সাত
ছেড়ে দিল বাস। চলে গেল মাটি কাঁপিয়ে।
প্রথম সার্জেন্টটা ঘাড় কাৎ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মোটর সাইকেলের হেডলাইট জ্বেলে দিল। হাত বাড়াল।
‘পাসপোর্ট প্লীজ।’
ভিতরের পকেটে হাত ঢোকাল রানা। পিস্তলের বাঁটটা ঠেকল হাতে। লক্ষ করল দ্বিতীয় সার্জেন্ট উঁচু করল কারবাইনটা। সোজা রানার বুকের দিকে লক্ষ্য করে ধরা ওটা। পাসপোর্টটা বের করে আনল রানা, এগিয়ে দিল বাড়িয়ে রাখা হাতে।
তিন সেকেণ্ড পরীক্ষা করেই মাথা ঝাঁকাল সার্জেন্ট। গিলটি মিয়ার দিকে হাত বাড়াল ওর পাসপোর্টের জন্যে।
‘তোমার পাসপোর্ট বের করে দাও,’ বলল রানা।
বিনা বাক্য ব্যয়ে পাসপোর্ট বের করে দিল গিলটি মিয়া।
‘আপনাদের দু’জনকেই অ্যারেস্ট করা হলো,’ গিলটি মিয়ার পাসপোর্টে চোখ বুলিয়ে বলল প্রথম সার্জেন্ট। ‘আমাদের সাথে যেতে হবে আপনাদের।
‘আমাদের বিরুদ্ধে চার্জটা কি?’ ডান হাতে গলার কাছে চুলকাল রানা।
অবাক হলো গিলটি মিয়া। তিনজন দেখে গোলমাল করার সম্ভাবনাটা দূর করে দিয়েছিল ও মন থেকে। রানাকে গলা চুলকাতে দেখে চমকে উঠল সে ভিতর ভিতর। এটা রানার সিগন্যাল। জানে সে। অবাক হলো, কিন্তু এক সেকেণ্ড দেরি করল না সে সিদ্ধান্ত নিতে। কারবাইন ধরা সার্জেন্টকেই পছন্দ হলো ওর।
রাকস্যাকের স্ট্র্যাপ ধরে ওটাকে কাঁধের উপর দিয়ে পিঠে রেখেছিল গিলটি মিয়া, ধাঁই করে মারল ওটা দিয়ে কারবাইনধারীর মুখে। ব্র্যাণ্ডির বোতলের নিচের দিকটা দড়াম করে পড়ল লোকটার নাকের উপর। তীব্র যন্ত্রণায় দিশেহারা লোকটা কারবাইন ফেলে দিয়ে বসে পড়ল মাটিতে চার হাত পায়ে ভর দিয়ে।
বিদ্যুৎবেগে রিভলভারের বাঁটে হাত চলে গেল বাকি দু’জনের, কিন্তু থমকে গেল ওরা। রানার হাতে চকচক করছে ওর ওয়ালথার পি.পি. কে।
‘নড়েচ কি মরেচ!’ গিলটি মিয়াও বের করে ফেলেছে ওর ভয়ঙ্কর-দর্শন খেলনা-পিস্তল।
বাংলা কথা বুঝল না ওরা, কিন্তু বক্তব্য বুঝতে পারল পরিষ্কার। পাথর হয়ে জমে গেল একেবারে।
কারবাইনটা মাটি থেকে তুলে নিল গিলটি মিয়া বাম হাতে। রেখে এল কয়েক হাত তফাতে। একে একে সব ক’টা কারবাইন ও রিভলভারই চলে গেল সেখানে।
‘পিছন ফিরে দাঁড়াও!’ হুকুম করল রানা। ওরা পিছু ফিরতেই ইটালিয়ান ভাসায় হুকুম করল গিলটি মিয়াকে, এদের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকো। যে একটু নড়বে তাকেই শেষ করে দেবে।’
দ্রুতহাতে দুটো মোটর সাইকেল থেকে স্পার্কিং প্লাগ খুলে পকেটে রাখল রানা। তৃতীয়টার পেট্রল ট্যাংক পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে স্টার্ট দেয়া অবস্থায় রেখে অটোমেটিক কারবাইন থেকে ম্যাগাজিনগুলো খুলে ছুঁড়ে দিল অন্ধকারে, তিনটে তিন দিকে। রিভলভারগুলোও গেল ওগুলোর পিছু পিছু। তারপর এগিয়ে এসে তর্জনী দিয়ে জোরে একটা খোঁচা দিল প্রথম সার্জেন্টের পাঁজরে। চমকে উঠল লোকটা।
‘পাসপোর্ট!’
পিছন ফিরে না চেয়ে পাসপোর্ট দুটো ফেরত দিল লোকটা। চাপা গলায় বলল, ‘ধরা পড়তেই হবে তোমাদের। কতদূর যাবে?’
গর্জন করে উঠল রানাগু ‘চোপরাও ইস্টুপিড, পিটিয়ে তোমায় করব টিট!’
‘কি বললেন?’
‘ও তোমরা বুঝবে না, সুকুমার রায়ের ছড়া। এখন এই রাস্তা ধরে সিধে হাঁটতে শুরু করো। থামলেই গুলি খাবে। কুইক মার্চ!’
বুটের শব্দ তুলে এগোল ওরা তিনজন অন্ধকার রাস্তা ধরে।
একলাফে উঠে বসল রানা চালু মোটর সাইকেলের উপর। গিলটি মিয়া আছড়ে-পাছড়ে উঠে পড়ল পিছনে। রানার কানের কাছে মোলায়েম কণ্ঠে বলল, ‘বলেছিলাম না, দিনটা ভাল যাবে?’
তীরবেগে ছুটল ওরা ভেরোনার পথে।
.
বিশ মিনিট একটানা চলবার পর মোটর সাইকেলের গতি কিছুটা কমাল রানা। ততক্ষণে বাসকে ছাড়িয়ে বহুদূর চলে এসেছে ওরা।
‘আবার থামচেন কেন, স্যার?’
‘আর বেশিদূর এটাতে করে যাওয়া ঠিক হবে না। এতক্ষণে সারা ইটালির টহল-পুলিসকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। ঢিল খাওয়া ভীমরুলের মত ছুটছে ওরা চারদিকে। ডাইনে মোড় নেব এবার আমরা।’
‘তারপর?’
‘তারপর আবার পাহাড়। আবার হাঁটা। ভাবছি এবার সোজা সুইটজারল্যাণ্ডের বর্ডারের দিকে হাঁটা ধরব।’ ডানদিকে একটা রাস্তা পেয়ে মোড় নিল রানা। ‘মোটর সাইকেলটা ভালমত লুকিয়ে রাখতে পারলে ওরা মনে করতে পারে আমরা ভেরোনায় চলে গিয়েছি।
রাস্তাটা রাঙামাটির রাস্তার মত উঁচু-নিচু। রানা অনুভব করতে পারল, ক্রমে উপর দিকে উঠছে ওরা। ফাইভ হাওরেড সি.সি.হারলি ডেভিডসনের পক্ষে এই ঊর্ধ্বগতি কিছুই নয়। স্বচ্ছন্দ গতিতে উঠে যাচ্ছে সড়সড় করে। পথটা ক্রমে এবড়ো- খেবড়ো হয়ে উঠছে, কিন্তু তাতে তেমন কোন অসুবিধে ছিল না, ঝাঁকি খেতে খেতে বহুদূর চলে যেতে পারত ওরা, কিন্তু তৃতীয় পাহাড়টার মাথায় উঠে বহুদূরে একটা গ্রাম দেখতে পেল রানা। থেমে দাঁড়াল। অফ করে দিল সুইচ।
‘ওই গ্রামের পাশ দিয়ে এটা নিয়ে গেলে শব্দ শুনতে পাবে ওরা। পুলিস জিজ্ঞাসা করলে বলে দেবে। কাজেই আরামের ভ্রমণ এইখানেই শেষ। নেমে পড়ো, গিলটি মিয়া।’
মোটর সাইকেলটা ঠেলে নিয়ে রাস্তা থেকে বেশ অনেকটা দূরে সরে গেল রানা। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর একটা বড়সড় ঝোপ পাওয়া গেল। যথেষ্ট সময় ব্যয় করে খুবই যত্নের সাথে লুকিয়ে রাখল ওরা মোটর সাইকেলটাকে। এর উপর নির্ভর করছে অনেকখানি। এটা পেলেই বুঝে নেবে ওরা কোনদিকে গেছে পলাতক আসামী। বার-কয়েক চারপাশ থেকে টর্চ ফেলে দেখে নিশ্চিন্ত হলো রানা। আকাশ থেকে দেখা যাবে, কিন্তু পায়ে হেঁটে এর দু’হাত তফাৎ দিয়ে চলে যাবে যে কেউ, নজরে পড়বে না মোটর সাইকেল।
সন্তুষ্ট চিত্তে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল রানা। পিছনে বিমর্ষবদন গিলটি মিয়া।
‘কদ্দূর হাঁটতে হবে, স্যার?’ জিজ্ঞেস করল গিলটি মিয়া খানিক উসখুস করে।
‘দূর খুব বেশি না,’ হাসল রানা। ‘সোজাসুজি যেতে পারলে বড় জোর পঞ্চাশ-ষাট মাইল। কিন্তু এঁকেবেঁকে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে যেতে হবে আমাদের। পাঁচ-ছয় দিন লাগবে বর্ডারে পৌঁছতে। টিরানোতে একবার পৌঁছতে পারলে সোজা জুরিখ চলে যাব আমরা। সেখান থেকে প্লেন পেতে অসুবিধে হবে না।’
‘আমরা বর্ডার ক্রস করলেই এরা সব হাত গুটিয়ে নিয়ে হাল ছেড়ে দেবে?’
‘সিলভিও ছাড়বে না। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে সুইস পুলিসের কোন অভিযোগ নেই, অন্তত ওদিক থেকে বাঁচা যাবে। দুই তরফের তাড়া থেকে বাঁচতে পারলে আমাদের পক্ষে আত্মরক্ষা করা সহজ হবে।’
গত কালকের মরা চাঁদটায় একটু প্রাণ এসেছে আজ। বেশ আলো দিচ্ছে। পরিষ্কার স্বচ্ছ নীল আকাশ। অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে সারা আকাশ জুড়ে। চাঁদ না থাকলেও পথ চলতে অসুবিধে হত না।
নিঃশব্দে হেঁটে চলল ওরা। কখনও খাড়াই, কখনও উৎরাই। পথের পাশে গ্রামগুলো ঘুমিয়ে আছে নিঝুম হয়ে। ছায়ার মত হেঁটে চলে গেল ওরা পাশ দিয়ে। টের পেল না কেউ।
পাঁচ ঘণ্টা সমান গতিতে একটানা হাঁটবার পর থামল রানা একটা পাহাড়ের চূড়ায়।
‘কষ্ট হচ্ছে, গিলটি মিয়া?’
‘কি যে বলেন, স্যার!’ অমায়িক হাসি হাসল গিলটি মিয়া। ‘আমি আরও ভাবছিলুম আপনার কতা। আমার পাকীর মত শরীল, ওজনই বা কতটুকু যে টানতে কষ্ট হবে?’ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘তবে হ্যাঁ, খিদে লেগেছে খুব জোর, এটুকু বলতে পারি। কিচু যদি মুকে দিতে বলেন, আপত্তি করব না।
বসে পড়ল রানা। বেশ ক্লান্তি বোধ করছে সে। কিন্তু বেশিক্ষণ বিশ্রাম নেয়া যাবে না, রাত শেষ হবার আগেই ঢুকে যেতে হবে পাহাড়ী এলাকার একেবারে গভীর অঞ্চলে। কোনরকম ঝুঁকি নেয়া চলবে না আর।
খাওয়া সেরে দু’পেগ ব্র্যাণ্ডি ঢেলে নিয়ে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ল রানা, সিগারেট ধরাল একটা। ফুরফুরে পাহাড়ী বাতাসে ঘুম এসে যাওয়ার জোগাড় হলো।
‘উই যে দেকা যাচ্চে দূরে, স্যার, ওটা কি?’
‘লেক গার্ডা। ওই লেকের পাশ দিয়ে গেছে টেন্টো রোড। ওটা পেরিয়ে সোজা উত্তর-পশ্চিমে হাঁটতে শুরু করব আমরা। অনেকগুলো ছোট-খাট পর্বত ডিঙাতে হবে আমাদের। রাস্তাঘাট সুবিধের নয়। একেবারে বাজে। কষ্ট হবে খুব।’
‘সেজন্যে পরোয়া করি না, স্যার। কষ্ট জীবনে কম করিনি। একেক দিন যে পিটুনি শুরু করত আপতাব দারোগা…উফ্! রাম পিটুনি। হেগে মুতে একাকার করে ফেলতুম। তবু স্যার স্বীকার যেতুম না চুরির মাল কোতায় রেকেচি। বলে দিলে যে ধরা পড়ে যায় আমারই কোন স্যাঙাৎ।’ আবার জীবন-চরিত বর্ণনা করতে শুরু করেছে টের পেয়ে থেমে গেল গিলটি মিয়া। হাসল। ‘কী সুন্দর সব দিশ্য দেকতে দেকতে চলেচি, স্যার। ভালই লাগচে। দেশ দেকা তো হচ্ছে!’
হেসে উঠল রানা।
‘তোমাকে সাথে না আনলে ভুলই করতাম। একা একা এত পথ চলতে খুবই খারাপ লাগত।’ উঠে বসল রানা। অবশিষ্ট ব্র্যাণ্ডিটুকু গলায় ঢেলে নিয়ে ফ্লাস্কের মুখটা রেখে দিল যথাস্থানে। সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘চলো, আরও খানিকটা দেশ দেখা যাক।’
চলছে তো চলছেই।
বহু দূরে উঁচু পর্বতের চুড়োয় সূর্যের আলো দেখে বুঝল রানা সকাল হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। আবার খুব বেশি তাড়াহুড়োও নেই। দু’ঘণ্টার আগে ভোর হবে না সমতল ভূমিতে। ভেরোনা টেন্টো রোড পার হয়ে এসেছে ওরা বেশ কিছুক্ষণ হয়। খাড়াই-উৎরাই ভেঙে এগিয়ে চলেছে আরও, আরও অভ্যন্তরে।
বেলা সাড়ে নয়টা নাগাদ পর্বত ডিঙিয়ে উঠে এল সূর্য। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস উত্তপ্ত হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগল না। অবসন্ন পা টেনে টেনে আরও আধঘণ্টা চলার পর পর্বতমালার চতুর্থ সারির মাথায় উঠল ওরা।
‘ব্যস! আর না।’ থেমে দাঁড়াল রানা। ‘লম্বা একটা ঘুম দিয়ে উঠে তারপর রওনা হওয়া যাবে আবার।
‘ওহ্! কী সুন্দর!’ পিছন ফিরে চেয়েই মুগ্ধ হয়ে গেল গিলটি মিয়া।
একটা ঘন ঝোপের ছায়ায় বসে পড়ল ওরা। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে লেক গার্ডা। মনে হচ্ছে হলুদ রোদের চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে বিশাল লেকটা। খেলনার মত দেখা যাচ্ছে দূরে দূরে কয়েকটা ফার্ম-হাউস, মাঠ, খেত-খামার। গরু চরে বেড়াচ্ছে মাঠে। মস্ত গাছগুলোকে মনে হচ্ছে ছয় ফুট উঁচু। সত্যিই অপূর্ব। হঠাৎ মনে হয় স্বপ্নের ঘোরে আছি।
রাকস্যাক থেকে দুটো চাদর বের করে বিছিয়ে ফেলল গিলটি মিয়া। রানা অনুভব করল ক্লান্তিতে অল্প অল্প কাঁপছে ওর হাত- পা। শোয়ার প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল দু’জন। কি যেন জিজ্ঞেস করেছিল গিলটি মিয়া ঘুমজড়িত কণ্ঠে, উত্তর দেয়া হয়নি, দিলেও সে শুনতে পেত কিনা সন্দেহ।
ঘণ্টা তিনেক নিশ্চিন্তে ঘুমানোর পরই বিচিত্র দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করল রানা। প্রথমে দেখল পা পিছলে বিরাট একটা খাদে পড়ে যাচ্ছে সে। পড়ছে তো পড়ছেই- বাঁচার কোন আশা নেই। হঠাৎ দেখল আশ্চর্য সুন্দর দুটো পাখা গজিয়েছে ওর পিঠে। খিলখিল করে হাসছে একটা মেয়ে। আরে, মেয়ে তো নয়, অপূর্ব সুন্দরী এক পরী। দু’জনে মিলে উড়তে শুরু করল ওরা, হাওয়ায় ভেসে নিঃশব্দে উড়ছে ওরা মেঘের পাশ দিয়ে। মেঘটা হঠাৎ একটা মৌচাক হয়ে গেল। তেড়ে আসছে অসংখ্য মৌমাছি পালা, পালা, পালা! মেয়েটাকে আর দেখতে পেল না রানা। বোঁ বোঁ ছুটে আসছে খুদে খুদে খ্যাপা কীট। মৌমাছিগুলো হঠাৎ ভীমরুল হয়ে গেল। দ্বিগুণ বেগে আসছে এখন। এবার রীতিমত ভয় পেল রানা, জোরে জোরে পাখা নাড়তে শুরু করল। এমন সময় মটাশ করে ভেঙে গেল একটা ডানা। ভাঙা ডানাটা হাতে নিয়ে ভীমরুল খেদাচ্ছে, আর এক ডানা ঝাপটাচ্ছে রানা। ডানায় গুলি খাওয়া শকুনের মত পাক খেতে খেতে নেমে আসছে নিচে
ক্রমে বাড়ছে পতনের বেগ। রানা বুঝতে পারল, স্বপ্ন দেখছে সে। প্রায় জেগে উঠে পাশ ফিরল। কিন্তু ভীমরুলের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছে সে এখনও।
হঠাৎ সচকিত হয়ে চোখ মেলল রানা। শব্দের উৎস আন্দাজ করে চাইল সেদিকে এবং সাথে সাথেই আড়ষ্ট হয়ে গেল। কয়েক মাইল দূরে প্রকাণ্ড গঙ্গা ফড়িংয়ের মত উড়ছে একটা হেলিকপ্টার।
‘ও কিছু নয়, স্যার,’ মৃদুকণ্ঠে বলল গিলটি মিয়া। ‘একটা পেলেন। পোকা মারার ওষুদ ছিটাচ্চে বোধায়।’
‘নোড়ো না, গিলটি মিয়া। চুপচাপ পড়ে থাকো যেমন আছ। না। তারচেয়ে ঢুকে পড়ো চাদরের তলায়। এদিকে যদি আসেও, দেখতে পাবে না আমাদের।’
‘পুলিসের পেলেন বলে সন্দো করচেন?’
‘মনে হয় সিলভিওর দলের। সরকারী হেলিকপ্টার নয়।’
কয়েক মাইল দূর দিয়ে চলে গেল হেলিকপ্টার, ছোট্ট একটা বিন্দুতে পরিণত হলো, তারপর আবার ফিরে আসতে শুরু করল। মাইলখানেক এগিয়ে এসেছে এবার।
‘খুঁজচে আমাদের, স্যার!’ চোখ বড় বড় হয়ে গেল গিলটি মিয়ার। ‘গরু খোঁজা করচে সারাটা এলাকা!’
রাকস্যাক থেকে শক্তিশালী বিনকিউলারটা বের করে চোখে লাগাল রানা। একলাফে অনেকটা সামনে চলে এল হেলিকপ্টার। হেলমেট মাথায় পাইলটকে দেখতে পেল রানা পরিষ্কার, কিন্তু অপর একজন লোক ওপাশের জানালা দিয়ে নিচের দিকে চেয়ে রয়েছে, তাকে ঠিকমত চিনতে পারল না। পিছন থেকে রিককির মত লাগল কিছুটা, তবে অন্য যে-কেউ হতে পারে। আর একটু এগিয়ে যেতেই দৃষ্টিপথের আড়াল হয়ে গেল লোকগুলো।
‘পুলিসের হেলিকপ্টার না ওটা। কোসা নোস্ট্রা খুঁজছে আমাদের।’ ঘোষণা করল রানা।
‘আমাদের কিচু করার আচে বলে তো মনে হচ্চে না, স্যার।’
রানা টের পেল, সত্যি করবার তেমন কিছুই নেই এখন ওদের। আরও মাইলখানেক কাছে সরে এল হেলিকপ্টার অমোঘ নিয়তির মত।
‘তা ঠিক’ বলল রানা। ‘কিন্তু নড়াচড়া না করলে আমাদের খুঁজে বের করা সহজ হবে না। চাদর মুড়ি দিয়ে বিশেষ সুবিধে হবে বলে মনে হয় না। এবার ওটা দূরে সরে গেলে আমরা ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়ব হামাগুড়ি দিয়ে।
‘মনে হচ্চে ব্যাটারা পরিষ্কার জানে যে আমরা এইদিকেই কোথাউ নুকিয়ে আচি।’
‘আকাশ থেকে মোটর সাইকেলটা দেখতে পেয়েছে খুব সম্ভব,’ বলল রানা।
ধীরে ধীরে বহুদূরে একটা ছোট্ট বিন্দুতে পরিণত হলো হেলিকপ্টার। রাকস্যাক আর চাদর নিয়ে তিন ফুট উঁচু ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে সরে এল ওরা হামাগুড়ি দিয়ে। ঘন পাতা ছাউনি তৈরি করল ওদের শরীরের উপর। তবু গলা পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিতে বলল রানা গিলটি মিয়াকে। পাতার ফাঁক দিয়ে নীল আকাশের দিকে চেয়ে উপর থেকে এই ঝোপটা কেমন দেখাবে কল্পনা করবার চেষ্টা করল রানা। কল্পনায় শুধু একরাশ ঝোপ- ঝাড় দেখা গেল, নিজেদের দেখতে পেল না সে। নিশ্চিন্ত মনে হাসল রানা।
কয়েক মিনিট পরই বাড়তে শুরু করল আওয়াজ। আসছে। ক্যাড়কেড়ে বিশ্রী শব্দটা কানে লাগছে। পাতার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল রানা ওটাকে। কাছেই একটা পাহাড়ের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ওটা, মাত্র বিশ ফুট উঁচু দিয়ে। হঠাৎ নিরাপত্তা সম্পর্কে অনি য়তা দেখা দিল রানার মনে। এই ঝোপের আড়ালে ওরা সত্যিই কি নিরাপদ? কিন্তু এখন আর এখান থেকে সরে যাওয়ার কোন উপায় নেই।
দুইশো গজ দূর দিয়ে উড়ে চলে গেল হেলিকপ্টার। পাখার বাতাসে রুক্ষ ঘাসগুলোকে শুয়ে পড়তে দেখল রানা। কটকট কটকট করতে করতে চলে গেল ওটা লেকের দিকে।
‘লেকের ওপর আর খুঁজবে না, এক্ষুণি ফিরে আসবে ওটা,’ বলল রানা। ‘এবার আমাদের মাথার ওপর দিয়ে যাবে। মড়ার মত পড়ে থাকো, গিলটি মিয়া।
‘দেকে যদি ফেলেও, কি হবে?’ হঠাৎ বলে উঠল গিলটি মিয়া।
‘ওয়্যারলেসে খবর দিয়ে অন্যদের নিয়ে আসবে এখানে।’
‘ডাক দিলেই এখানে পৌঁচে যাওয়া কি অতই সহজ? আর ততক্ষণ আমরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাব? ধরা অত সহজ হবে না, স্যার।’
‘একবার খুঁজে পেলে আর পিছু ছাড়বে না এরা, ধরা আমাদের পড়তেই হবে। প্রয়োজন হলে আরেকটা হেলিকপ্টারে করে লোক পাঠাবে সিলভিও। কিন্তু আর কথা নয়। এসে পড়েছে। সাবধান!’
ফিরে আসছে হেলিকপ্টারটা। সোজা এই পাহাড়ের মাথা লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে ওটা। খুব ধীরে। এ পাহাড়ের বড়জোর বিশ ফুট উপর দিয়ে উড়ে যাবে।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে রাস্তার ওপর দিন-দুপুরে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ভাবতে যেমন লাগে সেইরকম একটা অনুভূতি হলো রানার মধ্যে। মনে হলো কিছুই আর অজ্ঞাত নেই পাইলটের কাছে। নিশ্চয়ই এই পাহাড়টাই ভালমত লক্ষ্য করে দেখছে এখন ও। হঠাৎ কেবিন-ডোরের সামনে দাঁড়ানো রিকিকে দেখতে পেল রানা। সামনে ঝুঁকে নিচের দিকে চেয়ে রয়েছে সে।
ঠিক মাথার উপর এসে পড়ল হেলিকপ্টার। খুন করে ফেলে রাখা লাশের মত চুপচাপ শুয়ে আছে রানা ও গিলটি মিয়া চিৎ হয়ে। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রয়েছে সোজা উপর দিকে।
রোটর ব্লেডের ঝোড়ো হাওয়া এসে লাগল ঝোপের গায়ে। ফাঁক হয়ে গেল পাতার ছাউনি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে এ-ওর গায়ে লুটোপুটি খাচ্ছে ঝোপগুলো, এদিকে রানা ও গিলটি মিয়ার মাথার উপর খোলা আসমান।
রিকির দাগী মুখে বীভৎস নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠল, পরিষ্কার দেখতে পেল রানা। পরমুহূর্তে দেখতে পেল কি যেন দাঁত দিয়ে ছিঁড়ছে রিকি। মুখের কাছে ডান হাত।
‘গ্রেনেড!’ চিৎকার করে উঠল রানা। ‘গ্রেনেড ফেলছে! সাবধান!’
বিদ্যুৎবেগে পিস্তল বের করল রানা। গুলি করল। কিন্তু ঠেকানো গেল না। দ্রুত নেমে আসছে গোলমত ভয়ঙ্কর বস্তুটা।
ঝলসে উঠল তীব্র আলো। সাথে সাথেই কানে তালা লাগানো প্রচণ্ড শব্দ। রানার মনে হলো দুলে উঠল গোটা পাহাড়। পরমুহূর্তে কি যেন ছুটে এসে লাগল কপালে। চোখের সামনে দেখতে দেখতে কালো হয়ে গেল নীল আকাশ।