বীর্যবান

বীর্যবান

সোনার থালায় গরম ভাত আর পঞ্চব্যঞ্জন-মিষ্টান্ন সহযোগে মধ্যাহ্ন ভোজন করতে বসেছিলেন বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন। ভাত মেখে সবে তিনি মুখে তুলতে যাবেন, ঠিক সেই সময় মহামন্ত্রী, সেনাপতিসহ কয়েকজন ব্রাহ্মণ হুড়মুড় করে প্রবেশ করলেন ভোজনকক্ষে। মহামন্ত্রী বঙ্গেশ্বরকে বললেন, ‘চলুন, মহারাজ চলুন। মিনারের মাথার প্রহরীরা ওদের দেখতে পেয়েছে। ওরা দ্রুত প্রাসাদের দিকে এগিয়ে আসছে! ঘোড়সওয়ার তুর্কিবাহিনী, বক্তিয়ারের যবনবাহিনী…।’

ব্রাহ্মণ আর গুপ্তচরের দল আগেই তুর্কি হানার খবরটা বঙ্গেশ্বরকে দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন কথাটা বিশ্বাস হয়নি মহারাজের। কোথায় সেই পাহাড়-মরুভূমির দেশ তুর্কিস্তান। আর কোথায় এই আম-কাঁঠালের ছায়া ঘেরা বাংলার রাজধানী নবদ্বীপ। অতদূর থেকে এখানে আসা সম্ভব নাকি?’

মহামন্ত্রীর কথা শুনে বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন বললেন, ‘ঠিক বলছ? কতজন লোক তারা?’

মহামন্ত্রী বললেন, ‘সংখ্যায় তারা সতেরো জন অশ্বারোহী। নগরীর উপকণ্ঠে গতকাল রাতে তারা অশ্বব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে রাত কাটিয়েছিল।’

কথাটা শুনে লক্ষ্মণ সেন বললেন, ‘মাত্র সতেরো জন অশ্বারোহীর ভয়ে আমাকে প্রাসাদ ত্যাগ করতে হবে? মাত্র সতেরো জন তুর্কি বঙ্গ জয় করবে? ওই সতেরো জন তুর্কিকে পরাস্ত করার মতো সেনা কি নেই আমার?’

সেনাপতি বললেন, ‘ওই সতেরো জন তুর্কিকে আমরা পরাস্ত করতে পারি ঠিকই, কিন্তু ওটা কেবল তাদের অগ্রবর্তী বাহিনী। অমনি বহু ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছুটে আসছে চারদিক থেকে। একের পর এক সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এসে তারা আছড়ে পড়বে রাজধানীতে, এই প্রাসাদে। তাদের প্রতিহত করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।’

কথাটা শুনে ভাতের গ্রাম ধরা মহারাজার স্বর্ণাঙ্গুরীয় শোভিত শীর্ণ আঙুলগুলো ধীরে ধীরে তার মুখ থেকে নেমে এল। ফ্যাল ফ্যাল করে মহামন্ত্রী আর সেনাপতির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি।

মহামন্ত্রী তাগাদা দিলেন, ‘চলুন মহারাজ চলুন!’

বাংলার রাজা অস্পষ্ট ভাবে বললেন, ‘সত্যিই যেতে হবে? কিন্তু আমার রানিরা, নতুন যাদের রানি করার কথা তারা সবাই সঙ্গে যাবে তো?’

সেনাপতি বললেন, ‘অত লোক নৌকায় ধরবে না। তাদের সঙ্গে নেবার আয়োজন করার মতো সময়ও হাতে নেই। ওই তুর্কি অশ্বগুলো শয়তানের চেয়ে দ্রুতগামী।’

বাংলার রাজা হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঠিক সেই সময় খোলা গবাক্ষ বেয়ে বাইরে থেকে নজর-মিনারে দাঁড়ানো সৈনিকের চিৎকার ভেসে এল, ‘তুর্কিরা এসে গেছে! এসে গেছে! পরিখা ডিঙোচ্ছে ওরা!’

আর দেরি করা যাবে না। বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেনকে প্রায় পাঁজাকোলা করে উঠিয়ে নিয়ে মহামন্ত্রী, সেনাপতি আরও কয়েকজন প্রাসাদ ছেড়ে সুড়ঙ্গ পথে এগোলেন গঙ্গাবক্ষের দিকে। পড়ে রইল তার সাধের রাজধানী, অগুনতি পত্নী-উপপত্নী।

কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তক ছিলেন পিতা বল্লাল সেন। পিতৃধর্ম শিরোধার্য করে ‘আপনি আচরি ধর্ম’ অন্যকে শেখাতে ব্রতী হয়েছিলেন লক্ষ্মণ সেনও। নইলে এই সত্তর বছর বয়সে আবার তার দার পরিগ্রহণের বাসনা হয়? যে কারণে নগরীতে এক উদ্যান শোভিত প্রমোদ প্রাসাদে ইরাবতীও রয়ে গেল।

প্রথম যখন ইরাবতীর কানে খবরটা পৌঁছেছিল তখন ইরাবতী তা শুনে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল এই ভেবে যে এবার তার মুক্তি আসন্ন। সে মিলিত হবে চিত্রসেনের সঙ্গে। চিত্রসেন অবশ্য তাকে কথা দিয়েছিল যে মহারাজের সঙ্গে বিবাহ সম্পন্ন হবার পূর্বেই তাকে মুক্ত করে দূরদেশে চলে যাবে। তাকে আর সেই অপহরণের দায় মাথায় নিতে হবে না।

কিন্তু ইরাবতীর জানা ছিল না যে সিংহাসন বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজার তোষাখানার ধন-সম্পদ-রত্নরাজির মতো নারী রত্নেরও হাতবদল হয় নতুন শাসকের হাতে। ইরাবতী এখন তুর্কিদের সম্পত্তি।

লক্ষ্মণ সেনের এই উদ্যানপ্রাসাদে রক্ষীর প্রহরা থাকলেও সে প্রহরীরা ছিল চিত্রসেনের অনুগত। চিত্রসেনকে বেগ পেতে হত না তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে। কিন্তু এখন তুর্কিদের প্রহরা বসেছে এই উদ্যানবাটিতে। তাদের চোখ এড়িয়ে একটা মাছিরও অন্তঃপুরে প্রবেশ করার ক্ষমতা নেই। কেউ কেউ বলছে যে বক্তিয়ার নাকি ইরাবতীদের মতো নারীদের নিয়ে যাবে সুদূর তুর্কি মুলুকে।

খবরটা কি জানে চিত্রসেন? ইরাবতীর জানা নেই সে কথা।

মাসাধিক কাল আগে তুর্কিরা যখন রাজধানীর দখল নিল তারপর থেকে এই উদ্যানবাটির দ্বিতল অলিন্দ থেকে নীচে তাকিয়ে আর কোনওদিন সে দেখতে পায়নি সৈন্যাধক্ষ চিত্রসেনকে। বীর্যবান চিত্রসেনের অধীনস্থ রক্ষীরাই প্রাসাদের রক্ষী ছিল। তাদের কেউ আজ নেই একজন ছাড়া। সেই সৈনিক শুধু প্রাসাদের বাইরে প্রহরার কাজে নিযুক্ত।

ইরাবতী এক-একবার ভাবে সে অলিন্দে দাঁড়িয়ে ডাকবে সেই যুবক সৈনিককে। হয়তো সে সৈনিক ইরাবতীকে খোঁজ দিতে পারে চিত্রসেনের! ইরাবতী প্রাসাদের ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়ালেই সে তাকিয়ে থাকে ইরাবতীর দিকে। এক-একসময় ইরাবতীর মনে হয় ওই যুবক সৈনিক বন্দিনীর দিকে ওভাবে চেয়ে থাকে কেন? সে কি ইরাবতীর প্রেমে পড়েছে?—এ প্রশ্নের উত্তরও জানা নেই ইরাবতীর।

আর ওই যুবক তো সামান্য সৈনিক মাত্র। স্বয়ং বাংলার অধিপতি যেখানে রাজধানী ত্যাগ করেছেন তুর্কিদের ভয়ে, চিত্রসেনের মতো বীর্যবানেরও কোনও খোঁজ নেই, সেখানে কি ওই সামান্য সৈনিক মুক্ত করতে পারবে তাকে তার এই বন্দীদশা থেকে?

সেদিন দ্বিপ্রহরে ঝুলবারান্দা সংলগ্ন দ্বিতল কক্ষে বসে ইরাবতী ভাবছিল তার ভবিষ্যতের কথা। কী আছে তার কপালে? তাকে কি শেষ পর্যন্ত চলে যেতে হবে তুর্কিস্থানের কোনও হারেমে? এ জীবনে কি তার মুক্তি নেই? তার কি আর কোনওদিন দেখা হবে না চিত্রসেনের সঙ্গে? সে কি মুক্ত করে নিয়ে যেতে পারবে না তার প্রেমিকাকে? তুর্কি হারেমের বন্দিনী হবার চেয়ে তো তার ভালো ছিল বৃদ্ধ রাজার মহিষী হওয়া। এ সব কথা ভাবতে ভাবতে তার চোখ বেয়ে জল নামতে শুরু করল।

নিভৃত কক্ষে বসে কাঁদছিল ইরাবতী। তার কক্ষে একটা ছোট গবাক্ষ আছে। তা দিয়ে নীচের বাগিচার কিয়দংশ দেখা যায়। কাঁদতে কাঁদতে সেদিকে চোখ পড়তেই ইরাবতী দেখতে পেল সেই সৈনিক বাগিচায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে কক্ষ সংলগ্ন বারান্দার দিকে। হয়তো সে তাকিয়ে আছে ইরাবতীকে দর্শনের প্রত্যাশাতেই।

তাকে দেখেই ইরাবতীর হঠাৎ মনে হল, ‘আচ্ছা যদি ওই রক্ষীর সত্যি খোঁজ জানা থাকে চিত্রসেনের? যদি চিত্রসেনকে তার মাধ্যমে কোনও পত্র পাঠানো যায়?

বাঁচার একটা শেষ চেষ্টা তাকে করতেই হবে। একটা ঝুঁকি তাকে নিতেই হবে। হ্যাঁ, সে একটা পত্র পাঠাবার চেষ্টা করবে চিত্রসেনকে ওই রক্ষীর মাধ্যমে। কিন্তু কীভাবে সে পত্র লিখবে? তার কাছে তো কাগজকলম নেই।

কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পত্র লেখার একটা উপায় বার করে নিল ইরাবতী। তার কাজল আছে। তার সাদা কাঁচুলির একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে তাতে কাজল দিয়ে পত্র লিখতে বসল ইরাবতী।

অন্য দিনের মতো এদিনও দ্বিপ্রহরে উদ্যান প্রাসাদে প্রহরার কাজে নিযুক্ত হল সৈনিক অভিমন্যু। নির্জন দুপুর। কোথাও কোনও শব্দ নেই। বাগানে যে ময়ূরকুল ছিল তাদের মেরে খেয়েছে তুর্কি সেনারা। শ্বেত পাথরের ফোয়ারাগুলোও এখন শুষ্ক। আশেপাশের গাছগুলোতেও পরিচর্যার অভাবে আর ফুল ফোটে না। রুক্ষদেশের মানুষ ওই তুর্কিগুলো, প্রকৃতিগতভাবে তারাও রুক্ষ। চারপাশের রুক্ষতা-বিষণ্ণতার মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদ আর ওই ঝুলবারান্দাটা।

ওই অলিন্দটার জন্যই এ প্রাসাদ ছেড়ে যেতে পারেনি অভিমন্যু। অভিমন্যু প্রথমে ও-প্রাসাদে প্রহরার কাজে নিযুক্ত হয়েছিল রক্ষীপতি চিত্রসেনের যে ক্ষুদ্র সেনাদল ছিল তার সদস্য হিসাবে। তারপর রাজা লক্ষ্মণ সেন যখন নগরী ছেড়ে পালালেন তখন তাঁর সেনাদল ভেঙে গেল। কেউ লক্ষ্মণ সেনের পথ অনুসরণ করল, কেউ বা আবার আত্মগোপন করল গঙ্গার অপর প্রান্তে। চিত্রসেনও আত্মগোপন করে আছেন সেখানে। কিন্তু অভিমন্যু ত্যাগ করতে পারেনি নবদ্বীপ। পারেনি ওই অলিন্দের জন্যই। প্রতিদিন যে সে সূর্যাস্তের সময় ওই অলিন্দে এসে দাঁড়ায়।

অভিমন্যুর কোনওদিন তার সঙ্গে বাক্যালাপ হয়নি। কিন্তু তাকে দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই তাকে ভালোবেসে ফেলেছে সৈনিক অভিমন্যু। সে জন্যই তো নবদ্বীপ ত্যাগ করা হল না তার।

তুর্কিরা বাংলা রাজধানী দখল ক’রার পর কদিন ভয়ংকর ছিল নবদ্বীপের পরিস্থিতি। লুঠপাট চলল, আগুন লাগানো হল কিছু জায়গায়, মারাও পড়ল কিছু লোকজন। তারপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হল। সামান্য কিছু লোকজন দিয়ে তো আর এতবড় নগরী শাসন করা যাবে না। তাই তুর্কি সেনাপতি বক্তিয়ারের লোকেরা নগরীতে ঢেঁড়া পিটিয়ে জানাল যে স্থানীয় কিছু লোকজনকে নেওয়া হবে তাদের কাজে। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই অভিমন্যু নাম লেখায় তুর্কি রক্ষীদলে। আবার সে নিযুক্ত হল এই উদ্যান প্রাসাদে প্রহরীর কাজে।

তবে প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি তার নেই। রাজাপ্রাসাদসহ লক্ষ্মণ সেনের কোনও প্রাসাদেই প্রবেশ করার অনুমতি নেই স্থানীয় লোকদের। তাদের কাজে নিলেও তুর্কিরা অবিশ্বাস করে স্থানীয় বাঙালিদের। প্রাসাদের দ্বার আগলে তলোয়ার হাতে দণ্ডায়মান থাকে তুর্কিরাই।

কোনও এক প্রাসাদে তাদের অজান্তে নাকি প্রবেশ করেছিল এক বাঙালি। ধরা পড়ার পর সঙ্গে সঙ্গে তার মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। এই শাস্তিবিধানের নির্দেশই দিয়ে রেখেছেন সেনাপতি বক্তিয়ার।

বাগিচায় দাঁড়িয়ে অন্যদিনের মতো সেই বারান্দার দিকে তাকিয়ে ছিল অভিমন্যু। কখন ইরাবতী বাইরে বেরোবে তার প্রতীক্ষায়। এক সময় ধীরে ধীরে বেলা পড়ে এল। তারপর সূর্যাস্তের ঠিক প্রাকমুহূর্তে সেই ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়াল ইরাবতী। দিনের শেষ আলো এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে ইরাবতীর মুখ। অপরূপ সৌন্দর্য যেন ঝরে পড়ছে তার অঙ্গ বেয়ে। এক এক সময় অভিমন্যুর মনে হয় ইরাবতী কি সত্যি কোনও মানবী? নাকি অপ্সরা। কোনও নারীর অঙ্গে এত রূপ হতে পারে?

শুধু একটা জিনিসেই ধরা পড়ে ইরাবতী মানবী। সেটা তার মুখমণ্ডলের বিষণ্ণতা, বিপন্নতা। সেটা ধরা পড়ে অভিমন্যুর চোখেও। তার বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। অভিমন্যু ভাবে, সে যদি পারত এই নারীকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে…

ইরাবতী ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়াতেই নীচে কিছুটা তফাত থেকে অন্যদিনের মতো তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিল অভিমন্যু। এই সময়টার জন্যই তো সারা দিনরাত অপেক্ষা করে থাকে সে। সকাল বেলা ঘুম ভাঙার পরই সে ছটফট করে দ্বিপ্রহরের প্রতীক্ষায়। রক্ষীবদল হয় সে সময়। যতক্ষণ না অন্ধকার নামে ততক্ষণ এই বাগিচায় প্রহরার কাজে নিযুক্ত থাকে অভিমন্যু।

হঠাৎ অভিমন্যুর যেন মনে হল তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোলে হাসি ফুটে উঠেছে সেই নারীর! সত্যি নাকি? হ্যাঁ, এই প্রথম তার দিকে তাকিয়ে হাসছে ইরাবতী! রক্ত ছলকে উঠল অভিমন্যুর বুকে। তাহলে কি ইরাবতী এতদিনে বুঝতে পেরেছে যে কেন তার দিকে তাকিয়ে থাকে অভিমন্যু? আর এরপর তাকে আরও বিস্মিত করে, ওপর থেকে চারপাশে কোনও তুর্কি আছে কিনা দেখে নিয়ে অভিমন্যুকে ইশারায় কাছে ডাকল সেই সুন্দরী। চারপাশে অন্য কেউ আছে নাকি দেখে নিয়ে অভিমন্যুও এগোলে তার দিকে।

সেই ঝুলবারান্দার নীচে এসে দাঁড়াল অভিমন্যু। মুখ তুলে সে তাকাল ইরাবতীর দিকে। ইরাবতীও তাকিয়ে তার দিকে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি থাকলেও বিদায়ী সূর্যালোকে একটা বিষণ্ণতাও ফুটে উঠেছে তার মুখে। সেদিকে তাকিয়ে রইল অভিমন্যু।

হঠাৎ তার বাহুতে জলের ফোঁটা এসে পড়ল। বৃষ্টি নেই, তবে? কাঁদছে ইরাবতী। অভিমন্যুর দিকে তাকিয়ে করুণ এক আর্তি ফুটে উঠেছে তার চোখে। আর এর পরই হাতের মুঠি থেকে সে কী যেন একটা ছুড়ে দিল নীচে দাঁড়ানো অভিমন্যুকে লক্ষ্য করে। ভাঁজ করা রেশম বস্ত্রের একটা টুকরো! অভিমন্যু মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল সেটা।

আরও কিছু বলার ছিল ইরাবতীর অভিমন্যুর উদ্দেশে, কিন্তু ওপর থেকে সে খেয়াল করল একজন তুর্কি সেদিকে আসছে। অভিমন্যুও দেখতে পেল তাকে। ইরাবতী পর মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল ঝুলবারান্দা থেকে। রেশম খণ্ডটা তাড়াতাড়ি তার পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল অভিমন্যু। সেই তুর্কি রক্ষীও পৌঁছে গেল অভিমনুর কাছে। সন্দিগ্ধ ভাবে সে একবার ঝুল বারান্দায় দিকে তাকিয়ে নিয়ে অভিমন্যুকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি এখানে কী করছ?’

অভিমন্যু জবাব দিল, ‘কিছু না। টহল দিতে দিতে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি।’

তুর্কি বলল, ‘তবে তোমাদের আর এখানে বেশিদিন কাজে নিযুক্ত থাকতে হবে না।’

অভিমন্যু বলল, ‘কেন?’

তুর্কি বলল, ‘কিছুদিন পর থেকেই এই জেনেনা মহলগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হবে খোজা ও বৃহন্নলাদের। তোমাদের তো আর এ মহলের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া যায় না। আরও কিছু জেনেনাকে এনে রাখা হবে এখানে। খোজা বা বৃহন্নলাদের এখানে আনলে তারা মহলের ভিতরে যেতে পারবে। মাস তিনেকের মধ্যেই সেনাপতি বক্তিয়ার রওনা হবেন মুলুকের দিকে। তার কাফেলার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হবে জেনেনাদের। ততদিনে খোজাদের তত্ত্বাবধানে থাকবে ওরা। খোজারা তো বীর্যহীন। তাই তাদের দিক থেকে অন্য কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই!’—কথাগুলো বলে অন্যদিকে চলে গেল সেই তুর্কি প্রহরী।

অভিমন্যুও সরে গেল সে জায়গা থেকে। তারপর ঝোপের আড়ালে গিয়ে পোশাকের নীচ থেকে সেই রেশম খণ্ডটা বার করে কাঁপা কাঁপা হাতে তার ভাঁজ খুলল। কাজলে লেখা কয়েকটা শব্দের একটা চিঠি। তাতে শুধু লেখা; ‘চিত্রসেন প্রিয়তম মুক্ত করো আমাকে।’

চিঠিটা পড়ে বিস্মিত হয়ে গেল অভিমন্যু। তার মানে সৈন্যধ্যক্ষ চিত্রসেনের প্রেয়সী ওই নারী! এই চিঠি চিত্রসেনকে পাঠাবার জন্যই তাকে দেওয়া হল! অন্যের প্রেয়সী ইরাবতী!

কয়েক মুহূর্তের জন্য আশাভঙ্গের বিষণ্ণতা ঘিরে ধরল অভিমন্যুকে। কিন্তু তারপরই সে হতভাগ্য নারীর সজল চোখের আকুতি ভেসে উঠল অভিমন্যুর চোখে। কিছুক্ষণ ভাবল অভিমন্যু। তারপর সিদ্ধান্ত নিল যে চিঠিটা পৌঁছে দেবে চিত্রসেনের কাছে।

গুটিকয় সৈনিক নিয়ে নদীর ওপাড়ে জঙ্গলের ভিতর যেখানে চিত্রসেন আত্মগোপন করে আছেন, সে জায়গার খোঁজ জানা আছে সৈনিক অভিমন্যুর। হতে পারে ইরাবতী অন্যের প্রেয়সী। কিন্তু সে তো ভালোবেসে ফেলেছে ইরাবতীকে। তার ভালো চাওয়াটাই তো তার একমাত্র কাম্য। হয়তো বা প্রেয়সীর চিঠি পেয়ে তাকে কোনও ভাবে মুক্ত করে নিয়ে যেতে পারবে বীর্যবান সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেন।

সূর্য ডোবার কিছু সময় পর নতুন রক্ষী এল প্রহরার কাজে। তাকে দায়িত্ব সঁপে দিয়ে অভিমন্যু বেরিয়ে পড়ল সেই প্রাসাদকানন থেকে। এক সময় সন্ধ্যা নামলেই তুলসী মঞ্চ থেকে শাঁখের শব্দ ভেসে আসত নগরীর নানা মহল্লা থেকে, মন্দিরগুলো থেকে আসত সন্ধ্যারতির ঘণ্টাধ্বনি বা কীর্তনের শব্দ। লক্ষ্মণ সেনের প্রাসাদের তোরণের মাথা থেকে সারা নগরীতে ছড়িয়ে পড়ত ইমনের সুরমূর্ছনা। ধনীর অট্টালিকা থেকে দরিদ্র মানুষের কুটিরে জ্বলে উঠত দীপশিখা। আলোক মালায় শোভিত হত সারা নগরী। ফুল সাজে সজ্জিত নটী আর নাগরিকরা গঙ্গা থেকে ভেসে আসা মনোরম বাতাসে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য কলহাস্যে মেতে উঠত নগরীর প্রধান সড়ক। কিন্তু তুর্কিরা নবদ্বীপের দখল নেবার পর সে সব কিছু থেমে গেছে। অন্ধকার নামলেই আতঙ্কিত নগরবাসী ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ে। কোথাও কোনও বাতি জ্বলে না। নিঝুম হয়ে যায় নগরী। শুধু মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতা ভেঙে শোনা যায় তুর্কিদের ঘোড়ার খুরের শব্দ অথবা তাদের কর্কশ চিৎকার।

সেই উদ্যান ছেড়ে বেরিয়ে সতর্ক চোখে চারপাশে তাকাতে তাকাতে অন্ধকার পথে অভিমন্যু এগোল নগর ত্যাগ করে নদীর দিকে। এক সময় গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে গেল সে। জায়গাটা নির্জন। তুর্কিরা সাধারণত বিশেষ প্রয়োজন না পড়লে নদীর কাছে আসে না। মূল নগরীতেই তারা থাকে। চাঁদের আলোতে ঘাটে বাঁধা আছে জেলে ডিঙিগুলো। একটা ছিপ নৌকা নিয়ে অভিমন্যু ভেসে পড়ল উজানের দিকে।

বেশ অনেকটা সময় পর সে তার নৌকা ভেড়াল নদীর অপর পারে এক জায়গাতে। জঙ্গুলে জায়গা। হিংস্র শ্বাপদ হানার ভয় আছে। বর্শাটা ভালো করে বাগিয়ে ধরে জঙ্গলে প্রবেশ করল সে। কিছুটা এগোবার পরই তার চারপাশে এক সঙ্গে দপ করে বেশ ক’টা মশাল জ্বলে উঠল। তাকে ঘিরে ধরল বেশ কয়েকজন লোক। তাদের হাতের উদ্যত অস্ত্র তাক করা আছে অভিমন্যুর দিকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পরস্পরকে চিনতে পারল তারা।

লোকগুলো লক্ষ্মণ সেনের প্রাক্তন বাহিনীর লোক। চিত্রসেনের সেই ক্ষুদ্র সেনাদল। তবে ঠিক জায়গাতেই উপস্থিত হয়েছে অভিমন্যু। সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেনও এরপর একটা গাছের আড়াল থেকে এসে দাঁড়ালেন অভিমন্যুর সামনে। তারপর বিস্মিতভাবে বললেন, ‘তুমি এখানে? তুমি তো তুর্কি বাহিনীতে যোগ দিয়েছ?’

অভিমন্যু আসল কারণটা বলল, ‘তুর্কিরা যখন নগরী আক্রমণ করল তখন আমি সেই উদ্যানবাটিতেই ছিলাম। অতর্কিতে হানা দিল তুর্কিরা। আমি পালাতে পরিনি। ওদের সঙ্গে যোগ না দিলে আমি প্রাণে বাঁচতাম না।’

চিত্রসেন হয়তো অন্য কিছু আরও বলতে যাচ্ছিলেন অভিমন্যুকে। কিন্তু ‘উদ্যানবাটি’ শব্দটা শুনেই প্রথমে থেমে গেলেন তিনি। তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘সেই উদ্যানবাটি এখনও আছে? নাকি তা জ্বালিয়ে দিয়েছে যবন সেনাপতি? সেখানে যারা ছিল তারা কি এখনও জীবিত?’

অভিমন্যু উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ আছে। আমিও সেখানেই প্রহরার কাজে নিযুক্ত আছি।’

উত্তরটা শুনে সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেন আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে বললেন, ‘ইরাবতী? সে কি সেখানেই আছে?’

অভিমন্যু মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, সে সেখানেই বন্দিনী এখনও। তবে সম্ভবত আর বেশি দিনের জন্য নয়। আর কিছুদিনের মধ্যে তুর্কি সেনাপতি ফেরার পথ ধরবে। নারীদের সে সঙ্গে নিয়ে যাবে তুর্কি মুলুকে। সেই নারী আপনাকে একটা পত্র পাঠিয়েছেন। সেটা দিতেই আমি এসেছি।’ এই বলে অভিমন্যু সেই রেশম খণ্ডটা এগিয়ে দিলেন সেনাধ্যক্ষের দিকে।

চিত্রসেন চিঠিটা পড়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘তার সঙ্গে কথা হয় তোমার?’

অভিমন্যু বলল, ‘আমার সে সুযোগ নেই। প্রাসাদের ভিতর প্রবেশাধিকার নেই আমার। সে ঝুলবারান্দা থেকে সবার অলক্ষে এই পত্র ছুড়ে দিয়েছে আমাকে। সে বারান্দায় এসে দাঁড়ালে আমি নীচ থেকে দেখতে পাই তাকে। কিন্তু হয়তো আর তাও পাব না। খোজা আর বৃহন্নলারা তুর্কিদের সঙ্গে সেখানে শীঘ্রই প্রহরার কাজে নিযুক্ত হতে চলেছে। আপনি সাহসী বীর্যবান পুরুষ। আপনি যদি গিয়ে সেই নারীকে মুক্ত করতে পারেন…

অভিমন্যুর কথা শুনে আবারও বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন চিত্রসেন। তারপর হতাশ ভাবে বললেন, ‘সে আমার এই ক্ষুদ্র বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। স্বয়ং বাংলার রাজাই যখন তুর্কিদের প্রতিহত করতে পারলেন না। তখন আমি পারব কীভাবে? নবদ্বীপে প্রবেশ করার মানেই তো তুর্কিদের মুখোমুখি হওয়া। তাদের কবল থেকে ইরাবতীকে মুক্ত করার ক্ষমতা এখন বাংলার রাজা লক্ষ্মণ সেনেরও নেই।

‘তবে?’ জানতে চাইল অভিমন্যু।

চিত্রসেন বললেন, ‘তুমি এখনও নগরীতে আছ। তুমি যদি কোনও ভাবে ইরাবতীকে মুক্ত করে আনতে পারো তবে আমি গ্রহণ করব তাকে। এ কাজের জন্য তোমাকে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রাও পুরস্কার দেব। আমি আগামী পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত এখানে আছি। সে এলে আমি তাকে নিয়ে বাংলা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাব। তাকে আমি বৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেনের হাতে তুলে দেব না।’

অভিমন্যু বেশ হতাশ হল চিত্রসেনের কথা শুনে। চিত্রসেন তবে তাকে মুক্ত করতে পারবেন না। সে সামান্য সৈনিক, সে কেমন করে মুক্ত করবে সেই নারীকে? তবু সে চিত্রসেনকে বলল, ‘ঠিক আছে যদি আমি তাকে মুক্ত করতে পারি, আর সে যদি আসতে রাজি হয় তবে আমি তাকে পৌঁছে দেব এখানে।’ একথা বলে অভিমন্যু জঙ্গল ছেড়ে বাইরে বেরোবার পথ ধরল।

অভিমন্যু জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে যখন নদীর পাড়ে এল ঠিক তখনই আর একটা নৌকা এসে ভিড়েছে সেখানে। জনা চারেক লোক নৌকা থেকে নেমে এগোচ্ছে জঙ্গলে ঢোকার জন্য। অভিমন্যু মুখোমুখি হয়ে গেল তাদের।

দুজন টিকিধারী ব্রাহ্মণ আর তাদের সঙ্গে দুজন সৈনিক। এক ব্রাহ্মণকে চিনতে পারল অভিমন্যু। সে ব্রাহ্মণের নাম পুণ্ডরীক। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ব্রাহ্মণরাই তো নবদ্বীপ শাসন করত রাজা লক্ষ্মণ সেনের হয়ে।

পুণ্ডরীক নামের এই ব্রাহ্মণ রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাসদ ছিলেন। রাজার সঙ্গে যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন তুর্কিদের এড়িয়ে নগরী ত্যাগ করতে সক্ষম হন এই ব্রাহ্মণ তাদের মধ্যে অন্যতম। মাঝে মাঝে এই ব্রাহ্মণ লক্ষ্মণ সেনের সেই উদ্যান প্রাসাদে যেতেন সব কিছু ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য। সেই সূত্রে বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে বাক্যালাপের সৌভাগ্য হয়েছে অভিমন্যুর। কে যেন একবার অভিমন্যুকে বলেছিল যে ইরাবতীর সঙ্গে রাজার বিবাহে এই ব্রাহ্মণেরই নাকি পৌরহিত্য করার কথা।

এরা চারজন নিশ্চয়ই সাক্ষাৎ করতে এসেছে চিত্রসেনের সঙ্গে। চাঁদের আলোতে অভিমন্যু আর ব্রাহ্মণ চিনতে পারল পরস্পরকে। ব্রাহ্মণ সম্ভবত অনুমান করলেন যে, এই সৈনিকও চিত্রসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কোথাও যাচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেন নিশ্চয়ই এখানে আছেন? সৈনিক এত রাতে তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

অভিমন্যু তাঁকে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম জানিয়ে বলল, ‘আজ্ঞে, তিনি অরণ্যেই আছেন। আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নগরীতে ফিরছি। আমি সেই উদ্যানবাটিতে আগের মতোই প্রহরীর কাজ করি তুর্কিদের অধীনে। তুর্কিরা যখন হানা দিল তখন আমি পালাতে পারিনি। প্রাণ বাঁচাতে কাজ নিয়েছি তাদের অধীনেই।’

সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেনের মতোই সেই উদ্যানবাটির কথা শুনে বিস্মিত হলেন ব্রাহ্মণ পুণ্ডরীক। তিনি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, ‘ইরাবতী নাম্নী সেই কন্যা কি এখনও সেখানে আছে? যবনরা কলঙ্ক লেপন করেনি তো তার শরীরে?’

অভিমন্যু জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, সে সেখানেই আছে? তুর্কিরা এখনও তাকে স্পর্শ করেনি। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে তুর্কিদেশে। হয়তো আর কয়েক মাস পরই। মহারাজ কি মুক্ত করতে পারবেন তাকে?’

সে নারী সেই প্রাসাদেই আছেন আর যবনরা এখনও তার চরিত্র হনন করতে পারেনি শুনে উৎফুল্ল ভাব ফুটে উঠল ব্রাহ্মণ আর তার সঙ্গীদের মুখে। নিজেদের মধ্যে একবার দৃষ্টি বিনিময় করে নিলেন তারা। ব্রাহ্মণ পুণ্ডরীক এরপর বললেন, ‘তাকে উদ্ধার করার জন্যই তো সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেনের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি আমরা। সে যদি তাকে মুক্ত করে আমাদের হাতে তুলে দিতে পারে সে জন্য। মহারাজের পক্ষে এখানে এসে ইরাবতীকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।’

সৈনিক অভিমন্যু বুঝতে পারল যে সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেনের সঙ্গে ইরাবতীর গোপন সম্পর্কের কথা জানা নেই ব্রাহ্মণদের। চিত্রসেন ইরাবতীকে পেলে রাজার হাতে তুলে দেবে না। ইরাবতী নিজেও চায় চিত্রসেনকেই।

ব্রাহ্মণের কাছে অবশ্য ব্যাপারটা ভাঙল না অভিমন্যু। সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেনের অক্ষমতা সম্বন্ধেও বলল না কিছু। সে শুধু জানতে চাইল, ‘ওই কন্যাকে নিয়ে আপনারা কী করবেন?’

ব্রাহ্মণ পুণ্ডরীক একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘তুমি হয়তো জানো সৈনিক যে, ওই কন্যার সঙ্গে মহারাজের বিবাহের কথা ছিল। কিন্তু অকস্মাৎ তুর্কিরা এসে পড়ায় মহারাজকে শূণ্য হাতে নগরী ত্যাগ করতে হয়। বর্তমানে মহারাজ নিরাপদ স্থানেই আছেন। রাজধানী নবদ্বীপ ত্যাগ করতে হলেও তিনি এখনও এই বাংলাদেশের বিশাল ভূখণ্ডের রাজা। রাঢ় বাংলা-সমতট এখনও তার শাসনাধীন। তাঁর ফেলে যাওয়া ধনরত্ন-নগরীর শোক ভুলতে পারলেও কিছুতেই সেই নারীর শোক ভুলতে পারছেন না। ইরাবতীর জন্য আকুল তিনি। তাকে বিবাহ করতে চান মহারাজ লক্ষ্মণ সেন।’

রাজধানী গেছে যাক। কিন্তু যুবতী নারীর প্রতি আকাঙ্ক্ষা যে এখনও কৌলীন্য ব্যবস্থার অনুসারী মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের বৃদ্ধাবস্থাতেও যায়নি তা বুঝতে পারল অভিমন্যু। এরপর ব্রাহ্মণ বললেন, ‘শোনো সৈনিক। এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য আমরা সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেনের সাক্ষাৎ প্রার্থী ঠিকই। কিন্তু তুমিও যদি সেই নারীকে কোনও ভাবে মুক্ত করে আমাদের হাতে তুলে দিতে পারো তবে মহারাজ তোমাকে পুরষ্কৃত করবেন। সৈনিকের সামান্য জীবন আর তোমাকে বহন করতে হবে না। আগামী পূর্ণিমা তিথিতে আমরা সূর্যাস্তের পর এখানে আবার আসব।’ এই বলে সঙ্গীদের নিয়ে ব্রাহ্মণ এগোলেন অরণ্যে প্রবেশ করার জন্য।

নৌকায় উঠে অভিমন্যু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবল, ‘তাহলে মহারাজও মুক্ত করতে পারবে না সেই হতভাগিনী নারীকে! ভবিষ্যতে কি লেখা আছে সেই নারীর ভাগ্যে?’ ইরাবতীর প্রতি ভালোবাসায়, সমবেদনায় ভরে উঠল তার মন।

শেষ রাতে নগরীতে ফিরে তার ছোট্ট কুটিরে এসে শুয়ে পড়ল হতাশ অভিমন্যু। ঘুম নেমে এল তার চোখে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে অভিমন্যুর স্বপ্নে বারে বারে ভেসে উঠতে লাগল শেষবেলার আলোতে দেখা ইরাবতীর করুণ মুখচ্ছবি।

সে যেন বার বার অভিমন্যুকে বলতে লাগল, ‘আমার প্রেমিক চিত্রসেন না পারুক, বিবাহ প্রত্যাশী রাজা লক্ষ্মণ সেন না পারুক তুমি কি আমাকে বাঁচাতে পারো না সৈনিক? তুমিও তো আমাকে ভালোবাসো—আমি বুঝেছি। তুমি আমাকে রক্ষা করবে না তুর্কিদের থেকে?’ ইরাবতীর কাতর আর্তনাদ বার বার যেন পাক খেতে লাগল অভিমন্যুর স্বপ্নে।

এক সময় সেই করুণ আর্তনাদ আর সহ্য করতে পারল না সৈনিক। সে চিৎকার করে উঠল, ‘আমি তোমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করব ইরাবতী। তাতে যদি আমার মৃত্যু হয় তবুও আমি চেষ্টা করব। তোমার কান্না, আর্তনাদ আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’

চিৎকার করে কথাগুলো বলার পরই ঘুম ভেঙে উঠে বসল অভিমন্যু। বাইরে সূর্যোদয় হয়ে গেছে। তার কক্ষ সংলগ্ন রাজপথে লোক সমাগম শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরও স্বপ্নের মতোই অভিমন্যুকে আচ্ছন্ন করে থাকল ইরাবতীর সেই করুণ দৃষ্টি, তার কাতর অর্তনাদ।

বিড়বিড় করে অভিমন্যু বলল, ‘আমি যদি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকি তবে আমি তোমাকে মুক্ত করার চেষ্টা করব। তুমি সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেনকে ভালোবাসো তা জেনেও, অথবা অদূর ভবিষ্যতে কোনওদিন তুমি বৃদ্ধ রাজার মহিষী হবে তা জেনেও। আমি সামান্য সৈনিক মাত্র। তবু চেষ্টা করব। কিন্তু কী ভাবে? কী ভাবে?’

নিজের ছোট্ট কক্ষে বসে তাকে কী করে মুক্ত করা যায় তার উপায় খোঁজার চেষ্টা করছিল অভিমন্যু। হঠাৎ তার কানে এল ঢেঁড়া পেটাবার শব্দ। কী ঘোষণা করা হচ্ছে ঢেঁড়া পিটিয়ে? ঘোষণাটাও তার কানে এল।

তুর্কি সেনাপতি তার কাজে খোজা, বৃহন্নলা, ভৃত্য ইত্যাদি নিয়োগ করতে চান। তারই বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করা হচ্ছে ঢেঁড়া পিটিয়ে। খোজা-বৃহন্নলাদের নিশ্চয়ই নিয়োগ করা হবে প্রমোদ প্রাসাদ প্রহরার কাজে। গতকাল তো সেই তুর্কি এ কথাই বলেছিল অভিমন্যুকে।

একথাটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ইরাবতীকে মুক্ত করার একটা উপায় যেন দেখা দিল সৈনিক অভিমন্যুর মনে। কিছু সময়ের মধ্যেই ঘর ছেড়ে রাজপথে নামল অভিমন্যু। সে রওনা হল নবদ্বীপ নগরীর প্রান্ত সীমায় যেখানে খোজা-বৃহন্নলারা বাস করে সে মহল্লায়।

দিন কাটে। সেদিনের পর সেই সৈনিককে আর দেখতে পায়নি ইরাবতী। সেই সৈনিক কি তার প্রেমিকের কাছে পত্রটা পৌঁছে দিতে পেরেছিল? তা জানা নেই ইরাবতীর। ইতিমধ্যে আরও বেশ কিছু নারীকে আনা হয়েছে এই প্রাসাদে। কিছু নিম্ন শ্রেণির স্ত্রীলোককে নিয়োজিত করা হয়েছে বন্দিনীদের পরিচর্যার কাজে। আর তাদের প্রহরার কাজে নিযুক্ত হয়েছে বেশ কয়েকজন খোজা ও বৃহন্নলা। আর তুর্কি প্রহরীরা তো অবশ্যই আছে।

খোজা অথবা বৃহন্নলাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে বাইরে যায় দাসীরা। বন্দিনীদের রূপচর্চার সামগ্রী জোগাড় করার জন্য। সেনাপতি বক্তিয়ার নাকি বলেছেন যে সুন্দরীদের রূপচর্চার যেন কোনও সমস্যা না হয়। তাদের তুর্কিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর যেন সেখানে লোকজন মোহিত হয় এই বাঙালি সুন্দরী নারীদের দেখে। তুর্কি হারেমগুলোর শোভাবর্ধন করবে এই নারীর দল।

যারা খোজাদের সঙ্গে প্রাসাদের বাইরে যায় তারা মাঝে মাঝে কিছু খবর নিয়ে প্রাসাদে ফেরে। তারা কেউ কোনও সংবাদ দিতে পারে না সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেনের বা সেই সৈনিকের। তবে তাদের মুখ থেকে ইরাবতী শুনেছে যে সেনাপতি বক্তিয়ার নাকি তার মুলুকে ফিরে যাবার তোড়জোড় শুরু করেছেন। তিনি সঙ্গে নিয়ে যাবেন ইরাবতী সহ অন্য নারীদের।

সেদিনও সূর্য ডোবার প্রাকমুহূর্তে সেই অলিন্দে এসে দাঁড়িয়েছিল ইরাবতী। সে দেখার চেষ্টা করছিল সেই সৈনিককে কোথাও দেখতে পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু তার দেখা আজও পেল না সে। সূর্য ডুবে গেল এক সময়। আঁধার নেমে এল। বিষণ্ণ চিত্তে ইরাবতী ফিরে এল নিজের কক্ষে। অন্ধকার কক্ষে বসে সে ভাবতে লাগল তার ভাগ্যের পরিহাসের কথা।

মাতৃহীন ইরাবতী এক সামান্য কৃষকের সন্তান। রূপটাই হয়তো তার জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াল। কীভাবে যেন তার রূপের খবর পৌঁছেছিল বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেনের কানে। তিনি ব্রাহ্মণদের মাধ্যমে ইরাবতীর পিতাকে অনুরোধ জানালেন ইরাবতীকে রাজধানীতে পাঠাবার জন্য। মহারাজ তাকে অন্যতম ভার্যা রপে গ্রহণ করতে চান। রাজ অনুরোধ মানে তো রাজনির্দেশ! তাকে অমান্য করার ক্ষমতা সেই ক্ষুদ্র কৃষকের ছিল না। সে ইরাবতীকে পাঠিয়ে দিল রাজধানী নবদ্বীপে।

এই উদ্যান প্রাসাদে ঠাঁই হল ইরাবতীর। এখানেই তার সঙ্গে আলাপ ও প্রেম সৈন্যধ্যক্ষ চিত্রসেনের। সে তাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাল। চিত্রসেন তাকে বলল যে বৃদ্ধ মহারাজের সঙ্গে বিবাহ সম্পন্ন হবার পূর্বেই সে পালাবে ইরাবতীকে নিয়ে। ইরাবতী তাকে মন দিল।

তারপর একদিন হঠাৎই সব গন্ডগোল হয়ে গেল। তুর্কিরা এসে উপস্থিত হল। মহারাজ পালালেন, চিত্রসেনেরও আর দেখা মেলেনি। পত্রবাহী সেই সৈনিকও আর ফিরল না। তবে কি এবার সত্যিই তুর্কিদের সঙ্গে তাদের দেশে চলে যেতে হবে ইরাবতীকে। বাকি জীবনটা তাকে কাটাতে হবে এই বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরের কোনও অচেনা মুলুকে? যবনদের হারেমে অত্যাচার সহ্য করতে হবে আমৃত্যু?

তার চেয়ে তো বৃদ্ধ মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের ভার্যা হওয়া অনেক ভালো ছিল। সুখ না পেলেও জীবনে বৈভবের কোনও অভাব হত না তার। রাজমহিষীর সম্মানটা অন্তত সে লাভ করত। এ সব কথা ভাবতে ভাবতে শুধু সেই কক্ষে নয়, অন্ধকার নেমে আসতে লাগল ইরাবতীর মনেও। আশঙ্কা-আশাহীনতার জমাট বাঁধা অন্ধকার।

ঘর আর মনের অন্ধকারেই ডুবে ছিল ইরাবতী। একটা মৃদু শব্দে দ্বারের দিকে তাকাল সে। দরজা খুলে গেল। প্রতিদিনের মতো একজন নপুংসক-খোজা প্রদীপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে ঘরে। ইরাবতী ভেবেছিল অন্য দিনের মতোই প্রদীপটা ঘরে রেখে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে প্রদীপ হাতে তার দিকে তাকিয়ে রইল সেই খোজা।

লোকটাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরাবতী বিব্রত হয়ে ভালো করে তাকাল তার মুখের দিকে। লোকটার পরনে খোজাদের মতো ঢোলা পাজামা, হাতে-কানে-গলায় অলঙ্কার ও মাথার কেশরাশি পেছনে ঝুঁটি করে বাঁধা। এ যে সেই সৈনিক! খোজার ছদ্মবেশে প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে সে।

তাকে চিনতে পেরে ইরাবতী বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘সৈনিক! তুমি?’ অস্পষ্ট হাসি ফুটে উঠল তার মুখেও। সে বলল, ‘আমি অভিমন্যু। সেই সৈনিক। তোমাকে দাসীর ছদ্মবেশে এই প্রাসাদ থেকে বার করে নিয়ে যেতে এসেছি। শুধুমাত্র দুজন দ্বাররক্ষী ছাড়া অন্য কোনও তুর্কি এখন প্রাসাদে নেই। সেনাপতি বক্তিয়ারের দরবারে গেছে তারা। তাড়াতাড়ি পালাতে হবে। এই পুটুলিতে দাসীদের পোশাক আছে, দ্রুত পরে নাও এগুলো।’ এই বলে সে একটা ছোট কাপড়ের পুটুলি এগিয়ে দিল ইরাবতীর দিকে।

পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে ইরাবতী আর সময় নষ্ট না করে পরে নিল দাসীদের পোশাক। তারপর ঘোমটায় মুখ ঢেকে সৈনিকের সঙ্গে সেই কক্ষ ত্যাগ করল। প্রাসাদ থেকে বেরোবার দরজার মুখে পৌঁছে গেল দুজনে। সেখানে তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে দুজন তুর্কি। তারা বাধা দিল না। মাঝে-মাঝেই তো খোজাদের সঙ্গে বাইরে যায় দাসীরা, সুন্দরীদের জন্য নানা জিনিসপত্র কিনতে। আবার খোজাদের সঙ্গেই তারা ফিরে আসে প্রাসাদে। একজন তুর্কি মজা করে অভিমন্যুর উদ্দেশে বলল, ‘এই সন্ধ্যায় তোমরা দুজন ইশক-মুহব্বত করতে যাচ্ছ নাকি?’

কথাটা শুনে খোজাদের মতোই মুখ বেঁকিয়ে তালি দিল সৈনিক। তাই দেখে হেসে উঠল তুর্কি সৈনিকরা। ইরাবতী মনে মনে ভাবল, ‘চমৎকার অভিনয় জানে খোজাবেশী সৈনিক!’

কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাসাদ সংলগ্ন উদ্যান ত্যাগ করে পথে নামল তারা। তারপর অন্ধকার পথ বেয়ে দ্রুত এগোল নদীর দিকে। একসময় নদী তীরে উপস্থিত হল দুজনে। ইরাবতীকে নিয়ে একটা নৌকায় উঠে বসল অভিমন্যু। নদীর স্রোতে ভেসে চলল নৌকা। মাঝ গঙ্গায় উপস্থিত হবার পর ইরাবতী একটু ধাতস্থ হয়ে প্রশ্ন করল, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

সৈনিক জবাব দিল, ‘যেখানে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেন আছেন। আজ পূর্ণিমা। মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের পার্শ্বচর ব্রাহ্মণ পুণ্ডরীকেরও সেখানে থাকার কথা। তাদের যে-কোনও একজনের সঙ্গী হলে তুমি নিরাপদ। ইচ্ছামতো যে-কোনও একজনের সঙ্গে তুমি চলে যেও।’

ইরাবতী জানতে চাইল, ‘তারা কি তোমাকে আমায় উদ্ধার করতে পাঠিয়েছেন?’

বৈঠা টানতে টানতে অভিমন্যু বলল, ‘ঠিক তা নয়। তোমাকে উদ্ধার করার ক্ষমতা তাদের ছিল। তারা আলাদা-আলাদা ভাবে আমাকে বলেছে যদি আমি তোমাকে উদ্ধার করতে পারি তবে তারা পুরস্কার দেবে আমাকে। তবে পুরস্কারের লোভে আমি এ কাজ করিনি।’

‘তাহলে এত বিপদ মাথায় নিয়ে তুমি এ কাজ করলে কেন?’ প্রশ্ন করল ইরাবতী।

চাঁদের আলোতে ইরাবতীর দিকে মুখ তুলে তাকাল সৈনিক। ইরাবতী দেখল অদ্ভুত এক বিষণ্ণ হাসি ফুটে আছে সৈনিকের ঠোঁটের কোণে।

অভিমন্যু আর কোনও কথা বলল না। দাঁড় টানতে লাগল। ইরাবতীও কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। চাঁদের আলোতে বয়ে চলল নৌকা। জলে দাঁড় টানার মৃদু ছপছপ শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। এক সময় জঙ্গলাকীর্ণ নদীতটে এসে ভিড়ল অভিমন্যুর নৌকা।

চাঁদের আলোতে হয়তো নৌকাটাকে দূর থেকেই আসতে দেখেছিল চিত্রসেন আর ব্রাহ্মণ পুণ্ডরীক দু-পক্ষই। অভিমন্যু আর ইরাবতী নৌকা থেকে নামতেই দু-পক্ষ এগিয়ে এল। চিত্রসেনকে দেখতে পেয়েই উজ্জ্বল হয়ে উঠল ইরাবতীর চোখ। কিন্তু ব্রাহ্মণ পুণ্ডরীক প্রথমে বলে উঠলেন, ‘চলো ইরাবতী আমরা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। পুরুষশ্রেষ্ঠ বীর্যবান মহারাজ তোমাকে পাবার জন্য ব্যাকুল। এখনও বাংলার রাজা তিনি। রানি হবে তুমি।’

তার কথা শেষ হতে না হতেই চিত্রসেন তলোয়ার কোষ মুক্ত করে বলে উঠল, ‘না, ইরাবতী ওই বৃদ্ধের ভার্যা হবে না। সে আমার সঙ্গে যাবে। আমি ওর প্রেমিক।’

ব্রাহ্মণ বলে উঠলে, ‘না, এ হতে পারে না। আমরা ওকে নিয়ে যাব। তুমি রাজ নির্দেশ অমান্য করছ।’

‘রাজ নির্দেশ! আমাকে বাধা দেবার চেষ্টা করলে আমি এখনই দেখিয়ে দেব যে আপনার রাজা, আপনারা, নাকি আমি প্রকৃত পুরুষ। ইরাবতী আমার সঙ্গেই যাবে। চিৎকার করে কথাগুলো বলে উঠলেন সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেন।

ক্ষুদ্র হলেও চিত্রসেনের সঙ্গে সেনাদল আছে। তার সঙ্গে যুঝে ওঠা সম্ভব নয় বলে তাকে আর বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল না ব্রাহ্মণ আর তার অনুচরেরা। অসহায় ভাবে কিছুটা তফাতে গিয়ে দাঁড়াল তারা।

বিজয়ী পুরুষ চিত্রসেন এবার হেসে ইরাবতীকে বললেন, ‘আমার কাছে এসো ইরাবতী। বীর্যবান পুরুষের জয় সর্বত্র।’

ইরাবতীর মুখেও হাসি ফুটে উঠেছে। সে সেই বলদর্পী পুরুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেন এরপর অভিমন্যুর উদ্দেশে বললেন, ‘তোমাকে কী পুরস্কার দেব বলো?’

সৈনিক অভিমন্যু জবাব দিল, ‘কিছু চাই না। পুরস্কারের প্রত্যাশায় এ কাজ করিনি আমি। আপনারা দুজন সুখী থাকবেন।’ এই বলে অভিমন্যু পিছু ফিরে নৌকায় নামার জন্য পা বাড়াল।

চিত্রসেন বলে উঠলেন, ‘অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। খোজার পোশাকটা কিন্তু জব্বর মানিয়েছে তোমাকে। তাই তুমি কৌশলে ধোঁকা দিতে পারলে তুর্কিদের।’

নদীতে নেমে যাবার আগে কথাটা শুনে আবার ঘুরে দাঁড়াল সৈনিক অভিমন্যু। তারপর বলে উঠল, ‘এ শুধু পোশাক নয়।’

‘তার মানে?’

অভিমন্যু বলল, ‘আমিও প্রথমে ভেবেছিলাম শুধু খোজার পোশাক পরেই ধোঁকা দেওয়া যায় তুর্কিদের। কিন্তু পরে জানলাম যে প্রাসাদের তুর্কি দ্বাররক্ষীরা পরীক্ষা করে দেখে, যে খোজা প্রাসাদে ঢুকছে সে সত্যিই খোজা কিনা…।

চিত্রসেন প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি তবে খোজার পোশাকে তুর্কিদের উৎকোচ দিয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করলে?’

চাঁদের আলো এসে পড়েছে সৈনিক অভিমন্যুর মুখে। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত হাসি। চিত্রসেনকে অবাক করে দিয়ে অভিমন্যু সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, ‘আমি সত্যিই খোজা হয়ে গেছি।’ কথাগুলো বলে সে জলে নামল নৌকায় ওঠার জন্য। অনেক দূরে চলে যেতে হবে তাকে।

ইরাবতীর কয়েকমুহূর্ত লাগল কথাটা শোনার পর সম্বিত ফিরতে। তার মনে হল, ‘কে প্রকৃত পুরুষ? সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেন? রাজা লক্ষ্মণ সেন, নাকি এই সৈনিক? যে জীবনের সব কিছু বিসর্জন দিল তার জন্য? না, ওই সৈনিক খোজা নয়। খোজা হলেন রাজা লক্ষ্মণ সেন, তার পাশে দাঁড়ানো সেনাধ্যক্ষ চিত্রসেন। ওই সৈনিকের মতো বীর্যবান-পুরুষ আর কেউ নয়, কেউ নয়…

অজানার উদ্দেশে সৈনিক অভিমন্যু তখন দাঁড় টানতে শুরু করেছে। আর সময় নষ্ট না করে ইরাবতী তিরের মতো ছুটে গিয়ে ঝাঁপ দিল জলে। তারপর সাঁতরে গিয়ে উঠে পড়ল সৈনিকের নৌকাতে।

প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে চিত্রসেন এগোতে যাচ্ছিলেন নদীর দিকে। এত সহজে তিনি যেতে দেবেন না ইরাবতীকে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে কে যেন চিৎকার করে উঠল, ‘ওই দেখুন তুর্কিরা পিছু ধাওয়া করেছে। তারা জেনে গেছে ব্যাপারটা। জঙ্গলের ভিতরে এখনই পালাতে হবে!

সত্যিই গঙ্গাবক্ষে ভাটির দিক থেকে বিন্দু বিন্দু আলো ধেয়ে আসছে! হ্যাঁ, ওগুলি তুর্কিদের নৌকা। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর কালক্ষেপ না করে চিত্রসেন পাড়ে দাঁড়ানো সবাই আত্মগোপন করার জন্য ছুটল জঙ্গলের দিকে।

কিছু সময়ের মধ্যেই তুর্কিরা এসে ঘিরে ফেলল সেই ছোট নৌকাটাকে। গঙ্গাবক্ষে সেই নৌকাটার চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল তুর্কি নৌকাগুলোর মশালের আলোতে। পালাবার আর কোনও উপায় না থাকলেও অভিমন্যু বা ইরাবতীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। অভিমন্যুর হাত ধরে উঠে দাঁড়াল ইরাবতী। তারপর অভিমন্যুর গলা জড়িয়ে প্রথম কোনও বীর্যবান পুরুষের ঠোঁটে ঠোঁট রাখল সে।

আর তার পরমুহূর্তে তুর্কি তির ছুটে এসে একই সঙ্গে বিদ্ধ করল তাদের দেহ দুটোকে। অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হল অভিমন্যু-ইরাবতীর দেহ-মন। নৌকা থেকে একটাই দেহ-মন যেন ছিটকে পড়ল নদীর জলে। ইতিহাসের পাতায় জেগে রইলেন বাংলার রাজা লক্ষ্মণ সেন, তুর্কি সেনাপতি বক্তিয়ারের বঙ্গ বিজয়ের কাহিনি। আর অভিমন্যু-ইরাবতীর প্রেম কাহিনি সবার অলক্ষে বয়ে চলল নদীর গভীরে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *