মহীদাদুর এন্টিডোট – ১

বাড়ি ফিরতে আজ একটু দেরিই হয়েছে নয়নের। তার সাড়ে তিনশো তলার ব্যালকনির গ্যাংওয়েতে এয়ার ক্যাবটা যখন দাঁড়াল, তখন হাতের সোলার ওয়াচের দিকে তাকিয়ে নয়ন দেখল প্রায় আটটা বাজে। খিদে পাচ্ছে বেশ। সাধারণত ল্যাবরেটরি থেকে বেরনোর আগে সে হালকা স্ন্যাকস খেয়ে নেয়। কিন্তু আজ খাওয়া হয়নি। আসলে বেশ খানিকটা অন্যমনস্ক ছিল বলেই হয়তো খাওয়ার ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন সেটা পেটের ভিতর থেকে দিব্যি জানান দিচ্ছে। লম্বা করিডর দিয়ে হেঁটে এসে নয়ন নিজের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে রে ব্যান্ডটা বের করে টিপল। একটা সরু আলোর রেখা তালার ফুটোর ভিতর ঢুকে যেতেই দরজাটা খুলে গেল। বসার ঘরের সোফায় ভোলু বসে আছে। নয়নকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “শুভসন্ধ্যা। আজ তোমার একটু দেরি হয়েছে।”

“কাজের চাপ ছিল,” জুতো খুলতে খুলতে বলল নয়ন। “খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। আজ জল ঝাঁঝির সঙ্গে কুড়মুড়ে করে ভাজা অক্টোপাস দিয়ে একটা চমৎকার ডিশ বানিয়েছি। খেয়ে দেখো, ভাল লাগবে। আগে কফি দেব এক কাপ।

“না, কফি নয়। খাবারও একটু পরে দিয়ো। আগে আমাকে একটা ঠাণ্ডা শরবত দাও। বড্ড ক্লান্ত লাগছে।”

“নিশ্চয়ই। তুমি পোশাক বদলাও। আমি নিয়ে আসছি।” জামাকাপড় বদলাতে গিয়ে একেবারে স্নানটাই সেরে নিলো নয়ন। ফিটফাট হয়ে খাবার ঘরে আসতেই লম্বা গ্লাসে শরবত নিয়ে এলো ভোলু। হালকা সবজেটে হলুদ রং। উপরে বরফের কুচি ভাসছে। গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে শরীরটা যেন জুড়িয়ে গেল নয়নের। খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করল, “দারুণ খেতে হয়েছে তো। কী দিয়ে বানালে?”

“তোমার বারান্দা বাগানে একটা ছোট-ছোট সবুজ পাতার গাছ আছে, যেটাকে তুমি পুদিনা বলো। সেইটার সঙ্গে লেবুর রস দিয়েছি। আর-একটা সেই অদ্ভুত মশলা বানিয়েছিলে কীসব বীজ দিয়ে। ভারী সুন্দর গন্ধ। সেটাও ভেজে গুঁড়ো করে উপরে দিলাম।”

নয়নের খাবার ঘরে একটা শরবত ক্যাবিনেট আছে। প্রায় দু‘শো রকম শরবত সেখানে পারমুটেশন-কম্বিনেশন করে বানানো যায়। কিন্তু ভোলু সেখান থেকে শরবত না নিয়ে নিজে বানিয়েছে। আসলে ভোলুর মতো রোবটদের মাথায় একটা বিশেষ ধরনের যন্ত্র বসানো থাকে। তার সাহায্যে ওরা ঠিকঠাক বুঝতে পারে মানুষ কী চাইছে। এক-এক সময় মনে হয় যেন পুরোটা যান্ত্রিক নয়, সত্যিই বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। একটু বেশি দাম দিয়ে ভোলুকে কিনেছে বলে তাই মনে-মনে নিজের উপর একটু খুশিই হল নয়ন।

তবে এরকম দামি রোবটের আবার কতগুলো অসুবিধেও আছে। এরা খুব বেশীমাত্রায় সংবেদনশীল। মালিকের সব কাজকর্মের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখে। নয়ন যখন তার কম্পিউটারে কোনও কাজ করে, তখন ভোলু বেশ মন দিয়ে সেটা দেখে। নয়ন জানে ভোলুর দেখা মানে সেগুলো সবই তার মেমরিতে লোড হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনমত সেই তথ্য সে কাজে লাগাতে পারবে।

অনেক রোবটের মালিক এটা পছন্দই করে। কারণ তা হলে তার সব কাজকর্মের একটা ব্যাক-আপ বাড়ির রোবটের কাছে থেকে যায়। কোনও কারণে নিজের কম্পিউটার থেকে কিছু হারিয়ে গেলে অসুবিধে হয় না। তা ছাড়া কিছু ভুলে গেলে বা খুঁজে না পেলেও রোবট সাহায্য করতে পারে। কিন্তু নয়নের এটা ঠিক ভাল লাগে না। তার কাজকর্ম সারাক্ষণ কেউ লক্ষ করছে, সে যন্ত্র মানব হলেও ব্যাপারটা তার পছন্দ নয়। তাই বাড়িতে নিজের মতো করে কিছু করার থাকলে সেটা নিয়ে বসার আগে সাধারণত নয়ন ভোলুকে সুইচড অফ করে দেয়।

কিন্তু আজ দাদুর সঙ্গে কথা বলার আগে কি ভোলুকে সুইচড অফ করার দরকার আছে? একটু ভাবে নয়ন। দুপুরবেলা যখন সে নিজের ল্যাবে কাজ করছে, সেই সময় তার মনোবাহীতে প্রথমে একটা অ্যালার্ট এসেছিল। মহীদাদু পাঠিয়েছিলেন অ্যালার্ট মেসেজ। হাতের কাজটা সামলে নিয়ে মনোবাহীতে দাদুর সঙ্গে যোগাযোগ করে নয়ন বুঝতে পারল দাদু তাকে সোলার ডায়েরি দেখতে বলছেন। কিন্তু সোলার ডায়েরির মেসেজটা খুলে প্রথমটায় একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল নয়ন। কী একটা অচেনা, অদ্ভুত ভাষায় কয়েকটা লাইন লেখা।

নয়ন নিজে বাংলা আর এস্পেরান্তো দুটোই খুব ভালভাবে জানে। এই সৌরজগতে এখন আর দুটোর বেশি ভাষা জানার প্রয়োজনও হয় না। চেনা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মাতৃভাষা আর পৃথিবীর বাকি সকলের জন্য এসপেরান্তো। কিন্তু মেসেজটা এই দুটো ভাষার কোনোটাতেই নয়।

অবশ্য মেসেজটা ভাল করে কয়েকবার পড়ার পরই ব্যাপারটা মনে পড়ে গেল নয়নের। ছেলেবেলায় একবার সে প্রায় মাস চারেক মহীদাদুর বাড়িতে ছিল। তার মা সেসময় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। মায়ের দুটো কিডনি আর লিভার বদলাতে হয়। অপারেশনটা খুবই মামুলি। কিন্তু তারপর একটা বেশ লম্বা বিশ্রামের দরকার ছিল। সাধারণত এরকম ক্ষেত্রে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ট্রেন্ড রোবট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে সব দেখাশোনা করে। আর বাচ্চাদের নিয়ে গিয়ে রাখা হয় সরকারি কেয়ার সেন্টারে। সেখানে থাকা-খাওয়া, খেলাধুলো, লেখাপড়া সব কিছুরই ব্যবস্থা আছে। মা সুস্থ হলে আবার বাচ্চাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। নয়নের ক্ষেত্রেও সেরকমই ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু মহীদাদু কেন জানা নেই, সরকারি দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে আবেদন করেছিলেন যে এই চার মাস নয়নকে তিনি নিজের কাছে রাখতে চান।

সাধারণত এরকম আবেদন কেউ করে না। করলে গ্রাহ্য হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু মহীদাদু নিজে যেহেতু খুব নামকরা বিজ্ঞানী, তাঁর অনেক আবিষ্কার সরকারের কাজে লেগেছে, তাই হয়তো আবেদন নামঞ্জুর হয়নি। মা সুস্থ হয়ে ওঠা পর্যন্ত নয়ন ছিল মহীদাদুর বাড়িতে, দাদু আর দিদার তত্ত্বাবধানে। আর এই চারটে মাস বোধ হয় ছোট্ট নয়নের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়। নানা রকম কথা হত দাদুর সঙ্গে। অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখাতেন দাদু। সেসব এখন আর অবশ্য নয়নের ভাল করে মনে নেই। কিন্তু সেই সময়েই এই হরফগুলো তাকে চিনিয়েছিলেন মহীদাদু। বহু বছর আগে নাকি পৃথিবীতে এই লিপি চালু ছিল। একে বলে দেবনাগরী। দাদুর একসময় পুরনো জিনিস সংগ্রহের নেশা ছিল। তখনই এই লিপির সন্ধান পান। এর উচ্চারণের সঙ্গে বাংলার বেশ মিল আছে। তবে অক্ষরগুলো অনেকটাই অন্য রকম দেখতে।

নয়ন হরফগুলো চিনে নেওয়ার পর দাদু তার সঙ্গে একটা ভারী মজার খেলা খেলতেন। দেবনাগরী হরফে বাংলা লিখে সে আর দাদু পরস্পরকে মেসেজ পাঠাত। দিদাকে সেটা বলা হত না। দিদা তাতে রেগে যেতেন আর ছোট্ট নয়ন খুব মজা পেত।

অনেকদিনের অনভ্যাস। তাই প্রথমটায় নয়নের মনে হয়েছিল সে বোধ হয় হরফগুলো ভুলে গিয়েছে। কিন্তু সামান্য চেষ্টাতেই মনে পড়ল আর চিঠিটা পড়ে নয়ন বুঝতে পারল দাদু লিখেছেন, রাতে বাড়ি ফিরে যেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে নয়ন। বিশেষ জরুরি দরকার আছে। কিন্তু দরকারটা কি গোপনীয় কিছু? না হলে হঠাৎ দাদু দেবনাগরী ব্যবহার করেছেন কেন? নাকি অনেকদিন বাদে দাদুর আবার তার সঙ্গে সাংকেতিক চিঠি পাঠানোর খেলা খেলতে ইচ্ছে হয়েছে? এইসব ভাবতে-ভাবতে আজ ল্যাবরেটরিতে একটু অন্যমনস্কই ছিল নয়ন।

এই মহীদাদু হলেন নয়নদের পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ। ওঁর বয়স এখন প্রায় চারশো বছর। ওঁর থেকে গুনলে নয়ন হল ঠিক ছ’নম্বর প্রজন্ম। মহীদাদু ছাড়া নয়নের আরও তিনজন দাদু ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন মারা গিয়েছেন। বাকি দু‘জনের মধ্যে একজনের বয়স দুশো ছাড়িয়েছে। আর-একজন তিনশোর একটু বেশি। আসলে এই সৌরজগতে মানুষের দুশো-তিনশো বছর বেঁচে থাকাটা এখন কোনও ব্যাপারই নয়। নয়ন শুনেছে, একসময় পৃথিবীতে অসুস্থ হয়েই নাকি বহু মানুষ মারা যেত। কিন্তু এখন সব অসুখেরই ওষুধ বেরিয়ে গিয়েছে। তাই অসুস্থ হলেও সেরে উঠতে সময় লাগে না। তা ছাড়া বয়স বাড়লে শরীরের কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যদি দুর্বল হয়ে যায়, তা হলে সেটাও বদলে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে।

মানুষের নিজের শরীরের কোষ থেকেই ক্লোন করে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এখন গবেষণাগারে তৈরি করা যায়। অকেজো অঙ্গ বাদ দিয়ে নতুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি, কেউ যদি চায় বয়স্ক মানুষের কুঁচকে যাওয়া চামড়া বদলে নতুন চামড়া লাগিয়ে নেবে, তা হলে তাও করা যায় অনায়াসেই। নয়ন জানে আগে বয়স বাড়লে মুখে ভাঁজ পড়ত, চোখের জ্যোতি কমে আসত, অনেকে কানেও কম শুনত। তা ছাড়া হাঁটা-চলাতেও নাকি কষ্ট হত বেশ। এখন সেসবের বালাই নেই মোটেই। কার যে কত বয়স দেখে বোঝার কোনও উপায়ই নেই। সবাই বেশ সুস্থ, টগবগে, চনমনে।

আলাদা রকম মানুষ যে একেবারে নেই তা অবশ্য বলা যায় না। নয়নের মহীদাদুই বেশ একটু অন্য রকম। মহীদাদুকে দেখলে বোঝা যায় যে, তাঁর অনেক বয়স হয়েছে। কারণ বাইরের চেহারাটা খুব বেশি বদলাতে তিনি রাজি হননি। শরীরকে সুস্থ আর সক্ষম রাখার জন্য যেটুকু করা দরকার সেটুকুই করেছেন। মজার ব্যাপার হল এই কথাগুলো সবই নয়ন শুনেছে। সে যখন মহীদাদুর বাড়িতে গিয়ে থেকেছিল, তখন দাদুকে তার বুড়ো মানুষ বলেই মনে হত। কিন্তু তখন তার দাদুর এইসব ইচ্ছে-অনিচ্ছা বোঝার মতো বয়স ছিল না। তারপর, মানে গত বাইশ বছরে নয়নের সঙ্গে দাদুর আর দেখা হয়নি।

দেখা হওয়ার মতো পরিস্থিতি যে হয়নি, তা কিন্তু নয়। এখন সবাই নিজেদের পরিবার বা ফ্যামিলি ট্রি নিয়ে খুব সচেতন। আত্মীয়স্বজনরা পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। নিজের কাজের জন্য যে- কেউ যেখানে খুশি থাকতে পারে। যেখানে খুশি যেতেও পারে। সেসবে কোনও রকম নিয়ম-কানুন কিছু নেই। সব মানুষই এই সৌরজগতের নাগরিক। তা ছাড়া সকলেরই প্রায় সুপারসনিক কার আছে। সেগুলো জল-মাটি-কিংবা আকাশ, তিন জায়গায়ই সমান জোরে চলতে পারে। দরকারও হয়। কারণ, এখন তো সমুদ্রের নীচে ছোট-ছোট কলোনি তৈরি হয়েছে। সেখানে অনেক মানুষ থাকে। চাঁদে যাতায়াত তো অনেকদিন ধরেই আছে। গত একশো বছরে কাছাকাছি গ্রহগুলোতেও থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তবু কোনও একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার হবে, খবর পেলে সবাই কিন্তু আসার চেষ্টা করে।

নয়নদের পরিবারে প্রতি দশ বছরে এরকম একটা করে গেট টুগেদার হয়। মহীদাদু কিন্তু গত দুটো এরকম গেট টুগেদারেই আসেননি। কেন আসেননি, সেটা অবশ্য নয়ন ঠিক জানে না। ব্যাপারটা নিয়ে সে খুব একটা মাথাও ঘামায়নি। কারণ ইচ্ছে থাকলেও সবাই যে আসতে পারবেই তা তো আর নয়। তবে দ্বিতীয় যে গেট টুগেদারটা হয়েছিল, তাতে সবাই ধরে নিয়েছিল মহীদাদু নিশ্চয়ই আসবেন। কারণ তার কিছুদিন আগেই নয়নের সোনাদাদু মারা গিয়েছিলেন। তাঁর স্মৃতিচারণার জন্য একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান ছিল। মহীদাদু যেহেতু সকলের চেয়ে বড়, তাই সেই অনুষ্ঠানে তাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও ছিল। কিন্তু দাদু কিংবা দিদা কেউই সেদিন আসেননি।

সোনাদাদুর মারা যাওয়ার খবরটা শুনে নয়ন নিজে কিন্তু বেশ একটু অবাক হয়েছিল। সোনাদাদুর বয়স মোটেই বেশি নয়, মাত্র দেড়শ বছর। স্বাস্থ্য, চেহারা সবই চমৎকার। অথচ হঠাৎ একদিন তাঁর হৃৎপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দিল। এই ব্যাপারটা একটু অদ্ভুতই লাগে নয়নের। রোগবালাই নেই, শরীরের কলকব্জাও সব ঠিক আছে, তবু মানুষ অমর নয়। কে, কখন মারা যাবে কেউ জানে না। কেন হৃৎপিণ্ড এভাবে হঠাৎ কাজ বন্ধ করে দেয়, সেটাও কেউ জানে না। জানার চেষ্টাও হয় না। সবাই এটাকে খুব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেয়। বিজ্ঞানীরা এর কারণ খুঁজে বের করার জন্য কোনও চেষ্টা করছেন বলেও নয়ন শোনেনি। অন্যদের না লাগলেও তার কিন্তু ব্যাপারটা একটু অদ্ভুতই মনে হয়।

মহীদাদুর কথা ভাবতে-ভাবতেই এসব নানা চিন্তা ঢুঁ মারছিল নয়নের মনে। আসলে গত বাইশ বছর যে মানুষটার সঙ্গে দেখা হয়নি, তিনি কেন হঠাৎ তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, সেই প্রশ্নটা ভাবাচ্ছিল নয়নকে। তবে ইতিমধ্যে সময় বেশ খানিকটা গড়িয়ে গিয়েছে। বাড়িতে নয়নের নিজস্ব কিছু কাজও আছে। তাই আর বেশি ভাবাভাবির মধ্যে না গিয়ে সরাসরি মনোবাহীতে দাদুর সঙ্গে যোগাযোগ করে নেওয়াই ঠিক হবে ভাবল নয়ন। সে যখন অফিসে ছিল, তখন দাদু মনোবাহীতে যোগাযোগ করলেও বিশেষ কিছু বলেননি। আসলে নয়ন কাজ করে একটা বাচ্চাদের ওষুধ তৈরির ল্যাবরেটরিতে। সেটা সারা পৃথিবীর মধ্যেই একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ল্যাবরেটরি। অফিসের কোনও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যাতে বাইরে চলে না যায়, সেজন্য বিশেষ ধরনের স্ক্যানার বসানো আছে। মনোবাহীতে কথা বললেও সেটা সেই স্ক্যানারে ধরা পড়ে।

নয়ন ইতিহাসে পড়েছে, একসময় মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার জন্য টেলিফোন নামের একটা যন্ত্র ব্যবহার করত। সেগুলোতে নাকি তারের ভিতর দিয়ে কথাবার্তা শোনার ব্যবস্থা ছিল। পরে অবশ্য তার উঠে যায়। তখন যোগাযোগ হত স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। এখন অবশ্য সেসব ঝামেলা নেই। বিজ্ঞানীরা এমন একটা তরঙ্গ আবিষ্কার করেছেন, যেটা দিয়ে একজন আর-একজনের সঙ্গে মনে-মনেই কথা বলে নিতে পারে। তবে গুরুত্বপূর্ণ সব অফিসেই মনোবাহীর স্ক্যানার আছে। সেখানে এই কথাবার্তার তরঙ্গকে মনিটর করা যায়। দাদু হয়তো এমন কিছু নয়নকে বলতে চাইছেন, যেটা অন্য কেউ জানুক তিনি চান না। তাই তখন বলেননি। যদিও দাদুর এরকম কী কথা থাকতে পারে সে বিষয়ে নয়নের কোনও ধারণাই নেই, তবু একটু সাবধান হওয়ার জন্যই নয়ন রিমোট টিপে ভোলুকে অফ করে দেয়। তারপর মনোবাহীতে দাদুর সঙ্গে যোগাযোগ করে।

যোগাযোগ করে অবশ্য লাভ হয় না বিশেষ। কারণ মহীদাদু মনোবাহীতেও কিছু খুলে বলতে রাজি নন। তাঁর কথা শোনার জন্য নয়নকে যেতে হবে তাঁর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে অন্তত একটা দিন থাকতেও হবে। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর ঠিক হয় পরের শনিবার নয়ন যাবে মহীদাদুর বাড়ি। জুরান্তি নামের একটা উঁচু টিলার উপর মহীদাদুর বাড়ি। নয়নের সাড়ে তিনশোতলা ফ্ল্যাটের গ্যাংওয়ে থেকে সুপারসনিক কার নিয়ে রওনা দিলে প্রায় এক ঘণ্টার পথ।

শনিবার অফিসে ছুটি থাকে নয়নের। তার অভ্যাস হল, ছুটির দিনে নিজের সুপারসনিক গাড়ি নিয়ে ইচ্ছেমত বেরিয়ে পড়া। আকাশে ঘোরাটাই সুবিধে। কারণ কিছু বড় শহর ছাড়া পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গাই এখন মস্ত-মস্ত গাছে ঢাকা জঙ্গল। নয়ন শুনেছে একসময় নাকি মানুষ এত বেশি গাছ কেটে ফেলেছিল যে, বাতাস আস্তে-আস্তে দূষিত হয়ে যাচ্ছিল। ওজোন স্তরেও নাকি ফুটো হয়ে গিয়েছিল। বিপদ বুঝে সতর্ক হয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। বেশি-বেশি করে গাছ লাগানো শুরু হয় তখনই। একটা অসুবিধে অবশ্য ছিল। তখন মানুষকে চাষআবাদ করে ফসল ফলিয়ে খেতে হত। তার জন্য অনেক-অনেক জমি লাগত। তারপর একসময় যখন গাছের সবুজ পাতা কী করে জল, অক্সিজেন আর কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে খাবার তৈরি করে সেটা জানা হয়ে গেল, তখন আর চাষের দরকার থাকল না। ফল, মূল, আনাজপাতি সবই এখন কারখানায় তৈরি হয়। চাষের জমিগুলোতে অনেক-অনেক গাছ লাগিয়ে জঙ্গল তৈরি করে ফেলা হয়েছে। পৃথিবীর বাতাস তাই এখন খুব পরিষ্কার। দূষণ নেই মোটেই।

এইসব ফাঁকা জমিতে তৈরি করা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেই নয়নের খুব ভাল লাগে। কত রকম গাছ, পাখি, প্রজাপতি দেখা যায়। বনে অনেক রকম হিংস্র জন্তু-জানোয়ার আছে ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় নয়ন শুধু তার হলুদ রংয়ের অ্যান্টি-অ্যানিম্যাল বেল্টটা পরে নেয়। এটা পরা থাকলে কোনও ধরনের জন্তু-জানোয়ার, সাপ কিংবা বিষাক্ত পোকা কিছুই নয়নের শরীরের কুড়ি হাতের মধ্যে আসতে পারবে না। এরকমভাবে জঙ্গলে ঘুরতে-ঘুরতেই নয়ন নানা রকম গাছের চারা, বীজ কুড়িয়ে এনে নিজের বারান্দার ছোট্ট বাগানে লাগিয়েছে।

সবগুলো যে বেঁচেছে তা নয়। কিন্তু আবার কোনও-কোনোটাতে ফুল-ফলও ধরেছে। একটা লতানে গাছ যেমন এখনও নয়নের বারান্দায় দোল খায়। সেটাতে গাঢ় নীল রংয়ের ভারী সুন্দর প্রজাপতির মতো দেখতে ফুল ফোটে। নয়ন তার নাম জানত না। জানা সম্ভবও নয়। ফুল তো আর কোনও কাজে লাগে না। তাই ফুল নিয়ে এখন মানুষের কোনও আগ্রহও নেই। কিন্তু নয়ন ঠিক সেরকম নয়। ফুলপাতা-পাখি এসব তার ভাল লাগে। সে নিজেই নানাভাবে খোঁজখবর করে জানতে পেরেছে যে, ফুলটার নাম অপরাজিতা। মাঝে-মাঝে বারান্দায় গিয়ে সে আপনমনেই “অপরাজিতা, অপরাজিতা….” বলে ডাকে। তার মনে হয় ফুলটাও যেন তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে। ফুলের নাম আর গাছগুলো সে ভোলুকে চিনিয়ে দিয়েছে। সেগুলোর যত্ন করার দায়িত্ব ভোলুর। ভোলু অবশ্য ফুল চেনে না। তার কম্পিউটারে যেসব তথ্য স্টোর করা আছে, তাতে ফুল নেই। তবে নয়ন তাকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছে সেটা সে ঠিকঠাকই করে।

নয়ন নিজে জানে যে তার এইসব অভ্যাস অন্যদের চোখে বেশ অদ্ভুত ঠেকে। তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কিংবা অফিসের সহকর্মী কেউই এরকম ছুটির দিনে জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। তার মানে এই নয় কিন্তু যে তারা ছুটি পেলে আনন্দ করে না কিংবা বেড়াতে যায় না। সরকার থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশাল বিশাল পার্ক তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। তার কোনোটা বরফের দেশ, কোনোটা পাহাড়, কোনোটা এমনকি সমুদ্রও। সবই কৃত্রিমভাবে বানানো। কিন্তু দেখতে একেবারে আসলের মতো। সমুদ্রের পার্কে গেলে মনে হবে সত্যিই যেন সমুদ্রের তলায় চলে গিয়েছ। বরফের দেশে ছানাপোনা সমেত পেঙ্গুইন এসে পাশে বসবে। সেখানে থাকা-খাওয়া, আরও নানা রকম মজার ব্যবস্থা আছে। নয়নের পরিচিতরা সবাই এরকম পার্কে বেড়াতে যায়। কিন্তু নয়নের কেন যেন পছন্দ হয় না। তার ইচ্ছে করে সত্যিকারের সমুদ্রের ঢেউ দেখতে, মরুভূমির গরম বালিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে। যদিও লোকে পাগল ভাবতে পারে ভেবে সে নিজের এইসব ইচ্ছে নিয়ে কখনও অন্য কারও সঙ্গে আলোচনাও করে না।

মহীদাদুর বাড়ি যেতে হবে। তাই এই শনিবার নয়নের আর অভ্যেসমতো জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়া হল না। সকালে উঠে, ভোলুর বানানো একটা দারুণ স্বাদের মাখন আর চকোলেট মাখানো স্যান্ডউইচ খেয়ে সে রওনা দিল জুরান্তির দিকে। সেদিন মহীদাদুর সঙ্গে কথা বলার সময় যেহেতু ভোলুকে সুইচড অফ করে দিয়েছিল, তাই তার আজকের যাওয়ার ব্যাপারেও ভোলু কিছু জানে না। জানানোর ইচ্ছেও ছিল না নয়নের। তাই খাওয়া হয়ে গেলে সে ভোলুকে অফ করে দিয়ে জামাকাপড় পরল। তারপর ভোলুর সুইচটাতে টাইমার সেট করে দিল। এটার সুবিধে হচ্ছে, নয়ন টাইমারে যে-সময়টা সেট করে দেবে, ভোলুর সুইচ ঠিক সেই সময় নিজে থেকেই অন হয়ে যাবে। তা হলে ভোলু ঘরের কাজকর্ম সবই করে রাখতে পারবে। কিন্তু নয়ন কোথায় বেরিয়েছে, কখন বেরিয়েছে এসবের কোনও স্মৃতিই তার থাকবে না।

এতসব কাণ্ড করে ঘর থেকে বেরনোর সময় অবশ্য নয়নের একটু হাসিই পাচ্ছিল। মহীদাদুর সামান্য একটা মজা করে লেখা চিঠি নিয়ে সে কত কিছু ভাবছে। আসলে তো যা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, সেটা হল মহীদাদু অনেক দিন নয়নকে দেখেননি। দেখতে ইচ্ছে করছে। তাই এমন কায়দা করেছেন যাতে নয়ন কোনও অজুহাত দেখিয়েই যাওয়াটা বানচাল করতে না পারে।

নিজের সুপারসনিক গাড়িটায় উঠে, নয়ন সামনের ছোট ট্রেটাতে চার-পাঁচটা অপরাজিতা ফুল রাখল। এগুলো সে মহীদাদুর জন্য নিয়েছে। মহীদাদু যে ফুল ভালবাসেন, সেটা নয়নের মনে আছে। ছেলেবেলায় যখন দাদুর বাড়িতে ছিল তখন দাদু তাকে নানা রকম ফুলের কথা বলেছিলেন। ফুলগুলোর কী সব যেন নাম বলতেন দাদু … ভাবতে-ভাবতেই নয়ন চারপাশটা দেখছিল। আজ দিনটা ভারী সুন্দর। চারদিকে ঝকঝক করছে সূর্যের আলো। আকাশের রংটাও চমৎকার একটা সোনালি আভা মেশানো নীল। সারা আকাশ জুড়ে বিভিন্ন স্তরে ছুটে চলেছে নানা ধরনের সুপারসনিক গাড়ি। কোন গাড়ি কোন রুটে, কত দূর যাবে, তার উপর নির্ভর করে গাড়িটা আকাশের ঠিক কোন লেভেলে থাকবে। এই সুপারসনিক গাড়িগুলো সবই খুব উজ্জ্বল রংয়ের। কোনোটা টুকটুকে লাল, কোনোটা গাঢ় কমলা কিংবা গোলাপি কিংবা একেবারে ঝকঝকে সবুজ। দেখতে-দেখতে নয়নের মনে হচ্ছিল আকাশটা যেন একটা নীল গাছের জঙ্গল। আর সেই জঙ্গলে ফুটে আছে নানা রংয়ের ফুল।

প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর নয়ন দূর থেকে জুরান্তি পাহাড়টা দেখতে পেল। ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়। তার ঠিক মাথায় মহীদাদুর লাল সাদা রংয়ের বাড়ি। নয়ন যখন ছেলেবেলায় দাদুর কাছে ছিল, তখন কিন্তু তিনি এখানে থাকতেন না। মুম্বাই শহরে সমুদ্রের ধারে একটা মস্ত বাংলো ছিল তাঁর। সেখানে থাকার সময় প্রায় রোজই খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দাদুর হাত ধরে সে সমুদ্রের ধারে চলে যেত। লাল টুকটুকে বলের মতো সূর্যকে সমুদ্রের জল থেকে একলাফে আকাশে উঠতে দেখে ভারী মজা লাগত নয়নের। তারপর কবে যে মহীদাদু সেই সমুদ্রের ধারের বাড়িটা ছেড়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে বসলেন সেটা নয়নের ঠিক জানা নেই। তবে মায়ের কাছে একবার ভাসাভাসা শুনেছিল যে, মহীদাদুর সঙ্গে নাকি সরকারের কোনও একটা গণ্ডগোল হয়েছিল। মহীদাদু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগারের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সমস্যা হওয়ায় তিনি কাজটা ছেড়ে দেন। নয়নের কেমন যেন মনে হল, তারপরই হয়তো নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মহীদাদু এই পাহাড়ের উপর এসে থানা গেড়েছেন।

জুরান্তিকে ঠিক পাহাড় বলা চলে না, টিলা বলাই ভাল। তার উপরটা সমতল। সেখানেই দাদুর বাড়িটা। চারপাশে অনেকখানি খোলা জায়গা। একপাশে সুপারসনিক কার নামার জন্য একটা হ্যাঙারও রয়েছে। নয়ন চারপাশের উঁচু-উঁচু গাছগুলোকে এড়িয়ে সেই হ্যাঙারে এনে গাড়িটা নামাল। এই গাড়িগুলোর একটা সুবিধে হচ্ছে এগুলো একটা বিশেষ ধরনের নমনীয় জিনিস দিয়ে তৈরি। সেজন্য ইঞ্জিন বন্ধ করার পর একটা বোতাম টিপে দিলে গাড়িটা গুটিয়ে ভাঁজ হয়ে যায়। তখন সেটাকে একটা ছোট্ট বাক্সের মধ্যে ভরে রাখতেও অসুবিধে হয় না। গাড়ির শব্দ পেয়ে বাড়ির ভিতর থেকে মহীদাদুর স্ত্রী মানে, নয়নের ঠাকুরমা বেরিয়ে এসেছিলেন। নরম চেহারার মানুষটি। তবে মুখের ভাঁজে আর চোখের দৃষ্টিতে দৃঢ়তার ছাপ আছে। নয়নকে দেখেই তার মুখে একটা ভারী স্নেহের হাসি ফুটল।

“আয় দাদুভাই। আমরা সকাল থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছি। তোর দাদু তো অস্থির হয়ে উঠেছে।”

ড্যাশবোর্ডের উপর থেকে অপরাজিতা ফুলগুলো নিয়ে ঠাকুরমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করল নয়ন। ততক্ষণে বাড়ির ভিতর থেকে আরেকজন বেরিয়ে এসেছে।

“নয়নের গাড়িটা তুলে রেখে দাও পিলু আর সামনের বাগানে আমাদের ব্রেকফাস্ট দাও।”

ঠাকুরমার কথায় মাথা নেড়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল পিলু। তার শক্তপোক্ত চেহারা, আর জামার কাঁধে লাগানো হলুদ রংয়ের বোতাম দেখে নয়ন বুঝতে পারল পিলু হচ্ছে একেবারে স্পেশাল ক্যাটাগরির রোবট। এই ধরনের রোবটের দাম খুব বেশি। এরা শুধু, যে-কোনও ধরনের হুকুম তামিল করতে পারে তাই নয়, প্রয়োজনে নিজেদের মতো করে কিছু সিদ্ধান্তও নিতে পারে। যেমন মালিক যদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার কিছু বলার ক্ষমতা না থাকে তা হলে এইসব স্পেশাল ক্যাটাগরির রোবট নিজেই ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবে। তার মানে এই নয় অবশ্য যে, এদের চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা আছে। কিছু-কিছু বিশেষ পরিস্থিতি এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ প্রোগ্রাম করে তাদের সিস্টেমে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সেইসব ক্ষেত্রে তারা এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে। নয়নের মনে হল জুরান্তির মতো এরকম একটা বিজন জায়গায় থাকেন বলেই সম্ভবত মহীদাদু এত দামি রোবট নিজের বাড়িতে রেখেছেন।

তবে একটা জিনিস লক্ষ করে সে একটু আশ্চর্যই হল, পিলু যেখানে তার সুপারসনিক কারটা ভাঁজ করে তুলে রাখল, সেখানে আর কোনও গাড়ি নেই। মহীদাদু কি সুপারসনিক কার ব্যবহার করেন না? তা হলে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন কীভাবে? কথাটা ভাবতে-ভাবতেই লম্বাটে একটা করিডর আর তারপর বেশ সাজানো গোছানো ড্রইংরুম, বারান্দা পেরিয়ে ঠাকুরমার সঙ্গে নয়ন পৌঁছে গেল সামনের বাগানে।

পাহাড়ের গায়ে রোদে ভাষাভাষী একটা খোলা জায়গা। চারপাশে অজস্র নানা রংয়ের ফুলের গাছ। মাঝখানে একটা সাদা রং করা ডিম্বাকৃতি বেতের টেবিলের চারপাশে চারটি সাদা চেয়ার। লাল চেককাটা টেবিল ক্লথের উপর টিকোজি ঢাকা টি-পট আর কাপ ডিশ রাখা। একটা সাদা প্লেটে বেশ কয়েক রকমের বিস্কুট। বিস্কুটের গুঁড়ো পড়ে আছে ঘাসেও। সেগুলো খুঁটে-খুঁটে খেতে ব্যস্ত দু’-তিন রকমের ছোট-ছোট পাখি। কিন্তু আর কেউ কোথাও নেই।

“ওমা, তোর দাদু কোথায় গেল রে?”

ঠাকুরমার কথা শুনে ভারী অবাক হয়ে নয়ন সবে একটা কিছু বলতে যাচ্ছে, এমন সময় পিছন থেকে তার চোখের উপর হাত চাপা দিয়ে কে যেন বলে উঠল, “বলো দেখি আমি কে?”

খুব মজা লাগল নয়নের। ছেলেবেলায় এই খেলাটা সে প্রায়ই দাদুর সঙ্গে খেলত। কচি-কচি দুই হাত দিয়ে পিছন থেকে দাদুর চোখ দুটো চেপে ধরে বলত, “বলো তো আমি কে?”

আর দাদু ভান করতেন যেন নয়নকে চিনতেই পারছেন না। নানা রকম উলটোপালটা নাম বলতে-বলতে শেষ পর্যন্ত যখন বলে উঠত, “বুঝতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি এটা নিশ্চয়ই গজা,” তখন হো হো করে হেসে চোখ ছেড়ে দিত নয়ন। আসলে দাদুর পোষা কুকুরের নাম ছিল গজা। দাদু তাকে গজা ভাবছে দেখে ছোট্ট নয়নের হাসি যেন আর থামত না। কথাগুলো মনে পড়ে যেতেই মনটা খুশি খুশি হয়ে গেল নয়নের। চোখের উপর রাখা হাতের কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল, “কই বুঝতে পারছি না তো… তুমি নিশ্চয়ই গজা…”

হেসে উঠে চোখ ছেড়ে দিয়ে মহীদাদু বলে উঠলেন, “নাহ, তোর দেখছি সবই মনে আছে।”

“আসলে মনে ছিল না জান তো। তুমি যেই ওরকম করলে অমনি মনে পড়ে গেল।”

নয়নের কথা শুনে চেয়ারে বসতে বসতে মাথা নেড়ে মহীদাদু বললেন, “ঠিকই বলেছিস। আসলে মানুষের মন ভারী অদ্ভুত, বড় জটিল। স্মৃতির গুহায় অনেক কিছু জমা থাকে, ঘুমিয়ে থাকে। কখন যে কোনটা জেগে উঠবে, কী কারণে জেগে উঠবে সেটা বলা মোটেই সম্ভব নয়। এই যে তোর আমার চোখ চেপে ধরার ঘটনাটা মনে পড়ে গেল, , এটাও নাই মনে পড়তে পারত। আবার এর আশপাশে অনেক ঘটনা ঘটেছিল, যেটা তোর মনে নেই। সেটা কিন্তু এখনও মনে পড়ল না। খুব ইন্টারেস্টিং… হিউম্যান ব্রেন আমাকে চিরকালই ভীষণ টানে।”

“কিন্তু তুমি তো, আমি যত দূর জানি, হিউম্যান ব্রেন নিয়ে কাজকর্ম করোনি।”

“না, তা ঠিক করিনি। আবার বলতে পারিস যা নিয়ে কাজ করেছি তার সঙ্গে হিউম্যান ব্রেনের সম্পর্ক যে নেই তাও ঠিক বলা চলে না। আসলে আমার মাঝে-মাঝে মনে হয়…

কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই মহীদাদু হঠাৎ নয়নের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “তোর হাতে কী রে নয়ন?”

“ফুল। আমার বারান্দার বাগানে ফুটেছে। তোমার জন্য নিয়ে এলাম।”

“নাম জানিস এই ফুলের?”

“হ্যাঁ জানি, অনেক কষ্টে, পুরনো দিনের ইনফরমেশন ঘেঁটে বের করেছি। অপরাজিতা। এটা নাকি সাদা-নীল দু‘রকম রংয়ের হয়। আমি অবশ্য সাদাটা কোনোদিন দেখিনি। জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে ফুলটা দেখে খুব ভাল লেগেছিল। তাই চারা তুলে এনে টবে লাগিয়েছিলাম। আমার রোবট ভোলুকে যত্ন করা শিখিয়ে দিয়েছি। এখন দিব্যি ফুল ফুটছে। তবে বর্ষায় বেশি ফুল ফোটে। এখন ফুল কমে এসেছে।”

কথাগুলো বলতে-বলতে নয়ন লক্ষ করল মহীদাদু কেমন যেন একটা অদ্ভুতভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। নয়নের কথা শেষ হতে, তিনি একটু হেসে ঠাকুরমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল তাই না?”

দাদু কেন নিশ্চিন্ত হলেন সেটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল নয়ন, কিন্তু তার আগেই বিশাল একটা ঢাকা দেওয়া ট্রে-তে করে ব্রেকফাস্ট নিয়ে হাজির হল পিলু। নয়নের দিকে তাকিয়ে বেশ শান্ত কিন্তু গম্ভীর গলায় বলল, “ঠাকুরমা বলেছেন আপনার জন্য আগেকার দিনের মতো জলখাবার তৈরি করে দিতে। আমি সেরকমই চেষ্টা করেছি। সব কিছু আমার প্রোগ্রামে ছিল না। কিন্তু ঠাকুরমা দেখিয়ে দিয়েছেন। আশা করি আপনার ভাল লাগবে।”

“আমি কিন্তু তোমাকে তুমি করে বলব পিলু। তুমিও আমাকে তাই বোলো।”

“বেশ তো। অতিথি যেমন চাইবে আমি সেভাবেই কথা বলব।

কিন্তু তুমি কি জানতে চাও আমি কী রান্না করেছি?”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই…”

“আমি তোমার জন্য বানিয়েছি সাদা সাদা ফুলকো লুচি। সঙ্গে তোমার দাদুর বাগানের আলু, ফুলকপি আর মটরশুঁটি দিয়ে তরকারি। তাতে একটু টোম্যাটো আর ধনেপাতাও দিয়েছি। সঙ্গে নরম তুলতুলে বেগুন ভাজা আর নতুন গুড়ের পায়েস।”

“ওহ পিলু, আমার তো শুনেই জিভে জল এসে যাচ্ছে। আমার জন্য এত পরিশ্রম করেছ তুমি….অনেক ধন্যবাদ!”

“তুমি খুশি হলেই আমার পরিশ্রম সার্থক। তোমাদের সকলের দিন শুভ হোক।”

পিলু চলে যাওয়ার পর ট্রে-র ঢাকা সরিয়ে লুচির প্লেট নিয়ে খেতে-খেতে নয়ন বলল, “এত রকম আয়োজন তুমি করলে কী করে দাদু?”

“এতেই ঘাবড়ে যাস না, দুপুরের খাবারেও নানা রকম চমক আছে।”

“সে তো বুঝলাম। তোমার বাগানে ফুলকপি, কড়াইশুঁটি হয় তাও পিলুর কথায় বুঝলাম। কিন্তু বাকি জিনিসপত্র তুমি পাও কী করে? সুপারসনিক কার না থাকলে এখান থেকে কোথাও যাওয়া-আসা করাই তো বেশ মুশকিল।”

“কার যে নেই সেটা তার মানে তুই খেয়াল করেছিস। খুব ভাল, খুব ভাল। আসলে কী বল তো নয়ন, বুড়ো মানুষদের খুব বেশি জিনিসের প্রয়োজন হয় না। আমার বাগানে অনেক কিছুই হয়। বাকি যা লাগে সবই বললে দিয়ে যায়।”

“কারা দিয়ে যায়?”

“আসলে আমি তো সরকারি কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পর জুরান্তিতে এসেছি। সরকারের সঙ্গে আমার চুক্তিই আছে, আমার যা লাগবে ওরা দিয়ে যাবে। কোথাও যেতে চাইলেও ওরা নিয়ে যাবে। তাই সুপারসনিক কারের দরকার হয় না। এই তো, তুই আসবি বলে যা-যা চেয়েছিলাম সবই কাল সকালে দিয়ে গিয়েছে। আর তারপর থেকেই তোর ঠাকুরমা পিলুকে নিয়ে লেগে পড়েছে। চারশো বছর বয়স হতে চলল, এখনও বুড়ি রান্না করতে পারলে আর কিছু চায় না!”

কথাটা বলে হোহো করে হেসে উঠলেন মহীদাদু। কিন্তু কেন যেন নয়নের মনে হল দাদুর হাসিটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। দাদু যেন কোনও একটা কথা চাপা দেওয়ার জন্য ওরকম গলা তুলে হাসছেন।

ব্রেকফাস্ট খাওয়া হল দিব্যি জম্পেশ করে। খাওয়া শেষ হওয়ার পর পিলু যখন ট্রে-তে বাসনপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে, তখন আরাম করে চায়ে চুমুক দিয়ে নয়ন বলল, “হ্যাঁ, দাদু, তা হলে এবার…”

সঙ্গে-সঙ্গে নয়নের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মহীদাদু বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, আয় এবার আমাকে তোর সবজি বাগান আর পুষ্যিদের দেখাই। পুষ্যিরা অবশ্য আমার চেয়েও তোর ঠাকুরমার বেশি ন্যাওটা। দুটো কাঠবিড়ালি আছে, ওর হাত থেকে বাদাম না খেলে তাদের রীতিমতো গাল ফুলে যায়। আজ তুই আছিস বলে ব্যাটারা কাছে আসেনি। গাছের আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। একদিন থাকলেই দেখবি তোর সঙ্গেও ভাব হয়ে গিয়েছে….”

কথাগুলো বলতে-বলতে মহীদাদু চেয়ার ছেড়ে উঠে বাগানের দিকে হাঁটা দিয়েছেন। নয়ন লক্ষ করল ঠাকুরমা চোখের ইশারায় নয়নকে দাদুর সঙ্গে যেতে বলছেন। ঠাকুরমার কথা মেনে সেও বাগানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেল ঠাকুরমা পিলুকে বলছেন, “আজ দুপুরেও কিন্তু বেশ কয়েক রকম নতুন রান্না হবে পিলু। আমি বরং এখনই রান্নাঘরে গিয়ে তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলে দিই।”

হাঁটতে-হাঁটতে মহীদাদু এসে দাঁড়ালেন বাগানের একেবারে প্রান্তে। কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে নেমে গিয়েছে ঘন জঙ্গলে ঢাকা গভীর খাদ। দূরে-দূরে দেখা যাচ্ছে নীল-নীল পাহাড়ের সারি। বেড়াটার গা বেয়ে লতিয়ে গিয়েছে কোনও একটা অজানা লতা। সেটা হালকা গোলাপি রংয়ের থোকা থোকা ফুলে ভর্তি। একটা সবুজ রংয়ের পাখি বিদ্যুতের মতো সেই ফুলের ভিতর থেকে পোকা তুলে নিয়ে উড়ে চলে গেল। মহীদাদু একটু হেসে বললেন, “জানিস নয়ন, এই পাখিটাকে বলে বাঁশপাতি। কাছ থেকে দেখলে বুঝতে পারতিস, ওর চোখের নীচে একটা অদ্ভুত কালো দাগ আছে। দেখে মনে হয় যেন পাখিটা চোখে কাজল পরেছে।”

নয়ন একটু আশ্চর্য হয়ে বলল, “এই গাছপালা, ফুল, পাখি এসবই তুমি চেন? সবার নাম জান?”

“না, সব চিনি বলব না। তবে বেশির ভাগ চিনি। চারশো বছরের স্মৃতি তো নেহাত কম নয় রে ভাই। এক সময় স্বাভাবিকভাবেই অনেক কিছু চিনেছিলাম, জেনেছিলাম। তারপর একটা সময়ের পর থেকে, একদিকে চেষ্টা করতে লাগলাম জানা জিনিসগুলো যাতে ভুলে না যাই। অন্যদিকে প্রকৃতির এইসব সম্পদ যত বেশি সম্ভব যেন চিনে নিতে পারি।”

“কেন বলো তো, এসব তোমার কী কাজে লাগে?”

“আমার আর কী কাজে লাগবে! আমি তো এসব জেনে রেখেছি তোর জন্য। তুই তো ফুল, গাছ, পাখি এসব ভালবাসিস। নিজের চেষ্টাতেই তো অনেক কিছু জেনেছিস।”

“তা তো লাগে। কিন্তু সেটা তুমি জানলে কী করে? আমার এরকম শখের কথা তো আমার মাও জানে না।”

“কিন্তু আমি জানি। আমি জানতাম এরকমটাই হবে…’ দাদুর কথাবার্তা বেশ একটু বেখাপ্পা লাগে নয়নের। তার সন্দেহ

হয়, মহীদাদুর মস্তিষ্কের কোষগুলো হয়তো একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি সেগুলো বদলে ফেলা দরকার। কিন্তু সে বিষয়ে কিছু বলার আগেই মহীদাদু একটু নিচু গলায় বলেন, “নয়ন তোকে কিছু খুব জরুরি কথা বলার জন্য আমি এখানে ডেকে এনেছি। কিন্তু কথাগুলো এখন বলা যাবে না। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর তুই তোর ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বি। কিন্তু ঘুমোস না। ঠিক বারোটার সময় আমি তোকে ডাকব।”

“কিন্তু অত রাতে, ওরকমভাবে আমরা কথা বলব কেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে নয়ন।

“কারণ তোকে যেটা আমি বলব, সেটা অত্যন্ত গোপন কথা। আমি আর তোর ঠাকুরমা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ এটা জানে না। জানলে বিপদ হতে পারে। পিলু রোজ রাতে আমাদের একটা করে ঘুমের ওষুধ দেয়। আমরা সেটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। তারপর রাত বারোটায় পিলু নিজে থেকে সুইচড অফ হয়ে যায়। আমরা আবার ভোর পাঁচটায় উঠে ওকে অন করি। এই রুটিনের বাইরে যদি ওকে অফ বা অন করা হয় তা হলে সেটা রেকর্ড হয়। তাই আমি এটা ভাঙতে চাই না। আর আমি যে কথাগুলো তোকে বলব, সেগুলো কোনোভাবেই পিলুর সামনে বলা যাবে না। কারণ পিলু সাংঘাতিক অ্যালার্ট রোবট। আমাদের প্রতিটি মুভমেন্ট, কথাবার্তা সব ও মনিটর করে।”

“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না দাদু। পিলু কেন মনিটর করে? পিলু অফ-অন হচ্ছে কি না, তার রেকর্ডই বা কে দেখে…”

“এখন এত কথা বলতে পারব না। কারণ আমাদের বাগান দেখতে যতটুকু সময় লাগা উচিত, সেটা প্রায় শেষ হয়ে এলো। একটা জিনিস শুধু জেনে রাখ, যাদের জন্য আমি আজ সাধারণ জীবন থেকে বহু দূরে এই জুরান্তিতে নির্বাসিত, এসব তারাই করে।”

রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিল নয়ন। তবে ঘুমিয়ে পড়েনি। জেগে থাকার জন্য তাকে কোনও চেষ্টা করতে হচ্ছিল না। এমনিতেই সকালে দাদুর সঙ্গে কথাবার্তার পর মনটা একটা চাপা উদ্বেগে ভারী হয়ে আছে। তা ছাড়া নয়ন যেখানে থাকে তার থেকে এই জুরান্তির পরিবেশটা এতই আলাদা যে, সহজে ঘুম আসার কথা নয়। নয়নের সাড়ে তিনশোতলার অ্যাপার্টমেন্টটা একেবারে শহরের মধ্যে। সেখানে সারাক্ষণই নানা রকম আলো জ্বলে। রাত যে হয়েছে সেটা বোঝারই উপায় নেই। তা ছাড়া অনবরত হুশহাশ করে উড়ে যাচ্ছে রকমারি উড়ুক্কু যান। তাদের চলাচলের শব্দে কান এমন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে যে জুরান্তির চারপাশের এই ভীষণ নৈঃশব্দ্যে নয়নের মনে হচ্ছে কেমন যেন তার কানে তালা লেগে যাচ্ছে।

রাতের খাওয়া সেরে বাগানে একটু পায়চারি করতে গিয়েছিল। বেশ ঠাণ্ডা আছে। বাতাসে যেন ছুরির ধার। বেশিক্ষণ তাই থাকা যায়নি। কিন্তু তার মধ্যেও নয়নের মনে হচ্ছিল আকাশটা যেন একেবারে নীচে নেমে এসেছে। একটু চেষ্টা করলেই ঝকমকে হিরের ফুল বসানো কালো ভেলভেটের চাদরটাকে হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে। ভাল লাগছিল নয়নের। কিন্তু একটু পরেই পিলু এসে বলল, “বাইরের তাপমাত্রা খুবই কম। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়তে পার। ঘরে চলে এসো। তোমার রুম টেম্পারেচার কুড়ি ডিগ্রি করে দিয়েছি। আশা করি অসুবিধে হবে না। রাতে সুখনিদ্রা হবে।”

পিলুর পাছে কোনও রকম সন্দেহ হয়, তাই আর কথা না বাড়িয়ে ঘরে চলে এসেছিল নয়ন। মহীদাদু আর ঠাকুরমাও ততক্ষণে নিজেদের ঘরে চলে গিয়েছেন। পিলু তাকে ‘শুভরাত্রি’ জানিয়ে চলে যাওয়ার পর চুপচাপ বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করছিল। ঘড়িতে যখন ঠিক বারোটা পাঁচ, তখন দরজায় টুকটুক করে শব্দ হল। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে নয়ন দেখল ঠাকুরমা দাঁড়িয়ে আছেন, “আমাদের ঘরে আয়। ওখানে বসেই কথাবার্তা হবে। তোর দাদু অপেক্ষা করছে।”

মহীদাদুর শোওয়ার জানলা-দরজা সব বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বেশ ঠাণ্ডা। নয়ন বুঝতে পারে অন্য অনেক কিছুর মতোই এক্ষেত্রেও দাদু কৃত্রিমভাবে ঘরের তাপমাত্রা বাড়াননি। শীতের স্বাভাবিক পরিবেশটাই রাখতে চেয়েছেন। মস্ত একটা খাটে, পিছনে দুটো বালিশ দিয়ে আরাম করে বসেছিলেন দাদু। নয়নকে দেখে বললেন, “খাটে উঠে কম্বলের ভিতর ঢুকে বোস। না হলে শীত করবে। তোদের তো আবার এসব অভ্যাস নেই। শীত, গ্রীষ্ম কোনোকিছুর স্বাদ বোঝার ইচ্ছে নেই। ঘর মানে সারাক্ষণ ওই কুড়ি ডিগ্রি। আমার তো এই ব্যাপারটাই ভারী একঘেয়ে লাগে।”

“তোমরা কথাবার্তা বলতে শুরু করো। সারারাত তো আর জেগে থাকা যাবে না। ঘণ্টাখানেক অন্তত ঘুমোতে হবে। আমি বরং তিন কাপ কফি করে আনি।”