ভূত-ভবিষ্যৎ
ভাঙা থামের গায়ে হেলান দিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে বসে ছিলেন মহাকাশ বিজ্ঞানী গণপতি মজুমদার৷ এ জায়গাটা ছায়াময় হলেও প্রাচীরের বাইরে যতদূর চোখ যায় বোশেখের রোদে পুড়ছে ধুধু মাঠ৷ কোথাও কোনো বাড়িঘর নেই৷ গাছপালাও তেমন নেই, শুধু এই প্রায় ধসে যাওয়া প্রকাণ্ড বাড়ির পেছনের বাঁশবাগানটা ছাড়া৷ ওই বাঁশবাগানেই তো আজ সেই লোকটার এসে নামার কথা! তাকে কি ঠিক লোক বলা যাবে? তা জানা নেই গণপতিবাবুর৷ তিনি তাকে চোখে দ্যাখেননি, শুধু কণ্ঠস্বর শুনেছেন যন্ত্রের মাধ্যমে৷ একটু রিনিরিনি হলেও সে কণ্ঠস্বর মানুষেরই মতো৷
তিনমাস আগে প্রথম যেদিন তার সঙ্গে রেডিয়ো মারফত গণপতিবাবুর প্রথম পরিচয় হয়, সেদিন সে বলেছিল— আমাকে আপনি বলতে পারেন ‘ভবিষ্যতের মানুষ৷’ আপনাদের থেকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ইত্যাদিতে কয়েক হাজার বছর এগিয়ে আছি আমরা৷ এই যে আমি পৃথিবীর দিকে যাচ্ছি, এ ব্যাপারটা আমাদের কাছে, ‘টাইম ট্রাভেল’ করে অতীতে ফিরে যাওয়ার মতো৷
সেই প্রথম পরিচয়ের দিন তার কথা শুনে বেশ পুলকিত হয়েছিলেন বিজ্ঞানী গণপতি মজুমদার৷ তাঁর দীর্ঘ দিনের বিজ্ঞান সাধনা সফল হয়েছে৷ অবশেষে তিনি যোগাযোগ করতে পেরেছেন কোনো ভিনগ্রহের মানুষের সঙ্গে৷ কিন্তু সেদিন তিনি ধারণা করতে পারেন নি সেই ভবিষ্যতের মানুষের মাথায় অন্য মতলব আছে৷ কী করবেন তা এখন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি৷ তার সঙ্গে যোগাযোগকারী পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসাবে সেদিনই গণপতি তাকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য৷ সে বলেছিল— আমি যেতে পারি, কিন্তু সেটা কোনো নির্জন জায়গা হতে হবে৷ যেখানে কোনো লোকজন থাকবে না৷ যেখানে নির্বিঘ্নে আমার মহাকাশ যান উঠতে নামতে পারবে৷
তার কথা শুনে গণপতিবাবুর হঠাৎ মনে পড়ে গেছিল তাঁর বাবা বিজ্ঞানী উমাপতির মুখে শোনা এই বাড়িটার কথা৷ যদিও বাড়িটাকে তিনি তখনও চোখে দ্যাখেননি৷ এবাড়ির কথা মাথায় আসায় গণপতিবাবু ভিনগ্রহের মানুষের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন— হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওরকম একটা জায়গা আমার জানা আছে৷ কলকাতা শহর থেকে অনেক দূরে৷ ধুধু মাঠের মধ্যে শুধু দাঁড়িয়ে আছে একটা ভাঙা বাড়ি, আর একটা বাঁশবন৷ তার চারপাশে কোনো জনমানব নেই৷
ভিনগ্রহের মানুষ বলেছিল—ঠিক আছে তাহলে ওখানেই দেখা হবে৷ পৃথিবীর হিসাবে আমার সেখানে পৌঁছতে তিনমাস সময় লাগবে৷ আপনি ওই জায়গাতে গিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুন৷
আর এর দু-দিনের মধ্যেই এক সন্ধ্যায় হেতেমপুরের এই প্রাচীন জমিদার বাড়িতে এসে উপস্থিত হন গণপতিবাবু৷ তবে সেই ভবিষ্যতের মানুষের মতলবটা আগে বুঝতে পারলে তাকে তিনি আমন্ত্রণ জানাতেন কিনা সন্দেহ? মতলবটা সে খোলসা করেছে গতকাল রাতে৷ সে আসছে গণপতিবাবুকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে নাকি পরিণাম মারাত্মক হবে!
মাঝ দুপুর৷ কোথাও কোনো শব্দ নেই৷ শুধু মাঝে মাঝে ভাঙা বাড়ির ভিতর কোনো ইটের স্তূপের মধ্যে থেকে একটা তক্ষক ডাকছে৷
বিষণ্ণ মুখে গণপতি একবার তাকালেন সামনের রোদে পোড়া মাঠের দিকে৷ অন্য কেউ হলে এই ভরদুপুরে সেদিকে তাকাতই না চোখ ঝলসে যাওয়ার ভয়ে৷ কিন্তু এই মাঠটাকেও কেমন যেন সুন্দর বলে আজ মনে হল গণপতিবাবুর৷ তক্ষকের ডাকটাও বেশ মিষ্টি লাগছে৷ আসলে, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে পৃথিবীর সব কিছুই সুন্দর বলে মনে হয়৷
গত রাতে প্রথম যখন ভবিষ্যতের মানুষের কাছ থেকে গণপতি আসল ব্যাপারটা জানতে পারলেন, তখন তাঁর মনে হয়েছিল, ভোর হলেই তিনি এবাড়ি ছেড়ে চম্পট দেবেন৷ কিন্তু তার পরই তাঁর মনে হয়েছিল আরও একজনের কথা৷ যিনি থাকেন এবাড়ির দোতলার এক অন্ধকার ঘরে৷ ভবিষ্যতের মানুষ গণপতিবাবুকে না পেলে শেষ পর্যন্ত হয়তো তাঁকেই ধরে নিয়ে যাবে! কাজেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাটা ত্যাগ করতে হয়েছে গণপতিবাবুকে৷
দোতলার সেই ঘরে যিনি থাকেন তিনি গণপতিবাবুর ঠাকুরদা চণ্ডীপতি৷ গণপতিবাবুর হিসাব যদি ভুল না হয়, তবে চণ্ডীপতির বয়স একশোকুড়ি চলছে৷ গণপতিবাবু নিজেরইতো সামনের আষাঢ় মাসে সত্তর বছর পূর্ণ হবে!
মাসতিনেক আগে সেই সন্ধ্যায় প্রথম এ-বাড়িতে পা রেখে দোতলায় উঠে চণ্ডীপতিকে দেখে ও তাঁর পরিচয় পেয়ে চমকে গেছিলেন গণপতিবাবু৷ তাঁর ঠাকুরদা যে বেঁচে আছেন তাই জানা ছিল না গণপতিবাবুর৷ কুড়ি বছর আগে, আশি বছর বয়সে গণপতিবাবুর বাবা বিখ্যাত বিজ্ঞানী উমাপতি যখন দেহ রাখেন, তখনও তাঁর পিতার জীবিত থাকার খবর জানা ছিল না উমাপতিরও৷
ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার জন্য গণপতিবাবুর পারিবারিক ইতিহাস একটু জানা প্রয়োজন৷ চণ্ডীপতির পূর্বপুরুষরা একসময় ছিলেন, এ তল্লাটের জমিদার৷ তাঁরাই এ-বাড়ি বানিয়ে ছিলেন৷ চণ্ডীপতির অবশ্য যখন এ-বাড়ি হাতে পান, তখন আর জমিদারির কিছুই অবশিষ্ট ছিল না৷ শুধু এই বাড়িটাই পড়ে ছিল৷ গণপতিবাবুর মতো তাঁর বাবা উমাপতিরও ছেলেবেলায় মাতৃবিয়োগ ঘটে৷ মাতৃহীন উমাপতিকে এই বাড়িতেই মানুষ করে তুলতে থাকেন চণ্ডীপতি৷
চণ্ডীপতি ছিলেন কালী সাধক৷ ভূত-ভগবান, তন্ত্র-মন্ত্র সবেতেই প্রবল বিশ্বাস তাঁর৷ কিন্তু উমাপতি বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চণ্ডীপতির উলটো পথ ধরলেন৷ ভূত-ভগবানে বিশ্বাস নেই তাঁর৷ উমাপতির মনে তখন বিজ্ঞান-চেতনার উন্মেষ ঘটতে শুরু করেছে৷
এ সব ক্ষেত্রে যা হয়, এক সময় বাপ-ব্যাটার মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হল তাঁদের নিজের নিজের দর্শন নিয়ে৷ দুজনেই নিজেদের বিশ্বাসে অটল৷ প্রথম-প্রথম নিজেদের মধ্যে তর্ক, তারপর শুরু হল ঝগড়া৷ একদিন চণ্ডীপতি ছেলের প্রতি এমন খেপে গেলেন যে, বাড়ির দলিলপত্র ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন— এগুলো তোমার কাছে রাখো৷ আমি আর তোমার মতো নাস্তিকের মুখ দর্শন করতে চাই না৷ এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাও তুমি৷ আমার মৃত্যুর পর এবাড়ি যাতে তুমি বা তোমার সন্তানরা পেতে পার, সেজন্যই কাগজগুলো আগাম তোমার হাতে দিচ্ছি৷
কথাগুলো হয়তো রাগের মাথায় বলেছিলেন চণ্ডীপতি, কিন্তু অভিমানী উমাপতি বাবার কথা শুনে সেই দণ্ডেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলেন৷ এ সব ঘটনা অবশ্য গণপতিবাবুর জন্মের অনেক আগের কথা৷ কিন্তু পরবর্তীকালে উমাপতি আর চণ্ডীপতির কোনো দিন দেখা হয়নি৷ দুজনের কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেননি৷ উমাপতি কলকাতাতে এসে বিজ্ঞান সাধনা শুরু করেন৷ বিজ্ঞানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন৷ বিবাহ করেন৷ স্ত্রীর মৃত্যুর পর একমাত্র পুত্র গণপতিকে বড়ো করতে থাকেন৷ মহাকাশ বিজ্ঞান সম্বন্ধে তাঁকে শিক্ষা দিতে থাকেন৷
একদিন গণপতিবাবুও হয়ে ওঠেন মহাকাশ বিজ্ঞানী৷ এখানকার বাড়ির ব্যাপারটা জানতেনই না গণপতিবাবু৷ মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন আগে উমাপতি ছেলের কাছে ব্যক্ত করেন সব ঘটনা৷ চণ্ডীপতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি তিনি আর জীবিত নেই৷ এ তথ্যটা উমাপতি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন, তা জানেন না গণপতিবাবু৷ তবে তাঁর ঠাকুরদার মৃত্যুর ব্যাপারে গণপতিবাবুর অবিশ্বাস করার কিছু ছিল না৷ উমাপতি বয়স আশি আর চণ্ডীপতির একশো বছর হওয়ার কথা৷ একশো বছর খুব অল্প লোকই বাঁচে৷ তাই আরও কুড়ি বছর বাদে এবাড়িতে এসে চণ্ডীপতিকে দেখে বেশ চমকে গেছিলেন গণপতিবাবু৷
গণপতিবাবু আর ঠাকুরদা চণ্ডীপতি ছাড়া এবাড়িতে আর কোনো মানুষ থাকে না৷ একই বাড়িতে থাকলেও গণপতি আর চণ্ডীপতির মধ্যে কথাবার্তা দেখাসাক্ষাৎ নেই বললেই চলে৷ প্রথম রাতেই চণ্ডীপতি, নাতি গণপতিকে বলেছিলেন— দ্যাখো বাপু, তুমি যখন এসেই পড়েছ, তখনতো আর তোমাকে চলে যেতে বলতে পারি না৷ তবে আমাকে বিরক্ত করতে পাবে না৷ তুমি থাকবে এক তলায় আর আমি যেমন আছি তেমনই থাকব৷ আমাকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না৷ আর আমি না ডাকলে দোতলায় উঠবে না তুমি৷ বিশেষত দিনেরবেলা কখনোই ওপরে উঠবে না৷ আমি দিনে ঘুমোই৷— এসব শর্ত পালন করলে এখানে থাকতে পারো৷
গণপতিবাবু রাজি হয়েছিলেন চণ্ডীপতির শর্তে৷ প্রথম দিনের পর আর কোনো দিন দোতলায় ওঠেননি গণপতিবাবু৷ ঠাকুরদার আর তাঁর কথাবার্তাও হয়নি৷ শুধু যেদিন গণপতিবাবু ভবিষ্যতের সেই মানুষটার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য ছাতার মতো ডিশ অ্যান্টেনাটা চিলে কোঠার ছাদে বসিয়ে এসেছিলেন, সেদিন রাতে চণ্ডীপতি দোতলায় ভাঙা বারান্দা থেকে উঁকি মেরে গণপতিবাবুকে জিগ্যেস করেছিলেন— বাড়ির মাথায় ওই ছাতাটা কিসের?
গণপতিবাবু জবাব দিয়েছিলেন— আজ্ঞে, ওটা হল একটা অ্যান্টেনা৷ ওর সাহায্যে মহাকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়৷
উত্তর শুনে চণ্ডীপতি বলে উঠেছিলেন— ও তাহলে তুমিও বাপের ধারা পেয়েছ৷ বিজ্ঞান র্চ্চা করো: ফুঃ!
কথাগুলো বলে এমন ভাবে কটমট করে গণপতিবাবুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন যে, গণপতিবাবু আর তাঁর সঙ্গে কথা বলার সাহস পাননি৷
গণপতিবাবু একতলার যে ঘরে তাঁর যন্ত্রপাতি রেডিয়ো-সিস্টেম ইত্যাদি বসিয়েছেন, সে ঘরেই যদিও সারাদিন কাটান, কিন্তু জানলা দিয়ে দিনের বেলা ঠাকুরদাকে কোনোদিন দ্যাখেননি৷ ঠাকুরদা দিনের বেলা ঘর ছেড়ে বেরোন না৷ অন্ধকার নামলে দোতলার বারান্দায় তাঁর খড়ম পরা পায়ের শব্দ শোনা যায়৷ এবাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নেই৷ শুধু গণপতিবাবুর কাজের ঘরের জন্য একটা পোর্টেবল জেনারেটর আছে৷ খড়মের শব্দ, আর দোতলার ভাঙা থামের আড়ালে ছায়ার নড়াচড়া জানান দেয় ঠাকুরদার উপস্থিতি৷ একদিন শুধু পূর্ণিমার রাতে ঠাকুরদাকে ওপর থেকে নেমে বাড়ির পিছনে বাঁশবাগানের দিকে যেতে দেখেছিলেন গণপতিবাবু৷
বাড়িতে বসে সমস্যাটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে গণপতিবাবুর হঠাৎ মাথায় এল, ‘আচ্ছা, ভবিষ্যতের মানুষের ব্যাপারটা নিয়ে ঠাকুরদার সঙ্গে আলোচনা করলে হয় না? তিনি প্রাচীন মানুষ, হয়তো কোনো সমাধানের পথ বাতলাতে পারবেন৷ আর তিনি যদি এ-বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হন, তাহলে তো বেলা থাকতেই এ-তল্লাটে থেকে দুজনে সরে পড়া যাবে৷ গাড়িতো আছেই৷ ভবিষ্যতের মানুষ খুঁজে পাবে না কাউকে৷’
ঠিক এই সময় দূরের এক ছায়াপথে মহাকাশযান থেকে অচেনা এক গ্রহে সংবাদ পাঠাচ্ছিল তার চালক৷— হ্যালো? কো-আলফা-নাইন স্পেসশিপ থেকে বলছি৷ কন্ট্রোল রুম শুনতে পাচ্ছ?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, পাচ্ছি৷ হ্যালো?
—আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করবে স্পেসশিপ৷ সব ঠিক আছে৷ চিন্তার কিছু নেই৷
—কিন্তু মানুষটাকে যে ভাবেই হোক আনা চাই৷ জ্যান্ত অথবা মৃত৷ ওকে পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে যে পৃথিবীর মানুষ আমাদের থেকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে ঠিক কতটা পিছিয়ে আছে? তোমার এই অভিযানের সফলতার ওপর ভবিষ্যতে আমাদের পৃথিবী দখলের পরিকল্পনার অনেক কিছু নির্ভর করে আছে৷ লোকটাকে যে তুমি নিয়ে আসবে তা কী তুমি ওকে জানিয়েছ?
—হ্যাঁ, জানিয়েছি৷ তবে চিন্তার কিছু নেই, স্লিপিং গ্যাস থেকে শুরু করে লেসার গান সবকিছুই তো সঙ্গে আছে৷ পুরো একটা আর্মি ট্রুপের মোকাবিলা করতেও অসুবিধা হবে না…৷
দুই
ভিতর বাড়িতে ঢুকে ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেন গণপতিবাবু৷ দোতলার টানা বারান্দায় গা ঘেসে সার সার ঘর৷ আলো আঁধারি খেলা করছে ভিতরে৷ মাকড়সা জাল বুনেছে চারপাশে৷ মেঝেতে পুরু ধুলোর স্তর৷
ঠাকুরদার ঘরটা দোতলায় একদম শেষ প্রান্তে৷ অন্ধকার জায়গাটা৷ বাইরের আলো সেখানে ঢোকে না৷ ঠাকুরদার ঘরের দরজা বন্ধ৷ সেই দরজার সামনে গিয়ে গণপতিবাবু একটু ভয়ে ভয়ে বললেন— ঠাকুরদা? ঠাকুরদা জেগে আছেন?
প্রথমে কোনো জবাব এল না৷
গণপতিবাবু এরপর বললেন— আমি গণপতি, ঠাকুরদা, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি৷
এবার ভিতর থেকে ঠাকুরদার গলা শোনা গেল— কে গণপতি? তোমায় না দিনের বেলায় ওপরে উঠতে বারণ করছি৷ দরকার থাকলে রাতে এসো৷ এখন বিরক্ত কোরো না৷
গণপতিবাবু বললেন— রাতে আসলে হবে না ঠাকুরদা৷ আসলে, আমি একটা বিপদে পড়েছি৷ ভীষণ বিপদ, সে ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি৷
কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা৷ তারপর ঠাকুরদার ঘরের দরজাটা যেন নিজে থেকেই খুলে গেল৷ অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে ঠাকুরদার জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল— ভিতরে এসো৷
ঘরের ভিতর পা রেখে প্রথমে কিছু ঠাহর করতে পারলেন না গণপতিবাবু৷ অন্ধকার ঘরে চোখ সওয়াতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল তাঁর৷ এর পর তিনি দেখতে পেলেন তাঁকে৷ ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে গণপতিবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন ঠাকুরদা৷ পরনে রক্তবসন, পায়ে বেল কাঠের খড়ম, উন্মুক্ত উর্ধাঙ্গে পৈতে জড়ানো৷ বুকের ওপর নেমে এসেছে ধবধবে সাদা দাড়ি৷ ভ্রু, মাথার চুল সব একদম সাদা৷ চোখের দৃষ্টি কেমন যেন জুলজুলে৷
ঠাকুরদা বললেন— বলো কি বিপদ?
গণপতিবাবুর একটু ইতস্তত করে বললেন— ইয়ে, মানে, ব্যাপারটা একটু গোলমেলে৷ আমাকে আজ রাতে একজন ধরে নিয়ে যেতে আসছে৷
চণ্ডীপতি বললেন— ধরে নিয়ে যেতে আসছে মানে? তুমি কী কচি খোকা, যে ছেলেধরা ধরে নিয়ে যাবে?
গণপতিবাবু বললেন— না, ঠিক সেরকম ছেলেধরা নয়৷ আসলে আমি দীর্ঘদিনের বিজ্ঞান সাধনার ফলে ভিনগ্রহের এক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমর্থ হয়েছি৷ আমিই তাকে এখানে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম৷ কিন্তু মুশকিল হল, সে কাল আমাকে জানিয়েছে যে সে শুধু এখানে আসবে তাই নয়, আমাকেও সে তার সঙ্গে করে নিয়ে যাবে৷ যদি বাধা দিতে যাই, পরিণাম খারাপ হবে৷
ঠাকুরদা তাঁর কথা শুনে প্রথমে বেশ তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন— ও আবার সেই বিজ্ঞানের ব্যাপার-স্যাপার! উমাপতির রোগটা তোমার মধ্যেও ভালোরকম আছে দেখছি৷ তারপর প্রশ্ন করলেন— আচ্ছা গণপতি, তুমি ভূত-ভগবান বিশ্বাস করো?
গণপতিবাবুর সত্যি কথাই বলতে গেলেন— আমি বিজ্ঞানী তো, ওসব ব্যাপারে তাই আমার তেমন…
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ঠাকুরদা ভেঙচি কেটে বললেন— বিশ্বাস নেই তাইতো? তোমার বাবাও এ কথা বলতো৷ তোমরা ভূত-ভগবান, সুরলোক-দেবালোক-ব্রহ্মলোক এসব বিশ্বাস করবে না, আর আমাকে তোমাদের ভিনগ্রহ গ্রহান্তরের মানুষ এসব আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করতে হবে! যত্তসব হাবিজাবি কথা! এজন্যই তো উমাপতিকে এবাড়ি থেকে বের করে দিয়ে ছিলাম৷ সেই বলতো, ভিনগ্রহে নাকি মানুষ থাকতে পারে৷ সে একদিন যোগাযোগ করবে তাদের সঙ্গে৷
গণপতিবাবু কাঁচুমাঁচু ভাবে বললেন— আসলে, কাজটা কিন্তু বাবাই শুরু করেছিলেন৷ আমি শেষ করলাম৷ অনেক দূরের ব্যাপারতো, তাই যোগাযোগ করতে সময় লাগল৷ তবে ব্যাপারটা কিন্তু মিথ্যা নয়৷ রোজ তার সঙ্গে আমার রেডিয়ো মারফত যোগাযোগ হয়৷ চেষ্টা করলে হয়তো এখনই নীচের রেডিয়োরুম থেকে আপনার সঙ্গে তার কথা বলাতে পারি৷
চণ্ডীপতি দাঁত খিঁচিয়ে বললেন— তার সঙ্গে কথা বলতে আমার বয়ে গেছে৷ সে যদি আসে তবে নিজের ঠ্যালা নিজে সামলাবে৷ আমিতো তাকে ডাকিনি!
গণপতিবাবুর মনে হল ঠাকুরদার সঙ্গে কথা বলে আর বিশেষ লাভ হবে না৷ তিনি এবার একটু অভিমানের সুরে বললেন— ঠিক আছে আমিই যখন তাকে ডেকে আনছি, তখন আমার যা হওয়ার হবে৷ আমিতো পালিয়ে যেতেই পারি৷ নেহাৎ আপনাকে ফেলে দিতে পারছি না তাই৷ আমাকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ও যদি আপনাকে ধরে…৷
কথাটা বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিলেন গণপতিবাবু, কিন্তু হঠাৎ অট্টহাস্য করে উঠলেন চণ্ডীপতি৷ তারপর বললেন— কোথায় যাচ্ছ? দাঁড়াও৷
গণপতিবাবু থমকে দাঁড়ালেন৷ তাঁর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন চণ্ডীপতি৷ তারপর তিনি বললেন— তুমি যখন এ বংশের শিবরাত্রির সলতে তখন তোমার ব্যাপারটা নিয়ে আমাকেই ভাবতেই হবে৷ তা সে লোকটার ব্যাপারে তুমি কী কী জানো? সে দেখতে কেমন? চাল চলন কেমন? বেশ মোলায়েম শোনাল ঠাকুরদার কণ্ঠস্বর৷
তাই শুনে গণপতিবাবু সাহস ফিরে পেয়ে বললেন— তাকে আমি চেখে দেখিনি৷ গলাটাতো মানুষেরই মতো৷ সে নিজের পরিচয় দেয় ‘ভবিষ্যতের মানুষ’ বলে৷ সে নাকি বিজ্ঞান প্রযুক্তি ইত্যাদিতে আমাদের থেকে এগিয়ে৷ অনুমান করা যায় যে ভয়ঙ্কর হাতিয়ারও থাকবে তার সঙ্গে৷
চণ্ডীপতি বললেন— ও ভবিষ্যতের মানুষ৷ তারপর খড়ম পরা পায়ে অন্ধকার ঘরের এ-কোণ থেকে ও-কোণ পর্যন্ত খটখট শব্দে পায়চারি শুরু করলেন৷
গণপতিবাবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন৷
বেশ কিছুক্ষণ পর চণ্ডীপতি জানতে চাইলেন— আচ্ছা, আমি যে এ-বাড়িতে আছি৷ তা কী ভবিষ্যতের মানুষের জানা আছে?
গণপতিবাবু জবাব দিলেন— না ব্যাপারটা তার জানা নেই৷
—ঠিক আছে৷ তাহলে ব্যাপারটা সামলানো যাবে৷ তোমার চিন্তার কিছু নেই৷ তুমি বাঁশ ঝাড় থেকে শক্ত একটা লাঠি কেটে রেখো৷’
যদিও ঠাকুরদার চেহারা এই বয়সেও বেশ শক্তপোক্ত, তবু তাঁর কথা শুনে গণপতিবাবু বেশ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন— ভবিষ্যতের মানুষের সঙ্গে আপনি বাঁশ দিয়ে মোকাবিলা করবেন নাকি?
চণ্ডীপতি ধমকের সুরে বললেন— তোমাকে অত সব ভাবতে হবে না৷ আমাকে আর বিরক্ত কোরো না৷ তুমি এখন এসো৷ আমি ঠিক সময় নীচে নামব৷
গণপতিবাবু এর পর বেরিয়ে এলেন তাঁর ঘর থেকে৷
তিন
নীচে নেমে আসা পরই তাঁর রেডিয়ো-ঘর থেকে বিপবিপ শব্দ শুনে গণপতিবাবু সে ঘরে গিয়ে হেডফোন কানে লাগাতেই ওপার থেকে ভেসে এল সেই ভবিষ্যতের মানুষের কণ্ঠস্বর— এইমাত্র আমি পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করলাম৷ ল্যাটিচ্যুড-লঙ্গিচ্যুড মিলিয়ে হেতমপুর জায়গাটা আমার শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্রে দেখতে পাচ্ছি৷ যদিও তোমার বাড়ির অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়, তবে তা কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে৷ ঠিক সময় আমি পৌঁছে যাব সখানে৷ তুমি নিশ্চয়ই তৈরি আছ৷ আশা করি আমাকে কোনোরূপ বলপ্রয়োগ করতে হবে না৷— এটুকু বলেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল লোকটা৷
বিকাল হয়ে আসছে৷ ঠাকুরদার কথামতো বাঁশঝাড় থেকে একটা বেশ শক্তপোক্ত লাঠি কেটে আনলেন গণপতিবাবু৷ ঠাকুরদা সত্যিই কী এই লাঠি দিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রসমৃদ্ধ ভবিষ্যতের মানুষের মোকাবিলা করতে চাইছেন৷ ব্যাপারটা ভেবে এই উত্তেজনার মধ্যেও হাসি পেল বিজ্ঞানী গণপতি মজুমদারের৷
বিকাল গড়িয়ে এক সময় সন্ধ্যা নামল৷ অন্ধকারে ডুবে গেল চারপাশ৷ এক সময় ধীরে-ধীরে চাঁদ উঠতে শুরু করল৷ বাড়ির পিছনে বাঁশবাগান থেকে একপাল শেয়াল ডেকে উঠল৷ বেশ কিছুক্ষণ পর খড়মের খটখট শব্দ পেলেন গণপতিবাবু৷ সিঁড়ি বেয়ে ভিতর বাড়ির বারান্দায় নেমে এলেন ঠাকুরদা৷ চাঁদের আলোতে তাঁর সাদা-চুল-দাড়ি-পৈতে ধবধব করছে৷ গণপতিবাবু লাঠিটা নিয়ে তার সামনে দাঁড়াতেই তিনি বললেন— সেই ভবিষ্যতের মানুষ কোন পথে এখানে আসবে?
গণপতিবাবু জবাব দিলেন— তার এই বাঁশবাগানের ওখানে নামার কথা৷
চণ্ডীপতি বললেন— তাহলে ওদিকটাতেই চলো৷
বাড়ির পিছনে এসে হাজির হলেন দুজন৷ বেশ বড়ো বাঁশবন৷ ভিতরে জমাট বাঁধা অন্ধকার৷ কেমন যেন ছমছমে জায়গাটা৷ কিছু বাঁশ নুইয়ে পড়েছে মাটিতে৷ ঠিক যেন তারা ঘুমাচ্ছে৷ বাঁশবাগান আর বাড়ির মাঝে একটুখানি ফাঁকা জমি৷ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ধ্বসে পড়া একটা ঘর৷ জমিদারির রমরমার যুগে পাইকরা থাকত ওঘরে৷ তারা সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই দুটো প্রাণী চণ্ডীপতির সামনে এসে লেজ নাড়তে লাগল৷ গণপতিবাবু প্রথমে তাদের কুকুর বলে ভেবেছিলেন, কিন্তু ভালো করে দেখার পর বুঝতে পারলেন সেগুলো শিয়াল৷
চণ্ডীপতি হেসে বললেন, এ তল্লাটে তো আর কেউ থাকে না৷ এক সঙ্গে থাকতে খাকতে ওদের সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে৷
চণ্ডীপতির এর পর গণপতিবাবুকে বললেন, লাঠিটা আমাকে দিয়ে তুমি এই ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢোকো৷ যা হবে আমি সামলাব, খবরদার বাইরে বেরবে না৷
গণপতিবাবু ঘরে ঢুকে গেলে লাঠি হাতে নিয়ে বাঁশ বাগানের এখানে সেখানে চক্কোর কাটতে শুরু করলেন চণ্ডীপতি৷ সঙ্গে তাঁর পোষ্য দুই শিয়াল৷
অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে গণপতিবাবু বাইরেটা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছেন৷ কানে আসছে চণ্ডীপতির খড়মের খটখট শব্দ৷ বাঁশবনের অন্ধকারের মধ্যে মাঝে মাঝে তাঁর আবছা অবয়ব ও চতুষ্পদ প্রাণী দুটোর জ্বলজ্বলে চোখও নজরে আসছে৷
তখন মাঝ রাত হবে৷ হঠাৎ গণপতিবাবুর মনে হল, আকাশের একটা নক্ষত্রকে হঠাৎই যেন বেশি উজ্জ্বল মনে হচ্ছে৷ তিনি ভালো করে তাকালেন সেদিকে৷ সত্যিই, সেই আলোকবিন্দুর উজ্জ্বলতা আর আকার ক্রমশই যেন বেড়ে চলেছে৷ সে যেন ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে৷ আর তার পরই বাইরে প্রচণ্ড ঝড় উঠল, প্রলয় নাচন শুরু হল বাঁশবনে, থরথর করে কেঁপে উঠল মাটি৷ গণপতিবাবু বুঝতে পারলেন, সে এসে গেছে!
গণপতিবাবু দেখলেন, বাইরেটা একটা অদ্ভুত নীল আলোতে ভরে উঠেছে বাঁশবাগানের অর্ধেক প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে৷ আর সেই ফাঁকা জায়গাতে উলটানো পেয়ালা-পিরিচের মতো দেখতে বিশালাকৃতির এক ধাতব যান৷ ফ্লাইং-সসার৷ তার থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে নীলাভ আলো৷ তাতেই উদ্ভাসিত হচ্ছে চারপাশ৷ চণ্ডীপতিকেও দেখা যাচ্ছে৷ কিছু দূরে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে শিয়াল দুটোকে নিয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন অদ্ভুত যানের দিকে৷
এর পরই মহাকাশযানের দরজা খুলে গেল৷ প্রথমে একটা ছোট্ট সিঁড়ি নেমে এল ভিতর থেকে৷ তারপর দেখা গেল তাকে৷ ভবিষ্যতের মানুষ৷ গণপতিবাবু যতদূর তাকে দেখলেন, তাতে আগন্তুকের অবয়ব মানুষেরই মতো মনে হল৷ যদিও সে একটু খর্বকায়, উচচতা আনুমানিক ফুট চারেক হবে৷ পরনে ধাতব স্পেস স্যুট৷ তার মুখ বোঝা যাচ্ছে না, বিরাট হেলমেটে ঢাকা মুখ৷ কোমরবন্ধে একটা ইলেকট্রনিক প্যানেলে নানা রঙের বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলছে৷ বন্দুকের মতো কয়েকটা জিনিসও ঝুলছে কোমরবন্ধ থেকে৷ সম্ভবত সেগুলো কোনো ধরনের অস্ত্র৷
ভবিষ্যতের মানুষ হেলে-দুলে নেমে এল তার মহাকাশযান থেকে৷ তারপর সোজা গিয়ে দাঁড়াল চণ্ডীপতির মুখোমুখি৷ দুজনের মধ্যে এর পর কথা শুরু হল৷ কী কথা হচ্ছে অন্ধকার ঘরের মধ্যে থেকে শুনতে পাচ্ছেন না গণপতি, তবে চণ্ডীপতির হাত নাড়া দেখে মনে হল তিনি যেন ফিরে যেতে বলছেন ভবিষ্যতের মানুষকে৷ আর এর পরই দেখা গেল মহাকাশের মানুষ তার ধাতব হাত দুটো দিয়ে জাপটে ধরল চণ্ডীপতিকে৷ কিন্তু কী কৌশলে যেন চণ্ডীপতি এড়িয়ে গেলেন সেই ফাঁদ৷ ভবিষ্যতে মানুষের ধাতব হাত দুটো পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকিতে ঠং করে শব্দ হল৷
বারকয়েক এরকম নিষ্ফল চেষ্টা করল ভিনগ্রহী৷ কিন্তু প্রতিবারই সেই ধাতব বন্ধন থেকে পিছলে গেলেন চণ্ডীপতি৷ ভবিষ্যতের মানুষ এরপর কোমরে কী একটা যন্ত্রে চাপ দিতেই শোঁ-শোঁ শব্দে একটা গ্যাসীয় পদার্থ বেরুতে লাগল তার গা থেকে৷ মুহূর্তের মধ্যে একটা গ্যাসীয় বলয় তৈরি হল তার চারপাশে৷ যার মধ্যে চণ্ডীপতিও ঢাকা পড়লেন৷
কিছুক্ষণেই মধ্যেই অবশ্য সেই গ্যাসীয় আবরণ সরে গেল৷ গণপতিবাবু আবার দেখতে পেলেন দুজনকে৷ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা৷ শুধু শিয়াল দুটোকে আর দেখতে পেলেন না গণপতিবাবু৷ চণ্ডীপতি এর পর বাঁশটা মাথার ওপর তুলে ধরলেন ভিনগ্রহীকে আঘাত করার জন্য৷ ভিনগ্রহী সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে একটা অস্ত্র টেনে চণ্ডীপতিকে তাক করে চালিয়ে দিল৷ একটা লাল আলোর রশ্মি চণ্ডীপতির দেহ ভেদ করে ওপর দিকে উঠে গিয়ে জমিদার বাড়ির দোতলার একটা অংশে গিয়ে লাগল৷ সঙ্গে সঙ্গে দোতলার সেই অংশ দাউদাউ করে জ্বলে উঠল৷ কিন্তু চণ্ডীপতির তাতে কিছুই হল না! অন্য পাশে সরে গেলেন তিনি৷ ভবিষ্যতের মানুষ আবার তাকে তাগ করে অস্ত্র চাললো৷ এবারও সেই লাল রশ্মি তাঁর দেহ ভেদ করে গিয়ে পড়ল বাঁশঝাড়ের এক অংশে৷ সঙ্গে সঙ্গে সেখানেও আগুন ধরে গেল৷
গণপতিবাবু অনুমান করলেন, সম্ভবত লেসার গান ধরনের কোনো অস্ত্র ব্যবহার করছে ভবিষ্যতের মানুষ৷ আর এরপরই ঘটল আরও আশ্চর্য ঘটনা৷ হঠাৎই যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন চণ্ডীপতি৷ কিন্তু তাঁর সেই লাঠিটা সপাটে আঘাত হেনে ভবিষ্যতের মানুষের হাত থেকে তার অস্ত্রটাকে খসিয়ে নিল৷ লাঠিটা উপর্যুপরি আঘাত হানতে লাগল ভবিষ্যতের মানুষের ওপর৷ প্রথমে সে পিছু হঠতে শুরু করল, তারপর সিঁড়ি বেয়ে সে উঠে গেল মহাকাশ যানের ভিতর৷ বন্ধ হয়ে গেল তার দরজা৷ কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ধুলোর ঝড় উঠল চারদিকে৷ আবার কেঁপে উঠল মাটি৷ চারপাশে আলোড়ন তুলে পৃথিবীর মাটি ছাড়ল ভবিষ্যতের মানুষের মহাকাশ যান৷
গণপতি যখন ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন তখন বাইরের প্রলয় থেমে গেছে৷ কিন্তু ধ্বংস চিহ্ন ছড়িয়ে আছে সর্বত্র৷ চণ্ডীপতিকেও আবার দেখতে পেলেন তিনি৷ বিস্মিত গণপতিবাবু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে৷
চণ্ডীপতি তাঁকে বললেন— যাক এবারের মতে বেঁচে গেলে৷ সে চলে গেছে৷ কিন্তু আমার সঙ্গী দুটো গেল৷ কী একটা বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করেছিল ভবিষ্যতের মানুষ৷ এই বলে তিনি আঙুল তুলে কিছুদূরে মাটির ওপর দেখালেন৷ শিয়াল দুটো সেখানে মারা পড়ে আছে৷
গণপতিবাবু বললেন— কিন্তু আপনি এই বিষাক্ত গ্যাস, লেসার গানের মতো ভয়ংকর অস্ত্রকে ফাঁকি দিলেন কী কৌশলে? আমি তো আপনাকে জীবিত দেখব ভাবিইনি৷ আপনি যখন অদৃশ্য হয়ে গেলেন, আমিতো ভাবলাম আপনি ছাই হয়ে গেছেন৷
—মানুষ হলে নিশ্চয়ই তাই হতাম৷ জবাব দিলেন ঠাকুরদা৷
—তার মানে?
চাঁদের আলোতে গণপতিবাবুর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে ঠাকুরদা বললেন, তুমি কী আমায় জ্যান্ত মানুষ ভাবতে নাকি? বেঁচে থাকলে কত বয়স হত খেয়াল করেছ? আমি তো আসলে অতীত৷ ওই যাকে অন্য কথায় বলে ভূত৷ আমি অতীত বলেই তোমার ভবিষ্যতের মানুষ কিছু করতে পারল না৷ যাক, তোমরা তো আবার বিজ্ঞানী৷ ভূত-ভগবান বিশ্বাস করো না৷
এর পর তিনি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বললেন— আমার আস্তানাটা গেল৷ যাক ভালোই হল, বাড়িটার মায়া কাটাতে পারছিলাম না, সেটা কাটল এবার৷ এখন আমাকে যেতে হবে৷
গণপতিবাবু বিস্মিত কণ্ঠে বললেন— কোথায় যাবেন আপনি?
চণ্ডীপতি বললেন, যাব গ্রহান্তরে৷ সে গ্রহেও মানুষ থাকে৷ তবে ভবিষ্যতের নয় অতীতের৷ সে গ্রহের নাম ব্রহ্মলোক৷ তোমাদের দুরবিন বা রেডিয়োতে ধরা পড়ে না সে গ্রহ৷ এই বলে বাতাসে মিশে গেলেন চণ্ডীপতি৷