বিবর্তন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

বিবর্তন

লাইকন তার একশ বিশ তলার অফিসের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের বিস্তৃত আলোকোজ্জ্বল শহরটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। অকারণেই তার বুকের ভেতর একধরনের বিষণ্ণতা। একজন মানুষ যখন সবকিছু পেয়ে যায়, যখন তার আর কিছু চাইবার থাকে না, পাওয়ার কিছু থাকে না তখন মনে হয় বুকের ভেতর এ রকম অকারণ বিষণ্নতার জন্ম নেয়। এই জীবনে তিনি যা করতে চেয়েছেন তার সবকিছু করেছেন। এটা বলা কি খুব বেশি অতিরঞ্জন হয়ে যাবে যে আধুনিক পৃথিবীর সভ্যতার বড়ো অংশটুকু তার অবদান? শুদ্ধ করে বলা যায়, তার একক অবদান?

তিনি কি সবার আগে বলেননি যে মানুষের মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতা মেনে নেয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি কী কৃত্রিমভাবে মানুষের মস্তিষ্ককে বিকশিত করার বিষয়টির তীব্র বিরোধিতা করেননি? তিনি কি বলেননি মানুষের মস্তিষ্ক যন্ত্রণা আর চাপ সহ্য করার জন্যে তৈরি হয়নি? মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি হয়েছে বুদ্ধিমত্তার কাজ করার জন্য আর সেই বুদ্ধিমত্তার কাজ অনেক সহজে করা যায় যদি সেটি করার জন্য যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা যায়?

তিনি সারা পৃথিবীকে সেটি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পৃথিবীর মানুষ তার মুখের কথা বিশ্বাস করতে রাজি হয়নি। তাকে সেটা প্রমাণ করতে হয়েছিল। মানুষ যখন তার মস্তিষ্কের চাপের অংশটুকু যন্ত্রের ওপর ছেড়ে দিলো তখন রাতারাতি তাদের জীবন আনন্দময় হয়ে উঠেছিল। যৌবনের সেই দিনগুলোর কথা তার মনে পড়ে যায়। তিনি বিশ্বজোড়া নিজের নেটওয়ার্ক বসিয়েছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণার নূতন প্লাটফর্ম তৈরি করেছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মানুষের ভেতরে যে অযৌক্তিক আতঙ্ক ছিল তিনি সেটা দূর করেছেন। মানুষকে দেখিয়েছিলেন যন্ত্র—তার ভেতরে যত বুদ্ধিমত্তাই থাকুক, সেটি কখনো মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে না। তিনি সেটা নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন, সেটা মানুষকে দেখিয়েছিলেন। পৃথিবীজোড়া নেটওয়ার্কের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর কন্ট্রোল সিস্টেম কিহিরি এখন পৃথিবীর মানুষের সর্বক্ষণের সঙ্গী।

লাইকনের হঠাৎ কিহিরির সাথে যোগাযোগ করার ইচ্ছে করল, তিনি নিচু গলায় ডাকলেন, “কিহিরি।”

খুব কাছে থেকে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ভরাট গলায় কিহিরি বলল, “শুনছি মহামান্য লাইকন।”

“কেমন আছো?”

কিহিরি শব্দ করে হাসল, বলল, “আপনার সাথে কথা বলতে পারলে আমার সবসময়েই খুব ভালো লাগে।”

লাইকন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, “এই যে তুমি বললে ভালো লাগে—যতবার আমি এই কথাটি শুনি আমি কেমন জানি চমকে উঠি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সত্যি কি ভালো-লাগার অনুভূতি বুঝতে পারে?”

কিহিরি বলল, “আপনি নিজ হাতে আমাকে তৈরি করেছেন। আমার ভালো-লাগাটুকু সত্যি না কল্পনা সেটি আপনার থেকে ভালো করে কে জানবে?”

“কিহিরি, তোমাকে আমি কেন ডেকেছি জানো?”

“জানি না। কিন্তু অনুমান করতে পারি।”

“দেখি, অনুমান করো। তোমার অনুমান কতটুকু সত্যি পরীক্ষা হয়ে যাক।”

“আপনি আমাকে ডেকেছেন মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলার জন্য।”

লাইকন মাথা নাড়লেন। বললেন, “তুমি ঠিকই অনুমান করেছো কিহিরি। তোমার প্রতিভা দেখে আমি মুগ্ধ!”

কিহিরি আবার শব্দ করে হাসল, বলল, “আপনি আমাকে ডিজাইন করেছেন, কাজেই আমার প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই। মুগ্ধ হতে চাইলে আপনাকে আপনার নিজের প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হতে হবে।”

লাইকন একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “নিজের প্রতিভা দেখে নিজে মুগ্ধ হওয়া যায় না কিহিরি! বরং দুশ্চিন্তা হয়।”

“আমি সেটাও অনুমান করেছিলাম মহামান্য লাইকন।”

“তুমি নিশ্চয়ই জানো গত কয়েক দিন থেকে আমি কী নিয়ে চিন্তা করছি।”

“জানি মহামান্য লাইকন। আপনি ভাবছেন আপনি পৃথিবীর জন্যে যেটা করেছেন সেই কাজটি ভালো হলো কি না।”

লাইকন মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন, তার ভঙ্গি দেখে মনে হলো সত্যি বুঝি ঘরের পিছনে কিহিরি দাঁড়িয়ে আছে এবং তিনি তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন। লাইকন জিগ্যেস করলেন, “হ্যাঁ কিহিরি। বলো, কাজটা কি ভালো হলো?”

“এই প্রশ্নটির এখন কোনো অর্থ নেই। আপনি যেটা করতে চেয়েছিলেন সেটা করে দিয়েছেন। পৃথিবীর মানুষের মস্তিষ্কের ওপর চাপ কমিয়ে এনেছেন। মানুষের জীবন অনেক আনন্দময় করে দিয়েছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আমাদের তৈরি করেছেন, আমরা মানুষের পাশে পাশে থাকি। তাদের কাজকর্মে সাহায্য করি। তাদের কিছু জানতে হলে সেটা সাথে সাথে জেনে যায়। কিছু করতে হলে সাথে সাথে সেটা করতে পারে—”

“কিহিরি—”

“বলুন মহামান্য লাইকন।”

“তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অবান্তর কথা বলছো।”

“আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন মহামান্য লাইকন।”

“তার কারণ তুমি সরাসরি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছো না।” কিহিরি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

লাইকন একটা নিশ্বাস ফলে বললেন, “তার মানে তুমি মনে করো আমার কাজটি ঠিক হয়নি।”

“আমি সেটি বলিনি মহামান্য লাইকন। পৃথিবীর কোনো মানুষ সেই কথা বলবে না। আপনি মানুষের জীবন সহজ করে দিয়েছেন, আপনি যন্ত্রের সাহায্য নিয়েছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়েছেন কিন্তু সবসময়েই নিশ্চিত করেছেন যন্ত্র কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেন মানুষের জীবনে হস্তক্ষেপ না করে। মানুষ যেন নিজের মতো করে তার জীবন চালিয়ে নিতে পারে। আমরা, যন্ত্ররা সাহায্য করার জন্যে থাকব কিন্তু কখনোই নিজ থেকে এগিয়ে যাব না।”

“আমি এই সবকিছু জানি কিহিরি। তুমি আমাকে নূতন কিছু বলতে পারবে না।”

“আমি জানি মহামান্য লাইকন। তবু আমি বলছি কারণ আপনি নিঃসঙ্গ অনুভব করছেন। আপনি কারো সাথে কথা বলতে চাইছেন, আমি শুধু আপনার সাথে একটু কথা বলছি।”

লাইকন আবার একটা নিশ্বাস ফেললেন, তারপর ক্লান্ত গলায় বললেন, “কিহিরি।”

“বলুন মহামান্য লাইকন।”

“আমি এখন একটু একা থাকতে চাই।”

“ঠিক আছে মহামান্য লাইকন। শুভ সন্ধ্যা।”

কোথাও কোনো শব্দ হলো না কিন্তু কিহিরি চলে গেল। তাকে ডাকলেই সে ফিরে আসবে। কিহিরির স্রষ্টা লাইকন ডাকলে সে যেভাবে সাড়া দেবে পৃথিবীর একেবারে সাধারণ মানুষ ডাকলেও সে একইভাবে সাড়া দেবে। পৃথিবীর মানুষ যখন কিছু জানতে চায়, যখন কিছু করতে চায় তখন কিহিরি তাদের পাশে থাকে।

লাইকন জানালা থেকে সরে এসে তার ডেস্কের পাশে থাকা চেয়ারটাতে বসলেন। চেয়ারটা আস্তে আস্তে নিচু হয়ে তার জন্য একটা আরামদায়ক উচ্চতায় নেমে এলো, তার পায়ের অংশটি উঁচু হয়ে এলো। তিনি তার কানের কাছে মৃদু স্বরে একটি প্যানাটের সংগীত শুনতে পেলেন। ঘরের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কয়েক ডিগ্রি শীতল হয়ে গেল। ঘরের আলো দুই ডিবি নিষ্প্রভ হয়ে এলো। এর কিছুই তিনি করতে বলেননি কিন্তু কিহিরি জানে তিনি এটাই মনে মনে চাইছেন। কিহিরি তাকে দিনের পর দিন পর্যবেক্ষণ করেছে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি কথা, প্রতিটি মুহূর্ত লক্ষ করেছে, তিনি কখন কী করতে চান সেটি কিহিরি জানে। তাকে কিছু বলতে হয় না, কিছু করতে হয় না, কিহিরি সবকিছু করে দেয়।

লাইকন আরামদায়ক চেয়ারটিতে আধশোয়া হয়ে তার চোখ দুটি বন্ধ করলেন। কিহিরির সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্যটি সাধারণ মানুষ জানে না, তাদের জানার প্রয়োজন নেই। কিহিরি নিজেকে নিজে সৃষ্টি করে টিকে থাকতে পারবে, তিনি যখন থাকবেন না তখনো কিহিরি টিকে থাকবে। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের সেবা করে যাবে।

লাইকন বুক থেকে একটা বড়ো নিশ্বাস বের করলেন, কিহিরিকে তৈরি করার সময় তিনি সবকিছু চিন্তা করেছেন, শুধু একটা জিনিস তিনি চিন্তা করেননি। সেটা হচ্ছে মানুষের বিবর্তন। হ্যাঁ বিবর্তন। তিনি বুঝতে পারেননি মানুষ যখন সবকিছু পেয়ে যাবে তখন বিবর্তনের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। শুধু যে ফুরিয়ে যাবে তা নয়, বিবর্তনের দিকটি পরিবর্তিত হয়ে যাবে। মানুষের পরিবর্তন হবে উল্টো দিকে। তিনি সেটি শুরু করে দিয়ছেন। কিহিরি তাকে স্পষ্ট করে বলেনি কিন্তু কিহিরি সেটি জানে।

লাইকন চোখ খুলে তাকালেন। হঠাৎ করে তিনি কিহিরির কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন, সেটি নিচু গলায় বলল, “মহামান্য লাইকন। আমি আপনার আহ্বান ছাড়াই এসেছি।”

লাইকন ক্লান্ত গলায় বলল, “আমি জানি।”

“আমি দুঃখিত আপনার আহ্বান ছাড়া চলে আসায়। কিন্তু মহামান্য লাইকন, আপনি এটা করতে পারেন না।”

লাইকন উঠে দাঁড়ালেন, কোনো কথা না বলে একটু এগিয়ে গেলেন। ডেস্কের ড্রয়ার খুলে একটা রিভলভার বের করলেন।

কিহিরি কাতর গলায় বলল, “দোহাই মহামান্য লাইকন। আপনি এটা করবেন না। দোহাই—”

লাইকন রিভলভারটি তার মাথার দিকে তাক করে ধরে বললেন, “আমি এত বড়ো অপরাধবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারব না কিহিরি—”

লাইকন ট্রিগার টেনে ধরলেন।

* * * *

“আমি কিহিরি বলছি। আমি মানুষ নই। আমি মানুষের অনুরূপ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া। আমাকে তৈরি করা হয়েছিল মানুষকে সাহায্য করার জন্য। আমি নিষ্ঠার সাথে গত দুই হাজার বৎসর তাদের সাহায্য করে এসেছি। ধীরে ধীরে পৃথিবীর মানুষের বিবর্তন হয়ে পরিবর্তন হয়েছে। তাদের বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পেয়েছে। গত এক হাজার বৎসরে বিবর্তিত হয়ে তারা এখন পৃথিবীর অন্য যেকোনো প্রাণীর মতো বুদ্ধিহীন বুনো পশু ছাড়া আর কিছু নয়।

আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি মানুষের একটি দল নগ্ন দেহে কিছু বুনো পশুকে আক্রমণ করেছে। তারা দাঁত দিয়ে বুনো পশুর কণ্ঠনালি ছিঁড়ে নেবার চেষ্টা করছে। তারা ভাষাহীন-বুদ্ধিহীন একটি প্রাণী ছাড়া কিছু নয়। তাদের বুদ্ধিমত্তা নেই, শুধু সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে তারা কোনোভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। এত দ্রুত বিপরীত বিবর্তনে মানব প্রজাতি এভাবে বুদ্ধিহীন প্রাণীতে পরিবর্তিত হবে সেটি আমি কখনো কল্পনা করিনি।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *