ব্লু ফ্লাওয়ার ৪ – ৬০

৬০

গোপন বাড়িতে আতরের চিকিৎসা চলছে। কানে ব্যান্ডেজ পরিয়ে দিয়েছে। চোখের ডাক্তার এসেছেন। অদ্ভুতভাবে আতর এখন কান্নাকাটি করছে না। চুপ করে আছে।

তারেক আতরের কাছে গিয়ে বলল, “সুমাইমাকে তুইই রুকসার নাম দিয়ে শুভর কাছে পাঠিয়েছিলি?”

আতর বোবা চোখে তারেকের দিকে তাকাল। তারেক বললেন, “তুই কিন্তু জানিস না তোর কী হাল করতে পারি। যেটা করেছি, সেটা ডেমো। একটা চোখ গেছে, এবার বাকিটাও বের করে নেওয়া হবে। বল বল।”

আশরফ বললেন, “আমি বলছি। আতর বলুক ভুল বলছি নাকি। শুভর উপরে ওদের অনেক দিনের নজর ছিল। ওরা কোনভাবে জেনে গেছিল শুভ কী কাজ করে। ওদের উপর নির্দেশ এল শুভর সঙ্গে রুকসারের আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য। ওরা জানত একটা সময়ে শুভর রুকসারকে দরকার পড়তে পারে। তাই তো?”

আতর এবার কাঁদতে কাঁদতে বলল, “রুকসার আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ওর কাজ ছিল শুভকে মিসলিড করা। ও রফিকসাবকে মেরে দিয়ে পালিয়ে গেছিল। ওকে পাওয়া না গেলে বিলাল আর ইউসুফ আমাকেই মেরে দিত।”

তারেক ভীষণ রেগে গেলেন, “পাওয়া যাওয়ার পর এই হাল করলি তোরা?”

আতর বলল, “আমি করি নি স্যার। আমার কাজ ছিল ওকে খুঁজে নিয়ে আসা। ওরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কী করল, আমরা কী করে জানব?”

তারেক বললেন, “ওর নাম সুমাইমা?”

আতর বলল, “আমাদের তাই বলেছিল।”

তারেক বললেন, “ও কেন তোদের কাছে এসেছিল?”

আতর বলল, “অনেক টাকা পাওয়া যায় স্যার। ওরা খুব গরীব।”

তারেক বললেন, “তারপর তোরা ট্রেনিং দিয়ে পাঠিয়ে দিলি। শয়তানের বাচ্চা যত। তোকে বাঁচিয়ে রাখছি ভেবে নিজের উপর ঘেন্না হচ্ছে আমার।”

আশরফ তারেককে বললেন, “পাশের ঘরে চল।”

তারেক বেরোলেন। মাথুরকে ডেকে নেওয়া হল।

আশরফ বললেন, “সুমাইমাকে ওরা ট্রেইন করে পাঠিয়েছিল শুভর কাছে। সুমাইমা শেষ মুহূর্তে রফিককে মেরে দেয়। কেন মারবে? ওর তো আলাদা কোন অর্গানাইজেশন ছিল না। থাকলে পালিয়ে যাবার পর আবার আতরের পাল্লায় পড়ত না।”

তারেক বললেন, “রফিককেই শুধু মারে নি। তবসসুমকেও মেরেছে। খুনের ধরণ দেখে বোঝা যায়, রাগের মাথায় মেরে চলে গেছিল। আমাদের ওর জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”

আশরফ বললেন, “বাংলাদেশে আই এস আইয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ লিংক ম্যান আতর। ওকে কি আমরা ফেলে যাবো?”

তারেক বললেন, “তুষার স্যারের সঙ্গে কথা বল। কারগোতে তুলে নিয়ে চল। ওর আরো প্রপার ইন্টারোগেশন বাকি আছে। মে বি তুষার স্যারের সামনে বসলে আরো অনেক কিছু বলবে।”

আশরফ তুষারকে ফোন করলেন। তুষার ফোন ধরে বললেন, “বল।”

আশরফ বললেন, “স্যার, এই আতরকে নিয়ে যেতে পারলে ভাল হয়। আমার মনে হয়, ও অনেক কিছু জানে। দিল্লিতে না নিয়ে গেলে হবে না।”

তুষার বললেন, “তুমি জানো তোমাদের ওখানে থাকার জন্য আমাকে কত জায়গায় ফোন করে করে রীতিমত ভিক্ষা করতে হচ্ছে? দিল্লি একবারেই পছন্দ করছে না ব্যাপারটা। তোমাদের জন্য ঢাকার সঙ্গে আরও কত কত ব্যাপারে সমঝোতা করতে হবে তোমাদের কোন আইডিয়া আছে?”

আশরফ বললেন, “স্যার, আমার মনে হয় আতরকে দিল্লিতে প্রয়োজন পড়বে।”

তুষার বললেন, “ঠিক আছে। আমি দেখছি কী করা যায়।”

আশরফ বললেন, “স্যার, রুকসারের জ্ঞান ফেরে নি। আমরা ওকে কোন ইন্টারোগেশন করব না? ওকে পাঠিয়েছিল আই এস আই, শুভকে ডবল ক্রস করতে। উল্টে ও রফিককে খুন করে দিল।”

তুষার বললেন, “কী খবর ওর?”

আশরফ বললেন, “ডাক্তাররা বলছেন আটচল্লিশ ঘণ্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না। ওরা ওর সঙ্গে পশুর মত বিহেভ করেছে।”

তুষার বললেন, “পশুর মত কথাটা বোল না। পশুরা মানুষদের থেকে অনেক ভদ্রসভ্য। ওই দুজন আই এস আই এজেন্টের খোঁজ পেলে?”

আশরফ বললেন, “ছবি পেয়েছি। ওরা খোঁজ করছে। পেলে জানাবে।”

তুষার বললেন, “হোপফুলি পাবো। পুরো কনফিডেন্ট হতে পারছি না ও দেশটা ইন্ডিয়া নয় বলে। আমি কথা বলছি ঢাকার সঙ্গে। রুকসারের সঙ্গে ওরা দুজন যা করেছে, অন্তত তার জন্য ওদের কোর্ট মার্শাল হওয়া উচিত।”

আশরফ বলল, “রুকসারের জ্ঞান ফিরুক। কথা বলে যদি কিছু জানা যায়, আপাতত সে আশাতেই থাকি।”

তুষার বললেন, “আই নিড দোজ বাস্টার্ডস আশরফ। যেখানেই থাকুক, খুঁজে বের কর। ওদের যদি কোন মিশন থাকে, তার ব্লু প্রিন্ট এদের কাছেই থাকবে।”

আশরফ থমকে গিয়ে বললেন, “ঠিক স্যার।”

৬১

ইসলামাবাদ।

সন্ধ্যা সাতটা।

সেক্টর ওয়ানের সেন্ট্রাল পার্কের বেঞ্চে বসে সায়ক মৌলানার ছেড়ে যাওয়া বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, “রজ্জাকের পদোন্নতি হয়েছে তাহলে। ক্যুরিয়র বয় থেকে সরাসরি মৌলানার ভদ্র সভ্য নকল ছেলে। মৌলানার নাম হয়েছে আসগর আলম। বাপের চিকিৎসা করার জন্য ছেলে তাকে ওমান নিয়ে যাচ্ছে। এবার কথা হল মৌলানা ওমানে কেন গেল?”

বীরেন বাড়িটা দেখছিল। বিকেল থেকে প্রায় দু ঘণ্টা পার্কেই বসে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে সায়ক। এই বাড়িটাতেই তাহলে তাদের দেশের অন্যতম মোস্ট ওয়ান্টেড লোকটা লুকিয়ে ছিল? আর পাঁচটা বাড়ির মতই একটা বাড়ি। সেক্টর ওয়ানে সব বাড়িই এক রকমের। ইসলামাবাদের অন্যতম পশ এলাকা। ধূসর রঙের দেড়তলা বাড়ি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। শহরটাকে সুদৃশ্য করে সাজিয়ে রাখেছে পাকিস্তান সরকার। সায়ক বলল, “সম্ভবত বাড়িতে কেউ নেই। আমাদের একটা চান্স নিতে হবে বীরেন”

বীরেন বলল, “বাড়িটায় ঢুকব?”

সায়ক বলল, “হ্যাঁ। রাস্তার ক্যামেরাটা অন্য দিকে আছে। বাড়িটাকে ওরা র‍্যাডারে রাখতে চায় না বলে রিস্ক নেয় নি। আমাদের এই সুযোগটাই নিতে হবে। বাদাম খাবে?”

বীরেন বলল, “না না।”

সায়ক বলল, “চল।”

দুজনে পার্ক থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করল। বাড়িটার সামনে এসে সায়ক কলিং বেল বাজাল। বীরেন বলল, “ফাঁকা আছে না?”

সায়ক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তাদের দুজনকে অবাক করে বাড়ির দরজা খুলে গেল। এক মধ্যবয়স্ক লোক দরজা খুলে বলল, “বলুন।”

সায়ক বলল, “ইসমাইল সাহেবের বাড়ি এটাই?”

লোকটা বলল, “হ্যাঁ। বলুন।”

সায়ক বলল, “আমি ওর সঙ্গে একটা ব্যাপারে কথা বলতে চাইছিলাম।”

লোকটা বলল, “ভিতরে আসুন।”

লোকটা দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। সায়ক হঠাৎ বীরেনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আরে খান সাব, আপনার

ফোনটা তো অটোতে রেখে এসেছেন?”

বীরেন অবাক হয়ে সায়কের দিকে তাকাল।

সায়ক বলল, “চলুন চলুন। দেখে আসি।”

বীরেন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। সায়ক তাকে একপ্রকার ঠেলে বের করে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করে বলল, “চল। পা চালাও।”

বীরেন পিছনের দিকে তাকাল। দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। সে বলল, “আপনি ইসমাইল না কী নাম বললেন, তাকে চেনেন?”

সায়ক বলল, “না। হাঁটতে থাকো।”

বীরেন আরেকবার পিছনে তাকাল। একজন লম্বা মত লোক বাড়িটা থেকে বেরোল। সে বলল, “একজন বেরিয়েছে বাড়িটা থেকে।”

সায়ক বলল, “শিট। বাসে উঠে পড়।”

বাস স্ট্যান্ডে একটা ভিড় বাস এসে দাঁড়িয়েছে। দুজনে বাসে উঠে যথাসম্ভব বাসের ভেতরের দিকে গিয়ে দাঁড়াল। সায়ক জানলা দিয়ে ঝুঁকে দেখল।

না কেউ আসছে না। বাস চলা শুরু করতে সে শ্বাস ছাড়ল।

বাসটা পরের স্টপেজে দাঁড়ালে দুজন নামল। সায়ক বলল, “অনেক দিন পর এরকম একটা মিসফায়ার করলাম। বাড়িটায় লোক ছিল। অদ্ভুতভাবে ছিল। অতক্ষণ ধরে লক্ষ্য করলাম, তবু কাউকে দেখতে পেলাম না তখন?”

বীরেন বলল, “ইসমাইলটা কে?”

সায়ক বলল, “কেউ না। দরজা খুলে দেওয়ায় হতভম্ব হয়ে নামটা বললাম। যখন ও বলল ভেতরে যেতে, তখন বুঝলাম ইসমাইল বড় কথা না। ওর কোন সন্দেহ হয়েছে। ভেতরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করত। ভুল হয়ে গেল হে বীরেন, এ বাড়িটায় এখন ঢোকা যাবে না। ওরা সতর্ক হয়ে গেল।”

অটোয় উঠে সায়ক বলল সিটি বাস স্ট্যান্ডে যাবে। বীরেন বাইরের দিকে তাকাল। অত্যাধুনিক একটা শহর ইসলামাবাদ। সায়কের কাছ থেকে শুনেছে বিদেশী প্ল্যানার আনিয়ে অনেক খরচা করে এই শহরটা বানিয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু তাতে কী লাভ হল? সেই তো মৌলানার মত নরপিশাচদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল শেষ মেশ।

সিটি বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে রাওয়ালপিণ্ডির বাসে উঠল তারা। একদিন পেরোতেই দেশ নিয়াজির হত্যাকাণ্ড ভুলে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এখানেও অস্বাভাবিক কিছু নেই।

সায়ক চিন্তিত মুখে বসে রইল। এত বড় ভুল হয়ে গেল তার? বাড়িটায় লোক ছিল, সে কিছুতেই বুঝতে পারল না?

৬২

প্রেসিডেন্ট হাউজে জেনারেল সিদ্দিকি পরিবার নিয়ে প্রবেশ করেছেন। নিয়াজির খাস খানসামা জাকিরকে কাজে বহাল রাখা হয়েছে।

রিডিং রুমে সিদ্দিকি বসে স্কচ খাচ্ছিলেন। জাকিরকে দেখে বললেন, “তোমার মন খারাপ জাকির?”

জাকির বলল, “এভাবে গুলি চলবে এ হাউজে, ভাবতে পারি নি জনাব।”

সিদ্দিকি বললেন, “রাইট। তোমার কী মনে হয়? কারা এই কাজ করতে পারে?”

জাকির সতর্ক হল। বহুবার এমন হয়েছে, পূর্বসূরীকে খুন করেই উত্তরসুরি তার পদে আসীন হয়েছেন। সে বলল, “আমি হাউজের কাজ দেখি জনাব। আমি তো কাউকে চিনি না।”

সিদ্দিকি বললেন, “তা ঠিক। এটা তুমি ঠিক বলেছো। তা নিয়াজি সাহেব কি তোমার সঙ্গে রাজনীতির আলোচনা করতেন?”

জাকির মাথা নাড়ল, “না জনাব। সেরকম কিছু কোনদিন করেন নী।”

সিদ্দিকি বললেন, “তাহলে? কী আলোচনা করতেন?”

জাকির বললেন, “খাস কিছুই না। স্বাভাবিক কথাবার্তা হত।”

ফোন বাজল। জাকির ফোন ধরে কথা বলে বলল, “সামশের আলি সাহেব এসেছেন। উনি বললেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল।”

সিদ্দিকি বললেন, “হ্যাঁ। ওকে নিয়ে এসো।”

জাকির বেরিয়ে গেল। সামশের ঘরে ঢুকলে দরজা বন্ধ করে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল।

সামশের বলল, “আপনি ডাকার সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছি জনাব।”

সিদ্দিকি বললেন, “জেনারেল নিয়াজি অ্যাসাসিনেশনের তদন্তের দিকে গোটা দুনিয়া তাকিয়ে আছে সামশের। কী বলব তাদের?”

সামশের সিদ্দিকির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, “আপনি যেমন বলবেন, তেমন রিপোর্ট দেব জনাব।”

সিদ্দিকি গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, “এই সময়টা আমার এই পোস্টে হানিমুন পিরিয়ড হতে চলেছে। আমাকে কেউ কিছু বলবে না, সবাই শুধু দেখবে আমি কী করি। আপনিই বলুন, আমরা আর আমি কী বলতে পারি?”

সামশের বলল, “সেটাও আপনিই জানেন জনাব।”

সিদ্দিকি বললেন, “আপনার উপর জাসুসি করার জন্য নিয়াজি আপনার অফিসে দুজন লোক পাঠানোর তোরজোড় করছিলেন, এটা আপনি জানেন?”

সামশের বললেন, “জি না জনাব।”

সিদ্দিকি বললেন, “তাহলে আমি আপনার উপর কীভাবে ভরসা করব সামশের? আপনার উপর জাসুসির খবরই আপনি জানেন না, তাহলে আমি কী করে আপনাকে ভরসা করব?”

সামশের বলল, “এই মুহূর্তে আমার অফিসে কোন লোকই ঢুকতে পারে নি আমার উপর নজরদারী করার জন্য, এই ব্যাপারটাই আপনাকে আমার উপর ভরসা দেবে জনাব।”

সিদ্দিকি হাসলেন। বললেন, “আমি জানার আগে ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া মৌলানার ব্যাপারে জেনে গেল, এই ব্যাপারটাকে আপনি কী করে ব্যাখ্যা দেবেন?”

সামশের বলল, “মোবাইল ফোনের যুগ জনাব। আলোর থেকেও দ্রুতবেগে খবর পৌঁছে যায়।”

সিদ্দিকি বললেন, “গুড। আপনি প্রস্তুত হয়েই এখানে এসেছেন তাহলে। ঠিক আছে। আপনি আপনার আপডেট দিন। এমন কিছু আপডেট দিন, যেটা আমি শুনতে চাইবো।”

সামশের বলল, “মৌলানা সহি সলামাত ওমানে পৌঁছে গেছেন জনাব।”

সিদ্দিকি বললেন, “ব্যাস? আর কিছু না?”

সামশের বলল, “উনি আমাদের উপর শুধু ওকে পৌঁছনোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এর পর আমাদের সঙ্গে ওর প্রয়োজনমত যোগাযোগ করে নেবেন বলেছেন।”

সিদ্দিকি বললেন, “বাহ। আর আপনি সেটা মেনে নিলেন? আপনার নাম খারাপ করে লোকটা চলে গেল, আর আপনি জানেন না লোকটার প্ল্যান কী, কী করতে চায়?”

সামশের মাথা নিচু করল।

সিদ্দিকি বললেন, “দিস ইজ আটার ফেইলিউর, ইউ নো। এভাবে কাজ করলে আপনার থাকা আর না থাকার মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না।”

সামশের অস্থির হয়ে উঠল, “জনাব, অপারেশন ব্লু ফ্লাওয়ার অ্যাক্টিভেট করেছেন মৌলানা।”

সিদ্দিকি এবার খুশি হলেন, “এই তো। দেখেছেন, ঠিক ঠাক চাপ না দিলে কোন কথা বেরোয় না?”

সামশের বলল, “মুম্বইয়ের স্লিপার সেল অ্যাক্টিভেট করা হয়েছে।”

সিদ্দিকি বললেন, “গুড। এন্ড?”

সামশের বলল, “সুখবর যে কোন দিন আসতে পারে।”

সিদ্দিকি বললেন, “আপনি জানেন না কোন দিন আসবে?”

সামশের বলল, “না জনাব।”

সিদ্দিকি বললেন, “ঠিক আছে। ইউ মে গো নাও।”

সামশের উঠে দাঁড়ালেন।

৬৩

বিকেল পাঁচটা।

সুনয়নার পিছু নিয়েছেন শ্রীবাস্তব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুনয়না প্রথমে লোকাল ট্রেনে উঠে দাদর স্টেশনে নামলেন। সুনয়নার পরনে শাড়ি। সঙ্গে একটা মাঝারি সাইজের লেডিস ব্যাগ।

দাদর স্টেশনের বাইরে থেকে বাস ধরলেন তিনি। বাসে একটা স্টপ যাওয়ার পরেই বাস থেকে নেমে গিয়ে গ্রেট ফুড শপ নামের একটা ছোট রেস্তোরায় প্রবেশ করলেন।

রবিবার বলে রেস্তোরাঁয় লোক কম। শ্রীবাস্তব দূরত্ব রেখে বসলেন। ওয়েটার মেনু কার্ড দিল। শ্রীবাস্তব ধোসা নিলেন। দেখলেন সুনয়না পাওভাজি নিয়েছেন। শ্রীবাস্তব তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলেন। সুনয়না খেয়ে নিয়ে হাত ধুতে গেলেন। হাত ধুয়ে তার ব্যাগটা টেবিলে রেখে বেরিয়ে যেতেই একজন ওয়েটার এসে ব্যাগটা রেস্তোরাঁর কিচেনের ভেতরে নিয়ে গেল।

শ্রীবাস্তব দেরী করলেন না। তিনি রেস্তোরাঁর কিচেনের ভিতর প্রবেশ করলেন। দেখলেন, যে ওয়েটার ব্যাগটা নিয়ে যাচ্ছিল, সে অন্য দরজা দিয়ে বেরোতে যাচ্ছে। শ্রীবাস্তব চিৎকার করলেন, “সবাই যেখানে আছেন, দাঁড়ান। ক্রাইম ব্রাঞ্চ। স্ট্যান্ড বাই প্লিজ।”

ওয়েটারটা দাঁড়াল না। ব্যাগ নিয়ে দৌড়তে শুরু করল। শ্রীবাস্তব ছেলেটাকে ধাওয়া করলেন। ছেলেটা গলিতে ঢুকে যেন মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে গেল।

শ্রীবাস্তব চারদিকে তাকালেন, কোথাও নেই। যেন কর্পূরের মত উবে গেল ছেলেটা।

শ্রীবাস্তব দেরী না করে সঙ্গে সঙ্গে তুষারকে ফোন করলেন। তুষার ধরলেন, “বল।”

শ্রীবাস্তব সবটা বললেন। তুষার বললেন, “একা গেছিলে?”

শ্রীবাস্তব বললেন, “হ্যাঁ স্যার।”

তুষার বললেন, “এটাই ভুল হয়েছে। আমি সুনয়না দাভেকে অ্যারেস্ট করার কথা মুম্বই পুলিশকে বলে দিচ্ছি। ওকে আটক করুক।”

শ্রীবাস্তব বললেন, “আর ওই ব্যাগে কী থাকতে পারে?”

তুষার বললেন, “সুনয়না দাভেকে তোমাদের অফিসে নিয়ে বসাও। দেখো কিছু বলে কি না।”

শ্রীবাস্তব ফোন রাখলেন। রেস্তোরাঁয় ফিরে গিয়ে বললেন, “মালিক কে? এই রেস্তোরাঁর মালিক কে?”

ওয়েটাররা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলল, “মালিক নেই স্যার। উনি দেশের বাড়ি গেছেন।”

শ্রীবাস্তব বললেন, “যে ছেলেটা পালালো, ও কবে থেকে কাজ করছে এখানে?”

“তিন দিন স্যার। সবে জয়েন করেছে।”

শ্রীবাস্তব চেয়ারে বসলেন। মাথা কাজ করছে না। ছেলেটা যেন জানত তিনি তাকে ধরবেন। কেমন চোখের নিমেষে হারিয়ে গেল। ছেলেটা এই তিন দিনেই এই অঞ্চলটা রপ্ত করে নিয়েছে? নাকি আরো আগে থেকেই আসা যাওয়া করেছে?

সিগারেট ধরালেন শ্রীবস্তব। বললেন, “রেস্তোরাঁর শাটার বন্ধ কর। সবাই এখানে এসে দাঁড়াও।”

ছেলেগুলো তার কথা শুনল।

শ্রীবাস্তব বললেন, “দেখো, ন্যাশনাল সিকিউরিটির ব্যাপার। তোমাদের আজীবন জেল হতে পারে। যা প্ৰশ্ন করব, ঠিক ঠাক উত্তর দেবে। ঠিক আছে?”

একজন মাঝ বয়স্ক লোক বলল, “স্যার, এরা কী করবে? কিচ্ছু জানে না এরা। আমায় বলুন।”

শ্রীবাস্তব ভ্রূ কুঁচকালেন, “সামনে এসো।”

লোকটা সামনে এল। শ্রীবাস্তব বললেন, “বল।”

লোকটা বলল, “স্যার, সাতদিন হল আমাদের মালিক আসছে না। ফোনেও পাচ্ছি না। তিন দিন আগে এই ছেলেটা আমাদের মালিকের একটা চিঠি নিয়ে আমার কাছে এসে বলল মালিক পাঠিয়েছে। আমি দোকানের হিসেব দেখি স্যার। মালিকের হাতের লেখা খুব ভাল করে চিনি। আমি দেখলাম উনি লিখেছেন জরুরি কাজে দেশের বাড়ি যাচ্ছি। এই ছেলেটাকে কাজে লাগাতে হবে। আমি তারপরেও মালিকের ফোন ট্রাই করেছি। পাই নি। কিন্তু উনি যেহেতু ছেলেটাকে কাজে লাগাতে বলেছিলেন, আমি ওকে কাজ দিয়েছিলাম।”

শ্রীবাস্তব বললেন, “চিঠিটা আছে?”

লোকটা একটা চিঠি এগিয়ে দিল। শ্রীবাস্তব বললেন, “ছেলেটার আই কার্ড জমা নিয়েছিলে?”

লোকটা বলল, “না স্যার। আমি ভেবেছিলাম এখন কাজে লেগে যাক, পরে মালিক এলে উনিই সব নিয়ে নেবেন।”

শ্রীবাস্তব বললেন, “এখানে এখন যারা আছে, তারা তাদের আই কার্ডের ফটো আমাকে হোয়াটস অ্যাপ… না। হোয়াটস অ্যাপে না, আই কার্ড গুলো নিয়ে আমাকে দাও। আমি ছবি তুলে নিচ্ছি। এই তিন দিনে ওই ছেলেটার সঙ্গে কারো কথা হয়েছে? কোথায় থাকে কিছু বলেছে?”

লোকটা বলল, “ছেলেটা কারো সঙ্গেই কথা বলত না স্যার। যা কাজ বলতাম, সব করত। কিন্তু কাজের বাইরে একটা বাড়তি কথা বলত না।”

শ্রীবাস্তব চিন্তিত হলেন। এ লক্ষণ একবারেই সুবিধার নয়!

রেস্তোরাঁ থেকে বেরোতেই তার ফোন বেজে উঠল। সুনয়না দাভে আটক হয়েছেন। তাকে তাদের স্পেশাল ব্রাঞ্চে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

৬৪

আগের বদ্ধ ঘরটাতে ঢুকে বীরেনের এবারে আর অতো কষ্ট হল না। বরং মনে হল এটা চেনা জায়গা। সায়ককে সে কথা বলতে সায়ক হাসল, “এটাই হয়। আমারও একই জিনিস হত। সবটাই তো অভ্যাস, তাই না? মায়ের পেটের মত অপরিসর জায়গাতে সন্তান বড় হয়। অথচ তার সব থেকে বেশি নিশ্চিন্ত এবং নিরাপদ স্থান ওটাই। মৌলানাদের মত কীটেদের যেমন নিরাপদ স্থান জঙ্গীঘাঁটিগুলো। আমার তো ইচ্ছে করছে, ওই বাড়িটায় কয়েকটা গ্রেনেড ফেলে দিয়ে আসি। ইমান সেখ খুন হবার পর ইসলামাবাদের সব কমফোর্ট জোন পাল্টাতে হয়েছে আমায়। অদ্ভুত ধরণের হাত পা বাঁধা অবস্থায় থাকতে হয় আমাদের। কিছু করতে হবে না, শুধু যেন কোনভাবে ধরা পড় না।”

বীরেন বলল, “আমরা দুজন রাতের দিকে ওই বাড়িটায় আরেকবার যেতে পারি?”

সায়ক মাথা নাড়ল, “একবারে না। আমরা কিছু করতে পারি না। একটা কাজ ছাড়া। আগেও করেছি।”

বীরেন বলল, “কী কাজ?”

সায়ক চিন্তিত মুখে বলল, “সি আই একে জানানো যেতে পারে। মৌলানার ক্ষেত্রে ওরা কতটা অ্যাক্টিভ হবে, বুঝতে পারছি না। মৌলানা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বিরাট থ্রেট। আমেরিকার ক্ষেত্রে অতোটা না। আর যতক্ষণ না ওদের কোন ক্ষতি হচ্ছে, ওরা কিচ্ছু করে না।”

বীরেন বলল, “মৌলানা কিছুই করে নি আমেরিকার?”

সায়ক বলল, “টু বি স্পেসিফিক, আফগানিস্তানে গোলমাল তৈরির সময় এসব মৌলানাকে আমেরিকাই তৈরি করেছিল। তুমি সি আই একে ধোঁয়া তুলসীপাতা ভেবো না। আফগানিস্তানে একটা সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সরাসরি মদত ছিল। সেখানে ঝামেলা তৈরি করতে আমেরিকা এদের মত অসংখ্য সন্ত্রাসবাদীদের ডিরেক্ট ফান্ডিং করতো। নাইন ইলেভেনের পর এরা বুঝতে পারে দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পোষার ফলাফল কী হতে পারে। আমেরিকা কেন, অনেকেই এসব কাল সাপ পুষে চলেছে। কখন যে এরা আদর করে ছোবল মেরে দিয়ে যাবে, সেটা যারা সাপগুলো পুষছে, তারা বুঝতে পারে না। পাকিস্তান যেমন। দিব্যি একটা দেশ ছিল। কাশ্মীরকে বড় করে দেখাতে গিয়ে এদের আর্থিক স্থিতিশীলতাই বিগড়ে গেছে। কতবার লোডশেডিং হয় দেখেছো? কিসসু নেই দেশটার। অথচ এদের একটাই কাজ। অন্ধভাবে ভারতের ক্ষতি করে যেতে হবে। আজব ব্যাপার।”

বাইরে থেকে একটা হই হই শব্দ ভেসে এল। সায়ক বলল, “ঘরে থাকো। আমি দেখে আসছি।”

বীরেন বলল, “ভয়ের কিছু আছে?”

সায়ক বলল, “জানি না। দেখছি।”

সায়ক দরজা খুলে বেরোল। মিনিট খানেকের মধ্যে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বলল, “বাজারে সেনা ঢুকেছে। তোলা তুলছে।”

বীরেন বলল, “সেনাই তো এখন রক্ষক। ওরা এসব করছে কেন?”

সায়ক বলল, “এখন মাৎস্যন্যায় চলবে এ দেশে। ভোট অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গেছে। যে যেভাবে পারবে তাণ্ডব চালাবে। তা বলে ওদের ইন্টেলিজেন্স একবারে এলোমেলো হয়ে যাবে না। আমি একটা দিনই চান্স নিয়েছি। আর রিস্ক নেওয়া যাবে না। তবে মৌলানা বড় খোঁচাচ্ছে হে বীরেন। ব্যাটা অকারণে দেশ ছাড়ে না। আর একটা ব্যাপার, রজ্জাক কি কিছু জানবে?”

বীরেন বলল, “রজ্জাক ফিরে এসেছে? ও তো মৌলানার সঙ্গে চলে গেলো?”

সায়ক বলল, “আমার যদি খুব একটা ভুল না হয়, তবে রজ্জাক এতক্ষণে ওর দোকানে ফিরেও এসেছে। রজ্জাক তো একটা মাধ্যম ছিল। রজ্জাককে আটকে রাখবে না। এতক্ষণে দোকানেও বসে গেছে”

সায়ক ফোন বের করে উসমানকে ফোন করল। উসমান ফোন ধরতে সায়ক বলল, “প্রোজেক্ট রিপোর্ট কি জমা পড়ে গেছে জনাব?”

উসমান বলল, “মেইল চেক করি নি। দেখে জানাবো।”

সায়ক বলল, “জলদি করলে ভাল হয় জনাব। আমার অনেকগুলো কাজ বাকি।”

উসমান বলল, “ফোনটা কিছুক্ষণ হোল্ড করুন জনাব।”

সায়ক বলল, “জি জনাব।”

মিনিট খানেক পরে উসমান বলল, “প্রোজেক্ট রিপোর্ট জমা পড়ে গেছে জনাব।”

সায়ক ফোন রেখে বীরেনকে বলল, “যা ভেবেছিলাম। রজ্জাক ফিরে এসেছে। এবার?”

বীরেন অবাক হয়ে সায়কের দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার কী?”

সায়ক বলল, “তৈরি হও। আজ রাতে অপারেশন রজ্জাক। কিছু করার নেই। এটুকু ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে।”

বীরেন বলল, “তুষার স্যারের পারমিশন?”

সায়ক বলল, “বললে দেবেন ভেবেছো? আমি একটু ভেবে নিই। ততক্ষণে তুমি চোখ বুজে নাও।”

বীরেন কিছুই না বুঝে মাথা নাড়ল, “আচ্ছা’।

৬৫

সুমাইমার জ্ঞান ফিরেছে। তারেককে নিয়ে আশরফ কেবিনে প্রবেশ করলেন। সুমাইমা আশরফকে দেখে হাসল। আশরফ অবাক হয়ে বললেন, “তুমি এখনও হাসছো?”

সুমাইমা বলল, “আপনাদের কেমন বোকা বানিয়েছিলাম, ভাবতেই হাসি পেয়ে গেলো।”

আশরফ বসলেন। বললেন, “আমাদের বোকা বানালে ঠিক আছে। আতরকেও বোকা বানালে কেন? আর রফিককে?”

সুমাইমার চোখ জ্বলে উঠল, “রফিক আমার টার্গেট ছিল স্যার। অন্যেরা কেন মারবে? রফিককে আমিই মারতাম। আমাকে মারতেই হত। আমার দিদা আর মাকে যার জন্য সারাজীবন নরক যন্ত্রণায় কাটাতে হল, আমার জীবনটাই যার জন্য শেষ হয়ে গেল, তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়? আপনিই বলুন।”

তারেক বললেন, “দিদা?”

সুমাইমা বলল, “পাকিস্তানী বাহিনী আমার দিদাকে তুলে নিয়ে গেছিল। দিদাকে ওরা মারে নি। আধমরা করে ফেলে রেখে গেছিল। কুমারী অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিল। বাচ্চা ফেলতে পারে নি। কোন মতে এক অনাথ আশ্রমে জায়গা পেয়েছিল। আমার মা আশ্রমেই বড় হয়ে ওঠে। মাকে বিয়ে করেন অনাথ আশ্রমের এক শিক্ষক। পরে যখন উনি জানতে পারেন আমার মা ধর্ষণের ফলে সৃষ্ট সন্তান, মাকে উনি ত্যাগ করলেন। আমার পাঁচ বছর বয়সে আমার মা পাগল হয়ে গেল।”

আশরফ তারেকের দিকে তাকালেন। তারেক বললেন, “অবাক হবার কিছু নেই খান। এ দেশের অলিতে গলিতে পাকিস্তানিদের এমন অত্যাচারের কাহিনি পাবে।”

আশরফ সুমাইমার দিকে তাকালেন, “তারপর তুমি আতরের গ্রুপের খোঁজ পেলে। রফিকের কাছে পৌঁছতে শুভকে ব্যবহার করলে। আনবিলিভেবল। দুটো ঘুঘু দেশের ইন্টেলিজেন্সকে তুমি একা বোকা বানিয়েছো রুকসার।”

সুমাইমা হাসতে হাসতে বলল, “আমিও আমার মায়ের মত এবার পাগল হয়ে যাবো স্যার। আমার কাজ তো হয়ে গেছে। যে জন্য আমি এই পৃথিবীতে এসেছিলাম, যার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি সেই রফিককে আমি নিজের হাতে মেরেছি। ওর আর্তনাদ শুনে পাশের ঘর থেকে তবসসুম ছুটে এসেছিল, আমি ওকেও ছাড়ি নি। ঠিক করি নি বলুন?”

সুমাইমা অদ্ভুত চোখে তাকাল।

আশরফ বললেন, “আর যে দুজন তোমাকে অত্যাচার করল, ওদের কোন ডিটেইল দিতে পারবে?”

সুমাইমা বলল, “দিতে পারি। একটা শর্তে।”

আশরফ বললেন, “কী শর্তে?”

সুমাইমা বলল, “আমি ওদের নিজের হাতে মারব।”

আশরফ বললেন, “তুমি জানো তুমি কী বলছো?”

সুমাইমা বলল, “জানি। আপনি আমায় কথা দিন স্যার।”

আশরফ বলল, “আমি কী করে এরকম কথা দেবো রুকসার? এটা ইন্ডিয়া না। এখানে আমি কেউ না।”

সুমাইমা বলল, “আতর কিন্তু একটা এজেন্ট শুধু। ও আরেকজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে। তার কথা শুনেই আতর সব কাজ করে।”

আশরফ বললেন, “কে সে? দেখেছো?”

সুমাইমা বলল, “না। দেখি নি। তবে ওর নাম সেভ করা আছে ‘বস’ বলে। বাংলায় কথা বলে।”

আশরফ তারেকের দিকে তাকালেন। তারেক মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আশরফ বললেন, “ওদের দুজনের ডিটেলস দাও সুমাইমা। আমি চেষ্টা করে দেখব তোমার দাবি মেটাবার।”

সুমাইমা হাসল, “চেষ্টা? ঠিক আছে। তাই করবেন না হয়। এ দেশের লোকজনের স্মৃতি বড় কম স্যার। ভীষণ কম। এদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ ভুলেই গেছে পাকিস্তান এদের সঙ্গে ঠিক কী কী করেছে। এরপরেও এরা এদের হয়ে কাজ করে। এই লজ্জা রাখবার জায়গা কোথায়? ওদের দুজনের নাম বিলাল আর ইউসুফ। ঢাকাতেই থাকবে। গাজীপুরে।”

আশরফ বললেন, “ঠিকানা বল।”

সুমাইমা ঠিকানা বলল।

আশরফ কেবিন থেকে বেরিয়ে তুষারকে ফোন করে সবটা বললেন। তুষার বললেন, “এখনও এই মেয়েটাকে বিশ্বাস করা যায় কি?”

আশরফ বললেন, “মিথ্যে বলবে না স্যার। অন্তত এই অবস্থায়। আমিন সাহেব…”

তুষার বললেন, “আমাকে অ্যাড্রেসটা পাঠাও। আমি দেখছি।”

তুষার ফোন কাটলেন। আশরফ তুষারকে ঠিকানা পাঠালেন। কিছুক্ষণ পর তুষার ফোন করলেন। আশরফ ধরলেন, “হ্যাঁ স্যার।”

তুষার বললেন, “এই ঠিকানাটা ঢাকার একজন প্রভাবশালী লোকের আশরফ। এক্স মিনিস্টার জাহির! কনফার্ম না হয়ে কিছু করা সম্ভব না। আমাদের এই অপারেশনে জড়িয়ে পড়াটাও সম্ভব না।”

আশরফ বললেন, “আমাদের এই রিস্কটা নিতেই হবে স্যার। এই দুজনকে দরকার। যে কোন মূল্যে। কিছুতেই ছাড়তে পারব না।”

তুষার চুপ করে গেলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “উপরমহলে জানাতে হবে। আমি দেখছি কী করা যায়।”

৬৬

বলরামকে রশিদদের ঘরে নিয়ে এসে একটা বল দেওয়া হয়েছে। এক গাদা চকলেট আর খেলনা দেওয়া হয়েছে। বলরাম ঘরের মধ্যে একা একা খেলছে।

বাশার বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে। অনেক চেষ্টা করেও বাশার স্বাভাবিক হতে পারছে না। রশিদ বলল, “সব ট্রেনিং ভুলে গেছিস তুই বাশার। কিচ্ছু মনে রাখিস নি। চাচাজান যদি জানে, তোর কপালে দুঃখ আছে।”

বাশার বলল, “ছেলেটাকে আমি নিয়ে এসেছিলাম। ওকে অন্য কাজে লাগানো যেতো।”

রশিদ বলল, “স্বয়ং উপরওয়ালার কাজ করছে। এর থেকে বড় কাজ আর কী হতে পারতো? আমরা কেন আছি? আমাদের কেন পাঠানো হয়েছে? তার জন্যই তো। আমরা বলরামের জন্য দুয়া করব। বিধর্মী হলেও ওকে জেনো জন্নতে পাঠানো হয়, তার জন্য উপরওয়ালার কাছে আর্জি জানাবো।”

বলরাম দৌড়তে দৌড়তে বাশারের কাছে এসে বলল, “কাল আমরা কোথায় ঘুরতে যাবো গুরুজী?”

রশিদ বলল, “অনেক জায়গায় যাবো বাচ্চা। আমরা কাল খুব ঘুরব, মজা করব। কাল দিওয়ালী হবে। আমরা বাজি ফাটাবো কাল।”

বলরাম আনন্দে লাফ ঝাঁপ দিতে লাগল। রশিদ বলল, “চকলেট খা ব্যাটা। এই শাহিদ, বলরামকে চকলেট খাওয়া।”

শাহিদ একটা চকলেটের মোড়ক খুলে বলরামের দিকে চকলেট বারটা এগিয়ে দিল। বলরাম মেঝেতে বসে পড়ে চকলেট খেতে লাগল। রশিদ বলল, “কাল আমরা চারজন বেরোব। আমি, রশিদ, বাশার আর বলরাম।”

বাশার চমকে উঠে বলল, “আমি কেন যাবো? আমাকে তো সবাই চিনে ফেলবে!”

রশিদ বলল, “তোকে কেউ চিনবে না। তোর সে ব্যবস্থা করেই তোকে নিয়ে যাবো। তুই না গেলে বলরামকে কে সামলাবে?”

বাশার বলল, “সেটা ওকে নেওয়ার সময় মনে রাখার দরকার ছিল।”

রশিদ বাশারের মাথায় আলতো চাপড় মেরে বলল, “তোকে এখানে কেন রাখা হয়েছে বাশার? আমাদের জন্য রাখা হয়েছে। আমাদের খিদমত খাটার জন্য রাখা হয়েছে। তুই এখানে থেকে আমরা যা যা বলব, তার প্রতিটা কথা শুনে চলবি। নইলে তোর কপালে অশেষ দুঃখ আছে।”

বাশার বলল, “তোমরা যেভাবে বলেছো, তার সব কথাই শুনেছি। ওকে সামলানোর সমস্যাটার কথা আগে জানলে এখন এই সব প্রশ্নই আসত না।”

বাশারের ফোন বাজছিল।

বাশার দরজা খুলে দিল। এক আশ্রমিক একটা ব্যাগ দিয়ে গেল।

বাশার ব্যাগটা নিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখল। রশিদ বাশারকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, “সর সর। তুই এসব বুঝবি না। আমাকে দেখতে দে।”

রশিদ ব্যাগ খুলতেই তার মুখে হাসি ফুটল, “এই তো। জ্যাকেটের জুয়েলারি চলে এসেছে। বেটা বলরাম, এদিকে এসো বেটা।”

বলরাম চকলেট খেতে খেতে রশিদের কাছে এল।

রশিদ শুধু জ্যাকেটটা বলরামকে পরিয়ে দিয়ে বলল, “বাহ, দিওয়ালির গিফটটা ভাল হয়েছে না বেটা?”

বলরাম আনন্দ পেল। জ্যাকেটটা পরে ঘরের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। রশিদ বাশারকে বলল, “দেখেছিস, তোরই শুধু দুঃখ হচ্ছে। বলরাম কত আনন্দ পেয়েছে দেখ।”

শাহিদ বলল, “ভাই আমার ইন্ডিয়ায় এসে সত্যি সত্যি সাধু বনে গেছে। এত মহিলা ভক্ত হয়ে গেছে, জীবনটাই তো পালটে গেছে ভাইয়ের।”

বাশার বলল, “আমি আর কী বলব? তোমরা আমাদের কথা শুনবে না। ঠিক আছে, তাই হোক, আমি আমাদের স্বার্থে বলরামকে কুরবানি দিতে প্রস্তুত। জায়গা ঠিক হয়েছে?”

রশিদ বলল, “চাচাজান বলে দিয়েছে যে কোন জায়গায় করা যায় রে বাশার। আমি চাইলে তোর আশ্রমেও করতে পারি।”

বাশার চমকে উঠল। রশিদ জোরে হেসে উঠে বলল, “আমি জানতাম তুই ঘাবড়ে যাবি। চিন্তা করিস না। মুম্বইয়ের লোক যেখানে বেশি ভিড় করে, আমরা সেখানেই দিওয়ালী করব কাল। যা তুই, তোর বলরামকে নিয়ে বেরো এখন। আমি আর শাহিদ বলরামের নতুন জ্যাকেটটা আরো ভাল করে ডিজাইন করে দি। এসো বেটা, জ্যাকেটটা দাও।”

বলরাম জ্যাকেটটা খুলতে রাজি হল না। রশিদ বলল, “কীরে বাশার, বল।”

বাশার একবার বলতেই বলরাম জ্যাকেট খুলে দিল। রশিদ বলল, “দেখলি এবার, কেন তোকে কাল নিয়ে যেতে চাইছি?”

বাশার রশিদের কথার উত্তর না দিয়ে বলরামকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

#

ইন্টারোগেশন রুমে সুনয়না দাভে চুপ করে বসে আছেন। শ্রীবাস্তব তার সামনে বসতেই সুনয়না বললেন, “আমাকে আমার ল ইয়ারের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হোক।”

শ্রীবাস্তব বললেন, “সব দেওয়া হবে ম্যাডাম। তার আগে বলুন, আপনি রেস্তোরাঁয় ব্যাগটা ফেলে গেছিলেন কেন?”

সুনয়না শান্ত চোখে শ্রীবাস্তবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওহ, ব্যাগটা আমি রেস্তোরাঁয় হারিয়েছি? দেখেছেন? আমি ওটার জন্য থানায় যাচ্ছিলাম, মিসিং ডায়েরী করব বলে।”

শ্রীবাস্তব বললেন, “ম্যাম, সময় নষ্ট করবেন না। যেটা জানতে চাইছি, সত্যি সত্যি বলুন।”

সুনয়না বললেন, “কী সত্যি জানতে চাইছেন আমাকে খুলে বলুন।”

শ্রীবাস্তব চিন্তিত মুখে সুনয়নার দিকে তাকালেন। একে ভাঙা খুব কঠিন হবে।

৬৭

রাত এগারোটা। সায়ক বীরেনকে নিয়ে রজ্জাকের গাড়ির পার্কিং এর কাছে অপেক্ষা করছিল। বীরেন বলল, “রজ্জাক কি আদৌ কিছু বলবে?”

সায়ক মাথা নাড়ল, “কিচ্ছু জানি না। আসুক।”

এ জায়গাটা অন্ধকার। বাজারের পিছন দিক। নোংরাও। রজ্জাকের গাড়ি ছাড়া আর কারো গাড়ি নেই। রজ্জাকের দোকান বন্ধ করতে সময় লেগে যায়। স্বাভাবিকভাবেই আর কারো গাড়ি থাকে না। সায়ক অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল।

গলি পেরিয়ে রজ্জাককে আসতে দেখে গাড়ির আড়ালে চলে এল। বীরেন সায়কের পাশে বসে পড়ল।

হঠাৎ রজ্জাকের আর্তনাদ ভেসে এল। সায়ক “শিট! শিট”, বলে দৌড়তে শুরু করল। বীরেন সায়কের পেছনে ছুটল। মাটিতে রজ্জাক পড়ে আছে। রজ্জাককে ছুরি মেরেছে কেউ। রক্তে মাটি ভেসে যাচ্ছে। সায়ক বিষণ্ণ মুখে মাটিতে বসে পড়ে বলল, “আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। খবরটা বেরিয়ে গেছে। মৌলানা সাক্ষী রাখবে না। তবে আমাদের মত এ পার্কিং এ অপেক্ষা করছিল না। দোকান থেকে পিছু নিয়েছিল। ফাঁকা জায়গা দেখে স্ট্যাব করে দিয়েছে।”

রজ্জাক কাতরাতে কাতরাতে বিস্ফারিত চোখে বীরেনের দিকে তাকিয়ে কোনমতে তার কোমরে রাখা গাড়ির চাবির দিকে ইশারা করে চোখ বুজল। বীরেন চলচ্ছক্তিরহিত হয়ে গেল। জীবন তাকে আর কত এরকম ভয়াবহ দৃশ্যের সম্মুখীন করবে? সায়ক বীরেনের হাত ধরে টানল, “চল। লোক এসে যাবে। আর দেরী না। আমার মনে হচ্ছে গাড়িতে কিছু আছে। চল।”

ঘোরের মধ্যে বীরেন সায়কের সঙ্গে রজ্জাকের গাড়ির কাছে গেল। সায়ক গাড়ি আনলক করে বলল, “উঠে বস।”

বীরেন গাড়িতে উঠে বসতে সায়ক গাড়ি স্টার্ট দিল। বাজার পেরিয়ে হাইওয়েতে এসে গাড়ির ড্যাশ বোর্ড খুঁজতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর বিরক্ত গলায় বলল, “কিসসু নেই। দেখি ডিকিতে।”

গাড়ি থেকে নেমে ডিকি খোলা হল। ডিকিতেও কিছু নেই। হতোদ্যম হয়ে সায়ক বলল, “একটা বিতিকিচ্ছিরি দুঃস্বপ্ন ছাড়া তাহলে আর কিছুই পেলাম না আমরা?”

বীরেন বলল, “কিছু পাওয়া গেল না?”

সায়ক বলল, “তুমিও একবার দেখো তো।”

বীরেন মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দেখতে শুরু করল। স্টেপনি ছাড়া ডিকিতে কিছু নেই। আরো কিছুক্ষণ দেখার পর সায়ক ড্রাইভিং সিটে বসে বলল, “চল। এ গাড়িতে কিছু নেই।”

বীরেন হতোদ্যম হয়ে গাড়ির পিছনের সিটে বসল। সায়ক বলল, “আবার এ গাড়ি কোথাও একটা ছেড়ে রেখে যেতে হবে।”

বীরেনের চোখ পড়ল ড্রাইভারের সিটের পেছনে একটা ছোট পকেট আছে। সে তাড়াতাড়ি সেই পকেটে হাত ঢোকাতে তার হাতে একটা গিফট বক্স উঠে এল। সে উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল, “এটা কী?”

সায়ক গাড়ি দাঁড় করাল। বলল, “দেখি।”

বীরেন বক্সটা সায়কের হাতে দিল। সায়ক তড়িঘড়ি বক্সটা সিটের উপর উপুড় করল। বাক্স থেকে বেশ কয়েকটা একশো ডলার বিল বেরোল। এক জোড়া ভারতীয় ভোটার এবং আধার কার্ড। একটা কাগজে কাশ্মীর থেকে মুম্বই দয়া সাগর আশ্রমে যাবার রুট ম্যাপ আর আশ্রমের বেশ কয়েকটা টিকেট। সায়ক অবাক চোখে রুট ম্যাপটা দেখে বলল, “দয়াসাগর বাবার আশ্রমের রুট ম্যাপ ইসলামাবাদে? হোলি শিট! এই আশ্রমটা তো মুম্বইতে! মৌলানার সঙ্গে এই আশ্রম…”

সায়ক ফোন বের করল। উসমানকে ফোন করল। উসমান ঘুম ঘোরে ফোন ধরে বলল, “হ্যাঁ স্যার। অফিসের কাজে রাতে ফোন করছেন? আমার বউ রাগ করছে।”

সায়ক বলল, “এস ও এস। আই রিপিট, এস ও এস টু মেইন ব্রাঞ্চ। দয়া সাগর। যে ক’টা রিপোর্ট পেলাম, সবক’টায় মাছের গন্ধ লেগে আছে। এস ও এস। নাও।”

উসমান বলল, “কপি।”

ফোন কাটল সায়ক। বীরেন বলল, “আমি কিছু বুঝলাম না। মাছ মানে?”

সায়ক বলল, “ফিসি। উসমান তুষার স্যারকে জানাক। এই আশ্রমটার কথা ওরা কোন দিন বলে নি। এখানে রুট ম্যাপ দিয়েছে কেন? ভোটার আই কার্ড আর আধার কার্ড আছে। এর অর্থ ওদের লোকজন এই আশ্রমে যাচ্ছে? এটা কি একটা আশ্রয়ের জায়গা? কিছুই তো ঠিক লাগছে না হে বীরেন।”

বীরেন বলল, “গাড়িটার ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশ পেলে ঝামেলা হবে।”

সায়ক চিন্তিত গলায় বলল, “রাইট। মনে করানোর জন্য থ্যাংকস। উফ, এই মুহূর্তে আমার দয়াসাগর আশ্রমে যাওয়ার দরকার ছিল।”

এলোমেলো ভাবতে ভাবতে গাড়ি স্টার্ট দিল সায়ক।

৬৮

রাত দেড়টা।

পীযূষ দয়াসাগর আশ্রমের ডিটেলস পাঠিয়েছিলেন। তুষার সেটাই দেখছিলেন। তার ফোন বেজে উঠল। প্রাইভেট নাম্বার দেখাচ্ছে। তুষার তড়িঘড়ি ফোন তুললেন, “ইয়েস।”

“স্যার। এস ও এস। সায়ক। আমাকে শুধু বলল আপনাকে জানাতে দয়াসাগর। মাছের গন্ধ লেগে আছে।”

তুষার বসে ছিলেন। উসমানের কথা শুনে চেয়ার থেকে উঠে বসলেন, “রিয়েলি? সায়ক এটা বলেছে?”

উসমান হাই তুলল, “হ্যাঁ স্যার। ঘুমোতেই দিল না।”

তুষার বললেন, “ঠিক আছে। টেক কেয়ার উসমান।”

ফোন কেটে গেল।

তুষার চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থেকে শ্রীবাস্তবকে ফোন করলেন। শ্রীবাস্তব ধরলেন, “হ্যাঁ স্যার।”

তুষার বললেন, “সুনয়না দাভে কিছু বলল?”

শ্রীবাস্তব হতাশ গলায় বললেন, “কিচ্ছু না স্যার। এমন মুখ করে বসে আছে, কিছুই জানে না। ব্যাগের কথা বলায় বলল ব্যাগটা ভুলে ফেলে গেছে। এখন সেটার জন্য ডায়েরি করতে যাচ্ছিল, আমরা নাকি আটক করেছি। একে মহিলা, তায় কলেজ ফ্যাকাল্টি। ঠিক কোন জায়গাটা দিয়ে এগোব বুঝতে পারছি না স্যার। আয়েষাকে বললাম একবার জেরা করতে। ওকেও কিছু বলল না।”

তুষার বললেন, “ওকে। আমি কাল সকালে আসছি। দয়াসাগর আশ্রমের সব গেটে নজরদারী শুরু করে দাও। সিসিটিভি নেটওয়ার্ক অ্যাক্টিভেট করে দাও। ড্রোণের ব্যবস্থা কর। যে গাড়ি ঢুকবে বেরোবে, সব ক’টাকে ফলো কর। আশ্রম থেকে গাড়ি বেরোলে একটা ডিসট্যান্স থেকে ফলো করবে। সন্দেহজনক কিছু হলেই আটক করো। টেক স্টেপ। যা হবে আমি বুঝে নেবো মুম্বই পুলিশের সঙ্গে। আমি না মুম্বই না যাওয়া অবধি এভাবে চল। যদি তার আগে কিছু হয়, তোমার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে স্টেপ নেওয়ার। না হলে আমি গিয়ে রেইডের ব্যবস্থা করছি।”

শ্রীবাস্তব বললেন, “ওকে স্যার।”

তুষার ফোন রাখলেন। পীযূষের ডকুমেন্ট বলছে, দয়াসাগর বাবার কোন ব্যাক গ্রাউন্ড নেই। এ দেশে কোন জায়গায় জন্ম, কেউ জানে না। অথচ এত বড় ধর্মগুরু হয়ে গেল। এ দেশে সব সম্ভব? কোন প্রমাণ ছাড়া দয়াসাগরের আশ্রম রেইড করতে গেলে ভয়াবহ কাণ্ড হতে পারে। আগুন জ্বলবে।

সাধু সবাই হতে পারে না। অপরাধীরা এই ছদ্মবেশ, আর মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মারাত্মক সব অপরাধ করতে পারে। পরে যখন এদের কাজের কথা বাইরে আসে, তখন মানুষের চোখ থেকে ধর্মের মুখোশটা খুলে যায়। সমস্যা হল, ধর্মান্ধ মানুষ এতটাই বেশি এই উপমহাদেশে, এত কিছুর পরেও এই সব অসাধু লোকগুলোর সমর্থক থেকে যায়। আজমল কাসভের মত ছেলেদের ব্রেইন ওয়াশ করা কত সহজ হয়ে যায়।

স্টাডি টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তুষার। ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙল। তৈরি হয়ে ইরাবতীকে তুলে দিলেন, “আমি মুম্বই যাচ্ছি। টেক কেয়ার।”

ইরাবতী উঠে বসলেন, “আমাকে একবার বলবে না?”

তুষার বললেন, “আর্জেন্ট। এখনই বেরোতে হবে।”

ইরাবতী বললেন, “ফ্লাইটের ব্যবস্থা?”

তুষার বললেন, “হয়ে গেছে।”

ইরাবতী বললেন, “ঠিক আছে। সাবধানে যেও।”

তুষার হাসলেন। গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল।

গাড়িতে ওঠা মাত্র ফোন এল। আশরফ। বললেন, “বল।”

আশরফ বললেন, “স্যার, কথা হল? এরপর পাখি পালিয়ে যাবে তো।”

তুষার বললেন, “কথা হয়েছে। ঢাকা নজর রাখছে।”

আশরফ বললেন, “স্যার, আতরও কিন্তু স্বীকার করেছে, ওর বস ছিল ওই পলিটিকাল লিডার। মানে ভাবুন জাস্ট, এ দেশের একটা বিরোধী পলিটিকাল দলের নেতা, পাকিস্তানকে ডিরেক্ট হেল্প করছে, আর আমরা সব জেনেও কিছু করতে পারবো না।”

তুষার বললেন, “আমাদের কিছু করারও নেই। ঢাকা আমাদের দেশ নয় আশরফ। তুমি ভুলে যাচ্ছো। আমাদের নিজেদের বর্ডার ঠিক রাখতে হবে। আমি বি এস এফকে বলে দিয়েছি। বাংলাদেশ বর্ডারের সিকিউরিটি তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইনফিল্ট্রেশন আটকানো হবে।”

আশরফ বললেন, “তাহলে আমাদের এত পরিশ্রম জলে গেল স্যার?”

তুষার হাসলেন, “কিচ্ছু জলে যায় নি। আজকের নিউজপেপার দেখো। মাননীয় পাকিস্তান প্রেমী পলিটিকাল লিডার এক্সপোজ হয়ে গেছেন। ফ্রন্ট পেজে খবর বেরোবে।”

আশরফ উল্লাস করে উঠলেন, “ইউ আর গ্রেট স্যার।”

তুষার হাসলেন। বললেন, “ফেরো এবার। আতরকে নিয়ে এসো। আমি ঢাকাকে বলে রেখেছি। আতরের ক্লিয়ারেন্স ঢাকা দিয়ে দেবে। সোহানকে বল আতরকে দিল্লিতে ডিপোজিট করতে। তোমাকে আর মাথুরকে আমি মুম্বইতে দেখতে চাই। আজ বিকেলের মধ্যে। কপি দ্যাট?”

আশরফ বললেন, “কপি স্যার। আপনি যা বলবেন। মুম্বইতে কী হল আবার? আপনি কি মুম্বইতে?”

তুষার বললেন, “যাচ্ছি। সামথিং ইজ ভেরি ফিশি দেয়ার। ছেড়ে রাখা যাবে না।”

আশরফ বললেন, “ফিশি? কোন ব্যাপারটা স্যার?”

তুষার বললেন, “দয়াসাগর আশ্রম। এই বাবার কোন পাস্ট রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আশরফ।”

আশরফ বললেন, “গোটা দেশে একটার পর একটা আশ্রম খুলছে এই দয়াসাগর বাবা। এত ভক্ত এরা পায় কোত্থেকে স্যার?”

তুষার ম্লান হাসলেন, “ধর্মান্ধতা থেকে পায়। যাকে ঈশ্বর রূপে পুজো করবে, তার কিছু না জেনে মানুষ অন্ধভাবে বিশ্বাস করছে। যতদিন না এ দেশের মানুষের এটুকু বোধ বুদ্ধি হবে, দেশের সিকিউরিটির থ্রেট ততদিন থাকবে। লিভ ইট, চলে এসো, মুম্বইতে দেখা হবে।”

আশরফ হাসলেন, “ওকে স্যার।”

৬৯

সকাল সাতটা।

বলরামকে নিয়ে বেরিয়েছে তিনজন। গাড়ি চালাচ্ছে বাশার। বাশারকে দেখে চেনার উপায় নেই যে সেই দয়াসাগর। তাকে একবারে অন্যরকম লাগছে।

বলরাম ঘুমোচ্ছে পেছনের সিটে। রশিদ বলল, “আজ দিনটা দারুণ। সকাল সকাল ইন্ডিয়ার বরবাদি দেখবে পাকিস্তান। এই বাশার। বলরামকে ঘুম থেকে তোল। জ্যাকেটটা পরিয়ে দে।”

বাশার বলল, “আরেকটু ঘুমোক। দেরী আছে এখনও।”

শাহিদ বলল, “তা বলে লোকজনের মাঝখানে জ্যাকেট পরাবি নাকি? আমিই তুলে দিচ্ছি। পেছনে পুলিশ জিপ কেন?”

বাশার বলল, “টহল গাড়ি। ওরকম অনেক গাড়ি ঘুরে বেড়ায়। ভয়ের কিছু নেই।”

শাহিদ বলরামকে ঠেলল। বলরাম ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করল। বিরক্ত হয়ে বাশার বলল, “বললাম পরে তুলতে।”

বলরাম বলল, “আমি কোথায়?”

রশিদ বলল, “আরে বাচ্চা, আমরা পার্ক দেখতে যাচ্ছি। কত ঘুরবো সারাদিন।”

বাশার বলল, “আমি আছি তো।”

গুরুজীর গলা শুনে বলরাম খানিকটা শান্ত হল।

রশিদ বলল, “দেখেছিস কত ভালবাসে গুরুজীকে?”

শাহিদ বলল, “হ্যাঁ। গুরুজী নিজের হাতে কুরবানি দেবে আজ।”

দুজনে বাজেভাবে হেসে উঠল।

শাহিদ বলল, “পুলিশের গাড়ি এখনো আছে। কী করব?”

বাশার বলল, “বলছি তো। অসুবিধা নেই। এ শহরে সারাক্ষণ এরকম গাড়ি ঘুরে বেড়ায়।”

বলরামকে জানলার পাশে বসানো হয়েছে। বাশার লুকিং গ্লাসে বলরামকে দেখল। সে কিছুক্ষণ গাড়ি চালিয়ে

রাস্তার বাঁ দিকে গাড়ি দাঁড় করাল। খানিকটা দূরত্বে পুলিশের জিপটাও দাঁড়িয়ে গেল।

রশিদ বলল, “কী হয়েছে?”

বাশার বলল, “পেট ব্যাথা করছে। বাথরুম যাবো।”

রশিদ বলল, “শোন বাশার। একদম চালাকি করবি না। এখানেই গুলি করে পুঁতে দেবো।”

বাশার গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। রশিদ সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নামল, “কী হল?”

বাশার বলল, “তোমরা যাও। আমি পারছি না।”

রশিদ রেগে গেল, “মানে? পারছিস না মানেটা কী? চাচাজানকে বলব তুই পারছিস না?”

বাশার বলল, “চাচাজান আমাকে এখানে সেট আপ করতে পাঠিয়েছিলেন। আমি করেছি। আমার যা যা করার কথা আমি সব করেছি। কিন্তু চাচাজান আমাকে এই কাজটা করতে বলেন নি। এটা তুমি আর শাহিদ আমার উপর হিংসে করে জোর করে করাতে চাইছো। আমি এটা পারবো না।”

রশিদ বাশারের মুখ পেঁচিয়ে ঘুষি মারল। রাস্তায় লোক দাঁড়িয়ে গেল। বাশার ছুটে এসে রশিদকে প্রত্যাঘাত করল।

বাশার যে রশিদকে মারতে পারে, শাহিদ ভাবতে পারে নি। সে বলরামকে জোরে করে জ্যাকেটটা পরিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাশারকে মারতে শুরু করল। বাশার এবার ছাড়ল না। প্রাণপণে এলোপাথাড়ি হাত চালাতে শুরু করল।

গাড়ির ভেতরে বলরাম কাঁদতে শুরু করেছে। রশিদ আর শাহিদ কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাশারকে রাস্তায় শুইয়ে দিল। রশিদ বাশারের কলার চেপে ধরল, “রাস্তা থেকে তুলে তোকে চাচাজান এখানে পাঠিয়েছে, আর সেই তুই নিজেকে কী ভাবছিস এখন? উপরওয়ালা ভাবছিস? চল।”

বাশারকে শক্ত হাতে তুলে গাড়িতে নিতে যেতে বাশার রশিদের হাত ছাড়িয়ে দৌড়তে শুরু করল। হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের জিপটা থেকে জনা পাঁচেক পুলিশ নেমে বাশারের পথ জুড়ে দাঁড়াল। রশিদ চমকে সেদিকে তাকাল। তার কোমর থেকে রিভলভার বের করতে গেল, একটা গুলি এসে তার হাতে লাগল। রাস্তায় ছিটকে পড়ল সে। বাশার দু হাত তুলে দাঁড়াল। সে আত্মসমর্পণ করতে চায়। শাহিদ দৌড়ে গাড়িতে উঠতে গেল, তার পায়ে গুলি এসে লাগল।

গাড়ির ভেতর থেকে বলরাম তারস্বরে কাঁদছিল। বাশার পুলিশের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চা। প্লিজ ওকে বাঁচান।”

রশিদ রাগী গলায় বলল, “গদ্দার!”

বাশার হঠাৎ করে পকেট থেকে ছুরি বের করে রশিদের গলায় চালিয়ে দিল। রশিদ রাস্তায় পড়ে গেল। পুলিশ বাশারের পায়ে গুলি করল। বাশার কাতরাতে কাতরাতে রাস্তায় পড়ে গেল।

শ্রীবাস্তব দৌড়ে গাড়ির ভেতর গিয়ে দেখলেন বলরামের গায়ে বোম ভর্তি জ্যাকেট। তিনি বাশারের কাছে ছুটে গিয়ে বললেন, “ডেটোনেটর কোথায়?”

বাশার শাহিদকে দেখালো। শাহিদ পকেটে হাত দিয়ে ডেটোনেটর বের করতে গেল। শ্রীবাস্তব রিভলভার তাক করলেন শাহিদের দিকে। শাহিদ বাশারকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে শুরু করল…

সোমবার সকালে মুম্বই আরো এক ভয়াবহ ব্লাস্টের হাত থেকে বাঁচল।

#

ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকির চেম্বারে চুপ করে বসে রয়েছে সামশের। সিদ্দিকি বললেন, “দিল্লি ফোন করেছিল।”

সামশের থমথমে মুখে সিদ্দিকির দিকে তাকিয়ে বলল, “সরি জনাব।”

সিদ্দিকি বললেন, “ইস্তফাপত্রটা সেক্রেটারির কাছে দিয়ে যাবেন। আপনাকে স্যাক করা উচিত ছিল। একটা কারণে করলাম না। যাই হোক, প্রেসিডেন্ট নিয়াজি অ্যাসাসিনেশন কেসে আপনার নাম উঠে আসায় আপনাকে আটক করা হতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া প্রায় সবই জেনে গেছে অফিসার। আমার কিছু করার নেই। আমেরিকান প্রেশার আফটার অল।”

সামশের বলল, “আমি সহযোগিতা করব।”

সিদ্দিকি বললেন, “ইউ মে গো নাও।”

সামশের মাথা নিচু করে সিদ্দিকির চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল।

একটা শব্দ তার কানে যেতে একবার থমকে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল।

শব্দটা হল, “স্কাউন্ডেল।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *