বেঙ্গমা-বেঙ্গমির গপ্প
বেঙ্গমি বলে, ও বুড়ো! জেগে আছ কি!
বেঙ্গমা বলে, আছি।
ছেলে আসছে।
মেয়েটা?
আসবে’খন। না এসে পারে?……..
ধনুকবাঁকা ঝিলের ধারে বিশাল এক বটের গাছ। অজস্র-ঝুরি নামিয়ে শেকড়বাকড় ছড়িয়ে মাটি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকের ডালপালায় স্বাধীনতার ব্যাপ্তি। এই চৈত্রে চিকন পাতাগুলি আবহমণ্ডল থেকে কার্বনকণিকা শুষে নিচ্ছে ফেটোসিন্থেসিস প্রক্রিয়ায়। আর এ গাছেই বাস করে দুই আদ্যিকালের পক্ষী।
পুরাবিদ স্যার আলেকজাণ্ডার কানিংহাম এই বটতলা থেকেই কুড়িয়ে নিয়ে যান নাকভাঙা একটি মৌর্যযুগের বুদ্ধমূর্তি। এখনও টুকরো-টুকরো পাথর আটকে আছে শেকড়ের তলায়। এখানে-ওখানে ছড়ানো লাইমকংক্রিটের চাপড়ায় বসে ক্ষেতমজুররা দিনদুপুরের জিরেন এবং পান্তা খায়। গুঁড়ির ভেতর খাঁজে-ফোকরে আরও চাপ-চাপ লাইমকংক্রিটের চাপড়া বেয়ে আঁকাবাঁকা একটি ঢেমনা সাপ একবার ওপর একবার নিচে জ্বলজ্বলে চোখে কিছু খোঁজে। কিছু ভেবে কুল পায় না, উঠবে নাকি নামবে। কখনও সে দারুণ চমক খেয়ে কোটরে লুকিয়ে পড়ে। তীরধনুক নিয়ে ওই এগিয়ে আসে কষ্টিপাথরে গড়া এক মানুষ। অতি নিঃশব্দ তার হাঁটাচলা। হঠাৎ ঝুঁকে সে কুড়িয়ে নেয় আধপোড়া ফিল্টারটিপড একটি সিগারেট। আনমনে ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুলের ভেতর কানের ওপরদিকটায় সেটা গুঁজে রাখে। তারপর মুখ তুলে ডালপালার ভেতর পাখি খোঁজে। কিছুক্ষণ পরে হতাশ সেই কষ্টিপাথর মানুষটি নিচের ঝিলের দিকে নেমে যায়। ঝিলের ধারে-ধারে হাঁটতে থাকে। ঝিলের জলে শাকতোলানি মাছধরুনি মেয়েদের ভিড় দিনমান। আকলুর মেয়ে গৈরবা, গরবিনীকে বাংলার ছয় ঋতুর জলকাদা রোদবৃষ্টি শীত এভাবেই অপভ্রষ্টা করে ফেলেছে, হাঁসের মতো ডুবে-ডুবে গুগলি তোলে। রাতকানা বাপকে সে রোজ গুগলির ঝোল খাওয়াবেই। এদিকে তার রাতকানা বাপের স্বভাব, বিকেল হলেই ঠুকুস ঠুকুস করে খেয়াজাল আর খালুই হাতে ঝিলের দিকে আসবেই। তখন গৈরবা স্টেশনবাজারে হারাধনবাবুর বাড়ি কোমরে আঁচল বেঁধে দুপুরের এঁটো থালাবাসন মাজছে। বাড়ি ফিরতে ঝিলের ওপারে বাবলাবনের কাঁধে নাদুসনুদুস চাঁদবাবুর দেখনহাসি রূপ। ঝিকমিকোচ্ছে ঝিলের জল জ্যোৎস্নাগুঁড়ো মেখে। ঝপাস করে ব্যর্থ শেষ জাল ফেলে আকলু বলে, ধুস শালা! রাতকানা মানুষ বটে, ঝিলের তল্লাটে ইঞ্চি-ইঞ্চি মাটি মুখস্থ তার। পাড় বেয়ে ঠিকই ওপরে উঠে যায় এবং সঠিক পা ফেলে সঠিক দিকেই হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরে। রাতকানা হওয়ার পর তার বাড়তি একটি ইন্দ্রিয়ের আঁকুর গজিয়েছে। জীবজগতের খুব ভেতরদিকের, এমন কী জীবন্মৃত্যুর সীমান্তরেখাটিও তার চেনা হতে চলেছে। এক নতুন মানচিত্র তার সামনে যাচ্ছে খুলে। সাপের মতোই মাটিতে পায়ের শব্দের স্পন্দন প্রতিধ্বনিত হয় তার ওই অতীন্দ্রিয়জাত বোধে। সে হাঁক দিয়ে বলে, কে যায় গো?
আমি।
চাপা, রুক্ষ, বিরক্ত এই শব্দটি রাতকানা লোকটিকে কোমল ও বিনীত করে। সে গোপনে হেসে বলে, ছোটবাবু নাকি? সনজেবেলা চললেন কতি গো ছোটবাবু?
যেখানেই যাই, তোমার কী?
আকলু ধীবর অভিমানে চুপ করে যায়। আবার ঠাহর করে পা ফেলে। চষা মাটির চাঙ্গড়ে কদিন আগেকার এক কালবোশেখি একটুখানি বর্ষে গেছে। তাই মুখিয়ে উঠেছে হাতিশুঁড়ো, কুকুরশুঁকো দুব্বোঘাসের ছানাপোনা। থপথপিয়ে পা ফেলে অভিমানী ধীবর ভিজে জাল আর খালি খালুই হাতে বাড়ি ফেরে।
আর বাড়ি ফিরেই গৈরবার মুখোমুখি পড়ে বকা খায়। মরবে, তুমি মরবে। হয় কালে ডংশাবে, নয়তো ভূতপেরেতে ঘাড় মটকাবে।
আমোদিনীও গালমন্দ দেয় মরদকে। শেষে বলে, স্বভাব যাবে কতি?
আকলু গ্রাহ্য করে না। খ্যা খ্যা করে হাসে। তা মরণ যখন আসবে, আসবে। তবে কথা কী, লোচনবাবুর ছেলেটা উদিকে কতি যায়, বুঝি না। পেরায় সনজেবেলা দেখি বুড়োতলাবাগে যাচ্ছে।
গৈরবা আস্তে বলে, যে-যেখানে যাক, তুমার কী? মুখ খিল এঁটে বসে থাকোদিকিনি।
তবু আকলু বলে, বড় খটকা লাগে।…..
সুবচনী দাওয়ার কোণায় উনুনে শুকনো পাতা ঠেলে দিচ্ছিলেন। টগবগিয়ে ভাত ফুটছিল এনামেলের হাঁড়িতে। রোজ রাতে রুটিই খাওয়া হয়। নেহাত কোনও রাতে দিনের বাড়তি ভাত। আজ দুপুরে কাটোয়া থেকে দেওর অবনী হাজির। শিউলির জন্য আবার পাত্র ঠিক করেছে। দেওয়া থোওয়ার বালাই নেই। মেয়ে পছন্দ হলেই তুলে নিয়ে যাবে।
অবনীকে তার বিশ্বাস হয় না সুবচনীর। এই নিয়ে তিন-তিনবার কথা আনল। কিন্তু কোথায় কী? আসলে কুরুখণ্ডীতে আপিসের কী কাজে এসেছিল। মা-মেয়ের অন্নে ভাগ বসিয়ে গেল। আর খায়ও বটে অবনী। অবেলায় আবার কে ভাত বসাবে? শিউলি বলে গেছে সন্ধ্যাবেলা, রাত্তিরে আজ ভাত চাই মা। আলুভাত তো আলুভাতই!
সন্ধ্যার দিকে একটা টিউশনি জুটিয়েছে শিউলি স্টেশনবাজারে। দিনকাল খারাপ। তার ওপর এই পাড়াটায় বিদ্যুৎ জোটেনি। জীর্ণ একতলা দালানবাড়ি আর মাটির ঘরে ঠাসা। ফাঁকে-ফোঁকরে পোড়ো ভিটেয় আগাছার জঙ্গল। মেয়ের জন্য মাঝে উদ্বেগ বোধ করেন সুবচনী। কিন্তু বললেই তো বলবে, টর্চ আছে না?
টর্চের আলোয় সামনেটা দেখা যায়। পেছনে কী আছে কেমন করে দেখতে পাবে শিউলি! কিন্তু ওকে কিছু বলতেই আজকাল ভয় পান সুবচিনী। দিনে-দিনে তার মেজাজ কেমন রুক্ষ হয়ে উঠেছে। টিউশনির টাকায় সংসার চালাচ্ছে বলেই কি এমন মেজাজ হবে মেয়ের? ওর বাবা ছিলেন প্রাইমারি শিক্ষক। বড় তক্কবাজ মানুষ ছিলেন পাঁচুগোপাল। তেমনি জেদী রাগীও। এতকাল পরে মেয়ের মধ্যে যেন বাবার সেই খর মেজাজটি জেগে উঠেছে।
ভাঙা পাঁচিলের আব্রু ঢেকেছে যে-বুগানভিলিয়ার ঝাঁপি, তার ওপর ফিকে জ্যোৎস্না এসে ধাক্কা দিল। সেইদিকে তাকিয়ে গা ছমছম করল সুবচনীর। এখনও শিউলি ফিরছে না কেন?….
বেঙ্গমি ডাকে, ও বুড়ো! জেগে আছে কি?
বেঙ্গমা বলে, আছি।
মেয়েটা আসছে।
কৈ, দেখি! দেখি!….
বরুণের সিগারেটের আগুন জুগজুগ করেছিল। দূর থেকে দেখে শিউলি মিটিমিটি হাসে। চমকে দেবে নাকি সেদিনকার মতো ঝুরির আড়াল থেকে? পরে ভাবে, থাক। ভূতপেরেতের ভয় না মেনে বুড়োতলায় তার জন্য এমন করে যে এসে অপেক্ষা করে, তার সঙ্গে জোক করা ঠিক নয়। ভয় তো প্রথম-প্রথম শিউলিরও করত। তারপর কেটে গেছে। সন্ধ্যারাতের মাঠ পেরিয়ে ঝিলের ধারে বুড়োতলায় আসতে তার একটুও গা বাজে না। বরং কী এক আবেগ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় বটগাছটির দিকে। সে অভিসারিকা। অভিসারিকারা রাতবিরেতে ভয় পায় না।
হাল্কা জ্যোৎস্নায় ছায়ামূর্তি দেখে বরুণ সিগারেট ঘষটে নিভিয়েছে। ছায়ার দিকে সরে গেছে একটুখানি। তারপর সে চিনতে পারে। সাড়া দিয়ে বলে, কী? এত দেরি যে?
শিউলি বলে, স্টেশন ঘুরে এলাম।
কেন?
বোজ এক রাস্তায় আসি আর আকলুবুড়োর চোখে পড়ি! বুঝেও না বোঝার ন্যাকামি করো খালি!
ধুস! ও ব্যাটা রাতকানা জানো না?
শিউলি এদিক-ওদিক তাকিয়ে গুঁড়িয়ে পেছনদিকটায় যায়। সেখানে গাঢ় ছায়া। বলে, কী হল? এখানে এস।
তোমাকে দেখতে পাব না ওখানে। মনে হবে অন্য কেউ।
বরুণ ছায়ায় ঢুকে শিউলির মুখোমুখি দাঁড়ায়। শিউলি শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে, অন্য কেউ! তাহলে অন্য কেউও আছে তোমার?
ধুস! তুমি মাইরি জোক বোঝো না! বরুণ প্রেমিকের গলায় ফের বলে, চাঁদের আলোয় তোমাকে দেখলে দারুণ লাগে। বিলিভ মি—মাকালীর দিব্যি!
সে তার প্রেমিকাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। একটুখানি ছটফটানির পর প্রেমিকাটি শান্ত হয়। প্রেমিকের চুম্বন গ্রহণ করে। তারপর আস্তে বলে, বসো এখানে। দুষ্টুমি কোরো না।
প্রেমিক তার প্রেমিকাকে দু’ হাতে তুলে নেয়। নগ্ন শক্ত মাটিতে শুইয়ে দেয়। প্রেমিকা বলে, আঃ! পিঠে ব্যথা করছে।
প্রেমিক বলে, চুপ! এখন কথা বলে না।
আমি বলব। আমার অনেক—অনেক কথা আছে বলার।
মনে-মনে বলো। আমি মনে-মনে শুনি!…
বেঙ্গমি বলে, লজ্জা করে না উঁকিঝুঁকি মারতে? সরে এস দিকিন।
বেঙ্গমা বলে, বুড়ো হয়েছি। আজকাল তত নজর চলে না।
বেঙ্গমি আনমনে বলে, আমার এ পোড়া চোখের দোষ!
কেন গো?
মেয়েটাকে দেখি, আর খালি ভাবি এ কাকে দেখছি!
কাকে বলো তো?
তোমার বড় ভুলো মন! মনে পড়ে না সেই ঘুঁটেকুড়ুনি মেয়ে আর রাজপুত্তুরের কথা?
বেঙ্গমা শ্বাস ফেলে বলে, হুঁ।….
নিচের ঘরে একটি কালার টিভি ঘিরে মৌমাছির মতো ঝাঁক। কাছের সদর শহরে রিলেসেণ্টার বসেছে। তবে কলকাতা আসে না। সটান দিল্লি এসে ঝলমলায়। ইংরিজি বকবকানি থাকলেই চ্যানেল পাঁচে ঢাকা এসে পড়ে। বাংলা গান শোনো প্রাণ ভরে। ইংরিজি ছবি দ্যাখো। কথাবার্তা না বুঝলেও কাণ্ডকারখানা দেখে তাক লেগে যাবে।
ওপরের ঘরে লোচনবাবু সিগারেট টানছিলেন। সামনে ইতিহাসের শিক্ষক এবং শ্যালক ভবচরণ। তাঁর হাতেও সিগারেট। খাট ওপর বসে আছেন গৃহিনী অনুপমা। পা দুখানি ঝুলন্ত এবং স্থির। কচরমচর করে পান চিবুচ্ছেন। দাদার দিকে সপ্রশংস চাউনি। পায়ের তলা দিয়ে গলিয়ে এসে নাদুসনুদুস বেড়ালটি তুড়ুক করে খাটে উঠলে অনুপমা তাকে আদরে কোলে তুলে নিলেন। তার কোমল পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে কী একটা বললেন স্বামীর উদ্দেশে। কথাটায় কান করলেন না স্বামী।
শ্যালক বললেন, মেয়েটা গ্রাজুয়েট। বাবার একমাত্র সন্তান। ব্যাপারটা বুঝলে তো?
ভগ্নিপতি হাই তুলে বললেন, রাধু উকিলকে আমি চিনি না ভাবছ নাকি?
তাহলে আর কথা কী?
আছে।
অনুপমা মুখ বাঁকা করে বললেন, ঠং! অর্থাৎ ঢং।
লোচন বিরক্ত হয়ে বললেন, পিণ্টু যে স্কুলফাইনাল! তারওপর এ পাড়া গাঁয়ে—
কথা কেড়ে ভবচরণ বললেন, কুরুখণ্ডী আর পাড়াগাঁ আছে? আর স্কুলফাইনাল টাইনাল কথা নয়। রাধুবাবু রাজি। আসলে একটুখানি খুঁত, গায়ের রঙ। নাকমুখের গড়নও চমৎকার। তবে তার চেয়ে বড় কথা, রাধুবাবুর কয়েক লাখ টাকার সম্পত্তি—সবই পিণ্টু পাবে। টাউনে তিন-তিনখানা বাড়ি। গঙ্গার ধারে নতুন যে বাড়িটা করেছেন, দেখলে মনে হবে লণ্ডন না প্যারিস!
লোচন অট্টহাসি হেসে বললেন, তুমি খালি—
খালি নয়! ক্ষুব্ধ ভবচরণ বললেন। খালি-টালি ছাড়ো তো তুমি। ফোটো তো দেখলে মেয়ের। কী অনু, মেয়ে দেখতে খারাপ?
বালো—কুব বালো! অনুপমা বললেন। ডাগর বেড়ালটি এবার ঝুপ করে লাফিয়ে গিয়ে লোচনের পায়ের ফাঁকে বসল।
লোচন বললেন, পিণ্টু কী বলছে শুনেছ নাকি? দেখিয়েছে পিণ্টুকে?
ভবচরণ বললেন, দেখিয়েছি। বলেছে, ভেবে দেখবে। তবে ওর দায়িত্ব আমার।
দ্যাখো ভবদা—লোচন আস্তে বললেন, আমার কেন যেন সন্দেহ হয়!
কী কী, ঝুঁকে এলেন ভবচরণ।
মানে—পিণ্টুর ভাবগতিক ভাল ঠেকছে না।
কেন, কেন?
কেমন যেন….ঠিক বোঝাতে পারলেন না লোচন। গলার ভেতর বললেন, কী একটা—
টামো! গৃহিণী গর্জন করলেন। মুখ থেকে পানের কুচি ছিটকে পড়ল। অধরোষ্ঠ হাতের চেটোয় মুছে ফের বললেন, ঠবটাটেই টোমার ঠন্দ!
রুষ্ট কর্তা বললেন, আগে মুখের ভেতর থেকে আবর্জনাগুলো ফেলে এসে কথা বলো দিকি। কী বলে ঠ ঠ করে।
গৃহিনী হেসে ফেললেন। তারপর ধুপসধাপুস শব্দে মোজককরা মেঝেয় শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলেন। মুখের আবর্জনা ফেলতেই গেলেন।
ভবচরণ ভুরু কুঁচকে চাপা স্বরে বললেন, পিণ্টু কোথাও প্রেমট্রেম করছে নাকি?
লোচন শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, আই ডাউট।
মেয়েটি কে জানতে পেরেছে?
বেড়ালটিকে প্রায় লাথি মারার ভঙ্গীতে হটিয়ে লোচন ফিসফিসিয়ে বললেন, গেনু,—আমাদের গেনু আর কী! বুঝেছি। বলো
গেনু বলছিল, ছোটবাবু রোজ সন্ধ্যাবেলা বুড়োতলায় যায়।
বেশ তো। তাতে কী হয়েছে?
তুমি চিনতে না। পাঁচুমাস্টার—মানে পাঁচুগোপাল ছিল আমার ক্লাসফ্রেণ্ড। প্রাইমারি টিচার ছিল। বছর দুই আগে স্ট্রোকে মারা গেছে। তার একটি মেয়ে আছে। দেখতে-শুনতে মন্দ না। সেও স্কুলফাইনাল পাশ। খুব শার্প বুদ্ধিসুদ্ধিতে।
কাস্ট?
লোয়ার কাস্ট। সে ব্যাপারে গণ্ডগোল তো আছেই, তাছাড়া তোমার বোনকে তো চেনো।
অনু জানে?
মথা খারাপ? ওকে বলতে গিয়ে হিতে বিপরীত হোক।
ভবচরণ একটু ভেবে বলেন, কাস্ট-ফাস্ট আজকাল অবশ্য ফ্যাক্টর নয়। কিন্তু অবস্থা?
বুড়ো আঙুল নাড়েন লোচন। সেদিকে ঢু ঢু। রোজ দেখি, আমাদের বাগান থেকে পাঁচুর বউ শুকনো পাতা কুড়িয়ে জড়ো করছে। বুজলে না? কয়লার পয়সাও জোটে না।
ভবচরণ নড়েচড়ে বসেন। শক্ত মুখে বলেন, তোমার ঘরে তিন-তিনটে মেয়ে। খেয়াল আছে? তাদের বেলায় কে স্যাক্রিফাইস করবে, বলো? ব্যবসাতে লস খেয়ে ফতুর হতে বসেছিল। সন্টু পঁয়তাল্লিশ হাজার নগদ এনে দিল—এই শর্মার জোরে। নয় কী না বলো?
তুমি ঠিকই বলেছ ভবদা!
এখন তোমার পেট্রল পাম্প, ময়দাকল, ধানকল—আবার শুনলাম সণ্টু বলছিল, ঘানিকলও বসাবে।
লোচন ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলেন, তুমি একটু বোঝাও না পিণ্টুকে। আমার খালি ভয় করে, ভেতর-ভেতর রেজিস্ট্রি করে থাকলে তো কেলেঙ্কারি!
দেখছি। ভবচরণ আশ্বাস দিলেন। মুখটা বেজায় গম্ভীর। ফের সিগারেট ধরালেন। নেতাজির ছবির দিকে দুটি জ্বলজ্বলে চোখ।…….
বুগানভিলিয়ার ঝাঁপি রাতের হাওয়া আর জ্যোৎস্নায় ভূতে-পাওয়া এলোকেশী মেয়ের মতো দুলছে আর দুলছে। দাওয়ায় বসে সুবচনী প্রতীক্ষা করছিলেন মেয়ের। বাড়ি ঢুকতেই ক্ষীণস্বরে বলেন, এত রাত করে রে?
শিউলি জবাব দেয় না। কুয়োতলায় যায়। ঢনঢন শব্দে বালতি নামায়।
সুবচনী বলেন, কেন! ভুটুবাবুকে বলে সকালবেলা টিউশনির ব্যবস্থা করতে পারিস নে?
শিউলি জলের শব্দে কণ্ঠস্বর মিশিয়ে বলে, প্রাইমারি সেকশন মর্নিংয়ে জানো না?
সুবচনী চুপ করে থাকেন। উঠোনে জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে তার ভিজে শাড়ি মেলে দিচ্ছে শিউলি নজরে পড়লে অবাক হয়ে বলেন, চান করলি নাকি?
নাঃ। পিচরাস্তায় জলকাদা জমে আছে। ট্রাকের চাকা থেকে—ড্রাইভারগুলো আজকাল বড্ড….টুকরো টুকরো সব বাক্য। শায়াব্লাউজ-পরা শিউলি ভঙ্গীতে ঘরে ঢোকে। ঢোকার সময় দাওয়া থেকে লণ্ঠনটিও নিয়ে যায়।
একটু পরে শাড়ি বদলে বেরোয়। বলে, কাদায় ভূত করে দিয়েছে একেবারে। সব কাচতে থেকে লণ্ঠনটিও নিয়ে যায়।
একটু পরে শাড়ি বদলে বেরোয়। বলে, কাদায় ভূত করে দিয়েছে একেবারে। সব কাচতে হবে সায়াটাও।
সুবচনী বলেন, কুয়োতলা ভিজিয়ে রাখ বরং। সকালে কেচে দেব’খন।
শিউলি ফের কুয়োতলায় যায়। সুবচনী জানেন, মেয়ের যা জেদ। কথা না বাড়ানোই ভালো তবে পিচরাস্তার অবস্থা কী হয়েছে স্বচক্ষে দেখেছেন। কদিন আগে কলাবোশেখি এসে ঝরঝরিয়ে গেছে। খানাখন্দ জলকাদায় ভর্তি। ওদিকে তাহের কন্ট্রাক্টার জিপ হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছে। ওই রাস্তা তারই তৈরী। তাহেরের বাবা ছিল চাষাভুষো লোক। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছিল। কিন্তু অমন ঘরের অমন ছেলের রাতারাতি আঙুল ফুলে কী করে কলাগাছ হল, ভেবেই পান না সুবচনী। শিউলির বাবা বলতেন, তাহের পয়সা করেছে আসলে টেস্টরিলিফের সময়। পেমাস্টার হয়েছিল। ভূয়ো নামে চাল-গম বিলি হত। সেই চাল-গম রাত্তিরে ট্রাকে করে চালান যেত। স্বচক্ষে দেখেছি।
শিউলি শাড়ি ব্লাউজ মেলে দিচ্ছিল জ্যোৎস্নায়। বুড়োতলার মাটি এত ভেজা ছিল বুঝতে পারেনি। সুবচনী বলেন, আয়! ভাত বাড়ি।
কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মা!
সে কী? দারুণ চমকে ওঠেন সুবচনী। তুই-ই তো বলে গেলি, রাত্তিরে আজ ভাত খাবি।
ভুটুবাবুর বাড়ি আজ কী যেন ব্রত-টত ছিল। একগাদা লুচি-আলুরদম, দুটো রসগোল্লা—মা, তুমি খেয়ে নাও! লক্ষ্মীটি।
তুই অন্তত দুমুঠো মুখে দে।
উঁহু! অম্বল হবে। একে তো অম্বলের ঠ্যালায় অস্থির। রোজ একগাদা করে অ্যান্টাসিড খাচ্ছি।
সুবচনী দাওয়ার কোণা ঘিরে তৈরী রান্নাঘরে ঢোকেন। লম্ভের দম বাড়িয়ে দেন। মেয়েটা অম্বলে ভুগছে কিছুদিন থেকে। গতকাল দুপুরে কুয়োতলায় ওয়াক তুলছিল।
অন্ন মুখে তুলে চিবুতে গিয়ে কিছুক্ষণ থেমে থাকেন সুবচনী। হঠাৎ—খুবই হঠাৎ মনে হয়, মেয়ের মধ্যে কী একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন চোখে পড়ছে যেন। সবসময় আনমনা ভাব। ঠোঁট কামড়ে ধরে বারবার। আজ সকালে খিড়কির ডোবার ধারে একলা বসে ছিল। ডাকলে মুখটা একটু ফেরাল। চোখের ভুলই কি? চোখ ভিজে মনে হচ্ছিল।
হয়তো বাবার কথা মনে পড়েই কাঁদে। সুবচনীর মায়ের মন হু হু করে ওঠে। অন্ন রোচে না। আঁচিয়ে এসে দ্যাখেন, লণ্ঠনের দম কমিয়ে তক্তাপোষের বিছানায় শুয়ে আছে পাশ ফিরে।
সুবচনী আস্তে বলেন, ট্যাবলেট নেই? অম্বল বোধ করলে—
সুবচনী থেমে যান। শিউলির পিঠটা কাঁপছে। দম-কমানো লণ্ঠনের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যায়। পাশে বসে পিঠে হাত রেখে বলেন, কী হয়েছে মা?
অমনি মেয়েটা ঘুরে মায়ের ঊরুর ওপর মাথা কোটে।…..
বেঙ্গমি বলে, ও বুড়ো! ঘুমোলে নাকি?
বেঙ্গমা বলে, নাঃ।
বুঝলে কিছু?
কী বুঝব? বুঝেই বা লাভ কী?
মেয়েটার পেটে বাচ্চা এসেছে।
সে কী কথা?
ন্যাকামি কোরো না তো! অতক্ষণ ঝগড়াঝাঁটি হল, কানে ঢোকেনি?
বড্ড হাওয়া দিচ্ছে আজ।
চোতমাসে হাওয়া দেবে না রাতবিরেতে? তবে কথা কী, আমার কান মেয়ের কান।
কী বলছে ছেলেটা?
কী সব ইংরিজি বলছে, বুঝতে পারিনি। লোকেরা বড় খটমটো কথা বলে আজকাল।
তাহলে চুপ করে থাকো।
পারছি না গো! আমার বড় জ্বালা যে!
কেন গো?
মেয়ে হলে বুঝতে। তুমি যে পুরুষ।…….
ঝিলের দিক থেকে আবার ছুটে আসে চৈত্ররাতের হাওয়া। জ্যোৎস্নাগুঁড়ো মেখে ঝলমল করে ঝিলের বুক। চাঁদ এখন বুড়ো বটের কাঁধের ওপর। ওপারের ভরাটচর জমিতে বাবলা আর হিজলের জঙ্গল। সেদিকে কোথাও ডেকে ওঠে এক নিঃসঙ্গ হট্টিট্টি পাখি—ট্টি ট্টি ট্টি! …..ট্টি ট্টি ট্টি! বেঙ্গমী চাপা শ্বাস ছেড়ে বলে, বোকা মেয়েটা!…..
ভবচরণ ভাগ্নেকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছেন। স্টেশনের নির্জন ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে পুবের মাঠের দিকে তাকিয়ে বলেন, ঝিলে আজকাল আগের মতো হাঁসটাস আসে?
বরুণ আনমনে বলে, নাঃ!
ভবচরণ শহরের স্কুলে ইতিহাসের শিক্ষক। উদাত্ত কণ্ঠস্বরে বলেন, প্রাচীনযুগে গঙ্গা ওখান দিয়ে বয়ে যেত। ঝিলটি তারই স্মৃতিচিহ্ন। বুঝলে তো?
বরুণ ঝুঁকে সমান্তরাল রেললাইন দ্যাখে। কথা বলে না।
ইতিহাসের শিক্ষক বলেন, স্যার আলেকজাণ্ডার ক্যানিংহামের নাম শুনেছ। বিরাট পণ্ডিত ছিলেন। আমার লেখা এই জেলার ইতিহাস বইখানি অন্তত পাতা উল্টে দেখো। এই গ্রামের নাম ছিল কুলখাঁড়ি। সবে রেললাইন পাতা হয়েছে। স্টেশনের নামও দেওয়া হয়েছে কুলখাঁড়ি। স্টেশনমাস্টার ছিলেন। এক অ্যাংলো সায়েব—তখন বলা হত ইউরেশিয়ান। তো সেই সায়েবেরও খুব হিস্ট্রির বাতিক ছিল। তাঁর কাছে খবর পেয়ে ছুটে এলেন স্যার আলেকজাণ্ডার ক্যানিংহাম। তিনিই অনেক স্টাডি করে বললেন, কথাটি আসলে কুরুখণ্ড—অপভ্রংশে কুরুখণ্ডী এবং তস্য অপভ্রংশে কুলখাঁড়ি। র ল হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
হাহা করে হাসেন জেলার ইতিহাস লেখক। ফের বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলেন, ইদানিং শুনছি, গঙ্গার মজাখাতের ওপারে নাকি বুনোকুলের জঙ্গল ছিল। আর খাড়ি নাকি খাত। সেই থেকে কুলখাঁড়ি। তাছাড়া রাঢ়ের লোকেরা সব তাতেই চন্দ্রবিন্দু বসাতে সিদ্ধহস্ত। হাঁসপাতাল বলে, জানো তো? ভাগ্যিস ইতিহাস বলে না!
বরুণ দেখতে পায়, দূরে কালো হয়ে একটি ট্রেন বা মালগাড়ি আসছে। কালো বৃত্তাকার গতিশীল বন্ধুটিকে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে তার গা ছমছম করে। সে কথা বলে না।
ইতিহাসের শিক্ষক জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলেন, আজকাল সব ফোক-স্টাডিওলা
জুটেছে। সদ্য গোঁফগজানো ছোকরা। এঁড়ে তক্ক করে বলে কী জানো? কথাটা কুলখাঁড়িই হবে। আবার জেলা-সমাচার কাগজেও কয়েকটা চিঠি বেরিয়েছে পড়লাম। এক মুসলমান ভদ্রলোক লিখেছেন, আসলে কোন এক পাঠান জায়গিরদার কুলি খাঁর নামে নাকি নাম। একজন লিখেছে, কথাটা হবে কলুর খাড়ি। কোন এক কলুভদ্রলোক নাকি গঙ্গার ওই মজা খাত ইজারা নিয়েছিলেন নবাববাহাদুরের কাছে। আচ্ছা, বলো তো পিণ্টু, কলুভদ্রলোক কি মজা খাত থেকে তৈলনিষ্কাশন করার জন্য—মানে, খাতে জলের বদলে তেল ….খ্যা খ্যা খ্যা খ্যা!…..
সেই হাসি ঝড়ের মুখে ছেঁড়া পাতার কুচি উড়ে যাওয়ার মতো উড়ে গেল, ভেসে গেল ছত্রখান হয়ে। কামরূপ এক্সপ্রেস এসে ঢুকল প্ল্যাটফর্মে। ইতিহাসের শিক্ষক তবু দমে গেলেন না। ভাগ্নের কাঁধে স্নেহের থাবা হাঁকড়ে সবকিছু কোলাহল, ওভারব্রিজের কাঠের প্রচণ্ড কম্পন ও স্পন্দন, ধাবমান মানুষজনের ভিড়ের ভেতর স্বকীয়তা ও নির্জনতায় নিজেদের কোণঠাসা করে নিয়ে তিনি কানে ফুসমন্তর দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ওটা কুরুখণ্ডীই হবে। কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের পর পরাজিত এক পলাতক কুরুরাজপুত্র এখানে এসে বাস করেছিলেন। কুরুরা ছিলেন ক্ষত্রিয়। যোদ্ধার জাত। তোমরা সেই ক্ষত্রিয় কুরুকুলজাত। ডোণ্ট ফরগেট দ্যাট। তোমরা ফাইটার বংশ। হাজার-হাজার বছরের ফাইটিং ট্রাডিশান তোমাদের।
বরুণ মুখ তোলে। বিকেলের শেষ উজ্জ্বলতা ওভারব্রিজটিকে হঠাৎ জ্বালিয়ে দিতে থাকে। তার মুখে সেই জ্বালা সেই আকস্মিক তীব্রতার ঝকমকানি। মামার চোখে চোখ রাখে সে। তার মাথার ভেতর ‘ফাইটিং ট্রাডিশন’ কথাটি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। আর তারপর ইতিহাসবিদ চোখে ঝিলিক তুলে বলেন, কী পিণ্টু? পারবে তো ফাইট দিতে পাঁচুগোপালবাবুর মেয়ের জন্যে?
বরুণ আস্তে বলে, পারতাম। কিন্তু বাবা যদি বা কিছু না বলেন, দাদা কেলেঙ্কারি বাধাবে। দাদা এখন এরিয়ার লিডার। সব গুণ্ডামস্তান ওর হাতে।
আহা, আফটার অল তুমি তার সহোদর ভাই!
বরুণ একটু চুপ করে থাকার পর বলে, শিউলির বাবা দাদার বেপার্টির লোক ছিলেন। দাদার বিরুদ্ধে পিটিশন করেছিলেন। দাদা জানতে পারলে খুব বিপদ হবে মামাবাবু!
হুঁ, তাহলে এটা একটা প্রব্লেম। ইতিহাসবিদ মামাবাবু সমব্যথী কণ্ঠস্বরে বলেন। বাই দা বাই, গোপনে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করোনি তো?
করছি।
করেছ? ভবচরণ ভুরু কুঁচকে বলেন ফের, কবে করেছ?
গতমাসে।
হুঁ। ভবচরণ ভাগ্নের কাঁধ আঁকড়ে পা বাড়ালেন। সত্য উদঘাটনে সমর্থ হয়েছেন, মনের ভেতর সেই জয়গৌরব কানায়-কানায় উপচে উঠছে। ভাগ্নেবাবাজি তাঁর ফাঁদে এত সহজে পা দেবে, ভাবতে পারেননি।
আর বরুণ ভাবছিল ভাবছিল তাহলে সে ফাইটার বংশ! দেবে নাকি একটা দুর্দান্ত ফাইট? কয়েক পা এগিয়ে ডাকল, মামাবাবু?
উঁ! অন্যমনস্ক মামাবাবু সাড়া দিলেন।
যদি আমি শিউলিকে আপনার বাসায় রেখে আসি?
থমকে দাঁড়ালেন মামাবাবু। গলার ভেতর বললেন, টু রুম ফ্ল্যাটে থাকি। কোনওরকমের ঠাসাঠাসি বসবাস। আমারও বড় প্রব্লেম বাবা! প্রচণ্ড প্রব্লেম-অফ স্পেস।
বরুণ শক্তগলায় বলে, কলকাতা-টলকাতা পালিয়ে যেতাম। কিন্তু তাহলে শিউলির মায়ের ওপর জুলুম হবে! সেই ভেবে সাহস পাচ্ছি না।
ওভারব্রিজ থেকে সিঁড়িতে নামতে নামতে ভবচরণ বলেন, সাংঘাতিক প্রব্লেম! ভেরি ভেরি ডেঞ্জারাস।
নিচে প্ল্যাটফর্মে নেমে বরুণ বলে, আমি এখন এক জায়গায় যাব, মামাবাবু!
হুঁ।
প্লিজ মামাবাবু, এখনই বাবা-মায়ের কানে যেন কথাটা তুলবেন না!
উুঁ হুঁ হুঁ! ভবচরণ শক্ত মুঠোয় খপ করে ভাগ্নের হাতের কবজি ধরলেন। এর একটা নিষ্পত্তি করে ফেলা দরকার। তুমি এস আমার সঙ্গে।
বলে খ্যা খ্যা করে হাসেন। কুরুবংশ ফাইটার। এস—দেখি, কেমন ফাইট দিচ্ছ!
আশা-নিরাশায় কুরুবংশীয় যুবাপুরুষ মাতুলকে অনুসরণ করে।……
বটবৃক্ষের ডালে বসে বেঙ্গমি ডাকে, ও বুড়ো, ঘুমোলে নাকি?
বেঙ্গমা বলে, জেগে আছি।
মেয়েটা কখন থেকে বসে আছে।
তা তো দেখছি!
ছেলেটা এখনও আসছে না।
আসবে’খন। না এসে পারে?
দোতলার সেই ঘরে বসে হতবাক চারটি মুখ। একটি মুখ ঝুলে আছে, থুতনি গলার খাঁজে গোঁজা। পর্দার পেছনে আরও একজন। কোলে খোকামণি। চাঁদমামা দেখাচ্ছে খোকামণিকে। কিন্তু কান দুটি ঘরের দিকে ওত পেতে আছে।
অনুপমা কচরমচর পান চিবুচ্ছিলেন। কোলে নাদুস বেড়ালটি বারবার ওঠার চেষ্টা করছে। ঠেসে সরিয়ে দিচ্ছেন। শেষে উচ্চারণ করলেন, ঠণ্টুকে—
লোচন বললেন, চুপ। ওর কানে তুলো না।
ভবচরণ ম্লানহাস্যে বললেন, মণ্টুর চেয়ে প্রব্লেম হল তোমার ফ্যামিলির। তোমাদের রুর্যাল সোসাইটিতে এ জিনিস মেনে নেবে না—আই নো দ্যাট ভেরি ওয়েল।
লোচন বললেন, তা আর বলতে?
অনুপমা হাত নেড়ে বললেন, টা না।
পাটাকুড়োনির মেয়েকে আমি ঘরে টুলতে ডেব না।
বিরক্ত লোচন বললেন, মুখের রাবিশগুলো ফেলে এসো দিকি। তাপরে কথা বলো।
সুতরাং হাসলেন অনুপমা। বেরিয়ে গেলেন। বারান্দায় রেলিং ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বড় বউমা খোকাকে চাঁদমামা দেখাচ্ছে। খোকা কুঁই কুঁই করছে। নিচের উঠোনে মুখের রাবিশ ফেলে ফিসফিসিয়ে বললেন, শুনেছ বউমা—পিণ্টু…..
জয়া ঝটপট বলল, শুনেছি।
চলো, তোমার ঘরে চলো। সণ্টুকে গিয়ে বলি, বিহিত করুক শিগগির।
শাশুড়ি-বউ বারান্দা ধরে হাঁটতে থাকলেন। পুবদক্ষিণ কোণায় বউমার ঘর।…..
এ-ঘরে চুপচাপ তিনটি পুরুষমানুষ। শিলিং ফ্যান চক্কর খাচ্ছে। নিচের ঘর থেকে টিভির হিন্দি গান আবছা শোনা যাচ্ছে।
ভবচরণ সিগারেট অ্যাশট্রেতে ঘষে নেবালেন। বললেন, আমি বলি কী, সিচুয়েশন যখন এমন ক্রিটিক্যাল, তখন ফ্যামিলির স্বার্থে, এমন কী নিজের স্বার্থেও পিণ্টু স্যাক্রিফাইস করুক।
বরুণ মুখ তুলল। মামাবাবুর দিকে তাকাল।
মামাবাবু বললেন, তুমি মেয়েটিকে পরিত্যাগ করো পিণ্টু!
লোচন বললেন, রেজিস্ট্রি করে বসে আছে যে হতভাগা!
রাধু উকিল আছে। ভেবো না। ভবচরণ আশ্বাস দিলেন। পিণ্টু ডিভোর্সের পিটিশান করুক।
গ্রাউণ্ড?
গ্রাউণ্ড ক্যারেক্টার। মেয়েটি ব্যাডক্যারেক্টার।
হাসলেন লোচন।…কিন্তু তাহলে রাধুবাবু কি আর পিণ্টুর সঙ্গে মেয়ে দিতে চাইবেন?
হঁউ—চাইবেন।
কী সব বলো ভবদা! বিরক্ত মুখে লোচন বললেন। জেনেশুনে—
কথা কেড়ে ভবচরর বললেন, দেবে। কারণ মেয়ের একটুখানি খুঁত আছে—ভেবেছিলাম পরে বলব। এখনই বলে ফেলি। একখানা পা একটুখানি—মানে জন্ম থেকেই আর কী!
খোঁড়া?
না—না। খোঁড়া বলতে যা বোঝায়, তা ঠিক নয়। ভবচরণ তেড়েমেড়ে বললেন, ওই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য লক্ষ বর পেতে আছে। লুফে নেবে। কেন—তা তো আগেই বলেছি। লক্ষপতি লোক রাধু উকিল। শুধু দোষের মধ্যে বড্ড সন্দেহবাতিকগ্রস্ত লোক। বড্ড খুঁতখুঁতে। কিন্তু আমার বলতে গেলে বুজম ফ্রেণ্ড। সারা টাউনে একমাত্র আমাকেই বিশ্বাস করে। এদিকে পিণ্টুর চেহারা ভাল। একেবারে ফিল্ম হিরোর মতো দেখতে। নিজের ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে দ্যাখো! দ্যাখো, দ্যাখো!
মামা ভাগ্নের নিচু মুখটিকে সজোরে উঁচু করে ধরেন দুই হাতে। পিণ্টু চোখে দুটো নিচু করে। কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করে। বলতে পারে না।
আর সেই সময় পর্দা তুলে তরুণের আবির্ভাব ঘটে। রাগী মুখ। নাসারন্ধ্র স্ফীত। ঘড়ঘড়ে গলায় ডাকে, পিণ্টে!
বরুণ শুধু বলে, কী?
তরু এসে তার গালে চড় মারে। ভবচরণ ঝটপট মাঝখানে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বলে, কী হচ্ছে সণ্টু! ছিঃ!
সরে যান মামাবাবু। ওকে আমি মেরে শেষ করে ফেলব।
চড় খেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল বরুণ। জোরে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। তরুণ শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে, কালই দুই বেশ্যামাগিকে গ্রামছাড়া না করে ছাড়ছি না।
লোচন বলেন, আঃ! বড্ড বাড়াবাড়ি করিস বাপু তুই। খালি তিলকে তাল—
তুমি থামো! বাবাকে ধমক দেয় ছেলে। বাবা কাঁচুমাচু মুখে বসে থাকেন।
লোচন বড় ভাগ্নের দুই কাঁধ দরে বসিয়ে দেন খাটের ওপর। চাপা স্বরে বলেন, যা কেলেঙ্কারি হবার হয়েছে। আর মাথা ভাঙলেও তা ঘোরানো যাবে না। মাঝখান থেকে থানা পুলিশ হবে। কেলেঙ্কারিতে ঢিঢি পড়ে যাবে। তার ওপর কাগজ ওলারা বড়-বড় হরফে খবর ছাপবে; ওয়েস্টবেঙ্গলে এখনও কাস্টিজম? এ কি বিহারমুল্লুক হয়ে গেল? বাবা সণ্টু, মাথা ঠাণ্ডা রেকে এগুতো হবে। তাছাড়া তুমি একজন পলিটিসিয়ান—পলিটিক্সে নেমেছ। সাবধানে পা না বাড়ালে তোমার পলিটিক্যাল কেরিয়ারটিরও বারোটা বেজে যাবে।
পলিটিসিয়ান বড় ভাগ্নের নাকের ফুটো ফুলে-ফুলে ওঠে। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে।
অনুপমা ঘরে ঢুকে আর্ত চেঁচান, পিণ্টু অমন করে বেরিয়ে গেল কোথায়? তোমরা দ্যাখো—ওকে আটকাও গিয়ে। কী করে বসবে বাছা আমার ঝোঁকের বশে।
হু হু করে কাঁদেন ছেলের মা। তাঁর বিজ্ঞ দাদা বলেন, দেখছি। আমি দেখছি ওকে।
ভবচরণ বেরিয়ে যাবার সময় শ্যালককেও সঙ্গে নিয়ে যান। অনিচ্ছা সত্বেও শ্যালক ভারি শরীর বহন করে পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকেন।
রাস্তায় গিয়ে ভবচরণ বলেন, তোমাদের সেই পাঁচুবাবুর বাড়ি যাওয়া যাক। দেখি, কিছু নিষ্পত্তি করা যায় নাকি। পিণ্টু সম্ভবত সম্ভবত সেখানেই গেল। চলো, পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো আমাকে।
সুবচনী দাওয়ায় বসে ছিলেন লণ্ঠনের দম কমিয়ে। লোচনবাবুর সাড়া পেয়ে চমকে ওঠেন। লোচনবাবুর সঙ্গে এক তাগড়াই চেহারার ভদ্রলোক। হকচকিয়ে বলেন, সুবচনী, কী হয়েছে?
ভবচরণ সহাস্যে বলেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই আপনার। ইয়ে—পিণ্টু আছে নাকি?
সুবচনী আরও অবাক হয়ে বলেন, পিণ্টু? না তো! সে তো আমাদের বাড়ি কখনও আসে না।
লোচন বলেন, কেন মিথ্যা বলছ বাপু?
আপনার দিব্যি দাদা! সুবচনী হাঁসফাস করে বলেন। বিশ্বাস করুণ আপনার ছেলে—
কথার ওপর কথা রাখেন ভবচরণ, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমরা একটা ইমপর্ট্যান্ট কথাবার্তা। বলতে এসেছি আপনার সঙ্গে। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে তো বলা যাবে না!
সুবচনী হঠাৎ শক্ত হয়ে ওঠেন। আস্তে বলেন, আসুন।
দাওয়ায় একখানি কম্বল বিছিয়ে দেন সুবচনী। শ্যালক-ভগ্নীপতি তাতে উপবেশন করেন। পদচতুষ্টয় দাওয়ার নিচে দোদুল্যমান হয়। ভবচরণ একটু হেসে বলেন, আপনার মেয়েকে ডাকুন!
ফ্যাঁসফেঁসে গলায় সুবচনী বলেন, শিউলি তো নেই। ভুটুবাবুর বাড়ি টিউশনি করতে গেছে।….
বেঙ্গমি বলে, ও বুড়ো! দ্যাখো, দ্যাখো!
বেঙ্গমা নিচে উঁকি মেরে বলে, কী? ছেলেটা এল বুঝি এতক্ষণে?
বেঙ্গমি ফিসফিস করে বলে, না, না।
তবে কী হয়েছে?
মেয়েটা ইট-পাটকেল কুড়িয়ে জড়ো করছে।
সে কী? কেন বলো তো?
অই মা! পরনের শাড়ি খুলে ইটগুলান পুঁটুলি করে বাঁধছে যে! আমার বুক কাঁপছে।
কিছু বোঝা যায় না। কী হচ্ছে বলোদিকি?
দ্যাখো, দ্যাখো! ঝিলবাগে নেমে যাচ্ছে মেয়েটা!
তাই তো।……
বেঙ্গমী শ্বাস ফেলে। বেঙ্গমা শ্বাস ফেলে। চৈত্ররাতের একটা দমকা হাওয়া এসে সেই শ্বাসকে মিশিয়ে নেয় নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসে। ঝিলের ওপারে হিজল বাবলার ডালপালা বেয়ে এতক্ষণে চাঁদ পৃথিবীর শিয়রে দাঁড়াল। একলা হট্টিট্টি পাখিটা ডাকতে লাগল ট্টি ট্টি ট্টি….ট্টি ট্টি ট্টি। ঝিলের জলে জ্যোৎস্নাগুঁড়োর ঝিলিমিলি। আকলু ধীবর কখন বাড়ি ফিরে গেছে। আজ ধীবরবুড়ো গুটিকতক মৌরালা পেয়েছিল। তার ঘরে আনন্দলহরী।…….
বেঙ্গমি বলে ওঠে, ও বুড়ো! জেগে আছ কি?
বেঙ্গমা বলে, আছি। কী হয়েছে?
ছেলেটা আসছে।
অ।
কিন্তু মেয়েটা ইঁটের পুঁটুলি নিয়ে কোথায় গেল? কেন গেল?
আমার বড় ভয় করো গো!
আমারও।…….
বরুণ হনহন করে এগিয়ে আসে বুড়োতলায়। চাপা স্বরে ডাকে, শিউলি! কোনও সাড়া পায় না। সে ছায়ার ঢুকে পড়ে। শেকড়বাকড়ে টোক্কর খেতে খেতে বারবার ডাকে, শিউলি! ও শিউলি! শিউলি একরাতে এমনি লুকোচুরি খেলেছিল। আজ আর লুকোচুরির রাত নয়। সে বারকতক ডাকাডাকি করে জ্যোৎস্নায় ফেরে। শিউলি তাহলে তার দেরি দেখে বাড়ি ফিরে গেছে। বরুণ আনমনে চাঁদের দিকে তাকায়। শিউলি বলেছিল, ভাবা যায় না ওই চাঁদে মানুষ হেঁটেছে। সত্যিই ভাবা যায় না। শিউলি ঠিকই বলেছিল, হয়তো এ চাঁদ সে-চাঁদ নয়। ঠিকই বলেছিল।
আরেকবার ডাকবে ভাবে বরুন। ঠোঁট ফাঁক করে। কিন্তু ডাকে না। বরং সোজা শিউলিদের বাড়ি চলে যাবে। ওর মায়ের সামনে সব কথা খুলে বলবে। সে যদি কুরুবংশীয় হয়, সে যদি হয় ফাইটার—কেন ফাইট দিতে ভয় পাবে? আর যদি ভয় পায়, তাহলে মামাবাবুর ওই ইতিহাস মিথ্যে, মিথ্যে, মিথ্যে!
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে বরুণের। সিগারেট ধরায়। হঠাৎ কেন বাতাস থেমে গেল! নিসর্গের গভীর থেকে ভেসে আসতে থাকল শ্রুতিপারের সব আশ্চর্য ধ্বনিপুঞ্জ। জীবন্মৃত্যুর সীমান্তরেখা থেকে কেউ কিছু বলার চেষ্টা করছে কি? বরুণ চষা নরম মাটিকে গুঁড়ো করে দিতে দিতে হাঁটতে থাকে।
গৈরবা এখন স্টেশনবাজারে হারাধনবাবুর বাড়ি দুপুরে এঁটো থালাবাসন মাজছে। ধীবরবুড়ো তার বউকে পরোয়া করে না। তাছাড়া গত সন্ধ্যায় মৌরলামাছের ঝোল দিয়ে পান্তা খেতে খেতে আমোদিনী বলেছিল, ঝিলে এখনও বেরৎ-বেরৎ মাছ আছে। রাতবিরেতে ঘাই মারে শোনোনি?
আকলু জাল ফেলে। ঝপাস করে শব্দ হয়। এখানটায় গভীর খাত। দহ হয়ে আছে। কাল সন্ধ্যায় এখানেই মৌরালা পেয়েছিল। ঝিলের জলে দিনশেষের ছায়া। জলমাকড়সা তরতরিয়ে সাঁতার কেটে বেড়ায়। কিন্তু জাল কিসে আটকে গেল যেন! টানাটানি করে বুড়োধীবর। দম ফুরিয়ে যায় জাল টানতে। জালখানি ছিঁড়লে তার কী হবে?
তবু মরিয়া টানাটানি করতে থাকে। একটু পরে জাল গুটিয়ে আসে। এত ভারি কেন বুঝতে পারে না। কিনারায় জাল গুটিয়ে আসতেই একখানি ফিকে হলুদ হাত তার চোখে পড়ে। মানুষের হাত! তারপর কালো চুল একরাশ। আকলু থরথর করে কাঁপে। জালে মানুষ ধরা পড়েছে। মেয়েমানুষ!
বটের শেকড় নেমে এসেছে পাড়ের মাটি বেয়ে অজগর সাপের মতো। কাঁপা-কাঁপা হাতে খেয়াজালের মুঠোর দড়ি সেই শেকড়ে বাঁধে আকুল। এদিক-ওদিক তাকায়। দিনশেষে কেউ কোথাও নেই।
সে হাঁচড়-পাঁচড় করে পাড়ে ওঠে। থপথপিয়ে হাঁটে গ্রামের দিকে। এক্ষুনি খবর দিতে হবে। মরা মেয়েমানুষের চেয়ে তার জালখানির দাম তার কাছে অনেক বেশি।……
বেঙ্গমি ডাকে, ও বুড়ো। জেগে আছ কি?
বেঙ্গমা বলে, আছি, কী হয়েছে?
মেয়েটার জন্য মন কেমন করে গো!
হুঁ—আমারও।
দ্যাখো, দ্যাখো!
কী?
ছেলেটা আসছে!
এসে আর কী করবে? চুপচাপ বসে খালি সিগারেট টানবে।
ছেলেটার জন্য বড় কষ্ট হয়, জানো?
হুঁ—আমারও!…..