বৃত্তের বাইরে – ৭

।। ৭ ।।

সাত—আট দিন হয়ে গেল অথচ হারানো—প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ কলমে নিজের ছবি ইত্যাদি ইত্যাদি কোনও কাগজেই না দেখে খুবই বিস্মিত হলেন বিজু রায়। টিভি দেখবার সুযোগ অবশ্য পাননি। কিন্তু এতদিনে তাঁর যেটুকু গোঁফ দাড়ি বেরিয়েছে, তাদের সযত্নে ট্রিম করছেন তিনি। চোখেও কালো চশমা এঁটে বেরোন। তবু একটা অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে থাকে। তিনি কয়েকটা রেডিমেড পায়জামা—পাঞ্জাবি, জহর কোট কিনে নিয়েছেন, একটা আলোয়ানও। এই বেশ তাঁর অনভ্যস্ত। বলতে গেলে এই বেশে তাঁর স্ত্রী ছাড়া বড় কেউ একটা দেখেনি তাঁকে, তা গত কুড়ি বছর তো হলই। সকালে এক কাপ চা খাবার পরই চান—টান করে, দাড়ি কামিয়ে একেবারে ফুলহাতা শার্ট এবং ট্রাউজার্স পরে ফেলেন তিনি। অফিসে যাবার সময়ে এর ওপরেই চাপে কোট, টাই। গরমকালে হয়তো ফুলহাতার জায়গায় হাফ হাতা। একেবারে শোবার আগে, চান সেরে তবে পায়জামা—পাঞ্জাবি পরেন। ভোরবেলা চা দিতে এসে বদন বা প্রমীলা এ বেশে দেখে থাকতে পারে। বাস। কাজেই এখন বেশ কদিনের না কামানো দাড়ি গোঁফ ট্রিম করে, পাজামা—পাঞ্জাবির ওপর আলোয়ানটা ভাল করে মুড়ি দিয়ে ঘোরাফেরা করলে তেমন ভয় কিছু নেই। তবে সন্ধ্যা হলে আর সানগ্লাসটা পরতে পারেন না।

দিদিকে দাহ করে ফিরতে অনেক দেরি হল। দিদির দেহ আর সুখচরে নিয়ে যাবার হাঙ্গামা করেননি। তবুও। রত্না একাই এসেছিল। সে—ও সুখচরে দেহ নিয়ে যাবার কথা বলেনি। সুখচরের আপাত—পরিত্যক্ত বাড়িতে এখনও খুব সম্ভব শাঁটুল বাস করছে। গোপন। এটাই বাস্তব অসুবিধে। বলতে গেলে যে ছেলের হাত থেকে শেষ পাথেয় নেবার কথা দিদির, সেই ছেলের জন্যেই দিদি নিজের বাস্তুতে ফিরতে পারল না। দিদির বোধহয় ফেরবার ইচ্ছেও ছিল না। লিভারের ক্যানসার এমনই ভয়ানক রোগ, যে তা মানুষকে নিশ্চিতভাবে ইচ্ছা—অনিচ্ছা, প্রেম—অপ্রেম, আসক্তি—সংস্কার সমস্ত কিছুর বাইরে নিয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি হবার পর দিদির চোখের দৃষ্টিতে সেই চরম ঔদাসীন্য দেখেছিলেন তিনি। যখন শাঁটুলের ফেরবার খবর রত্না ফিসফিস করে জানাল, তখনও কোনও ভাবান্তর দেখেননি। দিদি, জড়বুদ্ধি বড়দার পরে বিজু রায়র প্রথম রক্তের সম্পর্ক, মায়ের পেটের রক্তের পোম আপন বলতে তিনটি বোন, তা সেই প্রথম সম্পর্ক এখন মহাপৃথিবীর মাটিতে, জলে, হাওয়ায় মিশে গেল। তিনি ডেকেছিলেন, মেসের পরিচিতদের। মণিময়, নিতাই ভট্টাচার্য চাঁদু মিত্তির প্রতুল বিশ্বাস বলে আরও একটি যুবক এবং কিছু বয়স্ক মানুষও তাঁর সঙ্গে নিমতলার শ্মশানঘাটে গেলেন। মণিময় বলল—’দিদির অসুখের খবর শুনেই তা হলে আপনি এসেছিলেন বিজনদা!’ খানিকটা ভাবুক স্বরে, ‘হুঁ’, দিয়ে বিজন দূরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এইভাবে শোককাতরতার ভান করতে তাঁর খারাপ লাগছিল। তবে শোককাতর না হলেও এক ধরনের দার্শনিক ভাবুকতা তো তখন তাঁকে পেয়েই বসেছিল! তিনি তো গঙ্গার জলরেখার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেনই। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু শুরু হয়। ভাই—বোনেদের মৃত্যু দিয়ে সেই মৃত্যুর পদক্ষেপ আরও দৃঢ় হয়। মৃত্যুর কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গেল তাঁর জীবনে। এখন জীবনটাকে বুঝে নিতে হবে। অবশ্য কতটুকুই যা জীবনের দেখেছেন তিনি। বোঝবার ক্ষমতাও অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। তবু! যতটুকু পারা যায়।

এই সময়ে রত্না এসে তাঁকে ডাকল। একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলল—’মামাবাবু, মায়ের বাপের বাড়ির কাউকে কি খবর দেওয়া উচিত?’

তখন বিজু রায়ের মনে পড়ে গেল যতক্ষণ অসুখ ছিল, চিকিৎসা ছিল ততক্ষণ দিদি ব্যক্তি, তিনি ব্যক্তি, রত্নাও একজন ব্যক্তি। যে যা পেরেছে, করেছে। কিন্তু মৃত্যু হওয়ামাত্র সমস্ত ব্যাপারটা সমাজের হাতে চলে গেল। এখন কাকে খবর দেওয়া হল আর কাকে হল না—এ সমস্ত ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তিনি খুব ভাবনায় পড়ে গেলেন। মুখাগ্নি তিনি করেছেন। ছেলের অনুপস্থিতিতে শ্রাদ্ধকর্ম তাঁর করার কথা। কিন্তু এখন চতুর্দিকে যদি শ্রাদ্ধবার্তা রটে যায় তা হলে তো তিনি তাঁর কাজ শেষ হবার আগে ফিরে যেতে বাধ্য হবেন।

একটু ভেবে তিনি বললেন—’দিদির শ্বশুরবাড়ির দিকেও তো কারও কারও থাকবার কথা!’

রত্না বলল, ‘আমার দুই ননদ আছে, তাদের তো খবর দিতে হবেই। আর কেউ আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। খুড়ো শ্বশুরের পরিবার কাছেই ব্যারাকপুরে থাকে, কখনও খোঁজ খবর নেয় না।’

—’সে কি তোমার মামারাই কেউ নেয়।’

—’ওই বিয়ে—থাতে কার্ড আসে, মাঝেমধ্যে চিঠি আসে।’

বিজু বললেন, ‘এক কাজ করো, তোমার ননদদের চিঠি দাও। আর সুখচরের বাড়িতেই কাজের আয়োজন করো। গুড্ডু কাজ করুক। পাঁচের ওপর বয়স তো হয়েছে। আমি কাগজে একটা খবর দিয়ে দিচ্ছি। ছেলে যে কালে বেপাত্তা, অত কার্ড—টার্ড করার তো কিছু নেই।’

—’ওর কথাটা ভাবলেন কিছু? মামাবাবু?’

—’ভাবছি, আরও কিছুদিন সময় দাও রত্না।’

মণিময়রা আগেই ফিরে গিয়েছিল। তিনি অস্থি না নিয়ে ফিরতে পারছিলেন না। ওরা থাকবে বলেছিল, কিন্তু পরদিন সবাইকারই অফিস। তিনি জোর করেই ওদের পাঠিয়ে দিলেন। তাঁর ফিরতে এগারোটা হল।

হরিহর বসে বসে ঝিমোচ্ছিল সম্ভবত। দরজা খুলে দিল। বিজু সিঁড়ির ওপর বেশ খানিকটা উঠে গেছেন, হরিহর হঠাৎ চাপা গলায় ডাকল, ‘বাবু!’

বিজু ঘুরে দাঁড়ালেন। হরিহর বলল—’সাইমন সন্ধেবেলায় এসেছিল। এই প্যাকেটটা দিয়ে গেছে।’ একটা পাতলা প্যাকেট ব্রাউন পেপারে মোড়া, সে বিজু রায়ের হাতে তুলে দিল। তারপর নিজের জায়গায় আবার ফিরে গেল। এবার বোধহয় নিশ্চিন্তে ঘুমোবে।

বিজু গঙ্গা থেকে চান করে এসেছিলেন। ঘরে গিয়ে আবারও হাত পা ধুলেন। জামাকাপড় বদলালেন। তারপরে শোবার ঠিক আগে প্যাকেটটা খুলে ফেলেন। একটা বড় চৌকো ব্রাউন পেপারের খাম, দুদিকে স্টেপল করে আটকানো। ভেতরে একটা সানডে পত্রিকা। এরই জন্য এত? সানডেটা বেশ পুরনো। কত পুরনো দেখবার জন্যই তুলতেই ভেতর থেকে ঠুক করে একটা লম্বা ব্রাউন পেপারের খাম পড়ল। খামটা হাতে করেই বিজু রায় বুঝতে পারলেন এর মধ্যে টাকা আছে। সাবধানে মুখটা ছিঁড়ে ফেলে দেখলেন একগোছা বেশ নতুন নোট। গুনতে লাগলেন। একশ টাকার পাঁচশটা নোট। অর্থাৎ পঞ্চাশ হাজার। বারে মজা! নলিনী কর যখন পঞ্চভূতে মিলিয়ে গিয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে, ঠিক তখনই তার কাছে ‘সানডে’র প্যাকেটে পঞ্চাশ হাজার টাকাটা দিয়ে গেল সাইমন? ‘পঞ্চাশ হাজার’ এই পরিমাণটা তাঁর মাথার মধ্যে টরে টক্কা টক্কা টরে করে কী যেন বলবার চেষ্টা করল। কিন্তু বিজু রায় এতই অবাক এবং এতই ক্লান্ত যে কিছুতেই সে সংকেত উদ্ধার করতে পারলেন না। নলিনী করের বোতল থেকে এক পেগের মতো হুইস্কি খেলেন তিনি জলে মিশিয়ে। খেয়ে কেমন একটা অপরাধবোধ হল। আপন মনেই বললেন ‘শোধ দিয়ে দেব।’ পরক্ষণেই নিজের মনে হেসে উঠলেন, কাকে শোধ দেবেন? নলিনী করের বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। পঞ্চাশ হাজার টাকার প্যাকেট বালিশের নীচে।

বেশ ভোরবেলা। তখনই ভাল করে মানুষজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, এমন সময়ে দক্ষিণের খোলা জানলা নিয়ে একটা মিহি বালিকা—কণ্ঠের ডাক ক্রমাগত ডেকে যাওয়া পাখির নাছোড়বান্দা ডাকের মতো তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে দিল। —’ও দাদু, ও দাদু, ও টঙদাদুর বন্ধু; ও দাদু, ও দাদু!’ তিনি গা থেকে চাদরটা খুলে দক্ষিণের জানলায় দাঁড়ালেন, ও দিকের ছাদে মণিদীপিকার ছোট্ট মুণ্ডু দেখা যাচ্ছে। ও তাঁকে দেখতে পেয়েছে। —’একবার এদিকে এসো না, ও দাদু!’ ব্যস, হঠাৎ তাঁর মস্তিষ্ক কম্পিউটারের মতো দক্ষতায় টরে টক্কা সংকেতের মর্ম উদ্ধার করে দিল। ‘পাত্তি টু পাত্তি চান্স নিতে হবে একবার। জিতলে পঞ্চাশ। হারলে পাঁচ। কুছ পরোয়া নেই। জীবন জুয়ায় অমৃত বা বিষ যা উঠল তা আমার। লক্ষ্মী যদি ওঠে তো সে দাদু পাবে।’ পঞ্চাশ মানে তা হলে পঞ্চাশ হাজার! তিনি চেঁচিয়ে বললেন—’আসছি।’ কলঘরে গিয়ে চোখে মুখে ভাল করে জলের ঝাপটা দিতে চোখে যেন ছুঁচ ফুটতে লাগল। আরেকটু ঘুম তাঁর শরীরের প্রাপ্য ছিল বোধহয়। পাঁচিলের ধারে গিয়ে তিনি দেখলেন, অল্প কুয়াশায় শুধু মণিদীপিকাই নয়, অদূরে ভাল করে চাদর দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা একটি মেয়েও রয়েছে।

মণিদীপিকা বলল—’ও মা, ও মা, এই তো টঙদাদুর বন্ধু। বলো, বলো না কথাটা!’

মেয়েটি একটু সংকোচের সঙ্গে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল,—’আমি আপনার নাম—টাম কিছুই জানি না। কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। আজ মণির জন্মদিন। প্রত্যেক বছর এই দিনে উনি মানে নলিনীকাকা আমাদের বাড়িতে খেতেন। উনি মণিকে ভীষণ ভালবাসতেন। আপনি, মানে আপনি কি আসবেন?’

বিজু রায় দেখলেন মেয়েটি নেহাতই অল্পবয়সী। রত্নার চেয়েও। কিংবা হয়তো অপুষ্টির জন্যে এমন দেখাচ্ছে। খুবই রোগা পাতলা। ভিতু—ভিতু মুখ। মুখের আদলটা যেন মণিদীপিকারই মতো। এই ভোর—কুয়াশায় মেয়েটির চোখে জল দেখতে পেলেন তিনি। ‘—উনি আসতেন।’ ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো আবার মেয়েটির গলার স্বর ছুঁয়ে গেল তাঁকে। তিনি বললেন—’নিশ্চয়ই আসব। কখন যেতে হবে?’ শেষ কথাগুলো তিনি বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বললেন। সে বলে উঠল—’আমি আর তুমি এগারোটার সময়ে লাল পায়েস খাবো। আর যদি টঙদাদু এসে পড়ে, তো বলব আড়ি, আড়ি, আড়ি।’ মণিদীপিকা তার বুড়ো আঙুল তুলে দেখাতে লাগল। কবেকার খেলা এ সব? বিজু রায়ের মনের ভেতরটা যেন ঝনঝন করে নড়ে উঠল। পুরনো দরজা জানলা। জানলার শিক, দরজার শেকল সব ঝনঝন করছে। আড়ি, আড়ি, আড়ি, ভাব ভাব ভাব। এই রকমই কচি একফোঁটা আঙুল, দোপাটির মতো নরম গাল, ঠোঁট, নাক, কপাল। ছেলেবেলায় তাঁদের এমনি আড়ি—ভাব ছিল বড্ড। তিনি ডিসেম্বরের ফিকে হতে থাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন—’ছুটকি তুই কোথায়? আমি যে কিছুতেই তোকে খুঁজে পাচ্ছি না।’

মাঝে মাঝে ছোটদের সবাইকে নিয়ে লুকোচুরি খেলা হত। বিজু ছোটখোকা চোখ বুজলেই সব দুদ্দাড় করে লুকোতে ছুটত। লুকানোর চোটে মায়ের ভাঁড়ারঘর শোবার ঘরের খাটের তলা সব উস্তম খুস্তম হয়ে যেত। এক এক করে সব কটাকে টেনে টেনে বার করতে পারত বিজু। ভোঁদড়, রাজা, নীলি, পল্টু, শোভা, মিনু সব, স—ব। কিন্তু এক এক দিন ছুটকিকে কিছুতেই খুঁজে পেত না। অবশেষে সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসত। খেলুড়িরা আর দেরি করতে চাইত না। সব যে যার বাড়ি চলে যেত। অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়ে বিজু ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলত। —’ছুটকি, তুই কোথায়?’ সে যেন আর কোনও দিনই ছুটকিকে খুঁজে পাবে না। ছুটকি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। লুকোতে গিয়ে সে পৃথিবীর আস্তরগুলো সরাতে সরাতে এমন জায়গায় চলে গেছে যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। রুদ্ধ কান্না ক্রমে চড়া আওয়াজে পৌঁছত। তারপর একসময়ে হঠাৎ পেছন থেকে চোখ টিপে ধরত ছুটকি।

—’দূর পাগল—এই তো আমি!’

—’কোথায় ছিলি?’

—’সে আমার লুকানো জায়গা, বলব কেন রে?’

—’তা হলে আর তোর সঙ্গে কোনওদিন খেলব না।’

—’খেলিসনি। কিন্তু সে জায়গাটা আমি কক্ষনো, কাউকে বলব না।’

—’কেন?’

—’তোরা জেনে গেলেই তো খুঁজে বার করবি। তখন? জিততে পারব?’

ছুটকি তুই তোর গোপন জায়গাটার কথা আমাকে কোনও দিনও বললি না। জেতার নেশায় না কিসের নেশায়, তা জানি না। কিন্তু এমন লুকোন লুকোলি যে সত্যিই তোকে আর কিছুতেই খুঁজে বার করতে পারলুম না। দ্যাখ ছুটকি, এখন খেলা ভাঙার খেলা শুরু হয়ে গেছে, সবাই যে যার বাড়ি চলে যাচ্ছে। কার কাছে জিতবি আর? শুকনো চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন বিজু রায়। সান্ত্বনাহীন।

—’বাবু, চা!’ হরিহর। তার গায়ে আজকে একটা পাঁশুটে রঙের চাদর উঠেছে। অধোবাস সেই এক। ঝলঝলে ইজেরের ওপর গামছা। হরিহর তাঁর খুব ভক্ত হয়ে উঠেছে। কেন কে জানে! নলিনী করের পোশাক পরিচ্ছদগুলো তিনি হরিহরকে দিয়ে দিয়েছেন। জামেয়ারটা বাদে। জামেয়ারটাও দেবেন। কিন্তু কদিন বাদে। এ সব পুরনো জিনিসের অনেক দাম পাওয়া যায়। জিনিসটা তো হরিহর কোনও দিন গায়ে দিতে পারবে না। তিনি জিনিসটা যথাস্থানে বিক্রি করে দামটা হরিহরকে দেবেন, ঠিক করেছেন। বলেই করবেন।

পাঁশুটে রঙের চাদরটা দেখিয়ে হরিহর বলল—’আপনার টাকা দিয়ে কিনলুম বাবু!’ তার মুখে অনাবিল হাসি। নলিনী করের এই লোকটির কাছে অনেক ধার ছিল, শোধ করতে পারেনি। প্রধানত সেই কথা মনে করেই তিনি একে এই কদিনেই বেশ কিছু টাকা দিয়েছেন। হরিহর সেগুলোকে কাজে লাগিয়েছে দেখা যাচ্ছে। তিনি ভোরবেলায় বেড—টি খান, সেটা জানিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা করেছে হরিহর। যেসব বড় হোটেলে কাজকর্ম উপলক্ষে তাঁকে উঠতে হয়, সেখানে সার্ভিস চার্জ ছাড়াও কতজনকে কত টাকা বকশিশ দিতে হয়, যে সেবার দাম চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তার জন্যেও। বেড—টি, নলিনী করের জীবন রহস্যের উদঘাটনের জন্য প্রয়োজনীয় কলকাঠি নাড়াতে সাহায্য করা এগুলো তো হরিহরের নিত্যসেবার মধ্যে পড়ে না, তাকে কিছু দেওয়াই তাঁর উচিত। এইভাবেই তিনি বোঝেন জিনিসটা। কিন্তু হরিহর কখনও এ ভাবে পায়নি। সে ভাবে সে উপরি পাচ্ছে। তাই তার ভক্তিটা ক্রমশই গাঢ়তর হচ্ছে।

হরিহর যখন চা—পাউরুটি দিতে এল তিনি নেমন্তন্নর কথাটা জানালেন হরিহরকে। আজকে নো মিল। এ বেলায়। চান—টান করে একটু বাজারের দিকে বেরোলেন তিনি। ক্যাডবেরি কিনলেন কয়েকটা। কিন্তু মণিদীপিকার যে দাঁতে পোকা! তা ছাড়া তিনি দুদিনের জন্য এসে তাকে ক্যাডবেরির স্বাদ চিনিয়ে দিয়ে চলে যাবেন। তারপর সে যদি রোজ রোজ বায়না করে? কয়েকটা ক্যাডবেরি কিনতে এত ভাবনা তাঁকে কখনও করতে হয়নি। তিনি নিউ মার্কেটে চলে গেলেন। একটা ঠিক মাপসই ফ্রক কিনতে হলে তাঁকে মাপটাও বলতে হয়। কিন্তু দোকানদারের কোনও প্রশ্নেরই তিনি জবাব দিতে পারলেন না। কত বছরের মেয়ে? কত বয়স মণিদীপিকার? সাতের কম। তার এখনও দুধে—দাঁত পড়েনি। হাত দিয়ে মেপে—মেপে অনেক কষ্টে একটা পছন্দ করলেন। গোলাপি রঙের ফ্রক তাতে সাদা লেস দেওয়া, ডোনাল্ড ডাক বসানো ঘেরের ওপর। তাঁর আরও কিনতে হচ্ছে করছিল, কিন্তু আবারও তাঁকে ভাবতে হল। নিজের হাতে বাচ্চাদের ফ্রক কেনা তিনি বোধহয় জীবনে এই প্রথম করলেন। তাঁর ছেলেমেয়ের পোশাক—আশাক তনুশ্রীই কিনেছে বরাবর। চকলেটও তিনি কমই কিনেছেন। বিশেষত তাঁর ছেলেমেয়ের, অন্তত ছেলের কথা তো মনে পড়ছেই, খুব দ্রুত চকলেটে অরুচি এসে গিয়েছিল। পছন্দের জন্যে দোকানদারের ওপরই নির্ভর করলেন তিনি। ফ্রকটা সত্যিই খুব সুন্দর। এক গোছা গোলাপফুলের মতো। এটা ওই রোগা কচি মেয়েটাকে উপহার দিতে ভাল লাগবে তাঁর। ও খুব খুশি হবে। ওর মা নিশ্চয়ই আরও খুশি হবে। বস্তুর মূল্য বড়রা ছোটদের চেয়ে অনেক ভাল বোঝে।

দোকানি ভাল করে বাক্সের মধ্যে জামাটা ভরে প্যাক করে দিতে, সেটা হাতে নিয়ে বেরোবার সময়ে বিজু রায়ের হঠাৎ খেয়াল হল তিনি এখনও ভাবছেন এই ফ্রকটা উপহার পেয়ে মণিদীপিকা বেশি খুশি হবে না তার মা। সচেতন হবার পর তাঁর বড় লজ্জা হল একটি শিশুকে এই দামি ফ্রক উপহার দিতে গিয়ে এত চিন্তা তিনি করছেন কেন? এর চেয়েও দামি উপহার তাঁর ব্যবসা—বন্ধুদের ছেলে—মেয়ে বা নাতি—নাতনিকে দেবার সময়ে তো এ সব কথা মনে আসেনি! বিজু রায় আবিষ্কার করলেন তিনি মণিদীপিকা এবং তার মাকে দয়া করছেন। এবং সবচেয়ে খুশি হচ্ছে মণিদীপিকাও নয়, তার মা—ও নয়। তিনি নিজে। ওটা একটা সাড়ে তিনশো টাকা দামের ফ্রকের প্যাকেট নয়। তাঁর দম্ভের প্যাকেট। দম্ভটাকে সুন্দর মোড়কে সাজিয়ে গুছিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে তাকে চেনা না যায়। ব্যাপারটা আবিষ্কার করে তিনি বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। এবং এইরকম বিষণ্ণ হয়েই মণিদীপিকাদের বাড়ি ঢুকলেন।

বাড়িটার একতলায় একটা প্রেস। ময়লা, ঝুল, পানের পিকে ভর্তি একটা সরু প্যাসেজ পার হয়ে, একই রকম নোংরা সিঁড়ি। দোতলায় উঠে তিনি এদিক—ওদিক তাকাচ্ছেন, ডানদিকের একটা ঘরের কপাট খুলে মণিদীপিকার মা বেরিয়ে এল। —’আসুন কাকাবাবু এদিকে।’

রক্তহীন ফর্সা বউটি। সিঁথির সিঁদুরটা কপালেরও খানিকটা অবধি নেমে এসেছে। কপালে একটা সিঁদুরের টিপ। ডুবে শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটা, পানপাতার মতো মুখ, স্বাস্থ্যহীন এইরকম নারীরা এখনও, এ যুগেও আছে? বিজু রায়ের মনে হল তাঁকে যেন কে বা কারা ষড়যন্ত্র করে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনেক দিন আগে। এখন জানেন সেটা ছিল দুর্ভিক্ষের বছর, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। চারিদিকে, এ বাড়ি ও বাড়ি তিনি এইরকম নারী, অনেক এ রকম মা, দিদি, বউদি, মাসি—পিসিদের দেখেছিলেন। দলে দলে ভিখারি আসত। তাদের কঙ্কালের মতো চেহারা, মেয়েদের খোলা গায়ে ন্যাতানো মাছের পটকার মতো বুক, কোটরাগত চোখ পাঁজরাসার শিশু, মায়ের বুকের বোঁটা প্রাণপণে আঁকড়ে আছে। সেই হাহাকারের সামনে এইরকম শান্ত, নিরুপায়, অসুস্থ নারীরা, হাতে শাঁখা, ছেঁড়া কাপড়ের আঁচল মাথায় তুলে দিচ্ছে। এনামেলের কাঁসিতে করে ফ্যান ঢেলে দিচ্ছে। তিনি দেখেছেন। দেখেছিলেন। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলেন। এখন তিনি যেখানে ঘোরাফেরা করেন, সেখানে মেয়েরা টেনিস বল বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেলুন থেকে নিখুঁত করে তুলে আসে সমস্ত দাগ। টানা ভুরু, আঁকা চোখ, সাটিন—কোমল ত্বকের মেয়েরা সব—ট্রাউজার বা সালোয়ার কামিজ, কদাচিৎ শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ায়। এই রকম রং, ফর্সা হলেও সেখানে অচল, এই পানপাতা মুখ কেউ ফিরেও দেখবে না। কিন্তু বিজু দেখলেন। ভাবলেন দুর্ভিক্ষ এখনও আছে, রাজপথ ছেড়ে অন্ধগলিতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাই সহসা চোখে পড়ে না। তিনি ভেবেছিলেন বাঁধাঘাট থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে। এখন দেখলেন, না। তাঁর ধারণাটা ঠিক নয়। একেবারেই ঠিক নয়।

মণিদীপিকাও এবার কলকল করতে করতে বেরিয়ে এল। বলল,—’টঙদাদুর বন্ধু, এমন সময়ে এসেছে যে আমি নেলপালিশ পরছিলুম।’ তার কচি আঙুলের নখে লাল টুকটুকে ছোপ।

তার মা লজ্জা পেয়ে বললেন—’দেখুন না, এমন বায়না করে…’

বিজু তখন ফ্রকের বাক্স আর চকলেটের প্যাকেটগুলো তার হাতে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার মা চকলেটগুলো তার হাত থেকে নিয়ে নিল—’ওর ভীষণ কিরমি কাকাবাবু জানেন তো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রোজ যেন ফুটকড়াই চিবোবে।’

ফ্রকের বাক্সের ডালাটা খুলে বউটি অবাক হয়ে তাকাল। ভয়ে ভয়ে বলল—’এত দামি জামা এনেছেন…’

তার বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে বিজু বড় লজ্জা পেলেন। কোনও রকমে বললেন—’বেশি দামি নয় বউমা, ওটাই খুকুর জন্যে আমার পছন্দ হল।’

—’কিন্তু আমার পুতুল?’ মণিদীপিকা এবার গালে আঙুল রেখে বলল, ‘যাঃ পুতুলটা তো আনতে ভুলে গেছ! চলো না। এক্ষুনি চলো, ছাদ দিয়ে গিয়ে নিয়ে আসি। টানাতেই তো আছে!’

তার মা যথাসাধ্য বকুনি দিয়ে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করলেও সে কিছুতেই শুনল না। পাঁচিল টপকে বিজু রায়কে মেসবাড়ির ছাদে যেতে হল। চিলেকোঠার ঘরের তালাচাবি খুলে ড্রয়ার থেকে পুতুলটা বার করতে হল। আবার পাঁচিল টপকে এদিকে এলে, মণিদীপিকা কৈফিয়ত হিসেবে বলল—’পুতুলও যে আজ আমাদের সঙ্গে খাবে। ওরও তো আজ জন্মদিন..।’

ওই ঘরটিতেই আসন করে খেতে দিল বউটি। পাশাপাশি দুটি আসনে। তিনি আর মণিদীপিকা, আর মণিদীপিকার কোলে অবশ্যই তার পুতুল। একটা আধছেঁড়া ভালুক, তার গলায় লাল ফিতে এবং একটি কাঠের কুকুরও সঙ্গী হল, তাদের মণিদীপিকা, তার পাতের উল্টোদিকে সাজিয়ে রাখল।

বিজু রায় একটু ইতস্তত করে বললেন—’খুকুর বাবা? বাবা খাবেন না?’

বউটি সঙ্কোচের সঙ্গে বলল—’ ট্রেনে ট্রেনে ঘুরতে হয় তো, খুব সকালবেলাই চলে যেতে হয়।’

মণিদীপিকা বলল—’আমার বাবা রোজ ট্রেনে চড়ে জানো তো দাদু! বাবার কাছে ম্যাজিক ওষুধ থাকে, সব সেরে যায়।’

তার মা আরও সঙ্কোচের সঙ্গে বলল—’আপনি নলিনীকাকার কতদিনের বন্ধু কাকাবাবু, আগে কখনও আপনাকে দেখিনি তো!’

কিন্তু তার কথা বিজু রায় যেন শুনতে পাচ্ছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল নিতাইদা! নিতাইদার মতোই একজন কেউ তা হলে এই ছোট্ট খুকুটির বাবা! ভজহরি ভুজিয়াওয়ালার কাছে বসলে বাড়ির লোকে ঠিক ধরে ফেলবে। গৌরাঙ্গদা মুখে ‘না বলব না। না বলব না’ করলেও ঠিক বাড়িতে বলে দেবে বিজু স্কুল পালাচ্ছে। এদিকে ফাইনাল পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। মা আজকাল খিটখিটে হয়ে গেছে খুব, শুনলে ধরে পিটুনি দেবে। কিন্তু নিতাইদা বড় মাই ডিয়ার লোক। সপ্তাহে একদিন দুদিন চাটনি—লজেন্স বিককিরি করতে চাইলে উৎসাহই দেয়। এক একদিন আবার মুড থাকলে বলবে—’এই যে দেখছেন আমার ছোট্ট ভাইটি, নিজে লেখাপড়া শিখিনি, কষ্ট করছি, ভাইটাকে মানুষ করব বলে। বলুন দাদা, মানুষ হবে না ভাইটা আমার? পড়াশোনায় খুব মাথা!’ বিক্রি চট করে বেড়ে যেত। হয়তো ওদিক থেকে এক মহিলা এক ঠোঙা কিনলেন। এদিকের এক প্রৌঢ় অমনি গম্ভীরভাবে পকেট থেকে টাকা বার করতে করতে বলে উঠলেন—’দাও হে, আমাকেও দাও গোটা বারো।’ পরে সব বিকিয়ে গেলে কোনও একটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পাথরের বেঞ্চিতে বসে কচুরি আর ছোলার ডাল খেতে খেতে দুজনের কী হাসি! শেষকালে শালপাতার ঠোঙাটা জিভ দিয়ে চেটে ফেলে দিতে দিতে নিতাইদা বলত ‘জানিস তো পৃথিবীর সব বড় লোকেরাই ল্যাবেঞ্চুস চানাচুর বিককিরি করে বড় হয়েছে।’

বিজু ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, একটু সন্দেহাকুল হত—’লজেন্স না হয় সব দেশেই পাওয়া যায়। কিন্তু চানাচুর? সে তো পৃথিবীর সর্বত্র পাওয়া যায় না।’

নিতাইদা ঢোক গিলে বলত—’বলিস কী? চানাচুর পাওয়া যায় না এমন দেশও আছে? তাহলে ধর দাদের মলম, কিংবা খবরের কাগজ?….তুই বড় বড় লোকেদের লাইফ—হিস্টরি পড়, ধর সুভাষ বোস, কিম্বা মাউন্টবান্টেন…।’

বিজু বলত—’কী যে বলো নিতাইদা! সুভাষ বোস খুব বড়লোকের বাড়ির ছেলে, এলগিন রোডে ওঁদের বিরাট বাড়ি, আর মাউন্টব্যাটেন তো লর্ড, লর্ড মানে জমিদার!’

নিতাইদা এবার মাথা চুলকোচ্ছে। ‘কিন্তু আমি শুনেছি যে…’

বিজুই তখন আলোক দিত নিতাইকে—’মস্ত বড় বৈজ্ঞানিক এডিসন খবরের কাগজ বিক্রি করতেন এরকম গল্প আছে। এব্রাহাম লিংকন সম্পর্কেও বলে—”ফ্রম লগ কেবিন টু দা হোয়াইট হাউস”…’

নিতাইদা উৎসাহে খাড়া হয়ে যেত, বেঞ্চিতে চাপড় মেরে বলত—’তবে? তবে? বলিনি? তাই যদি না হবে তো ফ্রম
র‍্যাগস টু রিচেজ কথাটা কোত্থেকে এল বল তো! বলতে পারিস?’

বিজুর জীবনে যখন কথাটা সত্যি হয়েছিল, তখনই একমাত্র সে জেনেছিল র‍্যাগস আর রিচেজ—এর মাঝখানের ফাঁকটা কী দিয়ে ভরাট হয়। অন্তত সে কী দিয়ে ভরেছিল। নিতাইদার পাত্তা তখন নেই যে তাকে ওয়াকিবহাল করা যাবে এ বিষয়ে। অবশ্য পাত্তা পাওয়া গেলেও যে বিজু তাকে ঠিকঠাক চিনতে পারত তা নয়। একজন কর্মবীরের ব্যস্ত মধ্যাহ্নে অল্প বয়সের চানাচুর ফেরিঅলা দাদাকে চেনা গেলেও কি ঠিক সে ভাবে চেনা যায়? যে ভাবে তারকেশ্বরের প্ল্যাটফর্মে বেঞ্চে বসে চেনাশোনা হত? তখন নিতাইদাকে চেনা হত একজন হ্যাংলা—চেহারার ভিখারিসদৃশ নিতাই পাল বলে, যার চোখে বিজু রায়ের প্রতি সম্ভ্রম দৃষ্টি। ‘র‍্যাগস টু রিচেজ’—এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ সে চাক্ষুস করছে। এইরকমই কিছু একটা হত। গৌরাঙ্গদার ক্ষেত্রে তাই—ই হয়েছিল। তিনি একেবারেই চিনতে পারেননি গৌরাঙ্গদাকে। ময়লা জামাকাপড়, একমুখ কাঁচা পাকা দাড়ি, চোখে মোটা পাওয়ারের নিকেল ফ্রেমের চশমা। কী করে চিনবেন। টেবিলের ওধারে ওই আর এধারে সাদা ধ্বধবে শার্ট। হালকা ব্রাউন ট্রাউজার্স। চুল থেকে ক্রিমের চেকনাই দিচ্ছে। চোখের সামনে প্রভাবশালী পুরুষ মহিলাদের মুখ সব সময়ে। গৌরাঙ্গদা কিছুক্ষণ পর ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠল—’চিনতে পারলি না তো?’ ‘তুই’ শুনে অদূরে বসা সেক্রেটারি ভুরু কুঁচকে তাকাল। গৌরাঙ্গদা বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে পেছন ফিরে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল। আরও মিনিটখানেক পর মাথার মধ্যে ফ্লিক করল। গৌরাঙ্গ দাস, গৌরাঙ্গদা ছাতুবাবুর ঘাট, গঙ্গায় ঝাঁপাই। রামসীতার মন্দিরের চাতালে গেঁজেল বলু ঠাকুর। ওঃ সে কি এ জন্মের কথা। যে মনে থাকবে?

বউটি তার কথার জবাব না পেয়ে খুব অপ্রস্তুত হয়েছে। না জানি সে কী গর্হিত কথা জিজ্ঞেস করে ফেলেছে। এই ভদ্রলোককে দেখলেই বোঝা যায় বড় বনেদি ঘরের মানুষ। রুপোলি জিনিস প্রচুর থাকার চাকচিক্য সর্বাঙ্গে। নলিনী করও বনেদি ছিলেন। কিন্তু এই রুপোলি চাকচিক্য তাঁর ছিল না। সন্দেহ নেই, নলিনীকাকার এ রকম বন্ধু থাকতেই পারে। সে তাড়াতাড়ি উঠে নতুন গুড়ের পায়েস নিয়ে এল।

বিজু বললেন—’আমি এত খাব না বউমা, একটু কমিয়ে দাও। আমার আবার ব্লাড শুগার আছে কি না।’

মণিদীপিকা বলল—’টঙদাদুরও তো ডাক্তারের বারণ। তা—ও খায়। লাল পায়েস খেতে টঙ দাদু ভীষণ ভালবাসে।

তার মায়ের দিকে একবার চাইলেন বিজু রায়, সে মৃদুস্বরে বলল—’অনেক কিছুই বারণ ছিল, শুনতেন না, গেরাহ্যি করতেন না কিছুকে।…’ বলতে বলতে তার গলা ধরে এল।

খাওয়াদাওয়ার শেষে খুকুকে আদর করে তিনি বেরিয়ে এলেন—দিদির মৃত্যুসংবাদ ও শ্রাদ্ধের খবরটা কোনও কাগজে দিতে হবে। কাছাকাছি যে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন কাউন্টার থাকবে সেখানেই দেবেন। তারপরে একবার সুখচর যেতে হবে।

খান্না সিনেমার কাছ থেকে বাস ধরলেন বিজু রায়। আটাত্তর নম্বর। প্রথম যেদিন যান, ট্রেনেই গিয়েছিলেন। মুখ লুকিয়ে। সোদপুরে নেমে অনেকটা রাস্তা রিকশায় যেতে হয়। দিদির অসুখ, দিদিকে আনা—নেওয়া, খবরাখবর ইত্যাদি তাড়াতাড়ির সময়ে ট্যাকসি, কখনও অ্যাম্বুলেন্স। আজকে কী রকম সংকোচ হল। মণিদীপিকাদের বাড়ি থেকে আসার পরই কি? চারিদিকে পিলপিল করছে মানুষের ভিড়। গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে সব শীতেও। মহিলারা অদ্ভুত দৃশ্য সৃষ্টি করে দৌড়চ্ছেন। জীবনে কখনও খেলার মাঠে দৌড়ননি এঁরা। মাঝবয়সে এসে বাস ধরতে দৌড়চ্ছেন। এমন চমৎকার শরীর—স্বাস্থ্য নিয়ে বিজু রায় কেমন করে বাস এড়াবেন?

দিদির বাড়ি পৌঁছে দেখলেন সদর দরজায় তালা মারা। খুব ঘটা করে। তিনি জানেন খিড়কির দিকে খোলা আছে। কিন্তু সেখান দিয়ে চোরের মতো ঢোকায় তাঁর মত হল না। শাঁটুল তাহলে এখনও যায়নি? অথচ রত্নাকে তিনি কাল স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন এ বাড়িতেই শ্রাদ্ধ হবে। শাঁটুলকে অতএব অন্য কোনও জায়গা খুঁজে নিতে হবে আপাতত। তিনি বিরক্ত হয়ে ফিরছেন, এমন সময়ে চাপা মেয়ে—গলায় ডাক শুনলেন—’মামাবাবু।’ জানলা ফাঁক করে রত্না ডাকছে—’আপনি যাবেন না। ওদিকে দরজা খুলে রেখেছি, আসুন।’ রত্নার গলায় ভীষণ আর্তি। অগত্যা, ইচ্ছে না থাকলেও, এবং ভেতরে ভেতরে রাগ হলেও বিজু বাড়িটাকে পরিক্রমা করতে আরম্ভ করলেন। বেশ বড় বাড়ি। অন্ততপক্ষে সাত কাঠার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে তৈরি হয়েছে। বাইরেও বাগানের অংশে পাঁচ ছ কাঠার মতো হবে। বাড়িটার সমস্ত অঙ্গ থেকে গাছপালা বেরিয়েছে। বাগানও জঙ্গল। পেছনের দিকের দরজাতেও তালা মারা। একটা ছোট্ট দরজা ফাঁক করে রত্না দাঁড়িয়ে আছে। ঢুকতে ঢুকতে বিজু বুঝলেন এটা জমাদার যাওয়া—আসার পথ। তিনি নাকে রুমাল দিলেন। রত্না বলল—’মামাবাবু, আর কোনও উপায় ছিল না, আপনি দয়া করে কিছু মনে করবেন না।’ বিজু উত্তর দিলেন না। রত্নার পরনে কোরা লাল পাড় শাড়ি। চুল রুক্ষ। সে অশৌচ পালন করছে। কলঘরের ভেতর দিয়ে উঠোনে এসে পৌঁছলেন তিনি। নাক থেকে রুমাল সরিয়ে বললেন—’এরকম দিন—দুপুরে খিড়কি দিয়ে যাতায়াত করলে তো লোকে টের পাবেই। তখন!’

রত্না বলল—’আমি যে হররোজ আসিই বাড়ি সাফা করতে আশে—পাশে সবাই জানে। এতটা বাগান চট করে ভেতরে লোকের নজরও পড়ে না।’

বিজু বললেন—’ওটা তোমার মনে হওয়া। যাক গে। শাঁটুলকে কি এখনও অন্যত্র সরাতে পারোনি?’

রত্না কিছু না বলে একটা ঘরের দরজা খুলে ধরল। ভেতরে একটা পুরনো পালঙ্কে কেউ শুয়ে আছে মনে হল। তিনি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন রত্নার দিকে। সে মৃদু গলায় বলল—’বুখার খুব।’

চটি খুলে ভেতরে ঢুকলেন বিজু। পালঙ্কের বিছানায় একটি যুবক। তারও পরনে থান, গলায় কাছা। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর বাকরোধ হয়ে গেল। কথায় বলে নরাণাং মাতুলক্রম। কিন্তু সেটা এতদিন কথার কথা বলেই মনে করেছিলেন তিনি। এ যুবকটিকে কিন্তু যে কেউ দেখলে বলবে—এ তাঁর ছোট ভাই। ওই একইরকম ঢেউ খেলানো একরাশ চুল। তাঁর মাজা রং, এখন রুপোর উজ্জ্বলতা পেয়েছে। এ ছেলেটি শ্যামবর্ণ। জ্বরের জন্য লালচে দেখাচ্ছে মুখটা। তাঁরই মতো কপাল। ঠোঁটের ঢেউ। বিজু রায়ের ভয় হল শাঁটুল চোখ খুললে, তাঁর কি নিজেরই সঙ্গে চোখাচোখি হবে? নিজের যৌবনের সঙ্গে? শাঁটুলের চুলে অল্প পাক ধরেছে। দু—চারটে করে সাদা চুল তার অজস্র এলোমেলো চুলের মধ্যে। তিনি কপালে হাত রাখলেন। শাঁটুল একটু শিউরে উঠল। জাগল না। বেশ ভালরকম জ্বর। রত্না বলল—’রোজ বুখার হচ্ছে বলেই নাকি এখানে এসেছিল, আমায় বলেনি কিছু। এখন বলুন এই বিমার লোককে কী করে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলি!’

—’না, না, তা তো হয় না’ বিজু বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন। বাইরে বেরিয়ে এলেন—’চিকিৎসার কিছু হয়েছে?’

—’কী করে হবে? ডাক্তার ডাকতে পারছি না। জ্বর কমার দাওয়া দিয়ে যাচ্ছি। দুটো করে। যখন দিই ঘাম দিয়ে দু ডিগ্রি বসে যায়। আবার ওঠে চড়বড় করে।

বিজু রায় নিরুত্তর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর রত্না বলল—’আমরা আপনাকে খুব, মানে আপনি খুব পরেশান হচ্ছেন আমাদের জন্যে।’

বিজু রায় ভাবনায় মগ্ন ছিলেন, কথাগুলো তাঁর কানে ঢুকলেও মাথায় কোনও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল না। একটু পরে তিনি বললেন—’সিমটমগুলো চট করে বলো তো। সর্দি—কাশি আছে?’

—’না, একদম না।’

—’জ্বরটা বাড়ে কখন?’

—’বেলার দিকে। সকালে কম থাকে।’

—’আর কিছু?’

—’খেতে চায় না। পেটটা ভারী।’

—জ্বরটা একবার দেখো তো। ‘রত্না জ্বর নিয়ে বলল—’চার ছাড়িয়ে যাচ্ছে।’

—’বলো কী? শিগগিরই মাথা ধোয়াও। আমি সাহায্য করব?’

—’না, না। একটা বড় কেতলি আছে, আমি ধুয়ে দিচ্ছি।’

—’এখানে কাছাকাছি কোথাও ফোন বুথ আছে?’

—’বেরিয়ে ডানদিকে বেঁকলে যে রাস্তায় পড়বেন, ওখানে একটা বড় দোকান আছে। ওদের ফোন আছে। বড় একটা ব্যবহার করতে দেয় না।’

বিজু বেরিয়ে গেলেন।

অগতির গতি ডক্টর পি. চ্যাটার্জি। লক্ষণাদি শুনে বললেন—’কোথা থেকে বলছেন?’

—’সুখচর।’

—’ও আপনার দিদির বাড়ি?’

—’হ্যাঁ, ওর ছেলে; আমার ভাগ্নেরই অসুখটা।’

—’ও আচ্ছা। এনটারিক মনে হচ্ছে। ওষুধগুলো বলছি লিখে নিন।’

লিখে নিয়ে বিজু বলে—’প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেবে?’

ফোনের মধ্যে হাসলেন ডাক্তার, বললেন—’চেনা লোককে দিয়ে দেয়। নেহাত না দিলে ফোনে আমার সঙ্গে একটা যোগাযোগ করিয়ে দেবেন।’

বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন রোগীর মাথা ধোয়ানো শেষ। সে উঠে বসে মিছরির শরবত জাতীয় কিছু একটা খাচ্ছে। তিনি রত্নাকে কাগজটা দিয়ে বললেন—’তোমার চেনা দোকান থেকে নিয়ে এসো। সেরকম চেনা দোকান আছে তো?’

—’হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি আমার নিজের পাড়া থেকে আনছি।’ বিজু টাকা বার করতে যাচ্ছিলেন, রত্না বলল—আমার কাছে আছে। আপনি তো বহোত দিয়েছিলেন। কিছুই বিশেষ খরচ হয়নি।’ সে একরকম দৌড়ে চলে গেল।

ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে রোগীর সামনে বসলেন বিজু রায়।

শরবতটা খাওয়া হয়ে গেলে গ্লাসটার জন্য হাত বাড়ালেন।

ক্ষীণ গলায় শাঁটুল বলল—’আপনি কে? ডাক্তারবাবু?’ রত্না তাহলে ইতিমধ্যে একে কিছুই বলেনি। তিনি বললেন—’শমিত, আমি তোমার ছোট মামা।’

শাঁটুল যেন একটা শক খেল। চোখ তুলে বিজুর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকাল। তারপর চোখ নামিয়ে নিল। বড় বড় পল্লব ঘেরা নিষ্পাপ চোখ। এত বড় ছেলের এমন চোখ বিজু বহুদিন দেখেননি। এ চোখ শাঁটুল কোথায় পেল? এ তো তাঁর চোখ নয়? এরকম মেয়েলি, মায়াবী চোখ। কোথায় দেখেছিলেন এমন চোখ? বিজুর ভেতরটা কেমন করতে লাগল। এই ছেলে লোক ঠকিয়ে খায়? জোচ্চোর?

শাঁটুল হঠাৎ বলল—’আপনি কি আমার পুলিশে ধরিয়ে দেবেন?’

—’এখন তুমি অসুস্থ। এসব কথা থাক শমিত।’

—’না। থাকবে না। সুস্থ হবার পর? তখন নিশ্চয়ই…’

—’এত যদি ভয় পাও তো গোলমেলে কাজ করেছিলে কেন?’

—’বিশ্বসুদ্ধুলোক দু নম্বরি করে খাচ্ছে! আর আমি করলেই কেচ্ছা। আপনিই বলুন।’

বিজু সামান্য হেসে বললেন—’সবাই সব পারে না শমিত। এটা তোমাকে স্বীকার করতেই হবে। যে পারে সে পেরে যাচ্ছে। তার কথা আমি বলতে পারব না। কিন্তু তুমি যদি অন্ধকারের জগতে চলে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে চাও, বেঁচে বর্তে থাকতে চাও একজন সাধারণ সুখী মানুষের মতো তাহলে আমি তোমাকে পরামর্শ দিতে, সাহায্য করতে রাজি আছি।’

শাঁটুল আবার তাঁর দিকে তাকাল। সেই চোখ, সেই দৃষ্টি। এতদিন, দিদির বাড়ি আসার দিন থেকে বিজু রায় ভাবছেন। ক্রমাগত ভেবে চলেছেন কী করবেন, কী করা উচিত। ঠগ জোচ্চোরের হাজতবাসই ভাল। যারা মনে করে দুনিয়ার সব পয়সাওয়ালা লোক অসদুপায়ে উপার্জন করেছে, তাদের শিক্ষা হওয়া ভাল। এমন ভেবেছিলেন। ভেবেছিলেন যে ভাগ্নে মামার সম্পর্কে অতি নীচ ধারণা পোষণ করে, আবার বিপদে পড়ে সেই মামার কাছ থেকেই লাখেরও বেশি টাকা এবং আনুষাঙ্গিক নানা সাহায্য চায়, যে সবের তলায় একটা চতুর, ঠগ মন কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি অনায়াসে চিনতে পেরেছিলেন, সেই ভাগ্নেকে কোনওরকম সাহায্য করতে গিয়ে তিনি বিপদে পড়ে যেতে পারেন। হঠাৎ এই চোখ এই দৃষ্টি তাঁকে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করল, সাহায্য নয়, বরং বলা চলে পৌঁছে দিল। সিদ্ধান্তও নয়, সংকল্পে।

তিনি আবারও বললেন—’রত্নার কাছে তুমি যে ব্যাপারটা সাজেস্ট করেছ, সেটাতে আমি রাজি আছি। অবশ্য আমার নিজেরও কিছু শর্ত থাকবে।’ তিনি চুপ করে রইলেন। একটু পরে শাঁটুল বলল—’বলুন কী বলবেন।’

—’তুমি লোকগুলির নাম ঠিকানা আমায় দাও। কে কত পায় তার একটা হিসেব দাও। আমি তোমার ওপর থেকে ওয়ারেন্ট তুলে নেবার ব্যবস্থা করছি।’

—’তারপর?’

—’তারপর, ওই টাকাটা আমি তোমার হয়ে দিয়েও দেব, এই বাড়ির এগেনস্টে। মানে বাড়িটা ধরো আমার কাছে বন্ধক থাকবে।’

—’সে কী, বারো কাঠার বাড়ি আপনি নিয়ে নেবেন এই এক—দেড় লাখ টাকা দিয়ে?’

—’নিয়ে নেব তা তো বলি নি শমিত।’

—’কিন্তু আমি ওই টাকা শোধ করব কী করে। শোধ করতে না পারলেই…’

—’শোনো, তোমার দিদিদের কাছ থেকে ”এ বাড়ির ভাগ তাদের চাই না” এই মর্মে কিছু সই—সাবুদ দরকার। তারপর এ বাড়িটা তুমি প্রোমোট করবে। মানে আমিই করব, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। যতটা আমরা তুলতে অনুমতি পাব, তার তেত্রিশ পার্সেন্ট কি ধরো চল্লিশ পার্সেন্ট তুমি পাবে। তোমার দিদিরা ভাগ ছাড়তে না চাইলে, ওই তোমার চল্লিশ পার্সেন্টের ভেতর থেকেই তাদের দিতে হবে। বাড়িটা আউটরাইট সেল করে দিলে যা পাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি আসবে এই প্রোমোটিং অ্যান্ড ডেভেলপিং থেকে।’

এই সময় রত্না এসে ঢুকল। সে ওষুধগুলো পেয়েছে। তবে দোকানি বোধহয় কিছু সন্দেহ করেছে। সে ভীষণ উত্তেজিতভাবে বলল। জ্বরের লালের তলায় তলায় শাঁটুল ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে শুয়ে পড়ল।

বিজু রায় বললেন—’জল নিয়ে এসো বউমা, ওষুধগুলো এক্ষুনি পড়া দরকার।’

ওষুধ খেয়ে শাঁটুল বলল, ‘আমার ভীষণ শীত করছে। এখুনি কিছু একটা করুন মামাবাবু। আমাকে…আমি…কিছুতেই জেলে যাব না…তার আগে বরং ঝুলে পড়ব…।’

রত্না ধমক দিয়ে বলল—’কী বাজে—আজে বকছ। মামাবাবু কীভাবে মার জন্যে করেছেন, জানো? আমাদের এ কদিন দেখভাল স—ব।’

—’আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না, যা হয় করুন। যা হয় করুন, যদি ঠকিয়ে নিতে ইচ্ছে হয় এ বাড়িতো তাই নিন, কিন্তু আমায় জেলের হাত থেকে বাঁচান।

শমিত ভীষণ উত্তেজিত গলায় কথাগুলো বলল।

রত্না বলল—’ওর মাথা ঠিক নেই, মামাবাবু, দয়া করে মনে করবেন না কিছু।’

বিজু রায় বললেন—’তুমি ঠগ বলে আমিও ঠগ হবোই এরকম ধারণা করে তুমি যদি কোনওরকম বিকৃত আনন্দ পেতে চাও শমিত, আমি বাধা দোব না। তবে তার আগে আমার আরও কিছু জানা দরকার। অনেক টাকা পাবে, এ বাড়ি প্রোমোট করলে, অত টাকা দিয়ে কী করবে?’

—’টাকাটাই তো আমাদের আসল প্রবলেম’, রত্না বলল। ‘টাকা পেলে সবটা ঠিক হয়ে যাবে।’

—’না, ঠিক হবে না। শমিতকে বলতে দাও। সে কী করবে। বসে বসেও খাওয়া যায় ওই টাকাতে। কিন্তু একটা সুস্থ সবল পুরুষ মানুষ তো ঠিক বসে বসে খেয়ে সুখী হতে পারে না।’

—’ব্যবসা করব’, অসুখে ক্ষীণ শাঁটুলের গলা থেকে শব্দ বার হল।

—’ব্যবসা তো আগেও করেছ, সফল হয়েছ একবারও?’

শাঁটুল চুপ করে রইল। বিজু রায় বললেন—’এই মুহূর্তে আমি ভেবে ঠিকঠাক করতে পারছি না। শিগগিরই তোমার একটা ব্যবস্থা করব। সেই ব্যবস্থা তোমাকে মেনে নিতে হবে। হাতে একগাদা টাকা পাবে আর সেগুলো যা—তা করে উড়িয়ে দেবে সে হবে না। যদি রাজি থাকো তো এগোব, নইলে…থাক।’

রত্না বলল—’বলে দাও, বলে দাও, দের করছ কেন? বললাম না ওষুধের দোকানে সন্দেহ করছে।’

বিজু রায় বললেন—’প্রেশার দিয়ো না বউমা। ওকে শান্তমনে ঠিক করতে দাও সব। ইতিমধ্যে যদি পুলিশ আসে, সে না না হয় আমি অ্যান্টিসিপেটরি বেলের বন্দোবস্ত করছি।’

—’না, না’, শমিত এবার প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল। ‘একবার থানা—পুলিশের দাগ লাগলে জীবনে কখনও মাথা তুলতে পারব না। কোনও কাজ করতে পারব না। মামাবাবু যা হয় করুন। খালি…খালি…’

বিজু রায় আস্তে বললেন—’শোনো শমিত। জীবনে কখনও কখনও এমন সময় আসে যে কাউকে নিঃশর্তে বিশ্বাস করতে হয়, করতেই হয়। আমাকে আমমোক্তারনামা মানে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিতে হবে তোমায়, আমি এক্ষুনি উকিলের ব্যবস্থা করছি। নাম আর অ্যামাউন্টগুলো চটপট দুজনে মিলে একটা লিস্ট তৈরি করে ফেল।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *