বিল্ববতী

বিল্ববতী

বিল্ববতী। বিল্বফলের মতো নিটোল বর্তুলাকার তার স্তনযুগল। চাঁদনী রাতে যখন সে তার মহল সংলগ্ন ক্ষুদ্র সরোবরের মর্মর সোপানশ্রেণিতে এসে দাঁড়ায় তখন সব জ্যোৎস্না যেন আকাশ থেকে নেমে এসে জমা হয় তার নিবিড় স্তন-খাঁজে। বিভ্রান্ত মৎস্যকুল ঘাই দিয়ে ভেসে উঠে চেয়ে থাকে বিল্ববতীর দিকে। তারা ভাবে আরও দুটো চাঁদ যেন আকাশ থেকে নেমে এসে আটকে আছে বিল্ববতীর বুকে। দিনের বেলাতে এই মরুরাজ্যের প্রখর সূর্য যেন শীতলতা খোঁজে বিল্ববতীর গভীর নাভিকূপে। ধাবমান ঘোটকের দল থমকে দাঁড়ায় বিল্ববতীর ঘোটকী সদৃশ ভারী নিতম্ব দেখে।

ক্ষীণ কটি, মৃগনয়না বিল্ববতী। বারবণিতা বিল্ববতী। নগর নটী বিল্ববতী। মহারাণা উদয়সিংহর সঙ্গসহচরী, প্রধানা বারবনিতা বিল্ববতী। তার রং যখন প্রস্ফুটিত হয়নি ঠিক সেই বয়সে, কোনও যুদ্ধবাজ তাকে গান্ধার রাজ্যের সরবরতীরস্থ শীতল কুটির থেকে উৎপাটিত করে এনে উপস্থিত করে ছিল নিষ্প্রাণ মরুরাজ্য জয়শালমেরের দাস বাজারে। সেখান থেকে স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে তাকে খরিদ করে মেবারাধিপকে উপহার দিয়েছিল কোনও এক রাজপুত সর্দার।

কিরিটশোভিত, তুষারময় গান্ধার রাজ্য থেকে রুক্ষ উষর মরুপ্রদেশে এভাবেই আগমন এই নারীর। পূর্বস্মৃতি প্রায় কিছুই স্মরণে আসে না তার। এমনকী নামটাও পর্যন্ত নয়। যখন তার বক্ষ প্রস্ফুটিত হতে শুরু করল, তখন তা দেখে কোনও প্রাচীন অভিজ্ঞ বারবনিতা ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার নামকরণ করেছিল ‘বিল্ববতী’। এই তার অকিঞ্চিৎকর অতীত জীবনের ক্ষুদ্র ইতিহাস।

তবে বর্তমানে সে মেবারের বারবনিতা শ্রেষ্ঠা। রাজ অনুগ্রহে এ পদ লাভ করেছে সে। হয়তো বা তার ওই অসীম সৌন্দর্যময় বিল্ব স্তনের জন্যই। মহারানা থেকে অতি সাধারণ নাগরিক, সকল পুরুষকেই আকৃষ্ট করে বিল্ববতীর বেলফলের মতো উদ্ভিন্ন স্তন। এক সহস্র বারবনিতা রয়েছে বিল্ববতীর অধীনে। রাজপুরুষ থেকে অচেনা বণিক, চিতোরের নগরজীবনে মনোরঞ্জন করে তারা। তবে গণিকা, বারবনিতা শ্রেষ্ঠা বিল্ববতী আজ শুধুই মহারাণার অঙ্কশায়িনী। গণিকাদের আবাসস্থলে সে থাকে না। মেবারের মহারানা তার জন্য এক ক্ষুদ্র মর্মর প্রাসাদ নির্মাণ করিয়ে দিয়েছেন চিতোর নগরীর এক নিভৃত সরোবরের কিনারে। সেখানে নিত্য আনাগোনা মোবারনরেশ উদয়ের। অন্তঃপুরে রাজমহিষীরা মহারানার প্রতীক্ষাতে থাকলেও তিনি কাল অতিবাহিত করেন বিল্ববতীর সঙ্গে। এ জন্য মহিষী ও সামন্ত সর্দারদের মনে বিল্ববতীর প্রতি অসন্তোষ আছে। রাজমহিষীদের অনেকেই সামন্তরাজা বা সর্দারদের কন্যা বা ভগিনী। ব্যাপারটা জানলেও এ নিয়ে তোয়াক্কা করেন না উদয়সিংহ। বিল্ববতী অপার সৌন্দর্যের আধার, বিল্বফলের মতো স্তনযুগলের অমোঘ আকর্ষণ তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায় বিল্ববতীর মহলে। শুধু কি শরীরী আকর্ষণ, হয়তো বিল্ববতীকে ভালোবেসে ফেলেছেন উদয়, এবং বিল্ববতীও।

মরু অঞ্চলে এক পাহাড়ের শীর্ষদেশে প্রাকারবেষ্টিত, জলাশয়, কানন, হর্ম্য প্রাসাদ, দেউল শোভিত মেবারের রাজধানী চিতোর গড় রাজপুতাধিপ উদয়ের আবাসস্থল। তার রাজপ্রাসাদ। দ্বিপ্রহরে হরিণ-মাংস ও পরমান্ন সহযোগে মধ্যাহ্ন ভোজনের পর নিদ্রা গেছিলেন উদয়। তার যখন নিদ্রাভঙ্গ হল তখন সূর্যাস্ত হয়েছে। তার ক্ষীণ আভাটুকু ছড়িয়ে আছে দুর্গস্থিত চিতোর নগরীর বুকে। আঁধার ঘনাতে শুরু করেছে প্রাসাদ নগরীর স্তম্ভ, অলিন্দের আড়ালে। প্রাকার গাত্রে মশাল জ্বালাবার আয়োজন শুরু করেছে রক্ষীর দল, প্রাসাদে দাসীরা সলতে পাকাচ্ছে প্রদীপে, মন্দিরে শুরু হয়েছে সন্ধ্যারতির প্রস্তুতি।

নিদ্রাভঙ্গের পর হাতির দাঁতের পালঙ্কে উঠে বসে গবাক্ষ দিয়ে গোধূলি সমাচ্ছন্ন নগরীর দিকে তাকালেন তিনি। দূরে নগরীর প্রান্তসীমাতে অবস্থিত বিল্ববতীর মহল। যদিও অন্য নানা হর্ম্যরাজির আড়ালে অদৃশ্য সেই ক্ষুদ্র প্রাসাদ, তবুও সেদিকে তাকিয়ে উদয় কল্পনা করার চেষ্টা করতে লাগলেন, বিল্ববতী এখন কী করছে? স্ফটিক পাত্রে ঢেলে রাখছে মহারানাকে আপ্যায়ন করার জন্য রক্তবর্ণের অথবা স্বর্ণাভ মদিরা? মহারানার শরীরে তার অঙ্গের মাদকতা ছড়িয়ে দেবার জন্য মৃগনাভি তৈল মর্দন করছে তার জঙ্ঘায়, কটিদেশে, মৃদঙ্গ সদৃশ নিতম্বে? চন্দনবারি লেপন করছে তার বিল্ববক্ষে? হয়তো তাই।

আজকাল অন্ধকার নামলেই তো মহারানা অমরসিংহের শিবিকা তাকে পৌঁছে দিয়ে আসে বিল্ববতীর মহলে। বিল্ববতীর সঙ্গে সেখানে নিভৃতে রাত্রি যাপন করেন উদয়। রতিক্রীড়া করেন কুসুম বিছানো পালঙ্কে অথবা বিল্ববতীর সঙ্গে চন্দ্রালোকে জলকেলি করেন সেই প্রাসাদ সংলগ্ন ক্ষুদ্র সরোবরে। রাত শেষে যখন শুকতারা ফুটে ওঠে তখন মহারানার শিবিকাবাহকের দল সেখানে আবার উপস্থিত হয় তাকে প্রাসাদে ফিরিয়ে আনার জন্য।

আজও নিশ্চয় তার জন্য প্রতীক্ষা করে থাকবে বিল্ববতী। এ কথা ভেবে নিয়ে কিছু পরে অন্ধকার নামতেই পালঙ্ক ত্যাগ করলেন মহারানা। রোজকার মতো বিল্ববতীর মহলে যাবার প্রস্তুতি শুরু করার জন্যই শয্যা ত্যাগ করেছিলেন মহারানা, কিন্তু পোশাক পরিবর্তনের পর দাসীরা যখন তার গুম্ফে সুগন্ধী লেপন করছে ঠিক তখনই তার মনে পড়ে গেল বিশেষ একটি কথা। সামন্ত সর্দার সেনাপতি শালব্রুমার নেতৃত্বে কিছু সামন্ত সর্দারদের সঙ্গে তাঁর আজ রাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক আছে। আলোচনার বিষয় বেশ গুরুতর।

মোঘল সম্রাট আকবর শাহ নাকি চিতোর অধিকার করতে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়েছেন মরুরাজ্যের দ্বারপ্রান্তে। তার সঙ্গে আছে বিশাল হস্তিবাহিনী আর অগণিত সেনা। আর একপক্ষকালের মধ্যেই হয়তো বা সম্রাট এসে উপস্থিত হবেন চিতোর কেল্লার পাদদেশে। চিতোরের মাটিতে মহাসংগ্রামের নানা ইতিহাস লেখা আছে। লেখা আছে আলাউদ্দিনের চিতোর ধ্বংসের ইতিহাস, কচ্ছের অধিপতি বাহাদুর শাহর চিতোর আক্রমণের ঘটনা, লেখা আছে রাজপুত নরনারীদের আত্মত্যাগের কাহিনি। কিন্তু সে সব বহুকাল আগের ঘটনা। পূর্বতন চিতোর অধিপতি বনবীরের থেকে চিতোর দখল করে সিংহাসন দখলের পর, বিগত কয়েক দশক যুদ্ধের কোনও আঁচ লাগেনি চিতোর নগরীতে। ভোগ বিলাসেই দিন কাটাচ্ছেন মহারানা উদয়, আর শান্তির জীবন কাটাচ্ছে নাগরিকরা। কিন্তু চর মারফত এই সংবাদ শুনে নড়েচড়ে বসেছে মেবারের হিতৈষী সামন্ত সর্দাররা। দীর্ঘদিন যুদ্ধ থেকে দূরে সরে থাকার ফলে সৈনিকদের শরীর মনেও কিছুটা শ্লথতা এসেছে। কিন্তু আকবর নামের ওই দুর্যোগকে প্রতিহত করতে হবে। কীভাবে রাজপুত সেনাবাহিনীকে আবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা যায়, মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াইতে উদ্বুদ্ধ করা যায় তার জন্যই মহারানার সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা সর্দারদের।

কথাটা মনে পড়তেই উদয় উভয় সংকটের মধ্যে পড়ে গেলেন। আলোচনাটা যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ তাতে সন্দেহ নেই। তার সঙ্গে আলোচনার পরই সৈন্যদের এবং অন্যান্য যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রস্তুতি শুরু করবে সর্দাররা। সামন্ত সর্দার শালব্রুমার আবেদনক্রমে সমর নিজেই সর্দারদের সম্মতি দিয়েছেন এই বৈঠকের জন্য। আবার ওদিকে তার জন্য নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে থাকবে প্রিয়তম বিল্ববতী। সামন্ত সর্দারদের সঙ্গে আলোচনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই বিল্ববতীর শরীরের, ভালোবাসার আকর্ষণ এক রাত্রের জন্যও প্রত্যাখ্যান করা মহারানা উদয়ের পক্ষে দুষ্কর। প্রতি রাতে বিল্ববতীর সৌন্দর্য, শরীর-সুধা যেন গণ্ডুষ ভরে পান করেন উদয়। মদিরার নেশা যেমন মদিরা পানের সময় আসন্ন হলে মানুষকে তাড়িত করে, তেমনই অন্ধকার নামলেই বিল্ববতীর শরীরের আহ্বান মহারানার মনকে তাড়িত করে তার মহলে ছুটে যাবার জন্য। মদিরার নেশা অপেক্ষা এ নেশা, এ আহ্বান অনেক বেশি তীব্র।

তার কী করা উচিত ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত একটা সিদ্ধান্ত নিলেন উদয়। তাতে দুকুলই রক্ষা পাবে। তিনি ঠিক করলেন, বিল্ববতীর মহলে গিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসবেন। সর্দাররা প্রাসাদে এলে তাদের নৈশ ভোজের আমন্ত্রণ জানিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হবে। মহারানা কিয়ৎকাল বিল্ববতীর প্রাসাদে তার সঙ্গ লাভ করে প্রাসাদে ফিরে এসে সর্দারদের সঙ্গে মিলিত হবেন নৈশভোজ সহকারে আলাপচারিতাতে। ভাবনাটা মাথাতে আসতেই উদয়সিংহ সেইমতো নির্দেশ দিলেন তাঁর ভৃত্যবর্গকে। সর্দার অমাত্যরা প্রাসাদে এলে তাদের যেন জানিয়ে দেওয়া হয় রানা স্থির করেছেন তাদের সঙ্গে তিনি নৈশভোজ সাঙ্গ করবেন ও সে সময় জরুরি বিষয়ে আলোচনা করবেন। সেই মতো যেন মহারানার জন্য তারা প্রতীক্ষা করেন।

প্রসাধন কার্য সম্পন্ন হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভৃত্যদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করে রক্ষী পরিবৃত স্বর্ণমণ্ডিত দারুকাঠের শিবিকাতে প্রাসাদ ছেড়ে রানা যাত্রা করলেন নগর প্রান্তে বিল্ববতীর মহলের উদ্দেশে।

অন্ধকার নেমে গেছে। দুর্গ প্রাকারে জ্বলে উঠেছে সার সার মশালের আলো। সন্ধ্যারতির ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে চিতরেশ্বরীর মন্দির থেকে। রানা প্রাসাদ ত্যাগ করার কিছু সময়ের মধ্যেই প্রাসাদে এসে উপস্থিত হলেন শালব্রুমা ও অন্য সমস্ত সর্দাররা। মহারানার ভোগবিলাস, নারী প্রীতি সুবিদিত সবার কাছেই। তারা ভেবেছিলেন এই বিপদকালীন পরিস্থিতিতে মহারানা হয়তো সময় রক্ষা করবেন। উদয়সিংহকে দেখতে না পেয়ে তারা মৃদু মনক্ষুন্ন হলেন ঠিকই, কিন্তু তারা প্রতীক্ষা করতে লাগলেন মহারানা কখন ফিরে এসে নৈশভোজে তাদের আহ্বান জানাবেন সে জন্য।

বিল্ববতীর মহলের সামনে মহারানা যখন শিবিকা থেকে নামলেন তখন আকাশে চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। আজ কিছু সময় পরই প্রাসাদে ফিরে যাবেন উদয়। তাই তিনি বিল্ববতীর মহলের বাইরে শিবিকাবাহক আর সঙ্গরক্ষকদের অপেক্ষা করতে বললেন। বিল্ববতীর ক্ষুদ্র মর্মর প্রাসাদে সার সার তেলের প্রদীপ জ্বলছে প্রবেশ তোরণের গায়ের কুলুঙ্গিগুলোতে। উদয়কে স্বাগত জানাবার জন্য প্রতিদিনের মতোই একটা বড় পিতলের প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল বিল্ববতী। মহারানা তার সামনে গিয়ে উপস্থিত হতেই বিল্ববতী প্রথমে নতজানু হয়ে তার চরণ স্পর্শ করল। কিছুটা তফাতে স্বর্ণপাত্রে ফুলমালা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক দাসী। তার থেকে সেই মালা নিয়ে বিল্ববতী তা সমর্পণ করল উদয়ের হাতে। মহারানার কণ্ঠে মালা পরাবার অধিকার বারবনিতার নেই। মহারানা উদয় তাই নিজেই ধারণ করতেন সেই পুষ্পমালিকা। উদয়কে নিয়ে তার মহলে প্রবেশ করল বিল্ববতী। প্রতিদিনের মতো প্রজ্জ্বলিত ধূপ আর চন্দনের সুবাসে মাতোয়ারা মহলের অন্তঃপুর। শ্বেতপাথরের মেঝে ফুলের পাপড়ি শোভিত। পাপড়ি পায়ে মাড়িয়ে বিল্ববতী সেই কক্ষের দিকে এগোতে যাচ্ছিল যেখানে তার সঙ্গে নিশিযাপন করেন মহারানা। কিন্তু মহারানা বললেন ‘আজ আর আমি রাত্রি যাপন করব না। প্রাসাদে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হবে। কিছু সময় এখানে অতিবাহিত করে আমাকে প্রাসাদে ফিরতে হবে। আমরা বরং সরোবরের তীরে এই সময়টুকু অতিবাহিত করি।’

উদয়ের কথা শুনে বিল্ববতী ‘যথা আজ্ঞা’ বলে তাকে নিয়ে এগোল বাটিকার পশ্চাৎভাগে নির্গমন তোরণের দিকে। সেদিকেই প্রাসাদ সংলগ্ন সেই ক্ষুদ্র সরোবর অবস্থান করছে। মহল থেকে বাইরে বেরোবার আগে প্রদীপটা নামিয়ে রাখল বিল্ববতী, তারপর মহারানাকে নিয়ে বাইরে এল। মহলের পশ্চাৎভাগ থেকেই শুভ্র সোপানশ্রেণি নেমে গেছে কাকচক্ষু সরোবরের জলে। আধখানা চাঁদ উঠেছে আকাশে। তার প্রতিবিম্ব ধরা দিচ্ছে জলে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। সেই নিস্তব্ধতা মৃদু ভঙ্গ করে নূপুরের ছমছম শব্দ তুলে হাত ধরে মহারানাকে নিয়ে বিল্ববতী নামতে শুরু করল সোপানশ্রেণি বেয়ে। নিম্নগামী তার প্রতি পদক্ষপে আন্দোলিত হচ্ছে তার বিল্বের ন্যায় স্তন-যুগল।

সোপানশ্রেণির শেষ প্রান্তে জল যেখানে ছুঁয়ে যায় সোপানের শেষ ধাপ, সেখানে ছত্রি সমেত শ্বেতপাথরের বেদি আছে বসার জন্য। সেখানে গিয়ে পাশাপাশি বসল তারা দুজন। শীতল বাতাস উঠে আসছে সরোবরের বুক থেকে। এ বাতাস শরীর জুড়িয়ে দেয়। এই মরুদেশে বর্ষার সামান্য কয়েকটা দিন ছাড়া বৃষ্টি নামে না। তাও সর্বত্র নয়। যতটুকু বা বর্ষা হয় তার প্রতিটা জলকণা শুষে নেয় তপ্ত মরু। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই প্রাচীন কেল্লা পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত হলেও এ ধরনের ছোট বড় বেশ কয়েকটা বৃহৎ পুষ্করিণী বা ক্ষুদ্র সরোবর আছে এই কেল্লা নগরীতে। এই জলের উৎস কি তা কেউ জানে না। এই সব কুণ্ডের জলই নগরবাসীদের তৃষ্ণা মেটায়, রাজপুত্রদের রুক্ষ শরীরকে শীতল করে।

বেশ শান্ত, শীতল পরিবেশ চারদিকে। মহারানা বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ভাবে চেয়ে রইলেন জলের দিকে। এক সময় বিল্ববতী মৃদু অনুযোগের সুরে বলল, ‘মহারানার এমন কী জরুরি সভা যে আজ রাতে তার সেবা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছেন এই দাসীকে?’

মৌনতা ভঙ্গ করে উদয় বললেন, ‘শুনছি দিল্লির বাদশাহ আকবর নাকি চিতোর দখল করতে আসছেন! আর ক’দিনের মধ্যেই তিনি নাকি উপস্থিত হবেন এখানে। যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। সে বিষয়ে আলোচনার জন্য সামন্ত সর্দাররা সমবেত হয়েছেন প্রাসাদে।’

কথাটা শুনে বিল্ববতী বলল, ‘পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত প্রাকারবেষ্টিত এই নগরী তো দুর্ভেদ্য, শত্রুসেনা কীভাবে প্রবেশ করবে এখানে?’ কথাটা শুনে উদয় বললেন, ‘আকবর কোনো ক্ষুদ্র নৃপতি নন। তিনি সম্রাট, বিশাল তার সেনাদল। যদি তিনি তার রণহস্তিদের দিয়ে দুর্গ তোরণ ভেঙে ফেলেন তখন? দখল করেন চিতোর গড়? যেমন করেছিলেন আলাউদ্দিন, করেছিলেন গুর্জরের সুলতান বাহাদুর শাহ।

বিল্ববতী বলল, ‘হঠাৎ বাদশাহর চিতোর অভিযানের কারণ কী?’

উদয় বললেন, ‘আক্রোশ। মালবের পদচ্যুত রাজা আর নরোবরের অধিপতিকে আমি আশ্রয় দিয়েছি মেবারে। রাজ্যভ্রষ্ট হলেও তারা আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেননি। একজন হিন্দুরাজা হয়ে হিন্দু রাজাদের আশ্রয়ের আবেদন আমি ফেরাতাম কীভাবে?’

এ কথা বলার পর মৃদু রসিকতার ছলে উদয় বললেন, ‘ধরো আকবর কেল্লা দখল করল। তখন তুমি কী করবে? তার সঙ্গে দিল্লি চলে যাবে? শুনেছি সম্রাটের আশীর্বাদধন্য বারবানিতারা নাকি বিশাল অর্থ সম্পদের অধিকারিণী। এক এক জনের এমন অর্থ আছে যা এই মরু প্রদেশের অনেক রাজাদের নেই। লোকে বলে বারবনিতারা নাকি আসলে কোনো পুরুষকে নয়, তারা একমাত্র অর্থ সম্পদকে ভালোবাসে। কী করবে তুমি? আমাকে ভুলে গিয়ে কোন মুঘলের বক্ষলগ্না হবে?

উদয়ের কথা শুনে বিল্ববতী তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তেমন হলে আপনার মহিষীরা, রাজ অন্তঃপুরের নারীরা কী করবেন?’

প্রশ্ন শুনে উদয় একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘সম্ভবত মহারানা কুম্ভের প্রাসাদের ভূগর্ভস্থ কক্ষে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে জহরব্রত পালন করবেন। যেমন আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণের সময় কেল্লার পতন হবে বুঝতে পেরে হাজারো হাজারো রাজপুত নারী ওই বিশাল কক্ষে অনির্বাণ অগ্নিকুণ্ডে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। যে কক্ষের ধূলিকণা আজও সংগ্রহ করে বিবাহিত রাজপুত নারীরা তার স্বামীর মঙ্গলকামনায় সিঁথিতে দেবার জন্য, অক্ষয় স্বর্গলাভের জন্য।’

কথাটা শুনে বিল্ববতী একটু আহতভাবে বলল, ‘আপনি তো জানেনই রানা পতিব্রতা রাজপুত নারী ছাড়া সে কক্ষে আমার মতো বারবনিতাদের প্রবেশাধিকার নেই। আমাদের পাদস্পর্শ ঘটলে নাকি অপবিত্র হবে সেই কক্ষ। আমারও দীর্ঘ দিনের বাসনা ছিল ওই কক্ষের পবিত্র ধূলিকণা সংগ্রহের। তেমন কোনো দুর্যোগ ঘটলে ওই কক্ষে আমার প্রবেশাধিকার না থাকলেও ছুরিকা তো আছেই। তা দিয়ে বক্ষ বিদীর্ণ করব।’

এ কথা বলার পর একটু হেসে বিল্ববতী বলল, ‘এ কথা ঠিকই যে গণিকারা অর্থের বিনিময়ে শরীর তুলে দেয়। কিন্তু তাদের মনও থাকতে পারে। বারবনিতা গৃহে যারা আসে তারা শুধু দেহপসারিণীর শরীরের খবর রাখে, মনের খবর রাখে না। তারা ভাবে সবটাই রূপজীবির ছলাকলা। তার মধ্যে যে কোথাও কখনও মনও লুকিয়ে থাকতে পারে সে ধারণা মানুষের থাকে না। মাতৃভূমি সুদূর সেই গান্ধার দেশের কথা আমার আজ কিছুই মনে নেই। এই মরু দুর্গকেই এখন আমি আমার দেশ বলে মনে করি। আমার মতো অনেক গণিকাও ওই একই কথা মনে ভাবে, এ দেশের মাটিকে ভালোবাসে, যাদের নানা দেশ থেকে একদিন এই চিতোরে আনা হয়েছিল।’

মহারানা উদয় তার কথা শুনে মৃদু বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘সত্যি তোমরা এ দেশকে ভালোবাসো?’ প্রশ্নটা করে বিল্ববতীর দক্ষিণ হস্ত নিজের কোলে টেনে নিলেন উদয়।

মহারানার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বিল্ববতী বলল, ‘হ্যাঁ, মহারানা। আমি সামান্য গণিকামাত্র। কিন্তু আপনি আমার প্রতি যে করুণা প্রদর্শন করেছেন তা কখনও পরিশোধ করার নয়। তবু আমি আমার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে সব সময় চেষ্টা করব আপনার পাশে থাকার। প্রয়োজনে আমি অস্ত্র ধরব আপনার জন্য। কুম্ভ প্রাসাদের গর্ভগৃহে আমার প্রবেশাধিকার না থাকতে পারে, কিন্তু কেল্লা রক্ষার্থে অস্ত্র ধরতে তো আমাদের বাধা নেই। জহরব্রত পালন করার সৌভাগ্য লাভ না করতে পারি কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে বুকে তির গ্রহণ করতে তো বাধা নেই।’

উদয়, বারবনিতা বিল্ববতীর কথা শুনে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন তার দিকে। আলাউদ্দিন, বাহাদুর শাহর আক্রমণে বহু যুগ আগে যখন চিতোরে প্রবল দুর্যোগ নেমে এসেছিল তখন মহারানি কর্ণাবতী সহ অন্য অনেক নারী শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন, জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তারা অস্ত্র ধরেছিলেন তাদের স্বামী-পুত্র-পিতা-ভ্রাতাদের রক্ষা করার জন্য। কিন্তু এ নারী তো কারো পত্নী নয়, কন্যা নয়, ভগিনী নয়!

চাঁদের আলো এসে পড়েছে বিল্ববতীর শুভ্র মুখমণ্ডলে, তার শরীরে। তার স্তনের প্রতিবিম্ব ধরা দিচ্ছে সরোবরের জলে। কোনো এক বৃহৎ মৎসরাজ সেই বর্তুলাকার প্রতিবিম্বকে খাদ্যবস্তু ভেবে ঘাই মারল সেই প্রতিবিম্বে। অনেকটা জল ছিটকে উঠে ভিজিয়ে দিল জলাশয়ের কিনারে বসা বিল্ববতীর শরীর। ভেজা বসনে প্রকট হয়ে উঠল বিল্ববতীর স্তনযুগল। তার দিকে তাকিয়ে উদয়ের মনে হল তার পাশে যে বসে আছে সে যেন এক জলপরী। জলাশয়ের গহীন থেকে সে এই মাত্র যেন উঠে এসে বসেছে উদয়ের পাশে! মহারানা তার কটিদেশ আলিঙ্গন করলেন। কী কোমল শরীর বিল্ববতীর। তার ঠোঁট ছুঁয়ে মহারানার চিবুক ধীরে ধীরে নেমে আসতে শুরু করল নীচের দিকে। বিল্ববতী এবার উন্মুক্ত করে দিল তার বক্ষ। আকাশে চাঁদের গায়ে মেঘ ভেসে যাচ্ছিল। হঠাৎ তাকালে মনে হয় চাঁদ যেন চলমান। সেই চাঁদ যেন চলতে চলতে হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হতে শুরু করল। তার সব আলো যেন শুষে নিচ্ছে বিল্ববতীর স্তনখাঁজ, শরীর! উদয়ের ঠোঁট স্পর্শ করল বিল্ববতীর কুচ। বিল্ববতীর বক্ষের মধ্যে ডুবে যেতে লাগলেন মহারানা। বিল্ববতী প্রাচীন বল্কলের মতো মহারানার শরীর থেকে খসিয়ে ফেলতে লাগল বস্ত্রের আচ্ছাদন। এক সময় সোপানশ্রেণির শেষ ধাপ থেকে সরোবরের জলে নেমে এল দুই নর-নারী। সম্পূর্ণ নিরাবরণ তাদের দেহ। জলকেলি শুরু করল তারা। তাদের গোল করে ঘিরে ধরে মৎসকুল দেখতে লাগল সেই দৃশ্য। তারপর সরোবরের থেকে উঠে উদয় বিল্ববতীর সঙ্গে মহলের অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন নিশি যাপনের জন্য।

রাত্রির শেষ প্রহরে শৃগালের ডাকে সম্বিত ফিরল মহারানার। তিনি ভুলেই গেছিলেন তার জন্য প্রাসাদে অপেক্ষা করে আছেন সেনাপতি, অমাত্য, সর্দারের দল। কথাটা মনে হতেই তিনি বিল্ববতীর বাহুডোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে মহল ত্যাগ করে শিবিকায় চেপে দ্রুত রওনা হলেন প্রাসাদের দিকে। আর অনেক আগেই অবশ্য সর্দারদের দল মহারানার জন্য মধ্যরাত পর্যন্ত প্রতীক্ষা করে নৈশ ভোজ না করেই ফিরে গেছেন যে যার গৃহে। উদয় যখন প্রাসাদে প্রবেশ করলেন তখন চাঁদ অস্তমিত। শুকতারা ফুটে উঠেছে। সর্দারদের না দেখতে পেয়ে মহারানা তার শয়নকক্ষে চলে গেলেন।

সূর্যোদয়ের কিছু সময়ের মধ্যেই কিন্তু আবার মহারানার প্রাসাদে হাজির হলেন অমাত্য সর্দারেরা। আগের রাতে বেশ অপমানিত বোধ করেই প্রাসাদ ত্যাগ করেছিলেন তারা। কিন্তু তারা যখন মহারানার প্রাসাদ ত্যাগ করে নিজ নিজ গৃহের দিকে পা বাড়াচ্ছিলেন ঠিক সেই সময় এক অশ্বারোহী চর এসে খবর দিয়েছে আকবর শেষ যেখানে ছাউনি স্থাপন করেছিলেন সেখান থেকে শিবির তুলে ফেলেছেন। অতিদ্রুত তিনি একদল অশ্বারোহী সেনা নিয়ে এগিয়ে আসছেন চিতোরের দিকে। একপক্ষকাল নয়, হয়তো বা আর ছয়-সাত দিবসের মধ্যেই পাহাড়ের পাদদেশে হাজির হবেন সম্রাট। এ সংবাদ স্থির থাকতে দেয়নি শালব্রুমা সহ অন্য অমাত্যদের। দেশের মাটিকে তারা মায়ের মতো ভালোবাসেন, বুক দিয়ে আগলে রাখেন কেল্লাকে। প্রকৃতপক্ষে এই সামন্ত সর্দাররাই মেবারের অভিভাবক। তাই মহারানার প্রতি গত রাতের অভিমান ভুলে তারা আবার রাজপ্রাসাদে ছুটে এসেছেন উদয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য।

শালব্রুমা সহ অন্য সামন্ত সর্দাররা যখন প্রাসাদে এসে উপস্থিত হলেন তখন রাত্রি জাগরণের ফলে মহারানা গভীর নিদ্রামগ্ন। তার নিদ্রাভঙ্গ হয় সূর্যদেব যখন চিতোর কেল্লার মাথার ওপর অবস্থান করেন ঠিক তখন। কিন্তু ততক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। মহারানার সাক্ষরিত আদেশনামা নিয়ে সামন্ত সর্দারদের অতি দ্রুত কেল্লা থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে আশেপাশের ভূস্বামীদের থেকে সেনা, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি সংগ্রহের জন্য।

মহারানার শয়নকক্ষের ঠিক বাইরেই একটি পিতলের তৈরি ঝুলন্ত গোলক আছে। কোনো একান্ত জরুরি পরিস্থিতি হলে সেই তাম্রগোলকে ঘা দেওয়া হয় মহারানার নিদ্রা ভঙ্গ করার জন্য। উদয় মেবারের সিংহাসনে আরোহন করার পর কোনওদিন সে গোলকে ঘা দিয়ে মহারানার নিদ্রা ভঙ্গের প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে শালব্রুমা মহারানার প্রধান ভৃত্যকে গোলোকে ঘা দিতে বললেন। পাছে মহারানা কুপিত হন সে কথা ভেবে ভৃত্য প্রথমে ঘা দিতে ইতস্তত করছিল। কিন্তু শালব্রুমা একে প্রধান সেনাপতি, তার ওপর তিনি আবার কন্যাদান করেছেন মহারানাকে। শালব্রুমা-কন্যা মহারানার অন্যতম মহিষী। কাজেই তিনি যখন দ্বিতীয়বার ভৃত্যকে গোলকে ঘা দিতে বললেন তখন আর তার নির্দেশ অমান্য করতে পারল না। কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে সে ঘা দিল গোলকে। ঝমঝম শব্দে মহল আলোড়িত করে বেজে উঠল সেই গোলক। বার কয়েক গোলকে ঘা দেবার পর মহারানার নিদ্রাভঙ্গ হল। পালঙ্কে উঠে বসে তিনি চাইলেন দ্বারের দিকে। মখমলের পর্দা সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল খাস ভৃত্য। মহারানাকে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে ভৃত্য বলল ‘আমাকে মার্জনা করবেন মহারানা। সেনাপতি শালব্রুমা আমাকে গোলকে ঘা দিতে বাধ্য করলেন। সেনাপতি ও সর্দাররা মন্ত্রণা কক্ষে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। বিল্ববতীকে নিয়েই একটা সুখস্বপ্ন দেখছিলেন উদয়। স্বপ্নভঙ্গ হওয়াতে মৃদু রুষ্টভাবেই ঘুম জড়ানো চোখে তিনি শয্যা ত্যাগ করলেন।

মহারানা সোজা গিয়ে হাজির হলেন মন্ত্রণাকক্ষে। গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য এ কক্ষে কোনো গবাক্ষ নেই। শুধু একটি মাত্র প্রবেশদ্বার। মশাল জ্বলছে কক্ষে। সেখানে শালব্রুমা সহ জনা সাতেক সর্দার অপেক্ষা করেছিলেন মহারানার জন্য। মাথা ঝুঁকিয়ে প্রথামাফিক মহারানাকে সম্মান প্রদর্শন করলেন তারা। মহরানার চোখে তখনও ঘুম জড়ানো। নিজের আসন গ্রহণ করলেন উদয়।

এক সর্দার মহারানার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনার নিদ্রাভঙ্গের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। গত রাতে চর খবর এনেছে বিধর্মী বাদশাহ তার পূর্বতন শিবির তুলে ফেলে অশ্বারোহীবাহিনী নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে চিতোরের দিকে। আর ছয়-সাত দিবসের মধ্যেই হয়তো চিতোর তোরণে পৌঁছে যাবে সেই নরাধম। আমাদের হাতে আর সময় নেই। এখনই যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে।’

উদয় তার কথা শুনে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘তার জন্য আমার নিদ্রাভঙ্গের প্রয়োজন কী ছিল? আপনারাই তো যা ব্যবস্থা গ্রহণ করার তা করতে পারেন।’

শালব্রুমা বললেন, ‘প্রয়োজন আছে। পার্শ্ববর্তী নৃপতি, ভূস্বামীদের কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে লোক পাঠাতে হবে। তার জন্য আপনার পাঞ্জার ছাপের প্রয়োজন। সেগুলো প্রস্তুত করে এনেছি।’

কথাটা শুনে উদয় নিষ্পৃহ ভাবে বলে উঠলেন, ‘কী আছে দিন? করে দিচ্ছি।’ তখনও উদয়ের চোখে বিল্ববতীর সুখস্বপ্নের রেশ লেগে আছে।

একজন অমাত্য এরপর মহারানার হস্তে ভূষাকালি লেপন করলেন। মহারানা তার পাঞ্জার ছাপ দিতে লাগলেন আদেশনামাতে।

এ কাজ মেটার পর মহারানা বললেন, ‘এবার তবে আমি ফিরে যাই?’

শালব্রুমা বললেন, ‘তার আগে একটা অনুরোধ আছে মহারানার কাছে।’

‘কী অনুরোধ?’ জানতে চাইলেন উদয়।

প্রৌঢ় সেনাপতি শালব্রুমা নিজের শুভ্র শ্মশ্রুতে হস্ত চালনা করে বললেন, ‘দিবা হোক বা রাত্রি, আজ থেকে মহারানা যেন এ প্রাসাদ ত্যাগ না করেন। যে কোনো সময় মহারানার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের প্রয়োজন হতে পারে।’

শালব্রুমার কথার অন্তর্নিহিত বক্তব্য স্পষ্ট। অর্থাৎ মহারানা যেন বিল্ববতীর মহলে রাত্রি যাপন করতে না যান। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? সেনাপতির কথা শুনে তাই উদয় বললেন, ‘প্রাসাদ ত্যাগ করলেও আমি তো নগরী ত্যাগ করি না। আমি কোথায় রাত্রিবাস করি তা আপনাদের জানা। রাত্রি কালে তেমন কোনো জরুরি প্রয়োজন হলে আপনারা সেখানে গিয়েও আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন।’

সামন্তদের ওপর রাজ্য চালনার যাবতীয় দায়িত্ব অর্পণ করে মহারানা এত দিন অতিবাহিত করেছেন ভোগবিলাস নারী আর সুরা নিয়ে। কিন্তু শিয়রে যখন সমন তখনও মহারানার এত নিস্পৃহতা! বারবণিতার প্রতি এত আসক্তি! আর ওই বিল্ববতী নামের গণিকার জন্যই যে তার কন্যা মহারানার সঙ্গ লাভ থেকে বঞ্চিত তাও শালব্রুমা জানেন। মহারানা গত রাতেও বিল্ববতীর মহলে গিয়ে অমাত্যদের মিথ্যা অপেক্ষা করিয়ে তাদের কার্যত অপমানিত করেছেন। মহারানা উদয় সিংহের কথা শুনে সেনাপতি শালব্রুমা আর নিজের ক্ষোভ ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন, ‘আমাকে মার্জনা করবেন রানা। আমি সদবংশজাত ক্ষত্রিয়। একলিঙ্গদেব আর চিতোরেশ্বরীর মন্দিরে পূজা না দিয়ে আমি অন্ন স্পর্শ করি না। আমি গণিকা গৃহে বা বেশ্যালয়ে গমন করি না।’

মহারানার মুখের ওপর এই কথা বলার সাহস হয়তো অন্য কেউ দেখাতে পারতেন না। শালব্রুমা প্রধান সেনাপতি। তাছাড়া তিনি কন্যাদান করেছেন রানাকে। সে জন্যই হয়তো বা তিনি এই সংকটময় পরিস্থিতিতে কথাটা বলে ফেলেছেন।

মহারানা প্রথমে ভাবলেন তিনি হয়তো ঘুম চোখে শালব্রুমার কথাগুলো ঠিক শোনেননি। কারণ তাকে এ কথা বলার স্পর্ধা কারো নেই। তাই উদয়, শালব্রুমাকে বললেন, ‘কী বললেন? আবার বলুন।’

শালব্রুমা আবারও একই কথা বললেন তার উদ্দেশে।

তবে শালব্রুমা নিজেকে সদবংশজাত বললেও তার কথার এ উদ্দেশ্য ছিল না যে মহারানা অসদ বা নীচ বংশজাত। কিন্তু এই ব্যাপারটাই কানে ধরল মহারানার। তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল তার। উদয় ব্যঙ্গ ভরে শালব্রুমাকে বললেন, ‘এতই যখন বংশগরিমা তখন নীচ বংশজাতর হাতে কন্যা সম্প্রদান করেছিলেন কী অভিলাষে? কোন সদবংশজাত সৈনিকের হস্তেই কন্যা সমর্পণ করতে পারতেন। চিতরেশ্বরের সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে নিজের আভিজাত্য বাড়াবার লোভ সম্বরণ করতে পারেননি কেন?’

এ কথা বলার পর উদয় মৃদু চুপ করে থেকে আবার বললেন, ‘শুনুন সেনাপতি। এবার থেকে যদি আপনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান তবে আপনাকে তা ওই বিল্ববতীর মহলে গিয়েই করতে হবে। আর আপনি যদি সেখানে যেতে অপারগ হন, যদি যুদ্ধে যেতে না চান তবেও বিশেষ সমস্যা তৈরি হবে না। আপনি যাদের বারবণিতা বলে ঘৃণা করছেন, প্রয়োজন হলে তারাই অস্ত্র ধরবে চিতোর রক্ষার জন্য। তারাই যুদ্ধ জয় করবে।’

মহারানা উদয়ের হয়তো বিল্ববতীর বলা কথাগুলো মনে পড়ে গিয়েছিল। তাই তিনি শেষের কথাগুলো বললেন।

এত অপমান! কাঁপতে শুরু করলেন প্রায়-বৃদ্ধ শালব্রুমা। ক্রোধে মহারানার আঙুলগুলোও কাঁপছে। শালব্রুমার বদলে অন্য কেউ হলে হয়তো মহারানা এখনই তাকে চিতোর ত্যাগ করার নির্দেশ দিতেন। অন্য সর্দাররা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হতবাক মহারানা ও তার প্রধান সেনাপতির কথোপকথন শুনে।

শালব্রুমা শেষ পর্যন্ত কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘তবে তাই হোক। আপনি আপনার বারবণিতাদের নিয়েই যুদ্ধে অবতীর্ণ হোন। তারা যদি পরাজিত হয় তখন না হয় আমাকে আবার ডাকবেন। আমি প্রস্তুত হয়ে রইলাম।’

উদয় বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই ডাকব। তবে যুদ্ধ করার জন্য নয়, বিল্ববতীর প্রাসাদে যুদ্ধ জয়ের উৎসব পালন করার জন্য। আমন্ত্রণ রক্ষা করবেন কিন্তু।’

মহারনার সঙ্গে আর বাক্যালাপ না করে অপমানিত শালব্রুমা মন্ত্রণাকক্ষ ত্যাগ করলেন। আর উদয়ও ফিরে গেলেন তার নিজের কক্ষে।

চিতোরে যখন এ ঘটনা ঘটল তখন সত্যি কিন্তু ধাবমান অশ্বপৃষ্ঠে মেবারের রাজধানীর দিকে এগোচ্ছিলেন আকবর। পাথুরে মাটির সঙ্গে ঘোড়ার নালের সংঘর্ষে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ উঠছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন বিজুরি চমকাচ্ছে ধাবমান অশ্ববাহিনীর পায়ে। এই অগ্রবর্তী বাহিনীতে পাঁচশত অশ্বারূঢ় সেনা। তাদের পশ্চাতে আসছে হস্তিবাহিনী ও পদাতিক সেনারা। প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে আকবরের বুকে। ধ্বংস করতে হবে মেবারের রাজধানী চিতোরগড়। রানা উদয় সিংহকে সম্রাটের সামনে নতজানু হয়ে জীবন ভিক্ষা করাতে হবে, যেমন করেছে অন্য রাজপুত রাজারা। কিন্তু কেন এই অদম্য প্রতিশোধ স্পৃহা মাত্র তেইশ বৎসর বয়সি যুবক সম্রাটের মনে? এর পশ্চাতে ক্ষুদ্র এক কাহিনি আছে।

শেরশাহ মুঘল পরিবারের গৃহবিবাদের সুযোগ নিয়ে দিল্লির সিংহাসন থেকে সম্রাট হুমায়ূনকে বিতাড়িত করে পাঠান সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। রাজ্যভ্রষ্ট হুমায়ূন যখন তার পরিবারের সদস্য ও সামান্য কিছু অনুচর নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন অমরকণ্টক পর্বতের অরণ্যভূমিতে আকবরের জন্ম হয়। রাজ্যচ্যুত হুমায়ূনের সদ্যজাত সন্তানকে নিয়ে তখন এক ভয়ঙ্কর অসহনীয় অবস্থা। যেখানেই তিনি যান না কেন তার পিছনে তাড়া করে বেড়াচ্ছে পাঠান সেনা। শত্রুর কোনো শেষ রাখতে নেই। হত্যা করতে হবে হুমায়ূনকে। আর ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা ভেবে হত্যা করতে হবে তার শিশুপুত্রকে।

ভিস্তিঅলার জল রাখার চর্ম থলির মধ্যে সদ্যজাত শিশুপুত্রকে লুকিয়ে পথ অতিক্রম করছেন বেগম হামিদাবানু, পাছে দূর থেকে ঘাতকের তির এসে সন্তানকে বিদ্ধ করে সেই আশঙ্কাতে। পাঠান সম্রাটের ভয়ে ভারতের কোনো রাজারা যখন হুমায়ূনকে আশ্রয় দিতে সম্মত হল না তখন হুমায়ূন বাধ্য হয়েই রওনা হলেন মরুস্থলীর দিকে। যদি কোনো মরু রাজ্যের রাজা অন্তত তার শিশুপুত্রের জীবন রক্ষার কথা ভেবে তাকে আশ্রয় দেন। কিন্তু সেখানেও তখন একই অবস্থা। যোধপুর, জয়শালমের, ভাট্টি, কোনো মরুরাজাই হুমায়ূনকে আশ্রয় দিতে রাজি হল না।

পাঠানরা সাধারণত মরু রাজ্যের দিকে পা বাড়ায় না। কী দরকার হুমায়ূনকে আশ্রয় দিয়ে পাঠানদের মরুস্থলীতে ডেকে আনার? রাজ্যের শান্তি বিঘ্নিত করার। নানা মরুরাজ্য থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে অবশেষে একদিন মালবরাজ মালদেবের কাছে আশ্রয়প্রার্থী হলেন হুমায়ূন। ধূর্ত মালদেব এক কূট কৌশলের সিদ্ধান্ত নিলেন। আশ্রয় দেবার নাম করে পরিবার সহ হুমায়ূনকে বন্দি করে তুলে দেবেন পাঠান সম্রাটের হাতে। আর তার বিনিময়ে সম্রাটের থেকে পাবেন প্রচুর সম্পদ।

এক দুর্গে হুমায়ূনকে আশ্রয় দিলেন মালদেব। তারপর সে খবর পাঠান সম্রাটকে পৌঁছে দেবার জন্য দিল্লির উদ্দেশে চর পাঠালেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে ব্যাপারটা জানতে পেরে গেলেন হুমায়ূন। রাতের অন্ধকারে দুর্গ থেকে পালিয়ে অজানা পথে রওনা হয়ে গেলেন। তারা গিয়ে উপস্থিত হলেন মরুভূমিতে। সেখানে কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই, জীবনের স্পন্দন নেই, এক ফোঁটা জল নেই, বালু সমুদ্রের ওপর অগ্নিশিখা বর্ষণ করে প্রখর মরুসূর্য। মরুভূমির সেই ভয়াল রূপ দেখে আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন হামিদাবানু। কীভাবে তিনি রক্ষা করবেন তার সন্তানকে?

তবে শেষ রক্ষা হয়েছিল, বলা যেতে পারে নিতান্ত ভাগ্যের জোরেই সেই মরুভূমি থেকে মুক্ত হয়েছিলেন আকবর পিতা হুমায়ূন। আশ্রয় পেয়েছিলেন অমরকণ্টকেরই এক গুপ্ত স্থানে। তারপর নানা ঘটনাপ্রবাহ। ভাগ্য-দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই পিতা-পুত্রের। কখনও গান্ধার-কাশ্মীর জয়, আবার কখনও পালিয়ে যাওয়া পিতৃভূমি তাতারে। অসীম কষ্ট সহ্য করে বেড়ে ওঠা আকবরের। কখনও খাদ্যাভাবে ঘাস সিদ্ধ করে খাওয়া, কখনও বা কান্দাহারে প্রবল শীত থেকে বাঁচার জন্য উন্মুক্ত আকাশের নীচে ভেড়াকে জড়িয়ে শুয়ে থাকা। আর এর মধ্যে দিয়েই বালক আকবরকে অস্ত্রশিক্ষায় পারদর্শী করে তুলছিলেন হুমায়ূন। বালক আকবরই তখন হুমায়ূনের আশার শেষ চিরাগ।

ব্যর্থ হয়নি হুমায়ূনের আকাঙ্ক্ষা। শেষ পর্যন্ত আকবরের তরবারিই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল সেকেন্দর শাহর পাঠান বাহিনীকে। বালক পুত্রের তরবারির জোরে আবার দিল্লির মসনদ ফিরে পেলেন হুমায়ূন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি বেশি দিন সিংহাসন ভোগ করতে পারলেন না। পাঠাগারের মঞ্চ থেকে পড়ে মৃত্যু হল হুমায়ূনের।

সিংহাসনে বসলেন আকবর। এরপরও কিন্তু আকবরকে দুর্যোগ পোহাতে হয়েছিল। অল্প দিনের মধ্যেই হাতছাড়া হয়ে গেছিল দিল্লি এবং আগ্রা। কিন্তু বৈরাম খাঁর সাহায্যে আবার তা পুনঃদখল করেছেন যুবক সম্রাট। সারা ভারতে বিস্তার করেছেন তার আধিপত্য। পিতার মুখে আকবর শুনেছিলেন যে হুমায়ূনের জীবনের কঠিনতম দিন ছিল মালদেবের চক্রান্তের হাত থেকে তার শিশুপুত্রকে রক্ষা করা। যে কোনো মুহূর্তেই সেখানে মৃত্যু নেমে আসতে পারত আকবরের জীবনে। আর মালদেবই সেই অবর্ণনীয় কষ্টের জন্য দায়ী ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মালদেবের সেই শঠতার প্রতিশোধ নেবার দায় বর্তেছে আকবরের ওপর।

মালদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেছিলেন তিনি। দখল করেছেন তার রাজ্য। মারবার ও অম্বর রাজ্যও তিনি ইতিমধ্যেই দখল করেছেন। কিন্তু এতদিন তিনি মেবারের দিকে হাত বাড়াননি। কিন্তু যেদিন খবর পেলেন রাজ্যভ্রষ্ট মালদেবকে উদয় সিংহ আশ্রয় দিয়েছেন সেদিন আর চুপ করে বসে থাকা সম্ভব হয়নি। বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন মালদেবের আশ্রয়দাতা উদয় সিংহের রাজধানী দখলের উদ্দেশে। আকবর ছুটে আসছেন চিতোরের দিকে।

সকাল বেলা মন্ত্রণা কক্ষ থেকে ফিরে আর ঘুম এল না উদয়ের। ক্রোধ ধীরে ধীরে প্রশমিত হবার পর উদয় বুঝতে পারলেন, যা ঘটেছে তা অভিপ্রেত নয়। বিশেষত এই সংকটময় পরিস্থিতিতে শালব্রুমাকে তিনি কথাগুলো না বললেই পারতেন। যদিও তাকে উত্তেজিত করার পিছনে শালব্রুমার অপমানজনক বক্তব্য অনেকাংশে দায়ী। শালব্রুমা বার্ধক্যের দিকে এগোচ্ছেন, হয়তো সেই কারণেই জামাতা আর মহারানার মধ্যে ব্যবধান ভুলে গেছিলেন তিনি। রাজা, মহারানা বা সম্রাটরা যখন ক্ষমতায় থাকেন তখন তারা কারো পিতা-ভ্রাতা-পুত্র-জামাতা নন, তারা শাসক, দেশের সর্বময় কর্তা, প্রভু। আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেও তাদের সঙ্গে বাক্যালাপের সময় তাকে দেশের সর্বময় কর্তার মর্যাদাই দিতে হয়, যা লঙ্ঘন করেছেন শালব্রুমা।

কিন্তু কী উপায় হবে এখন? আকবরের নেতৃত্বে তার যবন সেনা এগিয়ে আসছে চিতোর আক্রমণের জন্য। কথা আর তির একবার ছুটে গেলে তাকে আর ফেরানো যায় না। সেনাপতি শালব্রুমাকে ডেকে পাঠালে তিনি হয়তো আসবেন, কিন্তু তাতে মাথা নত হবে মহারানার। শালব্রুমার সাহায্যে হয়তো যুদ্ধে মহারানা জয় লাভ করবেন কিন্তু তাতে মহারানার সম্মান রক্ষা হবে না। নিভৃতকক্ষে বসে মহারানা এই সংকট থেকে মুক্তিলাভের উপায় খুঁজতে লাগলেন। সময় এগিয়ে চলল, সূর্যদেব এক সময় চিতোর নগরীর ঠিক মথার ওপর উঠলেন তারপর এগিয়ে চললেন পশ্চিমের দিকে। দ্বিপ্রহরের আহার সাঙ্গ করে উদয় আবার ভাবতে বসলেন। কিন্তু তিনি কোনো উপায় খুঁজে পেলেন না। কীভাবে তিনি প্রতিহত করবেন আকবরের আক্রমণ? চিতোর কেল্লার পরিত্যক্ত প্রাচীন রাজপ্রাসাদ-কুম্ভপ্রাসাদের মাথায় দিনের শেষ আলো ছড়িয়ে সূর্যদেব যখন দুর্গ প্রাকারের আড়ালে পরিক্রমণ শেষ করলেন তখন গাত্রত্থান করলেন মহারানা।

প্রতিদিনের মতোই দাসীর দল এদিনও দ্বার প্রান্তে উপস্থিত হয়েছে মহারানাকে চন্দনচর্চিত করে নতুন পট্টবস্ত্রে অলঙ্কারে সজ্জিত করার জন্য। প্রাসাদের ভিতর মর্মর আচ্ছাদিত প্রাঙ্গনে শিবিকা ও অঙ্গরক্ষীরা প্রস্তুত মহারানার অভিসার গমনের জন্য। মহারানা উদয় যখন প্রাসাদ ত্যাগ করে বিল্ববতীর মহলের দিকে যাত্রা করলেন তখন আঁধার নেমে এসেছে। দুর্গ প্রাকারে মশালের আলো জ্বলে উঠেছে। তবে এদিন যেন পথ ঘাটের পরিবেশ একটু অন্যরকম মনে হল মহারানার। সারাদিন প্রচণ্ড দাবদাহতে পুড়তে থাকে কেল্লা। নিতান্ত প্রয়োজন ব্যতিরেকে সাধারণ মানুষরা নিজেদের গৃহ ছেড়ে বাইরে আসে না মরু সূর্য্যের প্রচণ্ড প্রখরতা থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য। কিন্তু সূর্যাস্তের পরই পরিবেশের পরিবর্তন হয়। বিশেষত অন্ধকার নামার পর এ সময়টাই সর্বাপেক্ষা মনোরম।

মহারানা কুম্ভের প্রাচীন প্রাসাদের সন্নিকটে চিতোরের সব থেকে বড় জলাশয় গোমুখ কুণ্ড ও দুর্গ নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা কুম্ভ-জলাশয় থেকে শীতল বাতাস প্রবাহিত হয়। সান্ধ্যপ্রদীপ জ্বালাবার পর চিতোরবাসীরা গৃহ থেকে পথে নামে। তাদের কেউ যায় চিতোরেশ্বরী অথবা কুম্ভশ্যাম মন্দিরে সন্ধ্যারতি দেখতে, কেউ বা মেতে ওঠে নানা আমোদ প্রমোদে, গমন করে পাশা খেলতে অথবা বেশ্যালয়ে। রাজপথের পাশে তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে পণ্য সাজিয়ে বসে বিক্রেতারা। চলমান সুরা ব্যবসায়ী চর্ম থলি অথবা ধাতব কলসে সুরা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, পিষ্টক বিক্রেতা আর মালিকার দল পথে নামে তাদের পসরা নিয়ে। আলোতে, জনতার কোলাহল উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ থাকে পথঘাট। এদিন কিন্তু শিবিকার ভিতর থেকে বাইরে তাকিয়ে চারপাশ অন্য দিনের তুলনায় বেশ ফাঁকাই মনে হল উদয় সিংহর। আসন্ন দুর্যোগের পূর্বাভাস পেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে চিতোরবাসী। তাদের অধিকাংশই কীভাবে তাদের প্রাণ সম্পদ রক্ষা হবে তা নিয়ে শলা করছেন নিজ গৃহে বসে। দোলায় দুলতে দুলতে চিন্তিত মহারানা এক সময় গিয়ে হাজির হলেন নগরপ্রান্তে বিল্ববতীর ক্ষুদ্র প্রাসাদের সমুখে।

শিবিকা ত্যাগ করে পদব্রজে বিল্ববতীর মহলের প্রবেশ তোরণের দিকে এগোলেন উদয়। প্রতিদিনের মতোই তোরণদ্বার, মহল সেজে উঠেছে চিতোর নরেশকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। অঙ্গে সুগন্ধী লেপন করে স্বচ্ছ বক্ষ আবরণী, পট্টবস্ত্র, স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিত বিল্ববতী দাসীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহারানার প্রতীক্ষাতে। মহারানা মহলের প্রবেশ দ্বারে উপস্থিত হবার পর তাকে ফুলমালা সুগন্ধীতে বরণ করে বিল্ববতী তাকে নিয়ে চলল মহারানা যে কক্ষে নিশি যাপন করবে সেই কক্ষে।

বিল্ববতীর সঙ্গে কক্ষে প্রবেশ করলেন উদয়। মৃগনাভির সুগন্ধে মাদকতাময় পরিবেশ রচিত হয়েছে কক্ষের ভিতর। রূপোর প্রদীপ দণ্ডের ওপর একটা বিরাট ঘৃত প্রদীপ জ্বলছে। চন্দনকাঠের বিশাল পালঙ্কের ওপর সোনার সুতোয় বোনা মখমলের আচ্ছাদন, রাজহংসের পালকের নরম তাকিয়া, মিনা করা মরালগ্রীবার মতো সুরাপাত্র, স্ফটিকের পানপাত্র, তাম্বুলের স্বর্ণপাত্র, মহারানার সুখভোগের জন্য আরও নানা ধরনের উপাচারে সজ্জিত সে কক্ষ। পালঙ্কের মাথার ওপর বিরাট একটা ঝালরপাখা ঝুলছে। রজ্জু দ্বারা কক্ষের বাইরে থেকে এক দাসী বাতাস করছে সেই ঝালর দিয়ে।

পালঙ্কে উপবেশন করে মহারানা পানপাত্রের দিকে তাকালেন। বিল্ববতী ইঙ্গিত বুঝতে পেরে সেই স্ফটিক পাত্র স্বর্ণাভ মদিরাতে পরিপূর্ণ করে মহারানার হস্তে সমর্পণ করল। খাটের ছত্রিতে হেলান দিয়ে বসে মদিরার পাত্র নিঃশেষ করে বিল্ববতীর দিকে সেটা আবার পুনরায় পূর্ণ করার জন্য এগিয়ে দিলেন মহারানা। স্ফটিকের পানপাত্র দ্বিতীয়বার মদিরাপূর্ণ হলে সেটাতে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে শুরু করলেন তিনি। স্বর্ণাভ মদিরাপূর্ণ স্ফটিক পাত্র মাঝে মাঝে ঝিলিক দিচ্ছে প্রদীপের আলোতে। সেই আলো এসে পড়েছে মহারানার মুখমণ্ডলেও। সে মুখের দিকে তাকিয়ে বিল্ববতী স্পষ্ট বুঝতে পারল তাতে জেগে আছে দুঃশ্চিন্তার ছাপ।

‘আজ কোন কারণে চিন্তাগ্রস্ত? আজ কেমন যেন আনন্দহীন মনে হচ্ছে মহারানাকে?’

প্রশ্ন শুনে মহারানা উদয় ইশারায় তার পাশে বসতে বললেন বিল্ববতীকে। নির্দেশ পালন করল বিল্ববতী। মহারানা এক চুমুকে মদিরার পাত্র নিঃশেষ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, গভীর দুশ্চিন্তাগ্রস্থ আমি। আর কয়েকদিনের মধ্যে চিতোরে এসে আছড়ে পড়বে আকবরের অশ্বারোহী বাহিনী। কিন্তু সেনাপতি শালব্রুমাও যুদ্ধে যোগ দিচ্ছেন না। সংকট থেকে মুক্তি লাভের কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না আমি।’

‘কেন, তিনি যোগ দেবেন না কেন?’ জানতে চাইল বিল্ববতী।

মহারানা উদয় এবার সব ঘটনা বিস্তৃতভাবে প্রকাশ করলেন গণিকা বিল্ববতীর কাছে। মহারানার কথা শুনে বিল্ববতী বলল, ‘আপনি বলেছেন গণিকারাই আপনাকে যুদ্ধে জয়লাভ করাবে আকবরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে!’

মহারানা ম্রিয়মান ভাবে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ। হয়তো বা তোমার বলা কথাগুলো আমার মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। আর সে কথা শোনোতেই মনে হয় সব থেকে বেশি অপমানিত বোধ করেছেন সেনাপতি।’

মহারানার কথা শুনে বেশ কিছু সময় নিশ্চুপ ভাবে বসে রইল বিল্ববতী। তারপর হঠাৎ সে প্রশ্ন করল সম্রাটের সেনাবাহিনীর সংখ্যা কত?

উদয় জবাব দিলেন, ‘শুনেছি, পদাতিক আর অশ্বারোহী বাহিনী মিলে পাঁচ সহস্র। তবে পাঁচশত অশ্বারোহী সেনা নিয়ে প্রথমে উপস্থিত হতে চলেছেন আকবর। আর তার কয়েক দিনের মধ্যে তার সঙ্গে এসে মিলিত হবে তার পদাতিক বাহিনী, হস্তিকুল আর কামানবাহী উষ্ট্রশকট।’

মহারানার জবাবের পর আবারও কিছুক্ষণ বিল্ববতী কী যেন ভাবল। তারপর সে বলল, ‘দুশ্চিন্তা মুক্ত হন মহারানা। আপনার মুখের কথাই সত্যি হবে।’

বিল্ববতীর কথা বুঝতে না পেরে মহারানা উদয় বললেন, ‘সত্যি হবে মানে?’

বিল্ববতী বলল, ‘এই চিতোর নগরীতে এক সহস্র গণিকা আছে। তারা অস্ত্র ধরবে আপনার জন্য, পরাস্ত করবে যবন সম্রাটকে।’

এত সংকটময় পরিস্থিতিতেও এই নারীর কথা শুনে হাসি সম্বরণ করতে পারলেন না মহারানা। শিশুসুলভ কথা বলছে বিল্ববতী। তিনি বিল্ববতীর কটিদেশ আলিঙ্গন করে হেসে বললেন, ‘এ কথা হয়তো সত্যি যে তুমি আমার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে পারো। কিন্তু তা বলে প্রমীলা বাহিনী নিয়ে আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ! আকবরের মতো রণকৌশলী, নিপুণ যোদ্ধা ভারতবর্ষে কেউ নেই। সদ্য যৌবনে পদার্পণ করলেও এরই মধ্যে সে সারা ভারতবর্ষ জয় করে নিয়েছে। তার বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র নারী বাহিনী কী করবে? হয়তো একটা খণ্ডযুদ্ধ হবে। অথবা বালকের দল যেমন যুদ্ধ ক্রীড়ায় লিপ্ত হয় তেমন কিছু একটা। তোমরা বন্দি হবে মোগল সেনার হাতে। তারপর তারা তোমাদের দিয়ে কামজ্বালা মেটাবে। আঁচড়ে কামড়ে শেষ করবে তোমাদের দেহ।’

এ কথা বলে মহারানা আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। চিন্তার মেঘ যেন ঘিরে ধরল তাকে। তিনি বললেন, ‘তোমার ভবিষ্যৎ নিয়েও আমি শঙ্কিত। সেনাপতি শালব্রুমা যদি সত্যিই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে যোগ না দেন তবে আমার অনুগত সর্দার দিয়ে আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব আমি। পাহাড়ের ওপর প্রাকারবেষ্টিত চিতোর নগরী। ওপরে ওঠার একটাই মাত্র পথ। হয়তো বা সম্রাটের ওপরে উঠে আসা সহজ হবে না।

‘কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমরা যদি পরাজিত হই তবে কী হবে?’

‘শোনো বিল্ববতী, আরাবল্লী পর্বতের পাদদেশে পিছোলা হ্রদের তীরে আমার একটা প্রাসাদ আছে। ভিল উপজাতি অধ্যুষিত সে জায়গা এখানে থেকে বেশ দূরে এবং নিরাপদ স্থান। আকবর চিতোরে এসে উপস্থিত হবার আগেই আমি তোমাকে কয়েকজন রক্ষীর সঙ্গে সেখানে পাঠিয়ে দেব। যুদ্ধে যদি আমি জয়লাভ করি তবে তুমি আবার এখানে পদার্পণ করবে। আর যুদ্ধের পরিস্থিতি, ফলাফল যদি আকবরের অনুকূলে যায় তবে চিতোর কেল্লা ত্যাগ করে আমি পিছোলা হ্রদের তীরে তোমার সঙ্গে মিলিত হব। সেখানেই আমি আমার রাজধানী গড়ে তুলব।’

বিল্ববতী বলল, ‘না মহারানা। আপনাকে রেখে চিতোর ত্যাগের কোনো প্রশ্নই নেই। আপনি বৃথাই চিন্তিত হচ্ছেন। সে পরিস্থিতির সম্মুখীন আপনাকে হতে হবে না। আপনার সেবাদাসী বিল্ববতীর ওপর ভরসা রাখুন মহারানা। আপনার সেনাপতি শালব্রুমাকে আমি বুঝিয়ে দেব, ভাগ্যের ফেরে আমি বারবণিতা ঠিকই, কিন্তু এই বারবণিতাই চিতোর রক্ষা করতে পারে।’

মহারানা উদয় বিল্ববতীর শিশুসুলভ কথার জবাবে কী বলবেন তা বুঝে উঠতে পারলেন না। মহারানার হাত দুটে জড়িয়ে ধরে বিল্ববতী আবারও বলল, ‘আমার ওপর ভরসা রাখুন মহারানা, বিশ্বাস রাখুন। আকবরকে আমি পরাজিত করবই।’

এতদিন বিল্ববতীর কথার মধ্যে শুধু প্রেম-ভালোবাসার কোমলতাই শুনেছেন উদয়, আজ যেন অন্য এক দৃঢ়তা বিল্ববতীর কণ্ঠে। ব্যাপারটা উপলব্ধি করে মহারানা একটু আমতা আমতা করে বললেন, ‘কিন্তু কীভাবে? আকবরের তুর্কি তরবারির সামনে সারা ভারতের রাজা-সুলতানরা দাঁড়াতে পারছে না। সে তরবারীর সামনে দাঁড়াবার জন্য তোমার অস্ত্র কোথায়?’

বিল্ববতী বলল, ‘অস্ত্র আছে মহারানা। ও সব নিয়ে আপনি ভাববেন না। তবে মহারানার কাছে একটা অনুরোধ আছে সেবিকার।’

‘কী অনুরোধ?’ জানতে চাইলেন উদয়।

বিল্ববতী বলল, ‘যুদ্ধে জয়লাভ করে ফিরে আসার পর কুম্ভপ্রাসাদের ভূগর্ভস্থ প্রাচীন কক্ষে জহরব্রত পালন করা নারীদের পবিত্র চিতাভস্ম মিশ্রিত যে ধূলিকণা আছে যা সংগ্রহ করার অধিকার দিতে হবে আমাদের।’

মহারানা একটু চুপ থেকে বললেন, ‘যদি সত্যিই তুমি আকবরকে পরাজিত করতে পরো তবে সে অধিকার তুমি পাবে। কিন্ত ও ধূলিকণা তো বিবাহিত নারীরা তাদের সিঁথিতে লেপন করে কুমকুমে মিশ্রিত করে, তার স্বামীর মঙ্গলকামনার জন্য। হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে কিছু গণিকার নিশ্চয়ই স্বামী-সন্তান আছে। কিন্তু তুমি এই ধূলিকণা নিয়ে কী করবে?’

একটু চুপ করে থেকে বিল্ববতী বলল, ‘ওই পবিত্র ভস্ম মিশ্রিত ধূলিকণা যদি আমি সংগ্রহ করতে পারি তবে আমি নিজেকে অন্তঃপুরবাসিনী অন্য নারীদের সমমর্যাদাসম্পন্ন মনে করব।’

এ কথা বলার পর মহারানার কণ্ঠ আলিঙ্গন করে বিল্ববতী বলল, ‘দুশ্চিন্তা মুক্ত হন মহারানা। কালকের কথা ভেবে আজকের এই মধুযামিনীকে চলে যেতে দেবেন না।’

মহারানা হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক কথা। ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই মধুরাতকে ব্যর্থ হতে দেওয়া চলবে না।’ মহারানা নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করলেন বিল্ববতীকে। ডুবে যেতে লাগলেন, হারিয়ে যেতে লাগলেন তার শরীর সুধাতে।

ঠিক এই সময় চিতোর কেল্লার অভ্যন্তরে শালব্রুমার গৃহের এক নিভৃত কক্ষে মুখোমুখি দঁড়িয়ে ছিলেন পিতা-পুত্রী। এ-কক্ষেও একটা প্রদীপ জ্বলছে। তার আলোতে স্পষ্ট বেদনা জেগে আছে তাদের দুজনেরই মুখে। পিতা শালব্রুমার অপমানের কথা কানে পৌঁছতে দেরি হয়নি রাজমহিষীর। মহারানা প্রাসাদ ত্যাগ করার পরই সে ছুটে এসেছে পিতা গৃহে তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। দীর্ঘক্ষণ নিজেদের বেদনার কথা বিনিময় হয়েছে তাদের দুজনের মধ্যে। মহারানা কর্তৃক শালব্রুমার অপমানের কথা, মহারানা কর্ত,ক তার মহিষীকে অবহেলার কথা। এখন এই মুহূর্তে তারা দুজনেই ভাবছেন তাদের ভবিষ্যত কর্মপন্থার ব্যাপারে।

শালব্রুমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আজও মহারানা সেই বারবণিতার গৃহে গেলেন! অর্থাৎ তিনি তার সিদ্ধান্তে অবিচল। আমাকে তিনি আর আহ্বান করবেন না। তাদের দিয়েই যুদ্ধ করাবেন তিনি। ধ্বংস হতে চলেছে চিতোরগড়। না, আর কিছুই করার নেই। আতঙ্কে মানুষ কাল থেকেই চিতোর ত্যাগ করতে শুরু করবে। বিশেষত নারীরা। যারা মোগলবাহিনীর লালসার শিকার হতে চায় না।’

কথাটা শুনে কন্যা বলল, ‘কিন্তু আমি কী করব পিতা? স্বামীকে ত্যাগ করে যদি পলায়ন করি লোকে আমাকে কুলত্যাগিনী বলবে। আবার যদি প্রাসাদে থেকে যাই তবে…।’

কন্যার অসম্পূর্ণ কথাটা বুঝতে অসুবিধা হল না শালব্রুমার। মোগল সেনাদের দ্বারা তার সতীত্ব নষ্ট হবার ভয়ে আতঙ্কিত তার কন্যা।

আর তারপরই রাজমহিষী হঠাৎ বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, পথ একটা আছে।’

‘কী পথ?’ জানতে চাইলেন শালব্রুমা।

তাকে চমকে দিয়ে কন্যা বলে উঠল, ‘জহরব্রত পালন করব আমি। যুদ্ধ শুরু হলে মহারানা কুম্ভ প্রাসাদের সেই পবিত্র কক্ষে অগ্নিকুণ্ডে আত্মাহুতি দেব আমি। যেমন একসময় আত্মসম্মান বাঁচাতে সেই অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে অক্ষয় স্বর্গ লাভ করেছেন বহু নারী। আমিও সেই নারীদের অনুসরণ করব।’

ঘি-এর প্রদীপটা হঠাৎই দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল। আঁধার নেমে এল শালব্রুমার কক্ষে। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন শালব্রুমা। তিনি অনুভব করলেন তার পাদস্পর্শ করছে তার কন্যা। তারপর রাজমহিষী পিতাগৃহ ত্যাগ করে রওনা হয়ে গেল প্রাসাদের উদ্দেশে।

তিন দিন পর দ্বিপ্রহরে কেল্লা বুরুজের মাথায় দাঁড়ানো এক রক্ষী দেখতে পেল প্রচণ্ড এক ধূলিঝড় দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে চিতোরের দিকে। সে চিৎকার করে উঠল ‘আসছে! আসছে! যবন বাহিনী আসছে।’ তার চিৎকার শোনার সঙ্গে সঙ্গে নগরবাসীকে সতর্ক করার জন্য ঢেড়া বাজতে লাগল চতুর্দিকে। অবশ্য এ ক’দিনে চিতোর ছেড়ে বহু মানুষ অন্যত্র পলায়ন করেছে অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের কথা ভেবে। সেই ঢেড়ার শব্দ পৌঁছে গেল রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে মহারানা উদয়ের কানে। একইসঙ্গে বিল্ববতীর মহলে ও শালব্রুমার গৃহেও।

মহারানা তাঁর ভাগ্য তখন ছেড়ে দিয়েছেন বিল্ববতীর হাতে, বলা ভালো অদৃষ্টের হাতে। শালব্রুমা তার কক্ষে বসে পাথরের মূর্তির মতো চেয়ে আছেন তলোয়ারটার দিকে। যদি মহারানা এখনও একবার তাকে ডাক পাঠান তবে সব অভিমান ভুলে তিনি ওই তলোয়ার তুলে নেবেন চিতোর রক্ষার জন্য। আর বিল্ববতী সেই ঢেড়ার শব্দ শুনে তার প্রস্তুতি শুরু করল। নগর গণিকার দল সেই শব্দ শুনে তার মহলের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের তেমনই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল বিল্ববতী। আর রাজপ্রাসাদের রানিমহলে সেই শব্দ পৌঁছতে আতঙ্কে কান্নার ঢেউ উঠল রাজমহিষীদের মধ্যে। তাদের মধ্যে একজনই শুধু স্থির, অবিচল। সে শালব্রুমার দুহিতা। একজন দাসী তার জন্য মধ্যহ্নভোজন নিয়ে উপস্থিত হতে সে বলল, ‘আজ আমার ব্রত। খাদ্য স্পর্শ করব না। একটা শিবিকা ডাক। গোমুখকুণ্ডে স্নান করতে যাব।’

অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে চিতোরে এসে উপস্থিত হলেন আকবর। খাড়া পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত প্রাকার ঘেরা চিতোরগড়। একটি মাত্র পথ ওপরে ওঠার। সে পথ দিয়ে কেল্লার প্রধান প্রবেশদ্বারে পৌঁছতে সর্পিল পাকদণ্ডী পথে আরও বেশ কয়েকটা তোরণ যে তাকে অতিক্রম করতে হবে সে খবর আকবরের জানা আছে।

পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আকবর তাকালেন কেল্লার দিকে। কেল্লা প্রাকারে কিছু রক্ষী দাঁড়িয়ে আছে। তবে নিচ থেকে ছোঁড়া তিরের নাগালের বাইরে তারা। আকবর হিসেব করে দেখলেন যদি চিতোর কেল্লার মূল তোরণে উপস্থিত হতে হয় তবে অন্তত সাতটা তোরণ অতিক্রম করে তাকে ওপরে উঠতে হবে। নিচ থেকে পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথে সেই বিশালাকৃতির কয়েকটা তোরণ দৃশ্যমান। এমনও যদি হয় ওই তোরণগুলো অতিক্রম করার সময় কোনো প্রতিরোধ এল না তবুও সেই তোরণের দরজা অতিক্রম করে ওপরে পৌঁছতে অন্ধকার নেমে যাবে। আর তারপর যদি রাজপুত বাহিনী অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে গিরিবর্ত্মের আড়াল থেকে মোগল বাহিনীকে আক্রমণ করে তবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মোগলবাহিনী। অবস্থা হবে জাঁতাকলে আটকে থাকা মূষিকের মতো।

কাজেই বিচক্ষণ রণকৌশলী সম্রাট সিদ্ধান্ত নিলেন পরদিন ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ওপরে ওঠা শুরু করবেন। দ্বিপ্রহরে তিনি পৌঁছে যাবেন চিতোর কেল্লার প্রধান তোরণে। অশ্বারোহী বাহিনী দীর্ঘ পথ পরিক্রম করে এসেছে। তাদের বিশ্রামেরও দরকার। পরদিন ভোরের আলো ফুটলে ক্লান্তিমুক্ত মোগল সেনারা নব উদ্যমে রাজপুত বাহিনীর মোকাবিলা করতে পারবে। একথা ভেবে নিয়ে সম্রাট পাহাড়ের পাদদেশে তার সৈনিকদের শিবির স্থাপন করতে নির্দেশ দিলেন।

সম্রাটের তাঁবু খাটানো হল। তার ভিতরে বসে সম্রাট নিচ থেকে পাহাড়ের ওপর দুর্গটা লক্ষ করতে লাগলেন। না, রাজপুত সৈন্যদের মধ্যে তেমন কোনো চাঞ্চল্য লক্ষ করা যাচ্ছে না। একটা তির বা পাথরের খণ্ড ওপর থেকে শিবিরের দিকে উড়ে আসছে না। তবে কি উদয় সিংহ আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি শুরু করেছেন? ভাবতে লাগলেন আকবর। তার সেনারা কেউ চুলা জ্বেলে রুটি পাকাবার কাজে, পাথরে ঘষে ঘষে অস্ত্রে শান দেবার কাজে, ধনুকের ছিলা টানা সহ ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দুপুর গড়িয়ে চলল বিকালের দিকে।

কিন্তু বিকাল নাগাদই ঘড়ঘড় শব্দ তুলে উন্মুক্ত হয়ে গেল নিচের কেল্লার বিশাল তোরণের লৌহ কপাট। না, গুম্ফঅলা অসিধারী রাজপুত সেনারা নয়, প্রজাপতির ঝাঁকের মতো রমণীর দল বেরিয়ে আসতে লাগল কেল্লা তোরণ থেকে। পরনে তাদের লম্বা ঝুলের কাচ আর চুমকি বসানো রঙিন ঘাগরা। উর্ধাঙ্গ রঙিন চুনরি দ্বারা আবৃত। তাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। সত্যি যেন এক ঝাঁক রঙিন প্রজাপতি। শুধু একমাত্র বিল্ববতীর শরীরই মখমলের কালো আবরণে আবৃত।

পাথুরে মাটিতে এক সহস্র নারী নূপুরের ছমছম শব্দ তুলে নামতে শুরু করল নীচের দিকে। সেই শব্দ গিরিবর্ত্মে প্রতিধ্বনিত হয়ে পৌঁছে গেল আকবরের শিবিরে। ও কীসের শব্দ? সবাই সচকিত হয়ে তাকাল ওপর দিকে। তারা দেখতে পেল একটা রঙিন ঘূর্ণি যেন ছমছম শব্দ তুলে গিরি পথে পাক খেতে খেতে নেমে আসছে নীচের দিকে! পোশাক দেখে তো ওদের নারী বলেই মনে হচ্ছে! তবে তারা পুরুষ নয়তো? নারীবেশে তারা এগিয়ে আসছে নাতো অতর্কিতে আক্রমণ হানার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত হয়ে গেল মোগল সেনা। অসি কোষমুক্ত করে, ধনুকে তির রচনা করতে লাগল সেই রঙিন ঘূর্ণির জন্য।

সম্রাট আকবরের হীরক অঙ্গুরীয় শোভিত আঙুলগুলো স্পর্শ করল মখমলের সামনে শায়িত তাঁর তরবারির হাতল। চঞ্চল হয়ে উঠল শিবিরের বাইরে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা অশ্বগুলোও। পা ঠুকতে লাগল তারা। সূর্য তখন ডুবতে বসেছে। তার লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে, ঠিক সেই সময় সেই প্রমীলা বাহিনী নিচে নেমে উপস্থিত হল আকবরের ছাউনিতে। না, তাদের হাতে কোন অস্ত্র নেই, আর তাদের পদযুগল দেখে রমণী বলেই মনে হচ্ছে। মোগল বাহিনী সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র উঁচিয়ে ঘিরে ধরল তাদের। এক সেনাপতি কর্কশ স্বরে জানতে চাইল, ‘তোমরা কারা?’

কালো পোশাকে আবৃত এক রমণী জবাব দিল, ‘আমরা চিতোরের নগর নটী, বারবণিতার দল। চিতোর ত্যাগ করে সম্রাটের কাছে আশ্রয় নিতে এসেছি।’

আশ্রয় নিতে এসেছে বারবণিতার দল! চুনরি দিয়ে মুখ আর উর্ধাঙ্গ আবৃত সবার। তবুও সন্দেহ নিরসনের জন্য সেনাপতি বলল, ‘চুনরি হটাও। দেখি তোমরা সত্যি জেনেনা কিনা?’

কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। সেই কালো বস্ত্রখণ্ডে আবৃত নারী তার মুখ থেকে প্রথমে চুনরিটা সরালো। হ্যাঁ, সে নারী, এক অপূর্ব সুন্দরী নারী। সে নারী এরপর তার সঙ্গিনীদের নির্দেশ দিল তাদের শরীর থেকে সম্পূর্ণ চুনরি খসিয়ে ফেলতে। নির্দেশ পালন করে তারা মুহূর্তের মধ্যে চুনরি খসিয়ে ফেলল মাটিতে। সেনাপতি আর মোগল বাহিনী অবাক হয়ে দেখল তাদের সামনে সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরী রমণীর দল। চুনরির নীচে তাদের কোনো বক্ষ আবরণী বা অন্তর্বাস নেই। অন্ধকার নামার আগে দিনের শেষ আলো এসে পড়েছে তাদের উন্মুক্ত বক্ষে। তারা যেন আহ্বান জানাচ্ছে মোগল সেনাদের। নারীদের ঠোঁটের কোণের হাসিতে, চোখের চাহনিতে আলিঙ্গনের স্পষ্ট ইঙ্গিত।

মোগল সেনাপতি বুঝতে পারল, কথাটা নিশ্চয় মিথ্যা নয়। এই নারীকুল বারবণিতার দল। না-হলে অচেনা পুরুষদের সামনে এমন লজ্জাহীনা কখনও হতে পারত না। সেনাপতি এরপর তাকাল সেই রূপসীর দিকে। তার মুখমণ্ডল উন্মুক্ত হলেও তার শরীর কিন্তু তখনও কৃষ্ণবর্ণের বস্ত্রে আচ্ছাদিত। হয়তো বা উন্মুক্ত হবার প্রত্যাশাতেই তার দিকে তাকাল সেই মোগল সেনাপতি। কিন্তু সেই রমণী বলল, ‘আমি সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই। আমি চিতোরের গণিকাশ্রেষ্ঠা। একমাত্র তার সামনেই শরীরের আবরণ উন্মোচন করব আমি। তাঁর কাছেই আমি নিবেদন করতে চাই নিজেকে। আর তাকে আমার বেশ কিছু জরুরি সংবাদ দেবার আছে।’

এ কথা বলার পর সে তার সঙ্গিনীদের দেখিয়ে সেনাপতিকে বলল, ‘তবে আপনার সেনারা কেউই অভুক্ত থাকবে না। চিতোর কেল্লা ত্যাগ করে এসেছি আমরা। এই নারীকুল এখন মোগল সম্রাটের সম্পত্তি। সৈনিকদের মনোরঞ্জনের জন্য প্রস্তুত সবাই। আশা করি, তারা সম্রাট সেনাদের পথের ক্লান্তি দূর করে তৃপ্ত করতে পারবে।’ বিল্ববতীর এ কথা শুনে ঝিলিক দিয়ে উঠল মোগল সেনাপতির চোখ। সত্যিই এই রূপসী নারীর দল তাদের মনোরঞ্জন করবে! তাদের কামার্ত চাহনি ঘুরতে শুরু করল অর্ধনগ্নিকাদের স্তনের ওপর।

বিল্ববতীর কথা শুনে সেনাপতি বলল, ‘তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমি সম্রাটকে গিয়ে তোমার বক্তব্য জানাচ্ছি।’

সম্রাটের তাঁবুতে বিল্ববতীর যখন ডাক এল তখন সূর্য ডুবে গিয়ে দ্রুত অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। আর গণিকার দলও সৈনিকদের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাদের আলিঙ্গন করতে শুরু করেছে। কোনো কোনো মোগল সৈনিক আবার উপোসি বাঘের মতো নিজেরাই এগিয়ে আসছে বারবণিতাদের দিকে। এ সুযোগ হাতছাড়া করা খুব কঠিন কাজ। মোগল সেনার সংখ্যা পাঁচশত আর বারবণিতার সংখ্যা এক সহস্র। সারা রাত বাকি পড়ে আছে। একাধিক নারীকে সম্ভোগ করতে পারবে তারা। মেটাতে পারবে তাদের যৌন ক্ষুধা।

সম্রাটের তাঁবুর ভিতর একটা মশাল জ্বলছে। মেঝেতে পারস্য গালিচা পাতা। তার ওপর মখমলের বিছানায় তাকিয়াতে ঠেস দিয়ে বসে ভারত সম্রাট। পাশে শোয়ানো আছে তার তলোয়ার। সম্রাটও বিস্মিত হয়েছেন বারবণিতাদের আগমনে। বিল্ববতী প্রবেশ করল তার তাঁবুতে। বিল্ববতী তাঁবুতে প্রবেশ করে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্রাটকে কুর্নিশ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মশালের আলো এসে পড়েছে বিল্ববতীর মুখে। সে মুখ দেখে সম্রাট অবাক হয়ে গেলেন। এত রূপসি নারী! যেন সে কোনো সাধারণ নারী নয়। জন্নত থেকে কোনো হুরী এসে আবির্ভূত হয়েছে তাঁবুতে। দিল্লির বাদশাহী হারেমে এত সুন্দরী নারী একজনও নেই।

কিছুক্ষণ সে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর সম্রাট তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কে তুমি? তোমাকে তো ঠিক সাধারণ গণিকা বলে মনে হচ্ছে না?’

বিল্ববতী জবাব দিল, ‘আমি বিল্ববতী। আপনার অনুমান ঠিক জাঁহাপনা। আমি চিতোরের গণিকাশ্রেষ্ঠা। মহারানা উদয় সিংহের অঙ্গ সেবিকা আমি। সাধারণ মানুষ আমাকে স্পর্শ করতে পারে না।’

কথাটা শুনে সম্রাট জানতে চাইলেন, ‘তুমি তবে রানাকে পরিত্যাগ করলে কেন?’

বিল্ববতী বলল, ‘নিজের প্রাণ রক্ষা কে না চায়? প্রধান সেনাপতিই যখন যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন তখন রানার পরাজয় তো অবশ্যম্ভাবী।’ এই বলে মৃদু হাসল সে।

সম্রাট আকবর বললেন, ‘তার মানে?’

বিল্ববতী বলল, ‘মহারানা নাকি দুর্বব্যহার করেছেন প্রধান সেনাপতির সঙ্গে। তাই তিনি যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। মহারানা উদয় কোনোদিন তেমন কোনো যুদ্ধে যাননি। সৈন্য পরিচালনা করতে তিনি অক্ষম। সম্রাটের চিতোর জয় এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। যুদ্ধ হয়তো একটা হবে। কিন্তু তা অতি সামান্য। কাল দ্বিপ্রহরেই সম্রাটের বিজয় পতাকা উড়বে চিতোর কেল্লাতে। সম্রাট যদি অনুমতি দেন তবে আমি আসন গ্রহণ করতে পারি?’

এমনই কোনো কিছু যে একটা ঘটেছে তা মনে মনে অনুমান করেছিলেন সম্রাট। খুশিতে নেচে উঠল তার মন। তিনি ইশারাতে বসতে বললেন বিল্ববতীকে। সম্রাটের কিছুটা তফাতেই বসল বিল্ববতী। বসার সময় তার বস্ত্রে কালো রেশমের আবরণটা কিছুটা উন্মুক্ত হয়ে গেল। যুবক সম্রাটের চোখে পড়ল বিল্ববতীর গাঢ় বক্ষ বিভাজিকা। সে স্থানের ওপর যে সম্রাটের দৃষ্টি পড়েছে তা যেন বুঝতে পারল বিল্ববতী। আবছা একটা হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। সম্রাট আকবর এরপর কেল্লা সম্পর্কে একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন বিল্ববতীকে। কেল্লার জনসংখ্যা কত? রানার হয়ে যারা অস্ত্র ধরতে পারে তেমন সৈন্য সংখ্যা কত? কেল্লাতে অস্ত্রাগারের অবস্থান কোথায়? তোষাখানা কোথায়? মন্দিরগুলোতে কোনো সম্পদ গোপন করা আছে কিনা? এমন নানা প্রশ্ন। তার মতো করে সম্রাটের প্রশ্নের জবাব দিয়ে যেতে লাগল বিল্ববতী। আর সেই সঙ্গে বিল্ববতীর শরীর থেকে যেন ধীরে ধীরে খসে পড়তে লাগল কালো রেশমবস্ত্রের আচ্ছাদন। ক্রমশ প্রকট হতে শুরু করল তার বক্ষ বিভাজিকা। তারপর উন্মোচিত হতে লাগল বিল্ববতীর সুডৌল বিল্ববক্ষ। যুবক সম্রাট চেষ্টা করেও চোখ ফেরাতে পারলেন না সেদিক থেকে।

যুবক সম্রাট কথা বলতে বলতে যেন সম্মোহিত হয়ে যেতে লাগলেন সেই বক্ষের দিকে তাকিয়ে। বিল্ববতীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠতে শুরু করেছে। তার মনে পড়ল মহারানার কথা। তিনি বিল্ববতীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন সম্রাটের সঙ্গে লড়াই করার জন্য বিল্ববতীর অস্ত্র কই? বিল্ববতী তার আসল অস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। হতে পারেন আকবর সম্রাট। কিন্তু তিনি তো পুরুষ। যে কোনো পুরুষকে ঘায়েল করার অমোঘ অস্ত্র বিল্ববতীর এই স্তনযুগল। অজগরের দৃষ্টি যেমন শিকারকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তেমনই তার স্তনযুগল আচ্ছন্ন করে ফেলেছে যুবক সম্রাটকে।

বিল্ববতী এরপর হঠাৎই সম্পূর্ণ খসিয়ে ফেলল তার শরীরের আচ্ছাদন। তাকে কি একটা প্রশ্ন করতে গিয়েও বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন সম্রাট। মশালের আলোতে সম্রাটের চোখের সামনে জেগে আছে বিল্ববতীর নিটোল বিল্বফলের মতো স্তনযুগল, আর সেই শুভ্র স্তনে আঙুরের মতো কৃষ্ণ স্তনবৃন্ত!

বিল্ববতী সরে আসতে লাগল সম্রাটের দিকে। আর সম্রাটের হস্তও যেন নিজের অজান্তে এগোতে লাগল বিল্ববতীর নরম স্তন স্পর্শ করার জন্য। বিল্ববতী সম্রাটের একদম কাছে সরে এল। সম্রাটের হীরক অঙ্গুরীয়খচিত আঙুল প্রায় বিল্ববতীর স্তনবৃন্ত স্পর্শ করে ফেলেছে, ঠিক এমন সময় চিতোর কেল্লার মাথার ওপর থেকে ঘণ্টাধ্বনি ভেসে এল। আর সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে উঠে দাঁড়াল বিল্ববতী। বিস্মিত, হতচকিত সম্রাট দেখলেন বিল্ববতীর হাতে সম্রাটের তলোয়ার! যেটা কোষ মুক্ত করতে উদ্যত বিল্ববতী। এ কোনো কোমল নারী নয়, ভারত সম্রাটের প্রতি তার চোখে ফুঠে উঠেছে তীব্র ঘৃণা আর হিংস্রতা।

সে বলে উঠল, ‘যে স্তন মহারানা স্পর্শ করেন সেই স্তন স্পর্শ করার দুঃসাহস আপনার কীভাবে হল?’ এই বলে সে তলোয়ার কোষমুক্ত করে তা চালনা করল সম্রাটকে লক্ষ করে। আকবর অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় এক পাশে সরে গিয়ে রক্ষা করলেন নিজেকে। তলোয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে আবারও তার দিকে এগিয়ে এল বিল্ববতী। না, এভাবে বারবার তলোয়ারের আঘাত থেকে বাঁচা সম্ভব নয়। বিল্ববতীর দ্বিতীয় আঘাতটাও কোনোরকমে এড়িয়ে গেলেন সম্রাট। তারপর তাঁবুর ভিতর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলেন অস্ত্র সংগ্রহের জন্য। কিন্তু বাইরের পরিস্থিতি তখন আরও ভয়ঙ্কর। মোগল সৈনিকরা তখন কেউ পালাচ্ছে, আবার কেউ মৃত্যু যন্ত্রণাতে ছটফট করছে।

বিল্ববতী কেল্লাতে একজন বারবণিতাকে নির্দেশ দিয়ে এসেছিল যে চিতোরেশ্বরীর মন্দিরের বিশাল ঘণ্টাটা নির্দিষ্ট সময় বাজাতে। ওটাই ছিল সংকেতধ্বনি। প্রত্যেক বারবণিতা তার ঘাগরার নীচে জানুতে চর্ম রজ্জু দিয়ে বেঁধে এনেছিল তীক্ষ্ন ছুরিকা। ঘণ্টাধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তা তারা বসাতে শুরু করেছে আলিঙ্গনরত, কামার্ত মোগল সৈনিকদের বুকে। রাত্রির অন্ধকার বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে মোগল সৈনিকদের আর্তনাদে। তাঁবু থেকে সম্রাটের পিছন পিছন উদ্যত তলোয়ার হাতে বাইরে বেরিয়ে এসেছে বিল্ববতী। সম্রাটকে দেখতে পেয়ে তার দিকে অস্ত্র হাতে ছুটে আসতে লাগল আরও কিছু বারবণিতা। সম্রাট বুঝতে পারলেন তার আর কিছু করার নেই। কোনওরকমে একটা ঘোড়ায় উঠে পালাবার জন্য ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন ভারত সম্রাট আকবর। পিছনে পড়ে রইল তার হতাহত মোগল সৈনিকরা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে গেল। দুর্গ প্রাকারের ওপর থেকে রক্ষীরা দেখতে পেল নীচে মোগলদের তাঁবুগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। সে খবর দেবার জন্য মহারানার প্রাসাদের দিকে ছুটল তারা। কয়েকজন গণিকা নিহত বা আহত হলেও সে সংখ্যা নগণ্য। তাদের দেহগুলোকে মোগলদের ঘোড়াগুলোর পিঠে বেঁধে নিয়ে বিজয়িনী বিল্ববতী তার সহচরীদের নিয়ে কেল্লাতে ফেরার পথ ধরল। মহারানাকে দেওয়া কথা রাখতে পেরেছে সে। বারবণিতা বাহিনী পরাস্ত করেছে ভারত সম্রাট আকবরকে। ভোররাতে চিতোর কেল্লাতে বিল্ববতীর সঙ্গে ফিরে এল সেই বারবণিতার দল। আর তাদের আগমনে যেন উৎসব শুরু হয়ে গেল চিতোর নগরীতে।

অন্ধকার, নিষ্প্রদীপ কক্ষে সেনাপতি শালব্রুমা বসে ছিলেন মহারানা উদয়ের আহ্বানের জন্য। কিন্তু রাত্রি নামলেও ডাক আসেনি তার। দিনে বা রাত্রি নামার পর একবারের জন্যও কক্ষ ত্যাগ করেননি তিনি। শুধু মোগল সৈনিকরা যে এসে পড়েছে তা ঢেড়ার শব্দে জেনেছিলেন তিনি। তার বেশি কিছু তার জানা নেই। মধ্য রাতের কিছু সময় পর বাইরে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। তবে কি মোগল সেনা প্রবেশ করেছে কেল্লাতে? নিজেকে এবার আর স্থির রাখতে পারলেন না সেনাপতি। রানা তাকে ডাকুন বা না ডাকুন এ দেশ তো তারও নিজের। তাই মোগলদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরতে হবে তাকে। হয়তো বা তলোয়ার ধরা এখন নিষ্ফল, কিন্তু তিনি মৃত্যু বরণ করার আগে কিছু শত্রু নিধন করে তবেই মরবেন—এ কথা ভেবে নিয়ে সেনাপতি শালব্রুমা তার তলোয়ার নিয়ে বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন শত্রু নিধনের উদ্দেশে।

সারা কেল্লা মশালের আলোতে আলোকিত হয়ে উঠেছে। অন্ধকারকে উপেক্ষা করে চিতোরবাসী নেমে পড়েছে পথে। শালব্রুমা তাদের দেখে বুঝতে পারলেন তারা আতঙ্কিত নয়, উল্লসিত। এক সাধারণ নাগরিককে উল্লাসের কারণ জিগ্যেস করাতে সে জানাল, ‘বারবণিতারা মোগল বাহিনীকে পরাস্ত করেছে। কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন সম্রাট আকবর। প্রাসাদ চত্বরে উৎসব শুরু হয়েছে। সবাই সেখানে যাচ্ছে।’

নগরবাসীর কাছে কথাটা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন সেনাপতি শালব্রুমা। এই অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হল? ভারত সম্রাট আকবরকে কীভাবে পরাস্ত করল সামান্য বারবণিতারা? তবে ঘটনাটা যে সত্যি তা তো তিনি নগরবাসীদের উল্লাস দেখেই বুঝতে পারছেন। আর এরপরই ‘প্রাসাদ’ শব্দটা শুনে শালব্রুমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার কন্যার কথা। সে সেদিন বলে গিয়েছিল জহরব্রত পালন করবে। সত্যি সে তা করেনি তো? পিতার মন কেঁদে উঠল সেই অশুভ আশঙ্কাতে। আর কালক্ষেপ না করে তিনি ছুটতে শুরু করলেন রাজপ্রাসাদের দিকে।

মশাল আর প্রদীপের আলোতে আলোকিত রাজপ্রাসাদ। বহু মানুষ সমবেত হয়েছে প্রাসাদ চত্বরে। জনতার নৃত্য-গীত, উল্লাসধ্বনি, ঝাঝার, নাগাড়ার শব্দতে মুখরিত চারপাশ। জনতা চিৎকার করছে, ‘জয়, চিতোরেশ্বরীর জয়! মহারানা উদয় সিংহের জয়!’

প্রাসাদের প্রবেশ মুখে মহারানার চাটুকার এক সামন্ত সেনাপতি শালব্রুমাকে দেখে ব্যঙ্গ করে বলল, ‘সেনাপতি বিজয় উৎসবে যোগ দিতে এসেছেন বুঝি? বিল্ববতী যখন আছে তখন আর সেনাপতির প্রয়োজন কি?’

অপমানটা গায়ে মাখলেন না শালব্রুমা। প্রাসাদে প্রবেশ করে তিনি ছুটলেন রানি মহলের দিকে। রানি মহলের দাসী তাকে জানাল, ‘রানি সেই যে গোমুখকুণ্ডে স্নান করতে গেছেন আর ফেরেননি। কথাটা শুনেই শালব্রুমা প্রাসাদ পরিত্যাগ করে ছুটলেন গোমুখকুণ্ডের দিকে।

পবিত্র গোমুখকুণ্ড জলাশয়। গঙ্গা নদীর মতো এ কুণ্ডতে অবগাহন করে চিতোরবাসী শুদ্ধ হয়। একদা যে সব নারীর দল জহরব্রত পালন করেছিলেন তারা এই গোমুখকুণ্ডতে স্নান করেই আত্মাহুতি দেবার জন্য প্রবেশ করেছিলেন কুম্ভপ্রাসাদের ভূগর্ভস্থ কক্ষে। যেখানে অহর্নিশ প্রজ্জ্বলিত থাকে এক অনির্বাণ শিখা। যে আগুন কোনোদিন নেভে না।

মহারানা কুম্ভের প্রাচীন প্রাসাদ দীর্ঘকাল হল পরিত্যক্ত হয়ে গেছে, ধ্বসে পড়েছে তার বেশ কিছু অংশ। কেউ বাস করে না সেখানে। শুধু পুণ্য স্থান হিসাবে সেই ভূগর্ভস্থ কক্ষে ধুলো-রেণু সংগ্রহ করতে যান কুলনারীরা। বিশেষ কোনো ঘরবাড়িও নেই কুম্ভ প্রাসাদ সংলগ্ন অংশে। তাই কোনো মানুষও নেই। সারা নগরী উৎসবে মাতোয়ারা। নগরীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে মহারানা কুম্ভের সেই প্রাচীন প্রাসাদের কাছে শালব্রুমা যখন পৌঁছলেন তখন চাঁদ বৈতরণীর পথে। শুকতারা ফুটে উঠতে শুরু করেছে সূর্যোদয়ের আগমন বার্তা নিয়ে।

আধো অন্ধকারে এক ভৌতিক অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে খণ্ডহর প্রাসাদটা। বাতাসে যেন একটা পোড়া গন্ধ ভাসছে! সত্যি নাকি শালব্রুমার মনের ভুল? বুক কেঁপে উঠল তার। কিন্তু এরপরই তিনি একটু দূর থেকে দেখতে পেলেন একটা মূর্তি যেন গোমুখকুণ্ডের দিক থেকে এসে কুম্ভপ্রাসাদে প্রবেশ করল। নারী মূর্তি! ‘ও নিশ্চয় আমার কন্যা। থামাতে হবে ওকে। দূর থেকে ভেসে আসা গোলোযোগের শব্দ শুনে মোগলসেনা দুর্গে প্রবেশ করেছে বলে ভ্রম হয়েছে তার।’—এ কথা ভেবে নিয়ে শালব্রুমা অতি দ্রুত এগোলেন সেই প্রাসাদের দিকে।

এ প্রাসাদে আগে কোনওদিন প্রবেশ করেনি বিল্ববতী। কোনও গণিকার এই পবিত্র প্রাসাদে প্রবেশ অধিকার ছিল না। এ অধিকার আজ অর্জন করেছে বিল্ববতী। যুদ্ধ জয় করে কেল্লাতে ফিরে প্রথমে সে গিয়েছিল তার মহলে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির স্বর্ণকৌট আনার জন্য। সেটা নিয়ে এসে গোমুখকুণ্ডের পবিত্র জলে অবগাহন করে একটা মাত্র পট্টবস্ত্রে নিজেকে আবৃত করে প্রাসাদে প্রবেশ করেছে বিল্ববতী। পবিত্র স্থানে এই একটি মাত্র পট্টবস্ত্রে নিজেকে আবৃত করে রাখাই প্রথা। কোনও রেশম বস্ত্র বা অন্তর্বাস রাখতে হয় না শরীরে। প্রাসাদে প্রবেশ করেই একটা পোড়া গন্ধ অনুভব করল বিল্ববতী। সে বেশ বিস্মিত বোধ করল সেই গন্ধে। যে নারীকুল জহরব্রত পালন করে এখানে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন সে তো বহু বছর আগের কথা। তবে? ওই পোড়া গন্ধটাই বিল্ববতীকে নিয়ে গেল নির্দিষ্ট স্থানে। অন্ধকার সোপানশ্রেণি যেখান থেকে মাটির গভীরে নেমেছে। কটু গন্ধটা উঠে আসছে তার ভিতর থেকেই। রুক্ষ সেই সোপানশ্রেণি বেয়ে নামতে শুরু করল বিল্ববতী। অবশেষে সে পৌঁছে গেল ভূগর্ভস্থ সেই কক্ষে।

বিশালাকৃতির এক প্রাচীন কক্ষ। আর সেই কক্ষের ঠিক মাঝখানে একটা বৃত্তাকার স্থান। সেই পবিত্র অগ্নিকুণ্ড। পর্বতের মাথার ওপর চিতোর কেল্লার জলাশয়গুলোতে কোথা থেকে জল আসে তা কারো জানা নেই, তেমনই এই পবিত্র অগ্নিকুণ্ড শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কীভাবে জীবন্ত আছে তা সঠিক জানা নেই। কেউ কেউ অবশ্য বলেন যে এ আগুন নাকি পৃথিবীর আগুন নয়, স্বর্গের আগুন। ইন্দ্রদেবের বজ্রের আগুন। কোনও এক অজানা যুগে আকাশ থেকে খসে পড়েছিল এ আগুন। আর তার ওপর প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন মহারানা কুম্ভ। কুণ্ড থেকে ওঠা আগুনের লাল আভাতে আলোকিত কক্ষ। পাথুরে দেওয়ালগুলোর সর্বত্র আজও জেগে আছে অস্পষ্ট হাতের দাগ। বহু শতাব্দী আগে যে সব নারীরা জহরব্রত পালন করেছিলেন তারা অগ্নিকুণ্ডতে ঝাঁপ দেবার আগে দক্ষিণ হস্তে আলতা-সিঁদুর মেখে ওই ছাপ রেখে গেছিলেন দেওয়ালের গায়ে।

বিল্ববতী বিস্মিত ভাবে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল সেই পবিত্র চিহ্নগুলো। কেমন যেন একটা গা ছমছমে পরিবেশ বিরাজ করছে কক্ষে। হঠাৎই দেওয়ালের গায়ে একটা হস্তচিহ্ন খুব স্পষ্ট বলে মনে হল তার। যেন সিঁদুরের ছাপটা সদ্য কেউ এঁকেছে দেওয়ালের গায়ে। আর এরপরই তার চোখ পড়ল অগ্নিকুণ্ডের কাছেই এক স্থানে মাটিতে রাখা আছে মালা জড়ানো একটা কলস আর কিছু স্বর্ণালঙ্কার! বিল্ববতী গল্প শুনেছিল যে যারা জহরব্রত পালন করতেন তারা অগ্নিকুণ্ডতে ঝাঁপ দেবার আগে কলসে করে গোমুখকুণ্ডের পবিত্র জল বহন করে আনতেন এখানে। তবে কি কেউ জহরব্রত পালন করতে এখানে এসেছিলেন? বিল্ববতী ভালো করে তাকাল অগ্নিকুণ্ডের দিকে। এখনও যেন একটা সূক্ষ্ম ধোঁয়ার কুণ্ডলী নির্গত হচ্ছে অগ্নিকুণ্ড থেকে। বিস্মিত বিল্ববতী পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিল সেই কুণ্ডের ভিতর। লাল গনগনে অগ্নিকুণ্ডর ভিতর রয়েছে ছাই হয়ে যাওয়া কোন মানুষের শায়িত অবয়ব। কটু গন্ধ আর ধোঁয়ার উৎস এই অবয়বই। বেশিক্ষণ সেই অগ্নিকুণ্ডর সামনে আগুনের হলকার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। একবার উঁকি দিয়েই কুণ্ডের গা থেকে সরে এল বিল্ববতী।

তার অনুমান সত্যি। জহরব্রত পালন করেছে কোনো নারী! বিল্ববতী অনুমান করল, যুদ্ধে পরাজিত হবার আশঙ্কাতেই মোগল বাহিনীর হাত থেকে সতীত্ব রক্ষা করার জন্যই সম্ভবত জহরব্রত পালন করেছে সেই নারী। বিল্ববতী মাথা ঝুঁকিয়ে হাত জোড় করে প্রণাম জানাল সেই সতী নারীর উদ্দেশে। ওই কক্ষের পবিত্র রেণু সংগ্রহ করে এবার ফিরতে হবে বিল্ববতীকে। বাইরে ভোর হয়ে আসছে। কুণ্ড থেকে জহরব্রতী সতী নারীর ভস্মের কিছু অংশ উড়ে এসে পড়েছে মাটিতে। বিল্ববতী তার স্বর্ণ কৌটো হাতে মাটিতে ঝুঁকে পড়ল ভস্মমিশ্রিত পবিত্র ধূলিকণা সংগ্রহের জন্য।

ঠিক সেই মুহূর্তে কক্ষের দ্বারে উপস্থিত হলেন শালব্রুমা। যে গন্ধে আবৃত কক্ষের বাতাস তা পরিচিত অভিজ্ঞ সেনাপতি শালব্রুমার। যুদ্ধ ক্ষেত্রে বহুবার মৃত সৈনিকদের চিতা সাজিয়েছেন তিনি। এ গন্ধ তার পরিচিত। নরদেহের মাংস-মজ্জা পোড়ার গন্ধ। শালব্রুমা দেখতে পেলেন কুণ্ডের কিছুটা তফাতে মাটিতে ঝুঁকে পড়ে ভস্ম সংগ্রহ করছে এক নারী। যে নারীকে পশ্চাৎ ভাগ থেকে দেখলেও তার অবয়ব দেখে শালব্রুমা বুঝতে পারলেন এ নারী তার কন্যা নয়। অপর কেউ। আর এরপরই শালব্রুমার চোখে পড়ল সেই মালা জড়ানো কলস আর অলঙ্কারগুলোর ওপর। এখনও ক্ষীণ ধোঁয়ার কুণ্ডলী নির্গত হচ্ছে অগ্নিকুণ্ড থেকে। ব্যাপারটা বুঝতে আর অসুবিধা হল না শালব্রুমার। এই অগ্নিকুণ্ড গ্রাস করে নিয়েছে তার কন্যাকে। সত্যি জহরব্রত পালন করে কুণ্ডে ঝাঁপ দিয়েছে তার কন্যা। পিতা শালব্রুমার কণ্ঠ থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল।

নিস্তব্ধ কক্ষে সেই আর্তনাদ শুনে চমকে উঠে বিল্ববতী ফিরে দাঁড়াতেই পট্টবস্ত্র খসে পড়ল তর উর্ধাঙ্গ থেকে। শালব্রুমা তাকালেন সেই নারীর দিকে। এ যে বিল্ববতী! অগ্নিকুণ্ডের লাল আভা এসে পড়েছে তার শরীরের ওপর। শালব্রুমার মনে হল বিল্ববতীর স্তন দুটো যেন দুটো অগ্নিগোলক! যে অগ্নিগোলক জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিল তার সব কিছু! শালব্রুমার চোখ যেন জ্বলে যাচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে! নাক জ্বলে যাচ্ছে আত্মজার মাংস পোড়ার কটু গন্ধে! এ কি কোনো নারী নাকি পিশাচিনী? যে সংগ্রহ করছে তার কন্যার চিতাভস্ম!

প্রাসাদ আজ উৎসব মুখর। প্রাসাদের ভিতর বাহির জনাকীর্ণ। নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র শব্দ উল্লাসে মুখরিত। মহারানা উদয় সিংহ সারা রাত ধরে তার প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করছেন সেই আনন্দ উৎসব। তাকে দেখে জয়ধ্বনি, হর্ষধ্বনি করছে জনতা। তিনি মুঠো মুঠো স্বর্ণমুদ্রা ছুড়ে দিয়েছেন তাদের উদ্দেশে। আর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই সারা চিতোরবাসী সমবেত হয়েছে প্রাসাদের সামনে। সবাই দর্শন চায় মহারানার। মহারানাকে তাদের সাধ্যমতো উপঢৌকন দিয়ে প্রণাম জানাতে চায়। সবাই প্রাসাদে প্রবেশ করতে চায়। প্রহরীরা তাদের সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। শুধু সামন্ত সর্দার আর অভিজাত ব্যক্তিদেরই প্রাসাদে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে মহারানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। দরবার কক্ষে তার হাতে উপঢৌকন তুলে দেবার জন্য।

যুদ্ধ জয়ের আনন্দে বহু দিন পর স্নান সেরে আলো ঝলমল দরবার কক্ষে সিংহাসনে এসে বসেছেন মহারানা। ভাঁড়, পাত্র-মিত্র, সামন্ত সর্দাররা তাকে ঘিরে আছে। উপঢৌকন নিয়ে এক একজন অভিজাত নাগরিক, সর্দারের দল প্রবেশ করছেন দরবারে। চিতোর অধিপতি মহারানা উদয় সিংহকে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম জানিয়ে নজরানা-উপঢৌকন তুলে দিচ্ছেন ভৃত্যদের হাতে। মহার্ঘ বস্ত্রখণ্ড, স্বর্ণালঙ্কার, মুক্তাহার, দুর্মূল্য পাথর, স্বর্ণপাত্র এ ধরনের নানা মূল্যবান উপহার। ভৃত্যরা যে সব উপহার হাজির করছে উচ্চাসনে বসা মহারানার সামনে। তিনি যে সব উপহার দক্ষিণ হস্তের কনিষ্ঠ অঙ্গুলী দিয়ে একবার স্পর্শ করছেন। তারপর তা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্যত্র। অঙ্গুলি স্পর্শের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে মহারানা উপহার গ্রহণ করছেন। ওটাই দরবারি রীতি।

এত জনসমাগমের মধ্যেও মহারানা ভেবে চলেছেন প্রিয়তমা বিল্ববতীর কথা। সে তখন তার সরোবরস্থিত মহলে বসে কী করছে? সেও নিশ্চয়ই ভাবছে মহারানার কথাই। মহারানা উদয়ের মনে হচ্ছে এখনই তিনি ছুটে যান বিল্ববতীর প্রাসাদে। আলিঙ্গনে, চুম্বনে ভরিয়ে দেন তার বিল্ববক্ষ। প্রেয়সী বিল্ববতী। বীর্যবতী বিল্ববতী। মহারানা ভাবতে লাগলেন কতক্ষণে শেষ হবে এই উপহার গ্রহণ পর্ব, তিনি তারপর ছুটে যাবেন প্রিয়তমা বিল্ববতীর প্রাসাদে। একের পর এক লোক দরবার কক্ষে প্রবেশ করে চলেছে উপহারের ডালি নিয়ে। অন্তহীন জনস্রোত।

হঠাৎ একজন দরবারে প্রবেশ করে সোজা গিয়ে হাজির হলেন যে মর্মর বেদির ওপর মহারানার সিংহাসন তার সামনে। তার হাতে ধরা রক্ত বস্ত্রে আচ্ছাদিত একটা রেকাবি। তাকে দেখে মৃদু চমকে উঠলেন মহারানা সহ অন্য অমাত্যরা। অবশেষে সে নিজেই হাজির হল। সেনাপতি শালব্রুমা। উদভ্রান্ত চেহারা তার। পাগড়িহীন মস্তক। সর্বাঙ্গে ধুলোবালি লেগে আছে। পোশাকও এলোমেলো।

তাকে দেখে মহারানা উদয়ের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। বিদ্রুপের হাসি। সেনাপতিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, ‘আপনার আগমনে বড়ই প্রীত হলাম। উপহারও এনেছেন দেখছি। তবে আমার বীর্যবতী বিল্ববতী যতদিন আছে ততদিন আর অন্য কোনও সেনাপতির চিতোর রক্ষার প্রয়োজন হবে না। চিতোর রক্ষার জন্য আমার বীর্যবতী গণিকাকুলই যথেষ্ট।’

মহারানার কথা শুনে হেসে উঠল তাঁর ভাড় ও চাটুকাররা।

শালব্রুমার ঠোঁটের কোণেও যেন একটা আবছা হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, ‘জানি মহারানা। এই দরবার কক্ষে আমার আর কোনওদিন পদার্পণ ঘটবে না। চিতোর ত্যাগ করার আগে মহারানাকে যুদ্ধ জয়ের শুভেচ্ছা স্বরূপ শেষ উপহার দিতে এসেছি। দয়া করে তা গ্রহণ করুন।’

বিজয়ীর অপরাধীকে ক্ষমা করা শোভা পায়। তাই মহারানা উপহার গ্রহণ করতে আপত্তি করলেন না। একজন ভৃত্য সেই বস্ত্র আচ্ছাদিত রেকাবিটা শালব্রুমার হাত থেকে নিয়ে মহারানার সামনে উঠে দাঁড়াল। মহারানা যথারীতি তাতে অঙ্গুলি স্পর্শ করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু শালব্রুমা বলে উঠলেন, ‘মহারানা একবার দেখুন তাঁর জন্য কী উপহার এনেছি আমি। মহারানার প্রতি আমার শেষ উপহার।’

শালব্রুমার কথা শুনে কৌতূহলবশত মহারানা সরিয়ে ফেললেন উপহারের আচ্ছাদন। আর তার পরই চমকে উঠলেন তিনি। রেকাবিতে রাখা আছে দুটো সদ্য কর্তিত মাংস পিণ্ড। নিটোল বিল্বের মতো দুটো স্তন! তখনও রক্ত ঝরছে সেই স্তন যুগল থেকে!

শালব্রুমা সভা কাঁপিয়ে পাগলের মতো অট্টহাস্য শুরু করলেন। হতভম্ব মহারানা কিঞ্চিৎ হতভম্ব ভাবে বলে উঠলেন—’এক কার ছিন্ন স্তন?’

শালব্রুমা হাসতে হাসতে বলেই উঠলেন, ‘চিনতে পারছেন না মহারানা? যে স্তন আকবরের তলোয়ারের থেকেও শক্তিশালী, যে স্তন পরাজিত করেছে সম্রাট আকবরকে, আমাকে কন্যাহীনা করেছে, যে স্তনযুগল লাভের প্রত্যাশাতে আপনি প্রতি রাতে ছুটে যান, এই সেই বিল্ববতীর মহার্ঘ বিল্ব স্তনযুগল। মহারানার প্রতি আমার শেষ উপহার। বিল্বস্তনহীন বিল্ববতী এখন মহারানার জন্য প্রতীক্ষা করছেন কুম্ভ প্রাসাদের পবিত্র কক্ষে।’

এই ভয়ঙ্কর কথা শুনে মহারানা সিংহাসন থেকে লাফিয়ে উঠে তার তরবারি কোষমুক্ত করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই শালব্রুমা অট্টহাস্য করতে করতে কটিদেশ থেকে একটা তীক্ষ্ন ছুরিকা বার করে নিজের হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করালেন। মাটিতে ঢলে পড়ল শালব্রুমার দেহ। মহারানা আর কালক্ষেপ করলেন না। বিল্ববতীর কর্তিত স্তনযুগল রেকাবি থেকে তুলে নিয়ে কোষবন্ধে বেঁধে নিয়ে দরবার কক্ষ এবং প্রাসাদ ত্যাগ করে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করলেন, তারপর পাগলের মতো ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন কুম্ভ প্রাসাদের দিকে।

কিছু সময়ের মধ্যেই কুম্ভপ্রাসাদের সেই ভূগর্ভস্থ কক্ষে প্রবেশ করলেন মহারানা উদয়। মাটিতে পড়ে আছে রক্তস্নাত বিল্ববতী। মহারানা তাড়াতাড়ি গিয়ে তার পাশে উপবিষ্ট হয়ে কোলে তুলে নিলেন তার মাথাটা। বিল্ববতীর বুকে দুটো গভীর ক্ষত। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে তার থেকে। রক্তাক্ত গহ্বরের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে বক্ষ অস্থি। বিল্ববতীর শরীরে তখনও প্রাণ ছিল। হয়তো তার প্রাণবায়ু শরীর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে মহারানার জন্যই প্রতীক্ষা করছিল। বিল্ববতীর মাথা কোলে তুলে নিয়ে মহারানা বললেন, ‘চোখ মেলো বিল্ববতী। আমি এসেছি।’ চোখ মেলল বিল্ববতী। প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যেও মহারানাকে দেখে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল বিল্ববতীর ঠোঁটের কোণে। ধীরে ধীরে সে বলল, ‘আপনি এসেছেন মহারানা! দেখুন তো স্তনহীনা বিল্ববতীকে আপনার আগের মতোই সুন্দরী লাগছে কিনা?’

বিল্ববতীর মুখের দিকে তাকিয়ে মহারানার মনে হল এ যেন এক অপাপবিদ্ধ, পবিত্র নারীর মুখ। কোনও কলঙ্ক যাকে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারে না। যৌনতা নয়, যেন এক অপার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য চুঁইয়ে পড়ছে তার রক্তাক্ত শরীর বেয়ে। বিল্ববতী যেন কোন শায়িত দেবীমূর্তি।

মহারানা বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, বিল্ববতী। তোমাকে এখন আরও বেশি সুন্দরী দেখাচ্ছে। এত সুন্দর তোমাকে আমি কোনোদিন দেখিনি। স্বর্গের রূপসিরাও হার মানবে তোমার এই রূপ দেখে।’

কথাটা বলে মহারানার এরপর চোখ পড়ল বিল্ববতীর এক হাতে ধরা সেই স্বর্ণ কৌটোর ওপর। মহারানা বললেন, ‘তুমি কার জন্য এই পবিত্র ধূলিকণা সংগ্রহ করছিলে বিল্ববতী?’

প্রশ্ন শুনে শেষ বারের জন্য হাসি ফুটে উঠল বিল্ববতীর মুখে। নির্মল, পবিত্র সেই হাসি। বিল্ববতী ক্ষীণ কণ্ঠে বলল ‘নিজের জন্য মহারানা। ভেবেছিলাম আপনার মঙ্গল কামনাতে এই পবিত্র রেণু ধারণ করব মস্তকে। স্বামীর মঙ্গল কামনাতে যেমন এই রেণু ধারণ করে রাজপুত রমণীরা।’

কথাটা শুনে চমকে উঠলেন মহারানা উদয়। চোখের পাতা চিরদিনের মতো মুদে আসছে বিল্ববতীর। আর সময় নেই। মহারানা তাড়াতাড়ি সেই কৌটো থেকে পবিত্র ভস্মমিশ্রিত ধূলিকণা তুলে নিয়ে পরিয়ে দিলেন বিল্ববতীর সিঁথিতে। ঠিক যেমন বিবাহের সময় সিঁথিতে সিঁদুর দান করা হয় সেভাবে।

অসীম তৃপ্তিতে যেন চোখের পাতা মুদল বারবণিতা বিল্ববতী। মহারানার কোল থেকে তার মাথাটা গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। মহারানা আর্তনাদ করে উঠলেন—’বিল্ববতী!’

তার আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই প্রাচীন কক্ষে।

বেশ কিছুক্ষণ বিল্ববতীর নিথর শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকার পর সম্বিত ফিরে পেলেন মহারানা উদয় সিংহ। চোখের জল মুছে তিনি তার কোমরবন্ধ থেকে সেই কর্তিত স্তনযুগল নিয়ে স্থাপন করলেন বিল্ববতীর বক্ষে। বিল্বস্তনা বিল্ববতী। তার স্তনযুগল চেয়ে আছে মহারানার দিকে। পরম মমতায় মহারানা উদয় সেই স্তনযুগল আর বিল্ববতীর ওষ্ঠ চুম্বন করলেন শেষ বারের মতো। তারপর বিল্ববতীর শরীরটাকে কোলে নিয়ে এগোলেন সেই অগ্নিকুণ্ডের দিকে। পবিত্র অগ্নিকুণ্ডের সর্বহারা লেলিহান অগ্নিশিখা নিজের কোলে আশ্রয় দিল বিল্ববতীকে।

পরিশিষ্টঃ মোগল ইতিহাসে আছে সম্রাট আকবর একবার মাত্র চিতোর অভিযান করেন এবং চিতোর ধ্বংস করেন। স্বাভাবিক ভাবেই একজন সামান্য বারবণিতার কাছে ভারতসম্রাটের পরাজয়ের কথা সেখানে স্থান পাবার কথা নয়। কিন্তু রাজস্থানের ভট্ট কবিদের রচনায় আছে সম্রাট আকবর দুবার চিতোর অভিযান করেন। প্রথমবার তিনি মহারানা উদয় সিংহের বারবণিতাদের হাতে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়ে প্রাণ রক্ষার্থে পলায়ন করেন। আর এর ফলে মহারানা তার বীর্যবতী গণিকাদের সামন্ত সর্দারদের মতো সম্মান দিতে শুরু করেন। কিছু কালের মধ্যে বারবণিতাদের সঙ্গে সামন্ত সর্দারদের তুমুল বিবাদ শুরু হয় যা রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের। অপমানিত সামন্ত সর্দাররা হত্যা করতে শুরু করে বারবণিতাদের। আর তারাও অস্ত্র তুলে নেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই সম্রাট আকবর দ্বিতীয়বার চিতোর আক্রমণ করেন ও চিতোর ধ্বংস করেন। মহারানা উদয়সিংহ চিতোর ত্যাগ করে চলে যান পিছোলা হ্রদের তীরে। সেখানেই তিনি পূর্ব পরিকল্পনামতো গড়ে তোলেন তার রাজধানী। সম্রাট আকবর নাকি চিতোর দুর্গে প্রবেশ করেই খোঁজ করেছিলেন বিল্বস্তনা এক বারবণিতা বিল্ববতীর। পক্ক বিল্বের মতো যার স্তনযুগলের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন ভারত সম্রাট। কিন্তু বিল্ববতীর আর কোনো খোঁজ তিনি পাননি। ততদিনে কুম্ভপ্রাসাদের ভূগর্ভস্থ প্রাচীন কক্ষে অনির্বাণ অগ্নিশিখায় হারিয়ে গেছে বিল্বস্তন বিল্ববতী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *