বিরামগড়ের বন্দি
এক
মুম্বই থেকে কোলহাপুরের দিকে চলে গেছে যে ঝাঁ চকচকে হাইওয়েটা, তারই মাঝামাঝি জায়গায় ছোট একটা শহর, নাম আক্কানাদ। এই আক্কানাদ থেকে একটা সরু রাস্তা হাইওয়ে ছেড়ে ডানদিকে ঢুকে গেছে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার যাওয়ার পর সোজা রাস্তাটা হঠাৎই পাক খেতে খেতে একটা ছোট পাহাড়ের গায়ে চড়তে শুরু করেছে। শেষ হয়েছে যেখানে, সেখানেই শিবাজি মহারাজের আমলের দুর্গ, বিরামগড়।
দুর্গের পাথুরে পাঁচিলটা চল্লিশ ফুট উঁচু আর সব মিলিয়ে আড়াই কিলোমিটার লম্বা। এই পাঁচিলঘেরা বিরাট চৌহদ্দির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পনেরো ষোলোটা ছোট বড় পাথরে তৈরি বাড়ি। পেশোয়াদের আমল অবধি তার মধ্যে কোনোটা ছিল বারুদখানা, কোনোটা ঘোড়ার আস্তাবল, আবার কোনোটা রানিমহল। পাহাড়ের চূড়ার কাছে যে বাড়িটা, সেটাই সবচেয়ে বড়। ওটাই না কি ছিল দুর্গাধিপতির অফিস—কাম—রেসিডেন্স। এই বাড়িটার ছাদের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন পি.কে. ঘোষাল। প্রণবকুমার ঘোষাল। ফেরারি গ্রুপ অফ হোটেলস—এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
প্রণব ঘোষাল ছাদের পাঁচিলের ওপর হাত রেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়েছিলেন। তার পায়ের নিচে মাইলের পর মাইল ঘন জঙ্গলের সবুজ চাদর। সামনে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছিল। জঙ্গল আর পাহাড়ের ওপর গোলাপি, লাল, গেরুয়া, কমলা কত রকমের রং—ই যে একে একে ছড়িয়ে পড়ছিল তা আর বলে শেষ করা যায় না। চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু মাঝে মাঝে টিয়াপাখির ঝাঁক ট্যাঁ ট্যাঁ আওয়াজে সেই নৈঃশব্দ্যকে ভেঙে দিয়ে, দুর্গের দেয়ালের অসংখ্য ঘুলঘুলি আর ফাটলের মধ্যে তাদের লুকোনো বাসায় যাওয়া আসা করছিল। তা ছাড়া নিচের জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝে ময়ূরের কর্কশ চিৎকার। এছাড়া কোথাও আর কোনো আওয়াজ ছিল না।
খুব ভালো লাগছিল ঘোষাল সাহেবের। বহুদিন তিনি একা এমন শান্তভাবে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ পাননি। বহুদিন তিনি সূর্যাস্ত কিংবা সূর্যোদয় দেখেননি। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে তার দিন কাটে। সারা ভারতে মোট এগারোটা হোটেল রয়েছে ফেরারি গ্রুপের। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে সেই এগারোটা শহরে ছোটাছুটি করে বেড়াতে হয় তাকে, আর সবসময়েই তার পেছন পেছন ফাইল হাতে নিয়ে দৌড়য় ফেরারির ম্যানেজমেন্টের আরও চার পাঁচজন অফিসার। তারই মধ্যে আজ হঠাৎই এরকম একটা অকাজের দিন তার হাতে চলে এসেছে। আজ যে শুধু হাতে কাজ নেই তাই নয়, একজন ছাড়া আর কোনো সহকর্মীও নেই সঙ্গে।
মানুষের গলার আওয়াজে নিচের দিকে তাকালেন প্রণব ঘোষাল। ওই যে সেই সহকর্মীটি। ফেরারি গ্রুপের সেকেন্ড—ইন—কম্যান্ড, চিফ অ্যাকাউন্টান্ট সুধাকর আপ্তে। প্রায় চার তলার উচ্চতা থেকেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, আপ্তেও আজ মুডে আছে। এমনিতে শেভিল রোর থ্রি পিস স্যুট ছাড়া যাকে দেখা যায় না, সেই সুধাকর আপ্তে রংচঙে হাওয়াই—শার্ট আর বারমুডা পরে, প্রবল বেগে হাত পা নাড়তে নাড়তে চড়াই রাস্তাটা ধরে উঠে আসছে। ওর সঙ্গে মনুয়া বলে ছেলেটা রয়েছে। মনুয়া এই দুর্গের রাঁধুনি। ওকে নিয়ে আপ্তে জঙ্গল ভেঙে দু কিলোমিটার দূরে একটা ঝরনা দেখতে গিয়েছিল। ঘোষালসাহেবের শরীরটা খারাপ লাগছিল বলে উনি যাননি। এখন ওরা ফিরছে। ঘোষালসাহেব দেখলেন, মনুয়ার মাথায় একটা ছোট ঝুড়ি।
আপ্তে আর মনুয়া যখন দুর্গের দরজার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তখন ঘোষালসাহেব ওপর থেকে হাঁক ছাড়লেন — ঝুড়ি ভরে ওসব কী নিয়ে এলে আপ্তে?
ছাদের দিকে মুখ তুলে সুধাকর আপ্তে বলল, মাশরুম স্যার, লোকাল মাশরুম। যাকে বলে ব্যাঙের ছাতা। মনুয়া ঝরনার ধার থেকে তুলে আনল। আজ রাতে ফ্রায়েড রাইসের সঙ্গে চিকেন উইথ মাশরুম। রেসিপি—টা আমি মনুয়াকে বলে দেব। একবার খেয়ে দেখবেন, আপনার এগারোটা হোটেলের একটারও শেফ ওরকম বানাতে পারে কি না।
আচ্ছা আচ্ছা, সে হবে এখন। আপাতত তুমি চটপট ওপরে উঠে এসো। ফ্যানটাসটিক সানসেট হচ্ছে।
আপ্তে জবাব দিল, মাফ করবেন স্যার। অনেক চড়াই ভেঙেছি। আর ওই খাড়া সিঁড়িগুলো টপকাতে পারব না। আর, আমি তো মহারাষ্ট্রেরই লোক। অমন সানসেট অনেক দেখেছি। আপনি এনজয় করুন।
আপ্তে মনুয়াকে নিয়ে দুর্গের একতলায় ঢুকে পড়ল।
প্রণব ঘোষাল আবার সামনের দিকে তাকালেন। সব রং মুছে গিয়ে এখন শুধু অদ্ভুত একটা বেগুনি আভা ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়গুলোর গায়ে। অন্ধকার নেমে আসছে। পাহাড়ের গায়ে এখানে ওখানে এক এক মুঠো আলো জ্বলে উঠেছে। ওগুলো পাহাড়ি মানুষদের গ্রাম।
ওগুলোই কি সেই ভীল উপজাতির মানুষদের গ্রাম, যারা ছিল শিবাজির আসল শক্তি? মনে মনে ভাবলেন প্রণব ঘোষাল। ভাবতেই তার রোমাঞ্চ হল। আড়াইশো বছরে এখানে প্রায় কিছুই পালটায়নি। ওই পাহাড় জঙ্গল, ভীলদের গ্রাম। এই দুর্গ। সবকিছুই প্রায় একরকম রয়েছে। মনে হয় কান পাতলে এখনই ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনা যাবে। শোনা যাবে কোষ থেকে তলোয়ার টেনে বার করার ধাতব শব্দ। আর এইটাই হবে হোটেল বিরামগড়ের অন্যতম আকর্ষণ।
কথাটা ভাবতেই ঘোষালসাহেবের মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ল। ইয়েস। ঠিক এইজন্যেই বিরামগড় দুর্গ হতে চলেছে তার ফেরারি গ্রুপ অফ হোটেলস—এর বারো নম্বর হোটেল। অনেক টাকা খরচা করে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই ছোটখাটো দুর্গটাকে তিনি কিনেছেন। এবার এটাকে হেরিটেজ—হোটেলে কনভার্ট করবেন। বেশি কিছু বদলাবেন না। পাথরের দেয়াল, লোহার দরজা, কামান, বন্দুক সবই থাকবে। যে ঘুলঘুলিগুলো দিয়ে শত্রুদের গায়ে ফুটন্ত তেল ঢেলে দেওয়া হত থাকবে সেগুলোও। ওসবের সঙ্গে অ্যাড হবে লাক্সারি। এয়ার কন্ডিশনিং, স্পা, ব্যাঙ্কোয়েট, জিম — এইসব আর কী।
আর হ্যাঁ, দুর্গের মালিক জীবনদেব কেলকার সাহেবের আমলের লোকজনকে সরিয়ে দিয়ে কলকাতা থেকে ট্রেনড স্টাফ আনতে হবে। কিন্তু আশা করা যায় তাতে এই দুর্গের গায়ে জড়িয়ে থাকা যুদ্ধবিগ্রহের গন্ধ, এর গা ছমছমে ভাব—টাবগুলো নষ্ট হবে না। ওইগুলোর জন্যেই তো ফরেনাররা আসবে এখানে। যাকে বলে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম—সেই অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের টানে।
দুই
কোলহাপুর থেকে কেলকার সাহেবের এখানে আসবার কথা ছিল আজ দুপুরে। দুর্গ বিক্রির কন্ট্রাক্ট সই হবে। ষোলো কোটি টাকা ফেরারির অ্যাকাউন্ট থেকে কেলকার সাহেবের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়ে যাবে। এরকমই কথা ছিল। সেই মতনই বারোটা নাগাদ সান্তাক্রুজ এয়ারপোর্টে নেমেছিলেন পি.কে. ঘোষাল আর সুধাকর আপ্তে। কিন্তু একটার সময় হঠাৎ কেলকার সাহেবের ফোন। প্রচুর ক্ষমা টমা চেয়ে যা জানালেন, তা হল, ওঁনার এক আত্মীয় হঠাৎই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে নিয়ে উনি হাসপাতালে রওনা হচ্ছেন। কাজেই অ্যাপয়েন্টমেন্টটা দয়া করে যদি আগামীকাল শিফট করা যায়।
এরকম ক্ষেত্রে ‘না’ বলাটা চূড়ান্ত অভদ্রতা হত। কাজেই ঘোষাল সাহেব আর আপ্তে রাতটা বিরামগড়ে কাটানোই ঠিক করলেন। এইভাবেই পড়ে পাওয়া ছুটিটা হাতে এসে গেল ব্যস্ত মানুষ প্রণব ঘোষালের।
সেটা প্রণব ঘোষালের পক্ষে একদিক থেকে ভালোই হল। কারণ, এর আগে তিনি একবার মাত্র কয়েকঘণ্টার জন্যে বিরামগড়ে এসেছিলেন। তখন সবে জায়গাটা কেনার চিন্তা ভাবনা শুরু হয়েছে। তারপর থেকে সুধাকরই এখানে এসেছে। সব মিলিয়ে প্রায় সাত আটবার হবে। ও এখানকার লোকজনকেও ভালোমতন চিনে গেছে। প্রণব ঘোষাল ঠিক করলেন কাল সকালবেলায় উনিও প্রপার্টিটা ভালো করে ঘুরে দেখবেন। তাহলে এর পর আর্কিটেক্টের লোকজনের সঙ্গে রিনোভেশন প্ল্যান নিয়ে কথাবার্তা বলতে সুবিধে হবে।
আপাতত ছাদ থেকে আর কিছু দেখার নেই। পুরোপুরি অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশের তারার সঙ্গে পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে থাকা ভীলগ্রামের প্রদীপের আলো মিশে গেছে। নিচে নামার জন্যে প্রণব ঘোষাল সিঁড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, আর তখনই তিনি দেখতে পেলেন বৃদ্ধ মানুষটিকে।
সিঁড়ির মুখেই লোকটা দাঁড়িয়েছিল। ধবধবে সাদা চুল আর দাড়ি। পরনে বিশুদ্ধ মারাঠি কায়দায় পিরহান আর ধুতি। কানে সোনার মাকড়ি, হাতে লোহার বালা। লোকটা মাথা ঝুঁকিয়ে ঘোষালসাহেবকে প্রণাম জানাল। মারাঠি টানের হিন্দিতে বলল, হুজুরের যদি খুব ব্যস্ততা না থাকে তাহলে একটু বসেই যান। যে দুর্গ খরিদ করছেন তার ইতিহাসটা আর আপনাকে কে বলবে, এই বুড়ো মাধবরাও শিরোদকর ছাড়া?
ঘোষালসাহেব এক মিনিট ভেবে নিলেন। প্রস্তাবটা মন্দ নয়। যেমন চিতোরগড়ের সঙ্গে রানি পদ্মিনীর জওহর ব্রতের গল্প জড়িয়ে আছে সেরকম ইন্টারেস্টিং গল্প যদি বুড়ো কিছু বলতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে হোটেল বিরামগড়ের ব্রশিওরে সেটা ছেপে দেওয়া যেতে পারে। তিনি বললেন, না, তাড়া নেই। বলো কী বলবে।
বুড়ো প্রণব ঘোষালকে ছাদের একদিকে পড়ে থাকা একটা চারপাই দেখিয়ে সেটার ওপর বসতে ইশারা করল। নিজে বসল মুখোমুখি পাঁচিলের একটা ভাঙা অংশের ওপর। তারপর হঠাৎই অদ্ভুত একটা মন্তব্য দিয়ে তার কাহিনি শুরু করল। বলল, যে কোনো দুর্গের ইতিহাসই আসলে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। বীরত্ব দিয়ে দুর্গ জয় করা যায় না। বিশ্বাসঘাতক দিয়ে দুর্গ খোলাতে হয়। বিরামগড়েও ছিল এরকম এক বিশ্বাসঘাতক।
তখন শেষ পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাওয়ের আমল। গোরা সাহেবরা প্রাণপণে চেষ্টা করছে পুনে দখল করতে, কিন্তু তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ছোট্ট বিরামগড় দুর্গ। মাত্র একশো ঘোড়সওয়ার আর তিনশো পদাতিক সৈন্য নিয়ে দুর্গের অধিপতি যশোরাজ কেলকার যে লড়াইটা দিচ্ছেন তাতে ব্রিটিশদের চোখের ঘুম উড়ে যাওয়ার জোগাড়। দুর্গের নিচের ওই সরু পাহাড়ি খাতের মধ্যে দিয়েই তখন ছিল মুম্বাই থেকে পুনে যাবার একমাত্র রাস্তা। সেই রাস্তার ওপরে এই দুর্গ। ব্রিটিশরা একটা করে সৈন্যদল পাঠায় আর যশোরাজের সৈন্যরা ওপর থেকে গোলাবৃষ্টি করে তাদের নিপাত করে।
ব্রিটিশরা যে দুর্গ দখলের চেষ্টা করেনি তা নয়, কিন্তু সেটা তো অত সহজ কাজ ছিল না। দুর্গের তিনদিক ঘিরে পাহাড়ের খাদ। শুধু সামনের দিকে সরু একটা চড়াই রাস্তা। ওই রাস্তা ধরে ব্রিটিশ সৈন্যদের উঠতে দেখলেই মারাঠা সৈন্যরা ওপর থেকে আগুনের গোলা, পাথর, ফুটন্ত তেল এইসব ছুড়তে শুরু করত। তাছাড়া আশে পাশের পাহাড়ে দুর্ধর্ষ ভীলরা তো ছিলই। চোরাগোপ্তা আক্রমণে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কত লোকের বুকে যে তারা তির ফুঁড়ে দিয়েছে তার হিসেব নেই।
সব শেষে ছিল বিরামগড়ের মূল ফটক। সে এক আশ্চর্য জিনিস, দেখেছেন তো হুজুর? ভেতর থেকে একটা দশ বছরের ছেলেও সেই তিরিশ ফুট উঁচু লোহার গুল বসানো দরজা খুলে ফেলবে। কিন্তু বাইরে থেকে হাজার লোকে ঠেলেও সেই দরজাকে নড়াতে পারবে না।
হাতির কথা বলছেন? ওই ফটকের সামনে রাস্তাটা দেখেছেন? ঠিক ভাঁজ করা হাতের কনুইয়ের মতন বাঁকানো। হাতি যাতে বিরাট শরীর নিয়ে ওই বাঁক পেরোতে না পারে সেই জন্যেই ওটা অমন করে তৈরি। তার ওপর সারা দরজায় ধারালো পেতলের গুল বসানো। হাতি মাথা দিয়ে ঠেললে মাথা রক্তারক্তি হয়ে যাবে।
প্রণব ঘোষাল মনে মনে বুড়োর সমস্ত কথার নোট নিচ্ছিলেন। ওই ব্যাটা সুধাকর আপ্তে সাতবার এখানে এসেও এই সব ইন্টারেস্টিং তথ্য বার করতে পারেনি, আর তিনি মাত্র একবেলাতেই কত কিছু জেনে ফেললেন। একেই বলে ‘লাক’।
দুর্গ জিনিসটা অত সহজ নয় হুজুর—বলে চলল মাধবরাও। কাল সকালে ভালো করে দেখবেন। দুরকমের সিঁড়ি আছে। একটা হাতি কিংবা ঘোড়ার ওঠা নামার জন্যে—চার হাত চওড়া একেকটা ধাপ। আরেকরকমের সিঁড়ির সরু ধাপ, মানুষদের জন্যে। এই বিরামগড়ের মাটির নীচে পাঁচশো লোকের একবছরের খোরাকি চাল ডাল মজুত করে রাখার মতন গোলা আছে। পাহাড়ের মাথা থেকে যে ঝরনা নামছে তার জল ধরে রাখার জন্যে চার চারটে বড় তালাও আছে। অবরোধ করে বসে থাকবি? থাক না। কোনো অসুবিধে নেই।
প্রণব ঘোষাল তখনই মনে মনে ঠিক করলেন, ওই গোলাটাকে খুঁজে বার করে ওখানে একটা ক্যান্ডল—লাইট বার খুলবেন। ওঃ, পরিবেশটা কেমন হবে জাস্ট ভাবা যাচ্ছে না।
বুড়ো কিছুক্ষণ চোখ বুজে কী যেন ভাবল। তরপর বলল, শেষমেষ ব্রিটিশরা বহু চেষ্টার পর একজন বিশ্বাসঘাতককে খুঁজে বার করল। দুর্গের কর্মচারী ছিল লোকটা। প্রথমে সে দুর্গাধিপতি যশোরাজ কেলকারের খাবারে বিষ মেশাল। কিন্তু সে জানত না যশোরাজ বিষপাথরের থালায় ছাড়া খান না।
বিষপাথরটা কী জিনিস? জিজ্ঞেস করলেন প্রণব ঘোষাল।
সে এক আশ্চর্য পাথর হুজুর। তখনকার মুসলিম নবাবরা কোথা থেকে যে সে পাথর আমদানি করেছিলেন জানি না। সাধারণ মানুষ হীরে জহরত তবু চোখে দেখতে পেত, কিন্তু বিষপাথর চোখেও দেখতে পেত না, এমনই কিমতি সে জিনিস। বিষপাথরের থালায় বিষ—মেশানো খাবার দেওয়া মাত্র সাদা পাথর নীল হয়ে যেত। ওই বিষপাথরের থালার জন্যেই সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন যশোরাজ কেলকার।
কিন্তু বিশ্বাসঘাতক জিনিসটা হল শরীরের ভেতরের অসুখের মতন। বেশিদিন বাঁচতে দেয় না।
কেন বলছ এ কথা?
বলছি কারণ, এরপর শেষ অস্ত্রটা বার করল সেই বিশ্বাসঘাতক। রাতের অন্ধকারে দুর্গের মূল ফটক খুলে দিল।
কিছুক্ষণ আর কোনো কথা নেই। দুর্গের পায়ের কাছের জঙ্গল থেকে কোনো বন্য জন্তুর চিৎকার ভেসে এল। প্রণব ঘোষাল গলা খাকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তারপর?
তারপর আর কী? এটা আঠেরোশো সতেরো সালের ঘটনা। তার পরের বছর পুরো মারাঠা সাম্রাজ্যটাই যে ব্রিটিশ কোম্পানির কবজায় চলে এল সে তো আপনারা জানেন।
আর সেই লোকটার কী হল? সেই ট্রেচারার?
পালাতে পারেনি। ইংরেজদের কাছ থেকে ইনাম পাওয়া আর হয়নি তার। দুর্গের সৈনিকরা নিজেরা মরার আগেই তাকে মেরে ফেলেছিল।
তবে একটা কথা বলি হুজুর। মৃত্যুর পরেও তার আত্মা কিন্তু মুক্তি পায়নি। এখনো সে বিরামগড়ের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। হয় তো প্রায়শ্চিত্তের পথ খোঁজে।
আপনারা এখানে হোটেল খুললে সে কোথায় যাবে জানি না।
চলি হুজুর। প্রণাম।
আবার ঝুঁকে পড়ে প্রণাম জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল সেই বুড়ো মানুষটা। প্রণব ঘোষাল চারপাইয়ের ওপর ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলেন, যদি সেই অভিশপ্ত বিশ্বাসঘাতক হোটেল চালু হওয়ার পরেও এই দুর্গে ফিরে ফিরে আসে? যদি এরকম হয় যে, হোটেলের কোনো গেস্ট রাতে জানলা দিয়ে দেখতে পেল এক ছায়া মূর্তি মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে চেষ্টা করছে বিশাল খিলটা খুলবার, কিন্তু ছায়ার শরীর নিয়ে পেরে উঠছে না। কী হবে তাহলে? কোথায় পৌঁছে যাবে এই হোটেলের টি আর পি?
তিন
সাহাব, সাহাব, উঠিয়ে। খানা বন গিয়া। চলুন সাহেব, ডিনার সেরে নেবেন।
কানের কাছে ডাকাডাকি আর হাঁটুর ওপর হাতের ছোঁয়ায় ধড়মড় করে উঠে বসলেন প্রণব ঘোষাল। ছাদের ওপর এই চারপাইটায় শুয়েই কখন যে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছিলেন বুঝতেই পারেননি। এখন চোখ খুলে দেখলেন মনুয়া তাকে ডাকবার জন্যে ছাদে উঠে এসেছে।
লজ্জিতমুখে ঘোষাল সাহেব হাতঘড়িটার দিকে তাকালেন। বেশি বাজেনি। সবে সাড়ে আটটা। তবে মনুয়ার কথা মতন ডিনারটা সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া যায়। তাহলে কাল ভোর ভোর উঠে পুরো দুর্গটা দেখে নেওয়া যাবে। ওই বুড়ো যা সব বলে গেল—দুরকমের সিঁড়ি, দরজার ধারালো গুল, মাটির নিচের ঘর—ওগুলো সব মিলিয়ে দেখে নিতে হবে। হোটেলটাকে নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার সময় ওগুলোকে রক্ষা করা খুব জরুরি। ওগুলোর সঙ্গে ইতিহাস জড়িয়ে আছে — বিশ্বাসঘাতকতার রোমাঞ্চকর ইতিহাস।
ঘোষালসাহেব মনুয়ার পেছন পেছন দুর্গাধিপতির প্রাসাদের একতলায় এক বিশাল হলঘরে পৌঁছলেন। পাথরের দেয়াল। ছাদের কড়িবরগাগুলো বহু বছরের ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে। সেই কড়িবরগা থেকেই শেকলে বাঁধা দুটো বিরাট বাতিদান ঝুলছে। মনুয়া বাতিদানে অনেকগুলো মোমবাতি জ্বেলে দিয়েছে। তার আলোয় দেয়ালে টাঙানো অস্ত্রশস্ত্রগুলো মাঝে মাঝে চকচক করে উঠছে। প্রণব ঘোষাল এমন পরিবেশ শুধু সিনেমার পর্দাতেই এতদিন দেখেছেন। আজ বাস্তবে এরকম একটা জায়গায় পৌঁছিয়ে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি আবারও মনে মনে ভাবলেন, লাক্সারি জিনিসটা পয়সা দিয়ে যখন তখন কেনা যায়, কিন্তু আভিজাত্য অর্জন করতে হয়। আড়াইশো বছর ধরে বিরামগড় দুর্গের এই ডিনার—হল সেই আভিজাত্য অর্জন করেছে।
ঘরের ঠিক মাঝখানে শাল কাঠের বিরাট ডিনার—টেবিল। পালিশ করা নয়, করাত দিয়ে চিরে গাছের গুঁড়িগুলোকে পাশাপাশি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় একদিন এই টেবিলে বসে যারা খানাপিনা সারত তারা ছিল রোদে পোড়া, জলে ভেজা রুক্ষ সব মানুষ। তারা ছিল ঘোড়ার পিঠে মাইলের পর মাইল ছুটে চলা যোদ্ধা।
ঘর আর টেবিলের সঙ্গে মানানসই বাসনকোসন। তাদের মধ্যে চিনে ক্রকারির রংচং নেই। মোরাদাবাদি পেতলের সূক্ষ্ম কারুকাজও না। সাদামাটা ভারী ভারী কাঁসা পেতলের বাটি গ্লাস। পাথরের থালা।
ঘোষালসাহেবকে টেবিলের এক প্রান্তে বসিয়ে মনুয়া উঠোনের অন্যদিকে রান্নাঘরে খাবার আনতে চলে গেল। সে যখন চলে যাচ্ছে তখন ঘোষালসাহেব তাকে পেছন থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আপ্তে সাহেব কোথায়, মনুয়া? তিনি খাবেন না?
নেহি হুজৌর। উনকি তবিয়ত ঠিক নেই হ্যায়। মনুয়া জানাল দুপুরবেলায় রোদে ঘুরে আপ্তে সাহেবের না কি ভয়ঙ্কর শরদর্দ হয়েছে। তাই না খেয়েই শুতে চলে গেছেন।
মনুয়া রান্নাঘরে চলে গেল। ঘোষাল সাহেব মন দিয়ে উল্টোদিকের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা একটা বর্ম দেখছিলেন আর মনে মনে ভাবছিলেন আগেকার দিনের সমস্ত মানুষের শরীরই কি ওই বর্মটার মতন দৈত্যাকার ছিল? হঠাৎ তিনি খেয়াল করলেন কে যেন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ তুলে দেখলেন সেই বুড়ো মাধবরাও। তাকে দেখে মনটা খুশি হয়ে উঠল ঘোষাল সাহেবের। বললেন কী ব্যাপার মাধবরাও?
মাধবরাও চাপা স্বরে বলল, মনুয়ার মতন চ্যাঙড়ারা কী জানে, কেমন করে মেহমানের খাতিরদারি করতে হয়? থালা লাগিয়েছে দেখুন। এখানে একটা, ওখানে একটা। হুজৌর কি নিজের হাতে এসব সাজাবেন? লজ্জা লজ্জা।
বলতে বলতে মাধবরাও অভ্যস্ত হাতে চটপট থালা বাটিগুলোকে ঘোষালসাহেবের সামনে সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। দুয়েকটা নতুন বাসনও কোথা থেকে যেন নিয়ে এল। তারপর মাথা নিচু করে প্রণাম জানিয়ে যেমন এসেছিল তেমনি আবার বেরিয়ে গেল।
মনুয়া কাঁসার থালায় গরম ধোঁয়া ওঠা পোলাও বেড়ে দিল। তারপর পাশের পাথরের বাটিতে ঢেলে দিল চিকেন উইথ মাশরুম।
তারপর মনুয়া আর ঘোষালসাহেব দুজনেই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন সেই পাথরের বাটির দিকে। বাধ্য হলেন তাকিয়ে থাকতে। কারণ তখন সাদা পাথর রং বদলাচ্ছে। আকাশি থেকে হালকা নীল, তারপর দেখতে দেখতে থ্যাঁতলানো নখের মতন কালচে নীল হয়ে গেল সেই পাথরবাটি।
মনুয়া নিশ্চয় দুর্গের বাসিন্দাদের মুখে বংশপরম্পরায় চলে আসা গল্পটা জানত। সেইজন্যেই প্রণব ঘোষাল কিছু বলার আগেই মনুয়া নিজেই অস্ফুট স্বরে দুবার বলে উঠল—বিষপাথর! বিষপাথর! তারপরেই সে কাঁপতে কাঁপতে মেঝের ওপর বসে পড়ল। প্রণব ঘোষাল যখন টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে তার হাতটা ধরে ওঠালেন তখন সে কেবল বিড় বিড় করে বলছে মাফ কর দো, মুঝে মাফ কর দো সাহাব। গলতি হো গ্যয়া মুঝসে। প্যাসা কে লালচ মে বহোত বড়া গলতি কর দিয়া ম্যায়নে।
চার
দুর্গাধিপতি যশোরাজ কেলকারের বর্তমান বংশধর জীবনদেব কেলকার পরদিন ভোর না হতেই সঙ্গে পুলিশ নিয়ে বিরামগড় দুর্গে এসে উপস্থিত হলেন। কারণ, রাতেই তাকে ঘোষালসাহেব টেলিফোনে সব কথা জানিয়েছিলেন। বিরামগড়ের অন্য কর্মীরা প্রণব ঘোষালের মুখ থেকে সব শুনে সুধাকর আপ্তে আর মনুয়াকে সারা রাত একটা ঘরে আটকে রেখে দিয়েছিল। পুলিশের সামনে ফেরারি গ্রুপের চীফ অ্যাকাউন্টান্ট সুধাকর আপ্তে স্বীকার করল যে, কোম্পানির প্রচুর পয়সা সে ইতিমধ্যেই চুরি করেছে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হতে না পারলে সেই চুরি সে আর বেশিদিন ঢেকে রাখতে পারত না। অথচ প্রণব ঘোষাল বেঁচে থাকতে তার পক্ষে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পোস্টটা পাওয়া সম্ভব নয়। অতএব সে ঠিক করেছিল বিষাক্ত মাশরুম খাইয়ে প্রণব ঘোষালকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে।
আপ্তের প্ল্যানটা প্রায় নিখুঁতই ছিল। রান্না করে খাওয়ার মতন নিরাপদ মাশরুম আর প্রাণঘাতী বিষাক্ত মাশরুম এখানকার জঙ্গলে পাশাপাশিই গজিয়ে ওঠে। তাদের চেহারাও প্রায় একইরকম। খুব অভিজ্ঞ লোক ছাড়া অন্য কেউ তাদের আলাদা করতে পারে না। তাই প্রতি বছরই দুয়েকজন ভুল করে বিষাক্ত মাশরুম খেয়ে মারা যায়।
মনুয়া অবশ্য খুব ভালো করেই তফাতটা জানত এবং আজ সে বেছে বেছে বিষাক্ত মাশরুমই নিয়ে এসেছিল। তবে প্রণব ঘোষাল মারা গেলে সে তো আর সে কথা স্বীকার করত না। কাজেই প্রণব ঘোষালের মৃত্যুটা মনুয়ার অনিচ্ছাকৃত ভুল বলেই চালিয়ে দেওয়া যেত।
সবই ঠিকঠাক হত, শুধু যদি মাশরুমের তরকারিটা বিষপাথরের বাটিতে না পড়ত।
মনুয়া আর সুধাকর আপ্তেকে নিয়ে পুলিশের জিপ চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরেও জীবনদেব কেলকার বারবার নিজের মনেই মাথা নাড়ছিলেন আর বলছিলেন, অবিশ্বাস্য অবিশ্বাস্য! আমরা ছোটবেলা থেকে যে জিনিসের গল্প শুনে আসছি, সে জিনিস যে আমাদের রান্নাঘরের বাসনপত্রের মধ্যেই মিশে রয়েছে তা জানব কী করে? ঘোষালসাহেব, ধন্য বাঙালি নলেজ। আপনি দেখিয়ে না দিলে কোনোদিন পূর্বপুরুষের এই অমূল্য সম্পদ হাতে পেতাম?
প্রণব ঘোষাল দুয়েকবার বলতে গিয়েছিলেন, তিনি মোটেই ওই বিষপাথরের বাটি খুঁজে বার করেননি, করেছে মাধবরাও বলে এক বুড়ো। তার জন্যেই তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই জীবনদেব কেলকার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছেন, ওই নামে কেউ এখানে নেই মিস্টার ঘোষাল। আমার চাকরিতে ওই নামে কেউ থাকতে পারে না, তা সে যত গুণী লোকই হোক। কারণ যে বিশ্বাসঘাতকটার জন্যে আমার পূর্বপুরুষ যশোরাজ মারা গিয়েছিলেন তার নাম ছিল মাধবরাও। মাধবরাও শিরোদকার।