বিদেশী গুপ্তচর – ২.৮

আট

চোখ মেলল রানা।

প্রথমে কিছুক্ষণ কিছুই দেখতে পেল না সে, তারপর দেখতে পেল গিলটি মিয়ার উদ্বিগ্ন ফ্যাকাসে মুখ। উপুড় হয়ে ঝুঁকে রয়েছে গিলটি মিয়া ওর উপর।

‘আর কোথাউ লেগেচে, স্যার?’ রানাকে চোখ মেলতে দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হলো সে।

নিজের অজান্তেই হাতটা চলে এল রানার কপালে। ভেজা! রক্ত! ধড়মড়িয়ে উঠে বসল রানা।

‘নড়বেন না, স্যার!’ বিচলিত হয়ে উঠল গিলটি মিয়া। ‘আর কোথাউ লেগেচে?’

‘না,’ ধরা গলায় বলল রানা। ‘কোন পাথরের টুকরো ছুটে এসে লেগেছিল মনে হচ্ছে। হঠাৎ আকাশের দিকে চাইল। ‘কোথায় গেল ওটা?’

‘উই উদিক গিয়ে নেমে পড়েচে শালা। দেখাচ্চি। দাঁড়ান, আগে রক্ত পড়াটা বন্ধ করে নিই।

রাকস্যাক থেকে ফার্স্ট-এইড কিট বের করল গিলটি মিয়া ব্যস্ত হাতে। পানির ফ্লাস্ক নিয়ে এল। কপালটা ধুয়ে পরিষ্কার করতেই সব পানি শেষ করে ফেলার উপক্রম করল গিলটি মিয়া। বারণ করল রানা।

‘সব পানি শেষ কোরো না, গিলটি মিয়া। আমার তো ব্র্যাণ্ডি আছে। তুমি শেষে ছাতি ফেটে মরবে।’

‘বেশি কতা বলবেন না, স্যার,’ পুরো ডাক্তারী ভঙ্গি নিয়ে নিয়েছে গিলটি মিয়া। ‘শেষ হয়ে গেলে কোন পাহাড়ী ঝর্ণা থেকে ভরে লিতে কতক্ষণ?’

‘পথে কোন ঝর্ণা না পড়লে?’

‘আবার কতা বলে!’ রেগে উঠল গিলটি মিয়া। সবটুকু পানি দিয়ে রানার কপাল ধুয়ে ফার্স্ট-এইড কিট হাতড়াচ্ছে সে। ‘কি আচে? দু’পাঁচদিন পানি না খেলে মরে না মানুষ। নিন, এবার চোখ বুজে দাঁতে দাঁত কেমড়ে ধরুন।’

দুই মিনিট পর রানাকে ছেড়ে দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে গম্ভীর মুখে পরীক্ষা করল সে নিজের হাতের কাজ, তারপর হাসল সন্তুষ্ট চিত্তে।

‘লেখাপড়া করলে বিরাট সিবিল সার্জেন্ট হতে পারতুম, স্যার। হাতের কাজে খুঁত পাবেন না কোন।’

ইলাস্টোপ্লাস্ট টিপে ব্যথার পরিমাণ অনুভব করবার চেষ্টা করল রানা, তারপর বলল, ‘ভেরি গুড। এবার বলো দেখি কি হলো ব্যাপারটা? ভাগল কেন ব্যাটারা?’

‘ভাগবে না মানে? না ভেগে উপায় আচে? ডাইভার ব্যাটা একা মানুষ, পেলেন চালাবে, না আক্রমণ করবে?’

‘রিক্‌কির কি হলো?’

‘ও ব্যাটা তো আপনার এক গুলিতেই শেষ। বোম ফেলার পরপরই ও-ও তো পড়েচে পেলেন থেকে। ভাগ্যিস আমার ঘাড়ে পড়েনি! পেলেনটা সরে গেচিল ততক্ষণে। ওই দেকুন ঘাড় মটকে পড়ে আচে কি রকম।’

বিশ পঁচিশ ফুট নিচে ভাঙাচোরা বেকায়দা ভঙ্গিতে শুয়ে আছে রিকি। লাল হয়ে রয়েছে শার্টের বুক-পকেট। নিষ্প্রাণ খোলা চোখ চেয়ে আছে আকাশের দিকে নির্নিমেষে।

‘আর উই যে, ওখানে নেমেচে পেলেনটা। দেকতে পাচ্ছেন না? আমার আঙুল সোজা তাকান। উ…ই যে!’

দেখতে পেল রানা। প্রায় আট-দশ মাইল দূরে একটা বিচ্ছিন্ন ফার্ম-হাউসের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে রয়েছে হেলিকপ্টার। খুব সম্ভব ওখানেই আডি গেড়েছে সিলভিও। খেলনার মত বাড়িটার সামনে মনে হচ্ছে কয়েকটা পিঁপড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে।

বিনকিউলারটা চোখে লাগাল রানা। এক লাফে অনেক কাছে চলে এল বাড়িটা। অ্যাডজাস্টিং নব ঘুরিয়ে পরিষ্কার করে নিল রানা দৃশ্যটা। দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লুইসা পিয়েত্রো। হেলিকপ্টারের দিকে চেয়ে রয়েছে সে। একটু পাশ ফিরে কপ্টারটার দিকে চাইল রানা। ওখানটায় বেশ ভিড়। হাত নেড়ে কি যেন বলছে হেলমেট পরা পাইলট। মাথা নাড়ল সিলভিও। গিয়ান এবং পপিনিকে চিনতে পারল রানা ভিড়ের মধ্যে, বাকি সবাই অচেনা। কিছু একটা প্রশ্ন করল সিলভিও। আঙুল দিয়ে সোজা রানার দিকে দেখাল পাইলট, হেলমেটটা খুলে হাতে নিল, দুই হাত একত্র করে দ্রুত ফাঁক করল কথা বলতে বলতে। রানা বুঝল গ্রেনেডের বর্ণনা হচ্ছে।

আবার মাথা নাড়ল সিলভিও। তারপর ঝট করে ফিরল গীয়ানের দিকে। সংক্ষেপে কয়েকটা আদেশ দিল সে, একবার হাত তুলে দেখাল এই পাহাড়ের দিকে, তারপর ঘুরে হাঁটতে শুরু করল বাড়িটার দিকে। ওর পিছু পিছু পাইলটও চলল বাড়ির দিকে। ব্যস্ত হয়ে উঠল বাকি কয়জন। দু’জন ছুটে গেল ফার্ম- হাউসের পাশেই আর একটা ঘরের সামনে। দরজা দু’পাট হাঁ করে খুলে ঢুকে গেল ভিতরে। কয়েক সেকেণ্ড পর বেরিয়ে এল দুটো গাড়ি। টপাটপ উঠে পড়ল সাতজন, যে যেটায় পারল। সাঁ করে গেট দিয়ে বেরিয়ে এল গাড়ি দুটো, উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে উঠে এল বড় রাস্তায়, তারপর দ্রুতবেগে রওনা হলো এই পাহাড়ের উদ্দেশে।

‘এত কি দেকচেন, স্যার?’ জিজ্ঞেস করল গিলটি মিয়া।

‘রওনা হয়ে গেল ওরা। চামড়ার খোলের ভিতর রেখে দিল রানা বিনকিউলার। ঘণ্টা দু’য়েক লাগবে ওদের এখানে পৌঁছতে। চলো এগিয়ে থাকা যাক।’

‘কোতায়?’

‘আপাতত ওরা যেখানটায় গাড়ি রেখে হাঁটতে শুরু করবে সেইখানে পৌঁছতে হবে আমাদের।’

‘এই জকম নিয়ে পারবেন অতটা হাঁটতে?’

‘পারতেই হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। ধরা পড়লে হাটুরে কিল খেয়ে মরতে হবে। নয়জন আসছে ওরা। চলো নামতে শুরু করি।’

পাহাড় থেকে নিচে নামতে লাগল দশ মিনিট। এবড়ো- খেবড়ো পাথুরে জমির উপর দিয়ে এগোল ওরা পশ্চিম দিকে, ফার্ম-হাউসটা লক্ষ্য করে। মন্থর গতিতে এগোচ্ছে ওরা ঝোপ- ঝাড় আর পাথরের চাঁই এড়িয়ে। আধঘণ্টা একটানা হেঁটে টের পেল রানা কী অসাধ্য সাধনে লেগেছে সে। মাথাটা ঘুরছে। আর কতক্ষণ লাগবে বড় রাস্তায় পৌঁছতে কে জানে! এভাবে আর বেশিক্ষণ হাঁটা সম্ভব নয় ওর পক্ষে।

খাড়াই বেয়ে উপরে উঠলে দেখা যায় ফার্ম-হাউসটা, নিচে নামলে অদৃশ্য হয়ে যায়। দূরত্ব এখন সাত মাইল। রাস্তার বেশ কাছাকাছি এসে গেছে ওরা নিশ্চয়ই, এবার ধীরে ধীরে বামদিকে এগোনো দরকার। আরও আধঘণ্টা চলবার পর আবার একটা খাড়াই বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। খুবই সতর্কতার সাথে এগোচ্ছে ওরা এখন, মাঝে মাঝেই থেমে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে শুনবার চেষ্টা করছে গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ। উঁচু জায়গায় এসে রাস্তা দেখতে পেল রানা, কিন্তু ঢাল বেয়ে নামতে গিয়েই ঝপ করে বসে পড়ল।

বাম পাশে পাহাড়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে দুটো গাড়ি। পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে সাত-আটজন লোক। ঘুরপথে না এসে সরাসরি এলে ঠিক ওদের মুখোমুখি পড়ত ওরা।

গীয়ানকে দেখা গেল বসে আছে গাড়ির কাছে। পাহারা দিচ্ছে।

‘আড়ালে আড়ালে নেমে যেতে হবে আমাদের।’ চাপা গলায় বলল রানা। ‘আগে এই ব্যাটারা পাহাড় ডিঙিয়ে নিচে নামতে শুরু করুক, তারপর। একটা গাড়ি অকেজো করে দিতে হবে। তার আগে কাবু করতে হবে গীয়ানকে। কিন্তু বেশিদূর তো নামা যাবে না এই ঢাল বেয়ে। শেষের তিরিশ গজ একেবারে ফাঁকা, একটা ঝোপ নেই। একবার পিছন ফিরে চাইলেই…’

‘গুলি খাবে, আবার কি?’ বলল গিলটি মিয়া। ‘এই মোটা মরলে আমাদের কোন ক্ষতি আচে?’

‘আওয়াজ হবে। ফিরে আসবে ওই ব্যাটারা কি হলো দেখতে।’

‘ততক্ষণে আমরা ভাগলওয়া!’ হাসল গিলটি মিয়া। ‘আমাদের অত তাড়াহুড়ো কিসের? যাক না ব্যাটারা দুটো পাহাড় ডিঙিয়ে, তারপর জিরিয়ে-টিরিয়ে নিয়ে নামব আমরা ধীরে-সুস্তে।’

কথাটা ঠিক। রাজি হয়ে গেল রানা।

পাশের পাহাড়ের মাথায় উঠেই বসে পড়ল পপিনি। ঝোপের আড়ালে আরও একটু ভাল করে গা ঢাকা দিল রানা ও গিলটি মিয়া। এখান থেকে গজ পঞ্চাশেক হবে। আরও একজন উঠল চূড়ায়। বিরক্ত ভঙ্গিতে থুতু ফেলল পপিনি।

‘এত লোক একসাথে কষ্ট করে কোন লাভ আছে?’ বলল পপিনি। পাইলট বলল তিনজনই মারা গেছে একসাথে। নিজের চোখে দেখেছে সে। তার পরেও এত লোক লস্কর নিয়ে যাওয়ার কি মানে হয়? অর্ধেক আমরা থেকে গেলেই তো পারি, বাকি অর্ধেক যাক, নিয়ে আসুক লাল খাতাটা।’

‘বাজে বোকো না পপিনি,’ বকা দিল দ্বিতীয় লোকটা। ‘চীফ সাবধান হতে বলে দিয়েছে গীয়ানকে। মারা না-ও গিয়ে থাকতে পারে। ওই লোকটা খুবই নাকি ভয়ঙ্কর, ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিয়েছে আমাদের ভেনিসে। চলো, নামা যাক। উফ্, আরও পাঁচটা পাহাড় ডিঙাতে হবে।’

নামতে শুরু করল লোকটা। গজর গজর করতে করতে চলল পপিনিও। বাকি সবাই একে একে এসে পৌঁছল এবং নেমে গেল নিচে।

‘চলুন, স্যার, নিচের ওই সবশেষের ঝোপটার আড়ালে গিয়ে বিশ্রাম নেয়া যাক আদ-ঘণ্টা।’

অতি সন্তর্পণে, হাত বা পায়ের ধাক্কায় একটি পাথর না খসিয়ে নেমে এল ওরা আড়াইশো গজ ঝোপ-ঝাড় আর পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে আড়ালে। একটা বোল্ডারের উপর পাশ ফিরে বসে হাওয়া খাচ্ছে গীয়ান। কালো স্যুট আর কালো হ্যাট পরনে। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছে আনমনে।

মনে মনে হিসেব করল রানা। নিঃশব্দে যদি কাজ সারা সম্ভব হয়, তাহলে আর দেরি করবার কোন মানে হয় না। কিন্তু গুলি যদি করতেই হয়, এবং ওরা যদি কারণ অনুসন্ধান করতে আসেও, সবাই আসবে না। বড়জোর একজন বা দু’জনকে পাঠাবে। তাদেরও গাড়ির কাছে পৌঁছতে লাগবে কমপক্ষে ঝাড়া বিশ মিনিট। ততক্ষণে একটা গাড়ি অকেজো করে দিতে পারবে ও অনায়াসে। অপরটাতে চড়ে রওনা হবে ওরা ফার্ম-হাউসের দিকে। তারপর, যদি হেলিকপ্টারটা দখল করতে পারে…

অস্থির হয়ে উঠল রানা দশ মিনিটের মধ্যেই। প্রতীক্ষা করতে ওর ভাল লাগে না কোনদিনই। তার উপর গীয়ানের সিগারেট খাওয়া দেখে এবং ধোঁয়ার গন্ধে সিগারেটের তেষ্টা পেয়ে গেল ওর ভয়ানক। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে।

‘আমি চললাম, গিলটি মিয়া। তুমি এখানটাতেই থাকো। কাছাকাছি গিয়ে আমি যখন হাত তুলব, তখন একটা ঢিল মেরে ওর মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাবার চেষ্টা করো। শেষের দশ গজ ধাওয়া করে পৌঁছতে হবে ওর কাছে।’

গিলটি মিয়া বুঝল প্ল্যান কিছুটা পরিবর্তন করছে রানা। মাথা ঝাঁকিয়ে রাজি হয়ে গেল।

রওনা হতে যাবে রানা, ঠিক এমনি সময় উঠে দাঁড়াল গীয়ান। পায়চারি শুরু করল গাড়ির পাশে। মাঝে মাঝে ভ্রূ কুঁচকে পাহাড়ের দিকে দেখছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই দ্বিতীয় পাহাড়টায় চড়তে শুরু করেছে ওরা। খানিক বাদেই দেখা যাবে ওদের। এখনও কেন দেখা যাচ্ছে না, কেন আরও দ্রুত পা চালাচ্ছে না সবাই, সেটা ভেবে নিরতিশয় বিরক্ত হচ্ছে গীয়ান। অকম্মার ঢেঁকি, খেয়ে খেয়ে খোদাই ষাঁড় হয়ে গেছে, কুঁড়ের বাদশা সব ইত্যাদি যা নয় তাই বলে গাল দিল সে কিছুক্ষণ ওদের, অস্থির পায়ে পায়চারি করল, বার বার পাহাড়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, তারপর আবার গিয়ে বসল পাথরটার উপর। সিগারেট ধরাল আরেকটা।

রাকস্যাকটা খুলে রেখে ক্রলিং শুরু করল রানা। দ্রুত নিঃশব্দে নেমে যাচ্ছে নিচে। থামছে। দু’একটা বিচ্ছিন্ন ঝোপের আড়ালে, বা বিক্ষিপ্ত পাথরের আড়ালে থেমে দেখে নিচ্ছে গীয়ানের মতিগতি। আবার নামছে। মনে হচ্ছে প্রকাণ্ড এক লেজ- কাটা টিকটিকি এগিয়ে যাচ্ছে শিকারের দিকে

দশ গজের মধ্যে পৌঁছে গেল রানা। দৌড় প্রতিযোগিতার ভঙ্গিতে প্রস্তুত হলো সে- বাম পা সামনে, হাত দুটো মাটিতে। একটা হাত চট করে একবার উঁচু করেই নামিয়ে নিল।

গুলি করল গিলটি মিয়া। খটাং করে গাড়ির গায়ে লেগে ছিটকে এসে পড়ল মার্বেলটা গীয়ানের পায়ের কাছে। চমকে গাড়ির দিকে চেয়েছিল গীয়ান, এখন অবাক চোখে দেখছে গুলিটা, পরমুহূর্তে উঠে দাঁড়াল বিপদ টের পেয়ে।

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেক। প্রকাণ্ড এক লাফ দিয়ে ওর ঘাড়ের উপর পড়ল রানা। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল গীয়ান, রানা পড়ল ওর উপর। চার হাত-পা চলছে রানার সমানে।

রানার রাকস্যাকটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে দৌড়ে নেমে এল গিলটি মিয়া। কিন্তু সাহায্যের প্রয়োজন হলো না। ততক্ষণে পা ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনছে রানা গীয়ানের জ্ঞানহীন দেহটা বোল্ডারের আড়ালে।

‘উঠে পড়ো, গিলটি মিয়া,’ বলল রানা। ‘লাল গাড়িটায়।’

কালো গাড়িটার এঞ্জিনের বনেট খুলে ফেলল রানা, ডিস্ট্রিবিউটার ক্যাপটা খুলে হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে নিয়ে এল দু’তিনটে তারসহ, মাটিতে ফেলে পা দিয়ে চেপে চুর করে দিল সেটা। বনেট নামিয়ে কি মনে করে গীয়ানের হ্যাটটা টান দিয়ে খুলে মাথায় পরল, তারপর গিয়ে বসল লাল গাড়ির ড্রাইভিং সীটে।

বহুদূর থেকে একটা চিৎকারের শব্দ ভেসে এল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল রানা, দ্বিতীয় পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড়িয়ে আর সবাইকে ডেকে রাস্তার দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে দু’জন লোক। দেখে ফেলেছে ওরা রানা ও গিলটি মিয়াকে। নেমে আসতে শুরু করল এবার।

এঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে হাসল রানা। সিগারেট ধরাল একটা।

‘আজ আর আমাদের ধরতে হচ্ছে না। ফার্ম হাউসে পৌঁছতে ওদের লাগবে পাক্কা আড়াই ঘণ্টা।’

রওনা হলো ওরা। মাইল খানেক গিয়ে ভাল রাস্তায় পড়ল। বাঁক নিয়েই তুফান বেগে ছুটল ফার্ম-হাউসের দিকে। কাছাকাছি গিয়ে গতি একটু কমাল রানা।

‘সীট ছেড়ে নিচে নেমে বসো, গিলটি মিয়া। আমাকে দেখে ওরা মনে করবে গীয়ান ফিরছে রিপোর্ট করতে। অপ্রস্তুত অবস্থায় পাব ওদের আশা করছি।

একগাল হেসে সীট ছেড়ে নেমে গেল গিলটি মিয়া। পিস্তলটা বেরিয়ে এসেছে ওর হাতে। মাইল খানেক গিয়ে বাঁয়ে মোড় নিল রানা। টুপিটা টেনে মুখের অর্ধেকটা ঢেকে দিয়েছে সে আগেই।

‘পৌঁছে গিয়েছি, গিলটি মিয়া। তুমি যেমন আছ তেমনি বসে থাকবে। আমি আগে ঢুকব বাড়ির ভিতর। পাঁচ মিনিট পর ঢুকবে তুমি। আমার কোন বিপদ হলে তুমি সাহায্য করতে পারবে। দু’জনে একসাথে বিপদে পড়া ঠিক হবে না।

‘ঠিক আচে। পাঁচ মিলিট পরেই বেরোব আমি নাহায়।’

একবার ইচ্ছে করল রানার, সোজা গিয়ে হেলিকপ্টারে ওঠে। কাছেই মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ওটা চুপচাপ। কিন্তু ইচ্ছেটা দমন করল সে। আগে এ বাড়িতে যারা আছে তাদের কাবু করে নিতে হবে।

বাড়ির সামনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বাম হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছে রানা, ডানহাতে ওর ওয়ালথার পি. পি. কে। নিচু করে রেখেছে হাতটা।

ঘ্যাঁচ করে ব্রেক করল রানা। তিন লাফে পেরিয়ে গেল সামনের ছোট বাগানটা।

রানা আশা করেছিল গীয়ানকে ফিরতে দেখে দরজার কাছে এসে দাঁড়াবে সিলভিও বা আর কেউ। কিন্তু কেউ এল না। বন্ধ দরজায় কান পাতল রানা। কারও পায়ের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। বুঝল প্রথম চালটা ওকেই চালতে হবে।

হ্যাণ্ডেলে চাপ দিয়ে ঠেলা দিতেই ক্যাচম্যাচ শব্দে খুলে গেল দরজাটা। হলরূম। ঢুকে পড়ল রানা। সামনেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, ডানপাশে একটা বন্ধ দরজা, সিঁড়ির পাশ দিয়ে একটা প্যাসেজ।

আধ সেকেণ্ডের বেশি এসব দেখার সুযোগ পেল না রানা, কারণ ওর চোখ পড়ল হেলিকপ্টারের পাইলটের উপর। সিঁড়ি দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে নেমে আসছিল লোকটা, রানাকে দেখে জমে গেছে মূর্তির মত। হাঁ হয়ে গেছে ওর মুখটা, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর ছেড়ে। যেন ভূত দেখতে পেয়েছে সামনে।

‘টু শব্দ করলেই মারা পড়বে!’ বলল রানা চাপা গলায়।

পিস্তলটার দিকে চোখ পড়তেই হাত দুটো তুলে ফেলল সে মাথার উপর। রক্তশূন্য মুখ। ডান গালটা লাফাচ্ছে আপনাআপনি।

‘নেমে এসো!’ আদেশ করল রানা।

ঠিক যেন একরাশ ডিমের উপর দিয়ে হাঁটছে এমনি সন্তর্পণে রানাকে বিন্দুমাত্র না চটিয়ে নেমে এল পাইলট।

‘ঘুরে দাঁড়াও,’ আবার হুকুম করল রানা।

কান্নার ভঙ্গিতে বিকৃত হয়ে গেল লোকটার মুখের চেহারা। ওর স্থির বিশ্বাস, ঘুরলেই গুলি করবে রানা। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, রানার হাতের পিস্তলটা একটু নড়ে উঠতেই চোখ বুজে ঘুরে দাঁড়াল। লোকটাকে সার্চ করে দেখা গেল কোন অস্ত্র নেই ওর কাছে। তিন পা পিছিয়ে গেল রানা আবার।

‘আর সবাই কোথায়?’

প্যাসেজের শেষের দিকে একটা বন্ধ দরজার দিকে আবছা ইঙ্গিত করল লোকটা।

‘হাঁটো। কৌশল করতে গেলেই গুলি খাবে।’

এগোল পাইলট। প্যাসেজ ধরে কিছুদূর এগিয়ে বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল, হ্যাণ্ডেল ধরে চাপ দিয়ে খুলল দরজাটা, এবং পিছন থেকে রানার হাতের প্রচণ্ড এক ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে চার হাত-পায়ে ভর করে পড়ল গিয়ে চেয়ারে বসা সিলভিওর পায়ের কাছে।

‘খবরদার, কেউ নড়বে না!’ ঘরের ভিতর এক পা ঢুকে এসে বলল রানা।

চমকে উঠল লুইসা পিয়েত্রো। জানালার ধারে বসে ব্যস্ত হাতে উল বুনছিল, থেমে গেল হাত। ঝট করে ফিরল রানার দিকে। উজ্জ্বল হয়ে উঠল চোখ দুটো।

‘রানা। বেঁচে আছ তুমি!’

নিবিষ্টচিত্তে একটা ম্যাপ দেখছিল সিলভিও। জ্যান্ত, পিস্তলধারী রানাকে চোখের সামনে দেখে ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখটা। হাত থেকে খসে পড়ে গেল ম্যাপ। ঢোক গিলল বার দুই।

‘কি? ভাবতে পারোনি গ্রেনেড খেয়েও এখানে এসে হাজির হতে পারি, তাই না?’ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল রানা সিলভিওকে। ‘মৃত্যু-ভয় আসছে, সিলভিও?’

‘গ্রেনেড?’ তাজ্জব হয়ে গেল লুইসা। ‘গ্রেনেড ছুঁড়েছিল ওরা তোমার ওপর? তাই কপালটা কাটা দেখছি?’ তীব্রদৃষ্টিতে চাইল লুইসা সিলভিওর দিকে। ‘সিলভিও। তুমি হুকুম দিয়েছিলে গ্রেনেড ছোঁড়ার? কি কথা দিয়েছিলে তুমি আমাকে?’

‘চুপ করো লুইসা,’ ধমকে উঠল সিলভিও। ‘পুরুষ মানুষের কথার মধ্যে কথা বলোনা।’

‘পুরুষ, না কাপুরুষ?’ ফোঁস করে উঠল লুইসা।

লুইসার কথায় কর্ণপাত না করে রানার দিকে ফিরল সিলভিও।

‘আপনার সাথে কথা আছে আমার। আপনি এদেশ থেকে বোরোতে পারবেন না। প্রত্যেকটা রাস্তায় পাহারা বসেছে। পুলিস খুঁজছে আপনাকে হন্যে হয়ে, প্রত্যেকটা বর্ডার টাউনে স্পেশাল গার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ হোক বা কাল হোক, ধরা আপনাকে পড়তেই হবে। আমার সাথে যদি একটা সমঝোতায় আসেন…’

‘তোমাকে সমঝে নিয়েছি, আর কোনরকম সমঝোতায় আসার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই।

‘বইটা ফেরত দিয়ে দিন, সিনর মাসুদ রানা। যত টাকা চান, কিনে নেব ওটা আমি আপনার কাছ থেকে।’

‘টাকার চেয়েও বড় দু’একটা জিনিস এখনও এই পৃথিবীতে আছে, সিলভিও। নোট বইটা পাচ্ছ না তুমি, কাজেই ও-নিয়ে বাজে বকে লাভ নেই। ‘

‘কুনো অসুবিদে নেই তো, স্যার?’ দরজার বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করল গিলটি মিয়া। ‘সব ঠিকঠাক?’

‘এখানে কোন গোলমাল নেই,’ সিলভিওর উপর থেকে চোখ না সরিয়েই জবাব দিল রানা। ‘কিন্তু বাড়িতে আর কেউ আছে কিনা দেখার সুযোগ পাইনি। তুমি একপাক ঘুরে দেখো। যদি কাউকে দেখতে পাও, একবার প্যাঁচার ডাক ডেকে তাকে বন্দী করে নিয়ে আসবে এখানে। আর যদি বিপদে পড়ো, দু’বার ডাকবে ডাকটা। বুঝতে পেরেছ?’

‘নিচ্চয়। চললুম, স্যার।’

‘আর একটা কথা। শক্ত দড়ি পেলে নিয়ে এসো খানিকটা। ‘পেয়ে যাব, স্যার। আমি থাকতে কোন চিন্তা নেই আপনার। পাইলটটা জড়োসড়ো ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে একবার রানা আর একবার সিলভিওর মুখের দিকে চাইছে। কোজন বেশি ভয়ঙ্কর বুঝে উঠতে পারছে না বোধহয়।

‘কান পেতে রানার মুখে বাংলা কথা শুনছিল লুইসা, বলল, ‘বড় মিষ্টি ভাষা তো! যাই হোক, এখন কি করবে আমাদের? মেরে ফেলবে?’

‘বেঁধে রেখে চলে যাব। তোমাদের লোকজন এসে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে, খুলে দেবে ওরা।’

‘কিন্তু তাহলে পালাবে কি করে?’

‘হেলিকপ্টারটা নিয়ে উড়ে চলে যাব।’

মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেল সিলভিওর মুখ। বলল, ‘গুল মারছ! চালাতে পারবে না তুমি ওটা।’

‘সেটা নিজের চোখেই দেখতে পাবে।’

‘কিন্তু এদের তুমি চেনো না রানা,’ বলল লুইসা। ‘এরা বড় ভয়ঙ্কর। করতে পারে না এমন কাজ নেই। যতদিন বেঁচে থাকবে মৃত্যু-পরোয়ানা ঝুলবে তোমার মাথার ওপর। তার চেয়ে নোট বইটা দিয়ে দিলে ভাল হত না? তোমার নিজের দেশের ব্যাপার তো নয় এটা। আমি তোমার ভালর জন্যেই বলছি, রানা। দিয়ে দাও ওটা, প্লীজ!’

‘আমার মঙ্গল কামনার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ, লুইসা। কিন্তু বহু দস্যুদলের বহু মৃত্যু পরোয়ানা এখনও ঝুলছে আমার মাথার ওপর, সুযোগ পেলে তারাও ছাড়বে না আমাকে। কিন্তু ওসব পরোয়া করি না। করলে ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে থাকতাম। নোটবইটা ফেরত দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’

‘কিন্তু তুমি এক বিদেশী গুপ্তচর, ওটা ভারতে পৌঁছে দিলে তোমার কি লাভ, রানা?’

‘তোমাদের কি ক্ষতি শুনি?’

‘পিয়েত্রো গ্লাস ফ্যাক্টরির নাম মুছে যাবে পৃথিবী থেকে। শুধু ভারতেই নয়, গোটা ইউরোপ জুড়ে যে বিরাট ব্যবসা গড়ে উঠেছে গত দশ বছর ধরে, ধূলিসাৎ হয়ে যাবে সেটা। নোট বইটা উদ্ধার করতে না পারলে দল থেকে বের করে দেয়া হবে সিলভিওকে।’

কিছুতেই হাসি সংবরণ করতে পারল না রানা। হেসে উঠে বলল, ‘ছেলেমানুষের মত কথা বলছ, লুইসা। তোমাদের কাছে ব্যাপারটা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে, আমার কাছে মোটেই তা মনে হচ্ছে না। দশ বছর ধরে বে-আইনী ব্যবসা করে অঢেল টাকা করেছ তোমরা, এখন এ ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে তোমরা পথে বসবে না। আর দল থেকে যদি সিলভিওকে বের করে দেয়, সেটা ওর জন্যে শাপে বর হবে। মহা বাঁচা বেঁচে যাবে ও। কাজেই আমি তোমাদের কোন ক্ষতি দেখতে পাচ্ছি না। শুধু দেখতে পাচ্ছি টাকা আর ক্ষমতার লোভে তোমরা কত নিচে নামতে পারো। জুলি মাযিনিকে খুন করতে বাধেনি তোমাদের, অনিলকে খুন করতে বাধেনি, জবাই করেছ তোমরা স্টেফানো মন্টিনির মত একজন মহৎপ্রাণ আত্মভোলা স্পোর্টসম্যানকে, এখান পর্যন্ত তেড়ে এসেছ আমাদের দু’জনকে খুন করতে। যাবার আগে তোমাদের এই মেয়েলী চেহারার মেনীমুখো ভাইটার বুকের ভেতর একটা বুলেট ঢুকিয়ে দিয়ে যেতে পারলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু একজন অসহায় নিরস্ত্র, পরাজিত লোককে হত্যা করতে বাধছে আমার। কিন্তু তোমাদের তো বাধেনি? বিশেষ করে তুমি কি করে এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ড সমর্থন করলে, ভাবতে অবাক লাগছে। এতকিছুর পরেও কি করে ওকালতী করছ ভাইয়ের হয়ে? তোমার প্রতি আমার দুর্বলতা আছে, কিন্তু তাই বলে তোমার অন্যায় আবদার রক্ষা করব, তা ভেবো না। কিছুতেই দেব না আমি এ নোটবই।’

রানার তীক্ষ্ণ তিরস্কারে স্তব্ধ হয়ে গেল লুইসা। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখটা। কয়েক সেকেণ্ড কোন জবাব খুঁজে পেল না, তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, খুন-খারাপীর পেছনে কোনদিনই আমার সমর্থন ছিল না। এখনও নেই। তোমার বন্ধুর মৃত্যুতে আমি সত্যিই দুঃখিত।’

গিলটি মিয়া তার কামান হাতে ঢুকল ঘরে। অপর হাতে একগোছা পাকানো দড়ি।

‘কেউ নেই, স্যার। একেবারে ফাঁকা।

‘ঠিক আছে। এবার বেঁধে ফেলো সব ক’টাকে। জলদি।’

পাইলট কোন আপত্তিই করল না, কিন্তু সিলভিওর দিকে এগোতেই এক লাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে কণ্ঠনালী টিপে ধরল সে গিলটি মিয়ার। এরকম একটা ঘটনার জন্যে প্রস্তুত ছিল রানা। বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এল সে, বাম হাতে প্রচণ্ড এক ঘুসি মারল সিলভিওর থুতনির নিচে। চোখ কপালে উঠল সিলভিওর, হাত ছুটে গেল কণ্ঠনালী থেকে, শরীরটা ঘুরে গেল একটু। ধাঁই করে পিস্তলের বাঁট পড়ল সিলভিওর মাথায়। ধড়াস করে পড়ল মেঝেতে জ্ঞান হারিয়ে।

‘এবার বাঁধো।’ হুকুম করল রানা।

প্রেমিক রানার এই ভয়ঙ্কর রূপ বোধহয় স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি লুইসা। ওর আক্রমণের ক্ষিপ্রতা আর প্রচণ্ডতা এক সেকেণ্ডের জন্যে বিহ্বল করে দিল ওকে। নিজের ভাইয়ের উপর আঘাত পড়তে দেখে সহ্য করতে পারল না, ঝট করে মুখ ফিরাল জানালা দিয়ে বাইরে, পরমুহূর্তে আড়ষ্ট হয়ে গেল।

এই হঠাৎ আড়ষ্টতা নজর এড়াল না রানার। নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, এমনি সময় বাইরের দিকে চেয়েই কথা বলে উঠল লুইসা। কণ্ঠস্বরটা ভাবলেশহীন।

‘তোমার একটু তাড়াতাড়ি করা দরকার রানা। ফিরে আসছে ওরা।’

দ্রুতপায়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল রানা। দেখা গেল সত্যিই একটা ছাত খোলা গাড়ি আসছে এইদিকে ধুলো উড়িয়ে। অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে আসছে ওটা।

সিলভিওকে বাঁধা শেষ করে এইদিকে এগিয়ে আসছিল গিলটি মিয়া। রানার একটা বাহু ধরল লুইসা।

‘আমি তোমার হাতে বন্দী হতে চাই, রানা।’

‘তোমাকে বন্দী করতে চাই না আমি, লুইসা।’

‘বাঁধবে না আমাকে?’

‘না। কোন বাঁধনেই বাঁধব না। তুমি মুক্ত।’

ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল রানা ও গিলটি মিয়া।

হেলিকপ্টারে উঠে বাইরে মুখ বের করে দেখল রানা তীব্রবেগে ছুটে আসছে হুড খোলা গাড়িটা। ভিতরে ছয়জন যাত্রী। অনেক কাছে চলে এসেছে। খুব সম্ভব বড় রাস্তায় এটাকে থামিয়ে দখল করে নিয়েছে ওরা।

ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে চালু করল রানা এঞ্জিন। পিচ কন্ট্রোলের থ্রটল ঘুরিয়ে চালু করল রোটর ব্লেড।

মাথা বের করে গাড়িটা দেখল গিলটি মিয়া। ফার্ম-হাউসের গেট দিয়ে ঢুকছে এখন ওটা। গুলি করল গিলটি মিয়া। মুহূর্তে চুর হয়ে ফেটে ঝাপসা হয়ে গেল গাড়ির উইণ্ডস্ক্রীন। প্রাণপণে ব্রেক চাপল ড্রাইভার, কয়েক ফুট স্কিড করে এগিয়ে থেমে গেল গাড়িটা।

ডোবার ব্যাঙের মত লাফ দিয়ে নামল ছয়জন গাড়ি থেকে। পজিশন নিল যে যেখানে পারল।

হুইল ব্রেক ছেড়ে পিচ লিভারটা উপরে টানল রানা। ধীরে ধীরে শূন্যে উঠে যাচ্ছে হেলিকপ্টার।

গুলি করতে শুরু করল ওরা। গিলটি মিয়ার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল একটা গুলি। আরেকটা গিয়ে ঢুকল প্যানেলের গায়ে বসানো ঘড়ির মধ্যে। একজন টেকো লোকের কপালে সুপুরীর সমান ঢেলা তুলে দিল গিলটি মিয়া গুলি করে। কিন্তু তৃতীয় গুলির আর সুযোগ পাওয়া গেল না।

জয়স্টিকটা সামনে ঠেলে দিয়েছে রানা, আরও খানিকটা থ্রটল দিয়ে রাডার পেডালে রেখেছে বাম পা। কোণাকুণি ভাবে উঠে গেল হেলিকপ্টার। তিন সেকেণ্ডেই ফার্ম হাউসের আড়ালে পড়ে গেল ওরা ছয়জন।

উত্তর-পশ্চিম কোণে হারিয়ে গেল হেলিকপ্টার ছোট হতে হতে বিন্দু হয়ে গিয়ে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *