ভীষণ ভুল

ভীষণ ভুল

প্রথম পরিচ্ছেদ

আমাকে মুর্শিদাবাদের ন্যায় স্থানে কখনও যে বাস করিতে হইবে, তাহা আদৌ মনে করি নাই; তবে ঘটনাচক্রে পড়িয়া মানুষকে সকলই করিতে হয়; সম্প্রতি আমি এখানকার কালেজের প্রফেসর হইয়া আসিয়াছি, এবং কলিকাতার লোক হইয়া কলিকাতা ছাড়িয়া এই সুদূর মুর্শিদাবাদে বাসা লইতে হইয়াছে।

কেন জানি না প্রথম হইতেই স্থানটা আমার ভাল লাগে নাই, এখানকার লোকের সহিতও আমার মনের মিল হয় নাই, তাহারাও বোধ হয়, সেজন্য কিছুমাত্র দুঃখিত নহে; যে কারণেই হউক, এখানকার লোকের সহিত আমারও ঘনিষ্ঠতা ঘটিয়া উঠে নাই—কেহ বড় আমার কাছে আসিত না, আমিও বড় কাহারও কাছে যাইতাম না—একমাত্র ডাক্তার কেশববাবুর সহিত আমার বন্ধুত্ব হইয়াছিল। সময় পাইলে তিনি আমার সহিত দেখা করিতে আসিতেন।

আমি আজও এইমাত্র মনে করিতেছিলাম যে, তিনি আজ দেখা করিতে আসিবেন; কিন্তু বাহিরে কাহার কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম—ইনি আবার কে? আমি কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া তাঁহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম।

একটু পরে এক কঙ্কালসার ভদ্রলোক আমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহাকে পূৰ্ব্বে আর কখনও যে আমি দেখিয়াছি, তাহা আমার স্মরণ হইল না। আমি উঠিয়া অপরিচিত ব্যক্তিকে যেরূপ অভ্যর্থনা করা কর্তব্য, তাহাই করিলাম। তিনি আমার নিকটস্থ হইয়া ম্লানহাস্যের সহিত বলিলেন, “আমার চেহারার যে বিশেষ পরিবর্ত্তন হইয়াছে, তাহা আমি জানি, অথচ কেবল কয় বৎসর দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই।”

তখন আমি তাঁহাকে চিনিতে পারিলাম; এক সময়ে হরনাথের সহিত—একশ্রেণীতে না হইলেও এক কালেজে পড়িয়াছিলাম। আমি তাঁহার অনেক নীচের শ্রেণীতে পড়িতাম। এক সময়ে আমার অর্থস্বাচ্ছল্য একেবারেই ছিল না, সে সময়ে হরনাথ আমায় নানা প্রকারে সাহায্য করিয়াছিলেন, নানা কারণে আমি তাঁহার নিকটে ঋণী ছিলাম।

আমি লজ্জিত হইয়া বলিলাম, “হরনাথবাবু, কি আশ্চর্য্য, আপনাকে দেখিলে আর চিনিতে পারা যায় না! কে ভাবিয়াছিল, আপনার সঙ্গে এখানে—এই নির্ব্বান্ধবপুরীতে দেখা হইবে?”

যথার্থই হরনাথের বিশেষ পরিবর্তন হইয়াছিল। দেখিলে বোধ হয়, যেন তাঁহার আরও বিশ বৎসর বয়স বৃদ্ধি হইয়া গিয়াছে; কালবার্দ্ধক্য তাঁহাকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে অধিকার করিয়াছে; দেখিয়া মনে হয়, তিনি কোন কঠিন রোগ ভোগ করিতেছেন।

আমি তামাক দিতে উদ্যত হইলে, তিনি বলিলেন, “ও সব আমি অনেক দিন একেবারে ছাড়িয়া দিয়াছি—এখন যে কাজে নিযুক্ত হইয়াছি, তাহাতে মাথাটা খুব সাফ্ রাখা উচিত।”

এই বলিয়া তিনি চঞ্চলভাবে হাত দিয়া মুখটা দুই-তিনবার মুছিলেন। আর কখনও আমি তাঁহাকে এরূপভাবে দেখি নাই। আমি বলিলাম, “আপনি মুর্শিদাবাদে কেন?”

তিনি বলিলেন, “প্রায় তিনমাস হইতে আমরা এখানে বাস করিতেছি, কেবল কাল শুনিলাম যে, তুমি এখানে প্রফেসার হইয়া আসিয়াছ।”

“তাহা হইলে আপনি আমার কোন পত্র পান্ নাই?”

“না। না পাইবার কারণও আছে—আমি একস্থানে ছিলাম না।”

“কোথায় ছিলেন?”

“পশ্চিমে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম, এখন এইখানে আমি আর কমলা বাস করিব মনে করিয়াছি?”

কেবল কমলা কেন—তাঁহার স্ত্রী ও তাঁহার অপর কন্যা বিমলা কোথায়? বোধ হয়, হরনাথ আমার মনের ভাব বুঝিলেন, বলিলেন, “গত বৎসর আমার স্ত্রীর মৃত্যু হইয়াছে, তাহার মৃত্যুর পরেই আমি আমার বিমলাকেও হারাইয়ছি—” তাঁহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়া আসিল।

আমি অস্পষ্টস্বরে দুই-একটা সহানুভূতিব্যঞ্জক কথা বলিলাম, কিন্তু হরনাথ সে কথায় কান না দিয়া বলিলেন, “কমলার এখনও বিবাহ দিতে পারি নাই—সে বয়স্থা হইয়াছে।”

এ সকল কথায় হরনাথের কষ্ট হইতেছে দেখিয়া আমি অন্য কথা তুলিবার চেষ্টা পাইলাম; আমি জানিতাম, তাঁহার যেরূপ টাকা আছে, তাহাতে তাঁহার বসিয়া খাওয়া চলে; আরও জানিতাম, তাঁহার বই লিখিবার বাতিক আছে, আমি জিজ্ঞাসিলাম, “এখন নূতন কিছু লিখিতেছেন?”

“হাঁ, একখানা সম্পূর্ণ নূতন ধরণের বই লিখিতেছি।”

“বটে, কি সেখানা?”

“পাপিষ্ঠ-প্রতিভা’ বলিয়া একখানি বই লিখিতেছি। আমার বিশ্বাস চোর, ডাকাত, জালিয়াৎ, খুনীর মধ্যে যত ক্ষমতাপন্ন শক্তিশালী ব্যক্তি জন্মিয়াছে, তত আর অন্যত্র জন্মায় নাই, যথার্থ প্রতিভাশালীর অনুসন্ধান করিতে হইলে, পাপিষ্ঠের মধ্যেই অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।”

হরনাথ অতি স্থিরভাবে কথাগুলি বলিলেন বটে, কিন্তু আমি ইহা বিদ্রূপ ভাবিলাম। কি উত্তর দিব ভাবিতেছি, এই সময়ে ডাক্তার কেশববাবু তথায় উপস্থিত হইলেন। আমার নিকট একজন অপরিচিত লোক রহিয়াছে দেখিয়া তিনি সরিয়া পড়িবার চেষ্টায় রহিলেন; কিন্তু আমি তাঁহাকে যাইতে দিলাম না, তাঁহার সহিত হরনাথের পরিচয় করিয়া দিলাম। হরনাথকে বলিলাম, “দুর্বৃত্ত সম্বন্ধে যদি আলোচনা করিতে চাহেন, তবে আমাদের এই ডাক্তারের সহিত আলোচনা করুন; ডাক্তারকে সরকারী কাজে অনেক চোর ডাকাত খুনী সর্ব্বদাই দেখিতে হয়। ইনি আপনার কতক উপকরণ সংগ্রহ করিয়া দিতে পারিবেন।”

হরনাথ অতি শঙ্কিতভাবে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনাকে তাহা হইলে সৰ্ব্বদাই দুর্বৃত্তগণের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করিতে হয়?”

ডাক্তার বলিলেন, “সৰ্ব্বদা নহে—তবে অনেক সময়েই দুৰ্ব্বত্তগণ যাহাদের সর্ব্বনাশ করে, তাহাদিগকে আমায় দেখিতে হয়; কিন্তু সেটা যে বড় সুখের কাজ নয়, তাহা আপনি নিশ্চয়ই বুঝিতে পারেন। এই একটু আগে একটী বৃদ্ধ লোকের অঙ্গ-ব্যবচ্ছেদ পরীক্ষা করিতে হইয়াছে— মোগল পাড়ায় লোকটী খুন হইয়াছে!”

আমি বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলাম, “খুন! কোথায়?”

ডাক্তার বলিলেন, “আশ্চর্য্য! তুমি এ কথা এখনও শোন নাই? এই খুন লইয়া সহরময় খুব হৈ-চৈ পড়িয়া গিয়াছে। এরূপ খুন বড়-একটা ঘটে না; আশ্চর্য্যের বিষয়—পুলিস খুনীকে ধরিতে পারে নাই।”

হরনাথের মুখ হইতে কেমন একটা বিশৃঙ্খল হাস্যধ্বনি উত্থিত হইল। আমরা উভয়েই তাঁহার মুখের দিকে চাহিলাম, কিন্তু দেখিলাম, তাঁহার অবিচলিত ভাব, সে ব্যক্তি যে এ কথা শুনিয়া বিন্দুমাত্র বিস্মিত হইয়াছেন, তাহা বোধ হয় না।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ডাক্তার বলিলেন, “যাহা ঘটিয়াছে, তাহা এই;–যোধমল মাড়োয়ারী খুন হইয়াছে। সত্যেন্দ্র বাবু! বোধ হয়, আপনি এই লোকটার নাম শুনিয়াছেন, চকে ইহার খুব বড় গদী, টাকা ধার দেওয়াই ইহার ব্যবসায়, বলা বাহুল্য, সুদ সম্বন্ধে এ জোঁকের অপেক্ষাও শোষক ছিল। কাল তাহার নিজের গদীর মধ্যে, চকের মত জনপূর্ণ স্থানে, দিনের বেলায় তাহাকে কে খুন করিয়াছে; তাহার পর তাহার ঘরে সিন্দুকে যাহা কিছু ছিল, তাহা লইয়া পলাইয়াছে। সে যখন যোধমলের ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিতেছিল, সেই সময়ে যোধমলের চাকরের সঙ্গে তাহার দেখা হয়, সে তাহার সম্মুখ দিয়া সহজভাবে বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যায়। পরে সেই চাকর মনিবের গৃহে গিয়া, ভয়ানক ব্যাপার দেখিয়া চীৎকার করিতে করিতে বাসায় আসিয়া পড়ে—তখন খুনী নিরুদ্দেশ হইয়াছে।”

আমি জিজ্ঞাসিলাম, “আর কেহ কি, তাহাকে দেখিতে পায় নাই?”

ডাক্তার বলিলেন, “হাঁ সেখানকার আরও অনেকে তাহাকে দেখিয়াছিল, তাহাদের সকলেরই তাহার চেহারা বেশ মনে আছে, তাহাদের কাছে পুলিস খুনীর চেহারার বর্ণনা পাইয়াছে, কাজেই বোধ হয়, সে বেশি দিন লুকাইয়া থাকিতে পারিবে না—শীঘ্রই ধরা পড়িবে।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কিরূপ বর্ণনা পাইয়াছে?”

ডাক্তার বলিলেন, “খুনী দেখিতে লম্বা, বয়স পঁয়ত্রিশ হইতে পঁয়তাল্লিশ বৎসর। গায়ে একখানা বালাপোষ ছিল, মুখে লম্বা দাড়ী, চোখে বড় বড় পরকলার চশমা। লোকটা একটু কুঁজো, আবার খোঁড়াইয়া চলে।”

আমি জিজ্ঞাসিলাম, “যে খুন হইয়াছে, সে টাকা ধার দিত?”

ডাক্তার বলিলেন, “হাঁ, তবে সে জীবনে কত লোকের যে সর্ব্বনাশ করিয়াছে, তাহার সংখ্যা হয় না।”

আমি বলিলাম, “তাহা হইলে তাহার অনেক শত্রু ছিল, শত্রুদের মধ্যে কেহ তাহাকে খুন করিয়াছে।”

ডাক্তার বলিলেন, “খুব সম্ভব। তবে সে যে-ই হউক, তাহার সাহস যে অসাধারণ, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। প্রকাশ্য দিবালোকে চকের ভিতর এরূপে লোককে খুন করিয়া তাহার সিন্দুক হইতে জহরত ও নোটে পকেট বোঝাই করিয়া গণ্ডীর বাহিরে চলিয়া যাওয়া যে-সে লোকের কাজ নহে।”

ডাক্তার সহসা নীরব হইলেন। এবার যে হরনাথ হাসিয়া উঠিয়াছেন, তাহাতে সন্দেহ নাই—সে কেমন এক অদ্ভুত হাস্য; তবে তাঁহার মুখখানা যে আনন্দে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা তাঁহার মুখ দেখিলে সুস্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়।

হরনাথ বলিলেন, “ডাক্তারবাবু, আপনি এ খুন সম্বন্ধে যে সকল কথা বলিলেন, তাহা ঠিক; কিন্তু এক বিষয়ে আপনার বিষম ভুল হইতেছে।”

ডাক্তার বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “কোন্ বিষয়ে?”

হরনাথ বলিলেন, “এই খুনী কখনও ধরা পড়িবে না—কখনও না—দেখিবেন!”

ডাক্তার একটু বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “আপনি কি জন্য এ কথা বলিতেছেন?”

হরনাথ বলিলেন, “পুলিসের কাছে এই সকল লোকে এই খুনীর চেহারার যে বর্ণনা দিয়াছে, তাহাতে এত বিশেষত্ব আছে যে, তাহাকে ধরা সহজ হইবে না।”

ডাক্তার আরও বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “আপনার কথা বুঝিতে পারিলাম না—যতই তাহার চেহারার বিশেষত্ব থাকিবে, ততই তাহাকে ধরা সহজ হইবার কথা।”

হরনাথ বলিলেন, “আপনার কাছে শুনিলাম, খুনী লম্বা, তাহার বয়স পঁয়ত্রিশ হইতে পঁয়তাল্লিশ, তাহার গায়ে একখানা মোটা বালাপোষ ছিল, সুতরাং যে মোটা কি রোগা লোক, তাহা নিশ্চিত বলা যায় না, কেহ কেহ বলিয়াছে, সে রোগা লোক, কেহ কেহ আবার বলিয়াছে যে, সে মোটা লোক। তবে সকলেই বলিতেছে যে, লোকটা একটু কুঁজো, একটু খোঁড়াইয়া চলে, লম্বা দাড়ী ছিল। চোখে বড় চশমাও ছিল। আপনি কি মনে করেন যে, খুনীতে ইহার একটিও আর এখন বিদ্যমান আছে?”

“আপনি বলিতেছেন যে, সে ছদ্মবেশে আসিয়াছিল।”

“নিশ্চয়ই—চশমা ও দাড়ী সে এক মিনিটেই সরাইয়াছে, কুঁজ আর খোঁড়াইয়া চলা সে-ও সে রাস্তায় বাহির হইয়াই ত্যাগ করিয়াছে, তাহার পর মোটা বালাপোষ, তাহাও এতক্ষণ নিরুদ্দেশ হইয়াছে, এখন বলুন—যে সব লোক এই খুনীকে দেখিয়াছিল, এখন তাহারা ইহাকে চিনিবে কি? খুনীর সহিত ইহারা সমস্ত দিন কথা কহিয়া থাকিলেও ত তাহাকে ধরিতে পারিবে না।”

ডাক্তার অতি মনোযোগের সহিত হরনাথের কথা শুনিতেছিলেন। তিনি বলিলেন, “আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা ঠিক; তবে তাহার চেহারার উপর নির্ভর করিতেছে না। অমন খুনী ছদ্মবেশ সত্ত্বেও ধরা পড়িয়াছে। অনেক সময়ে এ সব বুদ্ধিমান্ লোক বেশি বুদ্ধি খাটাইতে গিয়াই ধরা পড়ে।”

হরনাথ বলিলেন, “যদি সঙ্গে সঙ্গে সে ঘোরতর গাধা হয়; তবে আপনি যে লোকের কথা বলিলেন, তাহাতে যতদূর বুঝা যায়, এ তেমন গাধা নয়, এ সহজে কোন ভুল-চুক করিবে না। আমি বাজি রাখিতে পারি, এ লোক কখনও ধরা পড়িবে না।”

আমি এতক্ষণ নীরবে বসিয়াছিলাম, এবার বলিলাম, “হরনাথবাবু তোমার কথা যদি ঠিক হয়, তবে দুঃখের বিষয় বলিতে হইবে–আমি আশা করি, এরূপ দুর্বৃত্ত পলাইতে পারিবে না— ধরা পড়িবে। একটা বিচারও ত ঈশ্বরের সংসারে আছে।”

হরনাথ উঠিয়া আমার দিকে চাহিয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “সত্যেন্দ্রবাবু, আমাদের মধ্যে কে নিশ্চিত বলিতে পারে যে, কোন্টা বিচার আর কোনটা অবিচার, কোন্টা ন্যায়, কোন্টা অন্যায়? যে লোকটাকে আমরা খুনী বলিতেছি, বোধ হয়, সে এই খুনের পূর্ব্বে ঠিক আমাদের মত সৎপথে ছিল; কি কারণে যে এই ভয়াবহ কাজ করিয়াছে, তাহা আমরা জানি না। তবে আমরা ইহা জানি যে, যাহাকে খুন করিয়াছে, তাহার খুন হওয়াই উচিত ছিল; এ অবস্থায় এ লোকটার ফাঁসী হউক, এ ইচ্ছা আমরা কেন করিব?”

হরনাথের এরূপ মন্তব্যে আমি একমত হইতে পারিলাম না, তবে এ কথা লইয়া তাঁহার সহিত তর্ক করা বৃথা ভাবিয়া আমি কোন কথা বলিলাম না। হরনাথ আমাকে তাঁহার বাড়ীর ঠিকানা দিয়া বলিলেন, “একদিন আমার ওখানে যাইও।”

যাইবার সময়ে তিনি আবার ডাক্তারের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করিতেছিলাম, এ সম্বন্ধে আমি অনেক ভাবিয়াছি। আমার কথা যে ঠিক, আর একদিন আপনাকে তাহা বুঝাইয়া দিতে চেষ্টা পাইব।”

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

পরদিন আমি হরনাথের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চলিলাম। তিনি আমাকে যে ঠিকানা দিয়াছিলেন, আমি সেই বাড়ীর সম্মুখে গিয়া একটু বিস্মিত হইয়া দাঁড়াইলাম, বাড়ীটা জরাজীর্ণ, বোধ হয়, বাদসাহী আমলে গঠিত, অনেক স্থান ভাঙ্গিয়া ভূমিসাৎ হইয়াছে, বালিচূণের চিহ্ন নাই, দরজা জানালাও ভগ্ন, কোনটী কোনটী একেবারেই নাই।

আমি এক সময়ে হরনাথকে ভাল বাড়ীতে বাস করিতে দেখিয়াছি; সেজন্য ভাবিলাম, তিনি কিরূপে এই ভাঙ্গাবাড়ীতে বাস করিতেছেন? তাহা হইলে তিনি কেবল তাঁহার স্ত্রী-কন্যা হারাণ নাই—তাঁহার টাকা-কড়িও বোধ হয়, সব গিয়াছে; নতুবা তিনি কখনই এরূপ বাড়ীতে বাস করিতেন না। আমি এই নিৰ্জ্জন বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম, ভিতরে গিয়া ডাকিলাম, আছেন—বাড়ীতে কে আছেন?”

তখনই একটা ঘর হইতে একটি বালিকা—এ যে কমলা বাহির হইয়া আসিল! এই কমলাকে আমি চারি বৎসর আগে দেখিয়াছি, তখন তাহার বয়ঃক্রম এগার বৎসরের অধিক নহে। এই চারি বৎসরের মধ্যে কমলার অনেক পরিবর্ত্তন হইয়াছে—নব যৌবন তাহার সর্ব্বাঙ্গে চমৎকার বাসন্তী-সজ্জা করিয়া দিয়াছে; কমলা যেখানে আসিয়া দাঁড়াইল, সেখানটা তাহার অপরূপরূপ লাবণ্যে যেন আলো করিয়া দাঁড়াইল। জানি না, এ সৌন্দর্য্যে কে না মুগ্ধ হয়!

কমলা আমায় দেখিয়া অত্যন্ত সলজ্জভাবে নতমুখে বলিল, “আসুন! বাবা বাহিরে গিয়াছেন, এখনই আসিবেন।”

আমি তাহার সঙ্গে একটী ঘরে আসিলাম, এই ঘরটী ভগ্নপ্রায় হইলেও দেখিলাম, বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন; তবে ঘরে আসবাব-পত্র কিছু নাই বলিলে অত্যুক্তি হয় না; দেখিলেই বোধ হয়, হরনাথ দারিদ্র্যের অসহ্য পীড়ন সহ্য করিতেছেন।

আমি মনোভাব গোপন করিয়া বসিলাম। আমি যে হরনাথের এই পরিবর্ত্তন লক্ষ্য করি নাই, সেই ভাব দেখাইবার চেষ্টা পাইলাম; কিন্তু বুদ্ধিমতী কমলা আমার মনোভাব বুঝিল, সে বলিল, “বাবা নিৰ্জ্জনে তাঁহার বই লিখিবেন বলিয়া এখানে আসিয়াছেন। আপনি কিন্তু ঠিক সেই রকম আছেন, এই এত দিনে চেহারার কোন পরিবর্তন হয় নাই।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “কমলা, আমি তোমায় তেমনই ছেলেমানুষটী দেখিব মনে করিয়াছিলাম।”

“আপনার সহিত দেখা করিতে আমার ভয় হইতেছিল।”

“কেন কমলা?”

“কি জানি, আপনি—এই কত লোক—আর আমাদের কোন খবরই নেয় না।”

“তুমি কি আমাকেও সেইরূপ মনে করিয়াছ?”

“না—তা নয়— তবে –”

“তবে কি, কমলা?”

“এই আগে যাহারা প্রায়ই আমাদের কাছে আসিত, আমাদের কত আদর-যত্ন করিত, বাবাকে মান্য-ভক্তি করিত, তাহারা যখন দেখিল, বাবার আর সে অবস্থা নাই, তাঁহার অসুখ হইয়াছে, তাঁহার শরীর ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, তখন তাঁহারা আর আমাদের কাছে আসিতেন না–বাবা এখন বড় খিট্‌খিটে হয়েছেন কিনা।”

“সেই জন্য তাহারা আর তোমাদের বাড়ীতে আসে না?”

“হাঁ, তাহাদেরও বড় দোষ নাই—বাবা বড় রাগী হইয়াছেন, হঠাৎ রাগিয়া উঠেন—যা মুখে আসে, তাই বলেন, কিন্তু তাহার পরই দুঃখিত হন্; আপনাকে আগে হতেই বলিয়া রাখিতেছি— না হইলে হয়ত আপনিও—”

আমি ব্যগ্রভাবে বাধা দিয়া বলিলাম, “কমলা, তুমি জান না, আমি তোমার বাবার কাছে কত ঋণী আছি, তিনি হাজার গালাগালি দিলেও আমি রাগ করিব না।”

“আপনি এখন এই কথা বলিতেছেন–”

কমলা সহসা নীরব হইল, নিকটে পদশব্দ হওয়ায় সে বলিল, “এই বুঝি বাবা আসিতেছেন।”

হরনাথ গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলে, আমি দেখিলাম, গত কল্য হইতে যেন অদ্য তাঁহার মুখ আরও বিবর্ণ। তিনি আমাকে দেখিয়া প্রথমেই আনন্দিত হইয়া বলিলেন, “যথার্থই আমি ভারি সুখী হইয়াছি–বসো বসো। বোধ হয়, সত্যেন্দ্র, আমার এই বাসা দেখে তুমি বিস্মিত হইতেছ, হাঁ ভাঙ্গাবাড়ী বটে, কিন্তু আমার পক্ষে খুব উপযুক্ত। নিৰ্জ্জন—কোন গোল নাই, এই রকম স্থানই আমি অনেক দিন হইতে খুঁজিতেছিলাম। আমার বইখানা লেখা শেষ হইলেই কলিকাতায় ফিরিয়া যাইব।”

এই পর্য্যন্ত বলিয়া হরনাথ কন্যাকে তথা হইতে প্রস্থান করিবার জন্য ইঙ্গিত করিল। কমলা সেই গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেল, সে গৃহ হইতে বাহির হইবামাত্র হরনাথ বলিল, “কেমন, কাল কি বলিয়াছিলাম,—পুলিস কখনও এই খুনীকে ধরিতে পারিবে না—কখনও না!”

সত্যকথা বলিতে কি যোধমলের খুন সম্বন্ধে আমি আর আদৌ চিন্তা করি নাই; সুতরাং কি বলিব স্থির করিতে পারিলাম না। হরনাথ বলিলেন, “নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে, এ সম্বন্ধে আমি কি বলিয়াছিলাম। তোমার বন্ধু ডাক্তারের বিশ্বাস যে, খুনী নিশ্চয়ই শীঘ্র ধরা পড়িবে— সম্পূর্ণ ভুল,—সম্পূর্ণ ভুল। তোমার বন্ধু ডাক্তার ভাবিয়াছিলেন যে, পুলিস খুনীর চেহারার যখন এরূপ বিশদ বর্ণনা পাইয়াছে, তখন তাহারা অতি শীঘ্র নিশ্চয়ই তাহাকে ধরিতে পারিবে। এখন দেখিতেছ, তাঁহার কতদূর ভুল বিশ্বাস জন্মিয়াছিল। পুলিস যে সব পন্থা অবলম্বন করিয়াছিল, তাহা সমস্তই কাগজে বাহির হইয়াছে, এই দেখ, আমি যে কথা বলিয়াছিলাম, ঠিক সেইরূপই হইয়াছে। এই গত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পুলিস তিনজনকে ধরিয়াছে—খুনীর চেহারার সঙ্গে ইহাদের চেহারার কোন কোন স্থলে মিলিয়াছে বলিয়াই পুলিস ইহাদের ধরিয়াছে। এক জনের লম্বা দাড়ী ছিল, একজন একটু কুঁজো ও খোঁড়া, আর একজনের চেহারার বর্ণনা এখানে দেখিতে পাইতেছি না–হয়তো তাহার অপরাধ যে তার চোখে চশমা ছিল। ইহারা তিন জনে অতি সহজেই প্রমাণ করিয়াছে যে, ইহাদের সহিত এই খুনের কোন সম্বন্ধ নাই। দেখিতেছ, এই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তোমার বুদ্ধিমান্ পুলিস তিন তিনটী ভুল করিয়াছে, ইহা তাহাদের শেষ ভুল নয়, নিশ্চয়ই আরও দু’-দশটা ভুল করিবে।”

এই বলিয়া হরনাথ আনন্দে নিজ হাত কচ্‌লাইতে লাগিলেন। যেন এই চিন্তাতেই তাঁহার অপার আনন্দ জন্মিতেছে। আমি তাঁহার মতে মত দিতে পারিব না, ভাবিয়া আমি তাঁহার কথায় কোন উত্তর না দিয়া খবরের কাগজ দেখিতে লাগিলাম। হরনাথ চঞ্চলভাবে গৃহমধ্যে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

সহসা হরনাথ আমার সম্মুখে দাঁড়াইলেন; বলিলেন, “তিন হাজার পাঁচশ চল্লিশ টাকা— মন্দ টাকা নয়; আরও আশ্চর্য্যের বিষয়, এই টাকার অধিকাংশ নম্বরী-নোট। অথচ ইহার একখানারও নম্বর পাওয়া যায় নাই। যোধমলের কর্ম্মচারীরা বলে যে, একখানা খাতায় এই সকল নোটের নম্বর লেখা ছিল। খুব সম্ভব, যে খুন করিয়াছে, সেই নিশ্চয়ই এই খাতাও লইয়া গিয়াছে।”

কিছু বলা আবশ্যক বিবেচনা করিয়া আমি বলিলাম, “দেখা যাইতেছে, লোকটা যোধমলের বাড়ীর সকল খবর জানিত।”

হরনাথ মাথা নাড়িলেন, বলিলেন, “অনেকে তাহাই মনে করিবে, তাহা আমি জানি, কিন্তু আমি তাহা মনে করি না; এ লোকটার পক্ষে যে যোধমলের বাড়ীর সকল সংবাদ রাখিতে হইবে, তাহার কোন মানে নাই। সে কিরূপে যোধমলকে খুন করিয়া তাহার টাকা আত্মসাৎ করিবে, তাহা মনে মন ঠিক করিয়া লইয়াছিল। তাহার পর মাথা ঠিক রাখিয়া সেই কার্য্য উদ্ধার করিয়াছে। যদি যে সাধারণ চোর হইত, তাহা হইলে যাহা কিছু সম্মুখে দেখিত, তাহাই সংগ্রহ করিত। এ লোক সেরূপ নহে, তাড়াতাড়ি এ লোক কাজ করে নাই; হয়তো সে কোন পাওনাদারকে টাকা দিবার জন্য এই ভয়াবহ কাজ করিতে বাধ্য হইয়াছে;–হয়তো সে বলিতে পারে, মেয়ের বিবাহ হয় না দেখিয়া এ কাজে প্রলুব্ধ হইয়াছে। আজকাল মেয়ের বিবাহ দেওয়া যে কি কষ্টকর, তাহা কি তুমি জান না? আমার মেয়ের—না—আর এ সব কথা নয়। এই যে কমলা আসিতেছে!”

অন্য কথা উঠায় আমিও আশ্বস্ত হইলাম। এই খুনের বিষয় আলোচনা করিতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না।

প্রায় দুই ঘণ্টা আমরা উভয়ে অনেক কথা কহিলাম। হরনাথ চিরকালই কথা কহিতে সুদক্ষ—তাঁহার পড়া-শোনাও যথেষ্ট ছিল—খুব কম বিষয়ই ছিল, যাহা তিনি জানিতেন না। আমি দেখিলাম, হরনাথের অবস্থার পরিবর্ত্তন হওয়ায় তাঁহার মনের বিশেষ পরিবর্ত্তন হয় নাই; তবে ইহাও দেখিলাম, অনেক বিষয়ে তাঁহার মতামত এক অভিনব ভাব ধারণ করিয়াছে। কমলার কথা আমার মনে ছিল, সুতরাং আমি হরনাথের কোন কথায়ই প্রতিবাদ করিলাম না। সেইজন্য তাঁহার সহিত আমার বিন্দুমাত্র অসন্তোষকর কিছু ঘটিল না। প্রায় দুই ঘণ্টা পরে আমি বিদায় লইলাম। হরনাথ আবার আসিবার জন্য আমায় পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিলেন। আমায় বিদায় করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিবার জন্য কমলা আমার সঙ্গে আসিয়াছিল। যে দরজার কাছে অসিয়া বলিল, “আবার আসিবেন, বাবা আপনাদের সঙ্গে কথা কহিলে ভাল থাকেন।”

আমি হরনাথের বাড়ী হইতে বাহির হইয়া আসিলাম। কমলার সুমিষ্ট কণ্ঠ যেন আমার কর্ণে মধুবর্ষণ করিয়া ধ্বনিত হইতেছিল; এই কি ভালবাসার পূর্ব্ব লক্ষণ—কে জানে?

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

সেইদিন হইতে আমি প্রায়ই হরনাথের বাড়ীতে যাইতাম, প্রায়ই কমলার সহিত আমার দেখা হইত। তাঁহারা উভয়েই আমার বিশেষ যত্ন ও আদর করিতেন; কিন্তু আমি সহস্ৰ চেষ্টা করিয়া তাঁহাদের সেই ভাঙ্গা বাড়ী হইতে বিষাদের ছায়া দূর করিতে পারিলাম না—কি যেন একটা কালো মেঘে কমলা ও তাহার পিতাকে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে; কারণ যে কি, তাহা আমি অনেক ভাবিয়াও স্থির করিতে পারিলাম না। সাহস করিয়া হরনাথকে জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না; কি জানি, পাছে তিনি অসন্তুষ্ট হন। কমলাকেও জিজ্ঞাসা করিতে সাহস হইল না; তবে আমি তাঁহাদের এই গুপ্ত বিষাদের কারণ কি জানিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা পাইতে লাগিলাম।

হরনাথ দিন দিন আরও চঞ্চল, আরও বিচলিত—আরও বিষণ্ণ হইয়া পড়িতে লাগিলেন। কমলার সুন্দর মুখে বিষাদের ছায়া আরও ঘনীভূত হইল। এমন কি আমি তাহার মুখ দেখিয়া বুঝিলাম যে, সে গোপনে কাঁদিয়া থাকে—কেন যে কাঁদে, তাহা জানিবার জন্য আমি অতিশয় ব্যাকুল হইয়া উঠিলাম; বুঝিলাম যে, হরনাথের যথেষ্ট অর্থ নষ্ট হইয়াছে—সে এই অর্থকষ্টে গোপনে গোপনে অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করিতেছে। ক্রমে আমি ইহাও জানিলাম যে, তাঁহার এক পয়সাও আয় নাই। কমলা সূচের কাজ করিয়া বিক্রয় করিতেছে, তাহাতে সে যাহা পায়, তাহাতেই কষ্টে সংসার চলে—হরনাথ এক পয়সাও আনিতে পারিতেন না।

তিনি কি একখানা বই লিখিতেছিলেন। তাঁহার বিশ্বাস, বইখানা বাহির হইলেই তাহার যশঃ মান অর্থ সবই হইবে। এখন আমি প্রায়ই তাঁহাদের বাড়ীতে যাইতাম, কিন্তু তাঁহাকে কখনও তাঁহার এই বই লিখিতে দেখি নাই। অথচ হরনাথ সর্ব্বদাই এই বইয়ের কথা বলিতেন, বইখানা বাহির হইলে তিনি বড় লোক হইয়া যাহা যাহা করিবেন, তাহাও বলিতেন; তাঁহার এই সকল কথা আকাশকুসুমচয়নবৎ আমার মনে হইলেও আমি কখনও তাঁহার কথার প্রতিবাদ করিতাম না। তিনি যাহা বলিতেন, তাহাতেই সায় দিয়া যাইতাম। আমি বুঝিয়াছিলাম, তাঁহার মেজাজ আর ভাল নাই। তাঁহার কথার প্রতিবাদ করিতে গেলেই আমাদের উভয়ের ঝগড়া হইয়া যাইবে। কমলার জন্য তাঁহার সহিত ঝগড়া করিতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। বিশেষতঃ হরনাথ পুনঃ পুনঃ বলিতেন, “কমলাই আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন,—যাহাতে কমলার ভাল দেখিয়া বিবাহ দিয়া তাহাকে সুখী করিতে পারি, ইহাই আমার জীবনের শেষ ইচ্ছা।”

তাঁহার নিজের জন্য তাঁহার বড়লোক হইবার ইচ্ছা একেবারে ছিল না—কেবল কমলা- কমলার জন্যই তিনি মনে মনে কতই আকাশ-কুসুম দেখিতেছিলেন, তাহার সুখের জন্য কতই মতলব করিতেছিলেন, এ অবস্থায় তাঁহার কথা সময়ে সময়ে নিতান্ত হাস্যজনক—এমন কি সম্পূর্ণ পাগলের মত কথা হইলেও আমি তাহাতেই সায় দিয়া যাইতাম।

যোধমল তিন সপ্তাহ খুন হইয়াছে; কিন্তু এই তিন সপ্তাহের মধ্যেও পুলিস তাহার হত্যাকারীকে ধরিতে পারে নাই—তাহারা আবার দুই-তিন জনকে ধরিয়া ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইয়াছে। খুনীর কোন সন্ধান পায় নাই। কে যে টাকা নোট লইয়া গিয়াছিল, তাহারও কোন সন্ধান হয় নাই।

ক্রমে লোকে যোধমলের খুনের কথা প্রায় ভুলিয়া আসিতেছিল। হরনাথ এই হত্যাকাণ্ডের কথা পুনঃপুনঃ না তুলিলে আমিও নিশ্চয় এ কথা ভুলিয়া যাইতাম। তিনি এই খুনের কথা বলিতে বিরক্ত হইতেন না,—তিনি যাহা বলিতেন, উহাতে তিনি স্পষ্টই দেখাইতেন যে, তিনি যোধমলের এরূপ মৃত্যুর জন্য কিছুমাত্র দুঃখিত নহেন, তাহার হত্যাকারী ধরা না পড়িলে তিনি সন্তুষ্ট ভিন্ন অসন্তুষ্ট হইবেন না।

তবে হরনাথ কখনও এই খুনের কথা কমলার সম্মুখে বলিতেন না। এ বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সতর্ক থাকিতেন; কমলা কখনও হঠাৎ আসিয়া পড়িলে তিনি এইকথা বদলাইয়া তৎক্ষণাৎ অন্যকথা পাড়িতেন—আমিও কমলাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিতাম না। আমি যখনই তাঁহাদের বাড়ীতে যাইতাম, তখনই দেখি, হরনাথ বাড়ীতে রহিয়াছেন, সুতরাং এপর্য্যন্ত কমলাকে গোপনে কিছু জিজ্ঞাসা করিবার কোন সুবিধা হয় নাই।

এতদিন পরে ভাগ্য আমার প্রতি সুপ্রসন্ন হইল; আমি দেখিলাম, আজ হরনাথ বাড়ীতে নাই। কমলা একাকী বসিয়া সেলাই করিতেছে। সে আমায় বসিতে বলিয়া বলিল, “এই হাতের কাজটা আমায় আজই শেষ করিতে হইবে–বসুন, বাবা এখনই আসিবেন।”

আমি কিয়ৎক্ষণ নীরবে বসিয়া তাহার সেলাই দেখিতে লাগিলাম। যাহা তাহাকে গোপনে পাইলেই জিজ্ঞাসা করিব মনে মনে স্থির করিয়া বসিয়াছিলাম, তাহা এখন কিছুতেই সাহস করিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না। সহসা কমলা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল, আমার হৃদয়ে যেন একটা ঝড় বহিয়া গেল, আমি আর নীরবে থাকিতে পারিলাম না, তাহার নিকটস্থ হইয়া বলিলাম, “কমলা, তুমি এত পরিশ্রম করিলে, তোমার শরীর থাকিবে না, নিশ্চয়ই তোমার অসুখ করিবে—তোমায় এ সব ত্যাগ করিতে হইবে—আমার কষ্ট হইতেছে—” আর বলিতে পারিলাম না।

সে আমার মুখের দিকে চাহিল, তাহার নধর অধরে ম্লানহাস্য দেখা দিল। সে বলিল, “আপনি আমার ভালবাসেন, তাহাই এ কথা বলিতেছেন, তবে ইহাতে যত পরিশ্রম হয়, আপনি মনে করিতেছেন, ঠিক তত পরিশ্রম আমার হয় না। সখ করিয়া আমি খাটিতেছি না।”

আমি ব্যগ্রভাবে বলিলাম, “তাহা আমি জানি, তাহাতেই তোমার দিনরাত্রি এত পরিশ্রম করিতে দেখিয়া আমার কষ্ট হইতেছে। এ কাজ তোমার উপযুক্ত নয়—তুমি বলিলে আমি তোমার এ পরিশ্রম বন্ধ করিয়া দিতে পারি।”

কমলার মুখ রক্তিমাভ হইল। আমি বুঝিলাম, সে আমার কথা বুঝিয়াছে—যে এখন আর নিতান্ত বালিকা নয়।

কমলা কোন উত্তর দিল না, ইহাতে আমি সাহস পাইয়া বলিলাম, “কমলা তুমি আমার মনের ভাব নিশ্চয়ই বুঝিয়াছ। আমি তোমায় প্রাণ মন সব দিয়া ভালবাসি, যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে—”

সহসা কমলা কাজ ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। করুণকণ্ঠে বলিল, “অনুগ্রহ করিয়া আর কিছু বলিবেন না—না না, আর কিছু বলিবেন না, আমাদের বিবাহ হইতে পারে না।”

আমি দুঃখিত হইয়া বলিলাম, “তাহা হইলে তুমি আমায় একটুও ভালবাস না?”

কমলা মুখ এত অবনত করিয়াছিল যে, আমি তাহার মুখ দেখিতে পাইলাম না। সে নতমুখে বলিল, “আপনি জানেন না, এখন আমাদের অবস্থা কিরূপ। বাবা যাহা বলেন, তাহাতে আপনার নিশ্চয়ই বিশ্বাস হইয়াছে যে, তাহার আগেকার অনেক টাকা আছে, কিন্তু সে আপনার ভুল। বাবার আর এক পয়সাও নাই, আমি সেলাই করিয়া যাহা পাই, তাহাতেই কষ্টে আমাদের একরূপ চলে।

আমি ব্যগ্রভাবে বলিলাম, “কমলা, তুমি কি মনে কর যে, আমি টাকার প্রত্যাশা করি! ইহা কখনও মনে করিও না। আমি খুব বড়লোক নই, তবে আমার যাহা আয় আছে, তাহাতে তোমায় ও তোমার বাবাকে সুখে রাখিতে পারি।”

কমলা মুখ তুলিল না, সেইরূপ নতমুখে বলিল, “আপনার অনুগ্রহ আমি কিছুতেই ভুলিতে পারিব না, তবে আপনার সহিত বিবাহ অসম্ভব।”

“কমলা, আজ না হয় পরেও তো একদিন তুমি আমায় একটুও ভালবাসিতে পার?”

“না—তা নয়—তা নয়, আপনি ভুল বুঝিতেছেন—আমি আপনাকে সকল কথা বলিতে পারিতেছি না।”

“তুমি আমায় একটুও বিশ্বাস কর না?”

আমার এই কথায় কমলা মুখ তুলিল। আমি দেখিলাম, তাহার দুই চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। আমি যে তাহার উপর একটু বিরক্ত হইয়াছিলাম, তাহা তাহার চোখে জল দেখিবামাত্র নিমেষে দূর হইল। সে কাতরে বলিল, “আপনি যদি সব জানিতেন, তাহা হইলে কখনও আমায় এ কথা বলিতেন না, তাহা হইলে আপনি আমার উপর দয়া করিতেন না। আপনি জানেন না, আমি কি কষ্টে আছি। সকলে আমাদের ত্যাগ করিয়া গিয়াছে, আপনি-আপনি—আমাদের ত্যাগ করিবেন না।”

কি করুণকণ্ঠে কমলা কথাগুলি শেষ করিল!

আমি বলিলাম, “কমলা, তুমি যাহা বলিবে, আমি তাহাই করিব।”

আমি তাহার হাত ধরিলাম। দেখিলাম, তাহার হাত থর থর করিয়া আমার হাতের মধ্যে কম্পিত হইতেছে; তথাপি সে আমার হাত হইতে হাত কাড়িয়া লইল না। এই সময়ে হরনাথ আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তিনি আমাদের দিকে লক্ষ্য করিয়া দেখিলে আমাদের উভয়েরই বিচলিত ভাব দেখিয়া কি ঘটিয়াছে, তাহা বোধ হয় বুঝিতে পারিতেন; কিন্তু তিনি যেন কি জন্য অন্যমনস্ক ছিলেন, তিনি লক্ষ্য করিলেন না; আমি পূর্ব্বে আর কখনও তাঁহাকে এত বিচলিত হইতে দেখি নাই। আমি তাঁহাকে দেখিয়াই বুঝিলাম যে, আজ একটা গুরুতর ব্যাপার কিছু ঘটিয়াছে।

হরনাথ ব্যগ্রভাবে কন্যাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার খোঁজ নিতে এখানে কেহ আসে নাই?”

কমলা বলিল, “না বাবা।”

কন্যার এই কথায় হরনাথ যেন অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া বসিল। আমি অনেকক্ষণ আসিয়াছিলাম, বিদায় হইবার জন্য উঠিলাম; আজও হরনাথ দরজা বন্ধ করিবার জন্য আমার সঙ্গে সঙ্গে আসিলেন। দরজায় আসিয়া বলিলেন, “সত্যেন্দ্র! তুমি ইচ্ছা করিলে আমার একটা বিশেষ উপকার করিতে পার।”

আমি বলিলাম, “হরনাথবাবু, আপনি কি জানেন না যে, আপনি যাহা বলিবেন, আমি সর্ব্বদাই তাহা করিতে প্রস্তুত আছি।”

হরনাথ বলিলেন, “আচ্ছা, কাল তোমার সঙ্গে দেখা করিয়া সব বলিব।”

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

পরদিন বৈকালে হরনাথ বাড়ীতে আসিলেন। তখন খুব শীত পড়ে নাই, তবুও দেখিলাম, একখানা মোটা রেপারে আপাদমস্তক আবৃত হইয়া আসিয়াছেন—তাঁহার মুখ প্রায় দেখা যায় না।

আমি বিস্মিত হইয়া দেখিলাম, তিনি ঘরের চারিদিকে অত্যন্ত ভীত ভাবে চাহিতেছেন, তাহার পর গৃহমধ্যে কেহ নাই দেখিয়া, তিনি মাথা হইতে রেপার খুলিলেন এবং বসিয়া বলিলেন, “আমার আসিতে দেরি হইয়াছে, আমায় অনেক ঘুরিয়া এখানে আসিতে হইয়াছে। একটা লোক আমার পিছু লইয়াছিল, তবে এই রক্ষা, আমি তাহার হাত ছাড়াইয়া আসিতে পারিয়াছি। আমার কাপড়ের ভিতর কি লুকান আছে, যদি সে জানিতে পারিত!”

এই বলিয়া হরনাথ রেপারের ভিতর হইতে একটা বড় খাম বাহিরে করিলেন। আমি দেখিলাম, খামটির গায়ে আগাগোড়া গালামারা। তিনি অতি সাবধানে সম্মুখে খামটী রাখিলেন।

আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “আপনার কিছু লইয়াছিল? সে কি! এই দিনের বেলায়— প্রকাশ্য পথে—”

মধ্যপথে বাধা দিয়া হরনাথ মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “না, তাহার জন্য আর মাথা ঘামাইয়া কোন ফল নাই। আমার মত লোকের উপর চাল চালিতে এই গাধাদের অনেক বিলম্ব আছে, এ সকল আমি কিছুমাত্র গ্রাহ্য করি না। যাক্, এ বিষয়ের আলোচনায় আর আবশ্যকতা নাই। তোমাকে কালই বলিয়াছি যে, তুমি আমার একটা বিশেষ উপকার করিতে পার, সেইজন্যই আমি এখন আসিয়াছি।”

“বলুন, কি করিতে হইবে।”

“এই খামটা তোমার কাছে খুব সাবধানে রাখ।”

এই—না আর কিছু আছে?”

“সব বলিতেছি। এই খাম খুব সাবধানে তোমায় কোনখানে লুকাইয়া রাখিতে হইবে। এই খামে অনেক দামী জিনিষ আছে। কি আছে তোমায় বলিব কি?”

“আপনার যদি বলিবার ইচ্ছা না থাকে, তবে বলিবেন না?”

“না—তোমায় বলিতে আমার আপত্তি নাই। তুমিই আমার এখন একমাত্র বন্ধু, তোমার কাছে কিছু গোপন করিব না। এই খামের ভিতরে তিন হাজার পাঁচশ’ চল্লিশ টাকার নোট আছে—সামান্য নয়।”

আমি বলিলাম, “অনেক টাকা, আপনি আমায় টাকা রাখিতে বলিতেছেন কেন, আপনি কি অন্য কোনখানে যাইবেন?”

হরনাথ মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “না—তা ঠিক নয়। আমার কাছে এ টাকা আর রাখা নিরাপদ নয়। সেই কারণে ইহা তোমার কাছে রাখিবার জন্য তোমায় বিরক্ত করিতেছি। অনেক কষ্টে এ টাকা আমার কমলার জন্য জোগাড় করিয়াছি—তাহার বিবাহের খরচ।”

হরনাথের কথায় আমি একেবারে স্তম্ভিত হইয়া পড়িলাম। তাহা হইলে তাঁহার যে এত টাকা আছে, কমলা তাহার কিছুই জানে না। সে দিন-রাত্রি পরিশ্রম করিয়া, দুই পয়সা উপার্জন করিয়া আহারের সংস্থান করিতেছে, আর তাহার পিতা তাহাকে কিছু না বলিয়া টাকা লুকাইয়া রাখিয়াছে! যদি খাটিয়া খাটিয়া কমলা মরিয়াই যায়, তাহা হইলে তাহার বিবাহের জন্য এত টাকা থাকিলে তাহার কি উপকার হইবে?

এরূপ কাজ কেবল মূর্খতা ব্যতীত আর কিছুই নহে, হরনাথের উপর আমার অত্যন্ত রাগ হইল, আমি সে রাগ গোপন করিতে পারিলাম না—দুই-এক কথা বলিয়া ফেলিলাম।

ইহাতে হরনাথ রাগ করিলেন না, বলিলেন, “কমলার বিবাহের টাকায় কিছুতেই আমি হাত দিব না; আমি যাহা সহ্য করিয়াছি, তুমি যদি তাহা সহ্য করিতে, তাহা হইলে তুমি বলিতে যে, আমি যাহা করিতেছি, তাহা ঠিকই করিতেছি। আমি সংসারকে বেশ জানি, কমলার বিবাহে যদি আমি টাকা দিতে না পারি, তাহা হইলে সে শ্বশুর বাড়ীতে গিয়া চিরজীবন কষ্ট পাইবে—কষ্টের অবধি থাকিবে না, হয় ত মারা যাইবে। যদি আমি তাহাকে তাহার বিবাহের সময় এই টাকা দিয়া বড় ঘরে বিবাহ দিতে পারি, তাহা হইলে সে কখনও কষ্ট পাইবে না।”

এই বলিয়া হরনাথ খামটা তুলিয়া লইয়া বলিলেন, “ইহাতে যাহা আছে, তাহাতে আমার কন্যা কখনও কষ্ট পাইবে না।”

হরনাথের কথা শুনিয়া যথার্থই আমার প্রাণে বড় আঘাত লাগিল; হরনাথ কমলার বিবাহের টাকা আমার কাছে রাখিতেছে। এ নিয়তির খেলা ব্যতীত আর কিছুই নহে। আমি হরনাথের অনুরোধ রক্ষা করিব বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছিলাম, কিন্তু অঙ্গীকারসত্ত্বেও আমি তাহার অনুরোধ রক্ষা করিতে ইতস্ততঃ করিতে লাগিলাম।

আমি বলিলাম, “যদি আপনি মনে করেন যে, আপনার বাড়ীতে এই টাকা রাখা নিরাপদ নয়, তাহা হইলে টাকাটা কোন ব্যাঙ্কে জমা রাখিতেছেন না কেন? আমার এখানে থাকিলে যে চুরি যাইবে না, তাহা কে বলিতে পারে? আপনার বাড়ী হইতেই যদি চুরি যায়, তবে আমার এখান হইতেই বা চুরি যাইবে না কেন?”

হরনাথ আমার কথায় উত্তর দিলেন না; তিনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। আমি বুঝিলাম, তিনি আমার মনের প্রকৃত ভাব বুঝিবার চেষ্টা করিতেছেন।

অবশেষে তিনি বলিলেন, “এই তোমার বন্ধুত্ব! — আমি মূর্খ বলিয়াই ভাবিয়াছিলাম যে, তোমার উপর আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে পারিব। এই কি বন্ধুত্ব!”

আমি বলিলাম, “আপনি সম্পূর্ণ আমায় বিশ্বাস করিতে পারেন না, কিন্তু এ কাজটায় বন্ধুত্ব কিসে প্রকাশ পাইতেছে না, তাহা বুঝিতে পারিতেছি না।”

হরনাথ কিয়ৎক্ষণ আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, তাহার পর ধীরে ধীরে বলিলেন, “তুমি এখনও ন্যাকামী করিতেছ? তুমি কি বলিতে চাও যে, তুমি কিছুই বুঝিতে পার নাই? ঠিক কত টাকা আছে, তাহা কি আমি ইচ্ছা করিয়া বলি নাই? তোমাকে আমার কার্য্যে কিছু গোপন না থাকে, সেইজন্যই আমি তোমায় এ কথা বলিতেছি। তিন হাজার পাঁচ শ’ চল্লিশ টাকা। এ টাকার কথা কি আমরা অনেকবার বলাবলি করি নাই?”

তিনি এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া আমার মুখের দিকে অত্যন্ত কঠিন ভাবে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার শীর্ণ মুখের কোটরগত নেত্রদ্বয় আমার মুখের প্রতি জ্বলিতে লাগিল। আমার শ্বাসরুদ্ধ হইবার উপক্রম হইল। একি! হরনাথ একি বলেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আমার চারিদিকে যেন সবেগে ঘুরিতে লাগিল, আমি একটা কথাও কহিতে পারিলাম না।

ক্ষণেক নির্নিমেষ তীব্র দৃষ্টির পর হরনাথ বলিলেন, “এই টাকা কোথা হইতে আসিয়াছে, তাহা তুমি জান? আমি জানি, তুমি আমায় ধরাইয়া দিবে না, যোধমলের মত বাইসের মরাই উচিত ছিল। সে অনেকের সর্ব্বনাশ করিয়াছিল, তাহার মৃত্যুতে জগতের উপকার হইয়াছে।”

আমার সর্ব্বাঙ্গ থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। আমি চারিদিকে অন্ধকার দেখিলাম; আমি তাঁহাকে কি বলিয়াছিলাম, তাহা আমার মনে নাই; তবে আমার মুখের ভাব দেখিয়া হরনাথ নিশ্চয়ই আমার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, “তুমি যে ইহার জন্য কোনরূপ বিপদে পড়িবে, সে ভয় করিও না। তুমি খবরের কাগজ পড়িয়া বুঝিয়াছ যে, আমি না বিশেষ ভাবিয়া-চিন্তিয়া কোন কাজ করি নাই। হইতে পারে পুলিসে একটু-আধটু সন্দেহ করিয়াছে, কিন্তু তাহাতে তোমার ভয়ের কারণ নাই। তাহাদের চেয়ে আমার সহস্র গুণ বুদ্ধি আছে, নিশ্চিন্ত থাক; আমি তাহাদের নাচাইয়া লইতে পারিব। তবে টাকাটা আমি আর আমার কাছে রাখিতে পারি না,—আর এখন বোধ হয় বুঝিতেছ, আমি টাকাটা কোন ব্যাঙ্কেও জমা রাখিতে পারি না। তবে তোমার কাছে থাকিলে কেহ সন্দেহ করিতে পারিবে না, তোমার উপর সন্দেহ করিতে কেহ সাহস করিবে না।”

আমি এই হতভাগ্যের সম্মুখে স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইয়া আছি। আমার কথা কহিবার ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হইয়াছে, অথচ কিছু করা আবশ্যক—এখনই করা আবশ্যক। কিন্তু কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না-আমার মাথার ভিতর যেন সিংহনাদে বারংবার ধ্বনিত হইতে লাগিল “কমলার বাপ খুনী—খুনী — খুনী!”

সপ্তম পরিচ্ছেদ

এই সময়ে কে দরজায় ঘা মারিল।

আমি বলিয়া উঠিলাম, “কে?”

নিমেষে হরনাথ রেপারে মুখ চোখ ঢাকিয়া ফেলিলেন। আমার ভৃত্য আমার হাতে একখানা চিঠী দিল, আমি চিঠীখানা দেখিতেছি, এই সময়ে তিন লম্ফে হরনাথ দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “সত্যেন্দ্রবাবু; সে কাজটা কাল দেখা যাইবে।”

আমি তাঁহার এমন ভীত ভাব আর কখনও দেখি নাই, তিনি যেন কোন রকমে তখন পলাইতে পারিলেই বাঁচেন! আমি কোন কথা বলিবার পূর্ব্বেই তিনি আমার বাড়ী হইতে অন্তর্হিত হইলেন।

তাঁহাকে ধরিয়া রাখিবার আমার ইচ্ছা ছিল না; তিনি আমার বাড়ী হইতে চলিয়া গেলে আমার বোধ হইল, যেন আমার বুক হইতে কে একখানা বড় পাথর সরাইয়া লইল। আমি যে ভয়াবহ কথা তাঁহার মুখে শুনিয়াছিলাম, তাহাতে আমার বিবেচনা শক্তি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়াছিল।

মানবের একি অধঃপতন! হরনাথের আজ একি ঘোরতর ভীষণ পরিবর্তন! যাঁহাকে একদা আমি দেবতুল্য বলিয়া জানিতাম, আজ তিনি নরহত্যা পরস্বাপহারী আততায়ী! আমি কি প্রকৃতই জাগ্রত, না স্বপ্নরাজ্যে। এ ব্যাপারে আমি কেবল বিস্ময়বিহ্বল হইলাম না, হৃদয়ের অন্তস্তলে একটা নিদারুণ আঘাতও অনুভব করিলাম; যেন এক প্রগাঢ় প্রলয়ান্ধকারের মধ্যে আমার অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়া গেল।

বোধ হয়, আর কেহ কখনও আমার ন্যায় সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়ে নাই। যে কথা আমি এইমাত্র শুনিলাম, তাহাতে হয় আমার এই চোর ও খুনীর সহায়ক হইতে হয়, নয় যাহাকে আমি প্রাণ দিয়া ভালবাসি, সেই কমলার পিতাকে ফাঁসী-কাষ্ঠে ঝুলাইতে হয়।

আর কেহ কি কখনও এরূপ অবস্থায় পড়িয়াছেন? কতক্ষণ আমি স্তম্ভিতপ্রায় বসিয়াছিলাম, তাহা আমি বলিতে পারি না। কে সবলে দরজায় আঘাত করায় আমার চৈতন্য হইল, – আমি চমকিত হইয়া দরজার দিকে চাহিলাম।

তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। ঘর প্রায় অন্ধকার হইয়া আসিয়াছে। ডাক্তার কেশববাবু গৃহমধ্যে আসিয়া বলিলেন, “কি, এখনও ঘুম হইতেছে নাকি?”

আমি বলিলাম, “আমি ঘুমাই নাই। দাঁড়াও, আলোটা জ্বালি।”

“তাড়াতাড়ি লও, আমি এখন থাকিতে পারিব না, কেবল একটা খবর দিবার জন্য এখানে গাড়ী দাঁড় করাইয়াছি; যোধমলকে যে খুন করিয়াছিল, সে এতদিনে ধরা পড়িয়াছে। এই এক ঘণ্টা হইল ধরা পড়িয়াছে।”

আমি রুদ্ধকণ্ঠে বলিলাম। “খুনী ধরা পড়িয়াছে—একঘণ্টা আগে ধরা পড়িয়াছে, আপনি তাহার নাম শুনিয়াছেন?

“না, তাহার নামটা এখনও শুনি নাই, জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিয়া গিয়াছি। ইনস্পেক্টরের ভারি বুদ্ধি! লোকটা খুব চালাক, অনেক সময়ে অতি বুদ্ধিতেই ইহাদের সর্ব্বনাশ হয়। ইনস্পেক্টার বলিতেছিল, এই লোক যখন-তখন খুনের কথা যদি না বলিত, তাহা হইলে কেহ কখনও ইহাকে সন্দেহ করিত না। একটা জায়গায় লোকটা সকলকে জোর করিয়া বলিতেছিল যে, এই খুনী কোন কালে ধরা পড়িবে না। সেইখানে একজন ডিটেটিভ উপস্থিত ছিল, লোকটার উপর তাহার সন্দেহ হয়, তাহাতেই লোকটা ধরা পড়িয়াছে। দেখিতেছেন সত্যেন্দ্রবাবু, আপনার বন্ধুর কথা খাটিল না।”

ডাক্তারের কথায় আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল। আমি আলো জ্বালিতে চেষ্টা পাইয়াও আলো জ্বালিতে পারিতেছিলাম না; যদি আলোতে ডাক্তার আমার মুখের তখনকার ভয়াবহ ভাব দেখিতে পান, তাহা হইলে তিনি কি মনে করিবেন—কি ভাবিবেন?

কতক্ষণ অলো না জ্বালিয়া থাকা যায়? আমি আলো জ্বালিয়াছি মাত্র—আর ডাক্তার আমার মুখ দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, “এ কি? আপনার অসুখ হইয়াছে, না–ভয়ানক কিছু হইয়াছে?” আমি মাথা নাড়িয়া অতিকষ্টে আত্মসংযম করিলাম, পরে বলিলাম, “একঘণ্টা আগে এই খুনী ধরা পড়িয়াছে—আর কিছু শুনিলেন?”

তিনি বলিলেন, “আর বিশেষ কিছু নয়। লোকটার উপর ডিটেটিভ অনেক দিন হইতে নজর রাখিয়াছিল, আজ পুলিস তাহাকে রাস্তায় ধরিয়াছে। সে হঠাৎ গ্রেপ্তার হওয়ায় এত স্তম্ভিত হইয়া পড়িয়াছিল যে, এ খুন অস্বীকার করিতেও পারে নাই।”

আমি মনে মনে ভাবিলাম, তাহা হইলে হরনাথের ভুল হয় নাই; যথার্থই ডিটেক্‌টিভগণ তাঁহার পিছু লইয়াছিল। তাঁহার বুদ্ধির অহঙ্কার করা সমস্তই বৃথা হইল! না জানি, এ কথা শুনিয়া হতভাগিনী কমলার কি অবস্থা হইয়াছে। আমি মৰ্ম্মাহত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “খুনী যে টাকা নোট চুরি করিয়াছিল, সে সম্বন্ধে কিছু শুনিয়াছেন?”

ডাক্তার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “না।”

আমি আমার সম্মুখস্থ খামটা দেখাইয়া বলিলাম, “সে নোট এই খামের মধ্যে।”

ডাক্তার বিস্ফারিত নয়নে প্রথমে কিয়ৎক্ষণ খামের দিকে চাহিয়া রহিলেন, তাহার পর বিস্মিতভাবে আমার মুখের দিকে চাহিলেন, চাহিয়া বলিলেন, “তাহার পর মহাশয়! কত দিন হইতে এরূপ রসিকতা শিখিয়াছেন?”

আমি বলিলাম, “রসিকতা করিবার অবস্থা আমার এখন নাই। যদি একটু আগে আপনি আসিতেন, তাহা হইলে আপনি খুনীকেও এখানে দেখিতে পাইতেন, এইখানেই তাহাকে আপনি দেখিয়াছিলেন, এই খুন লইয়াই তাহার সহিত অনেক আলোচনা করিয়াছিলেন।”

ডাক্তার অতি বিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন, “সে কি? আপনার সেই বন্ধু হরনাথবাবু! না আপনি কি বলিতেছেন, বুঝিতে পারিতেছি না।”

আমি সমস্তই তাঁহাকে বলিলাম, কিরূপে টাকা আমার কাছে আসিয়াছে, তাহাও বলিলাম। ডাক্তার দারুণ বিস্ময়ে আমার কথা শুনিতেছিলেন। আমি তাঁহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝিলাম যে, তিনি সহজে আমার কথা বিশ্বাস করিতে পারিতেছেন না।

আমার কথা শেষ হইলে, ডাক্তার বলিলেন, “এরূপ কথা আমি আর কখনও শুনি নাই। আমি লোকটাকে কেবল একদিন মাত্র দেখিয়াছিলাম, কিন্তু সে যে এরূপ ভয়াবহ কাজ করিতে পারে, তাহা আমি কখনও ভাবি নাই।”

আমি বলিলাম, “আমি তাঁহাকে যেরূপ জানি, আমি যেমন তাঁহার দয়ামায়া সচ্চরিত্রতার বিষয় জানি, তেমন যদি আপনি জানিতেন, তাহা হইলে আপনি কখনই এ কথা বিশ্বাস করিতে পারিতেন না। আর সেই লোক—সেই এমন ভাল লোক কিনা খুনী! খুনী-চোর–কি ভয়ানক—কি ভয়ানক!

ডাক্তার বলিলেন, “যাহা হউক, আপনার আর এক মিনিটও এই খাম এখানে রাখা উচিত নয়। চলুন, এখনই আমার সঙ্গে পুলিস-আফিসে চলুন, সেখানে আসামীর সঙ্গে দেখা করিতে ইচ্ছা করেন, তাহারও বন্দোবস্ত হইতে পারিবে। সকলেরই সঙ্গে আমার বিশেষ আলাপ আছে।” আমি বলিলাম, “চলুন, আমি এখনই যাইতে প্রস্তুত আছি—আমি আসামীর সঙ্গে একবার দেখা করিতে চাই।”

আমরা তখনই ডাক্তারের গাড়ীতে উঠিয়া পুলিস-আফিসের দিকে প্রস্থান করিলাম।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

পুলিশ-আফিসে আসিয়া ডাক্তার বলিলেন, “আপনি এখানে একটু দাঁড়ান, আমি সাহেবের সঙ্গে আগে দেখা করি, তাহা হইলে আপনাকে অনেক বাজে কথার জবাবদিহি করিতে হইবে না।”

ডাক্তার ভিতরে চলিয়া গেলেন, আমি বাহিরে শঙ্কিতহৃদয়ে তাঁহার অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।

প্রায় পনের মিনিট পরে ডাক্তার আমায় ভিতরে লইয়া গেলেন। দেখিলাম, এক চেয়ারে এক সাহেব অতীব গম্ভীর মুখে বসিয়া আছেন। তিনি আমায় দেখিয়া সম্মুখের চেয়ারে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। আমরা দুইজনেই তাঁহার সম্মুখে বসিলাম। সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি বলিতেছেন, যে লোক আপনাকে এই খামখানা দিয়াছিল, সে যোধমলকে খুন করিয়াছে বলিয়া আপনার কাছে স্বীকার করিয়াছিল!”

আমি। হাঁ—সে স্বীকার করিয়াছে।

সাহেব। আরও আপনি এই লোককে অনেক দিন হইতে চিনেন?

আমি হরনাথের সম্বন্ধে যাহা কিছু জানিতাম, সমস্তই তাঁহাকে বলিলাম, তবে যাহা হতভাগ্য হরনাথের বিরুদ্ধে না যায়, আমি তাহার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিলাম। সাহেব নীরবে শুনিয়া গেলেন। কথা শেষ হইলে, সাহেব বলিলেন, “তাঁহার এই স্বীকার ব্যতীত সে যে যোধমলকে খুন করিয়াছে, তাহার আর কোন প্রমাণ আপনি পাইয়াছেন?”

আমি। হাঁ—এই সাক্ষ্য যদি প্রমাণ হয়, তবে তাহাই প্রমাণ, অন্য কোন প্রমাণ আমি পাই নাই।

সাহেব। হাঁ, খামটাতে কি আছে, তাহা এখনই দেখা উচিত।

সাহেব খামখানা তুলিয়া বলিলেন, “এ দিকে সরিয়া আসুন, আমার বোধ হয়, ইহাতে যাহা আছে, তাহা দেখিয়া আপনারা বিস্মিত হইবেন।”

তিনি একখানা কাঁচি দিয়া, খামখানা কাটিয়া তাহার ভিতর হইতে একটা কাগজের বাণ্ডিল টানিয়া বাহির করিলেন। সেই বাণ্ডিল আর একখানা সাদা কাগজে জড়ানো ছিল, সাহেব সেখানি খুলিয়া ফেলিলেন। তাহার পর দেখিলেন, তাহার উপর লিখিত রহিয়াছে, “আমার কন্যা কমলার বিবাহের খরচ—তিন হাজার পাঁচশ চল্লিশ টাকা।”

এই কথা পড়িয়া আমার মনে হইল, যেন আমার দম বন্ধ হইয়া আসিয়াছে। সাহেব সে কাগজখানাও খুলিয়া ফেলিলেন, সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়সূচক শব্দ করিয়া উঠিলেন। আমি বিস্ফারিত নয়নে সেই বাণ্ডিলের দিকে চাহিয়া রহিলাম; আমি যাহা দেখিলাম, তাহাতে এত স্তম্ভিত হইয়া ছিলাম যে, আমার কথা কহিবার ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হইয়াছিল। আমি দেখিলাম, খামের মধ্যে নোট নাই, নোটের পরিবর্ত্তে কয়েক-খানা পুরাতন ছেঁড়া চিঠী—বাজে কাগজ!

আমি রুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া উঠিলাম, “এ সব কি-নোট কোথায়? যোধমলের কখনই এ সব জিনিষ নহে!”

সাহেব গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আপনি এই খামে নোট আছে বলায়, যথার্থই আমি বিস্মিত হইয়াছিলাম। যে খুনী ধরা পড়িয়াছে, যোধমলের সমস্ত নোটই তাহার কাছে পাওয়া গিয়াছে, সামান্য দু’দশ টাকা সে খরচ করিয়া ফেলিয়াছিল। এই খুনীর নাম হরনাথ নহে, ইহার নাম রঘুনাথ; এই লোক এক সময়ে যোধমলের গদীতে কাজ করিত। এখন হয় আপনার বন্ধুটি আপনার সহিত মজা করিয়াছেন, অথবা তাঁহার মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়া গিয়াছে।”

আমি চীৎকার করিয়া উঠিলাম, “তবে হরনাথবাবু খুনী নহেন!”

ডাক্তার বলিলেন, “আপনার বন্ধু যে খুনী নহেন, তাহা এখন বেশ জানা গিয়াছে, সাহেব যাহা বলিতেছেন, তাহা ঠিক, আপনার বন্ধুটি বদ্ধ-পাগল—ইহাকে পাগলা গারদে পাঠান একান্ত কৰ্ত্তব্য।”

আমি পুলিস-আফিস হইতে রাস্তায় আসিলে তখন আমার ভাবিবার ক্ষমতা ফিরিয়া আসিল—আমি তখনও ভাল কিছু বুঝিতে পারিতেছিলাম না। ডাক্তারের কথায় আমার চৈতন্যোদয় হইল। ডাক্তার বলিলেন, “সত্যেন্দ্রবাবু, যতদূর আমি বুঝিয়াছি, তাহাতে বোধ হয়, আপনি এই হরনাথবাবুর কন্যাকে ভালবাসেন। বোধ হয়, এই কন্যা তাহার বাপের অবস্থা আদৌ জানেন না। অথবা ইহা জানিয়াও গোপন রাখিতেছেন। যাহাই হউক, এরূপ লোকের সহিত বাস করা তাহার কন্যার পক্ষেও নিরাপদ নহে। যত শীঘ্র হয় হরনাথবাবুকে সরানো আবশ্যক।”

আমি ইহার উত্তরে কি বলিব? পাগলা গারদ! পাগলের—উন্মত্তের কন্যা কমলা—তাহাকে আমি বিবাহ করিব? কমলা নিশ্চয়ই তাহার পিতার অবস্থা জানে, সেইজন্যই সে বিবাহে অসম্মতা হইয়াছে, আমি বলিলাম, “আমি এখনই কমলার সহিত দেখা করিতে যাইতেছি।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *