ভয়ংকর স্বীকারোক্তি
দর্শকাসনের প্রথম সারিতে বসে খেলা দেখছিলেন অনিরুদ্ধ৷ রয়্যাল ইন্ডিয়ান সার্কাসের এদিনের শেষ শো চলছে৷ রাত প্রায় ন’টা বাজে৷ পাড়াগাঁয়ে রাত ন’টা মানে বেশ রাত৷ তার ওপর আবার উত্তরবঙ্গের শীতের রাত৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই খেলা ভেঙে যাবে৷ ট্রাপিজের খেলা, জোকারের লোক হাসানো, বাইক আর জিপের শূন্যে লাফানো—এই ধরনের সব খেলা৷ সামান্য কিছু পশুপাখি অবশ্য আছে৷ বিভিন্ন প্রজাতির কয়েকটা ছোট-বড় কুকুর, একটা বিরাট সাদা আরবি ঘোড়া, একটা ম্যাকাও, গোটা চারেক কাকাতুয়া, আর কয়েকটা রাজহাঁস৷ আপত্তিকর কোনওটাই নয়৷ সম্ভবত এই সার্কাস কোম্পানির প্রতিযোগী অন্য কোনও সার্কাস দল বেনামে অভিযোগটা পাঠিয়েছিল এই সার্কাস কোম্পানিকে বিব্রত করার জন্য৷ তবে সাবধানের মার নেই বলে অনিরুদ্ধ খেলা দেখতে এসেছেন৷
এমনই একটা উড়ো অভিযোগ পেয়ে বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গিয়ে এক সার্কাস কোম্পানি থেকে উদ্ধার করেছিলেন একটা পাইথন আর একটা চিতাবাঘের বাচ্চা৷ আর এই সার্কাস কোম্পানি সম্বন্ধে যে অভিযোগ বনদপ্তরের কাছে দু-দিন আগে এসেছে সেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ৷ যা উত্তরবঙ্গের ওই গণ্ডগ্রামে ছুটিয়ে এনেছে অনিরুদ্ধকে৷
সার্কাস দেখতে দেখতে অনিরুদ্ধ মনে মনে একটা কথা ভাবছিলেন৷ বছর কুড়ি আগে তিনি একটা দুর্ঘটনার তদন্ত করতে গিয়েছিলেন এক সার্কাসে৷ তাঁর যতদূর মনে পড়ছে সেই সার্কাস কোম্পানির নামও ছিল ‘রয়াল ইন্ডিয়ান সার্কাস’৷ অনিরুদ্ধ তখন ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসে যোগ দেননি৷ তিনি জীবনের প্রথম ক-বছর পুলিশে চাকরি করেছিলেন৷ আই. পি. এস ক্যাডার ছিলেন৷ ঘটনাটা সেই সময়কারই৷ যদিও তাঁর অকুস্থল ছিল বাংলা থেকে বহুদূরে মধ্যপ্রদেশের এক শহরে৷
পুলিশ আর তারপর ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসের কর্মজীবনে অনেক তদন্তের সমাধান করেছেন অনিরুদ্ধ৷ অনেক দুর্ঘটনার মধ্যেই থেকেছেন৷ কিন্তু সে দুর্ঘটনাটা তাঁর আজও এত বছর পর মনে আছে দুটো কারণে৷ প্রথমত দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে পাশেই এক জায়গায় চোখ চলে যাচ্ছিল অনিরুদ্ধর৷ তাঁর কয়েক হাত তফাতেই সার্কাসের আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য একটা সোফা রাখা আছে৷ সেখানে বসে আছেন সুঠাম চেহারার এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক৷ পরনে দামি কোট, মাথায় গল্ফক্যাপ৷ বাঁ হাতটা তাঁর কোটের পকেটে ঢোকানো৷ কোনও খেলা, বিশেষত ট্রাপিজের কোনও খেলা ভালো লাগলেই তিনি ডান হাত দিয়ে হাঁটুতে চাপড় দিয়ে বলে উঠছেন, ‘ওক. কে! ফাইন! বিউটিফুল!’
অনিরুদ্ধ ইতিমধ্যে খেয়াল করেছেন সার্কাসের ম্যানেজার ভদ্রলোক বেশ খাতির করছেন তাঁকে৷ খেলা চলাকালীন তিনি দু-দুবার এক সঙ্গীকে নিয়ে ভদ্রলোকের কাছে এসেছিলেন লেমোনেড আর কফি নিয়ে৷
ভদ্রলোক অবশ্য সে সব কিছু গ্রহণ করেননি৷ একবার শুধু তাদের থেকে জল চেয়ে নিয়ে কী একটা ওষুধ মুখে দিয়েছিলেন৷ মগ্ন হয়েই খেলা দেখছেন ভদ্রলোক৷
দ্বিতীয়ত সার্কাসের শেষের দিকে, এরিনা অর্থাৎ সামনের গোলাকৃতি খেলা দেখানোর উন্মুক্ত জায়গার ঠিক মাঝখানে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে এসে দাঁড়াল এক সুবেশী তরুণী৷
সে ঘোষণা করল, ‘এবার আমাদের শেষ খেলা৷ এ ভয়ংকর খেলা আজকাল আর কোনও সার্কাসে দেখানো হয় না, তা আমরা হলফ করে বলতে পারি৷ দর্শকদের কাছে আমাদের অনুরোধ, খেলা চলার সময় কেউ কোনও শব্দ করবেন না৷ কারণ খেলা দেখাবার জন্য মনঃসংযোগের অভাব ঘটলে খেলোয়াড়ের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে৷’
কথাগুলো বলেই এরিনার প্রবেশ মুখের পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই তরুণী৷
একটা মৃদু গুঞ্জনধ্বনি উঠল গ্যালারি আর আশপাশের চেয়ারে বসে থাকা দর্শকদের মধ্যে৷ কী খেলা? কী খেলা? কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অবশ্য সে গুঞ্জন স্তিমিত হয়ে গেল৷ অধীর আগ্রহে দর্শকরা চোখ রাখল এরিনার দিকে৷
আর এর পরই অনিরুদ্ধ দেখলেন একদল লোক লোহার তৈরি উঁচু খাঁচার বেড়া দিয়ে ঘিরতে শুরু করেছে এরিনা৷ এক সময় সার্কাসে হিংস্র প্রাণীদের খেলা দেখাবার সময় এরিনা লোহার খাঁচা দিয়ে ঘেরা হত ঠিক সেই ভাবে৷ ব্যাপারটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা উত্তেজনা অনুভব করে সোজা হয়ে বসলেন অনিরুদ্ধ৷
তা হলে অভিযোগটা কি সত্যি? নইলে তারা লোহার ফেনসিং দিয়ে ঘিরছে কেন জায়গাটা? হয়তো সার্কাস কোম্পানি ভেবেছে যে শহর থেকে অনেকদূরে গ্রামগঞ্জে এসব খেলা দেখালে প্রশাসন তার খবর পাবে না বা গুরুত্ব দেবে না ব্যাপারটা নিয়ে৷
মিনিট খানেকের মধ্যেই এরিনা ঘেরার কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল৷ এরই মধ্যে এরিনার মাঝখানে এনে রাখা হয়েছে বেশ উঁচু একটা লোহার টুল আর স্ট্যান্ডের ওপর রাখা একটা বড় ধাতব বৃত্ত৷
সে জিনিসগুলোও চেনা অনিরুদ্ধর৷ ছেলেবেলায় সার্কাসে তিনি এ খেলা দেখেছেন৷ স্ট্যান্ডে বসানো ওই বৃত্তের গায়ে আগুন ধরানো হত৷ আর টুলের ওপরে বসে থাকা হিংস্র প্রাণীরা রিংমাস্টারের নির্দেশে লাফ দিত ওই অগ্নিবলয়ের মধ্যে৷
বন্য জন্তুরা এমনিতে আগুনকে ভয় পায়৷ কিন্তু মানুষ যে হিংস্র প্রাণীকেও সে কাজ করাতে বাধ্য করতে পারে সেটা দর্শকদের দেখানোই ছিল খেলার বিষয়৷
লোহার খাঁচা দিয়ে জায়গাটা ঘেরার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁবুর সব আলো হঠাৎ নিভে গেল৷ শুধু একটা অদ্ভুত লাল আলো এসে পড়ল এরিনাতে৷ বৃত্তাকার জায়গাটাতে সেই লাল আলো ছাড়া তাঁবুর সব কিছুই ডুবে গেল অন্ধকারে৷ লোকজনের হাত-পা নাড়ার মৃদু থমথম শব্দও যেন থেমে গেল৷ সবারই চোখ লাল ভূতুড়ে আলো মাখা বৃত্তাকার এরিনার দিকে৷
পর্দা ঠেলে এরিনার মধ্যে আবির্ভুত হল একজন৷ লম্বা ছিপছিপে শক্তপোক্ত চেহারা৷ পরনে কালো পোশাক৷ হাতে একটা চাবুক৷
এরিনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে লোকটা মাটিতে চাবুকটা আছড়াতেই ফটাশ করে শব্দ করে কয়েকটা আলোর ফুলকি উঠল৷ ইলেকট্রিক হান্টার! যা দিয়ে বশে রাখা হয় হিংস্র পশুদের৷ লোকটা রিংমাস্টার!
লোকটা বেশ কয়েকবার মাটিতে চাবুক হাঁকড়ে কী যেন একটা ইঙ্গিত করল এরিনার প্রবেশ মুখের দিকে৷ সরে গেল সেদিকের পর্দা৷ কয়েকজন লোক তার আড়াল থেকে চাকা লাগানো বেশ বড় একটা খাঁচাকে ঠেলতে ঠেলতে হাজির করল এরিনার ভিতর৷ আর তার পরই তারা দ্রুত এরিনার বাইরে চলে গেল৷ যে জায়গা দিয়ে খাঁচাটাকে ফেনসিং ঘেরা এরিনাতে ঢোকানো হল, সে জায়গা বন্ধ করে দেওয়া হল৷ এরিনার মধ্যে শুধু রয়ে গেল রিংমাস্টার আর খাঁচা গাড়িটা৷
২
খাঁচাটার দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে মাটি থেকে একটা লাঠি তুলে নিল রিংমাস্টার৷ সম্ভবত যারা লোহার উঁচু টুল, স্ট্যান্ডের ওপর লোহার বড় রিং বসিয়ে গেছিল তারাই রেখে গেছিল সেই লাঠি বা রুলটা৷ সেটা নিয়ে রিংমাস্টার দর্শকদের দিকে পিছন ফিরে এগিয়ে গেল খাঁচার দিকে৷ তারপর রুলের ডগা দিয়ে বাড়ি দিল খাঁচার শিকগুলোতে৷ একটা ধাতব শব্দ উঠল সেই আঘাতে৷
আবারও কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা৷ এরপর রিংমাস্টার তার লম্বা রুলের শেষ প্রান্ত খাঁচার অন্ধকারের ভিতর ঢুকিয়ে খোঁচা দিল৷
‘আ-হ-হন৷’ পরমুহূর্তেই খাঁচার অন্ধকারের ভিতর থেকে তীব্র গর্জনে কেঁপে উঠল সার্কাসের তাঁবু৷
শব্দটা বিলক্ষণ চেনা অনিরুদ্ধর৷ কর্মোপলক্ষে বেশ ক’বছর গুজরাতের গির অভয়ারণ্যে কাটিয়েছেন অনিরুদ্ধ৷ ক্রুদ্ধ সিংহর গর্জন৷
রিংমাস্টার এরপর খাঁচার কাছ থেকে স্ট্যান্ডের কাছে ফিরে এসে পকেট থেকে কী একটা বার করে অগ্নিসংযোগ করল স্ট্যান্ডের মাথায় বসানো সেই রিংটার গায়ে৷ আগুন জ্বলে উঠল৷
তৈরি হল মাটি থেকে সাত-আট ফুট ওপরে একটা অগ্নিবলয়৷ এ কাজ শেষ করে সে আবার ফিরে গেল সেই খাঁচার কাছে৷ খাঁচার স্লাইডিং দরজাটা একপাশে টেনে উন্মুক্ত করল খাঁচার মুখ৷ একটা সিংহ খাঁচার অন্ধকার ছেড়ে লাফিয়ে নামল এরিনাতে৷ দর্শকরা সব নিশ্চুপ৷ সবাই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে এরিনার দিকে৷ সিংহটার দিকে লাঠি নিয়ে একটা খোঁচা দিল রিংমাস্টার৷ আবারও তাঁবু কাঁপিয়ে গর্জন উঠল—‘আ-হ-হহন৷’
রিংমাস্টার এরপর তার চাবুকটা মাটিতে আছড়াতেই প্রাণীটা এক লাফে টুলের ওপর চড়ে বসল৷ ঘাড় ঘুরিয়ে প্রাণীটা তাকাচ্ছে চারদিকে৷ সম্ভবত প্রাণীটাকে ধাতস্থ হবার জন্য একটু সময় দিল রিংমাস্টার৷ তারপর সে চাবুক হাঁকড়াতেই প্রাণীটা টুলের ওপর থেকে শূন্যে লাফিয়ে সেই অগ্নিগোলকের মধ্যে দিয়ে গিয়ে নামল এরিনার অন্যপ্রান্তে৷
রিংমাস্টার আবারও তাকে নির্দেশ দিল টুলে বসার জন্য৷ উঠল প্রাণীটা, তারপর আবারও লাফ৷
পরপর তিনবার লাফ দেবার পর রিংমাস্টারের নির্দেশে খাঁচার দিকে এগোল প্রাণীটা৷ খাঁচায় ঢোকার আগের মুহূর্তে একবার এরিনার বাইরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘আ-হ-ন-ন!’ ছোট্ট লাফে প্রাণীটা খাঁচার ভিতর ঢুকতেই রিংমাস্টার খাঁচার দরজা বন্ধ করে দিল৷
খেলা শেষ৷ জ্বলে উঠল তাঁবুর সব আলো৷ মুহূর্তের নিস্তব্ধতা৷ তারপরই দর্শকদের উল্লাস আর করতালিতে ফেটে পড়ল তাঁবু৷
অনিরুদ্ধ ততক্ষণে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছেন৷ সিংহ নিয়ে খেলা দেখাবার মতো এত সাহস লোকগুলোর হল কী ভাবে! মনে মনে নিজের কর্মপন্থা ঠিক করছিলেন তিনি৷ হঠাৎ তাঁর কানে এল একটা মৃদু আর্তনাদ—‘ওঃ গড!’
তিনি দেখলেন সেই সোফায় বসা ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়েছেন৷ বাঁ-হাতটা আগের মতোই তাঁর কোটের পকেটে ঢোকানো৷ ডান হাতটা কপালে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক টলছেন৷ হয়তো বা এখনই তিনি পড়ে যাবেন৷ ব্যাপারটা দেখামাত্রই অনিরুদ্ধ তাঁর কাছে গিয়ে লোকটার কনুই চেপে ধরে বললেন, ‘আপনার কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?’
নিজেকে সামলাতে কয়েক মুহূর্ত সময় নিলেন ভদ্রলোক৷ তারপর বললেন, ‘আপনাকে ধন্যবাদ৷ মাথাটা উত্তেজনায় একটু ঘুরে গেছিল৷’
কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালেন না ভদ্রলোক, ধীর পায়ে এরিনার পাশ দিয়ে এগোলেন অন্যদিকে৷
মনে মনে নিজের কর্তব্য স্থির করে নিলেন অনিরুদ্ধ৷ নিজের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট আর পুলিশে খবর দেবার আগে তিনি ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে একবার ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করবেন৷ আর পাবলিককেও চলে যাবার সময় দিতে হবে৷ বন্যপ্রাণী উদ্ধার করতে গেলে উৎসাহী জনতা অনেক সময় কাজের ব্যাঘাত ঘটায়৷
মিনিট দশেক অপেক্ষা করলেন অনিরুদ্ধ৷ তাঁবু ফাঁকা হয়ে গেল৷ জনতার কলরব যখন বাইরে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে তখন তিনি সরাসরি হাজির হলেন ম্যানেজারের তাঁবুতে৷
মধ্যবয়সি ম্যানেজার৷ দুজন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন৷ অনিরুদ্ধকে দেখে তিনি বললেন, ‘কী চাই?’
অনিরুদ্ধ কোনও ভণিতা না করে তাঁকে বললেন, ‘বন্যপ্রাণী নিয়ে খেলা দেখানো নিষিদ্ধ৷ আপনারা সিংহ নিয়ে খেলা দেখাচ্ছেন কেন?’
ম্যানেজার তাঁর কথা শুনে একটু রুষ্টভাবে বললেন, ‘সে কৈফিয়ৎ চাওয়ার আপনি কে?’
অনিরুদ্ধ তাঁর জ্যাকেটের পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ড বার করে সেটা ম্যানেজারের সামনে মেলে ধরে বললেন, ‘দিতে হবে৷ আমি ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিসার৷ আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে বন্যপ্রাণী কাছে রাখা ও তাকে নিয়ে খেলা দেখানো নিষিদ্ধ?’
মুহূর্তের মধ্যে যেন পালটে গেল ম্যানেজারের কণ্ঠস্বর আর মুখের ভাব৷ বিগলিত ভাবে তিনি বললেন, ‘আমাদের কী সৌভাগ্য আপনি এসেছেন! আসুন স্যার আসুন৷ সিংহটাকে দেখাই আপনাকে৷’
অনিরুদ্ধ বললেন, ‘হ্যাঁ, ওটাকে আমরা নিয়ে যাব৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই বনদপ্তরের লোক এসে যাবে৷ পুলিশও আসবে খবর পেলেই৷ বন্যপ্রাণী নিয়ে খেলা দেখানোর জন্য আপনাকে ও রিংমাস্টারকে গ্রেপ্তার করা হবে৷’
ম্যানেজার তাঁর একথার কোনও জবাব না দিয়ে তাঁকে নিয়ে এগোলেন সামনের দিকে৷ মূল তাঁবুর পিছন দিকে যেখানে সার্কাসের পশুপাখি রাখা হয় সেখানে এসে দাঁড়ালেন তিনি৷ সিংহের খাঁচাটা সেখানে রাখা৷ সেই রিংমাস্টার সমেত কয়েকজন লোক সেখানে দাঁড়িয়ে৷
কাছে গিয়ে প্রাণীটাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলেন অনিরুদ্ধ৷ সেখানে রয়েছে সিংহর মতোই বিশাল একটা ‘গ্রেট ডেন’ কুকুর! তার গা থেকে তখন সিংহের পোশাক খোলা হচ্ছে৷ কিছুটা তফাতে মাটিতে পড়ে আছে সিংহের মুখোশটা৷ এরিনার সেই লাল আলোর আধো অন্ধকারে পোশাকপরা বিশাল কুকুরটাই রিংমাস্টারের নিপুণ উপস্থাপনার জন্যে সিংহ হয়ে ওঠে৷ দর্শকরা বুঝতে পারে না কিছু৷
বিস্মিত অনিরুদ্ধ বলে উঠলেন, ‘কিন্তু সিংহের ডাকটা?’
ম্যানেজার এবার ইশারা করলেন রিংমাস্টারকে৷ লোকটা একটু দম টেনে শব্দ করল, ‘আ,হ-ন-ন!’
ম্যানেজার হেসে বললেন, ‘দর্শকদের দিকে পিছন ফিরে ও শব্দটা করে৷ আপনি ফরেস্ট সাহেব হয়ে শব্দটা ধরতে পারলেন না, পাবলিক ধরবে কী ভাবে? বাঘ-সিংহ নিয়ে খেলা দেখানো বন্ধ হবার পর এমনিতেই সার্কাসের আকর্ষণ কমে গেছে৷ তাই এই কৌশল নিতে হয়েছে৷’
তাঁর কথা শুনে পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘সত্যি কী নিখুঁত পরিকল্পনা! অভিনয়! আমিও ঘাবড়ে গেছিলাম!’
তাঁদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই টুপি পরা ভদ্রলোক৷
তাঁকে দেখিয়ে ম্যানেজার অনিরুদ্ধকে বললেন, ‘ইনি মিস্টার সুব্বা৷ নেপাল থেকে এসেছেন৷ আমাদের গেস্ট৷ আমাদের সার্কাসকে পাঁচ লাখ টাকা ডোনেট করলেন যাতে সার্কাসটা ভালো ভাবে চলে৷ হাজার কষ্টের মধ্যেও আমরা কোনও বেআইনি কাজ করি না স্যার৷ নিশ্চয়ই কেউ আমাদের বিরক্ত করার জন্য আপনাদের মিথ্যা অভিযোগ করেছে৷ হয়তো কোনও প্রতিযোগী সার্কাস কোম্পানির কাজ৷’
অনিরুদ্ধ কী বলবেন, ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না৷ ভাগ্যিস তিনি পুলিশে আগাম খবর দেননি৷ নইলে আরও লজ্জায় পড়তে হত৷ কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকার পর অনিরুদ্ধ হঠাৎ তাঁর মনের কোণে জমে থাকা প্রশ্নটা করলেন, ‘আপনাকে বিব্রত করার জন্য দুঃখিত৷ আমি এবার একটা ব্যক্তিগত কৌতূহল মেটাবার জন্য প্রশ্ন করছি৷ আপনাদের সার্কাস কি বছর কুড়ি আগে মধ্যপ্রদেশে জব্বলপুরের কাছে তাঁবু ফেলেছিল? কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছিল সে সময়? আমি তখন সার্কাসটাতে গেছিলাম৷’
ম্যানেজার বললেন, ‘সার্কাস তো সারা দেশেই ঘোরে৷ তবে কিছু ঘটেছিল কিনা বলতে পারব না৷ কুড়ি বছরে অন্তত পাঁচবার মালিকানা বদল হয়েছে কোম্পানির৷ আমি চাকরি নিয়েছি মাত্র পাঁচ বছর৷ আমার খেলোয়াড় কর্মচারীরা সব নতুন৷ পুরোনো কেউ নেই যে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে৷’
জবাব শুনে অনিরুদ্ধ বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে৷ আমার এই প্রশ্নের সঙ্গে আজকের ব্যাপারের কোনও সম্বন্ধ ছিল না৷’
ঘড়ি দেখলেন অনিরুদ্ধ৷ রাত দশটা বাজে৷ তাঁকে জেলা সদরে ফিরতে হবে৷ তাই তিনি এবার বিদায় নেওয়ার জন্য বললেন, ‘এবার আমি যাই৷ অনেকটা পথ ফিরতে হবে৷ জেলা সদরে যাব৷’
ম্যানেজার বললেন, ‘এখন অতটা পথ যাবেন! আপনাকে একটা অনুরোধ করি স্যার৷ এখানেই রাতটা কাটিয়ে নয় ভোরবেলা রওনা দেবেন৷ আপনার কোনও অসুবিধা হবে না৷ রাস্তাঘাটের হাল তো আপনি জানেনই স্যার৷ খুব খারাপ অবস্থা৷’
অনিরুদ্ধ একাই জিপ চালিয়ে চলে এসেছেন এখানে৷ জেলা সদরে পৌঁছতে তাঁর অন্তত ঘণ্টাচারেক সময় লাগবে৷ রাস্তার একটা অংশ আবার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেছে৷ মাঝে মাঝে রাস্তা আগলে হাতির পাল দাঁড়িয়ে থাকে৷ তাছাড়া বেআইনি কাঠ পাচারকারী আর চোরাশিকারিদের হিট লিস্টে আছেন তিনি৷
তিনি ভেবে দেখলেন প্রস্তাবটা মন্দ নয়৷ ম্যানেজার এরপর আর একবার অনুরোধ জানাতেই অনিরুদ্ধ রাজি হয়ে গেলেন তাঁর কথায়৷ সার্কাসের মূল তাঁবুর বাইরে যেখানে ছোট-ছোট তাঁবুতে কলাকুশলীদের থাকার ব্যবস্থা, সেখানেই একটা সুন্দর তাঁবুতে থাকা- খাওয়ার বন্দোবস্ত হল অনিরুদ্ধর৷ রাত বারোটা নাগাদ নিঝুম হয়ে গেল তাঁবু৷ অনিরুদ্ধও খাওয়া সেরে ছোট্ট তাঁবুর ভিতর শুয়ে পড়লেন৷
৩
রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল অনিরুদ্ধর৷ তাঁর তাঁবুর কিছুটা দূরেই সেই খাঁচা সমেত কুকুরটা রাখা আছে৷ কোনও কারণে কুকুরটা ডাকছে৷ সেই শব্দেই ঘুমটা ভাঙল৷ ঘড়ি দেখলেন অনিরুদ্ধ, রাত আড়াইটে বেজে গেছে৷ একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসতে চায় না তাঁর৷ তার ওপর তিনি খেয়াল করলেন মশার উপদ্রব শুরু হয়েছে৷ আর তো মাত্র ঘণ্টা তিনেকের মামলা৷ তার পরই ভোরের আলো ফুটবে৷ কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পর বিছানা ছেড়ে উঠে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালেন তিনি৷
কুয়াশা মাখানো চাঁদের আলোতে চারপাশে ঘুমিয়ে আছে সার সার তাঁবু৷ সারা দিনের কঠিন পরিশ্রমের পর তার ভিতর ঘুমাচ্ছে কলাকুশলীরা৷
কুকুরের ডাক ততক্ষণে থেমে গেছে৷ কিন্তু অনিরুদ্ধ ঘুমন্ত তাঁবুগুলোর ফাঁক গলে এগোলেন সেদিকেই৷
কিছুটা এগিয়ে খাঁচার কাছাকাছি পৌঁছে অনিরুদ্ধ খাঁচার কিছুটা তফাতে চাঁদের আলোতে একটা লোককে দেখতে পেলেন৷ খাঁচার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লোকটা৷ সম্ভবত তাকে দেখেই চিৎকার করছিল খাঁচার ভিতর থাকা গ্রেট ডেনটা৷ লোকটার পোশাক আর দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে অনিরুদ্ধ লোকটাকে চিনতে পারলেন৷ সেই মিস্টার সুব্বা৷ কোটের পকেটে বাঁ-হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছেন৷
অনিরুদ্ধ পায়ে পায়ে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তাঁকে দেখে ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, ‘ঘুম আসছে না৷ তাই একটু ঘুরে বেড়াচ্ছি৷’
অনিরুদ্ধ হেসে বললেন, ‘আমারও ওই এক অবস্থা৷ কুকুরের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল তাই উঠে পড়লাম৷’
বাকি রাতটা কাটাতে হবে৷ লোকটার সঙ্গে তাই আলাপচারিতা বাড়াবার জন্য অনিরুদ্ধ এরপর তাঁকে বললেন, ‘আপনার নাম শোনা হয়ে গেছে৷ আপনি কোথায় থাকেন? কী করেন?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘নেপালের বিরাটনগরে থাকি৷ ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করি৷ ব্যবসাটা বড়ই বলা যায়৷ ওতেই চলে৷’
অনিরুদ্ধ বললেন, ‘সেটা অনুমান করেছিলাম আপনার টাকা ডোনেট করার কথা শুনে৷ আপনি সার্কাস খুব ভালোবাসেন বুঝি?’
ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ৷ প্রথম জীবনটা আমার সার্কাসেই কেটেছে৷ ওদের বর্তমান দুর্দশার কথা আমি বুঝি৷ কিছু টাকা সঞ্চয় করেছি৷ আমি একা মানুষ৷ ভাবলাম কোনও ভালো কাজে টাকাটা ব্যয় করি৷ তাই সার্কাসের দুঃস্থ খেলোয়াড়দের জন্য টাকা দিয়ে গেলাম৷’
এ কথা বলে ভদ্রলোক বললেন, ‘সার্কাসের বন্যপ্রাণী নিয়ে খেলা বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তকে আমি সমর্থন করি৷ শুধু প্রাণীদের কষ্ট দেওয়ার কারণেই নয়, এতে মানুষের জীবনহানিরও সম্ভাবনা থাকে৷’
অনিরুদ্ধ বললেন, ‘ঠিক তাই৷ বহু বছর আগে তেমন এক অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছিলাম আমি৷ সে সার্কাস কোম্পানির নামও সম্ভবত ছিল ‘‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’’৷ সে জন্যই ম্যানেজার সাহেবকে তখন প্রশ্নটা করেছিলাম৷’
অনিরুদ্ধর কথা শুনে যেন মৃদু হাসলেন ভদ্রলোক৷ তারপর বললেন, ‘এখানে তো বসার জায়গা নেই৷ চলুন বড় তাঁবুর ভিতরে গিয়ে বসে আপনার সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনি৷’
অনিরুদ্ধ বললেন, ‘হ্যাঁ, চলুন৷’
সার্কাসের বড় তাঁবুর ভিতরে গিয়ে ঢুকলেন তাঁরা দুজন৷ সারা তাঁবু অন্ধকার৷ শুধু এরিনার মাথার ওপর একটা হলদেটে বাল্ব জ্বলছে৷ তার মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়েছে এরিনায়৷
যে তাঁবু খেলোয়াড় আর দর্শকদের চিৎকারে মুখরিত থাকে সে জায়গা এখন একদম নিঝুম৷ এরিনার গা ঘেঁষে সামনের ফাঁকা জায়গার দিকে মুখ রেখে তাঁরা দুজন পাশাপাশি বসলেন৷
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা৷ মিস্টার সুব্বা তারপর বললেন, ‘এবার বলুন আপনার সেই অভিজ্ঞতার কথা৷’
একটু ভেবে নিয়ে অনিরুদ্ধ বলতে শুরু করলেন, ‘সে অভিজ্ঞতা এই সার্কাস নিয়েই৷ সার্কাসের কোনও প্রসঙ্গ উঠলেই ব্যাপারটা আমার আজও মনে পড়ে৷ তার কারণ হল, অমন অভিজ্ঞতার সাক্ষী আমি কোনওদিন হইনি৷ আমি তখন ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে চাকরি করতাম৷ এস. ডি. পি. ও-র দায়িত্ব সামলাচ্ছি মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে৷ চোর-ডাকাত-গুন্ডা-মস্তান সামলানোই তখন আমার কাজ৷ একটা সার্কাস কোম্পানি তখন সেখানে তাঁবু ফেলেছে৷ বাঘ-সিংহ নিয়ে খেলা দেখানো তখনও নিষিদ্ধ হয়নি৷
‘কাজের চাপে সার্কাস দেখার ফুরসত পেতাম না৷ কিন্তু রাতে কোয়ার্টারে বসে শুনতে পেতাম দূর থেকে সেই সার্কাসের তাঁবু থেকে ভেসে আসা বাঘ-সিংহর ডাক৷ একদিন সারা দিনের ডিউটি শেষে রাত দশটা নাগাদ কোয়ার্টারে ফিরছি ঠিক তখনই স্থানীয় থানা থেকে খবর এল যে একটা সিংহ নাকি খেলা চলার সময় খেপে গিয়ে রিংমাস্টারকে মেরে ফেলেছে!
ব্যাপারটা গুরুতর৷ কাজেই বনদপ্তরকে খবর দিয়ে আমি ফোর্স নিয়ে পৌঁছে গেলাম সার্কাসের তাঁবুতে৷ সেই বীভৎস দৃশ্য দেখলে শিউরে উঠতে হয়৷ এরিনার ঠিক মাঝখানে বসে কালো কেশরওয়ালা এক আফ্রিকান সিংহ৷ মহা আনন্দে বসে সিংহটা রিংমাস্টারের মাংস চিবিয়ে চলেছে৷ রিংমাস্টারের দুই হাত, ঘাড়-বুক ততক্ষণে উদরস্থ করে ফেলেছে সে৷ পরবর্তী জীবনে বনবিভাগে কাজ করার সুবাদে বন্যপ্রাণী হামলার বহু ঘটনা দেখেছি৷ কিন্তু অমন বীভৎস দৃশ্য জীবনে আর কোনও দিন দেখিনি৷ বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, জালে ঘেরা সেই এরিনার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রাণীটার হাড় চেবানোর মটমট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম৷ শেষ পর্যন্ত প্রাণীটাকে গুলি করে মারা হয়৷’
কথাগুলো বলে একটু থামলেন অনিরুদ্ধ৷ তারপর বললেন, ‘সার্কাসের অন্য কর্মীদের থেকে যা শোনা গেল তা হল ওই সিংহটাকে নিয়ে একটা বিশেষ খেলা দেখাত সেই তামিল রিংমাস্টার৷ সিংহের হাঁ করা মুখের মধ্যে সে সটান নিজের ডান হাতটা ঢুকিয়ে দিত৷ সেদিন আগের দুটো শো-তেও সে কাজটা করেছিল কোনও বিপত্তি হয়নি৷ কিন্তু নাইট শো-তে সে সিংহের মুখে হাত ঢোকাতেই প্রাণীটা কামড়ে ধরে রিংমাস্টারের হাত৷ তারপর থাবার এক আঘাতে লোকটার মাথার খুলি চুরমার করে রক্ত খেতে শুরু করে৷ সার্কাসের লোকেরা সবাই একবাক্যে বলেছিল ওই আফ্রিকার সিংহটা নাকি সবচেয়ে অনুগত ছিল রিংমাস্টারের৷ একদম পোষা কুকুরের মতো রিংমাস্টারের নির্দেশ পালন করত প্রাণীটা৷
‘খেলা যখন চলত না তখন লোকটা সিংহটাকে খাঁচা থেকে বার করলে রিংমাস্টারের পায়ে পায়ে ঘুরত প্রাণীটা৷ অনেক সময় রাতে প্রাণীটাকে নিয়ে নিজের তাঁবুতে ঘুমাতেনও তিনি৷ একবার নাকি ট্রেনিং-এর সময় নতুন আনা একটা চিতাবাঘ যখন রিংমাস্টারকে আক্রমণ করেছিল তখন ওই প্রাণীটাই চিতাবাঘের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রভুর জীবন রক্ষা করে৷ কিন্তু সেই হঠাৎ ও ভাবে রিংমাস্টারকে আক্রমণ করল কেন, তার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি কেউ৷
‘যারা স্বচক্ষে ঘটনাটা দেখেছিল তারা বলেছিল, যেন তাকে মেরে খাবার জন্যই সিংহটা তাকে মেরেছিল৷ তারপর পরমানন্দে তার রক্তমাংস খাচ্ছিল৷ এটা হঠাৎই রেগে উঠে আক্রমণ করার ব্যাপার ছিল না৷ হঠাৎ সেই সিংহের মধ্যে মানুষের রক্ত খাবার আদিম জান্তব প্রবৃত্তি জেগে উঠেছিল কেন তা কেউ বলতে পারেনি৷
‘আমি নিজেও তার ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি৷’ কথা শেষ করে মিস্টার সুব্বার দিকে তাকালেন অনিরুদ্ধ৷
সুব্বা বললেন, ‘ওই সিংহটার নাম ছিল ‘ফারাত’৷ কালো কেশরওয়ালা ধূসর বর্ণের ইজিপশিয়ান সিংহ৷ আর রিংমাস্টার রঙ্গনাথন৷’
অনিরুদ্ধ বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে৷ ঠিক তাই৷ ব্যাপারটা আপনি জানেন? সে সময় খবরের কাগজেও ফলাও করে ছাপা হয়েছিল ঘটনাটা৷’
মিস্টার সুব্বা বললেন, ‘ঘটনাটা আমি জানি৷ আর তা কেন ঘটেছিল তাও জানি৷’
অনিরুদ্ধ বিস্মিত ভাবে বললেন, ‘কারণটা আপনি জানেন? আমি বহু ভেবেও উদ্ধার করতে পারিনি ব্যাপারটা৷ কী কারণ ছিল সিংহের ওই আক্রমণের পিছনে? আপনি কী ভাবে জানলেন?’
প্রশ্নগুলো শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে অনিরুদ্ধকে চমকে দিয়ে সুব্বা বেশ শান্ত স্বরে বললেন, ‘অনেক মানুষের জীবনে এমন ঘটনা ঘটে যা গল্পের চেয়েও অনেক চমকপ্রদ৷ আপনার অনুমান ঠিক৷ এই সার্কাসেই ঘটনাটা ঘটেছিল৷ বর্তমান ম্যানেজারের সেটা জানা নেই৷ আমি ঘটনাটি জানি, কারণ এই সার্কাসেই তখন খেলা দেখাতাম আমি৷ আর ওই ভয়ংকর ঘটনার নেপথ্যে আমি ছিলাম প্রধান কুশীলব৷’
‘আপনি!’
‘হ্যাঁ, আমি৷ আপনি যখন জানতে চাইছেন তখন আপনার কৌতূহল নিরসন করব আমি৷ ঘটনাটা শুনলে আপনার এতদিনের অমীমাংসিত রহস্যের সমাধান হবে৷ আর আপনার কাছে কথাগুলো বলে হয়তো কিছুটা ভারমুক্ত হব আমি৷ বলতে পারেন এটা আমার স্বীকারোক্তি৷ আপনার সঙ্গে আজ আমার দেখা হওয়াটা হয়তো একটা সমাপতন৷’
‘কী স্বীকারোক্তি?’
৪
এরিনার ওপর একটা ফ্যাকাশে আলো ছড়াচ্ছে মাথার ওপর ঝুলতে থাকা বালবটা৷ সেইজন্য এরিনার দিকে তাকিয়ে মিস্টার সুব্বা বলতে শুরু করলেন তাঁর কথা—
‘হ্যাঁ, এই সার্কাসের এরিনাই এক সময় ছিল আমার জীবন৷ আমার ধ্যান-জ্ঞান৷ ওই যে মাথার ওপর ট্র্যাপিজের ঝুলন্ত বারগুলো দেখছেন ওখানে খেলা দেখাতাম আমি৷ এরিনার মাথার ওপর শূন্যে দোল খেতাম৷ পাখির মতো উড়ে বেড়াতাম, বাতাসে ভল্ট খেয়ে নেমে আসতাম নীচের ওই এরিনাতে৷ আমার খেলা দেখে মুখরিত হয়ে উঠত জনতা৷ করতালিতে ফেটে পড়ত তাঁবু৷ আমি ছিলাম সে সময় এই সার্কাসের সেরা ট্র্যাপিজ খেলোয়াড়৷ ট্র্যাপিজ মাস্টার পশুপতি৷ পশুপতি সুব্বা৷
‘নেপালের বিরাটনগরের কাছে এক হতদরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলাম৷ আমাদের গ্রামের এক লোক সার্কাসে কাজ করত৷ তার হাত ধরে মাত্র আট বছর বয়সে এক সার্কাস দলে যোগ দিই আমি৷ তারপর এ-সার্কাস ও-সার্কাস ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কুড়ি বছর কেটে গেল৷ ততদিনে ট্র্যাপিজের খেলায় বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছি আমি৷ লেখাপড়া শেখার তেমন সুযোগ হয়নি৷ অন্য কোনও কাজও জানতাম না৷ কিন্তু খেলাটা আমি খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করতাম৷ ট্র্যাপিজই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান৷ সেজন্য সে-খেলায় সাফল্যও এসেছিল৷ এক বার থেকে এক বার-এ উড়ে যাওয়া, বা শূন্যে সাইকেল চালানো নেহাতই জলভাত ছিল আমার কাছে৷ অবশেষে নানা সার্কাসে ঘুরে আমি একদিন যোগ দিলাম এই রয়্যাল ইন্ডিয়ান সার্কাসে…’
এটুকু বলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইলেন শূন্য এরিনার দিকে৷ যেন স্মৃতির আড়ালে ডুব দিলেন তিনি৷ তারপর আবার ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন তাঁর কথা—
‘সার্কাসে তখন বাঘ-সিংহের খেলার রমরমা৷ মূলত হিংস্র পশুপাখিদের খেলা দেখার টানেই মানুষ সার্কাস দেখতে ছুটে আসে৷ আর রিংমাস্টারদের অসীম প্রতিপত্তি সার্কাসে৷ ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির দিক থেকে সার্কাসের ম্যানেজারের পরই তার স্থান৷
‘এই সার্কাসেও রিংমাস্টার রঙ্গনাথনের স্থানও ছিল, দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবেই৷ আমি নতুন দলে যোগদান করেই মনোনিবেশ করলাম নিজের কাজে৷ সারাদিন নিজে কঠিন পরিশ্রম করতাম৷ সার্কাসে অন্য যারা ট্র্যাপিজের খেলা দেখাত সেই সব ছেলে-মেয়েদেরও আরও ভালো করে তালিম দেওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম৷ ফলও মিলল, ক্রমশ এই সার্কাসে জনপ্রিয় হতে শুরু করল ট্র্যাপিজের খেল…’
একটু দম নিয়ে থেমে থেমে কথা বলছেন সুব্বা৷ তিনি আবার শুরু করলেন— ‘ভালোই চলছিল প্রথমে সবকিছু৷ সার্কাসের ম্যানেজারও খুব খুশি আমার কাজে৷ কিন্তু এর মধ্যেই নিহিত ছিল এক সর্বনাশের ইঙ্গিত৷ একটা সময় এমন হল যে শুধু রিংমাস্টারের খেলা নয়, আমার ট্র্যাপিজের খেলা দেখার জন্য লোক ছুটে আসতে লাগল সার্কাসে৷
‘একটা খেলা দেখাতাম আমি৷ চোখ বেঁধে এরিনার ওপর শূন্যে একটা ঝুলন্ত বার থেকে অন্য বার-এ লাফানো৷ বাঘ-সিংহের খেলার চেয়ে সে খেলার ঝুঁকি কোনও অংশে কম ছিল না৷ কারণ, পায়ের নীচে কোনও জাল পাতা থাকত না খেলা দেখাবার সময়৷ সামান্য হিসাবের ভুলচুক মৃত্যু ডেকে আনতে পারে৷ অসম্ভব জনপ্রিয় হতে শুরু করল আমার এই খেলা৷
‘ক্রমশ আমি মালিক আর ম্যানেজারের প্রশংসার পাত্র হতে শুরু করলাম৷ সার্কাসের তাঁবুতে আমার জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল৷ আর এতেই প্রমাদ গুনতে শুরু করল রিংমাস্টার রঙ্গনাথন৷ এমনিতেই ছিল সে রুক্ষ প্রকৃতির লোক৷ লোকজনের সঙ্গে মাঝে মাঝেই দুর্ব্যবহার করত৷ সার্কাসের কলাকুশলীরা তাকে ভক্তি নয়, ভয় করত৷ আমার ব্যবহার ছিল ঠিক তার উলটো৷ কোমল স্বহূদয়৷ কাজেই সার্কাসের অন্য লোকদেরও মন জয় করে নিতে শুরু করলাম আমি৷
‘আর এ সবই কাল হল৷ রিংমাস্টার রঙ্গনাথনের মনে ধীরে ধীরে আক্রোশ জমতে শুরু করল আমার প্রতি৷ মুখে কিছু না বললেও সে নানাভাবে আমাকে বিব্রত করতে শুরু করল৷ এই ধরুন আমি এরিনাতে খেলা প্র্যাকটিস করাচ্ছি৷ ঠিক সেই সময় সে সিংহটাকে নিয়ে হাজির হল এরিনাতে৷ আর সিংহটাও ছিল তার ভীষণ অনুগত৷ তার ইশারায় আমাকে দেখলেই সে দাঁত খিঁচোত৷
‘আমাকে অপছন্দ করার জন্য একবার আমার দিকে সিংহ লেলিয়ে দিয়েছিল৷ প্রাণীটা যখন আমার বুকের ওপর উঠে বসেছিল তখন ভয়ে কুঁকড়ে গেছিলাম আমি৷ আর তাই দেখে রঙ্গনাথনের কী হাসি! তবুও ব্যাপারগুলো মানিয়ে চলছিলাম…
‘কিন্তু এরপর যেন মরিয়া হয়ে উঠতে শুরু করল লোকটা৷ এরপর সে একটা কাজ করতে শুরু করল৷ আমি যখন এরিনায় এসে খেলা দেখাতাম, তখন ও সিংহটা নিয়ে এসে দাঁড়াত এরিনার বাইরে৷ আমার খেলা শেষ হলেই খেলা দেখাত সে৷ দর্শকরা ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও আমি ওপর থেকে বুঝতাম ব্যাপারটা৷
‘কেমন হিংস্র লোলুপ দৃষ্টিতে নীচ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত প্রাণীটা৷ ধীরে ধীরে প্রাণীটা কেমন যেন আতঙ্ক সৃষ্টি করল আমার মনে৷ আমার খালি মনে হত সত্যিই প্রাণীটা একদিন আমার ঘাড় মটকাবে না তো? কিন্তু ব্যাপারটা কাউকে বলতে পারতাম না আমি…
তারপর একদিন ঘটল সেই ঘটনা৷ সার্কাসের শেষ শো চলছে৷ আমি মাটি থেকে অনেক উঁচুতে বারের ওপর থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় অন্য বারে ঝাঁপ দেবার খেলাটা দেখাতে চলেছি৷ এক সহকর্মী আমার চোখে রুমাল বেঁধে দিতে চলেছে৷ ঠিক সেই সময় আমি নীচে তাকিয়ে দেখলাম এরিনার বাইরে সিংহটাকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে রঙ্গনাথন৷ হিংস্র প্রাণীটা লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে৷ রঙ্গনাথনের মুখে কুটিল হাসি৷ আমার চোখ বাঁধা হল৷ আমি ঠিক যে মুহূর্তে ঝাঁপ দিলাম ঠিক সেই মুহূর্তে রঙ্গনাথনের নির্দেশে তাঁবু কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠল প্রাণীটা৷ হ্যাঁ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার নির্দেশেই ডেকে উঠেছিল প্রাণীটা৷
‘ওই ডাকটা শুনে মনোসংযোগ নষ্ট হয়ে গেল আমার৷ সূক্ষ্ম হিসাবের পার্থক্য গুলিয়ে গেল৷ আমি ঝাঁপ দিলাম ঠিকই, কিন্তু উলটো দিকের বারটা ধরতে পারলাম না৷ সোজা আছড়ে পড়লাম তিরিশ ফুট নীচে এরিনার মাঝখানে৷ মাটিতে পড়ার আগে একজন লোকের সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ায় প্রাণে বেঁচে গেলাম ঠিকই, কিন্তু আমার বাঁ-হাতের কবজির হাড় টুকরো টুকরো হয়ে গেল৷ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করা হল, তাঁবুতে আবার ফিরিয়ে আনা হল, কিন্তু খেলা বন্ধ হয়ে গেল আমার৷ দুই হাতই তো ট্র্যাপিজ খেলোয়াড়ের সব কিছু৷ আমি রঙ্গনাথনের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগও করতে পারলাম না৷ কারণ সেই যে কাজটা করিয়েছে তার কোনও প্রমাণ নেই৷ সবাই ভাবল এটা একটা নিছক দুর্ঘটনা…
‘নিজের তাঁবুতে বসে দর্শকদের করতালি শুনতাম আমি৷ আর ভাবতাম আমি আবার একদিন এরিনাতে ফিরে আসব৷ আর তার সঙ্গে রঙ্গনাথনের প্রতি একটা প্রচণ্ড ঘৃণা পুঞ্জীভূত হতে শুরু করল আমার মনে৷ লোকটা যে আমাকে খুন করতে চেয়েছিল…৷’
অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে শুনে যেতে লাগলেন তাঁর কথা—
মিস্টার সুব্বা এরপর বললেন, ‘আমার হাতটা ভালো করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন ডাক্তাররা৷ কিন্তু একদিন তাঁরা জানিয়ে দিলেন আর যাই হোক এই হাত নিয়ে আর ট্র্যাপিজের খেলা দেখানো যাবে না৷ আমিও উপলব্ধি করলাম ব্যাপারটা৷ হাতটাতে কোনও জোর পাই না৷ আমি আর কোনওদিন ফিরতে পারব না এরিনাতে৷ খেলোয়াড় জীবন আমার শেষ৷ আর তার সঙ্গে রঙ্গনাথনের প্রতি আমার ঘৃণা আক্রোশে পরিণত হল৷ সার্কাস দলের সঙ্গে তখন আমি প্রায় বোঝার মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলাম এখানে-ওখানে…
‘কিন্তু এ বোঝা সার্কাস কোম্পানি কত দিন বইবে? মাস-ছয়েক এভাবে চলার পর সার্কাস তখন তাঁবু ফেলেছে জব্বলপুরে৷ একদিন সকালে ম্যানেজার আমাকে ডেকে সামান্য কিছু টাকা ধরিয়ে জানিয়ে দিল আমার চাকরি নেই৷ আমাকে সেদিন রাতের মধ্যেই সার্কাস ছেড়ে চলে যেতে হবে৷ পরদিন আমার জায়গাতে নতুন লোক আসবে…
‘ম্যানেজারের কথা শুনে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল আমার মাথায়৷ প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠার পর আমার মাথায় যেন খুন চেপে গেল৷ ওই রিংমাস্টার রঙ্গনাথনের জন্যই আমার আজ এমন অবস্থা৷ লোকটা আমাকে খুন করতে না পারলেও আমার সার্কাস-জীবন ও খুন করেছে৷
‘ঠিক করলাম চলে যাবার আগে তাকেও খুন করতে হবে৷ কিন্তু কী ভাবে? হাতে মাত্র রাতটুকু পর্যন্ত সময়৷ কথায় বলে, শয়তান যখন কারও ওপর ভর করে তখন সেই তাকে বুদ্ধি যোগায়৷ ঠিক করলাম রঙ্গনাথনকে তার অস্ত্রেই ঘায়েল করব আমি৷ মানুষ যখন প্রতিহিংসায় পাগল হয়ে যায় তখন সে এমন সব কাণ্ড ঘটায় যা সাধারণ সময় অকল্পনীয় বলে মনে হয়৷
‘সারাদিন প্রতীক্ষা করার পর তেমনই একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটালাম আমি৷ সিংহের হাতে খুন হয়ে গেল রঙ্গনাথন৷ ব্যাপারটা কেউ ধরতেই পারল না৷ ঘটনা ঘটার পরই আমি নিঃশব্দে তাঁবু ছাড়লাম৷ আমার তো চলে যাবার কথা ছিল…৷’ কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার সুব্বা৷
তাঁকে দেখে বিস্মিত অনিরুদ্ধর মনে হল ভদ্রলোক বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন৷ মৃদু কাঁপছেন তিনি৷ অনিরুদ্ধও উঠে দাঁড়ালেন৷ প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু আপনি ওই ঘটনাটা ঘটালেন কী ভাবে?’
নিজেকে সামলে নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘চারটে বাজতে চলল৷ আমি এখন বেরিয়ে পড়ব৷ তাঁবুর বাইরে গাড়ি পর্যন্ত আপনি আমার সঙ্গে চলুন৷ যেতে যেতে শেষ একবার ভাবার চেষ্টা করুন কী ভাবে কাণ্ডটা ঘটিয়েছিলাম আমি? কেন সিংহটা খুন করল রঙ্গনাথনকে?’
প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে শূন্য এরিনার দিকে শেষ একবার তাকিয়ে নিয়ে বাইরে যাবার জন্য হাঁটতে শুরু করলেন মিস্টার সুব্বা৷ প্রশ্নের জবাব ভাবতে ভাবতে তাঁকে অনুসরণ করলেন অনিরুদ্ধ৷
এরিনা ছেড়ে ঘুমন্ত তাঁবুগুলোকে অতিক্রম করতে করতে সুব্বা শুধু একবার বললেন, ‘আর কোনও দিন আমি এই সার্কাসের তাঁবুতে আসব না৷ নেপাল সীমান্ত খুব কাছেই৷ এই সার্কাসের তাঁবু পড়েছে শুনে শেষ একবার দেখতে এসেছিলাম৷’
টিনের ব্যারিকেড ঘেরা সার্কাসের চৌহদ্দির বাইরে এসে তাঁরা দুজন উপস্থিত হলেন৷ কিছুটা তফাতে একটা দামি গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল৷ সুব্বা সেই গাড়ির সামনে অনিরুদ্ধকে নিয়ে দাঁড়ালেন৷ ড্রাইভার মনে হয় তৈরি ছিল৷ সে দরজা খুলে ইঞ্জিন স্টার্ট করল৷ গাড়িতে ওঠার আগে অনিরুদ্ধর মুখোমুখি দাঁড়ালেন সুব্বা৷ প্রশ্ন করলেন, ‘কী, কিছু বুঝতে পারলেন?’
অনিরুদ্ধ জবাব দিলেন, ‘না, পারলাম না৷’
সুব্বা বললেন, ‘সেদিন শেষ শোতে রঙ্গনাথনের খেলা শুরু হবার আগে আমি একটা লাঠি নিয়ে সন্তর্পণে হাজির হয়েছিলাম সিংহের খাঁচার সামনে৷’
অনিরুদ্ধ বললেন, ‘ও বুঝেছি৷ লাঠির আঘাতে সিংহটাকে খেপিয়ে ছিলেন আপনি৷ তাই সে আক্রমণ করে রঙ্গনাথনকে…৷’
সুব্বা বললেন, ‘লাঠি দিয়ে আঘাত করে সিংহটাকে উত্তেজিত করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সেটা নিজেকে আক্রমণ করাবার জন্য৷’
অনিরুদ্ধ বললেন, ‘তার মানে?’
মিস্টার সুব্বার ঠোঁটের কোণে একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল৷ পকেট থেকে বাঁ হাতটা বার করে তিনি হাতাটা গোটালেন৷ তাঁর বাঁ-হাতটা কব্জি থেকে নেই! চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাঁর কাটা হাত!
হাতটা দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘সিংহটা এমনিতেই আমাকে পছন্দ করত না৷ সিংহটাকে আঘাত করে খেপিয়ে তুলে খাঁচার শিকের ফাঁক দিয়ে আমার অকর্মণ্য বাঁ-হাতটা ঢুকিয়ে দিলাম সিংহর মুখের ভিতর৷ ভয় আর অসম্ভব কষ্টকে জয় করলাম প্রতিশোধ নেবার জন্য৷ সিংহ চিবিয়ে খেল আমার এই হাতটা৷ আমি তাকে মানুষের রক্তের স্বাদ দিলাম৷ জাগিয়ে তুললাম তার বন্য আদিমতাকে৷ আর তার কিছুক্ষণ পর এরিনাতে রঙ্গনাথন তার মুখের মধ্যে হাত ঢোকাতেই…’
মিস্টার সুব্বা উঠে বসলেন তাঁর কালো কাচ ঢাকা গাড়িতে৷ কুয়াশা মাখা অন্ধকারে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন তিনি৷ অনিরুদ্ধর কাছে তিনি শুধু রেখে গেলেন এক ভয়ংকর স্বীকারোক্তি!
—