বিদেশী গুপ্তচর – ২.৪

চার

‘ওফ, বড় জব্বর মার মেরেচেন, স্যার; আমার মাতা হলে ফেটে একেবারে চৌচির হয়ে যেত। এদের মাতাও খুব শক্ত, স্যার। একাবারে ঝুনো নারকেল!’

খেলনা পিস্তল হাতে এগিয়ে এল গিলটি মিয়া। আসল পিস্তল ছোঁবে না বলে বি. সি. আই. গান-স্পেশালিস্টকে অনেক তেল মেরে ওর জন্যে এই পিস্তল তৈরি করিয়ে দিয়েছে রানা। ভায়োলেন্স মোটেই পছন্দ করে না গিলটি মিয়া, তাছাড়া আসল পিস্তলের কড়া আওয়াজটা একেবারেই সহ্য হয় না ওর, তাই নিঃশব্দ এয়ারগানের ব্যবস্থা। গুলি আছে ঠিকই, ছয়টা গুলি ভরা যায় এতে, তবে সেগুলো সত্যিকার অর্থেই গুলি, অর্থাৎ কাঁচের মার্বেল। এটা পেয়ে খুশি মনে এতই প্র্যাকটিস করেছে যে এখন তিরিশ ফুট দূর থেকে মাকড়াসার ডিম ফাটিয়ে দিতে পারে গিলটি মিয়া এক গুলিতে। পোয়াটেক ওজনের ঢিলের সমান এই গুলির আঘাত। নেহায়েত খারাপ নয়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় এর চেহারাটা। বহু দুর্ধর্ষ লোকের পিলে চমকে দিয়েছে গিলটি মিয়া এই পিস্তল দেখিয়ে।

‘তুমি হঠাৎ কোত্থেকে হাজির হলে, গিলটি মিয়া?’ খুশিতে কেঁপে গেল রানার কণ্ঠস্বর। আচমকা এই ভাবে উদ্ধার পেয়ে যাবে কল্পনাও করতে পারেনি সে।

‘সে অনেক হিস্টিরি, স্যার। প্রথম গেলাম আলফ্রেডো হোটেলে…’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে গিলটি মিয়া, পরে সব শুনব। দু’জনকে বন্দী করে রেখেছে ওরা এই বাড়িতে, ওদের বের করে আনি আগে!’ গিলটি মিয়াকে সাথে আসতে দেখে বলল, ‘তুমি এখানেই থাকো। এরা কেউ সামান্য একটু নড়ে উঠলেই…’

‘ঠকাশ। একগাল হাসল গিলটি মিয়া। ‘বুজতে পেরেচি।’ দ্রুত নিঃশব্দ পায়ে ফিরে এল রানা সিঁড়ির কাছে। কান পেতে শুনল, হেঁটে বেড়াচ্ছে ওড্ডি।

সাবধানে নামতে শুরু করল সে। একটু আওয়াজ হলেই সতর্ক হয়ে যাবে ওড্ডি। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে শব্দ না করে নামা বড় শক্ত। যতটা সম্ভব দেয়ালের গা ঘেঁষে নামছে রানা, প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলার আগে চাপ দিয়ে দেখে নিচ্ছে।

মাঝামাঝি নামতেই দেখতে পেল রানা ঘরের ভিতরটা।

ঘরের এমাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত পায়চারি করছে ওডি। প্যান্টের দুই পকেটে দু’হাত পোরা। বাঘের নজরে দেখছে বাতিস্তা আর ওস্তাদের দিকে।

মৃদু হাসল রানা। আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে ওডির ওকে দেখে। আরও দু’পা নামল সে নিচে, তারপর রিভলভারটা ধরল তাক করে।

‘গোলমাল করলে মারা পড়বে, ওড্ডি!’ শান্ত কণ্ঠে বলল রানা।

গুলি খাওয়া বাঘের মত লাফ দিল ওড্ডি। পকেট থেকে হাত বের করে আনছিল, কিন্তু রানার হাতে নাকবোঁচা রিভলভারটা দেখেই জমে গেল বরফের মত। ভীতি দেখা দিল ওর চোখে। দু’ফাঁক হয়ে গেল ঠোঁট।

‘তোমাদের খেলা শেষ, এবার আমার পালা,’ বলল রানা নিচে নামতে নামতে।

শুয়ে ছিল, তড়াক করে উঠে বসল পাগলা ওস্তাদ। বিস্মিত দৃষ্টিতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল রানাকে।

‘আরে! তুমি দেখছি দারুণ ক্যাপ্টেন হে! হারা গেম জিতে বসে আছো! কোন ইয়ারে পাস করেছ?’

ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বাতিস্তা। অবাক চোখে চেয়ে রয়েছে রানার দিকে।

ওড্ডিকে একটু নড়ে উঠতে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ল রানা।

‘খবরদার, ওড্ডি! মানুষ খুন করার অভ্যাস আছে আমার। এতটুকু ইতস্তত করব না গুলি করতে।’

স্থির হয়ে গেল ওড্ডি। একবিন্দু কাঁপল না রানার হাত, এক মুহূর্তের জন্যে সরল না ওর চোখ ওড্ডির উপর থেকে। সোজা এসে দাঁড়াল পাঁচ হাত দূরে।

‘ঘুরে দাঁড়াও,’ বলল রানা।

‘উচিত শিক্ষা দেব আমি তোকে, শুয়োরের বাচ্চা!’

‘ঘুরে দাঁড়াও!’

ধীরে ধীরে ঘুরল ওড্ডি। রিভলভারটা উল্টো করে ধরে নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে এল রানা। ঠাশ করে আওয়াজ হলো রিভলভারের বাঁটের সাথে ওড্ডির খুলির ঠোকাঠুকিতে। ঘোঁৎ করে একটা শব্দ বেরোল ওড্ডির নাক দিয়ে, হুড়মুড় করে পড়ল চেয়ারের উপর, ওখান থেকে সটান মেঝেতে। জ্ঞান আছে কি নেই পরীক্ষা করে দেখবার প্রয়োজন বোধ করল না রানা, মাথার পিছনে রিভলভারের বাঁট পড়তেই হাতে যে ঝাঁকুনি অনুভব করা গেল, তাতেই বুঝে নিয়েছে সে, অন্তত দুই ঘণ্টার জন্যে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় এর ব্যাপারে।

‘গুড!’ খুশি হয়ে উঠল ওস্তাদ। ‘ওই ছেলে দুটোকে কাবু করলে কি করে?’

ওড্ডির ছুরিটা বের করে নিয়ে ঘ্যাচ ঘ্যাচ কেটে দিল রানা ওস্তাদ আর বাতিস্তার বাঁধন।

‘আমি কাবু করিনি,’ বলল রানা। ‘বেরিয়েই দেখি আমার এক বন্ধু এসে হাজির। ওরই সাহায্যে কাবু করা গেছে ওদের।’

এই জায়গাটা চিনল কি করে আপনার বন্ধু?’ জিজ্ঞেস করল বাতিস্তা হাত ডলতে ডলতে।

‘জানি না। শুনব এখন সব। কেমন বোধ করছ? খুব বেশি জখম হওনি তো?’

‘আরে না,’ উত্তর দিল ওস্তাদ, ‘বাতিস্তাকে চেনো না তুমি। বললে এক্ষুণি এইট-হাণ্ডরেড মিটার স্প্রিন্ট দিয়ে আসবে একটা। স্পোর্টসম্যানকে কাবু করা কি এতই সহজ? তবে তুমি ঠিক সময় মত এসে পৌঁছেচ। এই ছেলেটা ভাল না। স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নেই। এর সাথে মিশো না তোমরা কোনদিন।’

‘চলুন, ওস্তাদ, ওই দুটোকে নিয়ে আসি এখানে।’ বলেই রওনা হলো রানা সিঁড়ির দিকে। ‘তিনটেকে এখানে বেঁধে রেখে বেশ কয়েকটা কাজ সারতে হবে আমাদের। দু’ঘণ্টা পর টনক নড়বে সিলভিও পিয়েত্রোর। হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করবে আমাদের। তার আগেই আমাদের কাজ গুছিয়ে নিয়ে কেটে পড়তে হবে।’

গিলটি মিয়ার পাখির মত শরীর আর হনুমানের সমান উচ্চতা দেখে হেসে ফেলল বাতিস্তা। রানাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ইনিই আপনার উদ্ধারকারী বন্ধু?’

‘হেসো না, বাতিস্তা!’ হঠাৎ রেগে গিয়ে ধমকে উঠল ওস্তাদ। ‘মানুষের জন্মগত ত্রুটি নিয়ে হাসতে হয় না। ওর তো কোন হাত নেই। নিশ্চয়ই ঈশ্বর ওকে অন্য কোন ভাবে ক্ষতি পূরণ করে দিয়েছে। সেখানে তুমি বা আমি ওর কাছে নস্যি।’

গনডোলায় লম্বা রশি পাওয়া গেল। গীয়ান আর পপিনির জ্ঞানহীন দেহ ধরাধরি করে নিয়ে এল ওরা বাড়ির ভিতর। তিনজনকে একসাথে বাঁধছে বাতিস্তা, ওস্তাদ পরীক্ষা করে দেখছে বাঁধন কোথাও আলগা রয়ে যাচ্ছে কিনা।

চেয়ারে বসে গিলটি মিয়ার দিকে ফিরল রানা।

‘হিস্টিরি রেখে খুব সংক্ষেপে রিপোর্ট দাও দেখি?’ রানা বলল, ‘হাতে সময় নেই।’

নিরতিশয় হতাশ হলো গাল-গল্পপ্রিয় গিলটি মিয়া। ঘণ্টা দুয়েকের মেটেরিয়াল রয়েছে ওর পেটে, দুই মিনিটে যদি সব বলে ফেলতে হয় তাহলে দারুণ লস্। ব্যাজার মুখে ঘাড়ের পিছনটা চুলকাল।

‘সেই হোটেলে গিয়ে একটা চিটি পেলুম। নকল অনিল চ্যাটার্জীর লেকা। ভয়ানক বিপদ দেকে সে চলে গেচে জেনেভা, একটা হোটেলের নাম দিয়েচে, আপনাকে বলেচে যেন সেখেনে দেকা করেন। ছবিটা দেকালুম কাউন্টারে, চিনতেই পারল না ব্যাটা।’

‘হুম!’ বলল রানা। ‘সারা ইউরোপে ঘোড়দৌড় করাতে চেয়েছিল ওরা আমাকে। যাই হোক, খবরটা জেনেই ফিরে এলে তুমি। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এলে কি করে?’

‘প্যাসেঞ্জারি পেলেনে উটিনি তো। যেটাতে গিয়েচি, ওটারই ডাইবারকে বললুম, আবার ফেরত লিয়ে চলো। ফিরে এসে মালপত্তর রাকতে গিয়েছিলাম বাসায়, ও বাবা, পাঁচ মিলিটও যায়নি, ঢুকল চার-পাঁচজন পেস্তলধারী। তাদের পিচু পিচু এল দুপুরের সেই মেয়েটা, আর তারই মত দেকতে এক ভদ্দরলোক।

‘তুমি কি করলে?’

‘আমি তো আগেই নুকিয়ে পড়েছি একটা ওয়ারড্রোবের ভেতর। ওফ্, কি বলব, স্যার, দশ মিলিট পরে দেকি নিভভয়ে সুড়সুড় করে হেঁটে বেড়াচ্চে আমার সারা গায়ে আট-দশটা তেলচোট্টা (আরশোলা)!’ শিউরে উঠল গিলটি মিয়া ওগুলোর কথা একবার ভাবতেই। ‘ভয়ে, ঘেন্নায় আরাকটু হলেই চিল্লিয়ে উটতাম, এমন সোমায় ঘরে ঢুকলেন আপনি। সাবদান করবারও সোমায় পেলুম না, দেকলুম একটা ফুলদানীর মদ্যে কি যেন ছেড়ে দিলেন আপনি…’

‘ওটা কি তুমিই সরিয়েছিলে ওখান থেকে?’ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল রানার মুখটা।

‘তবে আর কে?’ একগাল হাসল গিলটি মিয়া। ‘কিচু মনে করবেন না, স্যার, ওটার জন্যে আপনাকে এমন মার খেতে হবে জানলে আর ইস্পশ্য করতুম না। কিন্তুক দরজার গায়ে কান পেতে আপনাদের কতা শুনতে গিয়ে দেকি বার বার প্যাকেট, প্যাকেট করচে একটা লোক। আমার মনে হলো ও জায়গাটা মোটেই নিরাপদ নয়, তাই তুলে নিলুম।’

‘তোমার কাছেই আছে ওটা?’

‘নিচ্চয়!’ পকেট থেকে নীল প্যাকেটটা বের করে দিল রানাকে। ‘আপনার জিনিস বলে আর খুলিনি ওটা, যেমন ছিল তেমনি আচে।’

‘ওয়েল ডান, গিলটি মিয়া!’ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল রানা। রানার প্রংশসায় একেবারে কৃতার্থ হয়ে গেল গিলটি মিয়া। হাসি গিয়ে ঠেকল দু’দিকের দুই কান পর্যন্ত।

‘তারপর ভেঁড়িয়ে রইলুম বাইরে। আপনাকে কোতাউ নিয়ে চলেচে বুজতে পেরে পিচু নিলুম। বহু কষ্টে হাজির হয়েচি এই ভূতুড়ে বাড়িতে। নৌকো একখানা চুরি করা সোজা, কিন্তুক ওটাকে এ পয্যন্ত চালিয়ে নিয়ে আসা- ওরে বাপ! তার পরের ঘটনা তো নিজের চোকেই দেকলেন।’

উঠে দাঁড়াল রানা। বাঁধনগুলো পরীক্ষা শেষ করে প্যান্টের পিছনে হাত মুছল ওস্তাদ, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফিরল রানার দিকে।

‘এবার কি?’

‘চলুন, আগে গনডোলায় ওঠা যাক।’

গনডোলায় উঠে পড়ল সবাই। বৈঠা তুলে নিল বাতিস্তা। রওনা হয়ে গেল ওরা।

খুব সংক্ষেপে যা যা ঘটেছে বলল রানা ওদের। তারপর ফিরল বাতিস্তার দিকে।

‘জুলির হত্যাকারী কে জানতে পেরেছি আমি, বাতিস্তা।’

‘কে!’ থেমে গেল বাতিস্তার হাতের বৈঠা।

‘নির্যাতন করেছিল গীয়ান, কিন্তু ওকে খুন করেছে ওড্ডি।’

‘আমি এখানেই নেমে যাব, সিনর। গনডোলাটা বেঁকে গেল তীরের দিকে। ‘দয়া করে বাধা দেবেন না আমাকে।’

‘না। বাধা দেয়ার অধিকার আমার নেই।’ নৌকোটা তীরে ভিড়তেই ওড্ডির রিভলভারটা এগিয়ে দিল রানা বাতিস্তার দিকে।

‘ওটা দরকার হবে না, সিনর। কোথায় আপনার সাথে দেখা করব?’

‘ব্যবহার করো আর না করো, রাখো এটা সাথে।’ জোর করে গুঁজে দিল রানা রিভলভারটা বাতিস্তার হাতে। ‘আগামী দেড় ঘণ্টার মধ্যে ভেনিস ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি। পারলে ঘণ্টাখানেক পর ওস্তাদের বাসায় এসো একবার।’

অন্ধকারে মিলিয়ে গেল বাতিস্তার সুঠাম, দীর্ঘ দেহ।

বৈঠা তুলে নিল ওস্তাদ। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আমার কি কাজ বললে না, ক্যাপ্টেন?’

‘আর কিছুদূর গিয়ে আমরা দু’জন নেমে যাব। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছব আমরা আপনার বাসায়। আজ রাতেই পালাতে হবে আমাদের। মোটরবোটের ব্যবস্থা করা কি সম্ভব হবে এত রাতে?’

‘ব্যবস্থা হয়ে বসে আছে। সুন্দর একটা বোট ঠিক করেছি তোমার জন্যে। এক কথায় রাজি হয়ে গেছে ছেলেটা। আমারই সাগরেদ।

‘তাহলে আপনার আপাতত আর কোন কাজ নেই, ওস্তাদ। এইখানেই নামব আমরা। আপনি সোজা বাসায় ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করুন, আমরা আসছি।’

‘তোমরা চলেছ কোথায়?’

‘বাসায়। ওখান থেকে কয়েকটা জরুরী ফোন সারতে হবে আমার। এক ঘণ্টার বেশি দেরি হবে না।’

ঘ্যাঁশ্‌শ্‌ করে তীরে ভিড়ল গনডোলা। গীয়ানের রিভলভারটা এগিয়ে দিল রানা ওস্তাদের দিকে।

‘এটা সাথে রাখুন, ওস্তাদ।’

‘আরে দূর!’ একগাল হাসল ওস্তাদ। ‘পাগল নাকি তুমি? মানুষ খুন করতে পারব না আমি। রেডি, অন্ ইয়োর মার্ক, গেট- সেট বলে ঠাশ করে শূন্যে ফাঁকা আওয়াজ করা পর্যন্ত আমার দৌড়। ও জিনিস আমার কোন কাজে লাগবে না।’

নেমে পড়ল রানা।

‘আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম, ওস্তাদ।’

‘কষ্ট! বেশি ভদ্রতা দেখানো হচ্ছে, না? এমন এক বক্সিং লাগাব, একেবারে খালের মাঝখানে গিয়ে পড়বে! কোন্ ইয়ারে পাস করেছ?’

পাগলা ওস্তাদকে আর না ঘাঁটিয়ে এগোল রানা ও গিলটি মিয়া।

.

মিনিট পাঁচেক দ্রুত হেঁটে বাসায় পৌঁছল ওরা।

এখানে ফিরে এসেছে রানা নিরিবিলিতে আগামী প্ল্যান ঠিক করবার জন্যে। খুবই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে ওকে কয়েকটা ব্যাপারে। তার জন্যে দরকার এমন একটা নিরাপদ জায়গা যেখানে চিন্তার সূত্র ছিন্ন করবে না কেউ। এই বাড়িটাই এ মুহূর্তে ওর জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা।

গিলটি মিয়াকে এক কাপ চা খাওয়াবার অনুরোধ করে জানালার সব ক’টা কার্টেন টেনে দিল রানা, টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে বসল গিয়ে টেবিলে, পকেট থেকে বের করল নীল প্যাকেটটা।

নিজের অজান্তেই মৃদু হাসি ফুটে উঠল রানার ঠোঁটে। এরই জন্যে এতকিছু। এরই জন্যে হন্যে হয়ে খুঁজছিল ওরা অনিলকে, এরই জন্যে প্রাণ দিতে হলো জুলি মাযিনিকে, হয়তো এরই জন্যে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে অনিল- এরই জন্যে এতসব। কি আছে এর ভেতর? এমন কিছু আছে, যাতে নির্দোষ প্রমাণ করা যাবে অনিলকে?

একটা সিগারেট ধরিয়ে নীল প্লাস্টিকের মোড়ক খুলল রানা। তিন ইঞ্চি লম্বা, দুই ইঞ্চি চওড়া ছোট একটা নোট বুক। কাভারটা লাল। নোট বুকের গায়ে রবার ব্যাণ্ড দিয়ে আটকানো একটা চিঠি। ব্যাণ্ডটা খুলে চিঠির সম্ভাষণটা পড়ে অবাক হয়ে গেল রানা। ওকেই লেখা চিঠি। তিনটে শীট উল্টে লেখকের নাম পড়ল রানা। অনিল লিখেছে।

নোট বইটার পাতা উল্টাল রানা। প্রথম দু’তিনটি পৃষ্ঠায় কি যেন লেখা আছে দুর্বোধ্য কোডে। বাকি সব পৃষ্ঠা খালি। চেষ্টা করলেও যে আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই কোড ভেঙে অর্থ উদ্ধার করতে পারবে এমন ভরসা পেল না রানা। কাজেই চিঠির প্রতিই মনোনিবেশ করল সে।

.

প্রিয় মাসুদ রানা,

এ চিঠি যখন তোমার হাতে পৌঁছবে, যদি পৌঁছায়, তখন খুব সম্ভব আমি আর এই পৃথিবীতে নেই। একটা পোড়ো বাড়িতে ক্যাম্প-খাটে শুয়ে লিখছি তোমাকে এ চিঠি। কাঁধে গুলি খেয়েছি, গুলিটা রয়ে গেছে ভেতরে। দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে চলেছে। ডাক্তারের সাহায্য নেয়া যাচ্ছে না, ডাক্তার ডাকলেই ধরা পড়ে যাব। ধরা পড়া মানেই মৃত্যু।

লাল নোট বইটায় ভারতের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য আছে। লা কোসা নোস্ট্রার ড্রাগস ডিপার্টমেন্ট থেকে চুরি করেছি ওটা আমি। টের পেয়ে গেছে এই ডিপার্টমেন্টের চীফ সিলভিও পিয়েত্রো। লেগে গেছে আমার পিছনে। আমি জানি এই ভয়ঙ্কর লোকটার হাত থেকে নিস্তার নেই আমার, আহত অবস্থায় কিছুতেই বেরোতে পারব না ইটালী থেকে। রোম থেকে তেড়ে নিয়ে এসেছে এরা আমাকে ভেনিস পর্যন্ত। বুঝতে পারছি, জাল গুটিয়ে আনছে এখন, ধরা পড়তে আমার আর বেশি দেরি নেই। শেষ চেষ্টা হিসেবে তোমার উপর ভার দিয়ে যাচ্ছি আমি- যেমন করে পারো, এ নোট বইটা পৌঁছে দেবে আমার চীফ শ্রীরঞ্জন চৌধুরীর হাতে। রানা, যেমন করে পারো। তারপর যদি সময় করতে পারো, তাহলে আমার মাকে একটু আমার কথা বলো, সান্ত্বনা দিয়ো। ওঁকে ধারণা দেয়া হয়েছে, আমি দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক। তুমি বলো, আমি তা ছিলাম না।

এই বইটা হাতাবার জন্যে আমাকে সেই রকমই ভান করতে হয়েছিল, মিশে যেতে হয়েছিল এদের সাথে। ব্যাপারটা জানেন শুধু আমার চীফ আর আমি, আর এখন জানলে তুমি। আর কাউকে জানানো হয়নি। কাউকে না। আর সবাই জানে, আমি আনুগত্য বদলে ফেলেছি টাকার লোভে। গোপনীয়তা রক্ষা এতই জরুরী ছিল যে আমার মাকে পর্যন্ত ভুল ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। এটা দরকার ছিল। আমার নিরাপত্তার জন্যেই প্রয়োজন ছিল এর। কারণ আমার দেশেও লোক আছে এদের।

এ বইটার ব্যাপারে যাই করো, সাদামাঠা কিছু করতে যেয়ো না। ভারতীয় কনসুলেট বা এমব্যাসিতে যেয়ো না। পোস্টে পাঠাবার চেষ্টা কোরো না। রঞ্জন চৌধুরীর হাতে দিতে হবে তোমার বইটা নিজ হাতে। আর কারও হাতে নয়। সর্বত্র এজেন্ট আছে এদের। ভয়ানক ক্ষমতাশালী এরা। কাউকে বিশ্বাস কোরো না। সিলভিও পিয়েত্রো যদি জানতে পারে তোমার কাছে রয়েছে নোট বইটা, তোমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে দ্বিধা করবে না এক সেকেণ্ড। এদের আণ্ডার-এস্টিমেট কোরো না। দারুণ অসুবিধেয় পড়বে তুমি ইটালী থেকে বাইরে বেরোতে গিয়ে। ইচ্ছে করলে সব পথ বন্ধ করে দিতে পারে সিলভিও। ইউরোপের কোথাও তুমি নিরাপদ নও। ইংল্যাণ্ড অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, কিন্তু সেখান পর্যন্ত ধাওয়া করতে পারে এরা। যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা আমার চীফের হাতে তুলে দাও, ততক্ষণ পর্যন্ত কোথাও তোমার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই।

সব সময় মনে রাখবে, সারা ইউরোপে ওদের লোক আছে, প্রত্যেক দেশে রয়েছে নেট-ওঅর্ক। যমের মত ভয় করে এদের সবাই। বহু সরকারী কর্মচারী কাজ করছে এদের হয়ে- পুলিস, কাস্টম্স, এমনকি আর্মিতে পর্যন্ত আছে এদের লোক। এয়ারপোর্টে লোক আছে, হোটেলে লোক আছে, সবখানে। এমন কি প্রয়োজন হলে পেট্রলপাম্প ওয়ালাদের নির্দেশ দেয়া হবে তোমার গাড়ি অকেজো করে দেয়ার জন্যে, হুকুম পেলে প্লেন পর্যন্ত ক্র্যাশ করা হবে, গ্রেপ্তার করা হবে তোমাকে ট্রেন থেকে যে-কোন একটা আজেবাজে ছুতোয়। সহজে নিস্তার নেই তোমার। আমার একমাত্র ভরসা, সহজ লোক তুমি নও।

তোমাকে এত কথা বলার উদ্দেশ্য ভয় দেখানো নয়, সাবধান করে দেয়া। খুবই সতর্কতার সাথে কাজ করতে হবে তোমাকে। ভুলেও আণ্ডার-এস্টিমেট করবে না এদের।

তোমার উপর এই বিপজ্জনক গুরুদায়িত্ব চাপাতে হচ্ছে বলে আমি খুবই দুঃখিত। কিন্তু এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। নিজের কথা ততটা ভাবছি না যতটা ভাবছি দেশের কথা। আমার দেশের স্বার্থে তোমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথাটাও ভাবছি না, এটাকে স্বার্থপরতা বলা যায়, দুর্বল অক্ষমের এ স্বার্থপরতাটুকু ক্ষমা করে দিয়ো। আমার পক্ষে সম্ভব হলে আমি নিজেই করতাম কাজটা।

ডাক না আসা পর্যন্ত আনন্দে থাক- এই শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করছি।

অনিল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

চিঠিটা অন্যমনস্কভাবে ভাঁজ করে বুক-পকেটে রেখে দিল রানা। দ্রুত চিন্তা চলছে ওর মনের মধ্যে। ঘড়ি দেখল। ঘণ্টাখানেক পর ওড্ডি কি করছে ভেবে ব্যস্ত হয়ে উঠবে সিলভিও। তার আগেই ব্যবস্থা করতে হবে যা করার। এখনি সবকিছু ওরা জেনে ফেলেছে কিনা কে জানে। যত দ্রুত সম্ভব এদের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে ভেনিস থেকে।

চায়ের কাপ হাতে করে ঢুকল গিলটি মিয়া।

সংক্ষেপে বলল রানা সব ব্যাপার। শুনে ভ্রূ কুঁচকে গেল গিলটি মিয়ার।

চায়ের কাপ শেষ করে দুটো টান দিয়ে অ্যাশট্রেতে ফেলে দিল রানা সিগারেটটা। কানে তুলে নিল টেলিফোন রিসিভার। ডায়াল করল লিডো এয়ারপোর্টে।

এয়ার-ট্যাক্সি চালক মেথিসের সাথে বেশ খাতির হয়ে গিয়েছিল ওর লিডো থেকে দুপুরে পড়ুয়া যাওয়ার পথে। ওকেই চাইল রানা।

‘আপনি একটু ধরুন। আচ্ছা, হ্যালো, কে বলছেন আপনি?’

‘বলুন মাসুদ রানা। জরুরী দরকার।’

কয়েক সেকেণ্ড বিরতি। তারপর সেই একই কন্ঠস্বর ভেসে এল।

‘দুঃখিত। সিনর মেথিস এখানে নেই।’

‘কোথায় আছে?’

‘আমি ঠিক জানি না, সিনর।’

‘ওর তো এই সময় থাকার কথা? যাই হোক, আমার একটা এয়ার-ট্যাক্সি দরকার। এক্ষুণি। লিডো টু প্যারিস। চার্টার করতে চাই। ব্যবস্থা হয়ে যাবে?’

‘দাঁড়ান, একটু দেখে বলছি।’

অসহিষ্ণুভাবে অপেক্ষা করল রানা আধ মিনিট, খড়মড় আওয়াজ হলো, ভেসে এল কণ্ঠস্বর।

‘আমি দুঃখিত। আগামীকাল দুপুরের আগে কোন প্রাইভেট চার্টার প্লেনের ব্যবস্থা করা যাবে না, সিনর।’

‘খরচ যাই হোক কিছু এসে যায় না। আজ রাতেই আমার প্যারিস যাওয়া দরকার।’

‘সেটা সম্ভব নয়, সিনর। কাল দুপুরের আগে হবে না।’

‘এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের কানেকশন দিন। তার সাথে কথা বলতে চাই আমি।’

‘উনি বাসায় চলে গেছেন, সিনর,’ একঘেয়ে কণ্ঠে বলল লোকটা।

‘বাসার নাম্বারটা দিন।’ হাল ছাড়ল না রানা।

‘বাসার নাম্বার আমার জানা নেই, সিনর। দুঃখিত।’

ভ্রূ জোড়া কুঁচকে গেছে রানার, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে চোখের দৃষ্টি। পরিষ্কার বুঝতে পারল ব্যাপারটা। কোনরকম সহযোগিতা আশা করা যায় না এখান থেকে। অনর্থক সময় নষ্ট হবে, লাভ হবে না চেষ্টা করে। সত্যিই প্লেন নেই, নাকি ইতিমধ্যেই কাজে নেমে গেছে সিলভিও? এতই দ্রুত! এখন একমাত্র ভরসা পাগলা ওস্তাদ।

রিসিভারটা নামিয়ে রেখে গিলটি মিয়ার দিকে ফিরল রানা।

‘প্লেন চার্টার করা গেল না। তুমি বরং থেকে যাও, গিলটি মিয়া। এদিকের অবস্থাটা শান্ত দেখলে কাল-পরশু অ্যালিটালিয়ার একটা টিকেট কেটে পৌঁছে দেবে তোমাকে বাতিস্তা লিডো এয়ারপোর্টে।’

‘আর আপনি?’ শান্ত গলায় প্রশ্ন করল গিলটি মিয়া।

‘আমি মোটরবোটে করে চলে যাব ভেনিস থেকে ওদের চোখে ধুলো দিয়ে। টেনে বা গাড়িতে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। এয়ার-ট্যাক্সি চার্টার করা যাচ্ছে না। বোটে করে যতদূর যাওয়া যায় গিয়ে তারপর ধরব হাঁটা পথ।’

‘সে তো খুব ভাল কতা। আমাকে সাতে নিতে অসুবিদে কি?’

‘খুবই কষ্ট হবে, তাছাড়া বিপদও আছে এই লম্বা জার্নিতে। প্রতিপক্ষ খুবই শক্তিশালী, যাতে এদেশ থেকে বেরোতে না পারি সে চেষ্টার কোনরকম ত্রুটি করবে না। সর্বশক্তি নিয়োগ করবে ঠেকাবার জন্যে। কাজেই…’

‘কাজেই ওরা আপনাকে তেড়ে ধরে খুন করুক আর ইদিকে আমি ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুলে গোঁপে তা দিয়ে বসে থাকি, নিচ্চিন্ত, নিজঝঢ়াট। সেটি হচ্চে না। আমিও যাচ্চি আপনার সাতে। বেশি গ্যাঞ্জাম করলে নুকিয়ে পিচু নেব বলে রাকচি আগে থেকে।’

গিলটি মিয়ার চোখ পাকানো দেখে হেসে ফেলল রানা।

‘ঠিক আছে, যদি যেতে চাও, তৈরি হয়ে নাও পাঁচ মিনিটের মধ্যে। জামা-কাপড় এতেই চলবে, শুধু দুটো রাকস্যাকে পাঁচ- সাত দিন টেকার মত খাবার ভরে নাও। বিনকিউলারটা নিতে ভুলো না। এক বোতল ব্র্যাণ্ডিও নিয়ো। যাও, কুইক।

‘দু’মিলিট, স্যার। আসচি। মালপত্রগুনো?’

‘ওগুলো থাকবে। এর ব্যবস্থা করা যাবে পরে। ভাল কথা, তোমার ঘরে টেবিলের ড্রয়ারে গোটাকয়েক ম্যাপ দেখেছিলাম, ওগুলো নিয়ে নিয়ো সাথে। কাজে লাগবে।

‘ঠিক আচে।’

দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল গিলটি মিয়া। লম্বা জার্নির উপযোগী কাপড় পরে নিল রানা। প্যান্টের একটা গুপ্ত পকেটে রাখল নোট বইটা নীল প্লাস্টিক মুড়ে। অনিলের সততায় আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই- যথাসাধ্য সাহায্য করবে সে ওকে। সবচেয়ে বড় কথা এখন অনিলেরই খাতিরে ভেনিস থেকে ওদের মনোযোগ অন্যত্র সরানো দরকার। কাজেই একেবারে হাওয়া হয়ে গেলে চলবে না, পিছু ধাওয়া করবার জন্যে কিছু কিছু সূত্র রেখে যেতে হবে পিছনে।

এখন প্রথম কাজ সারাগাত হোটেল থেকে ওর পিস্তল আর টাকা নেয়া, তারপর সোজা ওস্তাদ স্টেফানো মন্টিনির বাসা। মোটরবোটটা একবার ছাড়তে পারলে আর ওকে পায় কে।

.

ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজা।

থমকে দাঁড়াল রানা চৌকাঠের উপর। সারাটা মেঝে লাল হয়ে আছে তাজা রক্ত লেগে। সারা ঘর লণ্ডভণ্ড।

কোসা নোসটা! ভয়ঙ্কর মাফিয়ার আর এক নাম- কোসা নোট্রা! বিদ্যুৎগতি এদের কাজে।

হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে ওস্তাদ রক্তাক্ত মেঝের উপর। ফাঁক হয়ে আছে গলাটা বিকট ভঙ্গিতে।

জবাই করা হয়েছে পাগলা ওস্তাদকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *