এগারো
ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল হলের উপর দিয়ে একটা পাক খেয়ে ঘুরে নামতে শুরু করল বি.ও.এ.সি। তিন মিনিটের মধ্যেই ল্যাণ্ড করবে দমদম এয়ারপোর্টে। কন্টিনেন্টাল হোটেলটা এক ঝলক দেখতে পেল রানা। মাত্র আটদিন! অবাক হয়ে ভাবল রানা, মনে হচ্ছে যেন কত যুগ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আসলে মাত্র আটদিন আগে রওনা হয়েছিল ও কলকাতা থেকে। কী বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে কেটেছে এই আটটা দিন, মনে হয় দিন তো নয়, যেন আট বছর কাটিয়ে এল সে ইউরোপে।
অথচ সব ঘটনা অনিলকে বলতে কত সময় লেগেছিল? পঁয়তাল্লিশ মিনিট!
.
‘কিন্তু তোমাকে প্লেনে ওঠার আগে যখন সার্চ করা হলো, তখন বইটা পাওয়া গেল না কেন?’ দমদমে নামার কয়েক মিনিট আগে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল অনিল।
এটা গিলটি মিয়ারও প্রশ্ন। ঠিক পিছনের সীটে বসেছে সে, সামনে ঝুঁকে এল উত্তরটা শোনার জন্যে।
হাসল রানা। ‘সার্চ করবার ঠিক কয়েক সেকেণ্ড আগে লুইসার মিংক কোটের হাতার ভাঁজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম ওটা।’
‘আচ্ছা!’ চোখ কপালে উঠল অনিলের। ‘সেই জন্যেই বিদায়মুহূর্তে অত প্রেম উথলে উঠেছিল তোমার? চুমু খাওয়ার ফাঁকে তুলে নিলে বুঝি ওটা আবার?’
‘হ্যাঁ। এবার তোমার দিকটা শোনাও, অনিল। আমি কিন্তু সবটা ব্যাপার জানি না এখনও।’
‘আমি তোমার মত গুছিয়ে বলতে পারি না,’ বলল অনিল। ‘তুমি প্রশ্ন করো, আমি উত্তর দিই।’
‘বেশ আমি যেটুকু বুঝেছি, সেটা হচ্ছে সিলভিও পিয়েত্রোর গ্লাস ফ্যাক্টরির মাধ্যমে কোসা নোস্ট্রার ড্রাগ ট্রাফিক শুরু হয়েছিল ভারতে। খুব সম্ভব কাঁচের খেলনা, পুতুল বা ঘর সাজাবার কাঁচের সামগ্রীর মধ্যে করে আসত ওটা। এ ব্যাপারেই পাঠানো হয়েছিল তোমাকে ইটালীতে।’
‘হ্যাঁ। দুই তরফা ট্রাফিক শুরু হয়েছিল। এখান থেকে যেত কাঁচামাল, ওখান থেকে আসত ফিনিশ্ড্ গুড হেরোইন হয়ে। কিন্তু আসলে যে ব্যাপারে আমার যাওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সেটা হচ্ছে আমাদের দেশের কয়েকজন খুবই উঁচু মহলের লোক জড়িয়ে পড়েছিল এই ব্যবসার সঙ্গে। ড্রাগের সাথে এরা গোপন তথ্য ফাঁস করতে শুরু করেছিল। কোসা নোস্ট্রার এটাও একটা সাইড বিজনেস। ইনফরমেশন বিক্রি। আমাদের চীফ টের পেলেন যে এইসব হোমরা-চোমরা প্রভাবশালী লোকদের মধ্যে আমাদের ডিপার্টমেন্টেরও কেউ কেউ জড়িত আছেন। কিন্তু এতই সাবধানে চলছিল কাজটা যে কাউকে ধরা তো দূরে থাকুক, সন্দেহ করবারও উপায় ছিল না। দিশে না পেয়ে গোপনে ডেকে নিয়ে আমার পরামর্শ চাইলেন রঞ্জন চৌধুরী।’
‘তুমি প্ল্যান দিলে যে ডবল-এজেন্টের রোল করে তুমি নামগুলো বের করে আনবে।’
‘হ্যাঁ। এই প্ল্যানের মস্ত দুর্বলতা ছিল একটাই। সেটা হচ্ছে, বিপদে পড়লে সাহায্য পাব না কারও কাছে। প্ল্যানটা বাস্তবায়নের জন্যে এই তরফকে অভিনয় করতে হবে যে আমি বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী। কাজেই সাহায্যের প্রশ্নই ওঠে না। একা কাজ করতে হবে আমাকে। ধরা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু। প্রথমটায় বারণ করেছিলেন আমাদের চীফ, কিন্তু আমার চাপাচাপিতে রাজি হয়ে গেলেন। ওঁর তখন খ্যাপা কুকুরের মত অবস্থা। রাজি না হয়ে উপায়ও ছিল না।’
‘তারপর তুমি কাজ শুরু করলে। উনিও চুটিয়ে অভিনয় শুরু করলেন অতি অভিনয় হয়ে যাচ্ছে কিনা সে খেয়াল না করেই।
‘উপায় ছিল না ওঁর।’ চীফের পক্ষ নিল অনিল। ‘প্রথম চার মাসে ওদের মধ্যে ঢুকে পড়ার পথ তৈরি করলাম। ছোট্ট একটা কাজের ভার দিল, সেটা সুসম্পন্ন করলাম কলকাতায় এসে। তারপর ফিরে গিয়ে ওদের সাথে যোগ দিলাম পুরোপুরি ভাবে। ম্লান হাসল অনিল। ‘তার পরের সব ঘটনা তো তুমি জানোই।’
চুপচাপ বসে রইল ওরা কিছুক্ষণ।
নেমে পড়ল প্লেন।
কলকাতাতেও নোট বইটা উদ্ধারের চেষ্টা চালানো সিলভিওর পক্ষে অসম্ভব নয়। তাই লণ্ডন পৌঁছেই খবর দিয়েছিল রানা রঞ্জন চৌধুরীকে। এয়ারপোর্টে গার্ডের ব্যবস্থা করবার অনুরোধ জানিয়েছিল। অনিলকে সাথে নিয়ে ফিরছে, সে খবরও জানাতে ভুল করেনি।
প্লেনটা থেমে দাঁড়াতেই যাত্রীরা কে কার আগে নামবে তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি শুরু করল। যেন প্রত্যেকেই দারুণ ব্যস্ত, জরুরী কাজ পড়ে আছে, এক্ষুণি না নামলে চলবে না। ওরা তিনজন বসে রইল গ্যাট হয়ে।
রানা ও গিলটি মিয়ার স্যুটকেস দুটোও তুলে দিয়েছিল বাতিস্তা অনিলের সাথে। ওগুলোর ভার গার্ডদের কাউকে দেবে বলে ঠিক করল রানা। এই খোলা এয়ারপোর্টে অনিলকে নিয়ে কাস্টমস ক্লিয়ারেনসের জন্যে অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
দরজা খুলে দেয়ার আধ মিনিটের মধ্যে হুড়মুড় করে নেমে গেল সব যাত্রী। রানা এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পরীক্ষা করল বাইরেটা। আট-দশ জনের একটা দল এগিয়ে আসছে প্লেনের দিকে। অনিলের মাকে পরিষ্কার চিনতে পারল রানা। সাদা শাড়ি, চোখে চশমা, হাতে ছাতা আর ব্যাগ। একটু পিছিয়ে পড়েছেন উনি। তাঁর আগে হাঁটছেন ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের ডাকসেটে চীফ- রঞ্জন চৌধুরী। আশেপাশের সাদা পোশাক পরা লোকগুলোকেও দেখবার চোখ থাকলে চিনতে ভুল হয় না- সিক্রেট সার্ভিসের ট্রেনিং পাওয়া গার্ড।
নেমে এল ওরা প্লেন থেকে। অনিলের হাতে গুঁজে দেয়ার চেষ্টা করল রানা নোটবইটা, কিন্তু কিছুতেই নিল না সে।
‘না, রানা। তুমি উদ্ধার করে এনেছ ওটা। তুমিই তুলে দাও ওঁর হাতে।’
‘কি খবর? কেমন আছেন?’ হাত বাড়িয়ে দিল রানা।
হ্যাণ্ডশেক করতে গিয়ে হাতে নোট বইটা ঠেকতেই একটু কুঁচকে উঠল রঞ্জন চৌধুরীর ভ্রূ জোড়া, মুহূর্তে সামলে নিয়ে হাসিমুখে জোরে ঝাঁকিয়ে দিলেন রানার হাত। হাতটা ছেড়ে দিয়ে রুমাল বের করলেন বেঢপ সাইজের কোটের পকেট থেকে। ততক্ষণে নোট বইটা চলে গেছে ওঁর পকেটে।
‘দেখা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে পরের ব্যাপারে নাক গলালে পরেরই উপকার হয়- কি বলেন, মিস্টার মাসুদ রানা?’
‘হ্যাঁ,’ মৃদু হেসে জবাব দিল রানা। ‘আর লৌহমানব স্পাইদের মধ্যেও দু’এক টুকরো কোমল মনোবৃত্তি থাকা ততোটা পাপ নয়।’
‘কথাটা আমি আর একটু ভেবে দেখব,’ গম্ভীর হয়ে বললেন রঞ্জন চৌধুরী। ‘সিদ্ধান্ত নেব আপনার কাছ থেকে পুরো ঘটনার রিপোর্ট পাওয়ার পর।’
‘আমার যা বলার সব বলে দিয়েছি অনিলকে। ওর কাছেই রিপোর্ট নিয়ে নেবেন। সন্ধ্যার ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরতে চাই আমি।’
অনিলকে জড়িয়ে ধরে মুহুর্মুহু চুমো খাচ্ছিলেন বৃদ্ধা। কথাটা কানে যেতেই খপ করে ধরলেন রানার হাত। আনন্দে, উত্তেজনায় কাঁপছে হাতটা।
‘সেটি হচ্ছে না, বাবা!’ কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন বৃদ্ধা। ‘ক’দিন আমার কাছে থাকতে হবে তোমাকে। নিজ হাতে রান্না করে তোমাকে না খাওয়াতে পারলে মরেও শান্তি পাব না আমি, বাবা।’
‘এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো ঠিক হচ্ছে না,’ বললেন রঞ্জন চৌধুরী। হাত তুলে ইশারা করতেই তিনটে গাড়ি এগিয়ে এল এদিকে। রানার দিকে হাত বাড়ালেন তিনি। ‘আপনাদের মালের আইডেন্টিফিকেশন ট্যাগ আর টিকেটগুলো দিন। রানার হাত থেকে ওগুলো নিয়ে বললেন, ‘খানিক বাদে এদের কেউ পৌঁছে দেবে ওগুলো অনিলের বাড়িতে। চলি। গুড বাই।’
দুটো গাড়িতে উঠে পড়লেন রঞ্জন চৌধুরী একজন ছাড়া বাকি দলবল নিয়ে। তৃতীয় গাড়িটার দিকে টানলেন বৃদ্ধা রানাকে। পালিয়ে যাবে মনে করে আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি এখনও রানার হাত।
গিলটি মিয়া বসল ড্রাইভারের পাশের সীটে। ওকে ঠেলে প্রায় ড্রাইভারের গায়ে সাঁটিয়ে দিয়ে উঠে বসল গার্ড। পিছনের সীটে অনিল ও রানাকে দু’পাশে নিয়ে মাঝখানে বসলেন বৃদ্ধা। রওনা হলো গাড়ি।
তেমনি আঁকড়ে ধরে আছেন বৃদ্ধা রানার হাত। মুখে আশ্চর্য উজ্জ্বল এক টুকরো পবিত্র হাসি। নিঃশব্দে হাসছেন তিনি। হাসছেন, তো হাসছেন, তো হাসছেনই। হাসছে মায়ের প্রাণ।
সারাটা পথ হাসতে হাসতে চললেন বৃদ্ধা।
দুই চোখে জলের ধারা।
(শেষ)