বিদেশী গুপ্তচর – ২.৬

ছয়

পনেরো মিনিট দৌড়ে একটা সরু রাস্তায় পড়ল ওরা। আরও কিছুদূর এগিয়ে পড়ল বড় রাস্তায়। দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছে ওরা। কিছুদূর হেঁটে মুখ খুলল গিলটি মিয়া।

‘সকাল হতে আর খুব বেশি দেরি নেই, স্যার। এই খোলামেলা জায়গায় দিনের বেলা চলা বোধায় ঠিক হবে না। বহুদূর থেকেও চেনা যাবে আমাদের।’

দু’পাশে এবড়ো-খেবড়ো মাঠ, খেত। সব সমতল। সত্যিই, আত্মগোপনের কোন উপায় নেই। রানা জানে, কেবিন-ক্রুসেট খালি দেখেই পুরো এলাকাটা সার্চের ব্যবস্থা করবে পুলিস। বিশেষ করে বড় বড় শহরে খুবই তৎপর থাকবে ওরা। কাজেই এখন গ্রামের কাছাকাছি থাকাই ভাল। হাঁটা পথে সরে যেতে হবে যতদূর পারা যায়। এবং সবার অলক্ষে।

‘সবই নির্ভর করছে এখন আমাদের ধরার ব্যাপারে পুলিস কতটা আগ্রহী, তার ওপর,’ বলল রানা। ‘আমরা ভাবছি খুব বেশি কিছু অপরাধ করিনি আমরা। কিন্তু ওদের দৃষ্টিভঙ্গিটা আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়া বিচিত্র নয়। ওরা হয়তো ভাবছে, ম্যারিয়ানোর কেবিন-ক্রুসেট চুরি করে, পিস্তল দেখিয়ে ডিজেল চুরি করে ভয়ঙ্কর দুই বিদেশী ডাকাত বেরিয়েছে ডাকাতি করতে। পুলিস থামতে বলেছিল, আদেশ অমান্য করেছি আমরা, এটাকেও ওরা হয়তো বিরাট করে দেখছে। কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছে ওরা ব্যাপারটাকে সেটা বুঝতে না পারলে আমাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে না। হয় বেশি ভয় পেয়ে অনর্থক সময় নষ্ট করব, নয়তো ধরা পড়ে যাব অসতর্ক অবস্থায়।’

‘প্রথমটাই তো আমার কাছে ভাল মনে হচ্চে, স্যার। বেশি সাবদান হওয়াই ভাল। দেরি হয় হোক। কিন্তু রাতের বেলা তো হাঁটচি নিচ্চিন্ত মনে, দিনের বেলা কি করব?’

‘আমিও সেই কথাই ভাবছি। দু’পাশে ফার্ম-হাউস খুঁজতে খুঁজতে যাব আমরা। দিনের বেলাটা লুকিয়ে থাকার মত কোন জায়গা পেয়ে যেতেও পারি। খড়ের গাদায়, গোয়াল ঘরে বা গুদাম ঘরে কোথাও না কোথাও জায়গা পেয়েই যাব।’

ঘণ্টা দেড়েক হাঁটার পর হঠাৎ কান খাড়া করল রানা।

‘আমিও শুনতে পেয়েচি, স্যার!’ বলল গিলটি মিয়া। রাস্তা ছেড়ে ঢাল বেয়ে পাশের খাদে নামতে শুরু করেছে সে।

রানাও নামল পিছু পিছু। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি ঢালের গায়ে শুয়ে পড়ল ওরা উপুড় হয়ে। একটা গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ এগিয়ে আসছে দ্রুত।

‘মাটির গোন্দো সব দেশেই এক, তাই না, স্যার?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল গিলটি মিয়া।

ঝট করে ওর দিকে ফিরল রানা। ‘হ্যাঁ। মানুষও এক। সব মানুষ এক।’

চলে গেল গাড়িটা। হেডলাইট নেভানো। শুধু সাইডলাইট জ্বলছে। পুলিসের টুপি চিনতে পারল রানা এক ঝলক দেখেই। সময় নষ্ট করেনি ওরা।

রাস্তায় উঠে এল রানা।

‘মাটের মদ্যে দিয়ে হাঁটা ধরলে কেমন হয়, স্যার? রাস্তাটা বিশেষ নিরাপদ মনে হচ্চে না।’

‘এবড়ো-খেবড়ো মাঠে খুবই কষ্ট হবে হাঁটতে, অথচ বেশিদূর এগোতে পারব না। চলো, যতদূর পারা যায় রাস্তা ধরে এগোই, তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।’

ভাঙা চাঁদের আলো বেশ কিছুটা জোরদার হয়েছে। আরও হালকা হয়ে যাচ্ছে মেঘ। মোলায়েম আলোর মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলল ওরা। ফুরফুরে ঠাণ্ডা বাতাস। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বিদেশী এক নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অতীতের অনেক কথা ভিড় করে আসতে চাইছে রানার মনে। অবচেতন মনের কোন্ গোপন মণিকোঠায় পড়ে ছিল হাজারো টুকরো কথা, স্মৃতি- ভেসে উঠছে সেসব মনের পর্দায়। মনে হচ্ছে স্বপ্নের ঘোরে আছে সে, হাঁটছে স্বপ্নে। পৃথিবীটা মায়াবী এক স্বপ্নের দেশ।

আরও আধ ঘণ্টা হাঁটার পর ফার্ম-হাউস পাওয়া গেল একটা। ঘড়ি দেখল রানা। সাড়ে চারটা। ভোর হতে দেরি নেই। এখানেই চেষ্টা করবে, না আরও সামনে গিয়ে আরেকটা ফার্ম-হাউস খুঁজবে, সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করছিল রানা, এমনি সময় কথা বলে উঠল গিলটি মিয়া।

‘চেষ্টা করে দেকতে ক্ষতি কি, স্যার? পরেরটা আবার কতদূর তার ঠিক আছে?’

দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। রাস্তা থেকে শ দেড়েক গজ উত্তরে টালির ছাত দেয়া চুনকাম করা দোতলা বাড়ি। ইটালীর গৃহস্থ- বাড়ি। ঝকঝক করছে চাঁদের আলোয়। পাশেই গোলাঘর। তার পাশে গোয়াল।

‘সাবধান করে দেয়া হয়েছে এদের,’ বলল রানা। ‘রাস্তার দু’পাশে যত ফার্ম-হাউস আছে প্রত্যেকের কাছে যাবে পুলিস। তবু চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি নেই। চলো। রাত থাকতে থাকতে একটা আশ্রয় খুঁজে নিতেই হবে।’

বড় রাস্তা ধরে একটা খোয়া বিছানো পথ গেছে ফার্ম-হাউস পর্যন্ত। কিন্তু সে পথে না গিয়ে মাঠ ভেঙে এগোল ওরা। একশো গজ নিশ্চিন্তে হেঁটে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল গিলটি মিয়া।

ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠেছে একটা কুকুর। কুকুর তো নয়, যেন বাঘের গর্জন।

‘দেকা হয়েচে, স্যার! চলুন এবার!’

‘হাউণ্ড!’ আপন মনে বলল রানা। ‘গুণ্ডাকে বশ করবার কায়দাটা কাজে লাগাব নাকি? এটার বেলায় খাটবে সেটা?’

গুণ্ডা হচ্ছে রানার পোষা ব্লাড-হাউণ্ডের বাচ্চা। কষ্ট করে ওটার সাথে খাতির করেছে সে। এখন দারুণ ভাব।

‘কোন কিছু খাটবে না, স্যার! চলুন, মানে মানে কেটে পড়ি। ওই দেকুন!’

বাতি জ্বলে উঠেছে দোতলার একটা ঘরে। দ্বিগুণ জোরে চিৎকার শুরু করেছে কুকুরটা, টেনে ছিঁড়ে ফেলবার উপক্রম করেছে চেন। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল রানা।

‘দৌড় দাও, গিলটি মিয়া। এসো আমার সাথে। ওরা মনে করবে কুকুরের ডাকে ভয় পেয়ে ভেগেছি আমরা।

উল্টো দিকে দৌড়াতে যাচ্ছিল গিলটি মিয়া, রানাকে সোজা সামনের দিকে দৌড়াতে দেখে থমকে গেল এক সেকেণ্ড, তারপর পিছু নিল। এক ছুটে গোলাঘরের পিছনে এসে দাঁড়াল ওরা। ঘটাং করে দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেল ওরা পরিষ্কার

দোতলা থেকে একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ‘হুট করে বেরিয়ে পড়ো না, বাবা। সাবধান! নেন্নি যাচ্ছে, একটু দাঁড়াও।’

‘ওই হারামজাদা ছেলের জন্যে দাঁড়ালে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আমার,’ মোটা পুরুষ কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ‘কুকুরটাকে বিরক্ত করছে জানি কোন শালা।

‘আমি আসছি, বাবা, একটু দাঁড়াও!’ হারামজাদা ছেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

‘দু’জন আসচে!’ ভয়ে ভয়ে বলল গিলটি মিয়া।

‘তিনজন,’ বলল রানা। ঝনাৎ করে শব্দ হলো শিকলের। ‘কুকুরটাকে ছেড়ে দিল ব্যাটা।

‘এই সেরেচে।’ দেয়ালের সাথে সেঁটে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল গিলটি মিয়া। ‘সব্বো শরীল কাঁপচে স্যার। বুকের ভেতর…’

‘চুপ!’ চাপা গলায় ধমক দিল রানা। এগিয়ে গেল কয়েক পা। দশ সেকেণ্ডের মধ্যেই গোলাঘরটা ঘুরে চলে এল একটা বড়সড় হাউণ্ড। রানাকে দেখেই চাপা একটা গর্জন ছেড়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটে এল ওর দিকে।

ছ্যাৎ করে উঠল রানার বুকের ভিতরটা। কিন্তু নড়ল না একটুও। শেষ লাফটা দেয়ার আগে হঠাৎ থেমে দাঁড়াল হাউণ্ডটা। ইতস্তত করল কিছুক্ষণ, তারপর নাক নিচু করে শুঁকতে শুরু করল রানার চারপাশটা।

‘এই তো লক্ষ্মী ছেলে!’ বলল রানা। হালকা করে শিস দিল দাঁতের সাথে জিভ ঠেকিয়ে।

কাজ হলো এতে। কাছে সরে এল কুকুরটা। লেজ নাড়তে দেখেই নিচু হয়ে ওটার মাথায় আদর করল রানা। আদর পেয়ে একেবারে গলে গেল কুত্তার বাচ্চা, রানার গাল চেটে দেয়ার উপক্রম করল।

‘বিউনো! এদিকে এসো!’ চিৎকার শোনা গেল বুড়ো লোকটার।

আওয়াজ শুনে বোঝা গেল গোলাঘরের কাছাকাছি কোথাও রয়েছে লোকটা।

‘যাও, বিউনো। ডাকছে!’ মৃদুকণ্ঠে বলল রানা। ঠেলা দিল ওকে গোলাঘরের দিকে।

রানার মুখের দিকে চাইল হাউণ্ডটা, বুঝতে পারল কি বলতে চাইছে সে, এক ছুটে গোলাঘরটা ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল। রানা ফিরল গিলটি মিয়ার দিকে। নেই!

অবাক হয়ে কয়েক পা এগিয়ে এল রানা। দেখল ইতিমধ্যেই একটা দরজা পেয়ে গোলাঘরের ভিতরে ঢুকে গেছে গিলটি মিয়া, দরজাটা সামান্য একটু ফাঁক করে দেখছে বাইরের অবস্থা। রানা কাছে যেতেই বিগলিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘এমনটি আর দেকিনি! একেবারে ভোজবাজী দেকিয়ে দিয়েচেন, স্যার!’

দরজাটা মেলে ধরল গিলটি মিয়া। ভিতরে ঢুকল রানা। দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই টর্চ বের করল পকেট থেকে। ঘরটা চট করে একবার দেখে মইয়ের দিকে এগোল রানা।

একগাদা খড় জড়ো করা আছে মাচার উপর। চারপাশে হাতখানেক জায়গা শুধু খালি রাখা আছে চলাফেরার জন্যে। গাদার উপর উঠে পড়ল গিলটি মিয়া। মচমচ শব্দ হলো। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আরামের একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। সরু পথ বেয়ে রানা চলে এল একটা দরজার কাছে, সামান্য ফাঁক করে চোখ রাখল সেই ফাঁকে।

কয়েক হাত নিচেই দাঁড়িয়ে আছে দু’জন লোক। একজনের হাতে একটা লণ্ঠন। কান খাড়া করে কি যেন শুনছে ওরা। কাৎ হয়ে আছে ঘাড়।

‘খুব সম্ভব বিড়াল,’ হারামজাদা পুত্র বলল পিতাকে। ‘চলো বাবা, ঘুমিয়ে পড়বে। নইলে কাল আবার তোমার মেজাজের ঠেলায় জান বেরিয়ে যাবে সবার। বিউনোকে তো জানোই। কেউ থাকলে…’

গজগজ করে কি যেন বলল বুড়ো বোঝা গেল না। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে রওনা হলো বাড়ির দিকে।

‘এটাকে ছেড়ে রেখে দাও আজ রাতে,’ বুড়োর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। পুলিসকে খুশি করার জন্যে সারারাত জাগতে পারব না আমি। ওরা আমার কোন্ কাজে লেগেছে কবে?’

বোঝা গেল বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল দু’জনই। ঘটাং করে লেগে গেল বল্টু। খানিক বাদে দোতলার বাতি নিভে গেল।

উঠে পড়ল রানা খড়ের গাদায়।

‘শুয়ে পড়েছে ওরা। খিদে লেগেছে? কিছু খেয়ে নেবে?’

‘না, স্যার। একোন আর কিচু খাব না। ঘুম আসচে দু-চোক ভেঙে।’

‘ঠিক আছে, ঘুমিয়ে পড়ো তাহলে। কাল সারাটা দিন বোধহয় এখানেই থাকতে হবে আমাদের। সন্ধের পর হাঁটা ধরব আবার।’ চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল রানা। ‘পড়ুয়া পেরিয়ে পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে পড়তে পারলে দিনেও হাঁটা যাবে। তার আগে নয়।

একটা সিগারেট ধরাবার ইচ্ছে দমন করল রানা। বেশ কিছুক্ষণ ঘুম এল না ওর চোখে। অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়লে ঘুম আসতে চায় না সহজে। কম ধকল যায়নি গত কয়েকটা ঘণ্টা।

ভবিষ্যতের কথা ভাবল রানা কিছুক্ষণ। কত পথ চলতে হবে কে জানে। হন্যে হয়ে খুঁজছে ওদের পুলিস। সিলভিও যে চুপচাপ বসে নেই সেটাও সহজেই বোঝা যায়। একদিকে ইটালিয়ান পুলিস, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর কোসা নোস্ট্রা- কিভাবে বেরোবে সে এদেশ থেকে? কোনদিকে যাবে?

আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল রানা।

.

চমকে জেগে উঠল রানা। ওর হাত ধরে নাড়া দিচ্ছে গিলটি মিয়া।

কয়েকটা ফুটো দিয়ে রোদ এসে পড়েছে অন্ধকার ঘরে, বেশ কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে তার ফলে অন্ধকার। কয়েকজনের গলার আওয়াজ পেল রানা। খুব কাছেই।

‘কি ব্যাপার?’ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল রানা।

‘বাঁদা-কপি, স্যার!’ ফিসফিস করে বলল গিলটি মিয়া। ‘লরীতে তুলচে।’

সাবধানে কোন রকম শব্দ না করে উঠে পড়ল রানা। নিঃশব্দ পায়ে দরজার কাছে এসে চোখ রাখল ফাঁকে। দরজার ঠিক নিচেই দাঁড়িয়ে আছে একটা দশ-টনী ট্রাক। ত্রিপল দিয়ে অর্ধেকটা ঢাকা। ঝুড়ির পর ঝুড়ি সাজানো রয়েছে বাঁধা কপি।

বাপ-বেটা কথা বলছে ড্রাইভারটার সাথে খোশমেজাজে।

খানিকক্ষণ কান পেতেই বুঝতে পারল রানা। পড়ুয়ায় চলেছে এই বাঁধা-কপির চালান। কথা বলতে বলতে চলে গেল ওরা বাড়ির দিকে। বোধহয় চা-নাস্তা খাওয়ানো হবে ড্রাইভার সাহেবকে।

মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল রানা।

‘চলো, গিলটি মিয়া! রওনা হওয়া যাক।’

ঝটপট রাকস্যাক ঝুলিয়ে নিল ওরা পিঠে। দরজা খুলেই লাফিয়ে নামল রানা ঝুড়ি ভর্তি কপির উপর। দ্রুত হাতে কয়েকটা ঝুড়ি সরিয়ে দু’জনের বসবার মত জায়গা করল। তারপর ইশারা করল গিলটি মিয়াকে।

সরু একচিলতে জায়গায় দাঁড়িয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল আগে গিলটি মিয়া, তারপর ঝুপ করে নামল রানার পাশে। বসে পড়ল দু’জন।

না, চা-নাস্তা নয়, বোধহয় ভাড়া চুকিয়ে দেবার জন্যে নিয়ে গিয়েছিল ওরা ড্রাইভারকে। কারণ এক মিনিট পরেই ফিরে এল তিনজন ট্রাকের কাছে।

‘চলি, কাল দেখা হবে আবার,’ বলল ড্রাইভার গাড়িতে উঠতে উঠতে।

‘পারলে আর একটু সকাল সকাল এসো। গুডবাই।’

স্টার্ট হয়ে গেল এঞ্জিন। খোয়া বিছানো উঁচু-নিচু রাস্তা ধরে নাচতে নাচতে চলল ট্রাক বড় রাস্তার দিকে।

একগাল হাসল গিলটি মিয়া।

‘আজকের দিনটা খুব ভাল যাবে, স্যার।’

‘কি করে বুঝলে?’

‘শুরুটা দেকলেই বোজা যায়। ঘুম থেকে উটেই এই যে তৈরী গাড়ি পেয়ে গেলুম, এটাকে কি বলবেন আপনি? কপাল বলবেন না? আমরা ডেকেচি লরীটাকে? আপনিই এসে হাজির। দেকবেন, দিনটা আজ এরকমই যাবে। ঠিক সোমায় মতন সবকিচু হাজির পাবেন আজকে।’

‘দেখা যাক। সিগারেট ধরাল রানা। ‘এবার ম্যাপটা বের করো দেখি। শহরে ঢোকার আগেই নেমে পড়তে হবে আমাদের। কোনদিক থেকে কোনদিকে যাব আগে থেকে দেখে রাখা ভাল।’

ম্যাপটা খুলে পড়ুয়ার নিচে আঙুল রাখল রানা।

‘এইখানটায় নেমে যাব আমরা ট্রাক থেকে। শহরে কড়া পাহারার ব্যবস্থা থাকবে। কাজেই আগে নামব। এই যে দেখছ, এটা হচ্ছে পাহাড়ী এলাকা। অ্যাবানোর দিকে রওনা হব আমরা। ওখান থেকে হেঁটে চলে যাব বারবানো। ওখান থেকে ভিনসেনযায় এসে বাস ধরব ব্রেসিয়ার উদ্দেশে। ব্রেসিয়ায় পৌঁছতে পারলে কোন কৌশলে মিলানো পৌঁছানো অসম্ভব হবে না।’

‘তারপরেই পেলেনে উটব?’

‘সেই চেষ্টাই করব, তবে আগে থেকে বলা যায় না কিছুই। আমাদের আটকাবার সব ব্যবস্থাই করবে ওরা। যে-কোন মুহূর্তে প্ল্যান বদলাতে হতে পারে। আপাতত এই ঠিক থাকল, তারপর যেমন সমস্যা আসবে তার তেমন সমাধান বের করে নেব আমরা চলতে চলতে। আগে থেকে সব সমস্যার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে লাভ নেই।’

আধঘণ্টা বাঁধা-কপি ঝুড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দুলল ওরা ট্রাকের দোলায়। ট্রাকের গতি আঁচ করে নিয়ে মনে মনে অংক কষে বের করল রানা পড়ুয়া পৌঁছতে আর বড়জোর মিনিট দশেক আছে। সাবধানে ঝুড়ি সরিয়ে পথ করে চলে এল ওরা ট্রাকের পিছনে।

চারপাশে একবার চোখ বুলিয়েই মনটা দমে গেল রানার। সমতল খোলা জায়গা। দূরে দেখা যাচ্ছে মাঠে কাজ করছে কয়েকজন কৃষক।

‘এখেনে নামলে এস্টেট ধরা পড়ে যাব, স্যার,’ বলল গিলটি মিয়া। ‘নিয়ন সাইনবোর্ডের মত দেকা যাবে আমাদের তিন মাইল দূর থেকেও।’

‘এছাড়া আর কোন উপায় নেই এখন।’

‘তা ঠিক। শহরে ঢুকলেই ক্যাঁক করে ধরে নেবে শালারা।’ হাসল গিলটি মিয়া, ‘বহুদিন এরকম চোরের মতন পালিয়ে বেড়াইনি, স্যার। বেশ মজাই লাগচে কিন্তু! আপনি সাতে আচেন বলে অত ভয় লাগছে না। তা চলুন, হাঁ করে কি ভাবচেন, নেমে পড়া যাক!’

‘দূরে ওই যে পাহাড় দেখা যাচ্ছে, ওই পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছতে পারলে আপাতত সমস্যার শেষ। চলো। আমি রেডি বললেই লাফ দেবে।’

টেইলবোর্ড ধরে ঝুলে পড়ল দু’জন। নিচ দিয়ে সড়সড় সরে যাচ্ছে রাস্তা দ্রুতবেগে।

‘রেডি!’

একসাথে লাফ দিল দু’জন। কয়েক পা দৌড়ে ঠিক করে নিল ভারসাম্য, তারপর সাঁৎ করে সেঁটে গেল রাস্তার পাশে দেয়ালের গায়ে। আড়াল হয়ে গেল মাঠে কর্মরত লোকগুলো।

চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে গিলটি মিয়া বলল, ‘ওদের চোকে ফাঁকি দিয়ে পাহাড়ে পৌঁচানো যাবে না।’

‘ওই পাহাড়ে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে বলে মনে হয়?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘দেকতে তো কাচেই মনে হয়, স্যার। কিন্তুক আমার মনে হয়, এই মাট-ঘাট পেরিয়ে ওখেনে পৌঁচতে একটি ঘণ্টা সোমায় তো লাগবেই।’ খোঁচা খোঁচা দাড়ি ভর্তি গাল চুলকাল গিলটি মিয়া! ‘ওই গোলাঘরে দিনটা থেকে গেলেই বোধায় ভাল করতুম, স্যার।’

‘ওই কৃষকগুলো ছাড়া আর কেউ নেই আশেপাশে। ওরা আমাদের নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে কেন?’ ঘড়ি দেখল রানা। সোয়া নয়টা। ‘তিরিশ মাইল সরে এসেছি আমরা। কম কথা নয়। চলো, অনুশোচনা না করে এগোনো যাক।’

দেয়াল টপকে মাঠে নামল ওরা। এগোল পাহাড় লক্ষ্য করে। অসমান জমিতে হাঁটার গতি বাড়ানো যাচ্ছে না। বার বার ঘাড় কাত করে দেখছে ওরা কর্মরত কৃষকদের। পাঁচ-ছয়শো গজ দূরে কাজ করছে ওরা। ব্যস্ত হয়ে আছে কাজে, এদিকে চাইছে না কেউ। চারজন বিট তুলছে খেত থেকে। একজন কাস্তে দিয়ে ঘ্যাচ করে কাটছে বিটের সবুজ মাথা। অপর একজন সাজিয়ে রাখছে একখানা তিন চাকার ঠেলাগাড়িতে।

হাঁটু সমান উঁচু সবুজ ঘাস মাড়িয়ে এগিয়ে চলল ওরা। মাইল দু’য়েক গিয়ে ক্রমে ঢালু হয়ে গেছে জমিটা। এই ঢালের শেষ থেকে শুরু হয়েছে প্রথম পাহাড়। কয়েকটা ছোট ছোট পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে পারলে পৌঁছানো যাবে বড় পাহাড়ের গায়ে। তারপর শুরু হবে খাড়াই উতরাই ভেঙে শুধু হাঁটা আর হাঁটা।

লম্বা ঘাসের মাঠ অর্ধেক পেরোতেই দূর থেকে ভেসে এল একটা চিৎকার-ধ্বনি।

‘এই সেরেচে, স্যার!’

‘সরাসরি ওদের দিকে চেয়ো না!’ ধমক দিল রানা। ‘ডাকুক। শুনতে পাচ্ছি না আমরা।’

কৃষকদের ছাড়িয়ে মাত্র একশো গজ এগিয়েছে ওরা পাহাড়ের দিকে এমনি সময়ে দেখে ফেলেছে ওদের কেউ। তবে ওদের থেকে পাঁচ-ছয়শো গজ ডাইনে সোজা পাহাড়ের দিকে হাঁটছে রানা ও গিলটি মিয়া, ধরে ফেলা সহজ হবে না। আর একটু জোরে পা চালাল রানা।

আড়চোখে দেখল রানা তিনজন কৃষক হাত নেড়ে ডাকছে ওদের।

‘দৌড় দেব, স্যার?’

‘পা চালাও, গিলটি মিয়া। ওরা দৌড় দিলে আমরা দৌড়াব, তার আগে নয়।’

‘কিন্তুক ডাকচে কেন শালারা? আমরা যা-মন তাই করচি, ওদের কি?’

‘মনে হয় ওদের খবর দিয়ে রেখেছে পুলিস কিংবা কোসা নোস্টা।

আবার একবার আড়চোখে ওদের দিকে চেয়েই থমকে দাঁড়াল রানা। একজন লোক তীর বেগে ছুটছে একটা ফার্মহাউসের দিকে। বাকি পাঁচজন এগোচ্ছে ওদের দিকে কোণা-কোণি ভাবে। প্রমাদ গুনল রানা। চট করে ফিরল গিলটি মিয়ার দিকে।

‘না-হে, আর ভদ্রতা করে লাভ নেই। এসো ওদের দেখিয়ে দিই বাঙালী লৌড় কাকে বলে।’

ছুটল দু’জন। গিলটি মিয়াকে পাঁই পাঁই করে ছুটতে দেখে হেসে ফেলল রানা।

‘অত জোরে না। আরও দু’মাইল যেতে হবে আমাদের দৌড়ে। দম পাবে না শেষে।’

মাঝারি গতিতে এগিয়ে চলল দু’জন পাহাড়ের দিকে। ওই পাঁচজনও দৌড়াতে শুরু করেছে। জনা তিনেক খুব জোরে দৌড়াচ্ছে, রানা বুঝতে পারল বড়জোর পাঁচশো গজ দৌড়াবে ওরা ওই গতিতে, তারপর শুয়ে পড়বে চিৎ হয়ে। ঢালের কাছাকাছি দৌড়ের গতি আর একটু বাড়িয়ে দিল রানা। পাহাড় আরও দেড় মাইল।

পিছন ফিরে দেখল রানা, প্রায় দু’শো গজের মধ্যে এসে গিয়েছিল তিনজন, এখন পিছিয়ে যাচ্ছে আবার। বেশ অনেকখানি পিছনে আরও চারজন লোককে দেখতে পেল রানা। একজনের মাথায় কৃষকদের মাথাল, বাকি তিনজনের মাথায় হ্যাট। প্রাণপণে ছুটছে ওরা।

দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছল ওরা পাহাড়ের গায়ের কাছে। একটু হাঁপ ধরেছে দেখে মনে মনে স্থির করল রানা এবার ঢাকায় ফিরে স্কিপিং-এর মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। পাঁচ ফুট উঁচু একটা দেয়াল ডিঙিয়ে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় পড়ল ওরা। রাস্তা পেরিয়ে আবার একটা দেয়াল। সেটা পেরিয়ে উঠতে শুরু করল ওরা পাহাড়ে।

পিছনের চারজন ধরে ফেলেছে সামনের পাঁচজনকে। বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে এগোচ্ছে ওরা।

একই গতিতে পাহাড়ে উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছে কিন্তু গতি কমাল না রানা। দশ মিনিট পর পাহাড়ের মাথায় উঠে থেমে দাঁড়িয়ে চাইল পিছন ফিরে। বেশ জোরে হাঁপাচ্ছে ওরা এখন।

তিনজন এখনও দৌড়াচ্ছে ঢালু মাঠে, জনা চারেক দেয়াল টপকাচ্ছে, আর দু’জন উঠতে শুরু করেছে পাহাড় বেয়ে। হাঁপাচ্ছে হাপরের মত।

প্রায় দৌড়ে নামতে শুরু করল ওরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। অনেকখানি নেমে আসবার পর আরেকটা দেয়াল পাওয়া গেল সামনে। সেটা টপকেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা।

‘রেলওয়ে! এটার কথা খেয়াল ছিল না আমার!’ বলল রানা।

আর একটু নেমে রেল লাইন দেখতে পেল ওরা। পাহাড়ের খানিকটা অংশ প্রায় খাড়াভাবে কেটে বসানো হয়েছে রেল লাইন।

হেসে উঠল গিলটি মিয়া। চট করে চাইল রানা ওর দিকে। কান খাড়া করে কি যেন শোনার চেষ্টা করছিল গিলটি মিয়া। ঘাড় সোজা করে চাইল রানার দিকে।

‘এই দেকুন, স্যার, বলেছিলাম না দিনটা ভাল যাবে! কপাল আর কাকে বলে!’

কি ব্যাপারে কথা বলছে সেটা আর জিজ্ঞেস করতে হলো না রানাকে, গিলটি মিয়া থামতেই অস্পষ্টভাবে কানে এল ট্রেনের শব্দ। হাসি ফুটে উঠল রানার মুখে। ভুরু কপালে তুলে মাথাটা ডানদিকে কাত করল গিলটি মিয়া। ভাবটা- এই দেখুন!

আছড়ে-পাছড়ে দশ ফুট প্রায়-খাড়া পাহাড় বেয়ে নেমে এল ওরা নিচে। রেল লাইনের পাশ দিয়ে দৌড় দিল গজ-পঞ্চাশেক দূরে ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করবে বলে। ঝোপের আড়ালে পৌঁছবার সাথে সাথেই এঞ্জিনের নাকটা দেখতে পেল রানা। মোড় ঘুরে বেরিয়ে আসছে পাহাড়ের আড়াল থেকে।

মস্ত লম্বা এক মালগাড়ি। ওয়াগনের পর ওয়াগন- যেন শেষ নেই। টেনে নিয়ে এগোতে গিয়ে এঞ্জিনের জিভ বেরিয়ে যাওয়ার দশা। বড়জোর পনেরো কি ষোলো মাইল স্পীডে পার হয়ে গেল এঞ্জিনটা রানাদের লুকিয়ে থাকা ঝোপের পাশ দিয়ে। পরিষ্কার দেখা গেল ড্রাইভার ও ফায়ারম্যানকে। গিলটি মিয়ার কনুই ধরে টান দিল রানা। বেরিয়ে গেল আড়াল থেকে।

প্রথম দশ বারোটা বন্ধ ওয়াগন পেরিয়ে যেতে দিল ওরা। তারপরই এল গোটা কয়েক ছাত খোলা নিচু ওয়াগন, একটা করে হলুদ পেইন্ট করা ঝকঝকে ট্রাক্টর বসানো আছে প্রত্যেকটায়। ছ’সাত গজ দৌড়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল ওরা দ্বিতীয় খোলা ওয়াগনে।

‘লুকিয়ে পড়ো, গিলটি মিয়া।’ বলেই এক গড়ান দিয়ে ট্রাক্টরের আড়ালে চলে গেল রানা।

গিলটি মিয়াও এল পিছু পিছু।

খট্ খট্ খটাখট, খট্ খট্ খটাখট- এগিয়ে চলল মালগাড়ি। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর ট্রাক্টরের আড়াল থেকে দেখতে পেল রানা, পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে ট্রেনের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে একজন লোক আরেকজনকে। মোড় ঘুরে আড়াল হয়ে গেল ট্রেনটা, দেখা যাচ্ছে না ওদের। উঠে বসল রানা।

‘ওরা বুঝে নেবে আমরা পাড়ি জমিয়েছি এই ট্রেনে করেই। কিছু না, সামনের স্টেশনে শুধু একটা ফোন করে দিলেই হাতকড়া লাগিয়ে দেবে রেলওয়ে পলিস।’

‘আগে হাতের কাচে টেলিফোন পেতে হবে না ওদের?’

নিশ্চিন্ত মনে রাকস্যাক খুলে খাবার বের করতে শুরু করেছে গিলটি মিয়া।

‘পরের তিনজন পুলিসের লোক হলে আর ফোন পর্যন্ত পৌঁছতে হবে না, গাড়িতে পৌঁছে ওয়্যারলেসে খবর দিলেই চলবে। যাই হোক, আগে খেয়ে নেয়া যাক, তারপর ভেবে বের করা যাবে কি করা যায়।’

আধ ডজন করে স্যাণ্ডউইচ, দুটো করে আপেল, আর সামান্য কিছু আঙ্গুর দিয়ে নাস্তা সারল ওরা।

আউন্স দু’য়েক ব্র্যাণ্ডি ঢেলে নিল রানা ফ্লাস্কের মুখে। গিলটি মিয়া পানি খেল শুধু, এসব খেলে নাকি বমি আসে ওর। ম্যাপটা বিছিয়ে নিয়ে তার উপর ঝুঁকে পড়ল রানা।

‘এহ্-হে! দশ মাইল পরেই ক্যাসেলফ্রাংকো স্টেশন,’ বলল রানা। ‘দাঁড়াও, এই যে আরেকটা লাইন দেখা যাচ্ছে, ক্যাসেলফ্রাংকো ছুঁয়ে চলে গেছে ভিনসেন্যা। ওই ট্রেনে একটু জায়গা করে নিতে পারলে বোঝা যাবে সত্যিই আজ কপালটা খুলে গেছে।

‘শিম্পাঞ্জী না কি যেন বললেন, ওখানে গিয়ে কি করব?’

‘সারাদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকব, তারপর সন্ধের পর একটা বাসে উঠে রওনা হয়ে যাব ভেরোনার পথে।’

‘তার মানে আর হাঁটতে হচ্ছে না। ওফ্, বাঁচালেন, স্যার। আবার যদি হাঁটতে বলতেন, তাহলেই কম্মো কাবার হয়ে গিয়েছিল আমার।’

‘কিছুই বলা যায় না, গিলটি মিয়া। অত খুশি হয়ো না। অবস্থা খারাপ দেখলে আবার পাহাড়ী পথ ধরব আমরা।’

*

নীল আর ঘিয়ে রঙের মস্ত সি.আই.টি. বাসটা থেমে দাঁড়াল বাস স্টপেজে। দশ-বারোজন যাত্রী বসে আছে ভিতরে, আরও সাত-আটজন নারী-পুরুষ বাস-শেল্টার ছেড়ে এগোল বাসের দিকে। নামল না কেউ। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে প্রত্যেকটা মুখ পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে কনুই দিয়ে গুঁতো দিল রানা গিলটি মিয়ার পাঁজরে।

উঠে পড়ল ওরা বাসে। ভেরোনার টিকেট কাটল রানা। এগিয়ে গিয়ে একেবারে ড্রাইভারের কাছাকাছি একটা সীটে বসে পড়ল দু’জন রাকস্যাক দুটো লাগেজ র‍্যাকে গুঁজে দিয়ে।

বাসটা ছেড়ে দিতেই বিরাট একটা হাঁপ ছেড়ে রানার দিকে ফিরল গিলটি মিয়া। ফিফিস্ করে বলল, ‘ভাগ্যদেবি ছাড়েনি আমাদের, স্যার, একোনো আচে কাঁদের ওপর।

বেলা একটা দেড়টার দিকে ভিনসেন্যায় পৌঁছে গেছে ওরা। সারাটা দিন কাটিয়েছে একটা সিনেমা হলে পর পর তিনটে ছবি দেখে। সন্ধে একটু ঘন হয়ে আসতেই বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে এই বাস-স্ট্যাণ্ডে।

‘ভেরোনায় পৌঁছে একটা গাড়ি চুরির চেষ্টা করতে হবে,’ বলল রানা। ‘ভাড়া নিতে গেলেই ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। রাতারাতি যদি ব্রেসিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারি, তাহলে বুঝব সত্যিই কাজের কাজ হলো।’

‘মিলানো পর্যন্ত সেই গাড়িতে গেলে ক্ষতি কি?’ জিজ্ঞেস করল গিলটি মিয়া।

‘অটোস্ট্রাডা পেরোনো মুশকিল হবে।’

‘সেটা আবার কি?’

‘ব্রেসিয়া থেকে মিলানো পর্যন্ত মোটরের রাস্তাকে অটোস্ট্রাডা বলে। টিকেট কাটতে হয় ওই রাস্তা ব্যবহার করতে হলে। দু’মাথায় পুলিসের চেক পোস্ট আছে। ধরা পড়ে যাব।’

‘কোনও লরীর পেচনে উটে বসলেই হয়।’

‘আমাদের খোঁজে আছে ওরা,’ বলল রানা। ‘সার্চ করতে পারে।’

‘তাহালে অন্য কোন রাস্তায় গেলেই হয়। আর রাস্তা নেই?’

‘আগে গাড়ি তো একটা সংগ্রহ করি, তারপর দেখা যাবে কি করা যায়।’

আটটা চল্লিশে থামল বাস ট্যাভারনিল বাস-স্টপেজে। গোলমালের জন্য মনে মনে তৈরি ছিল ওরা, কিন্তু এতই আকস্মিকভাবে ঘটল ব্যাপারটা যে রীতিমত চমকে উঠল দু’জন।

বাস-স্টপেজে আলো ছিল না, কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে বাসের ভিতরের আলোয় নিজেরই ছায়া দেখতে পাচ্ছিল রানা। বাইরেটা অন্ধকার।

দরজা খুলে গেল, ক্র্যাশ-হেলমেট পরা একজন মোটরসাইকেল সার্জেন্ট দাঁড়াল সেখানে এসে। পিঠে ঝুলানো অটোমেটিক কারবাইন, ডান হাতটা ওয়েইস্ট-হোলস্টারে রাখা রিভলভারের বাঁটের উপর। মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল গিলটি মিয়ার মুখটা।

প্রত্যেকটা প্যাসেঞ্জারের মুখের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে স্থির হলো সার্জেন্টের চোখ দুটো রানার মুখে এসে। তারপর দেখল গিলটি মিয়াকে।

‘এই সেরেচে!’ ঠোঁট না নড়িয়ে বলল গিলটি মিয়া।

‘বোঝা যাচ্ছে, কপালটা খুব ভাল আজ!’ টিটকারির সুরে বলল রানা।

‘দিনটা ভাল যাবে বলেচি, স্যার,’ রেগে গেল গিলটি মিয়া। ‘রাতের কতা তো বলিনি!’

‘আমি বলছি। রাতটাও ভাল যাবে। তুমি শুধু আমার ইঙ্গিতের অপেক্ষায় থেকো।’

‘আপনারা দয়া করে বাইরে আসুন,’ তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল সার্জেন্ট।

বোকার মত চেয়ে রইল রানা ওর দিকে।

‘আমাকে কিছু বলছেন?

‘আপনাদের দু’জনকে। একটু বাইরে আসুন, সিনর।’

‘কেন? কি ব্যাপার!’ যেন আকাশ থেকে পড়ল রানা।

আর সব প্যাসেঞ্জার হাঁ করে চেয়ে আছে ওদের দিকে। ড্রাইভার ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে সার্জেন্টকে, চোখে-মুখে অস্বস্তি। ওর বাসের ভিতর কোন গোলমাল হোক সেটা ও চায় না।

‘আপনাদের কাগজপত্র দেখতে হবে,’ বলল ধৈর্যের প্রতিমূর্তি সার্জেন্ট। ‘নেমে আসুন।’

হতাশ ও বিরক্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল রানা, উঠে দাঁড়িয়ে রাকস্যাকটা নামাল, ওটা পরতে পরতে বলল, ‘তোমারটা হাতেই রাখো, গিলটি মিয়া। এই ব্যাটাকে কাবু করতে হতে পারে। তৈরি থেকো।’

বাস ড্রাইভার চিৎকার করে প্রশ্ন করল, ‘কত দেরি হবে আপনাদের? এমনিতেই লেট হয়ে গেছি।’

‘এদের জন্যে অপেক্ষা করবার দরকার নেই,’ বলল সার্জেন্ট। ‘তুমি রওনা হতে পারো।’ কথাটা বলেই রাস্তায় নেমে দাঁড়াল সে, রানাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘জলদি!’

বুঝতে কিছুই বাকি রইল না রানার। গিলটি মিয়ার দিকে চেয়ে হাসল অভয়-হাসি। এগোল দরজার দিকে।

রাস্তায় নেমে কালো হয়ে গেল গিলটি মিয়ার মুখ। আরও দু’জন সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে। একজনের হাতে কারবাইন।

‘এই সেরেচে! এরা দেকচি তিনজন!’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *