মহীদাদুর বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর বেশ কয়েক মাস কেটে গিয়েছে। দাদুর দেওয়া ক্যাপসুলটা নয়ন খুব সাবধানে নিজের আলমারিতে তুলে রেখেছে। সেই আলমারি খুলতে হলে নানা রংয়ের লেসার রশ্মির যে কম্বিনেশন লাগে, সেটা নয়ন ছাড়া আর কেউ জানে না। তবে তার মধ্যেই একদিন সে নিজে রাতের খাওয়াদাওয়ার পর ভোলুকে সুইচড অফ করে ক্যাপসুলটা বের করে কম্পিউটারে ভরে দেখেছে। মহীদাদু খুব সহজ ভাষায় পুরো ফরমুলা বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মুশকিল হল কাজটা শুরু করতে হলে তো একজন শিল্পী মানুষের ডি এন এ লাগবে। সেরকম মানুষ নয়ন পাবে কোথায়?
মহীদাদু যখন কথাগুলো তাঁকে বলেছিলেন, তখন নয়ন অতটা বোঝেনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে ওরকম কাউকে খুঁজে পাওয়া কতটা কঠিন। ডি এন এ কারেকশনের জন্য গত পঞ্চাশ বছরে এরকম মানুষ কেউ জন্মায়নি। তার থেকে বেশি বয়স যাঁদের, তাঁদের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু শিল্পী আছেন। কিন্তু তাঁদের খুঁজে পাওয়া যাবে কীভাবে? পিউ-এর পরিকল্পনা এত নিখুঁত যে বেশির ভাগ মানুষ এই ব্যাপারগুলোই ভুলে গিয়েছে। স্কুল-কলেজে শেখানো হয় না। এ সম্বন্ধে কোনও তথ্য ইন্টারনেটে পাওয়া যায় না। গান, গল্প, কবিতা এই শব্দগুলো শুনলে সবাই তাই ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সত্যি কথা বলতে কী নয়নের নিজেরও তো ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। ছেলেবেলায় মহীদাদুর বাড়িতে যা শুনেছিল, সে তো ভুলেই গিয়েছে প্রায়। এরকম একটা ভাসা-ভাসা ধারণার উপর দাঁড়িয়ে সে কী করে এমন একজন মানুষকে খুঁজে বের করবে? চিনবে কী করে তাকে?
কিন্তু তবু নয়ন সহজে হাল ছাড়ার মানুষ নয়। মহীদাদুকে সে কথা দিয়েছে। তাই ইদানীং নয়ন প্রায় সব ছুটির দিনেই আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বিশেষ করে একশো-দেড়শ বছর বয়স হয়েছে, এমন সব মানুষ যে বাড়িতে আছেন। তাঁদের সঙ্গে অনেক গল্প হয়। পুরনো দিনের কথাও জানা যায়। শিল্পী কাকে বলে সেটা তাঁরা জানেন। দু’-এক জনের এসব বিষয়ে আগ্রহও আছে। কিন্তু তাঁদের ডি এন এ দিয়ে যে নয়নের প্রয়োজন মিটবে না, সেটা সে নিজেই বুঝতে পারে। দু’-একবার এঁদের কাছ থেকে গল্প শুনে একদম অচেনা মানুষের বাড়িতেও হানা দিয়েছে নয়ন। যেমন তার এক বন্ধুর ঠাকুরদা একজনের নাম বলেছিলেন, তিনি নাকি ভারী সুন্দর ছবি আঁকতেন। নয়ন অনেক খুঁজে তাঁর সন্ধানও বের করেছিল। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে জানা গেল সেই মহিলা বছরখানেক হল মারা গিয়েছেন। সেরকমই এক গায়কের সন্ধানে গিয়ে নয়ন জানতে পেরেছিল তিনি নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কোথায় গিয়েছেন কেউ জানে না। এভাবে শিল্পী মানুষ খুঁজতে খুঁজতে নয়ন ক্রমশ বুঝতে পারছিল, নিজেদের লক্ষ্যে একদম পরিকল্পনা মাফিক এগুচ্ছেন পিউ-এর কর্মকর্তারা। একদিকে শিল্পী জন্মাচ্ছে না। অন্যদিকে প্রবীণ শিল্পীরা হয় মারা যাচ্ছেন নয়তো হারিয়ে যাচ্ছেন।
মনে-মনে যখন বেশ খানিকটা হতাশ হয়ে পড়েছে নয়ন, সেই সময় একদিন সকালে মহীদাদুর মৃত্যুসংবাদ এলো। সেদিনটা ছিল রবিবার। খবরটা শোনার পর থেকে কিছুই আর ভাল লাগছিল না নয়নের। নিজেকে খানিকটা শান্ত করার জন্যই অনেকদিন পর সে তার সুপারসনিক কার নিয়ে বেরিয়ে সোজা চলে গেল জঙ্গলে। সময়টা বসন্তকাল। গাছে-গাছে ঝলমল করছে নতুন পাতা। নানা রকম ফুল ফুটেছে। প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। অনেক রকম পাখিও ডাকছে। গাড়িটা একটা মোটামুটি ফাঁকা জায়গায় রেখে জঙ্গলের মধ্যে ঢোকে নয়ন। তারপর এদিকওদিক ঘুরতে-ঘুরতে একসময় একটা মোটা শিমুল গাছের তলায় ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে।
ঠাণ্ডা হাওয়ায় যখন প্রায় চোখ লেগে এসেছে, তখন হঠাৎ একটা কীরকম অদ্ভুত শব্দ শুনে তার তন্দ্রা কেটে যায়। উঠে বসে এদিকওদিক তাকিয়ে কিছুই দেখতে পায় না। আওয়াজটা কিন্তু থামেনি। ভাল করে শুনে নয়ন বুঝতে পারে একটু দূরে একটা বুনো গোলাপের ঝোপের ওপাশ থেকে আসছে শব্দটা। তাড়াতাড়ি ঝোপটা পেরিয়ে উলটোদিকে গিয়েই চমকে ওঠে সে। মাটিতে একটা লোক পড়ে আছে। তার কপাল কেটে রক্ত পড়ছে। মানুষটার প্রায় অজ্ঞান অবস্থা। মুখ দিয়ে একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরচ্ছে, যেটা গাছতলায় শুয়ে সে শুনতে পেয়েছিল। লোকটির পাশে একটা ব্যাগ আর কিছু অদ্ভুত যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। সেগুলো সম্ভবত ওই ব্যাগ থেকেই পড়ে গিয়েছে।
এরকম একটা জনশূন্য জায়গায় একজন মানুষকে পড়ে থাকতে দেখে প্রথমটায় খানিকটা হকচকিয়ে গিয়েছিল নয়ন। কিন্তু তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে সে দৌড়ে নিজের গাড়ি থেকে ওষুধপত্রের একটা ছোট বাক্স বের করে আনে। রক্ত বন্ধ করার জন্য কপালে মলম লাগায়। তারপর একটা বিশেষ ওষুধের কয়েক ফোঁটা লোকটির ঠোঁট ফাঁক করে মুখের মধ্যে ঢেলে দেয়। ওষুধটা মুখের ভিতরে যাওয়ার একটু পরেই লোকটার গোঁ গোঁ আওয়াজটা আস্তে-আস্তে কমে যায়। আরও একটু পরে নয়ন বুঝতে পারে যে, তার জ্ঞান ফিরে আসছে।
তখন খুব সাবধানে তাকে তুলে ধীরে-ধীরে হাঁটিয়ে নিজের গাড়ির কাছে নিয়ে এসে গাড়িতে বসায়। তারপর গিয়ে সেই ব্যাগের মধ্যে যন্ত্রপাতিগুলো ভরে সেটাকেও তুলে নিয়ে আসে।
অচেনা মানুষটির কথা বলার মতো অবস্থা নেই। শরীরের ভিতরে কোনও ক্ষতি হয়েছে কি না কিংবা কী কষ্ট হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তাই বাড়িতে না এসে নয়ন প্রথমেই তাকে নিয়ে যায় ডাক্তারের কাছে। তিনি ভাল করে পরীক্ষা করে বলেন যে চোট খুব গুরুতর নয় ঠিকই, কিন্তু মনে হচ্ছে কোনও কারণে শক পেয়েছে। তাই বেশি নড়াচড়া না করে বিশ্রামে রাখাই ভাল। একটু সামলে উঠলে তখন সব কিছু জেনে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া যাবে। ডাক্তারবাবু লোকটিকে হাসপাতালেই ভর্তি করে নিচ্ছিলেন। কিন্তু লোকটার জামাকাপড় বেশ অন্য রকম। ব্যাগের যন্ত্রপাতিগুলোও অদ্ভুত। সব মিলিয়ে মানুষটার সম্বন্ধে একটু কৌতূহল হচ্ছিল নয়নের। তা ছাড়া ও কেন জনহীন জঙ্গলে গিয়েছিল, সেটাও জানার ইচ্ছে ছিল। তাই সে ঠিক করে হাসপাতালে নয়, নিজের কাছেই রাখবে ওকে। যদি কোনও কারণে বেশি শরীর খারাপ হয়, তখন হাসপাতালের কথা ভাবা যাবে। নয়নের এমন অদ্ভুত প্রস্তাবে ডাক্তারবাবু একটু আশ্চর্য হলেও আপত্তি করেন না।
প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল নীল নয়নের বাড়িতেই আছে। হ্যাঁ সেই অজানা লোকটির নাম নীল। সে নিজেই তার নামটা বলেছে, কিন্তু আর কিছুই বলতে পারেনি। প্রথম কয়েকদিন অবশ্য তার কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না। বেশির ভাগ সময়ই ওষুধের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। নয়নের নির্দেশ মতো তার সব দেখাশোনা করত ভোলু। কিন্তু আস্তে-আস্তে সে যখন সুস্থ হয়ে উঠছে, তখন তার সঙ্গে কথা বলে নয়ন বেশ আশ্চর্য হয়ে দেখল যে সে বাংলা, ইংরেজি এরকম বেশ কয়েকটা ভাষা দিব্যি বুঝতে পারছে। কিন্তু এস্পেরান্তোতে কথা বললে কিছুই বুঝছে না। যেরকম নিজের নামটা বলতে পারছে কিন্তু আর কিছু, যেমন সে কোথায় থাকত, কী করত এসব তার মনে নেই।
ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে তিনি নীলের ব্রেন ম্যাপিং করতে বললেন। কিন্তু তাতেও বিশেষ কিছু বোঝা গেল না। তবে ডাক্তার বললেন অনেকসময় মাথায় আঘাত লেগে এরকম হতে পারে। সেটা ম্যাপিংয়ে সবসময় ধরা পড়ে না। যেহেতু কিছু জিনিস মনে পড়ছে, কিছু পড়ছে না, তাই একটু অপেক্ষা করাই ভাল। স্বাভাবিকভাবে যদি স্মৃতিশক্তি ফিরে না আসে, তখন চিকিৎসা শুরু করা যাবে।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এরকম অসহায় অবস্থায় তো কোনও মানুষকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। তাই নীল নয়নের বাড়িতেই রয়েছে। তাতে অবশ্য নয়নের কোনও আপত্তি নেই। বরং সে বেশ খুশি। কারণ নীল মানুষটি ভারী ভাল। এমনিতে আপনমনে থাকে। কিন্তু নানা রকম মজার কথা বলে দিব্যি হাসাতে পারে। আবার ভারী সুন্দর করে গল্পও করে। নয়ন বুঝতে পারে যে নীল যথেষ্ট বুদ্ধিমান। কিন্তু মাথার আঘাত লাগার কারণেই সম্ভবত এক-এক সময় এমন সব কথাবার্তা বলে যে, শুনলে মনে হয় যেন সে অনেক পুরনো দিনের মানুষ। আজকের পৃথিবীর সম্বন্ধে তার কোনও ধারণাই নেই।
নীল নয়নের বাড়িতে থাকতে শুরু করার মাস ছয়েক পরে একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। নীলকে জঙ্গল থেকে তুলে আনার সময় নয়ন তার ব্যাগটাও তুলে এনেছিল। তারপর বাড়ি এসে ব্যাগটাকে সযত্নে ড্রয়ারের ভিতর ঢুকিয়েও রেখেছিল। কিন্তু তারপর নীলের অসুস্থতা, তাই নিয়ে নানা রকম দৌড়ঝাঁপ এসবের মাঝে সে ব্যাগটার কথা বেমালুম ভুলে যায়। নীলও ব্যাগের ব্যাপারে তার কাছে কিছু জানতে চায়নি। কিন্তু একদিন অফিসের কিছু কাগজপত্র বের করতে গিয়ে ড্রয়ারের ভিতর থেকে ব্যাগটা বেরিয়ে পড়ায় নয়ন তাড়াতাড়ি ব্যাগটা নিয়ে গিয়ে নীলের হাতে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে নীলের মুখটা যেন আনন্দে একেবারে উজ্জ্বল, উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, বলে, “এটা তুমি কোথায় পেলে নয়ন?”
“তুমি যেখানে পড়ে ছিলে, সেখানেই তো ছিল। যন্ত্রপাতিগুলো পাশে ছড়িয়ে ছিল। আমি সব গুছিয়ে ব্যাগের ভিতর ভরে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু তারপর তোমাকে নিয়ে এত টানাটানি শুরু হল যে ব্যাগের কথা ভুলেই গিয়েছি।”
নীল ব্যাগের ভিতরের জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে। খুব আলতো করে একটা লম্বাটে পাইপের মতো জিনিসে হাত বোলায়। তার কাণ্ডকারখানা দেখে নয়ন ভারী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “এটা কীসের যন্ত্র নীল?”
“এটা তো যন্ত্র নয়। তুমি এটা চেন না?”
নয়নকে মাথা নাড়তে দেখে নীলও ভারী আশ্চর্য হয়। তারপর বলে, “আচ্ছা দাঁড়াও। আজ রাতের খাবার খাওয়ার পর তোমাকে এর কেরামতি দেখাব।”
ভোলুর সঙ্গে নীলও আজকাল মাঝে-মাঝেই রান্নার কাজে হাত লাগায়। নয়নের জন্য নানা রকম পদ তৈরি করে। সেগুলো একেবারে অন্য রকম খেতে আর স্বাদও চমৎকার। নয়ন যেহেতু সারাদিন ব্যস্ত থাকে, তাই ডিনার টেবিলে দু‘জনের অনেক গল্পও হয়। সব মিলিয়ে রাতের খাওয়াটা আজকাল নয়নের কাছে খুব উপভোগ্য একটা ব্যাপার। সেদিন রাতে কুড়মুড়ে করে আলুর খোসা ভেজেছিল নীল। নয়নের সেটা দারুণ পছন্দ হল। আনাজের খোসাও যে আবার এরকমভাবে খাওয়া যায়, সেটা তার জানাই ছিল না। খাওয়া শেষ হলে ভোলুকে সুইচড অফ করে চার্জে বসিয়ে দু‘জনে এসে বসে নয়নের ঘরে।
ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে নীল সেই লম্বাটে পাইপের মতো জিনিসটা নিজের মুখের কাছে তুলে নিয়ে ফুঁ দেয়। আর অমনি তার থেকে একটা ভারী মিষ্টি শব্দ বেরতে থাকে। তেমন আওয়াজ নয়ন আগে কখনও শোনেনি। তার মনে হয় এই শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে তার মনটাও যেন কোন সুদূরে ভেসে যাচ্ছে। অনেকদিন পরে মায়ের মুখটা মনে পড়ে চোখে জল আসে আবার বুকের ভিতরটা কেমন যেন অন্য রকম আনন্দে ভরে ওঠে।
এক সময় শব্দ থামে। নয়ন দু‘হাতে নীলকে জড়িয়ে ধরে বলে, “এটা কী নীল? এমন জিনিস তো আগে কখনও দেখিনি, এমন আওয়াজও কখনও শুনিনি।”
“এটাকে বলে বাঁশি। এটা এক ধরনের বাজনা। এটা বাজাতে হয়। এই যে ফাঁপা নলটা দেখছ, এর গায়ে ছোট-ছোট ফুটো আছে। আমি ফুঁ দিলে সেই হাওয়া এই ফুটো দিয়ে বেরিয়ে নানা রকম সুর তৈরি করে। তাকেই বলে বাজানো। কিন্তু আমার খুব আশ্চর্য লাগছে নয়ন, তুমি আগে কখনও বাঁশি দেখোনি?”
“না, সত্যিই দেখিনি। এমনকি এর নামও কখনও শুনিনি। কিন্তু তুমি এটা কোথা থেকে পেলে। আর বাজাতেই বা শিখলে কোথা থেকে?”
“আমি তো খুব ছেলেবেলা থেকেই বাঁশি বাজাতে জানি। কিন্তু কার কাছে শিখলাম, কীভাবে শিখলাম তা তো মনে করতে পারছি না। অথচ দ্যাখো সুরগুলো কিন্তু সব ঠিকঠাক মনে পড়ছে। তোমার যদি ভাল লাগে, তা হলে আমি তোমাকে মাঝে-মাঝেই বাঁশি বাজিয়ে শোনাব। চাইলে তোমাকে শেখাতেও পারি।”
নয়ন এবার একটু হেসে বলে, “শিখতে পারব কি না জানি না। শুনব তো নিশ্চয়ই। তবে একটা জিনিস খেয়াল রেখো, ভোলু যেন কিছু জানতে না পারে।”
“কেন বলো তো, ভোলু জানলে অসুবিধে কোথায়?”
“আমি যেমন কোনোদিন বাঁশি দেখিনি, সেরকম ভোলুও নিশ্চয়ই দেখেনি। একদম অজানা কিছু দেখলে, মানে যার সম্বন্ধে কোনও ডেটা ওকে ফিড করা হয়নি, ও সঙ্গে-সঙ্গে সেটা মনিটর করে আর তার রিপোর্টও তৈরি করে। সেই রিপোর্ট সরকারের ঘরে জমা পড়লেই সেখান থেকে লোক আসবে তোমার আর তোমার বাঁশির খোঁজখবর নিতে। তখন কোথা থেকে তুমি বাঁশি পেলে, কেন তোমাকে আমি হাসপাতালে না দিয়ে নিজের বাড়িতে রেখেছি, এইসব নানা প্রশ্ন উঠে জল ঘোলা হবে। তাই ওসব ঝামেলায় না যাওয়াই ভাল।”
নয়নের কথার ধরনে হেসে ফেলে নীল। তারপর বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে। ভোলু বাদ। আমরা দুই বন্ধুই শুধু বাঁশি শুনব। ব্যস, তা হলে খুশি তো?”
“খুব খুশি। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি হলাম তুমি আমাকে বন্ধু বলায়। তুমি আসার আগে আমার কিন্তু সেরকম কোনও বন্ধুই ছিল না। অথচ দ্যাখো তোমার সঙ্গে কত তাড়াতাড়ি ভাব হয়ে গিয়েছে। আজকাল তো আমার মাঝে-মাঝে মনে হয়, তোমার যখন সব কথা মনে পড়ে যাবে আর তুমি নিজের বাড়িতে চলে যাবে, তখন তো আমি ভারী বিপদে পড়ে যাব।”
“আরে চিন্তা করছ কেন? আমি যখন নিজের বাড়িতে যাব, তখন তোমাকেও আমার সঙ্গে নিয়ে যাব?” হাসতে হাসতে বলে ওঠে নীল।
তারপর থেকে মাঝে-মাঝেই রাতে নয়নকে বাঁশি বাজিয়ে শোনায় নীল। তার সঙ্গে থাকতে-থাকতে নয়ন ধীরে-ধীরে বুঝতে পারে শুধু বাঁশি বাজানো নয়, আরও অনেক কিছুই নীল করতে পারে, যেগুলো তার সম্পূর্ণ অজানা।
যেরকম একদিন নীল স্নানে ঢোকার পর নয়ন শুনতে পায় স্নান ঘরের ভিতর থেকে একটা গুনগুন আওয়াজ আসছে। আওয়াজের ধরনটা নয়নের খানিকটা চেনা। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না। তাই নীল স্নান সেরে বেরনো মাত্র নয়ন তাকে চেপে ধরে, “বাথরুমে তুমি কী করছিলে বলো তো?”
” “বাথরুমে আবার কী করব! স্নান করছিলাম….” নীল তো অবাক। “না, না, তা নয়। একটা অন্য রকম আওয়াজ আসছিল তো…’ “ও, সে তো আমি গান গাইছিলাম।”
মহীদাদুর কল্যাণে গান ব্যাপারটা নয়ন কিছুটা জানে। তাই বাঁশির মতো অতটা হতবাক হয়ে যায় না। বরং নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি গান গাইতে পার?”
“অল্প-অল্প পারি। খুব ভাল বোধ হয় নয়। যদিও একসময় লোকে খুবই ভাল বলত।”
“কারা ভাল বলত? তোমার মনে আছে তাদের কথা?”
কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ে নীল, “নাহ মনে নেই। মনে পড়ছে না। গানগুলো কিন্তু মনে আছে। গান গাইতে গেলে আমার কোনোদিন একটা শব্দও ভুল হয় না।”
সামান্য হতাশ হয়ে নয়ন বলে, “আচ্ছা, একটা গানই শোনাও তা হলে।”
“উঁহু, এখন নয়। তুমি বলেছ না, ভোলুর সামনে নতুন কিছু না করতে। গান তোমাকে আমি রাতে শোনাব, ভোলুকে সুইচড অফ করার পর।”
দিনগুলো আজকাল ভারী ভাল কাটছে নয়নের। রোজ রাতে ভোলুকে সুইচ টিপে ঘুম পাড়ানোর পর বসে তাদের দুই বন্ধুর আসর। কোনোদিন নীল বাঁশি বাজিয়ে শোনায়। কোনোদিন গান গায়। নীলের কাছে শুনে-শুনে আজকাল একটু-একটু গান গাইতে পারে নয়নও। নীল বলেছে, নয়নের গলায় নাকি সুর আছে। একটু চেষ্টা করলেই সে পারবে। এই সুর ব্যাপারটা যে কী, সেটা অবশ্য নয়নের মাথায় ঢোকেনি। নীলও তাকে ঠিকমতো বোঝাতে পারেনি। কিন্তু সুরটা এখন চিনতে শিখেছে নয়ন। গলার আওয়াজটা ঠিক কেমনভাবে বেরলে সেটা সুরে বলা হয়, সেটা এখন সে বুঝতে পারে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আজকাল নীলের মতো তারও খানিকটা গুনগুন করা অভ্যাস হয়েছে। দু’-একদিন অফিসে কাজ করার সময় আপনমনে গুনগুন করায় সহকর্মীরা ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল। নয়ন সেটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু তারপর একদিন বস ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি কোনও মানসিক সমস্যা হচ্ছে? মানে কোনও ধরনের অসুবিধে বা চাপ, তা হলে সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় তোমার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা দরকার।”
নয়ন তো অবাক, বলেছিল, “কেন স্যার? আমার তো সেরকম কিছু মনে হয়নি।”
“তোমার কলিগরা বলছিল, তুমি নাকি আজকাল মাঝে-মাঝে নিজের মনে কথা বলো, অদ্ভুত ধরনের আওয়াজ করে কথা বলো….”
অনেক কষ্টে সেদিন ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়েছিল নয়ন। কিন্তু তারপর থেকে সতর্ক হয়ে গিয়েছে, কোনোভাবেই যেন কাজের সময় এককলি গানও গুনগুনিয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে না আসে। কিন্তু নয়নের কাছে কথাটা শুনে খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল নীল, “কেন, গান করাটা তো অন্যায় কাজ নয়। ভারী সুন্দর একটা জিনিস। সেটা নিয়ে তোমাদের এত ভয়, এত লুকোছাপা কীসের? তোমার মতো ওরাও তো শিখে নিতে পারে। তা হলে ওদেরও ভাল লাগবে। নতুন কিছু শিখতে তো সবসময়ই ভাল লাগে।”
নীলের প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়নি নয়ন। কারণ পিউ-এর কার্যকলাপ, যা সে নিজে মহীদাদুর কাছ থেকে শুনেছে সেগুলো তো আর নয়নকে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু নিজের মনে-মনে ভারী আশ্চর্য হয়েছিল। নীলের বয়স প্রায় তার সমান। তা হলে তো তারও নিশ্চয়ই ডি এন এ কারেকশন হয়েছে। তা হলে সে কী করে এত অন্য রকম! নয়নের মতো তারও কি কোনও মহীদাদু ছিল? নাকি পিউ যে অল্প কিছু হাতে গোনা শিশুর ডি এন এ কারেকশন করে না, যারা বড় হয় পৃথিবীকে শাসন করার অধিকার নিয়ে, নীল তাদের মধ্যে একজন। তা হলে তো নয়নের আরও বেশি সাবধান হওয়া দরকার। কারণ নিয়মিত চিকিৎসা চলছে। কোনও একটা সময় তো নীলের স্মৃতি ফিরে আসবেই। এখন নয়ন কোনও বেফাঁস কথা বললে তখন তো বিপদে পড়ে যাবে।
কিন্তু এতসব নানা রকম যুক্তি সত্ত্বেও, নয়ন কিন্তু নিজের মনেমনে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না যে, নীল আসলে পিউ-এর বিশ্ব জুড়ে পেতে রাখা ষড়যন্ত্রের জালেরই একটা অংশ। নীলের সহজ হাসি, খোলামেলা কথা সবই তার ওই যুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কিন্তু তা যদি না হয়, তা হলে নীল কেন এত অন্য রকম তারও কোনও ব্যাখ্যা সে খুঁজে পায় না। তাই নীলকে নিয়ে সারাক্ষণই তার মধ্যে একটা দোলাচল চলে।
এমনিতে নীল এখন পুরোপুরি সুস্থ। তাই মাঝে মাঝেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিকওদিক যায়। আবার নিজে-নিজে রাস্তা চিনে দিব্যি ফিরেও আসতে পারে। কেমন করে এয়ার ক্যাব ডাকতে হয়, সেটা নয়ন তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। নীল সাধারণত তাদের সাড়ে তিনশোতলার ব্যালকনিতে এয়ার ক্যাব ডেকে নেয়। তারপর তাতে চেপে চলে যায় নিজের পছন্দমতো জায়গায়। পছন্দমতো জায়গা বলাটা অবশ্য ভুল। সারা শহর জুড়ে যেসব অসংখ্য শপিং মল, নকল পাহাড়, নদী, সমুদ্দুর, মরুভূমি সাজানো আছে, সেসব কিছুই নীলের পছন্দ হয় না। তার সবচেয়ে ভাল লাগে ছুটির দিনে নয়নের সঙ্গে জঙ্গলে বেড়াতে যেতে, সত্যিকারের ঝরনার জলে পা ডুবিয়ে বসতে। কিন্তু তবু নয়ন তাকে বেরতে বলে। কারণ প্রথমত, চারদিকটা চেনা দরকার। আর নানা জায়গায় ঘুরতে-ঘুরতে কোনও কিছু দেখে নীলের পুরনো কথা মনে পড়েও যেতে পারে। যদিও এখনও পর্যন্ত সেরকম কোনও সম্ভাবনা দেখা যায়নি। বরং প্রতিদিনই বাইরে থেকে ঘুরে এসে নীল নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে নকল পাহাড়, নদী দেখে দর্শকদের উচ্ছ্বাসের বর্ণনা দেয়। আর সেগুলো শুনতে-শুনতে হেসে গড়িয়ে পড়ে নয়ন।
নীল দু’-একবার নয়নকে জিজ্ঞেসও করেছে, “এই মানুষগুলোর কখনও ইচ্ছে হয় না আসল পাহাড়, সমুদ্র কেমন হয়, গিয়ে দেখে আসতে? নতুন জায়গায় গিয়ে সেটাকে আবিষ্কার করতে ভাল লাগে না এদের?”
আরও অনেক কিছুর মতোই, নীলের এই প্রশ্নেরও কোনও উত্তর দেয়নি নয়ন। যদিও তার নিজের মনে অন্য আর-একটা প্রশ্ন বেশ কিছুদিন ধরেই উঁকিঝুঁকি মারছিল। নয়নের বাড়িতে নীলের থাকা প্রায় এক বছর হতে চলল। ইতিমধ্যে তার মাথার চিকিৎসাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ডাক্তারবাবুর ধারণা আর অল্পদিনের মধ্যেই নীলের সম্পূর্ণ স্মৃতি ফিরে আসবে। যদিও দুই বন্ধুর কেউই সেটা নিয়ে বিশেষ ভাবিত নয়। আর ভোলুর স্টোরেজে যেহেতু এরকম পরিস্থিতি নিয়ে কোনও তথ্য ফিড করা নেই, তাই এবিষয়ে তার কোয়েশ্চেন ব্যাঙ্ক ও খালি। সুতরাং নীলকে নিয়ে ভোলুর কোনও মাথাব্যথা, কিংবা বলা ভাল কম্পিউটার-ব্যথা নেই। অতএব সবকিছু চলছিল ভালই। কিন্তু সেদিন ঘটে গেল একটা সাংঘাতিক ঘটনা।
রোজকার মতো সকালবেলা নয়ন নিজের ল্যাবরেটরিতে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। হঠাৎ তার হাতের ব্যান্ডে বিপ বিপ শব্দ করে সবুজ রংয়ের আলোর সংকেত আসতে শুরু করল। নয়ন বুঝতে পারল অচেনা কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে, এমন কেউ যার সঙ্গে মনোবাহীতে তার যোগাযোগ নেই। বাটন টিপে ব্যান্ড চালু করে নয়ন তো অবাক। উলটোদিকে রয়েছেন পুলিশের একজন অফিসার। নীল নাকি রাস্তায় কী গণ্ডগোল করেছে, তাই তাকে তাঁরা নিজেদের অফিসে নিয়ে এসেছেন। নীল নিজের সম্বন্ধে কিছুই বলেনি, শুধু নয়নের নাম আর ব্যান্ড নম্বর দিয়েছে। তাই পুলিশ অফিসার নয়নের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
সব কথা শুনে নয়ন বুঝতে পারে যে, ব্যাপারটা ঠিক সুবিধেজনক নয়। তাই বসের সঙ্গে কথা বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে হাজির হয় পুলিশের অফিসে। নীল সেখানেই রয়েছে। তবে পুরো ঘটনায় পুলিশ অফিসার যে রীতিমতো হতভম্ব, সেটা বুঝতে নয়নের অসুবিধে হয় না। ঘটনাটা যদিও খুবই সামান্য। সেদিন সকালে নয়ন বেরিয়ে যাওয়ার পর নীলও একটা ক্যাব ডেকে বেরিয়েছিল। কিছুক্ষণ এদিকওদিক ঘোরাঘুরির পর তার ইচ্ছে হয় মাটিতে হাঁটবে। ইদানীং অধিকাংশ মানুষ যেহেতু আকাশপথেই চলাফেরা করে, তাই রাস্তাঘাট প্রায় শুনশান থাকে। নীল আপনমনে ওরকম একটা ফাঁকা রাস্তায় হাঁটছিল।
এমন সময় সে দেখে যে, একটা জায়গায় রাস্তার পাশে সার-সার রংচঙে পাথর বসানোর কাজ চলছে। পাথরগুলো দেখতে সুন্দর, রাস্তাটাকে দেখাচ্ছেও ভাল। কিন্তু এই পাথর বসানোর জন্য মিস্ত্রিরা একটা ঝলমলে হলুদ ফুলে ভরা গাছকে উপড়ে ফেলবে ঠিক করেছে। সেজন্য মাটি খোঁড়ার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। নীল নাকি লোকগুলোকে গিয়ে বলে যে, গাছটা না উপড়ে ফেলে পাথর বসালে সেটা আরও সুন্দর দেখাবে। লোকগুলো স্বাভাবিকভাবেই তার কথায় রাজি হয়নি। তখন নীল গাছটাকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে বসে পড়ে। হতভম্ব মিস্ত্রিরা পুলিশে খবর দেয়।
পুলিশও ঘটনা দেখে অবাক। তবে তারা অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুজিয়ে নীলকে সেখান থেকে তুলে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে এসেছেন। যদিও নীল নাকি তাদের ভয় দেখিয়েছে যে, কাল যদি সে গিয়ে দ্যাখে যে গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে, তা হলে ওখানেই মাটিতে শুয়ে থাকবে যতক্ষণ না আবার গাছটাকে ফিরিয়ে এনে পোঁতা হয়। ভয় পেয়ে মিস্ত্রিরা কাজ বন্ধ করে রেখেছে। পুলিশও ভেবে পাচ্ছে না কী করবে। কারণ এমন ধরনের কথাবার্তা তারা কস্মিনকালেও শোনেনি।
“উনি কি অসুস্থ? চিন্তাভাবনা ঠিকমতো করতে পারেন না?” পুলিশ অফিসারের প্রশ্নের উত্তরে নয়ন জানায় যে, তাঁর অনুমান সঠিক। বছরখানেক আগে নীলের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। সে এখনও পুরো সেরে ওঠেনি। তাই তার চিন্তার সূত্রগুলো একটু এলোমেলো।
“আমারও সেরকমই মনে হয়েছিল। তবে চিন্তাগুলো এলোমেলো নয়, খুবই অদ্ভুত। উনি বলছেন যে গাছটাকে উনি মেরে ফেলতে দেবেন না। এ আবার কী ধরনের কথা! এরকম কী বলা যায় না কি! রাস্তাটা সাজানো হচ্ছে, তাই গাছটাকে সরিয়ে দিতে হবে। এটাই তো নিয়ম। অথচ উনি সেটা মানতে চাইছেন না। আমার মনে হচ্ছে ওঁর অসুখটা বেশ জটিল। আপনি ডাক্তারকে এই ঘটনাটা বলবেন নিশ্চয়ই। দরকার হলে আমাকেও ডাকতে পারেন। আমি চাই যে উনি দ্রুত সেরে উঠুন।”
পুলিশ অফিসারের সব কথায় সায় দিয়ে ঘাড় নাড়ে নয়ন, যাতে কোনোভাবেই ঘটনাটা আর না গড়ায়। তারপর নীলকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু দুশ্চিন্তাটা যায় না। তাই বাড়ি ফিরে চুপচাপ শুয়ে পড়ে। এদিকে নীলও রাস্তায় প্রায় কোনও কথাবার্তা বলেনি। ফিরে এসে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছে। সারাদিন এভাবেই যায়। তারপর রাতের খাওয়াদাওয়া হলে ভোলুকে সুইচড অফ করে নীল নয়নকে বলে, “আমার জন্য তোমার আজ খুব টেনশন গিয়েছে। হেনস্থাও হতে হয়েছে বেশ খানিকটা। সেজন্য আমি ঠিক করেছি তোমাকে আজ একটা উপহার দেব। তুমি ঘরে গিয়ে বোসো, আমি আসছি।”
একটু আশ্চর্য হয়ে নিজের ঘরে চলে যায় নয়ন। একটু পরে হাতে একটা বড় সবুজ রংয়ের বোর্ড নিয়ে নীল ঢোকে। বোর্ডটা নয়ন চেনে। একটা বড় বাক্সে কতগুলো জিনিস আনা হয়েছিল। সেই বাক্সেরই একটা টুকরো ওটা। কিন্তু নীল যখন আস্তে-আস্তে বোর্ডটা তার দিকে ঘোরায় তখন সাংঘাতিক চমকে ওঠে নয়ন। গত সপ্তাহেই তারা দু‘জনে ছুটির দিনে জঙ্গলের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখেছিল। গাছপালার আড়ালে টুকটুকে লাল সূর্য। ঘরে ফিরছে পাখির ঝাঁক। সেইসবই যেন কী করে উঠে এসেছে বোর্ডের গায়ে।
“এটা কী?” অবাক হয়ে জানতে চায় নয়ন।
“একে বলে ছবি। আমি এঁকেছি তোমার জন্য। তুমি চিনতে পারছ? এগুলো আমরা দেখেছিলাম সেদিন। তুমি আগে কখনও ছবি দেখেছ?”
আস্তে-আস্তে মাথা নাড়ে নয়ন, “চিনতে পেরেছি। জঙ্গলের ধারে বসেছিলাম আমরা দু‘জনে। জান নীল, আমার মনে পড়ছে খুব ছেলেবেলায় আমি ছবি দেখেছি। মহীদাদুর বাড়িতে। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম। ছবি কী করে তৈরি হয়, তাও জানি না। তুমি এটা তৈরি করলে কী করে?”
“তৈরি করা নয়, একে বলে আঁকা। এর জন্য রং লাগে আর তুলি।
সেসব তোমাদের এখানে পাওয়া যায় না। আমি অনেক খুঁজেছি। কিন্তু কিছুদিন ধরেই ছবি আঁকতে বড্ড ইচ্ছে করছিল। তাই ঠিক করলাম নিজেই বানিয়ে নেব। জঙ্গল থেকে কাঠবিড়ালির লেজের লোম তুলে এনেছিলাম। তাই দিয়ে প্রথমে তুলি বানালাম। তারপর ভোলুর রান্নাঘর হাঁটকে নানা রংয়ের মশলা জোগাড় করে গুলে নিলাম। কিন্তু ছবিটা তোমার ভাল লেগেছে নয়ন?”
নীলের কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনছিল না নয়ন। কারণ তার মাথার মধ্যে তখন ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য চিন্তা। তাই খানিকটা অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ে প্রথমটায়, তারপর কেমন যেন অদ্ভুত চোখে নীলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, “তোমাকে আজ কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব, তুমি আমাকে সত্যি কথা বলবে তো?”
“নিশ্চয়ই বলব। তুমি আমার বন্ধু নয়ন। আমি কখনও বন্ধুকে মিথ্যে বলি না।”
“তুমি কি সত্যিই সব ভুলে গিয়েছ নীল? তোমার পরিচয় কিচ্ছুটি মনে নেই?”
ধীরে-ধীরে মাথা নাড়ে নীল, “না, আমি কিছুই ভুলে যাইনি। এতদিন তোমাদের সবাইকে যা বলে এসেছি, সেটা সত্যি কথা নয়।” “তা হলে তুমি কে?”
“সেটা আমি তোমাকে এখুনি বলতে পারব না নয়ন। তবে এটুকু বলতে পারি, আমার থেকে তোমার কোনও ভয় নেই। আমি তোমার কোনও ক্ষতি করব না। সত্যি কথা বলতে কী, কারও কোনও ক্ষতি করতেই আমি চাই না, করার ক্ষমতাও আমার নেই। তবে তুমি যদি আমার কাছে কোনও সাহায্য চাও, আমি চেষ্টা করব সেটা করতে।”
নয়ন যেন দু’-এক মুহূর্ত কী ভাবে। তারপর নীলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “নীল তুমি কি একজন শিল্পী?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি একজন আপাদমস্তক শিল্পী মানুষ।” “কী করে এত নিশ্চিত হচ্ছ তুমি?”
“আমি শিল্পী বলেই তো তোমার আশপাশে যারা আছে, তাদের থেকে আমি এতটা আলাদা। তোমরা যেটা ভাবতেই পার না, তোমাদের স্কুল, কলেজ, বই, খাতা কোথাও যা নেই, তা আমি অনায়াসে করে ফেলি। কিন্তু শিল্পীর কথা তুমি কোথায় শুনলে নয়ন? তুমি কেন শিল্পীর খোঁজ করছ?”
“আমার যে একজন শিল্পীকে বড্ড দরকার….”
সেদিন প্রায় সারারাত জেগে মহীদাদুর কাছে শোনা সব কথা নীলকে খুলে বলে নয়ন। শুনতে-শুনতে কখনও রাগে মুখ শক্ত হয়ে যায় নীলের। কখনও দু‘চোখ উপচে জল পড়ে
নীলের শরীরের কোষ থেকে ডি এন এ সংগ্রহ করেছে নয়ন। মহীদাদুর ফরমুলা অনুযায়ী বাকি আর সব উপাদানও জোগাড় করা হয়েছে। এবার সবকিছু মাপমতো মিশিয়ে অ্যান্টিডোট তৈরি করতে হবে। মুশকিল হচ্ছে নয়নের নিজের বাড়িতে কোনও ল্যাবরেটরি নেই। তার কাজের জায়গায় যদিও খুব উন্নতমানের ল্যাবরেটরি আছে। কিন্তু সেখানে নিজের মতো কিছু করাটা একটু বিপজ্জনক। যদিও নয়ন নিজে যেখানে কাজ করে, সেটা একেবারেই তার নিজের দখলে আর তাকে সন্দেহ করারও কোনও কারণ নেই, কিন্তু তবু সাবধান হওয়াই ভাল।
সবদিক বিবেচনা করে নীলই বুদ্ধি দেয় নয়নকে, “তুমি বসকে জানাও যে, একটু নতুন ধরনের ওষুধ তৈরির চেষ্টা করছ। সেজন্য আপাতত কিছুদিন তোমাকে একটু বেশি সময় ল্যাবরেটরিতে থাকতে হবে। আমার মনে হয় অনুমতি পেতে অসুবিধে হবে না। বিকেলের পর ল্যাবরেটরি যখন ফাঁকা হয়ে যাবে তখন নিজের কাজ করবে।”
বুদ্ধিটা মনে ধরে নয়নের। তবে একটু হেসে বলে, “বস যদি পরে জানতে চায় কাজ কতটা এগোল তখন?”
“তখন বলবে এখনও তেমন কিছু এগোয়নি। কয়েকটা জায়গায় মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে। আবার নতুন করে করছি। তবে আমার মনে হয় না কিছু জিজ্ঞেস করবে। তোমার বসের নিজে থেকে অত চিন্তা করার ক্ষমতাই নেই। উপরওয়ালারা কেউ না বললে খোঁজও নেবে না।”
বন্ধুর কথামতোই এগোয় নয়ন। প্রথমে কয়েকদিন একটু বেশি রাত পর্যন্ত ল্যাবরেটরিতে কাজ করে বোঝার চেষ্টা করে কেউ তার উপর নজর রাখছে কি না। কিন্তু সেরকম কিছু চোখে না পড়ায় একটু একটু করে সব উপাদানগুলো নিয়ে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে গুছিয়ে রাখে। তারপর একদিন সবার অলক্ষ্যে শুরু হয়ে যায় অ্যান্টিডোট তৈরির কাজ। ফরমুলা অনুযায়ী সব কিছু করতে সময় লাগে প্রায় দু‘সপ্তাহ। অ্যান্টিডোট তৈরি হওয়ার পর এবার সেটাকে মেশাতে হবে ট্যাবলেটের সঙ্গে। সে কাজটা বেশ কঠিন। কারণ ট্যাবলেটের অন্যান্য উপাদানগুলো যেখানে মেশানো হয়, সেখানে অনেক লোক কাজ করে। তা ছাড়া সেটা নয়নের নিজস্ব এলাকাও নয়। তাই ঘনঘন সেখানে গেলে সেটা চোখে পড়বেই।
নয়ন তাই প্রথমে ট্যাবলেট তৈরির পদ্ধতিটা সম্বন্ধে ভাল করে খোঁজ নেয়। ট্যাবলেটগুলো তৈরি হয় পরপর অনেক ধাপে। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন উপাদান মাপমতো মেশানো হয়। তারপর একটা ফাইনাল মিক্সিংয়ের পর বাইরের কোটিংটা দিয়ে ফয়েলের ভিতর ভরে ফেলা হয়। সবটা জানার পর নয়ন ঠিক করে একেবারে ওই ফাইনাল স্টেজেই অ্যান্টিডোট মেশাবে সে। একটা সুবিধে আছে, ফাইনাল স্টেজের কাজটা যার তত্ত্বাবধানে হয়, সেই হেনরি বার্টের সঙ্গে নয়নের ভাল রকম পরিচয় আছে। তাই কথাবার্তা বলার অছিলায় ওখানে যাওয়া যাবে। আর দ্বিতীয়ত, সেটা হল ওই ফাইনাল স্টেজের পর আর কোনও টেস্টিং হয় না। আগের প্রতিটি ধাপেই মিক্সিংয়ের পর একবার করে টেস্ট করা হয়। সুতরাং এই স্টেজেই অ্যান্টিডোট মেশানোটা সবচেয়ে নিরাপদ। নয়ন খোঁজ নিয়ে আরও একটা জিনিস জানতে পারে যে, এই ফাইনাল মিক্সিংটা হয় মাসে একবার। দিনটাও নির্দিষ্ট। প্রতিমাসের তৃতীয় বুধবার হেনরির তত্ত্বাবধানে এই কাজটা চলে। ট্যাবলেট ফয়েলে প্যাকিংয়ের জন্য চলে যায় শুক্রবার।