বিবাহ : শিকার এবং শিকারি
”যদি জানিতাম যে, স্ত্রীলোকের বিবাহ দাসীত্ব, তবে কদাপি বিবাহ করিতাম না।”
আজকের দিনে যে কথাটি মনে বড় ধরে, ঔপন্যাসিক তাই বলেছেন একশো বছরেরও আগে। যদিও উপন্যাসের প্রয়োজনে, নায়িকার জীবনদ্বন্দ্বে এই আবেগ ছিল ব্যক্তিগত, একান্ত, আজকের দিনে কিন্তু নারীপ্রগতির শুভলগ্নে এই আবেগ সত্যে পরিণত হয়েছে; ব্যক্তির আক্ষেপ একেবারে সাধারণীকরণের পথ ধরেছে। সংসারজীবনে রমণীর যেন কোনো রমণীয় অভিজ্ঞতাই নেই যা ছিল বা যা আছে তা যেন শুধুই দাসীত্ব, একের চরম সুখ—অপরের যন্ত্রণা-মাখানো। আসলে আজকের দিনে ভাবালুতা চলে না। যাঁরা ভাঙা হারমোনিয়াম কাঁধে ঝুলিয়ে ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গাইতেন, আজকের দৃষ্টিতে তাঁরা ছিলেন ‘স্টুপিড’ আর সেই একই চোখে আমাদের মা-ঠাকুমা, দিদিমা-রা সবাই ছিলেন দাসী। সে-কালের পুরুষেরা মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে দাসী আনতেই যেতেন। বিয়ের সময় হাত ধরে মিথ্যে কথা বলতেন—তুমি শ্বশুর-শাশুড়ি, দেওর-ননদদের কাছে সম্রাজ্ঞী হও—সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভব, সম্রাজ্ঞী শ্বশ্রাং ভব, আর সারা জীবন ধরে সবার সেবাদাসী করেই রাখতেন স্ত্রীকে। তারপর পড়ন্ত বেলায় আরও এক দুর্দান্ত শক্তিমান যুবক এসে সেই দীনা রমণীটিকে বলত—মা, আমি তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি, অমনি বুকের মধ্যে বেজে ওঠে গোধূলি-জীবনের ওপার থেকে ভেসে-আসা অবচেতনের সুর—সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভব, সম্রাজ্ঞী শ্বশ্রাং ভব। তবে কি এতদিনে সম্রাজ্ঞী হলেন তিনি। আমরা বলি—হ্যাঁ এতদিনেই।
আসলে ভারতবর্ষ কেন সমস্ত দেশে, সমস্ত কালেই সম্রাট হতে যেমন সময় লাগে, সম্রাজ্ঞী হতেও তেমনি। আগে রাজা হওয়া। তারপর ঘরে বাইরে সমস্ত শত্রুকে বশীভূত করা, অপর সামন্ত রাজ্যগুলি জয় করা, তারপর তো রাজ চক্রবর্তী, সম্রাট। বিয়ের পর যে রমণী শ্বশুরবাড়ি আসে, সেই শ্বশুরবাড়িটাকে যদি একটা অবিজিত রাজ্য ধরে নিই, তাহলে সেখানকার প্রতিষ্ঠিত সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞী হলেন শ্বশুর এবং শাশুড়ি। স্বামীকে সম্রাট ভাবার কোনো কারণই নেই, কেন না তার রাজযোগ থাকত ভবিষ্যতের জন্য জমা হয়ে। প্রতিষ্ঠিত সেই সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর মন পাওয়ার চেষ্টা করতে করতেই নজর দিতে হত সে রাজ্যের প্রজাবৃন্দের দিকে, অর্থাৎ দেওর, ননদ ইত্যাদির দিকে। মনে রাখা দরকার, স্বামীও এই প্রজাবৃন্দের একজন। এর পরেও আছে সামন্ত রাজ্যগুলি অর্থাৎ আত্মীয়স্বজন।
ভ্রমবশত আমি এমন একটি ঘরের কথা বলতে চেয়েছি, যাকে একান্নবর্তী পরিবার বলে। একটা সময় ছিল, যখন ভাবতাম ‘একান্নবর্তী’ মানে বুঝি একান্ন জন মানুষের পরিবার। শৈশবের দেশ-গাঁয়ের পারিবারিক সদস্যরাই আমার এই ভ্রমের কারণ এবং সম্ভ্রমেরও। তবে বিবাহের তত্ত্ব সম্বন্ধে যদি আলোচনা কিছু করতেই হয়, সেটা এই একান্নের পটভূমিকাতেই করতে হবে; কেন না আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও এ দেশের পারিবারিক চেহারা ছিল এইরকমই।
রাগ করবেন না যেন আজকের দম্পতিরা। সেকালের দিনের দাম্পত্যজীবনের পিছনে ধর্ম কিংবা আদর্শের ভাগ যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তা আজকের দিনেও আছে। কিন্তু আজকের ধর্মবোধ কিংবা সমাজবোধের সঙ্গে সেকালের মিলবে না। আজকের ভালোটা তাই সেকালের ভালো নয়। আজকের দিনে স্বামী-স্ত্রীরা নিজের নিজের ঘরে প্রথম থেকেই সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞী। ”দুটি প্রাণীর বেশি এ কুলায়ে কুলায় না।” আর আমাদের আইনও ঠিক দুটি প্রাণীর ছন্দোবন্ধে তৈরি। স্বামী-স্ত্রী আর খোকা-খুকু ছাড়া পরিবারে আর সব প্রজা—পরাধীন, ডিপেন্ড্যান্ট। হয়তো এর পেছনেও দর্শন আছে, তবে সে দর্শনের মূল্যায়ন হবে ভবিষ্যতের তুলাদণ্ডে, আজকে নয়। বিশেষত এখন যেহেতু ‘ট্রানজিশনে’র সময় চলছে, একান্নবর্তী পরিবারগুলির ক্রমবিভাজন চলছে—তাই বিবাহ-তত্ত্বের কথায় আমরা পুরোনো দিনেই ফিরে যাব।
আধুনিক কালের আর্থ-সামাজিক ভাবনায় সেকালেও রমণীরা সবাই ছিলেন নির্যাতিতা, নিপীড়িতা। কথাটা যে একটুও মিথ্যে নয়, তার প্রমাণও আছে প্রচুর। স্ত্রী এবং শূদ্রের নাম উচ্চারিত হয়েছে এক নিশ্বাসে। বেদে-বিদ্যায় তাঁদের অধিকার ছিল না প্রায়ই, জীবনের চলার পথে ছিল না কোনও স্বাতন্ত্র্য। বশিষ্ঠ কিংবা মনু স্ত্রীলোকের কৈশোরগন্ধী বয়সটা স্থাপন করেছেন পিতার অধীনে, যৌবনটা উৎসর্গ করেছেন স্বামীর জন্যে আর বার্ধক্যটা রেখেছেন পুত্রের অধীনে (অধুনা পুত্রবধূর)। কিন্তু কোনো বয়সেই স্বাধীনতা চলবে না—ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি। স্বামী এবং তাঁর পরিজনদের নিঃস্বার্থ সেবাই ছিল স্বর্গভোগের সুখ। সমগ্র মানবজাতির অর্ধাংশের মনে শুধু সেবার মোহ জাগিয়ে কত স্বর্গসুখ দান করা যায়, বশিষ্ঠ-মনুর মতো ধর্মশাস্ত্রকারেরা তার কোনো খোঁজ রাখেননি। যাঁরা কাব্য-নাটক লিখেছেন তাঁরা নায়িকাদের বসন্তের বাতাস গায়ে মাখিয়ে, প্রেমপুষ্পের মধু খাইয়ে জীবনধারণে সাহায্য করেছেন বটে, কিন্তু সাহিত্যকারদের কারুরই সাহস হয়নি ধর্মশাস্ত্রকে পুরোপুরি অতিক্রম করে নতুন কোনো আঙ্গিকে প্রেমশাস্ত্র রচনা করার। কাজেই রমণীর অন্তর-বিদ্রোহ কিংবা হাহাকার কোনোদিনই ধরা পড়েনি কাব্যে, নাটকে অথবা মহাকাব্যে তবু ধন্য, এরই মধ্যে এমন কবি আছেন, যিনি বিবাহিতা রমণীর অন্তর-বেদনা, তার জ্বালা কিংবা অভিমানটুকু ধরে রাখবার চেষ্টা করেছেন দু-একটি শ্লোকে এবং তাও বিবাহিতা রমণীরই জবানীতেই। তাদের মধ্যে একজন বলছে—সামান্য একটা কাজের জন্যেও যদি কারও বাড়ি যাই, শাশুড়ি-মাতা তা পছন্দ করেন না। কোনো কারণে একটি আত্মীয় যুবাপুরুষ যদি বাড়িতে আসে তবে সন্দেহ জাগে মেয়েদের মনে—শঙ্কাম আচরয়ন্তি যূনি ভবনং প্রাপ্তে মিথো যাতরঃ। রাস্তায় যাও একটু, আরম্ভ হয়ে যাবে ননদদের গঞ্জনা। নরমপানা মেয়েদের পক্ষে স্বামীর ঘর যেন ঠিক জেলখানা—কষ্টং হন্ত মৃগীদৃশাং পতিগৃহং প্রায়েন কারাগৃহম।
মনে রাখবেন এই ধরনের শ্লোক কোনো ব্যঞ্জনামুখর কবি—কালিদাস কি ভবভূতির হাত দিয়ে বেরোবে না। এই শ্লোক আসে তারই হাতে, সে সংসারে যে ভুক্তভোগী। বক্তব্য একেবারেই দ্ব্যর্থহীন, সাদা-মাটা, বড় বেশি স্পষ্ট। এই ধরনের কবির নায়িকারা একটুও লজ্জা পায় না বলতে যে, স্বামী বেটা যেন ঠিক যমের মতো, আর তার মা’টা হল বাঁকা-বুদ্ধির হাড়ি—কান্তঃ কৃতান্তচরিতঃ কুটিলা তদম্বা। এও কোনো বৈষ্ণব কবির নায়িকা রাধা নয় যে, জটিলা-কুটিলার ওপর তার অভিমান ফেটে বেরোচ্ছে। একেবারে গেরস্থঘরের বউ-এর মুখ দিয়েই পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে যে, কত কষ্ট করে তাকে স্বামীর ঘর সহ্য করে নিতে হচ্ছে—স্বভর্ত্তৃগেহং বনিতাঃ সহস্তে। তার ধারণা, কাজের লোক যেমন স্বকার্য সাধনের জন্য দীর্ঘ পথশ্রম সহ্য করে, যেমন করে ক্রীতদাস তার গুরু কর্মভার বহন করে চলে, রোগী যেমন একটু তিক্ত ওষুধগুলি কষ্ট করেই গেলে—কষ্টং কটুদ্রব্যমিবায়য়ার্ত্তাঃ, ঠিক সেইরকম করেই মেয়েরা স্বামীর ঘর সহ্য করে।
সংস্কৃত সাহিত্যে বিবাহিতা রমণীর প্রতি সমব্যথা নিয়ে রচিত এই কবিতাগুলির কথা যেন ভাবাই যায় না। ভাবা যায় না এসবও কোনো পুরুষ কবির রচনা—এত স্পষ্ট কথা। সহৃদয় সমব্যথীরা সংকলন গ্রন্থগুলির মধ্যে এই সব কবিতা-মুক্তক সঞ্চয়ন করেছেন। আজকের দিনে যখন সেকালের আর্থ-সামাজিক ভাবনায় কেবলই নারী-নির্যাতনের ছবি ফুটে উঠছে, তখন এই শ্লোকগুলির কথা মনে রাখা দরকার। নিঃসন্দেহে এই শ্লোকগুলি সমাজের কোনো সামগ্রিক চিত্র নয়, তবু শুধু নারী-নির্যাতন, শুধুই বঞ্চনা—এও কোনো সামগ্রিক চিত্র হতে পারে না। পাল্লাটা যদিও অবিচার আর বঞ্চনার দিকেই ভারী এবং তা কোন দেশে নয়? তবু আমাদের কবি সাহিত্যিকেরা তো সে সব চেপে রাখেননি। ব্যাস-বাল্মীকিরা তাঁদের নারী-চরিত্র সেই ভাবেই এঁকেছেন যাতে আমরা সেকালের দুর্ভাগিনীদের প্রতি সমব্যথী হতে পারছি। নিশ্চয়ই সে সব নারী-চরিত্রে কবি-হৃদয়ের বেদনা মাখানো আছে, যাতে আজকে স্পষ্ট করে বলতে পারি—সমাজের অবিচার হয়েছে এইখানে অথবা সেইখানে। নারীদের মুখেও যে কোথাও প্রতিবাদের ভাষা ঠিকরে বেরোয়নি—সে কথাও তো সত্যি নয়। ব্যাস-বাল্মীকি অথবা কালিদাস-ভারবি—এঁরা কেউই নির্বাক নারী-চরিত্র আঁকেননি, যেখানে সামাজিক অবিচার হয়েছে সেখানে ব্যক্তি-নারীর মুখেই কোথাও কোথাও তাঁরা জুগিয়েছেন প্রতিবাদের ভাষা। আর যেখানে জোগাননি সেখানে উলটো দিক দিয়ে সেই নারী-চরিত্রকেই বঞ্চনায় মহীয়ান করে দেখিয়েছেন, আর সেইখানটাই লুকিয়ে আছে আজকের সমালোচনার ব্যঙ্গ। কাজেই কবিরা আমাদের সঙ্গেই ছিলেন আর তাঁদের সমব্যথার সূত্র ধরেই পরবর্তীকালের ছোট ছোট কবিরা কিছু সাহসী শ্লোক রচনা করেছেন, যার দু-একটি আগে আমি উল্লেখ করেছি এবং পরেও করব। তবে দুঃখ এই যে, সে-সব কবিতা শুনে, তারপরেও হিন্দু-বিবাহের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা অবাঞ্ছিত মনে হয়। তবু তত্ত্ব একটা আছেই এবং সে তত্ত্ব বারবার সমৃদ্ধ করতে চেয়েছেন কবি-সহৃদয়েরা, আর ঠিক ততখানি দুরূহ এবং বিধিনিষেধের ঘোরে আবিল করে দিয়েছেন ধর্মশাস্ত্রকারেরা।
নারী-পুরুষ একের পানে অপরকে টানবে—এই তো স্বাভাবিক। সেখানে, ‘কারণ-ভোলা দুঃখে-সুখে একজনের প্রাণ চেয়ে থাকবে চেনা পদধ্বনির প্রতীক্ষায়, আরেকজন সারা দিনের কাজকর্ম সেরে এসে বসবেন ”পাড়ায় কোথা সতরঞ্জ খেলায়।” এই অপেক্ষা আর উপেক্ষার মাঝখানে পড়ে বৈবাহিক প্রেমের লাজুকলতা যায় শুকিয়ে। আমরা তাই প্রথমেই সেই বিদগ্ধা নায়িকার শর্তখানি আরোপ করব প্রেমিক স্বামীর ওপর। বলব—আমার কথাটি আমার দিক থেকে, আমারই অনুকূলে বোঝবার চেষ্টা কর উলটো আচরণ কোরো না—কার্যা ন প্রতিকূলতা। আর যখন তখন আমায় ঘরে ফেলে বাইরে বাইরে হডডি হডডি করে ঘুরে বেড়াবে—সেটি হবে না—ন চ বহির্গন্তব্যমস্মৎ গৃহাৎ। তারপর যদি কখনও আমার ওপর রাগ কর ঠাকুর, তবে সে রাগ যেন থাকে ক্ষণিকের তরে। এমন যদি হয় যে তোমার রাগ পড়ছেই না, তবে তোমার চরণদুটি ছোঁয়ামাত্রই যেন সে রাগের অন্ত হয়ে যায়—কোপশ্চ ক্ষণমাত্রমাহিতরুষা কার্যঃ প্রণামাবধিঃ। এইটুকু ঠিক এইটুকুনি প্রমদাব্রত যদি তুমি মেনে চল—মেনে চলা মানে, তাও খুব কঠোর করে নয় ছাড় ছোড় পাবে—তাহলেই আমি তোমার ভালবাসার পাত্র হব। শুধুই রাগারাগি করে কী লাভ—তত্রাহং দয়িতীভবামি শঠ যে কোপানুবন্ধেন কিম?
বাস্তবিক পক্ষে স্বামী-স্ত্রী মধ্যে যথাক্রমে প্রমদাব্রত এবং পতিব্রত, এই দুটিরই সুসামঞ্জস্য থাকলে তবেই না বিবাহবোধের দ্বারমুক্ত হয়। আমাদের প্রতিজ্ঞাও তো ছিল তাই। বেশ জানি বৃহদারণ্যক উপনিষদের আত্মারাম বিধাতাপুরুষ একটুও শান্তি পাচ্ছিলেন না, কেন না একা একা কি আনন্দ হয়? স বৈ নৈব রেমে, যস্মাৎ একাকী ন রমতে। আনন্দ উপযোগের জন্য দ্বিতীয় সত্তা চাই। অতএব তিনি এক ছিলেন, দুই হলেন। জায়া হলেন, পতি হলেন। স্ত্রী-পুরুষের এই যে কৃত্রিম বিভাজন—এর মধ্যে এক হওয়ার টানটা তাই রয়েই গেল—মনে-প্রাণে এক হওয়ার টান। স্মৃতিশাস্ত্রকারেরা পর্যন্ত এই তথ্য ভোলেননি। এই যে কট্টর মনু, তিনি পর্যন্ত পুরুষকে বলেছেন ‘জায়াত্মা’। যতটুকু স্বামী ততটুকুই স্ত্রী—এ নিয়েই সংসার, যো ভর্ত্তা সা স্মৃতাঙ্গনা। ধর্মশাস্ত্রকার বৃহস্পতি আরও সুন্দর করে পরিবেশন করেছেন এই চিরন্তন সত্য। তিনি বলেছেন বেদ, স্মৃতি অথবা লোকাচার—এ সবই সমস্বরে ঘোষণা করেছে যে, পাপে-পুণ্যে শরীরের অর্ধেকটাই হলেন স্ত্রী। যে সৌভাগ্যবান পুরুষের স্ত্রী বেঁচে আছেন, তিনি নিজে স্বর্গত হলেও, তাঁর শরীরের অর্ধেকটাই বেঁচে আছে—যস্য নোপরতা ভার্যা দেহার্ধং তস্য জীবতি। শরীরের দুই অর্ধাংশের মধ্যে এই যে পারস্পরিক প্রতিপূরণ নিয়তই চলছে, এর মধ্যেই নিহিত আছে আন্তর-মিলনের তত্ত্ব, বিবাহ-বিশ্বাসের তত্ত্ব। প্রান্তর কালের সেই অনুভবলেশহীন পাথুরে শরীরের স্থূল দিকটা থেকেই আমরা আস্তে আস্তে মনোলোকের সূক্ষ্মে উপস্থিত হয়েছি। ঋষি মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন—ইহৈব স্তং মা বি যৌষ্টং—তোমরা একই সঙ্গে থাক কখনও বিযুক্ত হয়ো না। আসলে সেই পাথরে পাথরে ঘষা খেয়ে শরীরটা যে জ্বলে উঠেছিল, বেদের ঋষি তাকে চিনতে ভুল করেননি। তিনি জানেন শরীরের এই আগুনই এক সময় দুই পুরুষ-নারীকে একমনা করে তোলে—দম্পতী সমনসা কৃণোষি। বিবাহ-তত্ত্ব মানেই স্থূল থেকে সূক্ষ্মে, শরীর থেকে মনে উত্তরণের কাহিনি। কিন্তু মজা হল, ঋষি কবি কিংবা সহৃদয়েরা যদি দুই পা স্থূল থেকে সূক্ষ্মে এগিয়েছেন, ধর্মশাস্ত্রকারেরা সেই সূক্ষ্ম থেকে এক পা এক পা করে পেছিয়েই গেছেন।
পুরাকালে, মানে একবারেই প্রাচীন কালে স্ত্রী-পুরুষের মিলনে কোনো বাধা ছিল না। যে-কোনো স্ত্রী যদি পুরুষের কাছে সম্ভোগের বাসনা জানাতেন, তাহলে তাকে প্রত্যাখ্যান করার রীতি ছিল না; পুরাশাস্ত্র বলেছে—ন কাংচন পরিহরেৎ। মেয়েরা যদি বলত,—ভজমানাং যজস্ব মাম—আমি তোমাকে ভজনা করছি, তুমিও আমাকে ভজনা করো, তাহলে সেই স্বর্ণযুগে পুরুষেরা তাঁদের বিমুখ করতেন না। এই প্রথায় কত বীরপুরুষ, কত মুনি-ঋষি কোমলা নারীর বাহুবন্ধনে ধরা দিয়েছেন, তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে রামায়ণ, মহাভারত আর পুরাণের শতেক কাহিনিতে। মহাভারতকার নিজে এই বন্ধনহীন সামাজিক শিথিলতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন—মেয়েরা তখন ছিল অনেকটা রাস্তায় ছাড়া গোরুর মতো—যথা গাবঃ স্থিতাঃ তাত, স্বতন্ত্র স্বেচ্ছাবিহারিণী, অধিকারহীনা—অনাবৃতা হি সর্বেষাং বর্ণানাম অঙ্গনা ভুবি। এই অবস্থায় যা হয়, উদ্দালক ঋষির স্ত্রী দাঁড়িয়েছিলেন আপন গৃহে। আর তাঁর পুত্র, উপনিষদের বিখ্যাত ঋষি শ্বেতকেতু ব্যস্ত ছিলেন অধ্যয়ন কিংবা অধ্যাপনায়। এমন সময় এক ব্রাহ্মণ এসে শ্বেতকেতুর মায়ের হাত ধরে বলল—চল গো সুন্দরী, ঘুরে আসি কোথাও—মাঠে, ঘাটে কিংবা বিজন বনে—জগ্রাহ ব্রাহ্মণঃ পানৌ গচ্ছাব ইতি চাব্রবীৎ। সেই যাবার পথে কোনোরকম বন্ধনহীন গ্রন্থি বেঁধে দেবার আগেই শ্বেতকেতু ফেটে পড়লেন ক্রোধে। তিনি নিয়ম করে দিলেন—আজ থেকে স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা চলবে না স্ত্রীলোকের, অর্থাৎ কিনা যেখানে বিবাহ হয়েছে সেখানে বিবাহধর্মের সীমা অতিক্রম করা চলবে না—ইতি তেন পুরা ভীরু মর্যাদা স্থাপিতা বলাৎ। উদ্দালকস্য পুত্রেণ ধর্ম্যা বৈ শ্বেতকেতুনা।
দুঃখ এই, শ্বেতকেতু মেয়েদের একটা সীমা ঠিক করে দিলেন বটে, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এমন কোনো বড় মানুষ ছিলেন না, যিনি পুরুষ মানুষের সীমা ঠিক করবেন। ধর্মশাস্ত্রকার বলেছিলেন—ন মাংসভক্ষণে দোষঃ—মাংস খাওয়ায় দোষ নেই, ন চ মদ্যে ন মৈথুনে—মদেও না মৈথুনেও না। কেন না এগুলি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি; কিন্তু নিবৃত্তিস্তু মহাফলা। সেই নিবৃত্তির জন্য বিধিনিষেধাত্মক শাস্ত্র নিয়ম বেঁধে দিল—যথেচ্ছ স্ত্রীসম্ভোগ কোরো না, বিবাহ করো—সীমার মধ্যে থাক।
পুরুষের প্রতিজ্ঞা থাকল না কিন্তু মেয়েরা সব ”সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী” হয়ে রইলেন। এ গুণ তাদেরই সীমার মধ্যে থেকেও, তাঁরা ভালোবাসার এমন নমুনা দেখালেন, যাতে কবি বলতে বাধ্য হলেন—It is woman’s whole existence. কিন্তু পুরুষ শুধু শুধুই যত বিশেষণ দাবি করল মেয়েদের কাছে। তাঁরা সতী হবেন, সাধ্বী হবেন, আরও কত কিছু। মুশকিল হল, স্ত্রীলোকের কাছে যে বিশেষণগুলি চাইলাম, সে ভালোই হোক কিংবা মন্দ, সেগুলির পুংলিঙ্গ হয় না, অথবা হলেও মানে দাঁড়ায় অন্য। যেমন স্ত্রীলোকের সাধ্বীত্ব কিংবা সতীত্বের প্রশ্নে একক কোনও পুরুষ মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখার অনুষঙ্গ থাকেই; কিন্তু সাধু কিংবা সৎ পুরুষ বলতে একপত্নীব্রত বুঝায় না। পতিতা স্ত্রী বলতে যা বোঝায়, পতিত পুরুষ বলতে তা বোঝায় না। বেশ্যা অথবা গণিকার কোনো পুংলিঙ্গ শব্দই নেই। অথচ গণিকা যদি ঘরে বসে দেহদান করে, তো পুরুষমানুষ সেখানে পঁচিশ মাইল দূর থেকে দৌড়ে এসে দেহ-দান করে। দেহ-দানের ব্যাপারে এখানে কে বেশি মহৎ সে প্রশ্ন আপাতত অবান্তর। কিন্তু এই শব্দগুলির কথা এখানে তুললাম এই কারণে যে প্রাচীন শাস্ত্রে, কাব্যে, ইতিহাসে এই শব্দগুলির নিয়ে বড় বেশি নাড়াচাড়া হয়েছে এবং তাও শুধু স্ত্রীলোকের প্রসঙ্গেই, পুরুষের প্রসঙ্গে নয়।
আসলে আমাদের ইতিহাস-পুরাণ কি ধর্মশাস্ত্রে স্ত্রী-পুরুষের মিলন-প্রসঙ্গে আদর্শের কথা যতখানি উচ্চারিত, কাজের বেলায় অনেকখানি বিচ্যুত। স্ত্রীকে প্রতিপালনের ব্যাপারে স্বামীর কিংকর্তব্যগুলি বলা আছে নিশ্চয়ই, কি সে শুধুই কর্তব্য এবং প্রতিপালন, ভালোবাসা নয়। এই যে বারবার বলা হয়েছে অবিবাহিত লোকেদের ধর্মে, যজ্ঞে অধিকার নেই—অযজ্ঞো বা এক যো পতীকঃ, তাতে আমার পাপী মন সিদ্ধান্ত করেছে যে, কোনো ছলে তড়িঘড়ি একটা বিয়ে করে ফেলাই ছিল পুরুষ মানুষের উদ্দেশ্য। কেন না যজ্ঞকার্যে স্ত্রীকে আপন পাশটিতে পাটঠাকুরের মতো বসিয়ে রাখা ছাড়া আর কোন কাজে লাগে? তা ছাড়া ‘ধর্মকামার্থসাধনে স্ত্রীকে যতটুকু কাজে লাগে, আমাদের মনু মহারাজ তা গুণে গেঁথে বলে দিয়েছেন। প্রথম প্রয়োজন পুত্র, যা দিয়ে পিতৃঋণ শোধ করা যায় (সম্পত্তিটাও বংশে বংশে নিজের ঘরেই থাকে)। দ্বিতীয়—ধর্মকার্য, মানে সেই যজ্ঞাদি (সঙ্গে আছে অতিথি নারায়ণদের সেবা এবং ধর্মকার্য রূপায়ণের দায়িত্ব)। তৃতীয় হচ্ছে শুশ্রূষা স্বামী পরিজন সবার (বিশেষ করে রোগে পড়লে)। চতুর্থ—’রতিরুত্তমা’—ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। অপত্যং ধর্মকার্যানি শুশ্রূষা রতিরুত্তমা—মনুর মতে এইগুলিই স্ত্রীলোকের উপযোগিতা; আমাদের পিতা-মাতামহী পর্যন্ত এই শ্লোকের অভিপ্রায় পূরণকেই সার্থকতা মানতেন। মনুর বহু আগে বেদ কিন্তু হৃদয়ের কথাটি বুঝেছিল। বেদের পুরুষ বলেছিল—তুমি আমার সকল কাজে তোমার হৃদয়খানি দিও—মম ব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু। তোমার মন যেন আমার মনের মতো হয়—মম চিত্তম অনু চিত্তং তে’স্তু। তুমি যেন একাগ্রচিত্তে আমার সব কথা শুনো—মম বাচম একমনা শৃণোতু।
এই বিপদ হল। হৃদয় মন—সব রইল পিছনে পড়ে। ধর্মশাস্ত্রকারদের সমস্ত ঝোঁক গিয়ে পড়ল স্বামীর কথা শোনার ওপর। কথা না শোনা মানেই স্বামীর বিরুদ্ধাচরণ, আর তার ফল হতে পারত স্ত্রীত্যাগ অথবা দ্বিতীয় বিবাহ। আমার একটা কথা কেবলই মনে হয়, জানি না সে কথা পণ্ডিতজনের কেমন লাগবে। কেবলই মনে হয়, আমাদের দাম্পত্য জীবনের ইতিহাস দুই ধারায় প্রবাহিত। সবাই জানেন বেদ মানে মন্ত্র আর ব্রাহ্মণ। মন্ত্রভাগ যেহেতু কবিতা তাই পরবর্তীকালের কবিরাও চলেছেন মন্ত্রকবির হৃদয়াবেগের অনুশাসনে। আর বেদের ব্রাহ্মণভাগেই যেহেতু বিধিনিষেধের আরম্ভ তাই ধর্মসূত্র, ধর্মশাস্ত্র এবং স্মৃতিগুলি চলেছে হৃদয়হীন শুষ্ক শাসনের পদ্ধতিতে। নইলে দেখুন, এই যে এত বড় রসশাস্ত্র, অলংকারশাস্ত্র—তার সমস্ত উদাহরণগুলি যেন স্ত্রীলোকের চাটুকারিতায় বাঁধনছাড়া। কবিতা আছে হাজারো যেখানে শুধু নারীর কটাক্ষ ভিক্ষায় কেটে যায় পুরুষের জীবন। এক দূতী তো নায়িকার পক্ষ হয়ে অতি কাঠখোট্টা এক প্রণয়ীকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন—দেখ বাপু, যারা প্রভুত্ব গোপন করতে জানে—ণুমেন্তি যে পহুতং, মনের মানুষ কুপিতা হলে যে নাকি দাসের মতো প্রসন্ন করতে পারে, তাঁরাই হলেন মহিলাদের প্রিয়, অন্যেরা কেবল বর্বর স্বামীমাত্র—তেব্বিয়ং মহিলাণং পিয়া সেসা সামিব্বিঅং অরাআ।
তা পুরুষ এ নির্দেশ মেনে নিয়েছে। তবে হ্যাঁ, যারা প্রভুত্ব গোপন করেছে, তাদের স্থান হয়েছে কবিতায় আর যারা প্রভুত্ব করতে চেয়েছে, তার সাধুবাদ পেয়েছে ধর্মশাস্ত্রকারদের কাছে। কালিদাসের কবিতায় শিব পর্যন্ত পার্বতীর দাসভাবে আনন্দ পেয়েছেন—অদ্য প্রভূত্যেবাবনতাঙ্গি তবাস্মি দাসঃ। আরেক জনকে প্রিয়া বোধহয় পদাঘাতই করেছিল, তাতে পুরুষটির বিচলন হয়নি। কোথাও বরঞ্চ মর্মান্তহরষে তার যে রোমাঞ্চ অঙ্কুরিত হয়েছিল তাতে সে ভয় পেয়ে বলেছিল—সেই রোমের খোঁচায় তোমার পায়ে লাগেনি তো? শুধু কবিতায় কেন ভারতবর্ষের বেশিরভাগ পুরুষ প্রায় এইরকমই ছিলেন। মাধবী নামে এক রমণী কবি তো রীতিমতো গর্ব করে বলেছেন যে, তিনি কেমন করে স্বামীকে বশে রেখেছেন। তিনি লিখেছেন—এক হাতে তাকে চড় কষালাম হাতটা জ্বলে উঠল যেন, সেই হাতে ফুঁ দিতে দিতে আরেক হাত দিয়ে হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরলাম তার গলা, সে যেন গলে গেল—একং পহরু বিন্নং হৎথং মুহমারু ত্র ণ বীয়ন্তে। সো বি হসন্তীত্র মত্র গহিত্ত বীএণ কণ্ঠস্মি।।
একে মহিলা কবির লেখা, তায় প্রাকৃত ভাষা। স্ত্রীলোকের মনের কথা একেবারে অক্ষত উঠে এসেছে এই কবিতায়। আধুনিক জীবনেও যে এই কবিতা একেবারে অসত্য তাও মানতে পারি না। অথচ এইরকম রমণীর চড়-খাওয়া সমাজেও ধর্মশাস্ত্রকারদের বিধিনিষেধ এবং স্বামীদের প্রভুত্বও চলেছে পাশাপাশি। মুশকিল হল কয়েক হাজার বছর ধরে পুরুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতে হতে আমাদের আধুনিক মনে নতুন এক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। নারী মানেই যেন নিপীড়ন। কিন্তু শত অত্যাচারের মধ্যেও তো রমণীরা তাদের মতো একটা জগৎ তৈরি করেছিল, সে কি কেবলই নিজগুণে? স্বামীরা যদি কখনোই তাদের কথা না শুনতেন, তাহলে শুধুমাত্র কৃপাকণা সম্বল করে তাঁরা এক একটি বিরাট সংসারের একেশ্বরী হয়ে উঠতেন কী করে! হতে পারে সে জগতের মধ্যে শিক্ষার আলোক ছিল না, ছিল না প্রগতির চিহ্নটুকু, হতে পারে সে জগতে পাওয়ার চেয়ে দেওয়ার ভাগই ছিল বেশি, কিন্তু সেদিনেও আপন পত্রচ্ছায়া বিস্তার করে রমণীরা নিজেদের এমন অপরিহার্য করে তুলতেন কী করে! সে কি শুধু এমনি এমনিই, শুধু না পাওয়ার আনন্দে, শুধুই অত্যাচারে, ত্যাগে! জানি, ত্যাগেরও একটা মোহ আছে, বঞ্চিত হতে হতে মহীয়সী হওয়ারও একটা মোহ আছে। কিন্তু সেই মোহ জন্মানোর পিছনে স্বামীদের কি সামান্য অবদানটুকুও ছিল না? আজকের দিনে যাঁরা আর্থ-সামাজিক ভাবনায় সেকালের সমাজের চিন্তা করেন তাঁরা এই অসংখ্য কবি আর আলংকারিকের কবিতায় স্বামীদের ‘দেহি পদপল্লবমুদারম’ ভাবটি নিঃশেষে ছেঁটে দেবেন কি করে? আসলে আমি যে কথা বলেছি—কবির জগতে যা ঘটেছে তা অসত্য নয়। ভারতবর্ষের অনেক স্বামীরাই ছিলেন স্ত্রীর অঞ্চলছায়ায় লুকানো মহার্ঘ এক রসিকতার সামগ্রী; সম্পূর্ণ সংস্কৃত সাহিত্যে তাদের যে গদগদভাব ফুটে উঠেছে, তার উত্তরাধিকার স্বামীরা জাতীয় সূত্রে এখনও ভোগ করছেন। স্বামীদের দিক থেকে এই নমনীয়তা, স্ত্রীর জন্য ব্যাকুলতা ছিল বলেই ধর্মশাস্ত্রে কেবল গেল গেল রব উঠেছে। ধর্মশাস্ত্রকারেরা তাই সর্বতোভাবে চেয়েছেন সমস্ত ক্ষমতা স্বামীদের হাতে ঠেসে দিতে, তারও কুফল ফলেছে সমাজের একাংশে। ভারতবর্ষে বিদেশিরা আসার পর ধর্মশাস্ত্রের হাত আরও শক্ত হল কিন্তু তবু বলব ভারতবর্ষের মূল দাম্পত্য ইতিহাসে এক ধরনের ‘ডিকটমি’ আছে—একদিকে তা যেমন স্বামীদেবতাদের স্ত্রীর পদপ্রান্ত চুম্বনের ইতিহাস, অন্যদিকে ধর্মশাস্ত্রের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় তা তেমনি চরম নিপীড়নের ইতিহাস।
সেই যেদিন বরবধূর যুগল হাতে বিবাহ কৌতুকের বাঁধন পড়েছিল, সেদিন অপরিচিত যুবকটি বধূকে কাঁপা গলায় বলেছিল—যে বাঁধন দিয়ে সূর্যদেব তোমাকে বেঁধে রেখেছিল পিতার ঘরে, সেই বন্ধনপাশ আজ আমি মুক্ত করলাম—প্রত্বা মুঞ্চামি বরুণস্য পাশাৎ—তোমাকে এখান থেকে মুক্ত করলাম বটে কিন্তু অন্য জায়গায় আরও বেঁধে দিলাম—প্র ইতো মুঞ্চামি নামুতঃ, সুবদ্ধামমুতস্করম। অন্য জায়গার এই বাঁধন নিশ্চয়ই স্বামীর ঘরের বাঁধন। বেদের এই মন্ত্রটিকে ধর্মশাস্ত্রকারেরা কিন্তু এমনভাবেই ব্যবহার করেছেন যাতে মনে হবে—এক জমি থেকে নিয়ে বলদকে যেমন অন্য জমিতে লাঙল দিতে নিয়ে যাওয়া হয়, তেমনি পিতৃগৃহের দড়িদড়া মুক্ত করে স্বামী যেন তাঁর বধূটিকে নিয়ে চললেন নিজের ঘরের জোয়ালটি তার কাঁধে চাপিয়ে দিতে। পুরুষ প্রতিজ্ঞা করেছে—গৃভণামি তে হস্তং সৌভগত্বায়, ময়া পত্যা জরদষ্টির্যথসঃ—ওগো বধূ তোমার হাত ধরছি সৌভাগ্যের জন্য, এই আমি যেদিন বুড়ো হয়ে যাব সেইদিন পর্যন্ত তুমি আমার সঙ্গে কাটাবে। শত শরৎকাল একসঙ্গে বেঁচে থাকার প্রার্থনায় সেদিন আকাশ, বাতাস মধু হয়ে গিয়েছিল। পুরুষ বুঝেছিল যে, তার সমস্ত জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার পাঠিয়েছেন দেবতা, তাঁকে সংসারের অধিষ্ঠাত্রী করে রাখতে হবে মহ্যং ত্বাদুঃ গার্হপত্যায় দেবাঃ। কিন্তু ধর্মশাস্ত্রকারেরা বধূজীবনের যা ফিরিস্তি দিয়েছেন তাতে এই ঋকমন্ত্রের আশ্রয় গেছে নষ্ট হয়ে। সদ্যোবধূর কর্মনির্দেশ খেয়াল করলে মনে হবে যেন তারা স্বামীর ঘরের গেরস্থালি সামলাতে সামলাতেই বুড়ো হয়ে যাবে এবং সেইটাই তাদের সৌভাগ্য। আর গৃহপতি মানে তো আমরা জানি—গৃহস্বামী, তাহলে ‘গার্হপত্য’ মানে তো নিশ্চয়ই গৃহস্বামিত্ব, পতিগৃহের সর্বাধিনায়কত্ব। ধর্মশাস্ত্রকারেরা কিন্তু ‘গার্হপত্য’ মানে শুধু ঘরগৃহস্থির কাজকর্মই বুঝেছেন, কোনো অধিকার নয়, স্বামিত্ব নয়; কেন না সেই কোন কাল থেকেই তো গার্হপত্য আশ্রম বলতে গৃহস্থাশ্রমই বোঝায়।
আমাদের পূর্বজা পিতা-মাতামহীরা কিন্তু নিজের বুদ্ধিতে ঋকমন্ত্রের অধিকার আর ধর্মশাস্ত্রের বিধানের মধ্যে অদ্ভুত সামঞ্জস্য ঘটিয়েছিলেন। মুখে তাঁরা—’তোমার সংসারে এসে হাত কালি হয়ে গেল’ বলে গালাগালি দিতেন, আর পড়শির কাছে তাঁর সোনার সংসারের গর্ব করতেন। বিরাট সংসারের মধ্যে একের বহু মানে অন্যের অপমানে, একের আদরে অন্যের অনাদরে এবং এককালের আপন অভ্যস্ত অত্যাচার পুনরায় পুত্রবধূর উপর নিক্ষেপ করে, পিতৃগৃহের আদরিণী কন্যাটি একদিন সত্যিসত্যিই সম্রাজ্ঞী হয়ে উঠতেন। কিন্তু তখন বড় দেরি হয়ে গেছে। স্বামী যে চেয়েছিলেন—সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভব, সম্রাজ্ঞী শ্বশ্রাং ভব—শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে তুমি সম্রাজ্ঞী হও, দেওর-ননদ এমনকী আমার কাছেও তুমি সম্রাজ্ঞী হও—সম্রাজ্ঞী অধিদেবৃষু—সেকি এই প্রৌঢ়া সম্রাজ্ঞীকে চেয়েছিলেন। আমি জানি, এই সম্রাজ্ঞীযোগের ইতিহাস কিংবা উপহাসের কথা আর কেউ না জানুক মহর্ষি কণ্ব জানতেন। শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা হচ্ছে। গুরুজনদের শুশ্রূষা থেকে আরম্ভ করে দাস-দাসী পরিজনদের সঙ্গে পর্যন্ত কীরকম সুন্দর ব্যবহার করতে হবে এবং কেমন করে শেষপর্যন্ত ‘গৃহিণীপদ’ লাভ করা যায় তার এক হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিলেন কণ্ব। আর ঠিক এইখানেই কালিদাসের কবিতা ধর্মশাস্ত্রের কাছে নতি স্বীকার করেছে। শকুন্তলা সব শুনলেন, শেষে বললেন, ‘আবার কবে তোমার তপোবনে ফিরে আসব বাবা’। মুনি বললেন—সেই যখন তুমি বিরাট এক রাজ্যের অধিশ্বরী হবে—স্বয়ং পৃথিবীরানীর সতীন যেন, ছেলেকে বসিয়ে দেবে পিতার প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যে আর তার হাতেই সঁপে দেবে স্বজন-কুটুম্ব ভরণের ভার, তখন আবার ফিরে আসবে এই শান্তচ্ছায়া তপোবনে—শান্তে করিষ্যসি পদং পুনরাশ্রমেহস্মিন।
মুনি যেটা স্পষ্ট করে বলেননি, তা বোধহয় বলা যায়। কণ্বের তিনটি উপদেশ-শ্লোকের দুটির মধ্যেই বিবাহিতা রমণীর পক্ষে গৃহিণীদের গুরুত্বের কথা বলেছেন। পিতামাতার ঘরে কন্যা যত কাজকর্মই করুক না কেন, সে তাঁদের তপোবন রাজ্যের সম্রাজ্ঞী। কন্যা-পিতৃত্ব যত কষ্টেরই হোক না কেন, আদরিণী কন্যাকে শ্বশুরালয়ের দাসী হিসেবে দেখতে কোনো পিতামাতারই ভালো লাগে না। অথচ কণ্ব জানেন, শ্বশুরগৃহে তাঁর কন্যারূপী শিকার মাত্র একটিই। শিকারি বহু—সেখানে দশজনে একজনের সঙ্গে মানিয়ে নেবার সময় সংক্ষেপ স্বীকার করে না। একজনের দশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার গুরুত্ব পছন্দ করে। কণ্ব জানেন—অজানা অচেনা সেই বাড়িতে কেউ নববধূর মস্তক আঘ্রাণ করেই বলবে না—এ গৃহের সম্রাজ্ঞী তুমি। কণ্ব জানেন—গৃহিণী পদের পেছনে ছুটতে ছুটতে একদিন শকুন্তলা তার পিতাকেই যাবে ভুলে। অতএব যেদিন সেইদিন আসবে, সম্পূর্ণ গৃহটির অধিকর্ত্রী হবে তাঁর মেয়ে—অভিজনবতো ভর্ত্তুঃ শ্লাঘো স্থিতা গৃহিণীপদে, তার নিজের ছেলে বসবে রাজসিংহাসনে, সেইদিন যেন শকুন্তলা তার বধূ জীবনের সমস্ত প্রশান্তি নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে আসে। ঘরে-বাইরে সম্রাজ্ঞীর মতো মেয়েকে দেখে পিতার মনও শান্ত হবে।
প্রৌঢ়া বয়সের এই সম্রাজ্ঞীযোগ, যা সমস্ত যৌবনের মূল্যে সংগ্রহ করতে হয়, এই যে সবারে প্রাণ-জুড়ানো গৃহিণীপদ, যা আপন জীবনের মূল্যে আয়ত্ত করতে হয়—এটাই কি পুরুষের চরম পাওয়া, না এটাই প্রতিজ্ঞা ছিল। সমাজসংস্কারক বলে যাঁরা পরিচিত, সেই ধর্মশাস্ত্রকারেরা যে গৃহিণী শব্দটির ভার অথবা ব্যবহার জানতেন না তা তো নয়, তবে তাঁদের শব্দোচ্চারণের মধ্যে যতখানি রসিকতা ছিল মমতা ততটা নয়। স্বয়ং রঘুনন্দন সেই শ্লোকটি উদ্ধার করে বলেছেন—ঘরখানা আসলে ঘরই নয় বাপু, যদি তাতে ঘরণী না থাকে, ঘরণীই হল ঘর—ন গৃহং গৃহমিত্যাহুগৃহিণী গৃহমুচ্যতে। কিন্তু মজা হল, তাঁদের ভাষায় ঘরণী হওয়ার এলেম হল—সে কত ভালো বউ, তা নয়, সে কতখানি ভালো দাসী—সেইটাই। আর শাস্ত্রীয় স্বামী যে কি চান তা ধরা আছে মহাসুভাষিত রত্নকোষের একটি শ্লোকে এবং তাও স্বামীর জবানিতেই। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, এই স্বামীর কালিদাসের সঙ্গে পরিচয় ছিল। কালিদাস বলেছিলেন—গৃহিণী, সে তো আমার অসময়ের মন্ত্রী নর্মকথার সখী, ললিত-নৃত্যে সোনার রসনায় তালমেশানো প্রিয়শিষ্যা—গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ। আমাদের স্বামী পুরুষটিও সময়কালে গৃহিণীকে মন্ত্রিত্বদানের ব্যাপারে একমত। কিন্তু তারপরেই তিনি বলেছেন—সময়কালে সে আমার মন্ত্রী বটে, কিন্তু কামের বেলায় দাসী—কার্যেষু মন্ত্রী, করণেষু দাসী। স্নেহে মমতায় সে হবে মায়ের মতো (পাঠক! মনুকথিত শুশ্রূষা শব্দটি স্মরণ করবেন)। ক্ষমায় একেবারে সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো, যত অপকম্মই করে আসুন স্বামী-দেবতাকে কিচ্ছুটি না বললেই তো ধৈর্যশীলা পৃথিবীর সঙ্গে তার তুলনা। ধর্মসাধনে সে যেমন পতির সহধর্মিণী, পত্নী, শয়নকালে সেই ব্যবহার করবে রতিপটু বেশ্যার মতো—ধর্মস্য পত্নী শয়নে চ বেশ্যা—তবেই না বউ; এই ছয় কিসিমের গুণ থাকলেই সে বউ নাকি কুল উদ্ধার করে—ষটকর্মভিঃ স্ত্রী কুলমুদ্ধরন্তী।
ধর্মে পত্নী আর শয্যায় বেশ্যা—এই দুয়ের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল ভেদ আছে এটা ধর্মশাস্ত্রকারদের জানা ছিল না। ধর্মকার্যের একান্ত সহায়ক যিনি তাঁর পক্ষে যে বেশ্যার মতো পুরুষের শয্যাসঙ্গের দাবি মিটানো কঠিন, একথা কে না জানে। তা ছাড়া এই স্বামী পুরুষকে আমি দোষ দিই কেমন করে; এইসব স্বামীরা তো সব মনুর আপন হাতে গড়া পুরুষসিংহ। ‘ধর্মকার্য’ এবং ‘রতিরুত্তমা’—এই কথাদুটি তো তিনিই এক নিশ্বাসে উচ্চারণ করে দারপরিগ্রহের সার্থকতা বুঝিয়েছিলেন। অথচ হাজার হাজার বছর আগের যে বৈদিক বিবাহমন্ত্র, যার মধ্যে বরবধূর মানসলোকের ছোঁয়া লাগানো আছে দিন যত গেছে, পরবর্তীকালের শাস্ত্রকারেরা তাঁদের বিধি নিষেধের জালে ফেলে মন্ত্রগুলির মুক্তশ্বাস রুদ্ধ করে দিয়েছেন।
ঋগবেদের বিবাহসূক্ত যেন কতগুলি মধুমন্ত্রের সমারোহ। আমরা যেমন সেকালের বিয়ে উপলক্ষে ছড়া লিখতাম, ঋগবেদের এই বিবাহমন্ত্রগুলি যেন প্রথম বিয়ের ছড়া। তবে মজা হল, এই বিবাহসূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি স্বয়ং সূর্যকন্যা সূর্যা। তিনি যেন তাঁর আপন জীবনকাহিনিটিই ঋকের ছড়ায় বেঁধে দিয়েছেন। সূর্যাকে বিয়ে করার জন্য প্রথম হৃদয়ের আবেগ নিবেদন করেছিল সোম, সূর্যেরও ইচ্ছে ছিল মেয়ে দেবেন তাঁকেই। কিন্তু ফুল ফুটলে যেমন ভ্রমরের অভাব হয় না, তেমনি সমস্ত দেবতারাই সূর্যার ব্যাপারে একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। সায়ন লিখেছেন—তাং সর্বে বরয়ামাসুঃ। কি করা যায়? তাঁরা নিজেরাই শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন—একটা সফল প্রতিযোগিতা হোক, যে জিতবে সূর্যা তাঁর। প্রতিযোগিতায় জিতে গেলেন অশ্বিনীকুমার। নিজেকে দেখে নিজেরই যেন চমক লেগেছিল সূর্যার—এত তার দাম, তাকে পাবার জন্য এত কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে দেবলোকে! এমন প্রতিযোগিতায় যে জিতল, সূর্যা তাঁকে বরমাল্য দেওয়ার ছলেই যেন আলিঙ্গন করলেন। সুভদ্রার মতো তিনি উঠে পড়লেন অশ্বিনীকুমারের রথে—মনই হল তার শকট, ‘চলিল কনকরথ মনোরথ গতি।’ অগ্নি দূত হয়ে গেলেন আগে আগে খবর দিতে। লাজে রাঙা বধূর মাথায় আকাশই বিছিয়ে দিল নীল লজ্জাবস্ত্রখানি—দৌরাসীদূত ছদিঃ। আর সেই বর বধূর মানসরথ বয়ে নিয়ে চলল সকাল-সন্ধের দুই শুকতারা—কিংশুক ফুল আর শাল্মলীর পাতা বিছানো পথে—সুকিংশুকং শাল্মলিং বিশ্বরূপং, হিরণ্যবর্ণং সুবৃতং সুচক্রম। আরোহ সূর্যে অমৃতস্য লোকম…।
অন্তত, তিন হাজার বছর আগে এর থেকে বেশি কবি-কল্পনা আর কী হতে পারে। সূর্যার পতিগৃহে যাত্রার শেষপর্বে সূর্যার আশীর্বাদ ভেসে এল যেন—নমস্কার তোমায় বিবাহের দেবতা। এবার তুমি পিতার ঘরে থাকা অন্য অবিবাহিতা মেয়েদের কাছে যাও—অন্যামিচ্ছ পিতৃসদং ব্যক্ত। তাকে অভিরূপ পতির সঙ্গে যুক্ত করো—সং জায়াং পত্যা সৃজ। যে পথ দিয়ে আমার বন্ধুরা সব মনের মানুষের সন্ধানে যাবে, সে পথ যেন সরল হয়, নিষ্কণ্টক হয়—অনৃক্ষয়া ঋজবঃ সন্তু পন্থাঃ, সং জাম্পত্যং সুখমস্তু দেবাঃ—তাদের পরস্পরের জীবন যেন সুখের হয়।
হায়, ঋগবেদের ঋষি তুমি কি জানতে—ধরণীর নাম মর্ত্যভূমি। স্ত্রীরত্নের জন্য দেবতাদের এমন কাড়াকাড়ি, এমনি বিয়ে তোমার নিকট কালে শুধু মহাভারত, পুরাণেই দু-একটা হয়েছে। আমরা সবাই বাঁধা পড়েছি সমাজসেবী মনু-বশিষ্ঠের কবলে। তিনি বলেছেন—ওসব ভালোবাসা-টালোবাসা ছাড়; স্ত্রীলোকের সৃষ্টিই হয়েছে—সন্তান সৃষ্টির জন্যে—প্রজনার্থং স্ত্রিয়ঃ সৃষ্টাঃ। আর পুরুষ! সন্তানার্থং চ মানবাঃ। তার মানে স্ত্রী-পুরুষ হলেন সন্তান উৎপাদনের পারস্পরিক প্রতিপূরক ‘মেশিন’। ছিলাম ভালো। মহাভারত পর্যন্ত বলে দিয়েছে—বিয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিয়ে হল গান্ধর্ব—নিজেরা দেখ, ভালোবাসো, বিয়ে করো। মনু হুংকার ছেড়ে বললেন—শাস্ত্রং, আর সঙ্গে সঙ্গে বিধিনিষেধের অনুস্বরগুলো ধনুঃশরের মতো বিঁধতে থাকল আমাদের। মনু বললেন, হ্যাঁ ঠিক কথা—ব্রাহ্মণেরা স্বক্ষেত্রে কিংবা পরক্ষেত্রে অনেক রকমের পুত্রটুত্র উৎপাদন করেছেন ঠিকই, কিন্তু ওসব কলিযুগে চলবে না। আমরা কলিযুগের লোকেরা এই কর্মে যে খুব উৎসাহী, তা মোটেই নয়। তবু জিজ্ঞাসা করি, কৃষ্ণ থেকে আরম্ভ করে অনেকেই তো এই কলিযুগের লোক। স্বীকার করলাম, তাঁরা শক্তিমান পুরুষ, অনেক কিছুই হজম করতে পারেন, আমাদের মতো কলিযুগীয়রা তা পারি না। কিন্তু অন্য আরও সব জিনিসগুলো? প্রথমেই ধরুন—বয়সের কথা। বেদ থেকে আরম্ভ করে কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা—কেউ এমন কচি-কাঁচা ছিলেন না যে, ভালোবাসা বুঝতেন না। উপরন্তু তাঁদের এক একজনের চেহারার যা উচ্চাবচ বর্ণনা, তার সঙ্গে মনুর মনগড়া বিয়ের বয়েস মেলালে বুঝতে হবে হয় মনু মিথ্যে বললেন, নয়তো ইতিহাস-পুরাণকারেরা মিথ্যে বলছেন। আর ভালোবাসা! ভালোবাসা, বিশেষ করে মেয়েদের ভালোবাসা জিনিসটা মনুর ধর্মশাস্ত্রে একেবারে বারণ। সে কেবল টাকা-পয়সার হিসেব রাখবে, ঘর-গৃহস্থি সামলাবে আর বিছানা তৈরি করবে। আর সেই তৈরি বিছানায় বসে পুরুষেরা যে কি করেন, তা নিয়ে বড় আক্ষেপ করেছেন এক মহিলা কবি। এ কবি যে সে নয়, স্বয়ং বিজ্জকা, যাঁর এক একটা শ্লোক আলংকারিকেরা মাথায় করে রেখেছেন। বিজ্জকা লিখেছেন—পুরুষ-মানুষের এ বড় অনুচিত শখ, কাণ্ডজ্ঞানহীনতাও বটে যে, বুড়ো বয়সেও তার মনের বিকার যায় না—অনুচিতমিদম অক্রমশ্চ পুংসাং যদিহ জরাস্বপি মান্মথা বিকারাঃ। শুধু প্রার্থনা করি এই যে, স্ত্রীলোকের স্তন-পতনের সঙ্গে সঙ্গেই যেন তাদের জীবন কিংবা রতিক্ষমতা শেষ না হয়ে যায়।
যত দুঃখেই রমণী এসব কথা বলুক না কেন মনু-মহারাজের ক্ষত্রিয় মন তাতে ভ্রূক্ষেপ করে না। মনু জানেন, স্ত্রীলোক মানেই পুংশ্চলী, যে-কোনো ছলায় পুরুষ মানুষের মনে ঝড় তোলাই তার স্বভাব। আজকের দিনে যাঁরা ভালোবাসায় বিশ্বাস করেন, তাঁরা জানেন, যে-কোনো মেয়েকে ভালোবাসতে গেলে তার কথাগুলো অনির্দিষ্ট বিধি-বিহীন বিধি আছে। এমনকি মহামতি বাৎস্যায়ন পর্যন্ত সে সব গোপন কথা আমাদের মতো করেই জানতেন। কিন্তু সেই মতে কেউ যদি ভালোবাসার পথে এক পাও বাড়ায়, তাহলেই মনুর মতে ‘সংগ্রহণ’ দণ্ড হবে। ‘সংগ্রহণ’ মানে কিন্তু পরস্ত্রীর প্রতি লোভাতুরতা এবং তার চরম ফল প্রাণদণ্ড। পরস্ত্রীর কেলেঙ্কারিতে প্রযুক্ত এই সংগ্রহণ দণ্ড কিন্তু সেখানেও নেমে আসবে, যদি আপনি অপরিচিত কোনো মহিলার সঙ্গে রসালাপ করার চেষ্টা করেন, যদি এটা ওটা উপহার দেন সেই অপরিচিতাকে। আবার যদি কোন বিপাকে তাঁর আধ আচরে বসার চেষ্টা করেন কিংবা যদি বলেন—’তোমার হাতের রাখীখানি ওই বাঁধ আমার দখিন হাতে’—তাহলেই হয়ে গেল। মনু বলবেন—এ হল ‘স্পর্শো ভূষণবাসসাম’-এর দণ্ড হবে সংগ্রহণের ধারায়, মানে প্রাণদণ্ডও হতে পারে।
আমরা জানি, প্রাণদণ্ড নাই হোক কিন্তু সমাজটা এক বাঁধা নিয়মের মধ্যেই চলতে আরম্ভ করেছিল। একটি ত্রিশ বছরের ছেলের সঙ্গে দ্বাদশবর্ষীয়া কুমারীর কিংবা চব্বিশ বছরের লায়েকের সঙ্গে অষ্টমী বালিকার উদ্বাহবন্ধনে প্রেম-ভালোবাসা—এসবের ভরাডুবি হয়ে গেছিল। তার সুফল কী হয়েছিল তা শোনা যাক এক প্রাচীন কবির মুখে। কবির নাম লক্ষ্মীধর; ইনি বিখ্যাত দার্শনিক লক্ষ্মীধর নন, তবে বিশিষ্ট কবি। সম্পূর্ণ গৃহস্থ-জীবনের ওপরেই কবির মন গেছে বিষিয়ে। তিনি বলেছেন—হায়, এই কী জীবন! যেখানে বিরহবিধুরা কামিনী কখনো জ্যোৎস্না-রাতের নিন্দে করে না, যেখানে শঙ্কা নেই, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব নেই, নেই দূতীর আশ্বাস-বাণী—ইন্দুর্যত্র ন নিন্দ্যতে ন মধুরং দূতীবচঃ শ্রূয়তে, যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকার কথালাপ বাষ্পাচ্ছন্ন হয় না নয়নের জলে, তনুদেহে কৃশতা আসে না দয়িতের ক্ষণিক অবহেলায়, সেইখানে সম্পূর্ণ নিজের বশর্বতিনী, অনুকূলা এক বিবাহিতা রমণীকে আলিঙ্গন করে শুধুই যে অকাতরে ঘুম দেওয়া—এই কি প্রেম! এ হল রোমাঞ্চহীন গৃহস্থ আশ্রমের ধর্মব্রত, যা শুধু অতিকষ্টে ভাবলেশহীনতায় আচরণ করা যায় মাত্র—স্বাধীনাম অনুকুলিনীং স্বগৃহিণীম আলিঙ্গ্য যৎ সুপ্যতে। তৎ কিং প্রেম গৃহশ্রামব্রতমিদং কষ্টং সমাচর্য্যতে।।
যদি বলেন এ সব বৈচিত্র্যলিপ্সু বহুভোগী পুরুষের সংলাপ, তাহলে বলব, শুধু সংসারের পুরুষের সংলাপ, তাহলে বলব, শুধু সংসারের একঘেয়েমি আর স্বামীর সেবাদাসীত্ব স্ত্রীলোকেরও ভালো লাগত না। মধুরবর্ণী নামে এক নারী-কবির মুখে তো সেই কথাটিই ধরা আছে আরও গভীর ব্যঞ্জনায়। সে বলেছে—আমার স্বামীর রূপ ঠিক চাঁদের মতো, গলায় আছে কোকিলের মিষ্টি সুর, স্ত্রীলোককে কী করে তুষ্ট করতে হয় তাও তিনি বিলক্ষণ জানেন, কিন্তু তাঁর দোষ একটাই—তিনি আমার স্বামী—ইত্থং ভর্ত্তরি মে সমস্ত-যুবতী-শ্লাঘ্যৈর্গুণৈঃ কিঞ্চন। ন্যূনং নাস্তি পরং বিবাহিত ইতি সান্নৈকদোষো যদি।।
এই যে একটি পুরুষ আর একটি স্ত্রীর জবানবন্দি শুনলাম আমরা, তাতে বেশ বুঝি গৃহস্থাশ্রম সেকালের নারী-পুরুষের কাছে এমন এক ভার জমিয়ে তুলেছিল যাতে কেউ সেই ভারের বেগেই ঠেলে চলতেন, কেউ-বা আধেক রাস্তায় বোঝা নামিয়ে তাঁদের অনুরাগ মুক্তির জায়গা করে নিতেন অন্য স্ত্রী কিংবা অন্য পুরুষের ঘরে। আর কেউ-বা হয়ে যেতেন স্থাণুর মতো—বিকারহীন, তরঙ্গহীন। ভালোবাসার উত্তাপ নেই, ধৈর্যহানি নেই, সদা প্রশান্ত ধ্যানীর মতো বোম হয়ে তাঁরা সংসার করে যাচ্ছেন। এই জাতীয় দাম্পত্য প্রেম বোঝানো দায়, তবুও কবির চোখে তার একটা ভাব ফুটে উঠেছে হর-পার্বতীর উতোর-চাপানে। শিব বললেন—হ্যাঁগো, তুমি এত নিষ্ঠুর কেন পার্বতী? পার্বতী বললেন—আমি ওইরকমই, পাহাড়-পর্বতের মেয়ে তো, তাই অমন পাথর পাথর স্বভাব—সহজঃ শৈলোদভবানাময়ং। শিব বললেন—তাই বলে একটু ভালোবাসা, কি একটু স্নেহ থাকবে না তোমার মনে? (পাঠক খেয়াল করবেন, স্নেহ কথাটির মানে যেমন ভালোবাসা, তেমনি স্নেহপদার্থও বটে, যা আগুনের ইন্ধন এবং ভালোবাসারও।) দ্বিতীয় অর্থের সূত্র ধরেই পার্বতী বললেন—তুমি হলে ভস্ম-পুরুষ, ভস্মের মধ্যে স্নেহপদার্থ ঢেলে লাভ কি—ন ভস্মপুরুষঃ স্নেহং বিভক্তি ক্বচিৎ। শিব বললেন—আমার ওপরে রাগ করে কোনো লাভই নেই পার্বতী। পার্বতী বললেন—সে কথা আর বলতে, তুমি হলে অচল স্থাণুপুরুষ, সেখানে রাগ করাই বা কি আর না করাই বা কি?
হর-পার্বতীর কথালাপে দাম্পত্য জীবনের যে চিত্র ভেসে ওঠে, এ চিত্র অনেক সংসারেই ছিল। আসলে ধর্মশাস্ত্রকারদের রুটিন-বাঁধা দাম্পত্য-জীবনে কোনও চমক ছিল না, ছিল না নতুনত্ব কিংবা সংঘাত। দাম্পত্য-জীবন মানে তাদের কাছে রুটিনমাফিক রতিক্রীড়া এবং পুত্রপ্রসব। বরঞ্চ কামসূত্রকার বাৎস্যায়নকে আমি ঋষি বলে মানি। তিনি তাঁর পূর্বাচার্যকে উদ্ধৃত করে সেই কোন কালে বলেছেন—যাকে বিয়ে করে পুরুষ সুখী হবে—যাং গৃহীত্বা কৃতিনমাত্মানং মন্যেত—তাকেই বিয়ে করবে। কারণ বাৎস্যায়নের মতে বিবাহের ফল হল আসলে অনুরাগ—ব্যূঢ়ানাং হি বিবাহানাম অনুরাগঃ ফলং ততঃ। আট রকমের বিয়ের মধ্যে এই অনুরাগের ছোঁয়া লাগে শুধু যুবক-যুবতীর নিজের পছন্দ করা বিয়েতেই, অন্তত বাৎস্যায়নের মত তাই—অনুরাগাত্মকত্বাচ্চ গান্ধর্বঃ প্রবরো মতঃ। কিন্তু এসব শুনলে ধর্মশাস্ত্রকারদের মাথায় রক্ত উঠবে। ধরুন আপনার ইচ্ছে হল—একটি ব্যস্ত ব্যাকুল পদের শ্যামা মেয়ে নিয়ে আসব ঘরে, অমনি বশিষ্ঠ ঠোঁট উলটে বলে উঠবেন—কালো মেয়ে! সে ভালো শুধু রমণ করার জন্য, ধর্মবিবাহে কালো মেয়ে! কক্ষনো না—কৃষ্ণবর্ণা যা রামা রমণীয় এব ন ধর্মায়। এ কি খুব ভালো কথা হল? বামুন মানুষ, কালো মেয়ে যদি বিয়েই করেন তা শুধু রতিকর্মের জন্য, কিন্তু তারও আগে একটা বামনী বিয়ে করে নিতে হবে। আর কারণ কি? আপস্তম্ব বলেছেন—যেমনটি বিয়ে করবে, তেমনটি হবে তোমার ছেলে। মনুর মতে, ব্রাহ্মণ যদি ব্রাহ্ম, দৈব্য, আর্ষ অথবা প্রাজাপত্য বিবাহ করে তবে তার ছেলে হবে রূপে কার্তিক আর যশে কর্মে শতজীবী। আর যদি ভালোবেসে গান্ধর্ব মতে বিয়ে করো, তাহলে ছেলে হবে মিথ্যেবাদী আর গুন্ডা—নৃশংসানৃতবাদিনাঃ। আমি বলি কি, একটা ব্রাহ্মণীকে ঘরে নিয়ে আসার পরেও যদি একটি কালো শূদ্রা বিয়ে করার ইচ্ছে করে, তাহলে সেখানে হয় অনুরাগের প্রশ্ন থাকবে, নয়তো অন্য কোনো আকর্ষণ অথবা দুটোই। এই যে ব্যাসপিতা পরাশর জেলের মেয়ে সত্যবতীকে নৌকোয় উঠেই প্রেম নিবেদন করেছিলেন তাঁর পুত্রফল কি খারাপ হয়েছে? কুজঝটিকার আবেষ্টনীর মধ্যে জন্ম হলেও ব্যাস কি মিথ্যেবাদী না গুন্ডা? অথচ এই কথা যদি মনু শুনতেন তাহলেই তিনি বলতেন—যে ব্রাহ্মণ শূদ্রার অধররস পান করিয়াছে—বৃষলীফেন-পীতস্য—শয্যায় তাহার নিঃশ্বাস গায়ে লইয়াছে এবং তাহাতে সন্তান উৎপাদন করিয়াছে তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিয়াও ফল হইবে না। স্মার্ত পণ্ডিত শাস্ত্রের প্রমাণ তুলে আবারও বলবেন—শক্তিমান পুরুষের কোনো অপকম্মেই দোষ হয় না, আমরা ওসব করতে গেলেই মরব, কালকূট বিষ শিবেরই সহ্য হয়, অন্যের নয়।
ধর্মশাস্ত্রকারদের কথা আমরা স্বীকারও করি না আবার অস্বীকারও করি না। আমরা শুধু বলি—তাঁরা প্রায় মুক্ত এক সমাজকে শুধুমাত্র কলিযুগের জিগির তুলে এরকম স্তব্ধ, সংকুচিত করে দিলেন কেন। অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা—এঁরা যত স্বাধীন ছিলেন, আমাদের ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতার উত্তরাধিকার হরণ করা হল কেন? স্ত্রী স্বাধীনতা বলতে আমরা এমন কিছু বুঝি না যা পুরুষের স্বাধীনতা বিপন্ন করে তোলে। আমি পক্ষপাতী নই সেই কথাগুলির যা গঙ্গা বলেছিলেন শান্তনুকে। গঙ্গা বলেছিলেন—মহারাজ! আমি যা করব, সে ভালো হোক কিংবা মন্দ—যত্তু কুর্য্যামহং রাজন শুভং বা যদি বাশুভম—আপনি তাতে বাধা দিতে পারবেন না। কোনো অপ্রিয় কথাও আমাকে বলা চলবে না। আপনি যদি এইভাবে চলতে পারেন, তবেই আমি আপনার সঙ্গে থাকব, নইলে চলে যাব—বারিতা বিপ্রিয়ং চোক্তা ত্যজেয়ং ত্বাম অসংশয়ম। সংসারে এমন স্ত্রীলোকের অভাব নেই, বিশেষত আজকাল। কোনো রকমের বারণ কিংবা যে কথাটা আপাতত অপ্রিয় লাগছে, সেটা তাঁরা সইতে পারেন না। একান্নবর্তী পরিবারের কথা ছেড়েই দিলাম, কিন্তু পুরুষ মানুষেরা যে স্বয়ম্ভূ নন, তারও যে বাবা-মা বলে একটা জিনিস থাকে, সেটা যেন অনেক স্ত্রীই ভুলতে বসেছেন। এককালে পতিদেবতারা বড়ই হুকুম চালিয়েছেন স্ত্রীলোকের ওপর, অতএব নিউটনের তৃতীয় সূত্রের প্রমাণে এখন তাঁরা এমনই বশংবদ হয়ে উঠেছেন যে আমার সেই প্রাচীন কবির কথা মনে পড়ে। কবি বলেছেন—দেখ বাপু, যিনি যে কাজ জানেন, সে কাজের বিষয়ে তিনিই প্রমাণ। জিজ্ঞাসা করতে হলে সেই কার্যজ্ঞ ব্যক্তিকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। ইনি আমার প্রিয়, ইনি আমার মান্য গুরুর মতো, অতএব তিনিই সমস্ত ব্যাপারে আমার সন্দেহ নিরসন করবেন—এই কথাটা ঠিক নয়—কার্যজ্ঞঃ প্রষ্টব্যো ন পুনর্মান্যো মম প্রিয়ো বেতি। এর পরে কবি ‘গুরু’ শব্দটির ওপর শ্লেষ করতে বলেছেন—তিনি যদি গুরুও হন তবে তাঁকে বড়জোর আসন দিয়ে সম্মান দেখানো যেতে পারে, ঠিক যেমন প্রিয়ার নিতম্বটি অতিগুরু হলেও তাকে আসন দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু প্রয়োজনীয় কার্যে প্রিয়ার নিতম্বখানি কি মন্ত্রণা দিতে পারে কোনো? গুরুরপি আসনসেব্যঃ প্রিয়ানিতম্বঃ কদা মন্ত্রী? আজকাল আবার তাই হয়েছে, সর্বক্ষেত্রেই প্রিয়ানিতম্বকে শুধু আসন দেওয়া নয়, সর্বদাই সর্বকার্যে তাকেই সাক্ষী মানি। দাম্পত্য-জীবনে এই অসম ব্যবহার চলে না, না পুরুষতন্ত্র, না স্ত্রীতন্ত্র। যা চলে, তা হল যুগ্মতন্ত্র, ভালোবাসায় বন্ধুত্বে যে পারস্পরিকতা গড়ে ওঠে সেটাই প্রয়োজন। তবু বলি, এতকাল ধরে পুরুষের যে সকল সিংহ-পৌরুষ, শুধুমাত্র অবলা স্ত্রীজাতির ওপরে পরীক্ষিত হয়েছে, সে তুলনায় কেবলমাত্র শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ সবলা স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা আর কতটুকু এবং সেটুকুও বিচার্য হবে হাজার হাজার বছরের শাস্ত্রীয় পুরুষাধিকারের নিরিখে। পারস্পরিকতা অথবা নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের সূত্রটি হারিয়ে গেলে কি হয়, তা বোধ হয় এখন সমস্ত মহিলাকুলের দিক থেকেই দেখবার সময় এসেছে। আমি তাই মহিলা কবি ভাবক দেবীকেই এ ব্যাপারে সাক্ষী মানি। ভাবক দেবী চার-পাঁচটি শব্দে আনুপূর্বিক বুঝিয়ে দিয়েছেন তার দাম্পত্য-জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেছেন—প্রথম পর্বের সেই মিলনে আমাদের এমন এক অবস্থা হয়েছিল, যে ভিন্ন দুটি শরীর যেন একাকার হয়ে গেল। তারপর তুমি হলে আমার প্রিয় আর আমি প্রিয়তমা (এই প্রিয়ত্বের সম্বন্ধও কিন্তু নবীন মিলনের জৈবিক আকর্ষণজাত, কেননা কবি বলেছেন আমি হয়ে পড়লাম ‘হতাশ প্রিয়তমা’)। এর পরেই ভাবক দেবীর চূড়ান্ত দুঃখের কথা। হতাশ প্রিয়তমা তখন বলেছে—এখন তুমি হয়ে গেছ আমার প্রভু, অধিকারী, আর আমি হয়ে পড়েছি গৃহস্থি সামলানো এক স্ত্রী মাত্র, আর কিছুই নয়—ইদানীং নাথস্ত্বং বয়মপি কলত্রং কিমপরম। তবু আমি মরিনি, তাতে বুঝি এতদিনে আমার বজ্র-কঠিন প্রাণের প্রাপ্য ফলটুকু পেয়েছি।
এইরকম একটা দাম্পত্য-জীবন, যেখানে সমপ্রাণতা নেই ভালোবাসা নেই, পারস্পরিক মুগ্ধতা নেই, সেখানে আনন্দ কোথায়? ধর্মশাস্ত্রের পণ্ডিতেরা এ আনন্দের মানে বোঝেননি বটে, কিন্তু সমপ্রাণতার আদর্শেই আমাদের রসশাস্ত্র গড়ে উঠেছিল। শৃঙ্গার রসে নায়ক-নায়িকা, স্বামী-স্ত্রী কেউ কারুর চেয়ে খাটো নয়। বৈষ্ণব রসতত্ত্ববিদ কৃষ্ণদাস কবিরাজ পর্যন্ত প্রাচীন রসশাস্ত্রের আদর্শ উদ্ধার করে বলেছিলেন, ‘দোঁহার যে সমরস ভরতমুনি জানে।’ আমার বলতে ভয় হয়, ধর্মশাস্ত্রের বিধি-নিষেধের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত যে দাম্পত্য-জীবন, তার প্রতিবাদ হিসেবেই রাধা-কৃষ্ণের তত্ত্বটা গড়ে ওঠেনি তো? বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে কৃষ্ণ একটুও প্রভু কিংবা স্বামী নন, তিনি সখা আর রাধা তার প্রাণসখী। যেদিন সমস্ত গোপীরা শারদ নিশায় জ্যোৎস্নাভিসারে এসেছিল সেদিন কৃষ্ণ তাদের প্রথমেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন ধর্মশাস্ত্রের অনুশাসনগুলি। বলেছিলেন—স্বামী-পুত্র, পরিবারের সেবা করা, সেই তো স্ত্রীলোকের পরম ধর্ম। রোগী হোক, জড় হোক অথবা দরিদ্র স্বামীদের কি ফেলে দেওয়া যায়, সে যে মহাপাপ—পতিঃ স্ত্রীভির্ন হাতব্যো লোকেস্পুভিরপাতকী। গোপীরা সব শুনলেন, প্রিয়তমের মুখে অপ্রিয় ভাষণ শুনে অকাট্য যুক্তি দিয়ে যা বললেন, তার নির্গলিতার্থ এই—তুমি যে বড় স্বামীর কথা, পতির অনুবৃত্তির কথা বলছ—যৎ পতি-অপত্যসুহৃদাম অনুবৃত্তিরঙ্গ, এত যে গালভরা উপদেশ দিচ্ছ, আমরা ওসব বুঝি না। আমরা বুঝি প্রিয়ত্বের সম্বন্ধ, বুঝি তোমার মতো প্রিয়তমকে, যে আমাদের আত্মা, আমাদের বন্ধু—প্রেষ্ঠো ভবান তনুভৃতাং কিল বন্ধুরাত্মা। তুমি যে বললে ঘরে ফিরে যেতে, আমরা যাব না। যে মন এতকাল শুধু ঘরে আবদ্ধ ছিল, সে মন তুমি হরণ করেছ—তোমারই চরণে আমারই পরাণে লাগিল প্রেমের ফাঁসী—যে হাত দুটো এতকাল ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল, আজ মনের সঙ্গে সেও শামিল হয়েছে, পা দুটিও সরছে না যে ফিরে যাব ঘরের পথে—পাদৌ পদং ন চলতস্তব পাদমূলাদ/যামঃ কথং ব্রজমথ করবাম কিংবা। আর সখা, এর পরেও যদি ফিরে যেতে বল, এর পরেও যদি ভালো না বাসো, তাহলে আমরা মরব যোগবলে তোমারই বিরহের আগুনে—ধ্যানেন যাম পদয়োঃ পদবীং সখে তে।
সহৃদয় পাঠক লক্ষ করবেন, প্রিয়তম, বন্ধু, আত্মা সখা—এইসব শব্দগুলিই শৃঙ্গার সম্বন্ধের মানস-সূত্র, যা বেশিরভাগ দাম্পত্যই ধর্মশাস্ত্রের চাপে ভুলতে বসেছিল। শাস্ত্রীয় বিবাহে স্বামী-স্ত্রীকে নানা শাস্ত্রবিধি, লোকবিধি মেনে চলতে হয়েছে, আর বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে প্রেমের সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছে শাস্ত্র-বিধির শেষ পারে। স্বয়ং রূপ গোস্বামীর মতো দার্শনিক কবি লিখেছেন, অনুরাগ যেখানে ধর্মকে অতিক্রম করে—রাগেন উল্লংঘয়ন ধর্মং, সেইখানেই শৃঙ্গার রসের প্রকর্ষ, সেইখানেই সখাকে সখীর প্রেমে সাজানো যায়। বৈষ্ণব তত্ত্ববেত্তা বলবেন—দেখ, এ সব কথা কৃষ্ণের সম্বন্ধেই খাটে, আমার-তোমার নয়; ধর্মতাত্ত্বিকরা ধমক দিয়ে বলবেন—স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এসব সখা-সখীর ভাব একদম বরদাস্ত করা হবে না, আমরা বলি, আমরা ঘোরতর সনাতন পন্থী, আমরা বেদের মতে চলি। বেদের পুরুষ নবীনা বধূটির পায়ে সাতবার পা ঠুকে বলেছে—তুমি আমার সাতপায়ের সাথী গো—মে সপ্তপদঃ সখাসি। অতএব এই বন্ধুত্বই হল সপ্তপদী মিলনের অন্তিম অভিপ্রায়। সাত পা একসঙ্গে হাঁটলেই নাকি বন্ধুত্ব হয়, অন্তত কালিদাসের শিব পার্বতীকে তাই বলেছেন—যতঃ সতাং সংনতগাত্রি সংগতং মণীষিভিঃ সপ্তপদীর্নমুচ্যতে। বেদপুরুষ আশীর্বাদ করে বলেছে—তোমাকে সৌভাগ্যের জন্য গ্রহণ করছি, সে বলেছিল—তুমি আমার ঘরে পাথরের মতো স্থিরায়তী হও—অশ্মেব ত্বং স্থিরা ভব, কিন্তু এ সব কিছুর ওপরে, ছাপিয়ে প্রাচীনা বধূর মনে কেবলই ভেসে এসেছে সেই সপ্তপদী বন্ধুত্বের কথা—যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং মম। হৃদয়ের এই বন্ধুত্ব যে একজন রমণীর মন কতখানি অধিকার করে থাকে তা বোঝা যাবে বিখ্যাত মহিলা কবি বিকটনিতম্বার কথায়। তিনি বলেছেন—বিয়ে না করে যারা অন্য প্রেমে জীবন কাটায়, যারা শুধু প্রেমের জন্য প্রেমের খেলা করে, কবির কটাক্ষ তাদেরই প্রতি। কিন্তু ভালোবাসার দেবতা যেদিন তাঁর শাণিত ফুলের শরগুলি গুটিয়ে নেন, সেদিনই তাদের ফুলখেলা বন্ধ হয়, কৃত্রিম এবং সাময়িক প্রেমবন্ধনের সেদিনই হয় সমাধি। কাজেই যাদের পা-দুখানি (দ্বিপদ) সপ্তপদীর অভিজ্ঞতা লাভ করল না, ভাগ্যসূত্র যাদের জীবনকে অন্যের সঙ্গে এক করে দিল না মঙ্গলসূত্রের বাঁধনে, তারা কি কখনো স্থায়ী, অখণ্ড প্রেমের দাবি করতে পারে।
এখানে নিরাপত্তা নয়, দাম্পত্য অভ্যাস নয়, গৃহকৃত্যের ধর্ম নয়, যেটা বড়, সেটা সেই দাম্পত্য-জীবনের অখণ্ড প্রেম—বন্ধুত্ব। রমণী সব সহ্য করতে পারে, কিন্তু যেদিন সে দেখে ঘর-দোর, পরিবার-পরিজন সব ঠিক আছে, শুধু আন্তর-প্রেমেই আছে অবহেলা, সেদিন অবন্তী সুন্দরীর কবিতা তার বারবার মনে পড়ে। অবন্তী সুন্দরী ব্রাহ্মণ কবি রাজশেখরের অতি প্রিয়তমা স্ত্রী। জাতিতে ক্ষত্রিয়া। কোন দিন সে বুঝি রাজশেখরের প্রেমের দীনতা বুঝে কেঁদে বলেছিল—হায় নিষ্ঠুর, তুমি কি ভুলে গেছ—কিং তং পি বীসরিঅ, তুমি কি ভুলে গেছ, একদিন লাজলজ্জার মাথায় জলাঞ্জলি দিয়ে সমস্ত গুরুজনদের মধ্যে দিয়ে স্রস্ত উত্তরীয়ে ছুটে গিয়ে তোমায় জড়িয়ে ধরেছিলাম—নিক্কিব জং গুরু অনস্ম মজঝভি। /অহিধাবিউন গহিও তং ওহুর-উত্তরীয়াত্র।।
কবি রাজশেখর রমণী-হৃদয়ের এই গভীর আবেগের কথা কতখানি বুঝেছিলেন, সে খবর জানি না; কিন্তু আমরা আধুনিকমনা, প্রগতিশীলও বটে। বিস্রস্ত বেশে যে রমণীরা গুরুজনের ভয় তুচ্ছ করে আমাদের কাছে ছুটে এসেছিল, আমরা তাদের বর এবং অভয় দুইই দান করেছি। প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রের অন্যায্য অত্যাচার আমরা তো সহ্য করতে চাই না বা করিও নি; কিন্তু আরও এক বিপন্ন বোধ যে আধুনিক যুবক-যুবতীকে ঠেলে দিচ্ছে অন্য এক অস্থিরতার দিকে। একালের যুবক-যুবতী তথা স্বামী-স্ত্রীর মিলন হচ্ছে এমনই এক তেপান্তরের জমিতে, যেখানে স্ত্রী, তাঁর ভাই-বন্ধু, বাবা-মা ছেড়ে এসেছেন কষ্টে দুশ্চিন্তায়; আর স্বামীও তার বাবা-মা আত্মীয় পরিজন ছেড়ে মিলিত হয়েছেন নববধূর সঙ্গে আরও গভীর প্রেমের অন্বেষায়। দু’জনেই যে বাপের বাড়ি ছেড়ে এসে একান্তে সংগত হল—এ কি ধর্মশাস্ত্রের প্রতিক্রিয়া, না রসশাস্ত্রের? আসল সুষম সত্যটি আছে বুঝি মাঝখানে। আমরা সেই সুদিনের প্রতীক্ষায় আছি, যেদিন রসের সঙ্গে মিলন হবে সুনীতি বিদ্যাবধূর।
(এই লেখাটির ভিত্তি-ভূমি হওয়া উচিত ছিল ধর্মশাস্ত্র এবং সামাজিক জীবনের প্রতিতুলনা। আমি সেদিকটায় সম্পূর্ণ না গিয়ে প্রায় বিস্মৃত প্রাচীন মহিলা এবং পুরুষ কবিদের দৃষ্টি থেকে সমাজটাকে ধরবার চেষ্টা করেছি।)