বিদেশী গুপ্তচর – ২.২

দুই

দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সিলভিও পিয়েত্রো।

‘এই নাটকীয়তার জন্যে আমাদের দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন, সিনর মাসুদ রানা,’ বলল সিলভিও, ‘কিন্তু এর প্রয়োজন ছিল। গত কয়েক ঘণ্টায় আপনি প্রমাণ করেছেন যে আপনি একজন অত্যন্ত দুর্ধর্ষ লোক। আপনার সম্পর্কে রিপোর্টও পৌঁছে গেছে আমার হাতে। কাজেই একটু বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হলো আমাদের। একটা কথা প্রথমেই পরিষ্কার ভাবে আপনাকে জানিয়ে দেয়া দরকার, প্রয়োজন হলে গুলি করবে গীয়ান আর পপিনি। কাজেই কোন রকম গোলমালের চেষ্টা করবেন না অনর্থক। বসুন, কয়েকটা কথা আছে আপনার সাথে।’

সোজা চাইল রানা লুইসার চোখে। কিছু বোঝা গেল না সে- চোখ দেখে। ওর পাশে গিয়ে বসবার জন্যে ইঙ্গিত করল সে রানাকে। এগিয়ে গেল রানা। বসে পড়ল লুইসার পাশে। পিছনে গীয়ান এসে দাঁড়াল রিভলভারটা রানার পিঠে ঠেকিয়ে।

‘এসব ব্যাপারে তুমি কেন আবার?’ প্রশ্ন করল রানা।

উত্তর দিল সিলভিও। ‘আমি ওকে বারণ করেছিলাম। কিন্তু ওর ধারণা আমি যদি ব্যর্থ হই, ও আপনাকে রাজি করাতে পারবে। ওর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলাম না। লুইসার সামনে আপনাকে এইভাবে রিভলভারের মুখে ছোট করা হচ্ছে বলে আমি খুবই অনুতপ্ত। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। শুধু লুইসার নয়, আপনাকে আমারও ভাল লেগেছে। আপনার কোন ক্ষতি হোক সেটা আমি চাই না

‘সে তো খুব ভাল কথা!’ মৃদু হেসে পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করল রানা। একটা ঠোঁটে লাগিয়ে কেসটা এগিয়ে ধরল সিলভিওর দিকে। ‘চলবে? অভ্যাস আছে?’

‘না। ধন্যবাদ।’ রানার মুখোমুখি একটা সোফায় বসল সিলভিও।

সিগারেট ধরিয়ে লম্বা করে টান দিল রানা, ভুশ করে ধোঁয়া ছাড়ল ছাতের দিকে, পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসল সোফায় হেলান দিয়ে, তারপর চাইল সিলভিওর চোখে।

‘বেশ বলুন এবার, কি ব্যাপারে কথা বলতে চান?’

‘অনিল চ্যাটার্জীর ব্যাপারে।’ সোফার দুই হাতায় দুই কনুই রেখে বাম হাতের আঙুলের ফাঁকে ডান হাতের আঙুলগুলো ভরে মুঠি পাকাল সিলভিও, সেই মুঠির উপর আলতো করে থুতনি রেখে শুরু করল আবার, ‘চ্যাটার্জী একজন ভারতীয়, আপনি বাংলাদেশের লোক। এক ভয়ঙ্কর ব্যাপারে জড়িয়েছে ও নিজেকে। যেমন গোপনীয়, তেমনি বিরাট ব্যাপার। আপনার দেশের সাথে এর সম্পর্ক নেই। কাজেই এক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের মত ব্যবহার আশা করব আমি আপনার কাছে। আপনি নিরপেক্ষ থাকুন। ওকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এই দণ্ড এড়িয়ে যাবার উপায় নেই ওর। কারো সাধ্য নেই ওকে রক্ষা করে। আপনি মাঝখান থেকে নাক গলিয়ে নাকটা খোয়াবেন, সেটা আমি চাই না। আমার অনুরোধ, যেহেতু ব্যাপারটা আপনার দেশের সাথে কোন দিক থেকে কোন ভাবে যুক্ত নয়, আপনি এ থেকে দূরে থাকুন।’

‘এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব। আমি এক কথায় রাজি।’

সতর্ক দৃষ্টিতে চাইল সিলভিও রানার মুখের দিকে। বার কয়েক চোখ মিট মিট করে ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর হাত বাড়াল সামনে। ‘তাহলে দিয়ে দিন।’

অবাক হলো রানা। ‘কি দিয়ে দেব?’

‘একটা নীল প্লাস্টিক মোড়া লাল খাতা। আপনার কাছেই আছে ওটা এখন।’

তিন সেকেণ্ড সিগারেটের মাথার আগুনটা পরীক্ষা করল রানা, তারপর ভুরু জোড়া কপালে তুলল।

‘নীল প্লাস্টিক মোড়া লাল খাতা? ওটা আমার কাছে আছে এ ধারণা হলো কি করে আপনার?’

ভুরু কুঁচকে গেল সিলভিওর। তির্যক দৃষ্টিতে চাইল রানার চোখের দিকে। আশ্চর্য ধূর্ত এবং নিষ্ঠুর একটা ভাব খেলে গেল ওর চোখে। এক সেকেণ্ড, তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল।

‘দয়া করে আমাদের সময় নষ্ট করবেন না, সিনর মাসুদ রানা। এই একটু আগে আপনি স্বীকার করেছেন নিরপেক্ষ থাকবেন আপনি। খাতাটা…’

‘এক সেকেণ্ড,’ বাধা দিল রানা কথার মধ্যে। ‘নিরপেক্ষ থাকতে রাজি হয়েছি ঠিকই, কিন্তু আপনাকে সাহায্য করবার কোন আশ্বাস আমি দিইনি। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। যাই হোক, খাতাটার কথা শোনা যাক। ওটা আপনার?’

‘আমার অর্গানাইজেশনের। আমার অফিস থেকে চুরি করেছিল ওটা অনিল চ্যাটার্জী।’

‘কেন চুরি করতে গেল? কি আছে ওর মধ্যে?’

‘অত্যন্ত মূল্যবান কিছু গোপনীয় তথ্য আছে। ওটা খোয়া গেলে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটে যাবে আমাদের ভাগ্যে। পথের ধুলায় মিশে যাব আমরা। আমার ওপর হুকুম হয়েছে, যে ভাবে হোক উদ্ধার করতে হবে ওটা। আমার কাছ থেকে খোয়া গিয়েছিল, আমাকেই উদ্ধার করতে হবে।

‘এত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অনিলের হাতে যখন পড়েছে, আপনাদের সতর্কতার বিশেষ প্রশংসা করা যায় না।

‘তা ঠিক।’ মাথা ঝাঁকাল সিলভিও। ‘কিন্তু ভয়ানক ধূর্ত এই লোকটা। বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারিনি আগে। তার ওপর দারুণ লোকটার সহ্য ক্ষমতা। এতদিন পর্যন্ত যে টিকে আছে…ভাল কথা, ওকে যে ক্ষিপ্রতা আর বুদ্ধিমত্তার সাথে উদ্ধার করেছিলেন তার জন্যে আপনাকে কংগ্রাচুলেশন জানানো হয়নি এখনও। কংগ্রাচুলেশনস্। দারুণ যোগ্যতার সাথে করেছিলেন কাজটা।’

লজ্জা পাওয়ার ভান করল রানা। ‘না, না। কি যে বলেন। আমার যোগ্যতা নয়, ওটা আপনার লোকেদের অযোগ্যতা। যাদের নিয়ে কাজ করছেন…’

‘তা ঠিক,’ বাঁকা করে হাসল সিলভিও। ‘কিন্তু অন্যদিকে তাদের যোগ্যতার অভাব নেই। এরা জানে কি করে মানুষের মুখ থেকে কথা বের করতে হয়।’

‘তাই নাকি? কিন্তু মনে হচ্ছে অনিলকে দিয়ে কথা বলাতে পারেনি ওরা, নইলে এখানে আপনার মূল্যবান সময় অপব্যয় করতে হত না।’

‘কথা অনিলকে বলতেই হত। আজ হোক কাল হোক স্বীকার না করে উপায় ছিল না। হয়তো সময় লাগত একটু বেশি। অসুস্থ ছিল বলে সাবধানে এগোতে হয়েছে গীয়ানকে। সুস্থ অবস্থায় থাকলে আরও চাপ দিতে পারত ও, মুমূর্ষু লোককে বেশি চাপ দেয়া যায় না, ফট করে মরে যায়।’

‘তাই জ্বলন্ত সিগারেট ঠেসে ধরে মৃদু নির্যাতনের ব্যবস্থা হয়েছিল?’

‘ঠিক বলেছেন। আধমরা লোক বা স্ত্রীলোকের ওপর প্রয়োগ করলে এতে বেশ কাজ পাওয়া যায়।’

‘জুলি মাযিনিকেও নিশ্চয়ই মরতে হয়েছে গীয়ানের হাতেই?’

‘না। ওড্ডি। কথা বের করেছে গীয়ান, কিন্তু শেষ কাজটা সেরেছে ওড্ডি। ডিভিশন অব লেবার। কিন্তু সিনর, আমরা আমাদের বক্তব্য থেকে সরে গেছি অনেক দূরে। দিয়ে দিন প্যাকেটটা।’

মাথার মধ্যে আগুন ধরে গিয়েছিল রানার। এক লাফে খুদে শয়তানটার ঘাড়ে পড়ে কণ্ঠনালীটা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল ওর। দাঁতে দাঁত চেপে সামলে নিল সে। সময় আসুক। এখন কিছু করতে গেলে অবধারিত মৃত্যু। সিগারেটে টান দিতে গিয়ে লক্ষ্য করল কাঁপছে ওর হাতটা।

‘উত্তেজিত হবেন না, সিনর মাসুদ রানা। আপনি বাংলাদেশের একজন দুর্ধর্ষ স্পাই হতে পারেন, কিন্তু কিছুতেই আমার কাছে পৌঁছতে পারবেন না। প্যাকেটটা দিয়ে দিলেই সসম্মানে বিদায় নেব আমরা, কেউ আপনার গায়ে হাত তুলবে না।’

‘আগে অনিলের সাথে কথা বলতে হবে আমাকে,’ বলল রানা মোলায়েম ভাবে। সিগারেটটা ফেলে দিল অ্যাশট্রেতে। ‘আগামীকাল বিকেল নাগাদ একবার আসুন আপনারা। ততক্ষণে অনিলের বক্তব্য শুনে একটা কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারব আশা করছি।’ হাই তুলল রানা। ‘ঘুম পাচ্ছে বড়ো। যদি কিছু মনে না করেন, আমি এখন বিশ্রাম নিতে চাই।’ লুইসার দিকে ফিরল রানা। ‘তুমি থাকবে, না এদের সাথে চলে যাবে, লুইসা?’

খপ করে রানার হাত ধরল লুইসা। ‘প্লী…জ, রানা! দিয়ে দাও ওটা। তুমি বুঝতে পারছ না কেন…’

‘বুঝতে আমি ঠিকই পারছি, সিনোরিনা। কিন্তু নিরপেক্ষতার খাতিরে অনিলের ভার্শান শোনা দরকার আমার। নইলে অবিচার করা হবে।’

উঠে দাঁড়াল রানা। সাথে সাথে কাঁধের উপর দড়াম করে আঘাত পড়ল। সামনের দিকে এক পা হোঁচট খেল রানা। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল গীয়ানের ভয়ঙ্কর মুখ। রিভলভারটা ধরা আছে রানার দুই চোখের ঠিক মাঝখানে। ট্রিগারের উপর চেপে বসে আছে তর্জনীটা।

‘বসো!’ গম্ভীর গলায় আদেশ করল গীয়ান।

তড়াক করে উঠে দাঁড়াল লুইসা। ঝট করে ফিরল সিলভিওর দিকে।

‘এটা কি হচ্ছে, সিলভিও? তুমি কথা দিয়েছিলে, ওর গায়ে হাত তোলা হবে না।’

‘কি করব বলো? উনি যে এমন অবুঝের মত ব্যবহার করবেন সেটা আমার জানা ছিল না।’ রানার চোখের দিকে চাইল সিলভিও। ‘বসে পড়ন, সিনর মাসুদ রানা। বল প্রয়োগের জন্যে আমি খুবই দুঃখিত, কিন্তু আপনি আপনার অবস্থাটা উপলব্ধি করতে পারছেন না এখনও। আপনি আমার বন্দী।’

‘তাই নাকি?’ বাম হাতে কাঁধটা ডলতে ডলতে বসে পড়ল রানা আবার। ‘তাহলে আর নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলতে গিয়েছিলেন কেন? আপনি নিজেই ঠেলে দিচ্ছেন আমাকে আপনার প্রতিপক্ষ শিবিরে।’

‘আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে,’ চিকন হাসি খেলে গেল সিলভিওর ঠোঁটে। ‘আমাদের হাতে সময় কম, অপেক্ষা করার উপায় নেই। আপনি এইমাত্র বললেন, অনিলের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমি দুঃখিত, সেটা সম্ভব নয়। মারা গেছে অনিল চ্যাটার্জী।’

ঠাণ্ডা, স্থির দৃষ্টিতে চাইল রানা সিলভিওর চোখের দিকে। তারপর মুচকে হাসল।

‘এত সস্তাদরের ব্লাফে কাজ হবে না, সিনর। বেঁচে আছে অনিল চ্যাটার্জী।’

‘হাসপাতালে রওনা হবার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মারা গেছে ও। ভিসকন্টির ফোন পেয়ে আমার লোকজন তৈরি ছিল আপনাদের গনডোলার জন্যে।’

একটা মোটরবোট ছিল গনডোলার অপেক্ষায়। মোটরবোটের ধাক্কায় ডুবে গেছে গনডোলা, ডুবে মরেছে অনিল। আপনার লোক দু’জন অবশ্য অনেক চেষ্টা করেছিল ওকে বাঁচাবার, কিন্তু লাভ হয়নি কোন, বালির বস্তার মত তলিয়ে গেছে সে পানির নিচে।

মুচকে হাসল সিলভিও রানার বিস্মিত, হতবাক মুখের দিকে চেয়ে। বলেই চলল, ‘আমাদের শক্তি, সামর্থ্য আর ক্ষমতা সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই আপনার, সিনর মাসুদ রানা, তাই অবাক হচ্ছেন এত সামান্যতেই। সারা ইউরোপে আমাদের অসাধ্য কিছুই নেই। যা খুশি তাই করতে পারি আমরা। যাক, যা বলছিলাম, অনিলকে নিয়ে আপনার দুই সঙ্গীকে গনডোলায় উঠতে দেখেই বুঝতে পারলাম প্যাকেটটা কোথায় লুকোনো আছে জানতে পেরেছেন অনিলের কাছ থেকে এবং সেটা সংগ্রহ করতেই গিয়েছেন আপনি। নইলে আপনিও যেতেন যেতেন ওর সঙ্গে হাসপাতালে। ব্যস, বাকিটুকু খুবই সহজ কাজ। খুবই সাবধানে অনুসরণ করা হলো আপনাকে। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।’ নিজের বিজয়ে আপন মনে হাসল সিলভিও। ‘ভাল কথা, আপনার সঙ্গীদের কি হলো সে কথা ভেবে হয়তো উদ্বিগ্ন হচ্ছেন আপনি। উদ্বেগের কিছুই নেই। নিরাপদে তীরে পৌঁছেচে ওরা, আমার লোকজন রীতিমত সাহায্য করেছে ওদের পারে উঠতে। বর্তমানে বহাল তবিয়তে আছে ওরা একটা বাড়িতে মাটির নিচের এক ঘরে। কিন্তু আপনি যদি অসহযোগিতা করেন, খুব বেশিক্ষণ ভাল থাকবে না ওরা। বুঝতে পেরেছেন? তুরুপের সব তাস এখন আমার হাতে, সিনর মাসুদ রানা। দয়া করে প্যাকেটটা বের করে দেবেন কি?’

.

কয়েক সেকেণ্ড সিলভিওর মুখের দিকে চেয়ে রইল রানা। দ্রুত চিন্তা চলেছে ওর মাথার মধ্যে। চেয়ে রয়েছে, কিন্তু দেখছে না রানা সিলভিওকে।

বোঝা গেল ভারত সরকার অনিলকে যাই মনে করুক, কিছু গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছে অনিল একটা শক্তিশালী আন্তর্জাতিক দলের কাছ থেকে, এবং এই তথ্য নিয়ে সে ভারতে পৌঁছতে চাইছে। এদের জন্যে সেটা পুনরুদ্ধার করা এতই জরুরী যে তা করতে গিয়ে দু’পাঁচটা খুন হয়ে গেলেও পরোয়া নেই- অর্থাৎ, এই তথ্য ভারতে পৌঁছলে ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে এদের। তাই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এরা এ ব্যাপারে। এমন হতে পারে যে ভারতের প্রতি আনুগত্যের এটাই একমাত্র প্রমাণ অনিলের হাতে। এটা খোয়া গেলেই সব যাবে ওর। কোন অবস্থায় যেন প্যাকেটটা এদের হাতে না পড়ে তার ব্যবস্থা করা দরকার।

নীল প্লাস্টিকে মোড়া প্যাকেটটা ভেসে উঠল রানার মানসচক্ষে। তামার ফুলদানীতে রয়েছে ওটা। মোটেই নিরাপদ নয়। একটু মাথা খাটালেই বের করে ফেলবে সিলভিও। প্রথমে ওকে সার্চ করা হবে, কিন্তু যখন পাওয়া যাবে না তখন খুব সহজেই বুঝে নেবে সিলভিও যে এ বাড়িতে ঢোকার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে কোথাও লুকিয়েছে রানা ওটা। কয়েক সেকেণ্ড একা ছিল রানা হলরূমে, নিশ্চয়ই ওখানেই কোথাও লুকোনো আছে ওটা।

হাতের তালু দুটো ভিজে এল রানার। অন্ধের মত এই ফাঁদে ধরা পড়ার জন্যে নিজের উপরই খেপে গেল সে। ওড্ডি আর সেই লোকটাকে এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে দেখে আগেই সন্দেহ করা উচিত ছিল ওর। যাই হোক, পরিষ্কার বুঝে নিয়েছে সে, প্যাকেটটা এদের হাত থেকে রক্ষা করবার কোন উপায় নেই। তবু এদের মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাবার চেষ্টা করতে হবে যতটা পারা যায়।

‘সিনর মাসুদ রানা,’ তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল সিলভিও, ‘দিয়ে দিন প্যাকেটটা।’

‘আমার কাছে যদি থাকত তাহলে কিছুতেই আপনাকে দিতাম না ওটা, কিন্তু যেহেতু নেই, দেয়া না-দেয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না। কি বলেন?’

ঝট করে উঠে দাঁড়াল সিলভিও।

‘প্রচুর সময় নষ্ট করেছি আমি ভদ্রতা রক্ষা করতে গিয়ে। আর নয়। হাত বাড়াল। ‘দিন প্যাকেট!’

‘প্লীজ, রানা! তোমার তো কিছু না, দিয়ে দাও না ওটা, ঝামেলা চুকে যাক।’ আবার রানার হাত চেপে ধরল লুইসা।

মৃদু হাসল রানা সিলভিওর চোখের দিকে চেয়ে।

‘খামোকা মেজাজ গরম করে লাভ নেই, খোকা। আমার কাছে নেই ওটা।’

পপিনির দিকে চাইল সিলভিও। মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করল। ‘সার্চ করো একে।’

ঘাড়ের পেছনে রিভলভারটা ঠেসে ধরে গুঁতো দিল গীয়ান জোরে। ‘উঠে দাঁড়াও।’

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল রানা।

প্রত্যেকটা পকেট সার্চ করল পপিনি দ্রুত হাতে, মাথা নাড়ল, নেই। তারপর মৃদু চাপড় দিয়ে পরীক্ষা করল রানার সর্বাঙ্গ। রানার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে স্টিলেটোটা বের করে আনল। তারপর সরে দাঁড়াল।

ঠিক এমনি সময়ে ঘরে ঢুকল ওড্ডি। রানার দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসবার চেষ্টা করল। চোখ দুটো জ্বলছে প্রতিহিংসায়। একটা চোখ ফুলে আছে বাতিস্তার ঘুসি খেয়ে।

‘সর্বক্ষণ চোখে চোখে রেখেছিলে একে?’ প্রশ্ন করল সিলভিও।

‘হ্যাঁ, সিনর। ডি ফ্যাবোরির দেয়াল-মন্দিরটায় গিয়েছিল ও। ‘শিকের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কি যেন নিল। আমাদের দেখতে পেয়েই দৌড়াতে শুরু করল।’

‘চ্যাটার্জী কি কোনদিন এই মন্দিরের কাছাকাছি গিয়েছিল?’ জিজ্ঞেস করল সিলভিও।

উত্তর দিল গীয়ান। ‘না, সিনর। কিন্তু ওই মেয়েলোকটা, জুলি মাযিনি, গিয়েছিল।’

‘হ্যাঁ!’ বলল ওড্ডি। ‘কয়েকদিন আগে এই মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি আমি ওকে। আমি মনে করেছিলাম প্রার্থনা করছে বুঝি।’

‘দৌড়াতে শুরু করার পর সিনর মাসুদ রানা কি ওটা কোথাও লুকোবার সুযোগ পেয়েছিল?’

‘না। আমি আর রিক্‌কি পেছনেই ছিলাম, চোখের আড়াল হতে দিইনি।’

রানার দিকে ফিরল এবার সিলভিও। ‘দিন প্যাকেট!’

‘দেব না।’ শান্ত কণ্ঠে বলল রানা।

রাগে লাল হয়ে উঠল সিলভিওর ফর্সা চেহারা। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়াল কিছুক্ষণ। ফুলে উঠেছে নাকের পাতা। বহু কষ্টে সামলে নিয়ে বলল, ‘প্রয়োজন পড়লে আমি কতটা কঠোর হতে পারি সে সম্পর্কে আপনার কোন ধারণাই নেই। শোনেন, মাসুদ রানা। নিজের অবস্থাটা আপনি মোটেই উপলব্ধি করতে পারছেন না। প্যাকেটটা পেতেই হবে আমার। কেউ আটকাতে পারবে না আমাকে।’ ঘরময় বার দুই পায়চারি করে এসে থামল আবার রানার সামনে। ‘আপনার কাছে আপনার সঙ্গীদের জীবনের মূল্য ঠিক কতখানি জানা নেই আমার। ওদের প্রাণের বিনিময়ে প্যাকেটটা ফেরত দিতে রাজি আছেন কিনা ভেবে দেখুন দুই মিনিট। প্যাকেটটা আমার হাতে তুলে দিলে ছেড়ে দেব আমি ওদের। যদি না দেন, এক্ষুণি হুকুম দেব আমি ওদের গুলি করে মেরে ফেলার জন্যে। বিশ্বাস করুন, ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছি না আমি। যা বলছি ঠিক তাই করব আমি দুই মিনিট পর।’

এই অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে মনে মনে চমকে গেল রানা। ও আশা করেছিল ওর উপর নির্যাতন চালানো হবে, কিন্তু হঠাৎ মোড় ঘুরিয়ে যে বাতিস্তা আর ওস্তাদের উপর আক্রমণ করে বসবে সিলভিও, এটা কল্পনাও করতে পারেনি। যত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই হোক, তার জন্যে দু’জন নির্দোষ লোকের প্রাণ নিতে দেবে না রানা এদের। কিন্তু আগে জানা দরকার ধোঁকা দিচ্ছে কিনা।

‘আপনার কথায় বিশ্বাস কি?’ প্রশ্ন তুলল রানা। ‘আমি কি করে জানব যে ওই দু’জন সত্যিই আপনার হাতে বন্দী হয়েছে? কি করে জানব যে সত্যি মারা গেছে অনিল চ্যাটার্জী? আমার সঙ্গীদের সাথে দেখা করবার আগে তো আমি কোন অবস্থাতেই দিতে পারি না ওটা আপনার হাতে। তাছাড়া দিলেই যে আপনি ওদের ছেড়ে দেবেন, তার কি নিশ্চয়তা?’

এতক্ষণে হাসি ফুটল সিলভিওর মুখে।

‘নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা যাবে। ওদের সাথে আপনার দেখা হওয়ারও ব্যবস্থা করছি। কিন্তু মনে রাখবেন, সিনর মাসুদ রানা, প্যাকেটটা না দিলে ওদের মরা মুখ দেখতে হবে আপনার। চলুন আমার সাথে। পথে কোন রকম গোলমাল করে লাভ নেই, পালাতে পারবেন না। যদি আমাদের হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে যাওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব হয়ও, জেনে রাখবেন সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু ঘটবে আপনার দুই সঙ্গীর।’

‘পালাব না আমি,’ বলল রানা। ‘কোথায় আছে ওরা?’

‘কাছেই।’ লুইসার দিকে ফিরল সিলভিও। ‘তোমার আসার দরকার নেই, লুইসা। আমার কথা আমি রেখেছি। জীবনে কোনদিন এতখানি ধৈর্য ধরতে দেখোনি নিশ্চয়ই তুমি আমাকে? কিন্তু এর পরেও যদি সিনর মাসুদ রানা কোন রকম গোলমাল করবার চেষ্টা করে তাহলে দাঁত বেরিয়ে পড়বে আমার, আসল রূপ বেরিয়ে আসবে। সেটা তোমার দেখার দরকার নেই। যতটা সহ্য করেছি তার বেশি সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তুমি জানো। কাজেই আমরা বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই হোটেলে ফিরে যাবে তুমি।’ রানার দিকে ফিরল, ‘চলুন সিনর। আমি সত্যি বলছি, না মিথ্যে বলছি দেখুন এসে নিজ চোখে।’

দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল সিলভিও। পিছন পিছন চলল রানা। তার পিছনে রিভলভার হাতে ওড্ডি, গীয়ান আর পপিনি।

হলরূমের মাঝামাঝি এসে থমকে দাঁড়াল সিলভিও। তড়াক করে লাফ দিল রানার বুকের ভিতর কলজেটা। একটা দুটো হার্টবিট মিস হয়ে গেল। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ঘরের চারপাশে চোখ বুলাল সিলভিও।

‘দাঁড়াও এক মিনিট!’ ধূর্ত হাসি ফুটে উঠল সিলভিওর ঠোঁটে। ‘এত সবের কোন দরকার না-ও পড়তে পারে। মন্দির থেকে এই বাড়ি পর্যন্ত ওড্ডির চোখে চোখে ছিলেন আপনি, প্যাকেটটা কোথাও লুকোবার সুযোগ ছিল না আপনার। কিন্তু এই হলরুমে কয়েক সেকেণ্ড আপনি একা ছিলেন। সেই কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ওটা এই ঘরেই কোথাও লুকিয়ে রাখা অসম্ভব নয়। আপনার কাছে যখন নেই, ওটা এ ঘরেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন ধরে নেয়াটা খুব একটা অযৌক্তিক কিছু হবে না। কি বলেন?’

বুকের ভিতর ধড়াশ ধড়াশ শুরু হয়ে গিয়েছে রানার। টের পেল ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে মুখটা রক্ত সরে গিয়ে। কিন্তু অসাধারণ মানসিক শক্তি বলে মুখের চেহারাটা ঠিক রাখল সে।

‘খামোকা খোঁজাখুঁজি করে লাভ নেই, সিনর,’ বলল রানা, ‘সত্যি কথা বলতে কি, ভিড়ের মধ্যে আমার এক বন্ধুর পকেটে পুরে দিয়েছি আমি ওটা। আপনার স্যাঙাত্রা কেউ দেখতে পায়নি। আমার সঙ্গী দু’জনকে মুক্তি না দিলে ওটা পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই আপনার। দেরি না করে চলুন সেখানে যাওয়া যাক।’

ঝট করে ফিরল সিলভিও ওড্ডির দিকে।

‘তোমাদের অলক্ষে ওটা পাচার করা সম্ভব ছিল এর পক্ষে?’ একটু ইতস্তত করে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল ওড্ডি। ‘ছিল। ভিড়টা খুব ঘন ছিল। চোখের আড়াল করিনি ঠিকই, কিন্তু আমরা শুধু এর কাঁধ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম। হাত দেখতে পাইনি। নিচ দিয়ে কারো হাতে ওটা দিয়ে দেয়া এর পক্ষে অসম্ভব ছিল না।’

‘খুবই ধূর্ততার সাথে কাজটা করেছেন, সিনর মাসুদ রানা, কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল সিলভিও। ‘কিন্তু তাতে অবস্থাটা এমন কিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে না। প্যাকেটটা আপনার বন্ধুর কাছ থেকে সংগ্রহ করে আমার হাতে তুলে দেবেন আপনি।’

হাঁফ ছাড়ল রানা। ‘তা দেব, কিন্তু তার আগে আপনার কথার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে আমাকে।’

‘তা ঠিক, ওদের দেখা পাবেন আপনি অল্পক্ষণের মধ্যেই। আবার একবার ঘরের চারদিকে চোখ বুলাল সিলভিও। মৃদু হেসে চাইল রানার চোখে। ‘তবে এই ভিড়ের মধ্যে বন্ধুর পকেটে পুরে দেয়ার কাহিনীটা আপনার উর্বর মস্তিষ্কের ফসলও হতে পারে। তাছাড়া আর কি কারণ থাকতে পারে হঠাৎ এ গল্প শোনাবার? আমার মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার প্রয়াস হিসেবেও ধরতে পারি আমি ব্যাপারটা। কাজেই আমার মনে হয় রওনা হবার আগে আমাদের একবার এই ঘরটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার।’ গীয়ানের দিকে ফিরল। ‘এক পা এদিক ওদিক নড়লে গুলি করবে।’ এবার ওড্ডি আর পপিনিকে আদেশ করল, ‘দেখো খুঁজে পাওয়া যায় কি না। বেশি সময় পায়নি ও। চট করে লুকিয়ে রাখা যায় এমনি কোন জায়গায় পেয়ে যাবে ওটা খুব সম্ভব। সাধারণ কোন জায়গায়। নাও, শুরু করো।’

হাল ছেড়ে দিল রানা। ভাগ্য অপ্রসন্ন। চেষ্টার ত্রুটি করেনি সে।

এক্ষুণি খুঁজে পাবে ওরা ওটা। বাতিস্তা আর ওস্তাদের কি হবে তা হলে? ওর নিজের ভাগ্যেই বা কি আছে? এই তিনজনের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা হবে? নাকি মাল পেয়ে ছেড়ে দেবে ওদের? কি করবে?

আশ্চর্য দক্ষতার সাথে হলঘরের দু’পাশ থেকে খুঁজতে খুঁজতে মাঝখানে আসছে ওড্ডি আর পপিনি। তামার ফুলদানীটার খুব কাছে চলে এসেছে ওড্ডি। প্রতিযোগীর ঘোড়ার মুখে ভুল করে মন্ত্রী চেলে দাবা খেলোয়াড় যেমন বোর্ডের অন্যদিকে চেয়ে আল্লাকে ডাকে, নিছক ইচ্ছাশক্তির বলে প্রতিযোগীর মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাবার চেষ্টা করে, রানার অবস্থা অনেকটা সেই রকম হলো। অন্যদিকে চেয়ে থাকার চেষ্টা করল সে, কিন্তু আড়চোখে ওড্ডির কার্যকলাপ লক্ষ না করেও পারছে না।

হঠাৎ ফুলদানীটা হাতে তুলে নিল ওড্ডি। ধড়াশ করে উঠল রানার বুক। মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে দেখল সে, ভিতরে হাত ঢুকাল ওড্ডি, তারপর মুখটা উল্টো করে ঝাঁকি দিল। কিছুই বেরোল না ওটার মধ্যে থেকে।

তাজ্জব হয়ে গেছে রানা, দুই চোখে ওর অবিশ্বাস।

সত্যিই, কিচ্ছু নেই তামার ফুলদানীর ভিতর।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *