ভুল
আগস্ট মাসের এক সকালবেলায় বিধুভূষণ নামক চল্লিশ–পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের এক ভ ভদ্রলোক অফিসে যাওয়ার জন্য কলেজ স্ট্রিটের এক বাসস্টপে দাঁড়িয়েছিলেন।
রাস্তা গিলতে গিলতে দোতলা বাসগুলো একটার–পর–একটা আসছিল। বিধুভূষণ সকলের মতো হাত তুলছিলেন, কিন্তু অতিরিক্ত বোঝাই ছিল বলে বাসগুলো থামল না। ড্রাইভার হাত নেড়ে পরের বাস–এ ইঙ্গিত করে গেল। এইভাবে পরপর তিনবার।
বিধুভূষণ একবার আড়চোখে দেখে নিলেন এখানকার পুরোনো বাসস্টপটা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না। না, সেরকম কোনও ঘটনা ঘটেনি। হাতে সময় ছিল। তিনি নিশ্চিন্তভাবে অপেক্ষা। করতে লাগলেন।
অবশেষে একটা বাস থামল। ‘নামতে দিন আগে–’ হাঁকল কন্ডাক্টর। সে দিকে কান না দিয়ে বিধুভূষণ সকলের সঙ্গে একজোটে ঢেউয়ের মতো ঝাঁপ খেলেন। কে নামল, কে উঠল তা তিনি বুঝলেন না, কিন্তু বাসটা ছেড়ে দেওয়ার পর বুঝলেন যে, তিনি উঠতে পারেননি। দু তিনজন লোক হইহই করে বাসটার পিছনে ছুটল। তিনি সেরকম কিছু না করে সতর্কভাবে হাত ঘড়ি, চশমা, মানিব্যাগ ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নিয়ে শান্তভাবে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আবছাভাবে তাঁর মনে হল একটা মোটা মতো লোক তাঁর সামনে পা–দানিটা আড়াল করেছিল–নইলে তিনি উঠতে পারতেন।
পরের বাসটাও এসে থামল। ‘নামতে দিন আগে–’ কন্ডাক্টর হাঁকল। সকলে ঢেউয়ের মতো ঝাঁপ খেল। সেই ভিড়ে বিধুভূষণ ইঁদুরের মতো দ্রুত চেষ্টায় একটা গর্ত খুঁড়ে নিলেন। এবারে হ্যান্ডেলটা ধরতে পারলেন তিনি। কিন্তু পা–দানিতে পা রাখতে পারলেন না। বাসটা ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি হ্যান্ডেল ছাড়লেন এবং বুঝলেন এবারও তিনি উঠতে পারেননি। এবারও তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন, কেন না এখনও সতেরো মিনিট সময় আছে। কিন্তু এবার তাঁর স্পষ্ট মনে হল একটা মোটামতো লোক–পাঞ্জাবি–পরা, ঘাড়ের চুল পুলিশদের মতো ছোট করে ছাঁটা–তাঁর পথ আটকে ছিল। তিনি দু-একবার চোখ বুলিয়ে লোকটাকে খুঁজলেন, সম্ভবত লোকটা উঠে গেছে। তিনি বিরক্তিকর ভিড় থেকে চোখ তুলে ল্যাম্পপোস্টে লটকানে চৌকো বাক্সের গায়ে একটা সিনেমার পোস্টার দেখতে লাগলেন। ‘এই তো আমাদের জাতীয় চরিত্র’–ভাবলেন তিনি–’মানুষের পথ আটকে রাখা, নিজে উঠে যাওয়া–এই সব।’
পরের বাসটা আসতে দেখে এবার সর্তক হলেন। এ বাসটাও থামল। ‘নামতে দিন আগে’–হাঁক কন্ডাক্টর। এবার তিনি ঢেউয়ে গা ছাড়লেন না। আগে থেকে সতর্ক ছিলেন বলে শক্ত থেকে কৌশলে তিনি হ্যান্ডেল ধরলেন। বারবার তিনবার। এইবার তিনি পাদানিতে পা রাখলেন।
কিন্তু নিয়তি। টের পেলেন কে যেন পিছন থেকে তাঁর কোমর ধরেছে। লোকটা টাল খাচ্ছে–তার নিশ্বাস বিধুভূষণের ঘাড়ের ওপর পড়ছিল। ‘আমি পড়ে যাচ্ছি যে, ও মশাই’ বিধুভূষণ। আর্তকণ্ঠে বললেন–’আমার কোমরটা ছেড়ে দিন।’ বিধুভূষণকে অবশেষে নামতে হয়। লোকটাই টেনে নামায় তাঁকে।
কখনও যা করেন না-এমনিতেই ভিতু, শান্তপ্রকৃতির বিধুভূষণ হঠাৎ তাই করলেন। ‘এটা কী হল?’ বলে লোকটার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। দেখলেন এই সেই লোক–পরনে পাঞ্জাবি, মাথার চুল পুলিশের মতো ছোট করে ছাঁটা–চর্বির পাহাড়। কোনও উত্তর দিল না লোকটা বিধুভূষণের দিকে চেয়েও দেখল না। অলসভাবে পান চিবোচ্ছিল। আধখোলা চোখ দুটো দেখে হঠাৎ মনে হয় লোকটা ঘুমিয়ে আছে।
এত রেগে গিয়েছিলেন বিধুভূষণ যে, তিনি তার পুরোনো হাঁপানির চাপটা অনুভব করলেন। তাঁর গলা আটকে আসছিল এবং হাত পা কাঁপছিল। মনে পড়ল তাঁর প্রেসার সম্প্রতি দু-শোর খুব কাছাকাছি গিয়েছিল–কোনওরকম উত্তেজনা ডাক্তারের বারণ। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বিধুভূষণ ঠান্ডা হয়ে গেলেন। রাস্তাঘাটে হাঙ্গামা উত্তেজনা তিনি সব সময়ে এড়িয়ে চলেন–তা ছাড়া তাঁর ভয় আছে হঠাৎ করোনারি অ্যাটাক হতে পারে। দুম করে মরে যেতে তিনি চান না।
বিধুভূষণ সরে এলেন। লোকটার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তিনি দাঁড়িয়ে দেখলেন পরপর তিনখানা একই নম্বরের বাস আসছে। তিনি সাবধানে লোকটাকে দূর থেকে একবার দেখে নিলেন। আশ্চর্য! বিধুভূষণের মনে হল তাঁর কোনও কথাই লোকটার কানে যায়নি। লোকটা বিধুভূষণ যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেদিকে তাকাল–কিন্তু বিধুভূষণকে দেখল বলে মনে হল না। যেন বিধুভূষণের দেহ ভেদ করে লোকটার দৃষ্টি সরে গেল। কোথাও বাধা পেল না। নির্বিকার লোকটির দিকে বিধুভূষণ তাকিয়ে রইলেন, আশ্চর্য!
তৃতীয় বাসটাতে জায়গা পেলেন বিধুভূষণ। যদিও ঠেলাঠেলি ভিড় ছিল তবু ভিতরে ঢুকতে পারলেন এবং রড ধরে দাঁড়ালেন। তাঁর অফিস পার্কস্ট্রিটে, ডালহৌসিতে বাসটা খালি হয়ে গেলে পার্কস্ট্রিট পর্যন্ত বসে যাওয়া যাবে। ঘড়ি দেখলেন বিধুভূষণ–প্রায় কুড়ি মিনিট কিংবা তারও কিছু বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তা হোক! আঠারো বছরের পুরোনো পোষা। চাকরি তাঁর–এটুকু খাতির তিনি পেতে পারেন–পানও।
ডালহৌসিতে বাসটা খালি হতে শুরু করল। ঠিক বিধুভূষণের সামনের সিট থেকে দুজনেই উঠে গেল–তাদের যাওয়ার জায়গাটা করে দিতে গিয়ে একটু কাত হলেন বিধুভূষণ। জানলার ধারের সিট বিধুভূষণের প্রিয়। লোকদুটো বেরিয়ে যাওয়া এবং বিধুভূষণের বসবার চেষ্টা করার ভিতরে যেটুকু সময়ের এবং দুরত্বের ব্যবধান ছিল তারই এক ফাঁক দিয়ে কী করে যে তা বিধুভূষণ বুঝলেন না-একটা মোটা মতো লোক ঢুকে গেল এবং জানলার ধারে বসে পড়ল। বিধুভূষণ তাকিয়ে দু-চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। আশ্চর্য! এ সেই লোকটা মোটামতো, পাঞ্জাবি পরা ঘাড়ের চুল পুলিশদের মতো ছোট করে ছাঁটা! মুহূর্তেই অন্যমনস্ক হয়ে গেল লোকটা, জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল, বিধুভূষণের দিকে ফিরেই তাকাল না। কার পাছার ধাক্কা খেয়ে বিধুভূষণ লোকটার পাশেই বসে পড়লেন।
তাহলে এসব কী হচ্ছে! বিধুভূষণ চোখ বুজে ভেবে দেখবার চেষ্টা করলেন। ছেলেবেলায়। লজিকে চান্স আর প্রব্যাবিলিটির যে কথা পড়েছিলেন তা মনে করবার চেষ্টা করে দেখলেন। কিছুই মনে পড়ল না। একবার সন্তর্পণে চোখ খুলে দেখলেন লোকটা তেমনি অন্যমনস্ক, বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বিধুভূষণ যে পাশে আছেন তা জানে বলে মনে হল না। বিধুভূষণ লক্ষ করলেন লোকটার মুখের বাঁ-পাশেঠিক চোখের কাছেই একটা লালচে আঁচিল রয়েছে।
তারপর ময়দানের খোলা হাওয়া লাগতেই বিধুভূষণের একটু ঢুলুনি এল। বারকয়েক ঝুঁকে পড়ল মাথা। নিজেকে এইভাবে ঘুমিয়ে নিতে দেন তিনি! জানেন, ঠিক স্টপেজে গাড়ি থামলেই তাঁর ঘুম ভেঙে যাবে। এই কোনওদিন অন্যথা হয়নি। এর সঙ্গে পাভলভের কন্ডিশনড রিফ্লেক্সের কোনও সম্পর্ক আছে কি না তা বিধুভূষণ ভেবে দেখেননি। কন্ডিশনড রিফ্লেক্সের কথা আবছাভাবে শুনেছেন তিনি। একটা কুকুরকে নিয়ে এই ধরনের পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। কিন্তু পৃথিবীর কোনও কুকুরের সঙ্গেই আজ পর্যন্ত তিনি নিজের সাযুজ্য খুঁজে পাননি।
আজও ঠিক স্টপেজে ঘুম ভাঙল এবং বিধুভূষণ ভাতঘুম থেকে জেগে উঠে আজকের যাবতীয় ঘটনার কথা ভুলে গিয়ে অফিসের দিকে হাঁটতে লাগলেন। ঘাড়ে মাথায় ময়দানের খোলা বাতাস লাগছিল। ভারী খুশি হয়ে উঠলেন তিনি।
অফিসে গিয়েই তিনি একগ্লাস জল খান। আজও খেলেন। হাজিরা খাতায় সই করলেন হাতঘড়ি দেখে। ঠিক পঁচিশ মিনিট লেট! তাই লিখে দিলেন। তারপর চক্রবর্তীর মুখোমুখি একই টেবিলে বসলেন বিধুভূষণ। চক্রবর্তী মাথা গুঁজে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে একটা ফাইল খুলে দেখছিল যা সে কখনও করে না। চক্রবর্তী মুখ তুলেই খুব নীচু গলায় বলল , ‘আজই লেট করলেন!’
‘কেন! আজ কী!’ জিগ্যেস করেন বিধুভূষণ।
‘আজ নতুন ম্যানেজার চার্জ নিয়েছে যে! বম্বে অফিসের লোক একটু কড়া ধাতের।’
হাসলেন বিধুভূষণ। সে হাসিতে আত্মপ্রত্যয় ছিল–চক্রবর্তী আড়চোখে দেখল।
দিনটা যেমন খারাপ যাবে বলে প্রথমটায় মনে হয়েছিল বিধুভূষণের তেমনটা হল না। লাঞ্চ পর্যন্ত বেশ কেটে গেল। বাকিটাও যাবে–এই ভেবে তিনি দুটি কলা দু-খানা বিস্কুট ও এক কাপ চায়ের টিফিন সেরে এসে চেয়ারে বসতেই বেয়ারা একটা চিরকুট নিয়ে এল। তাতে লেখা ‘ব্যাপারটা জরুরি। তাড়াতাড়ি আসুন।’ নীচে অস্পষ্ট সই। তার নীচে লেখা–’ম্যানেজার।’ একটু ভড়কে গেলেন বিধুভূষণ। গত আঠারো বছরে তিনি তিনবার মাত্র ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে তাঁর। মুখোমুখি হয়েছেন–তার মধ্যেও প্রথমবার সেই ইন্টারভিউয়ের সময়। দেখলেন চিরকুটটিতে সই ছাড়া আর বাদবাকি অংশ সুন্দর ঝরঝরে টাইপ করা। বুঝলেন–নতুন ম্যানেজার কাজের লোক কোনও বিষয় অস্পষ্ট রাখতে চান না। বেয়ারার মুখে সেলাম পাঠালেও হত–কিন্তু তা তিনি করেননি।
বিধুভূষণ কাউকে কিছু বললেন না। ব্যাপারটা গোপন রেখে তিনি দোতলা থেকে তিনতলায় উঠে এলেন। তিনতলায় মাত্র দুখানা ঘর–একখানা কমিটি রুম, অন্যটি ম্যানেজারের। দুটিই এয়ারকন্ডিশন করা–করিডোরে দাঁড়িয়েও সেই ঠান্ডা ভাব টের পাওয়া যায়। বিধুভূষণের প্রায় শীত ধরে গেল।
নিজের নামধাম লিখে একটা চিরকুট ভিতরে পাঠানোর পরও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। দুজন লোকসুটপরা–ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার পর তাঁর ডাক পড়ল। বিধুভূষণ প্রকাণ্ড দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন। দরজাটা তাঁর পিছনে আবার নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।
সবকিছুই প্রকাণ্ড দেখলেন বিধুভূষণ। প্রকাণ্ড জানলা, প্রকাণ্ড শেলফ, প্রকাণ্ড টেবিল–সবকিছুই খুব চকচকে ঝকঝকে। দেখলেন আরও অনেক আসবাব রয়েছে যার নাম তাঁর জানা নেই। এত কিছুর ভিতরে লোকটাকে চোখেই পড়ে না।
লোকটা–নতুন ম্যানেজার–কিন্তু মুখ তুলল না, বিধুভূষণের নামধাম লেখা চিরকুটটার দিকে চোখ রেখে বলল , ‘আপনি ব্যাঙ্কিংয়ের কিছু জানেন?’
বিধুভূষণকে কেউ একবার শূন্যে তুলেই নামিয়ে দিল–কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তার ওজনটা চুরি করে নিল। নিজেকে খুব হালকা অনুভব করলেন বিধুভূষণ–পাছে পাখার বাতাসে উড়ে যান সেই ভয়ে সামনের চেয়ারে পিছনটা চেপে ধরতেই তাঁর খেয়াল হল–এই ঘরে পাখা নেই।
চেয়ারটা চেপে ধরতে গেলে কোনও শব্দ হয়ে থাকবে। ম্যানেজার তাঁর অন্যমনস্ক চোখ তুলে বিধুভূষণকে দেখলেন। আবার একে না-দেখাও বলা যায়। সে দৃষ্টি বিধুভূষণকে ভেদ করে গেল। কোনওখানে বাধা পেল না। কিন্তু বিধুভূষণ দেখলেন বাঁ-চোখের পাশে সেই লালচে আঁচিল–মাথার চুল পুলিশদের মতো ছোট করে ছাঁটা, চর্বির পাহাড়। কী করে সম্ভব হল! আশ্চর্য!
‘স্যার…!’ বিধুভূষণ বললেন।
‘আমাদের কাজের সঙ্গে ব্যাঙ্কিংয়ের যোগাযোগ বেশি। আমার মনে হয়, আপনার ব্যাঙ্কিংটা শিখে নিতে হবে।’ ম্যানেজার বললেন, ‘আপনার বয়স কত?
‘আজ্ঞে?’ বিধুভূষণ কোনওরকমে মাথা ঠিক রেখে বললেন, ‘তেতাল্লিশ।’
‘তা এমন আর বেশি কী? এই বয়সেও অনেকে শেখে।’ ম্যানেজারকে একটু চিন্তিত দেখাল, ‘কিন্তু আপনাকে আরও বুড়ো দেখায়। ধরুন পঞ্চাশ টঞ্চাশ!’ একটু হাসলেন ম্যানেজার
সার্টিফিকেটের বয়স তা হলে তেতাল্লিশ?’
‘মানে, আমার আসল বয়সও…’
“ঠিক আছে।’ হাত তুলে বিধুভূষণকে থামালেন ম্যানেজার ‘কয়েকটা বই আপনাকে পড়তে হবে।’ ম্যানেজার খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। বিধুভূষণকে দেখেও দেখলেন না। কিন্তু চোখ দুটো বিধুভূষণের দিকেই রাখা আছে।
‘স্যার…’ বিধুভূষণ প্রায় লিত কণ্ঠে বলবার চেষ্টা করলেন ‘বাসের সেই ব্যাপারটা।’
‘আপনাকে একটা অফিসিয়াল পরীক্ষাতেও পাশ করতে হবে।’ বিধুভূষণের কথায় কান না দিয়ে ম্যানেজার বললেন।
‘…ব্যাপারটার জন্য আমি দুঃখিত।’ বিধুভূষণ তাঁর কথা শেষ করেন।
‘কোন ব্যাপারটা?’ ভ্রূ কোঁচকালেন ম্যানেজার।
‘কলেজ স্ট্রিটে পৌনে দশটা–না, দশটা বাজতে সতেরো মিনিটের সময়…’
‘কী হয়েছিল?
বিধুভূষণ অসহায়ভাবে মেঝের কার্পেটের দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘ব্যবহারটা খুবই খারাপ হয়েছিল স্যার–আমি স্বীকার করছি। আপনাকে চিনতে পারিনি!’
‘কখন? কোথায়?’
‘কলেজ স্ট্রিটে স্যার, পৌনে দশটায়না,দশটা বাজতে সতেরো মিনিটের সময়…’
‘পৌনে দশটা! কলেজ স্ট্রিট!’ ম্যানেজারকে খুব অন্যমনস্ক দেখাল, ‘কিন্তু আমি তো অনেক আগে অফিসে এসেছি! সাড়ে ন’টায়।’ বলেই সকৌতুকে বিধুভূষণের দিকে তাকিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হাসলেন ম্যানেজার, ‘আপনি আমাকে পেলেন কোথায়? আর আমার ফ্ল্যাট তো বালিগঞ্জে!’
বিধুভূষণ কথা খুঁজে পেলেন না। কিন্তু তাঁর মনে হচ্ছিল এর উত্তরে উপযুক্ত যে কথাগুলো বলা যায় সেগুলো তাঁর মাথার চারপাশে বাতাসের ভিতরে বিজবিজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারই দু-একটা ধরবার জন্য তিনি মাথা ঝাঁকালেন, কান চুলকোলেন, হাত দিয়ে মশা তাড়ানোর মতো বাতাসে ঝাঁপটা মারলেন। শেষপর্যন্ত তাঁর মুখ দিয়ে বেরোল, ‘ভুল স্যার…সবই ভুল…’
‘Crasy?’ হাসলেন ম্যানেজার, ‘কিন্তু ব্যাঙ্কিংটা ভুললে চলবে না। মনে থাকবে?
অসহায় বিধুভূষণ মাথা নাড়লেন–থাকবে।
‘আর দেখছি–আপনি আজ পঁচিশ মিনিট লেট!’ বলে সোনার চেনে বাঁধা গাড়ির চাবিটা বোঁ করে ঘোরালেন ম্যানেজার। বিধুভূষণের মনে পড়ল ম্যানেজারের গাড়ি আছে–অফিস থেকেই গাড়ি দেওয়া হয়। চাবিটা ঘোরাতে–ঘোরাতেই ম্যানেজার বললেন, ‘এরকম যেন আর না হয়।’
কি না হওয়ার জন্য বলেছেন ম্যানেজার, তা না বুঝেই বিধুভূষণ মাথা নাড়লেন–হবে না।
‘আপনি আসুন তাহলে…’ ম্যানেজার বললেন, তাঁর হাতে তখনও চাবিটা ঘুরছে, তিনি অস্ফুট গলায় বললেন, ‘পৌনে দশটা! কলেজ স্ট্রিট!’
বিধুভূষণ ফিরে আসছিলেন, কী একটা শব্দে পিছন ফিরে দেখলেন ম্যানেজারের হাত থেকে চাবিটা ছিটকে প্রথমে গ্লাসটপ টেবিলের ধারে লেগে মেঝের কার্পেটের ওপর পড়ে গেল। অন্যমনস্ক ম্যানেজার সেটা তুলতে নীচু হতেই ভীষণ চমকে উঠলেন বিধুভূষণ। তাঁর মনে হল ম্যানেজারের পিছন দিকটা কলকবজায় ভরা। রেডিওর পিছনের ঢাকনাটা খুলে ফেলল ভেতরটা যেমন দেখায়, অনেকটা তেমনি। মনে হল কোমরে একটা প্লাগ লাগানো আছে যার তার কোনও গুপ্ত প্লাগ পয়েন্ট পর্যন্ত গেছে! বিস্ময়ে ঘুরে দাঁড়ালেন বিধুভূষণ। এক পলকের ভুল সংশোধন করে ম্যানেজার আবার সোজা হয়ে বসেছেন তখন, গম্ভীর মুখ, চোখ অন্যমনস্ক। ধীরে বললেন, ‘আপনি আসুন।’
বিধুভূষণ কিছুই বললেন না। তাঁর মনে হল তিনি এক অদৃশ্য বেতার সংকেত পেলেন, ম্যানেজারের দূরমনস্ক চোখ যেন বলল , ‘কী করা যাবে বলুন, চাবিটা পড়ে গেছে–সুতরাং সেটা কুড়িয়ে নেওয়াই নিয়ম! একটা ভুল হয়ে গেছে–আপনি আমার কলকবজা দেখে ফেলেছেন। কিন্তু আমার কি করার ছিল?
বিধুভূষণ একটু ইতস্তত করলেন। কিন্তু ম্যানেজারের পিছন দিকটা আর দেখা গেল না। এবার উনি খুব সতর্ক। বিধুভূষণকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার?
‘কিছুনা স্যার!’ বিধুভূষণ খানিকটা দুঃসাহসে ভর করে হাসলেন, ‘আপনার পিছনটা…’
‘আমার পিছনটা..! ম্যানেজার হাঁ করে বিধুভূষণকে দেখতে লাগলেন।
‘আজ্ঞে, আমি দেখে ফেলেছি!’ দুষ্টু ছেলের মতো মুখ করলেন বিধুভূষণ।
কী দেখেছেন?’ প্রশ্ন করলেন ম্যানেজার।
‘আপনার পিছনে…’বলতে গেলেন বিধুভূষণ।
প্রায় লাফিয়ে উঠলেন ম্যানেজার, ‘কী? কাঁকড়াবিছে? আরশোলা?’ উঠে দাঁড়ালেন ম্যানেজার।
বিধুভূষণ দেখলেন। না, কলকবজা কিছুই নেই। পাঞ্জাবির সাদা পিঠ দেখা যাচ্ছে। এ কি চোখে দেখবার ভুল। নিজের চোখ কচলালেন বিধুভূষণ। কোনওক্রমে বললেন, ‘ভুল স্যার…সবই ভুল…’
মুহূর্তেই ম্যানেজারের ফরসা মুখ রাঙা হয়ে গেল। তিনি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। দু-হাতে পাঞ্জাবির পিছন দিকটা ঝাড়বার চেষ্টা করেছিলেন। হঠাৎ বিধুভূষণের কথা শুনে তিনি যেন আরশোলা বা কাঁকড়াবিছে খুঁজে না পেয়ে ভয়ংকর রেগে গিয়ে বললেন, ‘নাউ গেট ইওরসেলফ আউট! ইউ…ইউ…!’
বিধুভূষণ নিঃশব্দে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন। আসতে-আসতে শুনলেন ম্যানেজার চাপা রাগের গলায় বলছেন, ‘কলেজ স্ট্রিট…পৌনে দশটা…আমার পিছনটা…কাঁকড়াবিছে…আরশোলা! এর মানে কী?’
‘ভুল…স্যার…সবই ভুল…’ বিধুভূষণ মনে-মনে বললেন। বাইরে এসে করিডোর ধরে এগিয়ে গেলেন তিনি। চাকরিটা বোধহয় আর রাখা গেল না। কিন্তু কেন? কেন? কোথায় ভুল হচ্ছে।
নিজের সিটে এসে বসবার কিছুক্ষণ পরেই সেকশন ইনচার্জ-এর একটা চিরকুট পেলেন বিধুভূষণ। তাতে লেখা : ‘ম্যানেজারের আদেশ মতো আপনাকে জানানো হচ্ছে যে, ম্যানেজার মনে করেন আপনি আজ খুব সুস্থ নন। আপনাকে অফিস ছেড়ে যাওয়ার এবং বিশ্রাম নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। আজ এখন আপনার ছুটি।’ নীচে অস্পষ্ট সই। তার নীচে লেখা ‘সেকশন ইনচার্জ।’
মুহূর্তেই খুশি হয়ে উঠলেন বিধুভূষণ। গত আঠারো বছর চাকরিতে এই প্রথম তিনি একা ওপরওয়ালার ইচ্ছেয় ছুটি পেয়েছেন। কাউকে কিছু বললেন না বিধুভূষণ, চক্রবর্তীকেও না। তাড়াতাড়ি ফাইলে কাগজপত্র বেঁধে–হেঁদে রাখলেন। আশ্চর্য! তাঁর বিশ্রাম দরকার! কথাটা তাঁর নিজেরও অনেকবার মনে হয়েছে। আশ্চর্য!
বেরিয়ে পড়লেন বিধুভূষণ। বেরিয়েই একটা ট্যাক্সি ধরলেন। পিছনের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বললেন, ‘কলেজ স্ট্রিট–না, না, কলেজ রো…’
ট্যাক্সি দ্রুত চলল। হুহু করে হাওয়া লাগছিল বিধুভূষণের চোখে–মুখে। মুহূর্তেই ভাতঘুমটা ফিরে আসতে চাইছে টের পেয়ে যেন আধাস্বপ্নের ভিতর হাসলেন বিধুভূষণ। অনেক কিছুর শখ ছিল তাঁর। নিজের এমনি একটা গাড়ি থাকলে এমনি ঘুমিয়ে–ঘুমিয়ে অফিসে আসতে পারতেন তিনি, ঘুমিয়ে যেতেও পারতেন। না, কিছুই হয় না নিজের মনোমতো, কখনওই হয় না। কিন্তু কেন?
সামান্য চোখ খুলে তিনি বাইরের দিকটা দেখলেন। খানিকক্ষণ দেখেই চমকে উঠলেন তিনি –এ তো রেড রোড। আশ্চর্য! এ রাস্তায় তো তাঁর আসবার কথা নয়। ঝাঁঝিয়ে উঠলেন তিনি ‘এটা কী হল, অ ট্যাক্সি ড্রাইভার?’ ‘এটা তো রেড রোড…ধর্মতলা যে…’ ট্যাক্সিওয়ালা মুখ ঘোরাতেই খানিকটা থতমত খেয়ে আমতা-আমতা করে বিধুভূষণ বললেন, ‘ভুল স্যার…সবই ভুল…’ তিনি চোখ বুজে ফেললেন। কেন না ততক্ষণে ট্যাক্সি ড্রাইভারের বাঁ চোখের পাশে লালচে আঁচিলটা। দেখে ফেলেছেন, সেই পুলিশদের মতো ছোট করে ছাঁটা চুল, পরনে পাঞ্জাবি। আশ্চর্য! আর কিছুই দেখতে চাইলেন না বিধুভূষণ। শুধু আর-একবার বিড়বিড় করলেন ‘ভুল স্যার…’
ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে নিলে অনেকক্ষণ পর আর-একবার অতি সন্তর্পণে চোখ খুললেন বিধুভূষণ। টেলিভিশন তিনি কখনও দেখেননি। কিন্তু তাঁর হঠাৎ মনে হল সামনের উইন্ডস্ক্রিন। জুড়ে ছবি ভেসে উঠেছে, অচেনা পথঘাট, অচেনা গাছ, অদেখা বাড়ি–ঘর, লোকজন। এ কি বিদেশ! এত সহজে বিদেশ! এত অল্প সময়ে! না কি টেলিভিশন! মোটা ফরসা ম্যানেজারের কাঁধের পাশ দিয়ে কিছুক্ষণ সেই টেলিভিশন দেখে তিনি আর-একবার বলবার চেষ্টা করলেন ‘ভুল স্যার..সবই ভুল…’ম্যানেজার–এখন ড্রাইভার–তাঁকে লক্ষই করল না।
চোখ বুজে হঠাৎ পরম আরামে ঘুমিয়ে পড়লেন বিধুভূষণ।
কলেজ রো–তে নেমে ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে দিলেন তিনি। ভাড়াটা সরাসরি ম্যানেজারের হাতে দিতে একটু লজ্জা করছিল তাঁর। ম্যানেজার সেদিকে ক্ষেপও করল না, তাঁর দিকেও তাকাল না। এমন কি ভাড়ার এক টাকা কুড়ি পয়সা গুনেও নিল না। বিধুভূষণ বিনীতভাবে নমস্কার করলেন তাঁকে।
ট্যাক্সিটা চলে গেল। সেইদিকে চেয়ে রইলেন বিধুভূষণ। আশ্চর্য!
বাড়িতে ঢুকতেই একটা হইচই পড়ে গেল। বড় দুই ছেলেমেয়ে ছুটে এল, গিন্নি নেমে এলেন হাঁপাতে-হাঁপাতে, ‘কি গো, কী হয়েছে তোমার? শরীর–টরীর?
মৃদু হেসে বরাভয়ের ভঙ্গিতে হাত তুলে তাদের নিরস্ত করলেন বিধুভূষণ, ‘কিছু হয়নি।’
‘তাহলে অফিস?’
‘ছুটি হয়ে গেল আজ।’
‘কেন গো?’
হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিধুভূষণ, ‘একজন কেরানি মারা গেল হঠাৎ। তাই..’ একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমাকে বিরক্ত কোরো না কেউ। আমি একটু ঘুমোব।’ বলে সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে এলেন বিধুভূষণ। সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিলেন।
কী করে, কোন পথে গেলে লোকটাকে এড়ানো যায়–তা বিধুভূষণ ভেবে পেলেন না। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকবেন! কিন্তু সেটা কেমন দেখাবে? তা ছাড়া তাঁর ছেলেমেয়েরাও বড় হয়নি–বুড়ো মা-বাবাকে টাকা পাঠাতে হয়–গিন্নিকে নিয়ে তাঁর সাধআহ্লাদ এখনও মেটেনি। কী করবেন বিধুভূষণ?
অনেক ভেবে–টেবে দেখলেন বিধুভূষণ। তাঁর মনে হল এ ব্যাপারটা কাউকে জানিয়ে দিলে হয়। কাকে জানাতে হবে তার কিছুই তিনি জানেন না। তবু আবছাভাবে তাঁর মনে হল এ ব্যাপারে একটা যুক্তিপূর্ণ অভিযোগ তিনি খাড়া করতে পারেন।
কিছুই জানেন না বিধুভূষণ কাকে জানাবেন কী জানাবেন–এবং কীভাবে জানাবেন–তবু তিনি গোটা দুই ফুলস্ক্যাপ কাগজ তাঁর ছেলের লম্বা খাতা থেকে ছিঁড়ে নিলেন। তারপর কলম বাগিয়ে বসলেন তিনি।
পাঠ লিখলেন : ‘মান্যবরেষু।’
তারপর লিখলেন : আমার একটি অভিযোগ আছে…
তারপর কী লিখবেন ভেবে না পেয়ে কলম কামড়ে ধরে জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কোথায় কী একটা গোলমাল রয়েছে, ষড়যন্ত্র রয়েছে যা কিছুতেই ধরতে পারছেন না তিনি। উঠে খানিকক্ষণ পায়চারি করলেন। আবার বসলেন, খানিকটা আঁকিবুকি করলেন কাগজটার ওপর। আরও কাগজ ছিড়লেন খাতা থেকে। তারপর টেবিলে মাথা রেখে আস্তে-আস্তে ঘুমিয়ে পড়লেন বিধুভূষণ।
ঘুম ভাঙল গিন্নির ডাকে। ধড়মড় করে উঠে দেখলেন অন্ধকার হয়ে এসেছে। দরজা খুলে দিতেই গিন্নি বললেন ‘এত ঘুম!’ বেঁকিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন বিধুভূষণ হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল। এতক্ষণ অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। স্বপ্ন দেখেছেন যে একটা স্বপ্ন দেখে তাঁর ঘুম ভেঙে গেছে–কিন্তু আশ্চর্য হচ্ছে এই যে সেই ঘুম ভাঙাটাও আসলে স্বপ্নের ভিতরেই ঘটেছে–তারপর আরও একবার ঘুম ভাঙল, তাঁর মনে হল আগের জেগে ওঠাটাই স্বপ্ন ছিল। এইভাবে একটার–পর একটা স্বপ্ন ভাঙছিল তাঁর আরও মনে হচ্ছিল আগের স্বপ্নটাই ছিল স্বপ্ন, আগের ঘুমটাই ছিল ঘুম। স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্ন, তার ভিতরে স্বপ্ন এবং প্রতিটি স্বপ্নই ভেঙে যাওয়ার স্বপ্ন। এই ভাবে ঘুমের ভিতরে ঘুম ভেঙে যাওয়ার স্বপ্ন এবং তারও ভিতরে ঘুম ভেঙে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে-দেখতে কতদূর তলিয়ে গিয়েছিলেন বিধুভূষণ? ভেবেই উত্তেজিত হলেন বিধুভূষণ। রক্তচাপ বেড়ে গেল। গিন্নিকে বললেন, ‘আমায় একটা রামচিমটি কাটো তো! প্রথম-প্রথম যেমন কাটতে!’
‘কেন গো?’
‘বুঝতে পারছি না জেগে আছি কি না।’
‘আহা।’ গিন্নি বললেন।
‘দ্যাখো না!’
গিন্নি ফিক করে হেসে ফেললেন। হাসিটা চমৎকার, দুপাশে দুটি ছোট-ছোট আক্কেল দাঁত দেখা যায়–এখনও বুকের ভিতর তোলপাড় করে ওঠে বিধুভূষণের। তিনি দুই ব্যগ্র হাত বাড়িয়ে দিতেই গিন্নি ছুটে পালালেন।
বিধুভূষণ হাই তুললেন। লাইট জ্বাললেন। তারপর চুপচাপ টেবিলের ওপর অভিযোগ পত্রটার দিকে তাকিয়ে রইলেন : ‘মান্যবরেষু, আমার একটি অভিযোগ আছে…’ ব্যস, আর কিছু লেখা নেই।
গিন্নি চা নিয়ে এলেন কিছুক্ষণ পর। চায়ের কাপটা রেখে সদ্য বাঁধা খোঁপাটা ঠিকঠাক করতে করতে হঠাৎ বললেন, ‘ওঃ, তোমায় বলতে ভুলে গেছি। তুমি যখন ঘুমোচ্ছিলে তখন তোমায় খুঁজতে একটা লোক এসেছিল।’
চায়ের কাপটা প্রায় উলটে ফেলে ঘুরে দাঁড়ালেন বিধুভূষণ, ‘কে?’
গিন্নি হেসে বললেন, ‘কে যেন চিনি না। একটা চিরকুট দিয়ে গেছে।’
‘কেমন চেহারা লোকটার?’ রুদ্ধশ্বাসে বললেন বিধুভূষণ।
‘তেমন লক্ষ করিনি তো! তবে বেশ সুন্দর চেহারা। ফরসা, মোটা–সোটা, ছোট করে ছাঁটা চুল।’
‘পুলিশদের মতো?’
‘না, পুলিশ–টুলিশ মনে হল না তো?’
‘আহা, পুলিশ কে বলছে! বলছি চুলটা কি পুলিশদের মতো?’
‘কী জানি বাপু!’ রসালো ঠোঁট উলটে বললেন গিন্নি। কিন্তু সেদিকে লক্ষ করলেন না বিধুভূষণ, জিগ্যেস করলেন, ‘বাঁ-চোখের পাশে একটা লালচে আঁচিল ছিল? মনে করে দ্যাখো তো?’
গিন্নি খানিকক্ষণ ভেবে বললেন, ‘ঠিক মনে পড়ছে না, তবে হতে পারে। চোখ দুটো যেন কেমন বাপু, এমন হাঁ করে দেখছিল। মনে হচ্ছিল কোথায় যেন…’
‘ম্যানেজার…’ প্রায় আর্তকণ্ঠে বললেন বিধুভূষণ।
‘কে? কার কথা বলছ!’
জবাব দিলেন না বিধুভূষণ, হঠাৎ দু-হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘কই দেখি!’
চমকে দু-হাত পিছিয়ে গেলেন, গিন্নি, বললেন, ‘কী চাইছ? তোমার লজ্জা শরম…’
‘আহা ওসব নয়, চিরকুটটা দেখি!’
‘ওঃ! যেন খানিকটা হতাশ হলেন গিন্নি। আঁচলের গেরো খুলে চিরকুটটা দিলেন বিধুভূষণের হাতে। চলে যেতে-যেতে প্রায় হতাশ অস্ফুট গলায় বললেন, ‘কী যে হয়েছে তোমার…’
চিরকুটটা খুলে স্তব্ধ হয়ে গেলেন বিধুভূষণ। ঝকঝকে টাইপ পরা ছোট্ট একটু চিঠি : ‘এতদ্বারা শ্ৰীবিধুভূষণ সরকারকে জানানো যাইতেছে যে আমরা তাহার অভিযোগপত্রটির প্রাপ্তি স্বীকার করিতেছি…’
তাড়াতাড়ি আবার টেবিল হাতড়ে দেখলেন বিধুভূষণ–অভিযোগপত্রটা তখনও লেখাই হয়নি, শুধু পাঠটুকু লেখা আছে: মান্যবরেষু, আমার একটি অভিযোগ আছে…।’
আস্তে-আস্তে আবছাভাবে বুঝলেন বিধুভূষণ–এই অদ্ভুত খানাতল্লাশি থেকে তাঁর কোনও রেহাই নেই। আবছাভাবে তিনি ম্যানেজারের পিছনের সেই কলকবজা, প্লাগ ও গুপ্ত প্লাগ পয়েন্ট, বেতার সংকেত ও টেলিভিশনের অর্থ ধরতে পারলেন।
হতাশভাবে বসে রইলেন বিধুভূষণ। না, তাঁর আর কিছুই করবার নেই।