বোয়িং-২০৫০
৷৷ ১৷৷
খুব ধীর গতিতে এগোচ্ছিল সিকিওরিটি চেকের জন্য লাইনটা৷ পাশে আরো দুটো লাইন, সে দুটোও এগোচ্ছে খুব মন্থর গতিতে৷ মাঝখানের লাইনটাতেই দাঁড়িয়েছিল মাইক, ফিলিপ আর জর্ডন৷ অন্তত পাসপোর্ট আর অন্য পরিচয়পত্রে তাদের এ নামগুলোই লেখা আছে৷ তবে পরপর নয়, প্রত্যেকেই তারা দাঁড়িয়েছিল কয়েকজনের তফাতে তফাতে৷ লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলো এসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে৷ চেহারা আর পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাদের কেউ ইওরোপিয়ন, কেউ আমেরিকান, কেউ এই এশিয়া বা কেউ আফ্রিকার লোক৷ সবার মুখেই খুশির ঝিলিক৷ আজ এক দুর্লভ ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছে তারা৷ এই প্রথমবার লোকগুলো পৃথিবীর ইতিহাসে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সাতটা মহাদেশে পা রাখবে, ভাবা যায়! সেই উচ্ছ্বাসই ফুটে উঠেছে তাদের চোখে-মুখে৷ মনের ভিতর যত উৎকণ্ঠাই থাকুক মাইক, ফিলিপ আর জর্ডনও নিজেদের ঠোঁটের কোণে যথাসম্ভব হাসি ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল৷ আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা জাপানিজ কমান্ডো বাহিনীর লোকগুলোর সতর্ক দৃষ্টি বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে সিকিওরিটি চেকিং-এর জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার মুখগুলো৷ যদিও সিকিওরিটি চিফের সঙ্গে গতকাল বিকালেই একপ্রস্থ বৈঠক হয়েছে মাইকদের৷ তাঁর কাছে পৌঁছে গেছে বাক্সভর্তি ডলার এবং তাঁরই বদান্যতায় নিরাপত্তা বলয়ের আগের দুটো ধাপ অতিক্রম করা গেছে৷ তিনি নিজে এসে তাদের পরীক্ষা করতে আসায় তাঁর অধস্তন কর্মীরা আর তাদের পরীক্ষা করেনি, কিন্তু যতক্ষণ না তারা নিরাপত্তা বলয়ের শেষ ধাপ অতিক্রম করে বোর্ডিং পাস হাতে পাচ্ছে ততক্ষণ কোনো বিশ্বাস নেই৷ হয়তো শেষ মুহূর্তে ধরা পড়ে গেল তারা৷ ব্যর্থ হল একবছর ধরে করা তাদের এই পরিকল্পনা৷ তাই যাতে তাদের প্রতি নিরাপত্তারক্ষীদের মনে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ সৃষ্টি না হয় তার চেষ্টাই করে চলছিল তারা তিনজন৷ মাইকের পাসপোর্ট ইউনাইটেড কিংডমের, ফিলিপের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর জর্ডনের অস্ট্রেলিয়ার৷ তাদের তিনজনের অবয়বও ভিন্ন৷ মাইক ছিপছিপে লম্বা মাঝবয়সী, ফিলিপ টাকমাথা গোলগাল চেহারার আর জর্ডন বয়সে যুবক হলেও তাকে দেখতে খর্বাকৃতি চশমা পরা নিরীহ স্কুল মাস্টারের মতো৷ শুধু একটা ব্যাপারেই তাদের তিনজনের মধ্যে মিল আছে৷ গায়ের রঙ৷ সেটা লুকোতে পারেনি মাইকরা৷ তাদের চামড়ার রঙ দেখেই যে কেউ বলে দেবে তারা আফ্রিকান৷ ‘এ ব্যাপারটা কোনো সন্দেহের কারণ ঘটাবে না তো?’ এ প্রশ্নটা একবার উঁকি দিল মাইকের মনে৷ পরক্ষণেই আবার তার মনে হল আফ্রিকান যাত্রী তো আরও বেশ কয়েকজন আছে আশেপাশে৷ শুধুমাত্র তাদেরই বা সন্দেহ করতে যাবে কেন বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষীরা? তাই শান্তভাবে মাইক এগিয়ে চলল শেষ নিরাপত্তা বলয় অতিক্রম করার জন্য৷
মাইক একসময় পৌঁছে গেল জায়গাটাতে৷ প্রথমে একটা স্ক্যানার মেশিনের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে হবে তাকে৷ ইতিমধ্যেই চিফ সিকিওরিটি অফিসার তাজুমা এসে দাঁড়িয়েছেন সেখানে৷ ভাবলেশহীন মুখ৷ এ লোকটাকেই গতকাল ডলারের বাক্স দিয়েছে মাইকরা৷ লোকটা কাল বলছিল যে কাজ মিটে গেলে আজই সে পাড়ি দেবে অজ্ঞাত কোনো দেশে৷ বাকি জীবনটা সেখানে সে আরাম-আয়েশে কাটাবে৷ স্ক্যানার মেশিনের গায়ে মনিটর স্ক্রিনে যে ছবি ফুটে উঠছে তা ভালো করে দেখার অছিলায় তাজুমা সেই মনিটার স্ক্রিনটা তাঁর দেহ দিয়ে এমনভাবে আড়াল করে দাঁড়ালেন যে উপস্থিত অন্য নিরাপত্তাকর্মীদের চোখের আড়ালে চলে গেল সেটা৷ কয়েক মুহূর্তমাত্র আর তার মধ্যেই মাইক পেরিয়ে গেল স্ক্যানার মেশিনটা৷ এরপর তাজুমা নিজে তার কাছে এগিয়ে এসে তার হাতের ব্যাগটা খুলে পরীক্ষা করলেন তারপর ইশারায় অন্যদের জানিয়ে দিলেন চূড়ান্ত নিরাপত্তা পরীক্ষায় পাশ করেছেন এই যাত্রী৷ চাপটা এবার অনেকটাই কমে গেল মাইকের মন থেকে৷ সে এগোল বোর্ডিং পাস সংগ্রহের জন্য৷ সুবেশী এয়ারপোর্টকর্মী দুজন মহিলা তাকে স্বাগত জানিয়ে তার হাতে তুলে দিল বোর্ডিং পাস আর একটা ফুলের তোড়া৷ তা হাতে নিয়ে ‘বোয়িং-২০৫০’ বিমানের যাত্রী অতিথিদের জন্য বিশেষ লাউঞ্জের একটা নরম সোফায় গিয়ে বসল মাইক৷ তার সামনে একটা খবরের কাগজ রাখা আছে৷ সেখানে প্রথম পাতাতেই বেশ ফলাও করে ছাপা হয়েছে ‘বোয়িং-২০৫০’-এর উড়ানের ব্যাপারটা৷ আর হবে নাই বা কেন? এই প্রথম বিমান পৃথিবীর মানুষদের চব্বিশ ঘণ্টায় ছোঁয়াবে পৃথিবীর সব মহাদেশের মাটি৷ প্রথমে এশিয়া থেকে আফ্রিকা তারপর অন্য মহাদেশের ভূখণ্ড ছুঁয়ে বিমান যাত্রা শেষ হবে আন্টার্কটিকায়৷ ২০৫০ সালের জানুয়ারির প্রথম দিনের এই বিমান উড়ানের ঘটনা লেখা হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়৷ তাই বছরটার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই বিমানের নামকরণ করা হয়েছে ‘বোয়িং-২০৫০’৷
কাগজটার প্রথম পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে তার ফাঁক দিয়ে মাইক লক্ষ রাখতে লাগল লাউঞ্জের প্রবেশ মুখের দিকে৷ সিকিওরিটি চেকিং মিটে যাবার পর বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে একে একে লাউঞ্জে এসে বসছে যাত্রীরা৷ এক সময় সে পথ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল ফিলিপ, আর তার কিছুক্ষণের মধ্যে জর্ডনও৷ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল দলনেতা মাইক৷ পরিকল্পনার প্রথম ধাপটা নিখুঁতভাবে উতরে যেতে পেরেছে তারা৷ মাইকের থেকে বেশ তফাতে লাউঞ্জের দু-প্রান্তে আলাদা আলাদা ভাবে সম্পূর্ণ অপরিচিতের মতন আসন গ্রহণ করল ফিলিপ আর জর্ডন৷ তাদের একজন মনোনিবেশ করল সামনে পড়ে থাকা একটা ম্যাগাজিনের পাতায়৷ আর একজন উচ্ছ্বাসিতভাবে অন্যদের দেখতে লাগল অন্য যাত্রীদের মতো৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রীদের একটা বড় দল একসঙ্গে প্রবেশ করল লাউঞ্জে৷ ওমনি উপস্থিত সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল তাদের দিকে৷ এরা বিমানের অতিথি যাত্রী৷ ভি. ভি. আই. পি সব৷ ঐ তো অস্ট্রেলিয় ওপেন টেনিস গ্র্যান্ডস্লাম বিজয়ী মরিয়া নিকোলাস, সাউথ আফ্রিকার ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন, হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা টম মুর, ইওরোপের বিখ্যাত পপ সিঙ্গার অ্যাঞ্জেলিনা, আরও পৃথিবীবিখ্যাত মানুষ৷ সংবাদপত্র আর টেলিভিশনের দৌলতে সারা পৃথিবীতে পরিচিত মুখ সব৷ তাদের এই প্রথম চাক্ষুষ করলেও সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে তাদের মুখগুলোও চেনা মাইকের৷ তাদের দেখে মনে মনে হাসল মাইক৷ এ সব পৃথিবীবিখ্যাত লোকজনের সংখ্যা বিমানে যত বাড়বে তত তারা চাপ সৃষ্টি করতে পারবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে৷ রাষ্ট্রসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী সামরিক অভিযান চালিয়ে তো প্রায় নিকেশই করে দিয়েছে তাদের বাহিনীকে৷ তাদের দলনেতা ডেভিড আর কয়েকশো আত্মঘাতী সেনা শুধু এখনও টিকে আছে তাদের দখলিকৃত সেই গোপন জায়গায়৷ সে জায়গা দুর্গম বলে অভিযান চালাতে পারছে না রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেনারা৷ কিন্তু এই মানুষগুলোর প্রাণের জন্যই আবার পিছু হটতে বাধ্য হবে তারা৷ অর্থ আসবে, নিরাপত্তা আসবে, আবার বিশাল জেহাদি বাহিনী গড়ে উঠবে অভিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য৷ একসময় নতুন দেশ গড়ে তুলবে তারা৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ডক্টর আকিরাকে লাউঞ্জে প্রবেশ করতে দেখল মাইক৷ ব্রাজিলের ফুটবল দলের অধিনায়ক মার্কেজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে লাউঞ্জে প্রবেশ করলেন আকিরা৷ এই ছোটখাট মানুষটাকে সমীহ করে সারা বিশ্ব৷ নোবেলজয়ী এই জাপানি বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের জগতে অসম্ভব প্রতিভাধর৷ আইনস্টাইনের পরই আজকাল তাঁর নাম উচ্চারিত হয় পৃথিবীতে৷ গতকালই টেলিভিশনের পর্দায় তাঁকে বাইট দিতে দেখেছে মাইক৷ তার হাতে ধরা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ‘বোয়িং-২০৫০’ নিয়ে যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে তাতে তাঁর ছবিও ছাপা হয়েছে রোবট সংক্রান্ত গবেষণার জন্য৷ তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেও সামরিক বিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান ও আকাশ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের নানা শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ৷ এই যে হাইপার সুপারসনিক জেটবিমান—‘বোয়িং-২০৫০’ তার নির্মাতাও রাষ্ট্রসংঘের প্রধান বিজ্ঞান প্রযুক্তি উপদেষ্টা জাপানের এই বিজ্ঞানী৷ পৃথিবীর কাছে এ লোকটার দাম কত হতে পারে? এক কোটি ডলার? না না, বেশ কম হয়েযাচ্ছে অঙ্কটা৷ এ লোকটার বিনিময়ে অনায়াসে দশ কোটি ডলার নিশ্চয়ই চাইবে ডেভিড৷ এই লোকটার প্রাণের বিনিময়ে যে কোনো চুক্তি, যে কোনো অর্থমূল্যের দাবি নিশ্চয়ই মেনে নেবে পৃথিবী৷ তাঁকে দেখে মনে মনেভাবতে লাগল মাইক৷ আর তার সঙ্গী ফিলিপ আর জর্ডনও একই কথা ভাবতে লাগল তাঁকে দেখে৷
ভি. ভি. আই. পি-দের দলটা লাউঞ্জে প্রবেশ করে সবাই মিলে এক জায়গাতে জড়ো হওয়া মাত্রই উপস্থিত সাধারণ যাত্রীরা ভিমরুলের মতো ছেঁকে ধরল তাদের৷ কেউ তাদের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য, কেউ বা তাদের অটোগ্রাফ নেবার জন্য৷ এ সব মানুষের দুর্লভ সান্নিধ্য আর জীবনে ক’বার আসে! মাইক দেখল একবার ফিলিপ গিয়ে মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলল অ্যান্ডারসনের সঙ্গে, আর একবার জর্ডন গিয়ে ছবি তুলে এল টম মুরের সঙ্গে৷ এ ছবি দুটো পরবর্তীকালে অন্তর্জালের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে প্রমাণস্বরূপ ছড়িয়ে দিতে কাজে লাগবে ডেভিডের৷ সময় এগিয়ে চলল৷ ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তাদের ডাক পড়ল লাউঞ্জ ছেড়ে ‘বোয়িং-২০৫০’-এর উদ্দেশে রওনা হবার জন্য৷ অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘোষণা শোনামাত্র নিজেদের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মাইক ও তার দুই সঙ্গী৷ সার দিয়ে লাইন করে লাউঞ্জের বাইরে এসে দাঁড়াল যাত্রীরা৷ সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বিলাসবহুল তিনটে বাস৷ তারা যাত্রীদের নিয়ে যাবে বিমানের কাছে৷ সেখানে বাসে ওঠার আগে আবার বিমান সেবিকারা ফুলের মালা দিয়ে বরণ করল যাত্রীদের৷ তিনটে আলাদা আলাদা বাসে উঠে বসল তারা তিনজন৷ বাসের চাকা ধীর গতিতে ঘুরতে শুরু করল৷ মিনিট- খানেকের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল গন্তব্যে৷
৷৷ ২৷৷
বাস থেকে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে তারাও মাটিতে নামল৷ কিছু দূরেই রাজহংসের মতো দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিমানটা৷ ওর যাত্রীবহন ক্ষমতা নাকি একহাজার৷ কিন্তু তার এই প্রথম উড়ানে অতিথি-অভ্যাগত সহ মাত্র একশোজন যাত্রীকে বিমানে ওঠার সুযোগ দেওয়া হয়েছে লটারির মাধ্যমে৷ মাইকের দলের লোকজনের অন্তত কুড়িজন স্বনামে-বেনামে আবেদন করেছিল সেই লটারিতে৷ তবে শিকে ছিঁড়েছে মাত্র তিনজনের৷ তবে তারা তিনজনই কাজটা করার পক্ষে যথেষ্ট৷
বিমানটার চারদিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে জাপ কমান্ডো বাহিনী, ঘুরে বেড়াচ্ছে স্নিফার ডগ৷ তা দেখে একটু থমকে গেল মাইক৷ বিমানে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখে আবার তল্লাশি নেওয়া হবে নাকি? তাজুমা তো এখানে নেই, তবেকি হবে এবার? মুহূর্তের মধ্যে নিজের কর্তব্য স্থির করে নিল মাইক৷ তেমন কিছু হলে বিমানটার কাছাকাছি পৌঁছে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিজেকে উড়িয়ে দেবে মাইক৷ আর তার দেখাদেখি তার দুই সঙ্গীও একই কাজ করবে৷ এমন পরিস্থিতিতে এ কাজ করারই নির্দেশ দেওয়া আছে৷ বিস্ফোরণে প্লেনটা উড়ে যাবে৷ প্লেনের ভিতর ঢুকে পড়া বা আশেপাশের ভি. ভি. আই. পি. যাত্রীদের একটা অংশ আর নিরাপত্তারক্ষীরাও মারা যাবে৷ হয়তো মারা যাবেন বিজ্ঞানী ডক্টর আকিরাও৷ মাইকদের জঙ্গি গোষ্ঠীর ক্ষমতা এখন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে৷ রাষ্ট্রসংঘের সেনার আক্রমণে কোণঠাসা হতে হতে আফ্রিকার এক প্রত্যন্ত অংশে মাত্র কয়েকশো অস্ত্রধারীকে নিয়ে কোনোমতে টিকে আছে দলপতি ডেভিড৷ আর মাইকের মতো জনপঞ্চাশেক জঙ্গি আত্মগোপন করে আছে পৃথিবীর নানাপ্রান্তে৷ ধরা পড়ার মুহূর্তে প্লেনটা যদি উড়িয়ে দেওয়া যায়, যদি আকিরা সহ পৃথিবীবিখ্যাত মানুষকে হত্যা করা যায় তবে তাও পৃথিবী কাঁপিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট হবে৷
কিন্তু তেমন কিছু ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঘটল না৷ কমান্ডো বাহিনীকে সেখানে রাখা হয়েছিল বিমানটাকে পাহারা দেবার জন্যই, যাত্রীদের পরীক্ষা করার জন্য নয়৷ ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে বিমানে প্রবেশ করতে শুরু করেছে যাত্রীরা৷ ফিলিপ আর জর্ডনও প্রবেশ করল বিমানে৷ শেষ দলের যাত্রীদের সঙ্গে মাইক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল বিমানে৷ অনেক যাত্রীই সিঁড়ির মাথায় উঠে ভিতরে প্রবেশ করার আগে মুহূর্তের জন্য পিছনে ফিরে লাউঞ্জেরদিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছেন লাউঞ্জের মাথায় নির্দিষ্ট জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকা যাঁরা তাঁদের বিদায় দিতে এসেছেন তাঁদের উদ্দেশে৷ তেমনই বিমানে প্রবেশ করার মুখে মাইকও একবার পিছনে ফিরে হাত নাড়ল লাউঞ্জের দিকে তাকিয়ে৷ সেখানে সংবাদ মাধ্যমের বড় বড় ক্যামেরাগুলোও চোখে পড়ল মাইকের৷ বোয়িং-২০৫০-এর প্রথম যাত্রী উড়ানের ছবি তুলতে ওখানে হাজির আছে পৃথিবীর বড় বড় সংবাদ মাধ্যম৷ আর কিছু সময়ের মধ্যে ঐ সব সংবাদ মাধ্যমই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবে খবরটা৷ মনে মনে হাসল মাইক৷
বিমানে প্রবেশ করা মাত্রই তার হাতের বোর্ডিং পাসটা দেখে হাসিমুখে মাইককে আপ্যায়ন করে নিয়ে চলল বিমানের সামনের দিকে তার নির্ধারিত আসনের দিকে৷ ইতিমধ্যে ফিলিপ আর জর্ডনও তাদের আসন গ্রহণ করেছে৷ ফিলিপ যাত্রীদের বসার নির্ধারিত অংশের শেষভাগে ও জর্ডন মাঝামাঝি অংশে৷ বিমানের নব্বই শতাংশ আসন খালি পড়ে৷ সমস্ত যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে ককপিটের ঠিক পিছনের অংশে৷ মাইককে নিয়ে বসানো হল ককপিট থেকে শুধু একটা সারি তফাতে৷ মাইক দেখল তার সামনে দু-পাশের সারিতে বসে আছেন বিজ্ঞানী আকিরা, ক্রিকেটার অ্যান্ডারসন, অভিনেতা মুর এঁরা৷ স্বাভাবিক নিয়মে অতিথিদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে প্রথম সারির আসন৷ তবে অন্য যাত্রীদের অসুবিধা নেই কোনো৷ একটা বিমানে যাত্রীদের যতটা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়া সম্ভব, প্রত্যেক যাত্রীর জন্য সে ব্যবস্থা করে রেখেছে বিমান কর্তৃপক্ষ৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানের পাব্লিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে যাত্রীদের স্বাগত জানিয়ে ক্রু-দের নাম ঘোষণা করা হল৷ একজন পাইলট, দুজন কো-পাইলট, দুজন বিমান সেবক, আর পাঁচজন বিমান সেবিকার নাম ঘোষণা করা হল৷ অর্থাৎ যাত্রী বাদ দিয়ে তারা আরও দশজন লোক৷ পাইলটের নাম কুরেশা৷ এরপর সিট বেল্ট লাগানোর অনুরোধ জানানো হল যাত্রীদের৷ সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে মাইক জানলা দিয়ে দেখতে পেল সিঁড়ি লাগানো গাড়িটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে প্লেনের গা থেকে৷ মিনিটখানেকের মধ্যেই প্লেনের চাকা ঘুরতে শুরু করল আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে টেক-অফ করল বোয়িং-২০৫০ সাত মহাদেশ পাড়ি দেবার জন্য৷ তুমুল করতালিতে ভেসে গেল লাউঞ্জ৷ টেক-অফের দৃশ্যটাকে ক্যামেরাবন্দি করার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল ক্যামেরাম্যানদের মধ্যে৷ সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের সঙ্গে সেই দুর্গম স্থানে বসে স্যাটেলাইট টেলিভিশনে ডেভিডও নিশ্চয়ই দেখছে এই দৃশ্য৷—মনে মনে ভাবল মাইক৷ ঘড়ি দেখল মাইক৷ মনে মনে সে হিসাব কষে নিল ঠিক কোন সময়ে কাজটা শুরু করতে হবে তাকে৷ সময় এগিয়ে চলল৷ কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নেই বিমানে৷ যাত্রীরা কেউ নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজবে মশগুল৷ কেউ বা আবার সামনে রাখা ছোট্ট টেলিভিশনের পর্দায় মগ্ন৷ বোয়িং-২০৫০ বিদ্যুতের গতিতে অতিক্রম করে চলেছে একের পর এক দেশের আকাশসীমা৷
মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হল একসময়৷ মাইক পিছন ফিরে ইশারা করল ফিলিপকে৷ ফিলিপ তার হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে তার আসন ছেড়ে গিয়ে বসল যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত আসনগুলো ছেড়ে বেশ কিছুটা তফাতে আর একটা আসনে৷ স্বাভাবিক নিয়মেই সেটা চোখে পড়ল এক বিমান সেবিকার৷ সে তার কাছে গিয়ে বিনীতভাবে হাসিমুখে বলল, ‘যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত আসনেই কিন্তু আপনাকে বসতে হবে৷ আপনার কি নিজের আসনে বসতে কোনো সমস্যা হচ্ছে? আমি কি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি?’
ফিলিপ মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, আপনার সাহায্যের প্রয়োজন৷’
‘কি প্রয়োজন?’
ফিলিপ এবার তার রুমালের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের মনোযোগ আকর্ষণ করাল বিমান সেবিকার৷ নলটা তাক করা আছে তার দিকে৷ মুহূর্তের মধ্যে ফ্যাকাশে হয়ে গেল সেবিকার মুখ৷ ফিলিপ চাপাস্বরে হিসহিস করে বলল, ‘চিৎকার করলে এখনই ঝাঁঝরা হয়ে যাবেন৷ প্লেনেরও কেউ বাঁচবে না৷ আমাকে ককপিটের কাছে নিয়ে চলুন৷ তারপর ককপিটের দরজা খুলতে বলুন৷ চালাকি করলে বিপদে পড়বেন৷ এতগুলো লোকের প্রাণ যাবে৷’
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নির্দেশ পালন করল আতঙ্কিত বিমান সেবিকা৷ প্যাসেজের মধ্যে দিয়ে সে যন্ত্রের মতো এগিয়ে চলল ককপিটের দিকে৷ আর তার পিঠ ঘেঁষে ফিলিপ৷ মাইক আর জর্ডনও এবার উঠে দাঁড়াল নিজেদের আসন ছেড়ে৷
ককপিটের কাছে এসে দরজায় টোকা দিল বিমান সেবিকা৷ আই হোল দিয়ে তাকে দেখে নিয়ে দরজাটা সামান্য একটু ফাঁক করলেন কো-পাইলটদের একজন৷ মাইকও তখন পৌঁছে গেছে ককপিটের দরজার সামনে৷ লোকটা দরজা ফাঁক করতেই ধাক্কা দিয়ে হুড়মুড় করে ককপিটে ঢুকে পড়ল মাইক আর ফিলিপ৷ মাইকের হাতেও তখন উঠে এসেছে তার স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র৷ তারা সেগুলো তাক করল পাইলট আর কো-পাইলট দুজনের দিকে৷ মুহূর্তের মধ্যে ক্যাপ্টেন আর তাঁর সহকারীরা অনুমান করলেন কী ঘটতে চলেছে! নিজের আসনে বসে ক্যাপ্টেন মাইকদের উদ্দেশে বললেন, ‘কে আপনারা? কি চান?’
মাইক হিমশীতল স্বরে জবাব দিল, ‘আমরা আফ্রিকার ব্ল্যাক উইডোর আত্মঘাতী জঙ্গি৷ আমাদের কথামতো বিমান নির্দিষ্ট স্থানে উড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে৷ নির্দেশ না মানলে আকাশেই এ বিমান ধ্বংস করব আমরা৷’ কথা বলতে বলতেই এক ঝটকায় জ্যাকেটের চেনটা খুলে ফেলল মাইক৷ ক্যাপ্টেন দেখতে পেলেন তার বুকে বাঁধা বিস্ফোরকগুলো৷
ক্যাপ্টেন জানতে চাইলেন, ‘কোথায় নিয়ে যেতে হবে বিমানকে?’
ফিলিপ তার পোশাকের ভিতর থেকে একটা বিমান মানচিত্র পাইলটের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘এখানে চিহ্নিত করা আছে জায়গাটা৷’
অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন চিহ্নিত মানচিত্রের সে জায়গা চিনতে পারলেন৷ জায়গাটা আফ্রিকার একটা ছোট্ট মরু অঞ্চল৷ ছোট্ট একটা দেশ৷ সে দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে দেশটাকে দখল করার৷ রাষ্ট্রসংঘ সেখানে জঙ্গিদের খতম করে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করলেও এখনও পুরোপুরি সফল হয়নি৷
মাইক এরপর ক্যাপ্টেনকে বলল, ‘কাছাকাছির এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে জানিয়ে দিন বিমান হাইজ্যাক করা হয়েছে৷ আর যাত্রীদেরও ব্যাপারটা জানিয়ে দিন৷ তারা যেন নিজেদের আসনে বসে থাকে৷ নইলে বিস্ফোরণে উড়ে যাবে তারা৷’
নিরুপায় ক্যাপ্টেন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন তার কথায়৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই নীচের সারা পৃথিবীতে দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়ল— ‘হাইজ্যাক হয়েছে বোয়িং-২০৫০৷ তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আফ্রিকার কোন অজ্ঞাত দেশে!’
৷৷ ৩৷৷
পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে একজন কো-পাইলট যখন বিমান হাইজ্যাক হয়েছে ঘোষণা করলেন তখন ব্যাপারটা বিশ্বাস করতেই বিমানযাত্রীদের বেশ কিছুটা সময় লাগল৷ কোনো প্র্যাকটিক্যাল জোক করা হচ্ছে না তো তাদের সঙ্গে?
পাইলটকে ফিলিপের আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে রেখে বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল মাইক৷ ততক্ষণে জর্ডনও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পজেশন নিয়েছে৷
নিজের অস্ত্র উঁচিয়ে মাইক যাত্রীদের উদ্দেশে বলল, ‘আমরা প্লেন হাইজ্যাক করেছি৷ যাত্রী আর বিমানকর্মীরা যে যার আসনে বসে থাকলে আপাতত কারো কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই৷ নইলে প্লেন উড়িয়ে দেওয়া হবে৷ আমরা আত্মঘাতী জঙ্গি৷’
তার কথা শুনে মুহূর্তের জন্য একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল বিমানের ভিতর৷ অবাক হয়ে তারা তাকাল মাইকের দিকে৷ যেন তারা মাইকের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না৷ মাইক এরপর এগিয়ে গিয়ে সামনের আসনে বসে থাকা বিজ্ঞানী আকিরার কোটের কলার ধরে তুলে এনে ককপিটের দেওয়ালে ঠেসে দাঁড় করিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের নলটা তাঁর পেটে চেপে ধরে বলল, ‘আমার বুকে-পেটে যেগুলো বাঁধা আছে সেগুলো নিশ্চয়ই আপনি অন্তত চেনেন৷ জিনিসগুলো কী তা যাত্রীদের বলুন৷’
আকিরার মুখটা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে৷ তিনিই তো বানিয়েছেন এই বিমানটা৷ এ ঘটনা ঘটবে জানলে তিনি নিশ্চয়ই শুধু তাঁর রোবট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন৷ বিমানটা বানাতেনও না৷ সওয়ারীও হতেন না৷ এ কথা ভেবে মনে মনে হাসল মাইক৷
আকিরা ভয়ার্তভাবে যাত্রীদের উদ্দেশে বললেন, ‘হ্যাঁ, এগুলো সত্যি বিস্ফোরক!’
মাইক এরপর দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দিল আকিরাকে৷
যাত্রীরা হতবাক৷ কিন্তু একজন হঠাৎ সাহস করে তার আসন ছেড়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল মাইকদের সামনে৷ সে মাইকের উদ্দেশে বলল, ‘দেখুন আমরা কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই৷ পুলিশ-মিলিটারিও নই৷ নিজেদের জগৎ নিয়ে আমরা থাকি৷ সারা পৃথিবীর লোক আমাদের ভালোবাসে৷ আমাদের বন্দি করার অর্থ কি? বিমানটাকে নির্দিষ্ট জায়গাতে যেতে দিন৷’—এ লোকটা হলিউড অভিনেতা মুর৷ মাইক মনে মনে বলল, ‘সে জন্যই তো তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি৷ যাতে সারা পৃথিবী থেকে দেশের ওপর, রাষ্ট্রসংঘের ওপর চাপ সৃষ্টি হয় আমাদের শর্ত মেনে তোমাদের মুক্ত করার জন্য৷’ কিন্তু মুখে সে কর্কশ স্বরে নির্দেশ দিল, ‘নিজের জায়গায় ফিরে চুপ করে বসুন৷’
আর এরপরই একটা ঘটনা ঘটল৷ মুর হঠাৎ মাইকের হাতের অস্ত্রটা চেপে ধরতে গেলেন৷ সতর্ক ছিল পাশে দাঁড়ানো জর্ডন৷ সে তার হাতের অস্ত্রের বাঁট দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে আঘাত হানল মুরের মাথায়৷ মাটিতে ছিটকে পড়লেন মুর৷ অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি৷ এ দৃশ্য দেখে যাত্রীদের মধ্যে একটা বাচ্চা মেয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে কেঁদে উঠল৷ তাকে এক ধমকে থামিয়ে মাইক বলল, ‘আর কেউ চালাকি করবেন না৷ সবাই নিজেদের আসনে ঘাড় গুঁজে বসুন৷’ এরপর আর তার নির্দেশ অমান্য করার সাহস দেখাল না যাত্রীরা৷ ককপিটে বসা পাইলটও বিমান উড়িয়ে নিয়ে চললেন জঙ্গিদের নির্দেশমতো৷ সময় এগিয়ে চলল৷ অপার নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল বিমানের মধ্যে৷
একসময় বিমান তার উচ্চতা আর গতিবেগ কমিয়ে আনল৷ নীচে দেখা যেতে লাগল জনহীন মরুভূমি৷ বিমানটা নীচ দিয়ে চক্কর কাটতে লাগল মরুভূমির ওপর৷ তারই মধ্যে একটা লম্বা কিছু ওপর থেকে চোখে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যে৷ একটা পরিত্যক্ত রানওয়ে৷ সেখানেই এক জায়গাতে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেল৷ সেই ধোঁয়ার প্রতি পাইলটের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফিলিপ বলল, ‘আমাদের লোকরা সংকেত পাঠাচ্ছে৷ বিমান রানওয়েতে নামান৷’ একটা পাক খেয়ে সেদিকে নামতে লাগল বিমান৷ রানওয়ের মাটি ছুঁল বোয়িং-২০৫০৷ বেশ কিছুটা ছুটে ঝাঁকুনি দিয়ে থামল বিমানটা৷ মাইক সবার উদ্দেশে নির্দেশ দিল, ‘কেউ উঠবেন না, একইভাবে বসে থাকুন৷’
পাইলট আর কো-পাইলটকেও এরপর ককপিট থেকে বার করে এনে বসানো হল যাত্রীদের সঙ্গে৷
বিমানের জানলা দিয়ে যতদূর দৃষ্টি যাচ্ছে শুধু ধু ধু মরুভূমি৷ জনমানবের কোনো চিহ্ন নেই কোথাও৷ কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই মরুভূমির বুক চিরেই বিমানটার দিকে ছুটে আসতে লাগল লোকজনভর্তি বেশ কয়েকটা হুডখোলা গাড়ি৷ তারা এসে ঘিরে ধরল বিমানটাকে৷ সব মিলিয়ে দেড়শোজন জঙ্গি৷ এরাই শুধু এখন এই দুর্গম মরুরাজ্যে টিঁকে আছে৷ তাদের পরনে সামরিক বাহিনীর মতো পোশাক, হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, গলায় কার্তুজের বেল্ট, কারও কোমরে গ্রেনেড অথবা কাঁধে রকেট লঞ্চার!
একজন বিমান সেবিকাকে দিয়ে দরজা খোলানো হল৷ মাইক দরজায় দাঁড়িয়ে ইঙ্গিত করল তাদের ওপরে উঠে আসার জন্য৷ মই লাগিয়ে ফেলা হল৷ পুরো দলটাই উঠে আসতে লাগল বিমানে৷
সবাই আফ্রিকান৷ তার মধ্যে একজন দীর্ঘদেহী, মাথায় কালো ফেট্টি বাঁধা লোক৷ গলায় ঝুলছে গ্রেনেডের মালা৷ চোখের চাহনিতে ফুটে আছে জান্তব হিংস্রতা৷ সেই ডেভিড৷ তার সঙ্গীরা সব বিমানে উঠে আসার পর সে মাইকের পিঠ চাপড়ে প্রশ্ন করল, ‘আকিরা কোন লোকটা?’ জালে পড়া বড় মাছটাকে আগে দেখে নেওয়া প্রয়োজন৷ মাইক আকিরাকে টেনে এনে হাজির করল দলনেতার সামনে৷ ডেভিড সেই ছোটখাট মানুষটাকে প্রশ্ন করল, ‘তুমিই আকিরা?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ৷’
ডেভিড হলদেটে দাঁত বার করে হেসে স্বগতোক্তি করল, ‘অপারেশন সাকসেসফুল৷’
আকিরা শান্তভাবে তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা আমাদের নিয়ে কি করতে চাও?’
ডেভিড সাপের মতো হিসহিস করে বলে উঠল, ‘মুক্তিপণ দাবি করব৷ নইলে প্রথমে তোমাকে তারপর অন্যদের খুন করব৷’
ডেভিড খেয়াল করল, তার কথা শুনে ভয় পাবার পরিবর্তে হাসি ফুটে উঠছে আকিরার ঠোঁটে৷ তিনি বললেন, ‘মিশন সাকসেসফুল৷’
ডেভিড বলল, ‘তার মানে?’
আকিরা এবার তাঁর কোটটা ওপরে ওঠালেন৷ তাঁর বুকে বাঁধা আছে থরে থরে বিস্ফোরক!
আর এর পরমুহূর্তেই যাত্রী আর জঙ্গিসমেত বিমানটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে আকশের দিকে উঠে ছড়িয়ে পড়ল মরুভূমির অনেক দূর পর্যন্ত৷
৷৷ ৪৷৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন কলটা এল আকিরার কাছে৷ বিজ্ঞানী আকিরা তখন তাঁর গবেষণাগারে, কাজ করছিলেন৷ ফোনের ওপ্রান্ত থেকে রাষ্ট্রসংঘের এক কর্তাব্যক্তি উচ্ছ্বাসিতভাবে আকিরাকে বললেন, ‘ধন্য আপনার বিজ্ঞান প্রতিভা৷ জঙ্গিদের পুরো দলটারই মৃত্যু হয়েছে বিস্ফোরণে৷ কেউ ধরতেই পারেনি যে বিমানে ঐ তিনজন জঙ্গি ছাড়া আসলে কেউ মানুষ ছিল না৷ সবাই রোবট ছিল৷ বিশেষত রোবটের মধ্যে যে মানবিক গুণ আপনি ফুটিয়ে তুলেছেন তা অসাধারণ৷ তাদের পরিবর্তে জীবন্ত মানুষ হলেও তাদের যে পরিস্থিতিতে যে অভিব্যক্তি হবার কথা ঠিক সেই অভিব্যক্তিই ফুটে উঠেছিল তাদের আচরণে৷ রোবট ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সবচেয়ে কঠিন কাজ শুনেছি তাদের মধ্যে মানবিক বোধ ফুটিয়ে তোলা৷ এ ব্যাপারে অসাধ্য সাধন করলেন আপনি৷’
ভদ্রলোকের মুখে প্রশস্তি শুনে বিজ্ঞানী আকিরার কোনো উচ্ছ্বাস দেখা গেল না৷ তিনি বললেন, ‘ঐ মানবিক বোধ জাগানোর ব্যাপারটা নিয়েই আমি বেশ চিন্তিত৷’ ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, ‘কেন?’
বিজ্ঞানী আকিরা বললেন, ‘এয়ারপোর্টের চিফ সিকিওরিটি অফিসার তাজুমার রোবটটা বানাতে দেরি হচ্ছিল৷ প্রথমে ঠিক হল তাজুমাই কাজটা করবেন৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোবটটা বানানো হল ও এয়ারপোর্টে পাঠানো হল৷ কিন্তু আসল যাত্রী মানে ঐ তিন জঙ্গি যখন সিকিওরিটি চেকের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছে তখন হঠাৎ খেয়াল হল তাজুমার রোবটের প্রোগ্রামিং-এ ত্রুটি থেকে গেছে৷ লুকানো অস্ত্রসমেত জঙ্গিদের ছেড়ে দেবার কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি তাকে৷ অথচ সে নিজে থেকেই কৌশলে ছেড়ে দিল তাদের!’
‘নিজে থেকেই ছেড়ে দিল!’ বিস্ময় ফুটে উঠল শ্রোতার কণ্ঠে৷
বিজ্ঞানী আকিরা গম্ভীরভাবে বললেন, ‘ব্যাপারটা কেন ঘটল তা আসল তাজুমার বাড়ির লুকানো ক্যামেরায় ধরা পড়েছে৷ ঐ রোবটটাকে মনে হয় কিছু বেশি মাত্রায় মানুষ করে ফেলেছিলাম আমি৷ মানুষের তো শুধু গুণ থাকে না, অনেক দোষও থাকে৷ গতকাল তাজুমার বাড়িতেই ছিল তার রোবটটা৷ তাজুমা যখন বাড়িতে ছিলেন না তখন জঙ্গিরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে রোবটটাকেই তাজুমা ভেবে ঘুষ দিয়ে এসেছিল৷ রোবটটার ঐ ত্রুটিটাই এখন আমার ল্যাবরেটারিতে বসে সারাবার চেষ্টা করছি৷ ভাবা যায়! রোবটও শেষ পর্যন্ত মানুষের মতো ঘুষ খেল!’—এই বলে লাইনটা কেটে দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বিজ্ঞানী আকিরা৷
—