৪০
রাতে কিছুতেই ঘুমোতে পারল না বীরেন। সুলেমানের মুখটা তাকে ঘুমোতে দিল না। দোকানের কর্মচারীরা ঠিক করেছে দোকান চালাবে। সুলেমানের এক ভাই করাচী থাকে। সে আসবে। সম্ভবত সেই দোকানের দায়িত্ব নেবে। সুলেমান যেন নিজে মরে বীরেনকে মুক্তি দিয়ে গেল।
আরেকটু বেলা বাড়লে সে রজ্জাকের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রজ্জাক তাকে দেখে বলল, “কাল তুমি কোথায় ছিলে?”
বীরেন বলল, “আমিও মসজিদেই যাচ্ছিলাম। বরাতজোরে বেঁচে গেলাম।”
রজ্জাক বলল, “আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়েছেন। আচ্ছা, তোমাকে হিসেবপত্রের সব কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বুঝে নিতে হবে। এটা কিন্তু ছোট ব্যবসা না। অনেক বেশি হিসেব সামলাতে হবে। চলে এসো।”
বীরেন স্টক বুঝতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল গোটা বাজার এলাকা পুলিশে ছয়লাপ হয়ে গেছে।
পুলিশ এসে জানিয়ে গেল সব দোকান বন্ধ করে দিতে হবে। তদন্ত শুরু হবে।
রজ্জাক মাথা চাপড়িয়ে বলল, “হয়ে গেল আমার ব্যবসার হাল খারাপ। আর জায়গা পেল না ইবলিশের বাচ্চাগুলো! এবার দোকান বন্ধ রাখতে হবে। দে রে, ঝাঁপ ফেলে দে। নইলে পুলিশগুলোই দোকান ভাংচুর করতে শুরু করে দেবে।”
ঝাঁপ পড়ে গেল। দোকানের ভেতর বসে বিরক্ত মুখে রজ্জাক বলল, “একটু শান্তিতে এদেশে ব্যবসা করা যাবে না। এর থেকে সৌদি চলে যেতাম। সেখানেই ভাল থাকতাম। দাদার জন্য যাওয়া হল না। নিজে একদিকে মরল, আমাকেও অন্যদিকে মেরে গেল।”
বীরেন ঠিক করতে পারছিল না রজ্জাকের সঙ্গে এখনই কোন কথা বলবে কি না। কিছুটা ভেবে সে কিছু না বলাই মনস্থির করল। এখনই সব কিছু জানতে চাইলে রজ্জাক তাকে সন্দেহ করতে পারে।
জানলা দিয়ে উঁকি মারছে রজ্জাকের কর্মচারীরা। একজন বলল রাস্তায় পুলিশের কুকুর নেমেছে। রজ্জাক গলায় শ্লেষ এনে এক উর্দু প্রবচন বলল যার মানে বাংলায় করলে দাঁড়ায়, “চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।”
বিকেল নাগাদ পুলিশ দোকান খোলার অনুমতি দিল। তবে বাজারে বেশ কয়েকজন পুলিশ মোতায়েন হল। বীরেন যতটা সম্ভব কাজ বুঝে নিল। মাগরেবের নামাজের সময় সে দোকান থেকে বেরোতেই কানের কাছে সায়কের গলা শুনতে পেল, “সবজি বাজারের দিকে চল।”
বীরেন সবজি বাজার চিনে গেছিল। সবজি বাজারে প্রবেশের মুখে একটা বড় তোরণ আছে। সেখানে পৌঁছনো মাত্র ছদ্মবেশধারী সায়ক তাকে বলল, “তোরণের রাস্তায় ঢোকার পর ডানদিকে একটা ছোট রাস্তা বাজারের বাইরে যাচ্ছে। ওই রাস্তায় হাঁটতে থাকো।”
বীরেন সায়কের নির্দেশ মত হাঁটতে লাগল। সায়কও তার পেছন পেছন হাঁটছিল। এই রাস্তাটা বাজারের পেছন দিক এবং মসজিদের উল্টো দিক। একটা ছোট গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সায়ক গাড়ি খুলে ড্রাইভারের সিটে বসে বলল, “উঠে পড়।”
বীরেন গাড়িতে উঠে বসে বলল, “কোথায় যাবো?”
সায়ক বলল, “রাজা বাজার ছেড়ে যত দূরে যাওয়া যায়, তত দূর।”
বীরেন চমকে উঠে বলল, “মানে? কালকেই তো বললেন এখান থেকে পালালে আমার উপর সন্দেহ হবে?”
সায়ক গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, “আমাদের কাজই তো এরকম। সেকেন্ডে সেকেন্ডে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে। যাক গে, তোমার কৌতূহল নিরসনের জন্য বলে দিই, এ বাজারে ইসলামাবাদের টিকটিকিদের প্রবেশ হয়েছে। এখন তোমাকে এখানে রাখা মানে তোমাকে বিপদের মুখে ফেলে দেওয়া। প্রতিটা দোকানের লোক ধরে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে। যদিও তোমার একটা নকল আই কার্ড বানানো আছে কিন্তু সেটা বিপজ্জনক হয়ে যাবে হে বীরেনচন্দ্র। তাই নো রিস্ক।”
বীরেন হতাশ গলায় বলল, “ধুস, কত পরিশ্রম করলাম এদের হিসেব শেখার জন্য।”
সায়ক হো হো করে হেসে উঠল। বলল, “এরকম যে কত হিসেব আমি শিখেছি এ কয়েক বছরে, তার কোন ইয়ত্তা নেই। পাকিস্তানি আর্মি বা ইন্টেলিজেন্স ইন্ডিয়ান জাসুস পেলে কী করে জানো? পাতি ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে রেখে দেয়। তাই আপাতত হাওয়া গরম থাকাকালীন বেরিয়ে চল।”
বীরেন বলল, “কিন্তু রজ্জাক রিপোর্ট করে দেয় যদি?”
সায়ক বলল, “তা করবে। সে জন্যই ক’টা দিন একবারেই লুকিয়ে থাকতে হবে এখন।”
বীরেন বলল, “কোথায় লুকোতে হবে?”
সায়ক চিন্তিত গলায় বলল, “দেখা যাক।”
৪১
সকাল হয়েছে। খান বাড়িটা ঘুরে দেখছিলেন। বিরাট বিরাট ঘর
ছাদে উঠে দেখলেন তারেক চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। খান বললেন, “কী ব্যাপার? তুমি উদাস হয়ে গেছো কেন?”
খানের ডাকে তারেকের সম্বিত ফিরল। বললেন, “কী অদ্ভুত একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম খান। এখন আমার বউয়ের জন্য মন খারাপ করছে। ঢাকায় কী করছে একা একা কে জানে। ওকে তো আমি শুধু একটা পরিচয় পাওয়ার জন্য বিয়ে করেছিলাম, তবু খারাপ লাগছে। কাল যদি ওদের ছেড়ে দিতে হয়, আমি কী করব বল তো? এখন তো মনে হচ্ছে, এর থেকে স্যারের ডাক না পেলেই ভাল হত। এখানেই কাটিয়ে দিতাম।”
খান তারেকের কাঁধে হাত রাখলেন, “চিন্তার কিছু নেই। ভারতীয়রা অতো অমানবিক নয়। তোমার পরিবারের কথা নিশ্চয়ই মাথায় রাখবে।”
তারেক হাসলেন, “আমার কথাই ভুলে গেছিল! যাক গে, ঢাকার আপডেট হল, রফিকের বডি ওরা ওখানেই দাফন করে দিয়েছে।”
খান বললেন, “সেফ হাউজে কারা অ্যাটাক করেছিল কিছু জানা গেছে?”
তারেক মাথা নাড়লেন, “না। এই দুটো ঘটনা ভাবাচ্ছে। যথেষ্ট ভাবনার বিষয়।”
আকাশে মেঘ করে এসেছে। তারেকের ফোন বাজছিল। তারেক ধরলেন। কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। ফোন রেখে বললেন, “কোইন্সিডেন্স দেখো। এই মাত্র তুমি ঢাকার সেফ হাউজের কথাই বলছিলে। জানা গেছে। ওটা আই এস আইই করেছে।”
খান চমকে উঠলেন, “ঢাকায়? শিট!”
তারেক বললেন, “লোকাল রিক্রুট। সাত আটজনের কাজ। মুখ বেঁধে এসে বোম মেরে চলে গেছে। ওদের কাছে ও বাড়ির হদিস ছিল।”
খান তুষারকে ফোন করলেন। একটা রিং হতেই তুষার ফোন রিসিভ করলেন, “বল খান।”
খান বললেন, “স্যার, তারেক বলছে ঢাকার সেফ হাউজে আই এস আইই অ্যাটাক করেছে। ওদের লোকাল রিক্রুট আছে বেশ কিছু। ওরাই করেছে। এর মানে দাঁড়ায়, ঢাকায় আই এস আই অ্যাক্টিভ হয়েছে।”
তুষার বললেন, “হ্যাঁ। পাকিস্তানপন্থী র্যাডিকাল কিছু গ্রুপ আছে ওখানে। একটু আগে ঢাকা থেকে ফোন এসেছিল। ওরাও জানতে চাইছিলেন আমাদের এজেন্টরা ঢাকায় আছে নাকি? তোমাদের উপস্থিতি এখন একটা ইস্যু হয়ে গেছে।”
খান বললেন, “ওরা বিনা কারণে অ্যাটাক করে নি স্যার। ওরা বড় কিছু প্ল্যান করছে। আমরা এখানে বসে না থেকে কি ঢাকায় ফিরে যাবো?”
তুষার বললেন, “না না। একবারে না। সব কিছু থিতিয়ে যাক। ওখানে ওরা কিছু করলেও সেখানে আমাদের কিছু করার নেই। মাথায় রেখো, আমরা শুধু আমাদের থ্রেটগুলো নিয়ে ভাবব। ঢাকাকে আমরা খুব বেশি হলে অ্যালার্ট করে দিতে পারি।”
খান বললেন, “স্যার, কিছু কী জানা গেল?”
তুষার বললেন, “না। জানা যাবে। একটার পর একটা ক্লু আসছে। কোনটা ইস্ট থেকে আসছে, কোনটা ওয়েস্ট থেকে। ডটগুলো জোড়ার অপেক্ষায় আছি। যেখানে আছো, সেখান থেকে একবারে বেরোবে না। সময় আসবে। তখন যা করার করতে হবে।”
খান বললেন, “রিভেঞ্জ বাহিনী সম্পর্কে কিছু জানতে পারলেন?”
তুষার বললেন, “হ্যাঁ। মূলত ঢাকা বেসড কমবয়সী ছেলে মেয়ে। ঠিক কতজন সদস্য আছে, জানা যায় নি। রাজাকারদের বিচার চলছে। এই ব্যাপারে চর্চা বাড়ছে, ওরা ওদের মত করে তৈরি হচ্ছে। এরা একবারেই অহিংস নয়। ভীত নয়। জীবন দিতে দুবার ভাববে না। রুকসারের প্রোফাইলের সঙ্গে এদের চিন্তাভাবনা মিলে যাচ্ছে। তবে রুকসার ওদের হয়ে কাজ করছিল না অন্য কারো হয়ে, সেটার ব্যাপারে আমরা অন্ধকারে।”
খান বললেন, “আপনার জন্যই অপেক্ষা করে থাকব স্যার।”
তুষার বললেন, “ঠিক আছে। টেক কেয়ার।”
খান ফোন রাখলে তারেক বললেন, “ঢাকা পুলিশের এক বন্ধু ফোন করেছিল। ঢাকায় এই রাজাকারদের ফাঁসির প্রতিবাদে কয়েকটা জায়গায় কাল রাষ্ট্রের প্রতিশোধপরায়নতার বিরুদ্ধে হঠাৎ মিছিল শুরু হয়েছিল। বেশ কয়েকটা জায়গায় টায়ার পোড়ানো হয়। পুলিশ বা র্যাব নামার আগে ওরা মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে যায়। কুমিল্লায় কমিউনাল টেনশন তৈরি হয়েছে। আমাদের সাবকন্টিনেন্টে তো কমিউনাল টেনশন ছড়িয়ে দেওয়া সব থেকে সোজা কাজ। একটা কিছু নিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেই হল।”
খান চিন্তিত বললেন, “হু, ওরা নজর ঘুরিয়ে দিতে চাইছে এসব কিছু থেকে। দে আর প্ল্যানিং সামথিং বিগ ভেরি বিগ।”
তারেক বললেন, “হ্যাঁ। চিন্তার ব্যাপার হল আমরা ওদের র্যাডারে পড়ে গেছি। ঢাকার সেফ হাউজে অ্যাটাক সেটার প্রমাণ দিচ্ছে। ওদের কাছে খবর আছে তোমরা এ দেশে এসেছো। ওরা সেটা সাকসেসফুলি ট্র্যাক করেছে।”
খান বললেন, “ওরা এ বাড়ির সন্ধান জানে?”
তারেক বললেন, “জানতেও পারে। ১% চান্স থাকলেও পারে। অ্যালার্ট থাকতে হবে। রাতে দুজন করে জাগার ব্যবস্থা করতে হবে। এ বাড়িটাকে দুর্গ হিসেবেই ট্রিট করতে হবে। কোন ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নেই।”
খান বললেন, “ঠিক। জায়গাটা রিমোট হলেও ওরা যদি চুপ করে বসে শুধু আমাদের মুভমেন্ট দেখে, তাহলেও ঝুঁকির ব্যাপার আছে। চল দেখি।”
ওরা ছাদ থেকে এক তলায় সোহানদের কাছে এলেন। খান বললেন, “আজ রাত থেকে দুজন করে এ বাড়ি পাহারা দেবে। নিজেদের মধ্যে রোস্টার করে নাও। আমাদের দরকার হলে বলবে, আমরাও থাকব।”
সোহান বলল, “কোন দরকার নেই স্যার। আমরাই করে দেব।”
খান বললেন, “যদি সন্দেহজনক কিছু দেখো, আমাদের ডেকে দেবে। যদি তখনই রি অ্যাক্ট করার দরকার পড়ে, তাও আমাদের ডেকে দেবে। ঠিক আছে?”
সোহান মাথা নাড়ল, “রাইট স্যার।”
৪২
রাজা বাজার পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে শহরের মধ্যে বেশ খানিকটা পথ গিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় গাড়ি দাঁড়ি করাল সায়ক।
বীরেন বলল, “রাজাবাজারে আমার এ ক’দিন থেকে কোন লাভই হল না তাহলে? সেই তো পালিয়ে আসতে হল।”
সায়ক হাসল, “আমাদের ওভাবে ভাবলে হয় না বীরেন। এর পজিটিভ দিকগুলো দেখো। তুমি ওখানে থেকে ওদের অ্যাক্সেন্ট, কথার ধরণ অনেকখানি আয়ত্ত করে নিয়েছো। এটা কি কম মূল্যবান ছিল? এ দেশে থাকতে হলে ওদের মত হয়ে যেতে হবে আমাদের। তুমি বাঙালি, রবিবার সকালে সাদা আলুর তরকারি দিয়ে লুচি খেতে, সেসব ব্যাপার যত তাড়াতাড়ি তোমার গা থেকে মুছে যায়, তত মঙ্গল। আচ্ছা, শোন, আমি এখন গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করছি। তুমি একটু পর নামবে। আমার সঙ্গে পঞ্চাশ মিটারের ডিসট্যান্স রেখে আমাকে অনুসরণ করবে। একটা বাড়িতে আশ্রয় নেবো। কিন্তু একসঙ্গে গেলে হবে না। ঠিক আছে? গাড়ির চাবি গাড়িতেই রেখে নামবে। লক করারও দরকার নেই।”
বীরেন মাথা নাড়ল। সায়ক গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল। মিনিট তিনেক পর সে গাড়ি থেকে বেরোল। গাড়িটা যেখানে দাঁড় করানো, সেখান থেকে কিছুটা হাঁটলে আরেকটা বাজারের মত ঘিঞ্জি এলাকা শুরু হল। বীরেন কিছুই চেনে না। শুধু ধ্রুবতারার মত সায়ককে সামনে রেখে সে হেঁটে চলল। একটার পর একটা দোকান, গাদা গাদা মানুষের ভিড় পেরিয়ে সায়ককে দেখে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল তার। তবু সে দৌড়ল না। হেঁটে যেতে লাগল।
কসাই বাজার শুরু হল। চারদিকে মাংস ঝুলিয়ে রেখেছে। গন্ধে বীরেনের গা গুলিয়ে উঠল হঠাৎ করে। নাকে রুমাল দেবে নাকি ভেবেও চারদিকে তাকিয়ে কারো নাকে রুমাল নেই দেখে সে রুমাল বের করল না। কসাই বাজার পেরিয়ে পুরনো ভাঙা ভাঙা কতগুলো বিল্ডিং। সায়ক একটা বিল্ডিং এর কাছে এসে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে পড়ে তার ভেতর প্রবেশ করল।
বীরেন বিল্ডিঙটার ভেতরে ঢুকে দেখল নিচের তলায় বেশ কয়েকটা ঘুপচি দোকান। এক পাশে অন্ধকার সিঁড়ি। সে সিঁড়ি দিয়ে উঠে একতলায় উঠে দেখল চাবি দিয়ে একটা ঘরের তালা খুলছে সায়ক। সে চারদিকে দেখল।
না। এই ফ্লোরে আর কেউ নেই। টিম টিম করে একটা বাল্ব জ্বলছে।
সায়ক দরজা খুলে ঘরের ভেতরে যেতে বীরেনও ঘরের ভিতরে ঢুকল
ঘরের ভেতরেও সেই একই টিমটিমে আলো। ঘরটা বস্তায় ভর্তি। মেঝেয় এক কোণ একটু ফাঁকা। সেখানে কার্পেট পাতা। সায়ক বলল, “দরজা বন্ধ করে বস।”
বীরেন দরজা বন্ধ করে এসে বসল। সায়ক বলল, “আপাতত এখানে দু তিন দিন থাকা যেতে পারে।”
বীরেন বলল, “ইমান শেখের দোকানে যারা আসত, তারাই কি মসজিদে ব্লাস্ট করিয়েছে?”
সায়ক বলল, “হতে পারে। নাও হতে পারে। এখানে অসংখ্য অর্গানাইজেশন আছে। প্রত্যেকের নিজেদের মত দাবি দাওয়া। কে যে কখন কোন দাবিতে এসব করে, কেউ জানে না। বলাই বাহুল্য, এরা কেউ গান্ধীজীর শিষ্য না।”
কথাটা বলে সায়ক হাসল। বীরেন বলল, “ইমান শেখের দোকানে কোন অর্গানাইজেশনের লোকজন যেত?”
সায়ক বলল, “ইমান শেখকে ওরা কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কাজ দিয়েছিল। কাশ্মীরে ওদের নিজস্ব মিডিয়া আছে, মাঝে মাঝেই কেবল চ্যানেলে ওরা ওদের কথা বার্তা প্রচার করে। ইমান নিজেও কাশ্মীরি। আমাদের হাতে ধরা পড়ার পর ও ডাবল এজেন্ট হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, এরা সেটা জেনে যায় এবং ইমানকে শেষ করে দেয়। ওদের লোক তারপরে রজ্জাকের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করল। আমাদের সন্দেহ রজ্জাকই ওর দাদাকে ধরিয়ে দেয়। কাজটা হল না বীরেন। আমার লক্ষ্য ছিল তোমাকে রজ্জাকের বিশ্বস্ত করে তোলা। করার আগেই ব্লাস্টটা হল।”
বীরেন বলল, “রজ্জাকের দোকানে আমি এই লিফলেটটা পেয়েছিলাম।”
পকেট থেকে একটা সাদা লিফলেট বের করে সায়ককে দিল বীরেন। লিফলেটটা শ্রীনগরে একটা ভারত বিরোধী বিক্ষোভ মিছিলের। সায়ক দেখে বলল, “হু, এটা এখানেই ছাপা হয়ে শ্রীনগরে যাচ্ছে। যা দেখছি এরা নিজেরা খেতে না পেলেও কাশ্মীরে অশান্তি লাগিয়েই যাবে। তার মানে আমার ধারণা ভুল না। রজ্জাক এদের নতুন তাস। এই লিফলেটটা শ্রীনগরেই বিলি করবে ওরা। আজকের দিনটা বিশ্রাম কর। কাল দেখতে হবে রজ্জাক কবে আবার কাশ্মীর রওনা দেয়। আমাকে তুষার স্যারকে খবরও পাঠাতে হবে। এখানে তো সে উপায় নেই।”
চিন্তিত মুখে সায়ক পায়চারি শুরু করল। বলল, “ঘুমিয়ে নাও বীরেন। সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে নাও। শরীরের বিশ্রাম দরকার। জানি না এর পরে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।”
বীরেন চোখ বুজল।
সায়ক ঘরের অপরিসর জায়গাতে পায়চারি করতে লাগল।
৪৩
সন্ধ্যে সাতটা। ইসলামাবাদ।
স্যাটেলাইট টাউনশিপের একটা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াল।
গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার গেট ঠেলে ঢুকল সামশের আলি।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনটে টোকা দিতে দরজা খুলে গেল। ড্রইং রুমে মৌলানা বসে আছে। সামশের মাথা নিচু করে সালাম জানিয়ে বলল, “জনাব।”
মৌলানা ইশারায় বাকিদের সরে যেতে বলল। সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মৌলানা হজরতউল্লাহ বলল, “বসুন।”
সামশের বসল। মৌলানা বলল, “ব্যবস্থা হয়েছে?”
সামশের পকেট থেকে একটা ছোট ব্যাগ বের করে মৌলানার সামনের টেবিলে ব্যাগটা খুলে সেটা থেকে একটা পাসপোর্ট বের করে রাখল, “জনাব, এটাই আপনার আইডি। পরশু ভোরে আপনাকে আমরা মাসকটে পাঠানার ব্যবস্থা করছি।”
মৌলানা খুশি হল, “মাশাল্লাহ। যাক, আপনি আমাদের জন্য চিন্তা করেছেন দেখে ভাল লাগল। প্রেসিডেন্ট সাহেব জানেন?”
সামশের মাথা নাড়ল, “না জনাব। উনি জানার পর বাধা দিলে আমি কিছু করতে পারতাম না।”
মৌলানা মাথা নাড়াল, “এটা এ দেশের জন্য খুব দুঃখের কথা। আমরা কাদের জন্য লড়াই করছি?”
সামশের বলল, “কেউ তো কিছু করল না জনাব। উনিই ওর ইচ্ছেমত সব কিছু চালাতে পারছেন।”
মৌলানা বলল, “কতদিন আর? আল্লাহর এই দুনিয়ায় সবাইকে একদিন যেতে হয়। ওকেও যেতে হবে। চিন্তার কিছু নেই তো।”
সামশের ভ্রূ কুঁচকে মৌলানার দিকে তাকাল। মৌলানা বলল, “আপনার উপরে আমরা সবাই খুব সন্তুষ্ট। অথচ যে কাজটা আপনার অনেক দিন আগেই করা উচিত ছিল, আপনি সে কাজটা না করে বসে আছেন।”
সামশের বলল, “কী কাজ জনাব?”
মৌলানা বলল, “দেশের শত্রুর হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য কুরবানি চাই। আপনি কাউকেই পেলেন না, যে এই কুরবানি দিতে প্রস্তুত?”
সামশেরের মুখে হাসি ফুটল, “কেউ তো সেই নির্দেশ দেয় নি জনাব। দিলে এত দেরী হত না।”
মৌলানা বলল, “প্রেসিডেন্ট নিজেও কিভাবে ক্ষমতায় এসেছিল, ভুলে গেছেন? আপনি হাত গুটিয়ে বসে থাকলে এ দেশের কী হবে? গোটা পাকিস্তানের মানুষ চায় পাকিস্তান ইন্ডিয়াকে শেষ করে দিক। নিয়াজি সাহেব তো একবারেই নিস্তেজ হয়ে বসে আছেন। কিছুই করছেন না। এই অবস্থায় দেশের স্বার্থে, কাশ্মীরের স্বার্থে কি আমরাও চুপ করে বসে থাকব?”
সামশের বলল, “জনাব, আপনার আদেশ শিরোধার্য।”
মৌলানা বলল, “আপনারা না পারলে আমাকে বলবেন। আপনারা ভয় পেতে পারেন। এই ভয় কিন্তু এ দেশের জন্য ভাল না।”
সামশের চুপ করে রইল। মৌলানা বলল, “আমাদের পরবর্তী কাজের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কাশ্মীরিদের উপর অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবার সময় এসে গেছে। স্বয়ং দেশের প্রেসিডেন্টকে যদি আমরা আমাদের অপারেশনে সামিল করতে না পারি, তবে সে প্রেসিডেন্টকে রেখে লাভ নেই।”
সামশের মাথা নোয়াল, “জনাব।”
মৌলানা বলল, “বম্বেতে আপনার লোক কে আছে?”
সামশের অবাক হয়ে মৌলানার দিকে তাকাল, “বম্বে?”
মৌলানা বলল, “অবাক হবার কথা কিছু বলেছি বলে তো মনে হচ্ছে না। বম্বেতে আই এস আইয়ের কে আছে শুধু জানতে চেয়েছি।”
সামশের একটু ইতস্তত করে বলল, “একটা স্লিপার সেল আছে। অ্যাক্টিভ কেউ নেই।”
মৌলানা দুলে দুলে হাসল, “স্লিপার সেলই দরকার। ডিটেলস লাগবে।”
সামশের বলল, “কবে জনাব?”
মৌলানা হাসি মুখে বলল, “এখন।”
সামশের বলল, “আমি এখান থেকে…”
মৌলানা বলল, “ব্যবস্থা করুন। আমাদের কারো হাতে বেশি সময় নেই।”
সামশের রুমাল বের করে ঘাম মুছে আকবরকে ফোন করল। আকবর ফোন ধরে বলল, “জি জনাব।”
সামশের বলল, “মুম্বই ফাইলস অ্যাক্সেস লিঙ্ক লাগবে।”
আকবর অবাক হল, “এখন জনাব?”
সামশের বলল, “এখন। পাঠাও।”
আকবর বলল, “দিওয়ালীর জন্য?”
সামশের বলল, “এত প্রশ্ন কোর না। পাঠাও।”
আকবর বলল, “জি জনাব।”
সামশের ফোন রেখে মৌলানার দিকে তাকাল, “লিঙ্ক এসে যাবে জনাব।”
মৌলানা হাঁক পারল। ঘরের ভেতর থেকে একজনকে ল্যাপটপ নিয়ে আসতে বলল।
সামশেরের দিকে তাকিয়ে মৌলানা বলল, “যত বড় কাজ, তত বড় জায়গা মিলবে জন্নতে। ওরা আমাদের অপেক্ষায় আছে। আমরা ওদের আর অপেক্ষা করাতে পারি না। ঠিক তো?”
সামশের পাংশু মুখে মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক জনাব।”
৪৪
“টেরোরিজমের থ্রেট দু প্রকারের হয়। এক, এক্সটারনাল টেরোরিজম। যে সন্ত্রাসবাদের বীজ পোঁতে বিপক্ষ দেশ। তারা নানাভাবে আমাদের দেশের মধ্যে সমস্যা তৈরী করার চেষ্টা করে যায়। এটা সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই ওয়াকিবহাল। কিন্তু ইদানীং এক দ্বিতীয় টাইপের টেরোরিজম মাথাচাড়া দিচ্ছে। প্রোপাগান্ডা টেরোরিজম। এর পেছনে থাকা রাজনৈতিক পাকা মাথা। ত্রাস সৃষ্টি করে, মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দেওয়া যায় দেশের ভেতরে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, কোন সিনেমার কনটেন্ট অপছন্দ হল, মানুষ হই হই করে বেরিয়ে বাস পুড়িয়ে দিল। তারা পাবলিক বাস পোড়ানোতেই থেমে থাকল না, কোন রকম দয়া মায়া না দেখিয়ে স্কুলবাসকেও টার্গেট করে ফেলল। কোথাও রটে গেল কোন মন্দির বা মসজিদে নিষিদ্ধ মাংস ফেলে রেখে গেছে কেউ। ব্যস! হয়ে গেল। আঞ্চলিক লড়াই লেগে গেল। একটা খুব সাম্প্রতিক ঘটনার কথা বলি। বিহারের একটা গ্রামে জুলাই মাসে রটে গেল, বাইরে থেকে ছেলেধরা আসছে।
দুটি ছেলে, মেডিকাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করতে গ্রামে গ্রামে ঘুরত বাইকে করে। অচেনা মুখ দেখে, তীব্র আতঙ্কে এক গ্রামের মানুষ ছেলেদুটিকে পিটিয়ে মেরে দিল। কেউ একবারও দেখল না, আদৌ একটা বাচ্চাও গ্রাম থেকে নিখোঁজ হয়েছে নাকি। অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর নীতিহীনতায় ভরা এ দেশে মানুষের মনে পরস্পরের প্রতি ঘৃণার বীজ বুনে দেওয়া খুব সহজ কাজ। এই কাজগুলোই ইন্টারনাল টেরোরিজমের মধ্যে পড়ে। কম বেশি প্রায় সব পলিটিক্যাল পার্টি, জ্ঞানত বা না জেনেই এই ধরণের সন্ত্রাসবাদ ছড়াচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, আমরা যেন নিজেদের বুদ্ধি, বিচার দিয়ে সমস্ত কিছু বিবেচনা করে নিজেদের সিদ্ধান্ত নি। নিজেরা কখনও যেন মবে পরিণত না হই। দশটা লোক মিলে একটা লোককে মারছে দেখে মারার দলে আরেকজন না বাড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করি আদতে লোকটাকে কেন মারছে। দেশের আইন কী বলছে? কোন মানুষ কি দোষ না করেও দোষী হতে পারে? আমাদের ভাবার পরিসর, পড়াশুনার পরিসরটা আরও বাড়ানো দরকার। দেশের ভিতরের সন্ত্রাসবাদ, নিজের ভেতরের সন্ত্রাসবাদকে থামাতে না পারলে আমরা কখনও বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ভাবে লড়তে পারব না। তাহলে কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার আগেই আমরা হেরে বসে থাকব।”
বক্তব্য থামালেন তুষার। হল ভরে উঠল করতালিতে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত এক সেমিনারে তাকে ডাকা হয়েছে।
ইরাবতী তুষারের সঙ্গে এসেছেন।
বক্তব্য শেষ করে তুষার ইরাবতীর পাশে বসলেন। ব্রেক টাইম ঘোষণা হয়েছে। লাঞ্চে যাবার জন্য সবাই তাড়াহুড়ো শুরু করেছে।
ইরাবতী বললেন “ওয়েল সেইড।”
তুষার বললেন “থ্যাংক ইউ। তোমার মান রেখেছি তবে?”
ইরাবতী হাসলেন “নিশ্চয়ই। প্রাউড ওয়াইফ তোমার। খিদে পেয়ে গেছে। চল ডিনার হলের দিকে যাওয়া যাক।”
তুষার ইরাবতীকে নিয়ে ডাইনিং হলের দিকে এগোলেন।
একজন ফর্সা সুদর্শন ছেলে তুষারের দিকে এগিয়ে এসে বলল “স্যার, আপনার বক্তৃতা খুব ভাল লাগল।”
তুষার বললেন “ধন্যবাদ। তোমার নাম কী ইয়ংম্যান?”
ছেলেটি বলল “আবদুল ওয়াহাব স্যার।”
তুষার বললেন “কাশ্মীর?”
ছেলেটি বলল “হ্যাঁ স্যার। শ্রীনগর। আপনার স্পিচ আমার খুব ভাল লেগেছে স্যার। ইদানীং নিজের দেশে থেকেও খুব ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। সবাই কেমন সন্দেহের চোখে তাকায়, যেন কাশ্মীরি হয়ে কোন দোষ করে ফেলেছি।”
তুষার ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে বললেন “কোন দোষ কর নি। কোন অঞ্চলের মানুষকে আলাদাভাবে ট্রিট করতে হবে এটা দেশের সংবিধানে বলা নেই। বরং উল্টোটাই বলা আছে। তুমি কষ্ট পেও না। এখন একটা অসুস্থ সময় যাচ্ছে। আশা করা যায়, এই সময়টা এসেছে একটা সুস্থ সময়ের প্রিলুইড হিসেবেই। দেখা যাক। আশা করা তো মানা নয়, তাই না?”
আবদুল হেসে বলল “রাইট স্যার। ভাল লাগল আপনার সঙ্গে কথা বলে।”
ডাইনিং রুমে এসে গেছিলেন তারা। তুষার প্লেট নিতে যাবেন, এমন সময় ফোন বাজতে শুরু করল।
তুষার ধরলেন “হ্যালো।”
“স্যার, পীযূষ বলছি।”
“বল।”
“এখন কথা বলা যাবে?”
“শিওর। বল।”
“স্যার, লাস্ট টাইম আমরা ডার্ক নেট থেকে মুম্বইয়ের একটা স্লিপার সেলের কোড ডিকোড করেছিলাম, মনে আছে? আপনি কোন অ্যাকশন নিতে বারণ করেছিলেন? শুধু বলেছিলেন ট্র্যাক রাখতে?”
তুষার বললেন, “হ্যাঁ।”
“স্যার সেলটা নড় চড় শুরু করেছে। ইসলামাবাদ কন্ট্যাক্ট করেছে ওদের।”
তুষার বললেন, “আমি আসছি।”
ফোন রেখে তুষার ইরাবতীকে বললেন, “আমি খেতে পারছি না। আমাকে এখনই অফিসে যেতে হবে। তুমি খেয়ে নাও। আমি আমার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে নিচ্ছি।”
ইরাবতীর এরকম অভিজ্ঞতা অনেকবারই হয়েছে। তিনি হাসলেন। কিছু বললেন না।
৪৫
“জনাব। রাজা মার্কেট কেসে একটা লিড পাওয়া গেছে।”
আকবর নক না করেই সামশেরের চেম্বারে ঢুকে পড়ে বলল।
সামশের বলল, “কী লিড?”
আকবর বলল, “ইমান শেখের দোকানে ব্লাস্টের পরের দিন একটা ছেলে কাজ করতে এসেছিল। আমরা এলাকা তল্লাশি শুরু করার পর থেকে সে কাউকে না বলে চলে গেছে। সিসিটিভি ফুটেজ আছে। দেখবেন?”
সামশের সোজা হয়ে বসল, “দেখাও।”
আকবর সামশেরের কম্পিউটারে বসল। ইমান শেখের দোকানের সিসিটিভি ক্লিপ বের করে পজ করে বলল, “এই যে জনাব। এ।”
সামশের বলল, “গুড। এর হিস্ট্রি কী পাওয়া গেছে?”
আকবর বলল, “কয়েকদিন সুলেমানের দোকানে কাজ করেছে। রোজ সুলেমানের সঙ্গে মসজিদে যেত। যেদিন ব্লাস্ট হয়েছে, সেদিন যায় নি।”
সামশের আকবরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর কোন হিস্ট্রি? কী নাম?”
আকবর বলল, “শোয়েব আলী। বাকি কোন হিস্ট্রি পাই নি।”
সামশের বলল, “সুলেমানের দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ আছে?”
আকবর বলল, “না। সুলেমানের দোকানে সিসিটিভি নেই।”
সামশের বলল, “এর খোঁজ বের কর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ইমান শেখের দোকানে এ কী করতে গেছিল, কেন পালিয়েছে, যেভাবে হোক বের করতে হবে।”
আকবর বলল, “সুলেমানের দোকানের ছেলেগুলোকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যেটা জানা গেছে, এ দোকানে আসার পরে সুলেমানের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেছিল। সুলেমান শোয়েবকে পছন্দ করত। তারপর ব্লাস্টের পরের দিনই ছেলেটা রজ্জাকের কাছে চলে যায়। রজ্জাক বলছে ওর কাছে স্যালারি বেশি পাবে বলেই ছেলেটা ওর কাছে গেছিল। কেন চলে গেছে সেটা নিয়ে রজ্জাকও বুঝতে পারছে না।”
সামশের বলল, “স্নিফার ডগ আর তদন্তকারী অফিসারদের দেখে গা ঢাকা দেওয়ার তো একটাই অৰ্থ হয়। হয় এ ব্লাস্টে জড়িত ছিল, নয় এর অন্য কোন অভিসন্ধি ছিল।”
আকবর বলল, “কিন্তু জনাব ব্লাস্টের দিন ওর না থাকাটা এটাই প্রমাণ করছে…”
সামশের আকবরের কথা সম্পূর্ণ করল, “যে এ ব্লাস্টে জড়িত ছিল। এ দোকানে কী বলেছিল? নিজের সম্পর্কে কিছু বলে নি?”
আকবর বলল, “বলেছিল ও এতিম”
সামশের শিস দিয়ে উঠল, “দ্যাট সামস আপ এভ্রিথিং। এ ছেলে নিজের পরিচয় লুকিয়ে দোকানে কভার নিয়েছিল। তারপর রজ্জাকের দোকানে…”
সামশের ভ্রূ কুঁচকাল।
আকবর বলল, “কী জনাব? কিছু একটা স্ট্রাইক করল কি?”
সামশের বলল, “ইমান শেখের দোকানে কাজ করতে যাওয়াটাই এর টার্গেট ছিল। জামিল খানকে ফোন কর। আগে ওকে ধর। বহুদিন কোন যোগাযোগ করছে না। যদি রজ্জাকের দোকানে এই ছেলেটাকে জামিল ঢুকিয়ে থাকে, তাহলে একটা এক্সপ্ল্যানেশন পাওয়া যায়, কিন্তু যদি অন্য কেউ ঢুকিয়ে থাকে, তাহলে সেটাও আমাদের জানতে হবে ছেলেটাকে কে ঢুকিয়েছিল। তুমি জামিলকে জিজ্ঞেস কর তো।”
আকবর জামিলকে ফোন করল। জামিল ফোন ধরল, “জি জনাব।”
আকবর বলল, “জামিল মিয়াঁ, আমাকে একটা ইনফরমেশন দাও, ইমান শেখের দোকানে তুমি কোন চর ঢুকিয়েছো মসজিদ ব্লাস্টের পরে?”
জামিল বলল, “না।”
আকবর বলল, “কনফার্ম কর। উপরওয়ালার কসম নিয়ে সত্যি কথা বল।”
জামিল বলল, “না জনাব, সত্যি বলছি।”
আকবর ফোন রেখে সামশেরকে বলল, “ও সত্যি বলছে জনাব। এ ব্যাপারে ওর মিথ্যে বলার কোন কারণ নেই।”
সামশের আকবরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার কি মনে হচ্ছে? এ র-এজেন্ট হতে পারে?”
আকবর চিন্তিত মুখে সামশেরের দিকে তাকিয়ে বলল, “র এত দূর চলে আসবে জনাব?”
সামশের বলল, “না আসার কোন কারণ আছে কি? এভাবে লুকিয়ে পড়াটা যথেষ্ট সন্দেহ জনক। সিসিটিভি ফুটেজে পাওয়া ছবি, আর সুলেমান-রজ্জাকের দোকানে যারা যারা ওকে দেখেছে, তাদের বর্ণনা একসঙ্গে করে একটা ক্লিয়ার পিকচার বের করে ফেলো আজকের মধ্যে। থানাগুলোতে ইনফর্ম কর, একে যেখানে দেখবে, আটক করার ইন্সট্রাকশন দাও। দেরী কোর না। এ যেন পালাতে না পারে।”
আকবর মাথা নাড়ল, “জি জনাব। আমি এখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
৪৬
পীযূষ বললেন, “লোকেশন থানে স্যার। হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ এসেছে পাকিস্তান থেকে।”
তুষার বললেন, “কী মেসেজ এসেছে?”
পীযূষ বললেন, “গরম বাড়ছে। একদিন বিয়ার নিয়ে বসা যাক।”
তুষার হেসে ফেললেন, “একী? চিলড বিয়ার লেখে নি? বিয়ার গরম ভাল লাগে নাকি?”
পীযূষও হাসলেন। বললেন, “স্যার, এটা ওদের কোডের মধ্যে পড়ছে। পাকিস্তান থেকে শুধু একটা জায়গাতেই কি মেসেজ আসছে? অনেক জায়গাতেই আসছে। কিন্তু এই কোডটার মানে হল এবার শীতঘুম থেকে ওঠার সময় হয়ে এল।”
তুষার বললেন, “ঠিক। কাকে পাঠিয়েছে? কী নাম? কী কাজ করে?”
পীযূষ বললেন, “এটা এক কলেজ টিচারের কাছে এসেছে। মহিলার নাম সুনয়না দাভে। এই মহিলা গত বারো বছর ধরে কলেজে পড়াচ্ছেন।”
তুষার বললেন, “কী পড়াচ্ছেন?”
পীযূষ বললেন, “ম্যাথস স্যার।”
তুষার সভয়ে বললেন, “ওরে বাবারে। ম্যাথস। ওর ব্যাকগ্রাউন্ড কী বল তো? থানেতেই বাড়ি ছিল?”
পীযূষ বললেন, “স্যার সবই থানেতে। ঠিকানাও।”
তুষার বললেন, “এই স্লিপার সেল মেম্বারের ডিটেলস যখন বেরিয়েছিল, তখন তোমরা কেউ দেখো নি আর কিছু ইনফরমেশন পাওয়া যাচ্ছে নাকি?”
পীযূষ বললেন, “স্যার দেখেছিলাম। উনি এদেশেরই মানুষ। ঠিক কোন আইডিওলজি থেকে এসব করছেন জানি না। জ্যোতির্ময়বাবুর ক্ষেত্রেও তো আমরা একইভাবে পাজলড হয়ে গেছিলাম স্যার। ঠিক কোন কারণে এরা এই কাজে নামছেন, এত রাগ কেন বুকে চেপে ধরে আছেন, আমরা একবারেই অন্ধকারে।”
তুষার বললেন, “সব কিছু ট্র্যাক করা শুরু হয়ে গেছে?”
পীযূষ বললেন, “হ্যাঁ। এমনিতেই ট্র্যাকিং চলছিল, এখন পুরো দমে শুরু হয়ে গেছে।”
তুষার বললেন, “কোন রকম হিন্ট যেন না পায়। ওখানে আমি মাথুরকে….”
তুষার থমকে গেলেন। বললেন, “ওহ, মাথুর নেই। ঠিক আছে, ওখানে শ্রীবাস্তব আছে। ওকে বলছি। আচ্ছা পীযূষ, লাস্ট টাইম সায়ক যখন ব্লু ফ্লাওয়ার মিশনের লোকেশনগুলো পেয়েছিল, তার মধ্যে তো সিদ্ধি বিনায়কও ছিল। অমৃতসর ফেল হল, ওরা সিদ্ধি বিনায়ক টার্গেট করবে।”
পীযূষ বলল, “স্যার, সিদ্ধি বিনায়কের সিকিউরিটি আরো টাইট করে দেওয়া হয়েছে।”
তুষার বললেন, “সেটা ঠিক আছে, কিন্তু…”
তুষার চিন্তিত হলেন। পীযূষ বললেন, “কিন্তু কী স্যার?”
তুষার বললেন, “সিদ্ধি বিনায়কের মত জায়গা ওরা টার্গেট নাও করতে পারে। এর কারণ হল, ওরাও জানে এসব জায়গায় সিকিউরিটি আরো টাইট হয়ে গেছে। না না, এভাবে হাওয়ায় গেস ওয়ার্ক করে আমি কোন রকম কনক্লুশনে আসতে রাজি নই। তুমি শ্রীবাস্তবকে কাজ শুরু করতে বলে দাও। ওই সুনয়না দাভের প্রতিটা কাজের এক্সপ্ল্যানেশনসহ ডিটেলস চাই। বাই দ্য ওয়ে, ভদ্রমহিলা হোয়াটস অ্যাপে আর কাকে কাকে মেসেজ পাঠান?”
পীযূষ বললেন, “একটা কলেজ ফ্যাকাল্টিদের গ্রুপ আছে। ওখানে ওয়েব সাইট থেকে কপি করা কোটস বা মেসেজ ইত্যাদি পাঠান।”
তুষার বললেন, “ঠিক আছে। তুমি সেই মেসেজগুলো দেখেছো? মানে কোটগুলো?”
পীযূষ বললেন, “স্যার, দেখেছি। একবারে কাঁচা দাগের ইন্সপিরেশন কোটস ডাউনলোড করে পাঠান। সন্দেহজনক কিছুই নেই স্যার।”
তুষার বললেন, “তবু সেগুলো আমাকে ফরোয়ার্ড করে দাও। বুড়ো বয়সে ওই মেসেজগুলো যদি আমাকে কোনভাবে ইন্সপায়ার করে থাকে, তাহলে তো ভালোই। বাই দ্য ওয়ে, সায়কের লাস্ট লোকেশন কী আছে?”
পীযূষ বললেন, “রাওয়ালপিণ্ডি।”
তুষার বললেন, “আর কোন ভাবে কোন মেসেজ পাঠাতে পেরেছে?”
পীযূষ মাথা নাড়লেন, “না স্যার। পাঠায় নি।”
তুষার বললেন, “ঠিক আছে। তুমি মিশন মুম্বই শুরু করে দাও। তবে মুম্বইটা তুমি দেখলে অখিলকে বাংলাদেশটা বুঝিয়ে দাও। রফিকের সাবস্টিটিউটের খোঁজ এল কিছু?”
পীযূষ বললেন, “আমরা সেটাই অ্যানালিসিস করছি স্যার।”
তুষার বললেন, “আমি আর তিনটে দিন দেখব পীযূষ। যদি দেখি ঢাকা আমাদের আর সেরকম কিছু আউটপুট আসছে না, তাহলে বর্ডার সিকিউরিটি আরো বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের টিমটাকে বাংলাদেশ থেকে উইথড্র করে নেবো।”
পীযূষ বলল, “ওকে স্যার। তাই হবে।”
৪৭
ইঁদুর আছে ঘরটার মধ্যে। জেগে থাকলে কাছে আসে না। একটু রাত হলেই ওদের কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায়। রাত ন’টা।
সায়ক রুটি কিনে এনেছিল। দুজনে সেটাই খেল। বীরেন বলল, “আমরা রাজা মার্কেটে যাবো না?”
সায়ক বলল, “গেলেও একবারে ছদ্মবেশে যেতে হবে। তাও এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার তো কোন ইচ্ছেই নেই আমার। আশা করা যায়, তুমি এর মধ্যেই ওদের র্যাডারে চলে এসেছো। ওরা তোমাকে নিয়ে সন্দেহ করবে না, তা হয় না। স্লিপার সেলের মত তোমাকেও লুকিয়ে থাকতে হবে।”
বীরেন বলল, “ক’দিন?”
সায়ক বলল, “দিন পনেরো। এই বদ্ধ ঘরে থেকে দম বন্ধ হয়ে যাবে সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। ওরা ধরলে আগে ছাল তুলবে, তারপর জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আর সবার আগে তোমার দেশ তোমাকে ডিজ ওন করবে। এটা জানো নিশ্চয়ই?”
বীরেন বলল, “হ্যাঁ। কত বার যে শুনেছি।”
সায়ক বলল, “বার বার শোনা, আর নিজের সঙ্গে সেটা ঘটতে দেখার মধ্যে পার্থক্য আছে। যার জন্য জীবন দিচ্ছো, তারাই তখন বলে দেবে একে আমি চিনি না। বিষয়টা নট এ ম্যাটার অফ জোক বীরেনবাবু। বর্ডারে লড়াই করার মানে তুমি ফ্রন্টলাইনে থাকছো। বুক চিতিয়ে লড়াই করছো। আর এখানে থেকে সর্বক্ষণ তোমাকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হবে। খুব সহজে মিশে যেতে হবে এখানে। বীরত্ব দেখালেও হবে না। লুকিয়ে থাকো আর যা খবর আসবে, দেশে পাঠাতে থাকো। সিম্পল।”
বীরেন বলল, “সুলেমান ভাল লোক ছিল। এখন ওর জন্য খারাপ লাগছে। আগে জানলে ওকে মসজিদে ঢুকতে দিতাম না।”
সায়ক বলল, “আমরা সবাই ভাল লোক, যতক্ষণ না আমাদের স্বার্থের সংঘাত হচ্ছে। সুলেমান যদি জানতে পারতো তুমি একজন ভারতীয়, তোমার উদ্দেশ্য অন্য, তাহলে ও তোমাকে একই ভাবে ট্রিট করত না। সবার আগে ও পুলিশকে খবর দিত। কিন্তু, অন্যদিকে… হ্যাঁ, সুলেমান ভাল লোক ছিল। আমাদের দু দেশেই এরকম অসংখ্য ভাল মানুষ আছে যাদের মধ্যে মানবিক গুণ আছে। যারা মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখে। দেশভাগের আগে যখন দুটো দেশ এক ছিল, তখনো এরা এত কিছু ভাবেই নি। স্বার্থের সংঘাত হবার সঙ্গে সঙ্গে সব রকম ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। ঠিক কোন কারণে, কেন এত শত্রুতা, তার গভীরে গিয়ে কিছু লাভ নেই এখন। আমাদের লক্ষ্য আলাদা। ঠিক এই সময়েই, আমাদের দেশেও পাকিস্তানি কোন চর আছে। হতে পারে তারা টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশনের মদতপুষ্ট। তাদের জীবনের একটাই লক্ষ্য। ব্লাস্ট করা। মানুষের ক্ষতি করা। এরা ডেঞ্জারাস এলিমেন্ট। একটার পর একটা ঝড় আসবে, একটা অ্যাটাক করতে না করতে আরেকটা অর্গানাইজেশন আরেকটা অ্যাটাকের জন্য প্রস্তুতি নেবে, আমাদের কাজ হবে তাদের যে করে হোক আটকে যাওয়া।”
বীরেন বলল, “কী করে বুঝব, ওরা কোন অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিচ্ছে?”
সায়ক বলল, “যখন বহুদিন কোন বড় অ্যাটাক হবে না। বুঝবে এগুলো ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা। ইমান শেখের ব্যাপারে ওদের তৎপরতা বোঝাচ্ছে ওরা আবার কোন প্ল্যান শুরু করেছে। জামিল…”
সায়ক চিন্তিত মুখে বীরেনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই জায়গাটা সেফ। তুমি এখন শুয়ে পড়। আমি বেরোচ্ছি। না ফেরা অবধি এখানেই থাকবে।”
বীরেন অবাক হয়ে বলল, “কখন ফিরবেন?”
সায়ক বলল, “মাঝ রাতেও ফিরতে পারি, কিংবা ভোরে। কয়েকটা ফোন করার আছে।”
বীরেন বলল, “আমিও গেলে হত না?”
সায়ক বলল, “একবারেই না। তুমি রেস্ট কর। রেস্ট করাটা দরকার।”
পনেরো মিনিটের মধ্যে সায়ক ছদ্মবেশ নিয়ে তৈরি হয়ে গেল। বীরেনকে বলল, “দরজা বন্ধ করে দাও। কোড হল সাতটা নক।”
সায়ক পাঠানের ছদ্মবেশে বেরোল। বাজারের ব্যস্ততা কমেছে। কোন কোন দোকানে এখনও ভিড় আছে। হাঁটতে হাঁটতে সে একটা পিসিওতে এল। বক্সের ভেতর ঢুকল না। বাইরে বসেই নাম্বার ডায়াল করল। ও প্রান্তে একবার রিং হতেই ফোন ধরল, “হ্যালো।”
সায়ক বলল, “আমার কাছে দুটো বইয়ের পার্সেল এসেছে। দুটোই করাচীর। আরেকটা কিন্তু এখনও আসে নি
সঙ্গে সঙ্গে ও প্রান্তে আরেকজন ফোন ধরল, “হ্যাঁ, বল।”
সায়ক বলল, “আরেকটা পার্সেল কিন্তু এখনও আসে নি।”
ও প্রান্ত বলল, “পাঠানো হয় নি। বাড়ির প্রাচীর নিয়ে ঝামেলা লেগেছে তো আবার। এখন দেখা যাক কবে সমস্যা মেটে।”
সায়ক বলল, “ও তো লেগেই থাকে। আমার ছেলের আবার পরীক্ষা আছে। বই না এলে তো বিপদ। একটু তাড়াতাড়ি করলে ভাল হয়।”
“ঠিক আছে। দেখছি। আমি চেষ্টা করছি।”
“ঠিক আছে।”
সায়ক ফোন কেটে দিল।
পিসিওর মালিক বলল, “পরীক্ষার বই? আম্রিকা যাবার পরীক্ষা নাকি মিয়াঁ?”
সায়ক বলল, “হ্যাঁ। সেই কবে আসার কথা ছিল, এখনও এল না। কত টাকা হল?”
বিল মিটিয়ে সায়ক হাঁটতে হাঁটতে বাস স্ট্যান্ডে এল। ইসলামাবাদের লাস্ট বাস দাঁড়িয়ে আছে। জনা দশেক লোক হয়েছে। সায়ক বাসে উঠে পিছনের দিকের সিট নিয়ে জানলার পাশে বসল।
ঘড়িতে রাত দশটা পনেরো।
সায়ক চোখ বন্ধ করল। এই সময়টুকু একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক।
৪৮
ঢাকা। রাত আটটা।
একটা বন্ধ টেক্সটাইল কারখানার ভিতরের অফিস ঘরে আতর বসে আছে। কয়েকজন মিলে সুমাইমাকে এনে ঘরের ভিতর ঠেলে ফেলল।
সুমাইমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। মেঝেতে পড়ে তার ব্যথা লাগল, কিন্তু শব্দ হল না।
আতর বলল, “ভেবেছিলি পালিয়ে যাবি? তাই না?”
সুমাইমা আতরের দিকে তাকাল। কিছু বলল না।
আতর বলল, “তুই ঠিক কী চাস বল। বলবি মাগী?”
চিৎকার করে উঠল আতর।
সুমাইমা আতরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, “মেরে ফেলবি? রেপ করবি? কর।”
আতর বলল, “মারব?
এত সোজা? তাহলে তো হয়েই গেল। রফিক সাহেবের থেকে আনন্দ পেয়েছিলি না? আজ তোকে আরো
আনন্দ দেওয়ার লোক আসবে। আজ দেখি তোর কেমন সাহস।”
সুমাইমা পাগলার মত হাসতে শুরু করল।
আতর এগিয়ে এসে সুমাইমার গাল পেঁচিয়ে সজোরে একটা চড় মারল, “তোর জন্য আমাদের সব জায়গায় নাম খারাপ হয়ে গেল। এই জন্য তোর পেছনে আমরা এত খরচা করেছিলাম?”
সুমাইমার হাসি থামল না।
আতর রাগী চোখে সুমাইমার দিকে তাকিয়ে চেয়ারে বসল।
হাসতে হাসতে সুমাইমার দু চোখ বেয়ে জল পড়ছিল।
কিছুক্ষণ পর দুজন আতরের ঘরে ঢুকল। একজনের নাম বিলাল, অপরজন ইউসুফ।
ওদের দেখা মাত্র আতর সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল, “আসুন জনাব।”
বিলাল এসে সুমাইমার মাথার চুল ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে তাকে একটা চেয়ারের কাছে নিয়ে এসে বলল, “বল, তোকে কে পাঠিয়েছিল?”
সুমাইমা বিলালকে দেখে আবার হাসতে শুরু করল।
বিলাল আতরের দিকে তাকাল, “ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করিস নি? এতগুলো ডলার কী করতে পাঠানো হয় তোদের?”
আতর ভীত গলায় বলল, “আমরা তো খোঁজ নিয়েছিলাম। জেনেছিলাম ওর বাবা আমাদেরই লোক।”
বিলাল বলল, “খোঁজ নিস নি। খোঁজ নিলে এত বড় অঘটন ঘটত না। যে লোককে গোটা হিন্দুস্তান এতদিন ধরে খুঁজে পেল না, তাকে এই মেয়েটা মেরে ফেলল। ছি!”
আতর মাথা নিচু করে বসে রইল। বিলাল বলল, “এটা আজ রাত আমাদের দুজনের কাছে থাকবে। বাকিরাও দেখুক আমাদের কথা না শোনার ফল না হতে পারে। যা, এটাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর।”
আতর দলের ছেলেদের ডাকল। তারা সুমাইমাকে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
বিলাল বলল, “ইন্ডিয়ান শুয়োরগুলো কোথায় এখন?”
আতর বলল, “জি, একটা গ্রামে লুকিয়েছে জনাব। ওদের ড্রাইভারটাকে আজ সকালেই কব্জা করেছি। ঠিকানাও পেয়ে গেছি।”
বিলাল রেগে বলল, “তাহলে এখানে বসে কী করছিস?”
আতর বলল, “চিন্তা করবেন না জনাব। আজ রাতেই ওদের ব্যবস্থা করছি। আপনারা এখানেই থাকুন। আমাদের উপর ছেড়ে দিন।”
বিলাল বলল, “ওদের জ্যান্ত নিয়ে আসতে পারবি? ইন্ডিয়ান জাসুসগুলোকে আমি নিজের হাতে মারবো।”
আতর বলল, “জ্যান্ত হবে না জনাব। আমাদের সব তো ভাড়াটে সৈন্য জনাব।”
বিলাল বলল, “এতদিন ধরে আমাদের ডলারগুলো নিলি, ট্রেনিং ক্যাম্পের নাম করে। ট্রেনি ছেলেগুলো কোথায়? ভাড়াটে লোক পাঠাচ্ছিস? লজ্জা লাগে না?”
আতর মাথা নিচু করল।
বিলাল আতরের মুখে সজোড়ে চড় কষাল।
#
রাত একটা।
আশরফ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মাথুর পায়চারি করছিলেন।
গুরপ্রীত এসে বলল, “একটা পুলিশ ভ্যান এসে দাঁড়িয়েছে বাইরের গেটের সামনে।”
মাথুর বললেন, “এখনই এসেছে?”
গুরপ্রীত বলল, “হ্যাঁ।”
মাথুর বললেন, “সবাইকে ডেকে এই ঘরে নিয়ে এসো।”
গুরপ্রীত বেরিয়ে গেল।
মাথুর আশরফকে ডাকলেন। আশরফ উঠে বসে বললেন, “কী হল?
মাথুর বললেন, “পুলিশ ভ্যান। পুলিশ এসেছে কেন?”
আশরফ উঠে জানলার কোণ থেকে দেখলেন, প্রথমে একটা পুলিশ ভ্যান ছিল। এখন আরেকটা ভ্যান এসে দাঁড়ালো। আশরফ মাথুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শিট।”
মাথুর বললেন, “এবার কী করবে? এরা এ বাড়ি ঘিরে ফেলবে। লড়াই করবে?”
আশরফ চিন্তিত মুখে আরেকবার বাইরের দিকে নামলেন। হাতে ভারি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ভ্যান থেকে
কয়েকজন নামল। আশরফ গুণতে শুরু করলেন।
তারেক ঘরে ঢুকলেন, “ওদিকে তাকিয়ে লাভ নেই। এরা পুলিশ না। অনেকজন আছে। একবারে কোন আলো জ্বালাবার দরকার নেই। আমার সঙ্গে চল।”
গুরপ্রীত তাদের দলের বাকি তিনজনকে ডেকে নিয়ে এসেছিল।
ঘর থেকে বেরিয়ে জানলা বাঁচিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে তারা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল।
বাইরে থেকে গুলির শব্দ পাওয়া গেল। সোহান রিভলভার বের করল। তারেক বললেন, “একদম এ বোকামি না। ওরা কতজন আছে আমরা জানি না। আমার সঙ্গে এসো।”
লোকজনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।
তারেক বললেন, “এরা আর যাই হোক, পুলিশ না। পুলিশ অকারণ গুলি চালাবে না।
তারেক পথ দেখিয়ে বাড়ির কোণের ঘরে নিয়ে গিয়ে মেঝের একটা ঢাকনা খুলে টর্চ মারলেন। বললেন, “চল।”
আশরফ বললেন, “এটা কী? সুড়ঙ্গ?”
তারেক বললেন, “হ্যাঁ। এখন লড়াইয়ের সময় না। গা ঢাকা দেওয়ার সময়। এসো।”
তারেক টর্চ মেরে নিচে নামলেন। এক মানুষ সমান উঁচু একটা সুড়ঙ্গ। বললেন, “একদম শেষে যে নামবে, ঢাকনা বন্ধ করে দিও। আমার সঙ্গে এসো।”
তারেক হাঁটতে থাকলেন। একবারে বদ্ধ সুড়ঙ্গ। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তবু সবাই সাবধানে তারেককে সামনে রেখে হাঁটতে থাকলেন। প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটার পর একটা সিঁড়ি এল। তারেক সন্তর্পণে সিঁড়ি ভেঙে উঠে ঢাকনা অল্প সরিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। সুড়ঙ্গ তাদের বাড়িটার সীমানার বাইরে একটা পরিত্যক্ত মন্দিরের কাছে নিয়ে এসেছিল। মন্দিরটা বাড়ির পেছন দিকে। তারেক ঢাকনাটা পুরো খুলে বাইরে এসে বললেন, “চলে এসো।”
সবাই একে একে বাইরে এলেন। আশরফ বললেন, “এই সুড়ঙ্গের কথা তুমি জানতে?”
তারেক বললেন, “এটা গোপন সুড়ঙ্গ। আমার কলিগ আমাকে দেখিয়েছিল। খুব সম্ভবত রায়টের সময় এই বাড়ির জমিদার আগে থেকেই হয়ত কিছু আঁচ করতে পেরে এটা বানিয়েছিলেন।”
বাড়ির ভেতর থেকে টর্চের আলো দেখা যাচ্ছে। সোহান বলল “স্যার, আমরা ওদের ছেড়ে দেব? আমরা চারজন আছি তো। আপনারা শুধু অর্ডার করুন, বাকিটা বুঝে নিচ্ছি।”
আশরফ বললেন, “একবারেই না। আমাদের এক্সিস্টেন্সটাই লুকোতে হবে এখন। এখানে বসে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
মন্দিরের মধ্যে ঝোপ, জঙ্গল ভর্তি।
চারপাশে ধান ক্ষেত। খুব দূরে গ্রামের আলো দেখা যাচ্ছে।
তারেক ফোন বের করে একটা নাম্বারে কয়েকবার ডায়াল করলেন। ফোন সুইচড অফ বলছে। তারেক বললেন, “মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি কাল ড্রাইভারটাকে ছেড়ে দিয়ে। ওর ফোন বন্ধ। তার মানে কোনভাবে ওরা ওর থেকে খোঁজ পেয়েছে।”
আশরফ তুষারকে ফোন করলেন। তুষার ফোন ধরে বললেন, “বল।”
আশরফ সবটা জানালেন। তুষার বললেন, “ওখানেই থাকো। আমি দেখছি।”
তারেক শ্বাস ছাড়লেন, “আমার ভুলের জন্যই এটা হল। আমার উচিত ছিল ড্রাইভারটাকে রেখে দেওয়া। আমি ভাবলাম এখানে আবার ভিড় বাড়বে! ছেলেটা বিশ্বস্ত ছিল।”
আশরফ বললেন, “দে আর ট্র্যাকিং ইউ অলসো। নইলে তোমার ড্রাইভারের খোঁজ ওরা পেত না। তোমার ফ্যামিলি কোথায় আছে?”
তারেক বললেন, “বউ বাচ্চা সব শ্বশুরবাড়ি গেছে। তোমার কেন মনে হচ্ছে ওরা আমার খোঁজ পেয়ে গেছে?”
আশরফ বললেন, “ওদের ইন্টেলিজেন্সকেও খাটো করে দেখছি না বলে মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় না তুষার স্যার তোমাকে আর বাংলাদেশে রাখার রিস্ক নেবেন।”
তারেক বললেন, “আমি আর কোথাও যাবো না খান। তাতে মরতে হলে মরব। যে দেশ স্বাধীন করায় আমাদের সব থেকে বড় ভূমিকা ছিল, সে দেশে আই এস আই এসে যা ইচ্ছে করবে, আর আমাদের সেটা মেনে নিতে হবে? এটা সম্ভব?”
মাথুর হতাশ গলায় বললেন, “কত আশা করে এদেশে এসেছিলাম ভাই। কাচ্চি খাবো, ইলিশ খাবো। তা না, মাঝরাতে মাঠের মধ্যে পোড়ো মন্দিরে বসিয়ে রেখেছো।”
আশরফ বললেন, “রুকসার, তারপর প্রথমে ঢাকার সেফ হাউজে ওদের হামলা, এখন এখানে। কোন একটা লিংক মারাত্মক ভাবে কমপ্রোমাইজড হয়ে গেছে, নয়ত ওরা আমাদের শুধু দেখে যাচ্ছিল। বাংলাদেশ কাশ্মীরের ফিল দিচ্ছে। দিস ইজ সিরিয়াস ম্যাটার।”
তারেক হাসলেন, “রফিক মরে গিয়েও আমাদের জ্বালিয়ে যাচ্ছে। এ দেশে সযত্নে ওদের নেটওয়ার্ক ছড়ানো আছে। ট্রেনিং ক্যাম্প ফান্ডিং থেকে শুরু করে ধর্মের নামে পাকিস্তানপন্থীরা এক জোট হয়েছিল বহু আগেই। রানিং গভর্নমেন্টের প্যারালাল অর্গানাইজেশন চালায় ওরা। সময়ে সময়ে সব রিপোর্টই তো পাঠিয়েছি। কখনো খুলে দেখো নি তোমরা? সবাই কাশ্মীর নিয়েই পড়েছিলে নাকি?”
আশরফ বললেন, “তুষার স্যার নিশ্চয়ই দেখেছেন। কিন্তু অবস্থা যে এতটা খারাপ হয়ে আছে, আমি ধারণা করতে পারি নি। দুটো পুলিশের ভ্যান জোগাড় করে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে এসেছে…”
আশরফের কথা শেষ হতে না হতেই পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। তারেক বললেন, “র্যাব এসেছে। নকল পুলিশ আর আসল পুলিশের খেলা হবে।”
সোহান বলল, “স্যার, আমরা কি এখনও…”
আশরফ কড়া গলায় বললেন, “হ্যাঁ। দর্শক হয়েই থাকতে হবে।”
বাড়িটার ভেতর থেকে হৈ চৈ আর গোলাগুলির শব্দ শুরু হল। ওরা চুপ করে বসে রইল।
৪৯
সায়ক চলে যাওয়ার পর বীরেন চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল। তার ছবি এ দেশের সব খানে চলে গেছে? তুষার স্যার বলেছিলেন এরকম পরিস্থিতি আসা সময়ের অপেক্ষা। এরপর তার কাজই হবে নিজেকে যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখা। সায়কের মাথার দাম ধরা আছে পাকিস্তানে। সায়ক অকুতোভয় হয়ে ঘুরে বেড়ায়। সায়কের মতো অকুতোভয় হতে কি সে পারবে?
সায়ক বলেছিল ঘুমোতে। সে ঘুমনোর চেষ্টা করল। ঘুম হচ্ছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। রাত হয়েছে তো। এবার তো সে বেরোতেই পারে। একটু ঘুরে আসবে না হয় বাইরে থেকে? পরক্ষণে মত পাল্টাল। এটা সিসিটিভির যুগ। কখন কোন ক্যামেরায় মুখ ধরা পড়ে যাবে, কে জানে? এ পাশ ও পাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল দরজায় নকের শব্দে। তড়িঘড়ি উঠে বসল। দরজা খুলে দেখল ছদ্মবেশী সায়ক দাঁড়িয়ে আছে। ঘরে ঢুকে সায়ক বলল, “দরজা বন্ধ কর। তুমি সাতটা নক শুনেছিলে?”
বীরেন লজ্জা পেল। ঘুমের ঘোরে খেয়াল করে নি সায়ক কতবার নক করেছে। সায়ক বলল, “ভাগ্য বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সেটার কারণেই এ যাত্রা বেঁচে গেলে। পরের বার এই ভুল কোর না।”
বীরেন মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে।”
সায়ক পাউরুটি নিয়ে এসেছিল। বলল, “বাথরুম সেরে খেয়ে ফেলো। বেরনোর কথা স্বপ্নেও ভেবো না। যে ভয় পেয়েছিলাম, সেটাই হয়েছে। রজ্জাক তোমার কথা বলে দিয়েছে। ওরা তোমার ছবি মিডিয়ায় দিয়ে দিয়েছে। মনে রেখো, এখন ধরা পড়লে মসজিদ ব্লাস্টের পুরো দায় ওরা তোমার উপর দিয়ে দেবে। ওরা একটা কাঁধ খুঁজছে যার উপর সব দায় ঝাড়তে পারে। ব্লাস্ট করেছে একটা পলিটিকাল পার্টি, আর দোষ দেবে ইন্ডিয়ার উপর।”
বীরেন বলল, “পনেরো দিন এই ঘরে থাকতে হবে?”
সায়ক বলল, “দেখা যাক। এ দেশে ভোট হচ্ছে শুনেছো তো?”
বীরেন মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ।”
সায়ক বলল, “এদেশের ভোট হল সব থেকে বড় জোক। কিছুদিন পরেই দেখা যাবে সেনাবাহিনী আবার দেশের দখল নিয়ে নিয়েছে। কোন কারণ নেই, তবু এরা ভোট করবে। তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি। দেখো।”
সায়ক পকেট থেকে রাওয়ালপিণ্ডির ম্যাপ বের করে মেঝেতে রাখল, “দেখে নাও। তোমাকে তোমার চারপাশ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এতদিনে আশা করি বুঝে গেছো, রাওয়ালপিন্ডি বেশ পুরনো শহর এবং ভীষণ ঘিঞ্জি জায়গা। ঘিঞ্জি এলাকাগুলো আমাদের লুকোবার ক্ষেত্রে যেমন আদর্শ, ধরা পড়ার ভয় এখানেও কোন অংশে কম নেই। এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই রাস্তাটা ধরে বেশ খানিকক্ষণ হাঁটলে তুমি বাস স্ট্যান্ড পাবে। এটা অটো স্ট্যান্ড। রাওয়ালপিণ্ডিতে আমাদের ইমান শেখ ছিল। এখন নেই। এখন লিটারালি কেউ নেই। কবে হবে, তাও জানি না। কিন্তু কূটনৈতিক দিক থেকে রাওয়ালপিণ্ডির গুরুত্ব খুব বেশি।”
বীরেন বলল, “ইসলামাবাদে আমাদের কেউ আছে?”
সায়ক বলল, “আছে। আপাতত যত কম জানবে, তত ভাল।”
সায়ক ম্যাপটা বীরেনের হাতে দিয়ে বলল, “ভাল করে স্টাডি কর। মাথায় ঢুকিয়ে নাও। শত্রু দেশের অপরিচিত শহরের প্রতিটা কোণ চিনে নিতে হবে। অবশ্য শত্রু ভাবতেই হবে এরকম কোন ব্যাপার নেই। আমাদের কাজ হল, আমাদের দেশের উপরে আসা থ্রেটগুলোর থেকে নিজেদের বাঁচানো।”
সায়ক পকেট থেকে একটা দুটো ছোট ফোন বের করল। বীরেনের হাতে একটা ফোন দিল, “আপাতত থাকুক। দুটো নাম্বারই লোকাল। ভুলেও ওদেশে ফোন করতে যেও না।”
বীরেন বলল, “না না। সেটা মাথায় আছে।”
সায়ক মেঝের উপরে বসল। জল দিয়ে শুকনো পাউরুটি খেতে শুরু করল। বীরেনের মনে হল, সায়কের এভাবে এত কষ্ট করে এদেশে থাকার তো কোন দরকার ছিল না। দেশে থেকে স্বাভাবিক একটা কাজ করলে কী এমন যেতো আসতো? তা না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে কাজ করে যাওয়া, দেশের কেউ জানতেই পারছে না একটা ছেলে তাদের জন্য কত বড় আত্মবলিদান দিচ্ছে!
সে ম্যাপটা দেখল। রাজা মার্কেটে থাকার সূত্রে খানিকটা রাস্তা সে চিনেছিল। এবারে আরো ভাল করে ম্যাপটা দেখতে শুরু করল।