নয়
রানার পাশের সীটে বসে খুশি মনে পর্বতমালা দেখতে দেখতে চলেছে গিলটি মিয়া। আনন্দ আর ধরে রাখতে পারছে না সে। শেষকালে বলেই ফেলল, ‘উফ্! এইসব পাহাড়-পব্বত ডিঙিয়ে যদি হেঁটে যেতে হত, এক্কেবারে ফিনিশ হয়ে যেতুম, স্যার। ভাগ্যিস এটার ডাইবারীটা শিকে রেকেছিলেন, তাই রক্ষে!’ আবার একচোট হেসে নিয়ে বলল, ‘শালাদের এমন ক্যাঁচকলা দেকিয়ে দিয়েচেন, তিন পুরুষেও ভুলতে পারবে না। তবে মেয়েটাকে আমার তত খারাপ মনে হয়নিকো। কিন্তুক ওর ভাইটা, ওটা একটা…’
‘অত খুশি হওয়ার কিছু নেই, গিলটি মিয়া,’ বলল রানা মৃদু হেসে। ‘খানিক বাদেই নামতে হবে আমাদের!’
‘কেন? লণ্ডন-প্যারিস যাচ্চি না আমরা এটায় চড়ে?’
‘তেল নেই,’ সোজা সাপ্টা জবাব দিল রানা। ‘আর দশ মিনিটের মধ্যেই নামতে হবে আমাদের। বর্ডারটাও পার হওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।’
‘তার মানে আবার হাঁটতে হবে?’ আঁতকে উঠল গিলটি মিয়া। মাথা ঝাঁকাল রানা।
খানিকক্ষণ মন-মরা হয়ে বসে রইল গিলটি মিয়া, কিন্তু আবার খুশি হয়ে উঠতেও সময় লাগল না ওর।
‘কিন্তুক, যাই বলুন, বড় জবর ঘোল খাওয়ানো গেচে শালাদের। ওরা মনে করবে আমরা নাগালের বাইরে চলে গেচি।’
‘উঁহুঁ।’ মাথা নাড়ল রানা। ‘ওরা জানে বেশিদূর যেতে পারব না আমরা এটায় করে। পাইলট বলে দেবে যে তেল নেই এতে।’
‘তাহালে তো মুশকিল! আবার তাড়া খাওয়া নেড়ি কুত্তার মত ভেগে বেড়াতে হবে। তা এখুন আমরা চলেচি কোনদিকে?’
‘বর্ডারের দিকে। ওখানে কড়া পাহারা রয়েছে। যে করে হোক ওদের চোখে ধুলো দিয়ে ঢুকে পড়তে হবে আমাদের সুইজারল্যাণ্ডের ভেতর। একবার ওখানে পৌঁছতে পারলে টেনে করে চলে যাব আমরা জুরিখ। সেখান থেকে লণ্ডনের প্লেন ধরা কষ্টকর হবে না। কিন্তু তেলের যা অবস্থা তাতে বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছোনো যাবে বলে তো মনে হয় না।’
ফুয়েল গজের দিকে চেয়ে ভ্রূ কুঁচকে উঠল রানার। প্রায় জিরোতে গিয়ে ঠেকেছে কাঁটা। একটা ছোট চৌকোণ জায়গায় বার বার লাল বাতি জ্বলে উঠে বিপদ সঙ্কেত জানাচ্ছিল, এখন আর নিভছে না সেটা, জ্বলে রয়েছে সারাক্ষণ। আগামী তিন চার মিনিটের মধ্যেই একেবারে খালি হয়ে যাবে পেটস্ল ট্যাংক।
‘এদিক ওদিক একটু খুঁজে দেখো তো গিলটি মিয়া, প্যারাসুট পাওয়া যায় কিনা।’
‘মরি মরব, কিন্তুক আমি এত ওপর থেকে ঝাঁপ দিতে পারব না, স্যার। অসম্ভব। আপনার জন্যে খুঁজে দেখতে পারি…’
উঠতে যাচ্ছিল গিলটি মিয়া, বারণ করল রানা।
‘থাক। তাহলে আর দরকার নেই,’ খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে আঙুল তুলে দেখাল। ‘ওই দেখো টিরানো শহর। ওই পর্যন্ত পৌঁছতে পারব না আমরা। কিন্তু এখন এখানে নামাও নিরাপদ নয়, ফেরারও উপায় নেই।’
হঠাৎ বুদ্ধি খেলল রানার মাথায়, ‘আরে! গর্দভ আমি একটা! রিজার্ভ ট্যাংক তো দেখিনি। ওখানে কিছু পেটস্ল থাকতে পারে। নাকি রিজার্ভ ট্যাংকের তেলেই চলছি আমরা?’
একটা বোতাম টিপল রানা। পরমুহূর্তে হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে। সামান্য একটু উঁচু হয়ে গেল ফুয়েল গজের কাঁটা। লাল বাতিটা সর্বক্ষণ না জ্বলে বিপদ সঙ্কেত জানাতে শুরু করল আবার থেকে থেকে। রানার মুখে হাসি দেখে জোরে হেসে উঠল গিলটি মিয়া কিছু না বুঝেই। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘হাসছেন যে, স্যার?
‘তুমি হাসছ কেন?’
‘আপনাকে হাসতে দেখলে আমার খুব খুশি লাগে, স্যার। তাইতে হাসচি। পরিষ্কার উত্তর গিলটি মিয়ার। রানা জানে, এতটুকু মিথ্যে নেই ওর কথায়। আশ্চর্য এক মায়া-জালে জড়িয়ে গেছে গিলটি মিয়া ওর সাথে, চেষ্টা করেও দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি সে ওকে। ‘গোমড়ামুকো লোক আমার পচোন্দ হয় না, স্যার। কই, বললেন না, হাসচেন কেন?
‘আরও দশ মিনিটের পেটস্ল পাওয়া গেছে। টিরানোতে না নেমে আর একটু ভেতরে গিয়ে নামতে পারব এবার আমরা। উঁচুতে উঠতে শুরু করেছে হেলিকপ্টার। পর্বত ডিঙিয়ে আমরা সমতল জায়গায় নামার চেষ্টা করব। ম্যাপটা বের করো দেখি?’
সুইস বর্ডারের তুষার ঢাকা পর্বত-শৃঙ্গের পঞ্চাশ ফুট উপর দিয়ে টপকে চলে এল ওরা এপারে। ম্যাপ দেখে মোটামুটি পছন্দসই জায়গা বের করে ফেলল রানা। সাত মিনিট পর মেঘ ফুঁড়ে নেমে এল ওরা ছাগল-চরা একটা সবুজ মাঠে। কাছাকাছিই রাস্তা দেখা যাচ্ছে একটা।
‘লোকজন জড়ো হওয়ার আগেই ঝটপট নেমে পড়ো, গিলটি মিয়া। জবাবদিহি করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে।’
হেলিকপ্টার থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে উঠে এল ওরা রাস্তায়। হাঁটতে শুরু করল দ্রুতপায়ে। মাইল তিনেক হাঁটার পর অপেক্ষাকৃত ধীর করল হাঁটার গতি। আরও কিছুক্ষণ চলার পর পেছনে এঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেল রানা।
‘গাড়ি আসছে, দেখা যাক লিফট পাওয়া যায় কিনা।’
পাঁচ মিনিট পর দেখা গেল মস্ত এক টস্পক আসছে। কাছে আসতেই হাত তুলে থামবার ইঙ্গিত করল রানা। থেমে দাঁড়াল টাক, জানালা দিয়ে গোলগাল হাসি-খুশি মুখ বের করে মাথা ঝাঁকাল ড্রাইভার।
‘সেন্ট মরিয পর্যন্ত লিফট দিতে পারবে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘উঠে পড়ো।’ পাশের দরজাটা খুলে দিল ড্রাইভার।
ওই পাহাড়ের ধারে একটা হেলিকপ্টার দেখতে পেয়েছে ড্রাইভার, সেই গল্প শোনাতে শোনাতে নিয়ে এল রানাদের সেন্ট মরিয়ে। একবারও তার সন্দেহ হলো না ওই হেলিকপ্টারের সাথে এই বিদেশীদের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে। মেইন রোডে নেমে পড়ল ওরা ধন্যবাদ জানিয়ে।
চলতে চলতে একটা রেস্তোরাঁর দিকে চেয়ে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল গিলটি মিয়া।
‘কিচু খেয়ে নিলে হয় না, স্যার?’
‘সময় নেই, গিলটি মিয়া। টেনে যদি রিফ্রেশমেন্ট কার থাকে তাহলে দেখা যাবে। পা চালাও এখন।’
স্টেশনে গিয়ে জানা গেল আগামী পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে কোন টেস্ন নেই। একগাল হাসল গিলটি মিয়া।
‘এবার তাহলে কিচু…’
‘নষ্ট করবার মত একটা সেকেণ্ডও নেই আমাদের হাতে, গিলটি মিয়া,’ বলল রানা। ‘সিলভিও ওই ফার্ম-হাউসে বসে বসে আঙুল চুষবে না। এতক্ষণে নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘনিয়ে তোলার ব্যবস্থা করে ফেলেছে ব্যাটা। হাল ছাড়বে না সহজে। আর কোনও আক্রমণের সুযোগ দিতে চাই না আমি ওকে, হাত ফস্কে বেরিয়ে যেতে চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। চলো, একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখা যাক। রওনা হবার আগে খাবার কিনে নেব আমরা। পথ চলতে চলতে খাওয়া যাবে।’
দ্বিগুণ ভাড়া দেয়ার প্রস্তাব করায় শেষ পর্যন্ত রাজি হলো রেন্ট- এ কার ম্যানেজার। বিশ মিনিটের মধ্যে একটা কালো সিট ডি. এস-এর পেটস্ল ট্যাংক ভর্তি করে নিয়ে, এবং অতিরিক্ত সাবধানতার খাতিরে গোটা দুই দু-গ্যালনী টিনে পেটস্ল ভরে নিয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা জুরিখের পথে।
‘কতক্ষুণে পৌঁচব, স্যার?’
‘রাত সাড়ে আটটার আগে না,’ বলল রানা। ‘দেড়শো মাইল যেতে হবে গাড়ি চালিয়ে।’
দশ মিনিটের মধ্যে সিলভাপ্পানা পৌঁছে ডান দিকে মোড় নিল রানা, ছুটল ফুল স্পীডে। মাথার মধ্যে একই স্পীডে চিন্তা চলেছে ওর। বুঝতে পারছে সে, এয়ারপোর্টে শেষ চেষ্টা করবে সিলভিও। একবার লণ্ডনের পথে রওনা হয়ে যেতে পারলে রানাকে আর কিছুতেই ঠেকাতে পারবে না ওরা। কাজেই সব রকম চেষ্টা করবে সে যাতে নোটবই নিয়ে কিছুতেই প্লেনে উঠতে না পারে ও। কিছু একটা কৌশল চিন্তা করে বের করতে হবে ওর যাতে ধোঁকা দেয়া যায় সিলভিওকে। অবশ্য কোনরকম গোলমাল না-ও হতে পারে। ওরা যে জুরিখের দিকে চলেছে সেটা সিলভিওর পক্ষে জানা সহজ নয়। ও হয়তো মনে করবে মিলানো গিয়ে প্লেন ধরবার চেষ্টা করবে রানা। তবু সাবধান হতে হবে। চিঠিতে অনিল লিখেছিল, সব সময় মনে রাখবে, সারা ইউরোপে ওদের লোক আছে…প্রত্যেক দেশে রয়েছে নেট-ওঅর্ক…যমের মত ভয় করে ওদেরকে সবাই। কোসা নোস্ট্রার প্রচণ্ড ক্ষমতা সম্পর্কে রানা নিজেও পূর্ণ ওয়াকিফহাল। ওদের দক্ষতাকে হেয় করে দেখবার ধৃষ্টতা ওর অন্তত নেই।
চল্লিশ মিনিট পর কয়ের শহরে ঢুকল রানা, শহর এলাকা ছাড়িয়ে এসে আবার বাড়াল স্পীড। এবার ছুটেছে ওরা সারগানের দিকে। খাবারের প্যাকেট খুলল গিলটি মিয়া, গপাগপ গিলতে শুরু করল একটার পর একটা স্যাণ্ডউইচ। রানাও খেল কয়েকটা। কিন্তু মাইল দশেক গিয়েই চমকে উঠল রানা হঠাৎ। অদ্ভুত ধরনের আওয়াজ হলো এঞ্জিনে। গাড়ির গতি কমে আসছে।
পেট্রল গজের দিকে চেয়ে দেখল রানা। নাহ্ পেট্রল তো প্রচুর রয়েছে। দশ গ্যালন পেট্রল ভরিয়েছে সে সেন্ট মরিযে। তাহলে এত চমৎকার টিউন করা এঞ্জিন হঠাৎ গোলমাল শুরু করল কেন? ‘কি হলো, স্যার? থামচেন কেন?’
‘থামছি না। থেমে যাচ্ছে।’
গাড়িটা কিনার করে রেখে বেরিয়ে পড়ল রানা দরজা খুলে। প্রথমে এঞ্জিনের বনেট খুলল সে, তারগুলো পরীক্ষা করে দেখল, তারপর বুঝল কারবুরেটার না খুললে বোঝা যাবে না ব্যাপারটা। বুট থেকে টুল-কিট বের করে নিয়ে এল।
তিন মিনিটের মধ্যে টের পেল রানা গোলমালটা কোথায়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল ওর রাগে।
‘হারামীর বাচ্চারা পানি মিশিয়ে দিয়েছে পেট্রলে!’
‘সব্বোনাশ! একোন উপায়?’
‘চার গ্যালন পেট্রল আছে টিনে,’ বলল রানা। ‘ট্যাংকের পানি ফেলে দিয়ে…’
‘ঠিক বলেচেন!’ ছুটে গিয়ে টিন দুটো নিয়ে এল গিলটি মিয়া। ট্যাংকের তলা থেকে নাট খুলে সব পানি ঝরিয়ে দিল রানা রাস্তার উপর। নাটটা লাগাতে লাগাতে গিলটি মিয়াকে বলল, ‘ঢালো পেট্রল ট্যাংকের ভেতর।’
একটা টিনের মুখ খুলে নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে দেখল গিলটি মিয়া। ভ্রূ জোড়া কপালে উঠল ওর।
‘পেট্টল কোতায়, স্যার! এর মদ্যেও তো পানি!’
মুখটা কালো হয়ে গেল রানার। ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল গাড়ির নিচ থেকে।
সত্যিই! পরীক্ষা করে দেখল রানা, টিনের মধ্যে পরিষ্কার কলের জল।
.
‘বাহ্! ভাল ঘোল দিয়েচে শালারা!’ প্রশংসা না করে পারল না গিলটি মিয়া। ‘এঁটকে দিয়েচে রাস্তার মধ্যে। কিন্তুক একোন একটা ব্যবস্তা তো করা দরকার। কি করা যায়, স্যার? পেট্টল লিয়ে আসব?’ টিন থেকে পানি ঢেলে ফেলতে শুরু করল সে।
‘পারবে তুমি?’ দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘কি যে বলেন, স্যার! আপনি হুকুম করলে পুরো পেট্রল পামটা বেচে দিয়ে আসতে পারি আরাকজনের কাচে। পারি না কি! আদ ঘণ্টা, বড়জোর এক ঘণ্টা, লিয়ে আসচি আমি পেট্রল।
মাথা নিচু করে এপাশ-ওপাশ নাড়ছিল রানা, নিজের বোকামির জন্যে মনে মনে গাল দিচ্ছিল নিজেকে। পেট্রল ভরবার সময় একটু যদি খেয়াল করত তাহলে এখন এই অবস্থায় আটকে বসে থাকতে হত না রাস্তায়। অন্তত একটি ঘণ্টা পিছিয়ে গেল সে এখন। গাড়িটা এখানে ছেড়ে দিয়ে আর কোন গাড়িতে লিফট নেয়ার চেষ্টা করবে? না। তাতে আরও দেরি হয়ে যাবে জুরিখে গিয়ে পৌঁছতে। ঝট করে মাথা তুলল সে।
‘কোথায় যাচ্ছ পেট্রল আনতে?’
‘মাইল দশেক আগে একটা পেট্রল পাম দেকেছিলুম, স্যার। ওকান থেকেই ভাবচি…’
‘যাবে কি করে?’
‘ঠ্যাঙা দেকিয়ে চলে যাব, স্যার। ঠ্যাঙা দেকালেই পৌঁচে দেয় এদেশে যে কোন ডাইবার। মন খারাপ করে কোন লাভ নেই, স্যার, আমি রওনা হয়ে যাই, বেশি দেরি হবে না।’
‘দাঁড়াও, গিলটি মিয়া। অত তাড়াহুড়ো করো না। তাড়াহুড়ো করে একবার ভুল করেছি, আর ভুল করতে চাই না। কারও গাড়িতে যদি লিফট নিতে চাও এইখান থেকে সেটা সবচেয়ে সুবিধে হবে। এইখানে দাঁড়ালে যে-কোন দিক থেকে যে-কোন গাড়ি আসুক না কেন ভদ্রতার খাতিরে লিফট দিতে বাধ্য হবে।’
‘ঠিক বলেচেন, স্যার,’ এক কথায় রাজি হয়ে গেল গিলটি মিয়া।
‘আর একটা কথা, কি আশ্চর্য দ্রুত কাজ করেছে ওরা খেয়াল করেছ?’
‘করেচি, স্যার,’ একগাল হাসল গিলটি মিয়া। ‘অনেকটা আপনার মতই ঝটপট ওদের কাজ-কম্মো। তাজ্জব কারবার! এইটুকু সোমায়ের মদ্যেই গুবলেট করে দিলে পেট্রোলের মদ্যে।’
‘যেখানে পেট্রল আনতে যাচ্ছ, সেখানেও গুবলেট করে রেখেছে কিনা কে জানে?
‘রেকেচে, স্যার। আমি জানি। ধরে লিচ্চি, রেকেচে। তাই তোয়ের হয়েই যাচ্চি। ধানাই-পানাই আমার কাচে খাটবে না। কান খাড়া করল গিলটি মিয়া একটা গাড়ির এঞ্জিনের শব্দে।
‘ঠিক আছে। এই গাড়িতেই তুলে দিচ্ছি তোমাকে। খুব সাবধান থাকবে। আমি এদিকে কার্বুরেটার পরিষ্কার করে সবকিছু চেকআপ করে নিয়ে পাহারা দিই গাড়িটা।
রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াল রানা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও থামতে হলো ওপেলটাকে, না থামলে চাপা দিতে হয় রানাকে। ধুমসো মোটা এক লোক বিরক্ত ভঙ্গিতে চোখ-মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে।
‘পেট্রল ফুরিয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়েছি। দয়া করে আমার এই সঙ্গীকে পাম্প পর্যন্ত একটু পৌঁছে দেবেন?’
সাহায্যের আবেদন এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই দেখে রেগে গেল লোকটা। আপনমনে গজ গজ করল গাড়িতে ওঠার সময় কেন মানুষের হুঁশ থাকে না সে-সম্পর্কে, শেষ পর্যন্ত পাশের দরজা খুলে দিল। ধন্যবাদ দিয়ে এঞ্জিনের পিছনে লাগল রানা, গিলটি মিয়া উঠে পড়ল গাড়িতে দু’হাতে দুটো খালি টিন নিয়ে।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ফিরে এল গিলটি মিয়া পেট্রল পাম্পের ব্রেক-ডাউন ভ্যানে চড়ে। খুশি হয়ে উঠল রানা। আশ্চর্য লোকটা! এই বিদেশে কারও কথার একবিন্দু বোঝে না গিলটি মিয়া, ওর একটি কথাও বোঝে না কেউ, তবু দিব্যি কাজ চালিয়ে নিচ্ছে সে আকারে ইঙ্গিতে।
কিন্তু আকার-ইঙ্গিতের ধরন দেখে চমকে উঠল রানা। ড্রাইভিং সীটে বসা লোকটার পেটে খোঁচা দিল গিলটি মিয়া ওর ভয়ঙ্কর-দর্শন খেলনা পিস্তল দিয়ে। ভয়ে ভয়ে নেমে এল একজন ঢোলা জামা-কাপড় পরা শুকনো লম্বা নিষ্ঠুর চেহারার লোক।
‘কি ব্যাপার, গিলটি মিয়া?’ প্রশ্ন করল রানা।
‘বলচি, একটু দাঁড়ান, স্যার।’ পিস্তল দিয়ে এই গাড়ির পেটস্ল ট্যাংকের দিকে ইঙ্গিত করল সে লম্বা লোকটাকে। ‘হাঁ করে কি দেকচিস, হারামজাদা, ঢাল্ পেট্রোল যা আচে! একেবারে টই-টুম্বুর করে দিবি।’
লোকটা একবার রানা এবং গিলটি মিয়ার মুখের দিকে চেয়ে নিয়ে পাইপ লাগাল সিট্রনের ট্যাংকের মুখে। খুশি হয়ে রানার দিকে ফিরল গিলটি মিয়া।
‘এ শালা খুব হারামী, স্যার। অ্যা…ত বড় এক যন্তোর লিয়ে মারতে উটেচিল আমাকে। প্রথম বলে; বনদো হয়ে গেচে দোকান। আমি বললুম দে বাবা, বিপদে পড়েছি, একটু নাহায় সাহায্যই কর্। না। পচন্দ হলো না কতাটা। পোঁদ ঘুরিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকল গ্যারেজে। বুজলুম, সিদে আঙ্গলে ঘি উটবে না। কেমন একটু সন্দো হলো, গেলুম পিচু পিচু। ও বাবা! সাঁই করে চালাল যন্তোরটা মাতা সই করে। বাউলি কেটে সরে গেলুম। তারপর বের করলুম পেস্তলটা। এটা দেকেই শালার চকু চড়কগাচ! একেবারে ঠাণ্ডা। ফিরিজের পানি। টিন দুটো ভরে দিতেই এই পিচ্চি-লরীতে পেট্রোল ভরতে বললুম। ভাবলুম, আপনার সাথে এ লোকের আলাপ করিয়ে দোয়া দরকার। তাই ওরই গাড়িতে করে লিয়ে এলুম শালাকে আপনার কাচে। এবার কতা বলুন ওর সাতে, আমি টিন দুটো নামাই।’
ব্রেক-ডাউন ভ্যানের ট্যাংক থেকে অর্ধেকের বেশি পেট্রল চলে এল সিট্রনের ট্যাংকে। পাইপটা বের করে নিয়ে ট্যাংকের মুখ লাগাচ্ছে লোকটা, ভয়ে ভয়ে চাইছে গিলটি মিয়ার দিকে। ওর সামনে এসে দাঁড়াল রানা।
‘আমাদের কাছে পেট্রল বিক্রি না করার হুকুম পেয়েছ?’
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল লোকটা।
পিস্তলটা বের করল রানা, কিন্তু ততটা ভয় পেতে না দেখে খটাং করে লাথি মারল সে লোকটার হাঁটুর ছয় ইঞ্চি নিচে। ‘কেঁউ’ করে আর্তচিৎকার দিয়ে পা ভাঁজ করে চেপে ধরল লোকটা ব্যথার জায়গা।
‘উত্তর দাও!’ গর্জন করে উঠল রানা। ‘আমরা বেপরোয়া লোক। খুন করতে বাধবে না!’
‘টেলিফোন করেছিল আমার কাছে ওরা,’ বলল লোকটা। ‘তেল দিতে বারণ করেছিল?’
‘হ্যাঁ। আর বলেছিল সম্ভব হলে যে-কোন রকম গোলমাল বাধিয়ে দেরি করিয়ে দিতে।’
‘কতক্ষণ আগে ফোন পেয়েছ?’
‘ঘণ্টাখানেক আগে।’
ভিতর ভিতর ভয়ানক বিচলিত হয়ে উঠল রানা খবরটা শুনে। তার মানে সিলভিও জানে ওরা কিসে করে কোনদিকে চলেছে। শুধু এয়ারপোর্টেই নয়, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স বা জার্মান বর্ডারেও ফাঁদ পাতা থাকবে ওদের জন্যে। পালাবার সব পথ বন্ধ করে দিয়ে তাড়া করে ধরা হবে ওদের এবার। এদেশেও পেট্রল চুরির দায়ে পুলিস লাগাবে নাকি ওদের পেছনে!
পেট্রলের দাম বাবদ যথেষ্ট পরিমাণ ইটালিয়ান কারেন্সি গুঁজে দিল রানা লোকটার হাতে।
‘শোনো,’ বলল রানা। ‘কোসা নোস্ট্রার দুই দলের মধ্যে গোলমাল লেগেছে। এর সাথে নিজেকে জড়াতে গেলে মারা পড়বে যে-কোনও দলের হাতে। পাম্প বন্ধ করে বাড়ি চলে যাও। মুখ থেকে একটা কথা বের করলেই খুন হয়ে যাবে। আমার আরও লোক আসছে সেন্ট মরিয থেকে। সাবধান! ভাগো এখন।’
ভ্যানটা ঘুরিয়ে নিয়ে তুফান বেগে রওনা হয়ে গেল লোকটা। রানা উঠে পড়ল সিট্রনের ড্রাইভিং সীটে।
সারাগানস পেরিয়ে ওয়ালেনস্টাডের দিকে রওনা হলো স্ট্রিন ডি. এস.। পুরো একটা ঘণ্টা নষ্ট হয়ে গিয়েছে পেট্রলের গোলমালে, সেটা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে রানা বিপজ্জনক ভাবে গাড়ি চালিয়ে। অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে হাঁপিয়ে উঠল গিলটি মিয়া। খানিক উসখুস করে আপন মনে কথা বলতে শুরু করল।
‘কিন্তুক এই দেরি করিয়ে দিয়ে লাব কি ওদের?’
‘আমাদের যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে অভ্যর্থনার জন্যে প্রস্তুত হতে হবে না ওদের?’ বলল রানা। ‘একটা ঘণ্টা অনেক সময়। এতক্ষণে তৈরি হয়ে গেছে ওরা। মুশকিল হচ্ছে আমরা কোন্ পথে কোন দিকে চলেছি জানা আছে ওদের, কিন্তু আমরা ওদের কোন খবর পাচ্ছি না।’
‘ঠিক বলেচেন। কি মতলব ঠাউরেচে টের পাওয়া যাচ্চে না। পথেই এঁটকে দোয়ার ব্যবস্তা করেচে কিনা জানা নেই আমাদের। আমি ভাবচি কি, পেলেনে আমাদের যাওয়ার দরকার কি? যে- কোন একটা বডারের দিকে রওনা দিলে কেমন হয়?’
‘অসুবিধে আছে। এই ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে আমরা যা খুশি তাই করতে পারি না। তাছাড়া অত ঝুঁকি না নিয়ে জুরিখেই যদি ওদের কোন কৌশলে ফাঁকি দিতে পারি তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়। দেখা যাক, একটা না একটা বুদ্ধি এসে যাবে মাথায়, যাতে সময়ও বাঁচবে, পরিশ্রমও বাঁচবে।
ওয়ালেন লেক ছাড়িয়ে এসেছে ওরা বেশ কিছুক্ষণ হয়, দূরে টলটলে পানিতে আলোর প্রতিবিম্ব দেখে রানা বুঝল এসে গেল জুরিখ লেক। আর পঁচিশ মাইল। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় পথে আক্রমণ আসবার সম্ভাবনা কমে গেছে বেশ খানিকটা। লেকের ধার ঘেঁষা রাস্তা দিয়ে ঘণ্টায় সত্তর মাইল বেগে ছুটছে ওরা। হঠাৎ কথা বলে উঠল রানা।
‘একটা বাঙালী হোটেল চিনি আমি। ওখানেই উঠব আপাতত। তারপর দেখা যাবে কি করা যায়।’
‘এই গাড়িটা হোটেলের সামনে দেকলে বুজে নেবে ওরা কোথায় উটেচি আমরা।’
‘এটাকে ইউরোপা হোটেলের সামনে ছেড়ে দেয়ার কথা আছে রেন্ট-এ কার কোম্পানীর ম্যানেজারের সাথে। সেটা করতে যাওয়া আমাদের জন্যে বিপজ্জনক হবে। যে কোন একটা হোটেলের সামনে ছেড়ে দেব, খুঁজে নিক ওরা। পায়ে হেঁটে চলে যাব আমরা প্যালেস হোটেলে।’
জুরিখ পৌঁছে ঘড়ি দেখল রানা। রাত নয়টা। আধ ঘণ্টা পুষিয়ে নিয়েছে সে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে আধ মাইল হেঁটে প্যালেস হোটেলে গিয়ে হাজির হলো ওরা। ধূলি-মলিন জামা-কাপড় দেখে রিসেপশন-ক্লার্ক প্রথমটায় তেমন আমল দিতে চাইল না। ম্যানেজারের সাথে দেখা করার প্রস্তাবে একটু সচকিত হলো। রানা যখন বলল, এই হোটেলের মালিকের সাথে সে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত, তখন ব্যস্ত-সমস্ত ভঙ্গিতে নিয়ে গেল ওদেরকে ম্যানেজারের বন্ধ দরজার সামনে। চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ভয়ানক রাগী লোক, স্যার! আপনারাই ঢুকুন।’
বিরাট একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে সুইভেল চেয়ারে বসে কাগজপত্র ঘাঁটছে ধোপ দুরস্ত জামাকাপড় পরা একজন প্রকাণ্ড লম্বা চওড়া লোক। রানাকে ভ্রূ কুঁচকে দেখল আপাদমস্তক। কিন্তু গিলটি মিয়ার দিকে চোখ পড়তেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকটা। কপালে উঠেছে ওর ভুরু জোড়া।
‘আমনে! উস্তাদ! আমনে কৈথন!’
‘কে! লেদু না? লাম্বা আহাম্মুক!’ হাসি ফুটে উঠল গিলটি মিয়ার ঠোঁটে। ‘তুই কি করচিস এখেনে?’
প্রকাণ্ড টেবিল ঘুরে এসে একেবারে পায়ে হাত দিয়ে সালাম শুরু করল ঝাড়া ছ’ফুট লম্বা লোকটা গিলটি মিয়াকে। উঠে দাঁড়ালে আর নাগাল পাবে না, তাই বাঁকা থাকতে থাকতেই চট করে থুতনি ধরে আদর করল গিলটি মিয়া ওকে।
বসল সবাই। একগাল হাসল গিলটি মিয়া।
‘কতদিন দেকা নেই! জেল থেকে বেরোলি কবে?’ রানার দিকে ফিরে বলল, ‘আমার স্যাঙাৎ, স্যার।’
‘কি কমু, উস্তাদ! দুষ্কের কতা কি কমু। স্বাদীনতার লগে লগেই দ বাইরোয়া পরছিলাম। কই যাই ভাবতাছি, ইমুন সময় কানডা চাইপণ্ডা দরল আমার চাচায়। আইন্যা ফালাইল এই ফডোলে। কয়, দেহি কত চুরি করবার পারস। পরথম তিনডা মাস বুক বাসাইয়া কানলাম, উস্তাদ। তারপর শুরু করলাম। তিনডা বছরে, উস্তাদ, থুই নাই কিসু। সুইস ব্যাঙ বইরা ফালাইবার দশা করছিলাম, অহন হুনি আমার নামেই লেইখ্যা দিতাসে চাচায় এই ফডোল। হালার মাইয়াডারে আবার বিয়া কইরা ফালাইসি দ!’
‘বিয়েও করে ফেলেচিস! বাহ! তাইলে তো বেশ সুকেই আচিস মনে হচ্চে।’
‘না, উস্তাদ। দ্যাশের লাইগ্যা পরানডা পুরে! যাউগ গা, আমনের খবর কন। ইয়ানো ক্যামনে কৈথন আইলেন?’
‘সে অনেক হিস্টিরী। অত কতা বলবার সোমায় নেই। অল্প কিছুক্ষণ আচি। চলে যাব আজই। আমাদের পেচনে আবার বাজে লোক লেগে আচে। ওদের চোক ফাঁকি দিয়ে আজই পালাতে হবে আমাদের।’
‘আমি থাকতে আর কুনো চিন্তা নাই, উস্তাদ। কি লাগবো খালি হুকুম করবেন, আইন্যা হাজির করুম।’
রানার দিকে ফিরল গিলটি মিয়া।
‘কি কি লাগবে বলে ফেলুন, স্যার। ছেলেটা ভাল। সাদ্য মতো করবে।’
‘আপাতত একটা রূম দরকার। আধ ঘণ্টার মধ্যে রূমে বসে আমরা খেয়ে নিতে চাই। আর, কেউ আমাদের কথা জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে যে আমরা এই হোটেলে উঠিনি। ব্যস, এই।’
‘এইডা কুনো কাম অইলো, স্যার? কি মুসিবতে পরছেন, আমি কি সাইয্য করার পারি, হেইডা না কইবেন।’
‘ও ব্যাপারে আপনার কিছুই করবার নেই,’ বলল রানা। ‘কোসা নোস্ট্রা।’
‘সারসে! আই সব্বোনাশ! এইডা কি কন!’ ফ্যাকাসে হয়ে গেল ম্যানেজারের মুখটা। ‘হ্যাগোর লগে বাইজ্যা বইসেন! ঠাইট মাইরা লাইব দ।’
‘সেইজন্যেই আপনাকে এর মধ্যে জড়াতে চাই না। রিসেপশন ক্লার্ককে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে আপনি নিজে যদি আমাদেরকে ঘরে পৌঁছে দেন তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়।’
‘একশৎ বার। আমনেরা বয়েন, আমি নিজে গিয়া হ্যারে কইয়া আহি আগে।’
ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে একটুও ভুল করেনি লোকটা। দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
‘গুরুভক্তির নমুনা দেকে তো মনে হয় যেটুকু কাজ দোয়া হয়েচে ঠিক ঠিকই করবে। কিন্তুক বে-থা করে সংসারিক হয়েচে একোন, ওকে এসবের মদ্যে না জড়িয়ে ভালই করেচেন, স্যার।’
টেবিলের উপর থেকে টেলিফোন ডাইরেক্টরীটা টেনে নিয়ে এয়ারপোর্টের নম্বর বের করল রানা। রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করল। জানা গেল, লণ্ডনের দুটো ফ্লাইট আছে আজ- একটা সাড়ে এগারোটায়, অপরটা রাত দেড়টায়।
লম্বা পা ফেলে ঘরে এসে ঢুকল লেদু।
‘আহেন আমার লগে। খারোন, এই দরজাটা দিয়া লই।’ ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ডাকল, ‘আহেন। এই দিক দা।’
একটা সাইড ডোর দিয়ে বের করে নিয়ে এল ম্যানেজার ওদের নির্জন করিডরে, কয়েক পা এগিয়ে লিফট। লিফট এসে থামল পাঁচ তলায়। লম্বা করিডর ধরে এগিয়ে চারশো ছেচল্লিশ নম্বর কামরায় চাবি লাগাল ম্যানেজার। ঘর খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘খানা কি খাইবেন, উস্তাদ? দেশী না বিদেশী?’
‘দেশী, দেশী!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল গিলটি মিয়া। ‘সবচে ভাল হয় যদি ডাল, ভাত, আলুভত্তা আর কাঁচামরিচের ব্যবস্তা করতে পারিস।’
হাসল ম্যানেজার। মাথা নাড়ল।
‘উস্তাদের ডাইল খাওনের শখ রইছে দেহি অহনও? কিন্তুক ফিডাইয়া মাইরা লাইব আমারে বউয়ে যদি হুনে উস্তাদেরে ডাইল- বাত খাওয়াইয়া বিদাই দিসি। বড় ডরাই হুযুর, অরে খবর না দিলে জবর গোশ্শা অইব। ডাইলের কতা কমুনে, বাকিডা হ্যার হাতেই ছাইরা দেই, কি কন?’ রানার দিকে ফিরল, আর আমনেরে কি খাতির করুম, স্যার? কি খাইবেন?’
‘আমাকে বিশেষ কোন খাতির করতে হবে না,’ মৃদু হাসল রানা। ‘এক খাতিরেই আমাদের দু’জনের হয়ে যাবে। তবে খাতিরটা একটু তাড়াতাড়ি করুন। সাড়ে এগারোটার ফ্লাইটে লণ্ডনের প্লেন ধরবার চেষ্টা করব আমরা।’
ব্যস্তসমস্ত হয়ে চলে যাচ্ছিল ম্যানেজার, হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
‘আমনেরে কি নামে খুজ করব হ্যারা এইডা দ জিগান হয় নাই?’
‘মাসুদ রানা।’
দুই চোখ কপালে উঠল ম্যানেজারের।
‘হাইরি সব্বোনাশ! আমনেই হেই মাসুদ রানা সায়েব! কি খুশির দিন রে! কী সৌবাইগ্য আইজ আমার! কার মুখ দেইখ্যা উটছিলাম আইজ ঘুম থেইক্যা। এই বিদ্যাশে হটেশ আইসা হাজির আইজ আমার ওস্তাদে, আর তিন বছর দইরা বিয়ান হাইঞ্জা বেলা যার নাম হুনতাছি হউরের মুখে, দেহা তার আইজই পাইলাম! কী আচাইয্য! অক্ষণে ফাল দিয়া আয়া পরব চাচায় খবর হুনলে। আমনেই না বাচাইছিলেন হ্যারে ডামুইডিয় ডাহাইতের হাত থন?’
‘পা কি ভাল হয়ে গেছে ওর?
‘না, স্যার। ডাইন ফাওড়া কাইট্টা লাইসে। কাডের ফাও দা আছে।’
ঘড়ি দেখল রানা।
‘আমরা কাদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি বলেছি আপনাকে। আমাদের উপস্থিতিটা যত কম জানাজানি হয় ততই ভাল। বুঝতে পেরেছেন?’
‘বুঝলাম। খামোশ খায়া থাহন লাগব। আইচ্চা, কবুল। আমনেরা জিরাইয়া লন, আমি খাওনের বন্দোবস্তড়া করি।’
ম্যানেজার বেরিয়ে যেতেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাথরূমে গিয়ে ঢুকল রানা। সেই পুরানো জামাকাপড়ই পরতে হলো, কিন্তু দাড়ি কামিয়ে, দাঁত মেজে, স্নান সেরে নতুন গেঞ্জি ও জাঙ্গিয়া পরে রীতিমত আরাম বোধ করল সে। বেরিয়ে এসে নরম বিছানায় শুয়ে সিগারেট ধরাল। গিলটি মিয়া গিয়ে ঢুকল বাথরূমে।
গত কয়েকদিনের পরিশ্রমের পর নরম বিছানা পেয়ে দু’চোখ ভেঙে ঘুম আসতে চাইছে রানার। চোখ লেগে আসছিল, এমনি সময়ে খুট করে বাথরূমের দরজা খুলে গিলটি মিয়া বেরিয়ে এল। কেটে গেল তন্দ্রার ভাবটা। খাট ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করল সে।
আশ্চর্য করিৎকর্মা লোক লেদু। আধঘণ্টার মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে দু’জন বেয়ারার হাতে মস্ত দুটো ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে হাজির হলো। দরজায় টোকা দিতেই পিস্তল হাতে বাথরূমে গিয়ে দাঁড়াল রানা, গিলটি মিয়াকে ইঙ্গিত করল দরজা খুলে দেয়ার জন্যে। ম্যানেজার এসে ঢুকতেই পিস্তলটা যথাস্থানে গুঁজে বেরিয়ে এল বাথরূম থেকে।
বেয়ারাদের বিদায় দিয়ে দরজা লাগিয়ে এসে পরিবেশনে মন দিল ম্যানেজার।
এত রকমের ব্যঞ্জন দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল এর বেশির ভাগই তৈরি হয়েছে বাড়িতে। প্রথমে খুব খুশি হয়ে উঠল গিলটি মিয়া, তারপর গম্ভীর হয়ে গেল।
‘এটা কি করেচিস, লেদু? তোদের নিজেদের খাবার উটিয়ে লিয়ে এসেচিস নিচ্চয়? এত রান্না তো আদঘণ্টায় হয় না?’ হাত গুটিয়ে নেয়ার উপক্রম করল সে।
একেবারে মোক্ষম অস্ত্র ছাড়ল লেদু।
‘আমার লগে তেরিবেরি খাটব না, উস্তাদ। আমনে অহন খাওন বন্দ করলে তিন দিন আমি কিছু খামু না কইয়া দিলাম আল্লার কসম! আমি জবান লারি না, আমনে দ জানেন। পরাজিত ভঙ্গিতে আবার খাওয়ায় মন দিতে দেখে বলল, ‘আমি শুদু কইসি আমার মইদ্যে যেটুকু বুরা দ্যাহ, হেইটুক আমার বাপ- চাচার থন পাইসি; আর যেটুকু বালা দ্যাহ, হেইটুক দিসে আমার উস্তাদে। বাস, আর কিচ্ছু কওন লাগে নাই। যুর কইরা যা আছিল সব তুইলা দিছে বউয়ে। হেতিয়ে কয়, আবার ফাক করতে নাই দুইগণ্টা দেরি অইব, যা আছে লইয়া যাও স্বপনের বাপ…’
খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনর্গল গল্প করল ধোপ-দুরস্ত বিদেশী কাপড় পরা ম্যানেজার খাস দেশী বাংলায়। এটা ওটা তুলে দিল, না খেতে চাইলে ঝগড়া করল। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে আসতেই পাড়ল আসল কথা।
‘একজনে আইছিল, স্যার। জিগায়া গেছে আমনেগো কতা।’
‘কখন এসেছিল?’
‘এই দশ-পনেরো মিনিট অইব। কেরানী কইছে, না, এই ফডোলে উডে নাই হ্যারা। কিন্তুক বিশ্বাস যায় নাই। রেসটি খুইলা দেইখা তারপর গেছে।’
‘চেহারার বর্ণনা দিতে পারবেন?’
‘বাইঠা। মোড়া। কালা স্যুট আছিল পরনে। ইডালীর লোক বইলা মালুম হয়।’
‘গীয়ান!’ গিলটি মিয়ার দিকে চেয়ে বলল রানা। ‘তার মানে জুরিখে পৌঁছে গেছে সিলভিও দলবলসহ।’
একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরময় বার দুই পায়চারি করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রানা। ফিরল লেদুর দিকে।
‘এখান থেকে ইণ্ডিয়ান কনসুলেট কতদূর?’
‘আদা মিনিটের রাস্তা,’ বলল ম্যানেজার। ‘বাইরোইয়াই বাও দিকে গেলে ছয়-সাত বিল্ডিং পার অইলে ছাতের উপর ফেলেগ দেহা যাইব। ঈড়াই।’
‘ভেরি গুড। দশ মিনিট একা থাকতে চাই আমরা। তারপর এই হোটেলের পিছন দিয়ে বেরোবার কোন রাস্তা থাকলে সেই পথে বেরিয়ে যেতে চাই।’
‘একশ বার,’ বলল ম্যানেজার। টিপ দিল কলিং বেলে। ‘আমি নিজে রাস্তা দেহাইয়া দিমু।’
দুই বেয়ারার সাহায্যে এঁটো থালা বাসন নিয়ে চলে গেল সে। দরজা লাগিয়ে দিল গিলটি মিয়া।
‘কনসুলেটের কতা জিজ্ঞেস করলেন কেন? কি করবেন ভাবচেন, স্যার?’
‘একটা ধোকাবাজির প্ল্যান এসেছে মাথায়। দেখা যাক কাজে লাগে কিনা।’
নীল প্লাস্টিক মোড়া প্যাকেটটা বের করল রানা। ছোট্ট লাল বইটা বের করে রাখল জ্যাকেটের সাইড পকেটে। তারপর টেবিলের উপর রাখা একখানা স্ক্রিলিং-প্যাড থেকে গোটা বিশেক কাগজ খসিয়ে নিয়ে চারভাঁজ করল। ওজনটা পছন্দ হলো না, পিস্তল থেকে একটা বুলেট বের করে গুঁজে দিল একটা ভাঁজে। এবার ইলাস্টিক ব্যাণ্ড মুড়ে রাখল ওটাকে নীল প্লাস্টিকের খোলের মধ্যে। আবার ওজন নিয়ে সন্তুষ্ট হলো। তারপর খস খস করে চিঠি লিখল একটা। সেটাকে খামে বন্দী করে খামের মুখ আঠা দিয়ে লাগিয়ে প্লাস্টিক-প্যাকেট আর চিঠিটা রেখে দিল বুক পকেটে। তারপর সিগারেটে লম্বা করে একটা টান দিয়ে হাসল।
‘ব্যাপারটা একটু বুজিয়ে দিন, স্যার। আমার মাতায় ঢুকচে না।’
টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার কানে তুলে নিল রানা।
‘আমি লেদু, স্যার।’ ম্যানেজারের কণ্ঠ ভেসে এল। ‘এটটু আগে আবোর আইছিল হেই গায়েন। মোডা লোকটা। ধমক দিয়া গেছে কেরানীরে। কয়, দুইজন টুরিসরে ঢুকতে দেহা গেছে এই ফডোলে।’
‘সে কি উত্তর দিয়েছে?’
‘হ্যায় কইসে বাইরোইতেও দেহা গেছে, তহন কি চক্ষু বুইজ্যা আছিলা? আইছিল, আমরা খেদায়া দিছি। ফহির মিসকিন আর টুরিসের লগে আমগোর কুনো খাতির নাই।’
‘ঠিক আছে। অনেক অসুবিধায় ফেললাম আপনাকে, কষ্ট দিলাম অনেক। এবার আমরা রওনা হতে চাই।’
‘ঈতান কইয়া আর শরম দিয়েন না, স্যার। আমি আইতাসি।’
রিসিভার নামিয়ে রেখে রানা বলল, ‘একে তো হোটেলের বিল দিতে যাওয়াটা উচিত হবে না, তাই না?’
‘না, স্যার। বেইজ্জত করা হবে অনেকটা।’
‘তাহলে এক কাজ করো,’ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল রানা। দশ-বারোটা পাঁচ হাজার লিরার নোট বের করে দিল গিলটি মিয়ার হাতে। ‘ওর ছেলে স্বপনকে কিছু কিনে দিতে বোলো।’
‘তাই ভাল, স্যার।’
‘আবার এসেছিল গীয়ান। আমার মনে হচ্ছে ইণ্ডিয়ান কনসুলেটে পৌঁছানো সহজ হবে না।’ দরজায় মৃদু টোকা পড়ল। সেদিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘দেখো তো কে?’
পিস্তল হাতে আবার বাথরূমে ঢুকল রানা। সাবধানে দরজা খুলে উঁকি দিল গিলটি মিয়া। ঘরে ঢুকল ম্যানেজার। বেরিয়ে এল রানা।
‘এবার আমরা যাব। কোন্ পথে নামতে হবে দেখিয়ে দিয়েই আপনার ছুটি।
‘কন কি, স্যার। আমনেগো পৌচ্চায়া দিয়া তারপর ছুড়ি।’
‘ওনার কতার ওপরে কতা বোলো না, লাম্বা আহাম্মুক!’ ধমক দিল গিলটি মিয়া। ‘নাও ধরো।’
নোট দেখে আঁৎকে উঠল লেদু। ‘এইডা কি করতাছেন, উস্তাদ!’
‘তোর জন্যে না রে, গাদা। এগুলো তোর ছেলের জন্যে। নে ধর্, কিচু কিনে দিস ওকে। খেলনা-ফেলনা যা তোর পচোন্দ হয় দিস।’ নোটগুলো জোর করে লেদুর হাতে গুঁজে দিয়ে রাকস্যাকের দিকে ফিরল গিলটি মিয়া।
‘ওগুলো থাক, গিলটি মিয়া, ও আর দরকার হবে বলে মনে হয় না।’
লিফটের মুখেই বিদায় নিল ওরা ম্যানেজারের কাছ থেকে। দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই নামতে শুরু করল লিফট। রানার দিকে ফিরল গিলটি মিয়া।
‘কিন্তুক ব্যাপারটা আমি ঠিক বুজতে পারচি না, স্যার। কনসুলেটে যাচ্চি কেন? আর যাচ্চিই যদি, এত আগে কেন? এয়ারপোর্টে রওয়ানা দোয়ার সোমায়…’
‘অনিল জানিয়েছে যত যাই ঘটুক না কেন রঞ্জন চৌধুরীর হাতে দিতে হবে আমার এই খাতাটা। কাউকে বিশ্বাস করতে বারণ করেছে। আমি করিও না। কিন্তু এমন ভান করতে চাই যেন খাতাটা আমি কনসালের হাতে তুলে দিচ্ছি। আসলে ওর ভিতর কি আছে তুমি তো জানোই! বিশেষ করে অনুরোধ করব আমি যেন এটা ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে করে খুবই গোপনীয়তা আর সাবধানতার সাথে রঞ্জন চৌধুরীর হাতে পৌঁছবার ব্যবস্থা করা হয়। আমার কথার ততটা গুরুত্ব না দিলেও একবার কলকাতায় রঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেই সতর্ক হয়ে যাবে কনসাল। আমার বিশ্বাস সিলভিওর লোক আছে ইণ্ডিয়ান কনসুলেটে। যত সাবধানই হোক না কেন খবরটা বেরিয়ে যাবেই। আমরা কনসুলেটে ঢোকার পর পরই খবর নেয়ার চেষ্টা করবে সিলভিও, কি করছি আমরা ওখানে। যেই জানবে যে একটা নীল প্লাস্টিক মোড়া প্যাকেট দিয়েছি আমরা কনসালকে, পেট চেপে ধরে হাসবে সে। কারণ ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ থেকে ওটা হাতানো ওর জন্যে ডালভাত। আমি আশা করছি, এই খবর জানার পর আমাদের পিছু ধাওয়া করা ছেড়ে দেবে সে, নিরাপদে উঠতে পারব আমরা প্লেনে। আমাদের সাথে ওর ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা নেই- ওর চাই শুধু প্যাকেটটা। আসল ব্যাপার টের পেতে পেতে আমরা ফুড়ুৎ করে উড়ে যাব নাগালের বাইরে।’
হেসে উঠল গিলটি মিয়া। ‘দারুণ বুদ্দি বের করেচেন, স্যার।’
‘এখন কনসুলেট পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে হয়।’
লিফট থেকে বেরিয়ে ম্লান-আলোকিত একটা চত্বর পেরিয়ে রাস্তার পাশের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা।
চাপা গলায় বলল রানা, ‘আমি দশ গজ এগিয়ে গেলে তারপর পিছু পিছু রওনা হবে তুমি।’
‘গুলিটা যাতে আপনার ওপর দিয়েই যায়, সেজন্যে?’
‘তর্ক কোরো না, গিলটি মিয়া। যা বলছি তাই করো। আর, যদি গুলি ছুঁড়তে হয়, চোখ সই করে মারবে।’
সাবধানে দরজা খুলে মাথাটা বের করল রানা বাইরে।
বেশ চওড়া রাস্তা। দূরে দূরে এক একটা ল্যাম্প পোস্ট ফুটপাথের খানিকটা অংশ আলোকিত করেছে। বাকি অংশ অন্ধকার। যে কোন সংখ্যক লোক বাড়িগুলোর গেটের পাশে, বাগানে, বা দরজার কাছে অন্ধকার ছায়ায় লুকিয়ে থাকতে পারে। আগে থেকে বুঝবার কোন উপায় নেই।
পিস্তলটা বের করে হাতে নিল রানা। দ্রুতপায়ে এগোতে শুরু করল দেয়াল ঘেঁষে।
একটা বাড়ির মাথায় ফ্ল্যাগ দেখতে পেল রানা। কাছেই। আর তিনটে বাড়ির পর।
চট করে ঘাড় ফিরিয়ে গিলটি মিয়াকে খুঁজল রানা। পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু ও জানে, কাছেই কোথাও আছে সে।
হঠাৎ রাস্তার অপর পাশে একটা বাড়ির দরজার সামনে ম্যাচ জ্বলে উঠল। কিন্তু সিগারেট না ধরিয়ে রাস্তার উপর ছুঁড়ে ফেলল লোকটা জ্বলন্ত কাঠি। 1
মুহূর্তে বুঝতে পারল রানা, এটা কোনও সংকেত। দৌড় দিল সে। পিছনে কোথাও মৃদু গর্জন করে স্টার্ট নিল একটা গাড়ির এঞ্জিন- স্পষ্ট শুনতে পেল সে। এগিয়ে আসছে।
গিলটি মিয়ার পায়ের শব্দ শুনতে পেল রানা পিছনে। দৌড়াচ্ছে সে-ও।
পিছনে গাড়ির এঞ্জিনের শব্দটা দ্রুত এগিয়ে আসছে, অনেক কাছে চলে এসেছে সেটা। হঠাৎ রানা বুঝতে পারল কনসুলেটে পৌঁছবার আগেই গাড়িটা ওভারটেক করবে ওকে।
পিছন ফিরে চাইল রানা।
কালো একটা গাড়ি ছুটে আসছে তীর বেগে। আলো নেভানো। রানা চাইতেই দপ করে জ্বলে উঠল চারটে হেডলাইট। মুহূর্তে চোখ ধাঁধিয়ে গেল রানার। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না সে আর চোখে। দেয়ালের গায়ে সেঁটে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা।
‘শুয়ে পড়ুনি, স্যার! গুলি করবে!’ গিলটি মিয়ার গলার আওয়াজ পেল রানা।
কড় কড় করে গর্জে উঠল একটা এল. এম. জি. গাড়ির ভিতর থেকে। গতি কমাচ্ছে গাড়িটা। ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে রানা ফুটপাথের উপর। ফুলঝুরির মত আলোর ফুলকি বেরোচ্ছে মেশিন গানের মুখ দিয়ে। পিছনের দেয়ালটা ঝাঁঝরা হয়ে গেল। গুলি করল রানা।
গাড়ির ভিতর আর্তনাদ করে উঠল একজন লোক। পরমুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠল আরেকজন। রানা বুঝল দ্বিতীয়জন চিৎকার করেছে গিলটি মিয়ার নিঃশব্দ গুলি খেয়ে। হঠাৎ গতি বেড়ে গেল গাড়িটার। সাঁ করে বেরিয়ে গেল সেটা, অদৃশ্য হয়ে গেল বাঁয়ে মোড় নিয়ে।
উঠে দাঁড়াচ্ছিল রানা, ঝপ করে শুয়ে পড়ল আবার। রাস্তার অপর পারে দরজার আড়ালে দাঁড়ানো লোকটা গুলি করল। রানার চামড়ার জ্যাকেটের খানিকটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেল গুলিটা কাঁধ ঘেঁষে।
গুলি করল রানা।
এলোমেলো পা ফেলে আলোকিত রাস্তায় বেরিয়ে এল একজন লোক, শরীরটা বাঁকা হয়ে আছে সামনের দিকে, চার-পাঁচ পা এগিয়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে।
গিলটি মিয়াকে দেখা গেল এবার, লম্বা পা ফেলে দৌড়ে আসছে এদিকে। এক লাফে উঠে দাঁড়াল রানা। প্রাণপণে ছুটল দু’জন কনসুলেটের গেটের দিকে।
দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল দু’জন। এমনি সময় দু’পাট খুলে গেল বন্ধ দরজাটা। স্টেনগান হাতে বেরিয়ে এল দু’জন প্রহরী।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা ও গিলটি মিয়া। মাথার উপর হাত তুলল রানা। দেখাদেখি গিলটি মিয়াও।
‘ব্যাপার কি? থার্ড ওয়ার্লড ও অর?’ প্রশ্ন করল একজন সিকিউরিটি গার্ড।
‘কনসালের সঙ্গে জরুরী দরকার আছে আমার,’ বলল রানা। ‘একটু আগে যে আওয়াজ পেয়েছেন, সেটা আমাকে খুন করবার একটা ব্যর্থ প্রয়াস। শিগগির ঘরের ভেতর ঢুকে না পড়লে আবার গুলি হবে।’ রাস্তার দিকে চেয়ে চঞ্চল হয়ে উঠল রানা। আসছে আবার গাড়িটা। ওটার মধ্যে থেকেই গুলি করা হয়েছিল।
‘আপনারা ভারতীয়? বাঙালী?’
‘বাঙালী, কিন্তু ভারতীয় নই, বাংলাদেশের লোক। তাড়াতাড়ি করুন, এসে পড়ল!’
তর্কের ভঙ্গিতে শুরু করল একজন, ‘বাংলাদেশের লোক হলে এই কনসুলেটে কেন? আপনাদের কনসুলেট…’
গতি কমে আসছে গাড়িটার। দ্বিতীয়জন বুঝতে পারল ব্যাপারটার তাৎপর্য। কিন্তু স্টেন গানের মুখটা সরল না।
‘জলদি ঢুকে পড়ুন!’
ঢুকে পড়ল রানা ও গিলটি মিয়া।
‘দরজার সামনে থেকে সরে যাও। গিলটি মিয়া। দেয়ালের আড়ালে!’ চাপা গলায় বলল রানা।
চট করে সরে গেল গিলটি মিয়া। রানাও সরল, এবং হ্যাঁচকা একটানে সরিয়ে আনল বোকা প্রহরীটাকে খোলা দরজার সামনে থেকে।
পরমুহূর্তে আবার গর্জে উঠল মেশিনগান। ক্ষিপ্ত বোলতার মত বোঁ বোঁ আওয়াজ তুলে একঝাঁক গুলি ঢুকল খোলা দরজা দিয়ে। আন্দাজের উপর নির্ভর করে শুধু ডান হাতটা বের করে গুলি করল রানা। থেমে গেল মেশিনগান, গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ বাড়ল। ছুটে গিয়ে একটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল রানা রাস্তার উপর পড়ে থাকা দেহটা তুলছে দু’জন লোক গাড়িতে। তিন সেকেণ্ড পর তীরবেগে যে পথে এসেছিল সেই পথে অদৃশ্য হয়ে গেল কালো গাড়িটা।
দরজাটা বন্ধ করে রানার দিকে ফিরল বোকা প্রহরীটা।
‘আমার প্রাণ রক্ষা করার জন্যে ধন্যবাদ, মিস্টার…’
‘মাসুদ রানা।’ কথা জুগিয়ে দিল গিলটি মিয়া একগাল হেসে। ‘ওনার নাম মাসুদ রানা।’