বিয়ের খোঁপা
“তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎ কর্মপরায়ণ তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজে অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ যারা বিবাহে সামর্থ্য নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে, যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেন।”
(আল-কোরআন-সূরা আল-নূর, আয়াত নং-৩২ ও ৩৩, পারা-২৪)
১
মহিম মসজিদ থেকে আসরের নামাজ পড়ে বাসার গেটের কাছে এসেছে, এমন সময় সৌরভের গাড়ি আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। সৌরভ কাছে এসে গাড়ি থামিয়ে বলল, তোর কাছে এলাম।
: তাতো দেখতেই পাচ্ছি। চল্ ভিতরে চল্। তারপর দারোয়ানকে গেট খুলে দিতে বলল।
ড্রইং রুমে এসে মহিম বলল, একটু বস আমি চা-নাস্তার কথা বলে আসি।
: ওসব কিছু লাগবে না। খুব ব্যস্ত আছি। অনেকের কাছে যেতে হবে। তারপর একটা কার্ড তার হাতে দিয়ে বলল, আমার বিয়ে। তোকে আসতেই হবে।
মহিম কার্ডটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, এত শীঘ্রী বিয়ে করছিস্ কেন? তুই তো বলেছিলি, আমেরিকায় পড়তে যাবি।
ও আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না, বাবা-মা জোর করে দিচ্ছে। তারা নাকি কোনো আত্মীয়কে কথা দিয়েছিল, তাদের মেয়েকে বৌ করবে বলে। আমেরিকায় পড়তে গেলে কবে দেশে ফিরব না ফিরব তার কোনো ঠিক নেই, তাই বিয়ে দিচ্ছে। আমিও বলে দিয়েছি। বৌ নিয়ে আমেরিকায় চলে যাব, সেখানে দু’জনেই পড়াশুনা করব।
: তাহলে তো খুব ভালো কথা।
: তুই আসবি কি-না বললি না যে?
: আসব না মানে, নিশ্চয় আসব। তবে, বলে থেমে গেল।
: কি হল থেমে গেলি কেন? তবেটা কি শুনি।
: মানে বলছিলাম কি তোদের বিয়েতে তো খুব গান-বাজনা হবে। তুইতো জানিস, আমি ঐসবের ধারে কাছে যাই না।
: আরে না না, ওসব কিছু হবে না। আর হলেও যেখানে বিয়ে হবে সেখানে। হবে না। বাড়িতে হয়তো চেঞ্জার-টেঞ্জার কেউ বাজাতে পারে। সে সব তোর কানে পৌঁছাবে না। আচ্ছা তুই যে এই কথা বলছিস, কিন্তু রাস্তা-ঘাটে, দোকানে হোটেলে এবং বাড়িতে বাড়িতে রেডিও, টিভি ও টেপে দিনরাত কত গান বাজনা হচ্ছে, সে সব তো তোর কানে যায়। তখন কি করিস? কানে তুলো দিস, না আঙ্গুল দিয়ে বসে থাকিস?
: ঐ সব কানে দিয়ে আর কতক্ষণ থাকব? তবে জেনেশুনে যেখানে গানবাজনা হয় সেখানে যাই না।
: কেন?
: জেনেও জিজ্ঞেস করছিস্ কেন? ইসলামে ঐসব জায়েজ নেই, তাই যাই না। জানিস্, এক বাড়ির গানবাজনার ঠেলাতে অন্য বাড়ির ছাত্র-ছাত্রীদের যেমন পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে তেমনি মেয়েদের নামায কালাম পড়ার সময়ও খুব অসুবিধে হচ্ছে। সৌরভ অনেক দিন আগের থেকে জানে, মহিম খুব ধার্মিক। যাত্রা, থিয়েটার, সিনেমা, নাচ, গান, বাজনা কখনও দেখেনি ও শুনেনি। বলল, আচ্ছা, তুই তো কোরআন হাদিসের ব্যাখ্যা-ট্যাখ্যা পড়িস, তাতে কি সত্যিই লেখা আছে ঐসব হারাম?
: ডাইরেক্ট নেই, তবে ইনডাইরেক্ট আছে।
: যেমন?
: যেমন ধর, তাকে তোর বাবা বললেন, তোমার অমুক কাজটা করা উচিত নয়। কারণ ওটা করলে তোমার এই এই ক্ষতি হবে। এই কথার মধ্যে তোর বাবার ইনডাইরেক্ট নিষেধ রয়েছে। আর যদি বলেন, তুমি ঐ কাজ করবে না। করলে এই এই ক্ষতি হবে। এই কথার মধ্যে তোর বাবার ডাইরেক্ট নিষেধ রয়েছে। এবার নিশ্চয় আমার কথা বুঝতে পেরেছি।
: সবটা না পারলেও কিছুটা পেরেছি। কিন্তু গানবাজনা করলে বা শুনলে কি এমন ক্ষতি হবে বুঝতে পারছি না।
: বুঝবি কি করে? এসব জিনিস নিয়ে তোরাতো কোনো চিন্তা ভাবনা করিস না। আজকাল তো আবার ঘরে ঘরে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা নাচ গানের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। আমাদের পাশের বাড়ির তিন তলার ভাড়াটিয়ার এক মেয়ে প্রতিদিন ভোরে হারমোনিয়ামে এমন সারেগামা সাধে যে, আমাদের বাসার মেয়েদের ফজরের নামাযও কোরআন শরীফ পড়তে বেশ অসুবিধে হয়। যাকগে, ওসব কথা তুই বুঝবি না, তোর কার্ডে দু’দিন নিমন্ত্রণের কথা লেখা আছে। বিয়ের দিন বরযাত্রী হিসাবে যাব, কিন্তু বৌ-ভাতের দিন যেতে পারব না।
: যাবি না কেন শুনি?
: মুসলমানদের বৌ-ভাত বলে কিছু নেই। এটা করা ইসলামে জায়েজ নেই।
: কিন্তু সব মুসলমানরা করে থাকে।
: সব মুসলমানরা করে না। অনেকে করলেও যারা ধর্মীয় জ্ঞান রাখে এবং সেসব মেনে চলে তারা বৌ-ভাত করে না, ওলিমা করে।
: আরে বাবা, ওলিমা আর বৌ-ভাত একই কথা।
: না, এক কথা নয়। বৌ-ভাত হল, বৌ-ভাতে যাদেরকে নিমন্ত্রণ করা হয়, তারা ধনী আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। তারা খাওয়া-দাওয়ার আগে বা পরে বৌ দেখবে এবং তাকে কিছু উপহারসামগ্রী দেবেন। আর ওলিমা হল, ধনী, গরিব আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সবাইকেই নিমন্ত্রণ করবে। আর সেই সঙ্গে ফকির মিসকীনদেরকেও খাওয়াবে। সেখানে বৌ দেখার ও উপহার দেয়ার কোনো প্রচলন নেই। ঘরের বৌকে আত্মীয়-অনাত্মীয় পুরুষদের দেখান ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ।
: সে যাই হোক, তুই দু’দিনই আসবি। বৌ-ভাতের দিন তাকে কিছু নিয়ে আসতে হবে না। আর আমার বৌকেও দেখতে হবে না। যদি না আসি, তাহলে মনে ভীষণ কষ্ট পাব।
: ঠিক আছে, ইনশআল্লাহ আসব।
২
মহিম ও সৌরভ ধনী ঘরের সন্তান। প্রত্যেকের নিজস্ব গাড়ি আছে। ধানমন্ডি বয়েজ হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকে বন্ধুত্ব। ক্লাস সিক্স থেকে সৌরভ প্রতি বছর ফাস্ট হয়, আর মহিম সেকেন্ড। সাধারণতঃ ফার্স্ট সেকেন্ড ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় না, বরং রেষারেষি থাকে। কিন্তু ওদের দুজনের মধ্যে ভীষণ ভাব। একজন কোনো কারণে স্কুলে না এলে অন্যজনে তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ-খবর দেয়। সব থেকে আশ্চর্যের কথা, মহিম ও তাদের ফ্যামিলির সবাই খুব ধার্মিক। আর সৌরভ ও তাদের ফ্যামিলির সবাই খুব মডার্ন। ধর্মের কোনো কিছু মেনে চলা তো দূরের কথা, ধর্মীয় জ্ঞান তাদের নেই বললেই চলে। তবু দু’জনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। এমনকি স্কুল কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে পড়ার সময়ও সেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক এতটুকু শিথিল হয়নি। দু’জনেই এ বছর ফিজিক্সে অনার্স নিয়েছে।
সৌরভ ভালো ছাত্র, তার উপর বড়লোকের ছেলে অনেক গার্লফ্রেন্ড থাকা স্বাভাবিক। তাদের মধ্যে অনিকা নামে একটা মেয়ে সৌরভের সঙ্গে একটু বেশি মেলামেশা করে। অনিকাও ধনীর কন্যা। অত্যন্ত চালাক চতুর মেয়ে। পড়াশুনায় ভালো। দেখতে শুনতেও মন্দ নয়। সৌরভদের বাসায় যখন-তখন আসে। তার সঙ্গে প্রায় বেড়াতে যায়। অনিকা সৌরভের সবকিছু জেনে শুনে তার দিকে এগিয়েছে। মুখে ভালোবাসার কথা না বললেও কথাবার্তায় ও আচার ব্যবহারে মনের বাসনা জানাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সৌরভের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে অন্যান্য গার্লফ্রেন্ডের মতো তার সঙ্গে মেলামেশা করে। সৌরভের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে অনিকা ভাবল, সে কি অন্য কোনো মেয়েকে ভালবাসে, কথাটা চিন্তা করে তার সঙ্গে মেলামেশা কমিয়ে দিয়ে লক্ষ্য রাখল, কাকে সৌরভ ভালোবাসে জানতে হবে। দু’তিন মাস কেটে যাবার পরও অনিকা কিছুই জানতে পারল না।
অনিকা যে সৌরভকে বেশ কিছুদিন এড়িয়ে চলছে তা সে বুঝতে পেরে একদিন ভার্সিটিতে দেখা হতে বলল, কি ব্যাপার অনিকা, আজকাল যে তোমার পাত্তা পাওয়া যায় না?
: কেন? প্রায়ই তো এখানে আমাদের দেখা সাক্ষাত হচ্ছে?
: তা হচ্ছে, তবে আগে তুমি প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতে। এখন ছেড়ে দিয়েছ, তাই বললাম আর কি।
: তোমার কথা অবশ্য ঠিক, তবে তুমি তো একবারও আমাদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ-খবর নাওনি।
: কয়জনের নেব বল, তোমার মতো আরও তো অনেকে আছে? যাকগে, এখন চলি, আমাদের বাসায় এস কেমন? তারপর অনিকা কিছু বলার আগে সেখান থেকে চলে গেল।
তার কথা শুনে অনিকা অপমান বোধ করে খুব রেগে গেল। ভাবল, তাহলে আমাকে অন্য পাঁচটা গার্লফ্রেন্ডের মতো মনে করে? ঠিক আছে, আমিও দেখে নেব কতটা তুমি অহঙ্কারী, তোমার অহঙ্কার যদি না ভাঙ্গতে পারি তাহলে আমার নাম অনিকা নয়।
কয়েক দিন পর একদিন বিকেলে অনিকা সৌরভদের বাসায় এসে দেখল, ড্রইং রুমে কয়েকজন ছেলে মেয়ে এক সঙ্গে বসে গল্প করছে। অনিকা গুড আফটারনুন জানিয়ে সবাইয়ের দিকে এক পলক চোখ বুলাতে গিয়ে দিপালীকে দেখতে পেল। দিপালীর সাথে অনিকার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তার কাছে গিয়ে বলল, কিরে কেমন আছিস?
: দিপালী হাসিমুখে বলল, ভালো। তুই?
: আমিও ভালো। তা তোরা সব বসে রয়েছিস কেন? সৌরভ কোথায়।
: সৌরভ কাপড় চেঞ্জ করতে গেছে। আমরা বেড়াতে যাব। তুইও চল্ আমাদের সাথে।
: সে দেখা যাবে, বস্ আমি একটু খালাআম্মার সাথে দেখা করে আসি। কথা শেষ করে অনিকা ভিতরে চলে গেল।
এখানে যারা এসেছে, তারা প্রায় সবাই জানে অনিকা সৌরভকে ভালবাসে। তাই কেউ কিছু না বলে নিজেদের গল্প-গুজব চালিয়ে যেতে লাগল।
অনিকা প্রথমে সৌরভের মা আবিদা বেগমের কাছে গিয়ে বলল, খালাআম্মা কেমন আছেন?
: ভালো আছি মা, তুমি অনেক দিন আসনি কেন? কোনো অসুখ-বিসুখ করেনি তো?
: না খালাআম্মা, ওসব কিছু নয়, অন্য একটা ব্যাপার ছিল। তা সৌরভ কোথায়?
: সে তো ড্রইং রুমে বন্ধুদের সাথে গল্প করছিল, ওখানে নেই?
: না নেই। মনে হয় রুমে আছে, আমি তার কাছে যাচ্ছি বলে অনিকা সৌরভের রুমের দিকে এগোল।
সৌরভ তখন খালিগায়ে জাঙ্গিয়া পরে ফুল প্যান্ট পরছে, ঠিক সেই সময় অনিকা রুমে ঢুকে সৌরভের দিকে চেয়ে মোহিত হয়ে গেল। ফর্সা টকটকে সুঠাম দেহ, চওড়া বুক লোমে ভর্তি, পুরুষের এ রকম শরীর সব মেয়েরা কামনা করে। অনিকা অনেক আগে থেকে সৌরভকে ভালবাসলেও কোনোদিন তাকে স্পর্শ করেনি। ভাবত, আগে সৌরভ তাকে স্পর্শ করুক, তারপর সে যা করার করবে। সে আশা তার পূরণ হয়নি। আজ খালিগায়ে তাকে দেখে বিবেক হারিয়ে ফেলা। সব কিছু ভুলে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে লোমশ বুকে মাথা রেখে বলল, সৌরভ তুমি এত নিষ্ঠুর কেন, আমি যে তোমাকে কত ভালোবাসি তা কি তুমি বুঝতে পারনি? অনিকার শেষের দিকের কথাগুলো কান্নার মতো গলা থেকে বেরিয়ে এল।
ঘটনার আকস্মিকতায় সৌরভ কি করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে পারল না।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে নিজেকে মুক্ত করে একটু গভীর স্বরে বলল, না জানিয়ে হঠাৎ করে এখানে আসা তোমার উচিত হয়নি। ভালবেসেছ ভালো কথা। তাই বলে এভাবে নিবেদন করাও তোমার ঠিক হয়নি। এতদিন আমরা একসঙ্গে লেখাপড়া করছি। আমিও তোমাকে ভালোবাসি কিনা বোঝা উচিত ছিল। যাই হোক, এতে আমি কিছু মনে করিনি। আশা করি, তুমিও কিছু মনে করবে না। আমরা বেড়াতে যাব, সঙ্গী হলে খুশি হব। যাও ড্রইং রুমে গিয়ে বস, আমি আসছি।
অনিকা একটু বেশি সেক্সচুয়েল ধরনের মেয়ে। সেক্স সম্বন্ধে অনেক বই পড়েছে। তার জ্ঞানমতে কোনো যুবতী যদি কোনো যুবককে জড়িয়ে ধরে প্রেম নিবেদন করে, তা হলে সেই যুবক কিছুতেই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে না। কিন্তু সৌরভকে ব্যতিক্রম দেখে যেমন সে হতবাক হয়ে গেল, তেমনি ভীষণ অপমান বোধ করে অত্যন্ত রেগে গেল। রাগের চোটে কাঁপতে লাগল। অনেক কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারল না। কয়েক সেকেন্ড তার দিকে কটমট করে চেয়ে থেকে মাথা নিচু করে সেখান থেকে বেরিয়ে এল। তারপর কাউকে কিছু না বলে হন হন করে নিজের গাড়িতে উঠে চলে গেল। যেতে যেতে রাগে ফুলতে ফুলতে চিন্তা করল, সৌরভ নিশ্চয় নপুংসক, নচেৎ এ রকম করতে পারত না।
সৌরভ বাইরে যাবার পোশাক পরে কিছুক্ষণ পরে ড্রইংরুমে এসে অনিকাকে দেখতে পেল না। সে জানে দিপালীর সঙ্গে তার খুব ভাব, তাই দিপালীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, অনিকা এখানে আসেনি?
: ওতো ভিতর থেকে এসে চুপচাপ গাড়ি নিয়ে চলে গেল। কেন, আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি?
: হয়েছে, তাকে তো আমি তোমাদের সঙ্গে থাকতে বললাম। যাকগে, যে আমাদের সঙ্গে যেতে চায় না, তাকে তো আর জোর করে নিয়ে যাওয়া যায় না? কিন্তু মহিম তো এখনও এল না?
: সৌরভ তাকে আজ বিকেলে আসতে বলেছিল। সে কথা দিপালী জানে। তার কথা শুনে বলল, সে এলেও মেয়েদের সঙ্গে বেড়াতে যেত না। তাই না এসে এক রকম ভালোই করেছে। চল আমরা বেরিয়ে পড়ি।
এরপর থেকে অনিকা আর কোনো দিন সৌরভের ধারে-কাছে ঘেঁষে না। ভার্সিটিতে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে, না দেখার ভান করে পাশ কেটে চলে যায়। সৌরভ তা বুঝতে পেরে তার দিকে চেয়ে শুধু মৃদু হাসে। অনিকার ব্যাপারটা সে গোপন রেখেছে। এমন কি অন্তরঙ্গ বন্ধু মহিমকেও জানায়নি।
সৌরভদের বাড়ি শ্যামলী। আর মহিমদের বাড়ি মগবজারে। সৌরভের বিয়ে যার সঙ্গে হচ্ছে তার নাম পূর্ণিমা। পূর্ণিমা, পূর্ণিমা চাঁদের মত সুন্দরী। মেয়ে পুরুষ যে কেউ তার দিকে তাকালে সহজে দৃষ্টি সরাতে পারে না। তাদের বাড়ি সুত্রাপুরে। সে বিয়ে পাস করেছে। তার বাবাও খুব ধনী। ফরাশগঞ্জের খুব বড় কাঠের ব্যবসায়ী। দু’তিনটে স’মিলও আছে। তাদেরও বাড়ি, গাড়ি আছে। পূর্ণিমা দু’ভাইয়ের এক বোন, সে ছোট। ভাইয়েরা ব্যবসা দেখাশুনা করে। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। পূর্ণিমা উচ্চ সমাজের মেয়ে হলেও খুব ধার্মিক। ধর্মীয় বই অনেক পড়াশুনা করে।
বিয়ের দিন বিকেলে পূর্ণিমার ভাবিরা ননদকে এক বিউটি পার্লারে বিয়ের খোঁপা বাঁধার জন্য নিয়ে গিয়েছিল। পূর্ণিমা প্রথমে যেতে রাজি হয়নি। ভাবিদেরকে বলেছিল, এটা অপচয় ও বড়লোকি দেখান। এগুলো করা ইসলামিক দৃষ্টিতে না জায়েজ। ভাবিরা তার কথা শুনেনি, জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। ফিরতে তাদের সন্ধ্যে পার হয়ে গেল। পূর্ণিমার কয়েকদিন আগে সর্দি জ্বর হয়েছিল। মাথায় সর্দি বসে গিয়ে সাইনাসিসের মতো হয়েছে। আজ সকাল থেকে ঘাড়ে ও মাথায় বেশ যন্ত্রণা হচ্ছিল। বিউটি পার্লার থেকে ফেরার পথে গাড়িতেই পূর্ণিমা ভাবিদেরকে বলল, খোঁপার গোড়ায় বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কিছু যেন কামড়াচ্ছে।
বড় ভাবি বলল, তোমার তো সকাল থেকে মাথার ও ঘাড়ের যন্ত্রণা হচ্ছিল, তার উপর খোঁপা বাঁধতে হয়তো একটু বেড়েছে। তাই ঐ রকম মনে হচ্ছে। তাছাড়া ভাল অবস্থায় খোঁপা বাঁধলে এমনি একটু যন্ত্রণামতো হয়। কিছুক্ষণ পরে কমে যাবে।
বড় ভাবির কথা শুনে পূর্ণিমা ভাবল, তাই হয়তো হবে ও কিন্তু যন্ত্রণাটা ক্রমশঃ বাড়তে লাগল।
রাত নয়টার সময় বিয়ে পড়ান হয়ে যাবার পর পূর্ণিমা ছোট ভাবিকে ডেকে বলল, তুমি আমার খোঁপা খুলে দাও। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে, সহ্য করতে পারছি না।
ছোট ভাবি বলল, ওমা সেকি? বারোশো টাকা দিয়ে তোমার খোঁপা বাঁধিয়েছি। এখন ভোলা যাবে না। খুলতে হয় স্বামীর বাড়ি গিয়ে খুলবে। এই কথা বলে সে চলে গেল।
একটু পরে পূর্ণিমা বড় ভাবিকেও ডেকে যন্ত্রণার কথা বলে খোঁপা খুলে দিতে বলল। সেও ঐ একই কথা বলে চলে গেল।
পূর্ণিমার তখন যন্ত্রণার চোটে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।
৩
খাওয়া-দাওয়ার পর রাত এগারটায় বরযাত্রীরা বরকনে নিয়ে ফিরে এল।
পূর্ণিমাকে যখন মেয়েরা বরের গাড়িতে তুলে দেয় তখন সে বেসামাল হয়ে পড়েছিল। পিছনের সীটে সৌরভ ও পূর্ণিমা আর ড্রাইভারের পাশে শুধু সৌরভের এক দুলাভাই বসেছেন। কিছুদূর আসার পর পূর্ণিমা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে জড়িয়ে জড়িয়ে কোনো রকমে সৌরভকে বলল, আমার খোঁপাটা খুলে দিতে পারেন? ঘাড়ে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেউ যেন ঘাড়ের রগ কেটে দিচ্ছে।
সৌরভ নববধূর কথা শুনে বলল, এখানে আমি খুলব কি করে? বাড়িতে পৌঁছে কাউকে খুলে দিতে বলব।
বাড়িতে পৌঁছে সৌরভ গাড়ি থেকে নেমে ড্রইংরুমে এসে বসল। মেয়েরা বৌকে ধরে নামাতে গিয়ে দেখল, সে ঘুমিয়ে পড়েছে। সৌরভের বড় বোন শুভ্রা পূর্ণিমাকে ধরে নাড়া দিয়ে জাগাবার চেষ্টা করল। কিন্তু সফল হল না। তখন সে আরও দু’একজন মেয়ের সাহায্য নিয়ে পূর্ণিমাকে পাজাকোলা করে বাসর ঘরে এনে খাটে বসিয়ে আবার জাগাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনো কাজ হল না। শেষে শুইয়ে দিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, তোমার বৌ বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছে। আত্মীয় বলে তোমরা ভালো করে খোঁজ-খবর নিলে না। আমার তো মনে হয় বৌয়ের মৃগী রোগ আছে।
আবিদা বেগম তাড়াতাড়ি করে এসে বৌয়ের মুখে কয়েকবার পানির ঝাঁপটা। দিয়ে হাতের তালুতে পানি নিয়ে মাথার চাঁদিতে দিয়ে ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিতে বললেন। তারপর বৌয়ের জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পরও যখন জ্ঞান ফিরল না, তখন আবিদা বেগম স্বামীর কাছে এসে ঘটনাটা বলে বললেন, বৌমাকে মেডিকেলে নিয়ে যাবে, না করিম ভাইকে ডেকে নিয়ে আসবে?
ডাঃ করিম পিজি-র সার্জারী ডিপার্টমেন্টের হেড। নিজের বাড়ি সংলগ্ন একটা ক্লিনিকও করেছেন। প্রতিবেশী হিসাবে সৌরভদের সকলের সঙ্গে একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তিনিও বরযাত্রী হয়ে গিয়েছিলেন।
স্ত্রীর কথা শুনে ফায়েজ সাহেব আতঙ্কিত হয়ে বললেন, সে কি? আমি করিম ভাইকে ডেকে নিয়ে আসছি, তুমি বৌমার কাছে যাও, কথা শেষ করে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
সৌরভ এতক্ষণ ড্রইংরুমে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিল। আবিদা বেগম সেখানে এসে তাকে বললেন, তুই এখানে গল্প করছি, আর ওদিকে বৌমা অজ্ঞান হয়ে গেছে। তোর বাবা ডাক্তার আনতে গেল।
মায়ের কথা শুনে সৌরভের আসবার সময় গাড়িতে পূর্ণিমা যে কথা বলেছিল, তা মনে পড়ল। শঙ্কিত হয়ে বন্ধুদের বিদায় দিয়ে মায়ের সঙ্গে পূর্ণিমার কাছে এসে দেখল, অনেক মেয়ের ভীড়। তারা নানারকম মন্তব্য করছে। সে মাকে পূর্ণিমা গাড়িতে যা বলেছিল তা বলে বলল, এতক্ষণ সে কথা আমার মনে ছিল না।
আবিদা বেগম তাই নাকি বলে মেয়েদেরকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই খোঁপা খুলতে লাগলেন। খোঁপা খোলার সময় দেখলেন, রক্তে খোঁপা ও চুল ভিজে গেছে। তাড়াতাড়ি করে খুলে চুল সরিয়ে যা দেখলেন, তা দেখে তিনি ও অন্যান্য সব মেয়েরা ভয়ে শিউরে উঠলেন। প্রায় আট দশ ইঞ্চি লম্বা একটা তেঁতুলে বিছে ঘাড়ের রগকেটে গর্ত করে ঢুকে রয়েছে। আর সেখান থেকে গল গল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
ঠিক এমন সময় ফায়েজ সাহেব ডাঃ করিমকে নিয়ে ঘরে ঢুকে বললেন, তোমরা সব সরে যাও। ডাক্তার এসেছেন।
আবিদা বেগম চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ভয়ার্ত স্বরে বললেন, ডাক্তার ভাই, সর্বনাশ হয়ে গেছে। বৌয়ের খোঁপার মধ্যে মস্ত বড় তেঁতুলে বিছে ছিল। সেটা ঘাড়ের রগ কেটে ভিতরে ঢুকে বসে আছে।
ডাক্তার করিম তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে দেখেশুনে কয়েক সেকেন্ড স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারপর সামলে নিয়ে বললেন, আপনারা হৈ চৈ করবেন না। আমি এক্ষুনি আসছি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ক্লিনিকে গিয়ে দু’জন ডাক্তার ও দু’জন নার্স এবং সার্জারীর বাক্স নিয়ে ফিরে এলেন। তারপর সাঁড়াশী দিয়ে বিছেটাকে বের করে মেরে ফেললেন। ততক্ষণে অন্যান্য ডাক্তার ও নার্সরা ক্ষত স্থান পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বাঁধতে লেগে গেলেন।
ব্যান্ডেজ শেষ হবার পর ডাক্তার করিম নিজে একটা ইনজেকশান পুশ করলেন, তারপর রুগীকে ক্লিনিকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করলেন।
আবিদা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তার ভাই, বৌমার অবস্থা এখন কি রকম?
ডাক্তার করিম বললেন, এখন কিছু বলতে পারছি না। সবকিছু আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। তবে আমরা চেষ্টার ত্রুটি করব না।
বিয়ে বাড়িতে আনন্দের বদলে বিষাদের ছায়া নেমে এল। ফায়েজ সাহেব ফোন করে বিয়াই সাহেবকে ঘটনা জানিয়ে আসতে বললেন।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে পূর্ণিমার মা, বাবা, ভাই ও ভাবিরা এসে সবকিছু জেনে ও বিছেটা দেখে ভয়ে ও আতঙ্কে বধির হয়ে গেলেন। একটু পরে সবাই ক্লিনিকে গেলেন। সৌরভদের বাড়িরও প্রায় সকলে এসেছেন। তারা সবাই সারারাত পূর্ণিমার বেডের কাছে রইলেন। ডাক্তার ও নার্সরা কিছুক্ষণ পর পর এসে রুগীকে পরিক্ষা করছেন।
ভোর পাঁচটার সময় ডাক্তার বললেন, পূর্ণিমা মারা গেছে।
পূর্ণিমার মা, বাবা, ভাই ও ভাবিরা ডাক্তারের কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
সৌরভের চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। তখন তার পূর্ণিমার খোঁপা খুলে দেবার কথা মনে পড়ল। সেই সাথে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হতে লাগল।
আর পূর্ণিমার ভাবিরা দু’টো কারণে ভীষণ অনুশোচনার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে চোখের পানিতে বুক ভাসাতে লাগল। প্রথম কারণটা হল, পূর্ণিমা বিউটি পার্লারে খোঁপা বাঁধতে যেতে একদম রাজি ছিল না। তারাই জোর করে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয় কারণটা হল, খোঁপা বাঁধার কিছুক্ষণ পর থেকে বিয়ে হয়ে যাবার পর পর্যন্ত পূর্ণিমা অনেকবার কাকুতি মিনতি করে বলেছে আমার ঘাড়ে কি যেন কামড়াচ্ছে। তোমরা খোঁপা খুলে দাও। এখন তার কারণটা জেনে নিজেদেরকে ক্ষমা করতে পারছে না। দু’জনেরই মনে হচ্ছে, তারাই যেন পূর্ণিমাকে মেরে ফেলল। একসময় বড় জা ছোট জাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এ আমরা কী করলাম? তুই সবাইকে জানিয়ে দেরে ছোট, আর কেউ যেন কোনো মেয়ের খোঁপা বাঁধাতে বিউটি পার্লারে না যায়।
জাদু
“তারা ঐ শাস্ত্রের অনুসরণ করল, যা সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। সুলায়মান কুফর করেননি, শয়তানরাই কুফর করেছিল। তারা মানুষকে জাদু বিদ্যা এবং বাবেল শহরে হারুত ও মারূত দুই ফেরেস্তার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। তারা উভয়ই একথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা পরিক্ষার জন্য, কাজেই তুমি কাফের হয়ো না। অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যদ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহর আদেশ ছাড়া তদ্বারা কারও অনিষ্ট করতে পারত না। যা তাদের ক্ষতি করে এবং উপকার না করে, তারা তাই শিখে। তারা ভালোরূপে জানে যে, যে কেউ জাদু অবলম্বন করে, তার জন্য পরকালে কোনো অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্মা বিক্রয় করছে, তা খুবই মন্দ যদি তারা জানত।
(আল-কোরআন–১০২ নং আয়াত, সূরা বাক্বারা, পারা-২)
১
আমার বয়স তখন সাত কি আট। ক্লাস ফোরে পড়ি। প্রাইমারী স্কুল আমাদের বাড়ি থেকে তিন-চার মিনিটের পথ। একদিন কি কারণে যেন টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেল। তখন গ্রীষ্মকাল। বাড়িতে এসে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে গেলাম। আমরা দু’ভাই দু’বোন। তাদের মধ্যে চার বছরের বড় এক বোন। বাকিরা সবাই আমরা ছোট। আমরা না ঘুমিয়ে দুষ্টুমী করছিলাম। ঘন্টাখানেক পর মা খেয়ে এসে বলল, কিরে তোরা সব ঘুমাসনি?
মাকে দেখে আমরা চুপ করে গেলাম। বলল, ঘুমানি যখন তখন নিচে চল, বেদেনী এসেছে জাদু খেলা দেখাবে।
আমাদের দুটো ঘর। একটা একতলা তিন কামরা মাটির ঘর। সেটা টালির। ছাউনি। আর অন্যটা খড়ের ছাউনি দোতলা চার কামরা। আমরা দোতলা ঘরে উপরের তলায় থাকি। মায়ের কথা শুনে তিন ভাইবোন ছুটে নিচে চলে এলাম। দু’বছরের ছোট ভাইটাকে কোলে নিয়ে মাও নিচে এল।
নিচে এসে দেখি, বারান্দায় ছোট বড় মেয়েদের ভিড়। তারা সব গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে আর তাদের মাঝখানে একটা আধা বয়সী মেয়ে ডুগডুগি বাজাচ্ছে। মা এসে দাঁড়াবার পর আমি তার কোল ঘেঁষে দাঁড়ালাম।
বেদেনী তখন একটা বেশ বড় পিতলের জামবাটিতে পানি ভর্তি করে ঝোলা থেকে একটা ছোট পিতলের হাঁস বের করে সেই পানিতে ছেড়ে দিল। সেই সঙ্গে ডুগডুগি বাজিয়ে বলতে লাগল, লাগ লাগ ভেলকিটা লাগ, আমার দুচোখে বাদ দিয়ে সবার চোখে ভেলকিটা লাগ। তারপর দুর্বোধ্য কি সব মন্ত্র পড়তে লাগল। এইসব বলার সাথে সাথে পিতলের সেই হাঁসটা পানির মধ্যে সাঁতার কাটতে লাগল। অল্পক্ষণ পরে বেদেনী সবাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, এবার আপনারা আনি, দুয়ানি, সিকি, আধুলি জামবাটিতে ফেলুন। দেখবেন, হাঁস সেগুলো ডুব দিয়ে মুখে করে তুলে আনবে। তারপর ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে ভেলকি লাগার গদটা বলতে লাগল।
মেয়েরা অনেকে আঁচল থেকে আনি, দূয়ানি ও সিকি ফেলল।
পিতলের হাঁসকে সাঁতার কাটতে দেখে আগেই সবাই অবাক হয়েছে। এখন আরও বেশি অবাক হয়ে দেখল, পয়সা পড়ার সাথে সাথে হাঁসটা ডুব দিয়ে সেগুলো মুখে করে ভেসে উঠছে। আর বেদেনী হাঁসের মুখ থেকে নিয়ে নিজের কোঁচড়ে রাখছে। মাকে একটা সিকি ফেলতে দেখলাম। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলল। শেষে যখন কেউ আর পয়সা ফেলল না তখন বেদেনী তার গদ আওড়ান বন্ধ করে হাঁসটা পানি থেকে তুলে ঝুলিতে রেখে বলল, আজ চলিগো মায়েরা, আবার একদিন আসব। বেদেনী চলে যাবার পর মেয়েরা বলাবলি করতে লাগল, একেই বলে জাদু। আমি খুব অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, জাদু কি মা?
মা হেসে উঠে বলল, জাদু হল একটা মন্ত্র। সেই মন্ত্র পড়ে যাকে যা বলবে, সে তাই করবে।
সেই থেকে আমার জাদু শেখার জিদ চেপে গেল। পাড়ার দাদা, নানা সম্পর্কের মরুব্বিদের কাছে জাদুর কথা জিজ্ঞেস করলাম। তাদের অনেকে বললেন, জাদু বলে কিছু থাকলেও তা সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই। আবার কেউ কেউ বললেন, জাদু বলে কিছু আছে নাকি? ওসব ভাওতাবাজি। আমি তখন তাদেরকে বেদেনীর হাঁসের কথা বললাম। শুনে তাদের একজন বললেন, আরে ভাই, বেদেনীরা খুব চালাক। তারা মানুষের চোখে ধাঁ ধাঁ লাগিয়ে টাকা পয়সা রোজগার করে। তোমরা যে হাঁসকে সাঁতার কাটতে এবং ডুব দিয়ে পয়সা তুলতে দেখেছ, সেটা তোমাদের চোখের ভুল। আসলে হাঁসে কিছুই করেনি। বেদেনী মুখে আজেবাজে বুলি আওড়িয়ে সবাইয়ের মনকে আকৃষ্ট করে চোখে ধাঁ ধাঁ লাগিয়ে নিজেই হাত সাফাই দেখিয়েছে। তুমি এখন ছেলেমানুষ, সে সব বুঝতে পারবে না। বড় হও তখন বুঝবে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবু একে তাকে জিজ্ঞেস করি।
এভাবে তিন বছর পার হয়ে গেল। সে বছর আমি সেভেনে পড়ি। একদিন বাজারের লাইব্রেরীতে পাঠ্য বই কিনতে গিয়ে একজন সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের কাছে কোনো জাদু শেখার বই আছে? সে আছে বলে একটা বই এনে আমার হাতে দিল। পাঠ্যবইয়ের সাথে সেটাও কিনে ফেললাম। ফেরার পথে দূর সম্পর্কের এক চাচার সঙ্গে দেখা। তার নাম জহুর। সে আমার হাত থেকে বইগুলি নেবার সময় বলল, দেখি কি কি বই কিনেছি। জাদুর বইটা দেখে বলল, এটা কিনেছিস্ কেন?
আমি বললাম, জাদু শিখব।
জহুর চাচা বইটার ভিতরের দু’এক পাতা পড়ে বলল, দূর, এই বই পড়ে কি আর জাদু শেখা যায়? এতে সব গাঁজাখুরী কথা লেখা আছে। যাদু হল এক ধরনের মন্ত্র। যা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয়। কোথায় গেলে জাদু শেখা যায়, তা আমি জানি। সে জায়গা অনেক দূর। তুই এখন ছোট। মন দিয়ে লেখাপড়া কর। বড় হলে তোকে একদিন সেসব কথা জানাব।
বললাম, তোমার কথা মেনে নিলাম; কিন্তু তোমাকে এখন যে জায়গার নাম এবং সেখানে কেমন করে যেতে হয় বলতে হবে।
জহুর চাচা কিছুতেই রাজি হল না। আমিও নাছোড়বান্দা। পাশাপাশি বাড়ি। দেখা হলেই জোকের মত লেগে থাকি। বিশেষ করে প্রত্যেক নামাযের সময় দেখা হয়ই। একদিন এশার নামাযের পর মসজিদের সিঁড়িতে চাচাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আজ তোমাকে সেকথা বলতেই হবে। এই মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কথা দিচ্ছি, আমি পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে যাবার চেষ্টা করব না।
জহুর চাচা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে বস, বলছি। তারপর সিঁড়িতেই নিজে বসে আমাকেও বসতে বলল। আমি তার পাশে বসার পর বলতে শুরু করল
আমাদের দেশের উত্তর দিকে আসাম। আসামে কামরূপ কামাক্ষা নামে একটা জায়গা আছে। সেখানে শুধু পাহাড় আর পাহাড় ও সেইসব পাহাড়ের গুহায় যারা বাস করে তারা জাদু জানে। সেখানে অন্যদেশ থেকে যে লোক যায়, সে আর ফিরে আসে না।
জিজ্ঞেস করলাম, কেনো?
সেখানে পুরুষ লোকের সংখ্যা কম। তাছাড়া যারা আছে, তাদের পুরুষত্ব নেই। তাই কেউ যদি সেখানে যায়, তবে সেখানকার মেয়েরা তাকে আর ফিরে আসতে দেয় না। যে মেয়ে তাকে প্রথম দেখতে পাবে, সে তাকে নিজের কাছে। রেখে দেবে। এটাই তাদের নিয়ম। সেই মেয়ে আগন্তুককে রাজার হালে রাখবে। যদি সেই লোক ঐ মেয়েটির মন জয় করতে পারে, তাহলে তার কাছ থেকে জাদু শিখে ফিরে আসতে পারবে। নচেৎ পারবে না। ওখানকার পুরুষরা জাদু জানে কিনা জানি না, তবে অধিকাংশ মেয়েরা জানে।
বললাম, তা না হয় হল; কিন্তু সেখানকার পুরুষের পুরুষত্ব নেই কেন?
সেখানকার জঙ্গলে সিংহ আছে। বছরে একবার সেইসব সিংহ ও সিংহী মিলনের জন্য একে অপরকে গর্জন করে আহ্বান করে। তাদের সেই আহ্বানের গর্জনে এত ভীষণ শব্দ হয়, যা শুনে সেখানকার পুরুষদের পুরুষত্ব নষ্ট হয়ে যায়। শুনেছি, যেসব ভিনদেশি লোক তাদের কাছে থাকে, সেই সময় তাদেরকে মেয়েরা গুহার মধ্যে গর্ত করে পাথর চাপা দিয়ে রাখে, যাতে করে সিংহ বা সিংহীর বিকট গর্জন তাদের কানে না যায়। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছিস, জাদু শেখা কি দূরূহ ব্যাপার? তা না হলে তো যে কেউ গিয়ে জাদু শিখে আসতে পারত। তাছাড়া জাদু তো মামুলি জিনিস না যে, সেখানে গেলেই তারা তোমাকে শেখাবে।
জিজ্ঞেস করলাম পুরুষত্ব কি চাচা?
তুই এখন বুঝবি না। আরও বড় হ বুঝবি।
ভেবে রাখলাম ঘরে গিয়ে অভিধান দেখে শব্দটার অর্থ বুঝতে হবে।
তারপর যখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি তখন সুজিত সরকার নামে ক্লাসের। একটা ছেলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। আমাদের গ্রামের প্রায় দু’মাইল উত্তর-পূর্ব। দিকে মুগকল্যাণ হাই স্কুল। এই স্কুলে আমরা পড়ি। সুজিতের বাড়ি স্কুল থেকে প্রায় দেড়মাইল উত্তর-পশ্চিমে আন্টিলা গ্রামে। তাই বন্ধুত্ব হলেও কেউ কারো বাড়ি কোনো দিন যাইনি। সুজিত অঙ্কে খুব কাঁচা; কিন্তু ইংরেজিতে খুব ভালো। আর আমি অঙ্কে খুব ভালো, কিন্তু ইংরেজিতে খুব কাঁচা। তাই সে আমার কাছে অঙ্কের সাহায্য পাবার জন্য এবং আমি তার কাছে ইংরেজিতে সাহায্য পাবার জন্যে দু’জনে বন্ধুত্ব করি। তখনও আমার যাদু শেখার ঝোঁক কাটেনি। জাদু শেখার অনেক বইপত্র যোগাড় করে পড়ি। কিন্তু সেসব বইয়ে জাদু শেখার মতো কিছু ছিল না। যা ছিল তা শুধু বিভিন্ন কেমিকেলের সংমিশ্রণের ফলাফল, আর হাত সাফাইয়ের কারসাজি।
সুজিত আমার জাদুর শেখার শখের কথা জানতে পেরে একদিন বলল, তুই পি সি সরকারের নাম শুনেছিস্?
বললাম শুনিনি আবার। দুনিয়ার সবাই ওঁকে বিখ্যাত জাদুকর বলে জানে। লোকের মুখে ওঁর দু’টো জাদুর কথা শুনে আমার জাদু শেখার ঝোঁক আরও বেড়ে গেছে।
কি কি জাদুর কথা শুনেছি বলতো শুনি।
পি. সি. সরকার যখন একবার আমেরিকায় জাদু প্রদর্শনীতে যান তখন প্রদর্শনী মঞ্চে তার বিকেল চারটের সময় উপস্থিত হবার কথা ছিল। কিন্তু তিনি পাঁচটার সময় মঞ্চে উপস্থিত হন। চারটের অনেক আগে থেকে হাজার হাজার দর্শক তার যাদু দেখার জন্য সেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে দেখে তারা ভারতীয় নেটিভদের সময়ের জ্ঞান নেই বলে নানা রকম গালাগালি করতে লাগল। অবশেষে পাঁচটার সময় যখন পি. সি. সরকার মঞ্চে উপস্থিত হলেন তখন দর্শকরা তাকে যা-তা বলতে লাগল। তিনি কিন্তু একটুও ঘাবড়ালেন না। দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, মনে হচ্ছে আমার পৌঁছতে দেরি হয়েছে দেখে আপনারা উত্তেজিত হয়েছেন; কিন্তু আমি তো ঠিক চারটের সময় এসেছি। আপনারা দয়া করে নিজেদের ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখুন।
দর্শকরা তার কথা শুনে আরও রেগে গিয়ে যে যার হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে অবাক, সত্যিই তাদের ঘড়িতে তখন চারটে। কয়েক হাজার দর্শক মুহূর্তে যেন বোবা হয়ে গেল।
পি. সি. সরকার দর্শকদের উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার জাদু দেখে নিশ্চয় আপনরা এবার আনন্দিত হয়েছেন?
দর্শকরা বুঝতে পারল, সত্যি তিনি একজন বড় জাদুকর। তখন তাদের করতালিতে সেই বিশাল প্যান্ডেল মুখরিত হয়ে উঠল।
দ্বিতীয় ঘটনাটা বলছি শুন, পি. সি. সরকার যখন জাদু দেখাবার জন্য ইউরোপ সফর করেন তখন একদিন লন্ডনের এক হোটেলে সাথীদের নিয়ে চা খাচ্ছিলেন। পাশের টেবিলে কয়েকজন ইংরেজ বলাবলি করছিল, শুনেছি পি. সি. সরকার মস্তবড় জাদুকর। তিনি এখানে এসেছেন যাদু দেখাতে।
তাদের মধ্যে একজন একটা পাঁচ ডলারের নোট বের করে বলল, পি. সি. সরকার যদি এটাকে বিশ ডলার করে দিতে পারতেন, তা হলে বুঝতাম তিনি একজন সত্যিই বড় জাদুকর।
পি. সি. সরকার কথাটা শুনতে পেয়ে তাদেরকে কাছে ডেকে বললেন, পি. সি. সরকার নিশ্চয় বড় জাদুকর। তিনি আমাদের দেশের লোক। তাঁর কথা কি বলছেন, আমি একজন সাধারণ মানুষ হয়ে আপনার ঐ পাঁচ ডলারকে বিশ ডলার করে দিতে পারি।
ইংরেজগুলো পি. সি. সরকারকে চিনত না। সেই লোকটা ডলারটা পি. সি. সরকারের দিকে বাড়িয়ে ধরে বিদ্রূপ কণ্ঠে বলল, খুব তো বাহাদুরী দেখাচ্ছেন, কই এটাকে বিশ ডলার করে দেখান তো?
পি. সি. সরকার পাঁচ ডলারের নোটটা তার হাত থেকে নিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেই ডলারটাই ফেরত দেবার সময় বললেন, এই নিন বিশ ডলার।
তাদের কথোপকথন শুনে আশপাশের টেবিল থেকে অনেকে উঠে সেখানে এসেছে। সবাই দেখল, পাঁচ ডলারটা সত্যি সত্যি বিশ ডলার হয়ে গেছে। সেই ইংরেজ ভদ্রলোকটি অবাক হয়ে ডলারটা মানিব্যাগে রেখে বলল, সত্যিই ভারতীয়রা জাদু জামে। এখন স্বীকার করতেই হচ্ছে, আপনার মতো একজন সাধারণ মানুষ যদি এটা করতে পারলেন, তা হলে পি. সি. সরকার নিশ্চয় এটাকে একশো ডলার করতে পারতেন।
পি. সি. সরকার মৃদু হেসে সাথীদের নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন।
হোটেলের বাইরে এসে গাড়িতে উঠার সময় একজন পি. সি. সরকারকে বললেন, আপনি কি সত্যিই জাদুর দ্বারা পাঁচ ডলারকে বিশ ডলার করে দিলেন?
তিনি হেসে উঠে বললেন, তা তো আপনারাই নিজের চোখে দেখলেন। তবে ঐ ইংরেজ বেটা যখন মানিব্যাগ খুলবে তখন সেটাকে পাঁচ ডলারই দেখবে।
এই কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
আমার কথা শুনে সুজিত বলল, তাকে আমি এতদিন কথাটা বলিনি। এখন তোর জাদু শেখার ঝোঁক দেখে বলছি, পি. সি. সরকার আমার মামার জ্যাঠাতো ভাই। তার সঙ্গে আমার খুব জানাশুনা। উনি আমাকে খুব হে করেন।
আমি আনন্দে উল্লসিত হয়ে সুজিতের দুটো হাত ধরে বললাম, তুই তার কাছে একবার নিয়ে চল্। আমি জাদু শিখব।
সুজিত হাসতে হাসতে বলল, তুই দেখছি একটা মস্ত পাগল। মামা কতবড় মানিলোক। তিনি কি তোর সঙ্গে দেখা করবেন? না তোকে জাদু শেখাবেন? কত বড় বড় শিক্ষিত লোক জাদু শেখার জন্য তার পিছনে জোঁকের মত লেগে রয়েছে।
সুজিতের কথা শুনে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আর চোখ দু’টো পানিতে ভরে উঠল। আমি মাথা নিচু করে নিলাম।
সুজিত বুঝতে পেরে বলল, তুই মন খারাপ করি না। এবারে আমি কোলকাতায় গেলে মামাকে তোর কথা বলব।
আমি চোখ মুছে তার দিকে চেয়ে বললাম, ঠিক বলবি তো?
সুজিত বলল, হ্যাঁরে ঠিক বলব।
এরপর প্রায় দু’তিন মাস পার হয়ে গেল। এর মধ্যে সুজিত দু’বার কোলকাতায় মামাবাড়ি গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, মামা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাদু দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে শুনে এসেছি, সামনের মাসে ফিরবেন।
এর মাসখানেক পর সুজিত আমাকে একটা মলাটকরা বই দিয়ে বলল, তোর ভাগ্য খুব ভাল। এবারে কোলকাতায় গিয়ে মামার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তোর কথাও বলেছি। মামা তো প্রথমে আমার কথায় কান দিলেন না। যখন তোর যাদু শেখার ঝোঁক ও কান্নাকাটির কথা বললাম তখন মামা আমাকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন, তোর বন্ধুকে বলিস্, এখনও তার যাদু শেখার বয়স হয়নি। অন্ত তঃপক্ষে বি.এ. পাস করার পর এই লাইনে আসতে হয়। আমি বললাম, তা না হয় বলব, কিন্তু সে আমার কথা বিশ্বাস করবে কেন? তাছাড়া মনে খুব কষ্ট পাবে। হয়তো আমাদের বন্ধুত্ব আর থাকবে না। বরং তাকে একবার আপনার কাছে নিয়ে আসি। যা বলার আপনি বুঝিয়ে বলবেন। আমার কথা শুনে মামা একটু ভাবলেন। তারপর এই বইটা তোকে দিতে বলে বললেন, তাকে এখন আনার দরকার নেই। কোথায় থাকব না থাকব কোনো ঠিক নেই। তারচেয়ে এই বইটা দিয়ে বলবি, এটা স্টাডি করতে। আরও বলবি, এতে যতগুলো যাদুর কথা। লেখা আছে, সেগুলোর মধ্যে প্রথমটা তাকে শিখতে। সেটাতে যখন সে কৃতকার্য হবে তখন নিয়ে আসবি। আর একটা কথা, এই যাদু শিখতে গিয়ে যদি সে পড়াশোনায় অবহেলা করে, তা হলে জাদু শিখতে পারবে না। আর শোন, বইটা কাউকে দেখাতে নিষেধ করবি। তুইও কাউকে দেখাবি না। কয়েক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে সুজিত আবার বলল, তোর বাবা মা জানতে পারলে তোকে মারধর করবে। তুই বইটা লুকিয়ে রাখবি।
আমি বইটা খাতার মধ্যে রেখে বললাম, সেকথা তোকে বলতে হবে না। আমার কাছে আরও কয়েকটা জাদুর বই আছে। বাড়ির কেউ সেখবর জানে না।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বইটা পড়তে লাগলাম। ভূমিকাতে অনেক উপদেশ দেয়া আছে। তারপর জাদু শেখার প্রথম অধ্যায়ের শুরুতে লেখা রয়েছে, প্রথমে যৌগিক আসনে বসতে হবে। তারপর হাতে একটা কাঠপেন্সিল অথবা ছোট্ট একটা কাঠের টুকরো নিয়ে সেটার দিকে মনযোগ সহকারে চেয়ে থেকে বলবে, এটা কাঠ নয় সোনা। এভাবে অবসর সময়ে দিনের পর দিন সাধনা করে যেতে হবে। যখন সেই কাঠের টুকরা বা পেন্সিলকে তুমি সত্যি সোনা বলে দেখতে পাবে তখন বুঝতে হবে তুমি কৃতকার্য হয়েছ। এরপরও তোমাকে বেশ কিছুদিন ঐ সাধনা করতে হবে। তারপর যখন তখন কাঠের টুকরোটা নিয়ে বলবে এটা কাঠ নয়, সোনা এবং তুমিও যদি বলার সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে সোনা বলে দেখ, তাহলে তুমি জনসমক্ষে এই জাদু দেখাতে গেলে তারাও সেটা সোনা দেখবে।
নিচে বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে লেখা আছে, এটাতে কৃতকার্য না হয়ে পরেরগুলো শিখতে যেও না। কারণ বিপদ হবে।
এই পর্যন্ত পড়ে পি. সি. সরকারের উপর আমার মন বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল। বেদেনীর খেলা দেখার পর জাদু সম্বন্ধে মা যে কথা বলেছিল এবং জহুর চাচার কাছে যা শুনেছিলাম, তাতে আমারও দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, জাদু হল একটা মন্ত্র। ভারাক্রান্ত মনে পুরো বইটা পড়লাম। বুঝতে পারলাম, পি. সি. সরকার জাদু জানেন না। জাদুর নামে যা কিছু করেন, তা সাধনা করে মানুষকে ম্যাসমেরিজাম করার শক্তি অর্জন করেছেন।
কয়েক দিন পর সুজিত জিজ্ঞেস করল, কিরে মামার বই ফলো করে কিছু প্রগ্রেশ হচ্ছে না কি?
নিজের ধারণা চেপে রেখে বললাম, ঐসব জিনিস কি আর এত তাড়াতাড়ি কিছু হয়? ওসব সাধনার জিনিস ও বহুদিন সাধনা করতে হবে।
হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছি। আমারও জাদু শিখার খুব শখ ছিল। কিন্তু সাধনা করতে হবে জেনে ঐ চিন্তা বাদ দিয়ে দিয়েছি। সাধনা করার ধৈর্য আমার নেই।
২
পরের বছর আমি ক্লাস নাইনে উঠলাম।
একদিন ফজরের নামাযের পর কোরআন তেলাওয়াত করছি, এমন সময় জবেদ দাদা আমার কাছে এসে বসে শুনতে লাগল। তেলাওয়াত শেষে যখন কোরআন শরীফ জুজদানে আমার কাছে এসে বসে শুনতে লাগল। তেলাওয়াত শেষে যখন কোরআন শরীফ জুজদানে ভরছিলাম তখন জবেদ দাদা বললেন, ছোট বেলায় মক্তবে একটু আধটু কায়দা আমপারা পড়েছিলাম। সেসব একদম ভুলে গেছি। এখন কোরআন পড়তে খুব ইচ্ছা হয়। তুমি কি আমাকে কোরআন পড়া শেখাবে? ইমাম সাহেব বা আরও অনেকে পড়ে; তাদের কাছেও শিখতে পারতাম। কিন্তু তাদের পড়া আমার কাছে তেমন ভালো লাগে না। তোমার পড়াটা আমার কাছে খুব ভালো লাগে, তাই বললাম।
বললাম, কেন শেখাব না, নিশ্চয় শেখাব। কখন আপনার সময় হবে বলুন। ফজরের নামাযের পর পড়বেন?
তখন মসজিদে অনেকে থাকবে। আমার খুব লজ্জা পাবে।
বললাম, শেখার ব্যাপারে যেমন লজ্জা করতে নেই তেমনি ছোট বড় বিচার করতে নেই। আর জ্ঞানলাভ করার কোনো বয়স নেই। হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেন, “দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত মানুষের শিক্ষার সময়।”
তোমার কথা ঠিক। তবু ঐ সময়ে সম্ভব নয়। কারণ অনেক সময় ফজরের নামায পড়েই কাজে যেতে হয়। আমি রাতে এশার নামাযের পর পড়ব।
বললাম, ঠিক আছে তাই হবে। তাহলে আজ থেকে শুরু করবেন। তারপর আমি কোরআন শরীফ রেখে যখন তার সঙ্গে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলাম তখন হঠাৎ আমার মনে হল, জবেদ দাদাকে জাদুর কথা জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? মুরুব্বি মানুষ কিছু জানলেও জানতে পারেন। মসজিদের সিঁড়ি থেকে নামার পর তাকে আমার জাদু শেখার ইচ্ছার কথা জানিয়ে বললাম, আপনি এই ব্যাপারে কিছু জানেন?
জবেদ দাদা শুনে হেসে উঠে বললেন, তুমি ভাই এখন ছেলেমানুষ, এসব কথা জেনে কি হবে?
: কিছু হোক বা না হোক, আপনি জানেন কিনা বলুন?
: জানি, তবে এখন বলতে পারব না। পরে সময় করে একদিন বলব। এই কথা বলে তিনি চলে গেলেন।
জবেদ দাদারা তিন ভাই। মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিমে অল্প দূরে তাদের বাড়ি। জমি-জায়গা কিছুই নেই। খেটে খাওয়া মানুষ। ভিটেটুকুই সম্বল। তবে ভিটেটা বেশ বড়। তিন ভাইই আমাকে খুব স্নেহ করেন। আমি প্রায় তাদের বাড়িতে যেতাম। দাদীরাও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। গেলেই কিছু না কিছু খেতে দিতেন। একদিন মা আমাকে বলল, তোর জবেদ দাদার বাড়িতে গিয়ে তার
বৌকে বলবি, আমি তাকে ডেকেছি। মা প্রায় দাদিদের কাউকে না কাউকে ধান। ভাঙ্গাবার জন্য আমাকে দিয়ে ডেকে পাঠাতো। তখন কেঁকিতে আমাদের ধান। ভাঙ্গান হত। আমি জবেদ দাদার বাড়িতে গিয়ে তার বৌকে বললাম, মেজদাদি, আপনাকে মা ধান ভাঙ্গানোর জন্য ডেকেছে। সেদিন জবেদ দাদা ঘরে ছিলেন। তাকে দেখে সালাম দিয়ে বললাম, মেজদাদা আপনি আজ কাজ করতে যান নাই?
জবেদ দাদা বললেন, না ভাই আজ শরীরটা ভালো নেই। তারপর স্ত্রীকে বললেন, একে কিছু নাস্তা দাও।
বললাম, আমি এক্ষুনি খেয়ে এসেছি, এখন কিছু খাব না। জবেদ দাদা বললেন, তাতে কি হয়েছে, ছেলে বয়সে ঘনঘন খাওয়া যায়। আমি অসম্মতি জানিয়ে চলে আসতে লাগলাম।
জবেদ দাদা বলে উঠলেন, আরে ভাই না খাও না খাবে, চলে যাচ্ছ কেন? আমার কাছে এসে বস, সেদিন তোমাকে একটা জাদুর ঘটনা বলব বলেছিলাম না? আজ সেটা বলব।
জাদুর কথা শুনে আনন্দিত হয়ে দৌড়ে এসে তার পাশে বসলাম। জবেদ দাদা বলতে শুরু করলেন
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। তোমার নানাদের মাঠের পুকুরটা অনেক আগের কাটান। ভরাট হয়ে গিয়েছিল। তাই কাটান হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে ঐ পুকুরে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। তখন তোমার নানার বাবা বেঁচে ছিলেন। আমার তখন বয়স হবে সতেরো, কী আঠার বছর। আমিও সেই পুকুর কাটার কাজ করছি। তখন বৈশাখ মাস। সেদিন আমরা মোট বারজন ছিলাম। পুকুরটা তো মাঠের মাঝখানে। যেতে আসতে এক ঘন্টারও বেশি সময় লাগে। তাই সকালে যাবার সময় খাবার ও খাবার পানি সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম। একেবারে দু’টো আড়াইটা পর্যন্ত কাজ করে ফিরে আসতাম। একদিন কাজ করতে করতে বেলা একটার সময় সকলে পুকুর পাড়ের বাবলা গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। শেখ পাড়ার রহিম ও করিম দু’ভাই আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। এক সময় করিমকে পুকুরে নামতে দেখে রহিম তাকে বলল, এক্ষুনি যাচ্ছিস কেন? আরও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নে।
করিম বলল, খুব পিয়াস লেগেছে পানি খাব।
রহিম ও আমরা অনেকে বললাম। গ্লাস আর কলসিটা উপরে নিয়ে আয়, আমরাও খাব।
করিম গ্লাস ও কলসি নিয়ে আসার সময় পা ফসকে পড়ে গেলে কলসি ভেঙ্গে সব পানি পড়ে গেল।
আমরা সবাই কি করে পড়লি রে বলে তার দিকে চেয়ে দেখলাম, করিম গড়াতে গড়াতে নিচে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারল না।
রহিম ও আমি তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসে তাকে ধরে তুলে বসালাম। কিন্তু সে আবার শুয়ে পড়ে বিড়বিড় করে বলল, পানি খাব। তারপর তার আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
ততক্ষণে উপরে যারা ছিল তারাও নেমে এসেছে। আমি বললাম, করিম অজ্ঞান হয়ে গেছে। এখানে খুব গরম, সবাই মিলে একে উপরে নিয়ে যাই চল। তারপর পানি আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
সবাই ধরাধরি করে করিমকে পুকুরের পাড়ের উপরে এনে ছায়ায় শুইয়ে দিলাম।
রহিম বলল, পানির ব্যবস্থা করতেই হবে, নচেৎ একে বাঁচান যাবে না।
একজন বলল, আমি ঘরে গিয়ে পানি নিয়ে আসি।
রহিম বলল, ঘরে গিয়ে পানি আনতে একঘন্টা লাগবে। ততক্ষণে তো করিম মারাই যাবে।
আমি বললাম, তা হলে এখন উপায়? আমারও খুব পিয়াস লেগেছে। আজ আর কাজ করার দরকার নেই। চল সবাই মিলে ওকে ধরে নিয়ে বাড়ি যায়।
রহিম বলল, বাড়ি যেতে যেতে ও যদি মারা যায়? দেখছিস না পিয়াসে বেহুশ হয়ে গেছে?
আমাদের মধ্যে সোলেমান নামে একটা লোক ছিল। লোকটা যুবক বয়সে। অনেক দিন আগে কোথায় যেন চলে গিয়েছিল, কেউ তা জানে না। প্রায় আট দশ বছর পর দেশে ফেরে। লোকে জিজ্ঞেস করলে বলত, কামরুপ কামাক্ষ্যায় জাদু শিখতে গিয়েছিলাম; কিন্তু ভাগ্যদোষে জাদু শিখতে না পেরে ফিরে এসেছি। এখন তার বয়স প্রায় পঞ্চাশের মতো। সে এতক্ষণ চুপ করে ছিল, রহিমের কথা শুনে বলল, তোমরা যদি প্রতিজ্ঞা কর, এই ব্যাপারটা কাউকে বলবে না, তা হলে আমি এক মুহূর্তের মধ্যে পানি এনে রহিমকে বাঁচাতে পারি। আর আমরাও সবাই পানি খেতে পাব।
রহিম ছোট ভাইয়ের কথা ভেবে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে তার দুটো হাত ধরে বলল, সোলেমান ভাই, তোমার আল্লাহর দোহাই লাগে, তাড়াতাড়ি পানি আনার ব্যবস্থা কর। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনে কাউকে এ কথা জানাব না।
সোলেমান বলল, কিন্তু এরা তো কিছু বলছে না।
রহিম অশ্রুভরা চোখ নিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা সব চুপ করে আছ কেন? সোলেমান ভাই কি বলছে শুনতে পাওনি? তোমরা কি চাও, পানির জন্য করিম মারা যাক?
এবার আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করলাম।
সোলেমান বলল, কিন্তু খুব সাবধান, তোমাদের কেউ যদি প্রতিজ্ঞা রক্ষা না করে কাউকে বলে দাও, তা হলে তার ভীষণ বিপদ হবে। সারা জীবনেও সে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে না।
আমরা সবাই আবার প্রতিজ্ঞা করে বললাম, না, ব্যাপারটা এই কয়েকজন ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি জানবে না।
সোলেমান বলল, সবাই চোখ বন্ধ কর। খবরদার আমি না বলা পর্যন্ত কেউ চোখ খুলবে না। খুললে অন্ধ হয়ে যাবে।
আমরা সবাই চোখ বন্ধ কালাম।
এক মিনিটও হয়নি। সোলেমান আমাদেরকে চোখ খুলতে বলল।
আমরা চোখ খুলে দেখলাম, আমাদের মাটি কাটার বারোটা ঝুঁড়ি পানি ভর্তি। সবাই অবাক হয়ে একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম।
তাই দেখে সোলেমান বলল, তোমারা চুপ করে রয়েছ কেন? তাড়াতাড়ি করিমের মাথায় পানি ঢাল।
রহিম গ্লাস ডুবিয়ে করিমের মাথায় পানি দিতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে করিমের জ্ঞান ফিরে আসার পর বলল, আমাকে পানি খাওয়াও। রহিম তাকে বসিয়ে দু’তিন গ্লাস পানি খাওয়াল। তারপর আমরাও সবাই পানি খেলাম। এখনও দু’তিনটে ঝুড়িতে পানি রয়েছে।
করিম অবাক হয়ে ঝুঁড়িগুলোর দিকে চেয়ে রইল, কোনো কথা বলতে পারল না।
রহিম তার অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, সোলেমান ভাই পানি এনে খাইয়ে তোর জান বাঁচিয়েছে। তুই তো পানির পিয়াসে মরে যেতে বসেছিলি। খবরদার একথা কাউকে বলবি না। বললে তোর খুব বিপদ হবে।
করিমের ঘোর তখনও কাটেনি। সোলেমানের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। সোলেমান বলল, অমন করে আমার দিকে চেয়ে রয়েছিস কেন? কামরূপ কামাক্ষ্যায় আট-দশ বছর শুধু শুধু ছিলাম না। ওস্তাদের কাছে ওয়াদা করতে হয়েছিল, জীবনে কোনোদিন কারো ক্ষতি করব না। আর আমি যে জাদু শিখেছি, একথা কাউকে বলব না। ওস্তাদের কাছে করা ওয়াদা এত বছর পালন করে এসেছি। কিন্তু তোকে বাঁচাবার জন্য আজ আমাকে এই কাজ করতে হল। অবশ্য এ রকম কাজ করার জন্য ওস্তাদের হুকুম আছে। তারপর আর একবার সাবধান করে দিয়ে বলল, তবে আমি মরে যাবার পর তাদের কেউ যদি কাউকে বলে, তাহলে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে থাকতে কাউকে বললে, তার ক্ষতি হবে।
আমরা কোনো কথা বলতে পারলাম না। সবাই চিন্তা করছি, এক মিনিটের মধ্যে কি করে গ্রাম থেকে এতগুলো ঝুড়িতে পানি নিয়ে এল? তাও আবার মাটি কাটার ঝুড়িতে?
আমাদের অবস্থা বুঝতে পেরে সোলেমান বলল, কিরে তোরা সব চুপচাপ রয়েছিস কেন? নে এবার বাড়ি ফিরে যাই চল্।
এই পর্যন্ত বলে জবেদ দাদা আমাকে বললেন, কি ভাই, জাদু কি জিনিস। শুনলে তো? যাদু শেখা কি আর সহজ কাজ? যদিও কেউ শিখে থাকে, সে কোনোদিন জাদু দেখিয়ে পয়সা রোজগার করে না। আর নিজেকে জাদুকর বলেও প্রকাশ করে না। সোলেমান যতদিন বেঁচেছিল, আমি কাউকে এই ঘটনা বলিনি। অনেক বছর হল সে মারা গেছে। তবু বলিনি, আজ এই প্রথম তোমাকে বললাম।
আমি এতক্ষণ খুব অবাক হয়ে ঘটনাটা শুনছিলাম। জবেদ দাদা থেমে যেতে বললাম, তা হলে জাদু শিখতে হলে কামরূপ কামাক্ষ্যায় যেতে হয়, তাই না দাদা?
জবেদ দাদ বললেন, হ্যাঁ।
: আচ্ছা দাদা, কামরূপ কামাক্ষ্যা কোথায়? আর সেখানে কেমন করে যেতে হয়?
: তা কি করে বলব। আমি ওসব জানি না। এবার তুমি ঘরে যাও। মা হয়তো তোমার খোঁজ করছে।
আমি সোলেমানের পানি আনার ঘটনা চিন্তা করতে করতে সেখান থেকে চলে এলাম।
সেইদিন রাতে মাকে জবেদ দাদার কাছে শোনা জাদুর ঘটনা বলে জিজ্ঞেস কালাম, তুমি কি এই ঘটনা বিশ্বাস কর?
মা জানে আমি জাদুর উপর খুব ইন্টারেষ্টেড। তাই বলল, বিশ্বাস করব না কেন? আর এ কথাও ঠিক, যারা জাদু জানে তারা কোনোদিন তা প্রচার করে না। এমন একটা ঘটনা আমি আমার বড় খালার মুখে শুনেছি। তার এক জা জাদু জানত। সেই কথা কেউ জানত না। মারা যাবার পর বড় খালা আমাদেরকে বলেছিল।
আমি মাকে বললাম কি বলেছিলেন বলো না মা।
মা বলল, বলছি শোন—
আমার খালার বিয়ে হয়েছিল খুব বড় ফ্যামিলিতে খালুরা ছিল সাত ভাই। তাদের অবস্থা খুব ভালো। কোলেকাতায় দোকান ছিল। সাত ভাইয়ের মধ্যে বড় চার ভাই দোকান চালাতো। আর ছোট তিন ভাই জমি জায়গা দেখাশুনা করত। যে চার ভাই কোলকাতার দোকানে থাকত, তাদের মধ্যে প্রতি সপ্তাহে একজন করে বাড়ি আসত। শনিবার রাতে এসে রবিবার থেকে আবার সোমবার সকালে চলে যেত। এতে করে প্রত্যেক ভাই মাসে একবার বাড়ি আসত। তখনও সাত ভাই এক সংসারে।
একবার বর্ষার মৌসুমে নসেজ (চার নাম্বার) ভাইটার বাড়ি আসার পালা। সে দিন ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ভীষণ ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। ট্রেন থেকে নেমে ঝড় বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রায় দু’ঘন্টা অপেক্ষা করেও যখন ঝড়বৃষ্টি থামল না তখন ভিজে ভিজে গভীর রাতে ঘরে এসে পৌঁছাল।
সেদিন বিকেল থেকে আবহাওয়া খারাপ ছিল। সন্ধের পর ঝড়বৃষ্টি শুরু হতে ঘরের সবাই মনে করল, আজ কোলকাতা থেকে কেউ আসতে পারবে না। এলে কাল সকালে আসবে। নসেজ দেবরের স্ত্রীও তাই মনে করে জায়েদের সঙ্গে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বড় খালা ছিল জায়েদের মধ্যে সবার বড়।
স্টেশন থেকে তাদের বাড়ি মাইলখানেকের পথ। ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়িতে পৌঁছে দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে তার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে লাগল। তখনও তাদের কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি। বৌটা ডাক শুনে জেগে গিয়ে স্বামীর গলা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল। স্বামী ঘরে ঢুকে যাবার পর দরজা লাগিয়ে দিল। তখনও ঝড়ের দাপটে চওড়া বারান্দা থাকা সত্ত্বেও পানির। ছাঁট ঘরের ভিতরে আসছিল।
ততক্ষণ লোকটা ঠান্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপছে। বৌটা গামছা ও লুঙ্গি এগিয়ে দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি ভিজে কাপড় পালটে মাথাসহ সারা শরীর মুছে ফেল। কথা শেষ করে স্বামীকে সাহায্য করতে নিজেও লেগে গেল। তারপর তার পায়ে হাতে তৈল মালিশ করে বলল, তুমি বস, আমি রান্নাঘর থেকে তোমার ভাত নিয়ে আসি।
রান্নাঘর উঠনের শেষ প্রান্তে। তাদের রুম থেকে রান্নাঘর বেশ কিছুটা দূরে। তার কথা শুনে লোকটা বলল, রান্নাঘর থেকে ভাত আনবে কেমন করে, এখনও ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে?
বৌ বলল, তাই বলে তুমি না খেয়ে থাকবে? কিছু ভেবনা, আমি ভাত আনার ব্যবস্থা করছি।
লোকটা স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর দিতে দিতে বলল, একরাত ভাত না খেলে কি এমন হবে? ভাত আনতে গেলে তো ভিজে একাকার হয়ে যাবে। তাছাড়া যে রকম ঘন ঘন বাজ পড়ছে-না-না ভাত আনার দরকার নেই। বৌ নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল, তুমি বস, আমি একটু চেষ্টা করে দেখি। কথা শেষ করে বৌ দরজা খুলে বাইরে আসতে বৃষ্টির ঝাঁপটা ঘরের ভিতরে যাচ্ছে দেখে দরজা ভিড়িয়ে দিল।
লোকটা বাধা দিয়েও তাকে নিবৃত্ত করতে পারল না।
এদিকে বড় খালা পেশাব করবে বলে ঘরের দরজার বাইরে বেরিয়ে বারান্দার একপাশে কাজ সমাধা করে উঠে দাঁড়িয়েছে। এমন সময় বিদ্যুৎ চমকে উঠতে যা দেখল, তাতে যেমন খুব অবাক হল, তেমনি ভয়ে কাঁপত লাগল।
মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোতে দেখতে পেল, তার নসেজ জা, তার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে রান্না ঘরের ভেতর থেকে ভাত তরকারি বের করে তার উপর বড় ডিস চাপা দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
বড়খালা নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারল না? আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে গিয়ে চিন্তা করল। নসেজ বৌয়ের হাত এত লম্বা হল কি করে? সে কি তা হলে জিনের মেয়ে? এই সব চিন্তা করে বাকি রাত আর ঘুমাতে পারল না।
বৌ তার ঘরের দরজার কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে রান্নাঘর থেকে সবকিছু আনলেও ঝড় পানির ঝাঁপটায় তার জামা কাপড় ভিজে গেছে। ঘরে ঢুকে সেগুলো পাল্টে স্বামীকে খেতে দিল।
পরের দিন সকালে এক ফাঁকে বড় খালা নসেজ জাকে নিজের রুমে ডেকে একাকী বলল, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, ঠিক উত্তর দিবি তো?
নসেজ বৌ বলল, শুধু শুধু মিথ্যা বলব কেন? তাছাড়া আমি কখনো মিথ্যা বলি না।
বড় খালা রাতের ঘটনা বর্ণনা করে বলল, এটা কি করে সম্ভব হল বলতো শুনি? আমার মনে হল, আমি যেন ভেলকি দেখলাম।
নসেজ বৌ চমকে উঠে বড় জায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আগে কথা দাও, যা দেখেছ এবং এখন আমি যা বলব, তা আমি বেঁচে থাকতে অন্য কাউকে বলবে না। মরে যাবার পর বলতে পার।
বড় খালা বলল, ঠিক আছে, আমি তোকে কথা দিলাম।
নসেজ বৌ তখন বলতে শুরু করল—
আমার বয়স যখন নয়-দশ বছর তখন এক বেদেনী আমাদের উঠোনে সাপের খেলা দেখাচ্ছিল। সেখানে পুরুষ লোক কেউ ছিল না। শুধু মেয়েরা দেখছিল। আমিও দেখছিলাম সাপের খেলা দেখান হয়ে যাবার পর আমার মা আমার হাতে কিছু চাল ডাল দিয়ে বলল, এগুলো বেদেনীকে দাও। আমি সেগুলো দিতে এলে বেদেনী কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল, তারপর জড়িয়ে ধরে কোলে বসিয়ে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, মায়ের আমার তকদ্বির খুব ভালো। সাপ খেলা হয়ে যেতে অনেকে চলে গেছে। যারা ছিল, তাদের একজন জিজ্ঞেস করল, ভাগ্য ভালো বলতে তুমি কি বলতে চাচ্ছ?
বেদেনী বলল, মা আমার খুব স্বামী সোহাগিনী হবে। খুব বড় ঘরে বিয়ে হবে।
সেখানে আমার এক চাচি ছিল, সে বলল, আল্লাহ ছাড়া ভাগ্যের কথা কেউ জানে না। আমাদের নবী (দঃ) ভবিষ্যৎ বাণী বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছেন। হাদিসে আছে রসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেনঃ “ভবিষ্যৎ বক্তাগণের নিকট যে ব্যক্তি কিছু জিজ্ঞেস করে, তাহার চল্লিশ দিনের নামাজ কবুল হয় না।” [বর্ণনায়ঃ হজরত হাফসা (রাঃ)। মোসলেম] হাদিসে আরও আছে, “যারা ভবিষ্যৎ জানার জন্য ভবিষ্যৎ বক্তার কাছে যায় এবং ভবিষ্যৎ বক্তা গণনা করে দেয়, তাদের উভয়ের উপর আল্লাহর লানত পড়ে।”
বেদেনী চাচির কথা গ্রাহ্য না করে আমার কানে মুখ রেখে বলল, তোমাকে আমি কয়েকটা কথা শিখিয়ে দিচ্ছি, তুমি মুখস্থ করে নাও। যদি কোনো দিন বিপদে পড় কিংবা এমন অবস্থায় পড় যে, কি করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে পারছ না, তখন এই কথাগুলো পড়বে। আর যা মনে করবে তাই হয়ে যাবে। আর সাবধান, ঐ দুই সময় ছাড়া তুমি কখনও এটা মুখে উচ্চারণ করবে না। আর আমি যে তোমাকে এটা শেখালাম, তা যতদিন বেঁচে থাকবে ততোদিন কাউকে বলবে না। তারপর বলল। এখন আমি যে কথগুলো বলছি সেগুলো তুমি মনে মনে ঠোঁট নেড়ে নেড়ে মুখস্থ করে নাও। তোমার ভালোর জন্য তোমাকে শেখাচ্ছি। মাত্র পাঁচ-ছয়টা শব্দ কয়েক বার পড়তেই মুখস্থ হয়ে গেল।
বেদেনী কথা বলা বন্ধ করে আমার ঠোঁটের কাছে কান রেখে বলল, কই বলতো মা, শিখেছ কিনা দেখি।
আমি শব্দগুলো উচ্চারণ করলাম।
.
বেদেনী শুনে আমার দু’গালে চুমো খেয়ে বলল, সাবধান একথা কাউকে বলবে না। বললে তোমার খুব ক্ষতি হবে। তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাদের ধর্মে কি আছে জানি না। তবে আপনি দেখবেন, আপনার এই মেয়ে খুব ভাগ্যবতী। তারপর সে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
বেদেনী আমার কানে মুখ রেখে যখন কথা বলছিল তখন সেখানে যারা ছিল তারা প্রত্যেকেই দেখেছে। সে চলে যাবার পর আমার চাচি ও তাদের অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, বেদেনী তোর কানে কানে কি বলল?
আমি বললাম, সে কথা বলতে পারব না। তারপর আমি সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে পেলাম।
তারপরও বেশ কয়েক দিন মা, চাচিরা এবং সমবয়সি মেয়েরা আমাকে সেই কথা জিজ্ঞেস করেছিল। আমি বেদেনীর কথা ভেবে কাউকে বলিনি। আস্তে আস্তে দিনের পর দিন বেদেনী ও তার শেখান কথাগুলো ভুলে গেলাম। কিন্তু গতরাত্রে যখন তোমার দেবর অনেক রাতে বাড়ি ফিরল, তখন তাকে ঐ “ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কি করে রান্নাঘর থেকে ভাত এনে খাওয়ার চিন্তা করার সময় হঠাৎ করে বেদেনী ও তার শেখান কথাগুলো মনে পড়ে গেল। এর আগে কোনোদিন আমি বেদেনীর শেখানো কথা মুখে উচ্চারণ করিনি। বললাম না, এতদিন সব কিছু ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু গতরাতে ঐ সময় মনে পড়তে বেদেনীর শেখান কথাগুলো পড়ে পরীক্ষা করলাম। দেখলাম, রান্নাঘরটা আমার সামনে চলে এল। আমি হাত বাড়াতেই সবকিছু নাগালের মধ্যে পেয়ে গেলাম। তখন আমি ভাত তরকারী বেড়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলাম। বড় বুবু, তুমি এসব কথা কারও কাছে বলবে না বলে ওয়াদা করেছে। ওয়াদা পালন করবে নচেৎ তোমার ক্ষতি হবে। তবে আমি মরে যাবার পর যদি বল, তা হলে কোনো ক্ষতি হবে না।
বড় খালা বলল, তুই চিন্তা করিস না, এসব কথা কি কাউকে বলা যায়? সেই জা মারা যাবার পর একদিন আমার মায়ের কাছে বড় খালা বলেছিল। আমিও তখন সেখানে ছিলাম।
এই পর্যন্ত বলে মা আমাকে বলল, সোলেমানের যেমন কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি তেমনি আমার বড় খালার সেই জায়েরও কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি। আমার মনে হয় যারা জাদু শিখে তাদের ঘরে কোনো সন্তান জন্মায় না।
জবেদ দাদা ও মায়ের মুখে জাদুর কথা শুনে আমার আরও বেশি জাদু শেখার ঝোঁক চেপে গেল।
৩
কিছুদিন পরের ঘটনা। নানার আলমারীতে একটা বই পেলাম। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন আমার নানা মারা যান। উনি বিরাট ধনী ও হাজী সাহেব। ওঁর দু’টো বিয়ে। আমরা বড়র পক্ষের। ছোট নানি কলকাতার এক ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। ব্রিটিস পিরিয়ডে যখন নানাদের কলকাতায় সাবানের কারখানা ছিল তখন তাকে বিয়ে করেন। দুই নানি আমাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। একদিন নানি আলমারী পরিষ্কার করছিলেন, তখন আমিও সেখানে ছিলাম। জিনিসপত্রের সঙ্গে একটা বই দেখে নানিকে জিজ্ঞেস করে বইটা নিয়ে কয়েক পাতা পড়ে খুব অবাক হলাম। তারপর বইটা বাড়িতে এসে পুরোটা পড়ে আরও অবাক হলাম। বইটা আমার কাছে বহুদিন ছিল। ছোটবেলা থেকে যেমন আমার বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার নেশা ছিল তেমনি বই, কালেকসান করাও আমার নেশা ছিল। মায়ের ও নানির কাছে কান্নাকাটি করে টাকা পয়সা আদায় করে বই কিনতাম। পাকিস্তান আমলে আমি যখন এদেশে চলে আসি তখন বইগুলো ওখানে থেকে যায়। প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর আগে বইটি পড়েছিলাম, যতটা মনে আছে তা পাঠকবর্গের কাছে তুলে ধরছি।
মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক দেশে এক ইহুদী বণিক ছিল। তার মা ছাড়া আর কেউ ছিল না। বিরাট এলাকা নিয়ে তার বাড়ি। বছরের বেশির ভাগ সময় বিভিন্ন দেশে সে বাণিজ্য করতে যেত। ছেলে মায়ের সেবার জন্য দাস-দাসী রাখতে চাইত; কিন্তু তার মা ভীষণ কৃপণ। ছেলেকে বলল, আমি এখনও বুড়ি হইনি। এতদিন আমিইতো সবকিছু করে আসছি। ছেলে মাকে ভীষণ ভক্তি শ্রদ্ধা করত। তাই কিছু না বলে চুপ করে রইল।
ছেলেকে চুপ করে থাকতে দেখে মা বলল, তুই যদি আমার কথা শুনি, তা হলে আমি খুব খুশি হব।
ছেলেটা বলল, বল মা কি করতে হবে?
: তুই বিয়ে কর। তোর বিয়ের বয়স হয়েছে। বৌ আমাকে সব কাজে সাহায্য করবে।
: বেশ তোমার কথা মেনে নিলাম।
বণিকের মা ঘটকের দ্বারা অনেক দূরের গ্রামের খুব গরিব ঘরের একটা মেয়েকে বৌ করে আনল।
মেয়েটি দেখতে শুনতে যতটা না ভালো, তার চেয়ে অনেক বেশি গুণবতী ও গরিব ঘরের মেয়ে স্বামীর বাড়ির প্রাচুর্য দেখে অভিভূত হয়ে গেল। মনপ্রাণ উজাড় করে স্বামীকে ভালোবাসল। আর সেই সঙ্গে সংসারের সবকিছু করার সাথে সাথে শাশুড়ীর সেবাযত্ন করে চলল। শাশুড়ীকে কোনো কাজ করতে দিতে চাইল না। কিন্তু শাশুড়ী বৌয়ের কথা না মেনে তার সঙ্গে সেও কাজ কর্ম করতে লাগল। বৌকে আদর সোহাগ করে বলে, তুমি একা এত কাজ করবে কি করে? সংসারের কাজের চেয়ে তোমার স্বামীর সেবা-যত্ন করা বড় কাজ। ছেলে যতদিন ঘরে ছিল ততদিন মা বৌকে সংসারের কাজ তেমন একটা করতে দিত না। কাজ করতে এলে তাকে ছেলের কাছে পাঠিয়ে দিত।
এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর বণিক বিদেশে বাণিজ্য করতে গেল। তখন তো বিজ্ঞানের এত উন্নতি হয়নি। মটর, বাস তৈরি হয়নি। তাছাড়া সেটা মরুভূমির দেশ। যারা বিদেশে বাণিজ্য করতে যেত তারা উটে করে দল বেঁধে যেত। তাকে আরবীতে কাফেলা বলে। এক এক কাফেলায় পঞ্চাশ, ষাট, একশত বা ততোধিক বণিক থাকত। কারণ, মরুভূমির পথে ডাকাতরা বণিকদের সব লুণ্ঠন করে নিত।
যাই হোক বাণিজ্য করতে চলে যাবার পর তার স্ত্রী, শাশুড়ীর আসল রূপ দেখতে পেল। সে সংসারের কাজ কর্ম করা বন্ধ করে দিল। বসে বসে শুধু বৌকে এটা কর, সেটা কর বলে হুকুম চালাতে লাগল। এতেই সে ক্ষান্ত হল না। বৌকে আধপেটা করে খেতে দিতে শুরু করল। আর কথায় কথায় বৌয়ের উপর। শুধু শুধু মেজাজ দেখাতে শুরু করল।
বৌ শাশুড়ীর ব্যবহারে খুব অবাক হল। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করল না। যতদিন যেতে লাগল শাশুড়ীর অত্যাচার তত বেড়েই চলল। শেষে এমন হল বৌ যদি কোনো কাজে একটু ভুল করত অথবা করতে দেরি হত, তা হলে শাশুড়ী তাকে লাঠি দিয়ে পেটাতো।
বৌটা তবু কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস করত না। কারণ সে জানে। প্রতিবাদ করলে যদি ঘর থেকে বের করে দেয়, তা হলে সে যাবে কোথায়? তার তো কেউ নেই। বাবা জন্মের আগে মারা গেছে। মা জন্মের ছ’মাস পরে মারা গেছে। বড় হয়ে শুনেছে মরবার সময় মা তার এক দূর সম্পর্কের বোনের কাছে তাকে দিয়ে যায়। সেই মেয়েটি খুব গরিব ও বুড়ি ছিল। সে বেশি দিন বাঁচেনি। বুড়ি মারা যাবার পর যাদের বাড়িতে কাজ কর্ম করত ও থাকত, তারাও গরিব। তারাই বিয়েটা দিয়েছে। তাই সে শাশুড়ীর শত অত্যাচার সহ্য করে চলল। কয়েক মাস পর বৌটা লক্ষ্য করল, তার প্রতি শাশুড়ীর অত্যাচার যেন কমে যাচ্ছে। মনে করল, শাশুড়ী হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। মনে মনে বেশ খুশি হল। এর কয়েকদিন পর বণিক বাণিজ্য করে দেশে ফিরল।
ছেলে ফিরে আসার পর শাশুড়ী আর বৌকে কোনো কাজকর্ম করতে দিল না। সব সময় ছেলের কাছে রাখে। নিজেই সবকিছু করে। এমন কি ছেলের। বৌকে নিজে খাওয়াত। বৌটা জোর করে সংসারের কাজ করতে গেলে তার। হাত ধরে ছেলের কাছে পাঠিয়ে দিত।
শাশুড়ীর এহেন ব্যবহারে বৌটা তার আগের অত্যাচারের কথা ভুলে যায়। তবু স্বামীকে বলতে চেয়েছিল; কিন্তু তার বিবেক নিষেধ করল। বলল, তোমার স্বামী নিজের চোখে তোমার প্রতি তার মায়ের মধুর ব্যবহার দেখছে। এখন বললে সে তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।
তিন-চার মাস পরে বণিক যখন আবার বাণিজ্য করার জন্য বিদেশ চলে গেল, তখন থেকে শাশুড়ী বৌয়ের উপর আগের মত অত্যাচার শুরু করল।
বৌটা এর কোনো সমাধান খুঁজে না পেয়ে নীরবে সব অত্যাচার সহ্য করে চলল।
কয়েক মাস পরে বণিক ফিরে এলে তার মা বৌয়ের সঙ্গে মধুর ব্যবহার করতে লাগল এবং আগের মতো তাকে কোনো কাজকর্ম করতে দিল না।
একই ঘটনা বছরের পর বছর পুনারাবৃত্তি ঘটে চলল।
বৌ একসময় চিন্তা করল, শাশুড়ীকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেললে কেমন হয়? আবার চিন্তা করল, স্বামী ফিরে এসে যদি কোনো রকমে জানতে পারে, তাহলে সে আমাকেও মেরে ফেলবে। তাছাড়া স্বামী তাকে অত্যন্ত ভালোবাসে। সেও স্বামীকে অত্যন্ত ভালোবাসে তাকে ছেড়ে চলে যেতেও পারবে না। এইসব ভেবে মন থেকে কুমতলব বাদ দিয়ে ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিল।
একদিন বৌটার রাতে খুব জ্বর এল। সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না। অনেক বেলাতে শাশুড়ী ঘুম থেকে উঠে যখন দেখল, সংসারের সব কাজ কর্ম করা হয়নি, তখন তার মাথা গরম হয়ে গেল। বৌয়ের ঘরে এসে তার ঝুঁটি ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে লাঠি দিয়ে বেদম পেটাতে শুরু করল। আর বলতে লাগল, ফকিন্নির ঘরের মেয়ে হয়ে এত আরাম-আয়েশ কিসের? যা বান্দীর বাচ্চী কাজ কর।
বৌটা শাশুড়ীর পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে আর মারবেন না মা। আমার গত রাত থেকে খুব জ্বর। তাই আমি বিছানা থেকে উঠতে পারিনি।
শাশুড়ী বৌয়ের কথায় কর্ণপাত না করে তাকে মেরেই চলল, এক সময় ক্লান্ত হয়ে নিজেই মার বন্ধ করল।
বৌটা মেঝেতে পড়ে গোঁ গোঁ করতে করতে এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন বেলা প্রায় দু’টো কি আড়াইটা হবে। হামাগুড়ি দিয়ে কলসির কাছে গিয়ে পানি খেল। তারপর একটি পাটি নিয়ে দরজার বাইরে বারান্দায় শুয়ে রইল। কাল রাত থেকে জ্বর হওয়ায় এতক্ষণ পর্যন্ত পেটে কোনো দানা-পানি পড়ে নাই। খালি পেটে পানি খেতে পেটটা গুলিয়ে উঠে বমির ভাব হতে লাগল।
এমন সময় একটি আধা বয়সী ভিখারিনী সদর দরজায় এসে ভিক্ষা চাইল।
বৌটি বলল, আমি অসুস্থ উঠতে পারছি না, মাফ কর।
ভিখারিনী বলল, তোমার কি হয়েছে মা, আমি তোমাকে কি দেখতে পারি? কথা বলতে বলতে বৌটার কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর তার অবস্থা দেখে। মোলায়েম সুরে বলল, তোমার কি হয়েছে মা খুলে বলত?
বৌটা ভিখারিনীর কোমল সুর শুনে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, সে সব শুনে তোমার কি লাভ হবে মা?
: আমার লাভ না হলেও তোমার উপকার করার চেষ্টা করব।
: এই কথা শুনে বৌটার চোখ থেকে আরও বেশি করে পানি পড়তে লাগল। ভিখারিনী পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দিয়ে বলল, শুধু কেঁদে কেঁদে কোনো সমস্যার সমাধান করা যায় না। বরং কি হয়েছে আমাকে সবকিছু খুলে বল।
বৌটা তখন গা, হাত ও পায়ের কাপড় সরিয়ে দেখাল। তারপর বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত শাশুড়ীর অত্যাচারের কাহিনী বলল।
ভিখারিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি যদি আমার কথা শোন, তা হলে তুমি শাশুড়ীর অত্যাচার থেকে রেহাই পাবে।
: আমি তোমার কথায় রাজি, কি করতে হবে বল?
: আমি আজ রাতদুপুরে এসে তিনটি পাথর পর পর তোমাদের উঠানে ফেলব, সেই শব্দ শুনে তুমি দরজা খুলে বেরিয়ে আসবে। তারপর আমি তোমাকে যা যা বলব তা সব যদি তুমি করতে পার, তা হলে এই অত্যাচারী শাশুড়ী চিরকাল কেনা বাঁদীর মতো তোমার সেবা-যত্ন করবে।
: আমার সেবা-যত্ন করার দরকার নাই, অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়াই আমার কাম্য। কিন্তু আপনাকে আগেই বলে রাখছি আমাকে দিয়ে কোনো অন্যায় কাজ করাতে পারবেন না।
: না তা করাব না, এখন আমি যাই। রাত বারোটার সময় আসব ও তুমি ঘুমিয়ে পড় না যেন।
: ঠিক আছে তাই হবে।
: সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত। সন্ধ্যের পর শাশুড়ীর দেয়া আধপেটা খাবার খেয়ে ভিখারিনীর কথা মনে করে ভয়ে চিন্তা করতে লাগল, তার সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে কিনা, আর এমন কি বা কাজ আমাকে করতে বলবে। দুরু দুরু বুকে সেই সব ভাবতে ভাবতে সময় কাটাতে লাগল। এক সময় উঠানে পর পর। তিনটা পাথর পড়ার শব্দ পেয়ে বুঝতে পারল ভিখারিনী এসেছে। তখন তার বিবেক বলল, ঘরের বৌ হয়ে এত রাতে একটা ভিখারিনীর কথায় বিশ্বাস করে তার সঙ্গে যাওয়া উচিত নয়। পরক্ষণেই শাশুড়ীর অত্যাচারের কথা মনে হতেই বিবেক বিসর্জন দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
ভিখারিনী এগিয়ে এসে বলল, তুমি ভয় পেও না, তোমার ভালোর জন্যই ডেকেছি। এখন আমি যা করব বা বলব তার কোনো প্রতিবাদ করবে না। এই কথা বলে একটা রুমাল দিয়ে তার চোখ বেঁধে দিল, তারপর একটা হাত ধরে বলল এস। অল্প কিছুক্ষণ চলার পর চোখের বাঁধন খুলে দিল।
বৌটা তাকিয়ে দেখল, চারদিকে বিরাট বিরাট পাহাড়। তারা দু’জনে দু’টো পাহাড়ের মাঝখানে সরু গলির মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ার্ত স্বরে বলল, আমাকে কোথায় নিয়ে এলেন? এ ধরনের জায়গা আমাদের দেশে আছে বলে কখনও শুনিনি।
ভিখারিনী বলল, এটা আমাদের দেশ না, অনেক দূরে ভিন দেশে এসেছি। তারপর বেশ গভীর স্বরে বলল, তোমার শরীরের সব কাপড় খুলে রেখে সামনে। এগিয়ে যাও। অল্প দূরে একটা কুয়া দেখতে পাবে। কুয়ার পাড়ে দাঁড়িয়ে পেশাব করবে, তারপর ফিরে আসবে। কুয়ার পাড়ে গেলেই তার ভিতর থেকে কেউ তোমাকে পেশাব করতে নিষেধ করবে এবং ভয় দেখিয়ে বলবে, ফিরে যাও। তুমি সে সব অগ্রাহ্য করে তোমার কাজ শেষ করে ফিরে আসবে। তারপর আমি তোমাকে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দেব। তুমি বাড়িতে গিয়ে সেই মন্ত্র পড়ে ঘুমিয়ে পড়বে? পরের দিন থেকে দেখবে, তুমি ঘুম থেকে উঠার আগে তোমার শাশুড়ী সংসারের সব কাজ করে ফেলেছে। সে যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তোমাকে আর সংসারের কোনো কাজ করতে দেবে না। সেই সব করবে।
ভিখারিনীর প্রথম দিকের কথা শুনে যেমন ভয় পেয়েছিল তেমনি তার উপর রেগেও গিয়েছিল। কিন্তু শেষের দিকের কথা শুনে তা কিছুটা কমে গেলেও তার কথামত কাজ করতে সাহস করল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
ভিখারিনী এবার বেশ গরম মেজাজে বলল, কি হল, দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? যা বললাম তাড়াতাড়ি কর। তবু যখন তার নড়বার লক্ষণ দেখা পেল না তখন নিজে তাকে বিবস্ত্র করে বলল, যাও কুয়ায় পেশাব করে এস। নচেৎ এখানে তোমাকে রেখে আমি চলে যাব। এখানে জিন, পরীদের বাস এবং বাঘ, ভাল্লুক ও সিংহ বাস করে। তারা তোমাকে কি করবে তা তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ।
বৌটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ধীর পদক্ষেপে একটু এগিয়ে গিয়ে কুয়াটা দেখতে পেল। যেমনি কুয়ার পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে অমনি ভিতর থেকে একটা গুরুগম্ভীর শব্দ ভেসে এল এখানে পেশাব কর না। জলদি এখান থেকে চলে যাও, নচেৎ তোমার ভীষণ বিপদ হবে। সেই শব্দ শুনে আরও বেশি ভয় পেয়ে সে ফিরে এল।
ভিখারিনী কর্কশ শব্দে বলল, কি হল ফিরে এলে কেন? কুয়া থেকে যে শব্দই আসুক না কেন, তোমাকে পেশাব করতেই হবে। নচেৎ ফিরে যাবার কোনো পথ তোমার ভোলা নেই।
তারপর জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল, যাও তাড়াতাড়ি কর।
বৌটা মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে ভয়ে জ্ঞান হারাবার উপক্রম হল। কিছুক্ষণ পরে উঠে কুয়ার কাছে গেল, এবারও শুনতে পেল, কেউ যেন কুয়ার ভিতর থেকে বলছে, খবরদার, পেশাব কর না, করলে তোমার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি চিরকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। বৌটার তখন কোনো হুশজ্ঞান নেই, চিন্ত শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে। একদিকে কুয়ার এই নিষেধ বাণী, অপরদিকে ভিখারিনীর সতর্কবাণী, এবারে পেশাব না করে ফিরে গেলে, যদি সত্যি সত্যি তাকে এখানে রেখে চলে যায়, তা হলে এই পাহাড় জঙ্গলে একা ভয়ে মরে যাবে। মরে না গেলেও বাঘ-ভাল্লুকের পেটে যাবে। এইসব চিন্তায় এক রকম জ্ঞানশূন্য হয়ে কূয়ায় পেশাব করার মনস্থ করল। কিন্তু সহজে কি পেশাব হতে চায়? এমনিতেই তার সে আধমরা হয়ে গেছে। যাই হোক, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করে যেইমাত্র পেশাব করল, তৎক্ষণাৎ একটা আবছা ছায়ার মত কি একটা জিনিস কুয়া থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে উড়ে গেল। বৌটার তখন কোনো দিকে খেয়াল করার মতো মনের অবস্থা নেই! পেশাব করে সে ফিরে এল।
তাকে দেখে ভিখারিনীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, এই তো বাপের বেটির মত কাজ করেছ। এবার জামা-কাপড় পরে নাও।
বৌটা জামা-কাপড় পরার পর ভিখারিনী তার কানে কানে ছোট একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে তার চোখে রুমাল বেঁধে দিয়ে বলল, এবার মন্ত্রটা পড়তে দেখি?
বৌটা মন্ত্র পড়ল।
অল্পক্ষণের মধ্যে ভিখারিনী তার চোখ থেকে রুমাল খুলে দিয়ে বলল, যাও এবার দরজা লাগিয়ে ঘরে গিয়ে মন্ত্রটা পড়ার সময় মনে মনে বলবে, আমার শাশুড়ীর স্বভাব পরিবর্তন হোক। তারপর ঘুমিয়ে পড়বে। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে এই মন্ত্রের তেলেসমাতি দেখতে পাবে।
রুমাল সরিয়ে নিতে বৌটা চোখ খুলে অবাক হয়ে দেখল, সে তাদের সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দরজার দিকে একবার তাকিয়ে ভিখারিনীর দিকে চেয়ে চমকে উঠল। দেখল, সে নেই। তাকে চিৎকার করে ডাকতে গেল। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। তার মনে হল, সে স্বপ্ন দেখছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ির ভিতরে এসে সদর দরজা লাগিয়ে ভিখারিনী যা যা বলেছিল তা সব করে ঘুমিয়ে পড়ল।
রাত জাগার ফলে শুধু নয়, সমস্ত রাত মনের উপর দিয়ে ঝড়তুফান বয়ে গেছে। সেজন্যে অনেক বেলাতে কারও ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গল। চেয়ে দেখল, শাশুড়ী তার পা, হাত পা টিপে দিতে দিতে কাকুতি-মিনতি করে বলছে বৌমা উঠে গোসল করে নাস্তা কর। অনেক বেলা হয়েছে। আমি সবকিছু তৈরি করে রেখেছি।
বৌটা প্রথমে মনে করল সে বুঝি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে যখন বুঝতে পারল, না, স্বপ্ন নয় সত্যি তখন তার গত রাতের ঘটনা একের পর এক মনে পড়তে লাগল। তার মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, দেখলি তো যাদুমন্ত্রের কেমন খেলা? বৌটা মনে মনে খুব খুশি হলেও। শাশুড়ীকে এই রকম করতে দেখে তার বিবেকে খুব বাধল। তাড়াতাড়ি করে উঠে বলল, আপনি আমার হাত-পা টিপছেন কেন? যান আমি আসছি।
শাশুড়ী বলল, তোমাকে বুঝতে না পেরে তোমার সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। তারপর হাতজোড় করে বলল, আমাকে মাফ করে দাও মা।
বৌ আর কি বলবে? যাদুমন্ত্রের গুণ বলে মনে করল। বলল, ঠিক আছে, মাফ করে দিলাম। তারপর খাট থেকে নেমে গোসল করার জন্য কাপড় আনতে গেল।
শাশুড়ী বলল, আমি গোসলখানায় কাপড় রেখে এসেছি। সেখানে পানিও দিয়েছি। আমার সঙ্গে এস।
এরপর থেকে জাঁদরেল অত্যাচারী শাশুড়ী বৌয়ের কেনা বাঁদীর মতো হয়ে গেল। বৌকে রাজরানীর মত মেনে চলতে লাগল। তাকে সংসারের কোনো কাজকর্ম করতে দেয় না। এমন কি নাস্তা বা ভাত বেড়েও খেতে দেয় না, নিজে ভাত বেড়ে বসিয়ে খাওয়ায়।
বৌ শাশুড়ীর খাতির-যত্নে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। তার উপর তাকে এত পরিশ্রম করতে দেখে বৌয়ের খুব দয়া হতে লাগল। একদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে শাশুড়ীকে কাজ করতে দেখে বৌ বলল, আপনি অসুস্থ, শুয়ে থাকুন। আমি কাজকর্ম করছি।
শাশুড়ী শুনল না, বৌয়ের হাত ধরে ঘরে এনে বলল, তুমি বসে থাক। আমার তেমন কিছু হয়নি। কিই বা এমন কাজ, আমিই করতে পারব। তারপর বেরিয়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কাজ করতে লাগল।
এভাবে কিছুদিন যাবার পর বণিক বাণিজ্য করে দেশে ফিরল। এবারে ফিরে এসে সেও স্ত্রীকে আগের চেয়ে অনেক বেশি আদর সোহাগ করতে লাগল। সে স্ত্রীর প্রতি মায়ের দুর্ব্যবহারের কথা জানত না। বিয়ের পর থেকে বৌয়ের প্রতি তার ভালো ব্যবহার শুধু দেখে এসেছে। এবারে সেটা যেন আরও বেশি লক্ষ্য করে একদিন স্ত্রীকে বলল, মা তোমাকে আগের থেকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। তোমাকে তো কোনো কাজই করতে দিচ্ছে না।
তার স্ত্রী বলল, তোমার কথা ঠিক। আমি কত করে মাকে বলি, আমিও সংসারের কাজকর্ম করি। কিছুতেই যদি আমাকে কোনো কাজে হাত লাগাতে দেন। ওঁর বয়স হয়েছে, এত খাটাখাটনি কি সহ্য হয়? তুমি একটা দাসী রাখার ব্যবস্থা কর।
বণিক বলল, তাই রাখতে হবে। তারপর মাকে ডেকে বলল, তুমি তো বৌকে একটা কাজ করতে দাও না। তাই আমি ঠিক করেছি, একটা দাসী রাখব।
তার মা বলল, দু’তিনজনের সংসারে কি এমন কাজ যে, সেজন্য দাসী। রাখবি। দাসী রাখলে কত খরচ হবে ভেবে দেখেছিস। তুই কত কষ্ট করে বিদেশ থেকে টাকা পয়সা রোজগার করে আনিস। সেই টাকা আমি দাসীর পিছনে খরচ হতে দেব না। ওসব চিন্তা বাদ দে।
বণিক যত মাকে বোঝায়, মা ততো রেগে যায়। শেষে বণিক দাসী রাখার চিন্তা বাদ দিল।
এরপর অনেক বছর কেটে গেল। প্রথমে বণিকের মা মারা গেল। মা মারা যাবার পর বণিক বিদেশ যাওয়া ছেড়ে স্ত্রীর কেনা গোলাম হয়ে গেল। সব সময় স্ত্রীর সেবা-যন্ত করা তার নেশা হয়ে দাঁড়াল। বৌটা তাকে কিছুতেই নিবৃত্ত করতে পারল না। তারপর অনেক বছর পর বণিকও মারা গেল। তাদের কোনো সন্তান হয়নি এতবড় সংসারে বৌ একা বাস করতে লাগল। বৌয়ের বয়স এখন পঞ্চাশের উপর। সারা জীবন শাশুড়ী ও স্বামীর আদর সোহাগে জীবন কাটিয়েছে। এখন নিঃসঙ্গ জীবন কাটান তার পক্ষে কষ্টকর মনে হতে লাগল। সেই সঙ্গে জাদুর প্রভাবে স্বামী ও শাশুড়ীর আদর সোহাগের কথা মনে করে নিজের বিবেকের চাবুকে জর্জরিত হতে থাকল। ভাবল, জাদু শিখে স্বামী ও শাশুড়ীকে কেনা গোলাম ও বাদীর মতো করে ফেলেছিলাম। এটা যে কত বড় অন্যায়, কত বড় পাপ কাজ, তা এখন সে বুঝতে পেরে খুব অশান্তিতে দিন কাটাতে লাগল। তার মনে হল, এই পাপের জন্য বোধহয় সৃষ্টিকর্তা তার পেটে কোনো সন্তান দেয়নি। একদিন রাতে এইসব চিন্তা করতে করতে সেই যাদু মন্ত্রটা পড়ে ঘুমাল। ঐ রাতে স্বপ্নে দেখল, একটা কালো কুচকুচে বিকলাঙ্গ মানুষ তাকে বলছে, আমাকে চিনতে পারছ? তার বিকট চেহারা দেখে বৌটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, তোমাকে আমি চিনতে পারিনি। কে তুমি?
সেই বিকট চেহারার লোকটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল, আমি ভাল মানুষের দুশমন, খারাপ মানুষের বন্ধু। তুমি তোমার বিবেক বিসর্জন দিয়ে কুয়ায় পেশাব করে আমার বন্ধু হয়ে গেছ। সেদিন আমিই তোমাকে ঐ কাজ করতে বাধ্য করেছিলাম। তাই তোমার দুঃখ দেখে তোমার কাছে কয়েকটা কথা বলতে এসেছি। তুমি সেদিন যেমন বিবেকের কথা না শুনে যাদু শিখেছিলে, তেমনি এখন বিবেকের কথা না শুনে ফুর্তি করে দিন কাটিয়ে দাও। বিবেকের কথা শুনলে চিরকাল অশান্তিতে ভুগবে।
বৌটার বিবেক বলে উঠল, খবরদার, এর কথা আর শুন না। এ হল শয়তান, এই মানুষকে কুমন্ত্রণা দিয়ে পাপ কাজ করায়। বৌটা তখন সাহস করে বলল, তুই দূর হয়ে যা শয়তান। তোর কুমন্ত্রণায় আমি যে অন্যায় করেছি, তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। তুই আমার নজর থেকে দূর হয়ে যা।
সেই বিকট চেহারার লোকটা আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল, তোমার ঈমান তুমি নষ্ট করে দিয়েছ। প্রায়শ্চিত্ত করবে কী করে? তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে বৌটা আবার একজন সুন্দর বুড়ো দরবেশ লোককে দেখতে পেল। ইনাকে দেখে প্রায়শ্চিত্ত করার কথা বলবে কিনা চিন্তা করতে লাগল। তার মনে হল, দরবেশটা তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করছে, কি ভাবছ?
ও বৌটা জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?
: আমি তোমার বিবেক।
: আমার তো বিবেক নেই। তাকে বিসর্জন দিয়ে যাদু শিখেছি।
: যার উপর আল্লাহপাকের রহমত হয়, সে আবার বিবেক ফিরে পায়। তাই তো তুমি বিবেকের তাড়ণায় অশান্তির আগুনে জ্বলছ।
: কিন্তু বিবেক থাকলে তো শুধু হবে না। ঈমান থাকতে হবে। আমি তো সেটাও বিসর্জন দিয়ে যাদু শিখেছি।
: তা আমি জানি। আরও জানি মানুষ চেষ্টা করলে ঈমানও ফিরে পেতে পারে।
: বৌটা চমকে উঠে বলল, সত্যি বলছেন? আমি আবার ঈমান ফিরে পাব।
: হ্যাঁ, সত্যি বলছি শুধু ঈমান নয়, চেষ্টা করলে জীবনের সমস্ত অন্যায় ও পাপ মোচন করতে পারবে।
: বৌটা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কাতর স্বরে বলল, তা হলে বলুন, কি করে আমি তা করতে পারব।
: তুমি কি হজরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর কথা শুন নাই? তিনি বলেছেন, মানুষ সারা জীবন ধরে যত রকমের ছোট বড় পাপ করুক না কেন? ইসলাম গ্রহণ করে খাঁটি দিলে পাপ কাজ আর কখনও করব না বলে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে, আল্লাহ তার সমস্ত রকমের পাপ ক্ষমা করে দেন। তুমি যদি ঈমান ফিরে পেতে চাও এবং অশান্তির আগুন থেকে বাঁচতে চাও, তা হলে তাঁর কাছে গিয়ে তওবা করে ইসলাম কবুল কর। এছাড়া অন্য কোনো পথ তোমার। খোলা নেই।
: ওঁকে কোথায় পাওয়া যাবে?
: ওঁর জন্ম আরবের মক্কা নগরে বিখ্যাত কোরাইশ বংশে। পৌত্তলিক আত্মীয়-স্বজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর হুকুমে মদিনায় চলে যান। পরে অবশ্য মক্কার সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছে। এই কথা বলে দরবেশ অদৃশ্য হয়ে গেল।
দরবেশ অদৃশ্য হয়ে যাবার পর বৌটার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে রাতে আর ঘুমাতে পারল না। সকালে উঠে দাসীকে জিজ্ঞেস করল, তোকে তো বাজার থেকে কিনে এনেছি; কিন্তু তোর তো একটা পরিচয় আছে! বল কোথায় তোর দেশ? তোর কি জাত? স্বামী মারা যাবার পর বৌটা এই দাসীকে বাজার থেকে কিনে এনেছে।
দাসী ছিল মুসলমান। মালিককে বিধর্মী জেনে তা প্রকাশ করেনি। কারণ প্রকাশ করলে সে যদি আবার তাকে বেঁচে দেয়। এখন তার কথা শুনে ভয়ে ভয়ে বলল, আমার দেশ কোথায় জানি না। খুব ছোট বেলায় আমাকে ডাকাতরা লুটে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। এভাবে কয়েকবার মালিক বদলায়। তবে শেষবারে যে মালিকের কাছে ছিলাম, সে মুসলমান। সে খুব ভাল লোক ছিল। তার কাছেই আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি।
বৌটা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, মুসলমান আবার কী?
দাসী বলল, যারা আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী এবং এতদউভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে, সে সবের সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ একথার উপর পূর্ণ বিশ্বাস করে এবং হজরত মোহাম্মদ (দঃ)-কে তার রসুল বলে স্বীকার করে, তাদেরকে মুসলমান বলে।
বৌটা আবার জিজ্ঞেস করল, তাহলে ইসলাম কী?
: হজরত মোহাম্মদ (দঃ) যে ধর্ম প্রচার করেন, সেই ধর্মের নাম ইসলাম। বৌটা দাসীর কাছ থেকে আরও অনেক কিছু জেনে নিয়ে তার উপর বাড়িঘর দেখাশুনা করার দায়িত্ব দিয়ে হজরত মোহাম্মদ (দঃ) কাছে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য বেরিয়ে পড়ল। একেতো মেয়ে মানুষ, তার উপর একা। পথও দীর্ঘ। অনেক আপদ ও কষ্ট সহ্য করে একদিন মদিনায় পৌঁছাল। সে ইচ্ছা করলে জাদু মন্ত্রের দ্বারা অল্প সময়ের মধ্যে গন্তব্য স্থানে পৌঁছাতে পারত; কিন্তু যে জাদুর জন্য সে অশান্তির আগুনে জ্বলছে, যা থেকে সে পরিত্রাণ পেতে চায়, সেই মন্ত্র পড়ে গন্তব্য স্থানে যেতে তার মন চাইল না। তখনকার যুগে এত রকমের যানবাহন ছিল না। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া যেমন কষ্টকর, তেমনি বিপদজ্জনক। তবুও সে জাদু মন্ত্রের সাহায্য না নিয়ে এক কাফেলার সাথে বেরিয়ে পড়ল। মদিনায় পৌঁছে লোকজনদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, হজরত মোহাম্মদ (দঃ) অনেক আগে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। এখন মুসলমানদের নেতা হজরত ওমর (রাঃ)। বৌটা একজনকে বলল, আমি হজরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
লোকটা তাকে হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-র কাছে নিয়ে গেল।
মা আয়েশা (রাঃ) তাকে আপ্যায়ন করবার পর বৌটা তার জীবন কাহিনী বর্ণনা করে বলল, আমি ইসলাম গ্রহণ করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।
হজরত আয়েশা (রাঃ) সবকিছু শুনে বললেন, তুমি খলিফা ওমরের কাছে গিয়ে সব কথা বলে তোমার মনের ইচ্ছা ব্যক্ত কর।
এর পরের ঘটনা আমি জানি না। কারণ যে বইটা পড়ে এই কাহিনী লিখলাম, সেটা অনেক পুরাতন ও ছেঁড়া। বইটার শেষের দিকে সব পাতা ছিল না।
আমি ছোটবেলা থেকে নামায-রোযা করি। ধর্মের অনেক বইও পড়ি। আর যেখানে যতদূরেই ওয়াজ মাহফিল হোক না কেন আমার যাওয়া চাই। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় তেরো-চৌদ্দ মাইল দূরে উলুবেড়িয়া নামে একটা রেলওয়ে স্টেশন আছে। স্টেশন থেকে মাইলখানেক দক্ষিণে ফুরফুরা পীর সাহেব কেবলাদের সহযোগিতায় একটা মাদ্রাসা হয়েছে। সেখানে প্রতি বছর মাদ্রাসায় উন্নতিকল্পে ওয়াজ মাহফিল হয়। বহু বড় বড় ওলামায়েকেরাম এবং ফুরফুরার পীরের সাহেবজাদারাও ওয়াজ করেন। আমিও জ্ঞান হবার পর থেকে প্রতি বছর যাই। সে বছর শুনলাম, দাদাপীর সাহেবের ভাগিনা আব্দুল আজিজ কনকপুরী (রঃ) ওয়াজ করবেন। উনি যেমন খুব উঁচু দরের আলেম ছিলেন তেমনি খুব তাকওয়াধারীও ছিলেন। পীর সাহেব ওঁকে এলমে দরিয়া নাম দিয়েছিলেন। আমি উলুবেড়িয়াতে গিয়ে যেখানে উলামায়ে কেরামদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেখানে ওঁনার সঙ্গে দেখা করে যাদু কি, জানার জন্য গেলাম। কিন্তু এত লোকজন ওঁকে ঘিরে রেখেছে যে, কাছে যেতে সাহস হল না। ভেবে রাখলাম, কাল সকালে উনি যখন স্টেশনে ফিরবেন তখন জিজ্ঞেস করব। এই কথা ভেবে সারারাত মাহফিলে ওয়াজ শুনলাম। তারপর ফজরের নামায পড়ে স্টেশনে এসে ঢুকবার গেটে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ পর দেখলাম, উনি আগে আগে আসছেন, আর সঙ্গীরা ওঁনার পিছনে আসছেন। স্টেশনের গেট দিয়ে ঢোকা মাত্র আমি সালাম দিয়ে হাত মোসাফাহা করার জন্য হাত বাড়ালাম। উনি সালামের উত্তর দিয়ে আমার হাত ধরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমি সেই সুযোগে বললাম, হুজুর একটা কথা আমি জানতে চাই?
উনি দাঁড়িয়ে পড়তে পেছনের সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারা যে আমার প্রতি খুব বিরক্ত হয়েছে তা তাদের দিকে এক পলক চেয়েই বুঝতে পারলাম। ভয়ে আমার বুক তখন কাঁপছে।
উনি আমার কথা শুনে বললেন, কি জানতে চাও বল?
আমি বললাম জাদু সত্যি আছে কি না? যদি থেকে থাকে তা শেখার উপায় কী?
আমার কথা শুনে উনি কয়েক সেকেন্ড আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, জাদু আছে। ইসলাম জাদুকে নিষিদ্ধ করেছে। আর তোমাকে আমি যাদুর পিছনে ঘুরতে নিষেধ করছি। এই কথা বলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু পড়ে ফুঁক দিয়ে বললেন, যাও, আর কখনও এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না।
আমি জ্বী হুজুর বলে সালাম জানিয়ে সরে গেলাম।
এরপর থেকে জাদুর কথা আমি মন থেকে মুছে ফেললাম।