ব্যাকভলি

ব্যাকভলি

‘কত বছর পর? তা অন্তত তিরিশ বছর হবে!’ মনে মনে হিসাব করলেন সমীরণ৷ হ্যাঁ, প্রায় তিরিশ বছর পর তিনি আবার পা রাখতে চলেছেন তাঁর গ্রামে৷ কুসুমপুরে৷

পিচ রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি৷ বাইরে শীতের উজ্জ্বল সকাল৷ সেদিকে তাকিয়ে সমীরণের মনে হল, এ জায়গটা যেন ঠিক একই রকম আছে৷ দুপাশে সবুজ ধানের খেত, তার মাঝে মাঝে সূর্যকিরণে উদ্ভাসিত ফাঁকা মাঠ৷ একটা মাঠের দুপাশে গোলপোস্টও দেখতে পেলেন সমীরণ৷ হয়তো ওই মাঠটাতেও তিনি কোনোদিন খেলেছেন৷ তখন তো আর প্রতি ঘরে টিভি-ইন্টারনেট ঢুকে পড়েনি৷ ক্রিকেট হল বড়লোকদের খেলা, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের প্রাণের খেলা ছিল ফুটবল৷ বিকেল হওয়া মানেই ফুটবল মাঠ৷ কত খেলা হত এ সব মাঠে৷ কত ছেলে এ সব মাঠ থেকে উঠে পরবর্তীকালে কলকাতার মাঠ কাঁপিয়েছে, ঠিক যেমন সমীরণ নিজেই৷ কলকাতার বড়ো ক্লাবগুলো তখনও কর্পোরেট সংস্থা হয়ে ওঠেনি৷ ভিনরাজ্যের বা বিদেশের ফুটবলার আনার মতো আর্থিক সংস্থানও তাদের ছিল না৷ কাজেই ফুটবল জহুরিরা তখন কলকাতা থেকে ছুটে আসতেন এই সব গ্রাম-মফসসলের মাঠগুলোতে৷ ভালো প্লেয়ার দেখলেই তাকে তুলে নিয়ে চলে যেতেন কলকাতায়৷ যেমন তাঁকে নিয়ে এমন ডিসেম্বর মাসেরই এক শীতের রাতে কলকাতায় পাড়ি দিয়েছিলেন কলুটোলা ক্লাবের পরেশ সাঁতরা৷ তার পরের ঘটনাগুলো অবশ্য সমীরণের জীবনের উত্থানের ইতিহাস৷ প্রথমে সেকেন্ড ডিভিশন, তার পর ফার্স্ট ডিভিশন, তার পর কলকাতার তিন বড়ো ক্লাবে চুটিয়ে খেলা, অবশেষে ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপানো৷ উল্কাগতিতে ছুটে গেছে সমীরণের জীবন৷ খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি এখন এক নামী ক্লাবের কর্মকর্তা৷ তা ছাড়া এখন তাঁর নামের আগে আগে জ্বল জ্বল করে সরকারি খেতাব, যে খেতাব রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে কয়েক বছর আগে পেয়েছেন৷

সেদিন ছেলেগুলো যখন তাঁর বাড়ি অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ জানাতে গেছিল তখন তাদের মুখে বহু বছর পর ‘কুসুমপুর’ নামটা শুনে বেশ চমকে উঠেছিলেন সমীরণ৷ তাঁর চোখে মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠেছিল একটা মাঠ, একটা মুখ, আর শীতের সেই নির্জন রাত, যে রাতে পরেশ সাঁতরার কালো অ্যাম্বাসাডার গাড়িতে উঠে বসেছিলেন সমীরণ৷ জীবনের প্রথম গাড়ি চড়া৷ সে গাড়ি সময়ের সাথে সাথে তাঁকে বসিয়েছে আজকের এই ঝাঁ-চকচকে হালফ্যাশনের দামি গাড়িটাতে৷ স্মৃতির সরণি বেয়ে যা তাঁকে নিয়ে ছুটে চলেছে কুসুমপুরের দিকে৷ নিমন্ত্রণ করতে আসা ছেলেগুলো করজোড়ে বলেছিল, আপনাকে আমাদের গ্রামে আসতেই হবে স্যার৷ আপনার মতো বিখ্যাত মানুষ আমাদের গ্রামে এক সময় থাকতেন, তা ভাবতেই আমাদের কেমন গর্ববোধ হয়৷ যে মাঠে আপনি খেলতেন সে মাঠে একটা ফুটবল কোচিং সেন্টার চালু হচ্ছে ছোটোদের জন্য৷ আপনি গেলে ওরা উৎসাহিত হবে আপনাকে দেখে৷ ওরা বুঝতে পারবে, ওই মাঠে খেলা শুরু করেও একদিন আপনার মতো বিখ্যাত হওয়া যায়, নাম করা যায়!’

এরপর তাদের মধ্যে একজন বলেছিল, ‘আপনি বিখ্যাত মানুষ স্যার৷ আর হয়তো কোনো দিনও মাঠে পা রাখার সময় হবে না আপনার৷ আপনি যদি শেষ একবারের জন্য যান তবে আমরা আপনার স্মৃতিকে ওখানে পাকাপাকিভাবে ধরে রাখার জন্য একটা পরিকল্পনা করেছি…৷’

‘সেটা কী ব্যাপার?’ সমীরণ জানতে চেয়েছিলেন৷

এর পর তারা যা বলেছিল তা শুনে সমীরণ একটু লজ্জাই পেয়েছিলেন৷ বলেছিল, ‘আমরা একটা সিমেন্টের কাঁচা স্ল্যোব আপনা পায়ের ছাপ নেব স্যার৷ আপনার বাঁ পায়ের ছাপ আঁকা হয়ে থাকবে বরাবরের জন্য৷ আপনার বিখ্যাত বাঁ পা, যা দিয়ে আপনি ব্যাকভলিতে বহু বিখ্যাত গোল করেছেন৷’

তাদের কথা শুনে সমীরণ বলেছিলেন, ‘তোমরা যে কী বলো ভাই! ওসব ছাপ তো পেলে, গ্যারিঞ্চা, মারাদোনা, রোনাল্ডো, এদের নেওয়া হয়৷ আমরা কী অত বড়ো প্লেয়ার ভাই? বিশ্ব ফুটবলে আমাদের স্থান জানো তো? আমার মতো প্লেয়ারের পায়ের ছাপ নিলে লোকে হাসবে যে! কাগজে হয়তো কার্টুন ছাপা হবে আমাকে নিয়ে৷ সেইটা কী তোমরা চাও?’

তাঁর কথা শুনে ছেলেগুলো বলেছিল, ‘কেউ হাসবে না স্যার৷ বাংলা আর ভারতীয় ফুটবলে আপনার অবদানের কথা সবাই জানে৷ এখনও কোনো ভারতীয় প্লেয়ার মাঠে ব্যাকভলি করলে তার ব্যাকভলির সাথে আপনাদের ব্যাকভলির উপমা টানা হয়৷ অনেকে তো বিশ্বাসই করতে চায় না আপনি একসময় আমাদের গ্রামে থাকতেন৷ ও সব নিয়ে আপনি একদম ভাববেন না স্যার৷ তাছাড়া আপনার পায়ের ছাপের পাশে কোচিং সেন্টারের খুদে ফুটবলারদের পায়ের ছাপও আঁকা হবে৷ প্লিজ, একবারের জন্য আমাদের ওখানে চলুন স্যার৷’

পায়ের ছাপ নিয়ে কথা বলতে বলতে সমীরণের সে সময় হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল আরও একজনের কথা৷ তার পায়ের ছাপও তো একদিন আঁকা থাকত ওই জলকাদাঘামের গন্ধ মেশা মাঠে৷ সে কী এখনও সেখানে থাকে? এ ছেলেগুলো কী তাকে চেনে? তার কথা ছেলেগুলোকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সমীরণ চুপ করে গিয়েছিলেন৷ মুহূর্তের মধ্যে ভেবে নিয়েছিলেন, কুসুমপুরে যদি যান তবে সেখানে গিয়েই খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করবেন তাকে৷ এ বয়সে এসে তার কথা মনে হলেই কেমন যেন একটা অপরাধবোধ জেগে ওঠে সমীরণের মনে৷ হয়তো ব্যাপারটা কিছু না৷ তবু… এই আমন্ত্রণের সুযোগটা কাজে লাগিয়ে হয়তো শেষবারের জন্য দেখা করা যাবে তার সাথে৷

জায়গাটা যত কাছে এগিয়ে আসতে লাগল, সিটে বসে ততই যেন স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠতে লাগলেন সমীরণ৷ কৈশোরের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওই জায়গার সাথে৷ সে সময়ে ফুটবল মাঠে যারা তাঁর সাথে কুসুমপুরের মাঠে খেলত তাদের মুখ আর নামগুলো ভাবার চেষ্টা করতে লাগলেন সমীরণ৷ দু-একটা নাম যেন আবছা মনে পড়ছে৷ বোঁচা, পিণ্টু…৷ কিন্তু তাদের মুখগুলো সবই অস্পষ্ট৷ শুধু একটা মুখই জলছবির মতোই বারবার ভেসে উঠছে৷ তার নাম সমীর৷ যে সমীরণ আজ স্মৃতির সরণি বেয়ে কুসুমপুরের যাত্রী সে সমীরণ খেলতেন লেফট উইংয়ে, আর সেই সমীর খেলত রাইট উইংয়ে৷ সমীরণের দুর্দান্ত ব্যাকভলি বাঁ পায়ে, আর অন্যজনের ডান পায়ে কামানের গোলার মতো শট৷ তাদের যুগলবন্দিতে বাইরে থেকে খেলতে আসা কত টিম যে পর্যদস্ত হত তার কোও হিসেব ছিল না৷ আর সেজন্যই তো তাদের নামটা কুসুমপুর ছেড়ে পৌঁছে গিয়েছিল দূরে কলকাতা শহরে পরেশ মিত্তিরের কানে৷ তিরিশ বছর আগে এক শীতের রাতে কুসুমপুর থেকে সমীরণ আর তার বিধবা মাকে গাড়িতে চাপিয়ে রওনা হয়েছিলেন কলকাতার দিকে৷ পরদিন ভোরেই ছিল কলুটোলা ক্লাবের ট্রায়াল৷ সমীরণ আর ফেরেননি কুসুমপুরে৷ রাইট উইঙ্গার সমীরের সাথে আর কোনোদিন দেখা হয়নি তাঁর৷ কলকাতার যাবার পরপর, এমনকি বড়ো ক্লাবে ঢোকার পরও মাঝে মাঝে তিনি খেয়াল করার চেষ্টা করতেন, সমীর নামের রাইট উইঙ্গার কোনো ছেলে কোনো ক্লাবে খেলছে নাকি? কারণ, কলকাতায় খেলার যোগ্যতা অবশ্যই তারও ছিল৷ কিন্তু না, ও নামের কোনো প্লেয়ারকে তিনি খুঁজে পাননি৷ দামি গাড়ির আসনে সওয়ার সমীরণ কুসুমপুরের দিকে এগোতে এগোতে ভাবতে লাগলেন, ‘যদি সেই সমীরের খোঁজ তিনি পান তবে তিনি কর্মকর্তাদের বলবেন যে সমীরের পায়ে ছাপটাও যেন কংক্রিটের স্ল্যাবে রাখা হয়৷ এক সময় তো ফুটবলার হিসেবে কুসুমপুরে সবাই তাকে চিনত৷ সেই পুরনো ছাপ দুটো আজ থেকে আবার না হয় পাশাপাশি আঁকা হয়ে থাকুক৷ বিখ্যাত ফুটবলার সমীরণ এ ব্যাপারটা সম্বন্ধে উদ্যোক্তাদের অনুরোধ জানালে তারা নিশ্চয়ই তাঁর প্রস্তাবে আপত্তি জানাতে পারবে না৷

গাড়ি এগিয়ে চলল কুসুমপুরের দিকে৷ তারপর এক সময় তিনি দূর থেকে দেখতে পেলেন কুসুমপুরের মাঠটা৷ মাঠের এক কোণায় সেই জোড়া তালগাছ দুটো আজও দাঁড়িয়ে আছে৷ বাবুইপাখির বাসা ঝুলছে গাছগুলোর মাথায়৷ সমীরণের গাড়ি এসে থামল মাঠের লাগোয়া কুসুমপুর ফুটবল কোচিং ক্লাবের সামনে৷ সমীরণ তাঁর বিখ্যাত ব্যাকভলির মতোই যেন আজ নামলেন কুসুমপুরের মাটিতে৷

দুই

অনুষ্ঠান শুরু বেলা তিনটেতে৷ কিন্তু বেলা এগারোটাতেই নির্ধারিত স্থানে, কুসুমপুর ফুটবল কোচিং ক্লাবে সমীরণ পৌঁছে গেলেন৷ ইন্ডিয়ান টিমের ব্লেজার গায়ে সমীরণ ক্লাবের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই কর্মকর্তারা সব ছুটে এল৷ কিছু অল্পবয়সী ছেলে, যারা তাঁকে নিমন্ত্রণ করতে গিয়েছিল তারা আর কিছু প্রবীণ মানুষ৷ সমীরণ কিছুটা আগেই উপস্থিত হবেন বলে উদ্যোক্তাদের জানিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁকে এত তাড়াতাড়ি উপস্থিত হতে দেখে তারা বেশ অবাক হয়ে গেল৷ গাড়ি থেকে নেমে সমীরণ তাদের আশ্বস্ত করে বললেন, ‘এখানে আমার একটা কাজ আছে, তাই কিছুটা আগে চলে এলাম৷ আপনাদের আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই৷ সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি থাকব আপনাদের সঙ্গে৷ অনুষ্ঠান শেষ করেই যাব৷’

সমীরণ যা-ই বলুন, এত বড়ো মাপের মানুষ তাদের ক্লাবে পদার্পণ করেছেন, উদ্যোক্তারা কী তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে পারেন? তাঁর উপস্থিতিতে আবেগে আপ্লুত উদ্যোক্তারা বেশ খাতির করে তাঁকে ক্লাবের ভেতর নিয়ে গেলেন৷ বেশ বড়ো ক্লাব৷ সম্ভবত ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকরা খুব ধনী অথবা ক্লাবটা সরকারি কোনো অনুদান পায়৷ সমীরণরা তিরিশ বছর আগে যখন এ মাঠে ফুটবল খেলতেন তখন একটা ফুটবলের পয়সা জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে যেত৷ তাপ্পি মারা বল, বাঁশের তৈরি বারপোস্ট, টালি আর দড়মার তৈরি ছোট্ট ক্লাবঘরে বর্ষায় জল পড়ত৷ এত বড়ো ক্লাবঘরের কথা ভাবাই যেত না৷ সমীরণ বেশ খুশি হলেন ক্লাবটার অবস্থা দেখে৷ টাকাপয়সা না থাকলে ভালো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সম্ভব নয়৷

ক্লাবের ভেতর যত্ন করে বসানো হল সমীরণকে৷ তাঁকে ঘিরে বসলেন কর্মকর্তা৷ জানলা দিয়ে মাঠটা দেখা যাচ্ছে৷ কাদামাখা মাঠ নয়, সবুজ ঘাসের গালিচা ছাওয়া মাঠ৷ মাঠটাকেও তৈরি করা হয়েছে৷ দূরে মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ দুটোর মাথায় বাবুইপাখি বাসা বুনছে৷ মাঠের দিকে তাকিয়ে বেশ নস্টালজিক হয়ে বাবুইপাখির ঝাঁকের মতোই স্মৃতির জাল বুনতে শুরু করলেন সমীরণ৷ তাঁর চোখে ভেসে উঠতে লাগল মাথায় কোঁকড়া চুলঅলা ছিপছিপে এক তরুণ সমীরের মুখ৷ ওই তো মাঠের ও পাশে রাইট উইং দিয়ে বল নিয়ে এগোত সে, আর লেফট উইং ধরে সমীরণ৷ সে কি এখানেই আছে এখন? সমীরণ কতবার ভেবেছেন একবার এই কুসুমপুরে এসে দেখা করার চেষ্টা করবেন তার সঙ্গে৷ কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি৷ খ্যাতির বিড়ম্বনা আর কাজ মানুষের জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নেয়৷ তিরিশটা বছর যেন কোনো দ্রুতগামী ট্রেনের মতো সমীরণের চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল!

সমীরণের জন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই চা আর খাবার এসে গেল৷ সে সব খেতে খেতে তাঁকে ঘিরে বসা লোকজনের সঙ্গে এ অঞ্চলে তাঁর কৈশোরের স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন তিনি৷ কথা যখন বেশ জমে উঠল, তখন তিনি সুযোগ বুঝে কর্মকর্তাদের বললেন, ‘জানেন সে সময় এখানকার একজন খুব ভালো প্লেয়ার আমার সঙ্গে ওই মাঠে খেলত৷ আমার থেকেও ভালো খেলত সে৷ আমি লেফট উইং, সে রাইট উইংয়ে৷ এখনও সে এ অঞ্চলে থাকে কিনা জানি না৷ পরবর্তীকালে সম্ভবত কোনো কারণে খেলা ছেড়ে দেয়৷ ওর মতো ট্যালেন্টেড প্লেয়ার আমি কম দেখেছি৷ আপনাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে৷ আমি যদি তাকে মাঠে হাজির করি তবে আপনারা আমার সঙ্গে ওই সিমেন্টের স্ল্যাবে যদি তার পায়ের ছাপ রাখেন তবে আমার খুব ভালো লাগবে৷ এ মাঠে এক সঙ্গে দুজনে খেলেছি তো…৷’

তাঁর কথা শুনে কর্মকর্তারা বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয় নিশ্চয়ই৷ আপনি যখন বলছেন তখন নিশ্চয় তাঁরও ছাপ নেওয়া হবে৷ আমরা তাঁকে মঞ্চে তুলে একটা সংবর্ধনা দেব৷ এ অঞ্চলের স্থানীয় প্রবীণ কোনো ফুটবলারকে সংবর্ধনা দেওয়ার কথা আমরাও ভাবছিলাম৷ কিন্তু তেমন কাউকে পাইনি৷ ওঁর সঙ্গে পরিচিত হতে পারলে আমাদেরও বেশ সুবিধা হবে৷ কোচিং ক্যাম্প চালানোর ব্যাপারেও উনি আমাদের পরামর্শ দিতে পারবেন৷ কিন্তু কে তিনি?’

সমীরণ শুনে খুশি হয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ৷ তার নাম সমীর মিত্র৷ মিত্রপাড়ায় থাকতেন৷’

সমীর মিত্র! লোকগুলোর মুখ দেখে সমীরণ বুঝতে পারলেন, সমীরকে সম্ভবত তারা কেউ চেনে না৷ অবশ্য হয়তো না চেনারই কথা৷ অনেক পুরনো ব্যাপার৷

সমীরণ বললেন, ‘দেখি আমি এখন একবার তার খোঁজ বেরোব৷ আপনাদের একটা আমন্ত্রণলিপি দিন তো আমাকে৷ যদি তার খোঁজ পাই৷’

অনুষ্ঠানের কার্ড এসে গেল সমীরণের হাতে৷ উদ্যোক্তাদের কয়েকজন তাঁর সঙ্গী হতে চাইছিলেন৷ কিন্তু মিষ্টি হেসে তাঁদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন সমীরণ৷

নতুন কিছু ঘরবাড়ি-দোকানপাট হলেও কুসুমপুর জায়গাটা মোটামুটি একই রকম আছে৷ রাস্তাগুলোও একই আছে, শুধু মাটির বদলে পিচের হয়েছে৷ মিত্রপাড়া নামটাও এখনও একই আছে৷ কিছুটা স্মৃতি হাতড়ে, আর কিছুটা লোকজনকে জিজ্ঞেস করে ঠিক জায়গাতে পৌঁছে গেলেন সমীরণ৷ বড়ো রাস্তায় গাড়ি রেখে গলিতে ঢুকে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ আশপাশে বেশ কয়েকটা নতুন বাড়িঘর হলেও সেই বাড়িটা মোটামুটি আগের মতোই আছে৷ তবে বয়সের ভারে আরও কিছুটা যেন জীর্ণ-বিবর্ণ দেখাচ্ছে তাকে৷ রোয়াকঅলা বাড়িটা কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে রাস্তার ওপর৷ এক সময় সমীরণ কত আড্ডা দিয়েছেন এই রকে৷ এ বাড়িতে তখন প্রায়ই আনাগোনা ছিল তাঁর৷ নিজেরা থাকতেন এ বাড়ির পেছনের রাস্তায় একচিলতে একটা টালির ঘর ভাড়া নিয়ে৷ বাড়ির দরজার সামনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর দরজায় টোকা দিলেন তিনি৷ যেন স্মৃতির দরজায় ঘা দিলেন বহু বছর পর৷

ভেতর থেকে একটা গলা শোনা গেল, ‘দরজা খোলা আছে৷’ সমীরণ পাল্লা ঠেলে ঘরে পা রাখলেন৷ ভিতরে একটা টেবিলে একরাশ কাগজপত্রের মধ্যে মুখ গুঁজে বসেছিলেন একজন৷ মাথায় টাক, চোখে মোটা কাচের চশমা, শীর্ণকায় একজন লোক৷ সমীরণের দিকে লোকটা মুখ তুলে তাকাল৷ সমীরণ তাকে সমীর আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই লোকটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘আরে, সমীরণ না? অমার মন বলছিল তুই যখন এখানে আসছিস, তখন নিশ্চয়ই আমার খোঁজ নিবি৷’

সমীরণ এবার চিনতে পারলেন তাঁকে৷ আরে, এই তো সমীর! কাছে গিয়ে সমীরকে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, ‘এ কী চেহারা হয়েছে তোর? সে সময়ের কেউ যদি তোকে দেখে আজ, তা হলে চিনতেই পারবে না৷’

সমীর বলল, ‘লোকের আমাকে চিনে কী দরকার? আমি তো তোর মতো বিখ্যাত নই৷’ মৃদু অভিমানের সুর ধরা দিল তার গলায়৷ টেবিলের পাশেই অন্য একটি চেয়ারে মুখোমুখি বসলেন সমীরণ৷ তার পর তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কেমন আছিস? কী করছিস?’

সমীর জবাব দিল, ‘এই আছি৷ সামান্য একটা কাজ করি৷ কোনোরকমে দিন কেটে যায়৷ তুই তোর খবর বল? তুই তো এখন বিরাট মানুষ৷ মাঝেমধ্যেই টেলিভিশনে, খবরের কাগজে তোর ছবি দেখি!’

সমীরণ হেসে বললেন, ‘বড়ো মানুষ অন্যদের কাছে, তোর কাছে বন্ধুই৷ আচ্ছা, তুই খেলা ছেড়ে দিয়েছিলি নাকি? জানিস, কলকাতা মাঠে আমি খোঁজ করতাম সমীর নামে কোনো রাইট উইঙ্গার খেলছে নাকি? তখন তো আর মোবাইলের যুগ ছিল না৷ আর যেভাবে আমাকে এখান থেকে এক ঘণ্টার নোটিশে চলে যেতে হয়েছিল যে যাওয়ার আগে তোর সঙ্গে দেখাও করে যেতে পারিনি৷ সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল৷ এবার থেকে যোগাযোগ হবে৷ তোর ফোন নম্বরটা দে তো!’

সমীর বলল, ‘আমার তো ফোন নেই, তোর ফোন নম্বর দিয়ে যাস৷’ খেলা ছাড়ার প্রসঙ্গটা যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে গেল সে৷ সমীরণ এর পর পুরনো দিনের গল্প শুরু করলেন৷ এতদিন পর তিনি সমীরের খোঁজ নিতে এলেন— এ ব্যাপারটা সমীর কীভাবে নেবে তা নিয়ে একটা ভয় ছিল মনে৷ সে ভয়টা কেটে গেল৷ অতীতের নানা ঘটনা নিয়ে মশগুল হয়ে গেলেন দুজনে৷ যেন কোনো দিন বিচ্ছেদ হয়নি তাঁদের মধ্যে৷ ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলল৷ ঘণ্টাখানেক গল্পগুজবের পর সমীরণ তাকে বললেন, ‘শোন, এই নে আমন্ত্রণপত্র৷ আজ তুই অনুষ্ঠানে যাবি৷ আমার সঙ্গেই যেতে পারিস৷ উদ্যোক্তাদের আমি তোর কথা বলেছি৷ ওরা তোকেও সংবর্ধনা দেবে৷ বেলা তিনটেতে অনুষ্ঠান শুরু৷’

কার্ডটা হাতে নিয়ে আবেগে আপ্লুত সমীর বলল, ‘আমার মতো সামান্য মানুষকে সংবর্ধনা!’ চশমা আড়ালে চোখ ছলছল করে উঠল তার৷

সমীরণ বললেন, ‘হ্যাঁ, তোকে সংবর্ধনা দেবে ফুটবলার হিসেবে৷ এখন কেউ না জানলেও আমি জানি, আমার থেকে তোর যোগ্যতা বেশি ছিল৷ কেন যে তুই খেলা ছেড়ে দিলি!’

সমীর বিড়বিড় করে বলল, নিশ্চয়ই যাব, নিশ্চয় যাব৷ তুই যা, আমি নিশ্চয়ই যাব৷’ তার পর হঠাৎ সমীরণের ব্লেজারটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা ইন্ডিয়া টিমের ব্লেজার, তাই নারে? এক সময় আমিও এই ব্লেজার গায়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতাম৷’

সমীরণ তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘এ ব্লেজার গায়ে দেওয়ার যোগ্যতা আমার চেয়ে তোর কম ছিল না৷ জানিস, উদ্যোক্তারা সিমেন্টের ওপর পায়ের ছাপ নেবে৷ আমার বাঁ পা আর তোর ডান পায়ের ছাপ সারা জীবনের জন্য পাশাপাশি থাকবে৷’ সমীরের কাঁধে হাত রাখা সমীরণ অনুভব করলেন, তাঁর কথা শুনে সমীর যেন আবেগে কেঁপে উঠল৷ সমীরণ এর পর তার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন৷

তিন

তিনটেতে অনুষ্ঠান শুরু৷ এক ঘণ্টা আগেই ক্লাবে ফিরে এলেন সমীরণ৷ রঙিন পতাকায় মাঠ সাজানো হয়েছে৷ একপাশে মঞ্চ বাঁধা৷ মাইকে ঘোষক নির্দিষ্ট সময় সবাইকে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন৷ ইতিমধ্যে কিছু লোকজন জড়ো হতে শুরু করেছে৷ সমীরণ ফিরে আসতেই কর্মকর্তাদের কয়েকজন এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভদ্রলোককে পেয়েছেন? তিনি আসবেন? তা হলে ওঁর নামও ঘোষণা করব আমরা৷ একটা ছোটো সংবর্ধনাও আমরা ওঁকে দেব ভেবেছি৷’

সমীরণ হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, তিনি আসবেন৷ তার নাম সমীর মিত্র৷’ কিছুক্ষণের মধ্যেই মাইকে ঘোষণা শুরু হল, ‘আমাদের এই ফুটবল প্রশিক্ষণ শিবিরের উদ্বোধন করবেন ভারতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন সদস্য সমীরণ পালিত মহাশয়৷ তাঁর সঙ্গে সংবর্ধনা প্রদান করা হবে কুসুমপুরের এক সময়কার খ্যাতনামা ফুটবলার সমীর মিত্র মহাশয়কে…’

সময়ের সঙ্গেসঙ্গে ভিড়ে ভরে উঠল মাঠ৷ অন্য অতিথিরাও একে একে আসা শুরু করলেন৷ কর্মকর্তারা সমীরণের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ ক্লাবঘরের ভিতরেই মবড হয়ে গেলেন সমীরণ৷ কেউ তাঁর সঙ্গে ছবি তুলছে, কেউ আবার নানা প্রশ্ন করছে, অথবা বাড়িয়ে দিচ্ছে অটোগ্রাফের খাতা৷ এত কিছুর মধ্যেও তাঁর মন পড়ে আছে অন্য দিকে৷ সমীর কখন আসবে?

তিনটে বাজল একসময়৷ এক কর্মকর্তা এসে বললেন, ‘দাদা, এবার মাঠে যেতে হবে৷ অনুষ্ঠান শুরু হবে৷ আপনার সেই ভদ্রলোক কি এসেছেন? আমরা তো তাঁকে চিনি না৷ বাইরে অনেক লোকের ভিড়!’

ক্লাব থেকে বেরিয়ে মাঠ, মঞ্চের দিকে অন্যদের সঙ্গে এগোলেন সমীরণ৷ রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে মেয়েরা৷ শাঁখ বাজাচ্ছে, ফুলের পাপড়ি ছড়াচ্ছে৷ মাইকগুলো অবিরতভাবে বলে যাচ্ছে— ‘আমাদের অনুষ্ঠান এখনই শুরু হবে৷ আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন অতীত দিনের দিকপাল জাতীয় দলের প্রাক্তন সদস্য সমীরণ পালিত মহাশয়৷ তিনি মঞ্চে আসছেন, আপনারা তাঁকে করতালি দিয়ে সংবর্ধিত করুন…’

প্রচুর লোক হয়েছে৷ এখন তো ফুটবলের পড়ন্ত বেলা৷ বইপত্তরের ভারে, কম্পিউটার, টেলিভিশনের দৌলতে এমনিতেই ছেলেরা আর মাঠে যায় না৷ তার ওপর ক্রিকেটের রমরমা৷ তা সত্ত্বেও মাঠে এত লোক হবে, ধারণা ছিল না সমীরণের৷ ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর ছ-ফুট শরীরটা আরও তুলে ধরে সমীরণ দেখার চেষ্টা করলেন সমীর কোথাও আছে কিনা!

মঞ্চে উঠলেন সমীরণ৷ অন্য অতিথিরাও উঠলেন৷ স্থানীয় বিধায়ক, বিডিও সাহেব, হেডমাস্টার, গণ্যমান্য সব ব্যক্তি৷ তাঁরা মঞ্চে উঠতেই হাততালির ঝড়৷ মঞ্চের ঠিক নীচেই দাঁড়িয়ে জনা তিরিশেক ছোটো ছোটো বাচচা৷ গায়ে জার্সি, পায়ে বুট, কারও হাতে ফুটবল৷ তারা এই প্রশিক্ষণ শিবিরের শিক্ষার্থী৷ স্থানীয় কিছু ফুটবলার আর যাঁরা ছেলেদের খেলা শেখাবেন তাঁরাও আছেন৷ মঞ্চ থেকেই দেখা যাচ্ছে মাঠের একপাশে একদল লোক লম্বা একটা সিমেন্টের স্ল্যাব বানানোর কাজ শুরু করেছে৷ সিমেন্ট গোলা হচ্ছে সেখানে৷ সমীরণের পায়ের ছাপ ধরে রাখা হবে ওর ওপর৷ আসন গ্রহণ করার পর সমীরণ একবার উঠে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলেন, সমীরকে কোথাও দেখা যায় কিনা? উদ্যোক্তারা তাকে চেনে না, হয়তো সে নিজে থেকে এগিয়ে আসতে লজ্জাবোধ করছে! কিছুক্ষণ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করার পর সমীরণ ঘোষককে ডেকে বললেন, ‘একবার মাইকে ডেকে দেখবেন যে সমীর মিত্র মাঠ উপস্থিত আছে কিনা! তাকে মঞ্চে আসতে বলুন৷’

সমীরণের কথামতো মাইকে বেশ কয়েকবার সমীরের নাম ধরে ডেকে তাঁকে মঞ্চে আসার অনুরোধ জানানো হল৷ কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না৷

সমীরণের মনরক্ষার জন্যই হয়তো উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করল সমীরের জন্য৷ কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যায় না৷ অতিথিরা ব্যস্ত মানুষ, তাঁদের সময়ের দাম আছে৷ মিনিট দশেকের মধ্যেই উশখুশ শুরু করলেন তাঁরা৷ মঞ্চের নীচে সমবেত জনতা অনুষ্ঠান শুরুর প্রতীক্ষায়৷ সমীরণ শুনতে পেলেন মঞ্চে বসা হেডমাস্টার মশাই বিধায়ককে বললেন, ‘যে সব মানুষের সময়ের দাম নেই, তাঁদের জন্য অপেক্ষা করা উচিত নয়৷ উনি তো ভি আই পি নন৷ আমি ওঁর নাম কোনোদিন শুনিনি৷’

বিধায়ক বললেন, ‘হ্যাঁ আমারও অন্য প্রোগ্রাম আছে৷ মঞ্চের কাজ শেষ হলেই আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে৷’

সমীরণ বেশ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন৷ উদ্যোক্তাদের মুখ দেখেও বোঝা যাচ্ছে তারাও অস্বস্তিতে৷ শেষে তাদের একজন সমীরণের কানে কানে বললেন, ‘স্যার, আমরা অনুষ্ঠান শুরু করে দিচ্ছি৷ উনি এলে মঞ্চে উঠিয়ে নেব৷’

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলে৷ অতিথি বরণ, সংবর্ধনা জ্ঞাপন, একে একে অতিথিদের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতাদান… মঞ্চে বসে সমীরণের চোখ খুঁজতে লাগল সমীরকে৷ আর সঙ্গে সঙ্গে সমীরের প্রতি ক্ষোভ জাগতে শুরু করল৷ একটা অহংবোধও উঁকি দিতে লাগল তাঁর মনে৷ সমীরণ বিখ্যাত মানুষ, তিরিশ বছর আগেকার সেই গণ্ডগ্রামের মাঠে সমীরের সাথী নয়৷ তিনি আজ সেলিব্রিটি৷ কত মানুষ, কত ফুটবলার তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য বাড়ির দরজায় হাজির হয়৷ আর সেই সমীরণ এক অখ্যাত সমীরের বাড়ি বয়ে গিয়ে সংবর্ধনার আমন্ত্রণ জানিয়ে এলেন, অথচ সে এল না! কী ভাবছে অনুষ্ঠানের আয়োজকরা? ভাবছে সমীরণের কথার কোনো গুরুত্ব নেই৷ মঞ্চে বসা সমীরণের চোয়াল ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠল৷ তবুও তিনি নিজের বক্তৃতা দেওয়ার সময় একবার সমীরের নাম উল্লেখ করে বললেন, ‘এ মাঠে সে সময় আমার সঙ্গে আরও একজন খেলতেন৷ তার নাম সমীর মিত্র৷ খুব ভালো প্লেয়ার ছিল সে৷ দুজনে একসঙ্গে অনেক খেলেছি৷ আজকের অনুষ্ঠানে তার উপস্থিত থাকার কথা ছিল, কোনো কারণে হয়তো উপস্থিত হতে পারেনি৷’

মঞ্চের কাজ শেষ হল৷ তার পর ছোটো ছোটো ছেলেদের নিয়ে মাঠের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন তিনি৷ এই মাঠটাকে তাঁর মা বললেও অত্যুক্তি হয় না৷ এই মাটেই তো ফুটবল জীবনের জন্ম তাঁর৷ আবেগমথিত সমীরণ মাটি ছুঁয়ে মাঠটাকে প্রণাম করার পর বেশ কিছুক্ষণ ধরে কচিকাঁচাদের ড্রিবলিং দেখালেন, কিছু পরামর্শ দিলেন, একটা ব্যাকভলিও করলেন৷ তুমুল হর্ষধ্বনি উঠল জনতার মধ্যে৷ করতালির ঝড়৷

মাঝমাঠের কাজ মেটার পর উদ্যোক্তারা সমীরণ আর ছোটো ছেলেদের নিয়ে হাজির হল মাঠের একপাশে৷ এবার শেষ কাজ৷ বিরাট ট্রের মতো একটা জায়গাতে সিমেন্টের একটা স্ল্যাব বানানো হয়েছে৷ তার ওপর চিরদিনের জন্য আঁকা থাকবে বিখ্যাত ফুটবলার সমীরণ পালিতের পায়ের ছাপ৷ বাঁ পায়ের ছাপ দেওয়ার জন্য সমীরণ জুতো-মোজা খুলে শেষ একবারের জন্য চারপাশে তাকালেন৷ যদি শেষ মুহূর্তেও সে এসে থাকে, দেখার জন্য৷ ব্যাপারটা অনুমান করেই সম্ভবত পাশে দাঁড়ানো আয়োজকদের একজন বলল, ‘স্যার, ভদ্রলোক সম্ভবত আসবেন না৷ এলে নিশ্চয়ই আগেই আসতেন৷’ সমীরণ তাকে কিছু বললেন না৷ চোয়াল শক্ত করে সিমেন্টের নরম স্ল্যাবে পা রাখলেন৷ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলকে উঠল৷ অক্ষয় হয়ে রইল তাঁর পায়ের ছাপ৷ ঘণ্টা তিনেক পার হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই৷ এর পর মিনিট দশেকের মধ্যেই অনুষ্ঠান শেষ৷ সন্ধ্যা নামছে৷ শীতের ছোট বেলা৷ সমবেত জনতা যে যার পথ ধরল৷ অনুষ্ঠান শেষে কর্মকর্তারা সমীরণকে ক্লাবে নিয়ে গেলেন৷ সেখানে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন৷ না খাইয়ে তারা তাঁকে ছাড়বে না৷ সমীরের ব্যাপারটা নিয়ে মনটা তেঁতো হয়ে থাকলেও আপত্তি করলেন না তিনি৷ খাওয়াদাওয়া, কথাবার্তায় আরও ঘণ্টা দুই কেটে গেল৷ সব শেষে আয়োজকরা যখন সমীরণকে তাঁর গাড়িতে তুলে দিল, তখন আকাশে চাঁদ উঠে গেছে৷ মাঠের একদিকে জমতে শুরু করেছে কুয়াশার আবরণ৷ শূন্য মাঠ৷

চার

মাঠটা বিরাট৷ তাকে তিন দিকে বেড় দিয়ে বড়ো রাস্তায় উঠতে হবে৷ ধীরগতিতে চলতে শুরু করল সমীরণের গাড়ি৷ সমীরণ তাকিয়ে রইলেন কুয়াশামাখা মাঠের দিকে৷ আর কোনো দিন তাঁর ফেরা হবে না এ মাঠে৷ এই শেষ দেখা৷ আকাশে চাঁদ উঠেছে, সেই আলোতে কেমন যেন মায়াময় লাগছে মাঠটাকে৷ সমীরণের কৈশোর ঘুমিয়ে থাকবে ওই মাঠে৷ মাঠটাকে বেড় দিয়ে সমীরণের গাড়ি তখন বড়ো রাস্তায় উঠতে যাচ্ছে৷ ঠিক তখনই এক ছায়ামূর্তি দেখতে পেলেন সমীরণ৷ মাঠের এক পাশে তালগাছ দুটোর নীচে দাঁড়িয়ে তাঁর গাড়ি থামাবার জন্য হাত নাড়ছে একজন৷ গাড়ি থামল৷ চাঁদের আলোয় তার অবয়ব দেখে মুহূর্তের মধ্যে চিনে ফেললেন৷ ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে তাঁর উদ্দেশে হাত নাড়ছে সমীর!

গাড়ি থেমে নেমে সমীরণ এগোলেন তার দিকে৷ এই তো শেষ দেখা৷ যাওয়ার আগে জেনে যাবেন কেন সে এভাবে তাঁকে অপদস্থ করল আয়োজকদের কাছে! কী এত ক্ষোভ তাঁর ওপর? নাকি ব্যর্থ মানুষের দম্ভ কাজ করেছে না আসার পিছনে?

সমীরণের হাতে একটা বাঁধানো খাতামতো কী যেন একটা ধরা আছে৷ ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি জেগে আছে চাঁদের আলোতে৷ সমীরণ তার সামনে গিয়ে ক্ষোভের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, ‘আসবি বলে এলি না কেন? এত দিন পর দেখা হল, আমি নিজে গেলাম, তুই আমার শেষ অনুরোধটা রাখলি না? আয়োজকদের কাছে আমাকে বেইজ্জত হতে হল৷’

সমীর কোনো জবাব দিল না৷ শুধু তার হাসিটা আর একটু স্পষ্ট হল৷ তা লক্ষ্য করে সমীরণের মনে হল সমীরের হাসিটা হয়তো ব্যঙ্গ করছে তাঁকে৷ তিনি বললেন, ‘অনুমান করতে পারছি ব্যাপারটা৷

আমরা একসঙ্গে দুজনে খেলতাম৷ হয়তো বা তুই কিছুটা ভালো খেলতি আমার চেয়ে৷ কিন্তু আমি এতটা ওপরে উঠে গেলাম, আর তুই কিছু হতে পারলি না৷ তাই তুই আজ কায়দা করে বেইজ্জত করলি আমাকে৷ আমি চেয়েছিলাম তুইও আজ আমার সঙ্গে একটা সম্মান পাস৷ তোরও পায়ের ছাপ আঁকা থাকুক মাঠে৷ আমার সৌজন্যেই তো ব্যাপারটা ঘটত৷ নইলে ফুটবলার হিসাবে কেউ তোকে এখানে চেনে না৷’

সমীর বেশ শান্ত স্বরে বলল, ‘ক্ষোভ যে আমার একটা সময় ছিল না, তা অস্বীকার করে না৷ কিন্তু সে ক্ষোভ বহু বছর আগেই কেটে গেছে৷ তবে সেটা অন্য ব্যাপার৷’

‘কী ব্যাপার?’

সমীর বলল, ‘অত দিনের পুরনো ঘটনা আজ বলার ইচ্ছা ছিল না৷ তবু তুই বলছিস যখন বলি৷ তিরিশ বছর আগের এরকমই শীতের সন্ধ্যায় পরেশ সাঁতরা যার খোঁজে এই গ্রামে এসেছিলেন সে সমীর, সমীরণ নয়৷’

‘মানে?’

সমীর বলল, ‘মানে হল, সমীর আর সমীরণ নামটা গুলিয়ে ফেলেন উনি৷ গ্রামে ঢোকার মুখে তাঁর সঙ্গে বোঁচা আর পিণ্টুর দেখা হয়৷ তাদের কাছে কুসুমপুরের রাইট উইঙ্গার সমীরণের বাড়ির ঠিকানা জানতে চান৷ বোঁচার সঙ্গে সে সময় আমার একটা মনোমালিন্য চলছিল খেপ খেলার ব্যাপারে৷ আমার ওপর সে রেগে ছিল৷ তাই ইচ্ছাকৃতভাবেই আমার বাড়ির বদলে তোর বাড়ি দেখিয়ে দেয়৷

পরেশ সাঁতরা জোর দিয়েই বলেছিলেন, রাইট উইঙ্গারকে খুঁজছেন৷ তোকে নিয়ে তিনি চলে যাওয়ার পরই সে রাতে পিণ্টু এসে খবরটা আমাকে বলে৷’

সমীরণের মনে হল হয়তো তিনি আসল ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ, এটা হতে পারে৷ তোকে মিথ্যা বলব না, কলুটোলার ট্রায়ালের দিন আমি লেফট উইঙ্গার খেলি শুনি পরেশদা একটু যেন অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তো শুনেছিলাম রাইট উইঙ্গার খেল?’ ব্যস, এটুকুই বলেছিলেন৷ তোর কথা বলেননি আমাকে৷ বোঁচা পিণ্টুর ব্যাপার আমার জানা ছিল না৷ আমার কী দোষ? সে দিনের ট্রায়াল ম্যাচে তিনটে গোল করেছিলাম৷ তার পর ইঞ্চি ইঞ্চি করে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে ওপরে উঠেছি৷’

সমীর বলল, ‘তোর যোগ্যতা নিয়ে তো প্রশ্ন তুলিনি৷’

সমীরণ বলল, ‘তা হলে তুই এই ছলনা করলি কেন? ক্ষোভটা নিশ্চয়ই তোর মনে আছে৷ তুই যখন সে রাতেই ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল, তবে পরদিনই কলুটোলায় হাজির হলি না কেন? তা হলে তো সুযোগ পেতিস? আজ আর কোনো রাগ থাকত না৷’

সমীর হেসে বলল, ‘মিথ্যা রাগ করছিস আমার ওপর৷ আমি যে তোর ওপর রাগ পুষে রাখিনি, এই বাঁধানো খাতাটা তার প্রমাণ৷ খাতাটা ধর৷ এটা আমার উপহার তোকে৷ তোর ফুটবল জীবনের স্মরণীয় ঘটনার পেপার কাটিংগুলো যত্ন করে জমিয়ে রেখেছি এই খাতায়৷ এটা তোকে দেওয়ার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ কত বড়ো প্লেয়ার তুই৷ আমাকে যে মনে রেখেছিস, সেটাই অনেক বড়ো পাওয়া৷’ কোনো শ্লেষ নয়, আন্তরিকতা-ভালোবাসার স্পষ্ট সুর গলাতে৷

সমীরণ হতবাক৷ খাতাটা নিলেন৷

সমীর বলল, ‘তা হলে আমি চলি ভাই?’

সমীরণ বললেন, ‘যাওয়ার আগে বলে যাবি না, কেন তুই অনুষ্ঠানে এলি না? এই মাঠে আঁকা থাকত আমাদের পায়ের ছাপ৷ এই সুযোগ তো আর আসবে না৷’

সমীরের ঠোঁটের কোণে একটা আবছা হাসি৷ সে বলল, ‘আমার পায়ের ছাপ তো ওই কংক্রিটের স্ল্যাবে আঁকা যেত না, তাই এলাম না৷’

‘মানে?’

সমীর বলল, ‘সেদিনের সেই রাতে পিণ্টুর কাছে খবরটা পাওয়ামাত্রই স্টেশনে ছুটলাম ট্রেন ধরে কলকাতায় যাওয়ার জন্য৷ রাতের শেষ ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে৷ ট্রেনটা ধরতেই হবে৷ ট্রেনের হাতল ধরার জন্য ঝাঁপ দিলাম…৷’ কথা শেষ না করে সমীর থেমে গেল৷ যেন মৃদু কেঁপে উঠল সে৷ মুহূর্তের জন্য তার হাসিটাও মিলিয়ে গেল৷

সমীরণ উত্তেজনায় বলে উঠলেন, ‘তার পর? তার পর?’

‘তার পর?’ হাসি সমীরের ঠোঁটে৷ সমীরণের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়াল সে৷ তার পর ডান পা-টা একটু ওপরে উঠিয়ে বাঁ হাত দিয়ে টান দিল পায়র পাতায়৷ সমীরের বাঁ হাতে উঠে এল তার ডান পায়ের পাতাটা৷ কাঠের তৈরি! ফুটবলে পা ছোঁয়ালে যে পাতায় কোনো শিহরণ জাগে না৷ আগুনের গোলার মতো শটে নেট ছিঁড়ে ফেলতে পারে না৷ অনুভূতিহীন, ক্ষমতাহীন নিছক কাঠের একটি পা৷ সেই কেঠো পায়ের পাতা আবার ছিন্ন ডান পায়ে পরে নিতে নিতে সমীর বলল, ‘চলন্ত ট্রেনের হাতলটা ফসকে গেছিল৷ পা-টা চলে গেল ট্রেনের তলায়, কলুটোলায় আর যাওয়া হল না৷ ঠিক তোর ব্যাকভলির মতোই ট্রেনের তলায় ছিটকে পড়েছিলাম৷’

দুজন মাঠটার দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ৷ সমীরণ এক সময় তাঁর ব্লেজারটা খুলে পরিয়ে দিলেন সমীরের গায়ে৷ সমীর বিষণ্ণ হাসল, আপত্তি করল না৷ তারপর ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল মাঠের দিকে৷ দূরে কুয়াশায় হারিয়ে গেল সমীর৷ চাঁদের আলোতে জেগে আছে মাঠটা৷ সেই আলোতে সমীরণ যেন দেখতে পেলেন, সারা মাঠ জুড়ে জেগে আছে অসংখ্য পায়ের ছাপ৷ হাজারে হাজারে, লাখে লাখে পায়ের ছাপ! সমীরের পায়ের ছাপ! কংক্রিটের স্ল্যাবে সমীরণ যে পায়ের ছাপ এঁকে গেলেন, হাতুড়ি-ছেনি দিয়ে সে ছাপ মোছা গেলেও মাঠে আঁকা সমীরের পায়ের ছাপগুলো মোছা যাবে না কোনো দিন৷ নক্ষত্রখচিত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে সমীরণ তাকিয়ে রইলেন সেই ছাপগুলোর দিকে৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *