মহীদাদুর এন্টিডোট – ৪

একদম প্ল্যান মাফিক, সেই মাসের তৃতীয় বুধবারের প্রায় এক সপ্তাহ আগে নয়ন একদিন হেনরির ঘরে যায়। তার সঙ্গে নানা রকম গল্পটল্প করে জানায়, যে একটা নতুন প্রজেক্টের জন্য এই ট্যাবলেট তৈরির পদ্ধতিটা সম্বন্ধে তার জানা দরকার। কিন্তু যেহেতু তাদের ল্যাবরেটরির কাজের সঙ্গে এটার কোনও যোগ নেই, তাই হেনরি যদি তাকে সাহায্য করে তা হলে তার খুব উপকার হবে। আপত্তির কোনও কারণ নেই। হেনরি রাজি হয়ে যায় আর নয়নও মাসের তৃতীয় বুধবারে অ্যান্টিডোটের খুদি-খুদি ক্যাপসুলে ভরা শিশিটা জামার মধ্যে ভরে নিয়ে হাজির হয় হেনরির ঘরে।

ফাইনাল মিক্সিংয়ের কাজ চলছে। স্বাভাবিকভাবেই হেনরি সেদিন একটু ব্যস্ত। তাই নয়ন তাকে বলে, “তুমি তোমার কাজ করো। আমি বরং আজ একটু পুরো ব্যাপারটা ঘুরে দেখি।”

হেনরি খুশি হয়ে মাথা নেড়ে নিজের কাজে চলে যেতেই নয়ন এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে হাজির হয় ফাইনাল মিক্সিংয়ের মস্ত কন্টেইনারের কাছে। তারপর খুব সতর্কভাবে চারদিকটা দেখে নিয়ে অ্যান্টিডোটের ক্যাপসুলগুলো তার মধ্যে ফেলে দেয়। কন্টেইনারের মধ্যে অটোমেশনে সব উপাদান খুব দ্রুত মেশানোর কাজ চলছে। তাই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ক্যাপসুলগুলো গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে মিশে যায়। সেগুলোকে আলাদা করে চেনার আর কোনও উপায়ই থাকে না।

পুরো কাজটা করে ফেলার পর বুকের ধড়ফড়ানি একটু কমলে নয়ন যতখানি সম্ভব স্বাভাবিক মুখে হেনরির টেবিলের কাছে এসে দেখে যে হেনরি ততক্ষণে ফিরে এসেছে, “কোথায় ছিলে তুমি? একটু সময় পাওয়া গিয়েছে। চলো একসঙ্গে দু‘কাপ কফি খেয়ে নেওয়া যাক।”

কফির মাগটা নয়নের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে হেনরি। নয়নের তো অনেকক্ষণ ধরেই গলা-বুক শুকিয়ে কাঠ। তাই গরম কফির কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বলে, “আচ্ছা হেনরি, এই যে মিক্সিং হচ্ছে এর থেকে কত ওষুধ তৈরি হবে?”

“বাচ্চাদের এই ট্যাবলেটগুলো তো খুবই ছোট-ছোট। একটা মিক্সিং কন্টেইনার থেকে মোটামুটি দশ লক্ষ ট্যাবলেট তৈরি হয়। তুমি জান কি না জানি না, সারা পৃথিবীতে মাত্র দুটো সংস্থা এই ট্যাবলেটটা তৈরি করে। আমরা আর নিউজিল্যান্ডের একটা কোম্পানি। তবে তাদের উৎপাদন আমাদের তুলনায় অনেকটাই কম।”

হেনরির সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করে নিজের ঘরে ফিরে আসে নয়ন। তারপর সেদিন রাতে ভোলুকে সুইচড অফ করার পর নীলকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মহীদাদুর স্বপ্ন আমি শেষ পর্যন্ত সফল করতে পারলাম নীল। পৃথিবীর অন্তত দশ লক্ষ শিশু স্বাভাবিক মানুষের জীবন ফিরে পাবে। ভাগ্যিস তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। না হলে তো এই কাজটা করতেই পারতাম না।”

“দশ লক্ষটা কিন্তু পৃথিবীর জনসংখ্যার তুলনায় নেহাতই কম নয়ন। মহীদাদু চেয়েছিলেন পিউ-এর এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে। যদি সত্যিই সেটা করতে হয়, তা হলে কিন্তু তোমার এইটুকুতেই সন্তুষ্ট হলে চলবে না,” নীলের কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ে নয়ন।

পরপর ছয় মাস, প্রতি তৃতীয় বুধবারে নানা অজুহাতে হেনরির ঘরে গিয়ে কন্টেইনারে অ্যান্টিডোটের ক্যাপসুল মিশিয়ে আসে নয়ন। হেনরির সঙ্গে ইতিমধ্যে তার বেশ ভাবও হয়ে গিয়েছে। তাই সে কোনও সন্দেহ করেনি। কিন্তু তবু সাবধানতার জন্য মাঝখানে মাস তিনেক কাজটা বন্ধ রাখে নয়ন। ইচ্ছে করেই বুধবার বাদ দিয়ে অন্যদিনে হেনরির ঘরে যায়। বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে। তথ্য সংগ্রহের ভান করে। তারপর আবার পরপর ছয় মাস লুকিয়ে কন্টেইনারে অ্যান্টিডোটের ক্যাপসুল মিশিয়ে দেয়।

“মহীদাদুর ফরমুলা অ্যান্টিডোট তো মেশালাম। কিন্তু তাতে আদৌ কোনও কাজ হবে কি?”

নয়নের প্রশ্নটা শুনে নীল একটু আশ্চর্য হয়ে বলে, “তোমার এরকম সন্দেহ হচ্ছে কেন?”

“তার কারণ, মহীদাদু ফরমুলাটা তৈরি করেছিলেন। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষাও করেছিলেন। কিন্তু মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে তো দেখতে পারেননি। তাই সেখানে যদি কোনও সমস্যা হয়ে যায়?”

“সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। যদিও তোমার কাছে যা শুনেছি, তাতে আমার মনে হয় না ওঁর মতো বড় মাপের একজন বিজ্ঞানী বিষয়টা সম্বন্ধে একদম নিশ্চিত না হয়ে তোমাকে এরকম একটা কাজের দায়িত্ব দেবেন।”

“মুশকিলটা কী বলো তো নীল, অ্যান্টিডোটটা কাজ করছে কি না, সেটা বোঝার আমার কোনও উপায় নেই। কারণ যেসব বাচ্চার শরীরে এটা যাচ্ছে, তাদের ডি এন এ যদি আগের অবস্থায় ফিরেও আসে, তা হলেও তো আমি সেটা জানতে পারব না।”

“আমার মনে হয় তুমি জানতে পারবে। তবে সেই জানাটা তোমার পক্ষে কতটা বিপজ্জনক হবে সেটা বলতে পারছি না। তাই সেই ভাবনাটা আপাতত তুলে রেখে যত বেশি সম্ভব বাচ্চার শরীরে অ্যান্টিডোট পাঠানো যায় সেই কাজটা করাই ভাল। অবশ্যই যতটা সম্ভব সাবধানে। কোনওমতেই যেন কারও সন্দেহ না হয়।”

অস্ট্রিয়ার বাকাও ভ্যালি। দানিয়ুব নদীর ধারে আঙুরের খেত। সোনালি রোদে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। একপাশে একটা পুরনো দুর্গ। আসলে অবশ্য দুর্গ নয়, অনেকটা দুর্গের ধাঁচে তৈরি একটা ভিলা। পাঁচিলের গা বেয়ে উঠেছে আঙুরলতা। থোকা থোকা কালো আঙুর ফলে আছে তাতে। ভিলার ভিতরে একটা ঘরে, লম্বাটে টেবিলের চারপাশে বসে আছেন বেশ কয়েকজন মানুষ। অমন সুন্দর একটা পরিবেশে থাকা সত্ত্বেও তাঁদের কারও মুখে কিন্তু হাসি নেই, বরং কপালে ভয়ংকর দুশ্চিন্তার ভ্রুকুটি। এখানে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা সকলেই পিউ-এর সর্বোচ্চ কমিটির মেম্বার। প্রেসিডেন্টের অত্যন্ত জরুরি তলব পেয়ে সকলকে হাজির হতে হয়েছে। পিউ-এর এখন যিনি প্রেসিডেন্ট তাঁর নাম ক্রিস্টাল ক্রেটন। ডেনমার্কের বাসিন্দা। রোগা, লম্বা, খড়গনাসা, রূপোলী চুল। অন্য সদস্যদের মধ্যে দু‘জন বিজ্ঞানী আছেন। তাদের একজন হলেন মুসায়া মাব্বা, তিনি পেরুর লোক। অন্যজন কৃষ্ণ উডুগু, যাঁর বাড়ি শ্রীলঙ্কায় হলেও ইদানীং থাকেন কানাডায়।

ক্রেইন অভ্যেসমতো হাতের আঙুলের গাঁটগুলো বারকয়েক টেবিলে ঠুকে বললেন, “ডিয়ার মেম্বার্স, আমি এতটাই চিন্তিত যে কথাটা কীভাবে শুরু করব সেটাই বুঝতে পারছি না। আমাদের পারফেক্ট ইউনিভার্স প্রজেক্ট আজ একটা সাংঘাতিক বিপদের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা এতদিন ধরে বহু চেষ্টায় মানুষের সব রকম অপ্রয়োজনীয় ইচ্ছে এবং চিন্তাভাবনাকে ছেঁটে ফেলার একটা ব্যবস্থা করেছিলাম। এর ফলে মানবসভ্যতা অনেক উন্নত হয়েছে। মানুষ এখন অনেক বেশি কাজ করতে পারে। কল্পনা কিংবা অবাস্তব চিন্তাভাবনা করে সময় নষ্ট করে না। আমরা যারা পৃথিবীটাকে চালাই, তারা সবদিক বিবেচনা করে যেসব সিদ্ধান্ত নিই, সেগুলোই তারা মেনে নেয়। প্রতিবাদ করার কিংবা নিজেদের খুশিমতো চলার ইচ্ছেও তাদের হয় না। এর ফলে আপনারা সবাই নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে সারা বিশ্বে এখন পরিপূর্ণ শান্তি বিরাজ করছে। কোনও রকম হিংসা, হানাহানি, যুদ্ধ, বিদ্রোহ, বিপ্লব কিছুই এখন আর হয় না। কিন্তু এই শান্তি অনেকের সহ্য হচ্ছে না। তারা মানুষ, নাকি এই সৌরজগতের বাইরের কোনও প্রাণী আমি এখনও জানি না। কিন্তু তারা যে একটা গভীর ষড়যন্ত্র করছে সেটা আমরা বুঝতে পেরেছি।

“ঘটনার সূত্রপাত ঠিক এক বছর আগে। পিউ-এর একদম নিচু স্তরের যারা সদস্য, তাদের মধ্যে কয়েকজন একটা ভারী আশ্চর্যজনক খবর আমাদের দেয়। আমরা মানে আমি এবং আমাদের দুই ভাইস প্রেসিডেন্ট কিম আর টিমোথিই প্রথমে কথাটা শুনি। খবরটা হল ইদানীং জাপানের কিছু জায়গায় বাচ্চাদের মধ্যে অদ্ভুত ধরনের প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। তারা তাদের যে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে সেটা সব সময় মানতে চাইছে না। শুধু তাই নয় তারা নাকি ছবি আঁকছে, গান গাইছে, বানিয়ে-বানিয়ে গল্প বলছে। বুঝতেই পারছেন কথাটা শুনে আমাদের প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। কারণ এই বাচ্চাদের সবারই ডি এন এ কারেকশন হয়েছে। তারপর এই ধরনের প্রবণতা থাকার কোনও আশঙ্কাই নেই। তাই আমরা বিষয়টাকে প্রথমে তেমন গুরুত্বও দিইনি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ফ্রান্স, জার্মানির মতো অনেক দেশ থেকেই এরকম খবর আসতে শুরু করে এবং আমরা যথাযথভাবে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি প্রতিটি খবরই সত্যি।

“বিপদের গুরুত্ব আঁচ করে মাস ছয়েক আগে আমি, কিম আর টিমোথি একটা মিটিং করি। আমাদের মনে হয়েছিল এর পিছনে একটাই কারণ থাকতে পারে। কোনও কারণে এইসব বাচ্চাদের ডি এন এ কারেকশন ঠিকঠাক হয়নি। যাঁরা কাজটা করেছেন তাঁদের কাজে গাফিলতি ছিল। সেক্ষেত্রে তাদের জন্য যে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা হবে সেটাও আমরা ভেবে নিয়েছিলাম। কিন্তু তার আগে ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া দরকার ছিল। আজ আমাদের মধ্যে ডঃ মাব্বা আছেন। উনি জানেন যে এই পর্যায়ে আমরা ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল গণ্ডগোলটা বুঝতে বাচ্চাগুলোর ডি এন এ পরীক্ষা করে দেখা। পিউ-এর কয়েকজন চিকিৎসক সদস্যের সাহায্যে আমরা যেসব শিশুকে অস্বাভাবিক বলে চিহ্নিত করা গিয়েছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের ডি এন এ সংগ্রহ করি। মাব্বা নিজে তাঁর ল্যাবরেটরিতে সেগুলো টেস্ট করেন। তার যা ফল এসেছে সেটা দেখেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে আপনাদের সকলকে আজকের মিটিংয়ের জন্য ডেকেছি।”

প্রেসিডেন্টের কথা শুনে পিউ-এর সদস্যদের মুখে স্বাভাবিকভাবেই বিস্ময় এবং আশঙ্কার ছাপ ফুটে উঠল। ওদেরই মধ্যে একজন অ্যানা গিনেসবার্গ আর নিজেকে সামলাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, “ডি এন এ পরীক্ষায় আপনারা কী পেলেন ক্রিস্টাল?”

“পরীক্ষায় জানা গিয়েছে ওদের কারোরই কোনও রকম ডি এন এ কারেকশন হয়নি। একজন স্বাভাবিক মানুষের ডি এন এ যেমন থাকে, ওদেরও ঠিক তেমনই আছে। বুঝতেই পারছ সেজন্যই ওরা একজন পারফেক্ট ইউনিভার্সের শিশুর যেমন ব্যবহার করা উচিত তেমন ব্যবহার করছে না।”

“কী সর্বনাশ, তার মানে ওদের ডি এন এ কারেকশন হয়নি?” “আমাদের কম্পিউটার ডেটা বলছে অবশ্যই হয়েছে। অপারেশনের

পর কারেকটেড ডি এন এ-এর ছবিও আমাদের কাছে রয়েছে।” “তা হলে কী করে এটা সম্ভব হল?”

“সেটাই তো আমরা বুঝতে পারছি না। কারেকশন হয়ে যাওয়া ডি এন এ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরল কী করে? বাচ্চাদের মাবাবাকে অন্যভাবে জিজ্ঞেসবাদ করা হয়েছে। তাঁরা কিছুই জানেন না। যেসব ডাক্তারদের কাছে তাঁরা বাচ্চাকে নিয়ে যান, তাঁরাও কিছু বলতে পারেননি…” হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন ক্রিস্টাল। তাঁকে চুপ করতে দেখে কিম বলেন, “আপনারা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই যে পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক। কারণ শিশুদের কিছু করার ক্ষমতা আমাদেরও নেই। পৃথিবীতে এখন শিশুমৃত্যুর হার শূন্য। অথচ এই বাচ্চাগুলো যদি বড় হয়, তা হলে পারফেক্ট ইউনিভার্সের ব্যাল্যান্সটাই পুরো নষ্ট হয়ে যাবে।”

টিমোথি এতক্ষণ চুপ করে দুজনের কথা শুনছিলেন। এবার তিনি তাঁর স্বাভাবিক শান্ত কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে কেটে-কেটে বলেন, “ সবচেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার হচ্ছে যে আমাদের হাতে এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই। আমরা জানি না যতজন বাচ্চাকে আমরা আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি, তার বাইরে আরও কত এরকম বাচ্চা আছে। এও জানি না সেই সংখ্যাটা প্রতিদিন বাড়ছে কি না ৷ ঘটনাটা কীভাবে ঘটছে বুঝতে পারা যাচ্ছে না বলেই, এটাকে কী করে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে সেটাও আমরা বুঝতে পারছি না। আসলে ক্রিস্টাল আপনাদের সকলকে আজ এজন্যই ডেকেছেন, যাতে আমরা সবাই মিলে আলোচনা করে কীভাবে এগোব তার একটা রাস্তা ঠিক করতে পারি।”

পিউ-এর অন্য মেম্বাররা সকলেই এতক্ষণ খুব মন দিয়ে এঁদের কথা শুনছিলেন। সকলেরই মুখে চোখে গভীর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। নিজের কফির কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে ক্রিস্টাল বললেন, “ডঃ মাব্বা, একজন বিজ্ঞানী হিসেবে আপনার কী মনে হয়, কীভাবে এটা হতে পারে? আপনি তো নিজে ডি এন এ টেস্ট করেছিলেন। ডঃ উডুগু আপনারই বা কী মত?”

ডঃ মাব্বা চিন্তিত মুখে তাঁর হাতে ধরা পামটপে খুটখাট করছিলেন। এবার সেটা সরিয়ে রেখে বললেন, “দেখুন, গত কয়েকদিন ধরেই আমি এই বিষয়টা নিয়ে ক্রমাগত পড়াশোনা এবং খোঁজখবর করে যাচ্ছি। ডি এন এ কারেকশন একবার হয়ে যাওয়ার পর আবার সেটাকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনার কোনও পদ্ধতি এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। কোনও দেশেই কেউ এবিষয়ে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা গবেষণাও করছে না। করলে সেটা আমরা ঠিকই জানতে পারতাম। আর তেমন করার কোনও কারণও নেই। ডি এন এ কারেকশনে ঠিক কী হচ্ছে সেটা আমরা পিউ-এর এই কয়েকজন মেম্বার ছাড়া আর কেউই জানি না। কিন্তু তা হলে কি আমরা ধরে নেব ঘটনাটা প্রাকৃতিক, আপনা থেকেই ঘটেছে?”

কিম-এর কথার উত্তরে মাথা নাড়লেন ডঃ উডুগু, “না, প্রাকৃতিকভাবে এটা হওয়া সম্ভব নয়। অন্তত এত তাড়াতাড়ি তো নয়ই। কোনও কারণ নিশ্চয়ই আছে। সেটাকে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।”

“এতক্ষণ ধরে আলোচনাটা কিন্তু একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ” বেশ একটু বিরক্ত গলায় কথাটা বললেন জার্মানির জন গ্র্যান্ডি, “কেন হল সেটা যদি এখন বোঝা নাও যায়, কীভাবে হচ্ছে সেটা বোঝার তো চেষ্টা করতে হবে, যাতে আমরা অন্তত ব্যাপারটাকে কন্ট্রোল করতে পারি।”

মার্ক চাগাল টার্কির একজন খুব নামকরা চিকিৎসক। তিনি একটু অতিরিক্ত চুপচাপ মানুষ। সহজে কথা বলেন না। কিন্তু আজ পরিস্থিতি খুবই জটিল। মার্ক তাই সামান্য গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “আমরা বুঝতে পারছি যে ঘটনাটা প্রাকৃতিক নয়। লজিক্যালি দেখলে, সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের শরীরে এমন একটা কিছু ঢুকেছে যা ডি এন এ-এর চেহারাটা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে, মানে সোজা কথায় বলতে গেলে একটা কোনও অ্যান্টিডোট ওদের শরীরে গিয়েছে। এখন সেটা কেউ সচেতনভাবে করেছে নাকি কোনোভাবে চলে এসেছে সেটা আমরা পরে খোঁজ নিয়ে দেখব। কিন্তু আমার মনে হয় আগে বোঝা দরকার কীভাবে এটা শরীরে ঢুকছে। সাধারণত এই দুটো পদ্ধতিতে শরীরে অ্যান্টিডোট ঢোকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। প্রথমত খাবার আর দ্বিতীয়ত ওষুধ।”

“এগজ্যাক্টলি সো…” মার্কের কথায় সায় দিয়ে বলে উঠলেন আর এক সদস্য সিহান নঈম।

সিহানের দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা নেড়ে মার্ক বললেন, “ঘটনাটা শুধু বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। এখনও পর্যন্ত বড়দের ক্ষেত্রে এরকম কোনও কিছু আমাদের রাডারে ধরা পড়েনি। তার মানে খাবার এবং ওষুধ যা শুধু বাচ্চাদের জন্য ব্যবহার করা হয় সেগুলো প্রথমে পরীক্ষা করা দরকার। ক্রিস্টাল, কোনও বিশেষ অঞ্চলের শিশুদের মধ্যেই এরকম হচ্ছে বলে কি আপনাদের মনে হয়েছে?”

মাথা নেড়ে ক্রিস্টাল বললেন, “উঁহু, একমাত্র নিউজিল্যান্ড আর তার আশপাশের কয়েকটা দেশ থেকে এখনও কোনও খবর আসেনি। যদিও আমার ধারণা ওখানে পিউ-এর গ্রাউন্ড লেভেলের যেসব কর্মী আছেন তাঁরা বিপদ সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন নয় বলেই এটা হয়েছে। এছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আমরা এই ধরনের এক বা একাধিক বাচ্চাকে আইডেন্টিফাই করেছি।”

“তবু এটা নোট রাখা দরকার। নিউজিল্যান্ড বা তার আশপাশের দেশের বাচ্চার কী ধরনের খাবার খায় আর ওষুধ ব্যবহার করে সেটা আমাদের একটা সার্ভে করে দেখতে হবে।”

“তা হলে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হবে বাচ্চাদের রোজকার খাবার আর ওষুধ পরীক্ষা করে দেখা, তাতে কোনও ধরনের কোনও অ্যান্টিডোট বা অপরিচিত এলিমেন্ট দেখতে পাওয়া যায় কি না। আমার মনে হয় ডঃ মাব্বা আর মার্কের লিডারশীপে আমরা এই কাজটা করি। আমি সারা বিশ্বের সব পিউ-এর এজেন্টকে বলে দিচ্ছি তার এলাকায় বাচ্চাদের যে খাবার আর ওষুধ ব্যবহার হয়, সেটা অ্যানালাইসিস করে ডঃ মাব্বা আর মার্কের কাছে রিপোর্ট পাঠাতে। এর জন্য আমরা একটা ছয় মাসের টার্গেট ঠিক করছি। ঠিক ছ’মাস বাদে আমরা ওই রিপোর্টগুলো নিয়ে এখানেই আবার মিটিংয়ে বসব। যদি কিছু পাওয়া যায়, তা হলে তার উপর ভিত্তি করে পরের পদক্ষেপ ঠিক হবে। আর না পাওয়া গেলে আবার অন্যভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে।”

“আজ একটা বেশ অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে।”

রাতের খাবার খেয়ে, ভোলুকে সুইচড অফ করে বসেছে দুই বন্ধু। নীল কয়েকদিন আগেই বলেছে যে সে বাঁশিতে একটা খুব সুন্দর গানের সুর তুলেছে, সেটা নয়নকে শোনাবে। কিন্তু নয়নের একটা নতুন প্রজেক্টের কাজ চলছে বলে অনেক রাত পর্যন্ত লেখাপড়া আর কম্পিউটার নিয়ে খুটখাট করতে হচ্ছে। সময় আর পাচ্ছে না। নীল তাই একটু মনমরাই ছিল। কিন্তু নয়নের মুখে কথাটা শুনে একটু নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করল, “এত ব্যস্ততার মধ্যে আবার অদ্ভুত কী ঘটল ?”

“আরে, আজ দুপুরে কাজ করতে করতে ক্লান্ত লাগছিল। আমার ল্যাবের কফি মেশিনটা গোলমাল করছে। তাই কাফে কর্নারে গিয়েছিলাম এক কাপ কফি খেতে। দেখি সেখানে এক মাগ হট চকোলেট নিয়ে হেনরি বসে আছে ভারী উদাস মুখে। ওরা তো আর তোমার মতো কবিতা-টবিতা লেখে না, তাই হেনরির অমন পাঁশুটে মার্কা মুখ দেখে আমি তো অবাক। ছেলেটা এমনিতে বেশ হাসিখুশি। আর তুমি তো জান, গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে ইচ্ছে করেই আমি ওর সঙ্গে বেশ খানিকটা ঘনিষ্ঠতা করেছি। না হলে তো আমার মাঝেমাঝে ওর ল্যাবে যাওয়াটা সন্দেহজনক হয়ে যেত। তবে হেনরি কিন্তু আমাকে বেশ পছন্দই করে। তাই আজ ওকে ওরকমভাবে বসে থাকতে দেখে আমি নিজেই গিয়ে ওর সামনে বসলাম। প্রথমে দু‘চারটে এমনি মামুলি কথাবার্তা হল। তারপর ও যা বলল, শুনে তো আমি অবাক।

“রহিম শাহ, মানে ওর বস নাকি আজ পুরো টিমকে ডেকে পাঠিয়েছিল। ওদের ওষুধ নিয়ে কমপ্লেন এসেছে। ওষুধ ঠিকমতো কাজ করছে না। তাই আপাতত কিছুদিনের জন্য ওষুধ বাইরে পাঠানো বন্ধ থাকবে। প্রোডাকশনও স্লো করে দেওয়া হবে। স্টোরে যে ওষুধ রয়েছে সেগুলো আর একবার পরীক্ষা করে রিপোর্ট ঠিক থাকলে তবে এক্সপোর্ট হবে। রহিম শাহ নাকি বেশ কড়াভাবে হেনরিকে কথাগুলো বলেছে। স্বাভাবিকভাবেই হেনরি বেশ আপসেট।”

“অদ্ভুত ব্যাপার তো। হেনরি কী বলল, ও নিজে এরকম একটা অভিযোগের কী উত্তর দিয়েছে?”

“এরা তো খুব জোর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। তবে হেনরি এটা বলেছে যে ওষুধে সমস্যা হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক। কারণ সবকিছু ফরমুলা মেনে করা হয়। প্রত্যেক স্টেজে আলাদা টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা আছে। ও রহিম শাহের কাছে জানতে চেয়েছে যে কী ধরনের কমপ্লেন এসেছে। কিন্তু রহিম শাহ নাকি তার কোনও উত্তর দেয়নি। শুধু বলেছে উপরমহল থেকে ওকে এটা জানানো হয়েছে, তাই সবাইকে ভীষণ রকম অ্যালার্ট হতে হবে, না হলে বিপদ হতে পারে।”

নীল একটু চুপ করে কী যেন ভাবে, তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, “নয়ন তুমি প্রথমবার যে ওষুধে অ্যান্টিডোট মিশিয়েছিলে সেটা ঠিক কত বছর হল?”

নীলের কথায় চমকে ওঠে নয়ন। মনে-মনে একটু হিসেব করে বলে, “ঠিক ছ’বছর।”

“মহীদাদুর ওষুধ কাজ করছে নয়ন। তুমি সাবধান হও।”

“কী করে বুঝলে তুমি?” উত্তেজনায় নয়নের গলা প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে।

“বুঝেছি বলব না। অনুমান বলতে পার। তবে অনুমানটা মনে হয় ভুল নয়। বাচ্চাদের স্বভাবে বদল হচ্ছে। সেই বদলের কথাটা পিউ জানতে পেরেছে। জানার পর তার কারণ খুঁজতে শুরু করে হেনরির ল্যাবরেটরি পর্যন্ত কিন্তু পৌঁছে গিয়েছে ওরা। তার মানে গোলমালের কারণটা যে ওষুধ, সেটা এখন ওরা জানে…”

“কিন্তু হেনরির ল্যাবে গোলমালটা হচ্ছে বুঝলেও ওরা আমাকে চিহ্নিত করবে কী করে?”

“একটা কথা ভুলে যেয়ো না নয়ন, মহীদাদু কিন্তু বলেছিলেন পিউ-এর হাত যে কত লম্বা তোমাদের কোনও ধারণা নেই।”

নীলের অনুমান অনেকটাই ঠিক। বাস্তবিকই পিউ-এর হাত অনেকটাই লম্বা। বাকাও ভ্যালিতে সেই বৈঠকের পর পিউ-এর সব স্তরের কর্মীদের কাছেই অ্যালার্ট মেসেজ যায়। সেই মেসেজ অনুযায়ী প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের এলাকায় বাচ্চাদের জন্য যেসব খাবার আর ওষুধ বাজারে বিক্রি হয় তার স্যাম্পল টেস্টিং শুরু করে।

রিপোর্টগুলো আসতে থাকে ডঃ মাব্বা আর মার্কের কাছে। বেশ কিছু রিপোর্ট আসার পর সন্দেহটা প্রথমে হয় ডঃ মাব্বারই। তিনি লক্ষ করেন, জন্মের পর প্রথম পাঁচ মাস বাচ্চারা যেসব ওষুধ খাচ্ছে, তার মধ্যে নেভিটা নামের একটি ওষুধে একটা অজানা এলিমেন্ট রয়েছে। ডঃ মাব্বা সঙ্গে সঙ্গে মার্ককে ব্যাপারটা জানান। তিনিও রিপোর্টগুলো পরীক্ষা করে ডঃ মাব্বার সঙ্গে একমত হন। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে অনেক রকম পরীক্ষা করেও এলিমেন্টটা যে কী সেটা বোঝা যায় না। তবে দু‘জনে মিলে পৃথিবীর কোন-কোন জায়গায় এই ধরনের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে তার একটা তালিকা তৈরি করেন। তাতে দেখা যায় নিউজিল্যান্ড এবং তার আশপাশের কয়েকটা দেশ বাদ দিলে প্রায় সব দেশের রিপোর্টেই এই অজানা এলিমেন্টের অস্তিত্ব রয়েছে। ছয় মাস পরে পিউ-এর মিটিংয়ে তাঁরা যা জেনেছেন এবং বুঝেছেন সেটা পুরোটাই ব্যাখ্যা করেন ডঃ মাব্বা।

“আপনারা কি মনে করছেন যে এই এলিমেন্টটাই ডি এন এ-কে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনছে?”

“সেটা নিশ্চিতভাবে বোঝার কোনও উপায় নেই ক্রিস্টাল। কারণ ল্যাবে এই এলিমেন্টটা বিশ্লেষণ করে আমরা এটুকু বুঝতে পেরেছি ডি এন এ তৈরি করতে যেসব উপাদান লাগে, সেগুলো এটার মধ্যে আছে। এছাড়া বাকি যেসব উপাদান রয়েছে সেগুলোও অধিকাংশই আমাদের চেনা। তাই মার্কের এক পেশেন্টের ডি এন এ নিয়ে সেই বেসিক কম্পোনেন্টের সঙ্গে অন্য উপাদানগুলো মিশিয়ে আমরা এলিমেন্টটা তৈরি করেছিলাম। তারপর ল্যাবে একটা কারেকশন করা ডি এন এ-এর উপর সেটাকে অ্যাপ্লাইও করি। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয়নি। কারেকশন করা ডি এন এ আগের অবস্থাতেই ছিল। কোনও বদল হয়নি। তার মানে আমি বলতে চাইছি এই অজানা এলিমেন্টটা যে আসলে অ্যান্টিডোট, তার কোনও প্রমাণ কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমরা পাইনি।”

“তা হলেও কিন্তু সন্দেহটা একেবারেই যাচ্ছে না ডঃ মাব্বা। বরং বিষয়টা আরও জটিল হচ্ছে,” টিমোথির গম্ভীর গলায় রীতিমতো উদ্বেগের ছাপ, “প্রথমত এই অজানা এলিমেন্টটা ওষুধে এলো কী করে? ওষুধ তৈরির সময় প্রত্যেক স্টেপে পরীক্ষা করা হয়। আপনারা আমাকে সন্দেহের কথাটা জানানোর পর আমি সেইসব রিপোর্ট আনিয়ে পরীক্ষা করেছি। কিন্তু তাতে এরকম কোনও এলিমেন্টের উল্লেখ নেই। তা হলে ওটা ওষুধের মধ্যে গেল কী করে?”

“তার থেকেও আমার মতে এখন যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল সারকামস্ট্যানসিয়াল এভিডেন্স মানে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনো।”

“আপনি কি বলতে চাইছেন ডঃ উডুগু?” জানতে চায় ক্রিস্টাল। “ভেরি সিম্পল। আমাদের সার্ভে থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, যে সব অঞ্চলের বাচ্চারা এই ওষুধটা খাচ্ছে তাদের মধ্যেই পরিবর্তনটা হচ্ছে। অন্য কোনও খাবার বা ওষুধে অজানা কিছু পাওয়া যায়নি। যে-যে অঞ্চলের ওষুধে এই এলিমেন্ট নেই, সেখানে বাচ্চাদের কোনও বদলও হয়নি। তার মানে আমরা কিছু খুঁজে পাই বা না পাই বদলটা হওয়ার পিছনে ওই এলিমেন্টের কোনও একটা ভূমিকা আছে। তাই আগে আমাদের বাচ্চারা যাতে আর এই ওষুধটা না খায় সেটার ব্যবস্থা করা দরকার।”

“সেটা আমরা শুরু করেছি ডঃ উড়ুগু। ডঃ মাব্বা তাঁর সন্দেহের কথাটা আমাদের জানানোর সঙ্গে-সঙ্গেই যে ল্যাবরেটরিতে এই ওষুধগুলো তৈরি হয়েছিল, সেখানে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে স্টোর থেকে কোনও ওষুধ যেন এক্সপোর্ট করা না হয়। প্রোডাকশন বন্ধ করা হয়নি ঠিকই কিন্তু অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া যারা ওই ওষুধ তৈরির সঙ্গে যুক্ত তারা সকলেই এখন কড়া নজরদারির অধীনে। তাদের প্রত্যেকের মনোবাহী মনিটর করা হচ্ছে। প্রত্যেকের বাড়িতে যে রোবট কাজ করে, তার হার্ড ডিস্কে একটা স্পেশাল চিপ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মেম্বাররা নিজে ওদের সকলের বাড়িতে গিয়ে সার্ভিসিং কিংবা ব্যাটারি বদলানোর নাম করে এই কাজটা করে এসেছেন। তার ফলে এই লোকগুলো যখন বাড়িতেও থাকছে তখন কী করছে, কার সঙ্গে কথা বলছে সব কিছু আমরা নজর রাখতে পারছি।”

“মনিটর করে কী আমরা এখনও পর্যন্ত কোনও ব্লু পেয়েছি?” টিমোথিকে জিজ্ঞেস করলেন ইজরায়েলের ম্যাক্স অ্যালেন।

“দুর্ভাগ্যের বিষয় এখনও পর্যন্ত কিছু পাওয়া যায়নি। আমাদের সন্দেহের তালিকায় একদম প্রথমে যে লোকটি রয়েছে তার নাম হেনরি বার্ট। কারণ তার তত্ত্বাবধানেই ওষুধটা তৈরি হয়। একদম ফাইনাল স্টেজের সুপারভাইজারও সে নিজেই। হেনরিকে আমরা সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করছি এই কারণেই যে আমরা জানতে পেরেছি ফাইনাল মিক্সিংয়ের পর আর কোনও টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা নেই। এখান থেকে মিশ্রণটা সরাসরি ট্যাবলেট মেকিংয়ের স্টেজে চলে যায়। তার মানে কোটিং দিয়ে ফয়েলে ভরে ফেলা হয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন এই স্টেজে যদি কিছু মেশানো হয়, তা হলে সেটা মনিটর না হয়েই ট্যাবলেটে চলে যাবে। আর সেই কাজটা করার সুযোগ আছে একমাত্র হেনরি বার্টের। হেনরিকে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যদিও এখনও পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনও তথ্যই পাওয়া যায়নি।”

“আপনার কি মনে হয় হেনরি নিজে এই অ্যান্টিডোট তৈরি করেছে এবং সেটা সে ফাইনাল মিক্সিংয়ের সময় মিশিয়ে দিচ্ছে?”

ম্যাক্সের কথা শুনে খুব ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন ক্রিস্টাল, “আমার মনে হয় না। একেবারেই মনে হয় না। হেনরি বার্টের পুরো বায়োডাটা আমি দেখেছি। ওর ডি এন এ কারেকশন করা আছে। একজন ডি এন এ কারেকশন করা মানুষের পক্ষে এরকম সাংঘাতিক অ্যান্টিডোট আবিষ্কার করাই সম্ভব নয়। হেনরি যে কাজটা করে তার জন্য অফিশিয়ালি আমরা ওকে বিজ্ঞানী বলি, কিন্তু আসলে ও একজন খুব সাধারণ মানের কর্মী। ট্যাবলেট তৈরি করার পদ্ধতিটা হেনরি খুব ভাল করে জানে আর সেটাই নিখুঁতভাবে করতে পারে। তাই এটাও আমাদের কাছে একটা বিরাট প্রশ্ন যে, হেনরি যদি কাজটা করেও থাকে এলিমেন্টটা ও পেল কোথা থেকে আর কীভাবেই বা পেল?”

“এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই,” ডঃ উডুগুর কথা শুনে তার দিকে ঘুরে তাকান ক্রিস্টাল, “একজন বিজ্ঞানী হিসেবে আমি মনে করি, এই এলিমেন্টটা যদি সত্যিই অ্যান্টিডোট হয়, তা হলে এটা তৈরি করার জন্য, ডি এন এ নিয়ে যে ধরনের জ্ঞান এবং গবেষণা দরকার, সেটা করার ক্ষমতা এই মুহূর্তে পৃথিবীতে কারও নেই। অন্য গ্রহের কোনও প্রাণী এসে যদি করে থাকে, তা হলে অবশ্য সেটা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়।”

“আমিও ডঃ উডুগুর সঙ্গে একমত,” বললেন ডঃ মাব্বা, “তবে এক্ষেত্রে আমি একটা কথাই বলব। একজন হয়তো এই কাজটা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি অনেকদিন হল মারা গিয়েছেন।”

“আপনি কার কথা বলছেন ডঃ মাব্বা?” টিমোথি জানতে চায়।

“ডঃ মহীয়ান দত্ত। ডঃ দত্ত বেঁচে থাকলে কোনও সন্দেহ থাকত না তিনিই কাজটা করেছেন। ইনফ্যাক্ট অ্যান্টিডোটের প্রসঙ্গটা ওঠার পর আমার প্রথমে ওঁর কথাই মনে হয়েছিল। কিন্তু তারপর আমি হিসেব করে দেখলাম, যে বাচ্চাগুলোর মধ্যে এই পরিবর্তনটা এসেছে, তাদের কারোরই বয়স ছ’বছরের বেশি নয়। তার মানে এই অ্যান্টিডোটটা কাজে লাগানো হচ্ছে বছর ছয়েক আগে থেকে। কিন্তু ডঃ মহীয়ান দত্ত মারা গিয়েছেন প্রায় বছর দশেক। সুতরাং তিনি কোনোভাবেই এটা আবিষ্কার করতে পারেন না।”

“আপনি ঠিকই বলেছেন ডঃ মাব্বা,” সায় দেয় কিম, “ডঃ দত্তের পক্ষেও এই কাজটা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ আপনারা সবাই জানেন, মারা যাওয়ার আগে প্রায় বছর সাতেক উনি জুরান্তিতে নির্বাসনে ছিলেন। আমাদের কথায় রাজি হননি বলে ওঁকে ওখানে পাঠানো হয়েছিল। জুরান্তিতে কোনও ঠিকঠাক ল্যাবরেটরি ছিল না। আমরা ওঁর রোবট পিলুর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, তা সত্ত্বেও উনি নিজস্ব কিছু জিনিসপত্র নিয়ে টুকটাক কাজ করতেন। কিন্তু সেগুলো একেবারে ছেলেখেলার ব্যাপার। ডঃ দত্তর মৃত্যুর কিছুদিন পরে ওঁর স্ত্রীও মারা যান। ওঁদের কোনও সন্তান নেই। দু‘জনের মৃত্যুর পর জুরান্তির বাড়ি ভাল করে তল্লাশি করা হয়েছিল। সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া যায়নি। সুতরাং এই সম্ভাবনাটা মনে হয় বাদ দেওয়াই ভাল।”

মিটিংয়ে ঠিক হল হেনরি বার্টদের ল্যাবরেটরি থেকে ওষুধ এক্সপোর্ট আপাতত বন্ধ থাকবে। তবে সেটা কাউকে জানানো হবে না। ওষুধ এনে পিউ-এর তত্ত্বাবধানে স্টোর করা হবে এবং পরীক্ষা করার পর নিরাপদ বুঝলে তবেই বাইরে ছাড়া হবে। ল্যাবরেটরির কাজ স্বাভাবিকভাবেই চলতে দেওয়া হবে। যে এই দুষ্কর্মটি করছে সে যদি সব ঠিক হয়ে গিয়েছে ভেবে আবার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে তা হলে এবার নিশ্চিত ধরা পড়বে। যদিও ক্রিস্টাল নিজে মনে করছেন সেরকম সম্ভাবনা খুবই কম। এছাড়া ডঃ মাব্বা, ডঃ উডুগু আর মার্ক মিলে অজানা এলিমেন্টটাকে আবার পরীক্ষা করে দেখবেন যদি কিছু পাওয়া যায়।

সব সিদ্ধান্তই সর্বসম্মতিক্রমে হয়েছে। অন্য রকম কোনও মতামতও ছিল না। কিন্তু তবু মিটিং সেরে সলসবুর্গে নিজের বাড়িতে ফিরে এসে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল টিমোথির। বারবারই মনে হচ্ছিল কিছু একটা যেন বাদ পড়ে গেল। কোনও একটা বিষয়ে আরও একটু আলোচনা, আরও একটু আলো ফেলার দরকার ছিল, কিন্তু সেটা হল না।