ঠাকুরমা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মহীদাদু একটু সময় দু’ আঙুলে নিজের কপালটা টিপে বসে রইলেন। তারপর আস্তে-আস্তে চোখ খুলে নয়নের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর নিশ্চয়ই পুরো ব্যাপারটাই ভারী অদ্ভুত লাগছে, তাই না নয়ন? ভাবছিস শেষ পর্যন্ত চারশো পেরিয়ে মহীদাদুকে ভীমরতিতে ধরল।”
“না, তা ভাবিনি মোটেই। তবে আশ্চর্য হয়েছি নিশ্চয়ই। বিশেষ করে তুমি যখন মনোবাহীতে আমাকে কোনও কথা না বলে এখানে আসতে বললে, তখন বেশ একটু অবাক হয়েছিলাম।”
“আমার কোনও উপায় ছিল না রে। কারণ আমি বুঝতে পারছি যে আমার হাতে আর বিশেষ সময় নেই। তাই কোনও ঝুঁকি না নিয়ে তোকে ডেকে পাঠিয়েছি।”
“তার মানে…কী বলছ তুমি…”
“ঠিকই বলছি। আমি জানি মানে বুঝতে পারছি যে, আমার দিন শেষ হয়ে আসছে। আর বেশিদিন বাঁচব না। তার আগে আমার কাজ আমাকে শেষ করে ফেলতে হবে।”
“এটা তুমি কী করে বলছ দাদু? আমরা জানি যে, কেউ অমর নয়। কিন্তু কে কবে মারা যাবে সেটা কি কেউ বলতে পারে? সে তো সেই আদিম যুগ থেকেই অজানা এক তথ্য।”
“সবাই পারে না। কিন্তু কেউ-কেউ পারে। আচ্ছা আমাকে একটা জিনিস বল, তুই তো জানিস যে পৃথিবীর লোকসংখ্যা এখন নির্দিষ্ট। তার বেশি বাড়ানো কিংবা কমানো যায় না। তার মানে প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার মানুষ জন্মায় এবং মারা যায়। এখন এটা যদি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে হয়, তা হলে এই সংখ্যাটার হেরফের হবেই। কখনও বেশি মানুষ জন্মাবে কিংবা কম মানুষ মরবে। কিংবা উলটোটা। কিন্তু সেটা হয় না। তার মানে ঠিক কতগুলো মানুষ মারা যাবে এবং কতজন জন্মাবে সেটা কেউ নিয়ন্ত্রণ করে। একদম অঙ্কের নিয়মেই এর পর বলা যায়, যারা এটা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা নিশ্চয়ই জানে যে এবার কারা মারা যাবে। এই জটিল বিষয়টা নিয়ে তোর মনে কোনোদিন কোনও প্রশ্ন জাগেনি নয়ন?”
“একদম জাগেনি বলব না। ইনফ্যাক্ট আমার একটু আশ্চর্যই লাগে, এই যে কোনও এক অজানা কারণে একদিন হঠাৎ একটা মানুষ মারা যায়, সেই কারণটাকে কেন কেউ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে না? কেন বিজ্ঞানীরা এবিষয়ে এতটা উদাসীন!”
“চেষ্টা করে না, কারণ অধিকাংশ মানুষ এটা নিয়ে ভাবে না। ভাবার ক্ষমতাই তাদের নেই। কেন নেই সেকথাটা তোকে পরে বলছি। তবে কিছু লোক কিন্তু ভাবে। ভাবে বলা উচিত নয়, তারা ব্যাপারটা জানে। সেই বিজ্ঞানীরা মোটেই এ ব্যাপারে উদাসীন নন। বরং তাঁরাই ঠিক করেন যে, কারা মারা যাবে এবং কীভাবে মারা যাবে।
“কী সাংঘাতিক কথা! এরা কারা? এদের এরকম করার অধিকারই বা কে দিল?”
“এঁরা সবাই অতি উচ্চ পদমর্যাদার বিজ্ঞানী, ডাক্তার, প্রশাসক কিংবা অন্য কিছু। এঁরা একটি বিশেষ টিমের গোপন সদস্য। সমাজে বা পরিচিত মহলে এঁদের সকলেরই আলাদা পরিচয় আছে। কিন্তু তাঁরা যে এই কাজটা করে, সেটা খুব কম লোকেই জানে। এটাকে বলা হয় প্রজেক্ট। এর একটা বেশ গালভরা নামও আছে বুঝলি, পারফেক্ট ইউনিভার্স, সংক্ষেপে পিউ। পৃথিবীটাকে এখন বকলমে এঁরাই চালায়।”
“তুমি এত কথা জানলে কী করে?”
“আমিও তো এঁদের একজন মেম্বার।”
“তুমি এরকম একটা ভয়ানক প্রজেক্টের মেম্বার!”
মহীদাদুর কথায় সাংঘাতিক চমকে ওঠে নয়ন। তার দিকে তাকিয়ে একটু বিষণ্ণ হেসে মহীদাদু বলেন, “পারফেক্ট ইউনিভার্স মানে বুঝতে পারছিস তো? একটা নিখুঁত-সুন্দর পৃথিবী। সেরকমটা আর কে না চায় বল? তার পিছনে যে এরকম দানবীয় পরিকল্পনা থাকতে পারে, সেটা তো প্রথমে বুঝিনি। তবে এখন বোধ হয়, আমি পিউ-এর মেম্বার ‘ছিলাম’ বলাটাই ঠিক। কারণ অনেকদিন হল আমি আর ওঁদের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত নই। পিউ-এর সঙ্গে আমার কানেকশনের সব রাস্তাগুলোই ডিঅ্যাক্টিভেট করে দেওয়া হয়েছে। যদিও যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন খাতায় কলমে মেম্বার থাকব। কারণ ওঁরা আমাকে লাইফটাইম মেম্বারশিপ দিয়েছিল। তবে সেটাও আর বেশিদিন নয়।” “তুমি বারবার এই কথাটা বলছ কেন বলো তো দাদু?”
“বুঝতে পারলি না! আমি তো জানি রে দাদাভাই, পিউ যখন ঠিক করে নেয় কাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে, তারপর তাদের উপর কী কী করা হয়, কীভাবে পদ্ধতিটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, সেসবই তো আমার জানা। মানুষটা যখন ধীরে ধীরে শেষ পরিণতির দিকে এগোয় তখন সেটা ঠিকঠাক চলছে কি না, বোঝার জন্য মনিটরিং হয়। পিউ-এর মেম্বাররা সেই মনিটরিংয়ে কী কী লক্ষণ নোট করে তাও তো আমি জানি। তাই নিজের শরীরে সেই লক্ষণগুলো যখন ধীরে-ধীরে অনুভব করছি, তখন তো বুঝতেই পারছি যে হাতে সময় আর বেশি নেই।”
“এত কিছু বুঝতে পারছ, অথচ প্রতিবাদ করছ না? সেটা থেকে বেরিয়ে আসারও চেষ্টা করছ না?”
“প্রতিবাদ কার কাছে করব? কেউ তো আমার কথা বিশ্বাস করবে না। আর বেরিয়ে আসারও কোনও উপায় নেই।”
“কেন, উপায় নেই কেন?”
“কারণ আমি সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন যে ওষুধগুলো খাই, তাতেই মেশানো হচ্ছে এমন একটা উপাদান যেটা খুব ধীরেধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে কমিয়ে আনবে আমার জীবনীশক্তি। কোন ওষুধটায় কখন সেটা মেশানো হচ্ছে আমি জানি না। প্রতিটি ট্যাবলেট আমার পক্ষে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নয়। আমি সব ওষুধই খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারি। তাতে একদম প্রাকৃতিক নিয়মে আমি কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাব। আর যদি ওষুধ খেয়ে যাই তা হলে ওদের তৈরি করা রাস্তা দিয়ে মৃত্যুর দিকে এগোব। তোকে ছোটবেলায় আমি যে বাঘবন্দি খেলা শিখিয়েছিলাম না, আমার অবস্থা এখন অনেকটা সেরকম। তবে তা নিয়ে আমার কোনও আফসোস নেই। অনেক বছর বেঁচেছি। কিন্তু মরার আগে কিছু কথা বলে যেতে চাই, যেটা অন্য কেউ জানে না। সেজন্যই আমি তোকে ডেকে পাঠিয়েছি।”
“কিন্তু তুমি কথাগুলো আমাকেই বলতে চাইছ কেন দাদু?”
“কারণ আমি মনে করি যে, একমাত্র তুমিই আমার কথাগুলো বুঝতে পারবে।”
মহীদাদু হঠাৎ ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’তে চলে যাওয়ায় একটু থতমত খেয়ে যায় নয়ন। আর কোনও প্রশ্ন করে না। দাদুও একটু সময় স্থির হয়ে বসে বোধ হয় নিজের মনকে খানিকটা সংহত করেন। তারপর বলেন, “আমি যে পেশায় বিজ্ঞানী, সেটা তুই জানিস। কিন্তু আমি কী ধরনের কাজ করতাম সেটা নিশ্চয়ই তোর জানা নেই। জানা সম্ভবও নয়। সেটা বুঝতে হলে একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। আসলে খুব ছেলেবেলা থেকেই বিজ্ঞানে আমার আগ্রহ ছিল। আমাদের ছেলেবেলার সঙ্গে অবশ্য তোদের ছেলেবেলার অনেক পার্থক্য। তখন পৃথিবীটা অনেক অন্য রকম ছিল। বিজ্ঞান আজকের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। তবে তখনই কিন্তু সোমাটিক সেল থেকে ক্লোনিং আবিষ্কার হয়ে গিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা মানুষের শরীরের যে-কোনও কোষ থেকে ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গও বানিয়ে ফেলতে পারলেন। মানে এখন যেমন হার্ট, লাংস কিংবা কিডনি খারাপ হয়ে গেলে সেটা অনায়াসেই বদলে ফেলা যায়, সেটার শুরু তখন থেকেই। এর আগে সদ্য মারা গিয়েছে এমন মানুষের শরীর থেকে এগুলো তুলে এনে লাগানো হত। কিন্তু একজনের কোষের গঠনের সঙ্গে অন্যের কোষ যে পুরোপুরি মিলবে তা তো নয়। ফলে এই পদ্ধতিটা একশো শতাংশ সফল হত না। নিজের শরীরের কোষ থেকে ক্লোন করা শুরু হলে এই সমস্যাটা মিটে গেল।
“আমিও তখন কাজ করতাম ক্লোনিং নিয়েই। তবে আমার কাজের আসল ফোকাল পয়েন্ট ছিল ডি এন এ। তুই নিজে ল্যাবরেটরিতে কাজ করিস। তাই মানুষের শরীরে ডি এন এ-র ভূমিকা তোকে বোঝাতে হবে না। ভাল করেই জানিস যে, এন এ-র সামান্য পরিবর্তনে একটা মানুষের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো কীভাবে পালটে যেতে পারে। আমার অবশ্য চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে তেমন কোনও মাথাব্যথা ছিল না। আসলে সেই সময় এমন কতগুলো অসুখ ছিল, যার ওষুধ বিজ্ঞানীরা বের করতে পারছিলেন না। বের করা সম্ভব হচ্ছিল না, কারণ এগুলো সবই ছিল ডি এন এ-র ত্রুটি। ত্রুটি বলাটা বোধ হয় ঠিক হল না নয়ন, বলা উচিত, ডি এন এ-র কিছু ক্যারেক্টারের জন্য এই অসুখগুলো হত। কোনোভাবে এই ক্যারেক্টারগুলোকে ডি এন এ থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া যায় কি না, সেটাই আমি চেষ্টা করছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই সরকার আমার কাজে খুবই উৎসাহী ছিল এবং আমাকে নানাভাবে সাহায্যও করছিল। প্রায় পঞ্চাশ বছর এটা নিয়ে টানা কাজ করার পর আমি শেষ পর্যন্ত এই ক্যারেক্টারগুলোকে আলাদা করার পদ্ধতিটা বের করে ফেলি। এর মধ্যে বুঝতেই পারছিস যে আমার শরীর, মন এবং মস্তিষ্ক যাতে সম্পূর্ণ সচল এবং স্বাভাবিক থাকে, সেজন্য যেসব রিপ্লেসমেন্ট দরকার সবই করা হয়েছে।”
ঠাকুরমা কফি নিয়ে এসেছিলেন। গরম কফিতে একটা চুমুক দিয়ে মহীদাদু ফের বলতে শুরু করলেন, “আমি এই পদ্ধতিটা আবিষ্কার করার পর সারা বিশ্বের অন্যতম সেরা সব বিজ্ঞানী আর সরকারের সর্বোচ্চ পদে যাঁরা আছেন, তাঁদের নিয়ে একটা মিটিং হয়। সেখানেই জন্ম হয় পারফেক্ট ইউনিভার্স মানে পিউ-এর। তার মানে বুঝতেই পারছিস, পিউ-এর একেবারের শুরুর সদস্য যাঁরা, তাঁদের মধ্যেই আমি ছিলাম। আসলে আমরা সবাই চাইছিলাম পৃথিবীতে যেন অধিকাংশ মানুষ সুস্থ সবল থাকে। এই ধরনের রোগ, যার কোনও চিকিৎসা নেই, তাতে যেন আর কেউ কষ্ট না পায়। তাই ঠিক হয় মায়ের শরীরের ভিতর ভ্রূণ যখন সবে তৈরি হচ্ছে, তখনই সেটা পরীক্ষা করে দেখা হবে। যদি ডি এন এ-তে কোনও গণ্ডগোল থাকে, তা হলে তখনই সেই ক্যারেক্টারগুলো বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। তা হলে যে শিশু জন্মাবে তার আর এই ধরনের কোনও অসুখ হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। এভাবেই আস্তে-আস্তে একসময় পৃথিবী থেকে এইসব রোগের অস্তিত্বই লুপ্ত হয়ে যাবে।
“বুঝতেই পারছিস, এরকম একটা মহৎ প্রস্তাব আমাদের সকলেরই খুব ভাল লেগেছিল। আপত্তির কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। আর আমি যেহেতু এই পদ্ধতিটার মূল আবিষ্কর্তা, তাই আমার সম্মান এবং মতামত, দুই-ই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার সঙ্গে এই প্রজেক্টে আরও দু‘জন কাজ করেছিলেন। একজন ইহুদি বিজ্ঞানী ডঃ নাথনিয়াল, আর-একজন আফ্রিকার বিজ্ঞানী সুনে স্টাসেন। আমার মতো এঁরা দু‘জনও ওই মিটিং থেকেই পিউ-এর সদস্য হয়ে যান। তবে তখনই আমাদের এটাও বলে দেওয়া হয় যে, পিউ-এর এইসব কাজকর্মের বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে। সাধারণ মানুষকে এবিষয়ে কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই। কথাটা শুনে আমি আপত্তি করেছিলাম। কারণ আমার মনে হয়েছিল যে, আমরা তো মানুষের ভালর জন্যই কাজটা করছি, তা হলে সেটা জানাতে অসুবিধে কোথায়। কিন্তু তার উত্তরে আমাকে বোঝানো হয় যে, এত জটিল ব্যাপার সবাইকে বিস্তারিতভাবে বোঝানো যথেষ্ট কঠিন। ঠিকমতো না বুঝেই যদি কেউ আপত্তি করে তখন আমাদের প্রজেক্টটা সাকসেসফুল হবে না। কথাটার মধ্যে যুক্তি ছিল। তা ছাড়া অন্যরাও কেউ আপত্তি করেননি। তাই আমি শেষপর্যন্ত রাজি হয়ে যাই।”
“তোমাদের প্রজেক্টটা নিয়ে কি শেষপর্যন্ত কাজ শুরু হয়েছিল?” “হ্যাঁ-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে কীভাবে কাজটা হচ্ছে, তা নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাইনি। কারণ, একবার কাজ শুরু হয়ে গেলে তখন তো সেটার দায়িত্ব ডাক্তার আর প্রশাসনে যাঁরা আছেন তাঁদের। বিজ্ঞানীর কাজ তো ওখানেই শেষ। তা ছাড়া সরকার থেকে আমাকে বলা হয়েছিল ডি এন এ নিয়ে গবেষণার কাজটা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে। কারণ ডি এন এ-র সব অন্ধিসন্ধি হাতের মুঠোয় এসে গেলে যে যুগান্তকারী অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলা যাবে, সেটা ততদিনে সবাই বুঝে ফেলেছে।”
“তোমার সঙ্গে কি বাকি দু‘জনও তখন কাজ করছিলেন?”
নয়নের কথাটা শুনে মহীদাদুর সঙ্গে একবার ঠাকুরমার চোখাচোখি হল। তারপর মহীদাদু একটু বিষণ্ণ হেসে বললেন, “না, ওদের দু‘জনের কেউই আর আমার সঙ্গে কাজ করেনি। নাথনিয়াল যে-কোনও কারণেই হোক ডি এন এ নিয়ে গবেষণায় আর আগ্রহী ছিল না। ও একটা নতুন ধরনের ফল তৈরির চেষ্টা করছিল, যা খেতে খুব ভাল হবে আর তাতে এমন সব পুষ্টিগুণ থাকবে যাতে মানুষের জীবনীশক্তি বহুগুণ বেড়ে যাবে। তবে কাজটা ও শেষ করতে পারেনি। কারণ কয়েক বছর পরেই আমি কাগজে পড়েছিলাম যে, নাথনিয়াল মারা গিয়েছে। আমার থেকে নাথনিয়াল বেশ খানিকটা ছোটই ছিল। তাই বলতে হবে তুলনায় অল্প বয়সেই ও মারা গিয়েছিল। কিন্তু তখনও পর্যন্ত মানুষের মৃত্যু নিয়ে আমার মনে তেমন কোনও প্রশ্ন জাগেনি। তাই মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছিলাম। এখন অবশ্য মাঝে-মাঝে মনে হয়…”
কথার মাঝখানে চুপ করে গিয়ে আবার দু’-চুমুক কফি খেলেন মহীদাদু
“কফিটা কি ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে? আর-এক কাপ এনে দেব?”
ঠাকুরমার কথায় মাথা নেড়ে ফের বলতে শুরু করলেন, “সুনেও আমার সঙ্গে আর কাজ করেনি। ওকে সরকার থেকে অন্য একটা কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ও সেটা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমার সঙ্গে অনেক বছর তার কোনও যোগাযোগও ছিল না। কিন্তু হঠাৎই সুনে সোলার ডায়েরিতে আমাকে একটা মেসেজ পাঠায় যে, সে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি যেন সস্ত্রীক তার বাড়িতে যাই। তখনও আমি জুরান্তিতে আসিনি। তাই কোথাও যাওয়া-আসা করতে অসুবিধে ছিল না। সুনে তখন থাকত জার্মানির একটা ছোট্ট শহরে। সেখানেই ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করত।
“তার নেমন্তন্ন পেয়ে আমি আর তোর ঠাকুরমা সেখানে গেলাম। ভারী সুন্দর একটা ছোট্ট বাড়ি। তখন শীতকাল। চারদিক বরফে ঢেকে গিয়েছে। সুনে ছিল ভারী আমুদে মেয়ে। কুচকুচে কালো রং। মাথা ভর্তি রিংয়ের মতো পাকানো চুল আর ঝকঝকে দাঁতের হাসি। আমার কাছে সুনের এই চেহারাটাই সবসময় চোখের উপরে ভাসে। কিন্তু সেবার গিয়ে দেখি ওর সেই ঝকঝকে ভাবটাই আর নেই। কেমন যেন একটা সন্ত্রস্ত চেহারা। আমাদের দেখে অবশ্য খুশি হল খুব। সারাদিন নানা রকম গল্পটল্পও হল। একজন মোটাসোটা জার্মান মহিলা রোবট, সেই বাড়ির সব কাজকর্ম করে। রাতে ডিনারের পর তাকে সুইচড অফ করে সুনে আমাদের সঙ্গে কফি নিয়ে বসল।
“তখনই জানতে পারলাম সেই ভয়ংকর কথাটা। আমরা যে মানুষের মৃত্যুকে স্বাভাবিক মনে করছি, সেটা আসলে স্বাভাবিক নয়। খুব ধীরে-ধীরে মানুষের শরীরে এমন একটা কেমিক্যাল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যেটা একটু-একটু করে দেহের দুটো-একটা ভাইটাল অরগ্যানকে নষ্ট করে দেয়। কাজটা এমনভাবে চলে, যে যার শরীর সে নিজে কোনও অসুবিধে টের পায় না। তাই ডাক্তারের কাছে যাওয়ারও প্রয়োজন হয় না। তারপর হঠাৎ একদিন সেই অরগ্যানগুলো কাজ বন্ধ করে দেয় আর মানুষটির মৃত্যু হয়।”
“সুনে স্টাসেন কী করে কথাটা জানতে পারলেন?”
“সেটাই তো বলছি শোন। আসলে এই কেমিক্যালটা আবিষ্কার করেছিল সুনে নিজেই। তোকে একটু আগে বললাম না, সুনে আমার সঙ্গে কাজ করেনি। ওকে একটা আলাদা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এটাই ছিল সেই কাজ। অবশ্যই সুনে নিজে আসল কথাটা জানত না। ওকে বলা হয়েছিল, আমাদের এই সোলার সিস্টেমের বাইরের কিছু প্রাণীর নাকি এই সৌরজগতে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা আছে। যাঁরা মহাকাশ নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা সেরকমই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই অন্য সৌরজগতের জীবরা ঠিক কী ধরনের, সে সম্পর্কে এখনও কোনও নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাদের সম্ভাব্য আক্রমণ আটকাতে নানা ধরনের প্রস্তুতি চলছে। সুনের কাজটাও তারই একটা পার্ট। এমন কয়েকজন মানুষ এই কথাগুলো বলেছিলেন যে, সুনে ব্যাপারটা বিশ্বাস করেছিল। এটাও ওকে বলা হয়েছিল যে, রাসায়নিক বিষটা তৈরি হবে সেটা যেন খুব ধীরে-ধীরে প্রায় বুঝতে না দিয়ে শরীরে কাজ করে। যেহেতু সেই সব অজানা গ্রহের জীব সম্বন্ধে আমাদের কিছুই জানা নেই। তাই এই সাবধানতাটা নেওয়া দরকার। সুনে কেমিক্যালটা তৈরি করার পর সেটা প্রথমে বাঁদরের উপর এক্সপেরিমেন্ট করে। বাঁদরটার মরতে সময় লেগেছিল পাঁচ বছর। তখন ওকে বলা হয় ওই টাইমস্প্যানটা বাড়িয়ে দশ বছর করতে। সেটা করতে অবশ্য ওর খুব একটা অসুবিধে হয়নি। কাজটা শেষ করে ও পিউ-কে দিয়ে দেয়। তখনও পর্যন্ত ওর মনে এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না।”
“সন্দেহটা তা হলে হল কীভাবে?”
“খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে বলতে পারিস। সুনের এক বান্ধবী ছিল, তার নাম মারিয়া। তাকেও আমিও চিনি। ভদ্রমহিলা ব্লাড সেল নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তিনি হঠাৎ মারা যান। মারিয়া থাকতেন সুনের বাড়ির কাছাকাছি একটা শহরে। তাই মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সুনে তাঁর বাড়িতে গেছিল। নিয়মমাফিক মৃতদেহের পাশে ফুল রাখতে গিয়ে সে চমকে ওঠে। মারিয়ার দু‘চোখের পাতার উপর ছিল কালো ফুটকি-ফুটকি দাগ। পাশাপাশি চার-পাঁচটা কালো তিল থাকলে যেরকম হয়, অনেকটা সেরকম। সুনে আমাকে বলে, সে যখন এক্সপেরিমেন্টটা করছে, তখন প্রথমে অনেক একই ধরনের রাসায়নিক তৈরি করেছিল। জীবন্ত প্রাণীর উপর সেগুলো প্রয়োগ করার পর, যাতে কোনোভাবে গুলিয়ে না যায়, তাই প্রত্যেকটার আলাদা-আলাদা চিহ্ন ছিল। কোনোটাতে মৃত জীবটার কানের উপরটা নীলচে হয়ে যেত, কোনোটাতে জিভের মাঝ বরাবর একটা গাঢ় লাল রেখা পাওয়া যেত, এইরকম আর কী। ফাইনালি যে রাসায়নিকটা ও পিউকে দিয়েছিল, সেটার বৈশিষ্ট্য ছিল চোখের পাতার উপর ওরকম কালো ফুটকি-ফুটকি দাগ। বুঝতেই পারছিস মারিয়ার চোখের পাতায় ওরকম দাগ দেখে সুনে ভয়ানক চমকে ওঠে।
“কেমিক্যালটা পিউ-কে দিয়ে দেওয়ার পর ততদিনে প্রায় পনেরো বছর কেটে গিয়েছে। বাড়ি ফিরে সুনে পুরনো কাগজপত্র দেখে বুঝতে পারে পিউকে ওটা হ্যান্ডওভার করার সময় সে এই কালো-কালো ফুটকি হওয়ার ব্যাপারটা জানায়নি। আসলে এটা তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলে তখন তার মনেই হয়নি। পুরো ঘটনাটা নিজের মনে বিশ্লেষণ করে সুনে ঠিক করে যে তার সন্দেহটা সত্যি কিনা সেটা আগে বুঝে নেওয়া দরকার। তারপর চেনা-পরিচিতের মধ্যে কারও মৃত্যুসংবাদ পেলেই সে সেখানে যেতে শুরু করে এবং বছর তিন চারের মধ্যেই নিশ্চিতভাবে বুঝে যায় যে-কোনও মৃত্যুই স্বাভাবিক নয়। প্রতিটি মানুষকেই মারা হচ্ছে তার তৈরি করা কেমিক্যাল দিয়েই। কারণ সকলেরই চোখের পাতার উপরে থাকছে ঠিক একই রকম কালো দাগ।
“সুনে তখন যে মানুষরা মারা যাচ্ছে, তাদের জীবন এবং কাজকর্ম নিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করে তার মনে হয়, প্রতিটি মৃত্যুর একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। এঁরা সবাই অন্তত বছর দশ-বারো আগে নতুন কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মানে যে কাজ তাঁরা করছিলেন তার থেকে সরে এসে অন্য কিছু করতে শুরু করছেন কিংবা অনেক সময় কিছুই না করে শুধু নিজের খুশিমতো জীবন কাটাবেন ঠিক করে ফেলেছেন। সুনের মনে হয়, পিউ এই মানুষগুলোকে তখনই খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে এবং তারপরেই এদের মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। কারণ পিউ-এর কাছে পারফেক্ট ইউনিভার্সে এরকম বেকার মানুষের কোনও জায়গা নেই।
“সুনে আমাকে বলে যে, বিভিন্ন রকম ঘটনা এবং তথ্য বিশ্লেষণ করে সে বুঝতে পেরেছে যে পিউ প্রতি বছর একটা লিস্ট তৈরি করে। তাতে লেখা থাকে নেক্সট টেন ইয়ারে কোন-কোন মানুষের মৃত্যু হবে। তারপর তাদের শরীরে ওই কেমিক্যালটা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এখন সেটা কাকে কীভাবে দেওয়া হবে তার নিশ্চয়ই নানারকম পদ্ধতি আছে। তবে সব থেকে সহজ পদ্ধতিটা হল ওষুধের মাধ্যমে দেওয়া। কারণ, সব মানুষই তো এখন বহু বছর বাঁচে। তাই সুস্থ থাকার জন্য নানা রকম ওষুধ তাদের খেতেই হয়। বাড়িতে কাজের জন্য যে রোবট আছে, তাকে কয়েকটা প্রোগ্রাম ফিড করে দিয়ে একাজটা অনায়াসেই করিয়ে নেওয়া যায়। এরকম যে হতে পারে সেই চিন্তা তো কারও মাথাতেই আসবে না। তাই সন্দেহেরও কোনও ব্যাপার নেই। সবটাই একদম ঠিকঠাক মসৃণভাবে চলে।”
কথাটা শেষ করে মহীদাদু নয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলেন, “তোর নিশ্চয়ই আমার কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? আমারও হয়নি। আমি ভেবেছিলাম সুনে একটু অতিমাত্রায় কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়েছে। ওর মধ্যে হয়তো কোনও কারণে মৃত্যুভয় কাজ করছে, তাই এসব ভাবছে। তাই আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ তুমি কি শুধু এই কথাগুলো বলার জন্যই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছ, নাকি আমার কাছে কোনও সাহায্য চাইছ?’
“উত্তরে সুনে বলল, ‘না মহী, তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে না আমি জানি। ইনফ্যাক্ট পৃথিবীর কেউই আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। কারণ কেউ কথাটা বিশ্বাসই করবে না। কিন্তু আমি ঠিক করেছি পিউ-এর যাদের হাতে আমি জিনিসটা দিয়ে দিয়েছি, তাদের সঙ্গে দেখা করে আমি এই সন্দেহের কথাটা বলব। যদিও আমার আশঙ্কা সেটা বলার পর আমার পক্ষে হয়তো আর বেশিদিন বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। আমি নিজেও জানি না যে আমার শরীরের ভিতর ওই কেমিক্যালের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে কি না। তাই আমি ঠিক করেছিলাম যে পিউ-এর সঙ্গে কথা বলার আগে আমি কোনও একজনকে পুরো ঘটনাটা জানাব। সব দিক ভেবে মনে হয়েছে তুমিই হচ্ছ রাইট পারসন। তুমি আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও উড়িয়ে অন্তত দেবে না। তাই তোমাকে আসতে বলেছিলাম।’
কথা থামিয়ে মহীদাদু তার বিছানার পাশে রাখা সোলার ঘড়িটার দিকে তাকালেন।
“চিন্তা করো না। এখনও অনেক সময় আছে। পাঁচটার আগে পিলুর সুইচ অন করার দরকার নেই। আমি ঠিক সময়ে তোমাদের সতর্ক করে দেব।”
ঠাকুরমার কথা শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে মাথা নাড়েন মহীদাদু। সেই সুযোগে নয়ন বলে ওঠে, “তুমিও কি আমাকে এই কথাগুলো বলার জন্যই ডেকে এনেছ?”
“না, তোমাকে ডেকে এনেছি আমার কিছু কথা বলার জন্য। কিন্তু তার আগে সুনের কথাটা বলা দরকার ছিল। কারণ তা না হলে আমি কেন ভাবছি যে আর বেশিদিন বাঁচব না, সেটা তুমি বুঝতে পারবে না। যাই হোক, যে কথা বলছিলাম সেটা শেষ করে নিই। সুনের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবিনি। সত্যি কথা বলতে, তোর ঠাকুরমার কিন্তু সুনের কথা অনেকটাই বিশ্বাস হয়েছিল, আমার সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনাও করেছিল। কিন্তু আমিই তেমন একটা মাথা ঘামাতে চাইনি। তবে বছরখানেক পর, খানিকটা কৌতূহলবশতই ব্যাপারটা কোন দিকে গড়াল জানতে ওর সঙ্গে মনোবাহীতে যোগাযোগ করেছিলাম। তখন শুনলাম ও নাকি আর জার্মানিতে থাকে না। ভূমধ্যসাগরের একটা ছোট্ট দ্বীপে নতুন আস্তানা গেড়েছে। সেটা নাকি ভারী সুন্দর জায়গা। ওর শোওয়ার ঘরের বিছানায় শুয়ে সমুদ্রের উপর সূর্যোদয় দেখা যায়। ওর ফলের বাগানে প্রতিদিন ঝাঁকে-ঝাঁকে রংবেরংয়ের পাখি আসে। এমন উচ্ছ্বসিত হয়ে এসব কথা বলছিল যে, আমি আর পুরনো প্রসঙ্গ তোলার সুযোগই পেলাম না। সুনে খুবই ভাল আছে ধরে নিয়ে আমি আর ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি। কিন্তু তার বছর তিনেক পরে সে মারা গিয়েছে জেনে আমার বেশ জোরালো খটকা লাগল। সেটা আরও প্রবল হল কিংবা বলতে পারিস, সুনের কথাগুলো আমি বিশ্বাস করতে শুরু করলাম যখন পিউ-এর নির্দেশে আমাদের নতুন ঠিকানা হল জুরান্তি।”
“তার মানে তুমি বলতে চাইছ, ভূমধ্যসাগরের ওই দ্বীপে আসলে সুনে স্টাসেনকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল?”
“এগজ্যাক্টলি! এখন আমার কোনও সন্দেহ নেই যে, সুনে কথাগুলো পিউ-এর কর্তাব্যক্তিদের জানিয়েছিল এবং তার ফলেই ওকে ওই দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সুনে আশঙ্কা করেছিল যে, ওর শরীরেও কেমিক্যাল ঢোকানোর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে সেটাও একদম ঠিকঠাক। কারণ আমরা ওর বাড়িতে যাওয়ার ঠিক আট বছর পর সুনে মারা যায়। কাজটা সম্পূর্ণ করতে কেমিক্যালটার যেহেতু দশ বছর সময় লাগে, তা হলে আমি ধরেই নিতে পারি যে বছর দুয়েক আগে থেকেই সুনের শরীরে ওই বিষ ঢোকা শুরু হয়ে গিয়েছিল।”
“সুনেকে কেন নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল সেটা তো না হয় বুঝলাম। কিন্তু তোমাদের কেন জুরান্তিতে পাঠানো হল? তোমরা তো সেরকম কিছু করোনি।”
মহীদাদু একটু হেসে বললেন, “আমি কী করেছি সেটাই এবার তোকে বলব। কিন্তু তার আগে আর-এক কাপ কফি পেলে ভাল হয়।” “তোমরা কথা বলো, আমি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
ঠাকুরমা উঠে গেলে, কম্বলটা আর-একটু ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে মহীদাদু ফের শুরু করলেন, “তোকে তো বললাম যে, ডি এন এ থেকে কীভাবে নানা রকম অসুখের কারণগুলো বাদ দিয়ে দেওয়া যায় সেটা আমি আবিষ্কার করেছিলাম। কিন্তু সেখানেই আমার কাজটা থেমে থাকেনি। গবেষণা করতে-করতে আমি একসময় ডি এন এ-র পুরো স্ট্রাকচারটাকেই অসংখ্য টুকরোয় ভেঙে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করতে পারলাম। এই টুকরোগুলোর প্রতিটাই ছিল মানুষের চরিত্রের নানা রকম বৈশিষ্ট্যের উৎস। যেমন ধর কেউ ভিতু, কেউ দুর্বল, কারও আবার ভয়ংকর সাহস, কেউ বিজ্ঞান ভালবাসে, কারও ডাক্তারি পছন্দ, এসব কিছুর পিছনেই আসলে আছে ডি এন এ-এর একটা করে নির্দিষ্ট টুকরো। এবার ডি এন এ-এর কোন টুকরো মানুষকে কী বৈশিষ্ট্য দেয় তার একটা তালিকাও আমি তৈরি করেছিলাম। ক্রোমোজোমের আবিষ্কর্তার নাম অনুসারে তার নাম দিয়েছিলাম ‘মেন্ডেলস লিস্ট’।
“পিউ-এর কর্তাব্যক্তিরা এই লিস্টটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। কারণ তাঁদের মনে হয়েছিল এই লিস্টটা হাতে থাকলে কোনও সময় যদি পৃথিবীতে কোনও বিশেষ ধরনের মানুষের প্রয়োজন বাড়ে, তা হলে ডি এন এ ওই অংশটা ক্লোন করে সেরকম মানুষ তৈরি করে ফেলা যাবে। কথাটা আমার পছন্দ হয়নি, কিন্তু আমি কিছু বলিনি, কারণ আমি জানতাম কাজটা করা এককথায় অসম্ভব। ডি এন এ-এর একটা অংশকে ক্লোন করে সাপ-ব্যাঙ আর যাই-ই তৈরি করা যাক, মানুষ অন্তত তৈরি করা যাবে না। তবে সেটা পিউ-এর কর্তাব্যক্তিদের বললে আবার উলটো বিপদ আছে। তাঁরা হয়তো পুরো প্রজেক্টটাকেই অকেজো বলে বাতিল করে দেবেন। অথচ আমি নিজে তো বুঝতে পারছি যে, এই তালিকাটা থাকলে ভবিষ্যতে সব ধরনের জিনের অসুখ আমরা সারিয়ে ফেলতে পারব।
“আরও একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছিলাম, ডি এন এ-এর ওইরকম টুকরো একটা অংশকে ক্লোন করা যাবে না ঠিকই, কিন্তু সেটাকে শক্তিশালী করা যাবে। তার মানে বুঝতে পারছিস তো, একটা মানুষকে কোনও একটা বিষয়ে এক্সপার্ট বানানো যাবে, মানুষ হিসেবে তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই। আমি ঠিকও করে নিয়েছিলাম যে আমার পরবর্তী গবেষণার বিষয়ও এটাই হবে। তবে তখনও পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না বলে পিউ-কে এবিষয়ে কিছু জানাইনি। আমার কাজটা পছন্দ হওয়ায় একটা সুবিধে হয়েছিল, পিউ-এর তরফে আমাকে একটা মুম্বাই শহরে একটা সুন্দর বাড়ি আর তার সঙ্গে একটা চমৎকার ল্যাবরেটরি দেওয়া হয়, যাতে আমি নির্বিঘ্নে আমার কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারি।”
“এবার আর কফি বানালাম না। কোকোর সঙ্গে আমাদেরই বাগানের একটা গাছের শুকনো পাতা গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিয়েছি। খেয়ে দ্যাখ, ভাল লাগবে। এটা আসলে একধরনের এনার্জি ড্রিঙ্ক। আজ তো আমাদের ঘুম খুব কম হবে। এটা খেলে ক্লান্ত দেখাবে না। পিলুও কিছু বুঝতে পারবে না,” ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে রেখে দুটো বড় মাগ নয়ন আর মহীদাদুর হাতের কাছে এগিয়ে দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন ঠাকুরমা।
আগের কথার খেই ধরে মহীদাদু বলতে শুরু করলেন, “মুম্বাইয়ের ল্যাবরেটরিতে আমি নিশ্চিন্ত মনে কাজ করে যাচ্ছিলাম। প্রায় পঁচিশ বছর একইভাবে কেটেছিল। আমার গবেষণার কাজও তখন প্রায় শেষের মুখে। এই সময় একদিন আমি আমার এক ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হাসপাতালে যাই। এর আগে বহু বছর আমার হাসপাতালে যাওয়ার কোনও দরকার পড়েনি। ওষুধ তো সব বাড়িতেই আনিয়ে নেওয়া যায়। ছোটখাটো রিপ্লেসমেন্টও এখন বাড়িতেই হয়। সেই সময় আমার কোনও ভাইটাল অরগ্যানের রিপ্লেসমেন্ট দরকারও হয়নি। যাই হোক, হাসপাতালে যেখানে আমার বন্ধু বসে, সেখানে যাওয়ার সময় দেখি একটা দরজার উপর লেখা আছে ডি এন এ কারেকশন রুম। স্বাভাবিকভাবেই আমার একটু জানার আগ্রহ হয় যে, কী ধরনের ডি এন এ কারেকশন এখানে হয়। তাই আমি সেটা আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করি। আমার প্রশ্ন শুনে ডাক্তার তো অবাক, ‘সে কী! তুমি ডি এন এ নিয়ে এত কাজ করেছ আর এটা জান না! এখন তো সব বাচ্চারই ডি এন এ কারেকশন হয়। সবে যখন শরীরের সেলগুলো তৈরি হতে শুরু করে তখনই কারেকশন করে দিই আমরা।’
“ ‘কী কারেকশন করো?’
“ ‘একটা ডেফিনিট লিস্ট আছে। তার সঙ্গে মিলিয়ে করতে হয়।’
“ ‘সব বাচ্চার জন্য একই লিস্ট?’
” ‘হ্যাঁ। তা তো হবেই। কারণ এই কারেকশনটা তো আসলে আমরা করছি যাতে ভবিষ্যতে কোনও ধরনের জিনের অসুখ কিংবা ডি এন এ-এর ত্রুটিতে মানুষকে ভুগতে না হয়।”
“ডাক্তারের কথা শুনে আমার বিস্ময় ক্রমশ বাড়ছিল। কারণ আমি তো জানি কোনও ত্রুটি না থাকলে বাচ্চার ডি এন এ কারেকশনের কোনও দরকার নেই। কিন্তু এই ভদ্রলোক পিউ-এর কাজকর্ম কিংবা আমার রিসার্চের ব্যাপারে খুব বিস্তারিতভাবে কিছুই জানেন না। তাই আমি খুব সরল মুখ করে তাকে বলি, ‘ওই লিস্টটা আমাকে দেখাতে পার?”
“ডাক্তার তার ড্রয়ার খুলে লিস্টের একটা কপি বের করে আমার হাতে দেয়। আমি দেখি সেটা আমারই তৈরি মেন্ডেলস লিস্ট। তবে তাতে কোন টুকরোর কী কাজ সেটা লেখা নেই, আর কিছু-কিছু জায়গা মার্ক করা আছে। ডাক্তার আমাকে জানান, কারেকশনের সময় ওই মার্ক করা অংশগুলো তাঁরা বাদ দিয়ে দেন। তাঁদের উপর সেরকমই নির্দেশ আছে কারণ এটা করলে বাচ্চা অনেক বেশি সুস্থ আর কর্মক্ষম হয়। ডাক্তারের কাছে এটাও জানতে পারি যে, এই ডি এন এ কারেকশনের কাজটা তাঁরা করছেন গত কুড়ি বছর ধরে।
“ডাক্তারের কাছ থেকে লিস্টটা নিয়ে বাড়ি এসে আমার তৈরি মেন্ডেলস লিস্টের সঙ্গে মিলিয়ে যা দেখি, তাতে আমার মাথা ঘুরে যায়! কারেকশনের নামে ডি এন এ-এর যে অংশগুলো বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে বাদ পড়ে যাচ্ছে মানুষের সব রকম শিল্পী সত্তা, নতুন কোনও সৃষ্টির ভাবনা আর প্রতিবাদ কিংবা বিদ্রোহ করার ইচ্ছে। তার মানে এই কারেকশনের পর যেসব শিশুরা জন্মাচ্ছে, তাদের গান, নাচ, গল্প কবিতা, ছবি আঁকা এসব নিয়ে কোনও আগ্রহ থাকবে না। তারা নতুন কিছু ভাবতে পারবে না। এমনকি কোনও অন্যায় দেখে প্রতিবাদ পর্যন্ত করবে না, কারণ প্রতিবাদ করার ইচ্ছেটাই তাদের মনের মধ্যে তৈরি হবে না। আমি বুঝতে পারছিলাম পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যাতে মুখ বুজে তাদের হুকুম তামিল করে যায়, সেজন্যই এই ব্যবস্থা করেছে পিউ। তাদের নির্দেশে তৈরি হচ্ছে লক্ষ-লক্ষ রক্তমাংসের রোবট। তবে পিউ-এর সদস্যরা তো বোকা নয়। তাই একেবারে তাদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে অল্প কিছু শিশু নিশ্চয়ই জন্মাচ্ছে যাদের ডি এন এ কারেকশন হচ্ছে না। স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বড় হয়ে ওঠা এই শিশুরাই হবে পৃথিবীর শাসনকর্তা। মানে আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সবই এখন পিউ-এর হাতের মুঠোয়।
“সবটা বুঝতে পেরে প্রথমটায় আমার মনে হচ্ছিল নয়ন, আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাব। কারণ আমার আবিষ্কারকে ব্যবহার করে এত বড় একটা অন্যায় হচ্ছে, সেটা সহ্য করা খুব কঠিন। কিন্তু তারপর আমি আস্তে-আস্তে শান্ত হয়ে ঠিক করলাম যে, এর প্রতিকার আমাকেই করতে হবে। তোর ঠাকুরমাও আমাকে একই কথা বলল। যদিও তখনও আমি জানি না যে কীভাবে, কোন পথে আমাকে এগোতে হবে। সেইসময় একদিন তোর মা-বাবা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। কথায়-কথায় জানতে পারি যে, ঠিক তিনদিন পরে তাদের বাচ্চার ডি এন এ কারেকশনের ডেট দেওয়া হয়েছে। কোন হাসপাতালে হবে সেটাও তোর মা আমাকে বলেছিল। ভাগ্য ভাল যে, সেই হাসপাতালের দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি পিউ-এর নিচুতলার একজন সদস্য। তিনি আমাকে চিনতেন। আমি যে পিউ-এর একজন রীতিমতো হোমরা-চোমরা লোক সেটাও তাঁর জানা ছিল। আমি তখন তাঁকে গিয়ে মিথ্যে করে বলি যে, আমার গবেষণার জন্য কয়েকটা ডি এন এ কারেকশন আমাকে নিজের হাতে করতে হবে। পিউ সেটা জানে। আমাকে তারা অনুমতিও দিয়েছে। তাই তোর মা মানে শ্রীমতীর ক্ষেত্রে ডি এন এ কারেকশনটা আমি নিজে হাতে করব। ভদ্রলোক আমার প্রস্তাবে রাজিও হয়ে যান।”
“তারপর…”
উত্তেজনায় নয়নের গলা প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। মহীদাদু একটু দুষ্টুমির হাসি হেসে বলেন, “আমি হিসেব করে দেখেছিলাম, আমার মেন্ডেলস লিস্ট পিউকে দেওয়ার আগেই তোর মায়ের জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ তার ডি এন এ কারেকশন হয়নি। তার মানে সে একজন স্বাভাবিক মানুষ। তোর বাবাও তাই। যাই হোক, হাসপাতালের যিনি ইনচার্জ ছিলেন, সেই ডঃ সুরানা আমার কথায় রাজি হয়ে গেলেন। আমি এটাও বললাম যে, কাজটা আমি একাই করব, কারণ ব্যাপারটা গোপন রাখা দরকার। তাতেও কোনও আপত্তি হল না। আমার তখনকার পদমর্যাদায় সেটা না হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। সুতরাং তোর ডি এন এ কারেকশন আমি করলাম, মানে ডি এন এ-এর কোনও কারেকশন করলাম না। তুই একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে জন্মালি। ”
স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে নয়ন। তার মুখ দিয়ে প্রায় কথা বেরচ্ছে না। ঠাকুরমার মুখে হালকা হাসি। মহীদাদু কিন্তু প্রায় নির্বিকার মুখে বললেন, “তোর কখনও মনে হয়নি নয়ন, এই যে তুই ফুল ভালবাসিস, বারান্দার টবে গাছ লাগাস, ছুটির দিনে জঙ্গলে বেড়াতে যাস, এরকম অভ্যাস তোর সমবয়সী কিংবা তার থেকে বড় অধিকাংশ মানুষের নেই?”
“হ্যাঁ, মনে হয়েছে। অবাকও লেগেছে। ছেলেবেলায় আমার স্কুলের বন্ধুদের এসব কথা বললে তারা বিরক্ত হত, বুঝতেও পারত না। তারপর তোমার বাড়িতে থাকার সময় তুমি আমাকে কিছু মজার জিনিস শিখিয়েছিলে। সেটা একদিন স্কুলে বলায় টিচার ভীষণ বকলেন। বললেন এই ধরনের আবোল-তাবোল কথা যেন একদম না বলি…”
“তোকে আমি কবিতা শিখিয়েছিলাম। গানও শিখিয়েছিলাম। হাতে রং-পেনসিল ধরিয়ে দিয়ে ছবি আঁকতেও বসিয়ে দিতাম। আমি তো তখন জানি যে, সারাজীবনে তোর আর এগুলো জানার কোনও সুযোগ হবে না। মানুষকে এগুলো ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসবের অস্তিত্ব মুছে ফেলা হচ্ছে। পৃথিবীর সব মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, সংগ্রহশালা একটু-একটু করে নিঃশব্দে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। আমি খুব অসহায় বোধ করতাম। আর সেজন্যই চেয়েছিলাম তোর যাতে অন্তত কিছু স্মৃতি থাকে, তাই শ্রীমতীর অপারেশনের সময় আমি তোকে নিজের কাছে এনে রাখি।”
“আমাদের সময় কিন্তু কমে আসছে, আর বড়জোর আধঘণ্টা কথা বলতে পারবে…” ঠাকুরমার কথা শুনে দ্রুত নিজের হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠে নয়ন বলে, “তুমি কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছ, এবার সেটা আমি অনেকটা বুঝেছি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি আমাকে কোনও দায়িত্ব দিতে চাও?”
“হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছিস। দায়িত্ব দিতে চাই বলেই তোকে ডেকে পাঠিয়েছি। দায়িত্ব দিতে হতে পারে ভেবেই তোর সঙ্গে এতদিন যোগাযোগ রাখিনি, যাতে তোর উপর কোনও সন্দেহ না পড়ে। আসলে নয়ন ওই কারেকশন হয়ে যাওয়া ডি এন এ-কে কী করে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়, সেই অ্যান্টিডোট আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি। ডি এন এ-মূল কাঠামোটা তৈরি হয় যে উপাদান দিয়ে, তার সঙ্গে বিশেষ কিছু গাছের রস মিশিয়ে এটা তৈরি করা যায়।”
“তৈরি করা যায় কেন বলছ? তুমি তৈরি করোনি?”
“না, শেষ করতে পারিনি। কেন পারিনি সেটাও বলি তোকে। আমার গবেষণা যখন অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে, তখন একদিন পিউ থেকে আমাকে ডেকে পাঠায়। বুঝতেই পারছিস আমি যে কাজটা করছি, সে বিষয়ে পিউকে কিছু জানাইনি। ওরা অবশ্য কিছু সন্দেহও করেনি। তবে ততদিনে অন্য বিজ্ঞানীদের দিয়ে নানা রকম চেষ্টা-চরিত্র করে বুঝে গিয়েছে যে ডি এন এ-এর টুকরোকে ক্লোনিং করে অর্ডার মাফিক মানুষ বানিয়ে ফেলা খুব সহজ কাজ নয়। তাদের আশা, আমি কাজটা করতে পারব। তাই আমাকেই দায়িত্ব নিতে বলে। কিন্তু আমি তো জানি যে সেটা সম্ভব নয়। সেদিন সরাসরি পিউ-এর কর্মকর্তাদের সেটা জানিয়েও দিই। এর কিছুদিন পরেই জানতে পারি যে মুম্বাই ছেড়ে আমাকে জুরান্তিতে চলে আসতে হবে। সুনের কথাগুলো আমার মনে ছিল। তাই ওরা অনেক রকম ভাল-ভাল কথা বললেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমাকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। এখানে কোনও রকম ল্যাবরেটরি থাকবে না সেটাও আন্দাজ করেছিলাম। তাই আমার মুম্বাইয়ের গবেষণাগার থেকে খুব প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র লুকিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। জুরান্তিতে আমি আর তোর ঠাকুরমা মিলে ছোট্ট একটা ল্যাবরেটরি তৈরি করে কাজ শুরু করে দিই। অসুবিধে অনেক ছিল। তাই সময় লেগেছিল। আবার এখানেই পাহাড়ের গায়ে এমন একটা লতার সন্ধান পেয়েছিলাম যেটা আমার কাজটা অনেক সহজও করে দিয়েছিল। সব মিলিয়ে কাজটা একদম শেষ পর্যায়ে এসে আটকে গেল…”
“কেন, আটকে গেল কেন?”
“তোকে বললাম না ডি এন এ যে উপাদানে তৈরি, সেটা আমার লাগবে। কিন্তু সেটা যে-কোনও মানুষের ডি এন এ হলে হবে না। একজন সত্যিকারের সৃষ্টিশীল মানুষের ডি এন এ দরকার। যে মানুষ একদম নতুন কিছু ভাবতে পারে, তৈরি করতে পারে। কিন্তু এরকম মানুষের ডি এন এ আমি জুরান্তিতে বসে পাব কোথায়?”
“আমার ডি এন এ দিয়ে কি তোমার কাজ চলবে দাদু?”
“না সোনা, চলবে না। তুমি যখন ছোট ছিলে তখনই আমি তোমার ডি এন এ পরীক্ষা করে দেখেছি। তুমি সুন্দর জিনিস ভালবাসো, প্রকৃতি ভালবাসো নিশ্চয়ই। কিন্তু তুমি শিল্পী নও।”
“তা হলে তুমি আমাকে কী করতে বলছ দাদু?”
“আমি তোকে একটা ক্যাপসুল দেব নয়ন। তাতে আমি যে অ্যান্টিডোটটা তৈরি করেছি, তার পুরো ফরমুলা লেখা আছে। তোর কাজ হবে একজন সত্যিকারের সৃষ্টিশীল মানুষকে খুঁজে বের করা। এটা যে খুব কঠিন কাজ, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস। তারপর তার শরীর থেকে ডি এন এ সংগ্রহ করে তার সঙ্গে আমার দেওয়া ফরমুলা অনুযায়ী প্রত্যেকটা উপাদান মেশাতে হবে। আমি জানি তুই ল্যাবরেটরিতে যে ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করেছিস, তাতে এটাতে তোর কোনও অসুবিধে হবে না। এর পর হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তোদের ল্যাবরেটরিতে সেখানে বাচ্চাদের নানা রকম ওষুধ তৈরি হয়। তার মধ্যে ‘নেভিটা’ নামের একটা ওষুধ আছে যেগুলো সব বাচ্চাই পাঁচ মাস বয়স পর্যন্ত খায়। তোর দায়িত্ব হবে এই কেমিক্যালটা ওই ওষুধটার মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া। সেটা যদি তুই করতে পারিস, তা হলে যেসব বাচ্চারা টানা পাঁচ মাস ওই ওষুধটা খাবে, তাদের ডি এন এ আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে, তারা স্বাভাবিক মানুষের মতো বড় হবে।”
নয়ন একটু চুপ করে থেকে বলে, “কাজটা খুবই কঠিন দাদু। তবে আমি চেষ্টা করব। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব চেষ্টা করব নিশ্চয়ই।”
“দ্যাখ নয়ন, আরও একটা কথা তোর জেনে রাখা উচিত। আমি জানি পিউ-এর ক্ষমতা কী সাংঘাতিক, কত দূর পর্যন্ত তাদের হাত বিস্তৃত। ধরে নিলাম, তুই সবকিছু ঠিকঠাক করে শেষ পর্যন্ত ওষুধে কেমিক্যালটা মেশাতে পারলি। কিন্তু তার ফলে বাচ্চাগুলোর মধ্যে যে পরিবর্তনটা হবে সেটা কিন্তু পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যেই বোঝা যাবে। পিউ এটা নোটিস করবে না, সেটা হতে পারে না। কিন্তু ওদের কিছু করার থাকবে না। কারণ একশো বছরের বেশি বয়স হয়ে গেলে কোনও মানুষকে মেরে ফেলার ক্ষমতা পিউ-এর আছে। বাচ্চাদের মারার ক্ষমতা ওদের নেই। তাই ওরা চেষ্টা করবে বাচ্চাদের কেন এই বদলটা হচ্ছে তার কারণ খুঁজে বের করার। আমার ধারণা জাল গুটিয়ে এনে ওরা শেষপর্যন্ত তোকে ধরে ফেলবে। আর একবার যদি ধরতে পারে, তা হলে তুই যে আর স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারবি না, সে বিষয়ে আমার অন্তত কোনও সন্দেহ নেই। সেক্ষেত্রে নিজের জীবনের এমন একটা ঝুঁকি তুই নিবি কি না, ভাল করে ভেবে দ্যাখ। এক্ষেত্রে আমি তোকে জোর করতে পারি না দাদুভাই।”
“তোমাকে জোর করতে হবে না দাদু। আমি ঠিক করে ফেলেছি যে, কাজটা আমি করব। আমাকে করতেই হবে। এছাড়া আমার সামনে আর কোনও রাস্তা খোলা নেই।”
নয়নের কথায় মহীদাদুর মুখখানা জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। বালিশের পাশ থেকে একটা ক্যাপসুলের থেকে একটু বড় জিনিস বের করে নয়নের হাতে দিয়ে বলেন, “এটা রেখে দে। ফরমুলা যেভাবে লিখে রেখেছি তাতে বুঝতে তোর অসুবিধে হবে না। তবে খুব সাবধান। কাজটা করবি, কিন্তু যতটা সম্ভব সাবধানে আর গোপনে।”
“দরকার হলে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি তো?”
“করতে পারিস। কিন্তু করিস না। তা হলে সন্দেহ হতে পারে। তা ছাড়া আমার ভরসা না করাই ভাল। জুরান্তিতে আসা আমাদের প্রায় আট বছর হয়ে গেল। শরীরে বিষ ঢোকানো কবে থেকে শুরু হয়েছে তো জানি না। মৃত্যু যে কোনোদিনই আসতে পারে। আমাদের কথা ভাবিস না। এখন নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। পিলুর সুইচ অন করার সময় হয়ে আসছে।”