১০
দিল্লি এয়ারপোর্ট।
সন্ধ্যে সাতটা। এয়ারপোর্টে পৌঁছে মাথুরের সঙ্গে দেখা হল আশরফের।
কাগজপত্রের কাজ সেরে সিকিউরিটি সেরে অপেক্ষমান যাত্রীদের চেয়ারে বসে আশরফ হাসলেন, “ঘুমটা নষ্ট করলাম, নাকি?”
মাথুর প্রত্যুত্তরে হাসলেন, “একবারে না। যা একটা দিন যাচ্ছে। তবে আশা করছি শেষে গিয়ে খুব একটা খারাপ দিন কাটবে না।”
মাথুর বললেন, “রফিক তাহলে শেরাটনে উঠেছে?”
আশরফ বললেন, “হ্যাঁ। দ্যাট…”
আশরফ চুপ করে গেলেন।
মাথুর হাসলেন, “কবে থেকে ভদ্রলোক হয়ে গেলে তুমি?”
আশরফ চারদিকে তাকিয়ে বললেন, “কী দরকার? অন্য কথা আলোচনা কর।”
মাথুর বললেন, “ঠিক আছে, বুঝেছি।”
বোর্ডিং শুরু হল।
দুজনে প্লেনে তাদের সিটে গিয়ে বসলেন।
মাথুর বললেন, “ভারতীয় কেউ নেই নাকি? সবাই বাংলায় কথা বলছে দেখছি”
আশরফ বললেন, “টুয়েলভ এ বি সি, নাইন্টিন ই এফ, টুয়েন্টি সিক্স এ সি ডি, ফরটি এ বিতে ইন্ডিয়ান আছে। দুজন ব্যবসায়ী, বাকিরা পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রোজেক্টের কাজে যাচ্ছেন। এনটিপিসির লোক।”
মাথুর অবাক হয়ে বললেন, “এগুলো কী করতে জানলে?”
আশরফ ফিসফিস করে বললেন, “রফিক অ্যাক্টিভেট হয়েছে যখন, তখন আমাদের চোখ কান খোলা রাখা শুরু করতে হবে মাথুর। লাস্ট টাইম রফিক অ্যাক্টিভেট হয়েছিল ২৬/১১ তে। দেরাদুনে থেকে সব কন্ট্যাক্ট রেখে জাস্ট ভ্যানিশ হয়ে গেছিল। এবারেও দেশে ঢুকে ঢাকা চলে গেল, আমরা কিছু করতে পারলাম না। বার বার এরকম ইন্টেলিজেন্স ফেইলিওর হচ্ছে, এটা আমাদের লজ্জা।”
মাথুর বললেন, “ধুস। দেড়শো কোটি হতে চলেছে যে দেশের জনবসতি, সেখানে তুমি রফিক কীভাবে আসছে সেসব নিয়ে চিন্তা করছ। ভেবো না। যাক গে, আমি ঘুমালাম। আমার ঘুম পাচ্ছে।”
আশরফ বললেন, “ওকে। শোও।”
প্লেন উড়ল সাড়ে আটটা নাগাদ। মাথুর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আশরফ কফি নিতেই মাথুর পাশ থেকে ঘুম চোখেই বলে উঠলেন, “আমার জন্যেও নেবে। সঙ্গে স্যান্ডউইচও।”
আশরফ হেসে ফেললেন।
মাথুর উঠে স্যান্ডউইচ চিবোতে চিবোতে বললেন, “শুভকে বলে দিয়েছো তো?”
আশরফ বললেন, “কী আর্মস আনতে?”
মাথুর বিরক্ত গলায় বললেন, “না, ধুস! পুরনো ঢাকার কাচ্চি আনতে। সব সময় অ্যাকশন ফিল্ম ভাল লাগে তোমার? আমি তো ওদের আতিথেয়তার কথা ভেবেই ঢাকা যাওয়ার নামে এক পায়ে খাড়া হয়ে গেলাম। প্রতিবার বাংলাদেশ থেকে এসে আমার ওজন বেড়ে যায়।”
আশরফ বললেন, “আজ তোমার জন্য শেরাটনে কন্টিনেন্টাল অপেক্ষা করে থাকবে। কাচ্চি কাল খেও।”
মাথুর ব্যাজার মুখে বললেন, “ধুস। মেজাজটাই মাটি হয়ে গেল।”
আশরফ কফিতে চুমুক দিয়ে ঘড়ি দেখে বললেন, “ল্যান্ডিং এর সময় হয়ে এল। আমাদের আজ কোন কাজ নেই। জাস্ট চেক ইন কর, আর ঘুমিয়ে পড়।”
মাথুর বললেন, “তুমি শিওর, তুমি তাই করবে?”
আশরফ বললেন, “আমার তো ইচ্ছা করছে রফিকের রুমে ঢুকে ওকে গুলি করে মারি। সেটা যদি করতে পারতাম সব থেকে ভাল হত। দুর্ভাগ্যবশত সেটা সম্ভব না। স্যারের কড়া অর্ডার আছে, ওনলি ডেটা কালেকশন এন্ড ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন।”
মাথুর বললেন, “হু, উই ক্যান মেক ইট লুক লাইক অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট।”
আশরফ বললেন, “সারটেনলি।”
মাথুর বললেন, “আর কোন ইনফরমেশন?”
আশরফ চারদিকে একবার তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, “রফিক একজন মেয়ের সঙ্গে ঘুরছে। অনেক ছোট। মেয়েটার বাবার নাম আনোয়ার। কলকাতায় থাকত। এই মেয়েটার কোন হিস্ট্রি নেই। রফিক হঠাৎ করে একে নিয়ে ঢাকা চলে গেল কেন বোঝা যাচ্ছে না।”
মাথুর বললেন, “বিয়ে করবে বা শোবে, আর কী?”
আশরফ বললেন, “নিয়ে বেরিয়েছে মানে খুব ভাল করে জানে এ ইন্ডিয়া ফিরবে না। তার মানে ওই বিয়েই করবে হয়ত। ভালই আছে এরা।”
মাথুর আর আশরফ একসঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেসে উঠলেন।
১১
রাত বারোটা।
তুষার কম্পিউটারে কাজ করছিলেন।
ইরাবতী এসে বললেন, “তুমি ঘুমোবে না? সারা রাতের প্ল্যান আছে আজকে?”
তুষার বললেন, “তুমিই বা জেগে আছো কেন এত রাত অবধি? তোমার তো এত রাত অবধি জেগে থাকা অ্যালাউড না!”
ইরাবতী বললেন, “ঘুম আসছে না। তুমি টেনশড কেন? আবার কিছু হল?”
তুষার বললেন, “মাথুর আর খান বাংলাদেশে। বীরেন পাকিস্তানে যাবে। টেনশন হবে না?”
ইরাবতী বললেন, “আর বাকিরা?”
তুষার বললেন, “তারা তাদের কাজ করছে। কিন্তু আমার খানকে নিয়ে খুব ভয় লাগে আজকাল। কাশ্মীরে আক্রান্ত হবার পর থেকে ওর মধ্যে একটা মরিয়া ব্যাপার দেখতে পারছি যেটা এ কাজের জন্য ঠিক না। ভাবছি খানকে অফিসে বসিয়ে দেব।”
ইরাবতী হাসলেন, “আশরফ নিজে বসতে চাইলে তো!”
তুষারের ফোন বাজতে শুরু হল।
তুষার কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে বললেন, “উফ। এরা যদি একটু বিশ্রাম দেয়।”
ইরাবতী বললেন, “কী হল?”
তুষার ক্লান্ত গলায় বললেন, “পুঞ্চে দুটো ড্রোন ঢুকিয়েছিল। এই মাত্র গুলি করে নামিয়েছে জওয়ানেরা। সম্ভবত লঞ্চ প্যাডে আবার জঙ্গী জড়ো হচ্ছে।”
ইরাবতী শ্বাস ছেড়ে বললেন, “কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান কী করবে? এই কিছুক্ষণ আগেই পাকিস্তানের ইকোনমি নিয়ে পড়ছিলাম। ওরা একটা ভয়াবহ ফেজ দিয়ে যাচ্ছে। লোকে খেতে পারছে না, মাঝে মাঝেই পাওয়ার কাট হয়ে যাচ্ছে। অনেক ধার বেড়ে গেছে দেশটার। কাশ্মীর যদি ওরা পেয়েও যায়, তারপর কী করবে?”
তুষার বললেন, “কাশ্মীর হল পাকিস্তানের কাছে আলাউদ্দিন খিলজির পদ্মাবতী। পেয়ে গেলে কাশ্মীর নিয়ে কী করবে জানে না, কিন্তু চেষ্টা চালিয়েই যাবে।”
ইরাবতী বললেন, “দিন দিন আরো কঠিন পরিস্থিতি তৈরী হচ্ছে।”
তুষার বললেন, “কী করবে? কিছু করার আছে? কেউ জানে না কবে এসব মিটবে। রাজনীতির স্বার্থে দুই দেশের পলিটিশিয়ানরাই এই সমস্যাটাকে জিইয়ে রাখবে। যে সব দেশের বাজেটের বিরাট অংশ শুধু প্রতিরক্ষায় চলে যায়, সে দেশ কীভাবে উন্নতি করবে?”
ইরাবতী বললেন, “রিয়েলি? তাহলে তোমার স্যালারি হবে কী করে মিস্টার তুষার রঙ্গনাথন?”
তুষার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, আবার ফোন বেজে উঠল। ধরলেন। আশরফ ফোন করেছেন। তুষার বললেন, “বল। চেক ইন হল?”
আশরফ বললেন, “হ্যাঁ স্যার। এয়ারপোর্টে অনেকটা টাইম লেগে গেল। হোটেলে এসে অনেক চেষ্টা করেও রফিকের দেখা পাওয়া যায় নি।”
তুষার বললেন, “বেশি চেষ্টা করতে হবে না। আজকের রাতটা নিশ্চিন্তে ঘুমাও। বাকিটা আমি বলে দেব কী করতে হবে। তুমি কোন রকম অ্যাগ্রেসিভ ডিসিশন নেবে না। ক্লিয়ার?”
আশরফ হাসলেন, “স্যার আমাকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকছেন দেখছি আজকাল?”
তুষার বললেন, “হ্যাঁ। তোমাদের ম্যাডামকেও সেটাই বলছিলাম। খান আজকাল পেগলে গেছে। তুমি ঘুমিয়ে পড়। আশা করা যায়, কাল ব্রেকফাস্ট টেবিলে রফিকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। অ্যাস পার আওয়ার ইনফরমেশন, ব্রেকফাস্ট রফিক রুমে নেয় না। সবার সঙ্গেই করে।”
আশরফ বললেন, “ওকে স্যার। পুঞ্চের নিউজটা পেলাম। আশা করব ওরা আর কোন ড্রোন পাঠাবে না।”
তুষার বললেন, “ঠিক আছে। তুমি রেস্ট কর। এসব নিয়ে চিন্তা না করে ঘুমাও। আমি দেখে নিচ্ছি।”
আশরফ বললেন, “ওকে স্যার। গুড নাইট।”
ফোন রাখলেন তুষার। ইরাবতী বললেন, “একটা হল। এবার সায়কের ফোনটা বাকি, তাই তো?”
তুষার বললেন, “আজ সায়ক ফোন করবে না। আমার অন্য কাজ আছে।”
ইরাবতী বললেন, “কী কাজ?”
তুষার বললেন, “আমি জাস্ট বাংলাদেশের ম্যাপটা দেখছিলাম ভাল করে। আই এস আই বাংলাদেশে সক্রিয় হয়ে ওঠা মানে আমাদের আবার ইস্ট করিডরে সিকিউরিটি বাড়িয়ে দিতে হবে। কোন দিকে যে যাব!”
ইরাবতী চোখ বন্ধ করে বসলেন। তুষার আরো কিছুক্ষণ কাজ করে পেছন ফিরে দেখলেন ইরাবতী সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
তুষার আবার কাজে মন দিলেন। এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন বুঝে উঠতে পারেন নি রাত তিনটে বেজে গেছে।
১২
ঢাকা শেরাটন হোটেল।
ভোর ছ’টা। মাথুর ঘুমোচ্ছিলেন। পেটে খোঁচা খেলেন।
উঠে দেখলেন আশরাফ ট্র্যাক স্যুট পরে তৈরী হয়ে গেছেন।
মাথুর বিছানায় উঠে বসে বললেন, “রফিক বেরিয়েছে?”
আশরাফ বললেন, “রফিককেই বেরোতে হবে মর্নিং ওয়াকের জন্য? চল শহরটা টহল দিয়ে আসি। যতটা যাওয়া যায়।”
মাথুর বললেন, “পারলাম না। তুমি যাও আমি ঘুমাবো।”
আশরাফ বললেন, “দেখো মাথুর, তুমি না উঠলে পুরো এক বালতি জল ঢেলে দেবো আমি। উঠবে এবার?”
মাথুর বিরক্ত মুখে হেলতে দুলতে উঠে দাঁত মাজলেন। বাথরুম সেরে বেরিয়ে চেঞ্জ করতে করতে বললেন, “তোমায় এই জন্য আমার সহ্য হয় না। কোথায় এত জার্নি করে এসে একটু ঘুমোতে দেবে তা না, জ্বালাতন শুরু করে দিয়েছো।”
আশরফ বললেন, “চল বেরোই।”
দুজনে বেরোলেন।
মাথুর ফিসফিস করে বললেন, “এত বড় হোটেল, কোন ঘরে ঘুঘু ঢুকে বসে আছে, কে জানে।”
আশরফ বললেন, “সকাল সাতটা থেকে দশটা ব্রেকফাস্ট টাইম। প্রথম দেড় ঘন্টা আমি ব্রেকফাস্ট টেবিলে থাকবো, পরের দেড়ঘন্টা তুমি। রফিককে স্পট করা গেলে তখনই করা যাবে, যদি না…”
মাথুর বললেন, “কী যদি না?”
আশরফ বললেন, “যদি না ঘরে খাবার আনিয়ে খায়।”
মাথুর বললেন, “তুষার স্যার বলছেন রফিক ব্রেকফাস্ট টেবিলে থাকে। সো লেটস সি”
দুজনে রাস্তায় বেরোলেন।
সকাল থেকেই ঢাকার গুলশান এলাকা সচল হয়ে গেছে। মানুষজন রাস্তায় নেমে পড়েছেন। আশরফ বললেন, “ঢাকা আমার খুব ভাল লাগে। প্ৰাণ আছে।”
মাথুর বললেন, “জ্যামও আছে। তবে আমারও দারুণ লাগে। এখানকার খাবার সুপার্ব।”
আশরফ বললেন, “তুমি লাস্ট কবে লিপিড প্রোফাইল করিয়েছিলে হে? দেখেছো কোলেস্টেরল লেভেল টেভেল ঠিক আছে?”
মাথুর জোরে জোরে মাথা নাড়লেন, “ক্ষেপেছো? ওসব দেখা মানেই রেস্ট্রিকশন চলে আসবে। আমি দেখি না।”
আশরফের ফোন বাজছিল।
আশরফ ধরলেন, “হ্যাঁ শুভ। আমরা বেরিয়েছি। তুমি কোথায়? এসে গেছো? ওকে। হ্যাঁ এই তো।”
একটা ইনোভা এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। আশরফ গাড়িতে উঠে পড়ে বললেন, “উঠে পড়।”
মাথুর উঠে বললেন, “ওহ! এই তোমার মর্নিং ওয়াক?”
আশরফ হাসলেন, “যে আগে ঘুম থেকে উঠবে, সেই তো আগে খবর পাবে, তাই না?”
মাথুর শুভকে চিনলেন, “আরে, কেমন আছো?”
শুভ সালাম দিল হাসিমুখে। বলল, “আপনার কাচ্চি হবে আজ মাথুর ভাই।”
মাথুর খুশি হয়ে বললেন, “আর কী চাই?”
গাড়ি খুব কম গতিতে এগোতে শুরু করল। শুভ বলল, “রফিক এই এলাকায় আছে সেটা জানার পরে অনেক রাজাকারদেরই এলাকায় দেখা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে তারা রফিকের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। রফিক খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। তার প্ল্যান অন্য।”
আশরফ বললেন, “কী প্ল্যান কিছু জানা গেল?”
শুভ বলল, “জানোয়ারটার আসার মানে হল দেশের কোন না কোন মাদ্রাসা দখল করে ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হবে। অনেক হুজুরই আছে যারা পাকিস্তানপন্থী। আপনারা আশা করি খুব ভাল করে জানেন, এ দেশের স্বাধীন হওয়া অনেকেই ভালভাবে নেয় নি। এদের মধ্যে একটা বড় অংশ জামাতের সমর্থক। পজিটিভ দিক হল বাংলাদেশের সরকারে জামাতের প্রভাব কম। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী একটার পর একটা রাজাকারকে এই সরকার ধরে ধরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিচ্ছে। দে ডু হ্যাভ গাটস। কোন রকম ছাড়াছাড়ির ব্যাপার নেই। যত বয়সই হোক, আশি, বিরাশী, ধরা পড়লেই তাদের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে।”
আশরফ মাথা নাড়লেন, “এই খবরটা জানি। বাংলাদেশ ইজ ডুইং ট্রিমেন্ডাসলি ওয়েল এগেইন্সট দ্য পাকিস্তানীজ।”
শুভ বলল, “সমস্যা হল রিমোট এরিয়াগুলোতে বাংলাদেশী সরকার অতটা অ্যাক্টিভ হতে পারছে না। নোয়াখালি, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রামের মত এরিয়াগুলোতে ওদের হাতে বেশ কিছু মাদ্রাসা এসেছে যেখানে ওরা ওদের অ্যাক্টিভিটি চালাতে পারছে। জেহাদী কাজকর্ম, ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে মাদ্রাসায় দাখিল করা চলছে।”
মাথুর বললেন, “এ তো ইন্ডিয়াতেও চলতে পারে। সব কি উপর থেকে বোঝা যায়?”
শুভ মাথা নাড়ল, “উহু, ইন্ডিয়াতে ইন্টেলিজেন্স অনেক বেশি স্ট্রং। তবে ইচ্ছাশক্তিটা তো ম্যাটার করে। বাংলাদেশের এই সরকার যতদিন থাকবে, ইন্ডিয়ার বেশি অসুবিধা হবার কথা না। আপাতত রফিককে এক্সপোজ করাটা ফার্স্ট প্রায়োরিটি হতে হবে। আপনাদের কী কী আর্মস লাগবে?”
মাথুর আশরফের দিকে তাকালেন। আশরফ বললেন, “রফিকের রুমে হিডেন ক্যামেরা লাগানো যাবে?”
শুভ অবাক হয়ে আশরফের দিকে তাকিয়ে বলল, “শেরাটনে? ওরে বাবা।”
আশরফ হাসলেন, “এটা আগে করতে হবে। নয়ত হানি ট্র্যাপ। যদিও ও একটা মেয়েকে নিয়ে আছে, ওকে আরো লোভ দেখাতে হবে। কী করে দেখাতে হবে, সেটা আমি ভাবছি। তুমি আপাতত আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দাও। আমাদের এখন ব্রেকফাস্ট টেবিলে ডিউটি।”
শুভ বলল, “ওকে।”
তাদের দুজনকে শেরাটনের সামনে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেল।
১৩
ছত্রপতি শিবাজি টারমিনাস থেকে দুজন মধ্যবয়স্ক লোক ট্যাক্সি নিল। ট্যাক্সি চালক জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবেন?”
একজন বলল, “দয়াসাগর আশ্রমে।”
মিটার চালু হল।
ট্যাক্সি চালক বলল, “তাহলে আমি আপনাদের গুরুভাই। আমাদের পরিবারের সবাই বাবার ভক্ত।”
প্রথম জনই উত্তর দিল, “আচ্ছা।”
ট্যাক্সি চালক বলল, “কোথা থেকে এসেছেন আপনারা?”
দুজন দুজনের দিকে তাকাল।
দ্বিতীয় জন বলল, “দিল্লি থেকে।”
ট্যাক্সি চালক বলল, “আমারও তাই মনে হচ্ছিল। আপনাদের দেখে মুম্বইয়ের বলে মনে হচ্ছে না”
দ্বিতীয় জন সতর্ক গলায় বলল, “কোথা থেকে এসেছি মনে হচ্ছে?”
ট্যাক্সি চালক বলল, “ওই দিল্লিই। দিল্লির লোকজনের ড্রেস আপনাদের মত।”
দুজনে আশ্বস্ত হল।
ট্যাক্সি চালক বলল, “তবে আপনারা টিকিট নিয়ে এসেছেন তো? বাবাজীর আশ্রমে টিকিট ছাড়া ঢুকতে পারবেন না কিন্তু! অনেক ঝামেলা আছে এখন। সিকিউরিটি খুব কড়া হয়ে গেছে। আগের মত চাইলেই এখন ঢুকতে পারি না”
“আছে।”
“ঠিক আছে।”
বক বক করে যাচ্ছিল ট্যাক্সি চালক। প্রথম জন মোবাইল বের করে পকেট থেকে একটা সিম নিয়ে সে মোবাইলে ঢোকাল। নেটওয়ার্ক আসতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। প্রথম জন একটা এস এম এস করে সিমটা আবার ফোন থেকে বের করে নষ্ট করে ফেলল।
দয়াসাগর আশ্রমের গেটের বাইরে দুজনকে নামিয়ে দিয়ে ট্যাক্সি চলে গেল। বিরাট বড় গেট। তার এক কোণে একটা ছোট গেট। একজন গেটের কাছে গিয়ে দুটো টিকিট বের করে দিল।
ছোট গেটটা খুলে গেল।
দুজনে আশ্রমে প্রবেশ করল। অনেকটা অঞ্চল নিয়ে বাগান। ঘাসের বাগিচার উপর সুদৃশ্য ফুল ফুটে আছে। এক প্রান্তে বাবার নাম কীর্তন চলছে। রাস্তার দু পাশে আশ্রমিকরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দুজন হেঁটে মূল আশ্রম বিল্ডিংএর কাছে গেল।
আশ্রমের নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের আটকাল।
এবার দ্বিতীয়জন আরো দুটো টিকিট বের করে তাদের দিল।
নিরাপত্তারক্ষীরা কৌতূহলী চোখে তাদের দুজনকে দেখে নিয়ে তাদের আশ্রমের প্রধান দরজায় নিয়ে গেল। দরজা খুলে গেল।
দোতলা বিল্ডিং।
সিঁড়ি দিয়ে দুজনে উপরে উঠে গেল।
দোতলায় একটাই বড় ঘর। তারা পৌঁছনো মাত্র দরজা খুলে গেল।
হল ঘরে দশটা এসি চলছে। ঠান্ডায় জমাট বেঁধে যাচ্ছে যেন। গোটা ঘরে একজনই বসে আছে সাদা ধুতি, খালি গায়ে।
দয়া সাগর।
দুজনে ঘরে প্রবেশ করলে যারা দরজা খুলেছিল, তারা দরজা বন্ধ করে দিল।
দুজন দয়াসাগরের কাছে গিয়ে বসল। দয়াসাগর চোখ বন্ধ করে ছিল।
একজন দয়াসাগরের গালে চড় কষাল। এবার দয়াসাগর লাফ দিয়ে উঠল, “ইয়া আল্লা, ইতনা জোরসে কিউ মার রহে হো রশিদ?”
রশিদ অর্থাৎ প্রথমজন উঠে দয়াসাগরের গলা টিপে ধরে বলল, “তোকে বলা হয়েছিল স্টেশনে গাড়ি পাঠাবি। পাঠাস নি কেন?”
দয়াসাগর চিঁচিঁ করে বলল, “গাড়ি ছিল না। আমেরিকা থেকে ভক্তরা আসছে। তাদের নিতে গেছে।”
রশিদ দয়াসাগরের পেটে একটা লাথি মেরে বলল, “তোকে এদেশে আমেরিকান মেয়েদের সঙ্গে শোবার জন্য পাঠানো হয়েছিল? তোকে ধর্মগুরু হিসেবে ফান্ডিং কারা করেছিল, সব ভুলে গেছিস?”
দয়াসাগর বলল, “ঠিক আছে। এবার ছাড়ো ইয়ার। দিব্যি ভাল ছিলাম কতগুলো বুরবকের বাবা হয়ে। তোমরা আর ক’দিন দেরী করে আসতে! কী শাহিদ? কেমন আছো?”
শাহিদ চারদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। বলল, “মানতে হবে। তোর ক্ষমতা আছে। নাহ রে রশিদ। এটাকে বেশি মারিস না। ভাল কাজ করেছে।”
রশিদ রাগী চোখে দয়াসাগরকে কয়েক সেকেন্ড দেখে ছেড়ে দিল।
বাবাজী ছিটকে মেঝেতে পড়ে চিঁচিঁ করতে লাগল।
রশিদ বলল, “খাবার আনা। খিদে পেয়েছে। গোস্ত কাবাব আর রুটির ব্যবস্থা কর।”
বাবাজী বলল, “ঠিক আছে। সব হয়ে যাবে। তোমরা বিশ্রাম কর।”
শাহিদ বলল, “সব ইন্তেজাম হয়ে গেছে তো? নইলে তোর ইন্তেকালের ব্যবস্থা হবে।”
বাবাজী বলল, “সব হয়ে গেছে।”
শাহিদ বলল, “তোর বউ বাচ্চাকে দেখতে ইচ্ছা করে না রে? করাচীতে ওরা কেমন আছে, কী করছে, কিছুই জানতে ইচ্ছে করে না আর? ভক্ত দিয়ে কাজ চলে যাচ্ছে?”
বাবাজী মাথা নাড়ল, “ফোন করি তো।”
শাহিদ বলল, “না, ফোন করিস না। তোর বউয়ের সঙ্গে দেখা করে আসছি। তোর কপালে বড় দুঃখ আছে।”
বাবাজী ক্লান্ত মুখে বলল, “আজই ফোন করছি।”
১৪
ইসলামাবাদ এয়ারপোর্ট।
রাত আটটা। সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের একটা বিমান অবতরণ করল।
এয়ারপোর্টের সব প্রসিডিংস পেরিয়ে বীরেন যখন বেরোল, তখন ন’টা দশ। তার সঙ্গে কোন লাগেজ নেই। শুধু একটা ল্যাপটপের ব্যাগ। এয়ারপোর্টের বাইরে একটা লাল রঙের এস ইউ ভি দাঁড়িয়ে ছিল। বীরেন সেটায় উঠল। গাড়ি চলতে শুরু করলে এস ইউ ভির চালক পরিস্কার বাংলায় বীরেনকে বলল, “কোন অসুবিধা হয় নি তো আসতে?”
বীরেন চমকে বলল, “না। আপনিই সায়ক?”
সায়ক বলল, “আজ্ঞে। পাকিস্তানে তোমায় স্বাগত।”
বীরেন বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”
সায়ক বলল, “স্যার ট্যার বলতে হবে না। নাম ধরে ডেকো। শীত লাগছে?”
বীরেন বলল, “না।”
সায়ক বলল, “ভয়?”
বীরেন হাসল, “তা একটু একটু।”
সায়ক বলল, “এ কাজে দুটো জিনিস সামলে চলতে হবে। এক, এদেশে কাউকে বিশ্বাস করে কিচ্ছু বলবে
না। এমন কী আমাকেও বিশ্বাস করবে না। দুই, বাড়ির জন্য মন খারাপ করবে না।”
বীরেন বলল, “আপনার বাড়ির জন্য মন খারাপ করে না?”
সায়ক বলল, “বাড়ি? ভুলে গেছি বাড়ি কেমন দেখতে। পিজা খাও তো? নাকি কাবাব ভাল লাগে?”
বীরেন বলল, “কাবাব।”
সায়ক বলল, “ভরপেট খেয়ে নাও। কাল ভোরে বেরোব।”
বীরেন বলল, “কোথায় যাব?”
সায়ক বলল, “ওহ, আরেকটা কথা। আমি কাল কী করব, আজ তোমাকে বলব না। এর কারণ হল, কোন কারণে তুমি ধরা পড়লে আমাদের প্ল্যান লিক হবার চান্স থেকে যায়। সুতরাং আপাতত বলছি না কোথায়
যাব। তোমার কাজ হবে কাল ভোর তিনটেয় উঠে তৈরী হওয়া।”
বীরেন বলল, “ঠিক আছে।”
সায়ক গাড়িটা একটা ঘিঞ্জি বাজারের বাইরে পার্ক করে বলল, “চলে এসো। ব্যাগটা রেখে এসো না আবার।”
দুজনে নামল।
বীরেন বলল, “গাড়িটা?”
সায়ক হাসল, “থাক। পরে দেখা যাবে।”
বীরেন কিছু বলল না। হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করল। সায়ক একগাদা কাবাব অর্ডার করে বলল, “আমিও অনেকক্ষণ ধরে না খেয়ে রয়েছি। যাক গে, তুষার স্যার ভাল আছেন তো?”
বীরেন চারদিকে দেখছিল।
তার মনে হচ্ছিল সে পুরনো দিল্লির চাঁদনি চকের কোন রেস্তোরাঁতে বসে আছে। কোন পার্থক্য নেই। দুটো দেশ একই ছিল এক কালে। তারপরে সব পাল্টে গেল।
সে বলল, “হ্যাঁ, স্যার ভাল আছেন।”
গরম গরম কাবাব এসে গেছিল। সায়ক বলল, “খেতে শুরু কর। বিখ্যাত গোস্ত কাবাব।”
বীরেন একটা কাবাব মুখে দিল। অসাধারণ স্বাদ। মুখে দিতেই যেন গলে গেল। সায়ক চোখ বন্ধ করে খেতে লাগল। টিভিতে দেখাচ্ছে পেশোয়ারের আফগান সীমান্তে তালিবানরা ঝামেলা করেছিল। পাকিস্তানী সেনা কয়েকজনকে আটক করেছে। করাচীর কাছের একটা গ্রামের গীর্জায় বিস্ফোরণ হয়েছে। আপাতত কোন সংস্থা দায় স্বীকার করে নি।
খাওয়া হয়ে গেলে সায়ক বিল দিয়ে বাইরে বেরিয়ে বলল, “পাকিস্তানে থাকলে এসবে অভ্যস্ত হয়ে যেতে হবে। অবশ্য ওদেশও আজকাল কম যাচ্ছে না। ধর্মের ব্যবসায়ীরা মানুষের ঘা খুঁচিয়ে কাজ হাসিল করে নিচ্ছে। তোমার বাবার জন্য কষ্ট হয় না বীরেন?”
বীরেন বলল, “না। অবিশ্বাস হয় শুধু।”
সায়ক বলল, “রাজাকারদের দেখলে অবিশ্বাস হবারই কথা। এরা একটা দেশে থেকে দেশের মানুষদের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছে। ধর্মান্ধ এবং একইসঙ্গে মনুষ্যত্ববিরোধী। বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ খুনের পিছনে রাজাকাররাই দায়ী ছিল একাত্তর সালে। পাকিস্তান হেরে যাওয়ার পরেও তারা কম সক্রিয় ছিল না। তবে এদের একটা অংশ ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন দেশে। কেউ গুপ্তচর হল, কেউ বা সব ছেড়ে আলাদা জীবন যাপন করতে শুরু করল।”
একটা অটো নিল সায়ক। বীরেন গাড়িটার কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না।
খানিকক্ষণ বাদে একটা জায়গায় এসে অটোটা দাঁড়াল। সায়ক নেমে পড়ল।
এ জায়গাটা ঘিঞ্জি না। ঝকঝকে রাস্তাঘাট।
আরো খানিকক্ষণ হেঁটে একটা বাড়ির দরজা খুলে সায়ক বলল, “চলে এসো। তোমার আগমনের খবর পাঠিয়ে দি স্যারকে এবার। ভদ্রলোক আজ আমার গলা শোনার জন্য নিশ্চয়ই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন।”
বীরেন সায়কের সঙ্গে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল। সায়ক আলো জ্বেলে বলল, “ফর ইওর ইনফরমেশন বীরেন, এই বাড়িটা এক পাকিস্তানী আর্মি অফিসারের। ভদ্রলোক লন্ডন গেছে। আমি দুদিনের জন্য ট্রেস পাসিং করলাম।”
বীরেন হেসে ফেলল। মাথুর ঠিকই বলেছিলেন, সায়কের কোন কাজেই অবাক হওয়া চলবে না।
১৫
সকাল সাড়ে সাতটা। রেস্তোরাঁর ব্যাংকোয়েট সেকশনে ব্যুফে ব্রেকফাস্ট চলছে। ফ্লোরে বেশ ভিড় হয়েছে।
আশরফ একটা প্লেটে ব্রেড অমলেট নিয়ে খুব ধীরে খাচ্ছেন।
“আপনি কি কিছু মনে করবেন, আমি যদি এখানে বসি?”
একজন বেশ সুন্দরী ভদ্রমহিলা আশরফকে প্রশ্নটা করলেন।
আশরফ বললেন, “বসুন।”
ভদ্রমহিলা প্লেট নিয়ে আশরফের সামনে বসে সাহেবী ইংরেজিতে বললেন, “আপনাকে কাল দেখি নি। আপনি কি আজ চেক ইন করেছেন?”
আশরফ খাবারের লাইনের দিকে লক্ষ্য রেখে বললেন, “কাল রাতে এসেছি।”
“ওহ। আমি রুকসার। আমার বাবা বরিশালে থাকতেন। তার বাড়ি ভিজিট করতে এসেছি। আপনি বাংলাদেশী?”
আশরফ রুকসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এত প্রশ্নের উত্তর দিতে ভাল লাগছে না। আমি বুঝেছি। দ্য কোড ইজ লাইফ ইজ বিউটিফুল।”
রুকসার চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস। শুভর কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি স্যার।”
আশরফ বললেন, “আপনি চুপ করে খেয়ে যান। এই কথাগুলোই রফিকের সামনে বলতে হবে। বরিশালে যাবেন, কাউকে সঙ্গী পাচ্ছেন না। ওকে? আমাকে কেন বলে যাচ্ছিলেন? শুরুতে কোড বললেই হত।”
রুকসার চারদিকে তাকিয়ে বলল, “রিহার্সাল দিলাম একটু। আর কিছু না।”
আশরফ বললেন, “শুধু ব্রেড খাবেন আপনি? আর কিছু নিয়ে নিন।”
রুকসার বলল, “ওকে।”
আশরফ শুভকে ফোন করলেন, একবার রিং হতেই শুভ ধরল, “হ্যাঁ স্যার।”
আশরফ বললেন, “এই যে মেয়েটাকে পাঠিয়েছো, বিশ্বস্ত তো?”
শুভ বলল, “ভীষণ জোশ মেয়ে স্যার। চিন্তার কিছু নেই।”
আশরফ বললেন, “জোশ মেয়ে মানে? আমাদের কাজে লাগবে কি না বল। জোশ না কী এসব জেনে কী করব?”
শুভ বলল, “আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি স্যার। ভাববেন না। ও ঠিক সামলে নেবে।”
আশরফ বললেন, “তাহলেই ভাল।”
রুকসার এবার খানিকটা ফল নিয়ে আশরফের সামনে এসে বসল। আশরফ বললেন, “টার্গেট আসে নি।
এলে একইভাবে আলাপ করবেন।”
রুকসার বলল, “স্যার আপনি শাহরুখ খানকে দেখেছেন?”
আশরফ হেসে ফেললেন, “দেখেছি। টিভিতে। কেন?”
রুকসার বলল, “আমার খুব ইচ্ছা শাহরুখ খানের মুখোমুখি হওয়া। অন্তত একটা সেলফি তুলতে পারলে আর বেঁচে না থাকলেও হবে।”
আশরফ বললেন, “তোমার ইংলিশ অ্যাক্সেন্ট খুব ভাল। যাই হোক রুকসার, টার্গেটের সঙ্গে কথা বলার সময় আবার এসব বলতে যেও না।”
রুকসার হাসল। বলল, “ভাববেন না স্যার। আমি ভাল। খুবই ভাল হয়ত। চিন্তা করবেন না।”
পরক্ষণে ফিসফিস করে বলল, “অ্যাকচুয়ালি আপনি ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন বলেই বললাম।”
আশরফ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কাঁচের দরজা ঠেলে রফিক ঢুকল।
আশরফ বেশ কয়েক সেকেন্ড রফিককে দেখে সতর্ক গলায় বললেন, “দ্যাটস হিম। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি রেস্তোরাঁ থেকে। আমাকে রিপোর্ট করবে কী হল।”
রফিক তবসসুমকে নিয়ে রেস্তোরায় প্রবেশ করে কোথাও না বসে সরাসরি টেবিল থেকে প্লেট তুলছিল। আশরফ চুপচাপ ব্যাংকোয়েট থেকে বেরিয়ে রিসেপশনে নিউজপেপারের আড়াল থেকে ব্লু টুথ স্পিকারে মাথুরকে ফোন করলেন, মাথুর আশরফের ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন, উত্তেজিত গলায় বললেন, “শুয়োর স্পটেড?”
আশরফ চারদিক মেপে নিলেন। দুটো সোফা দূরে একজন বিদেশী যুবক খবরের কাগজ পড়ছে। রিসেপশনে দুজন বসে আছে। বেশ খানিকটা দূরে। চাপা গলায় বললেন, “স্পটেড।”
মাথুর চাপা উল্লাস করে উঠলেন। বললেন, “শুভকে বল এক গাড়ি এল এম জি দিয়ে যেতে। রামাধির সিংকে যেভাবে মেরেছিল, এই শুয়োরটাকে সেভাবে মারতে ইচ্ছে করছে।”
আশরফ বললেন, “ঠিক আছে। আমি মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করছি। তুমি বেশি এক্সাইটেড না হয়ে স্যারকে খবর দাও। আমি দেখছি ও কোন ফ্লোরে, কোন রুমে আছে। আর প্ল্যান বি অ্যাক্টিভেটেড।”
মাথুর অবাক গলায় বললেন, “এত তাড়াতাড়ি?”
আশরফ বললেন, “হ্যাঁ, শুভ কর্মঠ ছেলে আমরা তো জানিই। তুমি স্যারকে ফোন কর।”
মাথুর বললেন, “এখনই করছি।”
আশরফ কাগজের আড়ালে বসে রইলেন। মিনিট খানেক পর ব্যাংকোয়েটের কাঁচের দরজা খুলে দেখলেন রফিক আর তবসসুমের টেবিলে রুকসার বসে হেসে গল্প করছে।
আশরফের মুখে হালকা একটা হাসি এসে সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল। তিনি রেস্তোরার দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে আবার কাগজ নিয়ে বসলেন।
১৬
বনগাঁ লোকাল থেকে শিয়ালদা স্টেশনে নেমে লোকটা ভিড়ের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে ফেলল। প্রচন্ড ভিড়। দাঁড়াতে দিচ্ছে না। ট্রেনে ওঠার ভিড় আর ট্রেন থেকে নামার ভিড় এক জায়গায় মিশে গিয়ে ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে দিয়েছে।
স্টেশন এলাকা থেকে বেরনোর দরজায় টিটি দাঁড়িয়ে আছে। অফিস টাইমেও টিকিট চেক চলছে। টিটিকে টিকিট দিয়ে লোকটা হন হন করে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এল।
ভীষণ রোদ। লোকটা একটু ভেবে ফোন বের করল।
সিম পাল্টে ফোন করল। ও প্রান্ত থেকে একজনের গলা ভেসে এল, “কোথায়?”
লোকটা বলল, “শিয়ালদায়।”
“বাহ। তাড়াতাড়িই হল তো! আমি ভাবছিলাম এখনো বনগাঁতেই আছো বুঝি। বর্ডার পেরোতে অসুবিধা হয় নি তো?”
লোকটা বলল, “না।”
“কত গেল?”
“পাঁচ হাজার।”
“ভাল। ট্যাক্সি নিয়ে চলে এসো।”
লোকটা ফোন রেখে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গেল। গন্তব্যের নাম বলতে ট্যাক্সি চালক যে টাকা বলল তাতেই সে রাজি হয়ে ট্যাক্সিতে উঠল।
ট্যাক্সি স্টার্ট নিল। ঘন্টাখানেক পর এক বস্তির সামনে লোকটা নেমে চারদিকে দেখে বস্তিতে ঢুকে হাঁটতে শুরু করল।
মিনিট দশেক হেঁটে একটা ঝুপড়ির সামনে এসে আগের নাম্বারটাই রি ডায়াল করল। ও প্রান্তের লোকটা ধরে বলল, “ঢুকে যাও। দেখেছি।”
লোকটা ঝুপড়িতে প্রবেশ করল।
এক মাঝবয়সী লোক রান্না করছে। তাকে দেখে বলল, “আমার বাথরুমে জল আছে। স্নান করলে করে নাও।”
লোকটা বসে পড়ে বলল, “কোথায় যেতে হবে মল্লিকভাই?”
মল্লিক বলল, “এত তাড়া কীসের হাসান?”
হাসান বলল, “আজকের মধ্যে কাজ হলে ভাল। রমজান ভাই কালকে আবার সিলেট পাঠাবে। পুরো দৌড়ের মধ্যে আছি।”
মল্লিক বলল, “সিলেটে কী কাজ তোমার?”
হাসান বলল, “কাজের কী অভাব আছে? কে একজন লোক এসেছে, মাদ্রাসা খুঁজে বেড়াচ্ছে। তোমার আর কী? ভালই আছো। রান্না করছো, খাচ্ছো। চিন্তাই নেই কোন।”
মল্লিক বলল, “দূর থেকে দেখলে ওরকমই মনে হয়। এখানে কত কিছু বাঁচিয়ে থাকতে হচ্ছে বুঝলে এ কথা বলতে না। বাংলাদেশে আবার চিন্তা কী গো? কী এমন কাজ হয় ওখানে?”
হাসান বলল, “ঠিক আছে। কী করতে হবে বল।”
মল্লিক গ্যাসের আঁচ কমিয়ে হাসান যে খাটে বসে ছিল, তার তলা থেকে একটা ট্রাঙ্ক বের করে একটা প্যাকেট হাসানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এ নাও। এটা নিয়ে ফিরে গেলেই হবে।”
হাসান অবাক হয়ে বলল, “কোথাও যেতে হবে না?
মল্লিক বলল, “কোথায় যাবে আবার? কিছু চেনো নাকি? আমিই ব্যবস্থা করেছি। খেলে খেয়ে যেতে পারো।”
হাসান বলল, “না না। তাহলে আমি চলে যাই।”
মল্লিক বলল, “যাও। আমার কী?”
হাসান বলল, “কাঁধে ঝোলাবার ব্যাগ আছে?”
মল্লিক ব্যাগ বের করে দিল।
হাসান ব্যাগে প্যাকেটটা ভরে নিয়ে বলল, “তাহলে আমি চলি।”
মল্লিক বলল, “এসো।”
হাসান বেরিয়ে একই পথে হেঁটে বড় রাস্তায় এসে ট্যাক্সির জন্য দাঁড়াল।
তার পাশে একটা লম্বা মত লোক এসে দাঁড়িয়ে বলল, “আগুন আছে?”
হাসান বলল, “নাই।”
লোকটা বলল, “সিগারেট খাবেন?”
হাসান বলল, “খাই না।”
লোকটা হাসানের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “কী খাবেন?”
হাসান একটা ঝটকা দিয়ে লোকটাকে সরানোর চেষ্টা করল। হল না। লোকটা তার ঘাড় শক্ত করে ধরেছে। হাসান চিঁ চিঁ করে উঠল, “ছাড়ান দ্যান। আমি কিছু করি নাই।”
লোকটা হাসানকে একটা জোরে চড় মেরে রাস্তায় ফেলে দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বেশ কয়েকজন হাসানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল।
লোকটা বলল, “চল বাবা। অনেক ভাল আদর করব তোকে।”
হাসান বিস্মিত চোখে দেখল মল্লিক ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্তে বিড়ি খাচ্ছে। সে বিড় বিড় করে বলল,
“বিক্রি হইয়া গেসে কাফেরের কাছে।”
মুহূর্তের মধ্যে এন আই এর গাড়িতে হাসানকে তুলে নেওয়া হল। গাড়িতে ওয়্যারলেসে একজন বলছে, “টার্গেট ক্যাপচারড। নেক্সট?”
“সেন্ড হিম টু দিল্লি।”
হাসানের বুকটা ঠান্ডা হয়ে গেল।
১৭
মাথুর হোটেলের রুমে উত্তেজিত ভাবে পায়চারি করতে করতে আশরফকে বললেন, “রফিককে আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারি না। একে তুলে নিয়ে গিয়ে জেরা করলেই তো হত!”
আশরফ হতাশ গলায় বললেন, “তুষার স্যারের ইন্সট্রাকশন নেই। ওয়েট, ওয়াচ এন্ড ফলো আপাতত। চল বেরোই। তাছাড়া এখানে ওদের লোকও আছে। স্যার খুব একটা ভুল ডিসিশন দেন নি।”
মাথুর বললেন, “চল।”
দুজন বেরোলেন। হোটেল থেকে বেরিয়ে খানিকটা হাঁটার পর শুভর গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তারা গাড়িতে উঠলেন।
রুকসার গাড়িতে বসে ছিল। তাদের দিকে তাকিয়ে হাসল।
আশরফ বললেন, “আপাতত শুভর ডেরায় যাওয়া যাক। সেখানেই কথা হবে।”
গাড়ি অনেকটা রাস্তা গিয়ে বুড়িগঙ্গার কাছে দাঁড়াল। নদীর তীরে সার দিয়ে নৌকো দাঁড় করানো।
শুভ পথ দেখিয়ে তাদের একটা নৌকোয় তুললে মাঝি দাঁড় বাওয়া শুরু করল।
শুভ বলল, “এবার বলুন, কী কী চাই।”
আশরফ বললেন, “রুকসার বলুক। কতটা কী পেরেছে।”
রুকসার বলল, “আপাতত রাতে ওর স্যুইটে ডেকেছে।”
আশরফ শুভর দিকে তাকালেন। শুভ বলল, “কোন সমস্যা নেই। ওকে কী করতে হবে বলুন।”
আশরফ বুক পকেট থেকে একটা ছোট চিপ বের করে রুকসারকে বললেন, “এটা সাউন্ড রিসিভার। এটা ওর রুমে ঠিক জায়গায় রাখতে হবে।”
রুকসার চিপটা নিয়ে তার পার্সে রেখে বলল, “হয়ে যাবে। আর?”
মাথুর বললেন, “তুমি যখন রফিকের সঙ্গে কথা বলছিলে, তবসসুমের অ্যাটিচিউড কেমন বুঝলে?”
রুকসার হাসল, “উনি একটুও হিংসুটে নন। খানিকটা রোবোটিক নেচার। উঠতে বললে উঠছেন, বসতে বললে বসছেন টাইপ।”
মাথুর বললেন, “দুজনে একই স্যুইটে আছে?”
রুকসার বলল, “হ্যাঁ।”
শুভ বলল, “যন্ত্র পাতি কী লাগবে?”
মাথুর বললেন, “কিচ্ছু না। আপাতত রুকসার সাউন্ড রিসিভারটা রাখুক। ক্যামেরা ইন্সটলেশনের জন্য সময় লাগবে। হোটেলে পরিচিত কেউ থাকলেই তো হবে না, সিসিটিভি অ্যাক্সেস বন্ধ করা অসম্ভব। রফিকের
প্রতিটা মুভমেন্ট আমাদের রিপোর্ট করতে হবে।”
শুভ বলল, “ঠিক আছে। হয়ে যাবে তাও।”
রুকসার বলল, “মারাত্মক ওম্যানাইজার কিন্তু। আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছিল, যেন কতদিনের পরিচয়। আমি নিজেও খানিকটা অবাক হয়েছি। বয়স কম না এদিকে।”
আশরফ বললেন, “ঠিক আছে। বেস্ট অফ লাক। তুমি সাবধানে যাও।”
আশরফ আরো মিনিট কুড়ি ধরে রুকসারকে বুঝিয়ে দিলেন কী করে রিসিভারটা লুকিয়ে রেখে আসতে হবে। রুকসার পুরোটা বুঝে নিলে শুভ মাঝিকে নির্দেশ দিল নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
শুভ একটা ক্যাবে তুলে দিল রুকসারকে। রুকসার চলে যেতে তারা নদীর পাড়ে চুপ করে দাঁড়ালেন। আশরফের ফোন বাজল। আশরফ ফোনে কয়েক মিনিট কথা বলে শুভকে বলল, “এ দেশ থেকে এক অনুপ্রবেশকারী আজ এন আই এর হাতে ধরা পড়েছে। যেটুকু জানা যাচ্ছে, রফিক বাংলাদেশে নতুন কোন
ঘাঁটি খুঁজে বেড়াচ্ছে যেটা অবশ্যই ভারতীয় সীমান্তের আশে পাশে হবে।”
মাথুর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “সকাল থেকে শুধু মনে হচ্ছে শুয়োরটাকে ঝাঁঝরা করে দিই। কী করব, রফিক ইজ জাস্ট এ পার্ট অফ দেয়ার সিস্টেম। রফিক না থাকলে অন্য কেউ চলে আসবে। অগত্যা বেঁচে থাক!”
আশরফ বললেন, “বাহাত্তর হুর নিয়ে জন্নতে পার্টি করতে হবে বলে তৈরী হচ্ছে, ওর কপাল ভাল আমি ওকে ইন্ডিয়াতে পাই নি। পেলে উপরমহলের কারো কথা শুনতাম না।”
মাথুর বললেন, “রফিক ইন্ডিয়াতে ঢুকল, বাংলাদেশেও থানা গেড়ে বসে গেল, ওরা আবার বড় কিছু প্ল্যান করছে। কী হতে পারে? শুধু মাত্র ট্রেনিং ক্যাম্পে ওদের মন ভরবে বলে তো মনে হচ্ছে না।”
শুভ বলল, “ইসলামিক স্টেট, আই এস আইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বলে একটা কথা শুনেছিলাম। রফিক ওদের হয়ে অপারেট করছে না তো?”
আশরফ বললেন, “সব কিছু হতে পারে। আই এস আই সব খানে আছে। হামাসের সঙ্গেও কাজ করছে, ইসলামিক ব্রাদারহুডেও আছে, কোন কিছু ওরা ছাড়ে না। আরেকটা টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন ছাড়া ওরা কিছুই না।”
শুভ বলল, “আপনারা দুজনে একটা করে রিভলভার ক্যারি করতেই পারেন। ব্যবস্থা করে দেব?”
আশরফ মাথা নাড়লেন, “নাহ, ছেড়ে দাও। আপাতত বসের ইন্সট্রাকশন ফলো করি। পরে দেখা যাবে। বাই দ্য ওয়ে শুভ, রুকসারকে কী বলে নিয়েছো?”
শুভ বলল, “রুকসার বেশ কয়েকটা অডিশনে ফেল করেছে। হিরোইন হতে চায়। ওকে বলা হয়েছে আপনারা নেটফ্লিক্স থেকে এসেছেন। কাস্টিং করবেন। রফিক আপনাদের রাইভাল। ওর ডিটেলস জানার জন্য রিসিভারটা ফিট করে দিয়ে আসতে হবে।”
আশরফ বললেন, “গুড গড়। ও পারবে তো? এটা কি এথিকাল কাজ হল?”
শুভ বলল, “রিসিভারটা রেখে আসা নিয়ে কথা। নিশ্চয়ই পারবে। না পারার কোন কারণ দেখছি না। এথিকসের কোন প্রব্লেম হচ্ছে না যেহেতু ও নিজেই এখানে সব জেনেও কোন আপত্তি করে নি।”
আশরফ চিন্তিত মুখে কাঁধ ঝাঁকালেন, “লেটস সি।”
১৮
হোটেলে ফিরতে তুষার ফোন করলেন আশরফের ফোনে। আশরফ ধরলেন, “বলুন স্যার।”
তুষার বললেন, “রুমে আছো?”
আশরফ বললেন, “হ্যাঁ স্যার।”
তুষার বললেন, “স্পিকারে দাও।”
মাথুর টিভি দেখছিলেন।
আশরফ ইশারা করায় মাথুর টিভি বন্ধ করে দিলেন। আশরফ ফোনটা স্পিকারে দিলেন।
আশরফ বললেন, “বলুন স্যার।”
তুষার বললেন, “শেরাটন থেকে চেক আউট করে যাও।”
আশরফ বললেন, “ওকে স্যার।”
তুষার বললেন, “গুলশানে একটা বাড়ির ব্যবস্থা করা গেছে। তোমরা ওখানে থাকবে। রফিক ওখানে একা নেই। রফিকের সঙ্গে বেশ কয়েকটা রাঘব বোয়াল দেখা করতে আসবে। আই এস আইয়ের দুজন কাল ঢাকা পৌঁছবে। তোমাদের দুজনের মুখ ওদের চেনা। বলা যায় না তোমাদের রফিকও চিনতে পারে। এবার আমাকে বল হোটেল থেকে দূরে থেকে কীভাবে রফিকের সব কাজ জানা যাবে।”
আশরফ বললেন, “সাউন্ড রিসিভার আজ রাতে ইনস্টল হয়ে যাবে, যদি না অন্য কোন সমস্যা হয়।”
তুষার বললেন, “গুড। আর?”
আশরফ বললেন, “আর বলুন, আপনি কী চাইছেন। আপনি যেভাবে বলবেন, আমরা সেভাবে এগোব।”
তুষার বললেন, “দশ মিনিট সময় দাও। আমি আবার ফোন করছি।”
ফোন কেটে গেল।
মাথুর বললেন, “কাল তাহলে শুভকে কাচ্চি বিরিয়ানির কথা বলে দি?”
আশরফ হেসে ফেললেন, “সত্যি, তোমার এতক্ষণে এটা মনে হল?”
মাথুর বললেন, “তো কী মনে হবে? এখানে কাচ্চি আনা সমস্যা বলেই তো খাওয়া হচ্ছে না! একটু তো ভাল মন্দ খেতে চাই। এর বেশি আর কী চেয়েছি?”
আশরফ বললেন, “ঠিক আছে। ঢাকার সব দোকানের খাবার তোমাকে শুভ খাইয়ে দেবে। চিন্তা কোর না।”
মাথুর বললেন, “আই এস আইও ঢাকায় আসছে। কী ব্যাপার বল তো?”
আশরফ বললেন, “রফিক হল বুড়ো ঘুঘু। ও যেখানে থাকবে, সেখানে বড় বড় মাথারা আসবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আজ ডিনার আমরা রুমে করব। স্যার যখন বলছেন আমাদের মুখটা সবার চেনা, তাহলে না বেরনোই ভাল।”
মাথুর বললেন, “তাই হোক।”
আশরফের ফোন বেজে উঠল। তুষার ফোন করছেন। আশরফ ফোনটা স্পিকারে দিলেন, “হ্যাঁ স্যার।”
তুষার বললেন, “একটা ছোট ইউনিট পাঠাচ্ছি। ওরাও তোমাদের সঙ্গে থাকবে।”
আশরফ অবাক হলেন, “ছোট ইউনিট? কেন স্যার?”
তুষার বললেন, “তোমাদের দুজনের পক্ষে বেশি ঝুঁকি হয়ে যাবে। রফিক যদি তার টিম ঢাকায় ডেকে নেয়, তাহলে আমরাও দলে ভারি হয়ে থাকব।”
মাথুর বললেন, “ঠিক আছে স্যার। কতজনের টিম আসবে?”
তুষার বললেন, “চার জনের। শুভকে বলে রাখো, ও একটা মাইক্রোবাস ঠিক করে দেবে। রফিক যদি ঢাকা ছেড়ে সিলেট বা চট্টগ্রামের দিকে যায়, তোমরাও ওকে ধাওয়া করবে।”
আশরফ মাথুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আর যদি রফিককে তোলার সুযোগ পাই? আপনি অর্ডার দিলে যশোর বর্ডার দিয়ে ইন্ডিয়াতে নিয়ে যেতে পারি জানোয়ারটাকে।”
তুষার বললেন, “তার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে। অধৈর্য হচ্ছো কেন?”
আশরফ বললেন, “ঠিক আছে স্যার। ওরা কখন আসবে?”
তুষার বললেন, “আজ রাতে ঢুকে যাচ্ছে। তোমরা আজ রাতে চেক আউট করে যাও। হোটেল থেকে চেক আউট করে দেখবে বাইরে একটা কালো রঙের পাজেরো দাঁড়িয়ে আছে। নাম্বার ঢাকা ক ২৩১২। গাড়িতে উঠে যেও। পৌঁছে দেবে। ইউনিট জয়েন করে গেলে আমাকে মেসেজ করবে।”
আশরফ বললেন, “ওকে স্যার।”
ফোন রেখে দুজনে তৈরী হয়ে ব্যাগ নিয়ে হোটেলে চেক আউট করলেন। হোটেল থেকে বেরোতে মাথুর বললেন, “বাংলায় নাম্বার লেখা। খান তুমি বাংলা পড়তে পারো না?
আশরফ বললেন, “হ্যাঁ। ওই যে গাড়িটা।”
রাস্তার উপরেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনে গাড়িতে উঠতে গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বড়
গেটের সামনে গাড়িটা দাঁড়াল। গাড়িটা হর্ন দিতে গেট খুলে গেল। মাথুর চাপা গলায় বললেন, “এখনই শুভকে ফোন কর। কাচ্চি মাস্ট আজ রাত্রে।”
আশরফ হেসে ফেললেন।
#
বাড়িটা খুব বড়। ঝকঝক করছে ঘরগুলো।
আশরফ দেখে শুনে বললেন, “শেরাটনের থেকেও বেশ বড় ব্যাপার হে। এরকম অবস্থা বাংলাদেশেই সম্ভব। পাকিস্তান হলে কোন গর্তে ঢুকে থাকতে হত।”
শুভ কিছুক্ষণ পরে এসে পৌঁছল। বলল, “সাউন্ড রিসিভার ইন্সটল হয়েছে নাকি দেখে নিন। রুকসার অনেকক্ষণ হল শেরাটনে গেছে।”
আশরফ কানে হেডফোন দিয়ে ফোন চালু করলেন। মাথুর আগ্রহী গলায় বললেন, “দেখি দেখি।”
আশরফ মাথুরকে দিলেন হেডফোনটা। কয়েক সেকেন্ড শুনেই মাথুর তড়িঘড়ি আশরফকে হেডফোনটা ফেরত দিয়ে বললেন, “ধুস! তুমি এটা আমাকে শোনালে?”
আশরফ শুভর দিকে তাকালেন, “রুকসার এখন রফিকের বেডরুমে।”
শুভ বলল, “বুঝেছি। রফিকের বিশ্বাস পেতে ও সবটা পথ যাবে। আপনাকে আগেই বলেছি।”
আশরফ মাথুরের দিকে তাকালেন। মাথুর বললেন, “সবটা নিতে পারি না। এই জানোয়ারটার সঙ্গে এই বাচ্চা মেয়েটাকে পাঠানো…”
শুভ বলল, “কেউ পাঠায় নি। ও নিজে কাজটা করতে চেয়েছে। আপনি এত আপসেট হচ্ছেন কেন? হানি ট্র্যাপ আগে ইউজ করেন নি?”
মাথুর বললেন, “ঠিক আছে। লিভ ইট। রুকসার ঠিক ঠাক ফিরুক, এটাই চাইব।”
আশরফ বললেন, “কাল সকাল থেকে রফিকের লোকজন রুকসারের উপর নজর রাখবে। ওদের র্যাডার রুকসারের উপর অবশ্যই যাবে। আই এস আই ঢুকছে ঢাকায় শুভ। এখানে ওদের কে কে আছে?”
শুভ বলল, “প্রচুর লোক আছে। রাজাকারদের বেশিরভাগই পাকি শুয়োরদের পা চাটার জন্য সব সময় তৈরী। সে বুদ্ধিজীবিই বলুন বা সাধারণ মানুষ। এ দেশে এখনও অবৈধ পাক বীর্যের প্রচুর সন্তান ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
আশরফের ফোন বেজে উঠল।
আশরফ ধরলেন। ও পাশ থেকে ভেসে এল, “স্যার সোহান বলছি। ঢাকায় ল্যান্ড করলাম। আমাকে লোকেশনটা সেন্ড করুন। গাড়ি নিয়ে চলে আসছি আমরা।”
আশরফ বললেন, “শিওর। চলে এসো।”
ফোন রেখে সোহানকে লোকেশন পাঠালেন আশরফ।
শুভ বলল, “ক’জন আসবে স্যার?”
আশরফ বললেন, “চারজন। মানে আমরা ছ’জন।”
শুভ বলল, “ঠিক আছে স্যার। আমি তাহলে খাবারের ব্যবস্থা করছি।”
মাথুর বললেন, “কাচ্চি কবে খাওয়াবে বল তো?”
শুভ হেসে ফেলল, “আজকেই খাবেন?”
মাথুর বললেন, “মন্দ হয় না।”
শুভ বলল, “ব্যবস্থা করছি। আমি ছ’জনের খাবারের ব্যবস্থা করছি। আর হ্যাঁ, আপনারা যখন এই বাড়ি থেকে বেরোবেন, আমাকে একটা মেসেজ করে দেবেন। কখন কার নজর পড়বে সেটা বলতে পারছি না,
তবে একটু দেখে। বাংলাদেশ আপনাদের বন্ধু রাষ্ট্র হলেও সবাই কিন্তু বন্ধু নয়। শত্রুও কম নেই।”
আশরফ বললেন, “জানি। সাবধানে যেও।”
শুভ বেরিয়ে গেলে মাথুর বললেন, “এটা কী হল?”
আশরফ বললেন, “কী?”
মাথুর বললেন, “ঐ মেয়েটাকে রফিকের বেডরুমে পাঠিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল? ওটুকু মেয়ে!”
আশরফ ম্লান হাসলেন, “কেন আমাকে অস্বস্তিতে ফেলছো বল তো? রেহাই দাও প্লিজ।”
মাথুর কাঁধ ঝাঁকালেন।
আশরফ বললেন, “তোমাকে একটা স্ট্যাটস দিই? ৭২ এর যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনারা কয়েক লক্ষ বাংলাদেশী মা বোনকে ধর্ষণ করেছিল। শুধু মাত্র সংখ্যালঘু হিন্দু নয়, মুসলিম মেয়েদেরও। বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটার পর একটা পাকিস্তানী আর্মি যথেচ্ছভাবে রেপ করেছিল ওদের। সেই ক্ষত থেকে বাংলাদেশ এত বছর পরেও উঠে দাঁড়াতে পারে নি। বাঙালিদের একাংশ পাকিস্তানীদের এখনও প্রবল ঘৃণা করে। সেই দুঃস্বপ্ন ভুলবার জন্য ওরা শেষ অবধি যেতে পারে। প্লিজ ট্রাই টু বি এ রোবোট মাথুর সাব।”
মাথুর বললেন, “হু। ঠিক আছে। আমিও বুঝি। তবু মেনে নেওয়া যায় না। কেন জানি না, এই রফিকের নাম শুনলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়।”
আশরফ বললেন, “যারা নিরীহ মানুষদের কোন রকম চিন্তা ভাবনা না করে মেরে ফেলতে পারে, তাদের নাম শুনলে মাথা গরম না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। লিভ ইট। সোহানরা আসুক। আমাদের নেক্সট গেম প্ল্যান তৈরী করতে হবে।”
মাথুর বললেন, “ওকে।”
১৯
রফিকের হাঁফ ধরে যায় আজকাল। তার প্রিয় শিকার বাঙালি মেয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের মেয়েদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের আলাদা আকর্ষণ।
আগে হলে রুকসারের বয়সী মেয়েদের তিন চারজনকে কাবু করে ফেলত। এখন পারল না। নগ্ন রুকসারকে পেয়ে অতি উত্তেজিত হয়ে হাঁফ ধরে গেল। যৌন মিলন শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে গেল।
রুকসার বিদ্রুপের গলায় বলল, “আপনার বয়স হয়ে গেছে।”
রফিক খাটের পাশে রাখা বোতল থেকে জল ঢালল গ্লাসে। এক নিঃশ্বাসে এক গ্লাস জল খেয়ে বলল, “আমাকে সময় দাও। বয়স হয়েছে নাকি বুঝিয়ে দেব।”
রুকসার রফিকের কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, “আপনার স্ত্রী কিছু মনে করছেন না, আমাকে এই ঘরে এনে দরজা বন্ধ করলেন বলে?”
রফিক বলল, “তোমাকে কে বলেছে ও আমার বউ?”
রুকসার ফিক করে হাসল, “ওরও বুঝি আমার মত একা একা দেশ দেখতে ইচ্ছে করেছে?”
রফিক বলল, “ধরে নাও তাই। তুমি কোথায় থাকো যেন? আমি ভুলে গেলাম।”
রুকসার বলল, “বার্লিনে থাকি। তবে আই সোয়ার, আপনার মত হ্যান্ডসাম আমি জার্মানিতে দেখি নি। শুধু জনাব হাঁফিয়ে যান তাড়াতাড়ি।”
রফিক টিভি চালাল। নগ্ন নিম্নাঙ্গের উপরে কম্বল জড়িয়ে নিয়ে বলল, “সিলেট যাবে আমার সঙ্গে? তারপরে না হয় তোমার বরিশালে যাব একদিন?”
রুকসার বলল, “অ্যাজ ইউ উইশ। যাব।”
রফিক খুশি হল, “গুড। নাও ডান্স। ডান্স পারো?”
রুকসার বিনা বাক্যে উঠে পড়ল। বলল, “মিউজিক?”
রফিক রিমোট দিয়ে চ্যানেল পাল্টে মিউজিক চ্যানেলে দিল। কোথাও গান হচ্ছে না। সব খানে বিজ্ঞাপন।
বিরক্ত মুখে রফিক বলল, “নাচতে হবে না। পাশে বস।”
রুকসার রফিকের পাশে বসল। রফিক বলল, “বরিশালের কোথায় তোমার বাড়ি ছিল?”
রুকসার বলল, “শহরেই।”
রফিক বলল, “বাবার নাম কী তোমার?”
রুকসার বলল, “সাহিন আলম।”
রফিক বলল, “হু। তুমি জানো আমি কে?”
রুকসার বলল, “খুব হ্যান্ডসাম একজন পুরুষ। আর কী জানার দরকার আছে কিছু?”
রফিক বলল, “আছে। আমার সম্পর্কে কিছু জানো না তুমি।”
রুকসার হাসল, “আপনি খুব মিস্টিরিয়াস একজন মানুষ।”
রফিক এই কথায় খুশি হল। রুকসারের কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, “হোয়েন আই ফার্স্ট কেম টু দিস এরিয়া, আই ওয়াজ টুয়েন্টি। আমাকে জোর করে পাঠানো হয়েছিল। পাতি সেন্ট্রি ছিলাম। কাজ ছিল গ্রামে গ্রামে রেবেল খুঁজে বেড়ানো। আর আমরা কী করতাম জানো? গ্রামের মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতাম।”
রুকসার জোর করে হেসে উঠল খিলখিল করে, “তারপর কী করতেন?”
রফিক বলল, “এক্সপেরিমেন্ট। আমার কাজ ছিল এক্সপেরিমেন্ট করা। রাজশাহীতে একটা মেয়ের খোঁজ পেয়েছিলাম, যার কাছ ছিল আমাদের বাহিনী সে এলাকার বাইরে এলেই মুক্তিবাহিনীকে খবর দিত। সে মেয়েটার ভারি মজার হাল করেছিলাম আমরা।”
রুকসার স্বাভাবিক গলায় বলল, “কী করেছিলেন?”
রফিক বলল, “ফিফটি মেন, ওয়ান টিনেজ গার্ল। উই রেপড হার টিল হার লাস্ট ব্রেথ। তারপর ওর যৌনাঙ্গে পাথর গুঁজে দিয়ে গ্রামের বাইরে গাছে ওর বড়ি টাঙিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা ছিলাম বাঙালিদের ত্রাস। আমার নামে কাঁপত ইস্ট পাকিস্তান।”
রুকসার বলল, “আপনি আর্মিতে ছিলেন? হাউ ইন্টারেস্টিং। আমার বাবাও পাকিস্তান সাপোর্টার ছিল।”
রফিক বলল, “একজন সাচ্চা পাকিস্তানীর তাই তো হওয়া উচিত। আমি এখনো এই দেশটাকে বাংলাদেশ বলি না। ইস্ট পাকিস্তানই বলি। দুনিয়া জুড়ে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হবে আর ইস্ট পাকিস্তান সেখানে পিছিয়ে থাকবে, তা হয় নাকি?”
রুকসার বলল, “হয় না। আমি আপনাকে সাপোর্ট করি।”
রুকসার রফিকের কান কামড়ে তাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করল।
রফিক রুকসারকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল, “লুক গার্ল, আমার বয়স হয়েছে। কিন্তু আমার পৌরুষের বয়স এখনো হয় নি। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, এর প্রমাণ তোমাকে দেবোই আমি। নাও লেট মি স্লিপ। আমার অনেক কাজ আছে কাল।”
রুকসার বলল, “জি জনাব। যেমন আপনার মর্জি।”
রফিক রুকসারের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
রুকসারের ঘুম এল না। তার দু চোখ জ্বলছিল।