মসজিদে সাখরা

মসজিদে সাখরা

উমাইয়া খলীফাহ আবদুল মালেক বিন মারওয়ান ৭০ হিরজী মোতাবেক ৬৯১ খৃঃ মসজিদে সাখরা নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে একমত যে, ভূপৃষ্ঠে এটিই হচ্ছে সবচাইতে বেশী সুন্দর ইমারত। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এটি হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট ও সুন্দর স্থাপত্য নিদর্শন। সাখরা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পাথর। এই পাথরের রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাস। বর্ণিত আছে, হযরত আদম আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম এই পাথরের কাছে নামায পড়েছেন। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর কাছে নিজ ইবাদতগাহ নির্মাণ করেছেন। এই পাথরের উপর আগুনের স্তম্ভ দেখে হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম সেখানে একটা মসজিদ নির্মাণ করেন। হযরত ইউশা আলাইহিস সালাম এর উপর একটা গম্বুজ নির্মাণ করেন। তাকে কুববাতুজ জামান’ বলা হয়। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তীহ্ ময়দানে ওহী লাভের উদ্দেশ্যে বৈঠকের জন্য যে তাবু নির্মাণ করেছিলেন, পরবর্তীতে তাকে এই পাথরের কাছে স্থাপন করা হয়। এটাই সেই পাথর, যার কাছে হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম নিজ মেহরাব তৈরি করেছিলেন এবং এর কাছেই হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম প্রসিদ্ধ ইবাদতগাহ ‘হাইকালে সুলাইমানী’ নির্মাণ করেছিলেন। এটাই সেই পাথর, যার উপর থেকে নবী করীম (সাঃ) মেরাজের রাত্রে আসমানে উঠেছিলেন।

এই পাথরের উপর মসজিদ তৈরির উদ্দেশ্য হল, এটাকে রোদ-বৃষ্টি সহ বিভিন্ন ক্ষতিকর জিনিস থেকে হেফাজত করা। সেজন্য এর উপর মজবুত ইমারত তৈরি করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

অর্থ : আমি মেরাজের রাতে বাইতুল মাকদিসে পাথরটির ডানে নামায পড়েছি।’ আরেক হাদীসে এসেছে।

অর্থ ও বাইতুল মাকদিসের পাথরটি বেহেশতের পাথর। মসজিদে সাখরার ইমারতটি ৮ কোণ বিশিষ্ট। এক কোণ থেকে আরেক কোণের দৈর্ঘ্য গড়ে ২০.৫৯ মিটার। উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য হচ্ছে যথাক্রমে ২০.৬৯, ২০.৪২, ২০.৭৪, ২০.৬০, ২০.৯৬, ২০.৩৩, ২০.৭৪ ও ২০.৭২ মিটার এবং উচ্চতা হচ্ছে ৯.৫ মিটার। প্রত্যেক দেয়ালের সাখরা বা পাথর। মে রাজে যাবার সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ওপর বসেছিলেন।

উপরিভাগে জানালা রয়েছে। জানালার সংখ্যা ৫৬। এর মধ্যে ৪০টা জানালা দিয়ে ভেতরে আলো প্রবেশ করতে পারে। দেয়ালের বাইরের অংশে যে মোজাইক ছিল ১৫৪৫ খৃঃ তুর্কী সুলতান সুলাইমান কানুনী তা টাইলস দ্বারা পরিবর্তন করেন। ভেতর থেকে মসজিদের দেয়ালের উচ্চতা ৪ মিটার এবং দেয়ালের সকল অংশে মার্বেল পাথর লাগানো হয়েছে।

মসজিদে রয়েছে একটি বড় ও সুন্দর গোলাকৃতির গম্বুজ। মাটি থেকে ৭ গজ উঁচুতে নির্মিত গম্বুজের উচ্চতা হচ্ছে ১০৫ ফুট ও আয়তন ২০ . ৪৪ মিটার। গম্বুজে কাঠের তৈরি ২টা স্তর আছে। বাইরের স্তরটি শিশার পাতের তৈরি এবং তা বাইরে থেকে দেখা যায়। ভেতরের স্তরটি মসজিদের ভেতর থেকে দেখা যায়। তাতে সোনা মিশ্রিত পানি দিয়ে কুফী অক্ষরে নীল ভিটির উপর বিভিন্ন আয়াত লেখা আছে। এই মসজিদে বর্তমানে জামাত সহকারে নামায হয় না। পৃথকভাবে লোকেরা তাতে নামায পড়ে। শুধু মসজিদে আকসাতেই জামাতে নামায হয়। পাথরটি গম্বুজের মাঝামাঝি অবস্থিত। উত্তর থেকে দক্ষিণে পাথরের দৈর্ঘ্য হ চ্ছে ১৭.৭০ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে এর প্রশস্ততা হচ্ছে ১৩.৫০ মিটার। মাটি থেকে এর উচ্চতা হচ্ছে ১-২ মিটার। পাথরের চারপাশে রয়েছে নকশা করা কাঠের রেলিং। উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাথরের হেফাজত করা। পাথরের নীচে রয়েছে একটা গুহা। গুহার উপরে পাথরটিকে আসমান ও যমীনের শূন্যস্থানে ঝুলন্ত বলে মনে হয়। ভেতরের গুহাটি প্রায় ৪ সমকোণ বিশিষ্ট চতুর্ভূজ আয়তাকার, যার আয়তন হচ্ছে ৭x৫ মিটার সামনের দিকে থেকে নীচে যাওয়ার জন্য তাতে সিড়ির ১৪টি স্তর আছে। নীচের ৩টি সিঁড়িকে সেমি গোলাকার মনে হয়। পক্ষান্তরে, পাথরের ছাদের উচ্চতা হচ্ছে ৩ মিটার এবং ছাদে রয়েছে ৭০ x ৮০ সেন্টিমিটার বিশিষ্ট একটি ছিদ্র। সিঁড়ির বায়ে গর্তের বাম কোণকে ‘রোকনে দাউদ’ এবং উল্টো দিকের অর্থাৎ বিপরীত কোণকে বলা হয় রোকনে ইলিয়াস’। সিঁড়ির সাথে লাগা কোণের বিপরীতে মাটির স্তর থেকে সমান্য উঁচু এক স্তর বিশিষ্ট মিম্বারকে বলা হয় রোকনে ইবরাহীম ‘। রোকনে ইবরাহীমের মিম্বারের সামনেই হল ঐ স্তরটি। নীচে যাওয়ার সিড়ির ডানে ৪ সমকোণ বিশিষ্ট আয়তাকারের একটি মেহরাব আছে। এটাকে ‘মেহরাবে সুলাইমান’ বলা হয়। অনুরূভাবে, ভেতরে আরেকটি মেহরাবকে মেহরাবে খিদির’ও বলা হয়। প্রাক-ইসলাম যুগে, লোকেরা পাথরের উপরের ছিদ্র দিয়ে গুহার ভেতর কোরবানীর রক্ত প্রবাহিত করত। ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন, মসজিদে সাখরার জন্য খলীফা আবদুল মালেক মিসরের ৭ বছরের যে খাজনার আয় বরাদ্দ করেছিলেন, সেখান থেকে ১ লাখ দীনার উদ্বৃত্ত থেকে যায়। পরে আবদুল মালেক ঐ উদ্বৃত্ত অর্থ মসজিদে সাখরার তদারককারী ২জন প্রকৌশলীকে দিতে চান। তারা হলেন, ফিলিস্তিনের রাজা হায়াত কানদী এবং জেরুসালেমের ইয়াযিদ বিন সালাম। কিন্তু তারা ঐ অর্থ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, আমাদের সম্পদ থেকেই এই মসজিদ নির্মাণ করা উচিত। তখন আবদুল মালেক এই অর্থ দিয়ে সোনা কিনে তা মসজিদের গম্বুজ ও দরজায় লাগিয়ে দেন।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *