হয়নি।
“কিন্তু তা হলেও প্রায় পাঁচশো বছরের চেষ্টায় বিজ্ঞানীরা শেষ পর্যন্ত এমন একটা মহাকাশযান বানাতে সক্ষম হন যেটাতে চড়ে আগের পৃথিবীতে ফিরে আসা যায়। কিন্তু সেই পৃথিবী কেমন আছে, আদৌ আছে কি না, তা তো কেউ জানে না। হতেই পারে ক্রমশ গরম হতে-হতে পৃথিবী একটা উল্কাপিণ্ডে পরিণত হয়েছে। মানুষের অস্তিত্বই মুছে গিয়েছে। তাই ঠিক হয়, প্রথমে আমি একাই আসব পৃথিবীতে। দেখব সেখানকার অবস্থাটা কীরকম। সেখানকার মানুষের সঙ্গে মিশব, কথা বলব। আমার কাছ থেকে সব শুনে তারপর ঠিক হবে পরবর্তী পদক্ষেপ। যেদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয় সেদিন তার একটু আগেই আমি এই পৃথিবীতে প্রথমবার পা রেখেছিলাম। নামার পর পা টলমলে ছিল। তাই পড়ে গিয়ে পাথরে মাথা ঠুকে অজ্ঞান হয়ে যাই। এবার বুঝতে পারছ তো সেদিন আমি কেন ডাক্তারকে বলেছিলাম যে, আমার কিছুই মনে পড়ছে না। সত্যি কথা বললে তখন তুমিও কি আমার কথা বিশ্বাস করতে?”
নয়নের হতবাক মুখের দিকে তাকিয়ে নীল একটু হেসে বলে, “সবই তো বললাম নয়ন। এবার তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তুমি কী করবে। সামনে দুটো রাস্তা খোলা আছে। পিউ-এর হাতে ধরা পড়ে বাকি জীবনটা ধ্বংস করে দেওয়া অথবা আমার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বে চলে যাওয়া। তবে মনে রেখো দ্বিতীয় বিশ্ব তোমাদের এই পৃথিবীর থেকে এখনও প্রায় পাঁচশো বছর পিছিয়ে আছে। সেখানে এখনও মানুষ চাষ করে ফসল ফলায়। একশো বছরও কেউ বাঁচে না। অসুখ আর জরার কষ্ট দুই-ই তাদের পেতে হয়। তবে তারা কিন্তু মনের আনন্দে গান গায়, বাঁশি বাজায়, গল্প-কবিতা পড়ে। ছোট ছেলেমেয়েদের ডি এন এ কারেকশন হয় না, তারা নিজেদের খুশিমতো বেড়ে ওঠে…”
নীলের কথায় বাধা দিয়ে নয়ন বলে ওঠে, “কিন্তু নীল এটা কি পালিয়ে যাওয়া হবে না? আমি যে মহীদাদুকে কথা দিয়েছিলাম, তাঁর স্বপ্ন পূরণ করব।”
“সে কথা তো তুমি রেখেছ। যে লক্ষ-লক্ষ ছেলে-মেয়ে ওই অ্যান্টিডোট খেয়েছে, তারা তো স্বাভাবিক মানুষ হিসেবেই বড় হবে। পিউ-এর কথা মতো তারা চলবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাক, একদিন তারাই পিউ-এর সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেবে। তখন যদি আবার আমার মতো কেউ এখানে আসে, তা হলে সে নিশ্চয়ই ফিরে গিয়ে শুভ সংবাদটি জানাবে।”
নয়ন এবার দু‘হাতের মুঠোয় নীলের হাতটা চেপে ধরে বলে, “বেশ তাই হোক তা হলে। চলো, তোমার সঙ্গে তোমাদের বিশ্বেই যাই…”
নীল এগিয়ে গিয়ে সেই বুনো গোলাপের ঝোপের পিছনে ফুলে ভরা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে কিছুটা মাটি খুঁড়ে গোল চাকতির মতো একটা জিনিস বের করে। তারপর তাতে কতগুলো বোতাম টিপে আকাশের দিকে তুলে ধরতেই সেটা থেকে খুব সূক্ষ্ম একটা সরু আলোর রেখা বেরিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যায়। একটু পরেই যেখানে সেই আলোর রেখাটা মিলিয়ে গিয়েছে, সেখানে দেখা যায় একটা উজ্জ্বল রূপোলী বিন্দু। ক্রমশ সেটা বড় হতে থাকে। তারপর এক সময় একটা চারকোনা জিনিস নয়নদের ঠিক সামনে এসে দাঁড়ায়।
“উঠে পড়ো নয়ন। পিউ-এর লোকেরা জানতে পেরে গিয়েছে তুমি এখানে আছ।”
নীলের কথায় চমকে উঠে নয়ন দ্যাখে অনেক কুচকুচে কালো সুপারসনিক কার একটা দড়ির ফাঁসের মতো আকাশপথে তার দিকে ছুটে আসছে। আর দেরি না করে সে পা রাখে মহাকাশযানে। নীল উঠে দরজা বন্ধ করে বোতাম টিপতেই বিদ্যুৎ গতিতে উপরে উঠতে থাকে মহাকাশযান। তার স্বচ্ছ দেওয়ালে চোখ রেখে নয়ন অবাক হয়ে দেখে কীরকম অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে তার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে প্রথম বিশ্ব!
সমাপ্ত