ভগবানের হাত
নার্সিং হোমের ছোট্ট কেবিনে সন্ধেবেলা শুয়েছিল সুস্নাত৷ ভিজিটিং আওয়ার্স কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়েছে৷ সুস্নাতর কলিগরা তাকে দেখে ফিরে গিয়েছে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার হাজরা রাউন্ডে আসবেন৷ আগামিকাল সকালে সম্ভবত তার মুখের ব্যান্ডেজ খোলা হবে, একথা আজ সকালে নার্সের মুখে শোনার পর থেকে সারাদিন ধরে সুস্নাতর মনে চাপা একটা উত্তেজনা কাজ করছে৷ চোখ আর ঠোঁট বাদে, সুস্নাতর সারা মুখ ও মাথা সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজে মোড়া৷ প্রথমবার তো বেসিনের সামনে হাত ধুতে গিয়ে তার সামনের আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে সুস্নাত চমকে গিয়েছিল৷ মুখ তো নয়, ঠিক যেন মমির মাথা! তারপর থেকে আয়নার দিকে সে আর তাকাতে সাহস করে না৷ কিন্তু কালই তো তা হলে আসল ব্যাপারটা ঘটবে৷ নার্সের কথা ঠিক হলে, কাল তাকে তাকাতেই হবে আয়নার দিকে, তাও ব্যান্ডেজ খোলা অবস্থায়৷ সুস্নাতর মনে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ব্যান্ডেজ খোলার পর কী দেখবে সে? তার সেই চেনা মুখ, নাকি অন্যকিছু? নিজেকে চিনতে পারবে তো সে? তার কলিগরা অবশ্য তাকে আশ্বস্ত করে গিয়েছে, তেমন কিছু ঘটবে না বলে৷ ডাক্তার হাজরা কলকাতা শহরের অন্যতম বড়ো সার্জন৷ বিশেষত প্লাস্টিক সার্জারিতে তার সমকক্ষ এখানে আর কেউ নেই বললেই চলে৷ তিনি নিজে যখন অপারেট করেছেন, তখন নাকি চিন্তার কিছু নেই৷ বহু অ্যাক্সিডেন্ট কেসে তিনি মুখাবয়ব ফিরিয়ে দিয়েছেন নিখুঁতভাবে৷ লোকে বলে তাঁর হাত দুটো নাকি ‘ভগবানের হাত’! কিন্তু কলিগরা যাই বলে যাক, উৎকণ্ঠা কিছুতেই কাটছে না তার৷ ব্যান্ডেজ খুললে কী দেখবে সে? এই চিন্তা করতে-করতে হঠাৎই তার মনে পড়ে গেল সেই বীভৎস মুখটার কথা৷ ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠল এই ভেবে যে, তার মুখ ওইরকম হয়ে যাব না তো! শিউরে উঠল সুস্নাত৷ প্রাণপণে ভোলার চেষ্টা করতে লাগল সেই মুখটাকে৷
একটা মৃদু শব্দে সুস্নাতর চিন্তাজাল ছিন্ন হল৷ তার বেডের গায়ে প্লাইউডের পার্টিশন ওয়ালের ওপাশে কেউ যেন টোকা দিচ্ছে৷ ফুট সাতেক উঁচু এই পার্টিশন ওয়ালটাই একটা বড়ো ঘরকে দুটো কেবিনে ভাগ করেছে৷ দুটো কেবিনে ঢোকার দরজা অবশ্য আলাদা৷ সুস্নাতর কেবিনের দরজার সামনে যে লম্বা বারান্দার মতো প্যাসেজ আছে, তার ধারে সুস্নাতর দরজা পেরিয়ে পাশে ঘরে ঢুকতে হয়৷ দোতলার শেষ প্রান্তের কেবিন৷ ডাক্তার হাজরা ছাড়া ওই কেবিনে কোনো দিন কাউকে ঢুকতে দ্যাখেনি সুস্নাত৷
ঠক-ঠক! আবারও সেই শব্দ! তারপর ওপাশ থেকে একটা চাপা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘দাদা, আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?’ সুস্নাত সামান্য বিস্মিতবাবে বলল, ‘না, ঘুমইনি৷ আপনি কে?’ ওপাশের লোকটা বলল, ‘আমিও আপনার মতো বেডে শুয়ে আছি৷ আসলে, কথা বলার কোনো লোক নেই তো! তাই ভাবলাম যদি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলা যায়৷ তা আপনি বিরক্ত হলেন না তো?’ সে জবাব দিল, ‘না, না, বিরক্ত হব কেন? ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে গেলে সন্ধেবেলা এই সময় আমারও বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগে৷ সেই তো একঘেয়ে চুপচাপ থাকা! কথা বললে আমার ভালোই লাগবে৷’ সুস্নাতর কথা শুনে লোকটা মনে হয় আশ্বস্ত হল৷ সে বলল, ‘যাক বাঁচলাম৷ একদম হাঁপিয়ে উঠেছি কথা না বলে৷ তা আপনার তো অ্যাক্সিডেন্ট কেস, তাই না?’
‘কীভাবে জানলেন?’
লোকটা সামান্য চুপ করে থেকে বলল, ‘আড়ি না পাতলেও ওপাশের কথাবার্তা এপাশে শোনা যায়৷ তাই শুনে বুঝেছি৷ কী করে অ্যাক্সিডেন্ট হল?’
প্রশ্নটা শুনে সামান্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সুস্নাত৷ সে একবার ভাবল ব্যাপারটা লোকটাকে বলবে৷ কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল, লোকটা বিশ্বাস করবে না তার কথা৷ ঠিক যেমন তার কলিগরা করেনি৷ তা এক কলিগ তো বলেই ফেলেছিল, ‘তুমি কি আজকাল নেশাটেশা করছ? নাকি ‘‘হরর ফিল্ম’’ দ্যাখো?’
কাজেই দুর্ঘটনার মূল কারণটি চেপে গিয়ে বলল, ‘আমি সেক্টর ফাইভে একটা কম্পিউটার ফার্মে চাকরি করি৷ যে দিন অ্যাক্সিডেন্টটা হল, সে দিন অফিস থেকে বেরতে বেশ রাত হয়েছিল৷ রাত এগারোটা হবে৷ বেরিয়ে বাইপাসে উঠতেই ঝোড়ো বাতাস আর মুষলধারে বৃষ্টি! দাঁড়ানোর কোনো জায়গা না দেখে তার মধ্যেই বাইক নিয়ে এগোচ্ছিলাম৷ কিছুটা পথ এগোবার পরই, আমার বাইকের চাকাটা স্কিড করল৷ ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে ছিটকে পড়লাম রাস্তায়৷ আমার তারপর জ্ঞান ছিল না৷ পরে শুনলাম স্থানীয় লোকেরা আমাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে, রাত একটা নাগাদ এই নার্সিং হোমে দিয়ে যায়৷ নার্সিং হোমের লোকেরা আমার মোবাইলের কললিস্ট দেখে আমার কলিগদের সঙ্গে যোগাযোগ করে৷’ এই পর্যন্ত শুনে লোকটা জানতে চাইল, ‘আপনার কোথায় লেগেছে?’
সে জবাব দিল, ‘মুখে৷ ডিভাইডারে ধাক্কা মারার সময় হেলমেটটা কোনোভাবে ভেঙে গিয়েছিল৷ যখন আমাকে এখানে আনা হয়, তখন নাকি নার্সিং হোমের লোকেরাও আমার মুখ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল!’ এরপর একটু থেমে সে বলল, ‘তবে অন্য কোনো নার্সিং হোমে না গিয়ে, সে লোকগুলো যে ঘটনাচক্রে আমাকে এখানে এনেছিল, এ ব্যাপারে আমি ভাগ্যবান৷ ডাক্তার হাজরা মতো সার্জনকে আমি পেলাম৷ লোকে নাকি ওঁর হাতকে বলে, ‘ভগবানের হাত’! অ্যাক্সিডেন্ট বা বার্নিংকেসে মুখমণ্ডল ফেরাতে সকলে নাকি ওঁরই শরণাপন্ন হন৷ আমার ডান কানটাই শুনেছি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ দু-দুবার অপারেট করতে হয়েছে৷ তা আপনার কী কেস? আমার মতো অ্যাক্সিডেন্ট?’
লোকটা জবাব দিতে যাচ্ছিল মনে হয়, কিন্তু তার আগেই করিডরে ডাক্তার হাজরার গলা শোনা গেল, ‘হ্যাঁ, কাল সকাল দশটায় আসবেন৷ গেটম্যানকে বলা আছে৷ ঢুকতে হবে…’
তার গলার শব্দ পেয়েই পাশের কেবিনের লোকটা চুপ করে গেল৷ তারপরই সুস্নাতর কেবিনে ঢুকলেন ডাক্তার হাজরা৷ মধ্য-পঞ্চাশের ডাক্তার হাজরা বেশ সুপুরুষ৷ ফরসা, লম্বা, মেদহীন দেহ৷ টিকলো নাকে বসানো সোনার বাইফোকালের আড়ালে ঝকঝকে, সপ্রতিভ চোখ৷ নিখুঁতভাবে কামানো মুখ ও ঠোঁটের কোণে আবছা হাসির রেশ৷
সুস্নাত তাঁকে দেখে বিছানায় উঠে বসতেই তিনি হেসে বললেন, ‘কাল সকালে কিন্তু আপনার ব্যান্ডেজ খুলব৷’
সুস্নাত তার কথা শুনে একটু ভয়ে-ভয়ে বলল, ‘আমার মুখটা ঠিক আগের মতো থাকবে তো ডাক্তারবাবু?’
তার প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার হাজরা তাঁর দু-হাতের পাতা সুস্নাতর সামনে মেলে ধরে বললেন, ‘আমার এই হাতের উপর আপনি বিশ্বাস রাখতে পারেন৷ ডাক্তারি লাইনে সতীর্থরা অনেকে আমাকে ‘‘হ্যারল্ড গিলিস’’ বলে ডাকেন৷’
‘তিনি কে?’ জানতে চাইল সুস্নাত৷ ডাক্তারবাবু হেসে বললেন, ‘তাঁকে বলা যেতে পারে ‘‘ফেশিয়াল প্লাস্টিক সার্জারির জনক’’৷’ তিনিই প্রথম ১৯১৭ সালে ‘ওয়াল্টার ইও’ নামে এক ব্রিটিশ সৈনিকের মুখমণ্ডলে প্লাস্টিক সার্জারি করেন৷ ‘ইও’-র ক্ষতবিক্ষত কপালে তিনি ‘টিউবড ফ্ল্যাপ’ বা ‘নলাকৃতি চামড়ার পট্টি’ বসিয়ে তার পূর্বেকার মুখমণ্ডল ফিরিয়ে দিয়েছিলেন৷ তবে তার চেয়ে অনেক বড়ো কাজ আমি এবার আপনার ক্ষেত্রে করলাম৷ তিনি করেছিলেন, ‘অটোগ্রাফট’ আর আমি করলাম ‘অ্যালোগ্রাফট’!’’ শেষের কথাগুলো যেন অনেকটা স্বগতোক্তির ঢঙে বেশ আত্মপ্রসাদের সঙ্গে তিনি বললেন৷ সুস্নাত বলল, ‘অটোগ্রাফট আর অ্যালোগ্রাফট মানে?’
ডাক্তার হাজরা বললেন, ‘এই সব মেডিক্যাল টার্মস৷ আপনি ঠিক বুঝবেন না৷’
ডাক্তার হাজরা চলে যাওয়ার পর, সুস্নাত ভাবল যে, সে আবার কথা বলতে পারে পাশের কেবিনের লোকটার সঙ্গে৷ কিন্তু ওপাশ থেকে আর কোনো ডাক এল না৷ হয়তো সে ঘুমিয়ে পড়েছে, এই ভেবে সুস্নাতও আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল৷
দুই
পরদিন ঠিক বেলা দশটায় সুস্নাতর কেবিনে ঢুকলেন ডাক্তার হাজরা৷ সঙ্গে নার্স, নার্সিং হোমের একজন কর্মচারী ও অপরিচিত জনাতিনেক লোক৷ তাদের সঙ্গে ক্যামেরা ইত্যাদি আছে৷ সেই লোকগুলোকে দেখিয়ে ডাক্তারবাবু সুস্নাতকে বললেন, ‘এরা হলেন মেডিক্যাল রিপোর্টার৷ আজকের ঘটনার সাক্ষী হতে এসেছেন৷’
মিনিট খানেকের মধ্যেই ডাক্তার হাজরার নির্দেশে নার্স ব্যান্ডেজ খুলতে শুরু করল৷ এক একটা পট্টি খোলা হচ্ছে, আর সুস্নাতর বুক ধক করে উঠেছে৷ ঘরসুদ্ধ সকলে উত্তেজিতভাবে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুস্নাতর দিকে৷ একটা পিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে ঘরে৷
একসময় ব্যান্ডেজের শেষ পরতটাও খসিয়ে ফেলা হল সুস্নাতর মুখ থেকে৷ কারও মুখে কোনো কথা নেই৷ সুস্নাত তাকাল ডাক্তার হাজরার মুখের দিকে৷ গম্ভীরভাবে তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন সুস্নাতর মুখমণ্ডল৷ তা হলে কী…!
কিন্তু ধীরে ধীরে আবছা একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল ডাক্তার হাজরার মুখে৷ নার্সকে তিনি বললেন, ‘ওকে এবার আয়নাটা দিন৷’
নার্সের থেকে কাঁপা হাতে আয়নাটা নিয়ে সুস্নাত সেটি মুখের সামনে ধরে ভয়ে-ভয়ে আয়নার দিকে তাকাল৷ অনেকদিন পর সে দেখল নিজের মুখ৷ কপালে, নাকের পাশে সার্জারির কয়েকটা স্পষ্ট দাগ থাকলেও, তার মুখমণ্ডল প্রায় একইরকম আছে!
ডাক্তার হাজরা বললেন, ‘ওই দাগগুলো নিয়ে ভাববেন না৷ অয়েন্টমেন্ট লাগালে কয়েক মাসের মধ্যে ওই দাগগুলো ভ্যানিশ হয়ে যাবে৷’
সুস্নাতর মুখে এতক্ষণ পর হাসি ফুটে উঠল৷ সে এরপর আয়নাটা নার্সের হাতে ফেরত দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু ডাক্তার হাজরা সুস্নাতকে বললেন, ‘আসল ব্যাপারটা খেয়াল করেননি আপনি৷ আপনার ডান কানটা দেখুন৷’
তার কথা শুনে সুস্নাত আয়নাটা আবার তুলে ধরে ডাকাল কানের দিকে৷ একটা স্পষ্ট কাটা দাগের চিহ্ন! কানটা যেন আলাদা ভাবে জোড়া হয়েছে তার জায়গাতে৷ সম্ভবত সার্জারির জন্যই কিছুটা লম্বা আর ফর্সা দেখাচ্ছে কানটা৷ ডাক্তার হাজরা এরপর প্রথমে তার সেই কানটার দিকে একটু ঝুঁকে, ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে মন্তব্য করলেন, ‘ও ফাইন! কানটা আমি আপনাকে শেষপর্যন্ত ফিরিয়ে দিতে পারলাম! সত্যি কথা বলতে কী, আমিও বেশ কিছুটা কনফিউজড ছিলাম এ ব্যাপারে৷’ তরপর তিনি পকেট থেকে একটা পোস্টকার্ড সাইজের ছবি বের করে সুস্নাতর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি অ্যাক্সিডেন্টের দিন নার্সিং হোমে আসার পর আপনার মুখে ডানপাশের এই ছবিটা তোলা হয়েছিল৷ এটা দেখলে এবার আপনি আর আমার রিপোর্টার বন্ধুরা বুঝবেন, কী অসাধ্যসাধন করেছি আমি!’ সুস্নাত ছবিটা হাতে নিয়ে সেটা দেখেই চমকে উঠল৷ এত বীভৎস মুখমণ্ডল হয়েছিল তার! রক্তাক্ত এক ভয়ংকর মুখমণ্ডল৷ ডান কানের ছিদ্রটাই শুধু দেখা যাচ্ছে৷ কানের পাতার কোনো অস্তিত্বই নেই তাতে৷ কেউ যেন ছিঁড়ে নিয়েছে কানটা! সুস্নাত তাকিয়ে থাকতে পারল না ছবির দিকে৷ ছবিটা ডাক্তারবাবুর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে বলল, ‘ডাক্তারবাবু আপনি সত্যিই ভগবান৷’
ডাক্তার হাজরা ছবিটা রিপোর্টারদের কাছে দিয়ে নিজের হাতের পাতা দুটো মেলে ধরে আত্মপ্রত্যয়ের হাসি হেসে বললেন, ‘আমার এই হাত দুটোকে অনেকে বলে, ‘‘ভগবানের হাত!’’ এখন নিজেও বিশ্বাস করি কথাটা৷’
ছবিটা এরপর ঘরের লোকগুলোর হাতে-হাতে ঘুরতে লাগল৷ বিস্মিতভাবে সকলে ছবিটার সঙ্গে মেলাতে লাগল সুস্নাতর কানটা৷ রিপোর্টার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অ্যাক্সিডেন্টটা হল কীভাবে?’
এবারও সত্যি কথাটা প্রায় বলেই ফেলছিল সুস্নাত৷ মুহূর্তের জন্য তার মনে ভেসে উঠল বাইকের হেডলাইটের আলোতে দেখা ভয়ঙ্কর এক মুখচ্ছবি! কিন্তু সে ভূত দেখেছে বললে কি কেউ বিশ্বাস করবে? নিজেকে সামলে নিয়ে সে সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, ‘বাইকের চাকা বৃষ্টিভেজা রাস্তায় পিছলে গিয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা মারে৷’
আর একজন রিপোর্টার সুস্নাতর অনুমতি নিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুললেন সুস্নাতর কানের৷ ফ্ল্যাশ বালবের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠল ডাক্তার হাজরার মুখের হাসিও৷ রিপোর্টারদের কাজ শেষ হলে ডাক্তার হাজরা সুস্নাতকে বললেন, ‘আপনার ব্যাগটা আমাদের কাছে ছিল৷ যারা আপনাকে এখানে এনেছিল তারাই ওটা দিয়ে গিয়েছে৷’ এই বলে তিনি ইশারা করলেন নার্সিং হোমের কর্মচারীর দিকে৷ সে লোকটা একটা চামড়ার অফিস ব্যাগ এনে সুস্নাতর বিছানায় রেখে বলল, ‘ব্যাগটা কিন্তু আমরা খুলিনি, স্যার৷ শুধু ব্যাগের গায়ের ধুলো-কাদা মুছে দিয়েছি৷’
সুস্নাত দেখল ব্যাগটা৷ হ্যাঁ, ব্যাগটা তারই৷ সকলকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরনোর আগে ডাক্তার হাজরা ঝকঝকে হাসি হেসে, আবার সুস্নাতর দিকে তার হাতের পাতা দুটো মেলে ধরে বললেন, ‘আপনাকে আমি বলেছিলাম আপনি আমার হাতের উপর ভরসা রাখতে পারেন৷’
সুস্নাতর মনে হচ্ছিল, বেড থেকে নেমে একবার ডাক্তারবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে৷ কিন্তু তার আগেই তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷
তিন
মনটা বেশ হালকা লাগছে সুস্নাতর৷ যে অসহ্য আতঙ্ক তার বুকে চেপে বসেছিল সেটা কেটে গিয়েছে৷ ডাক্তারবাবু চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ব্যাগটা কাছে টেনে নিল সুস্নাত৷ ব্যাগটা খুলে বিছানায় সেটা উপুড় করতেই কাগজপত্তরের সঙ্গে কিছু শুকনো ঘাসের টুকরোও বেরিয়ে এল৷ কাগজগুলো ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎই একটা জিনিস হাতে উঠে এল সুস্নাতর৷ কিছুটা পুরনো একটা ফোটোগ্রাফ৷ পঁচিশ-ছাবিবশ বছরের এক অপরিচিত যুবকের ছবি৷ খুব সুন্দর মুখ৷ ঠিক যেন, কোনো সিনেমার নায়ক৷ এ কার ছবি? সুস্নাতর ব্যাগে এল কীভাবে? কিন্তু কিছুতেই সে স্মরণ করতে পারল না ব্যাপারটা৷ এক সময় তারা মনে হল, মাথায় চোট লেগে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়নি তো? ছবিটা নিশ্চয়ই তার পরিচিত কারও হবে, বা কেউ তাকে দিয়েছিল৷ নইলে এটা তার ব্যাগে এল কীভাবে! ঠিক এমন সময় পার্টিশনের ওপাশের কেবিন থেকে গতকালের সেই কণ্ঠস্বর আবার ভেসে এল, ‘দাদা কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?’ মুখের ব্যান্ডেজ খোলার উত্তেজনায় সুস্নাত ভুলেই গিয়েছিল লোকটার কথা৷ সে বলে উঠল, ‘না, আমি জেগেই আছি৷ কাল তো ডাক্তারবাবু চলে আসায় আর কোনো কথাই হল না৷ তা আপনি কেমন আছেন?’ লোকটা যেন অস্পষ্ট হেসে পালটা প্রশ্ন করল, ‘আপনি বলুন কেমন আছেন?’ সুস্নাত বেশ উৎফুল্লভাবে বলল, ‘জানেন আজ মুখের ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছিল৷ আমি তো তার আগে খুব আতঙ্কে ছিলাম৷ ডাক্তারবাবু অসাধ্যসাধন করেছেন! একটা ছবিতে দেখলাম কী বীভৎস মুখ হয়েছিল আমার! বিশেষত ডান কানের কোনো অস্তিত্বই যেন ছিল না৷ কিন্তু ডাক্তারবাবু চমৎকারভাবে সবকিছু জুড়ে দিয়েছেন৷ ডাক্তারবাবুর হাত দুটো সত্যিই ভগবানের হাত! উনি না থাকলে এ মুখ নিয়ে রাস্তায় বেরোতাম কীভাবে কে জানে? বাকি জীবনটা তো পড়েই আছে!’ লোকটা সামান্য চুপ থেকে বলল, ‘হ্যাঁ,সত্যি ভগবানের হাত৷ যে হাত ভগবানের তৈরি মুখের উপর হাতের খেলা দেখাতে পারে সে হাত তো ভগবানের হাত৷ আপনি ভাগ্যবান৷ তবে এবার থেকে একটু সাবধানে গাড়ি চালাবেন৷
সুস্নাত বলল, ‘সাবধানেই তো সেদিন গাড়ি চালাচ্ছিলাম, কিন্তু…’ সুস্নাত প্রায় বলেই ফেলতে যাচ্ছিল কথাটা৷ কিন্তু শেষমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রসঙ্গ পালটাবার জন্য বলল, ‘আচ্ছা, অ্যাক্সিডেন্ট হলে কী স্মৃতিবিভ্রম হয়?’
কিছু-কিছু ক্ষেত্রে হয় বলে শুনেছি৷ কিন্তু কেন? আপনার কি কোনো ঘটনা মনে আসছে না?’ লোকটা জিজ্ঞেস করল৷
সুস্নাত বলল, ‘এমনি ঘটনা তো আমার সবই মনে আছে৷ আসলে অ্যাক্সিডেন্টের সময় আমার সঙ্গে যে ব্যাগটা ছিল তার ভিতর থেকে একটা পোস্টকার্ড সাইজের ফোটোগ্রাফ বেরল৷ এক সুন্দর যুবকের সাদা-কালো ছবি৷ কিন্তু আমি কিছুতেই ধরতে পারছি না ছবিটা কার, বা কীভাবে এটা আমার ব্যাগে এল?’
ওপাশে সামান্য কিছুক্ষণের নীরবতা৷ লোকটা তারপর বলল, ‘আপনার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে পারলে ভালো হত৷ আমি আজ রাতেই নার্সিং হোম থেকে চলে যাব৷ হয়তো আপনার সঙ্গে আমার আর দেখাই হবে না৷ কিছু কথা বলার ছিল৷’
সুস্নাত বলল, ‘বাঃ! আপনারও ছুটি হয়ে যাচ্ছে৷ তা আপনি চলে আসুন না আমার ঘরে৷ আপনি বললে আমি যেতে পারি আপনার ঘরে৷’
লোকটা বলল, ‘এখানে পেশেন্টদের অন্য ঘরে যাওয়ার নিয়ম নেই৷ ডাক্তারবাবু জানলে রাগ করবেন৷ রাতে করিডর ফাঁকা হয়ে গেলে আমি যাওয়ার আগে আপনাকে ডাকব৷ প্লিজ একবার আসবেন৷’
লোকটার গলার স্বরে একটা আন্তরিক আহ্বান ফুটে উঠেছে৷ সে বলল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আসব৷ তা আপনার কী হয়েছিল? তা কিন্তু এখনও আমার জানা হয়নি৷ কী হয়েছিল আপনার?’
লোকটা জবাব দিল, ‘আমারও আপনার মতো মুখেরই ব্যাপার৷ সার্জারি হয়েছে৷’
সুস্নাত বলল, ‘আপনারও কি প্লাস্টিক সার্জারি হয়েছে নাকি? ‘‘অটোগ্রাফট’’ না ‘‘অ্যালোগ্রাফট?’’’ ডাক্তার হাজরার মুখে শোনা শব্দ দুটো চালিয়ে দিল সুস্নাত৷ লোকটা যেন একটু হেসে বলল, ‘শব্দ দুটোর মানে জানেন?’
সুস্নাত এবার একটু অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘না, আসলে ডাক্তারবাবুর মুখেই শব্দ দুটো শুনেছি৷’
লোকটা বলল, ‘আমি কিন্তু শব্দ দুটোর অর্থ জানি৷ আরও আছে, ‘‘আইসোগ্রাফট’’, ‘‘জেনোগ্রাফট’’… এসব প্লাস্টিক সার্জারির পরিভাষা৷ নিজের দেহের ত্বক বা চামড়া কেটে যখন সে দেহেরই অন্য কোথাও বসানো হয় তখন তাকে বলা হয় ‘‘অটোগ্রাফটিং’’ বা ‘‘অটোগ্রাফট’’, ‘‘আইসোগ্রাফটের’’ ক্ষেত্রে যমজ কোনো মানুষের একজনের ত্বক অন্যজনের দেহে বসানো হয়৷ আর ‘‘জেনোগ্রাফটের’’ ক্ষেত্রে এক প্রজাতিরটা অপর প্রজাতিতে বসানো হয়,’ একটানা কথাগুলো বলে থামল লোকটা৷ বিস্মিত সুস্নাত বলল, ‘আপনি এসব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন নাকি? অনেক জানেন দেখছি! আচ্ছা আপনি ‘‘অ্যালোগ্রাফটের’’ মানেটা বলবেন? ডাক্তারবাবু বললেন আমার নাকি ‘‘অ্যালোগ্রাফট’’ করছেন তিনি৷’ লোকটা বলল, ‘আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি পরে দেব৷ আচ্ছা, আপনি কিছু মনে না করলে দয়া করে বলবেন, অপারেশনের জন্য ডাক্তারবাবুকে কত পেমেন্ট করতে হচ্ছে?’
সুস্নাত একটু ইতস্তত করে বলল, ‘কলিগদের সঙ্গে ডাক্তারবাবুর কথা হয়েছে দেড় লাখ টাকা দিতে হবে৷ আজ বিকেলে তারা এসে টাকাটা মিটিয়ে দেবে৷ আমার অফিসই টাকাটা দিচ্ছে আসলে…’
সুস্নাত শুনল, লোকটা যেন অস্পষ্টভাবে বলল, ‘তার মানে পনেরো হাজার…’
সুস্নাত বলল, ‘কী বললেন?
কিন্তু ঠিক সেই সময় বারান্দায় পদশব্দ শোনা গেল৷ ডাক্তারবাবু! সঙ্গে-সঙ্গেই পাশের লোকটা চুপ হয়ে গেল সেই শব্দে৷ ডাক্তার হাজরা সুস্নাতর দরজা পেরিয়ে পাশের কেবিনে গিয়ে ঢুকলেন৷ এরপর খুব চাপাস্বরে যেন দীর্ঘক্ষণ ধরে পাশের কেবিনের লোকটার সঙ্গে কথা চলতে লাগল ডাক্তার হাজরার৷ একটা কথাই একবার স্পষ্টভাবে কানে এল সুস্নাতর৷ পাশের ঘরে লোকটা যেন একবার উত্তেজিতভাবে বলল, ‘এত কম!’
চার
সারাদিন লোকটার আর কোনো সাড়াশব্দ পায়নি সুস্নাত৷ বিকেলের পর থেকেই বৃষ্টি নেমেছিল৷ সুস্নাত খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল৷ বেশ রাতে ঘুম ভাঙল তার৷ বাইরে থেকে ভেসে আসা শব্দ শুনে সে বুঝতে পারল বৃষ্টি আরও বেড়েছে৷ বাতাসও বইছে৷ তার আঘাতে জানলার কাচের শার্সি কাঁপছে৷ শব্দ হচ্ছে৷ বিছানায় শুয়ে-শুয়ে বাইরে বৃষ্টির শব্দ শুনতে লাগল সুস্নাত৷ হঠাৎ প্লাইউডের দেওয়ালে মৃদু টোকা দেওয়ার শব্দের সঙ্গে সেই কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আপনি জেগে আছেন?’
সুস্নাত সঙ্গে-সঙ্গে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আমি জেগে আছি৷’
‘দয়া করে একবার বাইরে আসবেন৷’
সুস্নাত উঠে বসে বলল, ‘হ্যাঁ, আসছি৷’
লোকটা বলল, ‘আমার আর-একটা অনুরোধ আছে৷ দয়া করে আপনার ব্যাগের অচেনা লোকটার ফোটোটা সঙ্গে আনবেন৷ তার কারণটা বাইরে এলে বুঝতে পারবেন৷
সুস্নাত এবার বেশ অবাক হল লোকটার কথা শুনে৷ ও ছবির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?
সুস্নাত জবাব দিল, ‘ঠিক আছে, নিচ্ছি৷’ মিনিটখানেকের মধ্যেই ছবিটা নিয়ে করিডরে বেরিয়ে এল সুস্নাত৷ অন্ধকার বারান্দা৷ বাইরে অঝোরে বৃষ্টি, তার সঙ্গে দমকা হাওয়া৷ শুধু বাইরের রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের একটা আলো বারান্দার কোণে এসে পড়েছে৷ হলদেটে, বর্ষণসিক্ত, ম্যাটম্যাটে আলো৷ সুস্নাত দেখতে পেল সেই কোণে, কয়েক-হাত দূরে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক৷ তার মুখ দেখা যাচ্ছে না৷ তার পরনে মাথা ঢাকা টুপি, লম্বা ঝুলের বর্ষাতি৷ সুস্নাতর উপস্থিতি বুঝতে পেরে একইভাবে দাঁড়িয়ে লোকটা বলল, ‘আপনাকে ডাকলাম বলে আপনি রাগ করবেন না৷ যাওয়ার আগে কিছু কথা বলতে চাই আপনাকে৷’
‘না, রাগ করব কেন? বলুন, কী কথা?’
লোকটা বলল, ‘আপনার অ্যাক্সিডেন্টটা কীভাবে হয়েছিল, তা আমি জানি৷ সেদিন ঝড়-জলের রাতে রাস্তায় হঠাৎই আপনি আপনার গাড়ির সামনে এক ভয়ঙ্কর মুখ দেখতে পেয়েছিলেন৷ তা-ই দেখে আতঙ্কে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা মারেন…’ এ পর্যন্ত শুনেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল সুস্নাত৷
বিস্মিত সুস্নাত বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই৷ বীভৎস সেই মুখ! ও মুখ কোনো মানুষের হতে পারে না! কিন্তু ব্যাপারটা আপনি জানলেন কীভাবে?’
মুহূর্তখানেকের নিস্তব্ধতা৷ লোকটা এরপর সুস্নাতর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বর্ষাতির টুপিটা খুলে ফেলল৷ বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পড়েছে লোকটা মুখে৷ সুস্নাত দেখতে পেল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেদিনের রাস্তায় দেখা বীভৎস সেই মূর্তি! লোকটার মুখমণ্ডলে কোনো নাক নেই! ঠোঁটহীন মুখের বাইরে এসেছে দাঁতের পাটি৷ পলকহীন চোখ, সারা মুখে ছড়িয়ে আছে অজস্র কাটাকুটির দাগ৷ এরকম মুখ কোনো মানুষের হতে পারে না! আর-একটু হলেই সুস্নাত জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, দেওয়াল ধরে কোনোমতে সে সামলে নিল নিজেকে৷ তার অবস্থা দেখে লোকটা করুণস্বরে বলে উঠল, ‘দোহাই আপনার, আপনি ভয় পাবেন না৷ বিশ্বাস করুন, আমিও মানুষ৷ এ সবই সার্জারির চিহ্ন৷ যে ভগবানের হাত আপনার মুখ ফিরিয়েছে এ সবই তার হাতের দাগ৷ সেই একই হাত!’
সুস্নাত এবার একটু ধাতস্থ হয়ে কাঁপা-কাঁপা স্বরে বলল, ‘তার মানে?’
লোকটা পলকহীন চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ডাক্তার হাজরা প্লাস্টিক সার্জারির অনেক জটিল পরীক্ষা করেন আমার এই মুখ নিয়ে৷ আপনার মতো অনেকের মুখ ফিরিয়ে দিতে আমার এ মুখ কাজে লাগে তাঁর৷ আমি গরিব মানুষ, পরিবার-ছেলেপুলে আছে৷ এর বিনিময়ে যে পয়সা পাই তাতে সংসার চলে৷ এবার যেমন পেলাম হাজার পনেরো৷ মাসছয়েক সংসার চলে যাবে৷ তারপর আবার…’ এরপর একটু থেমে লোকটা বলল, ‘ছবিটা আমাকে দিন৷ ওটা আমারই ছবি ছিল৷ সেদিন রাস্তায় ওই জায়গায় পড়ে গিয়েছিল৷ লোকেরা আপনার ছবি ভেবে ব্যাগে পুরে দিয়েছে৷ জানেন, আপনারা তো আয়নাতে মুখ দ্যাখেন৷ আর আমি দেখি ওই ছবিটা৷ ওটাই আমার আয়না৷’
নির্বাক সুস্নাত ছবিটা এগিয়ে দিল তার হাতে৷ ছবিটার উপর পরম মমতায় হাত বোলাতে-বোলাতে লোকটা বলে যেতে লাগল, ‘আমার খুব কষ্ট জানেন, নিজের সন্তানরা পর্যন্ত তাকাতে পারে না মুখের দিকে৷ দিনের আলোতে বাইরে বেরলে লোকে ঢিল ছোঁড়ে৷ তাই রাত ছাড়া বাইরে বেরতে পারি না৷ কেউ-কেউ বলে আমি নাকি মানুষ নই, পিশাচ! কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমিও মানুষ, মানুষ..’ লোকটার কথাগুলো আর্তনাদের মতো ঘুরপাক খেতে লাগল বাতাসে৷ নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তারপর লোকটা বলল, ‘‘আমার জন্যই আপনার অ্যাক্সিডেন্টটা হল৷ পারলে এই হতভাগ্য লোকটাকে ক্ষমা করবেন৷ যাওয়ার আগে আপনাকে ‘অ্যালোগ্রাফট’ কথা অর্থটা বলে যাই৷ যখন একজন মানুষের দেহ থেকে কিছু নিয়ে সম্পর্কহীন ভিন্ন কোনো মানুষের দেহে তা বসানো হয়, তখন তাকে বলে ‘অ্যালোগ্রাফট’৷ তবে ডাক্তারবাবু একটা অসাধ্য সাধন করলেন৷ সত্যিই ওঁর হাত ‘ভগবানের হাত’!’’ একটা দুর্বোধ্য হাসি ফুটে উঠল লোকটার মুখে৷ আর কথা না বাড়িয়ে সুস্নাতকে নমস্কার করে পাশ কাটিয়ে এগোল লোকটা৷ ঠিক সেই সময় বাইরে প্রচণ্ড বিদ্যুৎ চমকে মুহূর্তের জন্য আলোকিত হয়ে উঠল বারান্দা৷ সেই আলোয় সুস্নাত স্পষ্ট দেখতে পেল, লোকটার ডান কানের জায়গাটা পাতলা একটা স্টিকিং প্লাস্টার দিয়ে ঢাকা! অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ছাটে ভিজতে লাগল সুস্নাত৷ ভেজা বাতাসে তখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই হাহাকার, ‘বিশ্বাস করুন, আমিও মানুষ, মানুষ…’