বিদেশী গুপ্তচর – ২.৩

তিন

পাঁচ মিনিট তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর ওড্ডি ঘোষণা করল, ‘এঘরে নেই ওটা।’

কাঁধ ঝাঁকাল সিলভিও।

‘থাকাটা অসম্ভব ছিল না। যাই হোক, খুঁজে দেখায় কোন ক্ষতি হয়নি আমাদের। এবার তাহলে আপনার সেই বন্ধুর কাছে দেয়ার কথাটা সত্য বলে ধরে নেয়া যায়, কি বলেন?’

শুকিয়ে আসা ঠোঁট ভিজাল রানা জিভের ডগা দিয়ে। পরিষ্কার বুঝতে পারছে গ্যাড়াকলে ফেঁসে গেছে সে এবার। প্যাকেটটা ফিরিয়ে না দিলে যে বাতিস্তা আর স্টেফানো মন্টিনিকে গুলি করে মারা হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু গেল কোথায় ওটা। কে নিল? ওড্ডি? শোবার ঘরে ঢোকার বেশ কিছুক্ষণ পরে এসে হাজির হয়েছিল ওড্ডি। হলরূমে ঢুকে প্যাকেটটা খুঁজে বের করে নেয়া সম্ভব ছিল ওর পক্ষে। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চাইছে লোকটা? প্যাকেটটা গাপ করে দিয়ে নিজে কিছু টাকা হাতাবার তাল করেছে? তাই হবে। ও ছাড়া আর কে নিতে পারে প্যাকেটটা?

‘চলুন, রওনা হওয়া যাক, সিনর মাসুদ রানা,’ বলল সিলভিও। ‘আপনার সহকর্মীদের সাথে দেখা করার পর আপনার সেই বন্ধুর কাছ থেকে নিয়ে আসবেন প্যাকেটটা।’

‘দাঁড়ান,’ বলল রানা চট করে। বুঝতে পারছে সে ওড্ডি যদি প্যাকেটটা নিয়ে থাকে, আর একবার এই বাড়ির বাইরে কোথাও লুকিয়ে রাখবার সুযোগ পায়, তাহলে ও যে নিয়েছে তা প্রমাণ করবার উপায় থাকবে না আর। এখন একমাত্র উপায় হচ্ছে প্যাকেটসহ ওকে হাতে-নাতে ধরা। নইলে আশা-ভরসা সব যাবে।

‘কি ব্যাপার?’ অসহিষ্ণু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সিলভিও।

‘বন্ধুর কাছে দেয়ার গল্পটা বানানো,’ বলল রানা। ‘আপনি ঠিকই সন্দেহ করেছিলেন, এই ঘরেই লুকিয়ে রেখেছিলাম আমি প্যাকেটটা।’

কথাটা বলতে বলতে ওড্ডির মুখের ভাব লক্ষ করল রানা। কিন্তু ওর কঠোর মুখে কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের আভাস ছাড়া আর কিছুই লক্ষ করা গেল না।

‘আশ্চর্য!’ তাজ্জব চোখে চাইল সিলভিও রানার মুখের দিকে। ‘হঠাৎ এই অসময়ে কথাটা আমাকে বলে দিচ্ছেন কেন? স্বেচ্ছায় আপনার দর কষাকষির ক্ষমতা হারাচ্ছেন আপনি, সিনর মাসুদ রানা। এখুনি পেয়ে গেলে আপনার সঙ্গীদের ছেড়ে নাও দিতে পারি, এই সন্দেহ আসছে না আপনার মনে?’

‘আসছে। কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসে না। প্যাকেটটা খুইয়ে ফেলেছি আমি। এই ঘরে ঢোকার সাথে সাথে ওই দরজার নিচে আলো দেখে প্যাকেটটা আমি এই তামার ফুলদানীতে রেখে দিয়েছিলাম।’

ভুরু কুঁচকে ফুলদানীটার দিকে চাইল সিলভিও, তারপর চাইল ওড়ির দিকে। লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল ওড্ডি। ফুলদানীটা আবার হাতে তুলে নিয়ে ভিতরটা দেখল, তারপর উপুড় করে ঝাঁকি দিল বার কয়েক।

সবাই বুঝতে পেরেছে, তবু অনর্থক বলল ওড্ডি, ‘কিছুই নেই এর ভেতর।’

‘সময় নষ্ট করবার কৌশল খাটিয়ে যাচ্ছেন আপনি একটার পর একটা,’ অনুযোগের সুরে বলল সিলভিও। ‘এতে কি লাভ আশা করছেন আপনি আমার জানা নেই। আমি বিরক্ত হয়ে উঠছি ক্রমে। আপনি কি আশা করছেন যে আপনার বন্ধুরা এসে উদ্ধার করবে আপনাকে? কেন বিশ্বাস করছেন না আমার কথা? আমি তো বলছি ওরা আমার হাতে বন্দী, প্রমাণ দিতে নিয়ে চলেছি আপনাকে, তবু কেন…’

‘ওটা আমি এই ফুলদানীর ভেতর রেখেছিলাম,’ শান্ত কণ্ঠে বলল রানা। ‘আমরা যখন শোবার ঘরে কথা বলছিলাম তখন সরিয়েছে ওটা কেউ। আপনারা ওই ঘরের মধ্যেই ছিলেন, কাজেই আপনাদের পক্ষে ওটা হাতানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু একজন আছে যে সবার পরে ঘরে ঢুকেছিল, এই হলঘরে একা থাকবার সুযোগ পেয়েছিল। সে হচ্ছে এই লোকটা।’ ওড্ডির দিকে ইঙ্গিত করল রানা মাথা ঝাঁকিয়ে।

আড়ষ্ট হয়ে গেল ওড্ডি। ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়ে উঠল ওর মুখটা। ঠোঁট দুটো সরে গেছে দাঁতের উপর থেকে। দুই চোখে গোক্ষুরের বিষ।

শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল লুইসা। বিস্মিত দৃষ্টিতে বোঝার চেষ্টা করল এতক্ষণ এই ঘরে কি করছে লোকগুলো। এগিয়ে এল কয়েক পা।

‘দেখুন, সিনর মাসুদ রানা,’ কটমট করে চাইল সিলভিও রানার চোখে, ‘বড় বিপজ্জনক খেলা খেলছেন আপনি। আমার দলের লোকের মধ্যে সন্দেহ ঢুকিয়ে গোলমাল পাকাবার চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না। এসব অনেক পুরানো কৌশল। পচে গেছে। আপনার সঙ্গীদের কাছে যাচ্ছি আমরা এখন, ওখানে আপনার মুখ দিয়ে কি করে সত্যি কথাটা বের করতে হবে জানা আছে আমার। চলুন।’

রানার মেরুদণ্ডের উপর রিভলভারের নল দিয়ে খোঁচা দিল গীয়ান।

‘হাঁটো।’

নড়ল না রানা। শান্ত কণ্ঠে আবার বলল, ‘কেউ নিয়েছে প্যাকেটটা। ওরই নেয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। রওনা হওয়ার আগে ওকে একবার সার্চ করলে আপনিই উপকৃত হবেন। আমি বাজি রাখতে পারি, এক্ষুণি ওকে সার্চ করলে পেয়ে যাবেন প্যাকেটটা।’

বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে এল ওড্ডি দুই পা, ঠাশ করে প্রচণ্ড এক চড় মারল রানার গালে। মার খেয়ে এক পা পিছিয়ে গেল রানা। রিভলভারটা ওর শিরদাঁড়ার উপর ঠেসে ধরে স্মরণ করিয়ে দিল গীয়ান গোলমাল করলে কি ঘটবে।

‘শুয়োরের বাচ্চা!’ রাগে হাঁপাচ্ছে ওড্ডি। আবার একটা প্রচণ্ড চড় তুলল।

‘থামো, ওড্ডি!’ ধমকে উঠল সিলভিও। কঠোর হয়ে উঠেছে ওর মুখটা। দুই চোখে সন্দেহ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরে গেল ওড্ডি। ‘আপনার অনুযোগের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছেন, সিনর? আপনার এ নালিশ মিথ্যে প্রমাণ হলে বড়ই দুঃখজনক ঘটনা ঘটবে আপনার কপালে। তখন আর ওকে বারণ করতে পারব না আমি, বারণ করবও না।’

‘অত বকর বকর না করে সার্চ করে দেখো ওকে,’ বলল রানা। ‘গাধামি কোরো না। ওকে বিশ্বাস করতে যাবে কেন তুমি? ও যদি মনে করে প্যাকেটটা গায়েব করে দিয়ে কিছু ফালতু টাকা রোজগার করা যাবে, আমি তো বুঝি না তাহলে কেন ওটা তোমার হাতে তুলে দেবে ও।’

সতর্ক দৃষ্টিতে চাইল সিলভিও ওড্ডির দিকে। ওড্ডির তীব্র দৃষ্টিতে আক্রোশ- দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে চেয়ে রয়েছে রানার চোখের দিকে।

‘প্যাকেটটা কি তোমার কাছে, ওড্ডি?’ মোলায়েম কণ্ঠে প্রশ্ন করল সিলভিও।

‘না। মিথ্যে কথা বলছে শুয়োরের বাচ্চা! দেখুন না, নিজের চোখেই দেখুন।’

ক্ষোভে দুঃখে একটার পর একটা পকেট উল্টে দেখাতে শুরু করল ওড্ডি। রাগে বিকৃত হয়ে গেছে ওর চেহারা। পকেট থেকে টুকিটাকি জিনিস বের করে ফেলতে শুরু করল মেঝের উপর।

সব পকেট দেখা হয়ে গেলে রানার দিকে ফিরল সিলভিও।

‘এবার আর কিছু বলার আছে?’

‘বেল্টের নিচে, প্যান্টের ভাঁজে, কিংবা শরীরের আর কোথাও লুকানো থাকতে পারে।’ কথাটা বলল বটে, কিন্তু গলায় তেমন জোর পেল না রানা।

‘খুঁজে দেখো।’ পপিনিকে আদেশ করল সিলভিও।

যথেষ্ট ভদ্রতা ও সংকোচের সাথে, যেন বাঘের গায়ে হাত দিচ্ছে এমনি ভঙ্গিতে ওড্ডির সারা শরীর সার্চ করল পাপিনি, তারপর সরে দাঁড়াল।

‘কিছুই নেই।’

‘এবার? আর কিছু?’ ক্রোধ দেখতে পেল রানা সিলভিওর চোখে।

‘আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে রেখে থাকতে পারে,’ বলল রানা কণ্ঠস্বরটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।

‘আপনার তাই মনে হচ্ছে, তাই না?’ হাসির চেষ্টা করল সিলভিও, কিন্তু সেটা মুখ ভেংচানোর মত দেখাল। ‘আমার কি মনে হচ্ছে জানেন? আমার মনে হচ্ছে তুমি একটা তৃতীয় শ্রেণীর গর্দভ। মিথ্যেবাদী কোথাকার?’ রাগে হাত দুটো কাঁপতে শুরু করেছে সিলভিওর। ‘আমার ভদ্রতাকে তুমি মনে করেছ দুর্বলতা। লুইসার অনুরোধে আমি চেয়েছিলাম ব্যাপারটা অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ছাড়াই নিষ্পত্তি হোক। কিন্তু বীচিতে গুঁতো না দিলে বলদ সোজা হয় না। আমার আর কিছুই করবার নেই।’ ওড্ডির দিকে ফিরল সিলভিও। ‘ওড্ডি, যা ভাল বুঝবে তাই করবে তুমি, আমার আর কিছুই বলার নেই। হোটেলে চললাম আমরা। যেমনভাবে পারো, দুই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে দেবে ওটা আমার কামরায়।

‘ঠিক আছে,’ বলল ওড্ডি দাঁতে দাঁত চেপে। ‘দু’ঘণ্টার মধ্যেই পাবেন ওটা।

খপ করে লুইসার হাত ধরল সিলভিও, টান দিয়ে নিয়ে গেল দরজার কাছে। দরজাটা খুলে পিছন ফিরে চাইল রানার দিকে। রাগটা সামলে নিয়েছে অনেকটা।

‘আমার সাথে গোলমাল ভারত সরকারের- তুমি বিদেশী গুপ্তচর, মাঝখান দিয়ে এর মধ্যে নোংরা নাকটা না গলালেই পারতে। এখন তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে তোমার সঙ্গীদের কাছে। ওখানে প্যাকেটটা ফেরত দিতে বাধ্য করা হবে তোমাকে। তারপর…’ কথাটা শেষ না করেই মাথা ঝাঁকাল সিলভিও। ‘চলি। খুব সম্ভব আর কোনদিন দেখা হচ্ছে না আমাদের।’

‘দেখা না হওয়াটাই তোমার জন্যে মঙ্গল হবে,’ বলল রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল সিলভিও।

‘অমন বড়াই আগেও বহুবার শুনেছি আমি। কান পচে গেছে শুনতে শুনতে। গুডবাই।’

চলে গেল সিলভিও লুইসাকে টেনে নিয়ে। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

.

ঘেটো নুয়োভোর পিছনে একটা অন্ধকার বাড়ির সামনে এসে থামল গনডোলা। একটিও বাতি নেই। নিঝুমপুরী। দেখলেই বোঝা যায় বহু পুরানো আমলের বাড়ি। মনে হয় এখুনি হুড়মুড় করে ধসে পড়বে ঘাড়ের উপর।

গনডোলা বেঁধে ফেলল পপিনি ঝটপট। শিরদাঁড়ার উপর রিভলভারের খোঁচা দিল গীয়ান।

‘নামো!’

ওডিড নেমে পড়েছে আগেই। পারে উঠে এল রানা পপিনির পিছন পিছন। চট করে ডাইনে বাঁয়ে চাইল সে একবার। খালটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ওর তীক্ষ্ণ কান কাছাকাছিই কোথাও ছপাৎ করে দাঁড় ফেলার শ পেয়েছে। একটা গনডোলা আসছে এইদিকেই।

শব্দটা ওড্ডির কানেও গেছে। কোন গোলমাল করবার আগেই খপ করে রানার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল সে বাড়ির ভিতর। ভ্যাপসা একটা দুর্গন্ধ এল রানার নাকে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল গীয়ান বা পপিনি। পাঁজরের উপর রিভলভারটার উপস্থিতি অনুভব করল রানা আবার।

দেয়াল হাতড়ে একটা তাক থেকে মোমবাতি নিয়ে জ্বালল ওড্ডি। সরু একটা প্যাসেজ ধরে এগোল ওরা। কিছুদূর গিয়ে দরজা। দরজাটা খুলতেই সিঁড়ি দেখা গেল। নোংরা সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করেছে ওডি I

পিছন থেকে ঠেলা খেয়ে নামতে বাধ্য হলো রানাও। বড়সড় একটা স্যাঁৎসেঁতে ঘর। তিনটে মোমবাতির আলোয় ম্লানভাবে আলোকিত।

দেয়ালের গায়ে পিঠ দিয়ে মেঝের উপর বসে আছে বাতিস্তা আর ওস্তাদ স্টেফানো মন্টিনি। হাত-পা শক্ত করে বাঁধা।

ওদের দিকে চেয়েই মনটা দমে গেল রানার। ও আশা করেছিল এদের ব্যাপারে মিথ্যে কথা বলেছে সিলভিও, কিন্তু নিজের চোখে দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারল কি বিচ্ছিরি প্যাচে পড়ে গেছে সে। প্যাকেটটা ফেরত না দিলে ওর সামনেই হত্যা করা হবে এদের। অথচ…

‘এই যে, সিনর! কি নাম যেন তোমার, তোমাকেও ধরে এনেছে? ছি ছি ছি ছি. জখম কোথায়? বিনা জখমেই আস্ত লোকটাকে ধরে ফেলল! কোন্ ইয়ারে পাস করেছ?’

‘অনিলের খবর কি, ওস্তাদ?’

রানা দেখল, লাল হয়ে আছে ওস্তাদের টাক, মাথার একপাশে গভীর ক্ষতচিহ্ন। গালে একটা লম্বা চেরা দাগ, টপ টপ রক্ত ঝরছে সেখান থেকে জ্যাকেটের উপর! বাম বাহুর কনুইয়ের কাছে চিরে ফাঁক হয়ে আছে ইঞ্চি তিনেক জায়গা, মেঝেতে জমে আছে রক্ত, আরও জমছে।

বাতিস্তার অবস্থাও তেমন সুবিধের নয়। একটা চোখ বুজে গেছে মার খেয়ে, কালো হয়ে আছে জায়গাটা। কপালে কাটা চিহ্ন- খুব সম্ভব এই আঘাতেই জ্ঞান হারিয়েছিল ও। কাপড়টা ছিঁড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়, গা দেখা যাচ্ছে, সেখানে আঁচড়ের দাগ।

ছেলেটাকে বাঁচানো গেল না হে,’ বলল ওস্তাদ। ‘নৌকোটা উল্টে দিল ব্যাটারা, ডুবে গেল। চেষ্টা করলাম, কিন্তু তুলতে পারলাম না।

‘চোপ রাও!’ দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে গেল ওড্ডি। দড়াম করে ওস্তাদের পাঁজরের উপর কষাল প্রচণ্ড এক লাথি। ব্যথায় কুঁকড়ে শুয়ে পড়ল ওস্তাদ একপাশে।

‘খুব জোরে মারে তো ছেলেটা!’ মুখ বিকৃত করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ওস্তাদ, ‘কোন্ ইয়ারে পাস করেছ?’ আবার লাথি তুলেছিল ওড্ডি, থেমে গেল রানার অস্বাভাবিক চিৎকার শুনে।

‘খবরদার, ওড্ডি! বুড়ো মানুষটাকে মেরো না ওভাবে!’

রানার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে থমকে গেল ওড্ডি। কিন্তু ওর অসহায় অবস্থা দেখে ফিরে এল সাহস।

‘মারলে কি করবে তুমি, শুনি?’

‘তোমাকে মেরে মরব। গুলি করেও ঠেকাতে পারবে না আমাকে।’

একটা চেয়ার এনে ঘরের মাঝখানে রাখল পপিনি, হুকুম করল, ‘বসো এখানে।’

রিভলভারের গুঁতো খেয়ে বসে পড়ল রানা। ওড্ডির ইঙ্গিতে রানার দুই হাত চেয়ারের পিছনে নিয়ে বেকায়দা ভঙ্গিতে চেপে ধরল পপিনি। দড়াম করে লাথি মারল ওড্ডি ওস্তাদের ভুঁড়ির উপর। তারপর রানার দিকে ফিরে হাসল।

অসহায়ভাবে গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেয় স্টেফানো মন্টিনি। গ্যাজলা বেরিয়ে এসেছে মুখ দিয়ে।

পাগলের মত টানা-হেঁচড়া করল রানা, কিন্তু সাঁড়াশীর মত চেপে ধরে আছে পপিনি, ছাড়ানো গেল না ওর হাত। দাউ দাউ করে জ্বলল রানার চোখ। পরোয়া করল না ওড্ডি, এগিয়ে এসে দাঁড়াল রানার সামনে। চাপা উল্লাস ওর চোখেমুখে প্রতিহিংসার সুযোগ পেয়ে।

‘আমাকে ফাঁসাবার চেষ্টা হচ্ছিল, না?’ মোলায়েম কণ্ঠে বলল ওড্ডি। ‘আমিই চুরি করেছি প্যাকেটটা, তাই না? ওটা কোথায় আছে দেখাচ্ছি তোমাকে।’ হিপ পকেট থেকে একটা ময়লা গ্লাভ বের করে ডান হাতে পরল ওড্ডি। আঙুলগুলো বার কয়েক খুলল এবং বন্ধ করল। তারপর মুঠি পাকাল।

নিরাসক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রানা। যেন বুঝতে পারেনি কি ঘটতে চলেছে। কিন্তু ভিতর ভিতর তৈরি হয়ে গেছে সে। শরীর নড়াতে পারছে না ঠিকই, কিন্তু মাথাটা নড়াতে পারবে। ঘুসিটা কাটাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে ও।

‘তোমাকে খানিক মেরামত করা হবে এখন,’ শান্ত কণ্ঠে বলল ওড্ডি। ‘এই রকম…’

সাঁই করে ঘুসি চালাল ওড্ডি। বিদ্যুৎ বেগে সরে গেল রানা বাম পাশে, ইঞ্চি দেড়েক। কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘুসিটা। ভারসাম্য হারিয়ে সামনে ঝুঁকে এল ওড্ডি। এক পায়ের হাঁটু দিয়ে ওর তলপেটে গুঁতো মারল রানা, অপর পায়ে লাথি মারল ওর পায়ের গোড়ালিতে। ছিটকে বাতিস্তার পায়ের কাছে পড়ল ওড্ডি। প্রাণপণে জোড়া পায়ে লাথি চালাল বাতিস্তা। জায়গামত পড়লে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘুমিয়ে যেত ওড্ডি, কিন্তু শরীর বাঁকিয়ে মুখটা সরিয়ে নিল সে, লাথিটা পড়ল ওর বুকের উপর, মেঝের উপর গড়িয়ে চলে গেল সে চার-পাঁচ হাত। ওড্ডির সুবিধের জন্যে একটু দূরে সরে গিয়েছিল গীয়ান, এক লাফে চলে এল কাছে, রিভলভারের ব্যারেল দিয়ে মারল রানার চোয়ালের উপর। মুখটা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল রানা, তাতে আঘাতের পরিমাণ কমল কিছুটা, কিন্তু তবু যতটা লাগল তাতেই বোঁ করে ঘুরে উঠল ওর মাথা। আবছা ভাবে অনুভব করল উঠে দাঁড়াচ্ছে ওড্ডি। অনর্গল গালি বেরোচ্ছে ওর মুখ থেকে।

বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ওড্ডি রানার উপর। চুল ধরে মুখটা উঁচু করল, নাক-মুখ ভর্তা করে দেয়ার জন্যে প্রকাণ্ড এক ঘুসি তুলল। কিন্তু খপ্ করে ধরে ফেলল গীয়ান ওর হাতটা।

‘এখন না, পরে।’ বলল গীয়ান। ‘ওর বন্ধুর সাথে দেখা করতে হবে ওকে। এখনই জখম করা ঠিক হবে না, দোস্ত।

এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিল ওড্ডি। পিছিয়ে গেল এক পা। জ্বলছে চোখ দুটো, মুখটা খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। সামলে নেয়ার চেষ্টা করল কয়েক সেকেণ্ড, তারপর মনে হলো গীয়ানের বক্তব্যের অর্থ বুঝতে পারল সে, ঝট করে পিছন ফিরল নিজেকে নিবৃত্ত করবার জন্যে।

‘প্যাকেটটা ফেরত দিচ্ছ?’ কানের কাছে মোলায়েম কণ্ঠে বলল গীয়ান।

মাথাটা ঘুরছে এখানো, কিন্তু তারই মধ্যে পরিষ্কার বুঝতে পারল রানা, ও যে জানে না প্যাকেটটা কোথায় একথা বিশ্বাস করবে না এরা। শোল্ডার হোলস্টার থেকে একটা রিভলভার বের করে ফেলেছে ওড্ডি। বাতিস্তার দিকে তাক করে ধরল সেটা। ওর চোখের দিকে চেয়ে পরিষ্কার বুঝতে পারল রানা, ওর একটি মুখের কথার উপর নির্ভর করছে বাতিস্তার বাঁচা আর মরা। ‘না’ বলার সাথে সাথেই গুলি করবে ওড্ডি।

যে করে হোক সময় নিতে হবে এখন। আর কোন উপায় নেই।

‘ঠিক আছে,’ বলল রানা, ‘এনে দেব ওটা আমি।’

কাছে এসে দাঁড়াল ওড্ডি। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘এই তো, লক্ষ্মী ছেলে। কোথায় আছে ওটা?’

‘সারাগাত হোটেলে উঠেছে আমার বন্ধু। ওখানেই আছে।’

‘কি নাম ওর?’

‘গামাল মুস্তাফা,’ বলল রানা অম্লান বদনে।

পপিনির দিকে ফিরল ওড্ডি।

‘সারাগাত হোটেলে ফোন করে জেনে এসো এই নামে কোন লোক আছে কিনা।’

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল পপিনি। পায়চারি শুরু করল ওড্ডি। স্থির, নিষ্কম্প হাতে রিভলভার তাক করে ধরে দাঁড়িয়ে রইল গীয়ান পাথরের মূর্তির মত। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল পপিনি।

‘আছে। আজই সন্ধ্যায় উঠেছে ওই হোটেলে। ঘুমাচ্ছে নিজের ঘরে, তেমন জরুরী কিছু না হলে নাকি তাকে ডাকা যাবে না।’

রানার দিকে ফিরল ওড্ডি।

‘প্যাকেটটা নিয়ে আসবে তুমি ওর কাছ থেকে। গীয়ান আর পপিনি যাবে তোমার সাথে। কোন রকম গোলমাল করলেই মারা যাবে এই দু’জন। আমি নিজ হাতে গুলি করব। বুঝতে পেরেছ?’

‘কঠিন কিছুই নেই এর মধ্যে। বুঝেছি।’

‘নিয়ে যাও একে,’ বলল ওড্ডি গীয়ানকে। ‘হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করবে তোমরা। দশ মিনিটের মধ্যে ও যদি হোটেল থেকে না বেরোয় পপিনিকে পাঠিয়ে দেবে আমার কাছে। এদের খতম করে দিয়ে পরবর্তী প্ল্যানের কথা চিন্তা করা যাবে।’

‘চলো। উঠে পড়ো, চাঁদ।’ রিভলভার দিয়ে উঠে দাঁড়াবার ইঙ্গিত করল গীয়ান।

উঠে দাঁড়াল রানা। টলে উঠল মাথাটা ঘুরে ওঠায়। সামলে নিয়ে ফিরল বাতিস্তা আর ওস্তাদের দিকে।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে ওরা। অনিশ্চিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে রানার মুখের দিকে। হঠাৎ হাসল ওস্তাদ। কাঁধ দিয়ে থুতনি চুলকে নিয়ে বলল, ‘আমাদের জন্যে ভেবো না, ক্যাপ্টেন। তোমার কাজ তুমি করে যাও।’

‘আমি ফিরে আসছি’ বলল রানা, কিন্তু গলায় তেমন জোর পেল না।

দ্রুত চিন্তা করছে রানা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে। এখন একমাত্র ভরসা কোন সুযোগে এই দু’জনকে চমকে দিয়ে কাবু করে ফেলে ফিরে এসে ওড্ডিকে কাবু করা। কিন্তু কিভাবে? হোটেলে রেখে আসা পিস্তলটার কথা মনে এল রানার। কিন্তু যে জিনিস এই ট্যুরিস্ট ঠাসা শহরে ব্যবহার করতে পারবে না সে, সেটা থাকা না থাকা সমান কথা। সবচেয়ে বড় কথা, রানার ক্ষমতা সম্পর্কে মোটামুটি পরিষ্কার ধারণা হয়ে গেছে গীয়ানের, ওকে অবাক করে দেয়া, কিংবা অতর্কিতে কিছু করে পরাজিত করা এখন আর অত সহজ হবে না। সর্বক্ষণ সতর্ক রয়েছে সে। একবিন্দু আলগা করছে না শিরদাঁড়ার উপর রিভলভারের চাপ। ওটা যতক্ষণ ওই জায়গায় ঠেসে ধরা আছে ততক্ষণ আচমকা কিছু করে বসা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।

দরজার কাছে এসে পিছন থেকে রানার কলার চেপে ধরল গীয়ান, টেনে থামাল।

‘দাঁড়াও! পপিনি, দরজা ফাঁক করে আগে বাইরেটা দেখে নাও একবার।’

এগিয়ে গেল পপিনি, আস্তে করে খুলল দরজা, বাইরেটা দেখে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। কেউ নেই।’

ইতিমধ্যে একবার খেলে গেছে রানার মাথায় ঝট করে একপাশে সরে গিয়ে রিভলভারটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করবে কিনা, কিন্তু কাজটা মান্ত্রক বিপজ্জনক হবে মনে করে আপাতত মুলতবী রেখেছে। কিন্তু স্থির করেছে রানা, গনডোলায় ওঠার সময় সুযোগ আসবে একটা। কোনভাবে নৌকোটা দুলে ওঠার সাথে সাথে যদি…

তারাজ্বলা মুক্ত আকাশের নিচে চলে এসেছে ওরা, আর কয় পা গেলেই খালের পাড়, এমনি সময় চমকে উঠল রানা একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে।

‘নড়েচ কি মরেচ! যে যেমন আচো ভেঁড়িয়ে থাকো! এটা আসল পেস্তল বাওয়া, খেলনা নয়।’

পাঁই করে ঘুরল গীয়ান। সাথে সাথে ঠকাশ করে শব্দ হলো। চাপা একটা প্রায়-অস্ফুট আর্তনাদ বেরোল গীয়ানের মুখ থেকে। ছিটকে মাটিতে পড়ল রিভলভার। বাম হাত দিয়ে ডান হাতটা চেপে ধরেছে সে।

দড়াম করে ওর সোলারপ্লেক্সাসে ঘুসি মারল রানা, কুঁজো হয়ে মাটিতে বসে পড়ল গীয়ান, তারপর এক লাথিতেই শুয়ে পড়ল সটান।

পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে পপিনি। আর কিছু না বুঝুক, ‘পেস্তল’ কথাটার মানে সে ঠিকই বুঝেছে। দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল গিলটি মিয়া।

‘এ শালার কপালে একটা আলু তুলে দোব, স্যার?’

‘না! দাঁড়াও!’ মাটি থেকে গীয়ানের রিভলভারটা তুলে নিতে নিতে বলল রানা।

রানা জানে পপিনির কাছে রিভলভার আছে। এতক্ষণে বেরিয়ে পড়ত সেটা যদি না গিলটি মিয়ার খেলনা পিস্তলটাকে সে আসল পিস্তল বলে ভুল করত। টের পাওয়ার আগেই কাবু করতে হবে ওকে। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াবার ইঙ্গিত করল রানা পপিনিকে। ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরল পপিনি। ঠকাশ করে রিভলভারের বাঁট পড়ল ওর মাথার পিছনে। বিনা দ্বিধায় জ্ঞান হারাল সে। ধড়াশ করে মাটিতে পড়বার আগেই ওকে ধরে আস্তে করে শুইয়ে দিল রানা গীয়ানের পাশে। পকেট থেকে বের করে নিল রিভলভার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *