পাঁচ
‘কিছুই করতে পারলাম না, সিনর!’ অবিরাম কাঁদছে বাতিস্তা, ফোঁপাচ্ছে। দরদর জল গড়াচ্ছে দু’চোখ বেয়ে। ‘ওরা প্রতিশোধ নিয়ে গেছে ওড্ডির মৃত্যুর। আমি যখন এসে পৌঁছলাম, তখন সব শেষ।’
‘আক্ষেপ করে কোন লাভ নেই, বাতিস্তা।’ ওর কাঁধের উপর হাত রাখল রানা। ‘আমাদের করবার কিছুই ছিল না। এখনও নেই। তুমি বাসায় চলে যাও। কি করতে হবে পরে একসময় জানাব আমি তোমাকে।’
‘আর আপনি? আপনি কি করবেন এখন?’
‘এখনও ঠিক করতে পারিনি কি করব। অনেকটা ভরসা করেছিলাম ওস্তাদের জোগাড় করা মোটরবোটের ওপর। এখন কি করা যায় ভেবে বের করতে হবে আবার। বদলে নিতে হবে প্ল্যানটা।’
‘কেন? মোটরবোটের চাবি তো আমার সামনে ওস্তাদকে দিয়ে দিয়েছে সিনর ম্যারিয়ানো। আপনাকে দেয়নি সেটা ওস্তাদ?’
‘না। হয়তো ভুলে গেছে।’
‘তাহলে নিশ্চয়ই ওটা ওঁর পকেটেই আছে,’ বলতে বলতে ঘরে ঢুকে পড়ল বাতিস্তা। জ্যাকেটের ভিতরের পকেট থেকে বের করে আনল দুটো চাবি পরানো একটা সুদৃশ্য রিঙ। ফিরে এসে রানার হাতে দিল ওটা। ‘চলুন, আমি চিনি বোটটা। দেখিয়ে দিচ্ছি আপনাকে।’
‘ভেরি গুড!’ বলল রানা। ‘তাহলে আর প্ল্যান বদলানোর কোন দরকার নেই। চলো, পথে বুঝিয়ে দিচ্ছি তোমাকে তোমার পরবর্তী কাজটা।’
দশ মিনিট অনর্গল কথা বলল রানা। চুপচাপ শুনল বাতিস্তা হাঁটতে হাঁটতে।
সব শুনে বাতিস্তা বলল, ‘কাজটা আপনার জন্যে খুবই বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে।’
‘কিন্তু এছাড়া ভেনিস থেকে ওদের নজর অন্যদিকে ফেরাবার আর কোন উপায় নেই।’
‘তা ঠিক,’ চিন্তিত মুখে বলল বাতিস্তা। ‘কিন্তু আমাকে সাথে নিলে আপনার অনেক সুবিধে হত।’
‘হত। কিন্তু তুমি ভেনিসে থেকে যে উপকার করতে পারবে, আমার সাথে গেলে সেটা পারবে না।’
মাথা ঝাঁকাল বাতিস্তা। বুঝতে পেরেছে। ‘ঠিক আছে। অনুকূল পরিবেশ দেখলেই প্লেনে তুলে দেব আমি ওকে।’
আঙুল তুলে দেখাল বাতিস্তা বোটটা। খুশি হয়ে উঠল রানা মনে মনে। ঝকঝকে চেহারার একটা বত্রিশ ফুট লম্বা কেবিন- ক্রুসেট। রানা জানে, খুবই শক্তিশালী এঞ্জিন থাকে এসব কেবিন- ক্রুসেটে। ট্যাংক দুটো এখন ভরা থাকলেই হয়।
যা ভয় পেয়েছিল, তাই। একটা ট্যাংক একেবারে খালি, অপরটায় অর্ধেক আছে তেল।
‘কোন চিন্তা নেই,’ বলল বাতিস্তা। ‘একটু এগোলেই মোটরবোটের ডিজেল-পাম্প। চলুন, তেল ভরা হলে নেমে যাব আমি।’
তেলের কথা শুনেই চোখ কপালে তুলল পাম্পওয়ালা। ‘এত রাতে ডিজেল দেয়া যাবে না। পাম্প বন্ধ।’
‘ডবল পয়সা দেব। একটু কষ্ট করতেই হবে আমাদের জন্যে, সিনর। আমাদের খুবই জরুরী দরকার।’ পকেট থেকে বেশ কয়েকটা পাঁচ হাজার লীরার নোট বের করে লোকটার নাকের সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে আনল রানা।
লোভে চকচক করে উঠল লোকটার চোখ জোড়া টাকা দেখে, কিন্তু নিভে গেল আলোটা খুব অল্পক্ষণেই। মাথা নাড়ল সে। ‘আমি খুবই দুঃখিত, সিনর। আপনাকে সাহায্য করতে পারলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু আসলে তেলই নেই আমার কাছে। আগামীকাল নতুন কনসাইনমেন্ট আসবে, তখন আপনাকে তেল দিতে কোন অসুবিধেই থাকবে না আর।’
রানা বুঝল, মিথ্যে কথা বলছে লোকটা। পাম্পটা দশ সেকেণ্ড পরীক্ষা করেই বুঝতে পারল ডিজেলের অভাব নেই ট্যাংকে। মৃদু ইশারা করল বাতিস্তাকে। এক লাফে লোকটার পিছনে চলে এল বাতিস্তা, পিছন থেকে পেঁচিয়ে ধরল গলা।
‘খবরদার!’ লোকটার কানের কাছে ফিস ফিস করে বলল বাতিস্তা, টু শব্দ করলে মটকে দেব ঘাড়।’
লোকটার পকেট থেকে চাবি নিয়ে পাম্প চালু করল রানা। ট্যাংক দুটো পুরো ভরে নিয়ে এসে দাঁড়াল লোকটার সামনে। ফেরত দিল চাবি। চার-পাঁচটা পাঁচ হাজার লিরার নোট ঢুকিয়ে দিল লোকটার বুক পকেটে। হাসল।
‘মিথ্যে কথা কেন বলছিলে?’
কোন উত্তর নেই। গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকটা নাক মুখ কুঁচকে। আশঙ্কা করছে এই বুঝি ধাঁই করে ঘুসি পড়বে ওর নাকের ওপর। মারল না রানা। আরও দুটো নোট গুঁজে দিল ওর পকেটে। পিস্তল বের করল।
‘একে ছেড়ে দিয়ে বাসায় চলে যাও তুমি,’ বাতিস্তাকে বলল রানা। ‘কোথায় কোথায় খোঁজ নিতে হবে তা তো জানাই আছে তোমার। লাইন পরিষ্কার দেখলে বাকি কাজটুকু সেরে ফেলবে। গুডবাই।’ লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে বাতিস্তা এক পা দু’পা করে। বেশ কিছুদূর সরে যেতেই উঠে পড়ল রানা মোটরবোটে। পিস্তলটা পকেটে পুরে বলল, ‘নেমকহারামী কোরো না। ফলটা তোমার জন্যেই খারাপ হবে।’
ছোট্ট একটা গর্জন করেই চালু হয়ে গেল এঞ্জিন। ধীরে ধীরে এগোল বোটটা, আর একটু গেলে পড়বে বড় খালে, তারপর বাড়বে স্পীড। চিওগিয়ার দিকে যাবে প্রথমে, সোজা দক্ষিণে, তারপর পো নদী বেয়ে চলে যাবে মিলানো পর্যন্ত; সেখান থেকে চেষ্টা করবে প্লেন ধরবার। রানা আশা করেছিল, টে, প্লেন, বাস বা গাড়িতে করে যাতে ও ভেনিস থেকে বেরোতে না পারে সে ব্যবস্থা করেই সন্তুষ্ট হবে সিলভিও, ও যে এত অল্প সময়ে বোট সংগ্রহ করে ফেলতে পারবে সেটা কল্পনাও করতে পারবে না। কিন্তু পাম্পওয়ালার ব্যবহার দেখে ভিতরে ভিতরে চমকে গেছে ও। প্রথমে এয়ারপোর্টের অসহযোগিতা, তারপর এই ডিজেল-অসহযোগ- নাহ্, দৈব-সংযোগ হতেই পারে না। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী কোন ব্যক্তির আদেশ আছে এদের উপর। রানার নাম ও চেহারার বর্ণনা দেয়া আছে এদের কাছে। রানা কি ভাবে ভেনিস থেকে বেরিয়েছে সে খবর সিলভিওর কানে পৌঁছতে দেরি হবে না। কাজেই মিনিটে মিনিটে প্ল্যান পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে। গোড়াতেই গলদ রয়ে গেল, কিন্তু ডিজেল ছিনিয়ে না নিয়ে আর কোন উপায় ছিল না ওর।
হঠাৎ ধুপধাপ পায়ের শব্দে চমকে ডানদিকে ফিরল রানা ও গিলটি মিয়া।
‘ঘাপলা বেধে গেছে, স্যার,’ বলল গিলটি মিয়া। ‘পুলিস!’
চারজন সেপাই এসে দাঁড়িয়েছে পারে। সশস্ত্র।
‘এই যে, সিনর!’ চিৎকার করে উঠল ওদের একজন। ‘মোটরবোট ভিড়াও তীরে।’
‘থামাতে বলচে, স্যার। থামাবেন?’ জিজ্ঞেস করল গিলটি মিয়া।
‘দাঁড়াও, দেখি।’ গতিটা একটু মন্থর করে দিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। পারে দাঁড়ানো সিপাইগুলোর কাছাকাছি এসে গেছে ওরা এখন। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল রানা, ‘কি ব্যাপার? কি হয়েছে?’
‘থামাও বোট! পারে নিয়ে এসো।’ বোটের সাথে হাঁটতে শুরু করেছে ওরা।
‘কেন? কি হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
বড় খালের একেবারে কাছে চলে এসেছে ওরা।
‘কি হয়েছে ভাল করেই জানা আছে তোমার!’ ধমকে উঠল একজন পার থেকে। পাম্প থেকে ডিজেল চুরি করেছ তোমরা এক্ষুণি। থামাও বোট!’
সবই বুঝল রানা। এখন বোট থামানো মানে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া, তারপর চলবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, কৈফিয়তের পর কৈফিয়ত। ওস্তাদের খুনের সাথে ব্যাপারটা জড়িয়ে ফেললে তো আর কথাই নেই। অন্তত দশ দিনের জন্যে আটকে যাবে সে ভেনিসে।
‘কি হলো? থামাচ্ছ না?’ রেগে উঠল একজন কর্কশ কণ্ঠধারী।
‘একটু তাড়া আছে, দাদা,’ বলল রানা। ‘আরেকদিন গল্প করা যাবে, আজ আসি।’
থ্রটল খুলে দিল রানা অর্ধেকটা। প্রায় লাফিয়ে এগোল কেবিন ক্রুসেট। মোড় নিল বাঁয়ে।
‘গুলি করবে সন্দো হচ্ছে, স্যার!’ বলল গিলটি মিয়া। ‘বন্দুক নামাচ্চে কাঁধ থেকে।’
‘শুয়ে পড়ো,’ বলল রানা। নিজেও নিচু করল মাথাটা।
বড় খালে এসে গেছে বোট। থ্রটল পুরো খুলে দিল রানা। দ্বিগুণ হয়ে গেল এঞ্জিনের গর্জন, সামনের দিকটা পানি থেকে একহাত উপরে উঠে গেল। ফুল-স্পীডে বাঁক নিয়ে আড়াল হয়ে গেল পারে দাঁড়ানো সেপাইদের রাইফেলের মুখ থেকে।
সোজা হয়ে বসল রানা। সিগারেট ধরাল।
.
লিডো পেরিয়ে পেলেস্ট্রিনার দিকে চলেছে কেবিন-ক্রুসেট অন্ধকার ভেদ করে। কোথাও বাতির কোন চিহ্ন নেই। আকাশে হালকা এক পরতা মেঘ থাকায় আধ-খাওয়া চাঁদটা ম্লান ভূতুড়ে আলো ফেলছে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের বিষণ্ণ ঢেউয়ের মাথায়।
শুয়ে শুয়ে কুঁই কুঁই করে করে বাংলাদেশের একটা জনপ্রিয় পল্লীগীতি গাইছে গিলটি মিয়া।…তোমরা সুখে রইলা। কোন দূরে যাও চইলা। নাইয়ারে, নায়ে বাদাম তুইলা…। হু-হু বাতাসে ডুকরে কেঁদে উঠতে চায় মনটা অচেনা, অজানা এক গ্রাম্যবধূর দুঃখে।
শক্তিশালী একটা শর্ট-ওয়েভ রেডিয়ো রিসিভারের টিউনিং নব ঘুরাচ্ছিল রানা, কানে হেডফোন। বিরক্ত ভঙ্গিতে খুলে ফেলল সে হেডফোনটা, অফ করে দিল রেডিয়ো।
‘নাহ্! আর পারা গেল না!’
ধড়মড়িয়ে উঠে বসল গিলটি মিয়া।
‘কি হলো আবার?’
‘এই বোটে করে আর বেশিদূর যাওয়া নিরাপদ নয়,’ বলল রানা। ‘পেসারো পর্যন্ত যত কোস্টাল-টাউন আছে সব জায়গার পুলিসকে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে। দুটো মোটরবোট নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে চিওগিয়া পুলিস। খুঁজছে আমাদের।’
‘অন্যায়টা কি করলাম আমরা, স্যার? আমাদের বিরুদ্দে কি প্ৰমাণ…’
‘কথা তো সেটা নয়,’ বলল রানা। ‘যেমন করে হোক আমাদের ঠেকানো দরকার। ঠেকাতে পারলে নোট-বইটা কেড়ে নেয়া এমন কিছু কঠিন হবে না ওদের পক্ষে। দারুণ সুবিধে হয়েছে সিলভিওর আমরা ডিজেল চুরি করতে বাধ্য হওয়ায়। এখন পুরো ইটালিয়ান পুলিস ফোর্স ব্লাড-হাউণ্ডের মত লেগে গেছে আমাদের পেছনে। হন্যে হয়ে খুঁজবে ওরা আগামী কয়েকদিন। সিলভিওকে আর কষ্ট করতে হবে না, পুলিসই কষ্ট করছে ওর হয়ে। কী মজা!’ সিগারেট ধরাল রানা। ‘দিনের বেলা এক মাইল দূর থেকে যে কেউ একবার তাকালেই চিনতে পারবে এই বোট। এর চেহারার বর্ণনা দিয়ে আকাশ-বাতাস গরম করে তুলেছে ব্যাটারা। টিটির দিকে পালাব তারও উপায় দেখছি না। পো নদী ধরে যে মিলানো পর্যন্ত পৌঁছতে পারব, মনে হয় না, ধরা পড়ে যাব আগেই। কাজেই ওই দুটো মোটরবোটের গুপ্তরে পড়বার আগেই তীরে পৌঁছোনো দরকার আমাদের। মোটরবোট ছেড়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে পড়ুয়া পৌঁছবার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। আমাদের চেহারা দেখতে পায়নি পুলিস, কাজেই এদিক দিয়ে চেষ্টা করলে ওদের আঙুল গলে বেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব নাও হতে পারে।’
‘ওরেব্বাপ! হাঁটতে হাঁটতে ক্ষয়ে যাবে পা। পড়ুয়ায় পৌঁচতে পৌঁচতে দেখব আরও ছ’ইঞ্চি বেঁটে হয়ে গেচি!’
কয়েক সেকেণ্ড চিন্তা করল রানা চিওগিয়া পৌঁছে পারে নামবে না এখুনি নামবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে বাঁক নিল সে। হঠাৎ কথা বলে উঠল গিলটি মিয়া। কান পেতে কি যেন শুনবার চেষ্টা করছে সে।
‘একটা ধুকপুক এঞ্জিনের শব্দ যেন শুনতে পেলুম, স্যার।’
‘কতদূরে?’ বলেই থ্রটল বন্ধ করে দিল রানা।
গিলটি মিয়াকে আর উত্তর দিতে হলো না। পরিষ্কার শুনতে পেল রানা মোটরবোটের এঞ্জিনের শব্দ। ডানদিক থেকে। এগিয়ে আসছে এইদিকে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না কিছুই। ধীরে ধীরে থেমে এল কেবিন ক্রুসেট। সিগারেটটা সাবধানে নিভিয়ে ফেলল রানা।
‘একটা চান্স্ নিয়ে দেখা যাক,’ বলল রানা। ‘অন্ধকারে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারে।’
চুপচাপ বসে রইল ওরা। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এঞ্জিনের শব্দটা জোর হচ্ছে ক্রমেই।
‘মনে হচ্চে অন্ধকারে আমাদের ঘাড়েই এসে পড়বে শালারা।’
সামান্য একটু থ্রটল দিয়ে খানিকটা বাঁয়ে সরিয়ে নিল রানা বোটটা। প্রায় নিঃশব্দে সরে গেল ওরা বেশ খানিকটা।
এগিয়ে আসছে পুলিসের বোট। এঞ্জিনের শব্দ বেড়ে গেছে এখন কয়েকগুণ। অনেক কাছে এসে পড়েছে। এমনি সময় দপ করে জ্বলে উঠল সার্চলাইট। তীব্র উজ্জ্বল সাদা আলো দিন করে ফেলল রাতকে।
‘পুলিসের বোট!’ চাপা কণ্ঠে বলল রানা। পুরো থ্রটল খুলে দিল সে। ‘ভাগলাম জান-প্রাণ নিয়ে।’
সার্চলাইটটা ঘুরে এসে স্থির হলো কেবিন-ক্রুসেটের উপর। ততক্ষণে ওটার নাক উঠে পড়েছে পানি ছেড়ে হাতখানেক উপরে। খোলা সমুদ্রের দিকে ছুটেছে প্রাণপণে।
‘ধরে ফেলচে, স্যার!’ ভীত গিলটি মিয়ার কণ্ঠস্বর। ‘এগিয়ে আসচে। পারচি না আমরা!’
প্রথম এক মিনিট কমে এল দূরত্ব, তারপর কয়েক সেকেণ্ড সমান থাকল, তারপর বাড়তে শুরু করল।
‘নিচু হয়ে থাকো, গিলটি মিয়া! চেহারা যেন দেখতে না পায়। মাইল দশেক ঘুরে আমরা আবার ফিরে আসব পারে।’
‘দুটো বোট খুঁজচে আমাদের। তা আরাকটা কই?’
‘চারদিকে চোখ রাখো। এর হাত থেকে বেরিয়ে আবার ওটার গুপ্তরে না পড়ি। সাবধান, গিলটি মিয়া, গুলি করছে ওরা!’
ছোট্ট একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেয়েছে রানা। পরমুহূর্তে কড়াৎ করে আওয়াজ হলো। মৃদু গুঞ্জন তুলে মাথার উপর দিয়ে চলে গেল পাঁচ পাউণ্ডের গোলা।
উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলেছে সার্চলাইটের আলো। বেশ অনেকটা দূরে সরে গেছে কেবিন-ক্রুসেট। দ্রুত সরে যাচ্ছে আরও দূরে। দ্বিতীয় গোলাটা পানিতে পড়ল দশ হাত ডাইনে। আধ মিনিটের মধ্যে আরও একটা স্ফুলিঙ্গ দেখা গেল। শব্দটা পৌঁছতে আরও একটু দেরি হলো। কিন্তু গুলিটা পৌঁছল ঠিক ঠিক। ছাতের খানিকটা অংশ মড়মড় করে ভেঙে দিয়ে বেরিয়ে গেল সেটা, ভাঙা কাঠের টুকরো-টাকরা পড়ল রানার আশেপাশে। গতিপথ সামান্য একটু পরিবর্তন করল রানা। নতুন গতিপথে বাতাসের বাধা কমে যাওয়ায় আরও জোরে ছুটল কেবিন-ক্রুসেট। সার্চলাইটের আওতার বাইরে চলে এসেছে ওরা এখন।
নিভে গেল সার্চলাইট। ডাইনে মোড় নিল রানা এবার। পুলিস বোটের দুটো লাল বাতি দেখা যাচ্ছে আধ মাইল দূরে। সোজা খোলা সমুদ্রের দিকে চলেছে ওটা।
‘আপাতত ধুলো দেয়া গেছে ওদের চোখে,’ বলল রানা। ‘কিন্তু ফিরে আসবে ওরা আবার। তার আগেই নেমে পড়তে হবে আমাদের।’
‘উই যে ওদের আরাকটা বোট!’ বলল হঠাৎ গিলটি মিয়া।
পিছন ফিরে দেখল রানা, আবার জ্বলে উঠেছে সার্চলাইট। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় বোটটাকে। রানার ধোকাবাজি টের পেয়ে গেছে ওরা। তীরের দিকে আসবার জন্যে ঘুরছে অর্ধবৃত্তাকারে।
ঢেউয়ের মাথায় খুব বেশি রকম নাচানাচি শুরু করল বোটটা। রানা বুঝল, বেলাভূমি আর বেশি দূরে নেই। গতি কমিয়ে দিল।
‘জোর একটা ধাক্কার জন্যে তৈরি থাকো গিলটি মিয়া। এসে গেছি।’
মিনিট তিনেক পর ভেজা বালির উপর দিয়ে দ্রুত পায়ে ছুটল ওরা সোজা পশ্চিম দিকে।