মজুমদারবাড়ির রহস্য
বাজার করে বড়ি ফিরছিলেন নগেনবাবু। এঁকে এই পানবাজার নামক আধা শহর আধা গ্রামের সকলেই খুব সমঝে চলে। পারতপক্ষে ঘাঁটায় না। কারণ, এই বছর পঞ্চাশ বয়েসের স্কুলমাস্টার ভদ্রলোক একজন অত্যন্ত ঠোঁটকাটা মানুষ, এই গ্রামের তিনি নীতি আর চরিত্রের স্বনিযুক্ত ধারক ও বাহক। কাউকে পরোয়া করিয়ারে লোক তিনি নন।
এই নগেন মিত্তিরকে সন্ত্রস্ত দেখায় একমাত্র যখন তিনি মজুমদারবাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যান। তখন তাঁর নতমস্তক, কাছে গেলে শোনা যায় চাপাগলায় তিনি রামনাম করে চলেছেন।
অবশ্য তাঁর আর দোষ কি? পানবাজারের কোনো লোককেই এই বাড়ির সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে যেতে দেখা যায়নি। কারণ, এই তল্লাটে সর্বত্র পানবাজারের মজুমদারবাড়ির একটি ভয়ংকররকমের হানাবাড়ি বলে সুনাম বা দুর্নাম আছে।
বাড়িটা যে খুব বিশালাকৃতি প্রসাদোপম তা নয়। বসবাসের একেবারেই অনুপযুক্ত তাও নয়। দোতলা বাড়ি, ভেতরে প্রকাণ্ড উঠোন ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উঠোনটা আগে আবর্জনা আর ঝোপঝাড়ে ঢাকা ছিল, কিছুদিন আগে পরিষ্কার করা হয়েছে। বাড়ির একপাশে মাঝামাঝি প্রায় দোতলা পর্যন্ত উঁচু খিলেন করা দেউড়ি। তিরিশ ইঞ্চি চওড়া দেওয়াল আর তিন থেকে চার ইঞ্চি মোটা সেগুনকাঠের দরজা বা জানলাগুলো স্বস্থানেই আছে। তাদের কোনো লয়ক্ষয় থাকার কথা নয়, যদিও তাদের পলেস্তারা বা রংচঙের আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
বাড়িটা বহুবার হাতবদল হয়েছে; কিন্তু কোনো ক্রেতাই দু-তিন সপ্তাহের বেশি এ বাড়িতে টিকতে পারেননি। কিছুদিন আগে এই বাড়িটা কিনে পুরঞ্জয় সরকার আর তার স্ত্রী পারমিতা এখানেই থাকবে বলে উঠে এসেছে। রবিবার সকালে পুরঞ্জয় বাজারের থলি হাতে বাড়ি থেকে বেরনো মাত্র, হবি তো হ, একেবারে মিত্তিরমশাইয়ের সামনে পড়ে গেল।
পুরঞ্জয় হাতজোড় করে কাষ্ঠ হেসে বলল– নমস্কার।
নগেনবাবু চমকে মুখ তুলে সামনে করজোেড় দণ্ডায়মান পুরঞ্জয়কে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। কাষ্ঠ লোষ্ট্র ইষ্টক কোনোরকম হাসির চেষ্টা না-করে টাকমাথাটা একটু নাড়লেন। হাতজোড় করা গেল না কারণ তখন তাঁর একহাতে ছাতা অন্যহাতে থলে। বললেন কী নাম?
থতমত খেয়ে পুরঞ্জয় বলল— আজ্ঞে, পুরঞ্জয় সরকার।
—পুরঞ্জয়? অদ্ভুত নাম!
—আজ্ঞে, পুরঞ্জয় মানে…
—আমাকে মানে বোঝানোর কোনো দরকার নেই। আমার নাম নগেন্দ্রনাথ মিত্র। তা, আপনিই তো ওই বাড়িটা কিনেছেন? আর, আপনার স্ত্রীকেও সঙ্গে করে এনেছেন?
ওপরে-নীচে ঘাড় নাড়ল পুরঞ্জয়।
নগেনবাবুর পরবর্তী প্রশ্নবাণ হল— কেন?
—এখানে থাকব বলে, অবশ্যই।
—থাকবেন বলে, না কি এইখান থেকে ধরাধাম থেকে ঝটপট দু-জনে চিরবিদায় নিতে চান বলে?
—এই বাড়িতে যাঁরা থেকেছেন তাঁরা সকলেই কি ঝটপট ধরাধাম থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন?
—সেটা তো আমি বলতে পারব না। তবে, তাঁরা যে ঝটপট এই বাড়ি থেকে, শুধু বাড়ি কেন, একেবারে এই গ্রাম থেকে বিদায় নিয়েছেন সেটা জানি। আপনারাও যে নেবেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মনে করবেন না যেন যে আমি আপনাকে ভয় দেখাচ্ছি। আমি কেবল আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি।
নগেনবাবুর শেষ কথাগুলো গায়ে মাখল না পুরঞ্জয়। বলল- যাঁরা চলে গেছেন তাঁরা কেন গেছেন বা কি তাঁদের অভিজ্ঞতা হয়েছিল সে সব কথা কি কাউকে বলে গেছেন?
নগেনবাবু মাথা নেড়ে বললেন— না। তাঁদের চলে যাওয়ার তাড়া এতই বেশি ছিল যে সে সময়টা আর নষ্ট করেননি তাঁরা। তবে হ্যাঁ, এখানে একজন আছেন যিনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও, এই গ্রামেই রয়ে গেছেন। তাঁর কাছে গেলে একেবারে ঘোড়ার মুখের খবর পাবেন –কে তিনি? কী নাম?
—তাঁর নাম বোধ হয় শিবপদ সান্যাল। থাকেন তাঁতিপাড়ায় একটা বাড়িতে। তিনি একসময়ে বর্ধমানে একটি বেসরকারি কলেজে অধ্যাপনা করতেন বলে শুনেছি। তাঁর কাছেই এ বাড়ির কিছু খবরাখবর পেলেও পেতে পারেন। অত্যন্ত মিতভাষী লোক। কখনোই ঝেড়ে কাশেন না। সবসময় বিরক্ত হয়েই আছেন। কাজেই, কতটা খবর তাঁর পেটের থেকে বের করতে পারবেন, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
—কিছু খবর আমাদের কাজের মেয়ে কাজলের কাছে পেয়েছি। তবে সেসবের কোনোটাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। অপরিণত মস্তিষ্কের অবাস্তব কল্পনা। ভয় পেতে মানুষ ভালোবাসে। তার থেকেই এইসব ভয়ংকর কল্পনার সৃষ্টি। সে যাই হোক, আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল। আপনি যে নিঃস্বার্থভাবে পরের উপকার করে থাকেন সেটা জানা রইল।
বলে পুরঞ্জয় মৃদু হেসে বাজারের দিকে রওনা হল। আর নগেনবাবু ভুরু কুঁচকে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে এই লোকটার কথায় রেগে যাবেন না খুশি হবেন সেই সমস্যার সমাধান করতে লাগলেন। রামানাম নেবার কথাটা আর মনেই এল না। শেষ পর্যন্ত এই ভেবে নিজেকে শান্ত করলেন যে, এই অপরিণত মস্তিষ্কের অবাস্তব কল্পনা যে কি বস্তু তা বাবাজি শিগগির টের পাবেন আর তখন কেঁদে কোনো কুল পাবেন না।
সেইদিনই বিকেলবেলা পুরঞ্জয় আর পারমিতা সাইকেলরিকশা করে অধ্যাপক শিবপদ সান্যালের বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হল। একতলা ছোটো বাড়ি, সামনে এক ফালি খালি জমি। সেখানে একটা বাগান করবার প্রচেষ্টা চলছে, দেখা গেল। একজন খাকি হাফপ্যান্ট পরিহিত মালী আর একজন পাজামা আর হাতকাটা গেঞ্জি পরা প্রৌঢ় ভদ্রলোক সেখানে সেই কাজে ব্যস্ত রয়েছেন।
জানা গেল, সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোকই গৃহকর্তা অধ্যাপক শিবপদ সান্যাল। অত্যন্ত অমায়িক মানুষ। পরিচয় পর্ব শেষ হলে সাদরে অতিথিদের ভেতরে নিয়ে গেলেন।
বসবার ঘরটি নিতান্তই সাদামাটা। আসবাব বলতে একটি রঙিন চাদরে ঢাকা তক্তপোশ, একটি নীচু টেবিল আর তার চারদিকে চারটে হাতলওলা কাঠের চেয়ার। আরও আছে চারটে বইয়ে ঠাসা আলমারি।
শিবপদবাবু অতিথিদের বসতে বলে একটা পাঞ্জাবি পরে আসতে ভেতরে চলে গেলেন। পুরঞ্জয় বসল না। ঘুরে ঘুরে বইয়ের আলমারিগুলো দেখতে দেখতে স্বগতোক্তি করল— যাক, ভদ্রলোক বই-কুণ্ঠ নন। কথা বলা যাবে। সজ্জন ব্যক্তি। ইতিহাসের অধ্যাপক।
শিবপদবাবু ঘরে ঢুকে সহাস্যে বললেন— ঠিক ধরেছেন। বহু বছর বর্ধমানের কারমাইকেল কলেজে ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস পড়িয়েছি বটে। এখন অবশ্য পড়াচ্ছি না পড়ছি। বসুন, চা আসছে।
শিবপদবাবু হাসতে হাসতে বললেন— এখানে আসতে না আসতেই একেবারে মিত্রমহাশয়ের খপ্পরে পড়ে গেলেন? উনি কিন্তু আমাকে একেবারেই পছন্দ করেন না। সে যাই হোক, কথাবার্তা শুরু করবার আগে আপনার বিষয়ে কিছু বলুন।
পুরঞ্জয় বলল— আমার নাম পুরঞ্জয় সরকার আর ইনি আমার স্ত্রী পারমিতা। আমার বাবা ডাক্তার, আমাদের আদি বাড়ি পূর্ব বাংলায়। ১৯৪৭ সালে আমার বাবা গুসকরায় এসে ডাক্তারি শুরু করেন আর কিছুদিনের মধ্যেই বেশ ভালো পশার করে ফেলেন। পারমিতা ছিল আমাদের প্রতিবেশী। ওর বাবার ওখানে বেশ বড়ো ধান-চালের ব্যাবসা। পাশাপাশি বাড়ি। ছোটোবেলা থেকে একসঙ্গে। যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কলকাতায় গেলুম, তখনও যোগাযোগ ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং যখন পাশ করলুম তখন পারমিতা কেমিস্ট্রি নিয়ে বি এস সি পড়ছে বর্ধমানে। আমি কোনোদিন চাকরি করিনি। শক্তিগড়ের কাছে রহিমগঞ্জে একটা পরিত্যক্ত ছোটো কারখানা ছিল, মেশিন শপ । খুব সস্তায় সেটা কিনে ফেললুম। বাবা টাকা দিল। সেখানে কাজ শুরু করলুম । বছর দুয়েকের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল। তখন পারমিতা এম এস সি পাশ করে গেছে। সে এসে আমার সঙ্গে যোগ দিল। এই সময়ে খুব খেটেছি, জানেন।
পারমিতা বলল— আজও খাটে। সবসময় কারখানার ভেতরে চরকির মতো ঘুরছে। কোথাও কোনো সমস্যা হলেই নিজেই জামার হাত গুটিয়ে মিস্ত্রিদের সঙ্গে কাজে লেগে যায়।
শিবপদবাবু জিজ্ঞাসা করলেন— তুমি কী করো?
—আমি কোয়ালিটি কন্ট্রোল, লার আর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দেখি।
—কী তৈরি হয় তোমার কারখানায়?
পুরঞ্জয় বলল— টেক্সটাইল বা জুট মিলের স্পেয়ার পার্টস। আজকাল তো আমার ক্লায়েন্টরা তাদের নিজেদের ডিজাইনে স্পেশাল পারপাস মেশিনও তৈরি করাচ্ছে।
—কোথাকার ক্লায়েন্ট এরা?
—পশ্চিমবাংলার কিছু আছে। তবে বেশিরভাগই বম্বে, নাগপুর বা মাদ্রাজের।
—বাঃ, খুব ভালো। কিন্তু তোমরা নিজেদের বাড়িতে না থেকে এই অজপাড়াগাঁয়ে বাড়ি কিনতে গেলে কেন?
—নিজেদের বাড়িতে থাকা অত্যন্ত অস্বস্তিকর হয়ে পড়ল। নীচু জাতের বাঙাল ছেলে বিয়ে করবার জন্যে পারমিতার বাবা প্রচণ্ড রেগে যান এবং মেয়ের আর কোনোদিন মুখ দর্শন করবেন না বলে ঘোষণা করেন। এই অবস্থায় একেবারে পাশের বাড়িতে থাকাটা সুখকর হচ্ছিল না, তাই—
—ঠিক আছে। বুঝেছি। কিন্তু তাই বলে এই মান্ধাতার আমলের ভূতুড়ে বাড়ি?
—মান্ধাতার আমলের ভূতুড়ে বাড়ি বলেই তো কিনলুম। এত কমদামে গুসকরার কাছে এত বড়ো বাড়ি আর কোথাও পাওয়া যেত? এখান থেকে বাসে গুসকরা মাত্র পাঁচটা স্টপ। এখান থেকে আমাদের ফ্যাক্টরিতে যেতে লাগে মাত্র মিনিট কুড়ি। তা ছাড়া আমি দেখেছি, এ বাড়ির মালমশলায় কোনো ভেজাল নেই। এর জান এখনও আরও একশো বছর। আর ভূত? তার সঙ্গে আমরা দু-জনেই মোকাবিলা করতে তৈরি আছি। আমরা দু-জনেই বিজ্ঞানের ছাত্র। ভূত যদি থাকেও, সেই বায়বীয় অপদার্থ আমাদের কোনো শারীরিক ক্ষতি করতে পারবে— সেই ভয় আমাদের নেই। আমাদের ভয় দেখিয়ে বাড়ি ছাড়া করবে, ভূতের সেই আশার গুড়ে বালি!
—ভূতের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করেও থাকবে? তোমাদের spirit আছে। তার মানে, ও বাড়ির spirit-দের কপালে দুঃখ আছে।
পুরঞ্জয় হাসতে হাসতে বলল। এবার আপনার কথা বলুন।
শিবপদবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন— আমার কথা তেমন কিছু গেয়ে বেড়াবার মতো নয়। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সেই সূত্রে সারা অবিভক্ত বাংলা ঘুরেছেন। অবসর নিয়ে বর্ধমানে বাড়ি কিনে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। সেইজন্যে আমি বাংলার প্রায় সমস্ত জেলা স্কুলে পড়েছি। আমার কর্মজীবন সেই বর্ধমানের কারমাইকেল কলেজে। অবসর নেবার একবছর আগে আমার স্ত্রীবিয়োগ হয়। আমার দুই ছেলে। দু-জনেই বিদেশে থাকে। কাজেই আমাকে একাই থাকতে হয়। মন লাগল না বলে বর্ধমানের বাড়িটা আমার বোন আর ভগ্নীপতিকে দান করে দিয়েছি। সেটা ঠিক কাজ হয়নি। তীর্থে তীর্থে অনেক ঘুরেছি। তাতে শুধু টাকাই খরচ হয়েছে, লাভ কিছুই হয়নি। শেষপর্যন্ত আবার বর্ধমান। বোন আর ভগ্নীপতি আমাকে চিনতেই পারল না। তখন থাকবার জন্যে সস্তায় আপনাদের বাড়িটা কিনেছিলুম।
—ছাড়লেন কেন? ভূতের উৎপাতে?
—না, মানুষের উৎপাতে। রাস্তায় ঘাটে, বাজারে, বাসস্টপে যার সঙ্গেই দেখা হয়, সেই বলে ‘বাড়ি ছাড়ুন’। নগেন মিত্তির তো বাড়ি ছাড়ছি না বলে রীতিমতো রেগেই গেলেন। শেষমেষ আমার ছাত্র সুবল দে আমাকে জোর করে প্রায় টানতে টানতে ওর এই বাড়িটাতে এনে ফেলল। দাম যা নিল তা প্রায় কিছুই নয়। আমি আপত্তি করাতে বলল—ধরে নিন এটা আমার গুরুদক্ষিণা।
—আপনি তো কিষনলাল জয়সওয়ালের কাছ থেকে কিনেছিলেন?
—হ্যাঁ। সে ওখানে একটা গেঞ্জির কল খুলবে বলেছিল। কিন্তু খুলতে পারল না। ওয়াকাররা সবাই পালিয়ে গেল। তখন কিষনলাল যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে বাড়ি বেচে চলে গেল।
—কিষনলাল আপনাকে বলেছিল যে বাড়িটা হানাবাড়ি?
—বলেছিল। তবু কিনলুম কারণ ওই টাকায় বর্ধমানে একটা দোচালা শেডও পাওয়া যাবে না। আরও একজন কিনতে চেয়েছিল। তাই, আমাকে একটু দামটা বাড়াতে হয়েছিল। তবে সেটা তেমন কিছু নয়। আমার পরে আসেন অ্যাডভোকেট রমেন ঘোষ। রমেনবাবু বোধ হয় সপ্তাহ দুয়েক ছিলেন। তার পরে আপনারা। বুঝতেই পারছেন, শুধু যাওয়া, শুধু আসা।
—হ্যাঁ, দিব্যি বুঝতে পারছি। এবারে বলুন, ওখানে আপনার অভিজ্ঞতা কী?
—অভিজ্ঞতা বলতে অতিপ্রাকৃত কিছু যদি বলেন, তবে বলব তেমন কিছু নয়। একমাত্র মাঝে মাঝে, না, মাঝে মাঝে নয়, প্রায়ই মাঝরাতের দিকে ঘুম ভেঙে যেত আর তখন খুব নিশ্বাসের কষ্ট হত। আমার ধারণা তার কারণ, ভূতের উপস্থিতি নয়, অ্যালার্জি। পোলেন অ্যালার্জি। আশেপাশে যে জঙ্গল আছে, সেখানে রাত্রিবেলা কোনো একটা বুনো ফুল ফোটে যার পোলেন বাতাসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আর সেই পোলেনে আমার অ্যালার্জি আছে।
—আর কিছু?
—হ্যাঁ, আর একটা আছে। রাত্রি হলে একটা কুকুর প্রায়ই বাড়ির সামনে এসে তারস্বরে চেঁচায়। ভোরের আলো ফোটার একটু আগে সেটা বন্ধ হয়, অথচ সারাদিনে একটাও কুকুরের ডাক শুনিনি। কেন কুকুরটা চেঁচায় আমি জানি না। ও ছাড়া আর কেউ জানে বলেও মনে হয় না।
পুরঞ্জয় মাথা নেড়ে বলল— হ্যাঁ, এই দুটো অভিজ্ঞতাই আমাদেরও হয়েছে। আর কিছু।
—তেমন কিছু নয়। মাঝে মাঝে ঘরের মধ্যে ঘস ঘস বা অন্য রকম শব্দ। নির্জন বাড়িতে ওসব হয়েই থাকে। আমার সকল কাজের কাজি, জগন্নাথ ভয় পেত। আমি কোনোদিন পাইনি।
—তার মানে মানুষই হোক বা ভূতই হোক, কেউ আপনার ক্ষতি করবার চেষ্টা করেনি।
শিবপদবাবু একটু ভেবে বললেন— তা আমি বলতে পারব না। আমি যদি ভয় পেতুম, তা হলে কি হত তা বলা যায় না। যেমন ধরুন, একদিন রাত্রে জগন্নাথ হঠাৎ ভয় পেয়ে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বেরোতে গিয়ে বঁটিতে পা কেটে রক্তারক্তি ব্যাপার করেছিল। ওর নাকি মনে হয়েছিল কেউ ওর পাশে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইছে। ও জানত না যে গ্রামাঞ্চলে রাত্রিবেলা শব্দ। সে কোথা থেকে কোথায় যায়, তা কেউ বলতে পারে না। বিশেষত, জায়গাটা যদি গাছপালায় ঢাকা থাকে।
একটু থেমে বললেন— আপনারা কি শুধু দু-জনেই থাকছেন, না সঙ্গে আর কেউ আছে!
পুরঞ্জয় বলল— আমাদের সঙ্গে কারখানার চারজন ডাকাবুকো ছেলে থাকে। আমরা থাকি দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিমের ঘরটায় আর ওরা থাকে রান্নাঘরের পাশের বড়ো ঘরটাতে। ওদের মধ্যে একজন রান্না করে। সে আমাদের সকালের খাবারটা করে দেয়। রাত্রের রান্নাটা পারমিতাই করে। বড্ডো ভালো রাঁধে। একদিন খাওয়াব আপনাকে।
শিবপদবাবু হেসে বললেন— তা বেশ তো।
বলে হঠাৎ নীচুগলায় বললেন— পারবে, তোমরা পারবে।
পুরঞ্জয় অবাক হয়ে বলল— কী পারব?
—না, মানে ওই বাড়িটাতে টিকে যেতে পারবে।
সাইকেলরিকশাওলা বলল— মজুমদারবাড়ি পর্যন্ত যেতে পারব না বাবু। ডাকঘরের সামনে নামিয়ে দেব।
তাই সই। দ্বাদশীর ম্লান চাঁদের আলোয় আলোকিত নির্জন প্রায়ান্ধকার রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে পুরঞ্জয় বলল— মনে হচ্ছে শিবপদবাবু কিছু একটা চেপে গেলেন। তাঁর অভিজ্ঞতাটা একেবারে নির্ভেজাল সহজ সরল স্বাভাবিক তা ঠিক মনে হল না।
পুরঞ্জয়ের কথাটা আর এগোতে পারল না। তার আগেই উলটোদিক থেকে চারজন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন লোককে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। কাছাকাছি আসতেই চারজনে প্রায় সমস্বরে বলে উঠল— কোথায় গিয়েছিলেন আপনারা? আমাদের বলে যেতে পারেননি? আমাদের একজন আপনাদের সঙ্গে যেত।
পুরঞ্জয় হাত নেড়ে বলল— আহা, আমরা কি শিশু নাকি? ভেবেছিলে ভূতের ভয় পাব?
—চারজনের একজন বলল— ভূতের কথা কে বলছে? আমরা আপনাদের জানি। ব্যাপারটা তা নয়। বাসে আসবার সময় শুনলুম আজ ঘণ্টা তিনেক আগে জি. টি. রোডে একটা ভয়ানক ডাকাতি হয়ে গেছে। এক ভদ্রলোক ট্যাক্সি করে বিয়েবাড়ি যাচ্ছিলেন স্ত্রীকে নিয়ে। একদল ডাকাত তাঁদের, মায় ট্যাক্সিওলাকে গুলি করে মেরে তাঁদের সর্বস্ব লুট করে পালিয়েছে।
—আমাদের দেখেছ? আমার হাতে জনতা ঘড়ি, ইনি তো কোনো গয়নাই পরেন না আর দু-জনেরই পায়ে হাওয়াই চপ্পল। কী লুট করবে ডাকাতরা? উলটে আমাদের হাতে রিকশাভাড়াটাই গুঁজে দেবে হয়তো।
হাসি চেপে সকলেই বলল— যাই বলুন, এরকম একা একা রাত্রিবেলা এই বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো আপনাদের ঠিক হয়নি।
চারজনের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সি ছেলে গোবিন্দ, দন্তবিকাশ করে বলল— কিন্তু কর্তাবাবু, এ জায়গাটা যেন সত্যি কেমনধারা। সন্ধের ঝোঁকে বাইরে বেরোলে খালি মনে হয়, এই বুঝি কিছু একটা ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ল। ভূত পেতনি বেম্মদত্যি শাকচুন্নি যেন চারদিকে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে।
পুরঞ্জয় বলল— তা, তুই এদের মধ্যে কোনটা রে গবা, যে তোকে দেখলেই এনারা কিলবিল করে ওঠে।
সেই রাত্রেই গবার কথা ফলে গেল।
মাঝরাতের দিকে ঘুম ভেঙে গেল পুরঞ্জয়ের। বেশ কষ্ট হচ্ছিল নিশ্বাস নিতে। মনে হল, পাশে পারমিতাও জেগে আছে। বলল— জেগে আছ?
উত্তর এল— হ্যাঁ। নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে তো? মনে হচ্ছে, রাত্রের খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গেছে।
পুরঞ্জয় বলল— দুটো জেলুসিল নিয়ে আসি।
বলে খাট থেকে নামতে গিয়ে থেমে গেল। মশারির বাইরে অন্ধকারটা যেন কেমন। মনে হচ্ছে যেন সারা ঘর জুড়ে ঘন কলো অন্ধকারটা তালগোল পাকাচ্ছে, একটা কোনোরকম অবয়ব নেবার চেষ্টা করছে। অথচ তার ভেতর দিয়ে জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলো ভালোই দেখা যাচ্ছে।
এরমধ্যে পারমিতাও উঠে বসেছে। বলল— কী হচ্ছে ওটা?
পুরঞ্জয় বলল— মনে হচ্ছে যেন তোমার কেমিস্ট্রি ল্যাবে বিকারের ভেতরে কোনো কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন চলেছে। দাও তো তোমার টর্চটা। আলো জ্বেলে দেখি।
হঠাৎ কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের ভেতর থেকে একটা ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল। যেন অনেক দুর থেকে কেউ বলছে— খবরদার! আলো জ্বালাবে না বলছি।
পুরঞ্জয় বলল— কেন? জ্বালব না কেন? আপনি কে মশায় আমাকে অর্ডার করছেন? আপনি কি প্রেতাত্মা, যাকে বলে ভূত?
কণ্ঠস্বর বলল— হ্যাঁ, তা বলতে পারো। তবে, আমি এবাড়ির মালিক, ঈশ্বর পুরুষোত্তম মজুমদার।
—আজ্ঞে না। আপনি কোন মান্ধাতার আমলে হয়তো ছিলেন, কিন্তু এখন এবাড়ির মালিক আমি, শ্রী পুরঞ্জয় সরকার। একগাদা কড়কড়ে টাকা দিয়ে রমেনবাবুর কাছ থেকে কিনেছি মশায়। এখন এই বাড়ি আমার, এই ঘর আমার, দরজা জানলা মেঝের টালি মায় দেওয়ালের টিকটিকি বা খাটের নীচে আরশোলা— সব আমার।
কণ্ঠস্বর এবার বেশ একটু উচ্চতর গ্রামে উঠল। বলল— চোপ! বেশি কথা বললে তোর ঘাড় মটকে রক্ত খাব, বলে দিলুম।
—বাজে বকবেন না তো। ঘাড় মটকালেই হল? ওই তো কুচকুচে কালো ধোঁয়ার মতো শরীর, ওই দিয়ে একজন অনিচ্ছুক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের ঘাড় মটকাবেন? পাগল না কি? ঘাড় মটকাতে গেলে কত পি. এস. আই. প্রেসার জেনারেট করতে হয়, তা জানেন? আপনার ধোঁয়াটে শরীরে তার সিকির সিকিও আসবে না। আগে গায়ে গত্তি লাগাতে হবে তারপড়ে ঘাড়-টাড় মটকাবার কথা ভাববেন। রক্ত খেলে তো ডিসপেপসিয়ায় দ্বিতীয়বার মরবেন। তার চেয়ে একটু শক্ত কিছু খান, তাহলে গত্তি লাগবে, অমন তালগোল পাকাতে হবে না। এই যেমন ধরুন। খিচুড়ি। ভুনি খিচুড়ি নয়, সেটা সইতে পারবেন না। ধরুন, শঙ্কটার খিচুড়ি। খেয়েছেন কোনোদিন?
—জানি, জানি। তোমার গিন্নি পরশু রাত্রে রেঁধেছিলেন। গন্ধটা বেশ ভালোই বেরিয়েছিল।
—আর সেইসঙ্গে ভেটকি মাছের পাতুড়িটা? সেটার কথাও বলুন।
—হ্যাঁ, সেটাও বেশ ভালোই।
—সত্যিই বড়ো ভালো রাঁধে আমার গিন্নি। কিন্তু দুঃখের কথা কি জানেন? রাঁধবে, কিন্তু আমাকে খেতে দেবে না।
—তা সে কোনো গিন্নিই তার কত্তাকে খেতে দেয় না। আমার গিন্নি ও দিত না। তবে, কাল রাতে তো দেখলুম, তুমি দিব্যি গপগপ আলুর দম আর মৌরলা মাছের ঝাল দিয়ে গুচ্ছের লুচি সাঁটালে।
পুরুঞ্জয় করুণ মুখে বলল— কোথায় আপনি গুচ্ছের লুচি দেখলেন? মাত্র ষোলোটা। তার বেশি কিছুতেই দিল না। আপনিই বলুন, ষোলোটা লুচিতে হয় কখনো?
পুরুষোত্তমকে বলতে শোনা গেল— বলো কি? মোটে ষোলোটা? আমার তো চাখতেই গোটা কুড়ি লাগত। সত্যি বউমা, ছেলেটাকে একটু ভালো করে খেতে-টেতে দিও। সারাদিন পরিশ্রম করে। দুটো না খেলে শরীর টিকবে কেন?
পারমিতা কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই হঠাৎ রেগে গেলেন পুরুষোত্তম। গলা চড়িয়ে বললেন— আরে মেলো যা! তখন থেকে বাজে বকবক করে ছেলেটা আমাকে আসল কথাটাই বলতে দিচ্ছে না।
পুরঞ্জয় বলল— কী আপনার আসল কথা?
পুরুষোত্তম বললেন— আসল কথা হল, তোমরা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। এখানে তোমাদের থাকা হবে না।
—কেন হবে না?
—কারণ, আমরা তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারি না। অশরীরী আর শরীরী কখনো একসঙ্গে থাকতে পারে না।
—কেন পারবে না? ওসব। মান্ধাতার আমলের ধারণা। এইতো ধরুন না, কিছুদিন আগেও আপনি আমাদের মতোই ছিলেন। আবার, কিছুদিন পরে আমরা আপনাদের মতো হয়ে যাব। তাহলে অসুবিধেটা কোথায়? সামান্য তফাত। তার চেয়ে চলুন আমরা রোজ সন্ধেবেলা জমিয়ে আড্ডা মারি। আপনাকে বা আমাদের আর একা একা থাকতে হবে না। রোজ রাত্রে একসঙ্গে খেতে বসব। আমরা খাব, আপনারও ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজন হয়ে যাবে।
বেশ কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারপর শোনা গেল— ঠিক বলছ? তোমার গিন্নি আবার ভয় পাবে না তো?
—উচ্চকিত হাসি হেসে উঠল পারমিতা। পুরঞ্জয় বলল – ওই শুনুন। আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন।
পানবাজার গ্রামের জনতার চিত্তে আর শান্তি নেই। কেউ স্তম্ভিত, কেউ চিন্তিত, কেউ বিমর্ষ, কেউ উদ্বিগ্ন আবার কেউ অসন্তুষ্ট। ব্যাপারটা কী হচ্ছে? সরকার পরিবার দিব্যি বহাল তবিয়্যাত মজুমদারবাড়িতে টিকে আছে। কোনো হেলদেল নেই। বাড়ি সারানো হচ্ছে, কলি ফেরানো হচ্ছে, পুরঞ্জয় ছোঁড়া বউকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে রোজ রহিমগঞ্জে নয়তো গুসকরায় যাচ্ছে-আসছে। বাজারে দেখা হলে হেসে কথা বলছে। এরকম তো হবার কথা ছিল না।
ভূত বলে নাকি কিছু নেই। সব কুসংস্কার। তবে কি এতগুলো লোক যারা এই ছোকরার আগে এল-গেল, তারা সব গাধা? রমেন উকিলের মতো ঘোড়েল লোকও অশিক্ষিত লোকেদের মতো কুসংস্কারে আচ্ছন্ন?
আসলে, মজুমদারবাড়ি পানবাজারের একটা গর্ব আর অহংকারের বস্তু। একশো বছর ধরে দেশ-বিদেশের লোক মজুমদারবাড়ির নাম একডাকে চেনে। হানাবাড়ি তো পানবাজারের মজুমদারবাড়ি। এই বাড়িতে কেউ টিকতে পারে না। কত দুঃসাহসী লোক রাত কাটাতে থেকেছে এখানে। কেউ সাহস দেখাতে, কেউ ও বাড়িতে লুকোনো বিশাল গুপ্তধন খুঁজতে তারা সক্কলে ভোরের আলো ফোটবার আগেই বাপরে মারে বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়েছে। আজ যদি সেই বাড়িতে কেউ দিনের পর দিন মহানন্দে বাস করে, তাহলে সেটা পানবাজারের লোকেদের অপমান নয়? তাদের এত বছরের গড়ে ওঠা মানসম্ভ্রম ধুলোয় গড়াগড়ি গেল না?
কেউ বলল— আসলে পুরঞ্জয় আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা ভয়ংকর ক্রিমিনাল। ওরা ভূতের চেয়েও মারাত্মক; তাই ওরা ভূতের ভয় করে না। ওখানে নিশ্চয়ই কোনো অসামাজিক কাজকম্ম চলছে। আমাদের পুলিশে খবর দিতে হবে।
কিন্তু তা কী করে হবে? কত মহা মহা খুনি, ডাকাত, বিপ্লবী জেলের পাঁচিল টপকে পালিয়ে এসে এ বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে গেছে। তাদের প্রত্যেকেই সেই রাতেই ছুটতে ছুটতে গিয়ে সেই জেলের পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকে গেছে। কেউ কেউ তো হার্টফেল করে ওখানেই ফিনিস।
কিচ্ছু করবার নেই। কাজেই, পানবাজারসুদ্ধু লোক বিষণ্ণ বিমর্ষ হয়ে দিন কাটাচ্ছে।
একদিন পুরঞ্জয় বলল— আচ্ছা, মজুমদারমশাই, যাঁরা মারা গেছেন, তারা সকলেই ভূত নয়, কেউ কেউ ভূত। কেন?
পুরুষোত্তম বললেন— সকলের কথা তো বলতে পারব না, বাবা। আমার নিজের কথাটা বলতে পারি। আমার ভেতরে একটা প্রবল অপরাধবোধ আছে। যতদিন পর্যন্ত না তার থেকে মুক্তি পাব, ততদিন আমাকে বোধ হয় এই ভাবেই থাকতে হবে।
—প্রবল অপরাধবোধ? কেন? কী করেছিলেন আপনি? মানে, আপনার যদি কোনো অসুবিধে থাকে তাহলে বলবার কোনো দরকার নেই।
—না, আমার আবার অসুবিধে কি? আমি এখন সব সুবিধে অসুবিধের বাইরে। আমি যা করেছিলুম তা হল দু-জন নিতান্ত নিরপরাধ স্ত্রীলোকের ভয়ংকর অকালমৃত্যু ঘটিয়েছিলুম।
পারমিতা বলল— কী সর্বনাশ! এরকম করতে গেলেন কেন?
কী আর বলব রে, মা। সবই গেরোর ফের। আমার বাবা, ঈশ্বর হরিশঙ্কর রায় সিপাহিবিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর কমিসারিয়েটে কাজ করতেন। সৈন্যবাহিনীর খাবারদাবার, জামাকাপড়, কাগজপত্র ইত্যাদি জোগাড় করে স্টোরে ঢোকানো তাঁর কাজ ছিল। তোমরা তো জানো নিশ্চয় যে বাংলা সিপাহিবিদ্রোহকে একেবারেই ভালো চোখে দেখেনি। হরিশ মুখার্জী তো তাঁর কাগজে বেশ কড়া ভাষায় তার বিরোধিতা করেছিলেন। হরিশঙ্কর ব্রিটিশদের কিন্তু আপ্রাণ সেবা করতেন আর তারাও তাদের হ্যারিকে খুব বিশ্বাস করত আর ভালোবাসত। এই সুযোগে তিনি তলায় তলায় প্রচুর টাকা করেছিলেন।
পুরঞ্জয় মন দিয়ে শুনছিল। চমকে উঠে বলল— অ্যাঁ, বলেন কি?
—হ্যাঁ, তাই। অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক ছিলেন। নব্বই বছর বয়েসে উনিশশো সাত সালে মারা যান। তাঁর কীর্তিকলাপ কেউ ধরতে পারেনি বরং রায়সাহেব খেতাব পেয়েছিলেন ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে। সমস্ত টাকা দিয়ে গয়না আর গিনি কিনেছিলে। তবে, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন, অসামাজিক কাজ কিছু করেননি। পাপস্থাপনের জন্যেই হয়তো, অনেক দানধ্যানও করেছেন। আঠেরোশো পঁয়ষট্টি কি ছেষট্টিতে পানবাজারে এই বাড়ি বানিয়ে সেখানে ধনরত্ন লুকিয়ে ফেলেন। পানবাজার তখন গভীর জঙ্গলে ঘেরা নিতান্তই ছোটো একটা দরিদ্র গ্রাম। কাজেই, কেউ কোনো সন্দেহই করেনি।
পুরঞ্জয় বিড়বিড় করে বলল— অর্থমনর্থম…
—ঠিক বলেছ। সেই অনর্থ নিয়ে এলুম আমি। ভাবো, বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়েস প্রায় পঁয়ষট্টি। আমার ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের সকলেই কৃতি, কলকাতায় থাকে। এক ছেলে নামকরা হোমিওপ্যাথ ডাক্তার আর অন্যজন সংস্কৃত কলেজের দর্শনের অধ্যাপক। তিন জামাইও প্রতিষ্ঠিত। তাদের ঘরে ছেলেপুলেও এসে গেছে। এই সময়, ঠিক এই সময়, আমার মতিভ্রম ঘটল।
—আশ্চর্য!
—তাই বটে। কলকাতায় গিয়েছিলুম এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে। সে তখন যাচ্ছিল গঙ্গার ধারে, পেনেটিতে এক বাগানবাড়িতে। সেখানে লখনউয়ের বিখ্যাত বাঈজী তানভি জানের গান হবে। আমাকেও নিয়ে গেল। আমি গান-টান তেমন বুঝি না। কিন্তু তানভিকে দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমি তার সঙ্গে দেখা করলুম। তার পেছনে পেছনে লখনউ পর্যন্ত চলে গেলুম। সেও আমাকে খেলাতে লাগল। জলের মতো টাকা খরচ হয়ে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলুম কারণ মনে হচ্ছিল তানভিকে ছাড়া আমি বাঁচব না। সে হেসে উড়িয়ে দিল। বলল, সেটা হতেই পারে না কারণ আমার বাড়িতে বউ-বাচ্চা আছে।
পুরঞ্জয় খাবি খেতে খেতে বলল— ও বাবা, এ যে একেবারে অন্ধরাহুর মতো প্রেম। বিশ্বচরাচর জীবন যৌবন সব হাপিস?
—আহা, বুঝছ না, আমার তখন পাগলের মতো অবস্থা। তানভিকে বললুম, আমি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করব, বউকে পানবাজারে রেখে দেব আর চৌরঙ্গীতে একটা বাড়ি কিনে সেখানে দু-জনে থাকব। আমার কথা শুনে তানভি যা বলল, তাতে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল আর আমি যে কোথায় নেমে যাচ্ছি সেই সত্যটা বিদ্যুতের চোখ ঝলসানো আলোর মতো আমার সামনে প্রকাশিত হল।
পুরঞ্জয় আর পারমিতা সমস্বরে প্রশ্ন করল— কী বলল তানভি?
—তানভি বলল, তুমি কি একটা পুরুষমানুষ? আমি তোমার ওপর নির্ভর করব কী করে? আজ আমার রূপ দেখে তুমি তোমার স্ত্রী ছেলেমেয়েকে ত্যাগ করছ, তোমার পিতৃপিতামহের ধর্ম ত্যাগ করছ। কাল যদি আমার রূপ কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায়, তখন আর একজন সুন্দরী মেয়েকে দেখে আমাকে যে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেবে না তার কী স্থিরতা আছে? তুমি চলে যাও, আর কোনোদিন এসো না।
পারমিতা হাততালি দিয়ে উঠল— শাবাশ, তানভি বাঈ, না তানভি ভাই।
পুরঞ্জয় চোখ পাকিয়ে বলল— চুপ করো। বাকিটা শুনতে দাও।
পুরুষোত্তম বললেন— এদিকে, আমার সেই বন্ধু যখন দেখল যে ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন সে পানবাজারে গিয়ে সরস্বতীকে, মানে আমার স্ত্রীকে, সব কথা জানাল। এটা অবশ্য আমি পরে জানতে পেরেছি। আমি যখন লখনউ থেকে টলতে টলতে বাড়ি ফিরলুম, দেখি এই উঠোনে আমার ছেলেমেয়েরা সপরিবারে বসে রয়েছে। আমি ঢুকতেই তারা আমাকে যে ভয়ংকর দুঃসংবাদ শোনাল তাতে আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলুম। সংবাদটি হল, কিছুদিন আগে সরস্বতী আমাদের বড়ো ছেলেকে একটা চিঠি লিখে বাড়ির একজন কাজের লোককে সেটা ডাকে দিতে বলে সন্ধে নাগাদ বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আর ফিরে আসেনি। সেই চিঠিতে লেখা ছিল, ‘অমি মৃত্যুবরণ করিতে চলিলাম। আমার মৃত্যুর জন্য কেহ দায়ী নহে।’
পুরঞ্জয় বলল— কী সর্বনাশ!
—চিঠি পেয়েই আমার ছেলেমেয়েরা পানবাজারে চলে আসে। আর, এসেই মাকে খুঁজতে বেরিয়ে খবর পায় যে একটি রাখাল ছেলে আগের দিন খুব ভোরে পশ্চিমপাড়ার জঙ্গলে একটা বটগাছের ডাল থেকে গলায় দড়ি দেওয়া একজন পাকাচুল বুড়িকে ঝুলতে দেখে। তার গায়ের রং খুব ফর্সা আর গায়ে অনেক গয়না। সে দৌড়ে পানবাজারে ফিরে এসে সকলকে খবর দেয়। পুলিশেও খবর দেওয়া হয়। কিন্তু, সবাই যখন পশ্চিমপাড়ার জঙ্গলে পৌঁছায়, তখন দেখা যায় সেই বটগাছের ডাল থেকে দড়িটা ঝুলছে ঠিকই, তবে তার তলাটা কাটা। তার মানে, গ্রামের লোকজন আসবার আগে অন্য একটা দল ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। তারা গয়নার লোভ সামলাতে না-পেরে দড়ি কেটে মৃতদেহ নামিয়ে নেয়। তারপর কী হয়েছিল সেটা আর বের করা যায়নি।
—কী অদ্ভুত কাহিনি! আচ্ছা, এটাতো গেল একটা অকালমৃত্যু। অন্যটা?
পুরুষোত্তম একটু চুপ করে থেকে বললেন— আমার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল তানভির ওপরে। আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের তখন বিচার করবার ক্ষমতা ছিল না যে সে এই ঘটনার জন্যে কোনোমতেই দায়ী নয়, একমাত্র দায়ী আমি। বাবার রিভলবারটা বের করে চলে গেলুম লখনউ। সেখানে তানভির বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে মারলুম। সকলের চোখ এড়িয়ে ফিরে এলুম পানবাজারে। এসেই কপালে রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি চালালুম। জানতুম, অপঘাতমৃত্যু হলে শ্রাদ্ধ হয় না। আত্মার শান্তির জন্য শান্তি স্বস্ত্যয়ন হয়। ছেলেরা করেছিল। কিন্তু আমার মুক্তি হল না। সরস্বতীর জন্যেও হয়েছিল কিন্তু তারও মুক্তি হয়নি সেটা আমি অনুভব করতে পারি। কীভাবে তা বলতে পারব না। আমি যদি তার মার্জনা পেতুম, তাহলে হয়তো আমাদের দু-জনেরই মুক্তি হত।
পুরঞ্জয় চিন্তিত হয়ে পড়ল। বলল— আপনার কেন হল না, সেটা বুঝি। আপনার স্ত্রীর হল না কেন?
পারমিতা বলল— নিশ্চয়ই তাঁরও একটা অপরাধবোধ আছে। স্বামীর বন্ধুর কাছে খবর পেয়েই ঝোঁকের মাথায় আত্মহত্যা করে বসা, এটা কোনো কাজের কথা নয়। নিদেনপক্ষে একটা মুখোমুখি আলোচনা করা দরকার ছিল।
পুরঞ্জয় বলল— হ্যাঁ, সেটা হতে পারে। আচ্ছা, আপনার স্ত্রীর যদি মুক্তি না হয়ে থাকে তবে তো তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেই হয়।
—যোগাযোগ করবার চেষ্টা করেছিলুম, পারিনি।
—বেশ। তাহলে, তিনি কোথায় আছেন সেটা বের করা দরকার। আমার মনে হয়, আপনার ছেলেরা যদি পশ্চিমপাড়ার জঙ্গলটা ভালো করে খুঁজতো তবে হয়তো তাঁর মৃতদেহটা পেয়ে যেত। তিনি তার ধারে-কাছেই কোথাও আছেন হয়তো।
পুরুষোত্তম একটু চিন্তা করে বললেন— আমার ছেলেরা শুধু নয়, গ্রামের লোকজন, পুলিশের লোকেরা সকলেই তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। কোথাও পায়নি। সরস্বতীর দেহাবশেষ আজ কোথায় আছে তা কি প্রায় ষাট বছর বাদে বের করা যেতে পারে?
পুরঞ্জয় বলল— হয়তো পারে। একটু ভেবে দেখা যাক সেইদিন খুব ভোরে পশ্চিমপাড়ার জঙ্গলে কী ঘটে থাকতে পারে। অত ভোরে কিছু লোক জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। কোথায় যাচ্ছিল?
—গদাধরের মন্দিরে হতে পারে। বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র, নাম শুনেছ অবশ্যই। ওই রাস্তাটা বর্ধমান স্টেশনের কাছ থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমপাড়ার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গিয়ে মন্দির হয়ে হবিবপুরে শেষ হয়েছে। হবিবপুর সেই সময়ে জি. টি রোডের পাশে একটা ছোটো গ্রাম ছিল। সে যুগে এই রাস্তায় বাস চলত না। লোকে হেঁটেই যাতায়াত করত।
—না। লোকগুলো গদাধরের তীর্থযাত্রী ছিল না। তারা ছিল বোধ হয় হবিবপুরের ব্যাপারি। সকালের বাজার নিয়ে বর্ধমানে যাচ্ছিল। যদি তীর্থযাত্রী হত তাহলে আশা করা যায় যে তারা শোরগোল তুলত ও মৃতের পরিচয় বের করবার চেষ্টা করত। হয়তো থানায়ও খবর দিত। কিন্তু তা তারা করেনি। অন্যদিকে, ব্যাপারিরা গয়না দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। কিন্তু তাদের হাতে সময় কম ছিল। তারা চটপট কাজ শেষ করেই হোক বা পানবাজারের লোকেদের গলার আওয়াজ পেয়েই হোক, খুব অল্প সময়ের মধ্যে ওই জায়গা থেকে চলে যায়। ওরা মৃতদেহ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেনি। কারণ, সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হত। তাহলে, সেটা গেল কোথায়? আচ্ছা রায়মশাই, ওখানে কাছাকাছি কোনো পুকুর বা ডোবা বা বাড়িঘর আছে বা ওইসময়ে ছিল?
পুরুষোত্তম বললেন— না, পুকুর বা ডোবা ছিল না। কাছে-পিঠে পানবাজার ছাড়া কোনো বসতিই ছিল না। বেশ ঘন জঙ্গল ছিল।
খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল পুরঞ্জয়। বলল— তা হলে তো অন্যভাবে চিন্তা করতে হয়।
পারমিতা বলল- আমি বলি কী, তোমার প্রশ্নের উত্তর সেই কুকুরটাকে জিজ্ঞাসা করলে হয় না; যেটা রোজ মাঝরাতে চেঁচিয়ে আমাদের ঘুম ভাঙায়? আমার তো মনে হয় উত্তরটা সে জানে আর আমাদের জানাতে চায়।
পুরঞ্জয় উত্তেজিত হয়ে লাফিয়ে উঠল। বলল— ঠিক বলেছ! একদম ঠিক। আজ রাতেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
যথারীতি মাঝরাতে কুকুরটা চিৎকার করতে শুরু করল। পুরঞ্জয় আর পারমিতা যথাসাধ্য নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে গিয়েছিল, কিন্তু ততক্ষণে একতলার লোকেদের ঘুম ভেঙে গেছে। তারা দু-জনের পায়ের শব্দ পেয়ে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পুরঞ্জয় ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে তাদের কোনো আওয়াজ করতে বারণ করে বাড়ি থেকে বেরোল। চারজন আওয়াজ করল না বটে, কিন্তু ওদের পেছনে পেছনে গেল। তারা বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা ঘটতে চলেছে। গবা তো লাফাতে লাফাতে চলল।
সামনের চত্বর পেরিয়ে সকলে লোহার গেটের কাছে এল। পুরঞ্জয় নীচু গলায় বলল— গবা, গেটটা খোলতো। আস্তে আস্তে খুলবে। দেখো যেন কুকুরটা চমকে না যায় বা ভয় না পায়।
গোবিন্দ পুলকিত কণ্ঠে বলল— ওই হতচ্ছাড়াটাকে মারবেন তো?
তাহলে আগে গোটাকয়েক লাঠি নিয়ে আসি, কর্তামশাই? এমন মার মারব যে ব্যাটার সারাজীবনের মতো ঘেউ ঘেউ করা বন্ধ হয়ে যাবে।
পেছন থেকে পারমিতা বলল— গবা, তোমাকে কেউ বুদ্ধি খাটাতে বলেছে? উনি যা বলছেন, তাই করো।
গোবিন্দ বিষণ্ন মুখে গেট খুলে দিল। সঙ্গেসঙ্গে একটা প্রকাণ্ড কালো কুকুর এক লাফে ভেতরে ঢুকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে বাড়ির পেছনে চলে গেল।
বাড়ির পেছনে একটা ঝোপঝাড় আর বুনো ঘাসে ঢাকা বেশ বড়ো পোড়ো জমি। একসময়ে বোধ হয় তরিতরকারির খেত ছিল। এখন আর সেসব কিছুই নেই।
সবাই যখন বাড়ির পেছনে গেল, দেখা গেল যে জমিটার একপাশে একফালি ঘাসজমির ওপরে এক জায়গায় কুকুরটা ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে।
পুরঞ্জয় বলল— তারক, এ বাড়িতে কোদাল, বেলচা বা শাবল জাতীয় কিছু আছে?
উত্তর দিল গোবিন্দ— আছে, কর্তামশাই। এক্ষুনি নিয়ে আসছি।
বলে একদৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। একটু বাদেই একটা কোদাল আর একটা শাবল নিয়ে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এল। বলল— কর্তামশাই, এতে হবে?
পুরঞ্জয় বলল— হবে।
বলে চারজনকে সম্বোধন করে বলল— শোনো, কুকুরটা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুরছে সেখানে মাটির নীচে বোধ হয় একটা মানুষের মৃতদেহ চাপা দেওয়া আছে। সেটা খুঁড়ে বের করা দরকার।
তারক বলল— আগে পুলিশকে খবর দিলে হত না, কর্তামশাই? তারাই সব কিছু করত।
—অবশ্যই খবর দেব। তবে আগে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে ওখানে আদৌ কিছু আছে কি না। বা, থাকলে সেটা কী। যদি মৃতদেহ হয়, তাহলে ও জায়গাটা খুঁড়তে তোমাদের আপত্তি থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে আমি নিজেই খুঁড়ব।
গবা বলল— আমি পুড়ল, কর্তামশাই।
—ঠিক আছে। তুমি পোঁড়ো, আমি কোদাল দিয়ে মাটি সরাচ্ছি।
এবার তারক আর বাকি পু-জন এগিয়ে এল। তারা বলল- আপনি সরুন, কর্তামশাই। যা করবার আমরা করছি। তবে একটা কথা, পরি কোনো মড়া বের হয়, সেটা কিন্তু আমরা ছোঁব না। বুঝতেই তো পারছেন। সেকথাটা জানাজানি হয়ে গেলে আমাদের জাত যাবে।
—বেশ, তাই হবে।
—কিন্তু, আমরা ওখানে যাব কী করে? কাছাকাছি গেলে বদি কুকুরটা তেড়ে এসে কামড়ে দেয়?
—বোধ হয় দেবে না। বিপদ বুঝলে পালিয়ে আসবে।
তাই হল। চারজনে জমির ফালিটার কাছে এগেতেই, কুকুরটা ঘোরা বন্ধ করে মাথা নীচু করে পিছু হটে পাঁচিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
বেশিক্ষণ খুঁড়তে হল না। একটু পরেই চারজনের আর্তনাদ শোনা গেল— ওরে বাবা! দেখে যান, কর্তামশাই।
পুরঞ্জয় আর পারমিতা তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। যে দৃশ্যটা দেখা গেল সেটা আনন্দজনক নয়। গর্তটার ভেতরে একটা নরকঙ্কালের হাত আড়াআড়ি পড়ে আছে।
পুরঞ্জয় বলল— তারক, গর্তটা মাটি চাপা দিয়ে দাও। কাল সকালেই আমার মোটরসাইকেলটা নিয়ে থানায় চলে যাবে। বড়োবাবু রাজেন্দ্র পালকে আমার নাম করে বলবে যে মজুমদারবাড়ির পেছনে বাগান করতে গিয়ে এইসব বেরিয়েছে। ওঁরা যেন তাড়াতাড়ি এসে পুরো কঙ্কালটা বের করে তার সৎকারের ব্যবস্থা করেন।
পুরুষোত্তম বললেন— সরস্বতীকে ওখানে মাটি চাপা দিয়েছিল কারা?
পুরঞ্জয় বলল— আপনার বাড়ির কাজের লোকেরা।
—সে আবার কী?
—হ্যাঁ। যে রাখাল ছেলেটি জঙ্গলের ভেতরে আপনার স্ত্রীর দেহ প্রথম দেখতে পেয়ে দৌড়ে পানবাজারে চলে যায় লোকজনকে খবর দেবার জন্যে, তার পেছনে পেছানেই আসে হবিবপুরের ব্যাপারিরা। তারা গয়নাগুলো খুলে নিয়ে মৃতদেহ একটা ছালায় ভরে পানবাজারে আসে। সেই সময় যদি কয়েক জন হাটুরে লোক ওই পথে থেকেও থাকে, তারা তাদের সন্দেহ করেনি কারণ ওরকম ছালাভরতি মাল নিয়ে তারা যাতায়াত করেই থাকে। এবং আমার বিশ্বাস সেই সময়ে ওই পথের সবচেয়ে কাছে ছিল মজুমদারবাড়ি। আজ হয়তো অনেক বাড়িঘর হয়ে গেছে।
—তোমার ধারণা একেবারে সঠিক।
—সেই লোকগুলো মজুমদারবাড়ির গেটের সামনে ছালাটা নামিয়ে দিয়ে অন্তর্ধান করে। একটু পরেই মজুমদারবাড়ির কাজের লোকেরা গেট খুলে ছালাটা দেখে কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সেটা ভেতরে নিয়ে আসে। কিন্তু ছালা খুলে গিন্নিমার মৃতদেহ দেখে স্বভাবতই তারা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। থানা পুলিশ হলে তাদের যে হাঁড়ির হাল হবে, সেটা বুঝতে তাদের অসুবিধে হয়নি। কাজেই, তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজের মেয়েরা ওঠার আগেই সেটা পেছনের বাগানে মাটি চাপা দিয়ে দেয়।
পুরুষোত্তম বললেন— নাঃ, তোমার বুদ্ধি আছে হে! জীবনে অনেক বড়ো হবে তুমি। আর, সেই বুদ্ধি খাটিয়ে তুমি আমাদের যে উপকার করলে, তার কোনো তুলনাই নেই। আমরা আজকেই চলে যাচ্ছি। তোমাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। তবে, বউমার রান্নার স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। আর একটা কথা, সরস্বতী বউমাকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছে যে তার ঠাকুমা বা দিদিমার নাম ক্ষণপ্রভা ছিল কি না।
পারমিতা বলল— শুনেছি, আমার মার দিদিমার নাম ছিল ক্ষণপ্রভা মজুমদার। বিয়ের পর মুখুজ্জে হয়েছিলেন। ভীষণ তেজিয়ান মহিলা। তাঁর ভয়ে সবাই কাঁপত। একবার এক পুলিশ কনস্টেবল আমার দিদিমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল। তখন তিনি ঘোড়ায় চড়ে খোলা তলোয়ার হাতে থানায় গিয়েছিলেন তাকে কাটতে। সাহেব ইনস্পেকটর থানা থেকে বেরিয়ে এসে ক্ষমা চেয়ে তাঁকে শান্ত করেন।
পুরুষোত্তম ম্লান হেসে বললেন— ক্ষণপ্রভা আমাদের মেয়ে। ছোটোবেলা থেকেই ওরকম।
—তা কী করে হবে? তাঁর মা তো শুনেছি পরিণত বয়েসে সন্ন্যাসিনী হয়ে গিয়েছিলেন। হিমালয়ে চলে যান।
—আমার ছেলেমেয়েরা বাড়ি বিক্রি করে দেবার আগে এই কথাটাই প্রচার করে গিয়েছিল। সে যাকগে, আসল কথা তুমি হচ্ছ আমার নাতনির নাতনি। আর আমাদের মুক্তিদাতা। কাজেই, আমার এই বাড়ি আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম। তোমার বরটা যদি বেশি তেরিমেরি করে, তাহলে সে যে দামে এ বাড়িটা কিনেছে, তার ডবল দাম তাকে দিয়ে দিও। এই ঘরের পাশের ঘরে একটা বেদি আছে যার ওপরে সরস্বতীর ঠাকুরের সিংহাসন থাকত। ওটা আসলে বেদি নয়— একটা সিন্দুকের পাথরের খোল। বেদির ওপরে একটা পাথরের ঢাকনা আছে। ওটা সরালে ভেতরে সিন্দুকটা পাবে। তার ভেতরে আমার বাবার সোনাদানা রয়েছে। সেসব তোমার।
পারমিতা হেসে বলল— থ্যাঙ্ক ইউ দাদু। তবে সেই সোনাদানা যেখানে আছে সেখানেই থাক। তার প্রভাবে আপনাদের কী দশা হয়েছিল তা তো দেখতেই পাচ্ছি।