মই
সাদাটে বাঁশটা এখন কালচে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাঁধুনি চমৎকার। শক্তপোক্ত। বয়স কত হবে মইটার?
পল্টন জন্ম থেকে দেখছে এটাকে। দাদু মইটা বানিয়ে দিয়েছিল বাবাকে। তাই বোধহয় এটার প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা ছিল পল্টনের বাবার। প্রতিদিন সকালে কাজে বেরোনোর আগে নিয়ম করে তেল খাওয়াত। জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘পাকা বাঁশ তেল খেতে খেতে কাঠ হয়ে যায়!’ একটু নড়বড়ে হলেই বেড় দিত লোহার তার দিয়ে। যত্নের কারণেই পাদানি বা বাঁশের সিঁড়িগুলো এখনও কংক্রিটের মতো মজবুত। বাঁশের তলায় টায়ারের কাটা টুকরো লাগানো। যাতে মার্বেল ফ্লোরে পিছলে না যায়।
উঠোনে কলতলার একধারে গত পনেরোদিন পড়ে রয়েছে মইটা। এর মধ্যে একদিন বৃষ্টিও হয়েছে। পল্টনের খেয়াল ছিল না। ঘরে ঢুকিয়ে রাখলে ভালো হত। আট ফুটের মইটার গায়ে হাত বুলিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তার বাবার ভালোবাসা জড়িয়ে রয়েছে এটায়। বাবা বলত, ‘ভালোবাসা ঢাললে জড়বস্তুও জীবন্ত হয়ে যায়। বন্ধু হয়ে ওঠে। জানবি, এটা যতদিন সঙ্গে থাকবে, আমার কিচ্ছুটি হবে না।’ মইটার গায়ে হাত বুলিয়ে বাবার ছোঁয়া পেল পল্টন!
কয়েকদিনের অবহেলায় মইটার গায়ে ধুলো জমেছে। চোখের জল মুছে গেঞ্জির ছেঁড়া টুকরো আর তারপিন তেল নিয়ে বসল পল্টন। যত্ন করে তেল খাওয়াতে লাগল বাঁশের জিনিসটায়। কয়েক দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে ধীরে ধীরে চকচকে আর সতেজ হয়ে উঠল মইটা। পল্টন ভাবল, জিনিসটাকে আর বাইরে ফেলে রাখবে না। বারান্দায় রেখে দেবে। যাতে বৃষ্টির জল না লাগে। বাবার মতো সেও প্রতিদিন যত্ন নেবে মইটার।
দিন পনেরো পর এই প্রথম নিজকে হালকা লাগছে পল্টনের। মাত্র দুটো সপ্তাহে তার জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে। সে যা ছিল, যেভাবে ছিল, যার কাছে ছিল— কিছুরই অস্তিত্ব নেই আর। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে, যে রুক্ষ দুনিয়ার ওপর এই মুহূর্তে সে দাঁড়িয়ে, সেটাই বাস্তব। এতদিন স্বপ্নই দেখছিল!
পল্টন অনেক ছেলেবেলায় হারিয়েছে মাকে। ভালো করে মনেও নেই মায়ের মুখ। বাবাই ছিল তার সব কিছু। বাবার আঙুল ধরে হাঁটতে শিখেছে। তার ছোট্ট হাতটা চক বুলিয়ে স্লেটে অক্ষর ফোটাতে শিখেছিল, বাবার বড় গরম হাতের মোলায়েম আদরে। ভাতের থালা নিয়ে লোকটা দুপুরভর ছুটে বেড়াত তার পিছন পিছন। ‘কে খায়-কে খায়’ সুর তুলে!
মানুষটা তাকে কোনওদিন বুঝতেই দেয়নি মায়ের অভাব। শৈশব, কৈশোরের পরতে পরতে মিশে রয়েছে বাবার ভালোবাসা। প্রথমবার হাফপ্যান্ট পরার পর খুব ভয় পেয়ে পল্টন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বাবা, ইয়ে করব কী করে?’ বাচ্চাদের প্যান্টে জিপার থাকে না। বোতামগুলো দেখিয়ে বাবা হেসে বলেছিল, ‘খুব সোজা। দুটো বোতামের সবচেয়ে নিচেরটা খুলবি। তারপর..’ স্বস্তি পেয়েছিল পল্টন।
বাবার সঙ্গে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া। সাইকেল চালাতে শেখা। ঘুড়ির মাঞ্জা দেওয়ার জন্য হামানদিস্তায় কাচ গুড়ো করা। ক্রিকেট ব্যাট বানিয়ে দেওয়া। পল্টনের গুরুতর, মামুলি প্রতিটা ঘটনার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে ছিল যে লোকটা, সে আর নেই! বিশ্বাস হচ্ছে না তার। পল্টনের বারবার মনে হচ্ছে, এই বুঝি সদর দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বাবা ডাক দেবে, ‘কই রে পিলু, এখনও পড়তে বসিসনি? সামনে অ্যানুয়াল পরীক্ষা যে বাবা! কিছু খেয়েছিস? আয় দেখ, গৌরাঙ্গর দোকান থেকে গরম কচুরি এনেছি!’
এই পৃথিবীতে তাকে পিলু বলে ডাকার কেউ রইল না। বারুইপুরের সমাপ্তি পাড়ায় সেদিন তাদের বাড়ির উঠোনটা ফুলে-ফুলে ঢেকে গিয়েছিল। পল্টন বুঝতে পারেনি প্রথমে। সামনে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা হলেও বিকেলে খেলার মাঠ টানে ওকে। বীরপাড়ার মাঠে ফুটবল খেলছিল পল্টন। জগবন্ধুকাকু ওকে মাঠ থেকে নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, ‘বাড়ি চল, দরকার আছে!’
পল্টন অবাক হয়েছিল। কেউ তো তাকে খেলার মাঠে কখনও ডাকতে আসেনি! কী দরকার, সেটা সারা রাস্তা বলেনি জগবন্ধুকাকু। তখন সন্ধে নামছিল। বাড়ির সামনে জটলা দেখে আরও অবাক হয়েছিল পল্টন। থমথমে মুখ দাঁড়িয়ে অনেকে। উঠোনে পা দিয়ে সে দেখেছিল, শববাহী খাটের ওপর থরেথরে সাজানো রজনীগন্ধার মালা। অসংখ্য ধুপের ধোঁয়া কুণ্ডলি কাপিয়ে রেখেছে একটা চেনা শরীর। পল্টন দেখেছিল তার বাবার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখটা। শ্যামলা রংটা কয়লার মতো নিকষ কালো হয়ে গিয়েছে!
পরেশমামা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘পল্টন, তোর বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না রে! এক ঝটকায় সব শেষ!’
২
‘পল্টন, ও পল্টন?’
দরজার বাইরে কর্কশ গলায় কেউ ডাকছে। ইদানীং সকালগুলো বড্ড একা কাটে পল্টনের। বাবা মারা যাওয়ার পর বন্ধুরা আসত দলবেঁধে। কিন্তু শোকেরও একটা অলিখিত মেয়াদ থাকে। ভিড় কমতে শুরু করলে বুঝে নিতে হয়, সময় ফুরিয়েছে। সেই নিয়ম মেনে বন্ধুদের আসাও কমেছে। পল্টন তবু স্বাভাবিক হতে পারেনি। সকালগুলো শুয়েই কাটায়। ডাক শুনে উঠোন পেরিয়ে দরজা খুলে পল্টন দেখল, সমরেশকাকু দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
‘বাড়ির ওয়্যারিংয়ের কাজটা এখনও শেষ হয়নি রে। বিপ্লব করছিল। কিন্তু তার যে এমন হবে, ভাবিনি রে। তুই বাকি কাজটুকু শেষ করে দে বাবা। সামনের সপ্তাহে গৃহপ্রবেশ। ইলেকট্রিকের কাজ শেষ না হলে ওটাও করতে পারব না!’ এক নিঃশ্বাসে বলে থামলেন সমরেশকাকু।
পল্টনের বাবা বিপ্লব সমাদ্দার ছিল ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। জাদু ছিল তার হাতে। কোনও জিনিস বিপ্লব একবার সারিয়ে দিলে চলত দীর্ঘদিন। বারুইপুরের অধিকাংশ বাড়ি থেকে ডাক পড়ত তার। বিপ্লব চাইত না তার ছেলেও এই লাইনে আসুক। স্বপ্ন দেখত, পল্টন একদিন চাকরি করবে। তবু বাবাকে দেখে-দেখে ইলেকট্রিকের সমস্ত কাজই শিখে গিয়েছিল পল্টন। অনেক সময় কাজের চাপ থাকলে বাবার সঙ্গে যেত। সমরেশকাকুর বাড়িতে যে তার বাবা কাজ করছিল, মনে পড়ল পল্টনের।
‘আজই কাজ ধরে নেব কাকু। চেষ্টা করব যাতে কয়েক দিনে শেষ করা যায়।’
‘তাই করিস বাবা। আর হ্যাঁ, তোর বাবা তো মজুরিটাও নেয়নি। বলেছিল, কাজ শেষ হলে নেবে। কে জানত, ও আর থাকবে না!’
পল্টন কি নিজেই ভেবেছিল, তার বাবা এভাবে তাকে একা ফেলে দিয়ে চলে যাবে? পুরসভা অফিসে এসি বসবে। সেপারেট লাইন দরকার। পরেশমামা কাজ করে বারুইপুর পুরসভায়। উনিই দুপুরে বলে গিয়েছিলেন, এসির লাইনটা যেন করে দেয় বিপ্লব। ইদানীং বিপ্লবের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। পল্টন বুঝতে পারছিল, বাবা বুড়ো হচ্ছে। ছটফটে ব্যাপারটা আর নেই। একটু কাজ করলেই হাঁপ ধরে যায়। উঁচুতে উঠলে হাঁটু কাঁপে।
পল্টন বলেছিল, ‘বাবা, আজ যেতে হবে না। কাল না হয় আমি যাব তোমার সঙ্গে।’
বিপ্লব হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘আর তো ক’টা বছর। তুই চাকরি করলে সব ছেড়ে দেব। আর ভালো লাগে না, বুঝলি!’
বীরপাড়ার মাঠে ফুটবল খেলতে যাওয়ার সময় সাইকেলে বারুইপুর পুরসভার সামনে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল বিপ্লবকে। সেদিন মইটা নেয়নি। ওটা থাকলে কি দুর্ঘটনা ঘটত?
ইলেকট্রিকের সরঞ্জামের ব্যাগটা সাইকেলের বাঁ হ্যান্ডেলে ঝোলাল পল্টন। মইটাকে আড়াআড়ি ডান কাঁধে রেখে প্যাডেলে চাপ দিল। ঠিক এভাবেই তার বাবা কাজে যেত। ছেলেবেলায় যতবার বাবাকে দেখত, তার ভয় আর গর্ব দুটোই হত। ভাবত, যদি মইটা কাঁধে নিয়ে একহাতে সাইকেল চালাতে গিয়ে পড়ে যায় বাবা! কিন্তু যখন দেখত, তরতর করে মই কাঁধে সমাপ্তিপাড়া ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার বাবা, গর্ব হত। বন্ধুদের বলত, তার বাবার মতো ব্যালান্স আর কারও নেই! বিপ্লবের মতো এক হাতে সাইকেল চালাতে চালাতে সমরেশকাকুর বাড়ির দিকে রওনা দিল পল্টন।
বাইপাস হওয়ার পর বারুইপুরের চেহারা পাল্টে গিয়েছে। ছড়িয়েও গিয়েছে অনেক। পশ্চিমপাড়ার জলাজমি ভরাট করে নতুন নতুন বাড়ি হচ্ছে। সমরেশকাকুর নতুন বাড়ি সেখানেই। বিপ্লবের সঙ্গে প্রথমদিন এসেছিল সে। চিনতে অসুবিধা হল না। রংমিস্ত্রিরা সবে কাজ শুরু করেছে। ইলেকট্রিকের কাজটা তার আগেই শেষ করতে হবে পল্টনকে। ঠোকাঠুকির জন্য দেওয়াল ড্যামেজ হলে, পুডিং মেরে ঠিক করে দেবে মিস্ত্রিরা।
সমরেশকাকুর বাড়িতে ঢুকে পুরোটা খুঁটিয়ে দেখে নিল পল্টন। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হিসেবে বাবার নামডাক হওয়ার কারণ ছিল, লোক ঠকানোর কাজ করত না সে। কনসিল ওয়্যারিংয়ের তার ফেলার প্রাথমিক কাজটা করে গিয়েছিল বিপ্লব। মডিউলার সুইচবোর্ডগুলো লাগানো, কানেকশন জোড়া, ফ্যান, আলোর সেট লাগানো ধরলে দিন পাঁচেকের মধ্যে বাকি কাজটুকু সেরে ফেলতে পারবে সে।
ইদানীং সব বাড়িতেই প্রোটেকশনের জন্য ডিসট্রিবিউশন বক্স লাগানো হয়। লাইন ট্রিপ করলে আপনা থেকে আরসিসিবি সুইচ নেমে যায়। ফলে বিপদের আশঙ্কা থাকে না। ফিউজ বদলানোর ঝক্কিও নেই। সুইচটা তুলে দিলেই লাইন চালু। আলাদা এমসিবি থাকে প্রতিটা পয়েন্টের সঙ্গে। ওখান থেকে কাজটা শুরু করবে পল্টন। সে মইটা দেওয়ালে লাগাল।
ডিসট্রিবিউশন বক্সটা হাতে নিয়ে মইয়ের দুটো সিঁড়ি ভাঙল পল্টন। তার পা দুটো কেঁপে উঠল। মইয়ে উঠে সে কখনও কাজ করেনি। বাবাই উঠত। সে নিচে দাঁড়িয়ে এগিয়ে দিত প্লাস, টেস্টার বা অন্য অনুষঙ্গ। অভ্যেস নেই বলেই কি পা কাঁপছে? পল্টনের মনে হল, তার পা নয়, মৃদু কাঁপছে মইটা। বয়স্ক মানুষের হাঁটু কাঁপে যেভাবে। দ্বিতীয় ধাপে দাঁড়িয়ে একটু সময় নিল সে। ব্যালান্স ঠিক করে উঠল তৃতীয় ধাপে। কাঁপুনিটা বেড়ে গেল। পল্টন পরিষ্কার শুনতে পেল, কেউ তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। খুব পরিশ্রমে যেমন হয়। হাঁ করে অনেকখানি অক্সিজেন গিললে মৃদু দুলুনি তৈরি হয় শরীরে। মইটায় সেই কম্পন টের পেল পল্টন।
ভয়ে পেয়ে এক লাফে মেঝেতে নেমে পড়ল পল্টন। কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখল মইটাকে। নাহ্, কাঁপছে না তো! ছুঁয়েও দেখল মইটাকে। কোনও অস্বাভাবিকত্ব নেই! তাহলে কি মনের ভুল? তা-ই হবে। মই তো জড়বস্তু। ওটা নিঃশ্বাস নেবে কী করে? পল্টন ফের উঠল মইয়ের সিঁড়ি বেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝল, কাঁপছে আবার মইটা। টেনে টেনে লম্বা শ্বাস নিচ্ছে!
৩
সকালে ঘুম থেকে উঠে সদর দরজাটা হাট করে খোলা দেখে ভীষণ অবাক হল পল্টন। চোরটোর ঢুকেছিল নাকি! এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনও কিছু চুরি গিয়েছে বলে মনে হল না তার। তাহলে? সে অবাক হয়ে দেখল, মইটা রাস্তার ধারে তাদের বাড়ির পাঁচিলে হেলিয়ে রাখা। গতকাল কাজ থেকে ফিরে ওটাকে বারান্দায় রেখেছিল। বাইরে গেল কী করে? নিশ্চয় পাড়ার ছেলেছোকরার কাজ। কারও বাগানের ফল চুরি করার জন্য নিয়ে গিয়েছিল হয়তো। রাস্তায় ফেলে পালিয়েছে।
রাস্তা থেকে মইটা কাঁধে তুলে ঘরে পা দিতেই গতকালের ঘটনা মনে পড়ে গেল পল্টনের। সমরেশকাকুর বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে মইটা ধন্ধে ফেলে দিয়েছিল তাকে। ভয় পেয়েছিল। মইটার কাঁপুনি আর লম্বা নিঃশ্বাস নেওয়ার কথা কাউকে বললে পাগল ভাববে তাকে। কিন্তু সে যা উপলব্ধি করেছে, মিথ্যে নয়। মইটা নিয়ে তারপর আর কাজ করেনি। রং মিস্ত্রিদের ঘরাঞ্চি নিয়ে বাকি কাজটা সেরেছিল পল্টন।
মইটা তার বাবার অত্যন্ত প্রিয় ছিল। ওটায় গোলমাল থাকলে সে ঠিক জানতে পারত। বিপ্লবের বয়স হচ্ছিল। শরীরে আগের মতো জুত ছিল না। কিন্তু মইটা ছাড়া কাজে যেত না। সমরেশকাকুর বাড়িতে ওই ঘটনার পর পল্টন ঠিক করেছে, মইটা খুব ভালো করে পরীক্ষা করে তবেই কাজে নিয়ে যাবে। ওটা আগের মতো শক্তপোক্ত নেই। মই থেকে পড়ে তার হাত-পা ভাঙতে পারে। ততদিন সমরেশকাকুর কাজ রং মিস্ত্রিদের ঘরাঞ্চি দিয়ে চালিয়ে দেবে।
মার্চ মাসের শেষে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। হাতে মাসখানেক সময়। বিপ্লব মারা যাওয়ার পর দিন পনেরো পড়তে পারেনি। পিছিয়ে পড়েছে অনেকখানি। সকালে একটু পড়তে বসেছিল। কাজের তাড়া থাকায় বেশিক্ষণ পারল না। রাত জেগে ক’টা দিন পড়তে হবে। না হলে ভালো রেজাল্ট সম্ভব নয়। পল্টনের বাবা তাকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বানাতে চায়নি। স্বপ্ন দেখত, পল্টন একদিন চাকরি করবে। বাবার স্বপ্নটা পূরণ করতেই হবে তাকে।
কাজ সেরে সন্ধেয় বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল পল্টন। পরীক্ষা থাকলে এমনটাই করে। এতে সারারাত পড়তে সুবিধা। ঘুম যখন ভাঙল, রাত দশটা। ভাতে-ভাত চাপিয়ে দিয়ে বই নিয়ে বসে গেল। সে আর্টসের ছাত্র। ইতিহাস, ভূগোল, পলটিক্যাল সায়েন্স ও সংস্কৃত নিয়েছে। ইতিহাস সবচেয়ে প্রিয় সাবজেক্ট। বিশেষ করে ইসলামিক পিরিয়ড। গ্র্যাজুয়েশনে ইতিহাসে অনার্স নেওয়ার ইচ্ছে।
ঘণ্টাখানেক হল কারেন্টটা নেই। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ হলেও ঠান্ডাটা রয়েছে। হ্যারিকেনের আলোয় আকবরের মারাঠা নীতি পড়ছিল পল্টন। হঠাৎ সদর দরজা খোলার মৃদু আওয়াজ শুনতে পেল। কেউ খুব সন্তর্পণে দরজাটা খুলেছে। কতক্ষণ একমনে পড়ছিল, খেয়াল নেই। ঘড়িতে দেখল, রাত দেড়টা বাজছে। চোর এল নাকি? পল্টন চুপিসাড়ে পড়ার ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। থোকা থোকা অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারটা সয়ে যাওয়ার পর দেখল, বারান্দায় মইটা নেই! গতরাতে যে নিয়ে গিয়েছিল ওটা, সেই আবার এসেছে! পা টিপে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল পল্টন। দরজাটা হাট করে খোলা। মুখ বাড়িয়ে বাইরে দেখল, কেউ নেই। পল্টনদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানদিকের রাস্তাটা একটু এগিয়ে একটা পুকুরে গিয়ে শেষ। ওদিকে কোনও বাড়ি নেই। অর্থাৎ মইটা যে নিয়ে গেল, সে বাঁদিকের রাস্তাটাই ধরেছে। দরজায় দাঁড়ালে বাঁহাতের রাস্তাটা অনেক দূর দেখা যায়। পল্টন কাউকে দেখতে পেল না। একটু দূরে ভবানীদের বাগানবাড়ি। সেখানেই কি কেউ নিয়ে গেল মইটা। সদর দরজাটা টেনে দ্রুত পায়ে এগোল পল্টন। মইটা বাবার জিনিস। পল্টন ওটা হাতছাড়া করবে না।
ভবানীদের বাগানবাড়ির সামনেও কাউকে দেখতে পেল না। গেটের একপাশে সিকিউরিটির ঘর। রহিমচাচা পাহাড়াদারের কাজ করে। হ্যারিকেনের আলো ভেসে আসছে ঘর থেকে। রহিমচাচা জেগে। এখান দিয়ে বাগানে ঢোকা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। বাগানবাড়িটা ছাড়িয়ে বাঁহাতে কিছুটা এগোলে চ্যাটার্জিপাড়া। মইটা নিয়ে সেদিকেই কি পালাল চোরটা?
ভবানীদের বাগানবাড়ি থেকে বাঁহাতে ঘুরেই আটফুটের মইটা দেখতে পেল! একমানুষ সমান পাঁচিলের ওপর জেগে রয়েছে মইয়ের মাথা। যে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে দেখা যাচ্ছে না। পল্টন চেঁচাল না। হাতেনাতে ধরতে হবে চোরটাকে। জোরে পা চালাল। মইটার সঙ্গে তার দূরত্ব কমছে। ডানদিকে ঘুরলেই চোরটাকে দেখতে পাবে। ঘুরেই থমকে দাঁড়াল পল্টন। তার পা দুটো যেন আটকে গিয়েছে রাস্তায়। হতবাক হয়ে গিয়েছে সে। এও কী হয়? তার সব জ্ঞান, বিদ্যে গুলিয়ে যাচ্ছে। বিপন্ন বিশ্বাস নিয়ে পল্টন দেখল, কেউ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে না মইটা। ওটা একা-একাই হেঁটে চলেছে!
একটা বাঁশের সঙ্গে আর একটা বাঁশ কাঠের সিঁড়িগুলো দিয়ে আটকানো। ডানপায়াটা এগোনোর পর এগোচ্ছে বাঁপায়াটা। রণপা পরে কেউ যেন হাঁটছে। মইটার তলায় টায়ারের টুকরো থাকায় শব্দ হচ্ছে না। পল্টনের ভয় করছে। গভীর অবিশ্বাস জাপটে ধরেছে তাকে। একটা জড়বস্তু কী করে হাঁটতে পারে? তখনই মইটা থামল। কোনও অবলম্বন ছাড়াই রাস্তায় ওপর দাঁড়িয়ে ওটা। মেরুদণ্ড এবং ঘাড়ে স্পন্ডলিসিস থাকলে যেভাবে একটা মানুষ পুরো শরীর ঘুরিয়ে পিছন ফেরে, ঠিক সেভাবে খানিকটা ঘুরল মইটা!
পল্টনের মনে হল, তাকে দেখে যেন নিশ্চিন্ত হয়েছে জড়বস্তুটা। আবার হাঁটতে শুরু করেছে। একবার ভাবল, দরকার নেই মইটার পিছনে গিয়ে। তীব্র কৌতুহল টানছে পল্টনকে। চ্যাটার্জিপাড়া পার করে বাইপাস। করিমপাড়া ছাড়িয়ে সেনপাড়া। কিছুটা এগিয়ে একটা নতুন তৈরি একতলা বাড়ির বুক উঁচু পাঁচিলে হেলান দিয়ে দাঁড়াল মইটা। যেন উঁকি মেরে কিছু একটা দেখছে ওটা। গলির বাঁকে একটা আমগাছের আড়ালে লুকিয়ে পল্টন দেখতে পেল, গেট পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নতুন বাড়িটার ঢুকে যাচ্ছে মইটা!
৪
লোহার তার দিয়ে কাঠের সিঁড়িগুলোর জায়গায় জায়গায় অনেকখানি করে বেড় দিল পল্টন। নড়বড়ে ভাবটা এখন আর নেই। একটা মালসায় তারপিন তেল নিয়ে যত্ন করে লাগাল মইটার গায়ে। ঠিক তখনই সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। পল্টন দরজা খুলে দেখল সমরেশকাকু।
পাঁচশো টাকার বেশ কয়েকটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে সমরেশকাকু বললেন, ‘তুই তো তোর বাবার মতোই এক্সপার্ট আর এক কথার মানুষ! আজ সকালে গিয়ে দেখলাম, সব কাজ সেরে ফেলেছিস।’
হাসি ফুটে উঠল পল্টনের মুখে।
‘আলো আর ফ্যানের সেটগুলো বাকি রইল। ওগুলো কবে লাগাবি?’
সমরেশকাকুর দিকে তাঁর নতুন বাড়ির চাবিগোছাটা এগিয়ে দিতে দিতে পল্টন বলল, মাল এনে রাখবেন। আর আজ সন্ধেবেলায় চাবিটা দিয়ে যাবেন। রাতে লাগিয়ে দেব।’
সদর দরজাটা বন্ধ করে আবার মইয়ের কাছে ফিরে এল পল্টন। সেই রাতে পল্টন মইটার পিছন পিছন যেখানে গিয়েছিল, সেটা ছিল সমরেশকাকুর নতুন তৈরি হওয়া বাড়ি। যেখানে বাবার বাকি কাজটুকু করছিল পল্টন। তখনও দরজা বসেনি, মইটা ঢুকে গিয়েছিল ওই বাড়িতে। পরদিন সকালে সমরেশকাকুর বাড়িতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল পল্টন। ডিস্ট্রিবিউশন বক্স বসানো হয়ে গিয়েছে। দেওয়ালে ঝকঝক করছে নতুন সুইচবোর্ড। সে তো করেনি! কে করল তবে? মইটা? তবে কি তার বাবা…’
ছেঁড়া গেঞ্জির টুকরো তারপিন তেলের মালসাতে চুবিয়ে মইটার গায়ে বোলাতে বোলাতে পল্টন বলল, ‘বাবা, তোমার শরীরটা এখন ঠিক তো? আর হাঁপ ধরছে না তো?’