মসজিদে আকসার প্রাচীন ইতিহাস

মসজিদে আকসার প্রাচীন ইতিহাস

বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রশ্ন করি, যমীনে প্রথম কোন্ মসজিদ তৈরি হয়েছিল? তিন উত্তরে বলেন, “মসজিদে হারাম। আমি জিজ্ঞেস করি, তারপর কোনটি? তিনি বলেন, মসজিদে আকসা। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করি, এ দুটোর মধ্যে সময়ের ব্যবধান কত? তিনি বলেন, ৪০ বছর। যারা বলেন, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম মসজিদে আকসা তৈরী করেছেন, তাদের এই বক্তব্যের উপর প্রশ্ন জাগে, ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর সাথে সুলাইমান আলাইহিস সালাম-এর সময়ের ব্যবধান হচ্ছে এক হাজার বছর। অথচ উপরোক্ত হাদীসে বলা হয়েছে, কা’বার ৪০ বছর পর মসজিদে আকসা তৈরি হয়েছে। ইবনুল যাওজী এই প্রশ্নের জওয়াবে বলেন, হাদীসে মসজিদে আকসার প্রথম ভিত্তির প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যেমনি কা’বার প্রতিষ্ঠাতা নন, তেমনি সুলাইমান আলাইহিস সালামও মসজিদে আকসার প্রতিষ্ঠাতা নন। বরং তারা ২ জন হচ্ছেন পুনঃনির্মাণকারী। কাবার মূল প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন, হযরত আদম আলাইহিস সালাম। পরবর্তীতে, বিভিন্ন জায়গায় তার সন্তানেরা ছড়িয়ে পড়ে। তাদের কেউ ৪০ বছর পর মসজিদে আকসা প্রতিষ্ঠা করেন। আরেক বর্ণনায় বলা হয়েছে, যমীনের উপর প্রথম মসজিদ হচ্ছে মসজিদে হারাম যা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তৈরি করেছেন। আর মসজিদে আকসা হচ্ছে ২য় মসজিদ, যা কা’বা শরীফ প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পর হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম তৈরি করেন। তারপর দাউদ আলাইহিস সালাম তার সংস্কার করেন এবং সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর পূর্ণতা সাধন করেন। অন্য আরেক বর্ণনায় এসেছে, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কাবা নির্মাণের ৪০ বছর পর মসজিদে আকসা নির্মাণ করেন।২২ এবার আমরা মসজিদে আকসার নির্মাণ ও সংস্কার সম্পর্কে ধারাবাহিক আলোচনা শুরু করবো।

১. হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর যুগ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মসজিদে আকসা নির্মাণ করেছেন বলে ইতিপূর্বে আমরা এক বর্ণনায় জানতে পেরেছি। তিনি নিজ জন্মভূমি ইরাকে ইসলাম প্রচারের অভিযোগে নির্যাতিত ও নিস্পেষিত হন এবং পরে ইরাক থেকে সিরিয়ায় হিজরাত করেন। তিনি তাঁর আশ্রয়কেন্দ্র সিরিয়ায় দীর্ঘদিন বসবাস করেন। তিনি ইরাক থেকে নিজের মা-বাপ ও আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ত্যাগ করেন আল্লাহর দীনের স্বার্থে হিজরাত করে। তারপর সিরিয়ায় যখন চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন তিনি মিসরে চলে যান। মিসরের ফেরাউন তার স্ত্রী সারার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ঘটনার পর তিনি পুনরায় সিরিয়ায় ফিরে আসেন। মিসরের ফেরাউন সম্রান্ত কারাবন্দী হাজারকে সারার প্রতি উপহার দেয়। হাজারও ঐ সফরে হযরত ইবরাহীমের আলাইহিস সালাম সফর-সঙ্গিনী ছিলেন। সারা হাজারকে ইবরাহীমের আলাইহিস সালাম উদ্দেশ্যে উপহার দেন। হাজারের ঘরে হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম জন্মগ্রহণ করেন।

আল খলীল শহরে মসজিদে ইবরাহীম। এর ভেতরে এক গুহায় হযরত ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এবং তাঁদের স্ত্রীদের কবর রয়েছে।

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম হাজার ও শিশুপুত্র ইসমাঈলকে মক্কার নির্জন মরুভূমিতে রেখে যান। মক্কায় কোন কৃষি আবাদী ছিল না। তিনি সেখানে ইসমাঈলকে আলাইহিস সালাম সাথে নিয়ে কাবা শরীফ তৈরী করেন। তারপর তিনি পুনরায় সিরিয়া ফিরে আসেন। তখন জেরুসালেম সিরিয়ার অধীন ছিল। কাবা শরীফ তৈরির ৪০ বছর পর তিনি মসজিদে আকসা তৈরি করেন।

২. হ্যরত ইসহাক ও ইয়াকুব আলাইহিস সালাম-এর যুগ হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর জন্মের দশ বছরেরও বেশী সময় পরে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর পরবর্তী সন্তান ইসহাকের জন্ম হয়। ইসমাঈলের মত ইসহাকও নবী ছিলেন। হযরত ইসহাকের ঘরে দুই ছেলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা হলেন ইয়াকুব ও ইসু। হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম নবী ছিলেন। তবে ইসু নবী ছিলেন না। ইয়াকুবের উপাধি ছিল ইসরাইল। তাঁর দিকে সম্বোধন করে তার বংশধরকে বনু ইসরাইল বলা হয়। পরবর্তীতে ইসুর পরিবর্তে ইয়াকুবের বংশের মধ্যে নবুওয়াত বিদ্যমান থাকে। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সাখরার স্থানে যে মসজিদে আকসা নির্মাণ করেন, তা দুর্বল হয়ে পড়ায় হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম তা সংস্কার করেন।

৩. হযরত মূসার আলাইহিস সালাম যুগ হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম-এর শেষ বয়সে বনু ইসরাইল হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম এর – আহ্বানে মিসর প্রবেশ করে। উল্লেখ্য যে, ইউসুফ আলাইহিস সালাম হযরত ইয়াকুবের সন্ত নি ও আল্লাহর নবী ছিলেন। পরবর্তীতে বন ইসরাইল মিসরে ফেরাউনের দ্বারা নির্যাতিত হয়। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম-এর যুগে তার সাহায্যে বনু ইসরাইল মিসর ত্যাগ করে। ফলে, পুনরায় তাদের জেরুসালেমের পবিত্র স্থানে ফিরে আসার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু জেরুসালেমের জালেম

অধিবাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলে। তাদের এই জিহাদ-বিমুখিতার জন্য আল্লাহ সিনাই মরু প্রান্তরের তীহ ময়দানে তাদেরকে ৪০ বছর মরু জিন্দেগী যাপনের শাস্তি দান করেন। কিন্তু তারা জেরুসালেমে পুনরায় ফিরে যাওয়ার জন্য আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও ভীরুতা ও কাপুরুষতার জন্য তা সফল হচ্ছিল না। কুরআন বনি ইসরাইলের ঐ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা উল্লেখ করেছে। ঘটনা হচ্ছে এই যে, ফেরাউন মিসরে বনি ইসরাইলের উপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে। সে তাদের ছেলে সন্তানদেরকে হত্যা করে মেয়ে সন্তানদেরকে জীবিত রাখে। পরে মূসা আলাইহিস সালাম-এর নেতৃত্বে মজলুম জনতার উদ্দেশ্যে সাগর শুকিয়ে পারাপারের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ফেরাউন ও তার দলবলকে সাগরের পানিতে ডুবিয়ে মারেন। বনু ইসরাইল সাগর পেরিয়ে সিনাই মরু প্রান্তরে উপস্থিত হয়। সিনাই প্রান্তরে পূর্ব থেকেই এক মূর্তিপূজারী জাতির বাস ছিল। বনু ইসরাইল তাদের কাছে আল্লাহর বিভিন্ন প্রতিকৃতি বা মূর্তি এবং সেগুলোতে পশু উৎসর্গসহ সেজদা করা দেখে মূসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে এসে আবেদন করে, হে মূসা! তাদের মত আমাদের জন্যও মাবুদ বানিয়ে দাও। এতে মূসা ভীষণ রাগ করেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা বোকা জাতি। সিনাই প্রান্তরের অধিবাসীরা যা করছে তা সম্পূর্ণ বাতিল ও ধবংসাত্মক কাজ। তোমরা কি চাও, যে আল্লাহ তোমাদেরকে গোটা বিশ্বের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তার পরিবর্তে আমি তোমাদের জন্য হাতের তৈরি অন্য মাবুদ পেশ করি? মূসা আলাইহিস সালাম তাদের এই অন্যায় আবদার এভাবে প্রত্যাখান করেন। তিনি তাদেরকে নিয়ে বাইতুল মাকদিস অভিমুখে রওনা দেন। কিন্তু বাইতুল মাকদিসের জালেম শাসক ও অধিবাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া সহজভাবে, সেখানে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তখন মূসা আলাইহিস সালাম বনি ইসরাইলকে লক্ষ্য করে বলেন, তোমরা কি আল্লাহর নিয়ামাত স্বীকার কর? আল্লাহ তোমাদের মধ্যে নবী পাঠিয়েছেন এবং তোমাদেরকে বাদশাহ বানিয়েছেন। তোমাদেরকে এমন কিছু দিয়েছেন যা আর কাউকে দেয়া হয় নি। তোমরা বাইতুল মাকদিসে প্রবেশ কর এবং এ ব্যাপারে পিছটান দেবে না। অন্যথায় তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা জওয়াব দিল, হে মূসা! বাইতুল মাকদিসে এক জালেম শক্তিধর জাতি বাস করে। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে না গেলে আমরা সেখানে যাব না। তখন আল্লাহর প্রতি ভয় পোষণকারী ও নিয়ামাত প্রাপ্ত দু’ব্যক্তি বললো, তোমরা শহরের প্রবেশ পথ দিয়ে প্রবেশ কর। তোমরা অবশ্যই বিজয় লাভ করবে। তোমরা আল্লাহর উপর নির্ভর কর, যদি তোমরা মুমিন হও।’

বনু ইসরাইল উত্তরে বলে, হে মূসা! তারা যতক্ষণ পর্যন্ত শহরে আছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সেখানে ঢুকবো না। তুমি এবং তোমার রব যাও ও সেখানে গিয়ে যুদ্ধ করে তাদেরকে পরাজিত করে দিয়ে আস। আমরা এখানেই বসে আছি। এর উত্তরে মূসা আলাইহিস সালাম বলেন, হে রব! আমি আমার ও আমার ভাই হারুন ছাড়া আর কারুর উপর নিয়ন্ত্রণকারী নই। আমার ও আমার কওমের মধ্যে তুমি ব্যবধান সৃষ্টি করে দাও। আল্লাহ এই দোয়ার জওয়াবে বলেন, তাদের জন্য বাইতুল মাকদিস চল্লিশ বছর পর্যন্ত হারাম করা হল এবং তারা যমীনে ঘুরাফিরা করতে থাকবে। তুমি জালেম কাওমের আচরণে নিরাশ হয়ো না। বনু ইসরাইল সিনাই মরুভূমির কঠিন পানিশূন্য তীহ প্রান্তরে পড়ে রইল। পানির পিপাসায় অস্থির হয়ে মূসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে পানি প্রার্থনা করল। মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে পানির আবেদন জানাল। আল্লাহ তাঁকে নিজ লাঠি দ্বারা একটি পাথরে আঘাত করার নির্দেশ দেন। ফলে, ১২ গোত্রে বিভক্ত বনি ইসরাইলের জন্য ১২টি ঝর্নাধারা ফুটে উঠল। তারা সেই পানি থেকে সবাই প্রয়োজন পূরণ করতে লাগল। এরপর তাদের খাদ্য সমস্যা দেখা দিল। তারা মূসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে খাবার চেয়ে বসল। ফলে, মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন এবং বনি ইসরাইলের জন্য মান্না ও সালওয়া নামক খাদ্য পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বনি ইসরাইল তাতে বিরক্ত হয়ে ওঠে এবং মূসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে ফরিয়াদ করে। হে মূসা! আমরা, একই প্রকার খাওয়ার উপর বিরক্ত হয়ে পড়েছি। তুমি তোমার রবের কাছে প্রার্থনা কর, যেন তিনি আমাদেরকে যমীনের উৎপাদিত সজি-তরকারী, সিম, ডাল ও পেঁয়াজ দান করেন। এতে মূসা আলাইহিস সালাম রাগ হন এবং প্রশ্ন করেন, তোমরা কি নিকৃষ্ট জিনিসের জন্য উৎকৃষ্ট জিনিসের পরিবর্তন কামনা কর? যদি তাই চাও, তাহলে তোমরা শহরে ছড়িয়ে পড় এবং সেখানে তোমরা যা চাবে, তাই পাবে। এদিকে মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর সাথে নির্ধারিত কর্মসূচী মোতাবেক ৩০ দিনের জন্য তূর পাহাড়ে চলে যান। তিনি নিজ কাওমকে ৩০ দিনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন। কিন্তু আরো ১০ দিন থেকে মেয়াদ পূর্ণ করায় এবং ফিরতে দেরী হওয়ায় তাদের কাছে সামেরী নামক এক লোক এসে প্রস্তাব করে, মূসা আটকা পড়েছে এবং তোমাদের কাছে আর ফিরে আসবে না। তাই তোমাদের উচিত, একটি উপাস্য গ্রহণ করা। বনি ইসরাইল প্রস্তাবটি চিন্তা করে দেখল, প্রস্তাবটি ছিল তাদের মনের মত। ইতিপূর্বেও তারা মূসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে অনুরূপ উপাস্য তৈরির দাবী জানিয়েছিল। কিন্তু মূসা আলাইহিস সালাম তা অস্বীকার করেছিলেন। যাই হোক, সামেরী সোনার তৈরী একটি গো-বাছুর নিয়ে আসল এবং গো বাছুরটি আওয়াজ দিতে পারত। বনু ইসরাইল গো-বাছুরের পূজা আরম্ভ করল। সামেরী বলল, এটা তোমাদের এবং মূসার উপাস্য।

হযরত মূসার স্থলাভিষিক্ত হযরত হারুন তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে। তোমাদের রব হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ-রাহমান। তোমরা আমার অনুসরণ ও আনুগত্য কর। তারা জবাবে বলেন, আমরা মূসা আলাইহিস সালাম ফিরে না আসা পর্যন্ত এইভাবে মূর্তিপূজা করতে থাকবো। হযরত মূসা ফিরে আসেন এবং নিজ সম্প্রদায়ের উপর অত্যন্ত রাগ করেন। তিনি বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ শুনে সেদিকে অগ্রসর হয়ে দেখেন যে, তাঁর কাওমের লোকেরা গো-মূর্তির নাচ-গান করেছে। তিনি রাগ করে বলেন, তোমরা আমার অনুপস্থিতিতে অত্যন্ত খারাপ কাজ করেছে। তারপর তিনি হাত থেকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত তাওরাত ফেলে দেন এবং প্রশ্ন করেন, হে আমার জাতি! আল্লাহ কি তোমাদের সাথে উত্তম ওয়াদা করেননি? তোমাদের কাছে কি সময় দীর্ঘায়িত হয়েছিল কিংবা তোমরা চাও যে, তোমাদের উপর তোমাদের রবের গযব নেমে আসুক। যে জন্য তোমরা আমার মেয়াদের অবসরে বিপরীত কাজ শুরু করে দিয়েছিলে? মূসা আলাইহিস সালাম হারুনকে প্রশ্ন করেন, তুমি যখন তাদেরকে গোমরাহীর কাজে লিপ্ত দেখলে, তখন কেন আমার অনুসরণ করলে না এবং কেন আমার নাফরমানী করলে? হারুন আলাইহিস সালাম বলেন, হে ভাই! কাওম আমাকে দুর্বল মনে করে আমাকে মেরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিল। তাই আমার বিষয়ে এমন কিছু করবেন না, যার কারণে দুশমনরা হাসতে পারে এবং আমাকে যালেমদের অন্তর্ভুক্ত করবেন না। তখন মূসা আলাইহিস সালাম পুনরায় প্রশ্ন করেন, তুমি তাদের উক্ত কুফরীর বিরুদ্ধে কেন লড়াই করলে না? তুমি জান যে, আমি মওজুদ থাকলে অবশ্যই লড়াই করতাম? হারুন আলাইহিস সালাম বলেন, হে আমার ভাই! আমার দাড়ি কিংবা মাথা ধরে টান দেবেন না। আমার আশংকা হয়েছিল আপনি এই ধারণাই করবেন যে, আমি আপনার কথা স্মরণ না রেখে কাওমের সাথে আপনার দূরত্ব সৃষ্টি করেছি।

তারপর মূসা আলাইহিস সালাম বলেন, হে রব! আমাকে ও আমার ভাইকে মাফ করুন এবং আমাদেরকে আপনার রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দিন। আপনি পরম দয়ালু ও মেহেরবান। তারপর মূসা আলাইহিস সালাম সামেরীকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার ঘটনা ও চক্রান্তটা কি? সামেরী জওয়াবে বলল, আমি যা দেখেছি, অন্যরা তা দেখেনি। আমি জিবরীলকে দেখেছি এবং জিবরীলের পায়ের স্থান থেকে এক মুষ্টি মাটি নিয়ে তা গো-বাছুরের প্রতিকৃতির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছি। এই চক্রান্ত করার জন্য আমার মন আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মূসা আলাইহিস সালাম বলেন, তোমার তৈরি ঐ মূর্তিকে জ্বালিয়ে এর ছাই আমি সাগরে নিক্ষেপ করবো। মূসা আলাইহিস সালাম মূর্তিটি ধ্বংস করে দিলেন এবং নিজ কাওমকে বললেন, তোমাদের মাবুদ হচ্ছেন সেই মহান আল্লাহ, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, তিনি সকল কিছু সম্পর্কে ওয়াকিফহাল।

এতে, বনি ইসরাইল লজ্জিত হয় এবং মূসা আলাইহিস সালাম তাদেরকে লক্ষ্য করে প্রস্তাব করেন, হে কাওম! তোমরা গো-বাছুরের প্রতিকৃতিকে মাবুদ বানিয়ে নিজেদের উপর যুলুম করেছ। তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর এবং নিজেদেরকে হত্যা কর। তোমাদের স্রষ্টার কাছে এটাই তোমাদের জন্য উত্তম। বনি ইসরাইল আল্লাহর কাছে তওবা করার সিদ্ধান্ত নিল এবং মূসা আলাইহিস সালাম-কে তা জানাল। তখন মূসা আলাইহিস সালাম বনি ইসরাইলের ৭০ জন আলেম নির্বাচিত করেন এবং তাদেরকে নিয়ে আল্লাহর কাছে বনি ইসরাইলের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার উদ্দেশ্যে তূর পাহাড়ের নিকটবর্তী হন। মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে গো-বাছুরের প্রতিকৃতি পূজার অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি বনি ইসরাইলের কাছে ফিরে এসে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার কথা জানান। কিন্তু তারা গোঁ ধরে বসে এবং বলে, হে মূসা। আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্য না দেখা পর্যন্ত তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি না। তাদের এই অপরাধের জন্য আকাশ থেকে এক বজ্রপাতের মাধ্যমে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। তখন মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, হে রব! তুমি ইচ্ছা করলে, তাদেরকে আমার আগমনের আগেও ধ্বংস করে দিতে পারতে। তুমি কি আমাদেরকে আমাদের মূখ লোকদের অপকর্মের জন্য ধ্বংস করে দেবে? এটা হচ্ছে তোমার পরীক্ষা, এই পরীক্ষার মাধ্যমে তুমি যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান কিংবা গোমরাহ করে থাক। তুমি আমাদের প্রভু! আমাদেরকে মাফ কর ও রহমত দান কর। তুমি সর্বোত্তম ক্ষমাকারী।

আল্লাহ বলেন, আমি যাকে ইচ্ছা আযাব দিই এবং সবকিছুর উপর আমার রহমত ছেয়ে আছে। কিন্তু মূসা আলাইহিস সালাম দোয়া অব্যাহত রাখেন যে পর্যন্ত না আল্লাহ ঐ মৃতলোকদেরকে পুনরায় জীবিত করেন। আল্লাহ তাদেরকে পুনরায় জীবন দান করেন। কিন্তু কি পরিহাস! বনি ইসরাইল তাদের মুক্তিদাতা মূসা ও হারুন আলাইহিস সালাম এর বিরুদ্ধে কাওরাহ বিন বাসহারের নেতৃত্বে বিদ্রোহের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কাওরাহ বনি ইসরাইলের নেতৃস্থানীয় আড়াইশ’ লোকের এক সভায় হযরত মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে বক্তব্য পেশ করে। বনি ইসরাইলের অধিকাংশ লোক এই সামষ্টিক বিদ্রোহের আহ্বানে সাড়া দেয়। সবাই মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এবং বলে, তোমরা ২ ব্যক্তি বনি ইসরাইলের ধ্বংসকারী। আল্লাহ মূসা ও হারুনের অনুসারী সত্যপন্থীদেরকে সাহায্য করেন এবং ১৪ হাজার বিদ্রোহীকে এক মহামারীর মাধ্যমে ধ্বংস করে দেন। তাওরাতে বর্ণিত আছে যে, বিশ বছর বয়স্ক অধিকাংশ যুবক মারা গেছে। তীহ প্রান্তরের অবশিষ্ট লোকিদের জন্য ৪০ বছর সশ্রম দণ্ড ঘোষণা করে বলা হয়, তাদেরকে এই ময়দানে ৪০ বছর কাটাতে হবে। তীহ ময়দানে হযরত মূসা ও হারুন আলাইহিস সালাম ইন্তিকাল করেন। তাঁরা দুইজনও জেরুসালেমে প্রবেশের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন।

যখন তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, এই কাপুরুষ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে জিহাদের মাধ্যমে জেরুসালেম জয় করা সম্ভব নয় তখন তারা জেরুসালেমের অতি নিকটে, পাথর নিক্ষেপের দূরত্বের মধ্যে নিজেদের লাশ দাফনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আল্লাহ তাদের সেই দোয়া কবুল করেন এবং তাদের আগ্রহ মোতাবেক তাদেরকে জেরুসালেমের কাছে দাফন করা হয়। বুখারী শরীফে কিতাবুল আম্বিয়া অধ্যায়ে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জেরুসালেমে হযরত মূসার কবরের স্থান চিহ্নিত করার আগ্রহ প্রকাশ করে বলেন, আমি হযরত মূসার আলাইহিস সালাম কবর দেখতে পাচ্ছি। এই আমলে মসজিদে আকসায় পৌছার ব্যাপারে বনি ইসরাইলের জিহাদবিমুখতা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোন কিছু নেই।

 ৪. ইউশা বিন নূন আলাইহিস সালাম এর যুগ। হযরত মূসা ও হারুনের আলাইহিস সালাম পরবর্তী নবী হলেন ইউশা বিন নূন। সূরা কাহাফে যে যুবকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তিনি হচ্ছেন, হযরত ইউশা’ আলাইহিস সালাম। সহীহ হাদীসের মাধ্যমেও তা প্রতিষ্ঠিত। তিনি তীহ ময়দানের অবশিষ্ট বনি ইসরাইলকে জেরুসালেম যাওয়ার নির্দেশ দেন এবং বলেন, সেটি হচ্ছে, ঈমানদারদের স্থান, কাফির-মুশরিকের স্থান নয়। তিনি বনি ইসরাইলের পরবর্তী বংশধরকে নিয়ে জেরুসালেম পৌছেন। তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে বাইতুল মাকদিস অবরোধ করেন এবং সূর্যাস্তের মুহূর্তে বিজয় সন্নিকট হওয়ায় আল্লাহর কাছে বিজয় না হওয়া পর্যন্ত সূর্যকে আটকিয়ে রাখার দোয়া করেন।

আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন।২৪ তিনি নিজ বাহিনী নিয়ে বাইতুল মাকদিসে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন এবং সাখরার স্থানে গম্বুজে মূসা’ নির্মাণ করেন। তাঁরা সেই গম্বুজের দিকে মুখ করে নামায পড়তেন। তারপর তারা তার পরিবর্তে সাখরার দিকে মুখ করে নামায পড়া শুরু করেন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) পর্যন্ত তা সবার কিবলা ছিল। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আমলে ১৭ মাস পর্যন্ত মুসলমানগণ মদীনায় বাইতুল মাকদিসের দিকে মুখ করে নামায আদায় করেন। তারপর আল্লাহর ইচ্ছায় কা’বা শরীফের দিকে কিবলাহ পরিবর্তন হয়ে যায়।

৫. ইউশা বিন নূন পরবর্তী যুগ হযরত ইউশা বিন নূনের পরে জেরুসালেমে বনি ইসরাইলের উপর তিন ধরনের শাসনকার্য পরিচালিত হয়। ১ম ধরনের শাসনপদ্ধতি হচ্ছে বিচারক গোষ্ঠীর শাসন। বনি ইসরাইলের ১২ বংশের বিচারপতিরা মিলে সুদীর্ঘ চারশ’ বছর পর্যন্ত জেরুসালেম শাসন করে। ২য় ধরনের শাসন পদ্ধতি হচ্ছে, বাদশাহী পদ্ধতি। বিচারপতিদের শাসন পদ্ধতি দুর্বল হওয়ার পর বাদশাহগণ জেরুসালেমে বনি ইসরাইলের শাসনভার পরিচালনা করেন। বিচারপতিদের দুর্বলতার সুযোগে বহিরাগত দুশমনরা জেরুসালেম দখল করে নেয়। অর্থাৎ খৃস্টপূর্ব প্রায় এক হাজার বছর পূর্বে, আমালিকা সম্প্রদায়ের লোকেরা বনি ইসরাইলের উপর আক্রমণ করে এবং তারা বনি ইসরাইলের কাছ থেকে ফিলিস্তিনের অধিকাংশ এলাকা কেড়ে নেয়। ঐ সময় হযরত শামউইল নবী আলাইহিস সালাম বনি ইসরাইলে শাসনভার পরিচালনা করেন। তিনি খুব বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এজন্য বনি ইসরাইল সরদারগণ নবীর কাছে শক্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একজন বাদশাহর আবেদন করেন। নবীর আবেদন ক্রমে আল্লাহ তাদের জন্য তালুত নামক একজন বাদশাহর আবির্ভাবের কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু নৈতিক দিক থেকে অধঃপতিত ও স্বার্থপরতার শিকার বনি ইসরাইল তাঁকে বাদশাহ হিসেবে মেনে নিতে ইতস্তত করতে থাকে।

তারা বলে আমরাই তালুতের চাইতে বাদশাহ হওয়ার বেশি অধিকারী। শেষ পর্যন্ত তাদের যে অংশ ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল, তারা তালুতের সাথে যুদ্ধ করে জালুতকে (জুলিয়েট) পরাজিত করে। ঘটনাবশতঃ যুবক দাউদ আলাইহিস সালাম এ সময় তালুতের বাহিনীতে ছিলেন। তিনি যুদ্ধে ফিলিস্তিনী বাহিনীর প্রধান জালুতকে হত্যা করে ইসরাইলীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। এই ঘটনা কুরআন মজীদের সূরা বাকারার ২৪৬ আয়াত থেকে ২৫১ আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তখন থেকে ইসরাইলীদের মধ্যে বাদশাহী পদ্ধতি শুরু হয়। তালুত তাদের বাদশাহ নিযুক্ত হন। শামুয়েল গ্রন্থে উল্লেখ আছে, তালুত হযরত দাউদের কাছে নিজ কন্যা বিয়ে দেন এবং তালুতের পরে তিনি ইসরাইলীদের ২য় বাদশাহ নিযুক্ত হন। দাউদ আলাইহিস সালাম জেরুসালেম শহর দখল করেন। ৩য় যুগ হচ্ছে, বিচ্ছিন্নতা ও পতনের যুগ।

৬. হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর যুগ হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম খৃস্টপূর্ব ৯৭৭ সালে জেরুসালেম শহর জয় করে সেখানে সিন্ধুক নিয়ে যান। তাতে হযরত মূসা ও হারুন আলাইহিস সালাম-এর নিদর্শন ছিল। তিনি আল্লাহর নির্দেশে জেরুসালেম শহরে পবিত্র ইবাদতের স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য একটি প্রশস্ত জায়গা প্রস্তুত করেন এবং নির্মাণ কাজের জন্য সকল প্রয়োজনীয় জিনিস মওজুদ করেন। কিন্তু একজন ইয়াতীমের সম্পত্তি মসজিদের স্থানে অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছার কারণে আল্লাহ তাকে মসজিদ নির্মাণ করতে নিষেধ করেন। কেননা, অবৈধ সম্পত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ইবাদতখানায় আল্লাহর পবিত্র ইবাদত করা যায় না। তারপর দাউদ প্রার্থনা করেন, হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে দিয়ে তা নির্মাণ করাও। আল্লাহ বলেন, ঠিক আছে, তোমার সন্তানই তা তৈরি করবে। হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম সাহইউন পাহাড়ে নিজ দফতর স্থাপন করেন এবং সেখানে একটি দুর্গ তৈরি করেন। জেরুসালেমে রাজধানী স্থাপনের আগে ৭ বছর পর্যন্ত, আল-খলীল ছিল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী।

৭. হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর যুগ। সুলাইমান আলাইহিস সালাম জেরুসালেমে জন্মগ্রহণ করেন। বাপের ইন্তিকালের পর তিনি জেরুসালেমের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তার শাসনকাল ছিল খৃস্টপূর্ব ৯৬৩-৯২৩ সাল পর্যন্ত মোট ৪০ বছর। তার আমলে জেরুসালেমে বাণিজ্য ও শিল্প প্রকল্প জোরদার হয়। আরাবাহ উপত্যকার খনি থেকে লোহা ও তামা উত্তোলনের ফলে রাষ্ট্রের আয় অনেক বৃদ্ধি পায়। কুরআনের তাফসীরকারগণ বলেছেন, তিনি ক্ষমতার মসনদ থেকে ৪০ দিন অনুপস্থিত থাকার পর পুনরায় ফিরে আসেন। তাঁকে আল্লাহ এমন বিশাল বাদশাহী দিয়েছিলেন যা তার পরে আর কাউকে দেয়া হয়নি। তিনি মা’বাদে সুলাইমান তৈরির উদ্যোগ নেন। অর্থাৎ তার তৈরি ইবাদতগাহকে তাঁর নামের সাথে যুক্ত করে মা’বাদে সুলাইমান বলা হয়। এর অপর নাম হচ্ছে হাইকালে সুলাইমানী। এটাকেই কুরআন মসজিদে আকসা বলে উল্লেখ করেছে। এই মসজিদ নির্মাণে ৩০ হাজার শ্রমিকের ৭ বছর সময় লেগেছিল। তিনি খুবই সুন্দর ডিজাইনে মসজিদটি তৈরি করেন। ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর যুগেই মসজিদে আকসা তৈরি হয়েছিল, তবে হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম তাকে বড় ও মজবুত করে তৈরি করেন।

৮. সুলাইমন আলাইহিস সালাম এর পরবর্তী যুগ। হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম-এর পরে তাঁর সাম্রাজ্য দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি হচ্ছে দক্ষিণ সাম্রাজ্য। এর অপর নাম হচ্ছে ইহুজা’ বা ইয়াহুদা। রাজধানী জেরুসালেম। সম্ভবতঃ পরবর্তীতে ইহুদী নামকরণের সাথে ঐ ইয়াহুদা নামের সম্পর্ক রয়েছে। হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম-এর ছেলে রাহাবআম হচ্ছেন ইয়াহুদা রাজ্যের রাজা। ২য়টি হচ্ছে, উত্তর সাম্রাজ্য। এর অপর নাম ইসরাইল এবং রাজধানী হচ্ছে নাবলুস কিংবা শাকীম। এই সাম্রাজ্যের রাজা হলেন সুলাইমান আলাইহিস সালাম-এর প্রধান সেনাপতি ইউরিআম। উত্তর সাম্রাজ্য অর্থাৎ ইসরাইল দক্ষিণ সাম্রাজ্য তথা ইয়াহুদা থেকে অপেক্ষাকৃত বড় ছিল এবং অধিকাংশ ইহুদী বংশ ইসরাইলেই বাস করত।

৯. ইসরাইল ও ইয়াহুদা সাম্রাজ্যের অবসান এবং মাবাদে সুলাইমান ধ্বংস ইসরাইল ও ইয়াহুদার মধ্যে বিরোধ ও সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় খৃস্টপূর্ব ৯৭০ সালে মিসরের ফেরআউন শাইশাক জেরুসালেমসহ ইয়াহুদা সাম্রাজ্য দখল করে। ফেরাউন মা’বাদে সুলাইমানীতে সংরক্ষিত মূল্যবান জিনিসপত্র এই বলে আত্মসাত কর যে, এগুলো হযরত সুলাইমানের মিসরীয় স্ত্রী তথা রাণীর সম্পত্তি। খৃস্টপূর্ব ৭২১ সালে আশুরীয় বাদশাহ সারজন ইসরাইল দখল করে সর্বশেষ ইসরাইলী রাজাকে আটক করে, রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে তাড়িয়ে দেয় এবং সেখানে নিজের গভর্নর নিযুক্ত করে। পরে মিসরের ফেরআউন শাইশাক আশুরীয় বাদশাহর কবল থেকে ইসরাইল দখল করে। এই সকল রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ফলে ব্যাবিলনের বাদশাহ বখতেনসর উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কেননা, দাজলা উপত্যকার আশুরীয় শাসক ব্যাবিলনের রাজার প্রভাব বলয়ে ছিলেন। তিনি মিসরীয় ফেরআউনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে ইয়াহুদা ও ইসরাইল দখল করেন এবং মিসরের ফেরআউন শাইশাককে পরাজিত করেন। তিনি খৃস্টপূর্ব ৫৮৭ সালে মসজিদে আকসা ধ্বংস করেন। বহু বনি ইসরাইলকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যান। কিছুসংখ্যক বনি ইসরাইল মিসরসহ অন্যান্য দেশের দিকে পালিয়ে যায়। ইতিহাসে এটাকে ব্যালিবনের বন্দী’ যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কোরআন মজীদে এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে

অর্থ : “আমরা কিতাবের মধ্যে বনি ইসরাইলকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, তোমরা যমীনে দুইবার বিশৃংখলা ও ফেতনা ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং বড় ধরনের বাড়াবাড়ি করবে। যখন ঐ দুই ফেতনার প্রথমটার সময়-কাল উপস্থিত হবে তখন আমরা তোমাদের উপর আমাদের এমন জঙ্গী শক্তিশালী লোককে বিজয়ী করবো, যারা তোমাদের ঘরে ঢুকে পড়বে। এটা এমন এক ওয়াদা ও ভবিষ্যদ্বাণী যা অবশ্যই সংঘটিত হবে।” (সূরা ইসরা ও ৪-৫)

১০. বন্দীদের প্রত্যাবর্তন ও মসজিদে আকসা পুনঃ নির্মাণ ব্যাবিলনের আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দেয়। কেননা, পারস্য সম্রাট কাওরাস এখমিনী যুদ্ধের মাধ্যমে ব্যাবিলন দখল করে নেন। ফলে ইয়াহুদা এবং ইসরাইল তার দখলে চলে আসে। কাওরাস বন্দীদেরকে ইয়াহুদায় পুনঃ ফেরত পাঠান এবং তাদের ইহুদী ধর্ম পালনের সুযোগ দেন। তখন থেকে ইহুদী’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায়, ইহুদী ধর্ম গ্রহণকারী ব্যক্তি। সেজন্য বনি ইসরাইল হওয়া জরুরী নয়। ইহুদীরা ব্যাবিলন থেকে ফিরে আসার পর জেরুসালেম শহর এবং হাইকালে সুলাইমানী পুনঃনির্মাণ করে। কিন্তু জেরুসালেমে তাদের অবস্থা হল দেশবিহীন জাতির অবস্থা। কেননা, জেরুসালেম পারস্য সম্রাটের অধীন ছিল। যাই হোক, তখন ৪২ হাজার বনি ইসরাইল, আরো ৭ হাজার শিশু ও কুমারী মেয়ে সহকারে জেরুসালেম ফিরে আসে।

১১. জেরুসালেমে গ্রীক আক্রমণ খৃস্টপূর্ব ৩২২ সালে মূর্তিপূজারী গ্রীকরা বাইতুল মাকদিস দখল করে। গ্রীক শাসক আলেকজান্ডার মাকদুনীর আদেশে ঐ আক্রমণ পরিচালিত হয়। তারা জেরুসালেমে পারস্য শাসনের অবসান করে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাইতুল মাকদিসে কর্তৃত্ব করে। এরপর জেরুসালেমে বাতালিসা শাসনের সূচনা হয় এবং রোমান শাসনের আগ পর্যন্ত তা বিদ্যমান থাকে।

১২. রোমানদের বাইতুল মাকদিস আক্রমণ খৃস্টপূর্ব ২৩ সালে রোমান শাসক হিরোদ (Herod) জেরুসালেম দখল করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি অবস্থা স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেন। তিনি ইহুদীদের সাথে সমঝোতায় পৌছেন এবং খৃস্টপূর্ব ২০-১৮ সালে হাইকালে সুলাইমানী পুনঃনির্মাণ করার সুযোগ দেন। পরবর্তীতে হাইকালটি হযরত যাকারিয়া, তার ছেলে হযরত ইয়াহইয়া এবং ঈসা বিন মরিয়ম পর্যন্ত ঐভাবেই। বিদ্যমান ছিল।

১৩. হযরত যাকারিয়া ও ইয়াহইয়ার আলাইহিস সালাম যুগ যাকারিয়া আলাইহিস সালাম এর আমলে মসজিদে আকসা বর্তমান ছিল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, যখন ইমরানের স্ত্রী আল্লাহর কাছে একটি নেক সন্তান কামনা করে তাকে মসজিদে আকসার সেবার জন্য দান করার নিয়ত করেন, তখন আল্লাহ তাকে মরিয়ম নামক একটি মেয়ে সন্তান দান করেন। মরিয়মকে মসজিদে আকসায় দিয়ে দেয়া হয় এবং তিনি তাঁর নিকটাত্মীয় নিঃসন্তান হযরত যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠেন। হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম ছিলেন হাইকালের প্রধান। তিনি শিশু মরিয়মের জন্মে আশাবাদী হয়ে মসজিদে আকসার মেহরাবে নিজের জন্য আল্লাহর কাছে একটি নেক সন্তানের দোয়া জানান। কঠোর বার্ধক্যে আল্লাহ তাঁকে একটি ছেলে সন্তান দান করেন। তাঁর নাম হচ্ছে ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম। হযরত ইয়াহইয়া নবী ছিলেন। ইহুদীরা হযরত যাকারিয়াকে আলাইহিস সালাম করাত দিয়ে চিরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। তারপর তারা হযরত ইয়াহইয়াকে আলাইহিস সালামও হত্যা করেন।

১৪. হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর যুগ কুমারী মরিয়মের ঘরে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জন্ম হয়। যৌবনে পদার্পণ করার পর তিনি মসজিদে আকসাকে দাওয়াহ কেন্দ্র বানান। তার সময় বনি ইসরাইল অগণিত অপরাধ করে। এমনকি, তারা মসজিদে আকসার পবিত্রতা ক্ষুন্ন করে এবং একে সুদখোরদের বাজার ও খেল-তামাশার কেন্দ্রে পরিণত করে। ঈসা আলাইহিস সালাম তাদেরকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে, তারা যদি এইভাবে নিজেদের অন্যায় ও অপরাধ অব্যাহত রাখে এবং মসজিদে আকসার পবিত্রতা নষ্ট করতে থাকে, তাহলে তাদেরকে এই মসজিদ থেকে বহিষ্কৃত করা হবে। তিনি বলেন, আল্লাহ এই মহান ইবাদতের স্থানটি ধ্বংস করে দেবেন এবং এর নাম-নিশানা পর্যন্ত মিটিয়ে দেবেন। খৃস্টানরা এটাকে গীর্জা হিসেবে ব্যবহার করে।

১৫. ২য় দফা ইবাদতগাহের ধ্বংস হযরত যাকারিয়া এবং ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম এই দুইজন নবীকে হত্যা করার পর বনি ইসরাইল ঈসা আলাইহিস সালাম-কেও হত্যার উদ্যোগ নেয়। তখন আল্লাহ রোমান ম্রাট তাইতুসকে বনি ইসরাইলের উপর বিজয় দান করেন। ৬৬ খৃস্টাব্দে রোমান বাহিনীর সাথে বনি ইসরাইলের সংঘর্ষ শুরু হয় এবং তা দীর্ঘ ৫ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তখন ইহুদীদেরকে ব্যাপকহারে হত্যা করা হয়। ৭০ খৃষ্টাব্দে রোমান বাহীন জেরুসালেম শহরে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং অজস্র ইহুদীকে দাস বানিয়ে নিয়ে যায়। জেরুসালেম শহর ধ্বংপে পরিণত হয় এবং কিছু সংখ্যক ইহুদী মিসর ও সিরিয়া পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তাইতুস জেরুসালেম শহরের নাম পরিবর্তন করে ঈলিয়া’ রাখেন। পরে সম্রাট কনস্ট্যানটাইন খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করে শহরের জেরুসালেম নাম পুনর্বহাল করেন। তখন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-এর ভবিষ্যদ্বাণী পুরো সত্য প্রমাণিত হয় এবং জেরুসালেম শহর ও মসজিদে আকসা সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। বখতে নসরের পর ২য় দফা মসজিদে আকসার বিনাশ সাধন করা হয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই মহান আল্লাহ রাব্বল আলামীন বলেছেন : “তারপর ২য় বারের প্রতিশ্রুতির সময় উপস্থিত হলে আমরা তোমাদের উপর অন্য লোকদেরকে বিজয়ী করবো, যেন তারা তোমাদেরকে মেরে চেহারা পরিবর্তন করে দেয়, প্রথমবারের মত তারাও যেন মসজিদে আকসায় প্রবেশ করে এবং বিজিত লোকদের সবকিছু ধ্বংস করে দেয়া।’ (সূরা ইসরা ৪-৫) আয়াতে বর্ণিত ২য় বারের প্রতিশ্রুতি হচ্ছে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী আকসা ও জেরুসালেমের ধ্বংস সাধন।

১৬. মসজিদে আকসার স্থানে মন্দির নির্মাণ ৭০ খৃস্টাব্দে তাইতুস কর্তৃক মসজিদে আকসা ধ্বংস হওয়ার পর আদরিয়াস নামক আরেক রোমান শাসকের আগমন ঘটে। তিনি জেরুসালেম শহরের সকল চিহ্ন এবং মসজিদে আকসার হাইকালের সকল ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলেন। ১৩৫ খস্টাব্দে তিনি মসজিদের স্থানে প্রতিমা পূজার জন্য মন্দির তৈরি করেন। মূর্তিপূজারী রোমানদের ঈশ্বর প্রভু ‘গোয়েবতারে’র নামানুসারে এর নামকরণ করেন। দেবতা পূজার নামে তারা সেখানে শিক শুরু করে।

১৭, মন্দির বিধ্বংস রোমানগণ খৃস্টধর্মকে স্বীকৃতি না দিয়েই ‘গোয়েবতার’ নামক মন্দির তৈরি করে। ফিলিস্তিনে খৃস্টধর্ম প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তা বিদ্যমান থাকে। খৃষ্টস্টন ধর্ম প্রতিষ্ঠার পর মন্দিরটি ভেঙ্গে ফেলা হয়। সম্রাট কনস্টান্টস্টাইন মন্দির ধ্বংসের পর সেখানে খৃস্টান ধর্মের বিকৃতি সাধন করে ত্রিত্ববাদ চালু করেন। ফলে, মসজিদে আকসা থেকে এক আল্লাহর ইবাদতের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায় এবং শিরকী ত্রিত্ববাদের চর্চা চলতে থাকে।

১৮. জেরুসালেমে খৃস্টান গণহত্যা ৬১০ খৃস্টাব্দে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যে খৃস্টান সম্রাট হিরাক্লিয়াস ক্ষমতায় আসেন। সেই সময় পারস্য সম্রাট ২য় খসরু খৃষ্টান শাসকদের কাছ থেকে সিরিয়া দখল করেন এবং ৬১৪ খৃস্টাব্দে জেরুসালেমে পৌছে তাও জয় করেন। তখন তিনি কেয়ামহা’ গীজাসহ খৃস্টানদের সকল গীর্জা ধ্বংস করেন এবং জেরুসালেম শহরের ৯০ হাজার খৃস্টানকে হত্যা করেন। এতে করে খৃস্টানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দুর্বল হয়ে আসে। কিন্তু, পরে হিরাক্লিয়াস দখলদার পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে পরাজিত করেন এবং ৬২৯ খৃস্টাব্দে জেরুসালেম পুনরুদ্ধার করেন।

এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেছেন :

অর্থ ও ‘নিকটবর্তী যমীনে নোম বাহিনী পরাজিত হয়েছে এবং অল্প কয়েক বছরের মধ্যে তারা আবার জয়লাভ করবে।’ (সূরা রূম-১) হিরাক্লিয়াস জেরুসালেম থেকে পারস্য বাহিনী কর্তৃক ছিনিয়ে নেয়া ক্রুশসহ পুনরায় শহরে প্রবেশ করেন। তাঁর সাথে ফিলিস্তিন বিজয়ী বিরাট বাহিনীও আনন্দ সহকারে জেরুসালেম শহরে প্রবেশ করে।

১৯. জেরুসালেমে ইহুদীবাদ ও খৃস্টবাদের অবসান হিরাক্লিয়াসের এই খুশীক্ষণে একজন আরব মুসলিম গিয়ে তাঁর কাছে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি হস্তান্তর করেন। চিঠিতে বলা হয়, চিঠিটি মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহর কাছ থেকে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি। হে হিরাক্লিয়াস! আমি তোমাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। তুমি ইসলাম গ্রহণ কর, আল্লাহ তোমাকে দ্বিগুণ সওয়াব দান করবেন। নতুবা প্রজাসাধারণের সকল গুনাহর দায়-দায়িত্ব তোমার উপর অর্পিত হবে। হে আহলে কিতাব! এমন একটি কালেমার বিষয়ে একমত হও, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। আর সেটি হচ্ছে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারুর ইবাদাত করবো না। তার সাথে আর কাউকে শরীক করবো না। এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে প্রতিপালক মানবো না। হিরাক্লিয়াস ইসলাম কবুল করার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু দরবারের লোকদের বিরোধিতার কারণে শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করতে মদীনায় হিজরাতের সামান্য আগে মসজিদে আকসায় মেরাজের মাধ্যমে সেখানে ইসলামী যুগের সূচনা হয়। হিরাক্লিয়াস ৬৪১ খৃঃ পর্যন্ত জেরুসালেম শাসন করেন। তখন মসজিদে আকসার এলাকায় চার দেয়াল ছাড়া আর কিছু ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে দেয়ালের সাথে নিজ বোরাক বেঁধেছিলেন সেটাকে হায়েত আল-বোরাক বা বোরাক দেয়াল বলা হয়। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সময় থেকেই জেরুসালেমের উপর ইহুদী ও খৃস্টানদের আধিপত্যের সমাপ্তির পয়গাম দেয়া হয়।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *