ভিউ ফাইন্ডার
বিশাল খোলা জানলাটা দিয়ে নিভা নদীর শিরশিরে হাওয়া ঢুকছে ঘরে। পেলমেট থেকে মেঝে পর্যন্ত লুটিয়ে পড়া সাদা সিল্কের কারুকাজ করা ফিনফিনে পর্দা ভঙ্গে-বিভঙ্গে দুলছে। যেন গাউন পরে জানলার ধারে কোনও তরুণী দাঁড়িয়ে। এই শহরে বিকেল বলে কিছু হয় না। দিনের আলো মরতে মরতে রাত ন’টা। তার পরও আকাশে একটা অদ্ভুত ফ্যাকাশে নীলচে ভাব থেকে যায়। কলকাতার সন্ধে ভাঙার মতো। বাইরে মিটমিটে মনমরা আকাশটা ঝুলবারান্দার মতো মুখ নামিয়ে অপেক্ষা করছে এখন। আর একটা দিনের জন্য বোধহয়। নিভা নদীর রং অবশ্য কালচে। টলমল পায়ে এগিয়ে চলেছে বাল্টিক সাগরের দিকে। যেতে যেতে ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাসের মতো ঠান্ডা বাতাস। কে বলবে মে মাস চলছে!
পুলওভারের চেনটা গলা অবধি টেনে দিলাম। তবু গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে হিমেল হাওয়া। ঝাপটা মারছে জ্যাকেটের বাইরে দুটো অসহায় হাতে। তালুতে-তালু ঘষে নিজেকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা করলাম। এইসময় যে এখানে ঠান্ডা আমেজ থাকে, জেনে এসেছিলাম। কিন্তু জানা আর উপলব্ধির মধ্যে আশমান-জমিন ফারাক। আচমকা যেন কলকাতার ভরা শীত ঘিরে ধরেছে আমাকে! গত পরশু আমি এসেছি সেন্ট পিটার্সবার্গে। রাশিয়ার একসময়ের রাজধানীতে এবার হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। কলকাতা থেকে উজিয়ে এতদূর আসার কারণ, আমার একটা শর্টফিল্ম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শর্ট লিস্টেড হয়েছে। স্বল্প পরিসরের সিনেমা আমি বেশ কয়েকবছর ধরেই বানাচ্ছি। কমার্শিয়াল নয়। মূলত ফেস্টিভ্যাল ওরিয়েন্টেড ফিল্ম বানাই। এর সুবিধা হল, পুরস্কার-টুরস্কার পেয়ে গেলে ছবি বানানোর খরচটা উঠে আসে। নামও ছড়ায়। অবশ্য কখনওই নিজের পকেটের টাকা দিয়ে শর্টফিল্ম বানাই না। সে ক্ষমতা আমার নেইও। কাউকে না কাউকে এর জন্য জোটাতে হয়। স্পনসর পেলে তবেই ছবি বানাই। যে ছবিটা আন্তজার্তিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম দশে জায়গা পেয়েছে, সেটা বানাতে অনেক সময় লেগেছে। শুরুতে একজন কিছু টাকা দিয়েছিলেন। তারপর আচমকাই হাত তুলে নেন। কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল আমাকে। তার পর, আর একজন জোটাতে জোটাতে কেটে গিয়েছে দেড়টা বছর। সেন্ট পিটার্সবার্গে বসে আজ মনে হচ্ছে, আমার চেষ্টা, লেগে থাকা, পরিশ্রম সব সার্থক। শুধু একটাই প্রার্থনা, শর্টফিল্মটা যেন প্রথম তিনে জায়গা পায়। পুরস্কার অর্থটা ফ্যাক্টর নয়। জীবন কোনও না কোনও ভাবে কেটে যাবে। কিন্তু প্রথম তিনে যদি সিনেমাটা থাকে, তা হলে আমি, দীপঙ্কর চ্যাটার্জি, ডিরেক্টর হিসেবে টলিউডে পায়ের তলায় জমি পেয়ে যাব।
‘আর্মেনিয়ান কফি কখনও টেস্ট করেছেন, মিস্তার চাতারগি?’
ওল্গভের কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম। ফর্সা, দোহারা চেহারা লোকটার। মার্জিত ও পরিশীলিত ব্যবহার। আস্তে কথা বলেন। বয়সও এমন কিছু নয়। ষাটের এপারেই হবে। আমার পদবীর উচ্চারণটা কেমন হওয়া উচিত, বেশ কয়েকবার শিখিয়েছি ওল্গভকে। কিন্তু উনি প্রতিবারই ভুল করে চ্যাটার্জির বদলে ‘চাতারগি’ বলেন। রাশিয়ানরা ‘ট’কে ‘ত’ বলে। আর ‘জ’ এদের উচ্চারণে ‘গ’। যে কারণে রাশিয়ার পা দেওয়ার পর থেকে আমি বিদঘুটে পদবীর মালিক হয়ে উঠেছি।
জানলার গায়ে ছোট্ট টি-টেবলটার উল্টো দিকে চেয়ার টেনে বসলেন ওল্গভ। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘আর্মেনিয়ান কফির গুণ হল, এর মিষ্টি গন্ধ দীর্ঘক্ষণ শ্বাসনালিতে ঘুরে বেড়ায়। পার্ফিউমের মতো!’
আমি হাসলাম। সোদপুরে স্টেশন রোডের দোতলা বাড়ির নীচেতলায় একটা ঘরে ভাড়া থাকি। সিনেমা বানানো আমার নেশা হলেও পেশা নির্দিষ্ট নেই। এটা-ওটা করে দিন কেটে যায়। কার্যত বেকার একটা বছর তিরিশের যুবকের কাছে কফি বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। পিটার্সবার্গ আসার প্লেনের খরচ যোগার করতে অনেক টাকা ধার করেছি। এই অবস্থায় আর্মেনিয়ান কফির স্বাদ নিয়ে বেড়ানোর সুযোগ কোথায়!
ওল্গভকে বললাম, ‘আমরা ভারতীয়রা চায়ে আসক্ত। কফি বড় একটা চলে না। তবে আর্মেনিয়ান কফির নাম শুনেছি।’
ওল্গভ হাসতে হাসতে বললেন, ‘তা হলে প্রথম স্বাদেই আপনি এর প্রেমে পড়তে বাধ্য।’
ওল্গভ ইভানোকভের সঙ্গে পরিচয় হওয়াটা একেবারে কাকতালীয়। গতকাল থেকে শুরু হয়েছে চলচ্চিত্র উৎসব। জারেদের একসময়কার প্রাসাদ উইন্টার প্যালেস, স্টেট মিউজিয়াম চত্ত্বরটাকে বলা হয় প্যালেস স্কোয়ার। পুরো জায়গাটাকে গোল করে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য মিউজিয়াম। সেখানেই চলছে চলচ্চিত্র উৎসব। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য লোক এসেছে। এত বড় অনুষ্ঠান। অথচ কত গোছানো। বিভিন্ন বিভাগে যারা নমিনেশন পেয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক থেকে তাদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নিজের কার্ডটা তুলতে গিয়ে আলাপ ওল্গভের সঙ্গে। ভদ্রলোক যেচেই পরিচয় করেছিলেন। বিদেশ বিভুঁইয়ে লোকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব সেভাবে হয় না। কে কীভাবে নেবে, বোঝা মুশকিল। কিন্তু কোনও দেশের লোকজন, সংস্কৃতি, তাদের আচার-ব্যবহার-বিশ্বাস-অগ্রগতির ধারা বুঝতে হলে সে দেশের একজনকে পাশে পেলে ভালো হয়। ওল্গভ পেশায় ফিল্ম জার্নালিস্ট। সদাহাস্যময় লোকটাকে প্রথম থেকে মনে ধরে গিয়েছিল আমার।
রাশিয়ানরা ভদকার মতোই কফিও ভালোবাসে। যে কারণে পেল্লাই মগে গরম কফি এনেছেন ওল্গভ। কলকাতায় যে ব্ল্যাককফি খেয়েছি, তার রঙ গাঢ় কালো। আর্মেনিয়ান কফি বাদামী। বেশ স্ট্রং। ধোঁয়ার একটা কুণ্ডলি কফি মগটাকে গম্ভীর করে তুলেছে।
আর্মেনিয়ান কফিতে এক চুমুক দিয়ে আমি ওল্গভকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার কালেকশন দেখাবেন না?’
জানলার দিকে তাকিয়ে ছিলেন ভদ্রলোক। উদাসী ছায়া পড়েছে ওল্গভের মুখে। ওঁর মুখটা সেন্ট পিটার্সবার্গের আকাশের মতো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। চোখ দুটো গাঢ় লাল। জল কাটছে। ঠান্ডা লাগিয়েছেন নাকি? আমার কথা শুনে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওঁকে পাথরের মূর্তি বলে মনে হল। যেন নির্নিমেষ তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ওঁর একজোড়া লালচোখ অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে আমাকে।
বিরতি ভেঙে ধরা গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার জোডিয়্যাক সাইন কী?’
হঠাৎ এইরকম অবান্তর প্রশ্নে বেশ অবাক হলাম। রাশিয়ানরা ভীষণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়। তাই বলে অতিথির কাছে ঠিকুজি-কুষ্ঠি কেউ জিজ্ঞেস করে নাকি?
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, ‘লিও!’
‘আর অ্যাসেনডেন্ট?’
‘লিবরা! কিন্তু কেন বলুন তো? আপনি কি অ্যাস্ট্রলজি চর্চাও করেন নাকি?’ কিছুটা তাজ্জব হয়ে প্রশ্ন করলাম।
‘আপনার ভালো সময় আসছে।’ নির্ভার এক চিলতে হেসে ওল্গভ বললেন, ‘কফিটা শেষ করুন। কালেকশনগুলো দেখাব আপনাকে।’
ওল্গভের বাড়িটা পিটার্সবার্গ শহরের দক্ষিণ প্রান্তে, কুতোজভ এমব্যাঙ্কমেন্টে। আমি লের্মন্তোভস্কি প্রসপেক্টের আজিমুত হোটেলে উঠেছি। জায়গাটা মোটামুটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে। একটা ট্যাক্সি ধরে কুতোজভে ওল্গভের বাড়ি আসতে আধঘণ্টা হয়তো লাগত। আমি নিইনি। নতুন জায়গা চেনার সহজ উপায় হল, পায়ে হেঁটে ঘোরা। গত পরশু থেকে হেঁটেই মারছি। তার অবশ্য কারণও আছে। হোটেলের ভাড়া চোকানোর পর মাত্র দুশো ডলার পড়ে আছে পকেটে। আরও দুটো দিন রাশিয়ায় কাটানোর মতো যথেষ্ট অর্থ একেবারেই নয়। তাই ইচ্ছে থাকলেও বিলাসিতার উপায় নেই। যে কারণে, ওল্গভ পরিচয় হওয়ার পর যখন আমাকে ডিনারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। এক রাতের খাওয়া খরচ তো বেঁচে যাবে!
বিদেশে পা না দিলে বুঝতাম না, জিপিএস সিস্টেম আসলে কী! ওল্গভের বাড়ির অ্যাডড্রেস গুগল ম্যাপের ‘হোয়্যার টু’তে পুট করতেই ভার্চুয়াল গাইড হাত ধরে পৌঁছে দিয়েছে সঠিক জায়গায়। হাঁটতে হাঁটতে আসার সময় পিটার্সবার্গকে আরও গভীরে গিয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছি। নিভা নদীর শাখাপ্রশাখা মাকড়শার জালের মতো ঘিরে রয়েছে শহরটাকে। ছোট-বড় অসংখ্য ব্রিজ। যে কারণে পিটার্সবার্গকে ভেনিসের সঙ্গে তুলনা করা হয়। পড়ন্ত আলোয় বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল শহরটাকে। তিনশো বছর আগে এই শহর তৈরি করেছিলেন জার পিটার দ্য গ্রেট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পুরোটাই ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিল জার্মান সৈন্যরা। কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ধ্বংসস্তুপকে আবার পুরোনো চেহারায় ফিরিয়ে দিয়েছে রাশিয়ানরা। নতুন পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশছোঁয়া অসংখ্য পাথুরে বাড়ি, স্মৃতিসৌধ্য, চার্চ, চওড়া রাস্তাগুলোর মনের ক্ষত কি জুড়িয়েছে? কে জানে!
আর্মেনিয়ান কফিটা শেষ করতেই ওল্গভ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলুন। আপনাকে আমার কালেকশন দেখাই। তারপর ডিনার করা যাবে।’
ওল্গভের বাড়িটাও শহরের অন্যান্য প্রাচীন বাড়িগুলোর মতো, এক প্যাটার্নের। বিশাল এবং ছাই রংয়ের। ওল্গভের ফ্ল্যাটটা গ্রাউন্ড ফ্লোরে। বেশ বড়। অন্তত দু’হাজার স্কোয়্যার ফুট তো হবেই। ওল্গভের ফ্ল্যাটে অন্য কাউকে দেখিনি। একাই থাকেন বোধহয় ভদ্রলোক।
ওল্গভ হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘গত শতাব্দীর গোড়াতে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর দেশের সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রের হাতে চলে যায়। এই বাড়িটা আমার দাদু তৈরি করেছিলেন। উনি রাশিয়ান আর্মির উঁচু পোস্টে চাকরি করতেন। অর্থও প্রচুর রোজগার করেছিলেন। দাদু যখন বাড়িটা তৈরি করেন, দু’তলা ছিল। সরকার এই বাড়ি অধিগ্রহণ করে মূল স্ট্রাকচারের ওপর আরও চারটে ফ্লোর তুলে দেয়। আমরা কোনওরকমে টিকে যাই। কিন্তু নতুন-পুরোনো বাকি ফ্ল্যাটগুলো বিভিন্ন পরিবারকে বসবাসের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের ভাগে পড়ে শুধু এই ফ্ল্যাটটা।’
সব মিলিয়ে চারটে ঘর ফ্ল্যাটটাতে। ড্রয়িংরুম, লিভিংরুম, ডাইনিং, কিচেনও পেল্লাই। হাঁটার শব্দে উডেনফ্লোর থেকে চাপা গমগমে আওয়াজ উঠে আসছে। যেন ঐতিহাসিক গাম্ভীর্য ঘাপটি মেরে রয়েছে মেঝের তলায়। একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলেন ওল্গভ। ঘরের ভেতরে মৃদু আলো জ্বলছে। আমি ওঁকে অনুসরণ করলাম।
ওল্গভ বললেন, ‘আমি একা মানুষ। তিনটে রুম খালিই পড়ে থাকে। তাই এই ঘরটাকে কালেকশন রুম করে নিয়েছি।’ একটু থেমে দম নিয়ে চওড়া হেসে বললেন, ‘মিউজিয়ামও বলতে পারেন।’
রাশিয়ানরা ইতিহাস ঘিরে বাঁচে। শুধু এই পিটার্সবার্গেই আড়াই হাজার মিউজিয়াম আছে, শুনেছি। ওল্গভের প্রতি আকর্ষণটা বেড়েছিল ওঁর কালেকশনের কথা শুনেই। পুরোনো ক্যামেরা সংগ্রহের নেশা ভদ্রলোকের। আমার যে শর্টফিল্মটা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সিলেক্ট হয়েছে, সেটা এক ফোটোগ্রাফারের গল্প নিয়ে তৈরি। কথা প্রসঙ্গে ওঁকে সিনেমার গল্পটা বলার পর ওল্গভ নিজের হবির কথা বলেছিলেন। ভদ্রলোকের সংগ্রহে নাকি প্রায় পঞ্চাশটা রেয়ার ক্যামেরা আছে। শুনে অবাক হয়েছিলাম যেমন, দেখার ইচ্ছেও প্রকাশ করেছিলাম।
ওল্গভ ডিনারে নেমন্ত্রণ করে হেসে বলেছিলেন, ‘সিনেমার সমালোচনা, ক্যামেরা জমানোর পাশাপাশি আমি কিন্তু রান্নাটাও ভালো করি।’
কালেকশন রুমে পা দিতেই একটা পুরোনো চাপা গন্ধ ধাক্কা মারল নাকে। অনেকদিন কোনও ঘরে বন্দি থাকলে ভ্যাপসা গন্ধ জমিয়ে রাখে বাতাস। দীর্ঘশ্বাসের মতো। এও তেমনই। হালকা পচা দুর্গন্ধও মিশেছে তাতে।
আমাকে নাক টানতে দেখে ওল্গভ বললেন, ‘ইঁদুর-টিদুর মরে থাকতে পারে কোথাও। একা আর কত দিক সামলাব!’
ঘরে আগে থেকেই নিভু একটা আলো জ্বলছিল। ওল্গভ দেওয়ালের দিকে সরে গিয়ে কয়েকটা সুইচ পর পর জ্বালিয়ে দিলেন। ঘরের চেহারাটা পাল্টে গেল সঙ্গে সঙ্গে। একদিকের দেওয়ালে ইলেকট্রিক লাইটের লম্বাটে প্যানেল থেকে নরম লালচে আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আলোর তলায় সমান্তরাল ছায়া। দেওয়ালের গা ঘেঁষে মাথা তুলেছে গোল, ছোট্ট মাথাওয়ালা অসংখ্য উডেন স্ট্যান্ড। অনেকটা ছোট্ট ক্যাফেটেরিয়াগুলোর স্ট্যান্ডিং কফি টেবলের মতো দেখতে। তার ওপর রাখা কাচের শোকেসে দেখা যাচ্ছে একের পর এক ক্যামেরা। শোকেসের ভেতরে জ্বলছে স্বচ্ছ সাদা আলো। অন্ধকার আকাশে যেন অসংখ্য ঝলমলে তারা ফুটে রয়েছে।
চমৎকৃত হয়ে শোকেসগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হতবাক হয়ে গেলাম। এই ঘরে ইতিহাস উল্টো পায়ে হাঁটতে শুরু করেছে! এখন ডিজিটাল সিঙ্গল লেন্স রিফ্লেক্স বা ডিএসএলআর ক্যামেরার যুগ। যার শুরুটা গত শতাব্দীর শেষ দশকে। তার আগে ছিল এসএলআর। ওল্গভের কালেকশনটা এসএলআরের ওপর। বা আরও ভালো করে বললে ক্যামেরার বিবর্তন কীভাবে হয়েছে, কীভাবে বদলেছে চোখ-মুখ-চেহারা, তাই ধাপে ধাপে ফুটে উঠেছে শোকেসগুলোতে। ১৯৮৫ সালের মিনোল্টা ম্যাক্সাম সেভেন হান্ড্রেড, ১৯৭৭-এর পেনট্যাক্স কে থাউজেন্ড, ১৯৭৩-এর অলিম্পাস ওএম! ১৯৫৯ সালের নিকন এফ দেখে থমকে গেলাম। প্রথম প্রফেশনাল থার্টিফাইভ এমএম এসএলআর ক্যামেরা। এটা বাজারে আসার পর ফটোগ্রাফির দুনিয়াটা পাল্টে গিয়েছিল। লাইকা এম-থ্রি, পোলারয়েড নাইনটি ফাইভ, রোলেইফ্লেক্স অটোম্যাট দেখতে দেখতে শিউরে উঠলাম। এতদিন এগুলোর শুধু নামই শুনেছি। দেখার সৌভাগ্য যতটুকু হয়েছে গুগল সার্চ করে কিংবা ভিন্টেজ ক্যামেরা বিক্রির বিজ্ঞাপনে। ঝকঝক করছে ক্যামেরাগুলো। যেন সদ্য কিনে আনা হয়েছে। এখুনি জ্বলে উঠবে একটা ফ্ল্যাশবাল্ব। গাঢ় খয়েরি রংয়ের ফিল্মে খোদাই হয়ে যাবে আমার বিস্ময়াবিষ্ট ছবি। শোকেসের তলা থেকে ছড়িয়ে পড়া সাদা আলোয় আশ্চর্য সুন্দর দেখাচ্ছে জিনিসগুলো। ছবি তুলতে ভালোবাসুক আর না-ই বাসুক, যে-ই দেখবে, মুহূর্তে বিহ্বল হয়ে পড়বে। আমার মতো।
কিন এক্স্যাক্টা দেখে কথা হারিয়ে গেল। জার্মান কোম্পানির এই ক্যামেরা মানুষের মনে আশ্চর্য আগ্রহ তৈরি করেছিল ফটোগ্রাফি সম্পর্কে। ১৯৩৬ সালে বাজারে আসে। সারা বিশ্বে কত ক্যামেরা যে বিকিয়েছিল, ইয়ত্তা নেই। তার ঠিক পাশের শোকেসে লাইকা ওয়ান আমার শ্বাসরোধ করে দিল। ১৯২৫ সালের ক্যামেরা। ওল্গভ এত ভিন্টেজ ক্যামেরা জোটালেন কী করে? লোকটার টাকা আছে!
ওল্গভ বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন আমার মনে কথা। মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘একদিনে হয়নি, মিস্তার চাতারগি। প্রায় তিরিশবছর ধরে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে এই কাজ করে চলেছি।’
একটু থেমে বললেন, ‘এখানে যে ক’টা ক্যামেরা দেখছেন, সব ক’টার মিল কী, জানেন?’
এক আশ্চর্য আবেশ ডুবে গিয়েছি আমি। হাত দুটো নিশপিশ করছে ক্যামেরাগুলো ছুঁয়ে দেখার জন্য। ওল্গভের প্রশ্নটা তাও ধাক্কা মারল। মিল আবার কী! ছবি তোলা যায়!
লালচে আলোয় ওল্গভের চোখ দুটো অসম্ভব রকম উজ্জ্বল আর লাল দেখাচ্ছে। যেন প্রবল উত্তেজনার ওঁর শরীরের সমস্ত এসে থেমেছে দুটো বড়বড় চোখে। মিষ্টি হেসে ওল্গভ বললেন, ‘সব ক’টাই ডিফেক্টিভ!’
‘মানে?’
স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি। বলে কী লোকটা? ভিন্টেজ ক্যামেরার একটা বাজার আছে, জানি। বিপুল অর্থের বিনিময়ে সেসব কেনাবেচাও হয়। কিন্তু ডিফেক্টিভ ক্যামেরা? তা নিয়েও লোকের আগ্রহ আছে?
ওল্গভ আমার হতবাক মুখটার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। এই চমকটা দেওয়ার জন্য বোধহয় অপেক্ষা করছিলেন। ধীর গলায় বললেন, ‘যে কোনও প্রোডাক্ট বাজারে আনার আগে কোম্পানিগুলো প্রথমে একটা প্রাথমিক জিনিস তৈরি করে। যাকে বলে টেস্টিং মেটেরিয়াল। সেটা নিয়ে চলতে থাকে নানা এক্সপেরিমেন্ট। এরর্গলো কারেকশন করতে করতে জন্ম নেয় নতুন মডেল। ফুলপ্রুফ হলে তবেই বাজারে আসে। এখানে যত ক্যামেরা দেখছেন, সবই টেস্টিং মডেল। কোনও না কোনও ত্রুটি এগুলোর মধ্যে আছে।’
আমি বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে শুনছিলাম ওল্গভের কথা। তিনি ফের বললেন, ‘এইরকম জিনিস জোগার করা প্রায় অসম্ভব। কোম্পানিগুলো এসব হাতছাড়া করে না। তাদের কালেকশনে রেখে দেয়। বলতে পারেন এই পৃথিবীতে আমিই একমাত্র লোক, যার কাছে এইরকম জিনিস আছে।’
আমি আরও অবাক হলাম। হতভম্ব হয়ে বলে ফেললাম, ‘তার মানে? ক্যামেরাগুলো দিয়ে ছবি তোলা যায় না?’
‘যায়! আবার যায়ও না।’ হেঁয়ালি করে বললেন ওল্গভ।
আমি ওঁর কথাটা ধরতে পারলাম না। সত্যিই ধাঁধাঁ লেগে যাচ্ছে আমার। ঢোঁক গিলে বলে উঠলাম, ‘মশাই, সাংবাদিক হলে কী হবে, আপনিই তো দেখছি নিজেই স্টোরি মেটেরিয়াল!’
ওল্গভ হাসলেন প্রাণ খুলে। এই ঘরের চার দেওয়ালে ওঁর হাসি ধাক্কা খেতে খেতে ঘুরতে লাগল।
লক্ষ করে দেখলাম, ঘরে একটাও জানলা নেই। রেয়ার ক্যামেরাগুলো রাখার জন্যই এয়ার টাইট ঘরটা। যাতে ধুলোবালি কম পড়ে। লালচে নিভু আলোর জন্য এতক্ষণ বুঝতে পারিনি, ক্যামেরাগুলো ঘরের এক দিকে রাখা। সেই দিকেই যত আলো ছড়িয়ে রয়েছে। আলোর প্যানেল দেওয়ালে এমনভাবে ফিট করা যে, ঘরের উল্টোদিকে ছড়ায়নি। যে কারণে উল্টোদিকটা বেশ অন্ধকার। দূরে একটা বড় টেবল শুধু দেখতে পেলাম। তার একপাশে আবছা মতো একটা স্ট্যান্ড চোখে পড়ল।
আমি ওদিকে তাকাতেই ওল্গভ হঠাৎ যেন সতর্ক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘ওটা আর একটা কালেকশন। বলতে পারেন, সেরা জিনিস। তবে আজ নয়, আপনাকে কাল সকালে দেখাব!’
‘যেগুলো দেখলাম, তার থেকেও সেরা জিনিস?’ জিনিসটা কী, আমি দূর থেকেই বোঝার চেষ্টা করতে করতে বললাম।
ওল্গভ একটু কঠিন গলায় বললেন, ‘এখন বাদ দিন। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। চলুন, ডিনার করবেন।’
২
নির্দেশ মতো কয়েক পা হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালাম একটা সাদা ব্যাকড্রপের মতো দেওয়ালের সামনে। কয়েক মিটার দূরে আমাকে লক্ষ্য করে দুটো বড় জোরালো স্টুডিও লাইটস জ্বলছে। চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে ও দুটো। গনেগনে উত্তাপও ছড়াচ্ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছে নিলাম। বুকের কাছে দুটো হাত জড়ো করে দাঁড়াতেই ফ্ল্যাশগান ঝলসে উঠল। একবার, দু’বার, তিনবার, বারবার। ফ্ল্যাশের আলোয় মুহুর্মুহুচোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।
‘যথেষ্ট হল। এবার চলুন তো?’ কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বললাম ওল্গভকে।
আলো দুটোর পিছনে কাঠের ট্রাইপডের ওপর হলদে রংয়ের বাক্স মতো একটা সাবেকি ক্যামেরা। তাতে আমার ছবি তুলছেন ওল্গভ। পুরোনো দিনের ক্যামেরাগুলোয় ছবি তোলার সময় একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হত। যাতে অবাঞ্ছিত আলো না ঢুকে পড়ে। ওইরকম একটা কালো কাপড়ে মাথা ঢাকা দিয়ে ছবি তুলছেন ওল্গভ। ভদ্রলোকের নাছোড় ছবিবাসনা দেখে দুটো হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে ওঁর দিকে এগিয়ে গেলাম। ফ্ল্যাশগান এখনও থেমে থেমে ঝলসে উঠছে। লোকটার হল কী? দু’পা এগোতে মনে হল, কালো কাপড়ের বাইরে এতক্ষণ ওল্গভের যে আবছা অবয়বটা দেখতে পাচ্ছিলাম, সেটা নেই! লোকটা গেল কোথায়? ক্যামেরাটা বহু পুরোনো। অটোমেটিক মোডের প্রশ্নই নেই! ওইরকম ক্যামেরায় ফ্ল্যাশও থাকত না। ওল্গভ ওটা ইন্সটল করেছেন। ছবি তোলার সময় ম্যানুয়ালি চালাতে হয়। তা হলে নিজে নিজেই ফ্ল্যাশ জ্বলছে কী করে?
আলোর বলয় থেকে বেরিয়ে এসে ডার্করুমে দাঁড়ালাম। চোখ কিছুটা আরাম পেল। কিন্তু একরাশ অন্ধকার এখন আমাকে ঘিরে ধরেছে। সেটুকু সইয়ে নেওয়ার সময় মনে হল, পিঠে মিহি তপ্ত নিঃশ্বাস এসে পড়ছে। চকিকে ঘুরতেই দেখলাম, একটা লোক আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আলোর দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে লোকটাকে বুঝতে পারছি না। তা ছাড়া আপাদমস্তক কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। ওল্গভ আমার থেকে অনেকটা লম্বা। যে লোকটা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তার উচ্চতা তেমনই। কিন্তু বলিষ্ঠ চেহারা। একটা জান্তব ঘরঘরে শব্দ ভেসে আসছে লোকটার গলা থেকে। সভয়ে দু’পা পিছিয়ে যেতেই টাল সামলাতে পারলাম না। হুড়মুড় করে উল্টে পড়ে গেলাম।
প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি, সন্দেহ নেই। দ্রুত উঠে বসতেই দেখতে পেলাম, ডার্করুমটা পুরো অন্ধকার। এতক্ষণ ঘরের কোণে স্টুডিও ফ্লোরটাতে যে আলো দুটো জ্বলছিল, নিভে গিয়েছে। আকস্মিক অন্ধকার যেন আলোর শেষ বিন্দুটুকু নিমেষে শুষে ফেলেছে। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। দলা পাকানো ভয় আঁকড়ে ধরল আমাকে। অন্ধকারে প্রথমে কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না। হাত দিয়ে ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করতে মনে হল, তুলতুলে নরম কিছুর ওপর বসে আছি। বিছানা নাকি? মনে পড়ে গেল, ডিনারের পর ওঁর বেডরুমের উল্টো দিকের ঘরে আমার শোয়ার বন্দোবস্ত করেছিলেন ওল্গভ। তা হলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম? বুকটা এখনও তোলপাড় করছে। দরদর করে ঘাম পড়ছে কপালের দু’কোণ বেয়ে।
একটু জল পেলে ভালো হত। অন্ধকারটা খানিকটা সয়ে গিয়েছে। বেডসাইড টেবল থেকে মোবাইলটা তুলে ওটার টর্চ জ্বাললাম। ঘরটা বেশ বড়। এককোণে বিছানা। ঘরের অন্য দিকে কালো লেদারের সোফাসেট। তার সামনে নীচু ক্রিস্টল টেবলটার ওপর সিলভার কালারের জলের জাগটা রাখা। সোফার পেছনেই জানলা। উঠে গিয়ে পর্দাটা টেনে দিলাম। আকাশের রং এখন আরও ফ্যাকাশে। মেঘের আস্তরণ ক্রমশ জমা পড়ছে পিটার্সবার্গের মাথায়। বৃষ্টি আসবে যে কোনও সময়। মোবাইলের স্ক্রিনে দেখলাম— ২টো পাঁচ। সকাল হতে বিস্তর দেরি।
এক গ্লাস জল নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসলাম। বাজে একটা স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ঘুচে গিয়েছে। আবার আদর করে ডাকতে হবে তাকে। রাতটা এখানে থাকার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না আমার। এমনকি ওল্গভও সে প্রস্তাব আগে দেননি। ওঁর ভিন্টেজ ক্যামেরার কালেকশন দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেল। সেটা কোনও সমস্যা নয়। এইসব শহর এত আধুনিক যে, রাত যতই হোক না কেন, ক্যাব ঠিক পাওয়া যায়। চাইলেই অ্যাপে একটা ট্যাক্সি বুক করে হোটেলে ফিরে যেতে পারতাম। ওল্গভই জোর করলেন থেকে যাওয়ার জন্য। তা ছাড়া, উনি যে লোভটা দেখালেন, সেটাই বা হাতছাড়া করি কী করে?
মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিল। ওল্গভ ওই জিনিসটা আমাকে তখন দেখাতে চাইলেন না কেন? ওটা কি এমন মহার্ঘ্য জিনিস? তেপায়া একটা স্ট্যান্ড মতো জিনিস দেখেছিলাম। অন্ধকারে পুরোটা বোঝা না গেলেও, বস্তুটা অন্য জিনিসগুলোর থেকে আলাদা রাখা ছিল। তার মানে, ওটার গুরুত্ব বেশি। না হলে বাকি ভিন্টেজ ক্যামেরাগুলোর সঙ্গে ওটাকেও ডিসপ্লেতে রাখা হত। কেন এমনটা করেছেন ওল্গভ? কোনও বিশেষ কারণ আছে?
ব্যাপারটা মনে হতেই চাপা কৌতুহল হল আমার। অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করলাম। এখন রাত দুটো বাজছে। ওল্গভ নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি যে ঘরে আছি, তার উল্টো দিকে ওল্গভের বেডরুম। ফ্ল্যাটের অন্য প্রান্তে মুখোমুখি আরও দুটো ঘর। তার একটা কালেকশন রুম। এখন আমি ওখানে গেলেও ওল্গভের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। কথাটা মাথায় আসতেই একটা ঝোঁক চেপে গেল।
ঘরের বাইরে এসে সামান্য অস্বস্তি হল। ওল্গভের বেডরুম থেকে কোনও শব্দ আসছে না। পিটার্সবার্গ শহরটা গভীর ঘুমে লেপ্টে রয়েছে এখন। আর এই ফ্ল্যাটটা যেন কোনও গুহার পেটে আশ্রয় নিয়েছে। অবর্ণনীয় আদিম অন্ধকারে ঘেরা। টর্চ না জ্বালিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনটা অন করলাম। মিহি আলো ছড়িয়ে পড়ল ড্রয়িংরুমে। বাইরে থেকে ঝিরঝিরে আওয়াজ ভেসে আসছে। বৃষ্টির তুমুল ফোঁটা ভেজাতে শুরু করেছে তিনশো বছরের পুরোনো শহরটাকে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম ফ্ল্যাটের অন্য প্রান্তে। রাতে যখন ওল্গভের সঙ্গে কালেকশন রুম ঢুকেছিলাম, চাবি দিয়ে দরজা খুলেছিলেন। কিন্তু বেরোনোর সময় বাইরে থেকে শুধু লকটা টেনে দিয়েছিলেন। তার মানে ওই ঘরে ঢুকতে অসুবিধা হবে না। ওল্গভ যদি জানতেও পারেন, অনুমতি না নিয়ে আমি তাঁর কালেকশন রুমে গিয়েছিলাম, বুঝিয়ে বলব, ওঁর সেরা কালেকশনটা টানছিল আমাকে। নিছক কৌতুহল ছাড়া আর কোনও অভিসন্ধি ছিল না।
শুধু বৃষ্টি নয়, বাইরের দুনিয়ায় বোধহয় তাণ্ডবও শুরু হয়েছে। মুহুর্মুহু বজ্রপাতে চমকে উঠলাম। ঝিরঝিরে আওয়াজটার তীক্ষ্মতা বেড়েছে কয়েকগুণ। লকের হাতলটা ঘুরিয়ে আমি ওল্গভের কালেকশন রুমে ঢুকে পড়লাম। নিঃশব্দে বন্ধ দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়ালাম খানিকক্ষণ। বাইরে ঝড়বৃষ্টি দাপালেও এই ঘরটা সাউন্ডপ্রুফ। শুধু আমার উত্তেজক নিঃশ্বাসের ওঠা-পড়া শুনতে পাচ্ছি। যেন বুকের ভেতরে গাঙ্গেয় ঝড় বইছে। শরীরকে শান্ত হওয়ার সময় দিলাম কিছুটা। ওই সময়টুকু ঘরের আনাচেকানাচে মোবাইলের টর্চ বুলিয়ে নিলাম। শান্ত-নির্ঝঞ্ঝাট একটুকরো ঘর। টর্চের আলো জ্বেলে কয়েক পা এগিয়ে রাতে দেখা একপায়া লম্বাটে শোকেসগুলোর সামনে এসে দাঁড়ালাম। কালচে রংয়ের বিভিন্ন চেহারার ক্যামেরাগুলো যেন পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ঘরটা লম্বাটে ধরনের। পুরোনো আমলের স্কুলের ক্লাসরুমের মতো। যে কারণে ঘরের উল্টো দিকের কোণে কী রয়েছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। পা ফেলে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। ওখানেই রাখা আছে সেই তেপায়া ক্যামেরাটা। যেটা ওল্গভের সেরা কালেকশন। খানিকটা এগোতেই অবাক হলাম, যে তেপায়া ক্যামেরাটা রাতের বেলায় দেখেছিলাম, সেটা নেই! ওল্গভ কি জিনিসটা সরিয়ে ফেলেছেন? বয়সের দিক থেকে ক্যামেরাটা হয়তো অতি প্রাচীন। কিন্তু এতটা মহার্ঘ্য যে, ওল্গভ সরিয়ে ফেলবেন? নাকি, তিনি ধারণা করেছিলেন, ক্যামেরাটার টানে রাতে আসতে পারি আমি?
ঘরের চারটে দেওয়ালের রং চাররকম। যে দিকটাতে শোকেসে ক্যামেরাগুলো রাখা, সে দিকের দেওয়ালের রং বোধহয় কালচে সবুজ। ওল্গভের সঙ্গে যখন এসেছিলাম, লালচে আলোয় আরও কালচে দেখাচ্ছিল। অন্য দুটো দেওয়ালে হালকা রংয়ের শেড। আমি যে দিকটা দাঁড়িয়ে, সেখানকার দেওয়ালের রং বেগুনি। টর্চের আলো ফেলে পুরো জায়গাটা জরিপ করলাম। একটা গোল টেবল, কিছু বড় পেপার বক্স ছাড়া অন্য আর কিছু নেই। নিরাশ হয়ে ভাবলাম, ফিরে যাওয়াই ভালো। সকালে না হয় ওল্গভের সঙ্গেই আসব। তখনই মনে হল, দেওয়ালের একটা কোণে লম্বাটে একটা ছবির ফ্রেম লাগানো আছে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বুঝতে পারলাম, ওটা আসলে একটা দরজা। রংটা দেওয়ালের মতো বেগুনি হওয়ায় এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। ইচ্ছে করেই যেন দুটোর রং একরকম করা হয়েছে। যাতে চট করে কেউ বুঝতে না পারে!
দরজাটা হালকা ঠেলতেই খুলে গেল। আলতো পায়ে ঢুকে পড়লাম ঘরটার মধ্যে। ছোট একটা ঘর। মূল ঘরের পিছনে এই ঘরটা দেখে কলকাতার বনেদি বাড়ির চোরাকুঠুরির কথা মনে পড়ে গেল। টর্চের আলো ঘরময় ঘোরাতেই কোণের দিকে দেখতে পেলাম তিনপায়া ক্যামেরাটা। ঘোমটার মতো করে কালো কাপড়ে ঢাকা। একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করলাম। আমি এগিয়ে গিয়ে কালো কাপড়টা সরিয়ে দিতে পুরো ক্যামেরাটা ভেসে উঠল। দূর থেকে যেটাকে কালচে বলে মনে হচ্ছিল, আসলে ওটা গাঢ় খয়েরি রংয়ের। একটা ছোট পেপার বাক্সের মতো দেখতে। মোটা পাইপের মতো চকচকে পিতলের লেন্স বেরিয়ে রয়েছে। জিনিসটার ওপর টর্চ ফেলে ভালো করে দেখার পর মনে হল, এটার বয়স একশোর বেশিও হতে পারে। ডাগ্যুয়েরো টাইপ ক্যামেরা। ফটোগ্রাফির দুনিয়ার একেবারে শুরুর দিকে এইরকম ক্যামেরার রাজত্ব ছিল। যত দূর মনে পড়ছে লুই ডাগ্যুয়ের নামে এক ফরাসি ভদ্রলোক এমন ক্যামেরা আবিষ্কার করেছিলেন।
আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, ক্যামেরাটা সারা গায়ে আঁচড়ের দাগ! ধারাল ছুরি দিয়ে ক্যামেরাটা বাদামী চামড়াটা ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। তাও জিনিসটা ঝকঝকে আছে। ক্যামেরাটা যে জায়গাটায় রাখা, তার উল্টো দিকে একটা ফটফটে সাদা দেওয়াল। স্টুডিওতে যেমন ফটোগ্রাফি ফ্লোর থাকে, তেমন। ক্যামেরাটার গায়ে কালো কাপড়টা চাপিয়ে দেওয়ার পর মনটা হালকা লাগছিল। সত্যিই জিনিসটা জব্বর। কালেকশনে রাখার মতোই।
আমাকে যে মোহটা এতক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, ক্যামেরা দর্শনের পর সেটা কেটে গিয়েছে। এই ঘরটা বোধহয় ডার্করুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দরজার উল্টো দিকের দেওয়ালে একটা বড় বোর্ড মতো লাগানো। তাতে অসংখ্য ছবি পিনআপ করা। বোর্ডের সামনে টেবলটাতে বেশ কয়েকটা বড়বড় ট্রে। কাছে গিয়ে মনে হল, ট্রেতে রাখা তরল পদার্থটা আসলে ফটো ডেভলপিং সলিউশন। এখন ডিজিটাল ক্যামেরার যুগ। কিন্তু ডাগ্যুয়েরোটাইপ ক্যামেরায় ফিল্ম দিয়েই ছবি তুলতে হয়। ফলে ছবি ডেভেলপ করার ব্যবস্থাও রেখেছেন ওল্গভ। বোর্ডে সাঁটানো ছবিগুলো বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েদের। সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডটা দেখে মনে হল এই ঘরেরই। মেঝেতে অনেকগুলো ছবি পড়ে আছে। কয়েকটা হাতে তুলে নিতে বুঝলাম, প্যানেল ফটোগ্রাফি। একই পুরুষ বা মহিলার বিভিন্ন মুভমেন্টের ছবি পর পর তোলা। একটা মেয়ের ছবি খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে কিছুটা অবাক হলাম। কয়েকটা শটের পর তার মুখের হাসি যেন মিলিয়ে গিয়েছে। তার বদলে একটা আতঙ্কের ছায়া। সাদাকালো ছবিগুলো খুব একটা স্পষ্ট নয়। অনেকটা ব্লার মতো। ছবির পিছনে সাদা ব্যাকগ্রাউন্ড হলেও একটা ঘোর অন্ধকার ফুটে উঠেছে। ওই অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে একটা দেওয়াল ঘড়ি। রেডিয়াম দেওয়া কাঁটাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওই অন্ধকারে আরও একটা আবছা জিনিস দেখা যাচ্ছে। ভালো করে দেখার জন্য মোবাইলের টর্চটা ফেললাম ছবির ওপর। একটা অস্পষ্ট তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা! ধীরলয়ে সেটা পেছন থেকে নেমে আসছে মেয়েটাকে লক্ষ্য করে। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি হলেও পরের শটগুলোতে মেয়েটার বুকে, গলায় কাঁধে কালচে রক্তের ধারা দেখা যাচ্ছে।
ছবিটা দেখে আমার নিঃশ্বাস আটকে গেল। এগুলো কীসের ছবি? দেওয়ালটার দিকে চোখ চলে গেল আমার। টর্চের আলোয় সাদা দেওয়ালটা আরও সাদাটে দেখাচ্ছে। দেওয়াল ঘড়িটা যান্ত্রিক নিয়মে এগিয়ে চলেছে সময়ের ঘর বেয়ে। একটা শিরশিরে ঠান্ডা স্রোত ঘাড়ের পিছন থেকে দ্রুত বয়ে এল আমার দু’হাতে। কেঁপে উঠল আমার শরীর। আমি ঢোঁক গিলে মেঝের দিকে তাকালাম। আরও অনেক ছবি পরে রয়েছে মাটিতে। প্রচণ্ড আতঙ্ক নিয়ে প্রতিটা ছবি উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম। এক প্যাটার্নের ছবি। কোথাও কোনও বদল নেই। ছবিগুলো যাদের, তাদের হাসি মুখ পাল্টে যাচ্ছে আতঙ্কে, যন্ত্রণায়। একটা তীক্ষ্ম ছুরির ফলা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে প্রত্যেককে। আমি তীব্র ভয়ে একের পর এক ছবি উল্টে যাচ্ছি। দেখতে ইচ্ছে করছে না। তবু আমার অদম্য কৌতুহল বাধ্য করছে ছবিগুলো দেখতে। প্রায় গোটা কুড়ি ছবি দেখার পর আমার হাত থেকে মোবাইলটা মাটিতে পড়ে গেল। আমি বুঝতে পারছি, আমার হাঁটু থরথর করে কাঁপছে। অস্থির আতঙ্ক আমার মেরুদণ্ডে বার্তা পাঠাচ্ছে, পা-লা-ও… পা-লা-ও… এ-খা-ন… থে-কে…!
যে ছবির প্যানেলটা আমার হাতে রয়েছে এই মুহূর্তে, সেটা আর কেউ, খোদ আমি! এই ঘরে পাঁচ মিনিটও হল ঢুকিনি। এর মধ্যে আমার ছবি কে তুলল? কে-ই বা ডেভেলপ করল? একটু আগে একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। এতক্ষণ সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। মনে পড়ে গেল। স্বপ্নে কেউ আমার ছবি তুলছিল। ছ’টা প্যানেল ছবি রয়েছে এখানে। আগের ছবিগুলোর ধারা যদি মানি, তা হলে আরও চারটে ছবি তোলা হবে আমার। আর ওই চারটে ছবি তোলার সময় পেছন থেকে নেমে আসবে একটা ধারাল ছুরি। ফালাফালা করে দেবে ঘাড়, গলা, হৃদপিণ্ড। স্তব্ধ হয়ে এই ঘরে পড়ে থাকব আমি!
আমার সব ভাবনা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। অন্য ছবিগুলো আবার উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম। এই অতর্কীত আক্রমণের একটা নির্দিষ্ট সময় আছে— রাত তিনটে! অসম্ভব টেনশনে স্থবির হয়ে যাওয়া শরীরটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে সচল করার চেষ্টা করলাম। মেঝে থেকে মোবাইলটা তুলে দেখলাম, রাত তিনটে বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। আর পনেরো মিনিট পরে বাকিদের মতো হাল হবে আমার! যাই হোক না কেন, এখান থেকে বেরোতে হবে। ওল্গভ একমাত্র বাঁচাতে পারেন আমাকে। কেন যে এই ক্যামেরাটা দেখার ফালতু ঝোঁক চেপেছিল মাথায়!
আমি ঢোকার সময় বড় ঘরের দরজাটা বন্ধ করেছিলাম। কিন্তু এটা খোলাই ছিল। পিছন ফিরতেই দেখলাম, ঘরের দরজাটা বন্ধ! নিঃসাড়ে উঠে আসা আতঙ্কটা গিলতে গিলতে দৌড়ে গেলাম দরজাটার সামনে। হাতল টানতেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম, ওটা বাইরে থেকে বন্ধ! এটা কী করে সম্ভব? ওল্গভ কি বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছেন দরজাটা? সমস্ত শক্তি জড়ো করে আমি দরজায় ধাক্কা দিলাম।
চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘মিস্টার ইভানোকভ। আমি এই কালেকশন রুমটার ছোট্ট ঘরটাতে আটকে পড়েছি। প্লিজ আমাকে বাঁচান। মিস্টার ইভানোকভ? আপনি কোথায়?’
ছোট্ট ঘরটার চার দেওয়ালে আমার কথা ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। কিন্তু ঘরের বাইরে থেকে শব্দ পেলাম না। বাইরের ঘরটার মতো এই ঘরটাও সাউন্ডপ্রুফ। আমি চেঁচিয়ে গলা ছিঁড়ে ফেললেও কেউ আসবে না। তবু চেষ্টা করলাম। কিন্তু বাতাসের মতো আমার প্রতিটা শব্দ এই ঘর শুষে নিল। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমি ক্রমশ ভেঙে পড়তে লাগলাম। সাহসের সব মুঠো আলগা হয়ে আসছে। ভরসা আর বিশ্বাসের দুটো জ্বলন্ত মোমবাতির শিখা চোখের সামনে দপদপ করে লাফাচ্ছে। শেষবারের মতো। এবার নিভে যাবে! দরজায় পিঠ দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমি মেঝেতে বসে পড়লাম। এখানে আমি শেষ হয়ে গেলে কেউ কিছু জানতে পারবে না। আমার বুড়ো বাবা-মা কৃষ্ণনগরে থাকেন। তাঁরা এটুকু জানবেন, ছেলে রাশিয়ার একটা শহরে গিয়ে চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছিল। অস্থিরতার একটা গুণ হল, সে থিতিয়ে যেতে দেয় না কাউকে। সীমাহীন ভয়, লাল পিঁপড়ের মতো ছেঁকে ধরা আতঙ্ক আবার অস্থির করে তুলল আমাকে।
হাতের মোবাইলটার দিকে চোখ পড়তেই কিছুটা ভরসা পেলাম। আরে, মোবাইলটা আছে তো। ওল্গভকে ফোন করতে পারি। এতক্ষণ খেয়াল করিনি, মোবাইলটার মাথায় নেটওয়ার্ক টাওয়ারের ঘরটা শূন্য। নো সার্ভিস হয়ে রয়েছে! এই ঘরের ভেতর নেটওয়ার্ক কাজ করে না। ঘরের বাতাস হঠাৎই যেন আগের থেকেও শীতল হয়ে এল। তার মধ্যেও বেঁচে থাকার আকাঙ্খা আমার হাত দুটোকে মরিয়া সচল করে তুলল। ভারী কাঠের দরজায় আছড়াতে লাগলাম দুটো হাত। গমগম করে শব্দ উঠছে দরজা থেকে। তীব্র একটা যন্ত্রণা অনুভব করছি হাতে। চামড়া কেটে যাচ্ছে তালুর। তবু, থামাতে পারছি না নিজেকে। আমার চেষ্টা, আবেদনটুকুই সাড় হল। কেউ এগিয়ে আসেনি আমার জন্য। অঝোরে কেঁদে উঠলাম আমি। ‘মা-মা গো-ও-ও-ও! আমাকে বাঁচাও, মা!’
দু’কোল ছাপিয়ে নামতে থাকা জলের ধারায় আমার মুখ ধুয়ে যাচ্ছে। ছাদের কার্নিশ বেয়ে যে ভাবে টপটপ করে পড়ে বৃষ্টির জল, সে ভাবে থুতনি বেয়ে গড়াচ্ছে। টি-শার্টের বুকের কাছটা ভিজে উঠছে। আমার ঠান্ডা লাগছে প্রচণ্ড। আমার চোখের জল কি ঘরের হীমশীতল বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে বরফ হয়ে যাচ্ছে?
মেঝে থেকে মোবাইলটা তুলে দেখলাম, তিনটে বাজতে দশ। জীবনের শেষ দশটা মিনিট রয়েছে হাতে। আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম ক্যামেরাটার দিকে। ওটা কি মৃদু কাঁপছে? ঘুমন্ত মানুষের শরীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে যেমন কাঁপে! একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, যে স্বপ্ন দেখেছি, তার সঙ্গে এই ক্যামেরার কোনও না কোনওভাবে একটা লিঙ্ক আছেই। কিন্তু কীভাবে, সেটাই বুঝতে পারছি না। এই ঘরে ঢোকার একটাই রাস্তা। সেটাও বাইরে থেকে বন্ধ। খুনি কি দরজা খুলে এই পথ দিয়েই ঢুকে আসবে?
দেওয়াল ঘড়িটা অবিরাম ঘুরে চলেছে। এক-একটা সেকেন্ডকে যেন খচ…খচ শব্দে চপার দিয়ে কাটছে ঘড়ির কাঁটা। সেকেন্ড থেকে মিনিটে পাল্টে যাচ্ছে তার আবিরাম প্রচেষ্টা। ওয়াল ক্লকটা যেন নিজের ডেস্টিনেশন জানে! আমি শিউরে উঠলাম। এখান থেকে কি বেরোনো যাবে না? সত্যিই আর বাঁচব না? একটা শেষ চেষ্টা করতেই হবে। আমি মরিয়া হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। টর্চের আলো ফেলে পুরো ঘরটা আবার খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। ছোট্ট একটা ঘর। মেঝেটা নিরেট পাথরের। প্রাণহীন নিস্তবদ্ধতা নিয়ে ওটাও যেন আমার গতিবিধি নজর রাখছে। ঘরের কোণে টেবলটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। ওটার তলায় অনেকগুলো পেপার বক্স। এই ঘরের বাইরেও এমন অনেক বাক্স দেখেছি। কী আনা হয় এসবে করে? হাতে আর দশ মিনিটও নেই। ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে স্টুডিও ফ্লোরটার দিকে একবার তাকালাম। অন্ধকার ওখানে কি কিছুটা তরল? গলা শুকিয়ে এল আমার। টেবলের তলায় রাখা পেপার বাক্সগুলো ঘাঁটতে লাগলাম। একটা অস্ত্রও যদি পাওয়া যেত, নিশ্চিত মৃত্যুর আগে প্রত্যাঘাত করার জন্য! সমস্ত পেপার বক্স সরাতে গিয়ে একফালি চওড়া কাঠ ভেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে টেবলটাকে ঠেলে সরিয়ে পাথরের মেঝের গায়ে একটা পাটাতন দেখতে পেলাম। গায়ে একটা আংটা। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে উঠলাম আমি। তার মানে, এখান থেকে বেরোনোর একটা রাস্তা আছে! কাঠের পাটাতনটা বেশ ভারী। সমস্ত শক্তি জড়ো করে টেনে ওটা খুলে ফেললাম। পচা দুর্গন্ধময় বাতাস একলাফে উঠে এসে ছড়িয়ে পড়ল আমার ওপর। নাকে হাত দিয়ে এক পা সরে গেলাম। নীচে একটা সুরঙ্গের মুখ ভেসে উঠেছে। একটা মানুষ স্বচ্ছন্দে গলে যেতে পারে। পুরোনো আমলের রাশিয়ান বাড়িগুলো কি কলকাতা শহরের মতো ছিল? এ সব নিয়ে আমার ভাবার সময় নেই। নিজেকে যে ভাবেই হোক বাঁচাতে হবে। দ্রুত নেমে পড়লাম গর্তটাতে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশেরও কম সময় লাগল নীচে নামতে। বুক সমান গর্তটাতে দাঁড়িয়েই বুঝতে পারলাম, আমার বাঁ হাতের দিকে আর একটা হোল আছে। ওই পথটাই ধরতে হবে। মৃদু একটা পদধ্বণি শুনতে পাচ্ছি। কাঠের মেঝেয় খসখসে পায়ে খুব সন্তর্পণে কেউ হাঁটছে। সে কি আসছে?
বাঁ পাশের গর্তটা আরও ছোটো। নীচু হয়ে ওটাতে ঢোকার সময় মনে হল, দেওয়াল কেটে বসে যাবে আমার গায়ে। গোলাকার গর্তটা এতই ছোট যে, হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। একবুক নিঃশ্বাস নিয়ে দ্রুত হাঁটু বেয়ে এগোতে থাকলাম। সামনে থেকে যে সামান্য ছেঁড়াছেড়া বাতাস বয়ে আসছে, ফ্রেশ মনে হচ্ছে। কিন্তু পচা দুর্গন্ধটাও বাড়ছে তালমিলিয়ে। খোলা কোনও জায়গায় গিয়ে পৌঁছব। মৃত্যুভয়ে আরও দ্রুত চলতে শুরু করলাম। মিনিটখানেক এগোনোর পর মনে হল, সুরঙ্গের মুখটা বড় হয়ে আসছে। মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে দেখলাম, একটা বড় হলঘর। তবে বেশ পুরোনো। মাথার ওপর কড়িবড়গা। বহুদিনের জমে থাকা পুরু কার্পেটের মতো ঝুল শিলিং থেকে ঝুলছে। ঘন ধুলো আর ময়লায় ঢাকা পড়েছে ভাঙাচোরা মেঝে। এখানে দীর্ঘদিন কেউ পা দেয়নি। পাথরের দেওয়ালে লম্বাটে বেশ কয়েকটা কাঠের বাক্স পর পর হেলিয়ে রাখা। বাক্সগুলো দেখতে কফিনের মতো। ধুলো আর ঝুলে সেগুলোও প্রায় পরিত্যক্ত। ভ্যাপসা, পচা গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, দরজা-জানলাহীন নিরেট একটা ঘর! এখান থেকে নিশ্চয়ই বেরোনোর জায়গা আছে। না হলে এই কফিনের মতো বাক্সগুলো এল কী করে? মনে হতে কাঠের বাক্সগুলোর মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। প্রতিটা বাক্সের গায়ে একটা করে পুরোনো সাদাকালো ছবি লাগানো। একটা বাক্সের সামনে গিয়ে ছবির ওপর মোবাইল টর্চের আলো ফেললাম। একটা মেয়ের হাসিমুখের ছবি। সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। যে প্রবল উৎসাহ আমাকে এতক্ষণ তাতিয়ে রেখেছিল, ভরসা দিচ্ছিল, সেটা নিমেষে মুছে গেল। ওপরে যে ছোট ঘরটা এতক্ষণ ছিলাম, সেখানে অনেক ছবির মধ্যে কুড়ি-একুশ বছরের এই মেয়েটার ছবিও আমি দেখেছি। খুন করার পর এই কফিনগুলোতে রাখা হয় মৃতদেহ! যে পচা গন্ধটা এখান থেকেই ছড়াচ্ছে। পাশের বাক্সটার দিকে নজর গেল আমার। ওটার ডালাটা আধখোলা। ভেতরটা শূন্য। কিন্তু ডালার ওপর একটা ছবি লাগানো আছে। যেন সদ্য তোলা হয়েছে ছবিটা। ফটো প্রিন্টের পেপার এখনও কাঁচা। আমি ছবিটার ওপর ঝুঁকে পড়েই সভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে এলাম। পোস্টকার্ড সাইজের ছবিটা আমার! আতঙ্কটা আবার হাঁটুবেয়ে তরতর করে উঠতে শুরু করেছে। আর কিছুক্ষণ পর এই বাক্সেই রাখা হবে আমার নিথর দেহ! যাবতীয় বন্দোবস্ত করা হয়ে গিয়েছে। অসহায় হয়ে আমি ঘরের চারদিকে তাকালাম। প্রতিটা প্রান্ত, প্রতিটা কোণ, দেওয়ালের ভাঁজ পাগলের মতো ছুটে গিয়ে পরীক্ষা করলাম। পালানোর কোনও পথ নেই। এটা একটা ফাঁদ। ইঁদুরের মতো একটা খাঁচায় আমি বন্দি! ধুলোবালির মধ্যে বসে পড়ে আমি হাঁপাতে লাগলাম। মোবাইলটা এমন সময় টুং শব্দ তুলে যেন সজাগ হল। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ব্যাটারি ড্রেন হওয়ার আগে শেষ নোটিফিকেশন দিয়েছে যন্ত্রটা। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা টুং শব্দ তুলে ক্লান্তিতে চোখ বুজল মোবাইলটা। দলাপাকানো ভয় আর ঠান্ডা কুয়াশার মতো আশঙ্কা ঘূর্ণী ঝড়ের মতো আমার সমস্ত স্নায়ুতে আছড়ে পড়ল। আমার বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টার মাঝে যে সামান্য আলোটুকু ছিল, সেটাও নিভে গেল। এই ঘরের সীমাহীন অন্ধকারে বসে মনে হল, স্যাঁতস্যাতে আদিম ভীতি চারপায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম আমি। পাথুরে দেওয়াল আমাকে পিছন থেকে ঠেলে ধরেছে।
‘মিস্তার চাতারগি?’
দুটো মিহি শব্দ আমার কানে এসে ধাক্কা মারল। কক্কে ডাকছে আমাকে? সত্যিই কেউ ডাকছে? নাকি, আমি আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যাচ্ছি? বেঁচে থাকার তাড়নায় আমার সিস্টেম ক্র্যাশ করে যাচ্ছে?
‘মিস্তার চাতারগি, আপনি কোথায়?’
ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালাম। অন্ধকার হাতড়ে এলোমেলো দৌড়ে দেওয়ালের যে গর্তটা দিয়ে ঘরে নেমেছিলাম, সেখানে কান পেতে শুনলাম আবার, ওল্গভের গলা। না-না, আমি পাগল হইনি। ওটা ওল্গভেরই গলা।
আমি চেঁচিয়ে ভেজা গলায় বলে উঠলাম, ‘মিস্টার ইভানোকভ। আ-আ-আপনি কোথায়? আমি ম্যানহোলটা দিয়ে নীচের ঘরে নেমে এসেছি। আপনি আমাকে বাঁচান প্লিজ, আমাকে বাঁচান।’
ম্যানহোল বেয়ে ওল্গভের গলা ভেসে এল, ‘আপনি উঠে আসুন তাড়াতাড়ি। একেবারে সময় নেই। দেরি করবেন না। বিপদ হয়ে যাবে।’
ওল্গভ কেন বললেন, ‘দেরি করবেন না’, আমি খুব ভালো করে জানি। হাতে আর বোধহয় মিনিটখানেক আছে। এই সময়টুকুর মধ্যে এই ঘর, ওপরের স্টুডিও ফ্লোর, কালেকশন রুম, ওল্গভের ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে আমাকে। যে করেই হোক বেরোতে হবে।
মেঝের গর্তের মুখেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ওল্গভ। হাতে টর্চ। রাতের পোশাকে লোকটাকে দিশেহারা লাগছিল। মুখের রং ফ্যাকাশে। আমাকে দেখেই ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলেন।
আমি ম্যানহোলটা থেকে উঠে দাঁড়াতেই উনি ভয় পাওয়া গলায় বললেন, ‘আপনি এখানে এলেন কী করে? কেন এলেন? আমি তো বলেছিলাম, কাল সকালে ক্যামেরাটা দেখাব!’
ওল্গভের কথার কী জবাব দেব? সত্যি অন্যায় করেছি। না হলে এমন বিপদে পড়তে হত না।
‘আপনি জানেন না, কী ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন! একটা অভিশাপ হাতছানি দিচ্ছে আপনাকে। আপনি জানেন না, ওর খিদে, তৃষ্ণা সব আছে। রক্তমাংসের শরীর চায় তার! গত তিরিশবছর ধরে ওর নির্দেশ পালন করতে করতে আমি ক্লান্ত। বিশ্বাস করুন, আমি চাইনি আপনি ওটার শিকার হন। কিন্তু আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সে আমাকে বাধ্য করে।’
‘কক্কে? কার কথা বলছেন আপনি? কীসের অভিশাপ?’ কাঁপা গলায় বললাম কোনওরকমে।
আঙুল তুলে ক্যামেরাটার দিকে দেখালেন ওল্গভ। ‘ওই, ওই ক্যামেরাটা! ওটা ক্যামেরা নয়! ওটা, ওটা কোনও যন্ত্রও নয়। ওটা আসলে…’
একটু থেমে ওল্গভ ফিসফিস করে বললেন, ‘পালান, আপনি এখান থেকে। তিনটে বাজতে আর এক মিনিটও দেরি নেই। পালান, পালান এখান থেকে।’
ওল্গভের কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখলাম, স্টুডিও ফ্লোরের দিকের অন্ধকারটা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। যে ক্যামেরাটা একটা কালো কাপড়ের নীচে গভীর ঘুমে তলিয়ে ছিল এতক্ষণ, ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। একটা ঘরঘর আওয়াজ পাচ্ছি। চাপা রাগে যেন গজরাচ্ছে কেউ! হিংস্রতার লাভা গড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। আবছা আলোয় দেখতে পেলাম, একটা তীক্ষ্ণ ছুরির চওড়া ফলা ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। অবাক হয়ে দেখলাম, ক্যামেরাটা যেন অদৃশ্য একটা হাত দিয়ে ধরে রয়েছে ছুরিটা!
আমি প্রচণ্ড ভয়ে কাঁপা হাত তুলে ওল্গভের পিছন দিকে নির্দেশ করলাম। ওল্গভ পিছন ফিরতে ফিরতে আমাকে দরজার দিকে ঠেলে দিলেন। ফিসফিস করে ফের বললেন, ‘পালান। আপনি পালান।’
ডার্করুমের খোলা দরজাটার দিকে ছুটতেই মনে হল, ওটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওল্গভের রক্ত জল করা আর্তচিৎকার ভেসে এল পিছন থেকে। আমি থামলাম না। দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগেই আমাকে বেরোতে হবে।
৩
আজকাল সন্ধের পর থেকে মাথাটা ভার হয়ে থাকে। চোখ দুটো লাল হয়ে যায়। জল কাটে। মাথা রগগুলো দপদপ করে। ব্যথা কমার একটা ওষুধ খেয়ে নিলাম। চাঙ্গা রাখতে হবে নিজেকে। সৌরভ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো এসে পড়বে। দোতলার ব্যাকনিতে এসে দাঁড়ালাম। রাশিয়া থেকে ফিরে উত্তরপাড়ায় গঙ্গার ধারে এই দোতলা বাড়িটা কিনেছি। সন্ধের পর থেকে জায়গাটার রূপই বদলে যায়। কালো জলের তরঙ্গে আলোর চাঁদমালা ভাসে। মনে হয় গঙ্গা যেন একটা লম্বা হীরের নেকলেসের মতো বয়ে যাচ্ছে। ব্যালকনিতে রাখা ইজিচেয়ারটাতে হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলাম।
রাশিয়া থেকে ফেরার পর আমার জীবনটা একলহমায় পাল্টে গিয়েছে। এবারের ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমার স্বল্পপরিসরের ছবি ‘ভিউ ফাইন্ডার’ সেরা শর্ট ফিল্মের পুরস্কার পেয়েছে। কিছু ইচ্ছে পূরণ হওয়ার পরও মনে হয় স্বপ্নই থেকে গিয়েছে। এও তেমনই। পুরস্কারের খবর ছড়িয়ে পড়তে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছি। কাগজে কাগজে ছবি, ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছে। টলিউড তো বটেই, বলিউডেরও বেশ কয়েকটা বড় প্রোডাকশন হাউস তাদের আগামী সিনেমা ডিরেক্ট করার জন্য কনট্র্যাক্ট করতে চাইছে। এতদিন এটাই চেয়েছিলাম। সিনেমা জগতে নিজের স্বতন্ত্র নাম তৈরি করব। কিন্তু সব ক’টা দরজা যখন খুলে গেল, তখন কেন যে আমি নিজেকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখছি, কে জানে!
আমি এমন ছিলাম না। বদলটা দেখতে পাচ্ছি সেই রাতের পর থেকে। ওল্গভের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে আমি সোজা নিজের হোটেলে ফিরে এসেছিলাম। ওইরকম ঘটনার মধ্যে দিয়ে গেলে যে কেউ মানসিক ভারসাম্য হারাবে। আমারও তাই হয়েছিল। মনের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছিল। প্রথম দিকে রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারতাম না। কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যাপারটা যেন উপভোগ করতে শুরু করেছি। যেন প্রতি রাতে অন্য কেউ জেগে ওঠে আমার মধ্যে। যত দিন যাচ্ছে সে আমার অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলছে। মাঝে মাঝে মনের অনেক গভীরে ডুবেও নিজেকে খুঁজে পাই না।
ওল্গভের কী হয়েছিল, পরদিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম। সেরা শর্ট ফিল্মের পরিচালককে পুরস্কৃত করার আগে আয়োজকদের তরফে ঘোষণা করা হয়েছিল, সেন্ট পিটার্সবার্গের নামী ফিল্ম জার্নালিস্ট ওল্গভ ইভানোকভ গত রাতে নিজের বাড়িতে মারা গিয়েছেন। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। এক মিনিট নীরবতা পালনও হয়েছিল। অসম্ভব খারাপ লেগেছিল আমার। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণটা বেঘোরে দিয়েছে লোকটা। কিন্তু কাকে বলব সত্যিটা? বললেও বিশ্বাস করবে? যদি করেও, আমিই ফেঁসে যাব। ওল্গভের বডিটা দেখার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। সত্যিই কি হার্ট অ্যাটাক? নাকি কেউ ছুরি দিয়ে ফালাফালা করে দিয়েছিল ওর শরীর?
এই প্রশ্নটা কাঁটার মতো বিঁধেই থাকত হয়তো, যদি না দিন পনেরো আগে আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটত। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে সেদিন একটা কুরিয়ার এসেছিল আমার নামে! দশটা বড়সড় পেপার বক্স। প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম। ওখানে চেনাজানা কেউ নেই। তা ছাড়া এই অ্যাড্রেস তো কারও জানার কথা নয়। উত্তরপাড়ার এই দোতলা বাড়িটা কিনে সোদপুর থেকে সবে শিফ্ট করেছি। তা হলে কে পাঠাল আমাকে কুরিয়ার? গোলাপি রংয়ের পেপার বক্সগুলোর ওপর প্রেরকের নামধামও লেখা ছিল না। ডেলিভারি বয় চলে যাওয়ার পর একটা বাক্স খুলে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। কয়েকটা ভিন্টেজ ক্যামেরা নিশ্চিন্তে শুয়ে রয়েছে বাক্সের মধ্যে! পর পর চার-পাঁচটা বাক্স খুলে আরও ক্যামেরা পেলাম। এই সমস্ত ক্যামেরা ওল্গভের কালেকশন রুমে দেখেছি। কিন্তু আমাকে এগুলো পাঠাল কে? একটা বাক্স খুলে কয়েকটা ক্যামেরার সঙ্গে একটা চিঠি পেলাম। আর কেউ নন, খোদ ওল্গভ ইভানোকভই লিখেছেন চিঠিটা। হতভম্বের মতো বসে ছিলাম কিছুক্ষণ। ভাগ্য কি মশকরা করছে আমার সঙ্গে? যে লোকটা মারা গিয়েছে, যার অন্ত্যেষ্টি পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে, সে চিঠি পাঠাচ্ছে? সেই রাতের থিতিয়ে যাওয়া ভয় আচমকা মিছিলের মতো ঘিরে ধরেছিল আমাকে।
তবু পড়েছিলাম, ওল্গভ চিঠিটা—
প্রিয় চাতারগি,
আশা করি ভালো আছেন। এই চিঠিটা পাওয়ার পর আপনি কতটা অবাক হয়েছেন, যেখানেই থাকি না কেন, দিব্বি বুঝতে পারছি। এইরকম অবাক আমিও হয়েছিলাম একসময়।
জানি না, আপনি কপালে বিশ্বাস করেন কিনা। আমরা রাশিয়ানরা ভীষণভাবে করি। কপালে যা লেখা থাকে, তার বাইরে যাওয়া যায় না। অনেকটা, কোনও গন্তব্যে পৌঁছনোর মতো। বছর তিরিশ আগে এই কপালই আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ছোট কাকার বন্ধুর কাছে। কাজানে আমাদের পৈত্রিক ক্যাসল আছে। পাহাড়ের কোলে সুন্দর মনোরম এক টুকরো দ্বীপের মতো। ক্যাসলটার কেয়ারটেকার ছিলেন কাকার বন্ধু মাকসিম। সেন্ট পিটার্সবার্গে আমার জন্ম, বড় হওয়া। তখন সাতাশ-আঠাশ বছরের যুবক আমি। দুনিয়াটা অন্যরকম ভাবে উপভোগ করছি। কাকাই একদিন বললেন, মাকসিম নাকি অসুস্থ। কখনও পিতৃপুরুষের বাসভিটে দেখিনি। দুই-ই হয়ে যাবে ভেবে একদিন চলেও গেলাম। ওটাই আমার ভুল হয়েছিল। পরে বুঝেছিলাম, নিয়তি আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ক্যাসলে একাই থাকতেন মাকসিম। ওঁর ক্যামেরা জমানোর বিদঘুটে শখ ছিল। একদিন কালেকশন দেখালেন। কিন্তু বললেন, ‘আসল’ কালেকশনটা রাতে নয় দিনে দেখাবেন। ওই রাতে একটা বাজে স্বপ্ন দেখলাম। ঘুম ভাঙার পর মনে হল, মাকসিম ওই ক্যামেরাটা দেখালেন না কেন? আশ্চর্য একটা আকর্ষণ তৈরি হল। আমি কালেকশন রুমে ঢুকলাম।
এবার বোধহয় আপনার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আপনি রিলেট করতে পারছেন। কেন ঘটল জানেন?
আপনাকে বলেছি, আমার দাদু রাশিয়ান আর্মির পদস্থ অফিসার ছিলেন। অবসরের পর কাজানে ফিরে গিয়ে দাদু একটা স্টুডিও খুলেছিলেন। ওঁর লেখা ডায়েরি থেকে পরে জেনেছিলাম, উনি মূলত মৃতদেহের ছবি তুলতেন। কারও আত্মীয় পরিজন মারা গেলে ডাক পড়ত। যে রাতে উনি মারা যান, সে রাতেও এক মহিলার মৃত স্বামীর ছবি তোলার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ছবি তুলতে যাওয়ার আগে দাদু ডায়েরিতে লিখেছিলেন, মারিয়া নামের ওই মহিলা ব্ল্যাক ম্যাজিক জানতেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য তার স্বামী ফদোরের ফাঁসি হয়েছিল। মৃত স্বামীকে এই দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন মারিয়া। খুব সম্ভবত বদলা নেওয়ার জন্য। তিনি সফল হয়েছিলেন কিনা, দাদু ডায়েরিতে লেখেননি। তার আগেই দাদু মারা যান। এমনকি, মারিয়াও ওই রাতে মারা যায়। কিন্তু নিজেকে দিয়ে বুঝেছি, ফদোর ফিরে এসেছিল!
দাদু মারা যাওয়ার পর পৈত্রিক সম্পত্তি বেহাত হয়ে যেতে পারে, ভেবে কাকা তাঁর বন্ধু মাকসিমকে দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিলেন পৈত্রিক বাড়িটার। আসলে, আমার মতো মাকসিমকেও টেনেছিল ওঁর নিয়তি। এটা একটা অভিশাপ। আর সেই অভিশাপের মূলে হল ওই ক্যামেরাটাই! ওটাকে নির্ভেজাল, সহজসরল যন্ত্র বলে মনে হতে পারে। আসলে ওই ডাগ্যুয়েরটাইপ ক্যামেরাটাই হল মারিয়ার স্বামী ফদোর! যখন রক্ততৃষ্ণা জেগে ওঠে ওর, শিকার এনে দিতে হয়। সেই কাজটা মাকসিম বাধ্য হয়ে করতেন। উনি মারা যাওয়ার পর মাধ্যম হিসেবে ক্যামেরাটা আমাকে বেছে নিয়েছিল। আশ্চর্যজনক আমি ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিলাম নিজেকে। যেন অচেনা কেউ বাস করতে শুরু করেছিল আমার মধ্যে। আমি আসলে তার নজরবন্দি। তার নির্দেশ পালনের দাস!
ক্যাসলে ওই রাতে আমাকে ক্যামেরাটা টেনে নিয়ে গিয়েছিল তার কাছে। মাকসিম নিজের জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। পরে বুঝেছিলাম, উনি আসলে মরতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুই একমাত্র বাঁচার পথ। ঠিক আমার মতো।
জানেন, ক্যামেরাটা নষ্ট করার অনেক চেষ্টা করেছি। ভাঙতে পারিনি। ফেলে এসেছি দূরের ডাস্টবিনে। বাড়ি ফিরে দেখেছি, ওটা ঠিক নিজের স্ট্যান্ডটার ওপর দাঁড়িয়ে আছে! প্রতিবার আবিষ্কার করতাম, আমার মতো অসহায় এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আমার মাথা ব্যথা শুরু হলে, চোখ লাল হলে, জল কাটলে বুঝতে পারতাম, ফদোরের শিকার চায়। ওকে শিকার এনে দিলে আবার সুস্থ হয়ে উঠতাম। আর পারছিলাম না এভাবে বাঁচতে। নিজেকে শেষ করার অনেক চেষ্টা করেছিলাম। সেটাও পারিনি। আমাকে দখলে রাখা শক্তিটা ঠিক জানতে পেরে যেত।
আপনাকে দেখার পর থেকে মনে হয়েছিল, আপনিই পারেন আমাকে মুক্তি দিতে। যেভাবে একসময় মাকসিমকে আমি মুক্তি দিয়েছিলাম। মনে আছে, আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার রাশি আর লগ্ন কী? মাকসিম আর আমার রাশি-লগ্ন আপনার মতোই, সিংহ এবং তুলা! শুধুমাত্র এই কম্বিনেশনের লোকেদেরই মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় ফদোর। আপনাকেও প্রথমে শিকার হিসেবেই নিয়ে এসেছিলাম আমার বাড়িতে। আপনার রাশিচক্র জানার পর মুক্তির আনন্দে নেচে উঠি। সেই কারণে রাত তিনটে বাজার কিছু মুহূর্ত আগে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম আপনার কাছে। যাতে আপনি বেরিয়ে যেতে পারেন। আর ফদোরের সমস্ত রাগ আছড়ে পড়ে আমার ওপর। ওর তৃষ্ণার্ত ছুরি যেন আমাকে ফালাফালা করে দেয়।
ওল্গভ ইভানোকভ
সে দিন ওল্গভের চিঠিটা অসংখ্যবার পড়েছিলাম। ওল্গভ যা বলেছে, সব যে সত্যি, ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম। যে অভিশাপ উনি বয়ে বেড়িয়েছে এতদিন, সেটা এখন তিলেতিলে গ্রাস করছে আমাকে। সেদিন সন্ধে থেকে আমার মাথা যন্ত্রণার শুরু। চোখ লাল হয়ে এল। জল কাটতে শুরু করল। আমি একটা সময়ের পর যন্ত্রণায় ছটফট করতে শুরু করলাম। ডাক্তার দেখায়নি। কোনও লাভ হবে না, জানি। এর কোনও চিকিৎসা নেই। এটা একটা ইঙ্গিত। ফদোর আমাকে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তার শিকার চায়!
গিরিখাতের মতো নিজের সংকীর্ণ জীবন, পিছল খাদের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা আমার ভাগ্যের কথা ভাবতে ভাবতে বোধহয় হারিয়ে গিয়েছিলাম। নীচ থেকে কলিংবেল বাজানোর আওয়াজ পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। নিশ্চয় সৌরভ এসেছে। ছেলেটা একটা নামী ইংলিশ ফিল্ম ম্যাগাজিনের জার্নালিস্ট। ও আমার একটা ইন্টারভিউ নিতে চায়। আমার উঠে আসার দিনগুলো ওর ফোকাস।
দরজা খুলে স্বাগত জানালাম সৌরভকে। অল্প বয়স। ঝকঝকে চেহারা। সৌরভকে দেখে আমার মাথা ব্যথাটা আরও বেড়ে গেল। চোখ দুটো লাল হয়ে কড়কড় করছে। জল কাটছে।
লিভিংরুমের গা দিয়ে তিরতির করে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। কুচিকুচি ঢেউ এসে ধাক্কা মারছে পাথর বাঁধানো পারে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে উঠে আসছে। গঙ্গার হাওয়া হুহু করে ঢুকছে জানলা দিয়ে। জানলার ধারে একটা চেয়ারে ওকে বসিয়ে বললাম, ‘চা, না কফি?’
ছেলেটা স্মার্ট। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আপনার যা ইচ্ছে!’
‘আর্মেনিয়ান কফি খেয়েছো কখনও?’
‘না স্যর।’
‘ট্রাই করে দেখো। এই কফি অনেকটা পার্ফিউমের মতো। আচ্ছন্ন করা একটা গন্ধ তোমার শ্বাসনালীতে ঘুরে বেড়াবে অনেকক্ষণ।’
‘আমি কিন্তু আপনার ক্যামেরার কালেকশন দেখব স্যর।’
‘নিশ্চয়, কফিটা আগে খেয়ে নাও!’
এই মুহূর্তে আমার ঠোঁটে একটা নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠেছে। শান্ত অথচ সুযোগসন্ধানী একটা ছায়ার তলায় দাঁড়িয়ে আছি। যেন একটা মুঠো ক্রমশ তালুবন্দি করে ফেলছে আমাকে। নিজেরই শরীরের ভেতরে বসে ছটফট করছি। যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। নিজের চোখ দুটোকে ভিউ ফাইন্ডার বলে মনে হচ্ছে।
আমি প্রাণপণে চেঁচিয়ে সৌরভকে বললাম, ‘পালাও এখান থেকে। ক্যামেরাটা তোমাকে শেষ করে দেবে। ওটা একটা অভিশাপ!’
আমার চিৎকার যেন একটা সাউন্ডপ্রুফ ঘরে থমকে গেল। হারিয়ে যেতে যেতে একবার জেগে উঠল মুক্তির আকাঙ্খা। অসহায় গলায় শেষবারের মতো বলে উঠলাম, ‘সৌরভ, তোমার রাশি আর লগ্ন কী?’
‘কর্কট ও তুলা। আপনি কি অ্যাস্ট্রলজি চর্চাও করেন স্যর?’ সহজ গলায় হেসে বলল সৌরভ।
আমি তার দিকে গভীর চোখ ফেলে তাকালাম। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললাম, ‘তোমার সময়টা ভালো যাচ্ছে না, তাই না!’