ব্যোমকেশ তপাদারের ডায়েরি

ব্যোমকেশ তপাদারের ডায়েরি

১১ অক্টোবর, পর্টোপ্রিন্স

রিপাব্লিক অফ হাইতি৷

আজ ভোরের ফ্লাইটে এদেশে এসে পৌঁছেছি ইন্ডিয়া থেকে৷ পথে দু’বার কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে হল৷ যদিও টিকিট ইত্যাদির ব্যবস্থা এখানকার বিজ্ঞান কংগ্রেসের আয়োজক সংস্থা ‘ক্রিয়োল সাইন্স সোসাইটি’ করে দিয়েছিল তবুও বার বার ফ্লাইট চেঞ্জ করা বেশ ঝামেলার ব্যাপার৷ হাইতিতে এই প্রথম এলাম৷ বিজ্ঞান কংগ্রেসে আমি আমার সাম্প্রতিকতম গবেষণা সম্বন্ধীয় পেপার পড়ব৷ অধিবেশন শুরু হবে দু-দিন পর৷ কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেহেতু বিজ্ঞানীরা বহুপথ অতিক্রম করে এখানে আসছেন, তাই যাতে তাঁরা ভালো করে বিশ্রাম নিয়ে অধিবেশনে যোগ দিতে পারেন সেজন্য আয়োজকরা দু-দিন আগেই সবাইকে এখানে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন৷ সে মতোই দু-চারজন ছাড়া সবাই আজই এখানে চলে এসেছেন বা রাতের মধ্যেই চলে আসবেন৷ এই বিজ্ঞান কংগ্রেসের আলাদা একটা মজা আছে৷ সাধারণত বিজ্ঞান কংগ্রেসগুলোতে বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট বিভাগভিত্তিক আলোচনা হয়৷ কোথাও পদার্থবিদ্যা, কোথাও রসায়নবিদ্যা, মহাকাশবিদ্যা বা জীববিদ্যা এসব ব্যাপার, বা আরও ভালোভাবে বলতে গেলে এইসব বিভাগের নির্দিষ্ট শাখাপ্রশাখা নিয়ে৷ কিন্তু এখনকার এই কংগ্রেসে বিজ্ঞানের যেকোনো শাখার যেকোনো বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণাপত্র বা পেপার পাঠ করতে পারবেন৷ এই যেমন আমি উদ্ভিদবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণাপত্র পাঠ করব৷ জার্মানি থেকে আসা অটোভান নিশ্চয়ই পাঠ করবেন রসায়ন শাস্ত্র সংক্রান্ত, ঘানার কোম্বাটু বক্তৃতা দেবেন পদার্থবিদ্যা বিষয়ক কোনো ব্যাপারে৷ আর প্রেইরির নাম এবং তাঁর দেশের নাম সবারই জানা৷ পৃথিবীর নামজাদা বৈজ্ঞানিকদের একটা অংশই তাঁর দেশে থাকেন গবেষণার সুবিধা অথবা ডলারের জন্য৷ প্রেইরি নিজে যথেষ্ট ধনী৷ তিনি ব্যক্তিগত একটি ছোটো বিমানে এখানে এসেছেন৷ নিজেই চালিয়ে এসেছেন সেই বিমান৷ শেষ বিকালে হাইতির রাজধানী পর্টোপ্রিন্সের এক বিরাট রিসর্টের সবুজ ঘাসে ছাওয়া লনে বসেছিলাম আমরা৷ আমরা মানে, আমি, প্রেইরি, কোম্বাটু, অটোভান৷ আমরা সবাই সকলের পূর্ব-পরিচিত৷ তাই একসঙ্গে বসা৷ অপেক্ষাকৃত তরুণ বৈজ্ঞানিকদের একটা দলও আমাদের কিছুটা তফাতে বসে আছে৷ বয়স অথবা নিজেদের পরিচিত পরিমণ্ডলে বসে সাধারণত কথা বলতে পছন্দ করে সবাই৷

আমাদের দলটার নিজেদের মধ্যে একসঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে ব্রাসেলসের এক বিজ্ঞান কংগ্রেসে৷ তারপর বিক্ষিপ্ত ভাবে এক-একজনের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে৷ এত বছর পর একসঙ্গে দেখা হওয়াতে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা৷ শুধু বিজ্ঞান নয়, রাজনীতি, সামাজিক অবস্থা, এমনকি বর্তমানের শিল্প-সংস্কৃতিও ছিল আমাদের আড্ডার বিষয়বস্তু৷

বেশ আড্ডা চলছিল, এমন সময় আমাদের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন ক্যারফু৷ এদেশের পঁচানব্বই শতাংশ মানুষের মতো তিনিও আফ্রিকার বংশোদ্ভূত৷ ক্যারফু নিজে একজন পদার্থবিজ্ঞানী, আর এই বিজ্ঞান কংগ্রেসের আয়োজক সংস্থার সভাপতি৷ তিনি আমাদের পাশে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, ‘নক্ষত্রমণ্ডলীদের মাঝে বসার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না৷ আপনাদের কারো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’

আমরা প্রায় সবাই বললাম, না হচ্ছে না৷ শুধু অটোভান বললেন, দোতলা থেকে তাঁর ঘরটা একতলায় দিলে ভালো হয়৷ যদিও লিফট আছে, তবুও বৃদ্ধ বয়সে একতলা- দোতলা ওঠানামা একটু অসুবিধাজনক৷

ক্যারফু জবাবে বললেন, ‘ঠিক আছে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি৷’ তারপর বললেন, ‘এখন আবার আমাকে সরকারের বিজ্ঞানমন্ত্রকে যেতে হবে৷ অতিথি-অভ্যাগতদের নামের তালিকা আগেই জমা দিয়েছি সেখানে৷ একজন বিজ্ঞানী অসুস্থ বলে শেষ মুহূর্তে আসতে পারছেন না জানিয়েছেন, তবে তিনি তাঁর পেপার পড়ার জন্য তাঁর সহকর্মীকে এখানে পাঠিয়েছেন৷ ভদ্রলোক এসে গেছেন৷ তাঁর নামটা মন্ত্রকে জমা দিতে যাচ্ছি৷’

কোম্বাটু জানতে চাইলেন, ‘কে আসতে না পেরে প্রতিনিধি পাঠালেন? আমাদের পরিচিত কোনো বিজ্ঞানী?’

ক্যারফু জবাব দিলেন, ‘আপনাদের ব্যক্তিগত পরিচিত কি না জানি না, তবে নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন৷ তিনি ম্যাকিনলে৷’

নাম শুনে আমি বলে উঠলাম, ‘রোবট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ম্যাকিনলের সঙ্গে শেষ আমাদের দেখা হয়েছিল ব্রাসেলস-এ সেই বিজ্ঞান কংগ্রেসে৷’

ক্যারফু বললেন, ‘হ্যাঁ, রোবট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিজ্ঞানী ম্যাকিনলে৷ উনি তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে রসো হেগার্ড নামে একজনকে পাঠিয়েছেন৷ তিনি একজন অল্পবয়সি ভদ্রলোক৷’

ক্যারফুর জবাব শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রেইরি সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘ম্যাকিনলে! সেই কিউবান ধাপ্পাবাজ? তার এখানে আসার কথা ছিল! সে না-এসে ভালোই করেছে৷ ব্রাসেলসের মতো সে এখানে এলে এবারও তাকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দিতাম৷ দেখি তার প্রতিনিধি কী বলে?’

ক্যারফু তাঁর কথা শুনে একটুখানি থতমত খেয়ে বললেন, ‘আমি সামান্য মানুষ, আপনাদের মতো বড়ো বড়ো বিজ্ঞানীরা নিজেদের কাজের ঠিক-ভুল বুঝতে পারেন৷ এ ব্যাপারে আলোচনার ধৃষ্টতা আমার নেই৷ তাড়াতাড়ি যেতে হবে৷ নইলে মন্ত্রক বন্ধ হয়ে যাবে৷’ সম্ভবত ম্যাকিনলে সম্পর্কে বিতর্ক এড়াবার জন্যই ক্যারফু এরপর তাড়াতাড়ি চলে গেলেন৷

প্রেইরি, ক্যারফু চলে যাবার পর ম্যাকিনলে সম্বন্ধে আবার মন্তব্য করলেন, ‘মিথ্যাচারী, ধাপ্পাবাজ! বলে কিনা যন্ত্রের মধ্যে সব মানবিক অনুভূতি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব৷ এরপর সে হয়তো একদিন বলবে এই কাঠের চেয়ার-টেবিল, ঘরবাড়িগুলোর মধ্যেও প্রাণপ্রতিষ্ঠা সম্ভব! আসলে সমাজতান্ত্রিক দেশের লোকেরা এসব নানা মিথ্যা প্রচার করে৷’

প্রেইরির কথায় আমার মনে পড়ে গেল ব্রাসেলস-এর ঘটনাটা৷ বিজ্ঞানী ম্যাকিনলের গবেষণার বিষয়বস্তু হল ‘রোবট’ অর্থাৎ যন্ত্রমানবের মধ্যে মানবিক অনুভূতির প্রকাশ সংক্রান্ত ব্যাপার৷ হ্যাঁ, এ কথা ঠিকই যে যন্ত্রমানবের মধ্যে মানবিক অনুভূতির, অর্থাৎ, দুঃখ, সুখ, ভয়, আনন্দ এসবের প্রকাশ ঘটানো যায় কি না তা নিয়ে রোবট ইঞ্জিনিয়াররা বিভিন্ন পরীক্ষা করেছেন৷ চিন এ ব্যাপারে এক ধাপ এগিয়েও গেছে৷ তাদের এক যন্ত্রমানবের চোখে একটা লেন্স বসানো আছে৷ সে সেই চোখ দিয়ে দেখা চারপাশের ঘটনা কিছুটা বিশ্লেষণ করতে পারে৷ ব্যাস এ পর্যন্তই এ ব্যাপারে বিজ্ঞানের অগ্রগতি৷ কিন্তু ব্রাসেলসের সম্মেলনে ম্যাকিনলে দাবি করে বসলেন, লেন্সের মাধ্যমে চিনা রোবটের পারিপার্শ্বিক ঘটনা বিশ্লেষণ তো সামান্য ঘটনা৷ যন্ত্রমানবের মধ্যে পরিপূর্ণ মানবিক গুণ সঞ্চারিত করা যায়৷ ভালোবাসা, ঘৃণা, দুঃখ, আনন্দ সবকিছু তার মধ্যে থাকতে পারে! প্রেইরি এ কথাটা শোনার পর ব্রাসেলসের সেই সম্মেলন মঞ্চে ব্যাপারটা নিয়ে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসেছিলেন ম্যাকিনলেকে৷ প্রেইরি রাজনৈতিকভাবে তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী, সেজন্যই হয়তো তিনি বললেন, ‘যন্ত্রমানবের মধ্যে প্রোগ্রামিং ছাড়া কখনও এসব সম্ভব নয়৷ হয় আপনি বিষয়টি ব্যাখ্যাসহ প্রমাণ করুন, অথবা বক্তব্য প্রত্যাহার করুন৷’ একদল বিজ্ঞানী সঙ্গে সঙ্গে প্রেইরির বক্তব্য সমর্থন করলেন৷ কিন্তু ম্যাকিনলে তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে কোনো প্রমাণ হাজির করলেন না, ব্যাপারটা কী ভাবে সম্ভব তার বিস্তৃত ব্যাখ্যাতেও গেলেন না৷ কাজেই এরপর একটা হই-হট্টগোল শুরু হয়৷ কার্যত অপমানিত হয়ে ম্যাকিনলেকে সেবার সভামঞ্চ ছাড়তে হয়েছিল৷ তবে মঞ্চ থেকে নামার আগে তিনি প্রেইরিকে একটা কথা বলেছিলেন, ‘কেউ না বুঝলেও ব্যাপারটা আমি বুঝতে পেরেছি৷ আমাকে যাই বলো আমি তোমার ফাঁদে পা দেব না৷’ ম্যাকিনলে এ-কথা তাঁকে কেন বলেছিলেন তা অবশ্য আমার জানা নেই৷ প্রেইরিকে কথাটা জিগ্যেস করা আমার উচিত হবে না, আর ম্যাকিনলেকে জিগ্যেস করার সুযোগ হয়নি৷ কারণ, ম্যাকিনলে সভাস্থল ছেড়ে হোটেল থেকে মানপত্র নিয়ে সোজা হাঁটা দিয়েছিলেন এয়ারপোর্টের দিকে৷ গত পাঁচ বছরের মধ্যে তাঁর সঙ্গে আমার আর কোনো যোগাযোগ হয়নি৷ শুনেছি ম্যাকিনলে নাকি ওই ঘটনার পর বিজ্ঞানীমহলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন৷ কোনো সভা-সমিতিতেও আর যান না৷ কোনো বিজ্ঞানী ফোন করলে লাইন কেটে দেন৷ এতদিন পর ম্যাকিনলের নাম শুনে বেশ কৌতূহলী হলাম আমি৷ তবে বিশেষত প্রেইরির উপস্থিতিতে ম্যাকিনলে প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা উত্থাপিত করা সঙ্গত মনে করলাম না৷ যাই হোক এরপর আমরা অন্য আলোচনায় মনোনিবেশ করলাম৷ আগামীকাল আমরাও জায়গাটা ঘুরে দেখব৷ সে বিষয়ে আলোচনায় মন দিলাম৷

সূর্য ডুবল একসময়৷ এবার রুমে ফিরতে হবে৷ আমি একটু ঝুঁকে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছি ঠিক সেই সময় কোম্বাটু বললেন, ‘আরে তোমার পেনডেন্টটা তো খুব সুন্দর! আজকাল তুমিও ফ্যাশানেবল হয়ে উঠছ৷’ অন্যরা হেসে উঠল তাঁর কথায়৷ আমি হাসলেও ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলাম৷ আমি কোনো অর্নামেন্ট পরি না৷ একটা আংটি পর্যন্ত নয়৷ আসলে সোনার হার আর এই লকেট বা পেনডেন্টটা সম্প্রতি আমি ধারণ করেছি অন্য কারণে৷ ওই পেনডেন্টের মধ্যে একটা মাইক্রোচিপ আছে, যাতে রাখা আছে আমার সাম্প্রতিক গবেষণার খুঁটিনাটি বিস্তৃত বিবরণ৷ এটা আমি আমার কলকাতার বাড়িতে রেখে আসতে ভরসা পাইনি৷ কয়েক বছরের মধ্যে আমার অনুপস্থিতিতে বার তিনেক চোরেরা হানা দিয়েছিল আমার বাড়িতে৷ তারা কিছু টুকিটাকি জিনিস নিয়ে পালালেও আমার কেন জানি না মনে হয়, তারা অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে হানা দিয়েছিল আমার বাড়িতে৷ হয়তো তাদের লক্ষ্য ছিল আমার গবেষণা সংক্রান্ত কিছু হস্তগত করা৷ যাই হোক কোম্বাটুর কথা শুনে আমি বললাম, ‘এই মাছের আকৃতির পেন্ডেন্ট সহ এই সোনার হারটা আমার এক বন্ধু উপহার হিসাবে আমার গলায় পরিয়ে দিয়েছেন৷ কলকাতা এয়ারপোর্টে বহুদিন পর তাঁর সঙ্গে দেখা হল এখানে আসব বলে ফ্লাইট ধরার সময়৷ এটা আর খোলা হয়নি৷’ অটোভান বললেন, ‘খুব সুন্দর লকেট৷ বেশ লাগছে৷ ওটা খোলার আর দরকার নেই৷ তোমার বন্ধু বেশ পয়সাওলা লোক বলতে হবে৷ এত দামি জিনিস গিফট করলেন!’

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ অন্যরাও উঠে দাঁড়ালেন রুমে ফেরার জন্য৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই রিসর্টের রুমে ফিরে এলাম৷ দরজা বন্ধ করে গলা থেকে মাছ আকৃতির লকেটটা খুলে মাছের ডানচোখ চেপে দিতেই মাঝখান থেকে লকেটটা ফাঁক হয়ে গেল৷ হ্যাঁ, মাইক্রোচিপটা ভেতরেই আছে৷ যাতে ধরে রাখা আছে আমার দীর্ঘদিনের পরীক্ষালব্ধ গবেষণা৷ আমার গবেষণা উদ্ভিদের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত ব্যাপারে৷ আমি এখন একটা ব্যাপার আবিষ্কার করতে পেরেছি যাতে ছোটো ছোটো উদ্ভিদ অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে বংশ বিস্তার করতে পারবে পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে অভিযোজিত করে নিয়ে৷ এর জন্য তাদের বিশেষ কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হবে না৷ ধরা যাক ধান বা গমের ক্ষেত্রে আমার গবেষণা প্রয়োজন করা হল৷ সেক্ষেত্রে একই ধরনের বীজ ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে চাষ করা যাবে৷ অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বৃদ্ধি পাবে সেই চারা৷ একটি গাছের থেকে তৈরি হবে অনেকগুলি চারাগাছ৷ ফসল ফলাবে এত কম সময়ে যা কল্পনার অতীত৷ যে সব দেশে খাদ্য বা চাষের অপ্রতুলতা থাকে সেখানে আমার গবেষণা অত্যন্ত কার্যকরী হবে৷ যে কোনো পরিবেশেই তারা বংশবৃদ্ধি করতে পারবে৷ আজকাল সাহারা মরুভূমিতে সবুজায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ আমার এই আবিষ্কার যদি সেখানে প্রয়োগ করা হয় তবে এক দশকের মধ্যেই সাহারা সবুজে পরিণত হবে৷ সবচেয়ে বড়ো কথা, আমার নিজের দেশেও তো বহু মানুষ অনাহারে থাকেন৷ পেটেন্ট করার পর আমার এই গবেষণাপত্র আমাকে নিজের দেশের হাতে তুলে দিয়ে মাতৃভূমির ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করার চেষ্টা করব৷ বিজ্ঞান কংগ্রেসে আমি এ বিষয় গবেষণাপত্র পাঠ করলেও গবেষণার গূঢ় তত্ত্ব ফাঁস করব না৷ আসল রহস্য জেনে গিয়ে তার পেটেন্ট কোনো বিজ্ঞানী আগেই করিয়ে নিতে পারেন৷ এমন মাঝেমধ্যে হয়৷

লকেটটা গলায় পরে নিয়ে আমার বক্তৃতা খসড়া তৈরি করার জন্য কাগজ নিয়ে বসতে যাচ্ছি ঠিক সেই সময় দরজার বাইরে কেমন যেন একটা শব্দ হল৷ কেউ যেন দরজা খোলার চেষ্টা করছে৷ আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম একজন ভদ্রলোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন৷ তাঁকে অবশ্য লোক না বলে ছেলে বলাই ভালো৷ বয়স সম্ভবত পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে৷ একমাথা কালো চুল৷ তামাটে গাত্রবর্ণ, মেদহীন ছিপছিপে৷ বেশ সুন্দর দেখতে৷ হাতে ধরা আছে একটা চাবি৷ আমাকে দেখে সে বেশ অপ্রস্তুত ভাবে বলল, ‘মাফ করবেন৷ আমি ভুল করে চাবি দিয়ে এটা আমার ঘর ভেবে দরজা খুলতে যাচ্ছিলাম৷’

আমি একটু বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘আপনার পরিচয়টা?’

পাছে আমি তাকে চোর ইত্যাদি না ভাবি তাই সে তাড়াতাড়ি জবাব দিল, ‘এখন বুঝতে পারছি আপনার পাশের ঘরটা আমার৷ দুটো দরজা পাশাপাশি হওয়াতে গুলিয়ে ফেলেছিলাম৷ আমিও এই বিজ্ঞান কংগ্রেসে বলতে এসেছি৷ আমার নাম হেগার্ড, আমি বিজ্ঞানী ম্যাকিনলের হয়ে এখানে বলতে এসেছি৷’

সভাপতি ক্যারফু তবে এর কথাই বলেছিলেন৷ আমি করমর্দনের জন্য তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘আপনার কথা আজ বিকালেই শুনলাম৷ ম্যাকিনলেও আমার বিশেষ পরিচিত৷ অবশ্য দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি৷ কেমন আছেন তিনি?’

ছেলেটি জবাব দিল, ‘ডক্টর ম্যাকিনলের মুখে আমি আপনার নাম শুনেছি৷ তিনি আপনাকে শ্রদ্ধা করেন৷ এমনি শারীরিক দিক দিয়ে তিনি ভালোই আছেন৷’

ম্যাকিনলের তরুণ সহকারী এরপর আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে বলল, ‘আমি এবার ঘরে ঢুকছি৷ আবার দেখা হবে৷’

আমি বললাম, ‘কাল তো প্রতিনিধিদের সবাইকে এখানকার দ্রষ্টব্য জায়গা ঘুরিয়ে দেখার ব্যবস্থা করানো হয়েছে৷ আপনি গেলে কাল ভোরেই আবার দেখা হচ্ছে৷’

সে সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, যাব৷’ তারপর পাশের দরজা চাবি দিয়ে খুলে ভিতরে ঢুকে গেল৷ আর আমিও আবার দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে লিখতে বসলাম৷

১২ অক্টোবর

 ভোরবেলায় আয়োজকদের দেওয়া বাসে করে আশেপাশের জায়গাগুলো একটু দেখে নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লাম আমরা৷ সব মিলিয়ে জনা কুড়ি বিজ্ঞানীর একটা দল৷ বাসে উঠেই খেয়াল করেছিলাম একদম শেষ দিকের আসনে গতকালের সেই হেগার্ড ছেলেটা বসে আছে৷ আমাকে দেখে সে হাসল৷ আমিও হাসলাম তাকে দেখে৷ আমি সামনের দিকে একটা আসনে বসার পর আমার পাশে প্রেইরি এসে বসলেন৷ কোম্বাটু, অটোভান বসলেন আমাদের ঠিক পিছনের আসনে৷ বাস চলতে শুরু করল৷

বাস চলতে শুরু করার পরই একজন সুবেশী তরুণী গাইড আমাদের উদ্দেশে মাইক্রোফোনে এ দেশটা সম্বন্ধে বিবরণ দিতে শুরু করলেন—‘আরাওয়াক’ বা নেটিভ আমেরিকানদের এই দ্বীপে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাস এসে পৌঁছেছিলেন৷ সে-সময় নেটিভ আমেরিকানরা এ দেশকে ডাকত ‘আইতি’ অর্থাৎ ‘পর্বতময় দেশ’ নামে৷ আইতি শব্দ থেকেই হাইতি নামের উৎপত্তি৷ কলম্বাস এ দেশ আবিষ্কার করার পর স্পেনীয়রা এ দেশে এসে এখানকার অধিবাসীদের স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করে হাইতিকে স্পেনীয় উপনিবেশে পরিণত করে৷ আটলান্টিক মহাসাগরের হিসপানিওলা দ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত এই দেশ স্পেনীয়দের থেকে তারপর দখল নেয় ফরাসি জলদস্যুরা৷ অতঃপর ফরাসি সরকার চাষবাস ও অন্যান্য কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য আফ্রিকা থেকে ব্যাপকহারে ক্রীতদাসদের আমদানি করতে থাকে এ দেশে৷ এক সময় কালো মানুষরাই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং ফরাসি প্রভুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ঔপনিবেশিক শাসন মুক্ত হয়৷ এজন্য হাইতিকে বলা হয় ‘কালো মানুষদের প্রথম স্বাধীন দেশ’৷ বর্তমানে ৮০ লক্ষ জনসংখ্যার এই দেশের সরকারি ভাষা ফরাসি ও ক্রিয়োল৷ অধিকাংশ মানুষ ধর্মে রোমান ক্যাথলিক৷ ৯৫ শতাংশ মানুষ কালো হলেও প্রশাসনিক কাজকর্মে সংকর মুনোঠাদের প্রাধান্য বেশি৷ এ দেশের উচ্চতম শৃঙ্গ ‘লা-সল’, প্রধান নদী ‘আর্তিবোনিত’৷ ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসিরা পর্টোপ্রিন্স নগর গড়ে তোলে৷ বেশ কয়েকবার আগুন ও ভূমিকম্পে এ শহর ধ্বংস হয়৷ পটোপ্রিন্সই বর্তমানে দেশের রাজধানী ও এ দেশের প্রধান বাণিজ্য নগরী ও বন্দর…’

গাইডের কথা শুনতে শুনতে বাসের জানলা দিয়ে সকালের সূর্যস্নাত সবুজ বনানী ঘেরা চারপাশের পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম৷

আমাদের প্রথমে হাজির করানো হল পর্টোপ্রিন্স টেকনিকাল ইনস্টিটিউটে৷ সেখানে আমাদের একটা সংবর্ধনার ব্যবস্থাও ছিল৷ তারপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ‘ন্যাশনাল প্যানথিয়ন মিউজিয়ামে’৷ সেখানে হাইতির প্রাচীন অধিবাসী নেটিভ আমেরিকানদের বিভিন্ন যন্ত্র, স্পেনিয়ার্ড ও ফরাসিদের বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখা আছে৷ মিউজিয়ামে একটা জিনিস দেখে পুলকিত হলাম৷ তা হল চামড়ার ওপর আঁকা একটা প্রাচীন সামুদ্রিক মানচিত্র বা চার্ট৷ ওটি নাকি স্বয়ং কলম্বাসের সম্পত্তি ছিল৷ এমন হতে পারে ওটি নিজেই বানিয়েছিলেন কলম্বাস! কাচের আধার-বন্দি সেই মানচিত্রের সামনে দাঁড়াতেই ইতিহাস যেন ছুঁয়ে গেল আমাকে৷ আমার পাশে দাঁড়ানো অটোভানও পুলকিত হয়ে সে জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এইসব ইতিহাসের নিরিখে, সময়ের নিরিখে সত্যিই আমাদের মানব জীবন কত ক্ষুদ্র!’

বেশ কয়েক ঘণ্টা আমাদের ঘুরে দেখতে সময় লাগল হাইতির মিউজিয়ামটা৷ সেটা দেখে এ দেশটা সম্বন্ধে আমাদের বেশ কিছুটা ধারণা হল৷ তারপর আমরা আবার বাসে চড়ে বসলাম৷

পথে বেশ কিছু দ্রষ্টব্য স্থান আমরা বাস থেকেই দেখলাম৷ এ দেশের পার্লামেন্ট হাউস, প্রাচীন ফরাসি চার্চ, অন্যান্য স্থাপত্য ইত্যাদি৷ সবশেষে দুপুরবেলা আমরা উপস্থিত হলাম শহরের গায়েই পাহাড়ের ঢালে এক পার্কে৷ সেখানেই আমাদের মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা ছিল৷ খাওয়া সেরে বিচ্ছিন্ন ভাবে পার্কে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম আমরা৷ ফুলের বাগান, ঝরনা সবই আছে এখানে৷ খুব মনোরম নিরিবিলি পরিবেশ৷ ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, হঠাৎই আমার দেখা হয়ে গেল প্রেইরির সঙ্গে৷ এখানে এসে বাস থেকে নামার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিলাম আমরা৷ যে-যার মতো করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম৷ প্রেইরি আমাকে দেখে বললেন, ‘দিনটা বেশ সুন্দর কাটল৷ এখান থেকে আমাদের আবার সোজা রিসর্টে ফিরতে হবে৷’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, সত্যিই ভালো কাটল সময়টা৷ মিউজিয়ামটা বেশ লাগল৷ এ জায়গাটাও ভালো৷’

প্রেইরি এরপর আমাকে বললেন, ‘আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন তা বুঝলাম কীভাবে জানেন৷ দূর থেকে আপনার গলার লকেটটা সূর্যের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছিল৷ বেশ সুন্দর জিনিসটা৷ জানেন তো আমি কেতাদুরস্ত মানুষ৷ আমার গলায় যে টাইপিনটা দেখছেন তা কিন্তু হীরার৷ আপনার এই পেনডেন্টটা আমি একবার হাতে নিয়ে দেখতে পারি? ডিজাইনটা খুব সুন্দর৷ এমন একটা লকেট আমার বানাবার ইচ্ছা আছে৷’

প্রেইরির কথা শুনে আমি একটু ইতস্তত করে গলার হার থেকে লকেটটা খুলে তাঁর হাতে দিলাম৷ তিনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেটা দেখতে লাগলেন৷ ঠিক এমন সময় কে যেন বলে উঠল, ‘কেমন বেড়াচ্ছেন?’

তাকিয়ে দেখি সেই হেগার্ড নামে ছেলেটা কখন যেন আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে৷ আমি জবাব দিলাম, ‘বেশ ভালো, তোমার কেমন লাগছে?’

সে জবাব দিল, ‘খুব ভালো৷ আসলে বিজ্ঞান কংগ্রেসে যেসব বিজ্ঞানী এসেছেন, তাঁদের কারো সঙ্গেই আমার তেমন পরিচয় নেই যে গল্পগুজব করে সময় কাটাব৷ এখানে না এলে আমাকে রিসর্টেই ঘরবন্দি অবস্থায় কাটাতে হত৷ সে-জন্যই আমার আরো বেশি ভালো লাগছে বেড়াতে৷ এ দেশটাও অনেকটা আমাদের দেশের মতো৷ বাস থেকে দেখছিলাম এখানে আমাদের দেশের মতো প্রচুর কফি চাষ হয়৷ এ দেশের মতো আমাদের দেশটাও একই বছর ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাস আবিষ্কার করেন৷ আমাদের দেশের মতো এ দেশেও প্রচুর কালো মানুষ৷’

আমি জবাব দিলাম, ‘কলম্বাস যে একই বছর এ দুটো দেশ আবিষ্কার করেন তা আমার জানা ছিল না৷’

প্রেইরি লকেটটা আমার হাতে ফেরত দিয়ে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন হেগার্ডের দিকে৷

হেগার্ড এরপর বলল, ‘তবে উন্নয়নের নিরিখে এ দেশটা আমাদের দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে৷ এ দেশের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ এখনও সাক্ষর নন৷ কিন্তু আমাদের দেশের প্রায় একশো শতাংশ মানুষ সাক্ষর৷ বাসে আসার পথে কয়েকজনকে রাস্তার টুপি খুলে ভিক্ষা করতে দেখলাম৷ কিন্তু আমাদের দেশে কোনো ভিখারি নেই৷ আমাদের দেশে শিক্ষা ও ক্ষুধানিবৃত্তির দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করে৷’

প্রেইরি এবার হেগার্ডের উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, ‘অনুগ্রহ করে আপনার পরিচয়টা বলবেন?’

হেগার্ড তার পরিচয় দিতেই প্রেইরি বেশ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ‘ও বুঝলাম৷ তাই আপনার বক্তব্য থেকে কেমন একটা গন্ধ বেরোচ্ছিল! তা বিজ্ঞান সম্মেলনে আপনি কী বিষয়ে বক্তৃতা করবেন? বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় কিছু, না কৃষিখামার নিয়ে? আপনার দেশে বিজ্ঞানচর্চা তেমন কিছু হয় বলে তো মনে হয় না৷ যা হয় তা মিথ্যা প্রচারের ঢক্কানিনাদ, বাইরের পৃথিবীকে দেখাবার জন্য৷’ প্রেইরির কথায় আমি বেশ অস্বস্তি বোধ করলাম৷ প্রেইরি নিঃসন্দেহে বড়ো বৈজ্ঞানিক৷ কিন্তু এভাবে অপমানজনক মন্তব্য করা তাঁর উচিত নয়৷ আমি প্রেইরিকে বললাম, ‘উনি এত অল্প বয়সে বিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগ দিতে এসেছেন, এটা একটা বড়ো ব্যাপার৷ উনি কী নিয়ে বলবেন তা শোনার আগে কোনো মন্তব্য করা ঠিক নয়৷’

ছেলেটা প্রেইরির মন্তব্য শুনে থতমত খেয়ে গেছিল কিছুক্ষণের জন্য৷ তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রেইরি? আপনার কথাও আমি শুনেছি৷ তবে আপনাদের দেশের বেশ কিছু বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সফলতা কিন্তু সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়৷ চাঁদে তো মানুষ পাঠিয়েছিলেন আপনারা৷ বিশ্বের দরবারে সেই চন্দ্রাভিযানের যে-ছবি আপনারা তুলে ধরেছিলেন তাতে দেখা যাচ্ছে যে চাঁদের মাটিতে আপনাদের পতাকা পতপত করে উড়ছে৷ চাঁদে তো বাতাস নেই, তবে পতাকা উড়ল কী ভাবে?’—এই বলে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সে হাঁটতে শুরু করল অন্য দিকে৷

সে চলে যাবার পর প্রেইরি হেগার্ডের উদ্দেশে মন্তব্য করলেন, ‘ইডিয়ট! ননসেন্স!’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘তবে ছেলেটার গতিবিধি কিন্তু সুবিধার নয়৷ কেমন যেন হঠাৎ এসে আমাদের মাঝে উপস্থিত হল৷ তাছাড়া আপনি যখন মিউজিয়ামে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন আমি খেয়াল করেছি, সেও মাঝে মাঝে আপনার দিকে লক্ষ রাখছিল৷ আপনি কোনো গ্যালারিতে ঢুকলে সেও আপনার পিছনে পিছনে সে-ঘরে যাচ্ছিল৷ ও কি আপনার পূর্বপরিচিত?’

আমি জবাব দিলাম, ‘কাল সন্ধ্যাবেলায় অতি সামান্য পরিচয় হয়েছে৷ আমার পাশের রুমেই ছেলেটা আছে৷ তবে ও যে আমার ওপর খেয়াল রাখছে তা আমার জানা ছিল না৷ আবার এমনও হয়তো হতে পারে যে, আমার সঙ্গে পরিচয় হবার সুবাদে কথা বলার জন্য আমার পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল৷’ কথার ফাঁকে লকেটটা আবার গলায় পরে নিলাম৷ প্রেইরি মন্তব্য করলেন, ‘এসব অজ্ঞাতকুলশীলদের থেকে সাবধানে থাকাই ভালো৷ তার ওপর সে আবার সেই কিউবান ধাপ্পাবাজটার লোক!’

প্রেইরি যতবড়ো বিজ্ঞানী হন না কেন, বারবার একজন বিজ্ঞানীর সম্বন্ধে এমন বিশেষণ প্রয়োগ আমার ভালো লাগছিল না৷ অতীতে আমি ম্যাকিনলের সঙ্গে যতটুকু পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছিলাম তাতে আমার ম্যাকিনলেকে নির্বিবাদী, মিষ্টভাষী ভদ্রলোক বলেই মনে হয়েছিল৷ আমি প্রেইরিকে বললাম, ‘আপনি-আমি ছাড়া এখন কেউ নেই, তাই আপনাকে একটা কথা বলি৷ কথাটা শুনে আপনি আবার ভেবে নেবেন না যে আমি ম্যাকিনলেকে সমর্থন করছি৷ হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ব্রাসেলসের বিজ্ঞান কংগ্রেসে ম্যাকিনলে তাঁর বক্তৃতা দিতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলেন৷ হয়তো সেটা তাঁর আবেগের আতিশয্য৷ কিন্তু তাঁর ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্য তাঁকে সময় দেওয়া উচিত ছিল আমাদের৷ এমনও তো হতে পারে যে জনসমক্ষে তিনি সেটা বিশেষ কারণবশত প্রকাশ করতে চাননি৷’

প্রেইরি বললেন, ‘তাহলে তো উনি আপনাকে, আমাকে, কোম্বাটু বা অটোভানকে চোর সন্দেহ করেছিলেন? কারণ আমরা চারজনই শুধু কোনো গবেষণার ইঙ্গিত পেলে তার ভিতর পর্যন্ত ভাবার ক্ষমতা রাখি৷’

আমি প্রেইরির কথায় কোনো মন্তব্য করলাম না৷ প্রেইরি এরপর হেসে আমাকে বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই ম্যাকিনলে নন, আমাদের অবিশ্বাস করেন না৷ আপনি আগামীকাল যে গবেষণাপত্র পাঠ করতে চলেছেন, তার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে একটু বলবেন? আপনার কাজ সম্বন্ধে আমার শ্রদ্ধা ও কৌতূহল দুটোই আছে৷’

কিছু না বলাটা অভব্যতা হবে৷ আমি প্রেইরিকে বহু বছর ধরে চিনি৷ রাজনৈতিক কয়েকটা ব্যাপারে তিনি তো স্পর্শকাতর ঠিকই, কিন্তু তিনি একজন অগ্রগণ্য বিশিষ্ট বিজ্ঞানী৷ আমি বললাম, ‘আমি একটা ব্যাপার আবিষ্কার করেছি যাতে ছোটো ছোটো উদ্ভিদ যে কোনো পরিবেশে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বংশবিস্তার করতে পারে৷ সে গতি কচুরিপানার বংশবৃদ্ধির তুলনায় অন্তত একশো গুণ দ্রুত৷ বিশেষত ঊষর অঞ্চলে অথবা যেখানে মানবশক্তি কম সেখানেও আমার এই আবিষ্কার কাজে লাগবে বলেই আমার ধারণা৷’

আমার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রেইরি বললেন, ‘আরে আমি যা আবিষ্কার করেছি, তার সঙ্গে আপনার আবিষ্কারের যদি মেলবন্ধন ঘটানো যায় তবে তো কৃষিক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটে যাবে!’

আমি বললাম, আপনার আবিষ্কারটা কী বলবেন?’

প্রেইরি বললেন, ‘এক বিশেষ ধরনের ‘ড্রোন’ বা উড়ন্ত বস্তু৷ এ ড্রোন শুধু কৃষিক্ষেত্রে নজরদারিই চালাবে না, স্বয়ংক্রিয় উড়ন্ত যন্ত্র নিজেই জায়গা চিহ্নিত করে আকাশ থেকে বীজ ছড়িয়ে দিতে পারবে৷ রেডারে এই ছোট্ট উড়ন্ত যানকে চিহ্নিত করা যাবে না৷ আমার আবিষ্কারের সমস্যা ছিল ছোট্ট ড্রোনে কয়েক কেজির বেশি জিনিস বহন করা যাবে না৷ কিন্তু আমার ড্রোন যদি আপনার আবিষ্কৃত বীজ বহন করে তখন? আর তো কোনো সমস্যাই থাকবে না তখন৷’

আমি বেশ চমৎকৃত হলাম প্রেইরির কথা শুনে৷ এমন হলে সত্যিই ভালো হয়৷ আমাদের দুজনের আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশগুলোর সংকটমোচন সম্ভব হবে৷ আমি প্রেইরিকে বললাম, ‘এ ব্যাপারটা নিয়ে ভবিষ্যতে আমরা আলোচনা করব৷’

প্রেইরি এরপর আমার থেকে বিদায় নিয়ে অন্য দিকে এগোলেন, আর আমিও নিজের মনে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম পার্কের ভিতর৷ ঘুরতে ঘুরতে একসময় বিকাল হয়ে গেল৷

বাসের হর্ন শোনা গেল৷ বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে৷ পার্ক থেকে আমি ধীর পায়ে এগোলাম পার্কিং লটের দিকে৷ বাসের সামনে উপস্থিত হয়ে দেখলাম প্রেইরি আগেই সেখানে পৌঁছে গেছেন৷ বাস ছাড়বে, আমরা বাসে উঠতে যাচ্ছি৷ প্রথমে প্রেইরি, তাঁর পিছন পিছন আমি৷ প্রেইরি সবে বাসের পাদানিতে একটা পা রেখেছেন ঠিক সেই সময় বাসের ভিতর থেকে হুড়মুড় করে একজন নীচে নেমে এল৷ তার সঙ্গে ধাক্কা লাগল প্রেইরির৷ তিনি প্রায় উলটে পড়লেন পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার ওপর৷ কোনো মতে আমি সামলে নিলাম নিজেকে৷ তাকিয়ে দেখি হেগার্ড! সে আমাদের দিকে তাকিয়ে বেশ লজ্জিতভাবে বলল, ‘আমাকে মাফ করবেন, আসলে এখন খেয়াল হল যে আমি আমার ক্যামেরাটা পার্কে ফেলে এসেছি৷ তাই তাড়াহুড়োতে নামতে গিয়ে বিপত্তিটা ঘটিয়ে ফেললাম!’

পাছে প্রেইরি কিছু বলে বসেন তাই আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমাদের লাগেনি৷ আপনি বরং ক্যামেরাটা খুঁজে আনুন৷’ আরও একবার আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে হেগার্ড ছুটল তার ক্যামেরা উদ্ধারের জন্য৷ আমরা বাসে উঠে পাশাপাশি দুটো সিটে বসলাম৷ আমি ভেবেছিলাম প্রেইরি হয়তো সিটে বসার পর হেগার্ড সম্বন্ধে কোনো বিরূপ মন্তব্য করবেন৷ কিন্তু তিনি শুধু একবার অসন্তাোষের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন মাত্র৷ বাস ছাড়ার ঠিক মুহূর্তে হেগার্ড আবার ছুটতে ছুটতে ফিরে এল৷ যদিও তার হাতে আমি কোনো ক্যামেরা দেখলাম না৷ হয়তো ছোটো ক্যামেরা, তার পকেটে আছে৷

বাস রওনা হয়ে গেল৷ আইসক্রিমটা খাওয়ার পর সারাদিন ঘোরাঘুরির কারণে সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি৷ প্রেইরির ডাকে ঘুম ভেঙে দেখি আমাদের বাস রিসর্টে প্রবেশ করেছে৷ অন্ধকার নামতে শুরু করেছে চারপাশে৷ রিসর্টের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে৷ পরদিন দশটায় অধিবেশন শুরু হবে৷ আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে৷ রিসর্টে ঢুকে আমি সটান চলে গেলাম নিজের ঘরে৷ দরজা বন্ধ করে ওয়াশরুমে যাবার জন্য জামা খুলছি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে, ঠিক তখনই আমি আয়নায় একটা জিনিস খেয়াল করে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ আয়নাতে আমার জামাখোলা বুকটা দেখা যাচ্ছে৷ আমার গলাতে হারটা আছে ঠিকই, কিন্তু সেই লকেট বা পেনডেন্টটা নেই! আমার স্পষ্ট মনে আছে প্রেইরির হাত থেকে লকেটটা নিয়ে সেটা আবার গলায় ঝুলিয়েছিলাম আমি৷

১৩ অক্টোবর

গতকাল সারারাত ঘুম হয়নি আমার৷ তন্ন তন্ন করে খোঁজার পরও আমার জিনিসটা মেলেনি৷ যদিও আমার গবেষণাটা আমার মাথার মধ্যে আছে এবং কয়েক মাসের মধ্যেই হয়তো আমি আবার সেটাকে ফিরিয়ে আনতে পারব আমার মস্তিষ্কের সাহায্যে কিন্তু আমার ভয় অন্য জায়গাতে৷ মাইক্রোচিপে ভরা গবেষণাপত্রটা যদি কোথাও পড়ে না গিয়ে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে সরিয়ে থাকেন তবে তিনি সেটা নিজের নামে পেটেন্ট করিয়ে ফেললে আমার আর কিছু করার থাকবে না৷ একবার মনে হচ্ছিল যে কর্তৃপক্ষকে আমার লকেটটা খোয়া গেছে তা জানাই৷ বলি যে ওর মধ্যে আমার গবেষণাপত্র রাখা ছিল৷ কিন্তু তাতে দুটো সমস্যা আছে৷ প্রথমত তাহলে আমি আমার বিজ্ঞানী বন্ধুদের কাছে মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হব৷ দ্বিতীয়ত ব্যাপারটা আয়োজকদের জানালে তারা নিশ্চয়ই পুলিশে খবর দেবে৷ পুলিশ এসে অতিথি-অভ্যাগতদেরও তল্লাশি করবে৷ বিজ্ঞানীরা তাতে অপমানিত বোধ করতে পারেন, আন্তর্জাতিক মহলে আয়োজক সংস্থারও বদনাম হবে৷ এমনকি বিজ্ঞান কংগ্রেসও পণ্ড হয়ে যেতে পারে৷ ইউরোপের এক বিজ্ঞান কংগ্রেসে একবার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল৷ সে দেশের রাষ্ট্রপতির সম্মেলন উদবোধন করার কথা ছিল৷ কিন্তু তাঁর আসার আগে তাঁর নিরাপত্তারক্ষীরা এসে তল্লাশির নামে বিজ্ঞানীদের এমন হেনস্থা করল যে রাষ্ট্রপতি যখন সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হলেন তখন আয়োজক ছাড়া একজনও বিজ্ঞানী সেখানে উপস্থিত নেই৷ বিজ্ঞানীরা সব সভা বয়কট করে চলে গেলেন৷ বক্তৃতা না দিয়ে রাষ্ট্রপতিও ফিরে গেলেন৷ কংগ্রেসও পণ্ড হল৷ এসব ভেবে নিয়ে আপাতত আয়োজক কর্তৃপক্ষকে কিছু না জানানোর ব্যাপারেই আমি মনস্থির করলাম৷ তবে আমি ঠিক করলাম যে সেই পার্কটাতে একবার যাব৷ যদি জিনিসটা বেখেয়ালে ওখানে পড়ে গিয়ে থাকে৷ সেই মতো ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই ঘর ছাড়লাম৷ পার্ক থেকে তাড়াতাড়ি আবার ফিরতে হবে৷ সাড়ে দশটায় বাস আসবে আমাদের রিসর্ট থেকে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যাবার জন্য৷ নীচে নেমে রিসেপশনে শুধু বললাম, কেউ যদি আমার খোঁজ করেন, তবে তাঁকে জানাতে যে আমি প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছি৷

রিসর্টের বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি ধরে আমি সোজা ছুটলাম পার্কের দিকে৷ চারপাশের পাহাড়গুলোর ফাঁক গলে দিনের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়েছে পর্টোপ্রিন্স শহরের ওপর৷

সকালের ফাঁকা রাস্তা ধরে আমার আধঘণ্টা সময় লাগল পার্কে পৌঁছাতে৷ পার্ক এখনও খোলেনি৷ গেটম্যানকে আমার বিজ্ঞান কংগ্রেসের পরিচয়পত্র দেখিয়ে আমার গতকালের এখানে আসার কথা বললাম এবং জানতে চাইলাম যে কেউ কোনো পেনডেন্ট কুড়িয়ে পেয়ে জমা দিয়েছেন কি না? গেটম্যান বলল, না, তেমন কিছু জমা পড়েছে বলে তার জানা নেই৷ তবে সে আমাকে জিনিসটা খোঁজার জন্য পার্কে ঢুকতে দিল৷

যে রাস্তা ধরে আমি আগের দিন হেঁটেছি সেই রাস্তায় সতর্ক দৃষ্টি রেখে আমি পৌঁছে গেলাম ঠিক সেই জায়গাতে যেখানে আমি আর প্রেইরি কথা বলছিলাম৷ কিন্তু সে জায়গাতে ভালো করে খোঁজার পরও লকেটটা পেলাম না৷ ব্যর্থ মনোরথ হয়ে আমি আবার ফেরার পথ ধরেছি, ঠিক সেই সময় আমার কানে এল, ‘হ্যালো! গুডমর্নিং৷’ তাকিয়ে দেখি আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে হেগার্ড বলে সেই ছেলেটা৷ এত সকালে এখানে এসেছে কেন? আমি তাকে কিছু জিগ্যেস করার আগেই সে বলল, ‘গতকাল ক্যামেরাটা পাইনি৷ বাস ছাড়বে বলে ভয়ে তাড়াতাড়ি আবার ফিরে গেছিলাম৷ আজ ভোরে আবার খুঁজতে এসেছিলাম৷ তবে পেলাম না৷ এখন ফিরব৷’

এরপর সে প্রশ্ন করল, ‘আপনি এখানে এলেন?’

আমি শুধু বললাম, ‘আমারও একটা জিনিস হারিয়ে গেছে, সেটা খুঁজতে এসেছি৷’

কী জিনিস সেটা জানতে চাইল না হেগার্ড৷ সে শুধু মৃদু হাসল তারপর আমার থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়াল পার্কের বাইরে যাবার জন্য৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ আমার ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়েই ছিল৷ তাতে উঠে পড়লাম৷ ট্যাক্সিটা সবে চলতে শুরু করেছে তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলাম৷ পার্কটার অনেকগুলো গেট আছে৷ আমরা যেটা দিয়ে পার্কে প্রবেশ করেছিলাম সেটা নয়, অন্য একটা গেট দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসছে প্রেইরি! কী ব্যাপার? আজ সকালে সবাই পার্কে হাজির কেন? নানারকম চিন্তা জট পাকাতে লাগল মনের মধ্যে৷

রিসর্টে আমি ফিরে এলাম ন’টার কিছু আগে৷ কেউ আমাকে খোঁজ করেছিল কি না তা রিসেপশনিস্টকে জিগ্যেস করতে সে বলল, ‘ডক্টর প্রেইরি আপনি বেরিয়ে যাবার পর পরই আপনার খোঁজে এসেছিলেন৷’ প্রেইরি কি তবে আমাকে খোঁজার জন্যই পার্কে গেছিল?

ঘরে ফিরে এলাম আমি৷ মাথার ভিতরে নানা দুশ্চিন্তা খেলা করছে৷ তার মধ্যেই স্নান-টান সেরে তৈরি হয়ে ঠিক দশটায় লনে দাঁড়ালাম রিসর্টের বাইরে৷ প্রেইরি সহ অন্যরাও সবাই ধীরে ধীরে উপস্থিত হল সে জায়গাতে৷ প্রেইরি আমাকে গুডমর্নিং জানালেন ঠিকই কিন্তু আমার খোঁজ করছিলেন কি না সে ব্যাপারে কিছু বললেন না৷ কিছুক্ষণের মধ্যে বাস এল৷ গন্তব্যস্থানের দিকে যাত্রা শুরু করলাম আমরা৷

বিরাট আয়োজন৷ বিশাল একটা ইনডোর স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয়েছে কংগ্রেসের৷ ভিতরে ভিড় থিকথিক করছে৷ ও দেশের বিজ্ঞানীরা তো আছেনই তার সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররাও হাজির হয়েছেন আমাদের বক্তৃতা শোনার জন্য৷ আমরা মঞ্চের নীচে ঠিক সামনের সারিতে আমাদের আসন গ্রহণ করলাম৷

কংগ্রেস শুরু হল৷ আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনের সূচনা করলেন এদেশের বিজ্ঞানমন্ত্রী৷ তাঁর বক্তৃতা, আয়োজকদের পক্ষ থেকে আমাদের এই সম্মেলনে হাজির হবার জন্য সাধুবাদ জানানো এসব পালা শেষ হলে কংগ্রেসের মূল কাজ শুরু হল৷ প্রথমে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হল অটোভানকে৷ তিনি দুটি গ্যাসের সংমিশ্রণে পরিবেশের দূষণরোধের উপযোগী এক ধরনের যৌগ আবিষ্কার করেছেন, সে বিষয়ে বক্তৃতা করলেন৷ সে যৌগটি নাকি চিকিৎসা ব্যবস্থায়ও বিশেষ কাজে লাগতে পারে৷ অটোভানের বক্তৃতা শুনলেও আমি ঠিক তার মর্মে পৌঁছাতে পারলাম না৷ আমার মাথায় শুধু একই চিন্তা খেলা করছে৷ আমার গবেষণা সংক্রান্ত চিপটা উধাও হয়ে গেল কী করে?

ঘণ্টাখানেক ধরে বক্তৃতা করলেন অটোভান৷ তাঁর বক্তৃতার পরই আমার নাম ঘোষণা করে দেওয়া হল বক্তৃতা করার জন্য৷ গবেষণাপত্রটা ভাগ্যিস আগেই তৈরি করে রেখেছিলাম৷ আমি মঞ্চে উঠে গেলাম৷ তারপর যন্ত্রচালিত মানুষের মতো সেটা পাঠ করতে লাগলাম৷ টানা দু-ঘণ্টা সেটা পাঠ করার পর আমি থামলাম৷ লিখিত বক্তৃতা বা গবেষণাপত্র পাঠ শেষে শ্রোতাদের হাততালি শুনে মনে হল সেটা তাঁদের ভালো লেগেছে৷ আমি মঞ্চ থেকে নামার সময় প্রেইরির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হল৷ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে প্রশংসাসূচক মাথা নাড়লেন৷ নীচে আবার আসন গ্রহণ করলাম আমি৷

আর এর পরই মধ্যাহ্নভোজের বিরতি ঘোষণা করা হল৷ ডাইনিং হলে গেলাম আমরা৷ একটা প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে খেতে শুরু করলাম৷ তার মাঝেই কয়েকজন বিজ্ঞানী এসে আমাকে আমার বক্তৃতার জন্য সাধুবাদ জানিয়ে গেলেন৷ আমার খাওয়া যখন প্রায় শেষের মুখে তখন হঠাৎ আমার কাছে এগিয়ে এলেন প্রেইরি৷ চাপা স্বরে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে৷ একান্ত জরুরি এবং গোপনীয়৷ কাল যে-পার্কে আমরা গেছিলাম সেখানে আজ বিকালে একবার আসবেন?’

আমি একটু ভেবে নিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে আসব৷’

প্রেইরি বললেন, ‘ঠিক আছে৷ ঠিক বিকাল পাঁচটা৷ আপনি চলে আসবেন তবে৷’ এ-কথা বলে প্রেইরি আবার দ্রুত অন্যদিকে চলে গেলেন৷

খাওয়া শেষ হবার পর আমরা আবার ফিরে গেলাম অধিবেশনের কক্ষে৷ দ্বিতীয় ভাগে অধিবেশনের একমাত্র বক্তা হলেন ম্যাকিনলের প্রতিনিধি হেগার্ড৷

সে তার বক্তৃতা শুরু করল এই ভাবে, ‘‘যন্ত্র’ এই শব্দটা শুনলেই আমাদের মনে হয় একটা প্রাণহীন বস্তু অথবা বস্তুর সমষ্টি৷ অনেক সময় নিষ্প্রাণ বস্তু বলতেও ‘যন্ত্র’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়৷ কিন্তু মানব শরীরও তো একটা যন্ত্রবিশেষ৷ তবে কী সে নিষ্প্রাণ? নিষ্প্রাণ অর্থে তার কী কোনো সুখ-দুঃখ-আনন্দের অনুভূতি নেই? যন্ত্রের মতো মানুষের শরীরও তো মৌলিক বা যৌগিক পদার্থের সমাহার মাত্র৷ এদিক থেকে যদি ব্যাপারটাকে ভাবা যায় তবে মানব শরীরে যেমন বিভিন্ন অনুভূতির প্রতিফলন দেখা যায় বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তেমনই যন্ত্রের মধ্যেও অনুভূতির সঞ্চার হতে পারে৷ বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে তথাকথিত যন্ত্রের দ্বারা যে মানুষ তৈরি করেন তাকে বলা হয় ‘রোবট’ বা যন্ত্রমানব৷ প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী সে অনুভূতিহীন৷ একটা সময় পর্যন্ত এ ধারণা হয়তো ঠিক ছিল৷ কিন্তু আজ আর তা ঠিক নয়৷ যন্ত্রের মধ্যেও অনুভূতি সঞ্চার করা সম্ভব৷ তাই সেই গবেষণার সৃষ্ট মানবকে আজ আর যন্ত্রমানব বলা ঠিক নয়, বলা উচিত ‘বিকল্প মানব’ বা ‘নতুন মানব’৷ শেষ কথাটা বলাই মনে হয় যুক্তিযুক্ত আর এই নতুন মানব সৃষ্টি করেছেন আমার পরম পূজনীয় বিজ্ঞানী ম্যাকিনলে৷’

বক্তা এ পর্যন্ত বলতেই সভাস্থলে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল৷ লোকটা পাগল নাকি? যন্ত্রে অনুভূতি সঞ্চারের কথা বলছে! গুঞ্জন দেখে বক্তা একটু থামলেন৷ তারপর যেন শ্রোতৃমণ্ডলীর উদ্দেশে একটু ব্যঙ্গছলেই বললেন, ‘না, আমি পাগল নই৷ বিজ্ঞানী ম্যাকিনলেও পাগল নন৷ আর আপনারাও নন৷ আমি খুব দৃঢ়ভাবে বলছি যে নতুন মানবের মধ্যে অনুভূতি সঞ্চার করা সম্ভব শুধু তাই নয়, আরও এমন কিছু গুণাবলীর সঞ্চার ঘটানো যায় যা সাধারণ মানুষের নেই৷ সে অর্থে তাকে অতিমানবও বলা যায়৷’

সভাস্থলের গুঞ্জন আরও বাড়ল এবার৷ দু-একজন চেয়ার ছেড়ে উঠেও দাঁড়ালেন এই উদ্ভট বক্তব্যের প্রতিবাদ করার জন্য৷ প্রেইরিও উসখুস করছেন৷ আমি প্রমাদ গুনলাম, এই বুঝি তিনি উঠে পড়লেন বলে! ঠিক সেই সময় হেগার্ড মঞ্চ থেকে প্রেইরির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি জানি এখানে বিশিষ্ট একজন বিজ্ঞানী এখনই উঠে দাঁড়াবেন আমার বক্তব্যের প্রতিবাদ করার জন্য৷ এখনই আমার কাছে তিনি আমার বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণ চাইবেন৷ প্রমাণ না দিতে পারলে আমাকে অপদস্থ করা হবে, ঠিক যেমন ব্রাসেলসে অপদস্থ করা হয়েছিল ম্যাকিনলেকে৷ তবে প্রমাণ আমি দেব৷ তবে আজ নয় কাল৷ এজন্য উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে আগামীকাল অধিবেশনের সময় থেকে দশ মিনিট সময় চেয়ে নিয়েছি আমি৷ অনুগ্রহ করে কালকের দিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন৷ এটুকুই শুধু আজ বলার ছিল আমার৷’ এই বলে হেগার্ড মঞ্চ থেকে নেমে সভাস্থল থেকে বেরিয়ে গেল৷

বেশ কিছুক্ষণ ধরে এরপর শোরগোল চলল সভাকক্ষে৷ কেউ কেউ বলল, ‘কালকে এ লোকটা কী নতুন পাগলামি করে দেখি!’ আবার কেউ বলল, ‘ধৈর্য ধরে আর একটা দিন অপেক্ষা করা যাক৷ বিজ্ঞানে তো শেষ কথা বলে কিছু নেই৷’ তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই অধিবেশন শেষ হয়ে গেল৷

ঘরে ফিরে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম৷ মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা কাজ করছে৷ লকেটটা কোথায় গেল? প্রেইরি আমার সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করতে চান কেন? তিনি কী লকেটটা সম্বন্ধে কিছু জানেন? চারটে নাগাদ আমি এরপর আবার রিসর্ট ছাড়লাম৷ ঠিক পাঁচটা নাগাদই পৌঁছে গেলাম পার্কে৷ প্রেইরির প্রতীক্ষায় আমি ঘুরে বেড়াতে লাগলাম পার্কে৷ ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই আমার চোখে পড়ল বেশ কিছুটা তফাতে একটা বড়ো গাছের আড়াল থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে হেগার্ড৷ আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমাকে যেন সে দেখতে পায়নি এমন ভাব দেখিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল পার্কের অন্যদিকে৷ এবার বেশ খটকা লাগল আমার৷ সকালে না হয়, সে পার্কে এসেছিল ক্যামেরা খুঁজতে৷ কিন্তু এখন সে পার্কে কী করছে? প্রেইরি বলেছিলেন সে আমাকে মিউজিয়ামে লক্ষ করছিল! তাহলে কী সে আমাকে অনুসরণ করছে? মাথার ভিতর আমার কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল৷ ছেলেটা আমাকে অনুসরণ করছে কেন? উত্তেজিত হয়ে আমি পায়চারি করতে লাগলাম বাগানের মধ্যে৷

প্রেইরি যখন এলেন তখন প্রায় সন্ধ্যা নামতে চলেছে৷ তিনি এসে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনাকে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম৷ গোপন কথা বলার পক্ষে আমার এই জায়গাটাই আদর্শ বলে মনে হয়েছে৷

আমি বললাম, ‘কী গোপন কথা?’

প্রেইরি বললেন, ‘আপনার বক্তৃতা আমি শুনেছি৷ বক্তৃতার অন্তর্নিহিত বক্তব্যও আমি বুঝেছি৷ আপনার গবেষণার পেটেন্ট আমি কিনতে চাই৷’

আমি বিস্মিত ভাবে বললাম, ‘আপনি কিনতে চান?’

তিনি একটু ইতস্তত করে জবাব দিলেন, ‘আমি মানে আমার দেশ৷ পেটেন্ট রেজিস্ট্রেশনও আমরাই করিয়ে দেব৷ তারপর পেটেন্টটা আমাদের দেশকে বিক্রি করবেন আপনি৷ যত ডলার চান আমরা দেব৷ এমন কি চাইলে আপনি আমাদের দেশের নাগরিকত্বও পেতে পারেন৷’

আমি বললাম, ‘হঠাৎ, এতবড়ো প্রস্তাব?’

প্রেইরি বললেন, ‘আমাদের সামরিক বিভাগের ওটা প্রয়োজন৷’

‘সামরিক বিভাগের?’ আমি আরও বিস্মিত হলাম তাঁর কথা শুনে৷ আমার গবেষণা কৃষি দপ্তরের প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু সামরিক বিভাগের কী কাজে লাগতে পারে?

প্রেইরি বললেন, ‘আসলে অনেক সময় ভিন দেশে যুদ্ধক্ষেত্রে মাসের পর মাস আটকে থাকতে হয় সেনাদের৷ অনেক সময় খাদ্যসংকট হয়৷ এমন অবস্থায় ওরা আপনার গবেষণার সাহায্যে দ্রুত ফসল ফলাতে পারবে৷’

প্রেইরি ব্যাখ্যা দিলেও কথাগুলো কেমন যেন বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হল না আমার৷ আমি তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে৷ প্রেইরি তারপর বললেন, ‘তাহলে আমাদের দিচ্ছেন তো আপনার গবেষণাটা? এখনই দিতে পারেন৷ আমি চেকও সঙ্গে সঙ্গে কেটে দেব৷ পৃথিবীর যেকোনো ব্যাংক থেকে টাকাটা তুলতে পারবেন৷ কত দিতে হবে সেটা শুধু বলুন৷’

আসল ব্যাপারটা চাপা দিয়ে আমি বললাম, ‘গবেষণাপত্র তো আমি সঙ্গে নিয়ে ঘুরি না৷ আপনার প্রস্তাব আমি শুনলাম৷ কিন্তু এটা পেটেন্ট করার পর সবার আগে আমি এটা আমার নিজের দেশের হাতে দেব৷’ আমার কথা শুনে একটা আবছা হাসি প্রেইরির ঠোঁটের কোণে জেগে উঠেই যেন মিলিয়ে গেল৷ তিনি বললেন, ‘কাল দুপুরের মধ্যে ব্যাপারটা আমাকে জানালে ভালো হয়৷’

এরপর একটু থেমে উনি বললেন, ‘আপনাকে একটা কথা বলি? আপনি ওই কিউবান হেগার্ডের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি করছেন না তো?’

আমি বিস্মিত ভাবে বললাম, ‘আপনি এ কথা কেন বললেন?’

মুচকি হেসে প্রেইরি বললেন, ‘আপনাদের দুজনকে আজ সকালে এই পার্কে দেখলাম, তাই৷’

আমি জবাব দিলাম, ‘আমরা দুজনেই নিজের নিজের আলাদা আলাদা কাজে এখানে এসেছিলাম৷ কিন্তু আপনি এখানে এসেছিলেন কেন?’

প্রেইরি আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, ‘হেগার্ডের গতিবিধি কিন্তু ভালো না৷ আপনি একটু সাবধানে থাকবেন৷ বিশেষত আপনার গবেষণাপত্র সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ওর সঙ্গে আলোচনা করবেন না৷ আমি-আপনি তিরিশ বছরের পরিচিত৷ কিন্তু ও একদম অজ্ঞাতকুলশীল৷’

আমি একবার বলতে যাচ্ছিলাম যে, হ্যাঁ, ওর চলাফেরা সন্দেহজনক, কিন্তু তার আগেই প্রেইরি বললেন, ‘আমার প্রস্তাবটা কিন্তু আর একবার ভেবে দেখবেন৷ আমি আপনার মত পরিবর্তনের প্রত্যাশায় রইলাম৷’

আমি জবাব দিলাম, ‘আপনাকে তো বললামই আমি ওটা আমার দেশকে দেব৷ আমাদের দেশে এখনও অনেক গরিব মানুষ আছে৷ আমার গবেষণার সুফল তারা লাভ করবে৷ তারপর তার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী এর সুফল লাভ করলে আমার আপত্তি নেই৷’

প্রেইরি এরপর আর কথা বাড়ালেন না৷ আমার থেকে বিদায় নিয়ে অন্যদিকে এগোলেন৷ আর আমিও পা বাড়ালাম পার্কের বাইরে আসার জন্য৷

১৪ অক্টোবর

পার্ক থেকে সোজা রিসর্টে ফিরে এসেছিলাম সন্ধ্যায়৷ ঘরে ঢুকে সুস্থির হয়ে আমি বসতে পারলাম না৷ ঘরটার এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করতে করতে খালি ভাবতে লাগলাম আমার গবেষণাপত্র সমৃদ্ধ লকেটটা কোথায় গেল? ওটা কি সত্যিই কোথাও পড়ে গেল? নাকি কেউ চুরি করল ওটা? যদি লকেটটা গলা থেকে খুলে পড়ে গিয়ে থাকে ও কোনো সাধারণ মানুষ পেয়ে থাকে তাহলে ভয়ের কিছু নেই৷ সে মাছের ভিতর থেকে চিপটা পেলেও তার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারবে না৷ কিন্তু ও জিনিসটা যদি কোনো বিজ্ঞানীর হাতে পড়ে? যদি তেমন কেউ সেটা নিয়ে থাকেন তবে খুব বিপদজনক ব্যাপার৷ শুধু আমার নয়, আমার দেশেরও অনেক ক্ষতি হবে তাতে৷ আমারই আবিষ্কার আমার দেশকে হয়তো ভবিষ্যতে অন্য কোনো দেশের থেকে কিনতে হবে৷ আমার গবেষণা যদি আগেই অন্য কেউ পেটেন্ট করিয়ে নেন তবে আমার কিছু করার থাকবে না৷ তার ওপর প্রেইরির হঠাৎ এতবড়ো প্রস্তাব, সর্বোপরি ম্যাকিনলের শিষ্য হেগার্ড বলে ছেলেটার অমন অদ্ভুত উপস্থিতি সব মিলেমিশে আমার মনকে অস্থির করে তুলেছে৷ আয়োজক সংস্থার পক্ষ থেকে একটা নাইটপার্টির আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানেও যাইনি আমি৷ রাত বারোটা নাগাদ শুয়ে পড়েছিলাম৷

আজ ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল৷ খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম পাহাড়ের মাথায় তখন সূর্যোদয় হচ্ছে৷ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনটা কেমন যেন ভালো হয়ে গেল৷ মনে মনে ভাবলাম, যা গেছে তা গেছে৷ তা নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই৷ অঘটন যদি কিছু ঘটার থাকে তা তো ঘটবেই৷ সে নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই৷ এসব ভাবলে এই বিজ্ঞান সম্মেলনের বক্তৃতাগুলো আমি উপভোগ করতে পারব না৷ দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলা ভালো৷ কোম্বাটু আর প্রেইরির বক্তৃতা আছে আজ৷ তাছাড়া ওই হেগার্ড আজ ম্যাকিনলের ওই অদ্ভুত গবেষণার সপক্ষে প্রমাণ দেবে বলেছে, কাজেই মাথার মধ্যে চিন্তার জট না পাকিয়ে সেগুলো উপভোগ করা ভালো৷

বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম আমি৷ নীচের লবিতে একবার বেরিয়ে এসে আবার ঘরে ঢুকলাম৷ ব্রেকফাস্ট এল৷ খাওয়া সেরে স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম৷ আমাদের সম্মেলনের খবর সবকটা কাগজেই বেরিয়েছে৷ আমার বক্তৃতার যথেষ্ট প্রশংসাও করা হয়েছে৷ যদিও আমি গতকাল নিজে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম লকেট হারাবার দুশ্চিন্তাতে৷ আজ সম্মেলন একটু সকাল-সকাল শুরু হবে৷ তাই স্নান ইত্যাদি সেরে নির্দিষ্ট সময় নীচে নামলাম আমি৷ প্রেইরি সহ অন্য সবাইও একে একে উপস্থিত হলেন৷ সম্ভাষণ বিনিময় হল সবার সঙ্গে৷ নিজেকে বেশ চনমনে লাগছিল৷ বাস এল, সেই বাসে চেপে নির্দিষ্ট সময় আমরা হাজির হলাম সম্মেলনস্থলে৷

অডিটোরিয়ামের ভিতরে ঢুকে দেখলাম আজকে যেন আরও বেশি ভিড়৷ আমরা যারা অতিথি, তাদের জন্য সংরক্ষিত চেয়ার ছাড়া একটাও চেয়ার খালি নেই৷ সেটা হেগার্ডের সেই বিস্ময়কর প্রমাণ চাক্ষুষ করার জন্য কি না তা আমার জানা নেই৷ হেগার্ডের গতকালের অদ্ভুত বক্তব্য কয়েকটা কাগজে বেশ মজা করে ছেপেছে৷ একটা কাগজে তো শিরোনামই ছেপেছে—‘যন্ত্রে মানবিক গুণের সম্ভার! বৈজ্ঞানিকের অবৈজ্ঞানিক কল্পনা!’

প্রথম সারিতে আমাদের সামনের কিছুটা তফাতে হেগার্ডকে বসে থাকতে দেখলাম৷ সে আজ আমাদের আগেই এখানে চলে এসেছে৷ নিজেদের আসন গ্রহণ করলাম আমরা৷ আমি, অটোভান, প্রেইরি, কোম্বাটু সব পাশাপাশি বসে৷

এদিনের মতো সভার কাজ শুরু হল৷ পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী কোম্বাটু বক্তৃতা দিতে উঠলেন৷ এই পদার্থবিজ্ঞানী উচ্চ স্থিতিস্থাপক সম্পন্ন এক ইস্পাত আবিষ্কার করেছেন৷ সে বিষয়ে তিনি তাঁর গবেষণাপত্র পাঠ করতে লাগলেন৷ মঞ্চের একপাশে যে জায়েন্ট স্ক্রিন লাগানো আছে তাতে প্রোজেক্টরের সাহায্যে দেখালেন তাঁর আবিষ্কৃত ইস্পাতের মলিকিউলের গঠন৷ বিশেষত স্থাপত্য শিল্পে কোম্বাটুর এই আবিষ্কার খুব কাজে দেবে৷ ভূমিকম্পপ্রবণ দেশে এই ইস্পাতের তৈরি খাঁচা দিয়ে হাইরাইজ বিল্ডিং বানালে তা চট করে ভাঙবে না৷ সেতু নির্মাণ বা ফ্লাইওভার নির্মাণের ক্ষেত্রেও তাঁর এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে৷ আমি বুঝতে পারলাম নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কোনো বাণিজ্যিক সংস্থা চড়া দামে কিনে নেবে কোম্বাটুর আবিষ্কারের পেটেন্ট৷ প্রায় তিন ঘণ্টা বক্তৃতা করলেন কোম্বাটু৷ আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলাম তাঁর বক্তৃতা৷ অবশেষে তুমুল করতালির মধ্যে দিয়ে শেষ হল তাঁর বক্তৃতা৷ এরপর বক্তৃতার পালা প্রেইরির৷

কোম্বাটু মঞ্চ থেকে নামার পর ঘোষক এসে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন৷ তিনি বললেন, ‘আলোচ্যসূচি অনুসারে এরপর বক্তব্য রাখবেন আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ভুবনজয়ী বিজ্ঞানী মিস্টার প্রেইরি৷ কিন্তু তার আগে আমরা দশ মিনিট সময় চেয়ে নিচ্ছি আপনাদের কাছে৷ এই দশ মিনিট সময় দেওয়া হচ্ছে বিজ্ঞানী ম্যাকিনলের সহকারী ও প্রতিনিধি মিস্টার হেগার্ডকে৷ তিনি তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণ দেবার জন্য গতকাল আজকে আমাদের থেকে দশ মিনিট সময় চেয়েছিলেন৷ আমরা তাঁকে এখন সে সময় দিচ্ছি৷ মিস্টার হেগার্ড আপনি মঞ্চে উঠে আসুন৷’ এই ঘোষণা হতেই সভাস্থলে হাততালি শোনা গেল৷ আমার মনে হল সভাস্থলের অধিকাংশ মানুষ যেন এই ঘোষণার প্রতীক্ষাতেই ছিলেন৷ কিন্তু, আমি তাকিয়ে দেখলাম কিছুটা তফাতে হেগার্ড তার আসনে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ হাঁ করে মিটিং-এর দিকে তাকিয়ে শ্বাস নিচ্ছে সে৷

ঘোষকসহ সবার চোখ হেগার্ডের দিকে৷ ঘোষক মঞ্চ থেকে আবার আহ্বান জানালেন, ‘মিস্টার হেগার্ড উঠে আসুন৷’ হেগার্ডের ঘুম এবারও ভাঙল না৷ মৃদু একটা হাসির রোল উঠল সভাকক্ষে৷ আয়োজকেরা বেশ বিব্রত৷ বিজ্ঞান কংগ্রেসের ভাবগম্ভীর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে হেগার্ডের জন্য৷ প্রেইরি এবার বেশ জোরে মঞ্চের ওপর দাঁড়ানো ঘোষকের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনি ওনার জন্য সময় নষ্ট করছেন কেন? মনে হয় উনি বধির৷’ প্রেইরি তাকে বধির বললেও প্রেইরির কথাতেই মনে হয় ঘুম ভাঙল হেগার্ডের৷ চোখ মেলে সে মঞ্চের দিকে তাকাতেই ঘোষক একটু রুষ্ট ভাবেই তার উদ্দেশে বললেন, ‘প্লিজ উঠে আসুন, আমরা আর সময় নষ্ট করতে পারছি না৷’

হেগার্ড মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপারটা কী হয়েছে সম্ভবত বুঝতে পারল৷ সবাই তার দিকে তাকিয়ে হাসছে৷ তাকে অনেকক্ষণ ধরে ডাকা হচ্ছে৷ আর ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই সে আসন ছেড়ে হ্যাঁচোর-প্যাঁচোর করে আমাদের সামনে দিয়ে এগোতে গেল মঞ্চের দিকে৷ আর সেখানে পৌঁছবার আগে সে একটা ছোট্ট অঘটন ঘটাল৷ মঞ্চের ঠিক নীচে আমাদের প্রথম সারির সামনের আসনের কিছুটা তফাতে মেঝেতে ভিডিওগ্রাফির যে কেবল পাতা ছিল, তাতে পা জড়িয়ে পড়বি তো পড় একদম প্রেইরির ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে! এবার স্পষ্ট হাসির রোল উঠল উপস্থিত সকলের মধ্যে৷ প্রেইরির ঘাড়ে পড়ার পরই অবশ্য হেগার্ড সামলে নিল নিজেকে৷ প্রেইরিকে ‘সরি’ বলে সে এগোল মঞ্চে ওঠার জন্য৷ প্রেইরি চাপা স্বরে তার উদ্দেশে মন্তব্য করলেন, ‘কিউবান ইডিয়েটটা আমার ঘাড়ের ওপর ছাড়া অন্য জায়গা পায় না! এই নিয়ে দু-দিন হল!’

মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াল হেগার্ড৷ একটু ধাতস্থ হবার জন্যই হয়তো কয়েক মুহূর্ত চুপ করে সে হলের চারপাশে তাকাল৷ দর্শকাসনে হাসির রোল, গুঞ্জন এবার থেমে গেল৷ সবাই কিন্তু এবার উৎসুক এই খ্যাপাটে লোকটা কী বলতে চায় তা শোনার জন্য৷

একটু গলাখাঁকারি দিয়ে হেগার্ড বলল, ‘গতকাল আমি আপনাদের বলেছিলাম যে যন্ত্রের মধ্যে যে মানবিক গুণাবলী সঞ্চার করা যায় এবং আমি আজ তা হাতেকলমে প্রমাণ করে দেখাব৷ কিন্তু এখন ভাবছি সেটা দেখাব কি না? কারণ, এখানে এমন কেউ থাকতে পারেন যিনি আমার এই গবেষণাটা চুরি করার চেষ্টা করতে পারেন৷’ এই বলে থেমে গেল সে৷

সভাঘর জুড়ে কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা৷ তারপর গুঞ্জন শুরু হল৷ ওই অসম্ভব ব্যাপার কোনো সময়েই সম্ভব নয়, লোকটা সেটা দেখাতে পারবে না বলেই নিশ্চয়ই চাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে৷ তাছাড়া অতিথি-অভ্যাগতদের পক্ষেও ব্যাপারটা অপমানজনক৷ বিজ্ঞানীরা কী চোর? গুঞ্জন ক্রমশ বাড়তে লাগল৷ তার বক্তব্য শুনে আয়োজকদের চোখে-মুখেও বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল৷ হেগার্ড কিন্তু নির্বিকার৷ তার বক্তব্য শুনে অপমানিতবোধ করে, আর চুপ থাকতে না-পেরে কোম্বাটু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘নিজের অক্ষমতা ঢাকার জন্য আপনি আমাদের চোর বলে ইঙ্গিত করছেন? আমরা ম্যাকিনলের গবেষণা চুরি করব?’ মঞ্চ থেকে হেগার্ড প্রথমে বেশ শান্তস্বরে বলল, ‘আপনি নন, তবে এখানে এমন কেউ আছেন যিনি সে কাজটা করতে পারেন৷’ আর এ কথা বলার পর হেগার্ড আমাকে বেশ চমকে দিয়ে বলল, ‘বিজ্ঞানী মিস্টার তপাদার, আপনার কী কিছু খোয়া গেছে এখানে আসার পর? একটা মাছের আকৃতির লকেট বা পেনডেন্ট?’

বিস্মিত ভাবে আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে ফেললাম, ‘হ্যাঁ, একটা মাছ- আকৃতির সোনার লকেট৷’

‘কী রাখা ছিল সেই লকেটের মধ্যে তা অনুগ্রহ করে বলবেন? আশা করি আমি আপনাকে সেটা ফিরিয়ে দিতে পারব৷’ আমি আরও অবাক হয়ে গেলাম তার কথায়৷ সারা হলঘর নিস্তব্ধ৷ আমি বলে ফেললাম, ‘ওর মধ্যে একটা মাইক্রোচিপে আমার গবেষণাপত্রটা রাখা ছিল৷’

‘কে সেটা নিয়েছেন সে সম্বন্ধে আপনার কোনো ধারণা আছে? কিন্তু আমি জানি কে ওটা কৌশলে চুরি করেছেন আপনার থেকে৷ তিনি একজন বিজ্ঞানী৷ এবং তিনি এই সভাতেই উপস্থিত আছেন৷’ কথা বলতে গিয়ে হেগার্ড গিয়ে দাঁড়াল প্রোজেক্টার মেশিনের সামনে৷ তাতে একটা চিপ লাগানো৷

আয়োজক সংস্থার সভাপতি মিস্টার ক্যারফু এবার বিজ্ঞানীদের সম্মান রক্ষার জন্য মঞ্চের একপাশ থেকে বাইরে এসে বললেন, ‘মিস্টার হেগার্ড আপনি কী বলছেন, জানেন? আপনি একজন বিজ্ঞানীর প্রতিনিধি ঠিকই, কিন্তু অন্য বিজ্ঞানীদের অপমান করার অধিকার আপনার নেই৷ আমরা আপনাকে এই বিজ্ঞান কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হব৷’

হেগার্ড হেসে বলল, ‘আমার তাতে আপত্তি থাকবে না৷ তবে তার জন্য দুটো মিনিট আমাকে সময় দিন৷ আমি প্রমাণ করে দেব বিজ্ঞানী তপাদারের গবেষণাপত্র হাতিয়েছেন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী প্রেইরি৷’

এত বড়ো সভাঘর৷ কিন্তু একটা পিন পড়লেও মনে হয় তার শব্দ শোনা যাবে৷ শুধু প্রেইরি প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে? আমি তোমার আর এই বিজ্ঞান কংগ্রেসের আয়োজকদের নামে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করব৷ ক্ষতিপূরণ চাইব৷ জেলে পুরব তোমাদের সবাইকে৷’

প্রেইরির কথায় হেগার্ড মুচকি হেসে বলল, ‘শুধু তাই কেন, আপনি যুদ্ধ লাগাতে পারেন৷ তবে এটা আগে দেখে নিন, ওসব করার আগে৷’ প্রজেক্টরটা চালু করল হেগার্ড৷ মঞ্চের জায়েন্ট স্ক্রিনে ফুটে উঠল একটা ছবি৷ সেই পার্কে আমি আর প্রেইরি দাঁড়িয়ে৷ আমি আমার লকেটটা খুলে দিলাম প্রেইরির হাতে!

নির্বাক বিস্ময়ে আমি অন্য সবাইয়ের মতো তাকিয়ে রইলাম পর্দার দিকে৷ ছবিটা এরপর শ্লথ গতিতে চলতে শুরু হল, অর্থাৎ যাকে বলে স্লো-মোশান৷ ছবিতে এরপর আমি বুঝতে পারলাম হেগার্ড এসে হাজির হল সেখানে৷ ছবিতে তাকে দেখা যাচ্ছিল না৷ কিন্তু আমি তখন তার সঙ্গেই কথা বলছি বুঝতে পারলাম৷ সম্ভবত এ ছবি হেগার্ডই তুলেছে, তাই তাকে দেখা যাচ্ছে না ছবিতে৷ আর আমি কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দেখতে পেলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য৷ প্রেইরি তাঁর লকেট ধরা হাতটা চকিতে তাঁর কোটের পকেটে ঢোকালেন৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গেই ডান পকেট থেকে একই রকম একটা লকেট বার করলেন৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা আমার হাতে তুলে দিলেন! আমি তারপর গলায় পরলাম প্রেইরির দেওয়া লকেটটা৷ এরপর ছবি শেষ হয়ে গেল!

প্রেইরি চিৎকার করে উঠলেন, ‘এ ছবি জাল ছবি৷’

হেগার্ড বলল, ‘এ ছবি জাল কি না তা সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন মিস্টার তপাদার৷ ঠিক আছে, আপনি যে ওটা সরিয়েছেন তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ আমি দিচ্ছি৷ এরপর আর আপনি ব্যাপারটা কোনো ভাবেই অস্বীকার করতে পারবেন না৷ আপনার বাঁ পকেটে এখনও জিনিসটা আছে৷ আপনি ওটা ফেরত দিন৷’

আমি খেয়াল করলাম কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রেইরি তাঁর কোটের বাঁ পকেটে হাত ঢোকালেন৷ আর তারপরই তাঁর মুখমণ্ডল কেমন ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করল৷

মঞ্চ থেকে হেগার্ড এরপর প্রেইরির উদ্দেশে বলল, ‘এবার কোটের পকেট থেকে হাতটা বার করুন প্রেইরি৷ আপনি ধরা পড়ে গেছেন৷’

প্রেইরি এরপর ডান পকেটে হাত ঢোকালেন তারপর পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন৷

নিস্তব্ধ কতগুলো মুহূর্ত৷ হেগার্ড মঞ্চ থেকে আবার বলল, ‘আপনার বাঁ-হাতটা বার করুন প্রেইরি৷ আপনি ধরা পড়ে গেছেন৷ মিস্টার তপাদারের গবেষণাপত্র চুরির দায়ে আয়োজকরা এরপর আপনাকে পুলিশের হাতে দেবে কি না জানি না৷’

হাত বার করলেন না প্রেইরি৷ তিনি এবার দরজার দিকে তাকালেন৷ আর এরপরই মঞ্চের এক কোণের আধো-অন্ধকার জায়গা থেকে ছুটে এল একজন লোক৷ একটানে সে প্রেইরির বাঁ-হাতটা কোটের পকেট থেকে বার করে এনে তাঁর মুঠো খুলে একটা জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে তা মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরল৷ মঞ্চ থেকে এসে একটা আলোকরশ্মি এসে পড়েছে লোকটার হাতে৷ আমি অবাক হয়ে দেখলাম সেই লোকটার হাতে চকচক করছে আমার সেই সোনার মাছ লকেটটা—যার মধ্যে রাখা আছে আমার গবেষণা!

আর এরপরই আরও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল৷ প্রেইরি তাঁর ডানহাতটা কোটের পকেট থেকে বার করলেন৷ তাঁর হাতে এবার উঠে এসেছে একটা ছোট্ট রিভলবার৷ সেটা নিয়ে সোজা তিনি ছুটে এলেন আমার দিকে৷ তারপর সেই রিভলবার আমার বুকের দিকে তাক করে সমবেত জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘আমাকে কেউ বাধা দেবার চেষ্টা করলে আমি এ লোকটাকে গুলি করব৷ এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এই ভারতীয় বিজ্ঞানী আমার পণবন্দি৷’ তারপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে কর্কশ ভঙ্গিতে বললেন, ‘দরজার দিকে চলুন৷ চালাকি করলে গুলি চালাব৷’

আমার কী করা উচিত বুঝতে না পেরে প্রথমে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ কিন্তু প্রেইরি রিভলবারের সেফটি ক্যাচটা খুলে আমার উদ্দেশে চিৎকার করে উঠলেন, ‘চলুন বলছি৷ নইলে এখনই গুলি চালাব৷’

এবার আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম৷ পায়ে পায়ে এগোতে লাগলাম দরজার দিকে৷ দর্শক আসন আর মঞ্চের মাঝখানের ফালি রাস্তা ধরে এগোচ্ছি আমি৷ আমার কয়েক পা তফাতে উদ্যত রিভলবার হাতে প্রেইরি৷ তিনি হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে দেখছেন আশপাশ থেকে সিকিউরিটির লোকেরা তাঁর দিকে ছুটে আসছে কি না৷ কিন্তু তারাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এ দৃশ্য দেখছে৷

আমি তখন দরজার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি৷ ঠিক তখনই ঘটল সেই ভয়ংকর ঘটনা৷ মঞ্চের ওপর থেকে প্রায় উড়ে এসে আমার আর প্রেইরির মাঝখানে পড়ল হেগার্ড৷ তারপর তার দেহ দিয়ে আড়াল করে দাঁড়াল আমাকে৷ প্রেইরি চিৎকার করে উঠলেন তার উদ্দেশে—‘সরে যাও৷ আমাকে বাধা দিলে গুলি চালাব!’

হেগার্ড চিৎকার করে উঠল, ‘না, আমি নড়ব না৷’—একথা বলার পর সে ঝাঁপ দিল প্রেইরির দিকে৷ কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে প্রেইরি হেগার্ডের বুক লক্ষ করে সটান গুলি চালিয়ে দিলেন পরপর দু’বার৷ হেগার্ড প্রেইরিকে জড়িয়ে নিয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে৷ সিকিউরিটির লোক আর গুলির শব্দ শুনে বাইরে থেকে পুলিশের লোকেরাও ছুটে এল৷ তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে কবজা করে ফেলল প্রেইরিকে৷ তারা তাঁকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে চলল৷ মাটিতে পড়ে আছে হেগার্ডের দেহ৷ তাকে ঘিরে লোকজন৷ একটা স্ট্রেচার চলে এল দ্রুত হেগার্ডকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে বলে৷ সে একদম নিথর৷ বেঁচে আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না৷ তাকে যখন বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন তার পিছন পিছন ছুটল সেই লোকটা যে প্রেইরির হাত থেকে আমার লকেটটা ছিনিয়ে নিয়েছিল৷ স্ট্রেচারে শোয়া প্রেইরির পিছন পিছন আমার সামনে দিয়ে লোকটা যখন বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আমি চিনতে পারলাম লোকটাকে৷ আরে! এ যে বিজ্ঞানী ম্যাকিনলে! পাঁচ বছরের মধ্যে চুল-টুল সব সাদা হয়ে গেছে বলে আমি তাঁকে প্রথম দর্শনে চিনতে পারিনি৷ পুরো ঘটনাতে আমার মাথার মধ্যে কেমন করে উঠল৷ সামনে একটা চেয়ার দেখে আমি তাতে মাথা নিচু করে বসে পড়লাম৷ আমার কানে ভেসে আসতে লাগল চারপাশের হই-হট্টগোল, চিৎকার-চেঁচামেচি, বাইরে থেকে পুলিশের গাড়ির মাইকের শব্দ৷ চুরি আর খুনের জন্য প্রেইরিকে সম্ভবত পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে৷

মাথা নিচু করে বসেই ছিলাম আমি৷ আমার অবরুদ্ধ চেতনা ফিরে পেলাম ঘোষকের কণ্ঠস্বরে৷ তিনি বললেন, ‘যা হবার তা হল৷ তবে অতিথি ও অভ্যাগতদের উদ্দেশে জানাই, আমাদের বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশন আবার শুরু হতে চলেছে৷ আপনারা অনুগ্রহ করে যে যাঁর আসন গ্রহণ করুন৷ আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন বিজ্ঞানী ম্যাকিনলে৷ তিনি প্রথমে আপনাদের উদ্দেশে কিছু নিবেদন করতে চান৷’

আমি মঞ্চের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে ঘোষক আর বিজ্ঞান কংগ্রেসের আয়োজক সভাপতির মাঝে উপস্থিত হয়েছেন বিজ্ঞানী ম্যাকিনলে৷ তিনি ঘোষকের হাত থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে বললেন, ‘আপনারা একটু আগেই পুরো ঘটনাটা বা দুর্ঘটনাটা চাক্ষুষ করলেন৷ দেখলেন কীভাবে হেগার্ড তার প্রাণ বিসর্জন দিল বিজ্ঞানী তপাদারকে বাঁচাবার জন্য৷ মানবিক অনুভূতির শ্রেষ্ঠ বহিঃপ্রকাশ অন্যের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া৷ আমি এবার বিশেষ কারণবশতঃ বিজ্ঞানী তপাদারসহ উপস্থিত আরও কিছু বিজ্ঞানীকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি৷ অনুগ্রহ করে আমার আবেদনে সাড়া দিন৷’

আবেদন শুনে আমরা ধীরে ধীরে উঠে মঞ্চের ওপর গিয়ে দাঁড়ালাম৷ আমি, কোম্বাটু, অটোভান সহ আর বেশ ক’জন বিজ্ঞানী ও নেতৃত্বস্থানীয় প্রতিনিধি৷ একজন একটা চাকাঅলা স্ট্রেচার ঠেলতে ঠেলতে মঞ্চের ঠিক মাঝখানে এনে রাখল৷ তাতে শায়িত আছে হেগার্ডের নিস্পন্দ দেহ৷ তার জ্যাকেটের বুকের কাছে গুলির ছিদ্র দুটো স্পষ্ট চোখে পড়ছে৷ স্ট্রেচারটা এনে রাখার পর ম্যাকিনলে হেগার্ডের দেহের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ আমরাও এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়লাম হেগার্ডের মৃতদেহের ওপর৷ সবাই নিস্তব্ধ৷ আবেগমথিত পরিবেশ৷ আমার জন্যই তো লোকটাকে জীবন দিতে হল! আমার তো বটেই, অনেকেরই এই ছেলেটার জন্য চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল৷ ম্যাকিনলে একবার আমাদের সবার মুখের দিকে তাকালেন তারপর একটানে হঠাৎ খুলে ফেললেন স্ট্রেচারে শায়িত হেগার্ডের জ্যাকেটের চেনটা৷ উন্মুক্ত হয়ে গেল জ্যাকেটের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হেগার্ডের দেহের ভিতরের অংশ৷ বিস্মিত ভাবে আমরা দেখলাম হেগার্ডের গলা থেকে পেট পর্যন্ত শরীরটা রক্তমাংসের নয়, অসংখ্য যন্ত্রাংশ, বৈদ্যুতিক সার্কিট ইত্যাদি দিয়ে তৈরি! তার বুকের কাছে যন্ত্রাংশের মধ্যে বিঁধে আছে প্রেইরির ছোড়া বুলেট দুটো!

বিস্মিত কোম্বাটু অস্পষ্ট করে বলে উঠলেন, ‘তাহলে এ মানব নয়, যন্ত্র মানব!’

ম্যাকিনলে তাঁকে সংশোধন করে বলে উঠলেন, ‘এ হল, নতুন মানব৷ এবার নিশ্চয়ই আপনাদের বিশ্বাস হল যে যন্ত্রের মানবিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটানো সম্ভব৷ যে কারণে এই নতুন মানব বিজ্ঞানী তপাদারকে বাঁচাতে রিভলবারের সামনে ঝাঁপাল৷ হেগার্ড তার অনুভূতির প্রমাণ আপনাদের কাছে দিত, কিন্তু প্রেইরি তার কাজটা আরও সহজ করে দিল৷ মানবিক অনুভূতির চূড়ান্ত নিদর্শন দেখাল হেগার্ড৷ তবে চিন্তা নেই, বুলেট দুটো সরিয়ে কলকব্জাগুলো মেরামত করলেই ও আবার জেগে উঠবে৷’

আমরা সবাই তাকিয়ে রইলাম হেগার্ডের উন্মুক্ত হূদয়ের দিকে৷

১৫ অক্টোবর

সকালবেলায় রিসর্টে আমার ঘরে বসে আমি প্রতীক্ষা করছিলাম ম্যাকিনলের জন্য৷ আমার গবেষণাপত্র, অর্থাৎ সেই মাইক্রোচিপস ভরা লকেটটা ফেরত দিতে আসবেন তিনি৷ খোলা জানালা দিয়ে সকালের সূর্যের আলো এসে ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘরে৷ জানলা দিয়ে নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে আলোকোজ্জ্বল পাহাড়শ্রেণি দেখা যাচ্ছে৷ এই সুন্দর দেশটা ছেড়ে আজই আমি পাড়ি দেব আমার দেশ ভারতবর্ষে৷ টেবিলের ওপর সকালের কাগজগুলো পড়ে আছে৷ সবকটা কাগজেই গতকালের ঘটনার কথা বেরিয়েছে৷ চুরি ও গুলি চালনার অভিযোগে প্রেইরিকে পোর্টোপ্রিন্সের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে৷ আপাতত বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রেইরির ঠিকানা শ্রীঘর৷

প্রত্যাশা মতোই কিছু সময়ের মধ্যেই আমার ঘরে প্রবেশ করলেন বিজ্ঞানী ম্যাকিনলে৷ সম্ভাষণ বিনিময়ের পর আমরা দুজন মুখোমুখি চেয়ারে বসলাম৷ ম্যাকিনলে তাঁর পকেট থেকে লকেটটা বার করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন ভিতরের জিনিসটা ঠিক আছে কি না?’

লকেটটা খুলে আমি দেখলাম চিপটা ঠিক মতোই আছে৷ আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, ‘পুরো ব্যাপারটা আমাকে একটু খুলে বলবেন৷ বেশ কিছু ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না৷ প্রেইরি যখন চিপটা হস্তগত করলেনই তখন তিনি সেটা বোকার মতো সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন কেন? ধরা পড়ার ভয় ছিল না?’

ম্যাকিনলে হেসে তাঁর সাদা চুলে হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘ঘটনাটা একটু গোড়া থেকেই বলি৷ আমি কিন্তু হেগার্ডের সঙ্গেই এদেশে এসেছিলাম৷ কিন্তু আমি আত্মগোপন করেছিলাম৷ কারণ আমি জানতাম প্রেইরি এ ধরনের কোনো কাজ ঘটাতে পারে৷ আমাকে দেখলেই ও সতর্ক হয়ে যেত৷ তবে এবার যে ও আপনাকে শিকার বানাবে তা অবশ্য আমি জানতাম না৷ ব্রাসেলসে প্রেইরি আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল যাতে আমি আমার গবেষণাটা ওর সামনে উদঘাটিত করি সে জন্য৷ তাহলে ও যে কোনো মূল্যে সেটা হস্তগত করত৷ সে সেখানে লোকজনও তৈরি রেখেছিল সে জন্য৷ তাই অপমানের বোঝা মাথায় নিতে হলেও আমি সেখানে প্রেইরির ফাঁদে পা দিইনি৷ যাইহোক সে পুরোনো কথা৷ এখানকার কথাটা বলি৷ আমার অনুমান আপনার গলায় লকেটটা দেখে সে সম্ভবত অনুমান করে ওর ভিতর নিশ্চয়ই গোপন কিছু আছে৷ নইলে আপনি-ই-বা হঠাৎ লকেট সহ সোনার হার পরতে যাবেন কেন৷ সম্ভবত গোপন কোনো ক্যামেরা দিয়ে সে লকেটটার ছবিও তুলে রাখে৷ যার সাহায্যে সে হুবহু একটা লকেট বানিয়ে ফেলে৷ পরদিন পার্কে আপনার সঙ্গে যখন প্রেইরির সাক্ষাৎ হয় তখন অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই সেখানে হাজির হয় হেগার্ড৷ তার চোখে বা লেন্সে ক্যামেরায় ধরা পড়ে যায় প্রেইরির লকেট বদলের দৃশ্য৷ গতকাল মঞ্চে যে ছবি আপনারা দেখলেন তা হেগার্ডের চোখ দিয়েই তোলা…’

ম্যাকিনলের কথার মাঝখানেই আমি বললাম, ‘একটা জিনিস মাথায় আসছে না যে প্রেইরিই যখন জিনিসটা হস্তগত করলেন তখন পরশু সন্ধ্যায় পার্কে ডেকে আমার গবেষণাটা তাঁর হাতে তুলে দেবার জন্য বিপুল অঙ্কের টাকা অফার করলেন কেন?’

ম্যাকিনলে হেসে বললেন, ‘কারণ তখন জিনিসটা, মানে লকেটটা তাঁর কাছে ছিল না বলে৷’

‘মানে?’ জানতে চাইলাম আমি৷

ম্যাকিনলে জবাব দিলেন, ‘প্রেইরি জিনিসটা হাতে পেলেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেটা অন্যত্র সরিয়ে ফেলত অথবা তার নিজস্ব প্লেনে দেশত্যাগ করত৷ সেটা আটকাবার জন্য হেগার্ড একটা কাজ করে৷ পার্ক থেকে প্রথম দিন ভ্রমণ শেষে যখন আপনারা বাসে উঠতে যাচ্ছেন তখন ও ইচ্ছাকৃতভাবে প্রেইরির ঘাড়ে পড়ে ও তার পকেট থেকে জিনিসটা হাতিয়ে নেয়৷ ঠিক যেভাবে ও গতকাল সভাগৃহে মঞ্চে ওঠার সময় আবার প্রেইরির ওপর পড়ে জিনিসটা ওর পকেট ঢুকিয়ে দেয়৷ এটা না করলে প্রেইরিকে হাতেনাতে দোষী সাব্যস্ত করা যেত না৷ হেগার্ডের হাত-পা সঞ্চালন সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেকগুণ দ্রুত৷’

ম্যাকিনলের কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে৷

তিনি এরপর বললেন, ‘তবে, প্রেইরির দেওয়া যে লকেটটা আপনি গলায় ঝুলিয়ে নিলেন সেটা কী হল? সেটা সত্যিই গলা থেকে খসে পড়েছিল পার্কে৷ পরদিন সকালে সেটা পার্ক থেকে উদ্ধার করে হেগার্ড৷ এই নিন সেই নকল লকেট৷’

ম্যাকিনলে সেই নকল লকেটটা বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন৷ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা৷ ম্যাকিনলে এরপর বললেন, ‘লকেটটা তো নয় হেগার্ডের দৌলতে প্রেইরির হাতছাড়া হল কিন্তু পরদিনই সে জেনে গেল আপনার গবেষণার মূল বিষয়বস্তু উদ্ভিদ বা কৃষিগবেষণা সংক্রান্ত৷ তবুও সে সেটা আবার হস্তগত করার জন্য আপনাকে পার্কে ডেকে টাকার লোভ দেখাল কেন সে ব্যাপারে আপনার কোনো অনুমান আছে?’

আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘প্রেইরি বলছিল সামরিক প্রয়োজন৷ যুদ্ধক্ষেত্রে আটকে পড়া সৈন্যদের খাদ্যসংকট মোচনে আমার গবেষণা কাজে আসবে…’

আমার কথা শুনে প্রায় অট্টহাস্য করে উঠলেন ম্যাকিনলে৷ তিনি তারপর বললেন, ‘হেগার্ড সাধারণ মানুষের চেয়ে আরও উন্নত৷ সে মানুষের চিন্তা-ভাবনাও পড়তে পারে৷ প্রেইরির ভাবনা সে পড়েছিল৷ সামরিক প্রয়োজনে প্রেইরি সেটা কাজে লাগাত ঠিকই তবে সেটা অন্যভাবে ব্যবহার করা হত৷ আর করা হত আমাদের দেশের ওপর৷ যে ছোট্ট দেশটা ওদের নাকের ডগায় বসেও ওদের কাছে মাথা নত করেনি৷ প্রেইরির অন্য শয়তানি বুদ্ধি খেলা করছিল৷’

‘মানে?’

‘মানে হল, আপনার গবেষণাকে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করত ও৷ আপনার গবেষণার প্রয়োগ ঘটানো হত শস্যের বদলে আগাছার ওপর৷ প্রেইরির তৈরি ড্রোন সেই আগাছার বীজ বহন করে ছড়িয়ে দিত আমাদের দেশে৷ আমাদের কৃষিক্ষেত্রগুলো সব ভরে যেত আগাছাতে৷ সারা দেশের মাটিতে ছড়িয়ে পড়ত সেই আগাছা৷ আপনার গবেষণা দুর্ভিক্ষ দূর করার পরিবর্তে আমাদের দেশে ডেকে আনত দুর্ভিক্ষ৷’

আমি স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ম্যাকিনলের দিকে৷ তারপর বললাম, ‘আমার গবেষণার এমন অপপ্রয়োগ করার কথা কেউ ভাবতে পারে তা আমার মাথাতেই আসেনি৷’

ম্যাকিনলে বললেন, ‘এটা আমাদের বৈজ্ঞানিকদের স্ট্রাজেডি৷ আলফ্রেড নোবেল ডিনামাইট যখন আবিষ্কার করেন তখন তিনি ভাবেননি যে পাহাড় ভেঙে রাস্তা তৈরির বদলে তা ব্যবহার হবে জনপদ ধ্বংস করার জন্য৷ শয়তানদের মাথায় অনেক ভাবনাই আসে৷’ একথা বলার পর তিনি বললেন, ‘বাইরে একজন দাঁড়িয়ে আছে, এবার তাকে ডাকি?’

এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ম্যাকিনলের আহ্বানে ঘরে প্রবেশ করল হেগার্ড৷ হাতে একগোছা গোলাপ৷ ফুলগুলো সে বাড়িয়ে দিল আমার দিকে৷ ম্যাকিনলে হেসে বললেন, ‘আমি কিন্তু ওকে ফুল আনতে বলিনি৷ মানবিক কর্তব্যবোধ থেকে ও ফুল এনেছে৷’

ফুলগুলো নিয়ে নতুন মানুষকে আমি জড়িয়ে ধরলাম৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *