মহাপুরাণে কুম্ভ

মহাপুরাণে কুম্ভ

মাস্টারমশাই বলেছিলেন—মূর্খ! ঘটে যে কিছুই নেই! বুদ্ধির পরিণতি না থাকার জন্যেই হোক কিংবা শিক্ষক মহাশয়ের কথায় কথঞ্চিৎ সত্যতা থাকার জন্যেই হোক,

 সেদিন থেকেই ‘ঘট’ শব্দটি নিয়ে আমার খটকা লেগেই ছিল। এর মধ্যে নৈয়ায়িকেরা ‘ঘট’ আর ‘ঘটত্ব’ নিয়ে এমন সব কঠিন তত্ত্বের অবতারণা করেছেন যাতে করে আমি বুঝতে পারি ‘ঘট’ শব্দের মানে বুঝতে চাওয়াই আমার ঘাট হয়েছে। নৈয়ায়িকেরা আমার মাথাটি সম্পূর্ণ ‘ঘটত্বাবচ্ছিন্ন-ভিন্ন’ করার পর আমি উলটো দিক দিয়ে (লোকে কঠিন শব্দের সোজা প্রতিশব্দ জানতে চায়) ‘ঘট’ শব্দটির কঠিন প্রতিশব্দ খুঁজতে আরম্ভ করি। অবশেষে সেই কাঠিন্যই আমার কাছে সহজ হয়ে ধরা দিল। ঘট মানে কুম্ভ, কলসী। ঘট গড়ে কুম্ভকার, ঘটে কিছু রাখবার জন্য। ঈশ্বর কুম্ভকার আমার মাথা-রূপ ঘটখানি গড়ে উলটো করে আমার ধড়ের সঙ্গে যোগ করে দিয়েছেন, তাতে যদিও মাথা আর গলার সঙ্গে ঘটের উপমাটা আসে ভালো, কিন্তু বুদ্ধির অমৃতটুকু নিয়তই যাচ্ছিল বেরিয়ে, মাস্টারমশাই তাই বলেছিলেন ঘটে আমার কিছুই নেই। কিন্তু দিন যত যাচ্ছিল ততই বুঝতে পারছিলাম, ঘট বুঝি উলটে যাবার জন্যেই তৈরি—ঘড়া না কাত করলে জল পাই না, ঘড়া উলটে ছিল বলেই মানুষের ধড়ে উলটো-ঘট। মোহন কুম্ভকার কবে কোনকালে কতবার তাঁর অমৃতকুম্ভ উলটে ফেলেছিলেন, তাই নিয়েই তো পুরাণ-কথা, সাধুর সমাগম, মানুষের মেলা—ওরে দেবতার ঘট উলটে পড়েছে, ছিটেফোঁটা যা পাই, ভাগ চাই। কুম্ভমেলা।

সহৃদয় পাঠককুল, আপনারা পুরাণে হাজারো তীর্থ-মাহাত্ম্য শুনে থাকবেন—পুত্রতীর্থ থেকে যমতীর্থ, পৈশাচ-তীর্থ থেকে ভিন্ন-তীর্থ—কিন্তু কোথাও কলসীর মাহাত্ম্য শোনেননি। কলিযুগের অবধূত নিত্যানন্দ যে কলসীর কানাকে প্রবাদে পরিণত করেছেন, কলসীর মাহাত্ম্য কিন্তু সেখানেই আরম্ভ হয়নি, বরঞ্চ কলসীটি যাঁর হাতে ছিল এবং তিনি যা কলসী থেকে পান করছিলেন সেইখান থেকেই কলসীর মাহাত্ম্য আরম্ভ। বেদ বলেছে সোমরস, আমরা বলি ওই আর কি! তা ঋগবেদ বলেছে—সোম ইন্দ্রের উদরে প্রবেশ করেন। কারণ তিনি তাঁর বন্ধু, আর বন্ধু বলেই তিনি তাঁর উদরে গিয়ে কোনো ক্ষতি করেন না—সখা সখ্যুর্ন প্র মিনাতি সঙ্গিরম। আর পুরুষ মানুষ যেমন শত আচ্ছন্ন পথে যুবতী মেয়েদের সঙ্গে মিলিত হয়, সোমধারা নাকি সেইরকম শতছিদ্র পথে বেরিয়ে এসে কলসীতে জমা হচ্ছিল—মর্ষ ইব যুবতিভিঃ সমর্ষতি সোমঃ কলশে শতযাম্না পথা।

ব্যাপারটা কিছুই নয়, সোমরস ছাঁকার ব্যাপার। তবে আমি কলসী-মাহাত্ম্য পাঠকের সামনে এইভাবে তুলে ধরতে চাই না, কারণ তাতে অপব্যাখ্যার সম্ভাবনা এবং ‘ব্যাদে আছে’ বলে লক্ষের থেকে উপলক্ষ বড় হয়ে উঠতে পারে। শুধু মনে রাখবেন সোম কিন্তু দেবতা এবং সেই দেবতার আধার যে কলসীখানি, সেও প্রায় ঋগবেদে সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। সূর্য, চন্দ্র, দুল্যোক, ভূলোক—সবাইকেই কোনো-না-কোনো ভাবে সোমের সঙ্গে যুক্ত করেছেন বেদের ঋষি গৃৎসমদ। আর সেই সোম হল রাজা। সোমরসের শতধারার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে শত নদীর, যাদের আশ্রয়স্থল সমুদ্র—মানে সেই পৃথিবীর কানায় কানায় ভরা বিরাট কলসীটি—রাজা সমুদ্রং বিগাহতে অপামূর্মিং সচতে সিন্ধুষু শ্রিতঃ।

বিরাট সমুদ্রের কলসীটি উজাড় করে তারই প্রতিরূপ ছোট কলসীটি ওপরে তুলে আনা—যার মধ্যে অমৃত আছে—সোমঃ পুনানঃ কলসেষু সীদতি—এই তো কুম্ভের রহস্য। এই কুম্ভের অধিকার নিয়েই সুরাসুরের দ্বন্দ্ব, এই জন্যই সমুদ্রমন্থন, এই কলসী-চোঁয়ানো ছিটেফোঁটার আস্বাদ নিতেই কুম্ভমেলা।

ঋগবেদের সোম-ছেঁচা নদীধারার আশ্রয়-সমুদ্রই যে ‘কলশ’, সে কথাটা আমি মিথ্যে বলিনি। মহাভারতে যদিও সোজাসুজি এখানে দেবাসুরে দ্বন্দ্বের কথাই নেই কিন্তু অন্য পুরাণগুলিতে আছে। ভাগবত পুরাণ বলেছে—দেবতারা তখনও অমৃত পান করেননি এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই অসুরদের হাতে ধরাশায়ী হচ্ছিলেন মাঝেমাঝেই। বিপদ বুঝে ব্রহ্মা, ইন্দ্র এবং অন্য বেঁচে-থাকা দেবতারা সমুদ্রের মাঝে শ্বেতদ্বীপে প্রভু বিষ্ণুর কাছে ধরনা দিয়ে পড়লেন। প্রভু পরামর্শ দিলেন আপাতত শুক্রাচার্যের শিষ্য অসুরদের সঙ্গে ‘মিউচুয়াল’ করে নাও—যাত দানব-দৈত্যেয়ৈঃ তাবৎ সন্ধিবিধীয়তাম। তারপরেই বিষ্ণু বললেন—অমৃত উৎপাদন করতে হবে, তাতেই দেবতারা জয় করবেন মৃত্যুকে।

ভারতীয় পণ্ডিতেরা বলেন পুরাণগুলি হল ভারতবর্ষের ইতিহাস। ন্যায়, অন্যায়, ভরাডুবি, সমাজ—সবই পুরাণ ‘রেকর্ড’ করে। যদি বলি অবস্থাটা এমন ছিল যে, আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্বে অনার্যদের হাতে আর্যরা মাঝেমাঝেই মার খাচ্ছিল, তাহলে বুঝি অন্যায়ও হয় না। মহাভারতে নারায়ণ সোজাসুজি আদেশ দিয়ে বলেছেন—দেবতারা যদি নিজেদের ভালো চায় তো, কলসী মথে অমৃত বার করতে হবে—মথ্যতাং কলশোদধিঃ।

পাঠক মশাই লক্ষ করবেন প্রভু নারায়ণ কিন্তু সমুদ্র আর কলসীকে এক করে দিয়েছেন—কলশরূপ উদধি-কলশোদধি। সমুদ্র মন্থন আরম্ভ হল—একদিকে দেবতারা অন্যদিকে অসুরেরা। অসুরদের কিন্তু বিকটাকার, দাঁত কড়মড়-করা রাক্ষস ভাবার কোনো কারণ নেই—অদিতির ছেলেরা হল দেবতা, দিতির ছেলেরা অসুর। তফাত এইটুকুই। এদের বাবাও কিন্তু এক এবং তিনি মুনি বটে। যাই হোক সাগর মন্থন আরম্ভ হল, কিন্তু আগেই বলে রাখি, সাগর মন্থনের ‘স্ট্র্যাটেজিটা ছিল সাংঘাতিক। মহাভারতকার সেটা স্বকণ্ঠে বলেননি কিন্তু পুরাণকারেরা সে কথা চেপেও যাননি। প্রভু নারায়ণ বলেছিলেন—বাপু হে, দরকার পড়লে শত্রুর সঙ্গেও সন্ধি করতে হয়—তারপরের ব্যবহার হল ‘অহি-মূষিকবৎ’ অর্থাৎ সাপ আর ইঁদুর যেমন একই বাক্সে বাঁধা পড়লে সাপ ইঁদুরের সঙ্গে গর্ত খোঁড়া পর্যন্ত সাময়িক সন্ধি করে এবং বেরিয়ে গিয়েই তাকে খেয়ে ফেলে, সেইরকম সাগরমন্থনে অসুরদের কাজে লাগাতে হবে মাত্র, তারপরের ভার আমার। অমৃত পাবে তোমরাই, অসুরেরা শুধু খাটনি করে মরবে—ক্লেশভাজো ভবিষ্যন্তি দৈত্যা যুয়ং ফলগ্রহাঃ।

সমুদ্রমন্থনের সরঞ্জাম অনেক। এল বাসুকিনাগের মতো বড় দড়ি, মন্দর পর্বতের মতো লম্বা একটি মন্থনদণ্ড, আর স্বয়ং ভগবান কচ্ছপের রূপ ধরে সেই মন্থন দণ্ডের তলায় তাঁর কঠিন পৃষ্ঠখানি অবলম্বন হিসাবে দিলেন। মন্থন আরম্ভ হলো। মহাভারত থেকে আরম্ভ করে এমন মহাপুরাণ প্রায় নেই যাতে এই সাগর-মন্থনের অপূর্ব বর্ণনা নেই। আমি আমার দীন ভাষায় সে বর্ণনা দেবার অপচেষ্টা করব না। শুধু এটুকু বললেই হবে যে অসুরেরা ছিল অহংকারী এবং বড় বেশি মানী। কৃষ্ণকে স্বপক্ষে আনতে কুরুরাজ দুর্যোধন যেরকম সাহংকারে কৃষ্ণের মাথার দিকে দাঁড়িয়েছিলেন, অসুরেরাও তেমনি নাগরাজ বাসুকির মাথার দিকটা টানাটানি করার জন্য বেশি পছন্দ করলেন। মুচকি হেসে দেবতারা ধরলেন বাসুকির লেজের দিকটা। মন্থন চলতে থাকল। মন্থনের ফলে প্রথম কী উঠল কিংবা তারপরই বা কী, এই নিয়ে মহাভারতে আর পুরাণে অপিচ পুরাণে আর পুরাণে বিস্তর মতভেদ আছে। মহাভারত বলেছে—নানা ওষধির মিশ্রক্রিয়ায় প্রথমেই সমুদ্র থেকে উঠে এল ঘি। ক্ষীর সমুদ্র, ক্ষীর, মানে দুধের সমুদ্র তো, তাই বুঝি মাখন তোলার কায়দায় প্রথমেই ঘি উঠেছে। মহাভারতে দেখছি, ঘি ওঠার পরেই দেবতারা, মনে রাখবেন দেবতারা, সুমুখে বসা ব্রহ্মাকে বললেন—সেই কখন থেকে মথেই যাচ্ছি,মথেই যাচ্ছি—চিরারব্ধম ইদঞ্চাপি—অমৃত তো ওঠেই না প্রভু! আমরা যে ভীষণ শ্রান্ত হয়ে পড়লাম। খাওয়ার ব্যাপারে সবাই তো একবাক্যে অসুরদের বড় বেশি দায়ী করেন, এখানে কিন্তু আমার ধারণা দেবতারাই বড় বেশি ঘি খেয়ে ফেলেছিলেন, বস্তুত ঘি তাদের বড় প্রিয়ও বটে। দেবতাদের কথা শুনে বিষ্ণু একটু রেগেই বলে উঠলেন—থামলে মোটেই চলবে না—ক্ষোভ্যতাং কলশঃ সর্বৈর্মন্দরঃ পরিবর্ত্ত্যতাম—সমুদ্রের কলসীতে মন্দর-দণ্ডের তুফান তোলো। উঠল তুফান—উদয় হলেন প্রাচী নায়িকার মুখে চুম-খাওয়া চাঁদ। চিরকালের উদাসীন সন্ন্যাসী ভগবান শঙ্কর তাঁকে চেয়ে নিলেন, তাঁর রুক্ষু জটায় ‘কিলিপ’ আটবেন বলে—যযাচে শঙ্করো দেবো জটাভূষণকৃনমম। দেব-দানব কেউ কিচ্ছু বললেন না। এবারে উঠলেন লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর ব্যাপারে মহাভারত এর বেশি কিছু বলেনি কিন্তু পদ্মপুরাণ, ভাগবত পুরাণ—এরা সবাই খবর দিয়ে বলেছে যে, লক্ষ্মীর জন্যে—দেবতা দানব সবাই পাগল হয়ে গেছিল। শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মা নাকি স্বয়ং ‘ইন্টারভিন’ করে তাঁকে বিষ্ণুর বক্ষ-লগ্না করে দেন। মহাভারতে যদিও সবার শেষে ওঠে কালকূট বিষ, পুরাণকারেরা কিন্তু অমৃত মন্থনে নাটকীয়তা আনবার জন্য অনেক আগেই বাসুকির মুখে বিষ তুলে দেন। ভাগবত আর অগ্নিপুরাণের মতে আবার প্রথমেই বিষ। কিন্তু বিষ্ণু, কিংবা পদ্মপুরাণ আগে উঠিয়েছে সুরভি গন্ধ, তারপরেই মন্থনের মুখে উঠে এসেছে উৎকৃষ্ট বারুণী মদ। পদ্মপুরাণ তাকে তরলা নায়িকার রূপ দিয়েছে—সে মদঘূর্ণিত লোচনা, স্খলিতপদা, টলটলে কাপড়-পরা—দেবতারা নাকি ত্যাগ করেছিল তাকে আর অসুরেরা বোধ হয় সেই কারণেই সাদরে গ্রহণ করেছিল টলটলে বারুণী-কন্যাকে। উঠেছিল আরও অনেক কিছু। ঐরাবত হাতি, উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়া, নন্দনের মন্দার মঞ্জরী। মহাদেব শিরোভূষণ চেয়েছিলেন চাঁদকে। প্রতিদান দিলেন বিষে নীলকণ্ঠ হয়ে। সবার শেষে অমৃত কুম্ভটি হাতে করে উঠে এলেন ধন্বন্তরি। হৈ হৈ পড়ে গেল দেবতা ও দানব সবার মধ্যে। ধন্বন্তরির হাতে শুভ্র কমণ্ডলু তাতেই আছে অমৃত—শ্বেত কমণ্ডলুং, বিভ্রদঅমৃতং যত্র তিষ্ঠতি। যার জন্যে এত চেষ্টা সেই অমৃত উঠেছে, অসুরদের মধ্যে একেবারে হট্টগোল পড়ে গেল। সবাই বলে, আমি নেব অমৃত, এ বলে আমি, ও বলে আমি—অমৃতার্থে মহান্নাদো মমেদমিতি জল্পতাম। এখনকার কুম্ভমেলায় শুধুমাত্র স্নানের জন্য পুণ্যার্থী মানুষের যে ভাবটি হয়, ঠিক সেই ভাবটি দেখা গেল অসুরদের মধ্যে।

লক্ষ করে থাকলেন, দেবতাদের চেয়ে অসুররাই ছিল বেশি নির্লোভ। সমুদ্র-মন্থন চলাকালে সারাক্ষণ তারা নীরব ছিল। তাদের লক্ষ ছিল স্থির, বিশ্বাস ছিল গভীর, বিশ্বাস এতটাই—অমৃত উঠবে, আমরা ভাগ পাবো। এতক্ষণ সমুদ্র থেকে যতকিছু ভালো জিনিস উঠেছে—সুরভি পারিজাত থেকে হাতি-ঘোড়া—যা কিছু, সবই দেবতারা একটি একটি করে ভাগ করে নিয়েছেন। অসুরেরা শুধু একেবারের তরে লক্ষ্মীর দিকে লোলদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। তা সে দেবতারাও তাকিয়েছিল। আর তাকাবেই বা না কেন, পুরাণকারের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি যেরকম ‘ফ্যাশান প্যারেডে’র কায়দায় সবার মধ্যে সলজ্জ হাসিতে, নূপুরের ধ্বনি তুলে হাঁটতে আরম্ভ করেছিলেন—ততস্ততো নূপুরবল্গু শিঞ্জিতৈবিসর্পতী হেমলতেব সা বভৌ—তখন তাঁর দিকে সবারই দৃষ্টি পড়তে বাধ্য। আর কিন্তু অসুরেরা কিচ্ছুটি চায়নি। বারুণী মদ দেবতারা ছোঁননি। সেই হেয় জিনিসটি বোধ হয় ইচ্ছে করেই অমৃতের বদলে অসুরদের দেওয়া হয়েছিল—আপাতত। কেননা বিলক্ষণ জানি সুরলোকে সবাই অত্যন্ত সুরাসক্ত। এতক্ষণ যারা কিছুই চায়নি, সেই তাদের সামনে যখন অমৃত উঠে এল তখন যে তারা মরিয়া হয়ে উঠবে তাতে আশ্চর্য কী! বস্তুত দেবতাদের গুণ-গাওয়া পুরাণগুলির মধ্যে একটি পুরাণ গোপনে স্বীকার করেই নিয়েছে যে, অমৃতের ছলে দেবতা আর দানবের মধ্যে বিষ্ণুই ভেদ তৈরি করেছিলেন। স্বয়ং বিষ্ণু আপন লোভবশত লক্ষ্মীকে হস্তগত করেছিলেন এবং সেই লোভেই ঐরাবত, পারিজাত, উচ্চৈঃশ্রবা সব ভাগ হয়ে গেল—

তেন লক্ষ্মীঃ স্বয়ং লোভাদ গৃহীতামর সুন্দরী।।

 ঐরাবতস্তথেন্দ্রেন পারিজাতোথ কামধুক।

উচ্চৈঃশ্রবাঃ সুরৈঃ সর্বং গৃহীতং বৈষ্ণবেচ্ছয়া।।

এবার অমৃত। অনেক পুরাণই বলেছে যে, অমৃত উঠবার পরে অসুরেরা সেই অমৃত ধন্বন্তরির হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। অগ্নিপুরাণের মতে অসুরেরা ছিনিয়ে নিয়েছিল বটে কিন্তু তারা নিজেরা অমৃত নিয়ে পালাবার আগে দেবতাদের প্রাপ্য অর্ধেক তাদের হাতে দিয়ে গিয়েছিল—অমৃতং তৎ-করাদ দৈত্যাঃ সুরেভ্যোর্ধং প্রদায় চ। গৃহীত্বা জগ্মুঃ-।

পুরাণ কিংবা মহাভারত সবাই একথা সমস্বরে স্বীকার করেছে অমৃতের অধিকার নিয়ে দেবতা এবং দানবদের মধ্যে প্রচণ্ড-গণ্ডগোল বেঁধেছিল—মহান্তং বৈরমাশ্রিতাঃ। একটা কথা এখানে বলে রাখা দরকার যে, প্রায় প্রত্যেক মহাপুরাণেই সমুদ্রমন্থনে অমৃতকুম্ভের উৎপত্তির কথা আছে, আছে অমৃত নিয়ে ঝগড়াঝাঁটির কথাও। কিন্তু এই বিবাদ কতদিন ধরে চলেছিল, কোথায় কোথায় এই অমৃত কতবারের তরে উলটে পড়েছিল, সে ঘোষণা প্রায় বেশিরভাগ মহাপুরাণে নেই। এমনকি নেই এ কথাও যে, অমৃতের ঘটটি দেবরাজ ইন্দ্রের হাতে দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি বংশানুক্রমে অমৃত ভোগ করবার জন্য তা রাখতে দিয়েছিলেন তাঁরই পুত্র জয়ন্তকে। বেশিরভাগ পুরাণে এবং মহাভারতে যা পাই তাতে দেখি—অসুররা যখন অমৃতের কলসীখানি ধন্বন্তরির হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন স্বয়ং বিষ্ণু আপন মায়ায় মোহিনী রূপ তৈরি করেন। মোহিনী কিন্তু এখানে ‘ভুবনমনোমোহিনী’ নয়, দৈত্যমনোবিমোহিনী। মনে রাখবেন এ রমণী ফর্সা নয়, একেবারে কৃষ্ণকলি—প্রেক্ষণীয়োৎপলশ্যামং সর্বাবয়বসুন্দরম। রমণীর নবীন বয়স এবং স্বীকার করা ভালো তার প্রত্যঙ্গ বর্ণনার শক্তি আমার নেই। পুরাণের ভাষায় সে স্তনভারকৃশোদরী, কাঞ্চী দুলিয়ে চলার ভঙ্গীতে, অপাঙ্গের হানাহানিতে দৈত্যদের মধ্যে কামনার আগুন জ্বলে উঠল—দৈত্যযূথপচেতঃসু কামম উদ্দীপয়ন মুহুঃ। যারা একটু আগে অমৃত পানের জন্য মারামারি করছিল, তারা এখন মোহিনী-মায়ায় মুগ্ধ হয়ে সেই অসামান্যা নারীর কটাক্ষমাত্রের অপেক্ষা করতে লাগল। পদ্মপুরাণ লিখেছে যে অমৃতকুম্ভ দৈত্যেরা পূর্বাহ্ণে ধন্বন্তরির হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল, সেই দৈত্যেরা সেই মোহিনী নারীর হাতেই অমৃতের ডালিটি দিয়ে বসল, আর সাপেক্ষ হল তার করুণা-দৃষ্টিপাতের, কারণ মোহিনী বলেছিল—আমি তোমাদেরই—

 যুস্মাকং বশগা ভূত্বা স্থাস্যামি ভবতাং গৃহে। …

প্রার্থমানাঃ সুবপুষং লোভোপহত চেতসঃ।

দত্ত্বাসৃতং তদা তস্মৈ ততোপশ্যন্ত তে’গ্রতঃ।।

এই ফাঁকে মোহিনী সুন্দরী অমৃতের ভাণ্ডটি নিয়ে দেবতাদের দুলে দুলে অমৃত পান করাতে থাকলেন আর এক একটি লোল কটাক্ষপাতে দৈত্যদের থামিয়ে রাখলেন শুধু। সময় এলো, যখন দৈত্যরাও বুঝল সব ভেলকি, এ শুধু বিষ্ণুর মায়া। আবারও দেবতা আর অসুরে মারামারি বাধল এবং দেবতারা যেহেতু আগেই অমৃত পান করেছিলেন তাই তাঁরা মেরে হঠিয়ে দিলেন দৈত্যদের।

ব্যাস এইটুকুই। মহাপুরাণগুলি প্রায়ই এর বেশি কিছু বলেনি, যেটুকু বেশি আছে তা হল সেই রাহুর কথা, যার শিরোশ্ছেদন করেছিলেন বিষ্ণু। কিন্তু ইন্দ্রের হাত থেকে কী করে সে অমৃত জয়ন্তের হাতে পাচার হল এবং সারা দুনিয়া ঘোরার পরিশ্রমে তিনি কোথায় অমৃতের ভাণ্ডখানি নামিয়ে রেখেছিলেন—সে খবর মহাভারতেও নেই, মহাপুরাণগুলিতেও প্রায় নেই। স্বাভাবিক কারণেই পণ্ডিতদের বিবেচনা মতো এসব কাহিনি সংযোজিত হয়েছে পরে। প্রয়াগ, পুষ্কর—এইসব তীর্থের মাহাত্ম্যবৃদ্ধির জন্যও এ কাহিনি তৈরি হয়ে থাকতে পারে।

সাধারণ মতে বারো দিন ধরে দেবতা আর অসুরদের বিবাদ চলেছিল অমৃতের অধিকার নিয়ে এবং এই বারো দিনে বারোবার অমৃত ভাণ্ডটি বারো জায়গায় নামিয়ে রাখেন জয়ন্ত। দেবতাদের এক দিন মানে মানুষের এক বছর। বারোবারের মধ্যে আটবার নাকি জয়ন্ত অন্যলোকে মানে ভূলোকের বাইরে এই কলসীটি নামান আর চারবার এই পৃথিবীতে এবং তার জায়গা হল—গঙ্গাদ্বারে প্রয়াগে চ ধারা গোদাবরী তটে।

এই সাধারণ মতেও কিন্তু একটা কথা লক্ষ করার মতো। মনে রাখবেন দেবতারা কিন্তু অমৃত রক্ষার জন্য ভীষণ সাবধানী। মহাভারতে গরুড় যখন অমৃত আনতে গেছিলেন তখনও কিন্তু তিনি দেখেছিলেন, হাজারো দেবতা পালে পালে ‘গার্ড’ দিচ্ছেন অমৃতরক্ষার জন্য। এ হেন অমৃত জয়ন্ত নিয়ে পালাবার সময় চারজন দেবতা কিন্তু ঠিক লক্ষ রেখেছিলেন। এঁরা দেবসভায় বিরোধী নেতা কিনা জানি না, কিন্তু আমি বুঝি এঁরা সবাই দ্যুলোকবিহারী নক্ষত্রকুল—চন্দ্র, সূর্য, বৃহস্পতি এবং শনি। অন্তরীক্ষচারী বলেই বোধ হয় এই কল্পনা। জয়ন্তের হাত থেকে সুধাভাণ্ড যাতে গড়িয়ে না পড়ে তার জন্য চাঁদ, যাতে কলসী ভেঙে না যায় সেজন্য সূর্য, দৈত্যেরা যাতে অমৃত স্পর্শ করতে না পারে সেজন্য বৃহস্পতি এবং জয়ন্ত যাতে একা একাই সুধা আত্মসাৎ না করেন সেজন্য শনি তার প্রতি দৃষ্টি রাখছিলেন। বলা বাহুল্য, এসব কথা মহাপুরাণগুলিতে প্রায় পাই-ই না। তবু বলি এমন সব সাবধানী চক্ষুর অন্তরাল থেকেও যে অমৃতকুম্ভ চারবার উলটে পড়েছিল, সে কথা আমার বিশ্বাস হতে চায় না। সূর্য, চন্দ্র—এইসব গ্রহকুলের দৃষ্টিরক্ষা থেকেই কিন্তু কুম্ভযোগ। বস্তুত আমার ধারণা অস্থায়ী জ্যোতিষশাস্ত্রের কল্পনামতেই এই অমৃতপাতের কাহিনি পরবর্তীকালে তৈরি হয়। নইলে দেখুন, কুম্ভ একটা রাশি এবং তা হল শনির স্বস্থান। ধনিষ্ঠা নক্ষত্রের শেষার্ধে, সম্পূর্ণ শতভিষা এব পূর্বভাদ্রপদের প্রথম পাদ নিয়ে কুম্ভরাশির গঠন। যে রাশিতে যে বৎসর সূর্য, চন্দ্র এবং বৃহস্পতির মিলন ঘটে সে বৎসর সেই রাশিতে সুধাকুম্ভপাত এবং বলা বাহুল্য কুম্ভযোগ। এই কুম্ভযোগ পুষ্করযোগ বলেও বিখ্যাত, অন্তত জ্যোতিষতত্ত্বরত্নাকর তাই বলেছে—স চ পুষ্করাখ্যঃ। পুষ্কর মাহাত্ম্যের সঙ্গেই পরে অমৃতপাতের কাহিনি মিশে গেছে এবং তাতেই এত সাধুসন্ত, এত সমাগম, এত মেলা। এই পুষ্করযোগের বিষয়ে শ্লোকগুলি আমি আর উল্লেখ করলাম না।

পাঠককুল, আমার মতের সঙ্গে নাই বা মত মেলালেন, আমার তো ধারণা দেবতাদের যা চরিত্র তাতে তারা আপন জ্ঞাতিভাই কশ্যপসম্ভব দৈতেয়, মানে অসুরদেরই ভাগ দিলেন না, আর আমাদের মতো মানুষদের ভাগ দেবেন! বিশ্বাস হতে চায় না। তবে এত পুরাণব্যাখ্যানের মধ্যে দুটি আত্মতুষ্টির ঘটনা আছে। এক হলো মহাভারতের পরিশিষ্ট বলে পরিচিত হরিবংশ পুরাণ বলেছে—

সমস্ত দেবতা ও অসুরেরা লবণ সমুদ্রের জলে মন্দর পবর্তকে মন্থন-দণ্ড বানিয়ে সমুদ্র মন্থন করলেন। সমুদ্রের জলে ছিল হাজার কিসিমের ওষধি (যা আয়ুর্বেদের ব্যবহারে কাজে লাগে)। সম্পূর্ণ হাজার বছর মন্থন করার ফলে সমস্ত ওষধি দুধে পরিণত হল এবং তার থেকেই অমৃত উঠে এল—সমাঃ সহস্রং মথিতং জলম ঔষধিভিঃ সহ। ক্ষীরভূতং সমাযোগাদ অমৃতং প্রত্যপদ্যতে।।

এইতো বুদ্ধিমানের মতো কথা, যা আমাদের মতো জড় মানুষেরাও মেনে নিতে পারে। আবালবৃদ্ধবনিতা—দুধের প্রয়োজন সবার, ওষুধের প্রয়োজন সবার। খেয়াল রাখবেন অমৃত হাতে সমুদ্র থেকে উঠেছিলেন ধন্বন্তরি, যিনি আয়ুর্বেদের প্রথম চিকিৎসক বলে খ্যাত। আর গরুড়পুরাণ এই অমৃত উত্তরণের কাহিনি কীভাবে বর্ণনা করেছে দেখুন। এই পুরাণ বলেছে—ভগবান হরি ক্ষীরোদসাগর মন্থনের সময় ধন্বন্তরির অবতার গ্রহণ করে অমৃতের কমণ্ডলু নিয়ে ক্ষীরসাগর থেকে উঠেছিলেন। এই ধন্বন্তরি সুশ্রুত নামে তাঁর শিষ্যকে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ উপদেশ করেছিলেন—

ক্ষীরোদমথনে বৈদ্যো দেবো ধন্বন্তরির্হ্যভুৎ।

বিভ্রূৎ কমণ্ডলুং পূর্ণম অমৃতেন সমুত্থিতঃ।।

আয়ুর্বেদমসাষ্টাঙ্গং সুশ্রূতায় স উক্তবান।।

লক্ষ করুন, ধন্বন্তরি, অমৃত এবং সুশ্রুত—এক যোগে উল্লেখে কী প্রমাণিত হয়? সহৃদয় পাঠককুল, আমাদের জীবনে ডাক্তার কি কখনও ভগবানের অবতারের মতো ধন্বন্তরি হয়ে দেখা দেয় না! তিনি কি কখনও তাঁর ঔষধব্যবহার কৌশলে মানুষকে অমৃত দান করেন না! তাহলে কি ঔষধই অমৃত—আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে তো তাই মনে হয়।

আরও একটা কথা। মহাভারতকার বলেছেন দেবতা আর দানবের অমৃতের অধিকারযুদ্ধে ভগবান বিষ্ণু যখন মোহিনী-মায়ায় অমৃত হরণ করেন তখন দেবতাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও তিনি সঙ্গী করেন—জহার দানবেন্দ্রেভ্যো নরেণ সহিতঃ প্রভুঃ। ‘পাবলিক’কে দলে রাখতেই হয়, কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘নরেণ’ মানে করেছেন ‘নরদেব সমভিব্যাহারে’। কিন্তু সে অর্থে আসে না। আবার যুদ্ধবিগ্রহের শেষে দেখা যাচ্ছে সেই অমৃত রাখতে দেওয়া হল কিরীটিকে অর্থাৎ নাকি নারায়ণকে—’দদৌ চ তং নিধিম অমৃতস্য রক্ষিতুং কিরীটিনে’ মানে করলেন ‘নরায়’ অর্থাৎ মানুষকে। এখন নর মানে যদি নারায়ণ বুঝি তাতে আমার আপত্তি নেই, কারণ আমার কাছে নরই নারায়ণ—সমস্ত শাস্ত্রের শেষ কথা। বস্তুত জীবনদায়ী যে প্রয়োজনে সমুদ্র মন্থন করেছিলেন দেবতারা অসুরেরা, সে মন্থন দেবাসুরের ‘ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত’ই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে, আমি বুঝি তাতে দেবতা এবং অসুর সবার পরিশ্রমই সাধু, কেননা দেবতা নয়, অসুর নয়, তার ফল ভোগ করছি আমরা। জীবনের সমুদ্রে যে বিষামৃত দুই-ই আছে। তাতে যে বিষরোগে ধুয়ে মুছে অমৃতের ওষুধটুকু দিতে পারে সেই তো ধন্বন্তরি, সেখানেই তো কুম্ভযোগ। কথাটা জড়বাদীর মতো হল নাকি! তা অপরা যুক্তি সবাই দেখান, আমারটা না হয় হল পরা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *